গল্প - সমরেন্দ্র বিশ্বাস
Posted in গল্প
১
জড়ানো গলার অস্পষ্ট আওয়াজ ভেসে আসে, ‘মাগো, অ্যাখন কত রাত্তির?’
নাকে অক্সিজেনের নল। হাতে সূচ, স্যালাইন চলছে। বুকের মধ্যে ঘড় ঘড় আওয়াজের গোঙ্গানি।
বেডের নিচে একফালি সিমেন্টের মেঝে। চাদর বিছিয়ে মা জেগে আছে। মেঝের ক্লান্ত বিছানার নিশি-জাগরণ ছেড়ে উঠে এল মা। ছেলের চুলে হাত বোলাতে বোলাতে বললো, ‘ অ্যাখন অনেক রাইত, বাবা তুই ঘুমা।’
টিপ টিপ করে স্যালাইন আর গ্লুকোজ শিরা উপশিরা বেয়ে কানাইর শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।একটু আগে সিস্টার এসে মাস্ক পরিয়ে নেবুলাইজারের ধোঁয়া দিয়ে গেছে।
‘মাগো-, আমার ঘুম আসে না।... ঘুম আমারে ছাইড়্যা গেছে।... আমি বাড়ী যামু, পাখানজোরে আমারে ফিরত নিয়া চল।... ব্যথায় আমি মইরা যামু।’
‘আগে ভালো হ। তোরে পাখানজোরে ফিরত নিয়া যামুই যামু। হের লইগ্যা আমি আর বেনু এহানে থান পাইত্তা বইসসা আছি!’
হাসপাতালের সার্জারি ওয়ার্ড। সেমি আই সি ইউর চারটে বেড একটা ঘেরের মধ্যে। তার দুটো বেডে এখন কোন রোগী নেই। একটা বেডের নিচে ছেঁড়া কম্বল বিছিয়ে কানুর ছোট ভাই বেনু শুয়ে আছে, হয়তো এইমাত্র ঘুমিয়ে পড়েছে।
কানুর পাছায় দেয়া ব্যাথার ইঞ্জেকশানটা ধীরে ধীরে কাজ করছে। মা বেডের পাশে একটা টুলে বসে কানুর চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে; এই হাতের স্পর্শে লেগে আছে বিশল্যাকরণী গাছের ছায়া, কিম্বা মহুয়ার জঙ্গলের নিচে ঢাকা পড়ে থাকা আরোগ্যকামী জড়িবুটি পাতার মমতাময়ী গন্ধ।
দেখতে দেখতে কানুর শরীরে ঝিম ধরে আসে। আচ্ছন্নতা - আবার একটা আবছা ঘুম পেয়ে বসে। কানু দেখতে পায় সে তার গ্রামের পাশে কালীমন্দির রোড দিয়ে ছুটে যাচ্ছে। অনেকক্ষণ ধরে ছুটতে ছুটতে সে পৌঁছে গেছে শাল সেগুনের বনের মধ্যে। হঠাৎ যমদূতের মত চেহারার একটা মানুষ তাকে তাড়া করছে। মানুষটার হাতে গদা, মাথায় মুকুট, সুদখোর দারাশ সাহুর থোবড়াটা যমদূতের ঘাড়ে অবিকল বসানো। তার সামনে ঘুরে ঘুরে যাচ্ছে বায়োস্কোপে দেখা নরকের কতোগুলো ছবি। না, কানু এখনই যমদূতের সামনে যাবে না। সে ছুটছে। ছুটতে ছুটতে সে পৌঁছে গেছে উঁচু টিলা আর শাল সেগুনে ঘেরা যে জঙ্গল, তার কিনারে। সেখানে একটা পরিত্যক্ত বাড়ী। যমদূতের হাত এড়াতে সে লুকিয়ে পড়লো অন্ধকার বাড়ীটার পলেস্তারা খসা