0

সম্পাদকীয়

Posted in

































১৩৪৮ সনের পয়লা বৈশাখ। রবীন্দ্রনাথ আশি ছুঁইছুঁই। কবির শেষ জন্মোৎসব পালনের অনুষ্ঠান। ক্ষিতিমোহন সেন পাঠ করলেন কবির লিখিত এক ভাষণ। 'সভ্যতার সংকট' শিরোনামের সেই প্রবন্ধের উৎসারণ সামগ্রিক এক হতাশা থেকে। যা কিছু শোভন, সুন্দর, ন্যায়ানুগ, তার সর্বাঙ্গে যেন দুর্দশার গ্রহণ! তিনি লিখলেন, 'প্রত্যহ দেখতে পেলুম, সভ্যতাকে যারা চরিত্র-উৎস থেকে উৎসারিতরূপে স্বীকার করেছে, রিপুর প্রবর্তনায় তারা তাকে কি অনায়াসে লঙ্ঘন করতে পারে!'

রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর চুরাশি বছর পরে আমরা আজ যে সামাজিক পরিমন্ডলে আবদ্ধ, সেখানে দাঁড়িয়ে কথাগুলি কি একটু ভিন্ন প্রেক্ষাপটে করা হয়ে থাকলেও এমন এক যুগমানবের কলম-নিঃসৃত মনে হয় না, যিনি আজকের দিনটি স্পষ্টভাবে দেখতে পেয়েছিলেন? অথচ সুন্দরের পূজা ছিল তাঁর জীবনের ব্রত।

বেশি নয়, মাত্র আটমাস আগের একটি ঘটনায় উত্তাল হয়েছিল নগরজীবন। কর্তব্যরত একজন তরুণী-চিকিৎসক ধর্ষিত এবং খুন হয়েছিলেন। ভয়ঙ্কর এই ঘটনাটি থেকে জল গড়িয়েছিল অনেকদূর। বিক্ষোভের আঁচ পৌঁছে গিয়েছিল এক মহাদেশ থেকে অন্যত্র। এক যুগেরও বেশি সময় আগে ঘটে যাওয়া 'নির্ভয়ার স্মৃতি' এখনও বহু মানুষের মনে অমলিন। কিন্তু যে 'রিপুর প্রবর্তনায়' একের পর এক ঘটে চলেছে মানবতার এই বলাৎকার, তাকে বশে আনা গেছে কি? যাবে কোনওদিন? আপাতভাবে এমন প্রশ্নের উত্তরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে জটিল নানান অনুষঙ্গ। জিন যার অন্যতম। একমাত্র প্রকৃত শিক্ষার সঙ্গেই বিশেষ এই রিপুটিকে বশে আনার বিষয়টি সম্পর্কিত বলে ভাবা মানবসমাজের পরিচায়ক।

চারপাশের লক্ষণগুলি কিন্তু অন্য ভবিষ্যত নির্দেশ করে। মহারাষ্ট্রের অম্বাজোগাই শহরে একজন মহিলা আইনজীবী প্রকাশ্য, এক বর্বর শারীরিক নিগ্রহের শিকার হলেন। দিল্লির অনতি দূরত্বে আইসিসিউ- এর ঘেরাটোপের মধ্যে ধর্ষিতা হলেন এক এয়ারহোস্টেস আর আমাদের এই বঙ্গে কী ঘটল? প্রাথমিকে চাকরি দেওয়ার নাম করে প্রথমে পাঁচ লক্ষ টাকার প্রতারণা তারপর অভিযোগ জানানোর ফলে সেই তরুণীকে ধর্ষণ!

এ কোন সমাজের অন্তর্গত আমরা? যা কিছু নিয়ে আমাদের গর্ব ছিল, তার সবকিছুই ভূলুণ্ঠিত। আর কি কখনও চেতনা ফিরবে? সামাজিক ন্যায় কি কখনও প্রতিটি প্রত্যন্তবাসীর নাগালে আসবে? কোনওদিন কি আমরা শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়ে কাটিয়ে উঠতে পারব রিপুর তমসা, দাঁড়াতে পারব নতুন এক ভোরের সামনাসামনি?

সুস্থ থাকুন। ন্যায়বদ্ধ থাকুন।

শুভেচ্ছা নিরন্তর।

0 comments:

0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - বেবী সাউ

Posted in






তারপর মানুষ নিজের কাছে ফেরে। অনেক অনেক দিন পেরিয়ে, বছর পেরিয়ে, শত্রু- মিত্র ভেঙে ফেরে। সময় তাকে অনেক কিছু দেয়। অনেককিছু নেয় সে সময়ের কাছ থেকে। ধার করে। পরে ফেরত দেবে ভাবে। জল-ঝড়-বাতাসের ঝাপট। খোলা মাঠ; বদ্ধ দরজা। রোমাঞ্চ, শিহরণ। মান-অপমান। সময় কেড়েও নেয় প্রচুর। ওইযে ছিল নির্মল একটা মন; ভালোলাগার একটা পৃথিবী; রোমাঞ্চ মণ্ডিত একটা চিলেকোঠা--- হারিয়ে যাওয়া সেই চাবি। কাকে বলবে এইসব গাল-গল্প! কাকে শোনাবে একঘেঁয়েমির চিত্র! সবাই যে আজ একরকম, প্রৌঢ়ত্বের মন নিয়ে হাঁটছে। অনেক কিছু জেনে গেছে এই অজানার চেতনা। তার কাছে যে আজ, আলো বাতাসের সবটুকু রিদম জানা। সান্দ্র বিকেলের হাওয়ায় ততক্ষণে শ্রান্ত অবসন্ন সেই মন, হৃদয়। অথচ, নির্জন হয়েছে সে; শক্ত হয়েছে আরও। ঝুরো ঝুরো বালির প্রাচীরে লেগেছে যেন সিমেন্টের ধারালো প্রলেপ। কিন্তু সে নিঃসঙ্গ, একাকী। সমস্ত অভিজ্ঞতার ঝুলি নিয়ে শহরের দিকে চোখ ঘুরিয়ে দেখে-- এই শহর আবিষ্কারের নয়; নতুনের নয়; নাকি রোমাঞ্চকর শিহরণকারী। তখন সে হয়ে পড়ে আরও বিধ্বস্ত। একা। নির্জন। পৃথিবীর এই নিঃসঙ্গতম মানুষটি কী ভাবে তখন! আলো অন্ধকার ডিঙিয়ে কীভাবে তুলে আনা যাবে আলোচনার পর্ব! কীভাবে নিজেকে ভাসানো যাবে আবার সেই নতুনের স্রোতে! একে একে খুলে রাখা বর্ম পরে নিয়ে আবার যদি ঝাঁপ দিতে পারা যেত মারিয়ানার খাদে! যদি এই দমবন্ধ ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ার আগে খোলা আকাশের স্পর্শ আবার আরেকবার পাওয়া যেত যদি! আর তখনই সে খুঁজতে বসে নিজেকে। যুদ্ধ করে। প্রাণপণে ফিরিয়ে আনতে চায় সেই দুনিয়াটিকে। আর তখন আবার আলো-বাতাসের সঙ্গে কথা বলে। অন্ধকার এবং ভ্যাপসা গন্ধের সঙ্গে ভাব জমায়। জানলার ফাঁক দিয়ে খোঁজে নীলনদের বিস্তৃত উপত্যকা।

"The man spoke little. This is the way of those who live alone, but one felt that
he was sure of himself, and confident in his assurance. That was unexpected in
this barren country. He lived, not in a cabin, but in a real house built of stone
that bore plain evidence of how his own efforts had reclaimed the ruin he had
found there on his arrival. His roof was strong and sound. The wind on its tiles
made the sound of the sea upon its shore"

ঠিক এরকমই, জাঁ গিয়োনো ফ্রাঁস লেরক নিজেকে খুঁজেছিলেন। তার আগের সেই জীবন্ত পৃথিবী-- যে তাকে বাঁচতে শিখিয়েছিল, জল-ক্ষুধা-আশ্রয় দিয়েছিল। মেষ পালকের গানে ভরে উঠেছিল জীবন। তার বহুবছর পরে, যুদ্ধ হিংস্র পৃথিবী ভেঙে একটা নিঃসঙ্গ লোক প্রান্তর ডিঙিয়ে হেঁটে যাচ্ছে ওই আশ্রয়ের খোঁজে। শান্তির আশ্রয়ে। নির্জনতার আশ্রয়ে। যেখানে সে মুখোমুখি হবে নিজের। কথা বলবে। নিজের সঙ্গে নিজেকে মেলাবে। আর এই আত্মপরীক্ষনটি চলে নির্জনে। অন্ধকারের ভিতর আত্মসমীক্ষার মাধ্যমে। তখনই লেখক বসেন, পুরনো অক্ষরের কাছে। তেমন সীমিত অক্ষরমালা তাঁকে এতদিন ভ্রান্ত একটি পথের সন্ধান দিয়েছে। আর সারা টি জীবন তিনি সেই সীমিত অক্ষরের পেছন পেছন ছুটেছেন। সৃষ্টির নেশায়। আবিষ্কারের নেশায়। দিস্তার পর দিস্তা কাগজে সেই সীমিত অক্ষর নিয়ে খেলা করেছেন। নেড়েচেড়ে দেখেছেন। সাজিয়েছেন। ভেবেছেন, দারুণ একটা আবিষ্কার! সারা পৃথিবী আশ্চর্য হয়ে দেখবে এই অক্ষরের ঝলকানি। কিন্তু আজ যখন সময় হয়েছে, সেই অক্ষরের কাছে ফিরে দেখেন যে আত্ম গর্বীমন খুঁজে পায় একঘেয়েমি, বিড়ম্বনা। সবকিছুই তখন ফ্যাকাশে। বহু ব্যবহৃত।

" আসলে সবই আদ্যিকালের। পৃথিবীও বদ্যিবুড়ি। শুধু কচিকাঁচারা, তরুণ-তরুণীরা প্রথম প্রথম দেখছে বলে, স্বাদ নিচ্ছে বলে তাদের চোখে জিভে সব আশ্চর্য ঠেকে। সতেরো বছরের ছেলেটি কলকাতা শহরে এসে যে রোমাঞ্চ অনুভব করবে আমি টোকিও, লন্ডন, নিউইয়র্কে গিয়ে তার এক কণাও পাব না। কলকাতাই আমাকে দীর্ঘ দিন ধরে তার সহোদরা নগরীদের সম্পর্কে অভিজ্ঞ করে তুলেছে, তালিম দিয়েছে। "
( চাঁদের ওপিঠে, মণীন্দ্র গুপ্ত)

নতুন সিলেবাস। পাঠ্যসূচি। নতুন বই। ভাবি, কি না কী লুকানো আছে তার অন্তরে। মলাট খোলার পর দেখা গেল, চর্বিতচর্বন। বুঝতে পারলাম, এই পর্বের পরে আসবে অন্য একটি পর্ব। ঠিক যেটা আমি জানি, সেও জানে। লেখকও জানেন হয়ত সেটুকু। তারপর পাঠক হিসেবে তাকে আর খোলার প্রয়োজন অনুভব করি না। কেননা, রোমাঞ্চের অভাব মানুষকে উৎসাহী করে তোলে যেমন, রোমাঞ্চের পরে পৌঁছে দেয় একটি স্থিরতায়। তখন সে তার পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতার সঙ্গে মেলাতে বসে, বর্তমান রোমাঞ্চকর অবস্থানটিকে। তাই আমরা বাস্তবে যখন কারো সঙ্গে কথা বলি, নতুন অপরিচিত ব্যক্তিটি আশ্চর্যতম অভিজ্ঞতা নিয়ে হাজির হন আমাদের সামনে। তারপর যখন দু-চারটি কথার পরে বুঝতে পারি, আসলে আমার পূর্বে জানা ব্যক্তিটির সঙ্গে সাদৃশ্য আছে বর্তমান ব্যক্তিটির। তখন আমরা যত না ওই অচেনা ব্যক্তিটির মধ্যে নতুনত্বের খোঁজ করি তার অধিক মেলাতে বসি পূর্বে চেনা ব্যক্তিটির সঙ্গে। আর তখনই আমরা হাঁপিয়ে পড়ি। ক্লান্ত হই।

তা বলে কিন্তু পৃথিবীতে বৈচিত্র্যের অভাব নেই! শুধু দৃষ্টি পাল্টেছে আমার। আমি-ই পুরনো হচ্ছি পৃথিবীর কাছে। জাবালির মতো। অসহায়তার চোখ নিয়ে কোথায় খুঁজবো রোমান্সের শরীর? মন? বয়েসে না, মনে এসে ছায়াপাত করে বার্ধক্য। মনে হয় এতদিন কী করলাম! শুধুমাত্র কিছু ডিগ্রির কাগজ। অ্যাডমিশন ফি। কলেজ। ক্যাম্পাস থেকে বেরোতেই পারলেই যেন বাঁচি তখন। দমবন্ধ লাগে। হাঁপ এসে যায়। স্কুল লাইফের বন্ধুরা নেই। প্রিয় শিক্ষকেরা এখন বহুদূরের। ছাড়তে ছাড়তে হারাতে হারাতে এই বিরাট কোলাহলে। সম্বল মাত্র কয়েকটি অক্ষর। শব্দ। আর এই পুরনো অভ্যেস, মনখারাপ নিয়ে কী আর কলম চলে? "এই অবস্থায় এসে কি আর লেখালিখি করা যায়!" ( চাঁদের ওপিঠে, মণীন্দ্র গুপ্ত)

তখনই সামনে এসে দাঁড়ায় অভিজ্ঞতা। অনন্তের পৃথিবী। সময় ভেঙে মেশে মহাকালের স্রোতে। আনন্দের গতিধারা আবার বইতে শুরু করে। একে একে উঠে আসে, দেশের বাড়ি। জানলা-ভাঙা নিগমানন্দ প্রাথমিক বিদ্যালয়। ছুট ছুট করে কবাডির মাঠ। প্রথম চোখের ইশারা। হেরে যাওয়া নয়, পূর্ণ ব্যাগের ভারে আমি নতুন হই। সামনের দিকে তাকাই। আবার হাঁটে মানুষের আকাঙ্খার পথ।

" আমি এখন কালস্রোতের কোথায় আছি? কত মাইল উত্তরে, কত মাইল দক্ষিণে? আমার ডানদিকে কত আলোকবর্ষ? আর বাঁয়েই বা কত? অঙ্কটা বেশি জানলে বা ধারণাশক্তি বেশি থাকলে হিসেবটা কিভাবে করা যেত জানি না। আপাতত আমার ছোটো হিসেবে, আমি এই ১৯৮৮ তে, পৃথিবীতে কলকাতায় আছি। আমি পেরিয়ে এসেছি অনন্ত কাল+ ষাট বছর। আর এখনো যেতে হবে হয়তো বছর পাঁচেক+ অনন্ত কাল।" আর তখনই ঝুমঝুম করে বেজে উঠল জাদুগরের ম্যাজিক বাক্স। অনন্ত শব্দটাতেই বিশাল বড় একটা পৃথিবী যেন খুলে গেল তার রঙবেরঙের ওড়না উড়িয়ে। তখনই আবার এসে বসল কবিতার খাতা। অক্ষরের পংক্তি। " এই দৃশ্যমান এবং বেদনীয় জগৎই কবিতার বিষয়-- আধার এবং আধেয়। এতদিন আমি ওই জগতের কথা ভেবেই কাটিয়েছি। অনন্তকালকে দুইপাশে রেখে এবার সাহস করে অন্যভাবে দেখা যাক। এই প্রকাশিত জগতের ওপিঠে বা অন্তরালে নিশ্চয়ই রয়েছে অপ্রকাশিত জগৎ। যেমন চাঁদের দেখা-পিঠের আড়ালে রয়েছে তার অদেখা-পিঠ। যেমন গাছের পাতার আলো-পড়া পিঠের অন্যদিকে রয়েছে তার অন্ধকার-জমা পিঠ। এমন কি বিন্দুরও, যদি অবস্থিতি থাকে, তারও সূচিমুখের আড়ালে আছে অজানা আঘাত।" ( চাঁদের ওপিঠে, মণীন্দ্র গুপ্ত)

আর এখানেই মণীন্দ্র গুপ্ত খুঁজে দেন একটি অন্ধকার জগতের সকাল। যাতে অন্ধকার রাজ্যেও ভেসে উঠছে সন্ধের ইমন। তৈরি হচ্ছে অসংখ্য রাগ-রাগিনী। এতদিন মনে রাখা অন্ধকার আসলে অন্ধকার নয়। বরং আশ্চর্য রহস্যময় একটা কবিতা। যার পরতে পরতে আবিষ্কারের কাপড়। ঘোমটার আড়ালে আশ্চর্য সেই রূপের ঝলক। ঠিক যেন রবীন্দ্রনাথের ছবির রহস্যময়ী অবগুণ্ঠন। নির্জন অন্ধকার তাঁকে দিয়েছিল আলোর মহিমা- দ্যুতি। আর তখনই অনুভব করি, আবহমানের ধারা। নিজেকে স্নান করাই। শুদ্ধ হই।

প্রকৃতি আমাদের সত্ত্বা। আমাদের বিকাশ। আমাদের এগিয়ে নিয়ে যাওয়া পথের পথপ্রদর্শক। আর প্রকৃতির আপন ধারার পথই হচ্ছে নিয়ম। রীতি। ধর্ম। অনুশাসন। আধার এবং আধেয়। আর সমস্ত প্রকৃতির মধ্যে নিজেকে খুঁজে ফেরাটাই সাধনা। প্রকৃতির সঙ্গে মেলানোর প্রচেষ্টাই ধর্ম। অজস্র ধুলোর বিন্দুর মাঝে নিজের আমিকে খোঁজা।অনন্তের খোঁজ বিপুলের খোঁজ। সেই খোঁজাটাই যখন দুর্বার হয়ে ওঠে তখনই আমরা সৃষ্টি আনন্দের খোঁজ পাই। ছুঁতে পারি তার এক দুটি আলোক স্ফুলিঙ্গ। ধন্য হই। আসলে সমস্তটাই প্রকৃতিতে বর্তমান। সমস্ত জিনিসই সাজানো আছে প্রকৃতির ঘরে। তার অতীত নেই, ভবিষ্যৎ নেই। নিত্য সঙ্গে অনিত্য মিশে গেছে প্রবহমান কালে। ‘একো বশী সর্বভূতান্তরাত্মা একং রূপং বহুধা যঃ করোতি’ (কঠোপনিষদ (২:২:১২))। শুধু তোমার প্রয়োজন মতো খুঁজে নাও তাকে। সাজিয়ে নাও ব্যবহার যোগ্য করে। ক্ষুদ্র আমি তখনই মেলে বিরাট আমি'র সঙ্গে। অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে, স্পর্শের মধ্য দিয়ে এই anticlimax পথের সূচনা। বিস্তারিত দৃশ্যের মধ্য থেকে প্রসারিত হবে এইসব রোমাঞ্চকর পথের অনুভব । বোধ। জ্ঞান। এতদিন যা যা সংগ্রহ করেছ তা থেকে বানিয়ে নিতে হবে সংযোজন। তাই কবিতা বিজ্ঞানীর কথায়,

" কবির খুব প্রয়োজনীয় নিকট বন্ধু হতে পারেন নৃতত্ত্ব, প্রত্নতত্ত্ব, জীবতত্ত্ব, সমুদ্রতত্ত্বের লোকেরা; ভূবিদ্যা, পদার্থবিদ্যা ও জ্যোতিবিদ্যার লোকেরা-- যাবতীয় অনুসন্ধিৎসু মানুষের দল। আড্ডা মারতে হয় তো এঁদের সঙ্গে। যেমন ভাব তেমনি লাভ। প্রথমোক্তদের মানুষ-ঘেঁষা পেশা ক্রমশ তাঁদের মূঢ়মতি ও হীনবুদ্ধি করতে থাকে। মনুষ্য সংশ্রব মনুষ্যত্বের পক্ষে সর্বথা ভালো নাও হতে পারে। দ্বিতীয়োক্তেরা ঠিক উলটো-- মহাপ্রকৃতির মধ্যে ঘুরে ঘুরে, খুঁজে খুঁজে তাঁদের চেতনা উদ্ভাসিত হতে থাকে। তাঁরা খুঁজে খুঁজে যাকে পান সে তো অভিজ্ঞতা বটেই, তাছাড়া যেপথে খোঁজেন সে পথও অভিজ্ঞতায় ছাওয়া। এই অভিজ্ঞতাগুলি কবির জগতের ভূমি, আকাশ, আবহাওয়া ও স্বপ্নের মৌল।" ( চাঁদের ওপিঠে, মণীন্দ্র গুপ্ত)

