প্রবন্ধ - চম্পা
Posted in প্রবন্ধ
আমার কাছে তিনি একজন শিক্ষকের মতো: বুদ্ধদেব দাশগুপ্তকে নিয়ে স্মৃতি চারণায় বাংলাদেশের অভিনেত্রী চম্পা
সকালে ঘুম থেকে জেগেই একজন গণমাধ্যমকর্মীর ফোন পেলাম। তিনিই আমাকে দাদার মৃত্যুর খবরটা প্রথম দেন। খবরটা শুনেই আমি হতবম্ভ হয়ে গেলাম। তারপর সারাদিন কেটেছে বিষণ্নতায়। কোভিড মহামারির এই সময়ে— মাত্র দুই মাস আগে ফোনে তার সঙ্গে আমি কথা বলেছি। তখন একবারের জন্যও আমার মনে হয়নি তিনি অসুস্থ। তিনি একদম স্বাভাবিক স্বরে কথা বলেছিলেন। মানসিকভাবেও যথেষ্ট শক্ত মনে হয়েছিলো। আমরা পুরানো দিনের আলাপ করেছিলাম। ছবির শুটিং, ডাবিংয়ের ছোটো ছোটো গল্প, ঘটনাগুলোর স্মৃতিচারণ করেছিলেন তিনি। বলেছিলেন, ‘কতদিন ধরে তোমাকে দেখি না। করোনাভাইরাস পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এসো।’ তার কিডনি সমস্যা ছিলো সেটা জানি। নিয়মিত ডায়ালিসিস করতেন সেটাও জানি। এর মধ্যে আমার বার বারই মনে হচ্ছিলো দাদাকে একটা ফোন করি। কিন্তু নানা কারণে আর ফোন করা হয়নি। সারাজীবন আমার এই আফসোস থেকে যাবে, কেন আমি তাকে ফোন করে খোঁজ নিলাম না। ‘লাল দরজা’ ছবিটি করার সময় তার এবং তার পরিবারের সঙ্গে আমার পরিচালক ও শিল্পীর সম্পর্ক ছাড়িয়ে পারিবারিক একটা সুন্দর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো। তার ছোটো মেয়ে শিউলির সঙ্গে আমার একমাত্র মেয়ে এশার একটা বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিলো। তার দুই মেয়ের সঙ্গেই আমারও হায়-হ্যালো ছিলো। লাল দরজা শেষ যাওয়ার পরও দাদা ও তার পরিবারের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা বজায় ছিলো। তিনি মাঝেমধ্যেই আমাকে ফোন করতেন। আমার স্বামী, আমার মেয়ের খোঁজ-খবর নিতেন। মহামারির মধ্যে আমাকে এবং আমার পরিবারের সবাইকে সাবধানে থাকার জন্য পরামর্শ দিতেন। আমিও তাকে সাবধানে থাকতে বলতাম। দাদা আমাকে বোনের মতো দেখতেন। সম্বোধন করতেন ‘দিদি’ বলে।
এখানে একটা মজার ব্যাপার আছে। সেটা হলো দাদা যেমন আমাকে দিদি বলে ডাকতেন, তেমনি তার দুই মেয়ে— বাবলি এবং শিউলিও আমাকে চম্পাদি বলে ডাকতো। এ ব্যাপারটায় মনে মনে আমি বেশ মজা পেতাম। প্রসঙ্গত আরেকটি কথা উল্লেখ না করলেই নয়। আমি ছোটোবেলাতেই বাবা-মাকে হারিয়েছিলাম। তাই ছিলাম স্নেহের কাঙ্গাল। দাদা এবং বৌদির আদর-স্নেহ যেন আমার সে অভাব অনেকটা পূরণ করে দিয়েছিলো। আমার অসুস্থতায় বৌদি নিজেই উদ্যোগী হয়ে ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করে আমাকে নিয়ে যেতেন। এভাবেই আমাদের পারিবারিক সম্পর্কটা আরও বেশি সুদৃঢ় হয়ে উঠেছিলো। আমার মেয়ে এশা আর দাদার মেয়ে শিউলিকে একইসঙ্গে কানাডায় পড়তে পাঠাই, যদিও তারা দুই জন দুটি আলাদা বিষয়ে পড়াশোনা করতো। লাল দরজার পরে তার সঙ্গে আমার আর কোনও কাজ করা হয়নি। তারপরও আমার কাছে মনে হয়, আমি ভালো একজন মানুষের সৌহার্দ্য পেয়েছি, এই বা কম কী?
