ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত
Posted in ধারাবাহিক৪
কিছু কিছু জিনিস সে খুব ভালো জানে। ব্রেজেনের মনে পড়ে। সেগুলো সে শেখাতে পারে মানুষজনকে এবং সেগুলো সত্যিই শিক্ষণীয় ব্যাপার। যেমন, সেনাবাহিনীর চাকরির নিয়মকানুনগুলো সে খুব ভালো করে জানে, কারণ প্রচুর নতুন পরিকল্পনা সে নিয়মিত করেছে একসময়; এইসব তার কাছে জলভাত। তার অল্পবয়সে সে ‘ইস্পাত হেলমেট’ এবং যুব সংগঠনের কাছে সে নিজের জেলায় ট্রেনিং নিয়েছিল; কঠিন অনুশাসনের মধ্য দিয়ে কেটেছে তার নিজের শিক্ষাপর্ব। ট্রেনিংএর সময়ে তার মিষ্টি খাওয়ার নেশা, এমনকি সেই গোপন ‘এডভেঞ্চার’-এর নেশাও একদম ছুটে গিয়েছিল।
সে ঘোড়া ছোটাতে জানে খুব ভালো। এই জানাটা তাকে অনেকটাই এগিয়ে রেখেছিল অন্যদের থেকে। সে দ্রুত একজায়গা থেকে আরেকজায়গায় চলে যেতে পারতো।
চাকরিতে অধস্তনদের সঙ্গে মিটিং করা, কাজের পরিকল্পনা করা, এসব নানা জিনিস সে খুব ভালো জানে।
তবে ট্রেনিংএর সময়ে যেভাবে সে মানুষ সম্পর্কে জানতে পেরেছিল, চাকরিতে ঢুকবার পরে আর তেমনি করে জানা হয়নি তার।
ফ্রন্টে লড়াই করা বুড়ো সেনাদের জানতো সে। আশ্চর্যজনকভাবে শান্ত এবং নিষ্পাপ যুবকদের জানতো সে, যারা মাঝেমধ্যে অদ্ভুত ঝুঁকির কাজ করতে পারতো। তবে সব ব্যাপারে এক অদ্ভুত গোপনীয় এবং কঠোর অনুশাসনের শৃঙ্খলে সে মাঝে মাঝে বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়তো। ইচ্ছে হলেই ট্রেনিং থেকে বেরিয়ে সে শহরে যেতে পারতো না। অবশ্য চাকরিক্ষেত্রে এত কঠোর বাধ্যবাধকতা ছিলনা। আর্মির চাকরিতে সে যথেষ্ট দক্ষতা দেখিয়েছে, সেনাবাহিনীর নতুন নিয়মকানুনের প্রয়োগকৌশল সম্পর্কে তার মনে এতটুকু সন্দেহ ছিলনা। যুদ্ধকে সমালোচনা করবার কোনও কারণ তার মনে জাগেনি, তাছাড়া সত্যিকারের একটা বিপ্লবের উস্কানিকে দমন করবার জন্য সুন্দরভাবে যুদ্ধকে ব্যবহার করা হয়েছিল।
যুদ্ধের সময়ে সেনাবাহিনীর ফুটওয়ার্ক, মৌলিক অবস্থান, হঠাৎ জরুরি কারণে মত বদলে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়ার দ্রুততা এবং নির্ভুল গতিপথ, এই ব্যাপারগুলো চিরকাল তার কাছে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। ছুটির সময়ে যদিও নিজেকে সুরক্ষিত মনে হত তার, তবে রোজকার ড্রিল কক্ষনো বন্ধ হতনা; একজন সৈনিকের নিজেকে ফিট রাখার জন্য রোজ অনুশীলন করা প্রয়োজন। এমনকি শান্তির সময়েও কোনও বাহিনীতে রোজকার ড্রিল বন্ধ রাখা উচিত বলে সে মনে করেনা।
চাকরিতে ঢুকবার পরে গোপনীয়তা এবং কঠোর অনুশাসনের বেড়াজাল না থাকলেও তার রুটিনের কোনও হেরফের হয়নি। ড্রিল তো রোজই করতে হবে। একজন শিক্ষানবিশ এবং বাহিনীর প্রধান কমান্ডারের রুটিনে বিশেষ ফারাক নেই।