তাই অসীমের পথে যাত্রী হতে পারেন কবিরাই। আলোকের ঝরণা ছেড়ে সহজেই নেমে যেতে পারেন মারিয়ানার গভীর খাদে। কেউ নেই। অনুসরণ অনুকরণের কোনও ধারা ততটাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায় না তাঁর কাছে। তিনি খোঁজেন এবং খোঁজেন। তিনি দেখেন এবং বোঝেন। উপলব্ধি ও অনুভবের মধ্য থেকে ছেঁকে তোলেন শব্দ। ধনী থেকে দরিদ্র সবাই তাঁর বন্ধু। আবার কেউ না বন্ধু নন। তাদের উপলব্ধির অভিজ্ঞতাটুকুই বন্ধু তাঁর। সৎসঙ্গের ব্যাখ্যাটা তাই এখানে যোজন বিস্তৃত। শিশুটিও তাকে দিতে পারে তার শিশুদের সন্ধান, ষোড়শী যুবতী দিতে পারে প্রথম প্রেমের ইশারা আবার মৃত্যুমুখে পতিত বৃদ্ধটি দিতে পারেন রহস্যময় পরাবাস্তবের ইঙ্গিত।

"কবিতা যার একদিক অনির্দেশ্য অনির্বচনীয়কে স্পর্শ করে আছে, সে কেমন হবে, কেমন হওয়া তার উচিত, এমন কোনও ফরমান জারি করা করা আমার পক্ষে ধৃষ্টতা। তবু প্রারম্ভিকভাবে এটুকু বলা যায়, কম্পিউটার, গাইগার কাউন্টার, পরমাণবিক বোমা, মঙ্গল চাঁদ শুকতারায় যাবার হাউই ও জাহাজ যে সূক্ষ্ম, নিপুণ, সংবেদনশীল, নির্ভুল, প্রলয়বীর্য, অনন্তভেদী, অমোঘলক্ষ্য ধ্যানের ফল, আমাদের কবিতাকেও যেতে হবে সেই পথে। এ কথার অর্থ কিন্তু এই নয় যে আমি কবিতার মধ্যে কিছু সফিস্টিকেটেড যন্ত্রপাতির লোহালক্কড় বা নাড়িভুঁড়ি বা কিছু বৈজ্ঞানিক সমীকরণ ভরে দিয়ে তাকে এক মহাপন্ডিত রোবট বানাতে চাইছি। আমি চাইছি তার আত্মা হোক অনন্তসম্ভব, আর সেই অনুযায়ী তার দেহ হোক নিখুঁতগঠন।’ ( চাঁদের ওপিঠে, মণীন্দ্র গুপ্ত)

এই নির্বিকার যাপনের শেষে ঘরে তুলতে পারবো শব্দের মালাকে! সাজাতে পারবো! প্রকৃতির দিকে মুখ করে বলতে পারি যদি- দেখো, তোমার ঘর থেকে জিনিস এনে কীভাবে সাজিয়ে তুলেছি, অন্দরসজ্জা। "আর কবিতার শেষে, ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছানো বা অভাবিত মোচড় দিয়ে থামা বা এতক্ষণের সারা শরীর ভরা চাপকে অকস্মাৎ মুক্ত করে দেওয়া এইভাবে শেষ করার অর্থ নাটকীয়তা, প্রকটতা, বাদ্যকারের তেহাই মারার লোভ"। তখনই ভেঙে যাচ্ছে নিরহংকার সাধনা। লোভ আসছে; প্রতিহিংসা পরায়ন মন আসছে। পুরস্কারের লোভে নিজের স্বতন্ত্রতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে প্রকৃত কবি। তখন ভ্রান্ত পথ তাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে না, " ( চাঁদের ওপিঠে, মণীন্দ্র গুপ্ত)

আমরা যেখানে আছি, যেখানে ছিলাম, যেখানে থাকব তার একদিকে অনাদি, অন্যদিকে অশেষ। সব কবিতা, সব গল্প, সব জীবনেরই শুরু যেমন স্রোতের মাঝখান থেকে ধরে নিতে হয় তেমনি তার শেষও ছেড়ে দিয়ে যেতে হয় মাঝখানেই।" তবে এই যে আমি রোজ প্রত্যহ নিয়ম করে খোলা খাতার সামনে বসে থাকছি। ধরতে চাইছি অখন্ডের নিত্যতাকে! কী হবে? শুধু শুধু হাপিত্যেশ করে বসে থাকা অনন্তের দিকে মুখ করে? কিছু পাওয়া নেই? অনন্ত আমাকে ফিরিয়ে নেবে স্রোতে? আর আমি ভেসে যাবো খড়কুটোর মতো? না; তা নয়। তোমার চাওয়াটা ঠিক। পাওয়াটা নয় হয়ত। এইযে তুমি পাওয়ার জন্য চাইতে বসেছ তখনই তোমার মধ্যে অস্থিরতা আসছে। অসন্তোষ আসছে। তুমি ধ্যানমগ্ন হতে পারছ না তোমার সৃষ্টির কাছে। বাইরের কোলাহল তোমাকে ভ্রমের লোভে টেনে নিয়ে যেতে চাইছে ভোগের দিকে। আর তুমি তোমার ফেলে রাখা কাজ ছেড়ে উঠে যাচ্ছ শুঁড়ি মাতালের ঠেকে। ওখানে গিয়েও শান্তি নেই। তোমার ফেলে রাখা কাজ তোমাকে কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না। কিছুতেই থাকতে দিচ্ছে না এই নেশার পৃথিবীতে। অথচ, যেতেও পারো না তুমি। এই অস্থিরতা যখন তোমাকে ফিরিয়ে আনলো তোমার দায়বদ্ধতার কাছে, সৃষ্টির সমীপে; তখন মনে হচ্ছে শিকল লাগল পায়ে। তুমি চাইলে মুক্তি। আকাশের দিকে। পাখির মতো করে। কিংবা হয়ত যখন ফিরে এলে ফেলে রাখা কাজের কাছে, ততক্ষণে অভিমান বশত চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে সেও। আর এই হল " অ্যান্টিক্ল্যাইম্যাক্স। কি হবে কি হবে ভেবে মন ক্রমাগত উত্তেজিত ও আকুল হতে থাকে, এবং তারপর হয়তো কিছুই ঘটে না। পাঠক শূন্যে ঝুলে থাকেন, আর তাঁর কল্পনা কাজ করতে থাকে গল্পের সীমানা ছাড়িয়ে গিয়ে"। ( চাঁদের ওপিঠে, মণীন্দ্র গুপ্ত)

আমারও আর ফেরা হয়না। সব ছেড়ে যাওয়া-রা চেয়ে চেয়ে দেখে শুধু। সামনে এসে দাঁড়ায় আরও দৃশ্য। আর আমিও প্রতিটি দৃশ্যমানের কাছে তুলে ধরি আমার কবিতা; শব্দ; অক্ষর। মিলেমিশে তৈরি হয় কবিতা ভাবনা। সাদা কাগজের সামনে এসে বসি। একপাশে কোলাহল করে হেঁটে যায়, আমার বাস্তব; অন্যদিকে মৌন সাধনায় রত আমার যাপন। কোনও দ্বন্দ্ব নেই, রেশ নেই। শুধু হেঁটে যেতে হবে ভেবে হেঁটে যাওয়া। বসত গড়ি। মনের মধ্যে লালন বাজে। রবীন্দ্রনাথ বাজে। সুমন এসে মেশে মাঝের স্রোতে। দেখি ততক্ষণে জমে ওঠা-রা মিলিয়ে গেছে শূন্যে। আর তখনই অসংখ্য খোঁজের মধ্যে তৈরি হয় প্রবহমানের ধারা। যেন এটাই মোক্ষ নয়, এখানেই শেষ নয়। বরং অন্তিম ভেবে শুরুর খোঁজ শুরু হয় এখান থেকেই। এখান থেকেই মহাকাব্যের চলন। যুধিষ্ঠির হেঁটে যাচ্ছেন। চারপাশে শীতল অতীত। সামনে অপার সৌন্দর্য। হাতছানি দিচ্ছে। সত্য বলে কিছু কী আদৌ! বরং এতদিনের জেনে আসা প্রিয় সত্য-রা, পদে পদে ভুল বলে প্রমাণিত হচ্ছে। মৃত্যু ঘটছে। তখনই তিনি অনুভব করেন, সত্য মানে তখন এগোনো। চিরন্তন। এগোও, এগোও। এগিয়ে যাও। চরৈবতি...চরৈবতি। আমিও হাঁটি। আর ভাবি, " একবার খুলে দে মা চোখের ঠুলি, দেখি শ্রীপদ মনের মতো"( রামপ্রসাদ সেন)। আর আমি চোখ খুলে নত হই, নতুন হই দৃশ্যের কাছে। এইযে অন্তিম লাইন বলে ভেবে এসেছি এতদিন, সেখানেই সংযোজিত হয় আবিষ্কারের পথ। আলোক বিন্দু। যে আমাকে পথ দেখাবে শুধু। থেমে থাকা, স্থিরতা থেকে মুক্তি দিয়ে মেলাবে অনন্ত আবহমানতার স্রোতে।

0 comments:

0

প্রবন্ধ - অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়

Posted in



















প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদর মোদী তাঁর ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠানে সমগ্র দেশবাসীকে সতর্ক ও সজাগ থাকতে বলেছেন সাইবার জালিয়াতির বিরুদ্ধে। কোভিড পরবর্তী যুগে সাইবার ক্রাইম মহামারীর ন্যায় অত্যধিক হারে বেড়ে যাওয়ায় জনগণ ভীত, সন্ত্রস্ত। একেকটা দিন যায় আর যারা তখনও ‘টার্গেট’ হয়নি শ্বাস ফেলে। যারা আক্রান্ত তারা প্রায় সর্বস্বান্ত।

সব সময়েই সমাজে ভাল ও মন্দ দু ধরনের মানুষ থাকে, একদল যখন কিছু ভাল কাজ করে অন্যদল তার বিপরীতে তাকে হেনস্থা করার চেষ্টা চালিয়ে যায়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি হাত ধরাধরি করে যখনই কোন নতুন আবিষ্কার বা পুরনোকে উন্নত করেছে তখনই অন্য এক গোষ্ঠী তাকেই সম্বল করে মানুষের ক্ষতি সাধনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তা পারমাণবিক ‘ফিউশন’ বা একীকরণ হোক অথবা ডিজিটাল দুনিয়ায় প্রবেশের মত অত্যাধুনিক ব্যবস্থা। পারমাণবিক একীকরণ মানুষের কল্যাণের জন্য ব্যবহার করার আগেই তৈরি হয়ে গেল মানব বিধ্বংসী পারমাণবিক বোম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তার পরীক্ষাও করা হোল, বিনা দোষে মারা গেল দেড় থেকে আড়াই লক্ষ লোক, চিরকালের মত পঙ্গু হয়ে গেল আরও বেশি এবং পরবর্তী প্রজন্ম তাদের শরীরে সেই বিষ বহন করতে লাগল।

বৈদ্যুতিক থেকে বৈদ্যুতিন দুনিয়ায় প্রবেশ করে এসে গেল কমপিউটার। কায়িক শ্রম লাঘব করে শুরু হোল নতুন এক শ্রমজীবন, কারিগরি প্রশিক্ষণ এবং পেশার অধিকারী ব্যক্তি, আদতে তথ্যপ্রযুক্তিবিদ। এই শ্রমে ঘাম ঝরে না কিন্তু ঘুম কাড়ে। যুগ যুগ ধরে চলে আসা পরিবার ও সমাজ জীবন ধাক্কা খাচ্ছে। অতিরিক্ত শ্রমে ক্লান্ত যুব সমাজকে ক্লান্তি দূর করতে নানা ভোগ্যপণ্য ও উৎকট বিনোদনে মজিয়ে দিচ্ছে। হাতের মুঠোফোনে বিরামহীন হরেক বিনোদন, শ্লীল অশ্লীলে ভেদাভেদ ঘুচে যাচ্ছে বয়সের ভেদাভেদ না মেনেই। আর্থিক বৈষম্যের শিকার সমাজ, একদলের হাতে অর্থ অফুরন্ত অন্যদের বাড়ন্ত। বাড়ছে দ্বেষ হিংসা ঘৃণা পরিবার থেকে সমাজে, বৃহত্তর সমাজে। স্বার্থান্বেষী রাজনীতিক এই সুযোগে জাগিয়ে তুলছে মানুষের মধ্যে সন্দেহ আর অবিশ্বাসের বীজ একাধিক প্রক্রিয়ায়, এমনকি পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্কেও। শহরের এই ব্যধি অচিরেই ছড়িয়ে যাচ্ছে দ্রুত গ্রাম্য জীবনে। সারা পৃথিবী এক অস্থির অবস্থায় রয়েছে। এরই মধ্যে প্রযুক্তি নিয়ে এল ডিজিটাল পদ্ধতিতে মানুষের পরিচয় নথিভুক্ত করার ব্যবস্থা। ডিজিটাল পরিচয় পত্র অনেক সুবিধেজনক ও সুরক্ষিত, ব্যক্তিগত পরিচয় এবং আর্থিক লেনদেন।

আধার কার্ডে প্রত্যেকের পরিচয় সরকারের ঘরে সুরক্ষিত বলা হলেও সব জায়গায় সেই সুরক্ষাকবচ খুলে দিতে হচ্ছে। ব্যাঙ্ক থেকে ফোনের সিম, হাসপাতাল থেকে শ্মশান সর্বত্র। ওঁৎ পেতে ছিল দুষ্টু লোকেরা। ঝাঁপিয়ে পড়ল টাকার ঝাঁপি নিয়ে। দুর্নীতির বাজারে বিক্রি হয়ে গেল আমাদের পরিচয়, যেন আমরাই বিক্রি হয়ে গেলাম। আর কিছু গোপন রইল না। “গোপন কথাটি রবে না গোপনে”, রবি ঠাকুরের গান যে এইভাবে সত্যি হয়ে উঠবে এত বছর পরে তা কি উনি জানতেন? আমতা আমতা করে সরকার একসময় স্বীকার করতে বাধ্য হোল কিছু ছাঁকনি দিয়ে বেরিয়ে গেছে। আরে ছাঁকনিটাই তো ফুটো। সুরক্ষিত রাখার যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়াই হয়নি। চোর আটকাতে সদর বন্ধ, খিড়কী দরজা হাট খোলা। আমাদের সব ডেটা এখন ক্রিমিনালদের হাতে। তারা রীতিমতো অফিস চালাচ্ছে। নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষিত প্রযুক্তিবিদ তাদের হাতে, নিত্যনতুন ক্রাইমের ফর্মূলা লিখছে। তাদের মাথায় এমবিএ ডক্টরেট মহাজ্ঞানীজন। শলাপরামর্শ দেওয়ার শিক্ষক আছে। আছে মনস্তাত্বিকও। তাদের পরিচালনা করছে কিছু মাফিয়া যাদের সঙ্গে রাজনীতিকদের যোগাযোগ রয়েছে। বিশাল ব্যবসা। একাধিক জায়গায়। ফাঁদ পাতা রয়েছে এ ভুবনে সর্বত্র।

এক দশকেরও আগে আমার জি-মেল সে হ্যাক করেছে বলে এক কম্পিউটার সায়েন্সের ছাত্র আত্মীয় জানালো। পড়াকালীন অবস্থায় শিখে নিচ্ছে জালিয়াতির পাঠ। চেকপয়েন্ট গবেষণা অনুসারে সারা বিশ্বে প্রতি বছর আগের বছরের চেয়ে তিরিশ শতাংশ করে সাইবার ক্রাইম লাফিয়ে বেড়ে চলেছে। গত বছর সাড়ে বারো বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়েছে এবং অনুমান আর চার বছরে চোদ্দ ট্রিলিয়ন ডলার ছোঁবে। এটা হচ্ছে প্রতিষ্ঠানে আক্রমণের হিসেব। এবছর দ্বিতীয় কোয়ার্টারে গড়ে প্রতি সংস্থায় প্রতি সপ্তাহে ১৬৩৬ বার আক্রমণ হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আক্রান্তের সংখ্যা প্রতি বছর তেরো শতাংশ করে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভারতে এবছর প্রথম চার মাসে ৭৪০,০০০ সাইবার ক্রাইম কেস নথিভুক্ত হয়েছে যার মধ্যে ৮৫% অনলাইন আর্থিক জালিয়াতি। এর মধ্যে ১,১৭,২০০ টির হদিস মিলেছে। বিশ্বে এবং এশিয়াতে যথাক্রমে দশম ও ষষ্ঠ স্থানে আছে ভারত। এ বছর সংস্থা এবং ব্যক্তি উভয়েই অনেক বেশি আক্রান্ত হচ্ছে বলে দেখা যাচ্ছে। প্রতি এক লাখে ৪৪৬ জন আক্রান্ত। তথ্যপ্রযুক্তি রাজধানী শহর বেঙ্গালুরুতে সব থেকে বেশি ক্রাইম নথিভুক্ত হয়।

খুব প্রচলিত কয়েকটি সাইবার ক্রাইম হোল – অন্যের কমপিউটার বা নেটওয়ার্কে বিনা অনুমতিতে ঢুকে পড়া বা হ্যাকিং, সন্দেহজনক সফটওয়্যার বা ম্যালওয়্যার কমপিউটারে ঢুকিয়ে দেওয়া, পরিচিতি তথ্য চুরি, ইলেকট্রিসিটি ফোন বা জলের বিল নিয়ে মিথ্যে তথ্য দিয়ে টাকা মেরে দেওয়া, ব্যক্তিকে প্রলোভিত করে তথ্য বা টাকা পাঠাতে বলা, চাকরি পাওয়ার নাম করে টাকা হাতানো। কোনরকম ভয় দেখিয়ে যেমন পর্নোগ্রাফি, বেআইনি লটারি, মধুচক্র বা মাদক সংক্রান্ত কোনো চক্রের নাম করে তার সাথে যুক্ত থাকার খবর পুলিশ বা সিবিআই নাম নিয়ে কোনো ব্যক্তিকে ফাঁসানো।

প্রতি ৩৭ সেকেন্ডে একজন আক্রান্ত হচ্ছে ভারতে বলে সমীক্ষায় প্রকাশ। সব থেকে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে ষোল থেকে চব্বিশ বছরের ছেলে বা মেয়ে। মধ্যবয়সী থেকে প্রৌঢ় এবং বৃদ্ধদের বেশি আর্থিক ক্ষতি হয়। তবে পঁচাত্তর বা তার বেশি বয়সের ব্যক্তিরা কম আক্রান্ত হলেও সহজে তাদের কব্জা করে টাকা আদায় করা যায়। প্রবীণদের প্রধান সমস্যা বয়সের জন্য অতিরিক্ত সতর্ক থাকতে না পারা, সহজেই পাসওয়ার্ড ভুলে যাওয়া বা রক্ষা করা। তারা কোনো কাগজে ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ডের পাসওয়ার্ড তার সাথেই লিখে রাখেন যা সবসময় বিপদের। এছাড়া ফোনে বা হোয়াটস অ্যাপে বা মেইলে এমন কোনো মেসেজ বা ছবি পাঠানো হয় এবং তা সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি বা ডিজিটাল অ্যারেস্টের হুমকি দেওয়া হয় যার ফলে সেই ব্যক্তি সামাজিক অবমাননার সম্মুখীন হতে পারে এমন সংবাদে সহজেই আনমনা বৃদ্ধকে মানসিকভাবে দুর্বল করে তাকে তার থেকে উদ্ধারের নামে বেশ মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। এই ধরনের ঘটনা আজকাল খুব বেশি শোনা যাচ্ছে। গত বছর প্রায় লক্ষাধিক পেনশনপ্রাপক এই ধরনের জালিয়াতির শিকার।

ব্যক্তিগত স্তরে জটিল পাসওয়ার্ড বানানো (এটা প্রবীণদের পক্ষে মনে রাখা মুশকিল) এবং মাঝেমাঝে বদলে ফেলা, সামাজিক শিক্ষা ও সচেতনতা, সফটওয়্যার আপডেট, ফায়ারওয়াল ব্যবহার, ভাইরাস প্রতিরোধ ব্যবস্থা, সমাজমাধ্যমে ব্যক্তিগত তথ্য দেওয়া থেকে বিরত থাকা ইত্যাদি কিছু নিয়ম মেনে চলার কথা বলা হয়। সাইবার অপরাধ মোকাবিলা করার জন্য সরকারিভাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীনে কাজ শুরু হয়েছে এবং পুলিশের প্রতি থানা ও হেড কোয়ার্টারে অপরাধ নথিভুক্ত করার ব্যবস্থা রয়েছে। তবে সব থেকে সুবিধেজনক ব্যক্তিগত স্তরে অচেনা নম্বরে সাড়া না দেওয়া বা ভুল করে ধরলেও যখন বোঝা যাচ্ছে সন্দেহজনক তখন তিরিশ সেকেন্ডের আগেই ফোন কেটে দেওয়া। ফোনের দখল যেন কোনভাবেই অপরাধীর হাতে না চলে যায়।

