Next
Previous
0

ধারাবাহিক - রাজা মুখোপাধ্যায়

Posted in


 


এবার ইউরোপ – ১

আগের কিস্তিতেই লিখেছিলাম ঘটনাবহুল নব্বইএর দশকের কথা। আসলে পিছন ফিরে এই সময়ের ঘটনাপ্রবাহ আতসকাঁচের তলায় ফেললে বুঝতে পারি এর বীজ পোঁতা হয়েছিল অনেক আগেই। আরও দশ বছর আগে, যখন থেকে বদলে যাচ্ছিলো আমার রুচি, আমার সামগ্রিক জীবন দর্শন। যার মধ্যে একটা বিষয় ছিল খাওয়া-দাওয়া। বুঝতে শুরু করেছিলাম আদিম যুগের মতো খাবারের কাজ শুধু উদরপূর্তি নয়, মানুষের মন আর মননের এক অভ্রান্ত প্রতিফলন দেখা যায় আহার নির্বাচন বা রন্ধন প্রক্রিয়ার মধ্যে। আর এই পুরো ব্যাপারটা কত বৈচিত্র্যময় আর বিচিত্র হতে পারে, গত তিন দশক এই দুনিয়ার অন্দরমহলে সামান্য ঘোরাঘুরি করার সুবাদে টের পেয়েছি। মানুষ বেছে নেয় তার খাদ্য। কিন্তু এর উল্টোটাও কি হতে পারে? অর্থাৎ খাদ্য কি খুঁজে নিতে পারে ভক্ষণকারীকে? এখন মনে করি, অবশ্যই পারে। একটু বলি।

১৯৮৯। অলোকদা (অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত) একদিন ফোনে বললেন, তাঁর এক বন্ধু, গ্যোটে ইন্সটিটুট-এর এক কর্তা, কুর্ট শার্ফ, তাঁর স্ত্রী মার্থেডিস এবং তাঁদের আরেক বন্ধু বারবারা তিনদিনের জন্য কলকাতায় আসছেন কিছু কাজে, যার মধ্যে একটা হলো সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে একটা সাক্ষাৎকার। অলোকদার ইচ্ছে আমরা, মানে আমি আর সুলগ্না ওঁদের একটু সহায়তা করি। সেই মতো নির্দিষ্ট দিন ও সময়ে গোখেল রোডের গেস্ট হাউসে পৌঁছলাম আমরা। আলাপ হলো তিনজনের সঙ্গে এবং অতঃপর নির্ধারিত ঘোরাঘুরি। এসব নেহাতই মামুলি ঘটনাক্রম আর এর সঙ্গে এই লেখার সরাসরি কোনও যোগসূত্রও নেই। তাই কি? শুরুতেই লিখেছিলাম না, খাদ্যও বেছে নিতে পারে তার ভক্ষণকারীকে? এই তিনজনের সঙ্গে যখন জীবনব্যাপী এক বন্ধুত্ব রচনা হচ্ছে, আমাদের অজান্তেই আমাদের মধ্যে অন্য এক পৃথিবীর হেঁশেলের সঙ্গে ভালোবাসাও জন্ম নিচ্ছে। সে ভালোবাসা যে ধীরে ধীরে গ্রাস করে ফেলবে এই অধমকে, তার কোনও আভাসই পাইনি সেদিন। অদেখা, অচেনা এই জগতকে প্রত্যক্ষ করার অপেক্ষা করতে হলো আরও বেশ কিছুদিন, যে পর্বে কলকাতাতেই আমাদের সঙ্গে পরিচয় হলো অলোকদারই এক তরুণ ছাত্র, বয়সে আমাদের থেকে সামাণ্য ছোট, হানস্‌ বয়েলের সঙ্গে। কলকাতার পথেঘাটে আমাদের বন্ধুত্ব যখন অঙ্কুরিত হচ্ছে, সেইরকম কোনও এক আড্ডায় সুলগ্নার নৃত্যচর্চার প্রসঙ্গটি এসে পড়ে। তার দিনকয়েক পর হানস্‌ আমাদের বলে যে আমাদের সম্মতি থাকলে হ্যোক্সটার (মধ্য জার্মানির একটি ছোটো শহর) এর লায়ন্স ক্লাব সামনের বছর কোনও এক সময় আমাদের আমন্ত্রণ জানাতে চায়। ‘আমাদের’ বললাম বটে কিন্তু আমন্ত্রণটি মূলত সুলগ্নার, ওখানে ওর একটি নাচের অনুষ্ঠানের। তখনও আমাদের পাসপোর্ট নেই। তার আগেই অবশ্য জার্মান ভাষাশিক্ষায় কিছুদূর অগ্রসর হয়েছি আমরা দুজনেই। আর জার্মান লেখক-শিল্পীদের জীবন ও সৃষ্টিকেন্দ্রিক অলোকদা রচিত কোলাজনাট্যে অভিনয় করছি নিয়মিত।