সে প্রথমে বুঝতে পারেনি যে সে নিজে নিজে ঘুরে যাচ্ছে, নাকি তাকে ঘোরানো হচ্ছে। সে বুঝতে পারলো যে তাকে ঘোরানো হচ্ছে। এখন অনেককিছু ঘটে যাচ্ছে যা সম্পূর্ণভাবে তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। তাকে ঘোরানো হচ্ছে, এটা বুঝতে পেরে বিষণ্ণ হয়ে পড়ল সে। ওরা সাবধানে তাকে বিছানা থেকে তুলে একটা স্ট্রেচারে রাখলো। প্রথমে তার মাথা একদম চিত হয়ে গেলো। সে সিলিং ছাড়া কিছুই দেখতে পাচ্ছেনা। তারপরে কে যেন মাথার নিচে বালিশ গুঁজে দিলো। হ্যাঁ, এবার সে ঘরের তৃতীয় ছবিটা দেখতে পাচ্ছে। এই ছবিটা সে আগে দেখেনি। ছবিটা দরজার কাছের দেওয়ালে ঝুলছে। সে খুশি হল ছবিটা দেখে। কারণ সে এবার এই ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকতে পারবে। নাহলে ছবিটার দুপাশে দাঁড়িয়ে থাকা ডাক্তারদের দিকে চোখ পড়তো তার। প্রধান ডাক্তার এখানে নেই। সে বোধহয় চলে গেছে। ওয়ার্ডের ডাক্তার আরেকজন তরুণ ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলছে। এই তরুণ ডাক্তারকে সে আগে দেখেনি। মোটাসোটা ছোটখাট চেহারার ওয়ার্ড ডাক্তার নিঃশব্দে তার মেডিকাল হিস্ট্রি পাঠ করছে এবং তরুণ ডাক্তারকে কী যেন বোঝাচ্ছে। ব্রেজেন বুঝতে পারছেনা ওরা কী বলছে। সে শুনতে পাচ্ছেনা ওদের কথা। ওর রাগ হচ্ছে যে ও কিচ্ছু শুনতে পাচ্ছে না। নাহ, ওরা অনেকটা দূরে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে কী যেন বলছে। অথচ বাইরের হলের সমস্ত শব্দ এখানে শোনা যাচ্ছে। একজন আহত চিৎকার করছে, কার যেন গোঙানি শোনা যাচ্ছে, বাইরে কাকে যেন বয়ে নিয়ে এসেছে গাড়িটা; গাড়ির ইঞ্জিনটা এখনও গোঁ গোঁ আওয়াজ করে চলেছে।
সে নিজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা স্ট্রেচার-বাহকের পিঠটা দেখতে পাচ্ছে। তার পেছন থেকে আরেকজন এখন বলে উঠলো, ‘নাও, চল দেখি!’
‘মালপত্র আছে তো আরও!’ সামনের লোকটা বলে উঠলো, ‘ডাক্তার বাবু!’ ওয়ার্ডের ডাক্তারকে বলে উঠলো সে, ‘মালপত্রগুলো বয়ে নিয়ে যেতে আরো লোক লাগবে।’
‘আরও লোক নিয়ে এসো!’ –
লোকদুটো বাইরে হলে বেরিয়ে গেলো। সে এখন তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে নিজের মাথা এতটুকু না নাড়িয়ে দুজন ডাক্তারের মাথার মাঝখান দিয়ে তৃতীয় ছবিটার দিকে তাকালো। অবিশ্বাস্য! এই ছবিটা এখানে কীভাবে এলো সে ভাবতে পারছে না। হয়তো কোনও স্কুলে বা উপাসনালয়ে ছিল ছবিটা, কিন্তু সে জন্মেও শোনে নি যে রোমানিয়াতে কোনও ক্যাথলিক আছে কোথাও! জার্মানিতে বেশ কিছু ক্যাথলিক আছে, সে শুনেছে। কিন্তু রোমানিয়াতে! পবিত্র মেরি মাতার একটা ছবি ঝুলছে দেওয়ালে। এও কি সম্ভব! বিরক্তিকর লাগছিল তার এই ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকতে, কিন্তু ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া তার আর কোনও উপায় নেই। ছবিতে আকাশনীল রঙের পোশাক পরা মহিলাটির মুখ-চোখ আশ্চর্যরকম গুরুগম্ভীর। তিনি পৃথিবীর গোলকের উপরে ভেসে ভেসে আকাশের দিকে চেয়ে আছেন। আকাশের গায়ে তুষারশুভ্র মেঘের ছড়াছড়ি। তার হাতে জড়ানো আছে বাদামী রঙের কাঠের তৈরি জপের মালা। এই ছবির বিষয়বস্তু কী অসহ্য ব্যাপার! ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে ভাবছিল সে। হঠাৎ সে লক্ষ্য করলো যে দুই ডাক্তার তার দিকে তাকিয়ে আছে। ডাক্তারেরা তার দৃষ্টি অনুসরণ করে একবার ছবিটির দিকে দেখলো, আরেকবার তার দিকে। তারা তার কাছে ঝুঁকে এলো। এখন এদের মাঝখান দিয়ে ছবিটির দিকে তাকিয়ে থাকা খুব মুস্কিল হয়ে পড়ল তার পক্ষে। চারটে চোখ এখন তাকে দেখছে এবং ওই অসহ্য ছবিটা দেখছে। এখন অন্য দিকে মনোযোগ ঘোরানো মুস্কিল! সে এমন একটা কিছু ভাববার চেষ্টা করতে লাগলো যাতে তার মনটা অন্যদিকে চলে যায়। সে তার চিন্তাটাকে তার জীবনের এমন একটা সময়ের দিকে নিয়ে যাবার চেষ্টা করতে লাগলো যেখানে তার ভালো ভালো স্মৃতি রয়েছে, যেখানে সে নিজের জীবন ঘিরে নিজস্ব জগত নির্মাণ করতে পেরেছিল। সেনাবাহিনীর সতীর্থ এবং অধস্তন অফিসারদের সঙ্গে কাটানো সময়, সেখানকার নানা ঘটনা, গালগল্প, কেচ্ছা এসব মনে করবার চেষ্টা করে যেতে লাগলো সে। কিন্তু সে কিছুতেই মনটাকে সেদিকে নিয়ে যেতে পারছিলো না। তার মনোযোগ এখন দুটো মাথার মাঝখানে ওই আট ইঞ্চি মত ফাঁকা অংশটায় আটকে আছে, যেখানে ওই ছবিটা ঝুলছে। তার অস্বস্তি কিছুটা কমলো, কারণ ওই আট ইঞ্চি ফাঁকটা একটু বেড়ে গেলো।
এখন মাথাদুটো একটু সরে গেছে। তবে তার খুব কাছে দুপাশে এসে দাঁড়িয়েছে দুজন। সে তাদের মুখগুলো দেখতে পাচ্ছে না, তাদের সাদা পোশাকের অংশ দেখা যাচ্ছে। সে শুনতে পেলো, ওরা বলাবলি করছে... ‘আপনি বলছেন যে তাহলে এই ক্ষত থেকে কিছু সেরকম সমস্যা নেই?’
-‘প্রশ্নই ওঠে না!’- ওয়ার্ডের ডাক্তারের কণ্ঠস্বর শোনা গেলো। কাগজের খচরমচর আওয়াজ শোনা গেলো। ওরা আবার তার মেডিকাল হিস্ট্রির ফাইলের পাতা ওলটাচ্ছে। ... ‘একদম না। মাথায় ছোট একটুখানি কাটা... তার জন্য এত বড় ব্যান্ডেজ... হাস্যকর! পাঁচ দিন আগে সেরে গিয়েছে। এখন এই যে শকের লক্ষণগুলো দেখা যাচ্ছে, তার সঙ্গে ওই ক্ষত... নাহ, এসবের কোনও সম্পর্ক নেই। আমরা এই বিষয়টাকে শক বলেই ধরে নেবো অথবা....’ - ডাক্তার হঠাৎ চুপ করে গেলেন।
-‘আপনি কী বলতে চাইছেন?’
-‘এভাবে এখানে ঠিক বলা সম্ভব নয়। তবে...’
-‘বলুন না। কী সমস্যা?’
খুবই অস্বস্তি হচ্ছিল তার, কারণ দুজন ডাক্তারই চুপ করে আছে। নীরবে সাঙ্কেতিক ইশারায় কোনও কিছু বলছে ওরা। তারপর হঠাৎ তরুণ ডাক্তারটি হাসিতে ফেটে পড়লো। তার অস্বস্তি একটু কমলো, কারণ ঠিক তখনই দুজন সৈনিক তৃতীয় একজন আহত সৈনিককে নিয়ে ঢুকলো। আহত সৈনিকটির হাত স্লিংএ ঝোলানো।
ওয়ার্ডের ডাক্তার আহত সৈনিকের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো... ‘ফাইনহালস্!’ তারপরে দুজন ভারবাহী সৈনিককে বলে উঠলো... ‘কর্নেলকে এবং তার মালপত্র সব গুছিয়ে গাড়িতে নিয়ে যাও।’
‘আপনি সিরিয়াস?’ তরুণ ডাক্তারটি বলে উঠলো ওয়ার্ডের ডাক্তারকে।
-‘ভীষণ সিরিয়াস।’
ব্রেজেন বুঝতে পারলো যে তাকে তুলে নিয়ে ঘুরিয়ে দরজার দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। মেরিমাতার ছবি তার বাঁদিক দিয়ে সরে গেলো, দেওয়ালটা একটু কাছে এলো। তারপরে লম্বা করিডোরে বেরিয়ে দেওয়ালে লাল রঙের যোগচিহ্নের মত ক্রসটা দেখতে পেলো সে। তার শরীরটা স্ট্রেচারে দুলছে। সে শুয়ে শুয়ে এগিয়ে চলেছে লম্বা করিডোরের মধ্যে দিয়ে। বাইরে উজ্জ্বল রোদ্দুর দেখা যাচ্ছে; চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে তার। পেছনে হাসপাতালের দরজাটা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে একপ্রকার নিশ্চিন্ত বোধ করতে লাগলো সে।
(চলবে)