দেয়ালের আড়ালে। একটা সাপ খস্ খস্ করে তার পায়ের পাশ থেকে বেরিয়ে গেলো। কানু ঘাপটি মেরে পরে রইলো অনেকক্ষণ। এই দুনিয়ায়, চরাচরে কোনও শব্দ নেই। কিছুক্ষণ পরে কানু টলতে টলতে পোড়ো বাড়ী ছেড়ে বেরিয়ে এলো। যমদূত মানুষটার কর্কশ চিৎকার আর শোনা যাচ্ছে না। কানু ভালো করে নজর করে দেখল, না ভয়ংকর চেহারাটা আশেপাসে কোথাও নেই। নাকে লাগছে ওষুধের তীব্র ঘ্রাণ। তার পেটের সেলাইটা ঘন ঘন শ্বাসের ওঠা পড়ায় ধাক্কা খাচ্ছে। ঘুমের মধ্যেই কানুর মনে হতে থাকে - সে ভালো হয়ে গেছে; না, তার কোন ব্যথা নেই, কোন শ্বাস কষ্ট নেই। এই তো সে কেমন নিজের জামা নিজের প্যান্ট নিজেই পরে নিচ্ছে। এই তো তার পকেটে ড্রাইভিং লাইসেন্স, মালগুজারের ট্রাকে চালের বস্তা ভরে আক্সিলেটর দাবিয়ে সে ছুটে যাচ্ছে বম্বে হাইওয়ে ধরে। রাজনাঁদগাঁওর ধাবাতে দুই গেলাস দিশি গিলে দড়ির খাটিয়ায় চিৎপাত হয়ে যখন সে শুয়ে আছে, তখন আবার পেটের সেই অসহ্য যন্ত্রণা, আবার সেই যমদুতের মতো মানুষটা!
ঘুমের ঘোরে অসুস্থ কানু বিড় বিড় করে আওয়াজ করতে থাকে – ‘বাঁচাও! বাঁচাও! আমি মৈরা গেলাম! আমার ট্রাকটা আন্ধারে খান্দের মইধ্যে উল্টাইয়া গ্যালো!’
হাসপাতালের মেঝেতে শোয়া বেনুর ঘুম ভেঙে যায়। বেডের নিচে পাতা ছেঁড়া কম্বলের বিছানা ছেড়ে উঠে আসে। দ্যাখে মা জেগে বসে আছে।
‘দাদা! কি হৈছে?’
‘ সপনো দেখছিল।’
বেনু ডাকে, ‘দাদা! দাদা!’ কোন উত্তর আসে না। এই যন্ত্রণাময় রাতে হাসপাতালের একুশ ওয়াটের সী এফ এল বাল্বটাকে গ্রাম-পাখানজোরের হ্যরিকেনের আলোর চাইতেও কম উজ্জ্বল মনে হয়।
মা বলে, ‘ বেনু তুই ঘুমা, আমি জাগুম! কাইল তোর অনেক কাম। বাসে কৈরা গাঁয়ে যাবি, টাকা জোগাড় করন লাগবো না? অ্যাকবার যখোন আইছি, কানুরে ঘরে ফিরাইয়া লৈয়া যামুই যামু!’
২
রাজহরার ‘শহীদ হাসপাতাল’। সারি সারি রোগী। কেউ বেডে, কেউ মেঝেতে। রোগীরা মূলত আদিবাসী কিম্বা নিম্নবিত্ত মানুষ। ছোট হাসপাতাল, কিন্ত আন্তরিকতার কমতি নেই।
পাখানজোর থেকে ভানুপ্র্রতাপপুর। সেখান থেকে ট্রাক ড্রাইভারের পাশে লম্বা সীটে শুইয়ে কানুকে নিয়ে আসা হয়েছে রাজহরায়। শহীদ হাসপাতালে। কানু মানে কানাই লাল দাসকে। আলট্রা-সোনোগ্রাফি করেই ডাক্তার বলেছিল, এক্ষুনি ভিলাই-এর হাসপাতালে নিয়ে যাও, জরুরী অপারেশন করাতে হবে, - অ্যাপেনডিসাইটিস বার্স্ট করেছে!