যতই প্রধানমন্ত্রী বলুন সদা সতর্ক থাকার কথা, মানুষের মন বিশেষত প্রবীণ মন অন্যমনস্ক, বিষাদগ্রস্ত, চিন্তাশীল, ক্লান্ত থাকেই আর সেই দুর্বল মুহূর্তে নিজেকে সচেতন রাখা মুশকিল। সেই সুযোগটাই নেয় সাইবার অপরাধীরা, হাতিয়ে নেয় কষ্টোর্পাজিত লাখ লাখ টাকা। সরকার উপযুক্ত সতর্কতা ও যথাযথ প্রতিরোধ ব্যবস্থা না নিয়ে সব নাগরিককে তাদের পরিচয় ও গোপন তথ্য সর্বত্রগামী করে দিয়ে বিপদের সামনে ফেলেছে।

0 comments:

4

প্রবন্ধ - সমরেন্দ্র বিশ্বাস

Posted in






পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের জন্ম ৩১ জানুয়ারী ১৯৪৩। সত্তর দশকের একজন প্রধান কবি হিসেবে তিনি পরিচিত। তার লেখা পাঁচটা কাব্যগ্রন্থ, একটা নির্বাচিত কবিতা সংকলন, এছাড়াও রয়ে গেছিল বেশ কিছু অগ্রন্থিত কবিতা, একটা পরিকল্পিত কাব্যগ্রন্থের পান্ডুলিপি। তার মৃত্যুর কয়েক বছর পরে বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হয়, কবির প্রকাশিত, অগ্রন্থিত বা অপ্রকাশিত কবিতাগুলোকে এক মলাটের মধ্যে ধরে রাখার। ২০২২ এর জানুয়ারীতে কাজরী রায়চৌধুরী ও বিতান ভৌমিকের সবিশেষ উৎসাহে, তাদের যৌথ সম্পাদনাতে প্রকাশিত হয় ‘কবিতাসমগ্র / পার্থ বন্দোপাধ্যায়’।
তিনি এমন একজন ব্যক্তিত্ত্ব, যিনি রকে আড্ডা দিচ্ছেন, বন্ধ কারখানার গেটে শ্লোগান দিচ্ছেন, বাচ্চাদের সাথে দোলনায় ঝুলছেন, রাজনীতির জটিল বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করছেন, বোহেমিয়ান হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছেন, কবিতা লিখছেন, নাটকের স্ক্রিপ্ট তৈরী করছেন, গনসংগীতের মহড়ায় নীরব শ্রোতা বা গানে ঠোঁট মেলাচ্ছেন, নিজের বাড়ির ছোট্ট কামরায় বন্ধুদের নিয়ে সাহিত্যের আড্ডা বসাচ্ছেন, সম্পাদনা করছেন উল্লেখযোগ্য সাহিত্য পত্রিকা। এই হলেন আমাদের পার্থ দা, পার্থ বন্দোপাধ্যায় (বন্দ্যোপাধ্যায়-এর বদলে তিনি নিজে বন্দোপাধ্যায় বানানই লিখতেন)।
প্রসঙ্গত জানাই পার্থ বন্দোপাধ্যায় জীবন কেটেছে কোলকাতার একটা সম্পন্ন অঞ্চলে, হাজরা রোডে। কিছু বামপন্থী গন আন্দোলনের সাথে প্রথম জীবনে যুক্ত ছিলেন। সেই হিসেবেই তিনি একজন বামপন্থী ব্যক্তিত্ব। ব্যক্তিগত জীবনে বেশ কিছুকাল একজন সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন। তার রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নিয়ে মন্তব্য করেছিলেন তারই এক অনুজ বন্ধু, শ্যামল ভট্টাচার্য – ‘পার্থদার রাজনীতি যত না মস্তিষ্কের ততোধিক হৃদয়ের। যত না তাত্ত্বিক গোঁড়ামির, তার চেয়ে বেশী মানবিক উদারতার’ [ সুত্র – ‘রবিশস্য’ পত্রিকা, শরৎ ২০১৫]।
তিনি মূলতঃ কবি হলেও নানা বিষয় নিয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন, নাটক লিখেছেন। তার নির্মিত চিত্রনাট্য নিয়ে সিনেমাও তৈরী হয়েছে। জীবনের প্রথম দিকে ‘ফুল ফুটুক’ ও তার পরবর্তী সময়ে যথাক্রমে ‘ম্যানিফেস্টো’ ও ‘পর্বান্তর’ পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। দেশ জুড়ে রাজনৈতিক বিতর্কের দিনগুলোতে ‘ম্যানিফেস্টো’ একসময়ে খুব উল্লেখযোগ্য একটা পত্রিকা ছিল এবং একে ঘিরেই পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের বাড়ীতে বসতো বৈঠক, সাহিত্যসভা। সেখানে চলতো সাহিত্যিক আলোচনা ও নানান রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে বিতর্ক। পার্থ বন্দোপাধ্যায় সক্রিয়ভাবে একসময়ে যুক্ত ছিলেন শ্রমিকদের বিভিন্ন আন্দোলনে। তিনি গান ও সাংস্কৃতিক গ্রুপ ‘গণবিষাণ’-এরও একজন নেতৃস্থানীয় কর্মী, নাট্যকার, নির্দেশক, গীতিকার। তার লেখার উপর গনবিষাণ-সংস্থা অন্ততপক্ষে ন’খানা গণসংগীত স্রোতাদের উপহার দিয়েছেন। আর্থিক উপার্জন তার তেমন একটা ছিল না, একান্নবর্তী পরিবারে তিনি ছিলেন বে-রোজগারে বা কম রোজগেরে মানুষ। পরবর্তী সময়ে বিয়ে করেন রত্না বন্দোপাধ্যায়কে। তাদের একমাত্র পুত্র সন্তান প্রাঙ্গণ। জীবনের শেষ দিকে এসে পার্থ বন্দোপাধ্যায় নিজেকে সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছিলেন। বড় একা হয়ে গিয়েছিলেন। তছাড়া পায়ে বাতের জন্যে একা একা চলা ফেরা করতেও অসুবিধে হতো। অবশেষে তিনি প্রয়াত হন ১৭ মার্চ ২০১৫তে।
# # #

পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের জীবন যেমন অধ্যয়ণের বিষয়, তার কবিতার বৈচিত্র্যময়তাও তেমনি আকর্ষনীয়! ‘কবিতাসমগ্র / পার্থ বন্দোপাধ্যায়’ বইটির পরিপ্রেক্ষিতে তার কবিতা নিয়ে সামান্য আলোকপাত করা যাক। কবির ‘তোমার জন্য তোমাদের জন্য’ কাব্যগ্রন্থের শেষ কবিতাটি ‘মহাশ্বেতা’ পাঠকদের জন্যে তুলে ধরছি।
পাতার আগুন জ্বালি
জ্বলে ওঠে বসন্তের দিন
#
হলুদ শিখার নৃত্য মধুবাতাসের বুকে
কিছুক্ষণ দাপাদাপি করে নিভে যায়
পড়ে থাকে অবশিষ্ট একরাশ শাদাকালো ছাই
#
তোমাকে দেবার মতো কিছু নেই বলে আজ
মহাশ্বেতা, ভষ্ম থেকে প্রতিমা বানাই (মহাশ্বেতা)

এতো কোনো কবিতা নয়, একটা ইতিহাস। বসন্তের বজ্র নির্ঘোষের দিনে কেউ কেউ আগুন জ্বালতে চেয়েছিল। কিন্তু সফল হয় নি সেই চেষ্টা – সত্তর দশকে আগুন জ্বলেছিল বটে, কিছুক্ষণ দাপাদাপি করে তা নিভে গেছে, পড়ে আছে ছাই এর অবশেষ। অন্য দিকে একসময়ে রাশিয়া, চীন, পূর্ব-ইউরোপ সাম্যবাদের ধ্বজা নিয়ে মানুষের আশা স্বপ্নের প্রতীক ছিল, তাও ততোদিনে ভেঙে পড়েছে। তবুও হাল ছাড়েন না কবি। যে স্বপ্নের প্রতিমাকে গড়ে তোলার স্বপ্ন ছিল, আগুন নিভে গেলেও মহাশ্বেতা সময়ের জন্যে কবি অবশেষে নির্মান করেন তার ভষ্মের প্রতিমা। ‘মহাশ্বেতা’ সেইসব আশা-ভঙ্গুর সময়ের জন্যে নির্মিত একটা কবিতার ভাষ্কর্য! অবশ্যই এটা কবিতা হিসেবেও অনন্য!
পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের কবিতা লেখা শুরু সত্তরের দশকে। সত্তর দশকের সন্ত্রাস, ৭২ সালের নির্বাচনের পর পশ্চিমবঙ্গের পটপরিবর্তন, ৭৩ সালের খাদ্য-অমিল, ৭৪এর সরকার বিরোধী আন্দোলন, রেল ধর্মঘট, ইন্দিরা গান্ধীর আমলে দেশ জুড়ে এমার্জেন্সী, বন্দীমুক্তি আন্দোলন – এই সব বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া তার কবিতায় ফুটে উঠেছে। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘পোস্টার অথবা কবিতা’ – যার রচনা কাল ১৯৬৮ -১৯৭৯, এখানকার লেখা কবিতাগুলো অনেকটাই সোজা সাপ্টা, বেশীর ভাগ বিবৃতিধর্মী, কোথাও আবেগময় এবং কোথাও কোথাও ছুঁয়ে আছে কাব্যিকতা!
সোজাসাপ্টা উচ্চারণে তিনি লেখেন –
‘পোষ্টার অথবা কবিতা
যে যা খুশি ভেবে নিতে পারো
আমি চাই কথাগুলো আটটা পাঁচটার গেটে অনায়াসে মিশে যাক
তেতে উঠুক অবস্থানের তাবু’। [পোস্টার অথবা কবিতা –১৯৬৮]
এরকমই ভাবেই পার্থ বন্দোপাধ্যায় তার কবিতার মধ্য দিয়ে প্রান্তিক শোষিত সংগ্রামী মানুষদের প্রতি অনুগত থাকতে চান। এই দিনগুলোতে তার বক্তব্যের মধ্যে নেই কোনো কাব্যিক লুকোচুরি, সোজা সাপ্টা কথাতেই তিনি লেখেন –
‘শৃঙ্খলিত মানুষের চলার ছন্দের মধ্যে
জেগে উঠছে যে ঘুম-ভাঙার গান
হে সময়, আমাকে তুমি তার প্রতি অনুগত থাকতে সাহায্য করো
হাতুড়ির ঘা মেরে
প্রতিদিন রক্তের ভেতরে তোমার অবিরাম নির্দেশ পাঠাও।’
(আমাকে নির্দেশ দাও / রচনাকাল – ১৯৭০)।
উপরের লাইনগুলো কতোটা কবিতা হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকতেই পারে। তবে এই কবিতার মধ্যে সময়ের যথার্থ আবেগ রয়েছে, রয়েছে সমাজ সচেতনতা। এরপরে ১৯৭৩ সাল, দেশ জুড়ে দুর্ভিক্ষ, খাদ্যাভাব। এ সময়ে লেখা কবিতার কথাগুলো পাঠকের হৃদয়কে বিদ্ধ করে, যখন পার্থ বন্দোপাধ্যায় তার দীর্ঘ কবিতাটিতে লেখেন –
‘ভারতবর্ষ, তোমার চোখের মণিতে দুর্ভিক্ষের কালো থাবা
তোমার মাথার উপরে মৃত্যু .........
ভারতবর্ষ, তোমার অহিংসার মন্ত্র আমাকে দীক্ষিত করেনি – আমি ব্রাত্য
আমি কোনো ফতোয়া মানিনি
মৃত্যু আমার বাঁপাশে ডানপাশে
আমার দিকেও নেমে আসছে পুষ্টিহীনতার করাল প্রতিহিংসা
#
হাজার হাজার জেল গারদ তুলে কেউ আমার মুখ বন্ধ করতে পারবে না
...... আমি কাউকে ভিক্ষার ঝুলি কাঁধে তুলে নেবার জন্য প্ররোচিত করিনি
-আমি সেই চন্ডাল
প্রত্যেকটা চিতার পাশে জেগে থাকছি
প্রত্যেকটা চিতার পাশে, আগুন আগলে রাখছি ঘৃণায়।’ [ মার্চ ’৭৩]

১৯৭৪ সালে দেশ জোড়া রেল ধর্মঘট, কবি রেল ধর্মঘটের সমর্থনে দাঁড়িয়েছেন, লিখছেন কবিতা, যদিও তার লেখার লাইন অনেক জায়গাতেই শ্লোগানধর্মী! যেমন, উদ্ধৃত অংশের শেষের লাইনগুলো –
‘প্রত্যেকটি ধর্মঘটি রেল-কর্মীর মাথার উপরে ঝুলছে গ্রেপ্তারি-পরোয়ানা
.........
তবু এই প্রতিজ্ঞামুখর সময়
বার বার জ্বলে উঠছে আগুনের অপ্রতিহত ইস্তাহার
যার কিছুই নেই তার কিছু হারাবার ভয় নেই
(রেল ধর্মঘটের আজ চার দিন / রচনাকাল - ১১ই মে ১৯৭৪)

‘বৃষ্টির দিনে কলকাতার এক উপাখ্যান’ দীর্ঘ কবিতাটাতে কবি জলে ভেজা শহরের চিত্র তুলে ধরে ব্যক্ত করেন নিজস্ব ক্ষোভ। আরেকটি দীর্ঘ কবিতা ‘বিপ্লব দীর্ঘজীবি হোক’এ কবি একজন ভিয়েতনামি মানুষের ধারাভাষ্যে সাম্রাজ্যবাদী চীন ও সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী রাশিয়ার বিরুদ্ধে উগরে দিয়েছেন তার ক্ষোভ ও ঘৃণা। প্রথম কাব্যগ্রন্থভুক্ত এইসব কবিতাগুলো মূলতঃ শ্লোগান বা বিবৃতিধর্মী; তবুও কবিতার ভেতর দু’চারটে দৃশ্য বা চমকপ্রদ বর্ণনা পাঠককে আকুল করে।
যদিও ‘পোস্টার অথবা কবিতা’ কাব্যগ্রন্থটির কিছু কবিতার উচ্চারণ কাব্যিক কারণে মনকে ছুয়ে যায়, কবিতা সেখানে শ্লোগান নয়। তিনি কবিতাকে লেখেন জীবনকে ছুঁয়ে, কবিতার ভাষা ছুঁয়ে থাকে প্রাচীন লোককথা, কবিতার লাইনগুলো গভীরতায় একটা ভিন্ন মাত্রা পায়। যেমন –
শীতের প্রস্তুতি ছিল গাছে গাছে পাতায় পাতায় ......
যা ছিল না আজও নেই
সে কেবল গরিবের গরম পোশাক ......
দিন যায় রাত্রি আসে
পৌষের আকাশ নিয়ে অভাগী ফুল্লরা গায়
আজো সেই বুক-ভাঙা যন্ত্রণার গান
দঃখীর সম্বল বলতে
জানু ভানু কৃশানু শীতের পরিত্রাণ ...(জানু ভানু কৃশানু / রচনা-১৯৭৪)
এই কবিতায় আসে অভাগী ফুল্লরার কথা। দুঃখী মানুষের সম্বল জানু, অর্থাৎ হাঁটু, যেটা জড়িয়ে সে শীত কাটায়। ভানু অর্থাৎ সূর্য, সেটাই কৃশানু বা রুগ্ন-দেহ বস্ত্রহীন মানুষের শীতের সম্বল। লোককথা এবং শব্দের গূঢ় ব্যবহার এই কবিতাটাকে নান্দনিক করে তোলে।
পার্থ বন্দোপাধ্যায় তার অনেক কবিতাতে নিপুন ছন্দের স্বাক্ষর রেখেছেন। উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরা যেতে পারে বক্তব্যের দিক থেকে মনোগ্রাহী একটা কবিতা, ‘হেলে’র কিছু লাইন।
ভয় পাস নে ভয় পাস নে ছেলে
কেউটে কিংবা গোক্ষুর নয় ও সাপ নেহাত হেলে
কামড়ে দিলে পা
খুব জোরতো দুচার দিনের ঘা
#
আর সাহস করে ছেলে
যদি তুলতে পারিস লাঠি
দেখবি ও সাপ পায়ের কাছে
ঠান্ডা মেরে গুটিয়ে আছে দিব্যি পরিপাটি ... (হেলে)।
এই কবিতাটা, যতদূর মনে পড়ছে, প্রতুল মুখোপাধ্যায় সুর করে নিজেই গেয়েছেন।
পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের কবিতার বিষয় সাধারণ মানুষ, নিরন্ন মানুষ, ফুটপাথের মানুষ। রাস্তার শিশুদের নিয়ে লেখা কবিতা ‘রাস্তায় যে বড়ো হবে’। এই কবিতার কয়েকটা লাইন –
‘একটি শিশু সোনার থালা’
মিথ্যে কথা – অলীক প্রতিশ্রুতি
তোর চাই নতুন বর্ণমালা
অ-য়ে অন্ন
আ-য়ে আশ্রয় ......
... এ পৃথিবী তোকে যতই বঞ্চিত করুক
তোর হাতেই নতুন পৃথিবী গড়বে
যদি তুই শিখে নিতে পারিস
শ-য়ে শ্রেনি
স-য়ে সংগ্রাম।
এই লাইনগুলোর মধ্যে দেখি কবি তার বিবৃতিধর্মীতা ভেঙে পাঠকদের দিকে ছুড়ে দেন কিছু নতুনতর শ্লোগান, যার আবেদনও অনবদ্য।
কবিতাসমগ্র-র পাতা পালটে আমরা পৌঁছে যাই পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থে – ‘কাকেরা আশ্চর্য পাখি’, যার প্রকাশকাল মার্চ ১৯৮৬।
কবির প্রতিবাদী কন্ঠস্বর এখানেও অব্যাহত। একজন সংগ্রামী সচেতন মানুষের দৃষ্টিতে তিনি লেখেন –
‘পায়ের নিচে ফুঁসছে মাটি
মাথার ওপর রক্তমাখা আকাশ
তাকাস, তোরা যাত্রাপথে মাথার ওপর তাকাস।’ (দিন আসছে)
এই পর্বের কবিতাগুলো পড়লে বোঝা যায় পার্থ বন্দোপাধ্যায় তার বাস্তব জীবনে জড়িয়ে আছেন বিভিন্ন শ্রমিক আন্দোলনের মধ্যে, ভাগ নিয়েছেন মজুরদের নুন্যতম দাবী দাওয়ার প্রশ্নে। তিনি পথ হেঁটেছেন শ্রমিকদের মিছিলে। তিনি ছাঁটাই হওয়া শ্রমিকদের সাথে বন্ধ কারখানার গেটে ধর্ণায় বসেছেন।
‘রুগ্ন শিল্পের মজুরদের ধারাবাহিক রুগ্নতার প্যানপ্যানানি ভালো লাগছে না আপনার
জীবন যখন গলানো পিচের মতো ফুটতে থাকে অভাবের কড়াইয়ে
খিদে যখন মৃত্যুর ছায়ার মতো পাক খেতে থাকে তলপেটে
চেনা গন্ধমাখা বৌয়ের শাড়ি চাপা অন্ধকারে হয়ে যায় ফাঁসের দড়ি-
তাতে আপনার কী যায় আসে – আপনি আটতলার বাসিন্দা .....’ (খোলা চিঠি / মাননীয় অর্থমন্ত্রী অশোক মিত্র সমীপেষু)। এই কবিতাটা সে সময়ে বন্ধ-থাকা এ-স্টক কারখানার আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে লেখা, যে শ্রমিক আন্দোলনের সাথে কবি সরাসরি জড়িয়ে ছিলেন।
কিংবা,
‘কারখানাতে / তালা মানেই / জীবন ফালাফালা / কেউ দিয়েছে গলায় দড়ি / কেউ দিয়েছে / রেল লাইনে গলা / কারখানাতে / তালা মানেই / শাদা থানের শাদা আকাশ / শূন্য ভাতের থালা ...... বন্ধ গেটের / অস্ত্রবিহীন তাঁবুর থেকে / উঠছে নতুন নারা / লোহার জাল / যতই কঠিন হোক / এসমা- ন্যাসা / হোকনা যতই জারি / লোহা গলানো হাতই পারে / ভাঙতে জারিজুরি’। ‘লোহার জাল’ শীর্ষক এই কবিতাতে দেখি কবি বিশ্বাস রাখেন শ্রমিকশ্রেণীর সংঘবদ্ধ সামূহিক শক্তিতে।
‘কারখানা লকআউট
দুমাস ছমাস নয়, পুরো চোদ্দমাস
ছেঁড়াফাটা রঙচটা তাঁবুর ভেতর বাড়ে দীর্ঘ হাহুতাশ ......
তাঁবু আগলে বসে থাকে মহিম-মাসুদ-পরিমল’। (সপ্তমী)
দুর্গা পূজা, সপ্তমীর দিন হিন্দু মুসলমান শ্রমিকেরা বন্ধ কারখানার গেটে ধর্ণা দিয়ে বসে আছে। এই কবিতা তার পক্ষেই লেখা সম্ভব, যেহেতু কবি নিজে শ্রমিক আন্দোলনের সাথে সরাসরি জড়িয়ে আছেন, তাদের মিছিল মিটিং ধর্ণায় ভাগ নিয়েছেন।
এই পর্বের কবিতাগুলো যে শুধু শ্রমিক মজদুর ভাবনা নিয়ে লেখা তা নয়। সাধারণ বিষয় নিয়ে অনেক কবিতা আছে এই গ্রন্থে। যেমন ‘কাকেরা আশ্চর্য পাখি’ বিষয় হিসেবে একটা ব্যতিক্রমী কবিতা, উপেক্ষিত পাখি কাকেদের নিয়ে লেখা কবিতা। ‘আমি-র মুখে’ কবিতাটা ব্যক্তিগত ঘেরাটোপ ভাঙ্গার কবিতা, আত্ম-আহমিকা বিসর্জন দেয়ার আহ্বানের কবিতা। লেকের রাস্তায় রঙচটা শাড়ি, ফাটা কামিজ পরা যুবতীরা তার কবিতার বিষয় হয়ে যায়( তিনটি যুবতী চলে যায়)। ‘প্রচ্ছদপট’ কবিতায় তিনি লেখেন ক্ষয়িষ্ণু বঞ্চনাময় এই সমাজ ও পৃথিবীর কথা –
‘নিরবধি কাল নয়, বিপুলা পৃথিবী নয়
এ মাটির কাছে তুমি চেয়েছিলে পিপাসার জল
এ মাটি দিয়েছে জল – তার চেয়ে ঢের বেশি ঢেলেছে গরল’

