গল্প - অচিন্ত্য দাস
Posted in গল্পসোমশেখর রায়চৌধুরিকে আমি বেশ কয়েক বছর চিনি। আসলে উনি বেড়াতে ভালবাসেন আর আমার একটা ছোটোখাটো ভ্রমণ-সংস্থা আছে। অনেকবার আমাদের আয়োজন করা সফরে গেছেন। ভদ্রলোকের বয়স, আমি পাসপোর্টে দেখলাম, ঠিক আশি। এবার পাসপোর্ট লাগছে বাংলাদেশ যাবার জন্য— উনি যাবেন একটা গ্রুপের সঙ্গে। তবে ওনার একটা বায়না আছে, আর সেটার ব্যবস্থা করতেই আমাকে ওনার বাড়িতে আসতে হয়েছে।
— “আসেন, আসেন। একটু চা চলবে তো?”
সোমশেখরবাবুর স্ত্রী গত হয়েছেন অনেক বছর আগে। একাই এই দোতলার ঘরটায় থাকেন। তবে আগেও দেখেছি এনার বাড়ির আবহাওয়াটা ঠিক ‘শান্তিপূর্ণ’ নয়। তাই হ্যাঁ বলতে একটু দেরি হচ্ছিলো। উনি ততক্ষণ কাজের মাসিকে বলে দিলেন চায়ের জন্য। ব্যাস, গরম তেলে যেন জল পড়লো। বাড়ির ছোটো বৌ ঝাঁঝিয়ে উঠলো— “এখন চা হবে তো রান্না হবে কখন। একটাই তো গ্যাস। এদিকে তো আবার একটার মধ্যে ভাত চাই ওনার! যত্তসব।”
চা এল, সঙ্গে চারটে মারি বিস্কুট আর কাজের মাসির সাবধানবাণী। — “ছোটো দাদাবাবু বারোটায় একবার অফিস থেকে আসবেন, কী সব কাগজে সইসাবুদ করাবেন। বৌদি বলে দিলো বাইরের লোকের সামনে সে কাজ হবেনি।
অর্থাৎ আমাকে বলা হচ্ছে বারোটার মধ্যে প্রস্থান করতে। আমি সরাসরি কাজের কথায় এলাম। — “আপনার জায়গাটা গুগল ম্যাপে দেখলাম। তবে ওদিকে তো দ্রষ্টব্য সেরকম কিছু নেই তাই সকলকে নিয়ে যাওয়া যাবে না।”
— “সকলের যাওয়ার কী দরকার— আমি একাই যাব।”
— “একা? রাস্তাঘাট সব পাল্টে গেছে। যদি চিনতে না পারেন। তার থেকে আমি একটা ছেলেকে দিয়ে দেবো আপনার সঙ্গে।”
— “না রে বাবা, অত লোক-লস্কর লাগবে না। ওরা যখন ঢাকার আশপাশটা ঘুরে দেখবে আমি তখন একটা দিনের জন্য যাব, আবার ফিরে আসবো ঢাকায়। অসুবিধেটা কোথায়?”
— “না, আপনার বয়স হয়েছে তো…”
— “হা হা হা, বয়স একটি সংখ্যা মাত্র, বুঝেছো। তুমি ভেবো না। আমাকে ঢাকা থেকে কারিয়াগঞ্জ যাবার বাস ধরিয়ে দিলেই হবে। আগে তো ঘন্টা তিনেক লাগতো... এখন কমই লাগবে মনে হয়। বাস গুমটি থেকে রাস্তাঘাট তো আমি চিনি।”
এনার ‘আগে’ মানে সেই নাইনটিন সিক্সটি ফোর। পঁয়েত্রিশ সালে জন্ম, ইস্কুল-কলেজ সব ওখানেই। পার্টিশনের সময় মাটি কামড়ে ওনার বাবাকাকারা রয়ে গিয়েছিলেন। তারপর চৌষট্টিতে এপার বাংলাতে চাকরি পাওয়াতে এদেশে আগমন এবং বসবাস। বললাম— “একটা গাড়ি করে দিচ্ছি। আপনাকে নিয়ে যাবে নিয়ে আসবে…”
— “তাহলে তো বাড়ি ফেরার মজাটাই চলে যাবে। বাসেই যাব। নেমে রিক্সা নেবো, সোনাডাঙ্গা বাজারের পাশ দিয়ে কলেজের ফুটবল মাঠ পার করে সবুজ পুকুর। তারপর তো আর পাঁচ মিনিটের রাস্তা। আচ্ছা তোমার এই ফোনে ম্যাপ দেখা যায়, দেখো তো জায়গাগুলোর কী অবস্থা এখন?”