তার পরের রাস্তা তারা পাড়ি দিয়েছে অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে। যন্ত্রণায় কাতরানো কানুকে আঁকড়ে থেকেছে মা। সঙ্গে ভাই বেনু।
এর পরে আরও পাঁচ দিন কেটে গেছে। পেট কেটে অ্যাপেনডিসাইটিস অপারেশন হয়ে গেছে ভিলাইয়ের হাসপাতালে। ধার দেনা করে এই কদিনে বিস্তর টাকা খরচ হয়ে গেছে। আরও কিছু টাকা জোগাড় না হলে নয়, বিনু মোবাইলে ফোনের পর ফোন করতে থাকে – কোথায় টাকা পাওয়া যাবে?
মা একটা গ্লাসে ডাবের জল ঢালছে। কানুর মুখে জল তুলে দিতে দিতে বলল, ‘অ্যাতো চিন্তা করন লাগবো না, সব ঠিক হইয়া যাইবো।’
বেনু দিশাহীন ভাবে হাত নাড়তে নাড়তে বলল, ‘অ্যাহন পরযন্ত তিস্ হাজার টাকা শ্যাষ হইয়া গেছে। কার কাছে যামু? কে ধার দেবে, কিছুই বুইঝা উঠতে পারি না।’
‘ক্যান? বাড়ির সাম্নের উঠানটারে আধা আধি বন্দক দিবি। খতে বাপের সই লইয়া লক্ষি সেনের ধারে যাবি। নিচ্চয়ই টাকা ধার পাবি ...!’
অ্যাপেনডিসাইটিসের অপারেশনটা ঠিক ঠাক হয়ে গেলেও বুকে বড়সড় ইনফেকশন হয়েছে। ‘মাগো, আমি মইরা যামু।’ কানুর নিঃশ্বাস নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে।
বেনু ডেকে নিয়ে আসে ডাক্তার জাভেদকে; সিস্টার এসে একটা ইনজেকশন দিলো, নেবুলাইজারের ঘন ধোঁয়া নাক দিয়ে ফুসফুসে ঢুকতে থাকে। কানু একটু একটু করে ঝিমিয়ে পড়ে। সিস্টার ওষুধ আর ইনজেকশনের একটা লম্বা লিস্ট ধরিয়ে দেয় বেনুর হাতে। বাইরের দোকান থেকে ওষুধ কিনে নিয়ে আসতে হবে।
হাসপাতালের ছোট্ট বেডেটার চার দিক ঘিরে একটা অঘোষিত ছোট্ট যুদ্ধক্ষেত্র তৈরি হয়ে আছে। যুদ্ধক্ষেত্রে আক্রান্ত মূল চরিত্রটি কানু। ধরাশায়ী সৈনিক। বিপন্ন তার অস্ত্বিত্ব! ভাই বেনু আহত কম্যান্ডারের মত তার মোবাইলটাকে দূরবীন কিম্বা রিমোটের মতো ব্যবহার করে বুঝে নিতে চাইছে শত্রুপক্ষের আক্রমন অথবা হাতে টাকা-না-থাকার আঘাত কোন দিক থেকে আসবে। বয়সের অভিজ্ঞতাটা কম হলেও জীবনের নানা ঘাত প্রতিঘাত বেনুকে সতর্ক করে দিয়েছে। যুদ্ধক্ষেত্রের তৃতীয় চরিত্রটি পাখানজোরের মা – সাক্ষাৎ মা ভবানী – মাথায় চিপচিপে সর্ষের তেল, পরনে সাদামাটা লাল শাড়ী, কপালে সিঁদুরের বড় ফোঁটা, দুই হাতেই মলিন শাঁখা। শীর্ণকায় চেহারা, অথচ তার দশ হাতে দশটা অস্ত্র, যা কোন ভগবান কিম্বা স্বর্গবাসী ইন্দ্রের দেয়া নয়, যা সে নিজেই খুঁজে পেয়েছে সন্তানের প্রতি স্বাভাবিক মায়ের মমতায়, যা সে খুঁজে পেয়েছে আজীবনের দারিদ্রের মধ্যে। মা নিজের পরাণ দিয়ে জানে, নিজের ছাওয়ালটারে ব্যারামছাড়া করেই সে ছুটি পাবে এই যুদ্ধক্ষেত্র থেকে, ফিরে যাবে তার নিজের গ্রাম পাখানজোরে।