তবুও কবি বিশ্বাস করেন সাথীদের সাথে মিলে সংঘবদ্ধ সংগ্রামে। লেখেন এই সুপরিচিত কবিতাটা, যাকে একটা জনপ্রিয় গানেও রূপ দেয়া হয়েছে।
‘শ্লোগান দিতে গিয়েই আমি চিনতে শিখি
নতুন মানুষজন
শ্লোগান দিতে গিয়েই আমি বুঝতে শিখি
কে ভাই – কে দুশমন’ ( শ্লোগান থেকে )।

এরপর ১৯৯১ সালে প্রকাশ পেলো পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের চটি কবিতার বই ‘তোমার জন্য, তোমাদের জন্য’। এখান থেকেই তার লেখার পটপরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। শ্লোগান, আন্দোলন, সমাজ ইত্যাদি বিষয় থাকলেও তার কবিতায় প্রেম বিষয়টা তেমনভাবে উচ্চারিত ছিল না। এই বইএর প্রথম কবিতা ‘তোমাকে’ – তাতে তিনি লিখলেন – ‘ঊর্মিমালা, আমাকেও ডাকো তুমি, ডাকো আজ অন্য কোন নামে’!
কবির নিজের ভেতরে জমিয়ে রাখা প্রেম ভলোবাসার স্মৃতি এতোদিন কবিতায় উহ্য ছিল, জানি না কেন, তার কবিতার বইতে তিনি তেমন ভাবে প্রকাশ করেন নি! এই তৃতীয় বইটাতে দেখলাম, কবি তুলে ধরেছে তার জীবনে প্রেমের স্মৃতি – ‘উনিশ বছর আগে’ কবিতায় –
‘মনে আছে, আমরা ছিলাম মুগ্দ্ধ আমাদের শরীরের ঘ্রাণে ও আস্বাদে
ঊনিশ বছর আগে, এরকমই ঝমঝম সন্ধ্যার ভেতর #
তুমি, আমি, ভালোবাসা ... মেঘ বৃষ্টি ঝড়’।
কিংবা, যে প্রেমের কথা কবি এতোদিন বলেন নি, এবারে তা লিখলেন কবিতায়,
‘তুমি বলেছিলে
এক আকাশ ভালোবাসার নীচে
দুজন মানুষ অকুলান হবে না’ (রাত্রি যায়)।
অথবা, ‘এপ্রিলের মৃত্যু’ কবিতায় নারীকে নিয়ে লিখলেন অসামান্য এই লাইনগুলো –
‘খোলা মাঠে গাছের মতো সাবলীল যে মেয়েটি
একদিন বৃষ্টির দিকে খুলে রেখেছিল শরীর
তাকেও দেখতে পাবে
বিবাহের যৌতুকে সেও পেয়েছে মৃত্যুর সাদা পাতা’ – তাহলে কি কবির পর্যবেক্ষণে বিবাহ-পরবর্তী সময়ে মেয়েটি সুখী নয়? বিবাহ তাকে উপহার দিয়েছে মৃত্যুর সাদা পাতা?
প্রেম ভালোবাসা বিরহ এসব কবিতার পাশাপাশি এই বইতে আছে কয়েকটি অসামান্য কবিতা, যেমন ‘মহাশ্বেতা’ বা ‘আলেয়া’! ‘মহাশ্বেতা’ – কবিতাটার উদ্ধৃতি এই নিবন্ধর প্রথমেই দিয়েছি, ‘আলেয়া’ থেকে তুলে দিচ্ছি তার কবিতার প্রথম তিনটে লাইন –
‘বাতাসের হাতে বেজায় লম্বা দড়ি
ফাঁসজাল হয়ে সমানে টানছে, সামনে টানছে শুধু
কিছুই জানিনা কদ্দুর যাওয়া – নিবিড় তিমির ধূ ধূ’।

কবির তৃতীয় কাব্যগ্রন্থটি সম্পর্কে বিতান ভৌমিক লিখেছেন, কবির “রাজনৈতিক কর্মীসত্তার সাথে ‘তোমার জন্য তোমাদের জন্য’ কাব্যগ্রন্থে আমরা দেখা পাই এক প্রেমিকের। দরদী মন তার কবিতায় রয়ে গেল। প্রেমিক স্বভাবও তার কবিতায় রয়ে গেল। কিন্তু রাজনৈতিক কর্মীর উপস্থিতি তুলনায় কমে এল।” [সূত্র – ভূমিকা, কবিতাসমগ্র / পার্থ বন্দোপাধ্যায় (এখানে আলোচিত বইটি)।]
পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ ‘শাদাপাতার দেশ’ প্রকাশিত হয় ১৯৯৪এ। এই পর্বের কবিতার অভিমুখ কিছুটা আলাদা। প্রেম, জীবন, সমাজ, পরিবেশ অনেক কিছুই রয়েছে – শ্লোগান ও বিবৃতি কমে এসেছে।
এই পর্বের একটা অসামান্য কবিতা, নগরায়নের বিরুদ্ধে, পরিবেশ-ধ্বংসের বিরুদ্ধে –
‘ভীষণ ধারালো জিভে গোঁফ চেটে নিয়ে
বাঘিনিকে স্থির ভাবে বলেছিল বাঘ
-জঙ্গল ফুরিয়ে গেলে লোকালয়ে যাবো
শুয়োর হরিণ যদি না পাই তো ক্ষতি নেই
মানুষের হাড়মাংস খাব।’ (জঙ্গল ফুরিয়ে আসছে)
প্রকৃতি ও পরিবেশ ধ্বংসের বিষয়টা যে কতো মারাত্মক হতে পারে, তা চার লাইনে বাঘের ভয়াবহ ডায়ালগে এখানে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে।
‘ভিন্ন জীবন’ কবিতার প্রথম লাইন কাব্যিকতার মাধুর্যে পরিপূর্ণ, - ‘মানব গিয়েছে ডুবে মল্লিকার দুই হাঁটু জলে’ – এই লাইন আমাদের ভাবনাকে আরো বিস্তৃতি দেয়। ‘বাংলার বিবেক / ১৯৯০’ কবি লেখক কবি বুদ্ধিজীবিদের দিকে ছুঁড়ে দেন তীব্র কঠাক্ষ! ‘চাঁদিপুর’ কবিতায় প্রেমের এক তীব্র আর্তি –
‘জোয়ারের অপেক্ষায় ঝাউয়ের ছায়ার নীচে বসে আছি আমরা দুজন
কখন সমুদ্রে যাব শরীরের অসম্ভব আকাঙ্খা জুড়াতে যাব কখন – কখন
মরে যেতে ইচ্ছে করে কোনো দিন জীবনের অতিরিক্ত ভালোবাসা পেলে’।
প্রসঙ্গত বলি, উপরের কবিতাটা কবি লেখেন, বিয়ের পর বউকে নিয়ে যখন তারা চাঁদিপুর ঘুরতে গিয়েছিলেন। [ কবিপত্নী রত্না বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণ, – ‘রবিশস্য’ পত্রিকা, শরৎ ২০১৫]
এমনি ভাবেই সময় এগিয়ে চলে। চলতে চলতে একসময়ে কি জীবনের রেস্ত সত্যিই ফুরিয়ে আসে, কেন তবে হাতের তালুতে কপাল সুদ্ধু মাথাটা ঢলে পড়বার ভয়, সে কি কোনো মৃত্যুর বিষণ্ণ চিন্তা? ‘শীতগ্রীষ্মের মাঝখানে’ কবিতায় কবি কেন উচ্চারণ করেন – ‘রেস্ত ফুরিয়ে আসছে ইয়ার’।
পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের পঞ্চম কাব্যগ্রন্থ ‘দ্বাদশ আশ্চর্য’ প্রকাশিত হয় ২০০২এ, এর কবিতাগুলোর রচনাকাল ১৯৯৯-২০০২। এটাই কবির শেষ কাব্যগ্রন্থ। যদিও নান্দীমুখ সংসদ থেকে প্রকাশিত হয়েছিল পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের ‘নির্বাচিত কবিতা’।
যথাক্রমে কবির চতুর্থ ও পঞ্চম কাব্যগ্রন্থ ‘শাদাপাতার দেশ’ ও ‘দ্বাদশ আশ্চর্য’ সম্পর্কে বিতান ভৌমিকের নিরীক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ – “মৃত্যুচেতনা ও দার্শনিকতার যে উন্মেষ দেখেছিলাম ‘সাদা পাতার দেশ’ কাব্যগ্রন্থে সেই মৃত্যুচেতনা ও দার্শনিকতা ‘দ্বাদশ আশ্চর্য’ কাব্যগ্রন্থে আরও পরিণতির দিকে এগিয়ে গেছে। নিচুতলার মানুষের প্রতি যে দরদ কবির সাথে ছায়ার মতো এতদিন জেগেছিল সেই দরদের ভেতরেও এবার দেখা দিল একধরণের দার্শনিক বোধ।” [ সূত্র – ভূমিকা, কবিতাসমগ্র / পার্থ বন্দোপাধ্যায়]
কবিতাসমগ্র-র পরবর্তী অংশে আছে কবির ‘পরিকল্পিত কাব্যগ্রন্থ’, যার তিনি কোনো নামকরণ করে যান নি।
কবির ‘পরিকল্পিত কাব্যগ্রন্থ’ থেকে একটা পুরো কবিতা তুলে দিচ্ছি, যে লেখায় কবি পার্থ বন্দোপাধ্যায় হয়তো নিজেকেই নিজে মেলে ধরেছেন – ‘কবির স্বভাবে নেই / দুদন্ড সুস্থির হয়ে / চুপচাপ বসা / স্বজনে বাচাল বলে / দুর্জনেরা বলে বোলচাল / কবি ভাবেঃ কেল্লা ফতে / এতদিনে করেছি কামাল / # / গ্রীষ্ম ও বর্ষায় নেই / কবির নিজস্ব কোনো / নিরাপদ ছাতা # / তুচ্ছাতি বিষয় নিয়ে এ সংসারে / কবে আর কার মাথা ব্যথা / # / রোদেই পুড়ুক / আর জলেই ভিজুক / ঋতুর তরঙ্গভঙ্গে / কবির আকাশ তবু / সত্যবদ্ধ খোলা সাদা পাতা’।
এ ছাড়াও রয়েছে পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের বিভিন্ন সময়ে লেখা পুস্তকাকারে অগ্রন্থিত কবিতা। এই অংশগুলোতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে মণিমাণিক্যের মতো অনেক কবিতা, যা কিনা কবির কাব্যিকতা ও তার ব্যক্তিজীবনকে বিশ্লেষণ করতে সাহায্য করবে।
জীবনের শেষর দিকের লেখা কবিতাতে দেখি, তার রাজনৈতিক ভাবনার বাঁক – এক্ষুনিই আমাদের এই পৃথিবীটাকে আমূল বদলে ফেলতে হবে - এই জাতীয় রাজনৈতিক তীব্র কর্মিসত্ত্বা তার মধ্যে যা কিছুটা ছিল, তা কালের প্রবাহে অবসিত হয়েছে। যে কাজ কবি পারেন নি, তা সম্পন্ন করার জন্যে তো তার উত্তরসূরীরা রয়েছে। ‘দিন কাটছে’ কবিতাটা পড়লে এই ভাবনার পরিবর্তনটা স্পষ্ট হবে –
‘সামনে উঁচু পাহাড়
ঠিক পেরিয়ে যাব আমি না পারলে আমার ছেলে
তেমন কোনো প্রতিজ্ঞা নেই আর’। (অগ্রন্থিত কবিতা)
‘জেগে থাকি’ কবিতায় খুঁজে পাই একজন জীবনানন্দীয় রোমান্টিক কবিকে – ‘ যতক্ষণ জেগে থাকি / এক পৃথিবীর গন্ধ লেগে থাকে বুকের ভেতর’ (অগ্রন্থিত কবিতা)।
সমস্ত কাব্যগ্রন্থের মধ্যে একটা অসাধারণ লেখা হিসেবে পাঠকদের নজর কাড়বে ‘সে কাঁদেনি’, পুরো কবিতাটাই তার ‘অগ্রন্থিত কবিতা’ থেকে তুলে দিলাম -
‘অঝোর বৃষ্টির রাত
একাই ভিজেছে আজ পাষাণপ্রতিমা
আমি জানি- আর কেউ সে কথা জানে না।
#
অবিশ্রান্ত ধারাপাত
সারা রাত সে কাঁদেনি – কেঁদেছে আকাশ।’


পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের কবিতাতে যে সব বৈশিষ্ট্যগুলো খুঁজে পাওয়া যায়, সেগুলোকে পরপর লিখলে এরকমটা দাঁড়ায় –
১- কবিতাতে দীর্ঘ বাক্যবন্ধের ব্যবহার।
২- কোথাও কবিতাতে নাটকীয় সংলাপ ধর্মিতা।
৩- কলাবৃত্ত, মিশ্র-কলাবৃত্ত, দলবৃত্ত ইত্যাদি সব ছন্দর ব্যবহারে পারদর্শিতা।
৪- কবিতার মধ্যে চমৎকার নিয়ে আসেন চলতি বা তৎসম শব্দ, দেশজ শব্দ কিংবা প্রাচীন কবিতার উদ্ধৃতি বা লাইন। যেমন – ‘আয়মনকুলির শোকে উথালিপাথালি নদী আজো পাড় ভাঙে’ লাইনে দেশজ শব্দ ‘উথালিপাথালি’র নিপুন ব্যবহার।
৫- কবিতার বিষয় নির্বাচনের বৈচিত্র্য। যেমন –‘কাকেরা আশ্চর্য পাখি’ কবিতাটা, যা কিনা কবির মৌলিক কল্পনা প্রতিভারও একটা দৃষ্টান্ত ।
৬- কবিতার জগতটা বর্ণ, দৃশ্য, গন্ধ-স্পর্শের এক মিশ্রিত জগত। চিত্রধর্মিতা তার কবিতার একটা বৈশিষ্ট্য। তার কবিতা জনহীন বায়বীয় পরিবেশে ভেসে বেড়ায় না।
৭- কবির কবিতার বিষয় মূলত নাগরিক জীবন। তার সাথে মিলে যায় দৈনন্দিন জীবনের খুটিনাটি, মানুষের বেঁচে থাকার কষ্টকর চেষ্টা, মজদুর শ্রমিকের লড়াই, প্রতিবাদ-বিদ্রোহ, মানুষের প্রেম-ভালোবাসা, এমনকি নৈসর্গিক নানা চিত্রমালা।
৮- কবিতার বিভিন্ন জায়গাতে অসামান্য সব চিত্রকল্পের ব্যবহার। যেমন- ‘বাতাসের হাতে বেজায় লম্বা দড়ি’ কিংবা ‘মানব গিয়েছে ডুবে মল্লিকার দুই হাঁটু জলে’ ইত্যাদি সব লাইন।
পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের কবিতাচর্চা সম্পর্কে বিশিষ্ট কবি রঞ্জিত গুপ্তর একটা মূল্যায়ন খুব প্রাসঙ্গিক – ‘সত্তরের কাব্য আন্দোলনের প্রথম দিনগুলিতে যে শিল্পহীন প্রচারধর্মীতার একমুখী চর্চা চলেছিল পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের সেদিনের স্বরটি তার দ্বারা ছিল অনেকাংশে আক্রান্ত। তবু কবি তার অন্তর্লীন স্বভাবে ছিলেন এর সম্পূর্ণ বিপরীত। কাব্যিক সুষমারিক্ত তার সেদিনের বিবৃতিধর্মীতার পেছনে আসলে কোন অকবিসুলভ অক্ষমতা ছিল না। বরং তিনি যেন সচেতনভাবেই চেয়েছিলেন প্রচলিত রূপবদ্ধ ভেঙ্গে কবিতার ভিন্নতর ভাষা খুঁজে নিতে।’ [ গ্রন্থসূত্র – কালের মন্দিরা – রঞ্জিত গুপ্ত]।
# # #
কাজরী রায়চৌধুরী ও বিতান ভৌমিক সম্পাদিত ‘কবিতাসমগ্র / পার্থ বন্দোপাধ্যায়’ পড়তে পড়তে এই নিবন্ধটি লিখতে প্ররোচিত হয়েছি। এতোক্ষণ যা লিখলাম, তা বেশীর ভাগই কবির কবিতা নিয়ে আমার প্রতিক্রিয়া, কবির জীবনের দু চারটে কথা। প্রসঙ্গক্রমে জানাই পেশাগত কারণে আমি বহির্বঙ্গে থাকতাম, তবুও পার্থদার সাথে আমার সামান্য কিছু ব্যক্তিগত যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল। মনে পড়ে, আমি মধ্যপ্রদেশ থেকে কোলকাতায়, যাদবপুর ইউনিভার্সিটির সত্যেনদা’র ক্যান্টিনে অপেক্ষা করছি, আমার ক্লাসমেট কবি তমাল ভৌমিকের সাথে দেখা করবো বলে। দেখলাম, কিছুক্ষণ পরে তমাল এলো, তার সাথে পার্থ বন্দোপাধ্যায়! তিনি সাহিত্য সংস্কৃতি রাজনীতি মহলে বেশ পরিচিত। আমি তো বিনা নোটিশে পার্থদা’কে দেখে অবাক! জানলাম, পার্থদা আমার সাথে নাকি দেখা করতেই এতোটা পথ পেরিয়ে এসেছেন। এম্নিভাবেই পার্থদা ছিলেন সবারই বন্ধু – তিনি যেমন আমার বন্ধু, তেমনি অনায়াসে সম্ভবতঃ আমার ছেলেরও বন্ধু!
এবার ‘কবিতাসমগ্র’ বইটি সম্পর্কে কিছু বলতে চাই।
এই বইটি নির্মাণে সম্পাদক-দম্পতি (কাজরী রায়চৌধুরী ও বিতান ভৌমিক) অত্যন্ত সক্রিয়তা দেখিয়েছেন। পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের মৃত্যুর অল্প কয়েকটা বছরের মধ্যেই তার সবগুলো লেখাকে জড়ো করেছেন, তাকে ২৭২ পৃষ্ঠার একটা সুন্দর বইএর আকার দিয়েছেন। হয়তো তাদের সাথে আরো কিছু বন্ধুসাথীরা ছিলেন, যারা পেছনে থেকে এই বিশাল কর্মকান্ডটিকে সম্পন্ন করতে সাহায্য করেছেন, যার সবটা আমি জানি না। তবে এক্ষেত্রে মূল উদ্যোগটি সংকলন সম্পাদক কাজরী ও বিতানেরই। মৃত্যুর পরে প্রায়শঃই কবি লেখকেরা হারিয়ে যায়, পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের মতো কবি ও একজন বিশেষ ব্যক্তির লেখাগুলোকে সংরক্ষিত রাখাটা অবশ্যই সময়ের বিচারে একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ – যা সম্পাদকদ্বয় করে দেখিয়েছেন।
‘কবিতাসমগ্র / পার্থ বন্দোপাধ্যায়’ বইটা হাতে নিলেই বোঝা যায়, এটা কোনো দায়সারা গোছের কাজ নয়। অত্যন্ত সুচারুভাবে সম্পাদিত এই কবিতাসমগ্রে রয়েছে গ্রন্থ বা বিষয়ভিত্তিক এক একটা পর্ব, পর্বের প্রথমে প্রত্যেকটি প্রকাশিত গ্রন্থের প্রচ্ছদের ছবি আছে, আর গ্রন্থভিত্তিক সূচি। পরিশিষ্টে আছে গ্রন্থতালিকা, প্রকাশকাল, প্রকাশকের নাম ঠিকানা। পরিশিষ্টে আরো আছে, পরিশ্রম করে তৈরী করা, সমস্ত কবিতাগুলোর বর্ণানুক্রমিক সূচি – যা ভীষণ উপযোগী।
কবিতাসমগ্রটা পরিপূর্ণতা পেয়েছে যে দুটো বিশেষ পর্বের সংযুক্তিকরণে – (১) পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের ‘পরিকল্পিত কাব্যগ্রন্থ’, যা কবি তার জীবিত অবস্থায় প্রকাশের আলোয় আনতে পারেন নি। (২)অন্য পর্বটা পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের ‘অগ্রন্থিত কবিতা’ – যেগুলো পান্ডুলিপি, ডায়েরী বা অন্য কোনো সূত্রে জোগাড় করে গ্রন্থিত করা অবশ্যই কষ্টসাধ্য কাজ। যদিও কবির পরিবারের ও কবিপত্নী রত্না বন্দ্যোপাধ্যায়ের সহযোগিতা এখানে উল্লেখযোগ্য। তবুও এই মূল্যবান সংকলনটার সম্পাদক হিসেবে কাজরী ও বিতানের নিষ্ঠা ও পরিশ্রমের প্রতি আমরা চিরকৃতজ্ঞ থাকবো।
যথেষ্ট মোটা সাইজের বই, কাগজের কোয়ালিটি, বাঁধাই, প্রচ্ছদ ইত্যাদি খুবই ভালো। সুন্দর প্রচ্ছদটি এঁকেছে তন্ময় মৃধা। বইটার মূল্য মাত্র চারশো টাকা, বইটার প্রকাশক – অন্যতর পাঠ চর্চা কেন্দ্র, কোলকাতা – ৭০০০৪৭। গ্রন্থটি উৎসর্গীকৃত হয়েছে, কোনো বিশেষ ব্যক্তি নয়, ‘কবিতার অনুরাগী পাঠকদের হাতে’। বইটাতে কবি পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের নিজস্ব হাতে লেখা পান্ডুলিপি, ব্লার্বে তার ছবিসহ সংক্ষিপ্ত পরিচিতি দেয়া আছে।
এই গ্রন্থটি প্রকাশ করার আগে বন্ধুপ্রতিম বিতান ভৌমিক জানিয়েছিল তাদের এই পরিকল্পনার কথা। তার সাথে কথাবার্তার মাধ্যমে কিছুটা অনুমান করতে পারি, সম্পাদকদ্বয় ও তাদের কাছাকাছি থাকা বন্ধুদের কতই না পরিশ্রম ও উদ্যোগ নিতে হয়েছিল পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের কবিতাসমগ্রটি প্রকাশ করবার জন্যে। বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে, এই গ্রন্থটি কোন বড় প্রকাশনা বা বিগ হাউজ পাবলিশার্সের আর্থিক বা ব্যবসায়িক আনুকুল্যে ছাপা হয় নি।
পরিশেষে আরো যে কথাটা বলতে চাই, কবির কবিতা পড়বার সাথে সাথে পার্থ বন্দোপাধ্যায়কে জানাটাও খুব জরুরী - গ্রন্থটির ‘ভূমিকা’র মধ্যে এই কাজটি খুব সুন্দর ভাবে পাঠকদের জন্যে করে রেখেছেন বিতান ভৌমিক। প্রায় ১৫ পৃষ্ঠা দীর্ঘ ভূমিকা জুড়ে রয়েছে পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের কবিতার আলোচনা, বিশ্লেষণ, কবির ব্যক্তিগত জীবনের নানা ঘটনা, সাল-তামামি। এই সুন্দর ভূমিকাটির জন্যে বিতান ভৌমিককে বিশেষভাবে অভিনন্দন জানাই।
সত্তর দশকের কবি পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের কবিতাসমগ্রটি বাংলা সাহিত্যে ঐতিহাহিক ভাবে একটা উল্লেখযোগ্য সংযোজন। উপরের আলোচনায় তার কবিতাসমগ্রর একটা পরিচয় দেবার চেষ্টা করেছি। আমার বারবার মনে হয়েছে এই কবির জীবনটাও স্বতন্ত্রভাবে আলোচনার একটা বিষয়। যার মধ্য দিয়ে সত্তরদশক ও তার পরবর্তী সময়ের সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক পরিস্থিতি ও শ্রমিক আন্দোলনের একটা ছবি আমরা খুঁজে পেতে পারি। আশা করি, ভবিষ্যতে পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের ‘গ্রন্থসমগ্র’ও প্রকাশিত হবে। তাতে তার সমগ্র সাহিত্য ও জীবন নিয়ে আরো বেশী আলোচনা ও চর্চার সুযোগ আমাদের সামনে হাজির হবে, এবং তা হবে সময়েরই প্রয়োজনে।

