Next
Previous
12

গল্প - অচিন্ত্য দাস

Posted in






কলেজ পাশ করে চাকরি খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে চায়ের দোকানে যখন একদিন বসে ভাবছি ‘পরবর্তী পদক্ষেপ’ কী নেওয়া যায়, পকেটে রাখা ফোন বেজে উঠল। উফ, একেই বলে ভাগ্য! চাকরির ফোন। তাও আবার স্বয়ং এম ডি ফোন করেছেন। ঢুকেই ম্যানেজারের পদ, কোলকাতার বাইরে এক প্রাইভেট ফার্মে।

ফোন করেছিলেন সত্যেন কাকা, আমার খুড়তুতো কাকা হন, বারাসাতে থাকেন। বললেন, “মধুপুরে আমার যে যাত্রীনিবাস মানে হোটেলটা আছে তার ম্যানেজার কাজ ছেড়ে দিয়েছে। তুই করবি? মাইনে বেশি দিতে পারব না কিন্তু অভিজ্ঞতা তো হবে …”


দেরি না করে তিন দিনের মধ্যে মধুপুর গিয়ে ‘কার্যভার গ্রহণ’ করলাম। ছোট হোটেল, দোতলা বাড়িতে গোটা আটেক ঘর আছে। দোতলার সামনেটা জুড়ে বেশ চওড়া বারান্দা। সামনে একটু ঘাস, আগাছা আর দু-চারটে কলাবতী ফুলের গাছ নিয়ে একখানা বাগানও আছে। এই অঞ্চলের মোটামুটি চালু হোটেল, সস্তা আর রাস্তার কাছে বলে বোধ হয়।

ওরে বাবা! হোটেল চালাতে তো দেখছি মেলা হ্যাপা! খাটনি আছে তাছাড়া সবকিছু চোখে চোখে রাখতে হয়। মাস খানেক লেগে গেল কাজটা ঠিক করে বুঝতে।

তারপর একদিন সত্যেন কাকার ফোন এলো। ভূমিকা ছাড়াই বললেন, “যা খবর পেলাম তাতে মনে হচ্ছে তুই কাজটা ধরে নিয়েছিস। ভালো। এ মাস থেকে তোর মাইনে একটু বাড়িয়ে দিলাম।”

আমি তো আল্হাদে আটখানা। এক মাসেই এম ডি মাইনে বাড়িয়ে দিলেন!!

সত্যেন কাকা তখনো ফোন কাটেননি। বললেন, “আর শোন, এই ধরনের কাজে ‘সফ্ট স্কিল’ খুব দরকার। সেটা তোর কম, তোকে শিখতে হবে।”

“কী স্কিল বললে?”

“সফ্ট। মানে অতিথিদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করবি যেন ওদেরই হোটেল। যা চাইবে তাতে কখনো না বলবি না কিন্তু তার মানে এই নয় যে সব করতে হবে। হ্যাঁ, যতটা সম্ভব ততটা করিস।এতে অতিথিরা বারবার ফিরে আসে। বুঝলি তো ব্যাপারটা।”

কথাটা বুঝলাম। এও বুঝলাম হোটেল চালাতে গেলে এ না হলেই নয়। নিজেকে ‘তরু হতে যে বা হয় সহিষ্ণু’ ধরনের হতে হবে। নিজেকে এই দিকে যতটা পারি পাল্টে নেবার চেষ্টা করলাম, খানিকটা পারলাম বলেই মনে হয়। যেমন সেদিন দুপুরের দিকে এক বয়স্ক স্বামী-স্ত্রী এলেন। ভদ্রলোক আমাকে দেখে যেন একটু অবাক হলেন। স্ত্রীকে বললেন, “নতুন লোক।”

বললাম. “হ্যাঁ স্যার। আমি এই মাস দুয়েক জয়েন করেছি। কতদিন থাকবেন স্যার … ডবল বেড …”

“ভাড়া আমি জানি, বাড়াওনি তো আবার? তাহলে অন্য হোটেল দেখবো। এই নিয়ে তিনবার এলাম।”

