ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়
Posted in ধারাবাহিকতৃতীয় পর্ব
পরের দিনটা কাটলো উৎকন্ঠায়, আশায়। না রায়পুর থেকে কোন পুলিশ অফিসার এলেন না।
সকাল এ গোটাচারেক ফ্ল্যাট থেকে কয়েকজন মহিলা ও পুরুষের প্যাসেজে চেয়ার লাগিয়ে বৈঠক, উঁচু গলায় কমেন্ট শোনা গেল। রত্না সকালে কুকুর নিয়ে ফেরার সময় ওই বৈঠকের পরে পড়ে থাকা কিছু মোল্ডেড ওয়ারের চেয়ারগুলোকে সবাইকে দেখিয়ে একেক লাথিতে প্যাসেজের এমাথা থেকে ওমাথায় পৌঁছে দিল।
আমি প্রোভেকেশনে পা না দিতে বারণ করলাম। সন্ধ্যেয় থানা থেকে একজন সিপাহী এসে সি এস পি র সই করা কিছু সামনস্ কয়েকজনকে সার্ভ করে গেল। থানায় বয়ান দিতে ডাকা হয়েছে। আমরা ঠিক করলাম, রায়পুরের পুলিশের সঙ্গে কথা না বলে কেউ যাব না। ইতিমধ্যে প্রবীণকে রায়পুর পি এইচ কিউ ডেকেছে ভালো করে মেডিক্যাল চেক আপ করার জন্যে।
সেদিন ছিল সোমবার,ঈদের ছুটি। আমার কলিগ ও বামপন্থী বন্ধু শাকিরের ঘরে সবাই প্রতিবারের মত বিরিয়ানি খেতে ও আড্ডা দিতে এককাট্টা হয়েছে। খালি আমি নিজের ঘরে।
সেখান থেকে আমার বন্ধু বিজয় বর্মার( যার যোগাযোগে এক রাত্তির আগে সি এস পি কে ডাকা হয়েছিল) ফোন এল---- দাদা, ছোটভাই বাবলু বিল্ডার্স লবির সঙ্গে কথা বলেছে। ওরা বলেছে রায়পরিবারের সঙ্গে আমাদের কোন প্রবলেম নেই। ওদের সঙ্গে কোন ডিসপিউট নেই। কিন্তু ওই জাঠপরিবারের সঙ্গে তাল দেয়া আন-অ্যাকসেপ্টেবল্। ওদের আমরা বিলাসপুর-ছাড়া করে হরিয়ানায় ফেরত পাঠাবো। রায়দের ওদের পক্ষে দাঁড়ানো চলবে না।
তাহলে রায়েরা আরামসে বিলাসপুরে ওদের ফ্ল্যাটে থাকতে পারে।
দাদা, আপনি কী বলেন?
আমার ভিতরে কিছু একটা ছিঁড়ে যায়। শুনি হরিদাস পাল বলছে---- আমি বিলাসপুরে কার সঙ্গে মিশবো,আমার ওঠাবসা কার সাথে হবে-- এ'সব কোন বিল্ডার্স লবি ঠিক করতে পারে না। ওদের কোন রাইট নেই। আমি ওই ফ্ল্যাটে পেমেন্ট করে এসেছি, ভিক্ষে চেয়ে নয়। দরকার হলে বিলাসপুর ছেড়ে দেবো, কিন্তু ওদের সাথে কোন আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ে যাবো না।
বাবলুকে বল্--- আমার জন্যে যেন কোন চেষ্টা না করে!
বর্মা বলে --ঠিক আছে।
তারপর বাইরে এসে বলে--আপনার বামপন্থী বন্ধুরা, সবাই এড়িয়ে গেল। কোন আলোচনা পর্য্যন্ত করতে চাইলো না। সিপি এমের নন্দু, শাকির, বিজলী ইউনিয়নের খান্ডে সবাই ভাব দেখালো--- এটা রায়দের গোঁয়ার্তুমির ফল, বিশেষ করে রায় গিন্নির। ভদ্রমহিলা বরাবরই প্রবলেম তৈরি করেন।
দাদা, কেবল সমাজবাদী পার্টির সিনিয়র আনন্দ মিশ্র, উনি আপনাকে খুব ভালো বাসেন। উনিই তুল্লেন, চাইছিলেন কি করা যায় , এনিয়ে কিছু কথাবার্তা হোক, শেষে সবার ঠান্ডা ভাব দেখে উনিও চুপ মেরে গেলেন।
রাত্তিরে রেণু ও জার্নালিস্ট অমিতাভ শোবে কি করে? ২১০ নং এর দরজাই বন্ধ হয় না যে!
রত্না বল্লো--- আমার ফ্ল্যাটে জায়গা হয়ে যাবে। আর তোমাদের ওখানে শুতে পার। আমি বাইরে থেকে আমার প্যাডলক লাগিয়ে দিতে পারি। সকাল ৬টায় খুলে দেব। রাত্তিরে কোন অসুবিধা বুঝলে মোবাইলে কল্ করবে, আমি ও রঞ্জন পৌঁছে যাবো।
( স্বামীর অবর্তমানে রেণু ও অল্প পরিচয়ের বন্ধু অমিতাভ কি দরজা বন্ধ করে শুতে অস্বস্তি বোধ করছে?)
আমি--- জোরাজুরি কোর না। তুমি অপশন দিয়ে দিয়েছ, ওদের ডিসাইড করতে দাও।
রত্না-- যুদ্ধের ময়দানে এতসব ন্যাকামি চলে না। কই, ও যখন জেলে ছিল আর ওর স্বামী ও আমার নামে হরিজন অত্যাচারের চার্জে অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট বেরিয়েছিল, তখন ভিলাই-রায়পুর পালিয়ে থাকার সময় আমি তো রাত্রে ভাইবোন পরিচয় দিয়ে হোটেলের একই কামরায় থাকতে
কোন ন্যাকামি করিনি?
--- রেণুও করছে না। তবু ডিসিশন ওদের নিতে দাও।
পরের দিনও কেউ এল না।
রায়পুর থেকে খবর এল যে কিছুদিন দুই পরিবারেরই রায়পুরে সরে থাকা ভাল।
রেণুরা রায়পুরে একটি ভাল ডুপ্লেকস্ বাড়ি খুঁজে নিয়েছে। বলছে--পাশেই আরো খালি আছে, আপনারাও চলে আসুন।
আমাদের ঘরে মিটিং বসল।
আমি বল্লাম- বিলাসপুরে থেকেই লড়বো। আমি ভাড়াটে নই, কোন অজুহাতে আমাকে খালি করানো যাবে না।
মেয়েরা বল্লো-- মেনে নিলাম। কিন্তু ১০দিন্পরে আমরা দিল্লি চলে যাবো। এখানে তোমরা কতখানি সেফ্?