৩
সেসব আজ থেকে অনেক কাল আগের কথা, পঞ্চাশ বছর তো হবেই। পূর্ব বাংলা থেকে পিল পিল করে উদ্বাস্তুরা আসছে। পুনর্বাসনের নামে তাদের পাঠানো হচ্ছে দন্ডকারণ্যের ধুসর জমিতে। কেন্দ্রের সরকারী সহায়তায় তৈরী হয়েছে দন্ডকারণ্য ডেভেলপমেন্ট অথরিটি।
পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্ত পেরিয়ে বনগাঁ। কানুর মার পূর্বপুরুষেরা আরও অনেকের মতো অনিশ্চিতের হাত ধরে ঢুকে পড়ে এ দেশে। পশ্চিমবঙ্গের নাভিমূল শিয়ালদহ স্টেশন ভরে যায় উদ্বাস্তুতে, এসব অনেকদিন আগেকার ইতিহাসের ছেঁড়া পাতা। এদিক ওদিক ধাক্কা খেতে খেতে তাদের পূর্বপুরুষেরা কিছু দিন থেকে যায় কলিকাতার কাছেই কোন এক সোদপুরে। গড়াতে গড়াতে পরবর্তী সময়ে তারা চলে আসে কোন্ডাগাঁও, মধ্যপ্রদেশে। এসবও শোনা গল্প। কানুর মা তখন তার মায়ের গর্ভে। তারও পরে সরকারী উদ্যোগে সেখান থেকে মধ্যপ্রদেশেরই রিফিউজি কলোনী পাখানজোরে।
কানুর মা পাখানজোরেই বড় হয়েছে - এখানেই তার শৈশব কেটেছে। আরও পাঁচটা উদ্বাস্তু ঘরের মেয়ের মতো বারোয়ারী চাপা-কলে জল টিপতে টিপতেই তারও যৌবন এসেছে। বয়সকালে বিয়ে হয়েছে তাদের মতই উদ্বাস্তু এক দরিদ্র পরিবারে। তার স্বামী মদনমোহন দাস – এক খেয়ালি মানুষ। কোন নিশ্চিত কাজকর্ম নেই। এদিক ওদিকে চাষিদের থেকে আলু কেনে, পুরনোবাজারে চট পেতে বসে আলু বেচে। কবে আলু বেচেতে বাজারে বসবে, কবে বসবে না তার কোনও ঠিকানা নেই। কোন দিন যদি কাজে যায়, সে তো ভগবানের ভাগ্য! এসব মদনমোহনের নিজের নিয়মেই চলে। পৃথিবীর কোন বাধা ধরা নিয়ম কানুন তার ক্ষেত্রে খাটে না। এখন মদনমোহন না খেয়ে ঘরে শুয়ে আছে, নাকি ছেলে হাসপাতালে - এসব ভেবে কিছু টাকা কড়ি জোগাড়ের চেষ্টা করছে, তা কানুর মা আন্দাজ করতে পারে না। মদনমোহনের এক বোন ভেগে গিয়ে বিয়ে করেছে এক পাঞ্জাবি ছোকরার সঙ্গে। তার এক দেওর, মদনমোহনের ছোট ভাই, সর্বহারার রাজনৈতিক দলে নাম লিখিয়েছে, সে ঘর ছাড়া প্রায় ত্রিশ বছর হোল, তার কোন ঠিকানা নেই। কানুর মার একটি মেয়ে জ্বরে ভুগে মরে গেছে এক বছর বয়সে, বেঁচে আছে দুই ছেলে কানু আর বেনু। ছোট ছেলে বেনু প্রায় প্রতিদিনই সকাল সকাল কোদাল ঝুড়ি নিয়ে চাষের কাজে যায়, কখনও