ভদ্রলোক আধার কার্ড বাড়িয়ে দিলেন। নাম দেখলাম সুশীতল বসু। একতলার একটা ঘর দিচ্ছি বলতে উনি আপত্তি করে উঠলেন। “না রে বাবা, আমার দোতলার ঘর চাই। তোমাদের হোটেলের ওই দোতলার বারান্দাটাই তো আসল, বসে বসেই সময় কেটে যায়।”

কাকার কথা মনে পড়ে গেল। খুব বিনীত ভাবে বললাম, “আজ তো খালি নেই স্যার, কিন্তু কাল খালি হচ্ছে। তখন আপনারা ওটা নেবেন। আর বারান্দা? আজকে বিকেলের চা টা স্যার নয় দোতলার বারান্দায় বসেই খাবেন, ব্যবস্থা করে দেবো।”

রাজি হয়ে গেলেন।

মার্কামারা পাতি বাঙ্গালি মধ্যবিত্ত পরিবার। অন্য জায়গায় কি এত খাতির পেতেন এনারা? এই যে খাতির করছি এটা আমার সদ্য শেখা ‘সফ্ট স্কিল’!

বিকেলে একবার দোতলায় দেখে আসতে গেলাম। বেতের চেয়ারে বসেছেন দুজনে। মহিলার গলা সিঁড়ি থেকেই কানে আসছিল। “বিস্কুটগুলো বড় মিষ্টি, একটাই খাবে। আর এবার থেকে চায়ে চিনি কম করো নয় বাদ দাও। সুগার তো বেশ বেড়েছে।”

“আরে ছাড়ো তোমার সুগার। এখন বাইরেটা দেখ কী সুন্দর। চল, চা-টা খেয়ে বেরোই।”

“ঠাণ্ডা পড়ছে। দুপুরের দিক ছাড়া বেরোনো যাবে না।”

“দুপুরে কি সূর্যাস্ত দেখা যায়!”

“ঠাণ্ডার মধ্যে সূর্যাস্ত দেখবে তো মাফলারটা আনলে না কেন? আলমারি থেকে বারও করে দিলাম, তাও ছেড়ে এলে। এত ভুলোমন...”

“এক কাজ করি, কাল সকালে একটা মাফলার কিনে নিই।”

“আবার নতুন মাফলার! এবার এর মধ্যেই কত খরচ হয়ে গেছে জানো? কুলিই তো নিল দেড়শ।”

আমি এসে দাঁড়িয়েছি দেখে সুশীতলবাবু বললেন, “সময় আছে? একটু বোস না এখানে…”

বসলাম। উনি বললেন, “ভাই, এখানে জমির কীরকম দাম চলছে জানো কি? জায়গাটা এত ভালো লাগে, মনে হয় একটা ছোট্ট বাড়ি করে …”

“আজ্ঞে স্যার, আমি তো এখানে নতুন। খোঁজ নিয়ে বলতে পারি … রাস্তার ধারে দাম শুনেছি খুব বেড়ে গেছে…”

“তবু?”

“ঠিক জানি না তবে চল্লিশ-পঞ্চাশ হাজার কাঠা …”

“ওরে বাবা, অত! না, না রাস্তার ধারে নয় আমার ওই পাহাড়ের দিকটায় হলেই হবে …”

উঠে আসতে আসতে শুনলাম মহিলা একচোট নিচ্ছেন স্বামীর ওপরে। “ভীমরতি ধরেছে, এইখানে জমি কিনবে! মুরোদ তো পেনসনের ওই টাকা কটা। শুভার বিয়েতে তো পভিডেন শেষই হয়ে গেল! এসব একদম মাথায় আনবে না …”

দিন দুয়েক পর সন্ধেবেলায় আপিসে বসে আছি। উনি, মানে সুশীতলবাবু ঢুকলেন। “বসব এখানে?”