লাল দরজা ছবি করার আগে একদিন হঠাৎ একটি টেলিফোন পাই। অপরপ্রান্ত থেকে বলা হলো ‘আমি বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত।’ নামটা শুনেই ভয় আর আবেগে আমার হাত কাঁপা শুরু করেছিলো। আগেও তো গৌতম ঘোষ, সন্দীপ রায়ের ছবিতে কাজ করেছি, কখনও এমন হয়নি। খুশিতে কথা পর্যন্ত গুছিয়ে বলতে পারছিলাম না। তিনি আমাকে বললেন, ‘শুনুন, পদ্মা নদীর মাঝি আর টার্গেট-এ আপনার কাজ আমি দেখেছি। আপনার অভিনয় আমার ভালো লেগেছে। আমি লাল দরজা নামে একটি ছবি করছি। আপনি প্রধান চরিত্র করবেন। রাজি আছেন? থাকলে আজই সংবাদ সম্মেলন করে আপনার নাম ঘোষণা দেবো।’ আমি কোনও রকমে খালি একবাক্যে বললাম, রাজি। ছোটো করে তিনি আমাকে গল্পটা শোনালেন। বললেন, ‘আপনার চরিত্রটার জন্য স্বতন্ত্র কিছু মুখভঙ্গি দরকার হবে। চাহনি আর ঠোঁটের ভঙ্গি দিয়ে হৃদয়ের বেদনাকে ফুটিয়ে তুলতে হবে।’ আরও কী সব বললেন, উত্তেজনায় কিছুই শুনিনি। শুধু বললাম, আপনার সিনেমায় অভিনয় করতে চাই। আর বেশি কিছু জানতে চাই না। পরে পত্রিকার মাধ্যমে জানতে পারি, তিনি আমাকে কাস্ট করেছেন। তখন অডিশন ছাড়া সিনেমায় কাজের সুযোগ মিলতো না। কিন্তু তিনি আমার উল্লিখিত দুটি ছবি দেখার পর আর আমাকে নিয়ে যাচাই বাছাইয়ের প্রয়োজন মনে করেননি।
কলকাতা গিয়ে তার সঙ্গে যখন আমার দেখা হয়, তখন দেখলাম গুরুগম্ভীর একজন মানুষ। আমি আরও ভয় পেয়ে গেলাম। তিনি কথা বলছিলেন একেবারে সরাসরি, যাকে বলা যায় চাছাছোলা। সে জন্য প্রথম দিকে কথা বলতেও ভয় লাগতো। দূরে দূরে থাকতাম। কিছুদিন কাজ করে বুঝলাম, বাইরেটাই খালি শক্ত, ভেতরে আসলে হাসিখুশি ও সাদা মনের একজন মানুষ। আলাপ শুরু করলে আর থামতেন না। বেশিরভাগই সিনেমা এবং খাবারের গল্প। আর ঘুরে ফিরে আসতো ইলিশের কথা। তবে সম্পর্ক যত হাসিখুশিই থাক, কাজে কিন্তু কখনও ছাড় দিতেন না। শুটিং করতে গিয়ে কত যে ধমক খেয়েছি। তিনি চাইতেন সব সময় চরিত্রের মধ্যে থাকি। মাঝেমধ্যে শুটিংয়ের ফাঁকে হেসে উঠতাম। কখনও কারও সঙ্গে হয়তা আলাপে মশগুল হয়ে যেতাম। তাতে তিনি রাগ করতেন, বুঝিয়ে বলতেন, চরিত্রের বাইরে মনটা থাকলে কাজে শতভাগ মনোযোগ থাকে না। চিত্রনাট্যের আবহে থাকলে কাজটা ঠিকঠাক হয়। শুটিংয়ে আড্ডা সহ্য করতেন না তিনি।
একবার একটা দুঃখের দৃশ্য করার আগে কী কারণে যেন আমি খুব জোরে হেসে উঠেছিলাম। শুধু এই অপরাধে তিনি কয়েক ঘণ্টা শুটিং বন্ধ করে রাখলেন। আমাকে ডেকে বললেন, ‘তুমি চরিত্রের বাইরে চলে গেছো। যাও, কিছুক্ষণ একা থাকো। কারও সঙ্গে কোনও কথা বোলো না।’ ডাবিংয়ের সময়েও তার কড়া নিষেধ ছিলো, ঘুম থেকে উঠে কোনও কথা বলা যাবে না। ঘুম থেকে উঠেই ডাবিংয়ে চলে আসতে হবে। কষ্ট বা দুঃখের জায়গাগুলোর ডাবিং আগে করতেন।