জোগালির কাজ করে, যখন যা মেলে। যখন এসব চাষের কাজ থাকে না, বেনু যায় শহরে, ব্যবসায়ীরা মাল আনে, তাদের মোট বইতে, কখন মালিকের সঙ্গী হয়ে - দু পয়সা ঘরে আসে। তাছাড়া আছে কানুর ড্রাইভারি, লরী বা ট্রাক নিয়ে বেরোয়, কখনো কখনো দু তিন দিন বাদে ঘরে ফেরে। কচিৎ কখনো পাল্লায় পড়ে দারু গিলে আসে, মাতলামিতে ঘরের সবাইকে অস্তির করে তোলে। পাড়া প্রতিবেশীরা সামাল দিতে হাজির হয়। এই হচ্ছে দশভুজা কানুর মার সংসার।
তবুও মা মরণাপন্ন ছাওয়ালটাকে ভালো করে তার ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। তাদের মুলি বাঁশের বেড়া, টালি ছাওয়া বাড়ী। বারোয়ারী জলের কলে ভিড়, খাই-খিস্তি। এই হাসপাতালে বসেও ক্লান্তি মাখা ঘুম ঘুম চোখে কানুর মা শুনতে পায় পাখানজোরের দুপুর বেলায় বাগানের গাছে গাছে পাখিদের কিচির মিচির, দেখতে পায় তাদের বেড়ার ঘরের ভেতরে ছড়ানো ছিটানো টুকিটাকি, তাদের অবুঝ -সবুজ ঘর গেরস্থালী।
৪
পরদিন সকালে কানুর অবস্থার বাড়াবাড়ি হোল। সিনিয়র ডাক্তার এল। সঙ্গে চেস্টের ডাক্তার। তাছাড়া দুজন পুরনো মুখ, তাদের চেনা দুজন ডি এন বি শিক্ষার্থী ডাক্তা্রও। ছিল সিস্টারাও। স্টেথোস্কোপ কান থেকে নামিয়ে সিনিয়র ডাক্তার ভ্রু কোচকালো। - ‘এক্ষুনি আই সি ইউ তে শিফট করতে হবে, ... পেশেন্টকে বল পাঁচ হাজার জমা করবে।’
এদিকে ট্যাঁক খালি। বিনুর পকেট তলানিতে ঠেকেছে।
‘টাহা অ্যাহনি হাতে নাই, শিগ্ গিরি জোগাড় কইরা দিমু।’ আরেকবার কানুর মার দুচোখ বেয়ে দরদর করে জল গড়িয়ে পরলো।
হাসপাতালের স্টাফরা একটা চাক্কায়ালা বেড নিয়ে এলো। নাকের পাইপ, মেডিকেল সাজ সরঞ্জাম সহ কানুকে চালান করা হোল আই সি ইউর গহন চিকিৎসার আলো অন্ধকার কামরায়।
মায়ের দুচোখের জল আর বিনুর হতবুদ্ধি ভাব পোস্ট গ্রাজুয়েটের ট্রেনিং করতে আসা ডাক্তার দুজনের নজর এড়ায় নি। তা ছাড়া জুনিয়র ডাক্তারেরা এই কদিন খুব কাছে থেকে গ্রামের এই গরীব মানুষ তিনটেকে দেখছে। ডাক্তার জাভেদ, ডাক্তার অনুপম মেডিক্যাল সার্ভিসের নুতন পাঠে মায়ের চোখের জলের অসহায় ভাষা পড়ে বুঝে নিতে চেষ্টা করলো – এই দুনিয়াতে মা বা ভাইয়ের স্নেহ, তাদের মায়া মমতাই একমাত্র বাঁচার জন্য যথেষ্ট নয়। শুধু ডাক্তারি জ্ঞান, টেকনোলজিক্যাল সেট আপ হলেই যে মানুষ বেঁচে থাকতে পারবে তারও কোনও গ্যারান্টি নেই – গরীব মানুষের বেঁচে থাকার জন্যে চাই যথেষ্ট টাকা! সদ্য এম বি বি এস পাশ করা ওদের কোমল মন দুটোও মায়ের চোখের জলের সঙ্গে আর্দ্রতায় নমনীয় হয়ে উঠলো।