কদিন দেখছি এই ভদ্রলোক আমকে বন্ধুর মতো ভাবতে শুরু করেছেন। বললাম, “হ্যাঁ হ্যাঁ, বসুন না”

“ওই সেদিনের কথাটাই বলতে এলাম। আসলে উর্মি আপত্তি করে কারণ আমাদের তো তেমন পয়সা কড়ি নেই। তবু কি জান ভাই, কোলকাতায় আর থাকতে ভালো লাগে না, তাই খরচাপাতি হলেও এখানে বারবার চলে আসি। ছোট দোতলা বাড়ি আমাদের। ছেলে থাকে পরিবার নিয়ে নিচের তলায়, ওপরের ঘরটায় আমরা। একে ঘিঞ্জি এলাকা তার ওপর বাড়ির পেছনে একটা ক্লাব হয়েছে। ওদের তো বারো মাসে ছত্রিশ পার্বণ। এই পুজো সেই পুজো এই দিবস সেই দিবস - টানা মাইক চলতে থাকে। যেদিন ওসব থাকে না সেদিন হয় রক্তদান শিবির নয় ছোটদের যোগ-ব্যায়াম প্রতিযোগিতা। মাইকে ‘ঘোষণা’শুরু হয়ে যায় সকাল থেকে। আর সামনের রাস্তায় আজকাল অটোর রুট হয়েছে। অটোওলারা খুচরো ফেরৎ দিতে চায় না, তার ওপর ডাকাডাকি ছোটাছুটি - সারাদিন হৈহৈ চেঁচামিচি।

এই জায়গাটা এত ভালো লাগে … ওই পাহাড়ের গা দিয়ে একটা জঙ্গুলে পায়ে চলা রাস্তা উঠে গেছে। সকালে গিয়েছিলাম ... কী যে সুন্দর।“

“হ্যাঁ, ওই গ্রামের লোকেরা আসা-যাওয়া করে। আদিবাসী মেয়েরা কাঠ কুড়োতে যায়।”

“হে হে এই হল ‘বনপথ’। কি হে, সময় নিচ্ছি বলে রাগ করছ না তো! তোমাদের সময়কার নয়, সে আমদের সময় একটা গান ছিল ‘দূর বনপথে ছায়াতে আলোতে/ ঝরানো পাতার ছন্দ বাজে কার পায়ে পায়ে….’ খুব সুন্দর গানটা। সেই রকমই বনপথ এটা। ওর কাছাকাছি যদি ছোট একটা বাড়ি করে থাকতে পারতাম! হ্যাঁ, তোমাদের হোটেলের বারান্দাটা বড় ভালো, বসে বসে কত দূর অবধি দেখতে পাই...”

“আপনার ভালো লাগে সেটা তো আমাদের গর্ব। আপনারা খুশি হলেই আমরাও খুশি।” নিজের ‘সফ্ট স্কিল’ এর প্রয়োগ দেখে আমি নিজেই খুশি!

“তোমাকে বলি ভাই। আমার একটা ইচ্ছে আছে। স্বপ্নও বলতে পারো – ওই দূরের দিকটায়, এই ধর দেড়-দু কাঠার ওপর হলেই চলে, একটা ঘর যদি বানাতে পারতাম! ছাদ ঢালাই না করে টালির ও করা যায়, খরচা কম। সামনে বাগানের জন্য একটু জায়গা ছেড়ে দিতাম। দিনভর পাহাড় আর বন চোখের সামনে থাকত! কখনো সখনো হয়তো মেঠো বনপথ দিয়ে হেঁটে চলে যেতাম অনেকটা …”

আমি কিছু না বলে মানুষটিকে দেখতে লাগলাম। এনার যা সংগতি তাতে এসব আকাশকুসুম স্বপ্নের কোনো মানে হয় নাকি। ইনি কি তা বোঝেন না? বোঝেন ঠিকই তবু স্বপ্নটুকু নিয়ে নাড়াচাড়া করতে ভালবাসেন।

“তুমি যদি একটু খোঁজ-খবর নিয়ে রাখো। ভাবছি এ বছরই আর একবার আসব।”


বেশ কিছু দিন হয়ে গেছে, বছরও ঘুরে গেল, ওনারা আসেননি। আমিও প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম আর ওসব জমির খোঁজ-খবর, বলাই বাহুল্য, নিইনি।


একদিন সকালের দিকে আমদের হোটেলের সামনের ডেস্কে যে বসে সে এসে বলল কে যেন আমার খোঁজ করছেন। গেলাম। বছর চল্লিশের একজন, আমি চিনতে পারলাম না।