রাত্তিরে রোজ ভাটাপাড়া স্টেশন থেকে সাত কিলোমিটার আসার সময় রাস্তায় তুমি সফট টার্গেট নও? বেশি কিছু না, দুটো লুম্পেনকে মদ খাইয়ে দেবে। তারা তোমাকে মোটরবাইকের ধাক্কায় ফেলে দিয়ে দো-চার লাথ-মুক্কা জমিয়ে পালিয়ে যাবে। তুমি হোস্টাইল পুলিসকে কমপ্লেন করবে? তারা তোমার জীবন ব্যতিবস্ত করে তুলবে।
তুমি রায়পুরে চলে যাও। বর্মা আংকলকে বলে রায়পুরে রিজিওনাল অফিসে তোমার পোস্টিং করিয়ে নাও। কিন্তু রেণু আন্টিদের সঙ্গে নয়, আলাদা।
বিজয় বর্মার সঙ্গে কথা বল্লাম।
ও বল্লো-- এই হোস্টাইল অ্যাপার্টমেন্টে আপনি ৫% সেফ, বিলাসপুরে অন্য পাড়ায় বাড়িভাড়া করে গেলে ৫৫%, আর রায়পুরে গেলে ৯৫%।
আর ভেবে দেখুন, এইরকম হামলা সম্ভব হয়েছে আপনারা হঠাৎ বড়লোকি দেখিয়ে শহরের বাইরে বড়লোকের পাড়ায় ফ্ল্যাটে চলে গেলেন,ঐ হতচ্ছাড়া মুখুজ্জের কথায়। ওই মিনোচা কলোনীর লোকেদের সঙ্গে আপনার কোন পরিচয় নেই। ওরা আলাদা ক্লাস। দশহাজার বর্গফুটের প্লটে ৫০০০ বর্গফুটের কনস্ট্রাকশন বানিয়ে গোটাদুই কালোকাঁচে ঢাকা ঢাউস গাড়ি নিয়ে সারা শহরের প্রতি নাকসিঁটকিয়ে থাকা লোকজন।
আর আপনার অ্যাপার্টমেন্টের লোকজন ? আদ্দেক আপনার মতই পাতি মধ্যবিত্ত, কিন্তু বিল্ডারকে ভগবান ভাবে, বড়লোকদের তেল লাগায়। কারণ একদিন ওদের মত হওয়ার স্বপ্ন দেখে।
আমার কথা শুনে থাকতেন শহরের মাঝখানে, ধরুণ আমাদের মত একটু ঘিঞ্জি পাড়ায়, আপনাদের ওপর মাঝরাতে এমন হামলা হতে পারতো না।
মাইরি বলছি, মাঝরাতে পুলিশ এসে বাড়ি ঘিরবে আর গুন্ডারা হামলা চালাবে?
দশটা ইয়ং ছেলে বেরিয়ে আসতো? পুলিশের কাছে কৈফিয়ৎচাইতো। তারপর চারপাশের বাড়িগুলোতে আলো জ্বলে উঠতো, দলে দলে লোকজন বেরিয়ে পড়তো, পুলিশ আর কটা গুন্ডা পালাতে পথ পেতো না।
পুলিশ এসব ভালো করেই জানে, তাই সে চেষ্টাই করতো না।
আর এমন দূরে বাড়ি নিয়েছেন যে আপনার ওখানে যাওয়াও একটা প্রোজেক্ট। আগে আমরা রোজ আড্ডা দিতাম। কিন্তু আপনি দিনের পর দিন সমানে দূরে বাড়ি নিতে থাকলেন।
সেদিন রাতে যদি আমার মোবাইল অফ থাকতো, বা আমি বিলাসপুরের বাইরে থাকতাম তো?
আপনার ভাগ্য ভালো তাই কনট্যাক্ট হল, আর ছোটভাই পৌঁছে গেল। আপনি আর ভাবীজি নিজেদের স্বভাব এইবয়সে তো পালটাবেন না। এড়িয়ে গিয়ে চুপ করে থাকবেন না। কাজেই আপনাদের সেফটির দিকটা আগে ভাবা উচিৎ।
কথা হল বর্মা ওর বাড়ির কাছে বিল্ডার্স গিল্ডের থেকে স্বতন্ত্র এক্জন প্রোমোটারের বানানো অ্যাপার্টমেন্টে খালি ফ্ল্যাটের খোঁজ করে রাত্তিরে জানাবে।
রেণুরা প্যাকার্স অ্যান্ড মুভার্স এর সঙ্গে কথা বলে পরশু রায়পুরে শিফট হয়ে যাবে। বাঁধাছাঁদা জোর কদমে চলছে।
ইতিমধ্যে ছোটমেয়ের দিল্লির বন্ধুর কনট্যাক্টে এক পুলিস অফিসার ফোন করে রায়পুর থেকে জানালেন যে আপনারা নিশিন্ত থাকুন, আপনাদের গায়ে আঁচ লাগবে না। আপনারা ন্যায় পাবেন , একটু সময় লাগবে।
পরের দিন ঘরের মধ্যে রেণুদের ও রত্না রায়ের মধ্যে কিসব ফিসফাস হতে লাগলো। আমি একটু অবাক হলাম। ওদের কয়েকবার যাতায়াতের পর রত্নাকে দেখা গেল কাপড়ে মোড়া কি একটা নিয়ে ওপরের ডিভানে লেপের নীচে ঢোকাল।
কি জিনিস রে বাবা? আমিও জানিনা।
টিভি দেখতে দেখতে মেয়েরা উঠে দাঁড়াল। আমি বই পড়ছিলাম। আমাকে ডেকে বল্লো--- বাবা, ওপরে চলো। আর মাকেও ডাক, কথা আছে।
আমাদের ওপরে দেখে রত্না যেন একটু চমকে উঠলো!
-- মা, ডিভানটা খোল।
-- কেন? হটাৎ কি হল?
-- সেটা তুমিই ভাল করে জান, মা।
--- এমনি বাঁকা বাঁকা কথা বলছিস্ কেন?
-- তাহলে সোজা করেই বলছি, তুমি আংকলদের ঘর থেকে কাপড়ে মোড়া কী এনে ওখানে লুকিয়েছ?
--- ইট ইজ নান অফ ইয়োর কন্সার্ন!
-- হাও ক্যান য়ু সে সো? দ্যাটস্ আওয়ার কনসার্ন অ্যাজ ওয়েল। টেল আস মম্।
রত্না কিছু বলে না। খালি ওর লরির হেডলাইটের মত জ্বলে ওঠা চোখ সবার মুখের ওপর ঘুরতে থাকে।
--- তাহলে আমিই বলি মা, সাইজ দেখে মনে হচ্ছে ওই কাপড়ে মোড়া বস্তুটি আসলে জার্নালিস্ট অমিতাভ তিওয়ারির চুরি যাওয়া পিস্তল। তাহলে চুরির গল্পটা মিথ্যে, ওরা ঝুটা রিপোর্ট লিখিয়েছে। এখন এই মাল আমাদের ঘরে কেন লুকোতে হবে? অধিকারের প্রশ্নে ওদের সঙ্গে দাঁড়ালে কি ওদের সমস্ত অপকম্মের ভাগীদার হতে হবে? আর বাবা, তুমি চুপ কেন?