জাভেদ বললো, ‘আম্মা, ডোন্ট ওরি, আমরাও চাঁদা তুলে কিছু পয়সার ব্যবস্থা করছি; দ্যাখো তোমরা কতোটা জোগাড় করতে পার।’
৫
আই সি ইউ তে কানুর লড়াই চলছে। ভেন্টিলেটর লেগেছে। অ্যাপেন্ডিসের অপারেশনের ধাক্কা সামলে ওঠার আগেই বুকের সংক্রমন জবাব দিতে বসেছে।
আই সি ইউর ভেতরে রোগী, আই সি ইউর বাইরে ওয়েটিং রুম। সেখানে বসে আছে রোগীদের আত্মীয় পরিজন; বসে আছে কানুর মা। বিনু গ্রাম থেকে আরও সাত হাজার টাকা ধার করে এনেছে। আরো আরো টাকা চাই। কোথ্থেকে এতো খরচ জোগাড় হবে?
মদন মোহন দাস, কানুর বাবা ও আলু বেচা যার পেশা, সে এই প্রথম বার ভিলাইর হাসপাতালে এসেছে। একটা ভাঙাচোরা শুকনো কাঠ খোট্টা গাছের মতো নির্বিকার মানুষটা হাসপাতালের ওয়েটিং হলে হাড় বের করা চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এখন আলুর ব্যাবসার সিজন নয়। তবু মানুষটা হয়ত আলু আর টাকার মধ্যে একটা যোগসূত্র নিয়েই ভাবছে, হয়ত ভাবছে টাকার চাষটা আলুর মতো কেন হয় না! একটা টাকাকে কুচো কুচো করে ছিঁড়ে মাটির নিচে গুজে দেবে, তাতে থোকা থোকা আলুর মতো কত নতুন নতুন টাকার নোট গজাবে। এমনটি যদি হতো, কারোর কোনও কষ্ট থাকতো না!
জাভেদ এই রোগীর চিকিৎসাতে ডাক্তারি করা ছাড়াও আরো কিছু করেছে। বন্ধু বান্ধব, পরিচিত- অল্প পরিচিতদের কাছে অ্যাপ্রোচ করে ছ-সাত হাজার টাকা জোগাড় করে ফেলেছে। অন্য ডাক্তারদের ধরে ফ্রিতে স্যাম্পেল ওষুধ জোগাড় করে দিয়েছে। ডাক্তার অনুপমও একাজে জাভেদের সঙ্গী। সে কলেজের সক্রিয় ছাত্র আন্দোলনে ছিল। জাভেদ তামিলনাড়ুর এক দরিদ্র পরিবারের সন্তান। শেষ পর্যন্ত ওরা দুজন ডাক্তারই এখানকার সম্ভ্রান্ত রোগীদের স্বজনদের কাছে গেছে। কেউ এড়িয়ে গেছে, কেউ কেউ সাধ্য মত পয়সা তুলে দিয়েছে পাখানজোরের কানুর জন্য।
মিস্টার চক্রবর্তী এখানকার কারখানার অফিসার, আপাতত সার্জারি ওয়ার্ডে ভর্তি। তার স্ত্রী, সমাজসেবী, মিসেস চক্রবর্তী কানুর সাহায্য বাবদ চার হাজার টাকা তুলে দিল। দিতে দিতে জাভেদকে হেসে হেসে বলল, ‘ডাক্তার! আরও দশ পনের বছর বাদে, তোমরা তখন আরও বড় ডাক্তার হবে, বড় চেম্বারে বসবে, অনেক টাকা পয়সা থাকবে, হয়ত লাখ টাকার বি এম ডবলু গাড়ী নিয়ে ঘুরে বেড়াবে। তখন কি তোমাদের এ দিন গুলোর কথা, এই সমস্ত গরীবদের কথা মনে থাকবে?’