এর পরের দৃশ্য পূর্ব বার্লিনের শ্যোনেফেল্ড বিমানবন্দর, সেপ্টেম্বরের কুড়ি তারিখ, উনিশশো নব্বই। কুর্ট আমাদের নিতে এসেছেন। আমাদের গন্তব্যস্থল পশ্চিম বার্লিনের শারলটেনবুর্গ অঞ্চলে বারবারার বাড়ি। প্রথমদিন নৈশাহার কি হয়েছিল তিন দশক পর তা মনে আছে বিশেষ কারণে। আমরা ‘হিন্দু’ বলে বারবারা সেদিন রান্না করেছিল মুরগির মাংস। কিন্তু খাওয়ার ব্যাপারে আমাদের যে কোনও ছুৎমার্গ নেই, পরদিন প্রাতরাশের টেবিলেই কাপ্টাইন পরিবারের সেই ধারণা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল।

জার্মানি বিখ্যাত রুটি আর বিয়ারের (Brot und Bier) জন্য। ছোটোবেলা থেকে আমরা যে পাঁউরুটির সঙ্গে পরিচিত ছিলাম, বার্লিনের তিরিশ বছর আগেকার সেই সকাল একধাক্কায় পুরনো সেই ছবিটা আমূল বদলে দিল। প্রকাণ্ড সেই টেবিলে নানারকম রুটির মধ্যে আমরা যে স্লাইস্‌ড রুটি খেতে অভ্যস্ত (যাকে ওরা ‘টোস্ট ব্রোট’ বলে থাকে), তা তো ছিলই, তাছাড়াও ছিল জগদ্বিখ্যাত জার্মান ‘ব্রাউন ব্রেড’, ‘মাল্টি-গ্রেন ব্রেড’ এবং ‘ব্র্যোটশেন’ (Broetchen)। আর দেখলাম ‘কোয়াসঁ’ (Croissant), যার উৎপত্তিস্থল অবশ্য ফরাসিদেশ।

এছাড়া সসেজ ছিল অসংখ্য প্রকারের আর ছিল নানান ধরণের সালামি আর ‘কোল্ড কাটস’- যেখান থেকে একটি বস্তুর উল্লেখ না করলেই নয়। তা হলো ‘অক্স টাং’ অর্থাৎ ‘ষাঁড়ের জিভ’। আর এই ‘অক্স টাং’–এর প্রসঙ্গ এলে অবধারিতভাবে এসে পড়ে ‘অক্স টেল’ স্যুপের কথা। কিন্তু সসেজ? এ নিয়ে দু’চার কথা না লিখলে আর এই বিষয়ের অবতারণা কেন?

সেবার, সেই প্রথমবার, আমরা জার্মানি পৌঁছেছিলাম দুই জার্মানি এক হয়ে যাওয়ার সপ্তাহদুয়েক আগে। বার্লিন শহরে তখন উৎসবের মেজাজ আর বারবারা আমাদের নিয়ে একেকদিন বেরিয়ে পড়তে লাগলো একেক দিকে আর প্রতিদিনই আমরা আবিষ্কার করতে লাগলাম নতুন নতুন খাদ্যবস্তু। এমনিতে এই তিরিশ বছর ধরে দেখে আসছি বারাবারার বাড়িতে দুটো ফ্রিজ। একটা রান্নাঘরের মধ্যে, যে রান্নাঘরে একটা ছোটো খাবার টেবিলও আছে। আরেকটা সংলগ্ন বারান্দায়, যে এলাকাটাকে ওরা বলে ‘হ্বিন্টার গারটেন’ (Winter Garten)। নানারকম ছোটোখাটো গাছ আর খুঁটিনাটি জিনিস সাজানো সেখানে। এই দুটো ফ্রিজই পরিপূর্ণ বিভিন্ন ধরণের খাদ্যদ্রব্যে। ভিতরের ফ্রিজে চিজ, মাখন আর ‘কোল্ড কাটস্‌’। বাইরেরটায় ফ্রুট জুস, বিয়ার আর পানীয় জল। এই জল খাওয়া নিয়ে বেশ ঝামেলায় পড়েছিলাম সেবার। সাধারণভাবে ওখানে সরাসরি যেকোনও কল থেকেই জল খাওয়া যায় কিন্তু কারও বাড়িতে বা রেস্তরাঁয় গিয়ে জল খেতে চাইলে অবধারিতভাবে একটি প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। ‘মিট স্প্রুডেল ওডার ওনে?’ মানে ফিজ থাকবে, না থাকবে না? এই ধন্দে বারবার পড়তে হয়েছিল আমাদের। ‘মিট স্প্রুডেল’ অর্থাৎ ঝাঁজওলা জল খেয়ে তেষ্টা মিটত না কিছুতেই।