( ঘাসফুল-মাওবাদী-সুশীলদের মোর্চা সিরিয়াস প্রশ্নের মুখে)।
রত্না মুখ খোলে-- হ্যাঁ, ওটা সেই রিভলবারই বটে। তিওয়রির ছিনিয়ে নেয়া লাইসেন্সড- রিভলবার। সেদিন মারপিটের সময় কেড়ে নিয়েছিল। আর ডাবল ব্যারেল বন্দুকও। চুরির রিপোর্ট মিথ্যে নয়।
আসলে ওরা পরে বুঝতে পেরে দরজা লাগানোর সময় এটাকে চালের টিনের মধ্যে গুঁজে দিয়ে গেছে। আজ প্যাকিংয়ের সময় চোখে পড়েছে। দোনলা বন্দুক থেকে গুলি চলার গল্প বানিয়ে আমাদের ওপর আর্মস্ অ্যাক্ট লাগিয়েছে। আর এই রিভলবারটা এমনি করে অবভিয়াসলি পুলিসই রাখিয়েছে, যাতে সার্চের সময় চালের টিন থেকে বের হলে আমাদের কমপ্লেনটাকে মিথ্যে প্রমাণ করা যায়।
-- বুঝলাম, কিন্তুআমাদের ঘরে যদি সার্চ হয়? হবে না তুমি কি করে জোর দিয়ে বলতে পারো? পুলিস জানে কোথায় রাখা আছে। সেখানে না পেলে ওরা ভাববে না কি রায়েদের ঘরগুলিও দেখি? আর পুলিসি খানাতল্লাসিতে তোমার ওই বাচ্চাদের মত লুকোনো হাতিয়ার একমিনিটে বেরিয়ে পড়বে। তারপর?
আন-লাইসেন্সড-হাতিয়ার জব্দ হলে তোমরা দুজন অন্দর। জামিন হতে কয়েক মাস। তোমাদের উপর ক্রিমিনাল চার্জ ফ্রেম হবে। আমার পরিশ্রমে গড়ে তোলা লিগ্যাল ক্যারিয়ার চৌপট।
সত্যি যদি তোমরা গুলি চালাতে, হাতিয়ার লুকিয়ে রাখতে আমার তার জন্যে ভুগতে তত দু:খ হবে না। কিন্তু যাদের সঙ্গে ভালো করে চেনাজানা হয়নি, তাদের হাতিয়ার রাখতে তুমি কি করে এত সহজে রাজি হলে? অ্যাডভেঞ্চার? তুমি পারো ও বটে! আমরা সরেজমিনে হাজির, ছোট বাচ্চা নই, তুমি একবারও আমাদের সঙ্গে কথা বলা দরকার মনে করলে না?
এক্ষুণি ওদের বল , মেয়েদের আপত্তি আছে, এটা আপনারা নিয়ে যান।
খানিকক্ষণ রত্না গিয়ে কিসব কথা বল্লো, ওরা এসে নিয়ে গেল। আমি হাঁফ ছাড়লাম।
এমন সময়ে হাসিহাসি মুখে সালোয়ার কামিজ পরা একজন শ্যামলা ইয়ং মেয়ে হাজির হলেন, সঙ্গে স্থানীয় থানা থেকে আসা দুই সাব ইন্সপেক্টর।
--- আমি রায়পুরের পুলিস হেডকোয়ার্টারের বিশেষ নির্দেশে তদন্তে এসেছি, অফিসার কিরণ গুপ্তা।
ম্যাডাম গুপ্তাকে আমরা প্যাসেজের কোণে দরজা ভেঙে কব্জার থেকে লটকে থাকা ফ্ল্যাট নম্বর ২১০ দেখিয়ে দিলাম। রত্না সঙ্গে গেলো। ওনার দুপাশে বিলাসপুর থানার দুই সেপাই আর একজন মহিলা অ্যাসিস্ট্যান্ট সাব ইন্সপেক্টর মনোরমা তিওয়ারি।
আরে, এই ম্যাডাম তিওয়ারিই জন্মাষ্টমীর আগের দিন রাত্রে বারোটার সময় এস পি সাহেব ডেকে পাঠিয়েছেন গোছের মিথ্যেকথা বলে রেণুকে তুলে নিয়ে গিয়ে মহিলা থানায় রেখেছিলো না?
আর রত্নাকেও একই বাহানায় নিয়ে যাচ্ছিলো, আমি এস পি কে ফোনে কথা বলে ভেরিফাই করায় রত্না বেঁচে যায়।
এখন সেই মনোরমাই খানিকক্ষণ পরে এসে মিষ্টিগলায় আমাকে বল্লো--- দাদা, কুছ কাগজ দিজিয়ে অউর ইঁহা গবাহ কে দস্তখত কর দিজিয়ে।
ম্যাডাম গুপ্তা দেখলেন যে যদিও তাড়াহুড়ো করে বিল্ডার দরজাটা জুড়েছে কিন্তু ভাঙা চৌকাঠ, ভাঙা কমোড আর বেডরুমের দরজার সানমাইকায় একগাদা লাথির ছাপ স্পষ্ট। তারপর দেখা গেল মেন দরজার ছিটকিনি একেবারে লাগছে না।
এবার উনি এলেন আমার ঘরে। বসে চা' খেতে খেতে বল্লেন--- সুন্দর ফ্ল্যাট, কত পড়েছে, বিশলাখ? রায়পুরে এইদামে এতটা স্পেস পাবেন না।
আমার রায়পুরে শিফট হওয়ার সম্ভাবনা শুনে বল্লেন-- কেন? এইখানেই থাকুন। আমরা পুলিস্গার্ড রেখে দিচ্ছি। রোজ রিপোর্ট নেব। কেউ আপনার কিস্যু করতে পারবে না।
আমার দিকে দেখুন। আমি পুলিশের চাকরি করতে করতে কোন দুশমন পয়দা করিনি কি? একটা-দুটো নয়, বেশ কিছু। তাবলে কি ঘরদোর ছেড়ে পালাব? কখ্নো না।
আমি বলি-- ঠিক বলেছেন। এখানে থেকেই লড়বো। সেদিন যা করেছে তারপর আর কি করবে?