ডাক্তার জাভেদর মুখে লজ্জিত ম্লান হাসি - ‘জানি না আন্টি!’
টাকা হাতে পেয়ে কানুর মা মিসেস চক্রবর্তী ও উপস্থিত লোকজনদের দুহাত তুলে নমস্কার করে বলল, ‘ভগোবান আপনাগো ভালো করুন। আমি পোলাটারে ভালয় ভালয় ফিরায়ে নিয়া যাইতে পারুম? কে জানে? ’
৬
ভাঙা মানুষেরা ভেঙে যেতে যেতেও খাড়া হয়ে দাঁড়ায়। শূন্য থেকেও প্রচুর জীবনী শক্তি কুঁড়িয়ে পায়। অন্তত ভাঙা জীবনের ইতিকথা তাই বলে।
কানু বেঁচে উঠেছে। অনেকটা সুস্থ। অপারেশনের ঘা পুরো শুকোয় নি। শরীর ভীষণ দুর্বল। ওরা হাসপাতাল থেকে এক তরফা জোর করেই ছুটি নিয়ে ফিরে যাচ্ছে নিজেদের গ্রামে। এক এক দিন হাসপাতালে থাকা মানেই অনেক অনেক টাকা। ধার অনেক হয়েছে, আর কত ধার করবে ; সাহায্য অনেক পেয়েছে, আর কার কাছেই বা সাহায্যের হাত পাতবে? হাসপাতালের ডাক্তাররা বলেছিল আরও কয়েকটা দিন থেকে যেতে।
যাবার সময় ডাক্তার জাভেদ মায়ের হাতে ধরিয়ে দিল কিছু বিনা পয়সায় জোগাড় হওয়া অ্যান্টিবায়টিক আর ওষুধ – যা প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী খেয়ে যেতে হবে। ডাক্তার জাভেদ আর অনুপম দুজনেই ওদের মনে করিয়ে দিল, ‘দশ দিন বাদে চেক আপ করানোর জন্য হাসপাতালে নিয়ে এসো। শুক্রবার আউট ডোরে। ফলো আপ মাস্ট, যেন ভুল না হয়!’