4 comments:

0

প্রবন্ধ - অম্লান রায় চৌধুরী

Posted in







যে দেশে দুর্নীতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ও সর্বজনগ্রাহ্য হয়ে ওঠে, সেখানে বিপদটা আসার আর বাকী নেই । এই বিষয়টাকে বুঝতে গিয়ে ঘরে ও বাইরে , দুদিক থেকেই আসা লড়াইটাকে সামলাতে গিয়ে দেখলাম বেশ গভীরতা ।

আসলে আমার আশঙ্কা , পশ্চিমবঙ্গ সহ সারা দেশের অধিকাংশ রাজ্যই কি তবে পৌঁছে গেল এমন একটি স্তরে, যেখানে দুর্নীতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ও সর্বজনগ্রাহ্য হয়ে উঠেছে?

এই কথা মনে হওয়ার কারণ হিসাবে সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা উপনির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের বিপুল জয়।

তবে, পাশাপাশি এ কথাটিও ভুললে চলবে না, আর জি কর কাণ্ডের পরেই এ রাজ্যের মানুষ যে ভাবে রাস্তায় নেমে দিনের পর দিন প্রতিবাদ করেছেন, সেই প্রতিবাদ কিন্তু কিছু অনুদানের পরিপ্রেক্ষিতে ভুলে যাওয়ার কথা নয়, বা এমনও নয় যে, শিক্ষক নিয়োগে পাহাড় প্রমাণ দুর্নীতির কথাও সাধারণ মানুষ ভুলে গিয়েছেন।

যদিও ঐ নিয়োগের দুর্নীতির ফল বেড়িয়ে গেছে , দুর্নীতি প্রমাণিত – দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে।

কাজেই শাসক নিয়েই এখন দেশের মানুষ চিন্তিত, তবে এ কথা সত্যি, শাসক পরিবর্তন করে ক্ষমতায় কাকে আনবে, তার দিশা আপাতত পশ্চিমবঙ্গে খুবই সমস্যার , কারণ নিরঙ্কুশ ভাবে গ্রহণীয় কথাটাই বোধ হয় আজকাল আর এখানে খাটেনা । শুধু দুর্নীতিটাই একমাত্র ইস্যু নয় ।

খোলা বাজারের কারণে মানুষ বা সমাজের সামনে অনেক দুয়ার খুলে গেছে , যেমন যার দ্বারা কিছুই হবেনা বলে ধরে রেখেছে তারই বাবা , সে এখন বিরাট প্রোমোটার হয়ে দুটো বাড়ির মালিক । অস্বাভাবিক মনে হয়না আজকাল । কা র ণ যোগ্য তা ব্যাপারটাই ঘেঁটে গেছে , যারা নিরুপন করবে , তাদেরও যোগ্যতার মাপকাঠি তে বিচার হয়নি । এরকমই একটা অবস্থায় চলছে ।

এগুলোর পেছনে যেটা কাজ করছে সেটা হলো – রাজনীতি যে সম্ভাবনাময় তারই ‘বহিঃপ্রকাশ’ বা ‘করোলারি’ । অনেক দিক খুলে দেয় , তারই একটা ছোট্ট সংস্করণ। ঐ ছেলেটিকে দেখে পাশের বাড়ির খোকাও বখে যাবে তারপরে কারুর হাত ধরে ঐ কাজই করবে ।

এটা একটা নিশ্চিন্তি , যার পক্ষে মাসে পাঁচ হাজার টাকা কামানো টা ছিল স্বপ্ন , সে পেলো হাতে দশ হাজার টাকা , ভগবান বলে তাকে তো মানবেই – যে দিলো টাকাটা -- এটাই করা হচ্ছে এবং হচ্ছে খুব ‘সুপরিকল্পিত’ ভাবে ।

শাসকের হাতে সারা দেশের সম্পদটাই ব্যবহার যোগ্য । নানান ভাবে । ঐ আমরা কিছু নাম দিয়েছি , গণতান্ত্রিক দেশ বলি তো , তাই , যেমন Municipality , panchyayat , gram sabha , যাদের হাতে থাকে দেশের সমগ্র খালি জায়গার লীজ । মানে শাসকের হাতে। সেটার ব্যবহার কেমন ভাবে হবে , কতটা আইন যোগ্য , কিভাবে আইনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখান হবে , সবটাই শাসকের নিয়ন্ত্রনে।

ঐ কাজগুলোকে শাসক দল আপাতভাবে লীজ নেয় বিভিন্ন সরকারি সংস্থার নামে’ , যেমন রাস্তা মেরামতের কাজ , গ্রামের পুকুর কাটার কাজ , জঙ্গল পরিস্কার করার কাজ – সবই করবে সরকারি দপ্তর , কিন্তু সিদ্ধান্ত শাসকের ।

কাজেই এগুলোই হলো শাসকের মুলধন, যার আশে পাশে মৌ মাছি ঘুরঘুর করবে, আর শাসক তাদের আটকাবে ও জালে পুড়বে , তোতা পাখী বানাবে । শাসন ক্ষমতা চালাবে এই ভাবেই ।

কেন তারা শুনবে , কারণ তাদের নিজের আওকাত নেই , সাধারণ প্রক্রিয়াতে নিজেদের জীবন যাপনে তারা অভ্যস্ত নয় , হয় চুরি ছিনতাই , না হয় লোক ঠকানো – মার দাঙ্গা – পয়সা নিয়ে দাঙ্গা কেনা , চিটীং বাজী করে , অথবা শাসকের ধামা ধরে ।

যারা তাদের নেবে , অবশ্যই সেই শাসককে হতে হবে মিশন লেস আন রেজিমেন্টেড অ্যাজেন্ডার কান্ডারী । কোনো নিশানা নেই – একমাত্র ভোটে জেতা ছাড়া।

সাধারণ পদ্ধতিতে স্কুল কলেজে পড়াশুনো করে , চাকরির পরীক্ষা দিয়ে , কিংবা স্পেসালাইজড কোনো কোর্স করে নিজেকে উপযুক্ত করবার ইচ্ছাটা তাদের হয়না , আমাদের ছোটো বেলায় দেখা , বাবা বলতেন , গ্রাজুয়েট হয়েছিস একটু টাইপটা শিখেনে। যদি ইংরাজী জানতাম , তাহলে শর্ট হ্যান্ডটাও শিখে নে , দেখি কোথাও স্টেনো গ্রাফারের চাকরী পাওয়া যায় কিনা । আজকাল সেখানে কম্পিউটার ও তারই অনুষঙ্গ অনেক কিছু হয়েছে ।

কিন্তু এ ক্ষেত্রে আলাদা কারণ, হয় তাদের মেধা নেই , না হয় কয়েক প্রজন্ম ধরে এর সাথে তাদের পরিবারের কোনো সম্পর্ক নেই । এদের রোজগার চিরকালই সরকার করিয়ে দেয় নানান রকম ভাবে। সংখ্যা আজও আছে , অনেক ।

শাসকের হাতে যদি এত কিছু থাকে নতুন কর্মসংস্থানের দিকে নজর দেবে কেন । নতুন শিল্প নিয়ে মাথা ব্যাথা করবে কেন ? লোক দেখান কিছু শিল্প মেলাই যথেষ্ট।

এই মানুষ গুলোই তো শাসককে অর্থ যোগাবে , শ্রম যোগাবে, ভোটের সময় বুথ আগলাবে -- দরকারে দুচারটে লাশও ফেলবে নির্ভয়ে , কারণ প্রশাসনের রক্ষা কর্তা যে পুলিশ, সেও তো অনেকটাই এ সমস্ত কাজের সাথে যুক্ত।

ঐ ‘বাধ্য’ থাকা ।

‘বাধ্যতা’ই সৃষ্টী করতে হবে । দেশের শাসকের কাছে সেটাই প্রথম কাজ ।

কেউ স্বভাবতই বাধ্য, ‘অবস্থার প্রেক্ষিতে’ --কেউ আবার , ‘আরো চাওয়ার দলে’, সেও বাধ্য - কেউ আবার, ‘বিপদ বা অপকর্ম সামলাতে ’, সেও বাধ্য – কেউ আবার চায়, ‘অবস্থার পরিবর্তন’ – সেও বাধ্য – যেমন , ঐ যাদবপুরের ছোট ফ্ল্যাট বেচে সাল্ট লেকের সরকারি আবাসনের তিন কামড়া ফ্ল্যাট , সুযোগ চাই ।

‘বাধ্যে’র এই বিচিত্র বিভাগ থেকে শাসককে বাছতে হয় – ‘প্রায়োরিটি’ ঠিক করতে হয় , তবে না চলে দেশ ।

শাসক সমস্যায় পড়ে তাদের নিয়ে যাদের বোঝা বড়ই মুশকিল । বর্তমানে এরা সংখ্যায় কম হলেও , এরা মেধাবী গোত্রের । বোঝার দিকটা বেশ প্রখর । কাছে আসে নানান কাজের মধ্য দিয়ে । শাসক কে ‘অবলিগেটেড’ করে তোলে বা তোলার ক্ষমতা রাখে – নিজেদের মেধার জোড়ে। আবার সেই সুবাদে বিশাল সুবিধাও নিয়ে নেয় ঐ তালে গোলে । শাসক কিছু ক্ষেত্রে বিপদেও পড়ে। দেখা গেছে ।

উদাহরণ দিয়ে লাভ নেই , আমাদের চোখে দেখা ,জানা , ঘুরে বেড়ানো মানুষ এরা।

দেশ চালানো কি অতই সহজ । অত সহজে কি চালানো যায় । আর এতদিন এ ভাবে টিকে থাকা যায় এ সমস্ত দিকগুলোকে না ভেবে। ।

তবে মানুষের অস্বস্তির প্রকাশ তো থাকবেই প্রতি বাদের মাধ্যমে । কাজেই প্রতিবাদ যদি হতে হয় – ঐ বাধ্যতা সৃষ্টীর অঙ্কুরেই আঘাত হানতে হবে। শিক্ষার মান বাড়াতে হবে , নইলে নিম্নমেধা রাজ করবে – যেমনটা বর্তমানে করছে – মেধার বৃদ্ধি মানেই আত্মনির্ভরতা – মানেই শাসকের আজ্ঞাবহ না হওয়া – মানেই নিজের মতবাদ তৈরি – ক্যাডারে ঘাটতি পড়বে , কোত্থেকে আসবে ক্যাডার যাদের আসার মূল কারণই নিজেদের কিছু করার সামর্থ নেই বলে ।

তবে আশার কথা হল মানুষ কিন্তু এখন নির্বাচনের চেয়েও প্রতিবাদের রাজনীতিতে আস্থা রাখতে চাইছেন। প্রমাণ বেশ মিলেছে গত কিছু সময়ে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির আঙ্গিনায় ।

কেবল বুঝছেনা প্রতিবাদের ভাষার রঙ্গটা কেমন হবে । এটা ঠিক যে অধিকাংশ মানুষই চান সুবিচার, অন্যায়ের প্রতিবাদ। প্রতিবাদের রাস্তাতেই যে একমাত্র আসল ন্যায়বিচার পাওয়া সম্ভব—সেই মানসিকতাই এখন পশ্চিমবঙ্গের বেশির ভাগ শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের মধ্যে কাজ করছে।

খুবই স্বাভাবিক , দেখা গেছে বিশেষত বেশ কয়েকটা ইভেন্টের পরে ।

যদিও আমার মনে হয়েছে যে, সাধারণ মানুষের অনেকেই বুঝেছেন নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় অন্য দলকে আনলেই যে ন্যায়বিচার পাওয়া যাবে এমন নিশ্চয়তা নেই , কারণ সিস্টেমের পচা ঘা সহজে যায়না – তবুও তুলুমূল্য বিচারের সময় এসেছে – মানুষকে বাছতে হবে – আধা এদিক আধা ওদিক করলে শাসক আবার বর্তমান শাসকের সব দোষগুলি নিয়ে নতুন রুপে আবির্ভূত হবে , যেটা কাম্য নয় ।

কাউকেই সংখ্যাগরিষ্ঠতার এমন একটা জায়গা দেওয়া যাবেনা যেখানে বিরোধীদের কন্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে যাবে । আমরা গণতান্ত্রিকতার মূল কাঠামো পাল্টাতে পারবোনা । কিন্তু কিছুটা সংশোধন বোধ হয় করার কথা ভাবা যেতে পারে।

সংখ্যা গরিষ্ঠতার মাত্রা বেশী হওয়ার ফলে দেখা যাচ্ছে একটা অহংবোধ , তার থেকে বেড়িয়ে আসতে হবে, কিভাবে ? কেবলমাত্র তখনই সম্ভব যখন শাসকের ভয় থাকবে, আসন হারানোর ভয়, ক্ষমতার থেকে দুরে চলে যাওয়ার ভয় থাকবে , ফেল করার ভয় থাকবে , তবেই দেশ বা রাজ্যকে ঠিকমতন বুঝবে । অর্থাত রোজ যেন পরীক্ষা দিতে হয় , প্রমাণ করতে হয় যে আমরা যা করছি সেটাই করা সম্ভব , আমার মনে হয় তখনই নাগরিক বেস্ট সরভিসটা পাবে। কি ভাবে করতে হবে সেটাকেই সাজাতে হবে – সবাইকে সাথে নিয়ে এক নির্মোহ আলোচনার মাধ্যমে।

এই গণতান্ত্রিক কাঠামোকে সামনে রেখে পরিবর্তনটাকে এফেক্টিভ করতে একটা বিচার, শুভবুদ্ধি সম্পন্ন নাগরিকের কাছ থেকে আশা করা বোধ হয় অমুলক নয় ।

0 comments:

0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in



















২০ (১)

বদ্রী পালোয়ান গেছে পড়শি জেলায় এক নওজোয়ানের জামিনের তদ্বিরে। ছেলেটির উপর ধর্ষণ ও মারপিটের মামলা শুরু হয়েছে। যাবার আগে রঙ্গনাথকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল—ব্যাটা মহা গুণ্ডা! যেখানে যায় একটা না একটা ঝঞ্ঝাট বাঁধিয়ে ছাড়ে।

তারপর বৈদ্যজীর থেকে দেড় হাজার টাকা নিয়ে জহরকোটের ভেতরের পকেটে ঠুঁসল। রঙ্গনাথের কৌতুহল—“এতগুলো নগদ টাকা এমন ভাবে নিয়ে যাওয়া”!

বদ্রীর জবাব,” গুণ্ডা শুধু এজলাসের নীচে কাঠগড়ায় নয়, উপরেও বসে রয়েছে।হাকিম তো তা-না-না-না করে জামিন দিয়ে দেবেন। কাগজ চলে যাবে কর্মচারিদের হাতে। তারপর বিশ রকম ঝামেলা। জামিনের উপযুক্ত কাগজ কই? কাগজ তৈরি কর। সম্পত্তির নকশা নিয়ে এস। তারপর সেটার যাচাই করা—কাঁচা এবং পাকা—সব হবে। এবং পদে পদে পয়সা ঠেকাতে থাক।

“ যারা ভাল মানুষ তারা জামিনের চক্করে না ফেঁসে জেলে পড়ে থাকা পছন্দ করে। নগদ নারায়ণের ব্যাপারই আলাদা—বড় আরাম। যেই হাকিম হেঁকে বলবে—একহাজার টাকার জামিন!