উনি বলেন-- এছাড়া একদিন তো এসব ব্যাপারের নিষ্পত্তি পারস্পরিক সমঝোতা হয়েই হবে। একসঙ্গে ফ্ল্যাটবাড়িতে সবাইকে মিলেমিশেই তো থাকতে হবে।
---কভি নহীঁ।ইনে্লাগোঁকে সাথ কোঈ সমঝোতা নহীঁ হো সকতি।
রত্নার কর্কশ টোন শুনে কিরণ গুপ্তা অবাক হয়ে তাকান।
--- কিঁউ ম্যাডাম? অ্যায়সী কৌনসী বাত হ্যায়? বাতাইয়ে না, নি:সংকোচ বাতাইয়ে। ম্যাঁয় তো শুননে অউর দেখনে কে লিয়ে হী খাসতৌর পর আয়ী হুঁ।
এবার রত্না বলতে থাকে। আমি চা বানিয়ে আনি।
ম্যাডাম,
কথাটা সত্যি নয়। এই হরিয়ানভী পরিবার মাত্র এপ্রিলে ভাড়ায় এসেছে।
আমরা ২০০৮ এ রেজিস্ট্রি করে কিনে এসেছি।
আমরা ধরে ফেলেছিলাম যে বিল্ডার প্লাস্টিক পেইন্টস্ এর বদলে সাধারণ মানের শস্তা পেইন্ট্স লাগিয়েছে। তার্পর পার্টনার অমিত শর্মাকে বাধ্য করলাম ওর নিজের খরচে প্লাস্টিক পেইন্টস্ লাগাতে।
আমি বাধ্য করলাম ১হর্স পাওয়ারের জায়গায় ৩ হর্স পাওয়ারের জলের পাম্প লাগাতে। লিফট ইন্স্টলেশনের জন্যে লেগে রইলাম। এখনও জেনারেটর লাগায় নি। পার্কিং স্পেস মিথ্যে বলে অন্যদের দুধের বুথ করতে বেচে দিচ্ছিল, তার বিরোধ করেছিলাম। কমন মিটারে হুকিং করিয়ে নিজের অন্য প্রোজেক্টের জন্যে কাজ করাচ্ছিলো বাধা দিলাম। অন্যেরা বলে আমার চুপ করে থাকা উচিৎ। বিল্ডারের সঙ্গে আমরা পারবো না। যা দিয়েছে অনেক দিয়েছে। কিন্তু ওদের দরকার হলে--- প্লীজ, আমাদের ওই কাজটা আপনি বিল্ডারকে বলে করিয়ে দিন না!
আমার সঙ্গে ক্ল্যাশ বাড়তে লাগলো। কারণ আমি সুচনার অধিকার আইনের মাধ্যমে করপোরেশনের অ্যাপ্রুভড নকশা এনে দেখালাম যে ও আটটা মর্টগেজড ফ্ল্যাট অন্যদের বিক্কিরি করে দিয়েছে, ফলে ওদের রেজিস্ট্রি বে-আইনী। তাতে বিল্ডার ওদের বোঝালো যে আমি সব ম্যানেজ করে দেব, আপনারা ভয় পাবেন না। এই মহিলা বাড়ি তৈরির নিয়ম কানুন কি জানে! ওকে একঘরে করুন।
ব্যস্, ২৮শে ফেব্রুয়ারি আমার ১২০টা ফুলের টব যাতে আমার দশ বছরের পুরোনো অ্যালুভেরা ও অন্যান্য গাছ ছিল-- সব নীচে ফেলে দিল। কারণ আমি নকশার বাইরে ছাদে কনস্ট্রাকশন করতে বাধা দিচ্ছিলাম। স্বামী বাইরে, ফোন করায় বল্লো থানায় ডাইরি কর। করলাম, পুলিস এসে ওকে জিগ্যেস করলো। পরের দিন আমার থ্রি-ফেজ মিটার মাত্র পনের দিন হয়েছে, পেট্রোল ঢেলে দিনদুপুরে জ্বালিয়ে দিল। কলোনীর গুচ্ছের লোক যারা এখানে থাকে না তাদের নিয়ে সারাদিন নীচে বসিয়ে রেখে আমার ব্যাপারে হাসাহাসি করতে লাগলো।
আমি ইলেকট্রিসিয়ান ডাকলে তাকে ভাগিয়ে দিল। সন্ধ্যে হয়ে আসছিল, খালি আমি আর ৮৬ বছরের চোখে ছানিওলা শ্বাশুড়ি। এদিকে জলও বন্ধ করে দিয়েছিল। কি যে করি! রঞ্জনকে ফোন করায় ও এস পি কে ফোন করে, তাতে চিতা স্কোয়াডের জওয়ান এসে আমাকে সাহায্য করে। পুলিশ পাহারায় বিজলীবিভাগের লোক এসে পুড়ে যাওয়া মিটার খুলে নিয়ে গেল। বল্লো-- আজকে কিছু হবে না। কাল আপনাকে পোড়া মিটারের ফীস জমা করে দিয়ে নতুন মিটার নিতে হবে, পুলিশ বলায় বিল্ডার ব্যঙ্গ করে দু'বালতি জল দেয়ালো। রাত্তিরে ও নিজেকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করে পাঁচজন কে নিয়ে একটি কমিটি বানালো। তারা এসে আমাকে বল্লো--- আপনি বল্লে আমরা বিল্ডারকে অনুরোধ করব যাতে আপনাকে টেম্পোরারি কানেকশন দ্যায়।
আমি ধৈর্য্য হারিয়ে ওদের ঘর থেকে বের করে দিয়ে বল্লাম-- আপনাদের সাহায্যের কোন দরকার নেই। রাত্তিরে রঞ্জন এলে আমরা দরজা জানলা খুলে ড্রইং রুমে অন্ধকারে রাত কাটালাম।
পরের দিন বিকেল নাগাদ নতুন মিটার লাগলেও ওদের কর্মচারী এমন করে সাপ্লাই কেটে দিল যে মাত্র দুটো পয়েন্টে লাইট এল।এসব ঠিক করতে এক সপ্তাহ লাগলো। ৪৬ ডিগ্রি গরমে হাঁটাহাঁটি করে পায়ের তলায় ফোস্কা পড়ে গেল। কিন্তু কিছু করতে পারিনি। এখন বিজলি বিভাগের কনজিউমার ফোরামে গেছি। কাজের কাজ কিছু হয়নি। তারপর কর্পোরেশনে আই এ এস অফিসারের সঙ্গে দেখা করে বিল্ডারের NOC আটকে দেয়ায় চটে গেছে। রঞ্জনের চেষ্টায় ঐ কমিটি ভেঙ্গে দিয়ে অন্য কমিটি তৈরি হয়েছে, রঞ্জন নিজে তার নির্বাচিত ট্রেজারার। ও মিটিংয়ে বলেছে যে কমন মিটারের বিল ২২০০০ টাকা বিল্ডারকে দিতে হবে কারণ ও ওর বন্ধুকে মিটার না দিয়ে বে আইনি ভাবে সে¾ট্রালাইজড্ এসির কানেক্শন কমন মিটারের থেকে দিয়েছে, ওর বচপন স্কুলের তিনটে গাড়ি নিজের বাড়িতে না রেখে এইখনে রেখেছে, পাম্প চালিয়ে ধোয়াচ্ছে,পার্কিং স্পেসে ওর অফিস বানিয়েছে, ওর ড্রাইভারকে এখানে ঘর দিয়ে রেখেছে, তারও কোন মিটার নেই।
এইসব নিয়ে রাগ।
হরিয়ানার পরিবারের মিটার থেকে হুকিং করার সময় ওরা ধরে ফেলে এবং সম্পন্ন লোক। তক্ষুণি লাইন জুড়ে নেয়। তাতে বিল্ডার রেগে গিয়ে রাত্তিরে ফ্ল্যাট খালি করতে গুন্ডা পাঠায়। আমি বাধা দিই। গুন্ডা কে ফিরে যেতে বাধ্য করি। সেই থেকে আমাদের দুই পরিবারের ইউনিটি আর বিল্ডরের রাগ। আবার নতুন এসেও পাশের ফ্ল্যটের বাঙালী পরিবারের ভদ্রলোকের হার্ট অ্যাটাক মত হল, বাচ্চা বৌটা কাঁদছিল। ওরা নিজের থেকেই গাড়ি করে নার্সিংহোমে নিয়ে গেল, পরে নিয়ে এল। আমি খাবার বানিয়ে দু'বেলা নার্সিংহোমে দিয়ে আসতাম। সেই থেকে বন্ধুত্ব। এই হল বেত্তান্ত।
---সবাই বলছে কিছুদিনের জন্যে রায়পুর চলে যেতে। আপনি কি বলেন?