“আমার বাবা-মা অনেকবার আপনাদের হোটেলে এসে থেকেছেন। আমি সুশীতলবাবুর ছেলে।”

“সুশীতল বসু?” আমার মনে পড়ে গেল, চাকরির প্রথম দিকের ব্যাপার তো।

“হ্যাঁ। উনি গত মাসে মারা গেছেন। মা আমাকে আপনার কাছে পাঠালেন।”

“ওহ, দুঃখিত। বলুন আমি কী করতে পারি।”

“আসলে ওনারা এই জায়গাটা খুব ভালোবাসতেন, বিশেষ করে বাবা। শুনেছি আপনাদের এখানে দোতলার বারান্দায় বাবা বসে থাকতে খুব পছন্দ করতেন। সকাল বিকেল নাকি বারান্দায় বসে কাটিয়ে দিতেন। ওই মা বলছিলেন আর কি।”

“ঠিকই বলেছেন, আমার বেশ মনে আছে।”

“মা আপনাকে একটা অনুরোধ করেছেন, যদি আপনি রাজি থাকেন …”

আমি একটু সতর্ক হয়ে গেলাম। কাকার কথা মনে পড়ল। অনুরোধ রাখলে অতিথি আবার ফিরে আসেন। কিন্তু উনি তো মার গেছেন, তাহলে?। যাক গে শুনি তো ব্যাপারটা কী।

যে অনুরোধটা এলো সেটা কিন্তু আমি আন্দাজ করিনি।

“মা বলছিলেন, বারান্দাটা বাবার কতখানি প্রিয় ছিল আর উনি ওখানে বসে দূরে পাহাড় জঙ্গলের দিকে দেখতেন। ওনার আবার একটা ছোট বাড়ি করে থাকারও ইচ্ছে হয়েছিল – ওই স্বপ্ন আর কি। তা অবশ্য হয়ে ওঠার কোনো প্রশ্নই ছিল না। তাই মা বললেন ওনার একটা ছবি যদি ওই দোতলার বারন্দায় টাঙিয়ে রাখা যেত… বড় ছবি নয়…”

একফুট বাই দেড়ফুট মতো কাচে ফ্রেম করা ছবি ব্যাগ থেকে বার হলো। হ্যাঁ, চিনতে পারলাম। সুশীতলবাবু।

কি করা উচিত? হোটেলে কি এরকম ছবি রাখা যায়? তবে কেন জানি না ছবিটা দেখে আমার মনটা যেন একটু নরম হয়ে গিয়েছিল। ভাবলাম একটা তো পেরেকের ব্যাপার, ওনার স্ত্রী যখন বলে পাঠিয়েছেন তখন থাক না বারান্দার দেয়ালে।

বললাম, “ঠিক আছে, রেখে যান। আমি সুবিধে মত দেয়ালে লাগিয়ে দেবো”


বিকেলে ছবিটা টাঙিয়ে চলে যাচ্ছিলাম কিন্তু কাচের ভেতর থেকে সুশীতলবাবুর দৃষ্টিটা যেন আমাকে আটকে রাখল। সেই ‘দূর বনপথের’ দিকে তাকিয়ে আছেন অপলক। এ জীবনে যা হলো না তাই হয়তো দেখছেন সেখানে। একটা লাল টালির ছাদওলা ঘর, সামনে একটু বাগান আর সেখানে দুটো বেতের চেয়ার।

একটা কথা মনে হচ্ছিল। শুনেছি গীতায় আছে আত্মা অবিনশ্বর। শরীর শেষ হয়ে গেলেও আত্মার বিনাশ নেই। আচ্ছা, স্বপ্নের কথা কিছু কি লেখা আছে সেখানে? শরীর বিলীন হবার পর এনার মত সাধারণ মানুষের স্বপ্নটুকুর কী হয়। তা কি জীবনাবসানের সঙ্গে সঙ্গে দূরের বনপথে মিলিয়ে যায় নাকি সবার অলক্ষ্যে পড়ন্ত বিকেলের আলোছায়াতে বাতাসে বাতাসে ভেসে বেড়ায়।