আমি গুগল ম্যাপ আর গুগল আর্থ দুটোই দেখলাম। বললাম— “হ্যাঁ, আপনার ওই সোনাডাঙ্গা মার্কেট তো দেখাচ্ছে। ফুটবল মাঠ কিন্তু দেখাচ্ছে না। বাড়িঘর হয়ে গেছে হয়তো। সবুজ পুকুর, সবুজ পুকুর…হ্যাঁ, এখানটায় একটা ওয়াটার বডি দেখিয়েছে... এটা হতে পারে”
— “দেখি ভাই, সবুজ পুকুর… কোন টা? চোখের জ্যোতি কমে গেছে, দেখতে পাব কি?...”
আমি লক্ষ্য করলাম উনি কেমন যেন ভাবনায় ডুবে গেলেন। নস্টালজিয়া। এনার এখনও যেরকম উৎসাহ আর সব ব্যাপারে আগ্রহ, তাতে মনে হয় বয়সকালে ইনি বেশ রোম্যানটিক ধরনের ছিলেন। এতদিন পরে পুকুর পাড়ের খোঁজ? হতেই পারে এখানে ওনার কোনও বাল্য কিংবা কিশোর প্রেমটেমের স্মৃতি আছে। তা না থাকলে এতদিন পরে এরকম আনমনা ভাব এসে যায় কী করে?
ধরেছি ঠিক। বলেই ফেললেন। — “আর তো কোনও বন্ধু-বান্ধব নেই, তুমিই যা আমার সঙ্গী। তোমাকে বলেই দিই। হাইস্কুলে পড়ার সময়… ওই তোমরা যাকে বল ‘কাফ লাভ’ তাই হয়েছিলো। পুকুরের ধারেই দুবার দেখা হয়েছিলো। ব্যাস। তবু কি জানো, তাকে আর ভুলতে পারিনি। এখন যেন আরও বেশি করে মনে পড়ে।”
— “আরেকটা কাজ করতে হবে ভাই তোমাকে। আমাকে নিয়ে একবার ব্যাঙ্কে যাবে? একটা দেড় লাখের ফিক্সড ভাঙ্গাবো… তোমাদের টাকাটা ওখান থেকেই দেবো আর বাকিটা— বুঝলে ভাই, হাত খুলে খরচ করবো এবার। এতদিন পরে বাড়ি ফেরা— কী বলো?”
আমার মেয়াদ বারোটা অবধি। ঠিক আছে বলে উঠলাম। ওঃ, এই মানুষটি বাড়ির রাস্তায় পা ফেলার জন্য বড়ো অস্থির হয়ে পড়েছেন!