কিরণ গুপ্তা রঞ্জনের দিকে ফেরেন।
--- কেন যাবেন? এখানেই থাকুন। আমরা আছি। আমি পুলিশে চাকরি করি, আমার কি কোন দুশমন নেই? পেশাই এমনি যে হয়ে যায়। তাবলে আমি কি ভিটে ছেড়ে পালাবো?
রঞ্জন ঠিক করে বিলাসপুর ছড়বে না।
কিন্তু পরের দিন রেণুরা চলে গেল রায়পুর। বলে গেল রায়পুর পুলিসের বড়কত্তারা বলছেন--- রায়পুরে গিয়ে এফ আই আর লেখাতে। আগেরটা ছিল মাত্র কমপ্লেন।পুলিশ অফিসার কিরণ গুপ্তার তদন্ত রিপোর্টে প্রাথমিক ভাবে অপরাধ দেখা যাচ্ছে, তাই এবার এফ আই আর করা।
ওরা আরও বলেছেন যে এবার অ্যাকশন হবে, তাই রায় ও হরিয়ানার পরিবার দুটো কিছুদিন রায়পুরে সরে যাক। সেখান থেকে লড়াই চালাক। কারণ বিলাসপুর পুলিশের বিরুদ্ধে কমপ্লেন। ওরা বদলা নেয়ার জন্যে কোন না কোন নতুন ঝুটা মামলায় ফাঁসাতে পারে। ইতিমধ্যে রেণুদের সঙ্গে রায় পরিবারের বিরুদ্ধেও আর্মস্ অ্যাকট ও হরিজন অত্যাচার অধিনিয়ম এর অধীন এফ আই আর হয়েছে, গ্রেফতারও হতে পারে।
রায়পুর পুলিসের জুরিসডিক্শনে গেলে বিলাসপুর পুলিশ কিছু করতে পারবে না।
এবার রায়পুরে সিভিল লাইনস্ গিয়ে এফ আই আর লেখানো হল। রেণু গুপ্তা অভিযোগকারী, ওর মারখাওয়া স্বামী ও রিপোর্টার বন্ধু প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী। রঞ্জনরা দু'জন সারকামস্ট্যান্সিয়াল এভিডেন্সের জন্যে।
অন্য সব ধারা সরিয়ে অতিকষ্টে পেনাল কোডের সেকশন ৩৯৫ ধারা লেখান গেল, তাই সই।
এদিকে বিলাসপুর থেকে আমাদের বিরুদ্ধে গুলি চালানোর কমপ্লেন করা দশজনকে রায়পুর নিয়ে এসে কিরণ গুপ্তা জেরা করলেন।
সন্ধ্যেয় খবর পেলাম আমাদের তিনদিনের মধ্যে রায়পুর শিফট করা উচিৎ। তবে পুলিশ অ্যাকশন হবে। রেণুরা চলে গেলে ওদের ঠিক করা প্যাকার্স ও মুভার্স দিয়ে ওদের মাল পাঠালাম। মেয়েরা ওদের বল্ল যে আমরা রায়পুরে ভাড়ার বাড়ি ঠিক করে জানালে ওরা যেন তাড়াতাড়ি একদিনের মধ্যে প্যাকিং করে দেয়। তাহলে সত্যিই বিলাসপুর ছাড়তে হবে!
ঠিক হল যে আমরা ষষ্ঠীপূজোর দিন সামান্য দরকারের জিনিস নিয়ে ভিলাই চলে যাব।
ওখানে ভাইবৌয়ের কাছে মা ও রত্না থাকবে, তবে আমি দুই মেয়ে নিয়ে ভিলাই হোটেলে থাকবো। সেখানে থেকে ল"ইয়ার ও বন্ধুদের সঙ্গে কথা চালাবো।
আবার মেয়েরা রায়পুরে বাড়ি খুঁজে আমাদের ক্যামেরায় তোলা ফোটো দেখাবে। আমরা হ্যাঁ বল্লে শুধু দু' বোন বিলাসপুর গিয়ে সমস্ত মাল মুভার্স দের মাধ্যমে নিয়ে আসবে। তারপর আমরা ভিলাই থেকে রায়পুর যাবো। রায়পুরের নির্দেশে আমাদের জন্যে পুলিশ গার্ড লেগেছে ফ্ল্যাটের বারান্দায়।
ঝামেলাটা হল পরের দিন সক্কালে, যখন গাড়ি আনিয়ে সমস্ত সুটকেস , অন্য লাগেজ, পোষা কুকুর সব তুলে মাকে নিয়ে আমরা গাড়িতে বসতে যাবো। খবর পেয়ে বিল্ডার এসে হাজির। আমাদের আটকাবে, ওর নাগালের বাইরে যেতে দেবে না। পুলিশ গার্ডকে বলছে -- ওরা মুজরিম, ওদের যেতে দিও না। আমি গার্ডকে বল্লাম -- তুমি থানাদার মিস্টার সিং কে জিগ্যেস কর, তার কম্যান্ড মানবে। বিল্ডার কে?