প্রাচীন সময় থেকেই যে খাদ্যবস্তুটি জার্মানিতে তার জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছে, তা হলো সসেজ। জার্মান রূপকথাতেও এর উল্লেখ রয়েছে। জার্মানির প্রতিটি অঞ্চলের রয়েছে নিজস্ব বিয়ার এবং সসেজ এবং প্রতিটি অঞ্চলই দাবী করে তাদেরটিই সেরা। এ এক অদ্ভুত প্রতিযোগিতা! কিন্তু কেন? অনেক পরে যখন দীপ্তেন্দুদার আগ্রহে সসেজ তৈরি এবং বিক্রির মধ্যে এলাম, বুঝলাম এ এক মহাসমুদ্র! মাংসের কিমা (সেটা গরু, শুয়োর, মুরগি বা যেকোনও প্রাণীর মাংস, যা খাওয়া হয়) আর মশলার সংমিশ্রণে যে এমন একটি অপূর্ব বস্তু সৃষ্টি হতে পারে, তা হাতেকলমে কাজ না করলে এভাবে জানা হতো না। বাভারিয়ায় একধরণের সসেজ তৈরি হয়, যা খেয়ে নিতে হয় বারোটার মধ্যেই, না হলে খারাপ হয়ে যেতে পারে। এই সসেজ প্রসঙ্গে একটা কথা বলতেই হয়, তা হলো ইউরোপের প্রতিটি দেশের সসেজ-সংস্কৃতি অবাক করে দেওয়ার মতো এবং তা আলাদাভাবে আলোচনার বিষয়বস্তু। বার্লিন এবং জার্মানির বিভিন্ন অঞ্চলে এই সসেজ-সংস্কৃতির গভীর প্রভাব চোখে পড়বে। এই বিষয়টির ব্যাপ্তি এত বেশি যে যে তার জন্য স্বতন্ত্র পরিসর দরকার। কিন্তু ‘লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট’- এর মতো যে কয়েকটি জিনিস সেদিন থেকে আজও আমাদের মজিয়ে রেখেছে, তার মধ্যে অন্তত দু’টির উল্লেখ করতেই হয়। ‘কারি হ্বুরস্ট’ আর ‘ব্রাট হ্বুরস্ট’। এর মধ্যে এতদিনে বিশ্বায়নের দৌলতে এই বস্তুগুলি হয়ত আর এখানে তেমন অপরিচিত নয়, তবুও এ কাহিনি তো প্রথম প্রেমের! এর মধ্যে প্রথম পদটির নাম থেকে বোঝা যাচ্ছে এখানে কারির একটা ভূমিকা রয়েছে, রয়েছে অনস্বীকার্য এক ভারতীয় যোগ। এর মূল উপাদান দুটি। টোম্যাটো কেচাপ আর সসেজ। একটি বড় মাপের সসেজকে টুকরো করে তার ওপর দিয়ে ছড়িয়ে দেওয়া হয় কেচাপ আর শেষে হালকা করে ওপরে ছড়িয়ে দেওয়া হয় একটা ভাজা মশলা, যার মধ্যে থেকে জিরের সুঘ্রাণ চিনে নিতে অসুবিধা হয় না। আর পরের পদটির নামকরণ থেকে তার ইতিহাস, নানান বিতর্ক ঘিরে আছে এই অসামাণ্য বস্তুটিকে। ‘ব্রাট’ শব্দটির জার্মান ভাষায় দু’রকম মানে হতে পারে। প্রথমটি ‘উদ্বৃত্ত’। অনেক আগে প্রচণ্ড শীতের মোকাবিলা করার জন্য বাড়তি নানারকম মাংস মিশিয়ে যে সসেজটি তৈরি করা হতো, তারই নাম ‘ব্রাটহ্বুরস্ট’। অন্য একটি তত্ত্ব অনুযায়ী ‘ব্রাটহ্বুরস্ট’ মানে পোড়া বা গ্রিল করা সসেজ। কিন্তু নামে কি আসে যায়? জার্মানি আর সসেজ, এই দুটি শব্দ উচ্চারিত হলেই প্রায় অবধারিতভাবে এসে পড়ে এই নামটি। প্রত্যন্ত কোনও প্রদেশে গেলেও চোখে পড়বে ছোট্ট একটি কিওস্ক-এর মধ্যে বা বাইরে একটি গ্রিলে থরে থরে পাশাপাশি শুয়ে এই সসেজ আর তাকে ঘিরে থাকা ছেলেবুড়োর ভিড়। লম্বা একটি রুটির পেট চিরে একটি সসেজ ভরে দিয়ে তার ওপর লম্বা করে সরষের পেস্ট দিয়ে রুটিটি চেপে দিয়ে পরিবেশন ওদেশে একটি অতি পরিচিত দৃশ্য। অবশ্য রুটি ছাড়াও স্যালাড সহযোগে এই বস্তুটি চেখে দেখাও প্রথাবিরুদ্ধ নয়।