মা কি জগতজননী? কৃতজ্ঞতা মেশানো দৃষ্টি, দু চোখে যাবতীয় ক্লান্তি মিশিয়ে কানুর মা বলতে থাকে, ‘নিচ্চয় আসুম। আর আপ্নাগো উপকারের কথা জনমভর ভুলুম না! ’
পাঁচতলা হাসপাতালের বিশাল অট্টালিকার চত্বর দিয়ে বেরিয়ে আসতে আসতে অতি দুর্বল কানাই আরেকবার হাসপাতালের ছায়াটাকে দেখে নেয়। এই সেই ছায়া, এই সেই হাসপাতাল, এখানকার কিছু সহৃদয় মানুষজনের জন্য সে আবার এই মাটির উপর হাঁটছে, ফিরে যাচ্ছে গ্রামে। তারা উঠে বসে অটোরিক্সায়।
অটোরিক্সা চলতে শুরু করে। কানুর চোখ বন্ধ হয়ে আসে। হাজার কোটি টাকার এই হসপিটাল, এই সাজানো গোছান ভিলাই শহরের সংগে পাখানজোরের গরীব কানুর দূরত্ব ক্রমশই বাড়তে থাকে। যে দূরত্বটা আগে থেকেই নির্দিষ্ট ছিল। শহীদ হাসপাতালের পরামর্শ আর মায়ের মনের অসম্ভব জোরে এই দূরত্ব ভেঙ্গে কানু ভিলাই পৌঁছেছিল দিনকয়েক আগে। অটোরিক্সা দূরে এগোতেই সেই দূরত্বটা ধীরে ধীরে আবার বাড়তে শুরু করেছে।
কানুর বন্ধ হয়ে আসা চোখে দিনের অন্ধকার নেমে আসে। গ্রাম আর শহরের, থাকা আর না-থাকার, টাকা আর না-টাকার মধ্যকার দূরত্ব খণ্ড খণ্ড মেঘের মত সূর্যটাকে ঢেকে দেয়। কানুর দুর্বল শরীরে অসংখ্য নক্ষত্র খচিত রাত্রির অগম্য ছায়াপথ নেমে আসে। দেখতে পায়, সে তার ঘরের দাওয়ায় বসে অমাবস্যার গভীর অন্ধকারে আকাশের ছায়াপথের দিকে তাকিয়ে আছে। কানুর নাকে ভেসে আসে গ্রামের মাটির সোঁদাসোঁদা সুবাস, ট্রাক ড্রাইভারের উত্তপ্ত কেবিনের ডিজেল পোড়া গন্ধ, হাসপাতালের অ্যান্টিসেপ্টিক ওষুধের ঘ্রাণ। কেন জানি না কানুর মনে হয়, চেকআপ করানোর জন্য ভিলাইর হাসপাতালে তাদের আবার ফেরত আসা নাও হতে পারে। অনেক খরচ। সে জানে না ছায়াপথের দীর্ঘ অন্ধকার কি করে পেরোতে হয়?
রাজহরা, ভানুপ্রতাপপুর পেরিয়ে যায়। দুপাশে ঘন জঙ্গলের সারি। নির্জন রাস্তা। একসময় পাখানজোরের রাস্তায় বাস থামে। মা জিগ্যেস করে, ‘ব্যথাটা বারতেছে বুঝি? এট্টু জল খা। ভালো লাগবো।’
কানুর চোখ খোলা। পা কাঁপে। বেনুকে ভর করে হাঁটে, বুক তার ক্ষীণকায়, ধুক পুক করে – যেন এখনও আই সি ইউর ভেন্টিলেটর কানুর বুকে হাওয়া সাপ্লাই দিচ্ছে। মনে পড়ে ডাক্তার জাভেদের মুখ।
‘তরে ফিরাইয়া লইয়া আইছি!’ - যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে নিষ্ক্রান্ত, ধ্বস্ত-বিধ্বস্ত, ট্যাঁক শূন্য, আপতত অস্ত্রহীন, অথচ প্রত্যাশাময়ী মা’র চোখ দিয়ে এখন জল গড়াছে। -‘আবার দশ দিন বাদে ভিলাইএর হাসপাতালে তোরে চেকাপের লাইগ্যা লইয়া যামু।’
শেষ পর্যন্ত দশ দিন বাদে ফলো-আপ চিকিৎসার জন্য তাদের আর ভিলাই এর হাসপাতালে যাওয়া হয়ে ওঠে না। ভবিষ্যতে আর কোন দিনই কানু হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ফিরে আসে না।
এদিকে পাখানজোরের মায়ের চোখের জলের উৎস শেষ হয়ে গেছে। জননীর চোখের সবটুকু জল জ্বলন্ত কাঠে পুড়ে পুড়ে অঙ্গারের আঁচে বাষ্প হয়ে উড়ে গেছে কানুহীন পাখানজোরের কৃষ্ণকায় আকাশে!