****
আর দিন চার-পাঁচ পরেই বাংলাদেশ যাত্রা এদের, এমন সময় ঘটনাটা ঘটে গেলো। খুব অপ্রত্যাশিত বলা যায় না, তবে একটু নাড়িয়ে দিলো, এই আর কি। বৃদ্ধরাই আমাদের যাত্রায় বেশি থাকে তাই আমাদের তৈরি থাকতে হয়। যেমন মেডিক্যাল ইনসুরেন্স, যেমন সেখানকার হাসপাতাল, ডাক্তার-বদ্যির সঙ্গে এক-আধটু ব্যবস্থা করে রাখা। বিদেশে বা দূরে কোথাও কেউ মারা গেলে মেলা হাঙ্গামা পোয়াতে হয়। সেদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে।
ভোর রাত্তিরে অ্যাটাক না স্ট্রোক কী একটা হয়েছিলো। তারপর বাড়িতে সে কি হুলস্থুল! হাসপাতালে নিয়ে যাবার জন্য নয়, উইলে সই হয়নি বলে। কাগজপত্র নিয়েই দুই ছেলে অ্যাম্বুলেন্সে উঠলো, যদি জ্ঞান ফেরে। এদিকে বাড়িতে দুই বৌ-এর ভেতর চুলোচুলি। একটা বার্মাটিকের আলমারি ছিলো ওনার ঘরে, সেটা নিয়ে টানাটানি। এ বলে ওটা আমাদের, সে বলে তাদের।
জ্ঞান আর পুরোপুরি ফেরেনি— সারাক্ষণ কেমন একটা ঘোরের মধ্যে অস্পষ্ট স্বরে কী যেন বলছিলেন। তারপর সন্ধ্যেবেলা মায়া কাটিয়ে চলে গেলেন।
****
ও বাড়িতে যাতায়াতের সূত্রে ফোন নম্বর দেওয়া ছিলো। তাই ফোনে শ্রাদ্ধের খবরটা আমাকে দেওয়া হয়েছিলো। খবরের কাগজে মোড়া এক ডজন সরুসরু কাঠির মত রজনীগন্ধা নিলাম। দাম তো কিছু কমালোই না তার ওপর ফুলওয়ালার পাটিগণিতে ডজন-এর মানে দশ হয়ে গেছে দেখলাম। যাইহোক, গিয়ে দেখি তখনও বেশি লোক হয়নি। শুনলাম ছেলে নাকি শ্রাদ্ধ বয়কট করেছে! সোমশেখরবাবুর ফটোটা একটি মেয়ে সাদা চাদর পাতা টেবিলে বসাচ্ছে। আমি একটা চেয়ারে গিয়ে বসলাম। পাশে এসে বসলেন এঁদের এক প্রতিবেশী। আমার পরিচয়টুকু জেনে নিয়ে বলতে শুরু করলেন — “উফ কাণ্ড দেখেছেন! মৃত্যুর মুখে কীরকম অশান্তি যে সহ্য করতে হলো রায়চৌধুরিবাবুকে! ছেলে দুটোর বলিহারি! সম্পত্তি সম্পত্তি আর সম্পত্তি। ছি ছি। মারা যাবার মুহূর্ত্তেও বাবাকে একটু শান্তি দিতে পারলে না। ভারি কষ্টের মৃত্যু, ভাবলেও দুঃখু হয়…”
ফটো বসে গেছে। আমি কাগজের মোড়ক খুলে ফুলগুলো ছবির পাশে রেখে দিলাম। মুখে কিছু বলিনি তবে প্রতিবেশী ভদ্রলোকটি যা বললেন তাতে আমার মন একটুও সায় দিচ্ছিল না। মোটেই এ মৃত্যু কষ্টের নয় বরং এরকম সুখমৃত্যু ভাগ্যের ব্যাপার! সম্পত্তি নিয়ে ঝামেলা তো কতদিন থেকে চলছিলো। সে ওনার সয়ে গিয়েছিলো। গত কয়েকটা দিন দেশের পুরোনো বাড়িতে যাওয়ার জন্য সোমশেখরের তর সইছিলো না। গুগলের ম্যাপ আর স্মৃতিতে থেকে যাওয়া রাস্তার ছবি সব মিলেমিশে গোটা মনটা ছেয়ে রেখেছিলো। বাড়ি ফেরার রাস্তাটা বড়ো আদর করে টানছিলো তাঁকে। জীবন-মৃত্যুর সীমানায় ঘোর লাগা সময়টাতে উনি মনে মনে পৌঁছে গিয়েছিলেন কারিয়াগঞ্জের বাস গুমটিতে। সাইকেল রিক্সা ডেকে বলছিলেন— “আমারে নূতন মানুষ পাইস, অ্যাঁ? এত ভাড়া লাগবা না কি! যাক গে আজ আর দরদাম করুম না। সবুজ পুকুরের পাশ দিয়া যাইও কিন্তু। ভাই পুকুর আইলে একটুকু ধীরে চালাইও। আর সোনাডাঙ্গার বাজারে দাঁড়াবা, কয়েটা আম লইয়া যায়ুম। অনেককাল পরে বাসায় আইতেসি তো…”
ঘোর লাগা চোখে অজানা এক রিক্সায় সবুজ পুকুরের পাশ দিয়ে বাড়ি ফেরার রাস্তায় যেতে যেতে উনি হারিয়ে গেলেন। আহা কি মধুর সমাপন! ওম শান্তি, ওম শান্তি।