অমনই দশটা সবুজ কড়কড়ে নোট টেবিলে ছুঁড়ে দিয়ে বলব—নাও ভাই! রেখে দাও যেখানে তোমার ইচ্ছে”।

রঙ্গনাথ আরও জানতে চাইছে-“ বদ্রী দাদা, ব্যাটা যখন একনম্বরের গুণ্ডা তখন কেন হাত ময়লা করছ? পচুক না ব্যাটা জেলে”!

“ গুণ্ডা কে নয়? রঙ্গনাথ বাবু, ভেবে দেখ—গুণ্ডার মাথায় কী শিং বেরোয়”?

তারপর ধীর স্বরে বলল—“ আমি খালি এইটুকুই জানি যে ব্যাটা কখনও আমার আখড়ায় চ্যালাগিরি করেছিল। বাইরের লোকের চোখে ও যত বড় গুণ্ডাই হোক, আমার চোখে ওইদিন ভাসে যখন কুস্তির আখড়ায় ও আমার ল্যাং খেয়ে ছিটকে পড়ত”।

এবার ওর গলার স্বর আরও কোমল হয়ে খাদে নেমে এল,”যাই বল, আমারই তো পোষ্যপুত্তুর বটে”!

পোষ্যপুত্তুর শব্দের অমন লাগসই প্রয়োগ দেখে রঙ্গনাথ ভির্মি খেল। তবে ওর মাথায় একটা রিসার্চ পেপার লেখার চিন্তা ঘাই মারল—‘আধুনিক ভারতে পোষ্যপুত্তুরের মহত্ত্ব’।

“এই সেদিনও আখড়ায় এসে কাঁইচি মারা শিখছিল, এখন তো পুরোদস্তুর পালোয়ান”! বদ্রীর গলায় আবেগের ছোঁয়া।

রঙ্গনাথ বুঝতে পারল যে সব পোষ্যপুত্তুরের ক্যারিয়ার এভাবেই শুরু হয়।

প্রত্যেক মহাপুরুষের আশে পাশে পোষ্যপুত্তুরদের ভীড় লেগেই থাকে। পুরুষ মহাপুরুষ হয়ে গেলেই তাঁর সম্মান রাখার দায়িত্ব পোষ্যপুত্তুরদের ঘাড়ে এসে পড়ে। ওরা ওনার ইজ্জত নিয়ে টানাটানি শুরু করে দেয়। কিছুদিন গেলে ওই ইজ্জত ফেটে গিয়ে সহস্রধারায় বয়ে চলে।লোকসভা বিধানসভার বিতর্কে সেই ধারায় ভেসে যায়। খবরের কাগজ আর বেতারে তার ছিঁটে পড়ে দুর্গন্ধ ছড়ায়। সেই ধারায় পুরো গণতন্ত্র ডোবে আর ভাসে। শেষ হয় বেহায়াপনার মহাসাগরে লীন হয়ে।

বদ্রী পালোয়ান ব্যাখ্যান করতে শুরু করলঃ

“ঝগড়ার শুরু পড়শি এক বামুনকে নিয়ে---“

--- মহাপুরুষেরা সাধারণতঃ নিজের সিংহাসনে বসে পোষ্যপুত্তুরদের খেলাধুলো দেখতে থাকেন। এই দেশে মহাপুরুষ আর তাঁর পোষ্যপুত্তুর ছাড়া কিছু ঝামেলা পাকানোর লোকও থাকে। তারা কখনও সখনও মহাপুরুষের সামনে এসে চেঁচায়—“ ওগো মহাপুরুষ, তোমার পুষ্যিদের ভ্রষ্টাচার আর দুর্নীতির চোটে টেকা দায়। বড্ড বাড় বেড়েছে। তোমার ইজ্জত পাংচার হল বলে”।

এমন সময়ে মহাপুরুষেরা একটিই কাজ করে থাকেন।

“ কী বলছেন, ভ্রষ্টাচার! আসুন, আমরা সবাই মিলে আগে ঠিক করি ভ্রষ্টাচার কাকে বলে? তার সজ্ঞা কী”? রঙ্গনাথের চিন্তার স্রোত বয়ে চলে।

“তো পড়শি এক বামুন। ওর বৌয়ের ভরা যৌবন”।

ব্যস্‌, ওইটুকু শোনামাত্র রঙ্গনাথ তার ‘আধুনিক ভারতে পোষ্যপুত্তুরের মহত্ত্ব’ গোছের থিসিসের কথা ভুলে মনপ্রাণ দিয়ে বামুনের পারিবারিক কেচ্ছা শুনতে লাগল।

“--- আমার চ্যালা তার কাছেপিঠে কোথাও থাকত। বামুন-বৌয়ের সঙ্গে কয়েক মাস ওর ইন্টুমিন্টু চলছিল। বামুন সব জেনেও না দেখার ভান করত। একদিন হল কি, পর্দার আড়ালও রইল না। বামুন ফ্যালফ্যাল করে দেখল যে আমার চ্যালা ওর বৌকে জাপটে ধরেছে। কিন্তু সে ব্যাটা খানিক চোখ মিটমিট করে থলের মত চেহারা করে চুপচাপ কেটে পড়ল। এতে আমার চ্যালার হল মটকা গরম। ওর মন পরিষ্কার, বেশি জিলিপি প্যাঁচানো পছন্দ নয়। একলাফে এসে বামুনের ঘাড় ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল—কিঁউ বে, আমার সামনেই কেটে পড়ছিস, লাজ-লজ্জার মাথা খেয়েছিস? মরদ ব্যাটা, তোর একটু রাগও হল না? আরে সত্যিকারের মরদ হলে একবার আমাকে আওয়াজ দিয়ে দেখতিস্‌!

“ তো বামুন বেচারা করবেটা কী! মন্তর গোছের কিছু ফিসফিস করে আউড়ে দিল। তাতে খেপে গিয়ে আমার চ্যালা হাসিমুখে ওকে এক কাঁইচি মেরে চিৎ করে দিল। বেচারার ঊরুর হাড় গেল ভেঙে।

“তারপর চেঁচামেচি কান্নাকাটি সব শুরু হল। বামুন এবার গলা ফাটিয়ে চেল্লাতে লাগল। আবার ওর বৌ চিল-চিৎকার জুড়ল—দেখ দেখ, লোকটা আমার ইজ্জত লুটে নিচ্ছে।

এবার তুমিই বল রঙ্গনাথ বাবু, এই দুনিয়ায় কার শত্রু নেই? এতেই থানায় রিপোর্ট লেখানো হল আর আমার চ্যালা ফেঁসে গেল”।

বদ্রী পালোয়ান হাসতে লাগল, যেন খুব মজার কথা শুনিয়েছে।

রঙ্গনাথ –“কিন্তু বদ্রী দাদা, এটা কেমন হল? ----- আগে বেচারার বিবিকে --- তারপর ওকেও”--?

বদ্রীর হাসি থামছে না। “ রঙ্গনাথ বাবু, তুমি মুখ ফুটে বল, বা না বল—এটাই সত্যি। যে নিজের বৌকে সামলাতে পারে না , সে সারাজীবন বেচারাই থাকে। ওকে নিয়ে হা-হুতাশ করে কী হবে? আমার মাথাব্যথা নিজের চ্যালাকে নিয়ে”।


বদ্রী পালোয়ান ক’দিনের জন্য বাইরে যাওয়ায় রঙ্গনাথ আজ ছাতে একলাই শুয়েছে । শীত জাঁকিয়ে পড়েছে। শীতের মজা উপভোগ করবে বলে বদ্রী ওর খাটিয়া খোলা ছাতে লাগিয়ে শুচ্ছিল, রঙ্গনাথ ঘরের ভিতর।

রাত প্রায় এগারোটা। ওর ঘুম আসছে না।

খাটিয়ার পাশে একটা কাঠের বাক্সোর উপরে একটি ব্যাটারিতে চলা রেডিও রাখা। কাঠের বাক্সটিতে কলেজের জন্য বইপত্তর এসেছিল। বইপত্তর গেল প্রিন্সিপালের ঘরে আর বাক্সটা মেরামতের পর বৈদ্যজীর ঘরে। রেডিওটা কলেজের। তবে রঙ্গনাথ আসার পর কলেজ থেকে চেয়ে আনা হয়েছে। ওটা আসার পর রূপ্পনবাবুর ম্যাজিক বা কানে লাগিয়ে স্থানীয় রেডিও স্টেশন থেকে আবহাওয়ার খবর শোনার হেডফোনটা ফালতু হয়ে গেল। রেডিও সারাদিন বেজে চলে—সে ঘরে কেউ থাকুক বা না থাকুক। তবে রাতের কয়েক ঘন্টা বিশ্রাম।

এ’সময় রেডিওতে শাস্ত্রীয় সংগীতের কোন প্রোগ্রাম তার শেষ নিঃশ্বাস ছাড়ছিল, এবার যেন দাঙ্গা শুরু হল। ভায়োলিন আর তবলা একে অন্যের উপর ঘন্টায় দুশো মাইল বেগে হামলা করছে। মনে হচ্ছে, ওদের দুই গাড়ি সংঘর্ষের ফলে ক্র্যাশ করে টুকরো টুকরো হল বলে। চারদিকে হাহাকার। হঠাৎ ভায়োলিন বাদক তার পাতলা তারে একটা ‘কিরররররর—‘ ধ্বনি বের করল, রঙ্গনাথের কলজে যেন বল্লমের খোঁচায় এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে গেল! তক্ষুণি তবলায় যেন বোমা ফাটল। তাতে সঙ্গীত-নাটক-অ্যাকাডেমির ভবনের ভিত নড়ে উঠল। রঙ্গনাথ লাফিয়ে উঠে দেখতে লাগল—রেডিও আস্ত আছে তো?

নাঃ, সেটা ক্যাসাবিয়াংকার মত নিজের কাজে অচল অটল। সমানে সঙ্গীত জগতের কোস্তাকুস্তির ধারাবিবরণী দিয়ে চলেছে। মনে হচ্ছে, এবার ভায়োলিন ল্যাজ গুটিয়ে পালাচ্ছে আর তবলার হামলায় আরও জোশ এসে গেছে। রঙ্গনাথ ক্লান্ত হয়ে দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে রেডিওর কান মলে দিল।

ঘন অন্ধকার! শীতের রাত তার সমস্ত সৌন্দর্য নিয়ে আবির্ভুতা। এ’রম সময়ে লোকের মনে ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস হোক বা না হোক, ভূতের বিষয়ে বিশ্বাস জন্ম নেয়। রঙ্গনাথ ভয় পায়নি, কিন্তু ওর কেমন যেন লাগছে, অদ্ভুত কোন অনুভূতি। সত্যি বলতে গেলে এসব ভয় পাওয়ারই লক্ষণ।

কিন্তু ভয়ের চিন্তা ফিকে হয়ে গেল। কারণ, রঙ্গনাথ এখন রেডিও থেকে রূপ্পন বাবু, ফের রূপ্পন বাবুর থেকে বেলা নামে এক মেয়ের কথা ভাবছে। যাকে কখনও চোখে দেখেনি, কিন্তু কানাঘুষোয় শুনেছে যে রূপ্পনবাবু নাকি ওকে প্রেমপত্র লিখেছে!

ও জানেনা যে সেই প্রেমপত্রটি কত লম্বাচওড়া, আর কতটা গভীর। তবে গুজব হল—সেই চিঠির বাক্যগুলো নাকি অনেকগুলো সিনেমার গানের লাইন জুড়ে তৈরি। পাড়ায় বলাবলি হচ্ছে যে বেলার পিসি প্রথম সেই লাভ লেটার ঘরের এক কোণায় পড়ে থাকতে দেখে। তারপর সেটা বেলার বাবা গয়াদীনের সামনে পড়া হয়। গোড়ায় দু’একটা লাইন থেকে গয়াদীনের কিছুই বোধগম্য হয়নি।

কিন্তু তারপর এল এই লাইনটি-‘মুঝকো আপনে গল্লে (গলে) লাগালো ও মেরে হমরাহী’। এটা পড়ামাত্র গয়াদীনের জ্ঞানের কপাট ধড়াম করে খুলে গেল। বোঝা গেল এই অনুরোধ কেউ বেলাকে করেছে। চিঠির শেষ লাইন অব্দি পৌঁছতে পৌঁছতে এটার আসল চেহারা স্পষ্ট হয়ে গেল। কারণ, তাতে বলা হয়েছে—“ ইয়ে মেরা প্রেমপত্র পড়কর কি তুম নারাজ ন হো, কি তুম্মেরি জিন্দগী হো, কি তুম্মেরি বন্দগী হো”। লেখকের নাম “শ্রী রূ”।

শোনা গেছে, চিঠিটা গয়াদীন ছাড়া শুধু প্রিন্সিপাল সাহেবই দেখেছেন। তার কারণ গয়াদীন গিয়ে রূপ্পনবাবুর নৈতিক অধঃপতনের সঙ্গে, কেন যেন, প্রিন্সিপালের নামও জুড়ে দিয়েছেন। প্রিন্সিপাল ওনাকে বোঝাতে চাইলেন যে লেখাটা কোন লাভ লেটার নয়, বরং বেশ উঁচু স্তরের কাব্যসংগ্রহ। আর সেটার লেখক ‘শ্রী রূ’ হলেও তাতে কাব্যগুণ কিছু কম হয়নি। কিন্তু ভবি ভোলেনি। গয়াদীনের মতে এগুলো নোংরামির প্রমাণ। তারপরে প্রিন্সিপাল বেশ কিছু কবিতার লাইন শুনিয়ে বোঝাতে চাইলেন যে সাহিত্যে এমন সব উদাহরণ ঝুড়ি ঝুড়ি রয়েছে। তখন গয়াদীন চটিতং হয়ে বললেন—ওইসব কবিতার লাইন তোমার চরিত্র-দোষের প্রমাণ। শেষে দু’জনে মিলে ঠিক করলেন—ওই চিঠির কথা আর কাউকে জানানো হবে না।

পরের দিন থেকেই শিবপালগঞ্জের হাওয়ায় নানারকম খবর উড়ে বেড়াতে লাগল।

একটা খবরঃ খান্না মাস্টারের দলের কোন ছোঁড়া বেলাকে প্রেমপত্র লিখেছে, কিন্তু মিছিমিছি রূপ্পনবাবুর নাম জুড়ে দিয়েছে।

দ্বিতীয় খবরঃ বেলা রূপ্পনবাবুকে চিঠি লিখেছে। রূপ্পন তার জবাব দিইয়েছেন, কিন্তু সেটা গয়াদীনের হাতে পড়ায় ইজ্জতে গ্যামাক্সিন হয়ে গেছে।

তৃতীয় খবরঃ বেলা একটি খারাপ মেয়ে। --এই গল্পটাই বেশি প্রসিদ্ধ হল।

(চলবে)

0 comments:

0

ধারাবাহিক - শৌনক দত্ত

Posted in








নোবেল জয়ী হান কাং-এর লেখায় টুকরা টুকরা রক্তাক্ত জগৎ




প্রিয়বরেষু
বাসু,

তোমার চিঠি যখন হাতে পেয়েছি দোল পূর্ণিমার রঙ তখন আমার মর্মে লেগে আছে। কর্মব্যস্ত জীবন থেকে কয়েকটা দিন চুরি করে শান্তিনিকেতন কাটিয়ে এলাম। খুব চেয়েছিলাম তুমি আসো চুটিয়ে আড্ডা দেই তোমার সাথে। তুমি তো এলে না, হয়ত সত্যিই অসুস্থ ছিলে কিংবা নিছক অসুস্থতা দেখিয়ে এড়িয়ে গেলে। ভালোই হলো মুখোমুখি হলে হয়ত অতীতের অনেক কবর চাপা কথা জেগে ওঠতো। তোমার শরীর এখন কেমন? সুভাষ ডাক্তারকে তো সেই ছোটবেলা থেকেই দেখাচ্ছো এবার অন্য একজন ডাক্তার দেখাও। প্রায়শ তোমার অসুস্থতার কথা শুনি এত ঘনঘন অসুস্থতা ভালো লক্ষণ নয় মোটেই।

হারুকি মুরাকামি আমার প্রিয় লেখকদের একজন। তার লেখা আমাকে খুব ভাবায়। সম্প্রতি ইজরাইলি গল্পকার, স্ক্রিপ্টরাইটার ও ফিল্মমেকার এটগার কেরেটের লেখাও আমার বেশ প্রিয়। ২০২৪ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়া দক্ষিণ কোরিয়ার হান কাং কে তুমি কি পড়েছো? মানুষের জীবনের ভঙ্গুরতা, যন্ত্রণার কথা বার বার হানের কলমে উঠে এসেছে আর গদ্য হয়ে উঠেছে কবিতা। ফুটপাতে পুরানো বই ঘাঁটতে গিয়ে আমার হাতে আসে ২০১৬ সালে ডেবোরো স্মিথের অনুবাদে ইংরেজিতে হান কাংয়ের লেখা সবচেয়ে জটিল চিন্তার অভিনব উপন্যাস 'হিউম্যান অ্যাক্ট' যা 'সোনানিয়ন ওন্দা' নামে প্রকাশিত হয় ২০১৪ সালে। তখন থেকে আমি হানের লেখার সাথে পরিচিত কিন্তু এত জলদি সে নোবেল পাবে ভাবিনি।

হিউম্যান অ্যাক্টস লেখা হয়েছে দ্বিতীয় পুরুষের বর্ণনায়। ইতিহাসভিত্তিক এ উপন্যাসের ভাষা আদতে কাব্যিক। ছয়টি অধ্যায় আর শেষে উপসংহার নিয়ে মোট সাত খণ্ডের উপন্যাসটিতে আছে চুন ডু হুয়ান নামের এক সামরিক শাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী কিশোরের গল্প। স্কুলপড়ুয়া কিশোর দং হো ১৯৮০ সালের মে মাসে জড়িয়ে পড়ে সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে দানা বাধা গণতন্ত্রকামীদের আন্দোলনে। পরবর্তী অধ্যায়গুলোয় পাল্টে যায় পরিপ্রেক্ষিত। জেয়ং দে নামের আরেক নিহত কিশোরের বয়ানে এগোতে থাকে কাহিনি। পড়তে পড়তে কারও মনে পড়তে পারে ওরহান পামুকের মাই নেম ইজ রেড–এর কথা। এখানে নামহীন লেখকের চরিত্রটি হতে পারেন হান কাং নিজেই, যিনি গোয়াংজু অভ্যুত্থানের কিশোর শহীদ দং হোর কবরে মোমবাতি জ্বালিয়ে সম্মান জানিয়ে আসেন। তারপর সিউলে ফিরে উপন্যাস লিখতে শুরু করেন আন্দোলনের শহীদদের নিয়ে। হানের হিউম্যান অ্যাক্ট পড়তে শুরু করে আমি রীতিমত অবাক হয়েছিলাম। বইটির প্রেক্ষাপটের সঙ্গে আমাদের নকশাল আন্দোলন কিংবা সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের জুলাইয়ের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের অদ্ভুত মিল পাওয়া যায়। ১৯৮০ সালে কোরিয়ার গোয়াংজুতে সংঘটিত গণতান্ত্রিক আনন্দোলনের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে এই উপন্যাসের কাহিনি। সেসময় ঘটনাচক্রে আন্দোলনে যোগ দেয় উপন্যাসটির মূল চরিত্র স্কুল শিক্ষার্থী ডংহো। ছাত্র-জনতার এই আন্দোলন দমন করতে রাষ্ট্রীয় বাহিনী চরম নিপীড়ন চালায়। আন্দোলনকারী অনেক ছাত্রকে তারা হত্যা করে। স্কুল শিক্ষার্থী ডংহো এরকম বেশ কিছু মৃতদেহ উদ্ধার করে এবং তাদের লাশের উপর দক্ষিণ কোরিয়ার পতাকা বিছিয়ে দিতে দেখা যায়। যদিও বিক্ষোভকারীদের বেশিরভাগই ছিল ছাত্র এবং ডংহোর বয়স ছিল সবার চেয়ে কম, তবুও স্বৈরাচারী শাসকের নিপীড়নের উপর বিশ্বাস করা ছিল কঠিন। ডংহোর মা উদ্বিগ্ন অবস্থায় দিন কাটাতে থাকে।