আমি মোবাইল লাগিয়ে থানাদারকে বল্লাম- আমরা সপরিবারে দূর্গাপূজোর ছুটিতে ভিলাই যাচ্ছি, কালীপূজোয় ফিরবো। উনি সেপাইকে আমার ফোনে নির্দেশ দিলেন যেতে দিতে।
কিন্তু বিল্ডার কোন কথা না শুনে আমার মোবাইল কেড়ে নিয়ে ওর পেটোয়া কোন অফিসারের সঙ্গে সেপাইয়ের কথা বলাতে চাইল। আমার কড়া কথায় ও থানাদারের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বকুনি খেয়ে মোবাইল ফেরৎ দিয়ে রাস্তা ছাড়ল।
আমরা বেরিয়ে গেলাম। রত্না ওর অ্যালোভেরা ও অন্যান্য গাছ ও ফুলের টবের দিকে যতক্ষণ পারে তাকিয়ে রইল।
বিলাসপুর-রায়পুর বর্ডারের কাছে এক তেমাথায় ট্রাকের আড্ডা আছে। সন্দেহ হল ওখানে বিল্ডার আমাদের আটকানোর শেষ চেষ্টা করতে পারে।
তাই শহরের বাইরে গিয়ে চিরাচরিত রাস্তায় না গিয়ে মাঝখানে এক কাঁচারাস্তা দিয়ে আমার কর্মস্থল ভাটাপাড়া ঘুরে টাকা তুলে ঘুরপথে ভিলাই পৌঁছুলাম। ভাইবৌ চিন্তায় ছিল।
ভিলাই হোটেলের ঘরে আরামে শুয়ে মেয়েকে জিগ্যেস করলাম- পুরো অপারেশনটায় অনেক টাকা লাগবে। তারপর হোটেলের ভাড়া, বাড়ি ঠিক হলে অ্যাডভান্স দেয়া, প্যাকার্স ইত্যাদি। কিকরে হবে?
জানালো- ওর বন্ধুরা দিল্লি থেকে ওর ব্যাংকে ইতিমধ্যে জমা করেছে। কয়েক কিস্তিতে দিলেই হবে।
সন্ধ্যেয় জানা গেল যে ভাইবৌয়ের টিমের পুরনো বাংলা গানের অনুষ্ঠান আছে দুটো পূজো প্যান্ডেলে। কিন্তু কথিকা পাঠের লোক অসুস্থ।আর মাঝের ফিলার লাইনগুলো লেখা হয় নি। ওর সহযোগী বিশ্বজিৎ কিন্তু কিন্তু করে বল্লো--- দাদা, জানি আপনার অবস্থা, কিন্তু আমাদের ইজ্জতে গ্যামাক্সিন! যদি একটু কষ্ট করে---!
পাগলা খাবি না আঁচাবো কোথায়!
সন্ধ্যেবেলা স্টেজে ওঠার সময় কুল কুল করে হাসি পাচ্ছিলো। কী -বোর্ড প্লেয়ারের পাশে স্ক্রিপ্ট নিয়ে আর ছোট টর্চ নিয়ে বসেছি। অন্ধকারে মিউজিক বাজলে অন্যমনস্ক হয়ে ভাবচি-- বার্তোল্ড ব্রেখট ও তো বাস্তুহারা হয়ে আমরিকাতে একটা গ্যারেজে নাটকের রিহার্সাল দিচ্ছিলেন। তাহলে এই হরিদাস পাল ও আজ সমগোত্রীয় হল!
আকবর বাদশার সনে হরিপদ কেরাণীর কোন ভেদ নেই।
মেয়েরা বল্ল্ - যদি দাঁত চেপে চেপে বাজে উচ্চারণ করে ছড়াও তাহলে পাব্লিকের মাঝখানে বসে আওয়াজ দেব।
তারপর তিন রাত্তির প্যান্ডেলে ঘুরে বেড়ানোর সময়ও মনে একটাই চিন্তা-- অত:কিম্?
আমার পাব্লিক প্রসিকিউটর বন্ধু ফোনে জানালেন যে তুই যেমন বলছিস যে কর্পোরেশনের অ্যাপ্রুভড নকশায় লিফট প্যাসেজের মধ্যে দিয়ে গেছে আর বাস্তবে গেছে তোর দুটো ফ্ল্যাটএর ড্রয়িংরুমের মধ্যে দিয়ে আর মূল নকশায় তো ফ্ল্যাট ফ্রন্ট রো'তে কিন্তু বাস্তবে দিয়েছে ব্যাক রো তে,তাহলে ৪২০ ধারায় ঠগের কেস লাগা, নন-বেইলেবল্। বিল্ডার বাপ-বাপ করে তোর পেছনে ঘুরবে।
মেয়েরা বল্লো- একসপ্তাহ এখানেই থাক। আমরা দিল্লিতে একদিনে দশটা বাড়ি খোঁজনেওয়ালী পার্টি। রায়পুর শহরে তোমাদের জন্যে ভালো থ্রি-রুম ফ্ল্যাট খুঁজে দেব, মোবাইলে ফটো তুলে ল্যাপিতে দেখিয়ে দেব। তোমরা হ্যাঁ বল্লে মুভার্স-প্যাকার্স ধরে মাল প্যাক করিয়ে বিলাসপুর থেকে রায়পুরে আনিয়ে ঘর গুছিয়ে দিয়ে তবে দিল্লি ফেরৎ যাব। কিন্তু দোহাই তোমাদের! তদ্দিন ভিলাই থেকে নড়বে না। বিলাসপুর থেকে ট্রাকে করে মাল আনা আমাদের ওপর ছেড়ে দাও। হ্যাভ ফেথ অন আস্ , ড্যাড্। তুমিই তো বল-- ছেলেমেয়ে আলাদা নয়। তুমিই তো বলতে মেয়ে না হয়ে ছেলে হলে তোমার মত আড্ডাবাজ, ভাটবকা, আলসে হত। তাহলে?
লরেল-হার্ডি কন্যাদ্বয়ের এবংবিধ আশ্বাসবাণী উচ্চারণে আশায় বুক বাঁধিলাম।
এদিকে সব পত্রিকার সিটি এডিশন আমাদের দুই পরিবারের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে চলেছে। আমরা নাকি আধা-ক্রিমিনাল সন্দিগ্ধ চরিত্রের লোক! আমরা নাকি গুলি চালিয়ে ধরা পড়ে থানা থেকে পালিয়ে রায়পুরে পুলিশের বড়্কর্তার আশ্রয়ে লুকিয়ে আছি।
বাড়ি পছন্দ হল। সামনেই দুটো পার্ক।ছিয়াশি বছরের মার নিশ্চিন্তে এক্ঘন্টা প্রাতর্ভ্রমণ এর জায়গা, নতুন ফ্ল্যাট।
কিন্তু আজকাল রাজধানী রায়পুরে নিয়ম পাল্টেছে।এগ্রিমেন্ট ছাড়াও পুলিশ ভেরিফিকেশন এর ফর্ম ভরে থানায়জমা দিতে হবে। মাওবাদী আতংকের কোল্যাটরাল ড্যামেজ। আমি খুশি। স্ত্রীকে বল্লাম --এটা ডেমোক্র্যাটাইজেশনের দিকে একটি পদক্ষেপ। আগে শুধু ঘরের কাজের লোকের জন্যে লাগতো। এক অর্থে আমরা ওরা সমান, মন্দ কি? ফ্ল্যাটের মালিক জানতে চাইলেন-- তোমার বাবা- মায়ের কাছে আশা করি কোন আগ্নেয়াস্ত্র নেই?