কাজ শেষ করার পর একবার কৌতুহলবশত তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম ডাবিংয়ের জন্য প্রস্তুতি হিসেবে ঘুম থেকে উঠে কারও সঙ্গে কথা বলতে বারণ করেছিলেন কেন? জবাবে তিনি আমাকে বললেন, ঘুম থেকে ওঠার পর কারও সঙ্গে কথা না বললে কণ্ঠের ভারিত্ব ভাবটা থাকে। আর কারও সঙ্গে কথা বললে কণ্ঠ পাতলা হয়ে যায়। দেশে ফেরার পর ছবির ডাবিং করতে গিয়ে বিষয়টা খতিয়ে দেখলাম আমি। তাতে আমার কাছে প্রমাণিত হলো, দাদার কথাই সঠিক ছিলো। এইভাবে তার কাছ থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি। তার মতো বড়ো পরিচালকদের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখে জীবনের ঝুলিটা সমৃদ্ধ করেছি। শিল্পী হিসেবে এগুলোকে অভিনয় জীবনের পাথেয় হিসেবে নিয়েছি। এগুলোর কারণে পরে আমার কাজের ধরণটাই বদলে যায়।
আবারো বলতে চাই, অভিনয়শিল্পী হিসেবে আমি যাদের কাছে ঋণী তাদের মধ্যে তিনিও একজন। কাজ করতে গিয়ে তার কাছ থেকে সিনেমা ও অভিনয় বিষয়ে অনেক কিছু শিখেছি। এগুলো আমার শিল্পীজীবনের প্লাস পয়েন্ট। তার সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে বুঝেছি, তিনি সবার থেকে আলাদা। তার কাজের স্টাইলটাও একেবারে আলাদা। প্রচণ্ড ডেপথনেস নিয়ে কাজ করতেন তিনি, খুব মনোযোগ দিয়ে কাজ করতেন। আমরা শিল্পী কলাকুশলী সবাই যেন গভীর মনোযোগ দিয়ে কাজ করতে পারি— এই জিনিসটা কিন্তু তার কাছ থেকে আমাদের শেখা। কীভাবে একটা ভালো কাজের জন্য মনোযোগ দিতে হয় এবং একটা কাজের সঙ্গে কীভাবে আরও ভালোভাবে ইনভলব হওয়া যায়— এই টেকনিকটাও তার কাছ থেকেই শেখা।
‘লাল দরজায়’ আমার কিছু জটিল সিকোয়েন্স ছিলো, যেগুলোতে ডায়ালগ নয় আমার চেহারা, আমার বডি ল্যাংগুয়েজ দিয়ে সব বোঝাতে হবে। শুধু ডায়ালগ বলেই আমার বক্তব্য শেষ করলাম কিন্তু আমার ভেতরে কী ঘটছে সেটা বোঝালাম না সেটা হবে না। ডায়ালগ ছাড়াও নিজের ভেতরের অনুভূতি কীভাবে বোঝাতে হবে মানে অভিব্যক্তি দিয়ে কীভাবে বক্তব্যটা তুলে ধরা যায় সেটা তার কাছ থেকে শিখেছি। দাদার কাছ থেকে এমন কঠিন কঠিন কিছু বিষয় শিখেছি যেগুলো আমার আজও কাজে লাগছে। শুধু তাই নয়, ব্যক্তিগত জীবন নিয়েও তিনি আমাকে নানা পরামর্শ দিতেন।
দাদা সাধারণ জীবনযাপন করতেন। সকালে চিরতার রস খেতেন। নিয়মিত যোগব্যায়াম করতেন। এসব নিয়ম আমাদেরও মেনে চলতে বলতেন। করোনার মধ্যেও কথা হতো। বলতেন, নিরাপদে থেকো। কয় মাস আগেই সর্বশেষ কথা হয়েছে। তার কথা শুনে মনে হয়েছিলো অনেকটাই সুস্থ এখন। বলতেন, কত দিন তোমাকে দেখিনি। করোনা কমলে এসে দেখা করে যেও। ভেবেও ছিলাম করোনা পরিস্থিতি একটু ভালো হলেই দেখা করে আসবো। সেই সুযোগ আর হলো না। এই কষ্ট আমার মন থেকে কোনওদিনই মুছে যাবে না।
দাদা চলে গেছেন। পেছনে রেখে গেছেন অনেক স্মৃতি এবং তার অসাধারণ সব শিল্পকর্ম। তার সঙ্গে কাজ করার নানা অভিজ্ঞতা, তার কাছ থেকে শেখা বিষয়গুলো আমার কাছে থেকে যাবে আজীবন। তিনি শারীরিকভাবে আমাদের মাঝে বেঁচে না থাকলেও, তিনি আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন তার সব অসাধারণ সৃজনশীল কাজের মধ্য দিয়ে।
লাল দরজা শুটিংয়ের দুটি মুহূর্ত |