সেসময় আন্দোলনকারীদের ধরতে রাতের বেলা রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে অভিযান চালাতে দেখা যায়। স্কুল ছাত্র ডংহোর সবচেয়ে কাছের বন্ধু জিয়োংকে তার চোখের সামনেই গুলি করে হত্যা করা হয়। হপ্তাখানেকের মাঝে জিয়োংয়ের বোন জিয়োংমি নিখোঁজ হয়। এমতাবস্থায় সেই এলাকায় রাতে অভিযান করার জন্য আসে বাহিনী। ডংহোর মা তাকে রাতে বাসায় না ফেরার জন্য বলে, কারণ ডংহোকে অভিযান করে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে মা উদ্বিগ্ন থাকে। উপন্যাসটি লেখক ডংহোর মৃত বন্ধু জিয়োংয়ের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বর্ণনা করা শুরু করে। সেখানে দেখা যায়, জিয়োং একটি লাশের স্তুপের মাঝে পরে আছে এবং সে বুঝতে পারছে তার নিখোঁজ বোন জিয়োংমিকেও সম্ভবত মেরে ফেলা হয়েছে। সে তার জীবিত বন্ধু ডংহোকে নিয়ে ভাবে এবং এসব হত্যাকান্ডের শাস্তি একসময় স্বৈরশাসক পাবে তার আশা ব্যক্ত করতে থাকে। ঠিক সেসময়ই সে বুঝতে পারে একদল রাষ্ট্রীয় বাহিনী এসেছে লাশের স্তুপের কাছে, জনগণ থেকে লুকাতে তারা লাশগুলো পুড়িয়ে দিতে চায়। হানের এই লেখা পড়তে পড়তে আমার নকশাল আন্দোলনের শোনা গল্পগুলোর কথাই মনে পড়তে থাকে।

তোমার নিশ্চয়ই পরাগ মিত্রের কথা মনে আছে। যার কাছে নকশাল আন্দোলনের গল্প শুনতাম আমরা। কমরেড কাকার কাছেও বহু ইতিহাস আমরা শুনেছিলাম। তাঁর মুখেই শোনা সেইসময় নকশালবাদে যোগদানের জন্য অনেক ছাত্র কলেজ পর্যন্ত ছেড়েছিল। চারু মজুমদার ছাত্রদের নকশাল আন্দোলনে যোগ দিতে প্রলুব্ধ করার জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। তিনি ঘোষণা করেছিলেন, এই বিপ্লব শুধুমাত্র গ্রামীণ জনগণের জন্য নয়, বরং যারা ‘শ্রেণী শত্রু’ তাদের বিরুদ্ধে লড়াই। এই শ্রেণী শত্রুর তালিকায় পড়বে সরকার থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ব্যবসায়ী, পুলিশ এবং আরো অনেকে। নকশালপন্থীরা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় দখল করে নেয়। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ এবং দিল্লির সেন্ট স্টিফেন্স নকশাল কার্যকলাপের জন্য অন্যতম ঘাটি হয়ে ওঠে। নকশালবাড়ি আন্দোলন বছরখানেকের মধ্যে অনেকটা স্তিমিত হয়ে এলেও অনেক বিশ্লেষকই মনে করেন, আজ পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় পরও সেই আন্দোলনের প্রাসঙ্গিকতা এবং তাৎপর্য বিন্দুমাত্র হারিয়ে যায়নি। এটি স্বাধীন ভারতের রাজনৈতিক সংগ্রামের ইতিহাসকে আমূলভাবে বদলে দিয়েছে। নকশাল আন্দোলন নিয়ে অনেক গল্প-উপন্যাস-গান-কবিতা লেখা হয়েছে। সমরেশ মজুদারের ‘উত্তরাধিকার’-এর চার প্রধান চরিত্র নকশালবাদ থেকে অনুপ্রাণিত হয়। বুকার পুরষ্কারজয়ী লেখিকা অরুন্ধতী রায়ের ‘দ্য গড অফ স্মল থিংস’-এর একটি চরিত্র নকশাল আন্দোলনে যোগ দেয়। মহেশ্বেতা দেবী তার ‘হাজার চুরাশির মা’ এই আন্দোলনের পটভূমিতেই লেখেন। পরে একই নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। ঝুম্পা লাহিড়ী, অনুরাগ মিশ্র, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সহ আরো অনেকের লেখনীতে নকশাল আন্দোলন বারবার উঠে এসেছে।

হান কাংয়ের লেখা কেমন? কী তাঁর উপন্যাসের মূল বিষয়? মূল ভাষার সৌন্দর্য বোঝার মুরোদ আমার নেই, তাই তাঁর অনুবাদক ডেবরা স্মিথের অনুবাদই ভরসা। তবে হিউম্যান অ্যাক্ট পড়ার পরে আমি খুঁজে খুঁজে তার অন্য উপন্যাসগুলো পড়েছি এবং পড়ার পরে মনে হয়েছে হান কাংয়ের লেখার গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, বাহুল্য বিবর্জিত লেখা। কলেবরের জায়গা থেকে অতি সংক্ষেপিত এবং মাত্র চারটি উপন্যাস লিখেই নোবেল জিতে নিয়েছেন তিনি। পৃষ্ঠার হিসেবেও সেটা ৬০০ থেকে কম। আমাদের পরিচিত অনেক লেখকের একটি উপন্যাসের চেয়ে কম, হান কাংয়ের সারাজীবনের গদ্য। চাইলে গোটা হান কাং পড়ে ফেলা যায় এক সপ্তাহে। বাহুল্য বিবর্জিত স্পষ্ট অথচ জটিল চিন্তার এই লেখাগুলোর দ্বারা দক্ষিণ কোরিয়ান কাব্যময় লেখার ভঙ্গিমায় হান কাং আমাদের নিয়ে যায় এমন এক জগতে, যেখানে বাস্তবতার ভয়াবহতা টের পাওয়া যায় ক্রমেই। মৃত লাশের মনে হতে থাকে জীবিত নিপীড়নের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা, অথচ আমাদের মনে হয়েছিল মৃত্যুই সবচেয়ে ভয়ঙ্কর।

হান কাংয়ের উপন্যাস ‘দ্য হোয়াইট বুক’ র পটভূমি হিসেবে এসেছে যুদ্ধ-পরবর্তী পোল্যান্ডের ওয়ারশ। নিরস্ত্র কথকের ছোট বোনের মৃত্যু সম্পর্কে খণ্ড খণ্ড চিন্তামগ্নতা নিয়ে তৈরি হয়েছে এই উপন্যাসের কাহিনি। জন্মের দুই ঘণ্টা পর মৃত্যু হয় শিশুটির। ‘দ্য হোয়াইট বুক’ উপন্যাসের উপস্থাপনশৈলীর মধ্যে নতুনত্ব লক্ষ করা যায়। দুঃখ, ক্ষতি এবং মানবাত্মার ভঙ্গুরতার কথা বলার জন্য ভাত, চিনির খণ্ড এবং বুকের দুধসহ মোট ৬৫টি সাদা বস্তুর বর্ণনা দেওয়া হয়েছে এখানে। এখানে উপস্থাপিত কাহিনির সঙ্গে লেখকের বাস্তব জীবনের অনেক মিল পাওয়া যায়, বিশেষ করে তাঁর বোনের শিশুবেলার মৃত্যুর সঙ্গে। হান কাংয়ের আরেক উপন্যাসের নাম ‘গ্রিক লেসনস’। উপন্যাসে বাকশক্তি হারানো একজন নারী প্রাচীন গ্রিক ভাষা পাঠ করার সিদ্ধান্ত নেয়। যার কাছে পাঠ নেবে তারও অবস্থা ওই নারীর মতোই: ধীরে ধীরে সে দৃষ্টিশক্তি হারাতে থাকে।
তবে এ উপন্যাসে দেখানো হয়েছে, ভালোবাসার প্রায়শ্চিত্তমূলক শক্তির মধ্যে আশাবাদী ও মানবীয় বিশ্বাস নিহিত থাকে। কারণ তাদের পাঠদান ও পাঠগ্রহণের প্রক্রিয়ায় পারস্পরিক ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। একজন আরেকজনের মানসিক যন্ত্রণা ও দুশ্চিন্তার কথা জানতে পারে, অনুভব করতেও পারে। পর্যায়ক্রমে তারা আরো নিকটবর্তী হতে থাকে। ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশের পর হান কাংয়ের এই উপন্যাস বিশ্বের বিভিন্ন এলাকায় ইতিবাচক সাড়া পায়।

এই সবগুলোই হয়ত তোমার পড়া কিন্তু আমাকে অবাক করেছে ১৯৭০ সালের শেষে জন্ম নেয়া হান কাং লেখালেখি শুরু কবিতার মাধ্যমে ১৯৯৩ সালে। একটি সাহিত্য ম্যাগাজিনে ছাপা হয় তার পাঁচটি কবিতা। পরের বছর ঔপন্যাসিক হিসেবে অভিষেক হয় তার। তিন দশকের লেখালেখিতে আন্তর্জাতিকভাবে তিনি নজরে আসেন অনেক পরে। ২০০৭ সালে প্রকাশিত 'দ্য ভেজেটেরিয়ান' উপন্যাসটি ইংরেজি অনুবাদে প্রকাশিত হয় ২০১৫ সালে। হিসেব করলে হান কাংয়ের আন্তর্জাতিক পরিচিতি মোটের উপর দশ বছর। এত কম সময়ের পরিচিতিতে নোবেল পুরস্কার জেতার ঘটনা আগে সেভাবে ঘটেনি। তার উপর এবারে নোবেল প্রত্যাশী যেসব লেখকদের নাম সামনে আসছিল, হান কাং তাদের মেয়ের বয়সীই হবে। এর বাইরেও মজার একটি বিষয় হলো, ২০১২ সাল থেকে (কাজিও ইশিগুরো ব্যতিরেকে) এক বছর পরপর সাহিত্যে নারী লেখককে নোবেল জিততে দেখা যায়। ২০২৪ সালের নোবেলেও এই ধারাবাহিকতা দেখা গেল। সব মিলিয়ে এবারের সাহিত্যের নোবেল বেশ অদ্ভুতই বটে। তুমি হান কাংয়ের কি কি পড়েছো জানিও। তুমি আরো গভীরভাবে হান কাংয়ের লেখার বিশ্লেষণ করতে পারবে আমি জানি।

হান কাংয়ের দ্য ফ্রুট অব মাই উওম্যান উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে একটা অভিনবত্ব চোখে পড়ে মোট আটটি কাহিনির সমন্বয়ে তৈরি হয়েছে এ উপন্যাস। এখানকার ভিন্ন ভিন্ন পর্বে মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের ব্যর্থতার চিত্র দেখানো হয়েছে। বেশির ভাগ জায়গায় তারা জীবনে কোনো আশা দেখতে পায় না। ‘মাই উওম্যান’স ফ্রুট’ অংশে হতদরিদ্র জেলেপল্লীতে জন্ম নেওয়া এক নারীর কথা বলা হয়েছে। নিজের চেষ্টায় সে পৃথিবীর শেষ প্রান্তে যেতে চায়। তবে তার বিশ্বাস হলো, জগতের রূপ দেখতে হলে বিয়ে করাও দরকার। সে জন্য স্বামীর সঙ্গে আগে সংসার পাতে সে। কিন্তু কিছুদিন পর তারা একে অন্যের প্রতি আর টান অনুভব করে না। এক পর্যায়ে স্বামীর কাছ থেকে দূরে কোথাও পালিয়ে পাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সে। কিন্তু সেই চেষ্টাও ব্যর্থ হয়। তারপর সে গাছ-লতা হয়ে ঘরের ছাদ পেরিয়ে যাওয়ার কথা কল্পনা করে। এ উপন্যাসে দেখানো হয়েছে মানসিক ক্লান্তি আর আধুনিক জীবনের নিরাশা পেরিয়ে যাওয়ার মতো মানুষের ইচ্ছাশক্তি থাকার বিষয়। তবে দ্য ফ্রুট অব মাই উওম্যান গল্পটির ভাবকাঠামোর পরিশীলিত রূপান্তর ঘটিয়ে দীর্ঘ দশ বছর পর ২০০৭ সালে এই গল্পটিকেই তিনি দ্য ভেজিটারিয়ান উপন্যাসে রূপ দেন। এক নারীর নিরামিষাশী হওয়ার সিদ্ধান্তের ফলে পারিবারিক সংকট আর সামাজিক নিষ্ঠুরতার গল্পকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে দ্য ভেজিটারিয়ান। এটি লিখতে তিনি তিন বছর সময় ব্যয় করেন। এটির কেন্দ্রীয় ও নারী চরিত্রকে ঘিরে গড়ে ওঠা অন্যান্য চরিত্রের পটভূমি এবং গাছপালা ও সূর্যকিরণের চিত্রকল্পের আবহ তৈরির জন্য তিনি অনেক ভাবনাচিন্তা ও পর্যবেক্ষণ করে মাসের পর মাস খেটে উপন্যাসটি সমৃদ্ধ করেন। দ্য ভেজিটারিয়ান তিনটি পর্বে বিভক্ত। ভয়ানক দুঃস্বপ্ন দেখে অসুস্থ হওয়ার পর মাছ–মাংস খাওয়া ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ইয়েয়ং হাই নামের এক বিবাহিত নারী। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে তার স্বামী চেইয়ং দেখতে পায় ফ্রিজ থেকে সব প্রাণিজ আমিষ খাদ্য ফেলে দিচ্ছে সে। নিজে নিরামিষভোজী হয়েই ইয়েয়ং ক্ষান্ত নয়, স্বামীর জন্যও মাছ–মাংস রাঁধতেও সে অস্বীকৃতি জানায়। শান্তভাবে বলে যে দিনের মধ্যে দুই বেলাই যেহেতু চেইয়ং বাইরে খাওয়াদাওয়া করে, তাই এক বেলা নিরামিষ খেলে তার এমন কিছু ক্ষতি হবে না। উপন্যাসের প্রথম পর্বে ইয়েয়ংয়ের ভেজিটারিয়ান হওয়া নিয়ে অস্বস্তি, যা ক্রমে পারিবারিক সংকট, অতঃপর সংঘাতের রূপ নেয়—সেটুকু ইয়েয়ং হাইয়ের স্বামী চেইয়ংয়ের বয়ানে, সোজাসাপটা ভাষায় লেখা। মাঝেমধ্যে কেবল কিছু অংশ লেখা হয়েছে ইটালিকে। বুঝতে অসুবিধা হয় না, সেগুলো ইয়েয়ং হাইয়ের স্বপ্নের বিবরণ। তাতে যত না কাব্য, তার চেয়ে বেশি আছে ভয়ানক সব নৃশংসতার চিত্র। রক্তাক্ত, বীভৎস সেই সব দুঃস্বপ্ন ইয়েয়ংকে ভয়ানকভাবে তাড়া করে। স্বপ্ন ভেঙে জেগে ওঠার পর প্রাণী হত্যা আর মাংস ভক্ষণের পুরো প্রক্রিয়াটি অস্বাভাবিক নিষ্ঠুর বলে মনে হয় তার কাছে। যদিও প্রতি বেলা মুরগি, গরু, শূকর, অক্টোপাসসহ নানা ধরনের মাছ–মাংস সব সময়ই ছিল তাদের খাদ্যতালিকায়। ইয়েয়ং হাই নিজে খুব ভালো রাঁধুনি। ছোটবেলায় মায়ের কাছে প্রায়ই ওয়েস্টার খাবারের জন্য বায়না করত।

দ্বিতীয় পর্বে ‘মঙ্গোলিয়ান মার্ক’ লেখা হয়েছে সর্বদ্রষ্টা বক্তার (ওমনিশ্যান্ট ন্যারেটর) ভাষায়। এখানে মূল দৃষ্টিভঙ্গি ইয়েয়ং হাইয়ের ভগ্নিপতির। আর তৃতীয় পর্ব ‘ফ্লেইমিং ট্রিজ’–এর বক্তা ইয়েয়ং হাইয়ের বোন ইন হাই। তিনটি অংশের মাঝখানে সময়ের ব্যবধান দুই বছর করে। মূল চরিত্রের সরাসরি বক্তব্য খুব অল্প পরিমাণ হলেও তার প্রাণী হত্যা নিয়ে পরিবর্তিত মনোভাব অনেকটাই বোঝা যায়। নিজে খাওয়ার জন্য অন্য প্রাণকে ধ্বংস করার ব্যাপারটি সহ্য করতে না পারা ইয়েয়ং একপর্যায়ে স্বামীর ‘শরীরে মাংসের গন্ধ’ পায় বলে তার সঙ্গে যৌন সংসর্গও ত্যাগ করে। স্বামীর বয়ানে জানা যায়, এই প্রত্যাখ্যানের ফলে ইয়েয়ংকে বৈবাহিক ধর্ষণের শিকার পর্যন্ত হতে হয়।

ইয়েয়ং হাইয়ের নিজের শরীর ও জীবনের ওপর তার অধিকার না থাকার বিষয়টির উল্লেখ করে এ আখ্যানকে তার আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার লড়াই হিসেবে দেখেছেন দ্য ইনডিপেনডেন্ট–এর বিশ্লেষক জুলিয়া পাসকাল। দ্য অস্ট্রেলিয়ান বইটিকে অদ্ভুতুড়ে বা ‘আনক্যানি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। গ্যাজেট ভ্যান আনটওয়েরপেন বলেছে, এটি হারুকি মুরাকামির ভক্তদের জন্য উপযোগী এক বই। আবার দ্য আইরিশ টাইমস একে দেখছে নারীদের প্রতি নিষ্ঠুরতার আখ্যানরূপে। আর দ্য গার্ডিয়ান–এর মতে, এই উপন্যাস নানা পীড়াদায়ক প্রশ্ন সামনে নিয়ে আসে।

উপন্যাসে হান কাং এমন এক দুনিয়ার চিত্র তুলে ধরেন, যা দৈনন্দিনতায় ভরা; কিন্তু খানিকটা বীভৎস, অদ্ভুত। পারিবারিক পরিস্থিতি বর্ণনার মধ্য দিয়ে তিনি উপস্থাপন করেন সমাজের সেসব রক্তাক্ত অনুভূতি, সচরাচর যেসব জনসমাজের সামনে আসে না। দ্য ভেজিটারিয়ান–এ বিষয়গুলো যেমন পোক্তভাবে উপস্থিত, তেমনি আছে হিউম্যান অ্যাক্টস–এও। মহান সাহিত্য যা করে, খবরের কাগজে পড়ে ভুলে যাওয়া একেকটি তথ্য বা গল্পের পেছনের বিশাল আখ্যানটিকে মহাকাব্যের মতো বিস্তৃতিতে নিয়ে যায়—হিউম্যান অ্যাক্টসও একই কাজ করেছে। ডং হো নামের কিশোরও হানের ছোটবেলায় পাওয়া সেই স্মরণিকা থেকে উঠে আসা। গোয়াংজুর গণহত্যার সময় নিহত আরও নাম না জানা কিশোর-তরুণেরাও উপন্যাসের চরিত্র হয়ে এসেছে। হান কাংয়ের কলমে বিভিন্ন নামের এসব শহীদ আসলে কাল্পনিক কোনো চরিত্র নয়। গোয়াংজু অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে লেখা হিউম্যান অ্যাক্টস–এর সঙ্গে পাঠকেরা নকশাল বা সম্প্রতি বাংলাদেশে ছাত্র–জনতার যে অভ্যুত্থান ঘটল, তার মিল পেতে পারেন।

খুব বেশি না লিখেও দক্ষিণ কোরিয়ার নোবেলজয়ী এই কথাশিল্পী আখ্যান রচনায় অনন্য আর নিজস্ব শৈলী সৃষ্টিতে সমর্থ হয়েছেন। দ্য কনভারসেশন–এর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে হান কাং যে কথা বলেন, সেটি হয়তো তাঁর লেখালেখির মূল মন্ত্র। কাংয়ের কথা হলো, মূলত তাঁর উপন্যাস মানবজীবনের যন্ত্রণা আর বেদনা নিয়ে লেখা। মানুষের প্রতি মানুষের অমানবিক বর্বর আচরণ, অসহনীয় নির্মমতা তাঁকে খুবই পীড়া দেয়।

এ কারণেই কি হান কাংয়ের লেখার অন্দরমহলে এত চাপা রক্তের ছাপ দেখা যায়, আর একের পর এক তিনি লিখতে থাকেন রক্তাক্ত মানুষের গল্প?