মেয়েরা ভির্মি খেল। মায়ের ওপর যে আর্মস্ অ্যাক্টের এফ আই আর আছে!
যদি এখানকার থানা বিলাসপুর থানাকে জিগায়!
ভাবলাম। তারপর যত জায়গায় পোস্টেড ছিলাম-- সবগুলো থানার নাম দিলাম মায় ছোটবেলার যাদবপুর থানা শুদ্ধু।
থানা থেকে একবার ফোন এল। ব্যস!
মনে হয় ব্যাংকের অফিসার শুনলেই লোকে নিশ্চিন্ত হয়ে যায়। সরকার যাকে অতগুলো টাকার দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়েছে।
কী নাঈভ ধারণা! থাক, আর নিজের জাতকে সবার সামনে খিস্তি করবো না।
এইবার আসল কাজ। বিলাসপুর থেকে জিনিসপত্র আনা।
দুই মেয়ে সক্কাল বেলা গাড়ি বুক করে বিলাসপুর পৌঁছুলো। সোজা সিভিল লাইনস্ থানায় গিয়ে পুলিস প্রোটেকশন চেয়ে সঙ্গে একজন গার্ড নিয়ে বৈশালী প্রাইড ( আমাদের অ্যাপার্টমেন্টের নাম) গেল। ওদের কিছু বন্ধু যারা রত্না রায়ের ড্যাফোডিল স্কুলে পড়েছে তারা সারাক্ষণ সঙ্গে রইল। প্যাকিং হতে থাকলো। এক মেয়ে গিয়ে টেলিফোন, গ্রসারি, মোবাইল, বিজলি বিভাগ, ইলেকট্রনিক্স এর দোকান সর্বত্র গিয়ে লেটেস্ট বিল চেক করে পেমেন্ট করে রসীদ নিয়ে এল। রাত দশটায় ট্রাক ছাড়ল।
তালা দিয়ে বেরিয়ে আসার সময় সামনের ফ্ল্যাটে বিল্ডার, তাঁর স্ত্রী ও অন্যান্য কুশীলবদের ভীড়। সবাই হাসছে, হাততালি দিচ্ছে,মেয়েটা তাকিয়ে দেখছে।
শোনা যাচ্ছে টিটকিরি-- আজকে এই বাড়ি পবিত্র হল।
-- সব আপদগুলো শেষমেষ বিদেয় হল।
--- হ্যাঁ, হ্যাঁ, গঙ্গাজল ছিটাতে হবে।
-- কই, শর্মাজী মিস্টি নিয়ে এসো।
--- সে আর বোলতে, আনতে পাঠিয়েছি।
এখন তো মানবে যে অমিত শর্মা ঠিকই বোলতো?
ট্রাক বেরিয়ে গেল। তারপর আস্তে আস্তে মেয়েদের ভাড়া করা স্কর্পিও। বিল্ডারের বৌ ব্যঙ্গভরা হাসি হাসি চোখে মেয়েকে দেখতে লাগলো। পেছন থেকে গাড়ির তালে তালে হাততালি শোনা যাচ্ছে। গাড়ির গতির সঙ্গে হাততালিও বাড়ছে।
অজিতার গলায় কি যেন দলা পাকিয়ে ওঠে। শুকনো চোখ জ্বালা করছে, বন্ধুদের হাত নাড়ে।
রাত দেড়টায় ভিলাই পৌঁছে দু'বোনে জানাল যে রাত্তিরে ট্রাক গ্যরেজে রায়পুরে আছে। কাল সকালে মা-মেয়ে মিলে আনলোড্ করে ঘর গোছাবে। বিশবছর পরে আবার রায়পুরে ইউনিভার্সিটি পাড়ায় গেরস্থালী শুরু।
বরাবরের ল্যাদখোর রঞ্জন অফিস থেকে ছুটি পাওয়া যাবে না বাহানা করে মা-মেয়ের ওপর সব চাপিয়ে দিয়ে ডিউটি চলে গেল।
মা-মেয়ের চোখে চোখে অর্থপূর্ণ মেসেজ বিনিময় হল।
--- এ আর নতুন কি?
পরের কয়েকটা মাস বড় যন্ত্রণার। সেই থোড় বড়ি খাড়া আর খাড়া বড়ি থোড়!
কোথাও কিছু এগুচ্ছে না। খালি পাচ্ছি নানান ধরণের আশ্বাসবাণী।
--- ঘাবড়াবেন না, হচ্ছে, একটু ধৈর্য্য ধরুন।
ব্যাপারটা দাঁড়াল এইরকম।
মূল বিবাদ বিল্ডারের দু'নম্বরীর সঙ্গে জোড়া ফ্ল্যাটের মালিক রায়পরিবারের ও এক ভাড়াটে পরিবারের।
বিল্ডার চেষ্টা করছে অসম্পূর্ণ অ্যাপার্টমেন্টে ওর দাদাগিরি-জীহুজুরি চালিয়ে যেতে, কাজ পুরো হয়ে গেছে বলে মিথ্যে ঘোষণা করে মেইন্টেনান্সের দায়দায়িত্ব কিছু ফ্ল্যাটমালিকদের নিয়ে বানানো পেটোয়া কমিটির ওপর চাপিয়ে দিতে। কর্পোরেশনের কাছে বন্ধক রাখা ফ্ল্যাটগুলোকেও বিক্রি করে এবং অ্যাপার্টমেন্টের ঘেরা জমিতে কিছু বে-আইনি দোকান খুলে নিজের গ্যাং বসাতে। তারওপর আছে ওনার গিন্নির বচপন স্কুলের তিনটি গাড়ি যেগুলো ওর বাংলোতে না রেখে রাখা হবে আমদের ওখানে এবং রোজ পাম্পচালিয়ে ধোয়া হবে। ওর ড্রাইভার এখানেই স্টোর রুমে থাকবে, তার কুলার-বিজলি চলবে আমাদের কমন মিটার থেকে। ওর আরেক মিনি পার্টনার, বাড়ি থেকে ভাগ নিয়ে চলে আসা এক সর্দারজি, দুটো ফ্ল্যাট ও এক ছাদ বেআইনি ভাবে বিনা রেজিস্ট্রি করে কিনবেন, এসি চালাবেন, কিন্তু কোন মিটার ছাড়াই। সকলের কমন মিটার থেকে তার জুড়বেন বা এর ওর থ্রি-ফেজ মিটার থেকে হুকিং করবেন--- এসব নিয়ে কিস্যু বলা যাবে না।
পার্কিং স্পেসের মধ্যে দোকান খোলা হবে, চুপ করে থাকতে হবে। রেন-ওয়াটার হার্ভেস্টিং পিট আজকাল কম্পালসারি, জেনারেটর রুমে ওর স্টোর, তবু চুপ করে থাকতে হবে।
আমি হরিদাস পাল খুব ভদ্রলোক, তাই ওর কমিটিরও ট্রেজারার-- জনগণের সঙ্গে থাকতে হবে যে! তবে তো ওদের একস্পোজড- করা যাবে! কিন্তু রত্না রায় একেবারে মাওবাদী। জনগণের একতায় দীর্ঘমেয়াদী আন্দোলনে বিশ্বাস নাই।
সে তর্ক করে, কর্পোরেশনের অফিসে গিয়ে রাইট টু ইনফর্মেশনের আবেদন দিয়ে প্রমাণিত নকশা এনে চেঁচামেচি লাগায়।
--- এরা আমাদের বোকা বানাচ্ছে, তোমাদের পাঁচজনকে বন্ধকী ফ্ল্যাট বিক্কিরি করেছে, কাল তোমাদের কর্পোরেশনের লোক ঘরখালি করাতে বলতে পারে। রেজিস্ট্রির টাকা ডুববে। তোমরা কথা বল।
ওরা ভয় পায়, বিল্ডারের কাছে যায়। বিল্ডার বোঝায় --- সব বাজে কথা, ওই মহিলা বন্ধকের কী জানে! আমি সব ঠিক করে দেবো।
বিল্ডার বিজলি বিভাগে পয়সা খাইয়ে তিনটে বন্ধকী ফ্ল্যাটে মিটার লাগিয়ে দেয়। জনতা মুগ্ধ, জনতা কনভিন্সড-।
বিল্ডার ওয়েলফেয়ার স্টেট, রায়পরিবার মাওবাদী। ফলে ওরা ঝাঁপিয়ে পড়ে।
আমাদের মিটার জ্বালিয়ে দেয়া হয়। জল ছাড়া, আলো ছাড়া আমার ৮৬ বছরের মা ও বৌ ক'দিন কাটায়। আমি হরিদাস পাল ভাটাপাড়ায় ব্যাংকের অডিট নিয়ে ব্যস্ত থাকি।
জনতা বিল্ডারের মাহাত্ম্যে মুগ্ধ হয়ে হাততালি দেয়।
এবার বিল্ডার পুরো ব্যাপারটা আম পাব্লিক ও অ্যাড্মিনিস্ট্রেশনের সামনে অন্য ভাবে পেশ করে।
প্রেস কনফারেন্সে, থানায়, পত্রিকার অফিসে বা মন্ত্রীদের কাছে কোথাও বিল্ডারকে দেখা যায় না। থাকে বিল্ডারের বৌ ( ওর নাকি ছাদে একটি নির্মাণাধীন পেন্ট হাউস আছে, সেই সুবাদে) আর কিছু মহিলা-পুরুষ-শিশু, হয়তো একই পরিবারের জনাচারেক।
-- আসলে না ওটা ফ্ল্যাটের অধিবাসীদের কমিটির সঙ্গে এক বাইরে থেকে আসা হরিয়ানার পরিবারের ক্ষমতার লড়াই।
-- আর কি জানেন, ওই পরিবারটি, ওরা বিশেষ সুবিধের নয়। ওরা না স্বামী-স্ত্রীও নয়। বন্ধুর বৌকে ভাগিয়ে নিয়ে এসেছে।
-- ওমা! সেকি কান্ড! আর--?
-- হ্যাঁ, হ্যাঁ, যা ভাবছেন তাই! রাত্তিরে নানারকম লোকজন আসে। বলুন তো, আমরা বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে ঘর করি, আমরা কি করি?
-- কী করি? তাড়াও বাপু, তাড়াও! এটা ভদ্দরলোকের পাড়া, এসব অসৈরণ চলবে না।
--- কিন্তু ওই রায়পরিবার! ওরা তো ভাললোক বলেই জানতাম। মিসেস রায় শুনেছি সবাইকে সাহায্য করেন।
--- দূর থেকে ওমনি মনে হয়। আমরা তো ভুক্তভোগী। মিসেস রায় আসলে নাম কামাতে চায়। ক্ষমতালোভী। বিল্ডার যদি ওকে প্রেসিডেন্ট করতো তাহলে দেখতেন ওই সবার আগে ঐ বিয়ে না-হওয়া জাঠ পরিবারটিকে দূর-দূর করে তাড়াতো।
--- আর স্বামী? ব্যাংক অফিসারটি?
---- আরে মশাই কে যে কার স্বামী? ওদের মধ্যে তো মিলমিশ নেই। থাকবে কোত্থেকে? অমন ডাকাবুকো মহিলার ওই মিনমিনে ন্যাকাষষ্ঠী হাজব্যান্ড! খালি ব্যাংক, বইপত্তোর আর গোটাকয় বন্ধু।
কাঁহাতক পোষায়! কি বলছি বুঝতেই পারছেন। হি-হি-হি-হি-!
এইভাবে দুটো পরিবারকে বাস্তুহারা করার জন্যে একটি জনপ্রিয় যুক্তিসংগত মিথের নির্মাণ হয়। আহিস্তা! আহিস্তা!
কাউকে বলা হয় না যে হরিদাস পাল নিজে ওই কমিটির ট্রেজারার। বলা হয় না যে বিল্ডারের স্ত্রী প্রত্যেক মিটিংয়ে বসে সবাইকে উশ্কিয়ে ছিলো -- চলো, সবাই মিলে হরিয়ানার পরিবারটিকে ঘর থেকে টেনে বার করি।
প্রত্যেক মিটিংয়ে রত্না রায়কে আঙুল তুলে বলতো-- ওই ষাট বছরের বুড়িয়া! আমাদের বিরুদ্ধে থানায় যাচ্ছে, বিজলিবিভাগে যাচ্ছে, করপোরেশনের অফিসে যাচ্ছে।
বলা হয় না যে জবাবে রত্না শুধু শুকনো ইংরিজিতে বলতো--- মিটিংয়ে কথা বার্তা অ্যাজেন্ডা অনুযায়ী হোক, তারপর মিনিটস্ লেখা হলে সবাই মিনিটস্ বুকে সাইন করে বাড়ি যাক, ঘরের কাজকম্মো পড়ে আছে।
সবাই পরে অবাক হয়ে বলতো--আপনারা এত শুনেও চুপ করে আছেন!
হরিদাস পাল হাসতো--- ওদের হিসেবে খেলবো না, আমার হিসেবে খেলবো। রত্না রাত্তিরে হেসে বলতো-- আমার বয়স ছ'বছর বাড়িয়ে দিলো। তুমি চুপ করে রইলে?