কোরিয়ান চলচ্চিত্রে যাঁদের আগ্রহ, তাঁরা এ ব্যাপারে একমত হবেন যে হত্যা, মৃত্যু, নৃশংসতাকে অন্য এক দৃষ্টিতে দেখার আর দেখানোর প্রবণতা আছে কোরিয়ানদের মধ্যে। সম্প্রতি অস্কার পাওয়া ছবি প্যারাসাইট–এও আমরা দেখেছি চরম দারিদ্র্যের ফলে মানবিক অধঃপতন এবং এর সমান্তরালে ধনকুবের এক পরিবারের বিলাসী জীবনযাপনের প্রতি বিদ্বেষ; ফলাফল হত্যা আর নিষ্ঠুরতা।

কাংয়ের লেখায় যে টুকরা টুকরা রক্তাক্ত জগৎ, যে নিষ্ঠুরতা, তা বৃহদাকারের নয়, অনেকটা ফুটকির মতো; কাব্যিক ভাষার আচ্ছাদনে অজস্র রূপক দিয়ে ঘেরা। তাঁর উপন্যাসে ডুব দিলে অনুভব করা যায় সেই ‘আনক্যানি’ ভরা দুনিয়াকে।

বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা সহ-

তোমার সুস্মি
১২ এপ্রিল,২০২৫

0 comments:

0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in




















জেরাল্ডের এপার্টমেন্টেরও জেরাল্ডের মতই দু’খানা আলাদা সত্তা আছে। তাদের একজনের সঙ্গে আরেকজনের কোনও বিরোধ নেই। একজন আরেকজনের ব্যাপারে নাক গলায় না এবং একজন আরেকজনকে এতটুকুও জায়গা ছেড়ে দেয় না। সত্তা দুটি এতটাই আলাদা যে সত্যি সত্যিই একজনের সঙ্গে আরেকজনের সাক্ষাৎ হবার কিম্বা মিলেমিশে কাজ করবার সেরকম কোনও অবকাশ তৈরি হয় না। অবশ্য তাদের মালিকানা রয়েছে একজন মানুষের হাতে এবং সেই মানুষটির চারপাশের পরিবেশের মধ্যে একসঙ্গে ও প্রায় একই সময়ে তাদের স্ফুরণ ঘটতে থাকে। জেরাল্ডের প্রকৃত সত্তা কোনটি তা কেউ বলতে পারে না, এবং তিনি নিজেও যে কেন কোনও বিশেষ একটিকে অগ্রাধিকার দেন না, সেই বিষয়টা জানা যায় না। কিন্তু প্রাধান্য দেবার প্রাসঙ্গিকতা এখন শুধু গৌণ নয়, বেশ দেরি হয়ে গেছে। অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর, পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সের যুবক জেরাল্ড সন্দেহাতীত ভাবে দ্বৈতসত্তার অধিকারী। তবে তার সঠিক কারণটা কারো কাছেই বোধগম্য নয়। হয়তো বা শারীরিক এবং মানসিকভাবে তিনি খুব দুর্বল ছিলেন শিশু বয়সে। এমনটিও বলা হয় যে তাঁর রক্তে বিচিত্র জাতির মিশ্রণ ঘটেছে। তাঁর মা ছিলেন এক ইহুদি বিদ্বান পণ্ডিত ব্যক্তির কন্যা এবং তাঁর বাবা উত্তর ফ্রান্সের কৃষক পরিবারের সন্তান, যে পরিবারে এক দু’জন ধর্মযাজক ছাড়া বেশির ভাগ মানুষ ছিল ক্ষেতখামারের মালিক। জেরাল্ড তাঁর পূর্বজদের সম্বন্ধে উল্লেখ করতে পছন্দ করতেন, যেমন মনস্তত্ত্ব বিষয়ে আগ্রহের বিষয়টা তিনি সম্ভবত তাঁর পিতামহের থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছেন। তাঁর পিতামহ ছিলেন একজন যাজক। বিশাল বিদ্বান না হলেও তিনি ছিলেন সুবক্তা এবং মানুষের মন ও আত্মাকে পড়ে ফেলবার এক অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল তাঁর। অপরপক্ষে মানুষ বিষয়ে জেরাল্ডের বাবার সেরকম আগ্রহ ছিল না। তিনি কাঠখোট্টা, লাজুক প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। এক কৃষককন্যাকে বিবাহ করে গ্রামের খামারবাড়িতে বসবাস করে নিস্তরঙ্গ জীবন কাটানো ছাড়া বিশেষ কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল না তাঁর। কিন্তু খামারের মালিকানা আসলে ছিল জেরাল্ডের বাবার খুড়তুতো দাদার এবং অবশেষে জেরাল্ডের বাবা কৃষককন্যার বদলে প্রফেসর রোজেনদালের জ্ঞানী এবং পরিশীলিত স্বভাবের কন্যাকে বিবাহ করেছিলেন। সেই কন্যার ত্বক ছিল সম্পূর্ণ সাদা এবং হাতগুলো ছিল ভীষণ ফ্যাকাসে। জেরাল্ডের বাবা প্যারিস গিয়েছিলেন আইন বিষয়ে পড়াশুনা করবার জন্য, যদিও সে কার্যক্রম আর শেষ করে উঠতে পারেননি। এক বন্ধুর মাধ্যমে প্রফেসর রোজেনদালের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল তাঁর। একাকিত্ব, কঠোরতা এবং নিজস্ব ক্ষোভের বাতাবরণ সামলে উঠতে উঠতে কী ভাবে যেন প্রফেসর রোজেনদালের কন্যার প্রেমে পড়েছিলেন তিনি। প্রথমে যদিও সেই কন্যাকে খুব অদ্ভুত মনে হত তাঁর। ওই কন্যার সৌন্দর্য তাঁর মনে অদ্ভুত ভীতির উর্দ্রেক করতো এবং আসলে তিনি সেই কন্যাকে ঘৃণা করতেই চেয়েছিলেন। মেয়েটি তাঁকে বন্য জন্তুর মত মনে করে, এ কথা বুঝতে পেরে মনে ব্যথা পেয়েছিলেন তিনি। কালেভদ্রে মেয়েটি তাঁর সঙ্গে কথা বলত। যেটুকু বলত, সে কথা ভারি সংযত। যদিও মেয়েটি খুবই জ্ঞানী ছিল, তবুও তাঁর সঙ্গে ছোটখাট সাধারণ বিষয়েই কথাবার্তা হত। মেয়েটি জানত যে সে ছাত্র, পড়াশুনা করে; তবুও ভারি ভারি তত্ত্বের কথা কোনো দিন বলেনি তাঁর সঙ্গে। তিনি অনুভব করেছিলেন যে সেই মেয়েটিও তাঁর প্রেমে পড়েছে। একদিন কাছে ডেকেছিলেন মেয়েটিকে এবং ধর্ষণ করেছিলেন। অবশেষে তাঁদের বিবাহ হয় এবং জেরাল্ডের জন্ম হয়। জন্মের সময় জেরাল্ডের মায়ের অবস্থা মরোমরো হয়েছিল, কারণ শিশু এত বিশাল আকারের ছিল যে সবাই ভেবেছিল বড় হয়ে বাবার মত দৈত্যাকৃতি চেহারা হবে। কিন্তু পাঁচ বছর বয়সে তাঁর ভারি অসুখ করেছিল এবং বাড়বৃদ্ধি কমে গিয়েছিল। ছোটখাট চেহারা নিয়েই বেড়ে ওঠেন তিনি; প্রাপ্তবয়স্ক হবার আগেই মায়ের মৃত্যু ঘটে। তাঁর বাবা প্যারিস শহরটার সঙ্গে কখনই নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারেননি; ফলে জেরাল্ডকে পড়াশুনার জন্য প্যারিসে রেখে দিয়ে তিনি গ্রামে ফিরে যান তাঁর নিঃসন্তান খুড়তুতো দাদার রেখে যাওয়া খামারবাড়িতে।

সেই থেকে জেরাল্ড নিজের মত থাকেন। তিনি ডাক্তারি পড়েছিলেন; প্যারিসের হাসপাতালে কয়েকবছর শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ করতে করতে শল্যচিকিৎসক হিসেবে বেশ পাকাপোক্ত হয়ে উঠেছিলেন এবং বুঝতেও পারেননি যে কবে যেন তিনি এক বিখ্যাত মানুষ হয়ে উঠেছেন। এই পর্বের শুরুতেই যে দু’খানা সত্তার কথা উল্লেখ করা হয়েছিল, সেই বিষয়টার সঙ্গে জেরাল্ডের এক বিশেষ প্রতিভার গূঢ় সম্পর্ক আছে। যেমন, তাঁর একটা অদ্ভুত মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণী ক্ষমতা আছে। শল্যচিকিৎসক হিসেবে অবশ্য সেই প্রতিভার সদ্ব্যবহার করবার সুযোগ পান না তিনি। কিন্তু শল্যচিকিৎসক হিসেবে অনেক বেশি মানুষের সঙ্গে পরিচিতি ঘটবার সুযোগ থাকে এবং অনেক বেশি সংখ্যক মানুষকে তাঁর পর্যবেক্ষণের আওতায় নিয়ে আসতে পারেন। জেরাল্ড একেবারেই কৌতূহলী ব্যক্তি নন। যাঁদের পর্যবেক্ষণ করবার জন্য তাঁর আগ্রহ জন্মায়, তাঁদের তিনি একটু আলাদাভাবে খাতির করেন। তাঁদের জীবন বিষয়ে অবশ্য তিনি কিছু জানতে চান না। তাঁদের কার্যকলাপ অথবা মানুষ তাঁদের সম্বন্ধে কী বলে, সেসব নিয়েও তিনি এতটুকুও মাথা ঘামান না। কিন্তু তিনি তাঁদের সঙ্গে দেখা করেন, ধীরস্থির ভাবে তাঁদের দিকে চেয়ে থাকেন, নানা কথাবার্তা বলেন, তাঁদের মুখমণ্ডলে আনন্দ অথবা বিষাদের অভিব্যক্তি লক্ষ্য করতে থাকেন নিবিষ্টমনে। তাঁদের হাত নাড়া, চলাফেরা, বসে থাকা কিম্বা দাঁড়ানোর ভঙ্গিমা, কে কী ভাবে সিগারেট ধরাল… এইসব… সব কিছুই যেন মানুষগুলির মনোজগতের দরজা খুলে দেয় জেরাল্ডের কাছে। তিনি দাবি করেন যে অনেককিছুই মানুষ লুকিয়ে রাখতে পারে, কিন্তু বাইরের চেহারায় মানুষের মনের ছবি ফুটে উঠবেই। মানুষের মনের ছবি খুঁজে বের করবার ইচ্ছেটাই জেরাল্ডের আগ্রহের প্রধান চালিকাশক্তি। তিনি প্রতারিত হতে চান না এই ব্যাপারে। সব সময় সত্যিটা খুঁজে বের করতে মন চায় তাঁর। বিভিন্ন বস্তুর আপেক্ষিকতা তাঁকে দীর্ণ করে। তিনি শিখেছেন যে মানুষকে মূল্য দেওয়া উচিত এবং কেউ কেউ তাঁকে এই শিক্ষা দিয়ে যায় যে তাঁর এই ভাবনা সম্পূর্ণ ভুল। যে ভাবে উৎকৃষ্ট শিল্পকর্মের নির্দিষ্ট মূল্য থাকে, সেইভাবেই মানুষকেও মূল্য দেওয়া উচিত বলে মনে হয় তাঁর; কিন্তু মাঝেমাঝে তিনি ভুল প্রমাণিত হন। কারণ, সবার সেই মূল্য পাবার যোগ্যতা থাকে না। মূল্য এবং অযোগ্যতার মধ্যে পার্থক্য না করতে পারার অক্ষমতা অবশ্য খুব বেশি বিরক্তিকর ব্যাপার নয়। কিন্তু অপরপক্ষে জেরাল্ড অনুভব করেন যে, বিপরীতে, তার এই ক্ষমতার সঙ্গে কল্পনা বা আত্মবিশ্বাসের কোনো সম্পর্ক নেই; মানুষের যেমন দৃষ্টিশক্তি থাকে, ঠিক তেমনই এটি একটি শক্তি, একটি প্রতিভা এবং অবিশ্বাস্যভাবে তিনি এই ক্ষমতার অধিকারী। ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলবার জন্য তিনি শব্দ হাতড়ে ফিরতে থাকেন। এই ক্ষমতার গুণগত বৈশিষ্ট্য কথায় প্রকাশ করতে গেলে সেরকম কোনও নির্দিষ্ট নিয়ম কিম্বা আইন নেই। উদাহরণস্বরূপ বলা চলে যে, নৈতিকতার মান দ্বারা মানুষকে বিচার করা চলে না এবং শিল্পকীর্তিগুলিও সব সময় সৌন্দর্যের মান দ্বারা বিচার করা সম্ভব হয় না। কারণ নৈতিকতা নির্বিকল্প নয়, এবং সৌন্দর্য মানুষের স্বাদের মত পরিবর্তনশীল। তবে যে সৌন্দর্য চিরকালীন এবং শাশ্বত, তার সঙ্গেই হয়তো বা একমাত্র তুলনা চলে জেরাল্ডের এই বিশেষ ক্ষমতার গুণমানের বিধিগুলির। যদিও বিষয়টা পুরোপুরি শিল্পকলার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা যায় না, কারণ বিশ্বসংসারের নানা বিচিত্র প্রাণময় এবং জড়বস্তু… সব, সবকিছুর প্রতি জেরাল্ড আকর্ষিত বোধ করেন এবং এই আকর্ষণের মধ্যেই লুকিয়ে আছে তাঁর এই বিশেষ ক্ষমতার রহস্য।

আমরা দেখতে পাচ্ছি যে জেরাল্ডকে আর পাঁচটা সাধারণ দ্বৈতসত্তাসম্পন্ন মানুষের শ্রেণিতে রাখা যাবে না। তাঁর ব্যাপারটা এমন নয় যে একটা বহির্জগতের পেশাগত সত্তা এবং আরেকটা ঘরোয়া সত্তা; এমন নয় যে একটা প্রকাশিত এবং আরেকটি গোপনীয়; এমন নয় যে একটা সত্তা দিনের বেলায় প্রকাশ পায় এবং আরেকটি রাতে। তাঁর ক্ষেত্রে এরকম অতিসরলীকরণ একেবারে অর্থহীন। তাঁকে দ্বিখণ্ডিত ব্যক্তিত্বের অধিকারী বা দ্বৈতসত্তাসম্পন্ন মানুষ বলে সরাসরি দেগে দেওয়া যাবে না। আগেই বলেছি যে তাঁর ক্ষেত্রে একটি সত্তার সঙ্গে আরেকটির কোনো বিরোধ নেই। কিন্তু তাঁর অন্তরে একটা গোপন নেশা আছে যেটা তাঁকে সত্যসন্ধানের জন্য তাড়িয়ে বেড়ায়। তিনি খুঁজে বের করতে চান যে এই জগতে ‘সত্য মূল্য’ বলতে ঠিক কী বোঝায়। আমাদের জীবনের দৈনন্দিন ওঠাপড়ায়, প্রতিনিয়ত যন্ত্রণাকাতর মনুষ্যজীবনে কী সেই পরম প্রাপ্তি, কোন বস্তু একেবারে ধ্রুব, যার ঐশ্বরিক কর্তৃত্ব আছে এবং যা একেবারে স্বতন্ত্র… এই সব তিনি খুঁজে ফিরতে থাকেন। আমরা যদি বলি যে জেরাল্ড প্রকৃতপক্ষে ঈশ্বরের অন্বেষণে রত, তাহলে অসঙ্গত হবে না। জেরাল্ডের প্রতিদিনের সাধারণ জীবনযাপনে, পেশাগত কাজে যে সত্তা ব্যস্ত থাকে, তাঁর সঙ্গে যে মানুষটি পিয়ানো বাদনরত কিশোর বের্নহার্ডের মুখের দিকে তাকিয়েছিল, তাঁর কোনো মিল ছিল না। জেরাল্ড হঠাৎ যেন এক কোমল হাতের পরশ অনুভব করেছিলেন…

‘আমাদের সম্পদ…’ তিনি বলেছিলেন তাঁর সঙ্গীতশিক্ষক বন্ধুকে। তিনি অত্যন্ত খুশি হয়েছিলেন বের্নহার্ডের বাজনা শুনে এবং বলেছিলেন যে এই ছেলে একদিন খুব ভাল পিয়ানোবাদক হবে এবং কোনো কোনো মাপকাঠিতে এই কিশোরের প্রতিভা অসামান্য।

‘এই সম্পদ রক্ষা করা আমাদের কর্তব্য। অতি অবশ্যই এই কিশোরের সত্তা বিশেষ স্বতন্ত্র!’ বের্নহার্ডের হালকা বাদামি মুখমণ্ডলের বিষণ্ণ চোখের দিকে তাকিয়ে উচ্চারণ করলেন জেরাল্ড। তিনি এখনও জানেন না যে বের্নহার্ডের ঠিক কোন বৈশিষ্ট্য তাঁকে আকর্ষণ করছে। কিন্তু এত অল্পবয়সী একজন মানুষ কী ভাবে এত অনায়াসে বাখের কম্পোজিশন বাজিয়ে দিতে পারে? এই কিশোরের বাহ্যিক প্রকাশ এবং বাজনা সবকিছুই এক ছন্দে গাঁথা; কোথাও এতটুকু বিন্যাসের অভাব নেই। জেরাল্ড বাদ্যযন্ত্রের উপরে আনত কিশোরের ক্ষীণকায় শরীরের দিকে তাকিয়ে ভেবে চলেন… কাঁধ ঈষৎ ঝুঁকে পড়েছে, মুখ অদ্ভুত গাম্ভীর্যে পরিপূর্ণ, সুরের প্রতি সম্পূর্ণ নিবেদনে ডুবে আছে মন। গাঢ় সোনালী চুলের গুচ্ছ এসে পড়েছে কপালে, ধূসর চোখ বিষাদে ঢাকা, চেয়ে আছে পিয়ানোর চাবিগুলোর দিকে, মাঝে এক দু’ বার বাজনা থেকে মুখ তুলে জেরাল্ডের সঙ্গে চোখাচোখি হল। দুই হাত বড়, চওড়া, সুন্দর, উষ্ণ, বলিষ্ঠ কিশোরের হাত…

জেরাল্ড পরে বের্নহার্ডের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বিস্মিত হয়ে লক্ষ্য করলেন যে সে কেমন যেন বিব্রত বোধ করছে কথা বলতে। তিনি তাঁর বাজনা এবং প্রতিভা ইত্যাদি নিয়ে প্রশংসা করছিলেন। কিন্তু এই কিশোর অপ্রতিভ ভঙ্গিতে চুপ করে থাকে। জেরাল্ড তাঁর অস্বস্তি কাটাবার চেষ্টা করেন, কিন্তু বিশেষ লাভ হয় না। এক্ষেত্রে জেরাল্ডের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা কিছুটা ধাক্কা খায়। বের্নহার্ডের বাজনা শুনে তাঁর মনে হয়েছিল যে এই কিশোর অত্যন্ত পরিণতমনস্ক এবং সপ্রতিভ। অথচ ব্যাপারটা ঠিক তার উল্টো। অর্থাৎ তাঁর ভাবনা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। আসলে তিনি এই বয়সের ফরাসি ছেলেদের বিষয়েই সাধারণত জানেন, যারা শিক্ষা এবং অনুশীলনের মাধ্যমে নিজেকে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি সপ্রতিভ এবং বাক্যবাগীশ হিসেবে গড়ে তোলে। এই জায়গাতেও একটা প্রতিবন্ধ কাজ করছে, কারণ বের্নহার্ড এখনও ফরাসি ভাষা খুব ভাল শিখে উঠতে পারেনি। ফলে সে নিজেকে সাবলীলভাবে প্রকাশ করতে পারছে না।

শেষে জেরাল্ড বের্নহার্ডকে জানিয়েছিলেন যে কোনও প্রয়োজনে কিম্বা যদি কোনও বিষয়ে কিছু জানার দরকার হয়, তাহলে যেন সে অতি অবশ্যই জেরাল্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করে। প্রয়োজন ছাড়াও সে যখন ইচ্ছে যেতে পারে জেরাল্ডের কাছে। বের্নহার্ড তাঁকে ধন্যবাদ দেয় এবং তাঁর ঠিকানা ও ফোন নাম্বারের জন্য একটা ভিজিটিং কার্ড চেয়ে নেয়। জেরাল্ড আন্তরিকভাবে বলেন যে আবার তাঁর সঙ্গে দেখা করবার জন্য তিনি ইচ্ছুক। শীঘ্রই আবার যেন সে দেখা করে। কিন্তু জেরাল্ড সেদিন ভুল ভেবেছিলেন। বের্নহার্ড জেরাল্ডের সঙ্গে দেখা করেছিল ঠিকই। তবে খুব তাড়াতাড়ি সেই সাক্ষাৎ ঘটেনি। বেশ অনেকগুলো সপ্তাহ চলে গিয়েছিল এবং সেই সময়টুকুর মাঝখানে বের্নহার্ডের জীবনে অনেককিছু বদলে গিয়েছিল।



(চলবে)

0 comments: