0

সম্পাদকীয়

Posted in



বাড়ি ফেরার কথা ছিল অনেকগুলি মানুষের। হয়ে উঠলো না। চিরপ্রতীক্ষায় থেকে গেলেন তাঁদের আত্মীয়-পরিজন। কেউ গিয়েছিলেন পেশাগত কারণে, কেউবা নিছক বেড়াতে কিন্তু তাঁরা সবাই ঘরমুখো হয়েছিলেন যে ট্রেনটি চেপে, যাত্রা শুরু করার অল্পক্ষণের মধ্যেই সেটি দুর্ঘটনাগ্রস্ত হয়। অনেকেরই ফেরা হলো না আর।

এখনও পর্যন্ত যতটুকু জানা গেছে, সংশ্লিষ্ট কেউই এই ভয়ংকর বিপর্যয়ের দায় স্বীকার করেননি। হাস্যকরভাবে মামলা রুজু হয়েছে যে মালগাড়িটি কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের পিছনে ধাক্কা মারে, তার চালকের বিরুদ্ধে, যিনি সেদিনই প্রাণ হারান। আরও ন্যক্কারজনক দৃষ্টান্ত তুলে ধরে এই অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে এমন একজনের অভিযোগের ভিত্তিতে, যিনি এই মুহূর্তে চিকিৎসাধীন এবং যিনি পাল্টা অভিযোগ করেছেন যে তাঁকে দিয়ে সাদা কাগজে সই করিয়ে নেওয়া হয়েছিল। 

এ তো কল্পনাতীত! বিশ্বের এক অন্যতম বৃহৎ রেল পরিষেবার মান ঠিক কীরকম হওয়া উচিত, সে নিয়ে ভারতবাসী হিসাবে আমাদের কোনও স্পষ্ট ধারণা আছে কি? আছে কি নির্দিষ্ট কোনও প্রত্যাশা? আমরা বরং চোখ - ধাঁধানো কিছু 'বন্দে ঘোষণা'য় যারপরনাই প্রীত। 

রাজনৈতিক প্রভুদের সাফল্য ঠিক এইখানে। যে ন্যারেটিভটি তাঁরা আমাদের গলাধঃকরণ করতে বাধ্য করেছেন, আমাদের চাহিদার সীমারেখাটি ঠিক তার সঙ্গে মানানসই। কিন্তু অতর্কিতে, বলা যায়, বিনা মেঘে বজ্রাঘাত হলো যাঁদের জীবনে, আলো নিভে গেলো বরাবরের মতো, তাঁদের পরিজনদের কী হবে? আরও কতটা পথ চললে আমরা আমাদের মানুষ বলে ভাবতে পারবো? উত্তরগর্ভ এই প্রশ্নগুলি আপাতত রইলো কিছু লাশচাপা।

সুস্থ থাকুন। সৃজনে থাকুন।

শুভেচ্ছা নিরন্তর।

0 comments:

0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - রঞ্জন রায়

Posted in






বাবা রামদেবের শীর্ষাসন পর্ব

গৌরচন্দ্রিকা

“Entire Country Taken For A Ride, You Shut Eyes For 2 Years!’

‘গোটা দেশকে বোকা বানানো হচ্ছে আর আপনারা গত দু’বছর ধরে নাকে তেল দিয়ে ঘুমুচ্ছেন!’

পবিত্র ক্রোধে গর্জে উঠেছেন সুপ্রীম কোর্টের বেঞ্চ কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে; প্রসংগ বাবা রামদেবের পতঞ্জলি আয়ুর্বেদের বিজ্ঞাপন, তারিখ ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪।

এবম্বিধ ক্রোধের কারণ?

সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতি হিমা কোহলি এবং এহসানউদ্দিন আমানুল্লা ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল এসোসিয়েশনের দায়ের করা মামলার শুনানি করছিলেন। আবেদদনকারীদের বক্তব্য ছিল – পতঞ্জলি আয়ুর্বেদ যেভাবে বিজ্ঞাপন করে ক্যান্সার থেকে বিভিন্ন রোগ নিরাময়ের দাবি করছে এবং সরকার স্বীকৃত আধুনিক এলোপ্যাথি পদ্ধতির বিরুদ্ধে দুষ্প্রচার করছে তাতে জনগণের স্বাস্থ্য নিয়ে ছেলেখেলা হচ্ছে এবং সেগুলো স্পষ্টতঃ দেশের Drugs and Magic Remedies (Objectionable Advertisements) Act 1954 এর উল্লংঘন।

ঠিক আছে, কিন্তু নিরপেক্ষ ন্যায়ের সিংহাসনে বসে এত উষ্মা!

কারণ, কোর্টের মর্যাদাহানি। ব্যাপারটা বুঝতে আমাদের চারবছর পিছিয়ে যেতে হবে।

কোভিড মহামারী ও বাবা রামদেবের ব্যবসা

সালটা ২০২০। মার্চের শেষ থেকে কোভিড মহামারীর আতংক গোটা ভারতে ছড়িয়ে পড়ল। প্রধানমন্ত্রী লকডাউনের আদেশ দিলেন, থালা ও শাঁখ বাজাতে এবং দীপ জ্বালাতে বললেন। জনতাকে বললেন—কুরুপাণ্ডবের যুদ্ধ ১৮ দিনে শেষ হয়ে গেছল, দেখ আঠারো দিনে কী করি! জনতা ভরসা পেল কিন্তু অচিরাৎ বুঝল যে এই শত্রু অজানা, একে পরাস্ত করতে কোন রামবাণ এখনও মানুষের হাতে আসে নি, রিসার্চ চলছে; এবং ততদিন ম্যালেরিয়ার ওষুধ ক্লোরোকুইন এবং আরও কয়েকটি ওষূধ নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট চলছে।

মার্চ ২০২০ থেকে দেশে করোনার ভীতি ছড়িয়ে পড়ল। তার সঙ্গে শুরু হল গোমূত্র সেবন বা নাকে সরষের অথবা আয়ুর্বেদিক তেল লাগিয়ে করোনা ঠেকানোর বিপত্তারণ মন্ত্র। এমন সময়ে লক ডাউন শুরু হওয়ার পর ভারত সরকারের আয়ুষ মন্ত্রক থেকে গেজেটে ১ এপ্রিল নির্দেশ প্রকাশিত হল যে কেঁউ যদি আয়ুর্বেদ বা ইউনানি বা সিদ্ধ পদ্ধতিতে রোগ নিরাময়ের দাবি প্রিন্ট, টিভি বা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে প্রচারিত করে তবে তার বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।


সেইসময়ে ২৮শে মে, ২০২০ তারিখে ইকনমিক টাইমসে একটি খবর প্রকাশিত হয়। তাতে বলা হয়েছিল যে মধ্যপ্রদেশের ইন্দোর জেলার কালেক্টর চুপচাপ বাবা রামদেবের পতঞ্জলি রিসার্চ ফাউন্ডেশন ট্রাস্টের তৈরি আয়ুর্বেদিক ওষুধ কোভিদ-১৯এর রোগীদের উপর পরীক্ষার অনুমতি দিয়েছিলেন, কিন্তু খবরটা চাউর হওয়ায় এবং এ নিয়ে কিছু এনজিও এবং প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী কংগ্রেসের দিগ্বিজয় সিং দেশের ড্রাগ কন্ট্রোলার জেনারেলের অনুমতি ছাড়া এবং নতুন কোন ওষুধ মানুষের উপর পরীক্ষার জন্যে নির্ধারিত আইনি প্রোটোকলের পালন ছাড়া এমন অনুমতি দেয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলায় (২২শে মে) সে অনুমতি বাতিল করা হয় ।

এ নিয়ে পতঞ্জলি ট্রাস্টের ৯৬% শেয়ারের মালিক আচার্য বালকৃষ্ণ বলেন – ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে। আমরা আয়ুর্বেদ নিয়ে কোন নতুন এক্সপেরিমেন্ট করছি না । যে ওষুধগুলো বহু লোক নিয়মিত ব্যবহার করছে তা করোনা রোগীদের দিলে কতটুকু লাভ হয় দেখতে চাইছি।

ম্যাজিক শো

২৩শে জুন, ২০২০ সন্ধ্যেবেলা। করোনা প্যানডেমিকে ভারতে আক্রান্তের সংখ্যা তখন প্রায় ৫ লক্ষ ছুঁতে চলেছে। গোটা দেশ উৎফুল্ল। কারণ বিদেশি ভ্যাকসিন বের হয় নি তো কী? ভারতের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী আয়ুর্বেদের রিসার্চে নাকি দেশি ওষূধ বেরিয়েছে; ভ্যাকসিন নয় একেবারে সারিয়ে তোলার ওষুধ।

সমস্ত চ্যানেলে দেখাচ্ছে বাবা রামদেব আচার্য বালকৃষ্ণকে পাশে নিয়ে প্রেস কনফারেন্স করছেন। সামনের টেবিলে রয়েছে করোনিল , শ্বাসারি এবং অনুতৈল নামে নাকে দেওয়ার জন্যে একটি তেল। বাবা রামদেব জানালেন যে উনি রাজস্থানের জয়পুরের ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ মেডিক্যাল ইন্সটিটিউট নামের একটি হাসপাতালে ১০০ জন রোগীর উপর রান্ডমাইজড কন্ট্রোল ট্রায়ালের নিয়ম মেনে পরীক্ষা চালিয়েছেন। তাতে ৩ দিনে ৬৬% এবং ৭ দিনে ১০০% রোগী সুস্থ হয়ে উঠেছে। অতএব—মা ভৈঃ !

সন্ধ্যেয় ইন্ডিয়া নামের হিন্দি চ্যানেলকে দেয়া একটি ইন্টারভিউয়ে উনি জানালেন যে কোভিদের চিকিৎসার জন্যে কোন এলোপ্যাথিক ওষুধ খাওয়ার দরকার নেই । প্রায় ৫৪৫ টাকার এই তিনটে ওষুধের কম্বিনেশনই যথেষ্ট । সাতদিনে একশ’ পার্সেন্ট সাকসেস! দুনিয়ায় কোন দেশ এখন অব্দি যা পারেনি—অক্সফোর্ড হোক বা আমেরিকা বা চীন বা জার্মানি—তা প্রাচীন আয়ুর্বেদ পারল।

সমস্ত টিভি চ্যানেলে চ্যানেলে বাবাজির যোগ প্রজ্ঞা এবং রিসার্চের জয় জয়কার। যারা এ নিয়ে প্রশ্ন করার গুস্তাখি করছে সোশ্যাল মিডিয়ায় তারা দেশদ্রোহী এবং বিলিতি সাহেবদের পা-চাটা অভিধা পেল।

কেউ কেউ প্রশ্ন করল ওষুধটি বাজারে ছাড়ার বা বিজ্ঞাপিত করার আগে উনি আইসিএমআর ( ইন্ডিয়ান যেন্টার ফর মেডিক্যাল রিসার্চ) থেকে অনুমতি নিয়েছেন তো? বাবা হেসে জবাব দিলেন—কোন বে-আইনি কাজ করিনি। দরকারি অনুমতি এবং কাগজপত্র সবই আছে।

অ্যান্টি ক্লাইম্যাক্সঃ

কিন্তু সেদিনই রাত্রে আয়ুষ মন্ত্রক পতঞ্জলি আয়ুর্বেদকে নোটিস ধরিয়ে জানাল যে এই দপ্তর সমস্ত কাগজপত্র পরীক্ষা করে নিশ্চিন্ত হয়ে অনুমতি না দেয়া পর্য্যন্ত যেন করোনিলের বিক্রি এবং প্রচার বন্ধ রাখা হয়। কেন ?

কারণ ২১ ডিসেম্বর ২০১৮তে ভারত সরকারের গেজেটে ড্রাগস এন্ড কসমেটিক্স অ্যাক্টের কিঞ্চিৎ সংশোধন করে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল যে কোন আয়ুর্বেদিক, সিদ্ধ, ইউনানি বা হোমিওপ্যাথিক ওষুধের নামে কোন রোগ নিরাময়ের বা চিকিৎসার জন্যে বিজ্ঞাপন দেয়া বা প্রচার করা নিষিদ্ধ।

এদিকে দেখা যাচ্ছে হরিদ্বারে এই ওষুধ উৎপাদনের জন্যে লাইসেন্সের আবেদনে কোথাও করোনার চিকিৎসার নামগন্ধ নেই । অনুমতি নেয়া হয়েছিল ‘ইমিউনিটি’ বা শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্যে ।

রিসার্চের নামে যা দেখা গেলঃ ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালস রেজিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়ার রেকর্ডেও এই প্রয়োগে পতঞ্জলির নাম আছে কিন্তু করোনিল বা শ্বসারির নাম নেই। রিসার্চের স্থান এবং ফলফলের জায়গা খালি।

৯৫ জনকে নিয়ে তথাকথিত ট্রায়াল হয়। ৪৫ জনকে (ট্রিটমেন্ট গ্রুপ) ওষুধ দেয়া হয় এবং বাকি পঞ্চাশ জন ‘প্লেসিবো’ গ্রুপ, অর্থাৎ যাদের ওই ওষুধ দেয়া হয়নি।

কিন্তু এতে শুধু ২০ থেকে ৪০ বছরের লোককে নেয়া হয়েছিল। অনেকেই উপসর্গবিহীন, বা সামান্য কিছু উপসর্গ। পুরো রিসার্চ ঠিকমত করলে অর্থাৎ চিকিৎসার পর ফলো-আপ পিরিয়ডের উপসর্গ, সাইড এফেক্ট এসব দেখতে গেলে দু’মাস লাগে। অথচ এঁরা একমাস পুরো হতে না হতেই ওষুধ বানিয়ে ফেললেন।

এরা কোন মেডিক্যাল জার্নালে রিসার্চের ফল এবং রিপোর্ট প্রকাশ করা দরকার মনে করেননি। Peer Reviewও নয়। রোগীদের ক্লিনিক্যাল রিপোর্ট যেমন কো-মরবিডিটি আছে কিনা, চিকিৎসার সময় এবং ডোজ, নারী-পুরুষ –এসব কোন রেকর্ড নেই।

ফলে মহারাষ্ট্রের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ওই রাজ্যে আয়ুষ মন্ত্রকের অনুমতি না পাওয়া পর্য্যন্ত করোনিলের বিক্রি নিষিদ্ধ করে দিলেন। মুজফরপুর এবং জয়পুরে বাবা রামদেব এবং আচার্য বালকৃষ্ণের বিরুদ্ধে এফ আই আর হল। রাজস্থানের স্বাস্থ্যমন্ত্রী হুংকার দিয়ে মানুষের স্বাস্থ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলার অপরাধে কড়া ব্যবস্থা নেবেন বলে জানালেন।

ফের ম্যাজিকঃ শীর্ষাসন

সাতদিন গেল না। এবার ৩০ জুন তারিখে রামদেব এবং আচার্য বালকৃষ্ণ আবার প্রেস কনফারেন্স করলেন। বললেন – উনি আয়ুর্বেদকে বদনাম করার ষড়যন্ত্রের শিকার। উনি নাকি কখনই দাবি করেননি যে পতঞ্জলির নতুন ‘ক্লিনিক্যালি ট্রায়ালড” বটিকা করোনিল করোনা সারাতে পারে বা এই অষুধ খেয়ে করোনার রোগী সেরে গেছে।

ওনার ঘোষণা অনুসারে আয়ুষ মন্ত্রক ওদের তিনটি ওষুধের প্যাকেজ—দিব্য করোনিল,দিব্য শ্বাসারি বটি এবং দিব্য অনুতৈলকে ‘প্রতিরোধ ক্ষমতা’ বৃদ্ধির ওষূধ হিসেবে বিক্রি করার লাইসেন্স দিয়েছে।

কিন্তু অ্যাডভোকেট তুষার আনন্দ দিল্লি হাইকোর্টে আবেদন দিয়ে প্রার্থনা করেছেন যে উচ্চ আদালত মিথ্যা দাবি করে লোকের প্রাণ নিয়ে খেলা করার অপরাধে বাবা রামদেবের বিরুদ্ধে এফ আই আর করার নির্দেশ দিক।


২০২০ সালের জুন মাসে দুজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর—স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডক্টর হর্ষবর্ধন এবং সড়ক ও পরিবহন মন্ত্রী নীতিন গড়করি-- পাশে দাঁড়িয়ে সমস্ত মেইনস্ট্রিম চ্যানেলে করোনিলের সাতদিনে করণা সারিয়ে তোলার দাবির পর বাবা রামদেবের ঐ তিনটি ওষুধের প্যাক প্রায় সাতশো টাকা দামে বিক্রি হওয়া শুরু হয়। দ্রুত বিক্রির হিসেব কয়েক কোটি ছাড়িয়ে যায়।

তবে এরপর কোভিশিল্ড ও কোভ্যাক্সিন সরকারি এবং বেসরকারি হাসপাতালে সহজলভ্য হওয়ায় বাবার বিক্রি অনেকটা কমে যায়। তখন বিরক্ত বাবা রামদেব অ্যালোপ্যাথিক সিস্টেমের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে বলতে থাকেন যে অনেক ডাক্তার তো ডাবল ডোজ ভ্যাকসিন নেওয়ার পরেও মারা গেছে।

বাবার করোনিল খেয়ে কেউ তো মারা যায় নি। অ্যালোপ্যাথিক ডাক্তাররা জনতাকে বোকা বানাচ্ছে, ধোঁকা দিচ্ছে।

আর টিভি ক্যামেরার সামনে শুয়ে উনি পা নাচাতে নাচাতে বলতে থাকেন—ডক্টর-টর-টর! আরও বলেন যে অ্যালোপ্যাথিক সিস্টেম ‘স্টুপিড সায়েন্স’!

সেই ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়লে ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন থেকে ওঁর বিরুদ্ধে ১০০০ কোটি টাকার মানহানির মামলা করা হয়। প্রধানমন্ত্রী মোদীজিকে চিঠি লিখে বলা হয় রামদেব বাবাকে সিডিশনের আইনে বিচার করতে।

দশ মাস কেটে গেল। বাবার ব্যবসা বেড়ে চলেছে। এদিকে কোভিড মহামারী তার দ্বিতীয় পর্যায়ে নতুন মিউটেশন করে আরও ভয়ানক রূপ ধরেছে। লোক মারা যাচ্ছে, অক্সিজেন সিলিণ্ডার এবং হাসপাতালে বেড পাওয়া যাচ্ছে না।

এই পরিস্থিতে স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন চিঠি লিখে বলে—হয় অ্যালোপ্যাথিকে ‘স্টুপিড সায়েন্স’ বলার জন্যে বাবা রামদেবকে শাস্তি দিন, নয় আধুনিক মেডিক্যাল ফেসিলিটি বন্ধ করে দিন।

বাবা একটি ভিডিওতে হাসিমুখে বলেন আমাকে কে জেলে পুরবে? কার বাপের এত হিম্মত? তাঁর বিজনেস সাম্রাজ্যের ৯৪% অংশের মালিক আচার্য বালকৃষ্ণ বলেন—আই এম এ হিন্দুদের ক্রিশ্চান বানাতে চায়, তাই পতঞ্জলির ওষুধের বিরুদ্ধে মামলা করছে। ডক্টর জয়লাল, আই এম এ’র সচিব বলেন—আমাদের চিন্তা হল এর ফলে বাবা রামদেবের বিরাট ভক্তের দল ভ্যাকসিন নিতে চাইবে না, যার ফল অত্যন্ত চিন্তাজনক হতে পারে।

সরকারের থেকে সাড়া না পেয়ে মরিয়া আই এম এ সুপ্রীম কোর্টের দরজায় গেল। মামলা শুরু হল।

সুপ্রীম কোর্ট মামলা গ্রহণ করে বাবা রামদেবকে তিরস্কার করে বলল—ডাক্তারদের এবং অন্য চিকিৎসা পদ্ধতিকে সমালোচনা করার বাবার কোন অধিকার নেই।

বাবা -আমি ঠিক এরকম বলতে চাই নি বলে সাফাই দিলেন।

মামলা কিছুদিন হিমঘরে রইল। ব্যবসা চলতে লাগল। কিন্তু আই এম এ লেগে রইল।

গত বছর নিয়মিত শুনানি শুরু হলে জাস্টিস আমানুল্লা এবং জাস্টিস প্রশান্ত মিশ্রের বেঞ্চ পতঞ্জলি কোম্পানিকে বলে –সব ফলস ক্লেই্মের বিজ্ঞাপন বন্ধ করতে।

সুপ্রীম কোর্টের বেঞ্চের সামনে পতঞ্জলির অ্যাডভোকেট ২১শে নভেম্বর, ২০২৩ তারিখে শপথ নিয়ে যা বললেন তার ভাবার্থঃ

আগে যা হয়েছে তা হয়েছে, এখন থেকে কোম্পানি তার উৎপাদিত ওষুধের বিজ্ঞাপন বা মার্কেটিংয়ে কোন আইন ভাঙবে না। বিশেষ করে নিজেদের ওষূধের আরোগ্য করার ক্ষমতা নিয়ে কোন দাবি বা অন্য কোন চিকিৎসাপদ্ধতির বিরুদ্ধে কোন বক্তব্য মিডিয়ায় বা বিজ্ঞাপনে দেবে না। এবং এটা পালন করতে পতঞ্জলি কোম্পানি বদ্ধপরিকর।

পরের দিন পতঞ্জলি কোম্পানি এক সাংবাদিক সম্মেলন করে। সেখানে বাবা রামদেব বলেনঃ

পতঞ্জলি হাজার হাজার লোককে বিপি, সুগার, থাইরয়েড, অ্যাজমা, আর্থরাইটিস, ওবেসিটি, লিভার , কিডনি ফেলিওর এবং ক্যান্সার থেকে নিরাময় করেছে। সুপ্রীম কোর্ট তদন্ত করে যদি দোষী পান তো শাস্তি দিন; কোটি টাকা ফাইন করুন , এমনকি মৃত্যুদণ্ড দিন-মাথা পেতে মেনে নেব।

পরবর্তী শুনানি ছিল ফেব্রুয়ারি ৬।

কিন্তু শুনানি চলাকালীন গত ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ তারিখে আই এম এ’র পক্ষে সিনিয়র অ্যাডভোকেট পি এস পটওয়ালিয়া শীর্ষ আদালতকে বললেন—পতঞ্জলি কথা রাখেনি। সমানে একই রকম বিজ্ঞাপন ও দুষ্প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। গত নভেম্বরে আদালতে শপথ জমা করার পরের দিনই পতঞ্জলি একটি সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে ফের আদালতের আদেশের কড়া সমালোচনা করে।

সিনিয়র কাউন্সিল আদালতের সামনে পতঞ্জলির একটি লম্বা চওড়া বিজ্ঞাপনের নমুনা পেশ করেন যাতে এই দাবিগুলি করা হয়েছেঃ

আমাদের বিরাট ডেটাবেস—এক কোটির বেশি লোক সম্পূর্ণ সেরে গেছে। লাখ লাখ লোক নিজে থেকে এগিয়ে এসে প্রমাণ দিয়েছে। আমাদের কাছে বাস্তব এবং ক্লিনিক্যাল এভিডেন্স আছে।


অ্যালোপ্যাথি পদ্ধতিতে রিসার্চ হয়না। তাই ওরা রক্তচাপ, ডায়বেটিস, থাইরয়েড, বাত, হাঁপানি এসব সারাতে পারে না; শুধু নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।অথচ আমাদের যোগ, আয়ুর্বেদ ও প্রাকৃতিক চিকিৎসার সম্মেলনে লক্ষ লক্ষ লোক এই অসুখগুলো থেকে মুক্তি পেয়েছে।

অ্যাডভোকেটের মতে এইধরণের বিজ্ঞাপন সম্বন্ধিত আইনের ধারা ৩ এর সরাসরি উল্লংঘন।

জাস্টিস আমানুল্লার প্রশ্নঃ কোম্পানি এই রকম দাবি করে কোন সাহসে? সরকারের আয়ুষ মন্ত্রালয় করছেটা কী? এই পিটিশন তো দু’বছর আগে জমা পড়েছিল।

জাস্টিস হিমা কোহলি বলেন—আমাদের বিচার্য বিষয় সুপ্রীম কোর্টের গত নভেম্বরের আদেশের কী হল? তার কতটুকু পালন করা হয়েছে?

সরকারের পক্ষে সলিসিটর জেনারেল কে এম নটরাজ বলেন—যদি Drugs and Magic Remedies (Objectionable Advertisements) Act 1954 এর উল্লংঘন প্রমাণিত হয় তখন সে ব্যাপারে উপযুক্ত অ্যাকশন নেবার এক্তিয়ার যে রাজ্যে ঘটনা ঘটেছে সেখানকার রাজ্য সরকারের।

তাহলে আয়ুষ কী করছে?

“আমরা নোডাল এজেন্সি। আমরা ডেটা সংগ্রহ করছি এবং বিভিন্ন এজেন্সির সঙ্গে কনসাল্টেসন করছি।

যেমন, আইন ভাঙা নিয়ে কোন কমপ্লেন হয়েছে কি? হলে সম্বন্ধিত রাজ্য সরকার কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে? আমরা আইন ভাঙলে কোম্পানিকে অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে”।

জাস্টিস কোহলি জানতে চান কারা সেই এজেন্সি এবং কিসের কনসাল্টেসন?

জবাবে নটরাজন জানান—চারটে স্টেজ আছে—উৎপাদনের অনুমতি, মার্কেটিং, আইন ভাঙা এবং উৎপাদিত ওষূধের গুণমান নির্ধারিত মাপদণ্ড অনুযায়ী কিনা এইসব খুঁটিয়ে দেখা। কাজেই চারটে স্টেজের জন্য চারটে আলাদা এজেন্সির সঙ্গে কথাবার্তা চলছে। উত্তর দেওয়ার জন্য আরও একটু সময় চাই।

তখন জাস্টিস আমানুল্লা বললেন—আমরা দুই ব্যক্তির নামে (বাবা রামদেব এবং আচার্য বালকৃষ্ণ) সুপ্রীম কোর্টের আদেশের অবমাননার (কন্টেম্পট) নোটিস দেব।

তবে শেষ পর্য্যন্ত আদালত শুধু পতঞ্জলি কোম্পানি এবং আচার্য বালকৃষ্ণের নামে নোটিশ ইস্যু করেছে এবং পতঞ্জলিকে আগামী নির্দেশ পর্যন্ত তাদের সবরকম ওষুধ ও অন্যান্য উৎপাদিত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ করে দিয়েছে।

মামলা চলছে।



জব সাঁইয়া ভয়ে কোতোয়ালঃ

সুপ্রীম কোর্টের আদেশের পর সাতটা দিন কাটেনি নিচের খবরটি আমাদের চোখে পড়লঃ

কেন্দ্রীয় সরকার হরিদ্বারের পতঞ্জলি অর্গানিক রিসার্চ ইন্সটিট্যুটকে একটি প্রোজেক্টের জন্য নমামি গঙ্গে প্রোগ্রামের অন্তর্গত ন্যাশনাল গঙ্গা প্ল্যানের ফান্ড থেকে ৫০ লক্ষ টাকা মঞ্জুর করেছে। প্রোজেক্টটি হল রিসার্চের মাধ্যমে Sewage treatment Plants (এসটিপি) এর থেকে নির্গত sludge বা বর্জ্যকে biosolids এ রূপান্তরিত করে প্রাকৃতিক কৃষির জন্যে সার হিসেবে প্রয়োগ করার একটি মানক পদ্ধতি ( standard operating procedure) তৈরি করা। এই National Mission for Clean Ganga কিন্তু জলশক্তি মিশন মন্ত্রকের অধীন।

এইবার প্রশ্ন ওঠেঃ বাবা রামদেবের গত কয় দশকের আয়ুর্বেদ বা জৈব কৃষির ব্যাপারে রিসার্চের রিপোর্ট কার্ড কেমন? কেমনই বা তাঁর কোম্পানির তৈরি ভেষজের গুণবত্তা বা কোয়ালিটি?

বাবা রামদেবের রিপোর্ট কার্ড

বাবা রামদেবের ওষুধ নিয়ে বিতর্ক নতুন নয়। এর আগে উনি ক্যান্সার, এইডস (এইচ আই ভি), এমনকি সমকাম (!) সারানোর দিব্য আরোগ্যের দাবি করে হইচই ফেলেছিলেন। এঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগী এবং পতঞ্জলি আয়ুর্বেদের ৯৪% শতাংশের মালিক আচার্য বালকৃষ্ণও বিতর্কিত চরিত্র।

ওঁর হাইস্কুল এবং সম্পূর্ণানন্দ সংস্কৃত ইউনিভার্সিটি থেকে পাশ করার কোন রেকর্ড পাওয়া যায়নি বলেও বলা হয়। সিবিআই ওঁর বিরুদ্ধে নকল ডিগ্রির ভিত্তিতে পাসপোর্ট নেওয়ার অভিযোগে কেস করে। পাসপোর্ট ২০১১ সালে বাজেয়াপ্ত হয়ে যায়। সাত বছর পরে হাইকোর্ট শর্ত সহ পাসপোর্ট ফেরত দেওয়ার আদেশ দেয় ।

যোগগুরু থেকে ব্যবসায়ী?

২৩ জুন ২০২০ তারিখে সন্ধ্যেয় ইন্ডিয়া টুডে টিভির সাক্ষাৎকারে বাবা রামদেব বলেন যে উনি ব্যবসা করেন না , জনতার সেবা করেন। অ্যাঙ্কর রাজদীপ সরদেশাই হেসে বলেন—ব্যবসা করছেন তো! এখন তেল টুথপেস্ট ঘি চাল ম্যাগি কোল্ড ড্রিংক এবং জিন্স—সবই তো বিক্রি করছেন।

কিন্তু শুধু মধ্যপ্রদেশের প্রাক্তন কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রী দিগবিজয় সিংই নন, বাবা রামদেবকে কয়েক বছর আগেই ‘ফেক’ বা নকলি ঘি বিক্রির দায়ে অভিযুক্ত করেছিলেন উত্তর প্রদেশের বহরাইচ জেলার কাইজারগঞ্জের দাপুটে বিজেপি এম পি—শ্রী বৃজভুষণ শরণ সিং।

নামটা কি চেনা চেনা লাগছে?

আদালতের চোখে বাবা রামদেবের ব্যবসার সুনীতি

ন্যাশনাল অ্যান্টি-প্রফিটিয়ারিং অথরিটি (এন এ এ) গত মার্চ ২০১২ তারিখে এক রায়ে বাবা ফরামদেবের পতঞ্জলি আয়ুর্বেদ লিমিটেডকে ৭৫.০৮ কোটি টাকা পেনাল্টি জমা করতে বলে। ওঁর অপরাধ?

জিএসটি (পণ্য এবং সেবা কর) দর কম হওয়ায় নিয়ম অনুযায়ী ওঁর কোম্পানির ওয়াশিং পাউডার বিক্রির সময় দাম কমানো উচিত ছিল। উনি তা না করে প্রডাক্টের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। এটা কেব্দ্রীয় জিএস টি আইনের উল্লংঘন।

এই পণ্যটির উপর জিএসটি আগে ২৮% ছিল । পরে কমে প্রথমে ১৮% তারপরে ১২% হয়ে যায় । তাহলে পতঞ্জলির উচিত ছিল সেই হিসেবে দাম কমিয়ে দেওয়া যাতে করহ্রাসের সুফল গ্রাহক পায় ।

রায়ে বলা হয়েছে ওই রাশি এবং ১৮% জিএসটি যোগ করে আগামী তিনমাসের মধ্যে কেন্দ্র ও রাজ্যসরকারের গ্রাহক কল্যাণ ফান্ডে জমা করতে হবে। ডায়রেক্টর জেনারেল অ্যান্টি-প্রফিটিয়ারিংকে (ডিজিএপি) আগামী চারমাসের মধ্যে অনুপালন/ কমপ্লায়েন্স রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে।

বিগত ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ তারিখে ডায়রেক্টরেট অফ রেভিনিউ ইন্টেলিজেন্স বাবা রামদেবের চীনে রপ্তানি করার সময় ৫০ টন( ৫০,০০০ কিলোগ্রাম) রক্তচন্দনের কাঠ বাজেয়াপ্ত করে। এর বিরুদ্ধে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি্‌ ২০১৮ তারিখে বাবা দিল্লি হাইকোর্টে রিট পিটিশন দাখিল করে বলেন—ওঁর কাছে ডায়রেক্টরেট জেনারেল অফ ফরেন ট্রেডের বৈধ অনুমতি আছে। আর এই কাঠ অন্ধ্রপ্রদেশের বনবিভাগের থেকে নীলামের মাধ্যমে কেনা।

বাবার পারমিট ছিল সি গ্রেড রক্তচন্দনের কাঠ রপ্তানি করার। রেভিনিউ ইন্টেলিজেন্স ওনার কনসাইনমেন্ট এই সন্দেহে জব্দ করে যে এতে গ্রেড এ এবং গ্রেড বি’র কাঠ রয়েছে। ঐ দুটো গ্রেড রপ্তানি করা নিষিদ্ধ।

ইকনমিক টাইমসের অনুসারে ২০১৪তে বিশ্ববাজারে এ গ্রেড রক্তচন্দনের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় দাম প্রতি টন ৩০ লাখ টাকা থেকে বেড়ে ২ কোটি পৌঁছে যায়। হাইকোর্ট আগামী শুনানির তারিখ ১৮ই এপ্রিল ঠিক করেছিলেন। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকার ও ডি আর আইয়ের জবাবও চেয়ে পাঠিয়েছিলেন।

ব্যাপারটা তক্ষুনি মেটেনি। ডায়রেক্টর অফ রেভিনিউ ইন্টেলিজেন্স (ডি আর আই) ১ অগাস্ট, ২০১৮ তারিখে পতঙজলি আয়ুর্বেদ, এবং তার চিফ ফিনানসিয়াল অফিসার সমেত আরও আটজনকে শোকজ নোটিস জারি করে বলে কাঠের গুঁড়িগুলোর সঙ্গে কাগজে বলা কোড মিলছে না – অর্থাৎ স্মাগলিংয়ের ইঙ্গিত ।

হরিদ্বার কোর্ট বাবা রামদেবের কোম্পানি পতঞ্জলি আয়ুর্বেদ লিমিটেডকে ‘মিসব্র্যান্ডিং’ এবং মিসলিডিং অ্যাড’ এর জন্যে ১১ লক্ষ টাকা ফাইন করেছিল। অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের মতে ‘অন্য কম্পানির তৈরি মাল নিজেদের লেবেল লাগিয়ে বিক্রি’ করা ফুড সেফটি অ্যান্ড স্ট্যান্ডার্ড ( প্যাকেজিং অ্যান্ড এবং লেবেলিং রেগুলেশন্স ২০১১) আইনের ধারা ৫২ (মিসব্র্যান্ডিং) এবং ধারা ৫৩ (মিস্লিডিং অ্যাড) এর উল্লংঘন।

এছাড়া পতঞ্জলির মধু, নুন, সরষের তেল, জ্যাম এবং বেসনের মান নিয়েও অভিযোগ ছিল। তার ভিত্তিতে ১৬ অগাস্ট, ২০১২ তারিখে কিছু স্যাম্পল জব্দ করে পরীক্ষা করা হয় , যা নির্ধারিত মানের চেয়ে কম পাওয়া যায়। পরীক্ষাটি উত্তরাখন্ডের একমাত্র অনুমোদিত রুদ্রপুর ল্যাবে করা হয়। আলাদা আলাদা করে ফাইন করলে মোট ১৮ লাখ টাকা ফাইন হত। ম্যাজিস্ট্রেট একসাথে ১১ লাখ টাকা ফাইন করে একমাসের মধ্যে জমা দিতে আদেশ দিয়েছেন। বলেছেন আবার যদি কোয়ালিটিতে খামতি পাওয়া যায় তাহলে আরও কড়া শাস্তি হবে।

সন ২০১৭তে একটি আর টি আই পিটিশনের উত্তরে জানা যায় যে পতঞ্জলির দিব্য আমলা জুস এবং শিবলিঙ্গি বীজ সরকারি ল্যাব পরীক্ষায় ফেল করেছে। শিবলিঙ্গি বীজে ৩১.৬৮% ‘ফরেন ম্যাটার’ (অন্য পদার্থ) পাওয়া গেছে। আর আমলার জুসের পি এইচ ভ্যালু নির্ধারিত মান ৭ এর চেয়ে কম পাওয়া গেছে। এর ফলে অ্যাসিডিটি হতে পারে।

এর একমাস আগে পশ্চিমবঙ্গের পাবলিক হেলথ ল্যাবরেটরির পরীক্ষায় পতঞ্জলির আমলা জুস গুণমানের বিচারে পাস না করায় সেনাবাহিনীর ক্যান্টিন স্টোর্স ডিপার্টমেন্ট ( সি এস ডি) এক ব্যাচ আমলা জুস ওখানে বিক্রি স্থগিত করে।

প্রায় দুই দশক আগে সিপিএম নেত্রী এবং রাজ্যসভার সাংসদ বৃন্দা কারাত ৩ জানুয়ারি, ২০০৬ তারিখে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী শিব বসন্তের একটি চিঠি নিয়ে দাবি করেন যে বাবা রামদেবের হার্বাল আয়ুর্বেদিক দিব্য ফার্মেসিতে তৈরি ওষুধে জড়িবুটি ভেষজ ছাড়া মানুষের হাড়ের গুড়ো এবং পশুর শরীরের অংশও মেশানো রয়েছে।

কারাতের ইউনিয়নের সদস্য শ্রমিকেরা মে মাসে হরিদ্বারে দিব্য ফার্মেসির প্রেসকৃপশন এবং ওদের কাউন্টার থেকে কেনা ওষুধের রসিদ সহ স্যাম্পল নিয়ে সরকারি পরীক্ষার জন্যে জমা করে। ওরা জানায় যে একটি মৃগী সারানোর ওষুধে মানুষের খুলির হাড়ের গুড়ো এবং যৌনশক্তিবর্ধক ওষুধে (দিব্য যৌবনামৃতবটি) ভোঁদড়ের অন্ডকোষের পাউডার মেশানো হয়।

তখন বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক নেতারা -- শরদ পাওয়ার, লালুপ্রসাদ, মুলায়ম সিং, প্রকাশ জাবড়েকর, রাম মাধব এবং সুভাষ চক্রবর্তী--বাবার পক্ষে দাঁড়িয়ে যান; বৃন্দা কারাতকে মাল্টিন্যাশনালের পয়সাখাওয়া দালাল বলে আক্রমণ করা হয় । ওঁর ইউনিয়ন অফিসে হামলা হয়।

এদিকে বাবা বৃন্দার দেওয়া স্যম্পলের প্রতি সন্দেহ প্রকাশ করেন কেননা ওই স্যাম্পল কোন সরকারি কর্মচারি বাজেয়াপ্ত করেনি। উনি নিজে কিছু স্যাম্পল দেন তাতে ভেষজ ছাড়া অন্য কিছু পাওয়া যায় নি।

তখন কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী অম্বুমনি রামদাস সংসদে জানান যে হায়দ্রাবাদের সরকারি ল্যাবে মানব ডিএনএ পাওয়া গেছে, অন্যগুলিতে পাওয়া যায়নি। আরও অনুসন্ধান দরকার। একমাস বাদে উত্তরাঞ্চল সরকার বাবাকে সকল অভিযোগ থেকে মুক্তি দেয়।

বাবা রামদেব আন্না হাজারের ভ্রষ্টাচার বিরোধী আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন, কিন্তু পুলিশের গ্রেফতারের ভয়ে সালোয়ার কামিজ পরে পালাতে গিয়ে ধরা পড়েন।

তবে ২০১৪ সালের আগে থেকেই উনি বিজেপিকে ভোট দেওয়ার জন্যে খোলাখুলি প্রচার করতে থাকেন এবং বলেন আগামী নির্বাচনে বিজেপি সরকার এলে লিটার প্রতি পেট্রলের দাম ৩৫ টাকা হয়ে যাবে।

এছাড়া উনি কংগ্রেস সরকারকে ভ্রষ্ট (করাপ্ট) বলেন এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের পক্ষে বক্তব্য রাখেন। বিজেপি অকৃতজ্ঞ নয়। প্রথমে উত্তরাখণ্ডের রাজ্য সরকার পরে কেন্দ্রীয় সরকার বাবা রামদেবকে জেড ক্যাটেগরির সিকিউরিটি প্রদান করে।

উপসংহার

উইকিপিডিয়া বলছে --পতঞ্জলি আয়ুর্বেদ লিমিটেডে একটি ভোগ্যপণ্য উৎপাদক এবং বিতরক সংস্থা। এর ২০১৬-১৭ সালে ঘোষিত টার্ন ওভার (বছরের ব্যবসা) ১০২১৬ কোটি টাকা এবং ২০১৯ সালের হিসেবে এর সম্পদের মূল্য ৩০০০ কোটি টাকা।

কিন্তু সুপ্রীম কোর্টের জাস্টিস হিমা কোহলি এবং জাস্টিস আনসারউদ্দিনের বেঞ্চ বাবা এবং আগরওয়ালকে কাঁদিয়ে ছেড়েছে। ওদের বাধ্য করেছে সুপ্রীম কোর্টে এসে হাতজোড় করে বারবার ক্ষমা চাইতে এবং দেশের প্রায় ৬০টি দৈনিক সংবাদপত্রে বড় বড় করে বিজ্ঞাপন দিয়ে আগের ভ্রামক এবং ক্ষতিকর বিজ্ঞাপনের জন্য পাবলিকের কাছে ক্ষমা চাইতে।

তারপর পতঞ্জলির জনপ্রিয় ১৪ টি উৎপাদএর লাইসেন্স সাসপেন্ড করার জন্য সরকারকে নির্দেশ দিয়েছে। ফলে উত্তরাখণ্ডের উত্তরাখণ্ডের স্টেট লাইসেন্সিং অথরিটি ফর আয়ুর্বেদিক এবং ইউনানী সার্ভিসেস বিগত ২৯ এপ্রিল তারিখে সুপ্রীম কোর্টকে শপথপত্র দিয়ে জানিয়েছে যে ওরা ১৫ এপ্রিল তারিখে এক আদেশ জারি করে দিব্য ফার্মেসি এবং পতঞ্জলি আয়ুর্বেদ লিমিটেডের শ্বাসারি গোল্ড, শ্বাসারি প্রবাহী, পতঞ্জলি দৃষ্টি আইড্রপ ইত্যাদি ১৪টি প্রোডাক্টের ম্যানুফ্যাকচারিং লাইসেন্স সাস্পেন্ড করে দিয়েছে।

এটাও বলা হয়েছে যে কোন আয়ুর্বেদিক বা ইউনানি পদ্ধতির ওষুধের গায়ে “আয়ুষ মন্ত্রালয় দ্বারা অনুমোদিত” গোছের লেবেল লাগানো চলবে না।

এছাড়া ওরা ১৬ এপ্রিল তারিখে হরিদ্বারের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের কোর্টে স্বামী রামদেব এবং আচার্য বালকৃষ্ণের বিরুদ্ধে একটি ক্রিমিনাল অভিযোগ দায়ের করেছে।

গ্রহের কী ফের! দু’মাস আগেও স্বামী রামদেব উত্তরাখণ্ড সরকারের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর ছিলেন। আর আজ অপরাধী? তবে বাবা দু’বার সমন পেয়েও ম্যাজিস্ট্রেটের কোর্টে হাজির হন নি।

প্রশ্ন রয়ে গেলঃ ভারত সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রক কার পাশে দাঁড়িয়ে?

0 comments:

3

প্রবন্ধ - অনিরুদ্ধ গঙ্গোপাধ্যায়

Posted in






সদ্য কৈশোরে উপনয়ন পর্বের পর আহ্ণিক উপবাস ইত্যাদি পালন করেছি নিতান্তই গতানুগতিকভাবে। তাতে কিছুটা ছিল একটা নবলব্ধ অভিনবত্বের আস্বাদ, বেশিটাই পারিবারিক বাধ্যবাধকতা। আনুষ্ঠানিক ব্যাপারগুলোই মুখ্য ছিল, তার তাৎপর্য বা গুরুত্ব অনুধাবন করার মত বিচারবুদ্ধি তখন হয়নি।

পরবর্তী সময়ে কিছুটা সচেতন হলেও, বিভিধ ব্যস্ততার জন্যেই হোক বা হয়তো তেমন আগ্রহের অভাবেই হোক, এ সম্বন্ধে বিশেষ কোন অনুসন্ধিৎসা জাগেনি। সম্প্রতি সংবাদে কয়েকটি ঘটনার বিবৃতি পড়ে কৌতুহল জাগল। উপনয়নের প্রক্রিয়া নিয়ে ততটা নয়। বরং যে মন্ত্রে ব্রহ্মচর্যে দীক্ষিত করা হয়, সেই গায়ত্রী মন্ত্র সম্বন্ধে। এই মন্ত্র বিষয়ে কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে যেটুকু জানতে পারলাম, তা যাতে ক্রমে বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে না যায়, তাই মনে হলো তাড়াতাড়ি যেটুকু পারি, লিখে রাখাই যুক্তিযুক্ত। আর হয়তো বা কিছু আগ্রহী পাঠকের সামান্য উপকারেও আসতে পারে, এই ভাবনা থেকেই এই আলেখ্যের অবতারণা।

প্রথমেই একটি সতর্কীকরণ। এই আলেখ্যতে যদি কেউ জাতিবাদ বা বর্ণবাদের গন্ধ খোঁজেন, তা কিন্তু নিতান্তই ভুল হবে। একটি প্রাচীন, এবং জ্ঞানী পন্ডিতদের মতে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ, বৈদিক মন্ত্রের উৎপত্তি, তৎসম্বন্ধীয় পৌরাণিক কাহিনী, তার অর্থ বা গূঢ়ার্থ ইত্যাদি নিয়ে কিছু প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান করতে গিয়ে যা পেয়েছি, তাই এ বৃত্তান্তের অনুপ্রেরণা। তার বেশি কিছু নয়। রামকৃষ্ণ মিশনের শ্রদ্ধেয় স্বামী সমর্পণানন্দ মহারাজ বলছেন, গায়ত্রী মন্ত্র পৃথিবীর যে কোন দেশের, যে কোন ধর্মের, যে কোন জাতি বা বর্ণের মানুষ নির্দ্বিধায় সশ্রদ্ধায় জপ করতে পারেন। কোনরকম বৈষম্য বা বিধিনিষেধের কোন প্রশ্নই নেই।

গায়ত্রী শ্লোকের কথা বলতে গেলে বেদ সম্বন্ধে দু-চার কথা সংক্ষেপে বলতে হয়।

বেদের উৎপত্তিকাল নিয়ে বহু মত আছে। তবে অনেক ভারততত্ববিদদের গবেষণাপ্রসুত মত হল, মোটামুটিভাবে ১৫০০ থেকে ১২০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে ঋগ্বেদ সংহিতার অধিকাংশ রচিত হয়েছিল, এবং এর উৎস স্থল ছিল অধুনা উত্তর-পশ্চিম পঞ্জাবের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে, যার বেশির ভাগ এখন পাকিস্তানে। সেই সময়কাল থেকে শুরু করে ৪০০ থেকে ১৫০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত পর্যায়কে বৈদিক কাল বলা হয়। অর্থাৎ উত্তর কাংস যুগ থেকে লৌহ যুগ জুড়ে। এবং এই সময়ে সমগ্র উত্তর, পশ্চিম এবং অধিকাংশ পুর্ব ভারতে বৈদিক সভ্যতার বিস্তার ঘটে। বৌদ্ধ মহজনপদের আবির্ভাব এবং অধিকতর প্রচলনের সাথে সাথে বৈদিক সাহিত্য স্তিমিত হয়ে পড়ে।

বৈদিক শ্লোকগুলির আবির্ভাব কিভাবে হয়েছিল, তা নিয়ে অনেক তত্ব আছে। সে কথায় পরে আসছি। সে যুগে তো লিখন পদ্ধতি ছিল না। তাই ‘শ্রুতি’ এবং ‘স্মৃতি’, এই দুই সম্মিলিত প্রকারে বেদের সম্প্রচার হয়। অর্থাৎ গুরু থেকে শিষ্য, এক প্রজন্ম থেকে আর এক প্রজন্মে, শুনে, বারংবার আবৃত্তি করে এবং স্মৃতিশক্তির ওপর নির্ভর করে বৈদিক বিদ্যার প্রসার হয়। অনেক পন্ডিতের মতে এর সঙ্গে অভিনয়, মুখভঙ্গি এবং বিভন্ন মুদ্রারও প্রয়োগ হতো। মৌখিক শিক্ষণপদ্ধতি ও আবৃত্তিতে উচ্চারণ, ছন্দ, স্বরবিরাম, অক্ষর বা শব্দবিশেষে জোর দেওয়া ইত্যাদি কৌশল অপরিহার্য ছিল যা কোন লিখিত লিপিতে সম্ভব নয়। বেদগুলি লিপিবদ্ধ করা শুরু হয় আনুমানিক ৫০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ থেকে। ততদিনে দুর্ভাগ্যবশত স্বাভাবিক কারণেই অধিকাংশ শ্লোকই বিস্মৃতির অতলে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

এসব হল একাডেমিক বেদ বিশেষজ্ঞদের মত। হিন্দু অধ্যাত্মবাদী পন্ডিতরা বিভিন্ন পুরান, উপনিষদ এবং মহাভারত ইত্যাদি প্রাচীন মহাকাব্যের ভিত্তিতে বিশ্বাসধারা ও দার্শনিক দৃষ্টিকোণ প্রদান করেছেন। তবে এই সব বিশ্বাস ও দর্শনের মধ্যে কোন এক বিষয়েও বিবিধতা আছে, এবং কখনও কখনও আপাতবিরোধী মনে হলেও, একাধিক মতের সহাবস্থান লক্ষ্য করা যায়।

এই শাস্ত্রজ্ঞদের বিশ্বাস, মহর্ষিদের অনুভুতিপ্রসুত বেদের স্তোত্রগুলি ক্রমবর্ধমান সংখ্যায় অবিন্যস্তভাবে উদ্ভুত হয়ে যাচ্ছিল, শিক্ষার্থীদের শেখানোও হত বিশৃঙ্খলভাবে। কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন নামের এক ঋষি অন্যান্য বেদজ্ঞ জ্যেষ্ঠ ঋষিদের কাছ থেকে সম্পূর্ণ বেদ শিক্ষা করেছিলেন। তাঁর মনে হয়, এই সুবিশাল জ্ঞানভান্ডারকে সুবিন্যস্ত করে, বিষয়ানুসারে বিভক্ত করা প্রয়োজন। পরিনত জীবনে তিনি এই সম্পাদনার কাজে ব্রতী হন, এবং অবশেষে সমগ্র বেদকে চার ভাগে বিভাজন করেন – ঋক, যজুর, সাম এবং অথর্ব। মতান্তরে তিনি প্রথম তিনটি বেদেরই সংকলন করেছিলেন, অথর্ব বেদ পরে সংযোজিত হয়। এই মহৎ কীর্তির জন্য তিনি বেদব্যাস (‘ব্যাস’ শব্দের অর্থ বিভাজন) নামে পরিচিত হলেন। এ ছাড়াও পুরাণ, মহাভারত, ব্রহ্মসুত্র ইত্যাদি গ্রন্থেরও রচয়িতা ব্যাসদেব।

বেদকে বলা হয় ‘অপৌরুষেয়’, অর্থাৎ মনুষ্যসৃষ্ট নয়। তাহলে প্রশ্ন ওঠে, কোথা থেকে এর উৎপত্তি হল ? কেনই বা তবে বিভিন্ন বেদমন্ত্রের শ্রেয় বিভন্ন মহর্ষিদের দেওয়া হয়ে থাকে ? এর এক গভীর তাত্বিক ব্যাখ্যা দেওয়া হয় যা অনেকটা এই রকম।

মানুষের মন বড়ই চঞ্চল। সর্বদাই বহু চিন্তাভাবনায়, নানা আবেগে উদ্বেগে ভারাক্রান্ত থাকে। তবে নিবিড় ধ্যানযোগের মাধ্যমে এই অশান্ত চিত্তকে শান্ত করার প্রকৌশল আমাদের মহর্ষিরা সিদ্ধ করেছিলেন। এখন, যত পার্থিব শক্তি আছে, তার মধ্যে হিন্দু দর্শনে শব্দকে বলা হয় ব্রহ্মস্বরূপ। সৃষ্টির আগের থেকে, আদি, বর্তমান, এমনকি বিলয়ের পরও মহাজাগতিক শব্দতরঙ্গ ছিল, আছে এবং থাকবে। তার কিছু আমাদের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য, অধিকাংশই নয়। তাত্বিকরা বলছেন, সমাহিত চিত্তে এই অধরা ধ্বনিই পুঞ্জীভুত বাক্যসমূহরূপে মহর্ষিদের অন্তরাত্মায় প্রকাশ পেয়েছিল এবং অনুভূত হয়েছিল। সেই জ্ঞানই গীত হয়েছিল বেদবাক্যরূপে। সেই কারণেই বেদের বাণীও শাস্বত, অবিনশ্বর। যুগে য়ুগে আবিষ্কৃত হয়েছে এবং হবে। সমর্পণানন্দ মহারাজ সহজ কথায় বুঝিয়েছেন, মাধ্যাকর্ষণের আবিষ্কর্তা নিউটনকে বলা হলেও মাধ্যাকর্ষণ কিন্তু বরাবরই ছিল এবং থাকবে। তেমনই বেদের জ্ঞান, সনাতন এবং অবিনশ্বর। যে যুগমানব এই জ্ঞান আহরণ করতে পারেন, তিনিই যুগান্তরে ও কালান্তরে সত্যদ্রষ্টা, ব্রহ্মর্ষি।

এমনই এক ঋষি ছিলেন বিশ্বামিত্র। অবশ্য পূর্বাশ্রমে তিনি ছিলেন এক দোর্দন্ডপ্রতাপ ক্ষত্রিয় রাজা। পরে অনেক তপস্যাবলে ঋষি, রাজর্ষি ও দেবর্ষি হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর মন ছিল কলুষিত। ক্রোধ, অহংবোধ, জিগীষা, কামনা, বাসনায় ভরা। জীবনে তিনি বহু কুকর্ম করেছিলেন। তপস্যা করে দুর্লভ বরপ্রাপ্ত হয়েও সে সব শক্তির অপচয় করেন হীন চরিতার্থতায়। বলা বাহুল্য, এই জন্য তিনি বার বার পরাজিতই হলেন, চিত্তশান্তি হল না। অবশেষে, সহস্র বর্ষব্যাপী এক অসাধারণ কৃচ্ছ্রসাধনা ও ধ্যানযোগের পর তিনি এমন এক অবস্থায় পৌঁছলেন, যখন তাঁর মন সম্পূর্ণ ভারশূন্য, চিত্তে আর কোন পার্থিব আকাঙ্খা অবশিষ্ট নেই। এ এক অতুলনীয় রূপান্তর। সেই দিব্য তুরীয় অবস্থায় তিনি পরিনত হলেন এক ব্রহ্মর্ষিতে, যখন তাঁর অন্তরাত্মায় আকুলস্বরে রণিত হল এক অসীম ক্ষমতাশালী, অনন্য প্রার্থনা :

तत्सवितुर्वरेण्यं
भर्गो देवस्य धीमहि
धियो यो नः प्रचोदयात्

[ তৎ সবিতুর্বরেণ্যং
ভর্গো দেবস্য ধীমহি
ধিয়ো য়ো নঃ প্রচোদয়াৎ ]

এই হল গায়ত্রী স্তোত্র, বা ঋগ্বেদে যাকে ঋক বলা হয়। ঋক হল এক একটি শ্লোক। একাধিক শ্লোক সন্নিবেশে গঠিত হয় একটি সম্পূর্ণ সূক্ত। ঋক এবং মন্ত্র অনেক সময় সমার্থক হিসেবে উল্লেখ হয় বটে, কিন্তু এই স্তোত্র কিভাবে মন্ত্রে রূপান্তরিত হয়ে গেল, আর কেমন ভাবে আরও গভীর অর্থবহ হয়ে উঠল, সে আলোচনায় আসছি একটু পরে।

ঋগ্বেদের একাধিক শাখা ছিল বলে মনে করা হয়, যার একটিই মাত্র শাখা, যার নাম ‘শাকল’, এবং অন্য একটি শাখা ‘বাষ্কল’-এর সামান্য অংশ, এ যুগে অবশিষ্ট আছে। এখনকার উপলব্ধ ঋগ্বেদে ১০টি মন্ডল, ১০২৮টি সূক্ত এবং ১০,৬০০টি ঋক পাওয়া যায়। এক একটি মন্ডল এক এক জন ব্রহ্মর্ষির দিব্য অনুভূতির সংকলন। এর মধ্যে দ্বিতীয় থেকে নবম মন্ডল হল সর্বপ্রাচীন বেদ, এবং তৃতীয় মন্ডল ব্রহ্মর্ষি বিশ্বামিত্রের নাম বহন করে। ঋগ্বেদের এই তৃতীয় মন্ডলে ৬২টি সূক্ত এবং ৬১৭টি ঋক আছে। ৬২তম সূক্তের ১০ম ঋক হল গায়ত্রী স্তোত্র।

গায়ত্রী স্তোত্র ঋক অথবা মন্ত্র রূপে ঋগ্বেদে তো আছেই, যজুর্বেদেও চার বার এবং সাম বেদে একবার ব্যবহৃত হয়েছে। এ ছাড়াও বিভিন্ন উপনিষদ, শ্রীমদ্ভাগবদ্গীতা, হরিবংশ, মনুস্মৃতি ইত্যাদি সব প্রাচীন গ্রন্থাবলীতে বারংবার উল্লেখিত হয়েছে। এমন কি, বৌদ্ধ গ্রন্থ সূক্ত নিপাতে ভগবান বুদ্ধ স্বয়ং তাঁর অনুগতদের বলেছেন এই মন্ত্র অধ্যয়ন করতে। এর থেকে ধারণা করা যেতে পারে মন্ত্রটির মাহাত্ম্য কত ব্যাপকভাবে স্বীকৃত। সাম্প্রতিক কালে রাজা রামমোহন রায় প্রতিটি ব্রাহ্ম সভার শুরুতে গায়ত্রী মন্ত্রের সমবেত ধ্যান প্রথার প্রববর্তন করেন।

কিন্তু এই ‘গায়ত্রী’ আদতে কে, বা কী ?

গায়ত্রী আসলে একটি ছন্দের নাম। আগেই জেনেছি, বেদের স্তোত্র মৌখিক গায়ন বা আবৃত্তির মাধ্যমেই প্রচারিত হত। স্বভাবতই ছন্দের প্রয়োগ আবশ্যিক ও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সমগ্র বেদে সাতটি প্রধান ছন্দের দেখা পাওয়া যায়। এগুলি হল গায়ত্রী, উষ্ণিক, অনুষ্টুপ,বৃহতী, পংক্তি, ত্রিষ্টুপ ও অগতী। এগুলির প্রত্যেকটির নিজস্ব কাঠামো আছে। অন্য আরও কিছু কম ব্যবহৃত ছন্দও আছে।

সবথেকে বেশি শ্লোক গঠিত হয়েছে ত্রিষ্টুপ ছন্দে, তারপর গায়ত্রী ছন্দে। কিন্তু মান্যতায় গায়ত্রী সর্বাগ্রে। গীতায় বলা হয়েছে, “ছন্দসমূহের মধ্যে আমিই গায়ত্রী”। আমাদের সময়ে, কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তার রেশ থেকে, বোধহয় সমকালীন কবিতায় ছন্দের অপ্রাসঙ্গিকতা নিয়েই, লিখেছেন, “সকল ছন্দের মধ্যে এই যে গায়ত্রী, তুমি নাও। গায়ত্রীর মত নারী শুয়ে আছে”। ছন্দপতনের জন্যও তিনি গায়ত্রীকেই নির্বাচন করলেন।

সে যা হোক, আমরা তো রয়েছি বৈদিক যুগে। তাই এইখানে গায়ত্রী ছন্দের গঠনটি একটু জেনে নিই। এই ছন্দে সমগ্র শ্লোক রচিত হয় মোট ২৪টি শব্দাংশ বা সিলেবল নিয়ে। এই ২৪টি সিলেবল আবার তিনটি সমান অংশে বিভক্ত হয়, যার প্রত্যেকটিকে বলা হয় এক একটি পাদ। অর্থাৎ প্রত্যেক পাদে ৮টি করে শব্দাংশ বা সিলেবল থাকতে হবে। নীচে এই কাঠামোটি বোঝানো হয়েছে।









অন্যাান্য আরো অনেক দেব-দেবীদের, যেমন বিষ্ণু, কৃষ্ণ, শিব, গণেশ, দুর্গা, সরস্বতী, লক্ষী ইত্যাদি, স্তুতিতে গায়ত্রী মন্ত্র রচিত হয়েছে। কিন্তু গায়ত্রী মন্ত্র বলতে সাধারণত আপামর ভক্তদের কাছে উপরোক্ত স্তোত্রই প্রাধান্য এবং পরিচিতি পেয়ে এসেছে।

অবশ্যই গায়ত্রী নামের এক দেবীও বর্তমান। ইনি পৌরাণিক দেবী। বিভিন্ন পুরাণে এঁর পরিচিতি ও বর্ণনার রকমফের আছে। মৎস্য পুরাণ অনুসারে ব্রহ্মার দেহ ভেদ করে অর্ধেক পুরূষ এবং অর্ধেক নারীরূপে তাঁর জন্ম, শতরূপা নামেও পরিচিত। মদনদেবের কামশরে বিদ্ধ হয়ে ব্রহ্মা এঁকে বিবাহ করেন, এবং মনু-সহ সাত সন্তানের জন্ম হয়। এই দেবীকেই আবার সরস্বতী ও সবিতা নামেও স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। স্কন্দ পুরাণে ব্রহ্মার স্ত্রী ও সরস্বতী পরিচয়ে তো বটেই, পার্বতী রূপেও বিদ্যমান। ব্রহ্মা অজাচারে লিপ্ত হতে গেলে মহাদেব নাকি তাঁকে বধ করেন ও পরে এই গায়ত্রী দেবীর অনুরোধে পুনর্জীবিত করেন। কূর্ম পুরাণে তিনি গৌতম ঋষিকে বরদান করে তাঁর জীবনের বাঁধা-বিপত্তির অবসান করেন। পদ্ম পুরাণের কাহিনীটি অধিক প্রচারিত। ব্রহ্মা একবার এক যজ্ঞ করছিলেন, তখন তাঁর স্ত্রী সাবিত্রী বা সরস্বতীর যজ্ঞস্থলে প্রয়োজন ছিল। কিন্তু কোন কাজে ব্যস্ত থাকায় সাবিত্রী আসতে অসমর্থ হলে, যজ্ঞ সম্পূর্ণ করার জন্য ব্রহ্মা এক সর্বগূণলক্ষণা সুন্দরী অভিরা নারীকে তৎক্ষণাৎ বিবাহ করেন এবং তাঁর সহায়তায় যজ্ঞ সম্পন্ন করেন। এই নারীই গায়ত্রী। স্বাভাবিকভাবেই সাবিত্রী ক্রোধবশে যজ্ঞস্থলে সকলের শাপান্ত করতে লাগলেন। তখন ব্রহ্মা, বিষ্ণু ইত্যাদি সকলে তাঁকে তুষ্ট করলে সাবিত্রী শেষে গায়ত্রীকে ব্রহ্মার দ্বিতীয় স্ত্রী রূপে স্বীকৃতি দেন। আসলে গায়ত্রী নাকি সাবিত্রীরই রূপভেদ। এইভাবে সাবিত্রী, সবিতা, সরস্বতী, গায়ত্রী সব সমার্থক হয়ে গেছেন। প্রধানত ব্রহ্মার স্ত্রীরূপে পরিচিত হলেও শৈব পূরাণগুলিতে আবার অন্য চিত্র পাওয়া যায়। লিঙ্গপুরাণে মহাদেবের অঙ্গ থেকে তাঁর জন্ম, শ্বেতকল্পে শ্বেতবর্ণা, পীতকল্পে পীতবর্ণা, লোহিতকল্পে লোহিতবর্ণা ও কৃষ্ণকল্পে কৃষ্ণবর্ণা। তিনি বেদমাতা। বরাহ পুরাণে আবার ভীষণা রূপ ধারণ করে তিনি বেত্রাসুরকে বধ করেন। শৈব মান্যতায় তিনি সদাশিবের পত্নী মনোমণি। সরস্বতী, লক্ষী এবং পার্বতীর সম্মিলিত রূপ, গায়ত্রী মন্ত্রের দৈবী প্রকাশ। তাঁর পাঁচ মাথা ও দশ হাত, প্রস্ফুটিত লাল পদ্মে আসনা। বর্তমানে উত্তর ভারতে তিনি এই মুর্তিতেই পূজিত হন।

গায়ত্রী মন্ত্রে যাঁর ধ্যান করা হয়েছে, তিনি কিন্তু এই গায়ত্রী দেবী নন, তিনি হলেন সবিতৃ দেব। ইনি বৈদিক দেবতা। এইখানে জানা দরকার যে বৈদিক দেবতা ও পরবর্তী পৌরাণিক দেব-দেবীদের মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। অধিকাংশ পৌরাণিক দেব-দেবীদের কোন উল্লেখ বেদে নেই। যে সব বৈদিক দেবতারা কোন জাগতিক বা প্রাকৃতিক ঘটমান বিষয়ের প্রতিনিধিত্ব করেন, ইনি তাঁদের মধ্যে একজন। সূর্যোদয়ের আগে পূর্ব দিগন্ত যে স্বর্ণাভ আভায় আলোকিত হয়ে ওঠে, সবিতৃদেব হলেন তারই প্রতিভূ দেবতা।

সবিতৃ ঋষি কাশ্যপ ও তাঁর এক পত্নী অদিতির ১২ পুত্রের একজন। তাই তিনি একজন আদিত্য। তাঁর করমন্ডল ও কেশ স্বর্ণাভ। যখন হলুদ বর্ণের পোষাক পরিধান করে সোনার রথে বিচরণ করেন, তখন তাঁর অবয়ব থেকে এক উজ্জ্বল স্বর্ণালী দ্যুতি বিচ্ছুরিত হয়। তিনি মিষ্টভাষী ও শিষ্টাচারী। সকল সদাচারী ব্যক্তিদের তিনি অমৃতলোকের দিকনির্দেশ করেন। তাঁর আগমনে সূর্যোদয় হয়, এবং তাঁরই নির্দেশে সন্ধ্যাগমন ঘটে। তাই উভয়কালে তিনি পূজ্য। সকল জীবের নিদ্রাভঙ্গ ও বিশ্রামকাল নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি। মর্ত্যলোক এবং অন্তরিক্ষের মধ্যবর্তী অঞ্চল তাঁর প্রভাবে চালিত হয়, তাই বায়ুপ্রবাহ ও বৃষ্টিপাতও তিনিই সৃষ্টি করেন।

সবিতৃ ও সূর্য কি অভিন্ন ? এই প্রশ্নের পক্ষে ও বিপক্ষে বিবিধ পন্ডিতের অনেক মত আছে।

ঋগ্বেদের ১১টি সূক্তে এবং অন্যান্য গ্রন্থাদিতে প্রায় ১৭০ বার যে সবিত্রের উল্লেখ রয়েছে, তাঁকে প্রায়শই সূর্য বা সূর্যের নামান্তরের সঙ্গে সমান্তরাল বা সমার্থক বলে মনে হতে পারে। তাঁর যে সব বৈশিষ্ট্য এবং ক্রিয়াদির বর্ণনা রয়েছে, তা সূর্যের সঙ্গে অনেকাংশে মিলে যায়। কিন্তু অনেকে আবার প্রভেদও দেখতে পান। এমনও উদাহরণ আছে যেখানে ইন্দ্রাদি কয়েক অন্য দেবতার সঙ্গেও সবিত্রের একীকরণ করে বোঝানো হয়েছে।

পঞ্চম খ্রীষ্টপূর্বাব্দের নিরুক্তিকার যাস্কের মত হল, আকাশ থেকে রাত্রির অন্ধকার চলে গিয়ে যখন রশ্মি বিকীর্ণ হয়, সেই হল সবিতৃ (বা সবিতা)র কাল। চতুর্দশ শতকের বেদ ভাষ্যকার সায়নাচার্য্য বলছেন, উদয়ের পূর্বে তিনি সবিতা, উদয় থেকে অস্ত পর্যন্ত সূর্য। যাঁরা সবিতৃ ও সূর্যকে এক বলে মানেন, তাঁরা এই দুই টীকাকে সমর্থন মনে করেন। আবার অন্যরা বলেন, সাকার সূর্য এবং নিরাকার রশ্মি, যা শক্তির প্রকাশ, এই দুইয়ের প্রভেদ এখানে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

যাস্ক এও বলেছেন, ‘সু’ ধাতু থেকে সবিতৃ শব্দের উৎপত্তি, তাই সবিতা অর্থে প্রসবিতা। আবার সায়নাচার্য্যের ব্যাখ্যায়, ‘তৎসবিতুঃ’র অর্থ হল জগৎ-প্রসবিতুঃ। সমগ্র বিশ্বজগতের জন্মদাতাই তো পরম ব্রহ্ম। যজুর্বেদের টীকায় আবার সবিতৃকে বলা হয়েছে প্রজাপতি, যা ব্রহ্মর অপর নাম। স্থানান্তরে এমন উল্লেখও আছে যে সমস্ত সৃষ্টিশক্তির ধারক একমাত্র সবিতৃ। শুধু তাই নয়, অন্য দেবতারা তাঁর অমান্যতায় অপারগ। এই সব যুক্তি দিয়ে ব্রহ্মবাদীরা বলেন যে সবিতৃ নেহাতই সূর্য নন, তিনিই সৃষ্টিকর্তা পরমেশ্বর।

বৈদিক ধর্মে যে অর্থই করা হোক, পরবর্তী ব্রহ্মবাদী ঋষিরা কিন্তু নিরাকার একেশ্বর পরমাত্মায় বিশ্বাসী। তাঁরা বেদকেই অবলম্বন করলেন, কিন্তু যোগ করলেন গভীর দার্শনিক তত্ব। আধুনিক কালের পন্ডিতরাও বেদবাণীসমূহের নিজ নিজ দার্শনিক তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেছেন। এখন কথা হল, এই সব বিজ্ঞ ব্রাহ্মণেরা কেমন করে স্বীকার করতে পারেন যে গায়ত্রী মন্ত্রের মাধ্যমে সকাল সন্ধ্যে তাঁরা সূর্যেরই স্তব করে চলেছেন যা এক জড়পদার্থমাত্র ? বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর ‘সবিতা ও গায়ত্রী’ শীর্ষক প্রবন্ধে সুন্দর মীমংসা দিয়েছেন। প্রথমে বিভিন্ন সাক্ষ্য আলোচনা করে তিনি বলছেন, “বোধ হয় এখন স্বীকার করিতে হইবে যে, সবিতা, পরব্রহ্ম নহেন, জড়পিন্ড সূর্য্য”। অবশেষে তিনি বললেন, “ইহাতে ক্ষতি কি ? ব্রাহ্মণেরাই বা লাঘব কি ? গায়ত্রীরই বা লাঘব কি ? যে ঋষি গায়ত্রী প্রণয়ন করিয়াছিলেন, তিনি যে অর্থই অভিপ্রেত করিয়া থাকুন না, যখন ব্রহ্মপক্ষে তাঁহার বাক্যের সদর্থ হয়, আর যখন সেই অর্থেই গায়ত্রী সনাতন ধর্ম্মোপযোগী এবং মনুষ্যের চিত্ত-শুদ্ধিকর, তখন সেই অর্থই প্রচলিত থাকাই উচিত। তাহাতে ব্রাহ্মণেরও গৌরব, হিন্দুধর্ম্মেরও গৌরব। এই অর্থে ব্রাহ্মণ শূদ্র, ব্রাহ্ম, খ্রীষ্টীয়ান্ সকলেই গায়ত্রী জপ করিতে পারে।“

সুতরাং গায়ত্রী মন্ত্রের ব্রহ্মপক্ষে থাকাই যুক্তিযুক্ত। সজাগ পাঠকরা কিন্তু বলবেন, এই রচনায় তো এখনও পর্যন্ত সম্পূর্ণ গায়ত্রী মন্ত্রের অবতারণাই হয়নি। ঠিক কথা। আসলে ঋষি বিশ্বামিত্র প্রণীত সবিতৃ-গায়ত্রীর ঋক থেকেই যাত্রা শুরু। এই ঋক মন্ত্রে রূপান্তরিত হয়েছে আরও পরে। শুক্ল যজুর্বেদ সংহিতার ৩৬তম অধ্যায়ের তৃতীয় মন্ত্র হল সম্পূর্ণ গায়ত্রী মন্ত্র, যেখানে বিশ্বামিত্রের ঋকের পূর্বে যুক্ত করা হল শব্দগুচ্ছ:

ॐ भूर्भुवः स्वः

সুতরাং পূর্ণ রূপে মন্ত্রটি হল: ওঁ ভূর্ভুবঃ স্বঃ তৎ সবিতুর্বরেণ্যং ভর্গো দেবস্য ধীমহি ধিয়ো য়ো নঃ প্রচোদয়াৎ। লক্ষ্যণীয় যে প্রাথমিক এই শব্দগুলি কিন্তু গায়ত্রী ছন্দে বদ্ধ নয়। মন্ত্রাকার সাধনেই এগুলি যুক্ত করা হয়েছে।

এইবার সময় এসেছে এই মন্ত্রের আক্ষরিক অর্থ এবং অন্তর্নিহিত ভাবার্থ বা গূঢ় তত্ব বিশ্লেষণের প্রয়াস করার। প্রয়াস মাত্র। কারণ যে গভীর আধ্যাত্মিক দর্শন এর মধ্যে নিহিত বলে মান্যতা পেয়েছে, তার সম্যক উপলব্ধি সাধারণের কাছে উপস্থাপন করার মত প্রয়োজনীয় যোগ্যতার দাবিদার আমি নই। তা ছাড়া, বিভিন্ন তাত্বিকেরা বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাই এখানে আমরা সায়নাচার্য্যের শরণাপন্ন হব, এবং তাঁর কাছে অগ্রিম ক্ষমাপ্রার্থী হয়ে কিঞ্চিত সরলীকরণের চেষ্টা করব।

প্রথম শব্দ ওঁ। সকলেই জানেন, সৃষ্টির প্রারম্ভে ধ্বনিত তিন আদি স্বর অ, উ এবং ম মিলিত হয়ে ওঁ-কারের উৎপত্তি। হিন্দু ধর্মের পবিত্রতম প্রতীক। যে কোন ঋকের শুরুতে ও শেষে ওঁ ব্যবহার করলে তা মন্ত্রে পরিনত হয়।

পরবর্তী তিনটি শব্দকে বলা হয় ব্যাহৃতি। ব্যাহৃতি নিয়ে বিশদ আলোচনায় না গিয়ে শুধু বলা যায় যে ওঁ-কারের মতই পবিত্র এবং আদি সাতটি শব্দকে ব্যাহৃতি বলা হয়, যার মধ্যে আবার প্রথম এই তিন শব্দ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। মন্ত্রে ব্যাহৃতির প্রয়োগ অনিবার্য। এখানে এই তিন শব্দের স্বতন্ত্রভাবে ব্যাখ্যা প্রয়োজন, কারণ এদের প্রয়োগ মন্ত্রের ব্যাপ্তিকে প্রসারিত করেছে।

ভূ – পৃথ্বীলোক বা স্থূল বা ভৌতিক জগৎ; ভাবান্তরে স্থূল শরীর।

ভুব: - অন্তরীক্ষ লোক; ভাবান্তরে সূক্ষ শরীর, যা না তো সম্পূর্ণ শারীরিক, না আধ্যাত্মিক।

স্ব: - স্বর্গলোক বা কারণ-জগৎ; ভাবান্তরে আত্মার ক্ষীন আবরণ, যার পেছনে আত্মা, পরমাত্মা বা পরমেশ্বর বিরাজমান। বৈদিক আধ্যাত্মবাদ অনুসারে সকলের অন্তরেই পরমেশ্বর আসীন, অজ্ঞানতার কারণে যাঁর উপলব্ধি থেকে মানুষ বঞ্চিত।

তৎ - সেই (দেবতা; ঈশ্বর)।

সবিতু – সবিতা; বা অন্তর্যামী। লক্ষণীয়, যে সবিতৃদেবকে আগে আমরা মর্ত্য ও অন্তরীক্ষের মধ্যাঞ্চলের দেবতা বলেই বর্ণনা করেছিলাম, এই ব্যাহৃতি ত্রয়ী সেখান থেকে তাঁকে ত্রিলোকের অধীশ্বর পরম ব্রহ্মের মর্যাদায় রূপান্তরিত করেছে।

বরেণ্যং – বরণীয়, পূজনীয়।

ভর্গো দেবস্য – এক অর্থে অন্ধকার নাশক দীপ্তির দেবতাকে; ভাবার্থে চেতনার উন্মেষকারী পরমেশ্বরকে। ভর্গ মানে অন্নও হয়। তাই অন্য অর্থে জাগতিক সম্পন্নতা প্রদানকারী দেবতাকে। শব্দটি এই মন্ত্রকে তিন মাত্রায় ব্যবহার করার উপয়োগী করেছে। জাগতিক সম্পদ, পাপনাশক আধ্যাত্মিক শক্তি, এবং সর্বোচ্চ স্তরে অজ্ঞানতার অন্ধকার থেকে চেতনার দ্যুতি, এই সর্বস্ব প্রদান করেন যে ঈশ্বর, তাঁকে।

ধীমহি – ধ্যান করি; ভাবার্থে ধারণ বা প্রতিষ্ঠিত করি।

ধিয়ো – বুদ্ধি; কর্ম ও ধর্মজীবনের প্রজ্ঞা।

য়ো – সেই, অর্থে সেই দেবতা বা পরমেশ্বর।

ন: - আমাদের।

প্রচোদয়াৎ - নিয়ে যান, বা দিগ্দর্শন করান; প্রেরণা প্রদান করেন।

এই সমস্ত শব্দার্থকে একত্রিত করে যদি অতি সাধারণ গদ্যে মন্ত্রটিকে প্রকাশ করার চেষ্টা করি, তবে অনেকটা এইরকম দাঁড়ায়:

“সেই সর্বব্যাপী, বরেণ্য, সর্বস্ব-প্রদায়ী, জ্যোতির্ময় ঈশ্বরের ধ্যান-প্রতিষ্ঠা করি, যেন তিনি আমাদের জ্ঞান ও বুদ্ধির আলোক উন্মোচিত করে দিকনির্দেশ করেন”।

প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বহু গূণী পন্ডিত, দার্শনিক ও সাহিত্যিক অনেক ভাষায় গায়ত্রী মন্ত্রের অনুবাদ বা ভাবানুবাদ করেছেন। কিন্তু অল্প কথায় অনেক কথা বলে যাওয়ার মত দক্ষতা ও শৈলী আমাদের রবি ঠাকুরের মত আর কার ? তাঁর “বেদ: সংহিতা ও উপনিষদ”এ সরল পদ্যে গায়ত্রী ঋকের যে ভাবানুবাদ তিনি করেছিলেন, তা এইখানে উল্লেখযোগ্য:

যাঁ হতে বাহিরে ছড়ায়ে পড়িছে
পৃথিবী আকাশ তারা,
যাঁ হতে আমার অন্তরে আসে
বুদ্ধি চেতনা ধারা –
তাঁরি পূজনীয় অসীম শক্তি
ধ্যান করি আমি লইয়া ভক্তি।

তবে মনে রাখতে হবে যে এই অনুবাদ মন্ত্রের নয়, কারণ এতে প্রারম্ভের ব্যাহৃতি অন্তর্ভুক্ত হয়নি।

শাস্ত্রজ্ঞানী বিদ্বজন গায়ত্রী মন্ত্রকে এক অতি উচ্চ মর্যাদার স্থান দিয়েছেন। তাঁরা বলেন, এই মন্ত্র নিয়মিত জপ করলে অতুল সুফল পাওয়া সম্ভব, অন্য মন্ত্রের প্রয়োজন নেই। গায়ত্রী মন্ত্রের শক্তি নাকি অপরিসীম। আমার এক অগ্রজ সহকর্মী বলতেন, দৈনিক জীবনে যখনই কোন কঠিন পরিস্থিতি এসেছে, মনে মনে গায়ত্রীর শরণাপন্ন হয়ে সর্বদাই তিনি অশেষ মনোবল ও উপকার পেয়েছেন। এই প্রত্যয় নিছকই অটুট বিশ্বাসপ্রসূত, না বাস্তব অভিজ্ঞতানির্ভর, তা বলা মুশকিল। তবে মন্ত্রটির এই আভিজাত্যের কারণ বোধহয় মন্ত্রের মধ্যেই নিহিত।

প্রথমত, এখানে কোন বিশেষ দেবী-দেবতার স্তবগাথা নেই। এই ঈশ্বর যে কোন বিশ্বাসের মানুষের ঈশ্বর হতে পারেন। তাই এই মন্ত্র কোন ধর্ম বা জাতি ভেদে সীমাবদ্ধ নয়, সার্বজনীন।

দ্বিতীয় কারণ, শুধুমাত্র অতি উচ্চমার্গের সাধনা অর্থাৎ ঈশ্বরানুভূতির জন্যেই যে এই মন্ত্র উপযোগী, তা নয়। যে কোন পার্থিব অথবা আধ্যাত্মিক লক্ষ্যে গায়ত্রী মন্ত্রে সমানভাবে নির্ভরশীল হওয়া যায়।

তৃতীয়, এবং সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, এই মন্ত্রে কিন্তু সরাসরিভাবে কোনই চাহিদা নেই, যা সাধারণত আমাদের অন্যান্য পুজা মন্ত্রে থাকে। এখানে ঈশ্বরের কাছে অর্থ-মোক্ষ ইত্যাদির প্রত্যাশা নেই। যা ভিক্ষা করা হয়েছে তা হল অকলুষিত বুদ্ধি। নিষ্কলঙ্ক বুদ্ধিবলে মানুষ যে কোন সাফল্য অর্জনে সক্ষম, কারণ তখন নিরপেক্ষ বিচারে সঠিক পথের সন্ধান মেলে। এমন সুচিন্তিত আবেদন আর কোন প্রার্থনায় আছে বলে আমার জানা নেই।

গায়ত্রী মন্ত্রের শক্তি সর্বসাধারণকে বুদ্ধিবলে বলবান করুক, এই কামনাই করি।


3 comments:

0

প্রবন্ধ - ইন্দ্রনীল মজুমদার

Posted in






আমরা এই ভীষণ অস্বস্তিকর গরমে একটা জিনিস খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারছি যে, গাছ আমাদের পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে এক অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে আসছে। গাছ ছাড়া আমরা তথা গোটা প্রাণিজগৎ বাঁচব না। গাছই পারে চারপাশের তাপমাত্রাকে ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে। কিন্তু আজ সরকারি নানান প্রকল্পের অজুহাতে কিংবা কর্পোরেটদের লোভের তাড়নায় অনেক গাছ কাটা হচ্ছে। সমাজের তথাকথিত নিয়ন্ত্রণকারীরা নিজেদের অসীম লোভ সামলাতে না পেরে গাছ কেটে নিজেদের পরিবেশকে এক বিশাল বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। রাজার ইচ্ছায় গাছ কাটা যায়। কিন্তু, আজকাল অসচেতন স্বার্থপর কিছু গাছকে বাঁচাতে না পারলেও পেরেছিল আজ থেকে প্রায় ৩০০ বছর আগের এই দেশেরই কিছু পরিবেশ সচেতন মানুষ।

ঘটনাটি ঘটে রাজস্থানের মারওয়ার অঞ্চলে। সেখানে বনাঞ্চল রক্ষার জন্য বিষ্ণোই সম্প্রদায়ের গ্রামবাসীরা এক আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। তাই এই পরিবেশরক্ষার আন্দোলনের নাম ‘বিষ্ণোই আন্দোলন’। রাজস্থানের পশ্চিমাঞ্চল অর্থাৎ থর মরুভূমি অঞ্চল, হরিয়ানা এবং পাঞ্জাব রাজ্যের কিছু অঞ্চল জুড়ে বিষ্ণোই সম্প্রদায়ের মানুষেরা বসবাস করে থাকে। মরুভূমি অঞ্চলে থাকার জন্য অতীতকাল থেকেই এঁরা বৃষ্টির জল সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলেন। তাঁরা বনাঞ্চলকে নিজেদের জীবনের অংশ করে তুলেছিলেন। শুধু তাই নয়, তাঁরা সহজ কৃষি কৌশল ব্যবহার করে মরুঅঞ্চলেও ফসল ফলাতে দক্ষতা অর্জন করেছেন। এভাবেই, তাঁদের রোজকার জীবনে আচার আচরণ মরুভূমির রুক্ষ পরিবেশকে সুস্থায়ী করে তুলেছিল। এইরকমই পরিবেশ রক্ষাকারী ও পরিবেশ নিবেদিত সম্প্রদায় হল বিষ্ণোই। বলা হয় যে, এঁরা বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের উপ-সম্প্রদায় হলেও ধর্মীয় রীতির দিক দিয়ে দেখতে গেলে পুরোপুরি হিন্দু নয়। কেননা এঁরা হিন্দুদের মতো মৃতদেহ পোড়ান না। কেননা মৃতদেহ পোড়াতে কাঠ ও গাছ লাগবে যে! তখন তো আর আধুনিক চুল্লি ছিল না। আর কাঠ ও গাছ বাঁচাতে তথা পরিবেশ বাঁচাতে তাঁরা মৃতদের দাফন করেন। এই বিষ্ণোই সম্প্রদায়ের মানুষের গুরু হলেন মহারাজ জাম্বাজী যিনি ১৪৮৫ সালে বিষ্ণোই বিশ্বাস বা ধারা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি গাছ ও প্রাণীর ক্ষতি করা নিষিদ্ধ এই নীতি তৈরি করে গিয়েছিলেন। আসলে, প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং মানব সম্প্রদায়কে একাত্ম করে তোলাই ছিল তাঁর মতাদর্শের নীতি। বিষ্ণোই ঐতিহ্যের এই জীবনাচারের ফলে পশ্চিম রাজস্থানের মারওয়ারের রাজপুত প্রধান মহারাজ জাম্বাজীকে গুরু জাম্বেশ্বরের আসনে বসিয়েছিলেন। গুরু জাম্বেশ্বর ২৯টি নীতি প্রণয়ন করেছিলেন যা একজন বিষ্ণোকে আমৃত্যু অনুসরণ করে চলতে হবে। এই নীতিগুলোর মধ্যে ছয়টি তো অসাধারণ যেগুলো দৈনন্দিন জীবনে পরিবেশ রক্ষা আর সমস্ত জীবন্ত প্রাণীর প্রতি সমবেদনার কথা বলে। শুধু গাছ কাটা নিষিদ্ধ করাই নয়, এই সম্প্রদায়ের মানুষদের পরিত্যক্ত প্রাণীদেরকে আশ্রয় দিতেই হবে। আবার এই সম্প্রদায়ে চারপাশের সকল বন্যপ্রাণীদের সঙ্গে প্রকৃতির সকল সম্পদকে ভাগাভাগি করতে বলা হয়েছে।

১৭৩৭ সাল। যখন যোধপুরের মহারাজা অভয় সিং রাঠোর তাঁর নতুন প্রাসাদের জন্য খেজরি গাছের খোঁজ করছিলেন। তিনি কর্মকর্তাদের কাছ থেকে জানতে পারেন যে, খেজারলি গ্রামে প্রচুর বড়ো বড়ো গাছ আছে। সেই গাছগুলো শুধু বড়োই নই শতবর্ষেরও প্রাচীন। তাঁর লোভদৃষ্টি পড়ে ঐ গাছগুলোর ওপর আর তার ফলে নিজের নতুন রাজপ্রাসাদের স্বার্থে সেই গাছগুলো কাটার নির্দেশ দেন। সেই গাছগুলো কাটার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য যে আন্দোলন গড়ে ওঠে তা হল ‘বিষ্ণোই আন্দোলন’। এই আন্দোলন অনেকটা ‘চিপকো আন্দোলন’-এর মতো কেননা এখানেও মহিলা-শিশুরা গাছগুলোকে জড়িয়ে ধরে সেগুলোকে আপ্রাণ রক্ষা করার চেষ্টা করেছিল। বৃদ্ধা অমৃতা দেবীর নেতৃত্বে খেজারলি এবং তার আশেপাশের গ্রামের বিষ্ণোই সম্প্রদায়ের গ্রামবাসীরা এই আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন।

তা রাজার কর্মকর্তারা সৈন্য বাহিনী নিয়ে যখন গাছ কাটতে সেই গ্রামের ধারে আসে তখন গ্রামবাসীরা তাদের প্রতিরোধ করেন। গ্রামবাসীরা বিষ্ণোই সম্প্রদায়ের বলে তাঁদের অঞ্চলের পবিত্র গাছগুলোকে অন্যায়ভাবে হত্যা মেনে নিতে পারেনি। অমৃতা দেবী নামের একজন বিষ্ণোই বৃদ্ধা তাঁর সম্প্রদায়ের সকল মহিলা ও শিশুদের সমবেত করে গাছগুলোকে আলিঙ্গন করে বা জড়িয়ে ধরে থাকেন যাতে রাজার লোকেরা গাছ কাটার আগে তাঁদেরকে কাটতে বাধ্য হয়। অমৃতা দেবীর তিন কন্যা আশু, রত্নী এবং ভাগু ও তাঁদের মায়ের সাথে যোগ দিয়েছিলেন এই আন্দোলনে। অন্যদিকে এই প্রতিরোধ দেখে রাজার আদেশের দোহাই দিয়ে মানুষ সহ গাছ কাটতে আরম্ভ করে রাজার সৈন্যরা। এই রাজ সৈন্যরা মানবতা মোটেও বুঝতো না, অশিক্ষার ফলে, অল্প বুদ্ধির ফলে ও রাজার আজ্ঞা পালন করার তাগিদে তারা গাছ কাটার কুড়ালের আঘাতে বিষ্ণোই নারী ও শিশুর দেহ টুকরো করার পরেই গাছগুলোকে টুকরো করে। পরিবেশবিরোধী গাছ কাটার সিদ্ধান্ত বিষ্ণোই গ্রামবাসীরা মেনে নিতে পারেনি আর তার ফলে ৩৬৩ জন নিহত হয়ে ‘বৃক্ষ শহীদ’ হন। ইসলামি শাসন কিন্তু নেই তবুও হিন্দু রাজার শাসনেই ঘটল এত বড় নৃশংসতা!

রাজা অভয় সিং এই নৃশংস ঘটনার কথা জানতে পেরেই গ্রামে ছুটে আসেন এবং গ্রামবাসীদের কাছে ক্ষমা চান। আর তার সাথে সৈন্যদেরও তিনি গাছ কাটার কাজ বন্ধ করার জন্য নির্দেশ দেন। রাজা হিসেবে নিজের ক্ষুণ্ণ ‘ইমেজ’ রক্ষা করার জন্যে হোক কিংবা মানবতার খাতিরে তখন তিনি বিষ্ণোই অঞ্চলকে একটি সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে মান্যতা দান করেন। আর গুরু মহারাজ জাম্বেশ্বরের অহিংস নীতি মেনে তিনি গাছ ও প্রাণীর ক্ষতি করে এমন কাজগুলোকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। তাঁর সেই ঘোষণা বা আইন আজও সেই বিষ্ণোই অঞ্চলে বিদ্যমান রয়েছে বলে জানা যায়।

এই বিষ্ণোই আন্দোলন মানব সমাজের বা পরিবেশবিদ্যার ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে এক অবিস্মরণীয় ও উল্লেখযোগ্য পরিবেশ আন্দোলন হিসেবে। প্রায় তিনশো বছর আগে রাজস্থানের বিষ্ণোই সম্প্রদায়ের এইসব গ্রামের মানুষেরাই অমৃতা দেবী নামক এক মহিলার নেতৃত্বে, তাঁদের কাছে পবিত্র খেজরি গাছগুলোকে রাজার একটি নতুন প্রাসাদের জন্য রাজসৈন্যদের দ্বারা কাটা পড়ার হাত থেকে বাঁচানোর একমাত্র বলা যায় প্রধান লক্ষ্যে আঁকড়ে ধরে রাজসৈন্যদের হাতে কাটা পড়ে নিজেদের জীবন বিসর্জন দিয়েছিলেন। পরিবেশ আন্দোলনের ধারা লক্ষ্য করলে বোঝ যায় যে এই ‘বিষ্ণোই আন্দোলন’ হল এই ভারত দেশ তথা উপমহাদেশে ঘটা প্রথম পরিবেশ আন্দোলন। যার ছায়া পাওয়া যায় চিপকো সহ বিভিন্ন পরিবেশ আন্দোলনে। এই ‘পরিবেশ দিবস (৫ই জুন)’-এর মাসে মহান বিষ্ণোই আন্দোলনের গাছ তথা পরিবেশ রক্ষার লড়াইয়ের সকল শহীদদের প্রতি রইলো সশ্রদ্ধ প্রণাম। তাঁদের স্মরণ করেই পরিবেশ রক্ষা করবার জন্য বেশি করে গাছ লাগাবার প্রতিজ্ঞা আমাদেরকে নিতেই হবে।

0 comments:

0

প্রবন্ধ - মনোজিৎকুমার দাস

Posted in








গাথাসপ্তশতী (সত্তাসাই বা গাহা কোশ) প্রাকৃত ভাষায় লেখা কবিতা সংগ্রহ। কবিতাগুলো প্রেম অপ্রেমের। কবিতাগুলোতে সাধারণত একজন বিবাহিত মহিলা বা অবিবাহিত মেয়ের খোলাখুলি প্রেম অপ্রেমের কথা উঠে এসেছে। তারা প্রায়ই তার বন্ধু, মা বা অন্য আত্মীয়, প্রেমিক, স্বামী বা নিজের কাছে তার অপ্রত্যাশিত অনুভূতি ও আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে,যা গাথা সপ্তশতীতে উঠে এসেছে।

প্রচীন ভারতের একটি উল্লেখযোগ্য রাজবংশ ছিল সাতবাহন । সময়কাল: খ্রিস্টীয় প্রথম শতক থেকে তৃতীয় শতক। উত্তর ভারতে নয়- সাতবাহন রাজ্য গড়ে উঠেছিল দক্ষিণভারতে। রাজ্যটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন: সিমুক। সাতবাহন বংশের রাজধানী ছিলতের প্রতিষ্ঠানপুর । হাল ছিলেন সংস্কৃতমনা একজন সাতবাহন রাজা। ইনি কেবল রাজ্যই শাসন করেননি- প্রাকৃতভাষায় লেখা কবিতার একটি সঙ্কলন গ্রন্থনা করেছিলেন, যাতে তাঁর নিজের লেখা কবিতাও ছিল। প্রাকৃতভাষা মানে প্রাচীন ভারতের সাধারণ জনগনের ভাষা- অর্থাৎ উচ্চকোটির সংস্কৃত ভাষা নয়। রাজা হাল কর্তৃক সঙ্কলিত কবিতার সঙ্কলনটির নাম: ‘গাথাসপ্তশতী বা সত্তাসাই বা গাহা ' বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কবির লেখা প্রায় সাতশ স্তবক রয়েছে গাথাসপ্তশতীতে।

সংগ্রহটি ১ম শতাব্দীতে বসবাসকারী রাজা হালা সংগ্রহ করেন । অনেক কবিতায় লেখকদের নাম অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, যার মধ্যে কিছু দক্ষিণ ভারতীয় কবিদের লেখা।

কবিতাগুলো সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়েছে, কখনও কখনও মুছে ফেলা হয়েছে এবং বিভিন্ন কবিতা দিয়ে প্রতিস্থাপিত হয়েছে, যদিও প্রতিটি পাণ্ডুলিপিতে শিরোনামের অর্থের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ৭০০টি কবিতা রয়েছে।

বিস্ময়করভাবে যা ধর্মনিরেপেক্ষ-শুধু ধর্মনিরেপেক্ষই নয়- গাথাসপ্তশতীর স্তবকগুলোতে যৌনতার আভাসও আছে। উদাহরণ দেয়া যেতে পারে।
১)
আমার মনে আছে-
ও আমার পায়ের কাছে বসে।
নিশ্চুপ।
ওর চুল নিয়ে খেলছিল আমার পায়ের পাতা।


২)
প্রেম।
হায়, হারিয়ে যাচ্ছে সবই।
মুঠো করো হাত।
মুখে মধুর স্তন।
একটি ফোঁটাও যেন মাটিতে না পড়ে।

একটি মেয়ের দাঁড়ানোর ভঙ্গিতে কিশোরীর প্রেমকাতর মনোদৈহিক ক্ষুধা এমনই তীব্র ভাবে ফুটে উঠেছে গাথাসপ্তশতীর এই গাথাটিতে। অবশ্যই এই গাথাটিতে আমরা দেখতে পাচ্ছি, ভেজানো দরজার কাছে মেয়েটি যেন কাকে খুঁজছে। রাস্তার দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে সে চেয়ে আছে। তার চাহনির মাঝে অবশ্যই প্রেমকাতরতা আছে।


ভেজানো দরজার কাছে দাঁড়ানো ও মেয়ে।
কাকে খুঁজছ তুমি?
উষ্ণ চোখ, বাদামি বৃন্ত-
রাস্তার দিকে চেয়ে রয়েছে।

প্রেমের আবেগের অনুষঙ্গ আছে। গাথা সপ্তশতী কামসূত্রের সাথে মেলে না। কামসূত্র প্রেম ও যৌনতার একটি তাত্ত্বিক কাজ। অন্যদিকে, গাথা সপ্তশতীতে প্রেমকে জটিল ও আবেগগতভাবে অপূর্ণ বলে মনে হয়।

সৌন্দর্যের বন্দনা ব্যক্ত হয়েছে নিচের স্তবকটিতে। সৌন্দর্যের কারণেই দুটো হৃদয় এক হয়, একজনের অঙ্গ প্রেমিকা বা প্রমিকের অঙ্গের সাথে মিলিত হয়। গাথাসপ্তশতীর নিচের অনুবাদে এ কথাই উঠে এসেছে।

ঈশ্বর ওকে গড়েছে।
ওর সৌন্দর্য আমার মন কেড়েছে।
ওর কথা আমার কানে, ওর হৃদয়ে
আমার হৃদয়; ওর অঙ্গে অঙ্গ
আমার।

অনেক কবিতায় একজন নারীর অনুভূতির রূপক তুলনা করার জন্য হিন্দুধর্মে দেব-দেবীর নামও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে গাথা সপ্তশতীর বিভিন্ন স্তবকে।

যে লোকরা এই কবিতাগুলো রচনা করেছিলেন তারা গ্রামীন জনপদ ও অরণ্যের সীমানার মাঝে বাস করতেন। কৃষি ও শিকার ছিল তাদের প্রধান পেশা। প্রায় ১০০টি কবিতায় ক্ষেত্র, চাষের অধীনে ফসল, চাষের সরঞ্জাম ও আনুষাঙ্গিক যেমন বেড়া দেওয়া, কৃষিকাজ পরিচালনা এবং কৃষি পণ্য সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াকরণের উল্লেখ রয়েছে। একইভাবে প্রায় ১০০টি কবিতায় শিকার করা প্রাণী, শিকারের সরঞ্জাম ও শিকার অভিযানের উল্লেখ রয়েছে।
প্রাকৃত ভাষার কবিতা নীতিবাগীশদের দ্বারা গ্রহণযোগ্য নয় বলে গাথা সপ্তশতীর একজন আক্ষেপ করে লিখেছেন---

এইসব নীতিবাগীশরা কেন প্রাকৃত কবিতা এড়িয়ে চলে?
এড়িয়ে চলে আমাদের গান, আমাদের প্রেম ও অপ্রেম।
ওরাও তো আমাদের গান ও কবিতার নির্যাস চায় জানি
তবে কেন তারা আমাদের প্রেমকে বলে ছাই?

গাথাসপ্তশতীর কয়েকটি স্তবকের অনুবাদ আমরা দেখতে পারি। কৃষক স্বামীটি দিনভর কাজ করে। কৃষকের বউটি স্বামীর জন্য অস্থির মনে হয় নিচের স্তবকটি পড়ে।

সে দিনভর কাজ করে ।
লাঙ্গল চষে জলাভুমির কাছে।
সেই রাতে তার বউ শুয়েছিল। ভারি অস্থির।
চোখ খোলা। বৃষ্টির ফোঁটা গুনছে।

নিচের স্তবকটি লক্ষ্য করুন, নারীটির সৌন্দর্য ফুটে ওঠেছে।আয়ত চোখের কারণে সে সুন্দরী। এই স্তবকটিতে প্রচ্ছন্ন আনন্দের অনুষঙ্গ বর্তমান। তার স্বামী অথবা প্রেমিক তাকে চন্দ্রমুখী সম্বোধন করে বলছেন তার আয়ত নয়নের কারণে রাতকে প্রহরে প্রহরে উপভোগ করবে।

ও চন্দ্রমূখী নারী,
তোমার আয়ত চোখের কারণে-
রাতও গিয়েছে বেড়ে-
আর আমিও সদ্ব্যবহার করি প্রহরের।

আমরা গাথাসপ্তশতীর আরো একটা স্তবকের অর্ন্তনিহীত অর্থ অনুধাবন করতে পারি। বাবা মার একটা অন্তরঙ্গ মূহুর্তের অভিব্যক্তি মেয়ের মুখে উঠে এসেছে। শেষ লাইনের --- ' চাঁদের কলঙ্কের মতন মায়ের চাঁদমুখ ' বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। মায়ের ফ্যাকাশে মুখকে ' চাঁদের কলঙ্ক' বলে কবি উপমা টেনেছেন।


ছোট ঘটনা। তবু মনে আছে।
মা রান্না করছিল। বাবা কী বলল।
মা হাসল। তারপর ছুঁলো নিজের ফ্যাকাশে মুখ।
চাঁদের কলঙ্কের মতন মায়ের চাঁদমুখ।

গাথাসপ্তশতীর আরো কয়েকটি গাথার বঙ্গানুবাদ আমরা তুলে ধরতে পারি, যেগুলো পড়ে প্রেম অপ্রেমের দোলাচল লক্ষ করা যায়।
১)
ও (মেয়েটি) খুবই দ্রুত ভাবতে পারে।
কিন্তু, আজ ও নিজেকে নিল সামলে।
বলল,‘সে তোমাকে দেখতে এসেছে।’
বলে প্রেমিককে দিল স্বামীর দিকে ঠেলে!
মেয়েটির দরজায় সে দাঁড়িয়ে।
সে কেবলি তরমুজ বিক্রি করতে চায় না।
কিন্তু, সে তো আর ছল জানে না।
যে নারকেল নিয়ে এসেছে সে যে বেশি চতুর!

২)
তারা যখন থামে
মেয়েটি গলার হার দেখে লজ্জ্বা পায়।
কিন্তু যেহেতু মেয়েটি কাপড়ের কাছে পৌঁছতে পারে না-
পুরুষটিকে আবার তুলে নেয়।


৩)
যে নারী জানে- কী করে ভালোবাসতে হয় নিজেকে-
জানে কী করে প্রশমিত করতে হয় ক্রোধ
যখন সে একই সঙ্গে শূন্য ও পূর্ন।


৪)
আমি দেখছি নর্তকীদের
কী যে ভালো লাগছে।
চুলের সুগন্ধী
তুমি আমায় পা দিয়েছিলে।


৫)
মেয়েটি বলেছিল আমায় কী করতে হবে।
অথচ সকালে ও কাপড় পড়ল
বাঁশের বেড়ার ওপাশে!

গাথাসপ্তশতীর কবিতাগুলো খ্রিস্টীয় প্রথম শতক থেকে তৃতীয় শতকে লেখা প্রাকৃত ভাষার অমূল্য সম্পদ হিসাবে চিরভাস্বর হয়ে থাকবে।

তথ্যসূত্র:

১) প্রাচীন ভারতের ইতিহাস (দ্বিতীয় খন্ড) - সুনীল চট্টোপাধ্যা
২)হাজার বছরের প্রেমের কবিতা -  অবন্তী স্যান্নাল

0 comments:

0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in




















৪১

ফাইনহালস ভাবছিল যে সে পরে কখনো কাজকর্ম শুরু করবে। আপাতত একদম বিশ্রাম। সে কয়েকটা দিন খালি ঘুমোবে। মায়ের আদরে প্রশ্রয়ে সময় কাটাবে সে। মা খুব খুশি হবে। দীর্ঘ সময়ের পর সে ফিরেছে এবং শীগগিরই তার কোথাও যাবার নেই। বাড়িতে নিশ্চয়ই কিছু না কিছু ব্যবস্থা আছে ধূমপানের জন্য। সে গড়িয়ে গড়িয়ে শুধু বই পড়বে আর ধূমপান করবে। ফ্রয়লাইন মের্ৎজবাখ নিশ্চয়ই এখন আগের চেয়ে ভালো পিয়ানো বাজাতে পারে। অতীতে এমন হয়েছে যে সে বাগানে বসে বই পড়ছে আর পাশের বাড়ি থেকে ভেসে আসা ফ্রয়লাইন মের্ৎজবাখের অপটু হাতের বাজনার শব্দ তাকে শুনতে হয়েছে। সে বড় সুখের সময় ছিল। যদিও সেই মুহূর্ত যে সুখের, এমন কথা অবশ্য সেই সময়ে মনে হয়নি তার। আজ সে জানে সে কথা। অনেক বিল্ডিং বানানোর স্বপ্ন দেখত সে আগে। ভাবত যে এমন সব বিল্ডিং বানাবে যেগুলো অতীতে কেউ বানায়নি। কিন্তু পরে তাকে এমন সব বিল্ডিং বানাতে হয়েছিল, যেগুলো তার কল্পনার সৃষ্টি থেকে বেশ কিছুটা আলাদা। সে একজন মধ্যমানের আর্কিটেক্ট হয়ে উঠেছে। তবে নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে ধ্যানধারণা থাকা খারাপ কিছু নয়। তাই সে এখন খুব সাদাসিধে বাড়িঘর বানাতে চায়, যেগুলো বানানো শেষ হলে তার মনে একটা অদ্ভুত তৃপ্তি হবে। জীবনে সব বিষয়ে নিজেকে নিয়ে গুরুগম্ভীর ভাবনা ভাবার কোনো প্রয়োজন নেই।

ঘরে ফিরবার পথটা এখন তার কাছে বড় দীর্ঘ মনে হচ্ছে। তবে খুব বেশি হলেও আর আধ ঘণ্টার বেশি সময় লাগবে না তার। শরীর বড় ক্লান্ত ঠেকছে। কেউ যদি এইটুকু পথ গাড়ি করে পৌঁছে দিত তাকে, খুব ভালো হত। সে বিছানায় শুয়ে এতক্ষণে ঘুম লাগাতো। যে পথটা এখন তাকে ধরতে হবে, এই ঘুরপথে যাওয়াটাও তার কাছে বিরক্তিকর। আমেরিকান ফ্রন্টের সামনে দিয়ে যেতে হবে তাকে। সমস্যা হতে পারে কিছু। সে এখন কোনো ঝামেলা চায় না। বড় ক্লান্ত লাগছে। সবকিছুই বিরক্তিকর বলে মনে হচ্ছে।

সে তার টুপি খুলে হাত জোড় করে মুঠো করে দাঁড়াল মধ্যাহ্নের ঘণ্টা শুনে। বুড়ো ফিঙ্ক আর বাচ্চাটাও ঘণ্টা শুনে তাই করল। কফিন বানাচ্ছিল যে ছুতোর, সেও কাজ ফেলে, যন্ত্রপাতি দূরে সরিয়ে হাত জোড় করে দাঁড়াল। যে মহিলা সব্জি বেছে কাটছিল উঠোনে বসে, সেও ঝুড়ি সরিয়ে হাত জোড় করে দাঁড়াল উঠোনে। সর্বসমক্ষে প্রার্থনা করতে মানুষ আর আজকাল লজ্জা পায় না। যদিও পুরো ব্যাপারটা অসহ্য বিরক্তিকর মনে হল তার নিজের কাছেও। সে নিজেও অতীতে প্রার্থনা করেছে, তবে একান্তে। ইলোনাও প্রার্থনা করতো। ভারি ধর্মপ্রাণ বুদ্ধিমতী মহিলা ছিল সে। সে খুব সুন্দরী ছিল, জ্ঞানগম্যি বেশ ভালো ছিল। ইলোনার এতটাই ধর্মে মতি ছিল যে পুরোহিত বা ধর্মযাজকদের দেখেও তার ধর্মবিশ্বাস এতটুকু টলে যায়নি। ফাইনহালস নিজে যখন প্রার্থনা করত, সে লক্ষ্য করেছে অভ্যাসবশত সে ঈশ্বরের কাছে কিছু না কিছু চাইতো, যদিও তার সেরকম বিশাল কোনো চাহিদা ছিল না। এখন তো ইলোনা আর নেই, সে মৃত। ফলে এখন ফাইনহালস যদি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে, তাহলে সে কী চাইবে? ইলোনা যাতে তার কাছে ফিরে আসে, সেইজন্য সে অতীতে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতো। সে এখন বাড়ি ফিরতে চায় শান্তিতে; তাই নির্বিঘ্নে বাড়ি ফিরবার জন্য প্রার্থনা করল ঈশ্বরের কাছে। যারা নিয়মিত প্রার্থনা করে ঈশ্বরের কাছে, ফাইনহালসের সন্দেহ হয় যে তারা প্রতিদিন কোনো না কোনও ইচ্ছে পূর্ণ হবার জন্য, ক্ষুদ্র স্বার্থের জন্য ঈশ্বরের প্রার্থনা করে। কিন্তু ইলোনা তাকে বলেছিল… ‘আমাদের ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করা উচিত, যাতে ঈশ্বরের কষ্ট না হয়।’ ইলোনা নাকি কোথায় পড়েছিল এমন ভাবনার কথা; অভূতপূর্ব মনে হয়েছিল তার। এখন ফাইনহালস নিজে প্রার্থনা করছে। প্রার্থনা ঠিকঠাক তখনই হওয়া সম্ভব, যখন মানুষ সেভাবে নিজের ইচ্ছাপূরণের জন্য কিছুই চায় না। সে অতীতে গির্জায় গিয়েছে; কিন্তু কেন কে জানে ধর্মযাজকদের চেহারা, মুখচ্ছবি, তাদের বক্তৃতা দেওয়া ধর্মের বাণী… সবকিছুই তার কাছে অসহ্য বোধ হত। তবে সে ঈশ্বরকে কষ্ট দিতে চায়নি। ঈশ্বর হয়তো ধর্মযাজকদের মুখচ্ছবি এবং বাণী ইত্যাদিতেই ভালো থাকেন। নিজের অজান্তে তার মুখে একচিলতে হাসি ফুটে উঠল। প্রার্থনা শেষ করে হাতজোড়ের মুঠো খুলে টুপিটা ফের পরে নিল সে।

‘ওই যে দেখুন!’ বলে উঠলেন বুড়ো ফিঙ্ক… ‘এখন আবার ওদের অন্য কোথাও চালান করে দিচ্ছে।’ হাইডেসহাইমের দিকে আঙুল তুলে দেখালেন তিনি। ফাইনহালস দেখতে পেল কফিনের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটা ট্রাক। ট্রাকে তোলা হচ্ছে সেই অফিসারদের যারা ফিঙ্কদের বাড়িতে ছোট হলঘরে ছিল। সেই অফিসারদের বুকে আঁটা মেডেলগুলো অবধি পাহাড়ের উপর থেকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। তারপর সেই ট্রাকটা খুব তাড়াতাড়ি গাছে গাছে ঢাকা গ্রামের পথ ধরে দূরে মিলিয়ে গেল পশ্চিমদিকে, যেখানে কোনো যুদ্ধের চিহ্নমাত্র নেই…

‘ওরা অবশ্য বলেছিল যে খুব শীগগির একটা পদক্ষেপ নেবে’ বলে উঠলেন ফিঙ্ক, ‘ট্যাঙ্কগুলো দেখতে পাচ্ছেন আপনি?’

‘আশা করি ভাইডেসহাইম শীগগির জয় করে নেবে ওরা’ বলে ফাইনহালস। মাথা নাড়েন বুড়ো ফিঙ্ক, ‘বেশি সময় লাগবে না… তারপর আমাদের সঙ্গে আবার দেখা করতে আসবেন তো?’

‘হ্যাঁ’ বলে ফাইনহালস, ‘মাঝেমাঝেই এসে আপনাদের সঙ্গে দেখা করব।’

‘খুব খুশি হব,’ বলেন বুড়ো ফিঙ্ক… ‘একটু তামাক চলবে নাকি?’

‘ধন্যবাদ!’ বলে ফাইনহালস, সে নিজেই তামাক নিয়ে ভর্তি করে পাইপ। বুড়ো ফিঙ্ক অগ্নিসংযোগ করে দেন তাতে। সবাই তাকিয়ে থাকে পাহাড়ের নিচে ফুলে ফুলে ঢাকা উপত্যকার দিকে। বুড়ো ফিঙ্ক নাতির মাথায় হাত রাখেন।

‘এখন এগোব আমি’ হঠাৎ বলে ওঠে ফাইনহালস, ‘আমাকে যেতে হবে, আমি ঘরে ফিরতে চাই…’

‘যান’ বলে ওঠেন বুড়ো ফিঙ্ক, ‘ধীরে সুস্থে চলে যান, এখন কোথাও কোনো বিপদ নেই।’

ফাইনহালস করমর্দন করে, ‘আপনাকে অনেক ধন্যবাদ!’ বলে সে তাকায় বুড়োর দিকে… ‘অনেক অনেক ধন্যবাদ… আশা করি শীগগির আপনাদের সঙ্গে দেখা করতে পারব।’ ফাইনহালস শিশুটির সঙ্গেও করমর্দন করে। শিশুটি ভাবুক এবং সন্দিগ্ধ ঘন কালো সরু চোখে তার দিকে চেয়ে থাকে।

‘আপনি কাস্তেটা সঙ্গে নিন’… বলেন বুড়ো ফিঙ্ক, ‘তাহলে আরও ভালো হবে।’

‘ধন্যবাদ’ বলে ফাইনহালস। ফিঙ্কের হাত থেকে কাস্তেটা নিয়ে পথ চলতে শুরু করে সে। একমুহূর্তের জন্য মনে হচ্ছিল যে সে কফিনের দোকানের দিকের পাহাড়ের ধাপে চড়তে শুরু করেছে। কিছুদূর গিয়ে একদম পরিষ্কার চকচকে হলদে কাঠের বাক্স দেখা যাচ্ছিল। দূরবিন দিয়ে দেখলে যেমন আরও বড়, আরও পরিষ্কার দেখা যায়, তেমনি পরিষ্কার সে দেখতে পাচ্ছিল খালি চোখেই কফিনের দোকানের উঠোনটা, যতক্ষণ না সে ডানদিকে বেঁকে গ্রাম পেরিয়ে যাবার পথটা ধরল। ধীরে ধীরে স্কুল থেকে ছুটির পর বেরিয়ে আসা ছাত্রছাত্রীদের ভিড়ের মধ্য দিয়ে গিয়ে বেরিয়ে গেল সে হাইডেসহাইম থেকে। বাদাবনের মধ্য দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে যাবার কোনো ইচ্ছে ছিল না তার। খুবই বিরক্তিকর ব্যাপার সেটা তার কাছে। তাছাড়া একবার ডানদিকের পথ ধরে আবার ঘুরপথে বাঁয়ে গেলেই লোকজনের সন্দেহ আরও বেশি হবে।

সোজা পথটা যেটা উপত্যকার ফলের বাগানের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, সেটা ধরল সে। পথটা শান্ত, চুপচাপ। তার একশ মিটার সামনেই সে কাস্তে হাতে আরেকজন মানুষকে দেখতে পেল।

ভাইডেসহাইমে ঢুকবার মুখে আমেরিকান প্রহরী আছে দু জন। স্টিলের হেলমেট খুলে সিগারেট খাচ্ছে তারা। ফুলে ফুলে ঢাকা গাছগাছালির মাঝে দাঁড়িয়ে খুব একঘেয়ে লাগছে তাদের, সেটা বোঝাই যাচ্ছে। ফাইনহালসের দিকে তাকালই না তারা। তিন সপ্তাহ ধরে তারা এখানে থানা গেড়ে বসে আছে, তার মধ্যে গত দুই সপ্তাহে ভাইডেসহাইমের দিকে একটাও গুলিগোলা চলেনি। ফাইনহালস শান্তভাবে প্রহরীদের পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাবার সময় একবার মাথা নাড়ল। প্রহরীরাও নির্বিকারভাবে মাথা নাড়ল তার দিকে চেয়ে।

আর মাত্র মিনিটদশেক যেতে হবে তাকে। বাগানের মধ্য দিয়ে সোজা, তারপর বাঁয়ে হয়সার আর হোপেনরাথের বাড়ি পেরিয়ে প্রধান সড়ক দিয়ে একটু নিচু ঢালে গেলেই বাড়ি। পথে হয়তো চেনা কারো সঙ্গে দেখা হতে পারে। কিন্তু কারো সঙ্গেই দেখা হল না পথে। চারদিক অস্বাভাবিক রকমের চুপচাপ। শুধু দূরে ট্রাকের শব্দ শোনা যাচ্ছে মাঝে মাঝে। তবে এখন মনে হয় না কেউ গুলিগোলা ছুঁড়বার কথা ভাবছে। প্রতিদিন যেমন হুঁশিয়ারি দেবার মত করে গ্রেনেড ছোঁড়ে এরা, সেসবও আজ বন্ধ।

ইলোনার কথা মনে এলো তার। এই মনে হওয়ার সঙ্গে কিছুটা তিক্ততা লেগে আছে। তার মাঝে মাঝে মনে হয় যে ইলোনা তাকে এড়িয়ে যাচ্ছে। কোথাও পালিয়ে গেছে হয়তো। মরে গেছে? মরে গেছে… মরে যাওয়াটাই যেন একমাত্র সোজা কাজ। এখন তো ইলোনার তার সঙ্গেই থাকার কথা ছিল। তার মনে হয়েছিল যে একমাত্র ইলোনাই তার সঙ্গে থাকতে পারে। কিন্তু হয়তো সেও বুঝেছিল, যে প্রেম অল্প কিছু মুহূর্তের জন্য সত্যি, তার উপর ভর করে জীবনের সিদ্ধান্ত নেওয়া চলে না। একসঙ্গে বৃদ্ধ না হওয়াই ভালো। তাহলে সে প্রেম নষ্ট হয়ে যায়। চিরদিন একসঙ্গে কাটাবার মত যে প্রেম, সেটা কিছুটা আলাদা রকমের হবে হয়তো। ইলোনা অনেক কিছু জানত, যেটা সে জানে না। তার হঠাৎ নিজেকে বঞ্চিত বলে মনে হল। কারণ, সে কিছুক্ষণের মধ্যেই বাড়ি ফিরবে, সেখানে থাকবে, খুব বেশি কাজ করবে না, পড়বে, এবং প্রার্থনা করবে যাতে ঈশ্বরের কষ্ট না হয়, এমন কিছু চাইবে না ঈশ্বরের কাছে নিজের ক্ষুদ্রস্বার্থের জন্য… টাকাকড়ি, সাফল্য, আর যা কিছু মানুষ জীবনে চায় আর কি! তাছাড়া এমন কোনো বিল্ডিং বানানো, যেটা শুধুমাত্র সে বানাতে পারে, এরকম কিছু অবশ্য যে কোনো মধ্যমেধার আর্কিটেক্ট বানিয়ে দেবে। ফলে কী আর চাইবে সে?

হোপেনরাথদের বাগানের পাশ দিয়ে যাবার সময়ে তার মুখে একচিলতে হাসি ফুটে উঠল… এরা এখনও বাগানের গাছে সাদা রঙের মিশ্রণটা লাগিয়ে দেয়নি, যেটা ফাইনহালসের বাবা গাছে দিতে বলতেন সবাইকে, সেটা দেওয়া নাকি ভীষণ দরকারি। বুড়ো হোপেনরাথের সঙ্গে এই নিয়ে ঝামেলা হত তাঁর। কিন্তু বুড়ো হোপেনরাথ এখনও রঙ লাগায়নি গাছগুলোতে।

এখন আর খুব বেশি দূরে নয় তার ঘর। বাঁয়ে হয়সারদের বাড়ি, ডাইনে হোপেনরাথদের। এখন মাঝের সরু গলিটা দিয়ে কিছুটা যেতে হবে। তারপর প্রধান সড়ক ধরে একটু বাঁয়ে নিচু ঢালে নামলেই তাদের বাড়ি। হয়সারদের বাগানের গাছে সাদা রঙটা লাগানো হয়েছে। সে মুচকি হাসল। তারপরেই সে গোলার শব্দ শুনতে পেল পরিষ্কার। সে সঙ্গে সঙ্গে শুয়ে পড়ল মাটিতে। একটু হাসবার চেষ্টা করল, কিন্তু আবার একই সঙ্গে ভয় পেয়ে গেল, কারণ গোলাটা হোপেনরাথদের বাগানে পড়েছে। গোলাটা বাগানের কোনো একটা গাছে গিয়ে পড়েছে, আর গাছগুলো থেকে ঝরঝর করে বৃষ্টির মত সাদা ফুল ঝরে পড়ছে উপত্যকার মাটিতে। দ্বিতীয় গোলাটা অনেকটা দূরে কোথাও পড়ল, সম্ভবত বয়মারদের বাড়ির কাছাকাছি, যেটা তাঁর বাবার বাড়ির ঠিক উল্টোদিকে। তৃতীয় এবং চতুর্থটাও ওইদিকেই পড়ল, তবে আরেকটু বাঁয়ে এবং এই দুটো ততটা উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন নয় আগেরগুলোর মত। সে ধীরে ধীরে উঠল। পঞ্চমটাও ওই দিকেই পড়ল। সে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। সব চুপচাপ। কেবলমাত্র সারা গ্রামের কুকুরগুলো ডাকতে শুরু করেছে। হয়সারের খামারের হাঁসমুরগিগুলো সন্ত্রস্ত হয়ে ডানা ঝাপটে যাচ্ছে। অন্য কোনো খামারে গরুর দল প্রবল ভীত কণ্ঠে হাম্বারব জুড়ে দিয়েছে। সে ভাবতে লাগল… এই গোলাগুলি বর্ষণ একেবারে অর্থহীন… অর্থহীন।

তবে হয়তো ওরা সেই আমেরিকান গাড়িটাকে লক্ষ্য করে গোলা ছুঁড়ছে। সেই গাড়িটা ফিরে যাবার শব্দ পায়নি সে। কিন্তু বড় রাস্তার কোণে যখন সে পৌঁছালো, সেখানে কোনো গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল না। ফ্রয়লাইন মের্ৎজবাখের প্রেমিক এতক্ষণে ফিরে গেছেন। রাস্তাটা একদম খালি। শুধু গরুদের হাম্বারব এবং কুকুরের ঘেউঘেউ ছাড়া পথে বাকি কয়েকটা পদক্ষেপে তাঁর সঙ্গে আর কেউ বা কিছুই নেই।

এই পথে শুধুমাত্র তার বাবার বাড়িটাতেই সাদা পতাকা টাঙ্গানো আছে। পতাকাটা বেশ বড়। মাঝেমধ্যে বাড়িতে অনুষ্ঠান হলে, আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব এলে যে টেবিলক্লথটা আলমারি থেকে মা বের করতেন, সেই টেবিলক্লথ দিয়েই পতাকাটা বানানো হয়েছে। মুখে মুচকি হাসি ফুটে উঠল তার আবার। কিন্তু হঠাৎ পরক্ষণে মাটিতে শুয়ে নিজেকে ছুঁড়ে দিতে দিতেও বুঝতে পারল সে যে একটু দেরি হয়ে গেছে। এসব গোলাগুলি একদম অর্থহীন… ভাবল সে… একেবারে অর্থহীন।

ষষ্ঠ গোলাটা গিয়ে লেগেছে তার বাবার বাড়ির ত্রিকোণ ছাদের গায়ে। বাড়ির দেওয়াল থেকে পাথর, প্লাস্টার খুলে রাস্তায় ছিটকে ছিটকে পড়ছে। সে শুনতে পেল বাড়ির মাটির নিচে সেলারের ঘর থেকে তার মায়ের আর্তচিৎকার। সে তাড়াতাড়ি হামাগুড়ি দিয়ে বাড়িটার দিকে যাবার চেষ্টা করল। সপ্তম গ্রেনেডটা পড়বার আগে সে নিজেই চেঁচিয়ে উঠেছিল জোরে। কয়েক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল তার যে মরে যাওয়াটা একেবারেই সোজা ব্যাপার নয়। ওই গোলাটা তার শরীরে আঘাত করবার কয়েক সেকেন্ড আগে সে আর্তনাদ করে গড়াতে গড়াতে পৌঁছে গিয়েছিল তার বাড়ির চৌকাঠের ঠিক সামনে। পতাকার দণ্ডটা ভেঙে সাদা কাপড়টা উপর থেকে মাটিতে পড়ে ঢেকে দিয়েছিল তার শরীর। (শেষ)

0 comments:

0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in




















১৩

আমাদের শিবপালগঞ্জ মহকুমা সদর বটে, কিন্তু এমন কিছু বড় গ্রাম নয় যে ওকে টাউন বলা যাবে। ওখানে একটা গ্রামসভা রয়েছে আর শিবপালগঞ্জের বাসিন্দাদের ইচ্ছে যে ওটা টাউন নয়, গ্রামসভাই থাকুক, নইলে ঘরদোরের জন্যে বেশি ট্যাক্স দিতে হবে। এই গ্রামসভার প্রধান হলেন স্বভাবকবি রামাধীন ভীখমখেড়ীর ভাই।

ওনাকে তারিফ করতে হয়, কারণ সাতবার লাগাতার উনি গ্রামসভার প্রধান রয়েছেন, অথচ জেলেও যাননি, পাগলাগারদেও নয়। ‘গঞ্জহা’দের মধ্যে উনি নিজের মূর্খামির জন্য প্রসিদ্ধ। এইজন্যেই উনি ‘প্রধান’ পদে অভিষিক্ত হওয়ার আগে সবার প্রিয় ছিলেন। বাইরে থেকে কোন আধিকারিক এই গ্রামে পরিদর্শনে এলে এরা প্রধানকে অফিসারদের সামনে যেন থালায় চড়িয়ে পেশ করত। কখনও কখনও এমনও বলত—সাহেব, শহর থেকে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের তো আপনারা হাজারবার দেখেছেন, এবার না হয় এখানকার মাল কেমন দেখে নিন।

গ্রামসভার নির্বাচন হবে আগামী জানুয়ারি মাসে, আর এখন নভেম্বর। প্রশ্ন হল এবার কাকে ‘প্রধান’ করা যায়। গতবারের নির্বাচনে বৈদ্যজী বিশেষ আগ্রহ দেখাননি, কারণ উনি তখন গ্রামসভার কাজটাজকে মহা-ফালতু টাইপের ভাবতেন। এক হিসাবে ফালতু তো বটেই, কারণ গ্রামসভাতে যেসব সরকারি আধিকারিকেরা আসতেন তাঁরা সব ওই দুধভাত গোছের, মানে ফালতু অফিসার। ওনাদের না ছিল পুলিসের ডান্ডা, না তহসীলদারের দাপট।

তাই রোজ রোজ অমন সব অফিসারের কাছে কাজের হিসেব পেশ করা মানে নিজেদের মান-ইজ্জত খোয়ানো। গ্রামসভার প্রধানকে জমিটমির জন্যে মামলা করতে হত, কিন্তু শহরের আদালতে হাকিম এবং উকিলদের সঙ্গে এনার তেমন কোন ওঠাবসা ছিল না যেমনটি এক চোরের সঙ্গে অন্য চোরের থাকে। মামলাবাজির দুনিয়ায় লোকজনের সঙ্গে দুশমনি বেড়ে যায়, অথচ, মুশকিলে পড়লে পুলিস ব্যাটারা শুধু মুচকি হাসে আর কখনও কখনও মোটা আওয়াজে “পরধানজী” ডেকে থানার বাইরের ভূগোল শেখাতে থাকে।

ইদানীং, গ্রামসভার কাজকর্মে বৈদ্যজীর রুচি বেড়ে গেছে, কারণটি প্রধানমন্ত্রীজির একটি বক্তৃতা - যা উনি খবরের কাগজে পড়ে থাকবেন। ওই বক্তৃতায় বলা হয়েছে—গ্রামের উন্নয়ন শুধু স্কুল, সহকারী সমিতি এবং গ্রাম-পঞ্চায়েতের মাধ্যমেই হতে পারে। হঠাৎ বৈদ্যজীর খেয়াল হল—এতদিন উনি পল্লী উন্নয়নের কাজ শুধু কো-অপারেটিভ ইউনিয়ন এবং কলেজের মাধ্যমেই করে এসেছেন। গ্রাম-পঞ্চায়েত তো ওনার নাগালের বাইরেই রয়ে গেছে!

“আহা! এজন্যেই বুঝি শিবপালগঞ্জের ঠিকমত বিকাশ হচ্ছে না। তাই ভাবি, ব্যাপারটা কী”?

খেয়াল হতেই কতকগুলো বিষয় স্পষ্ট হল। এক, রামাধীনের ভাই তো গ্রামসভার সর্বনাশ করে ছেড়েছে। গ্রামের পতিত জমিতে লোকজন ইচ্ছেমত জবরদখল করে ঘর তুলেছে--নিঘঘাৎ প্রধান ব্যাটা ঘুষ খেয়েছে। গ্রাম-পঞ্চায়েতের ভাঁড়ারে মা-ভবানী, নিশ্চয় প্রধান তহবিল-তছরূপ করেছে। গ্রামের এখানে সেখানে জঞ্জাল জমেছে, প্রধান ব্যাটা যে একটা শুয়োরের বাচ্চা –এ’নিয়ে কোন সন্দেহ আছে? থানাদার প্রধানের নালিশ শুনে বেশ ক’জনকে হাজতে পুরেছে—এর মানে ও এখন পুলিশের দালাল!

প্রধানজী বন্দুকের লাইসেন্স পেয়েছে! ওটা নিশ্চয়ই ডাকাতির জন্য ভাড়া খাটে! আরে গতবছর যে আমাদের গাঁয়ে বজরঙ্গী খুন হল, তার রহস্য কি এখনও অজানা?


যারা ভাঙ খায় তাদের সমাজে তরিবত করে ভাঙ বাটাকে এক শিল্প, কাব্য, বা সংস্কৃতির সম্মান দেওয়া হয়। অবশ্যি, একটু ভাঙের পাতা চিবিয়ে নিয়ে এক লোটা জল খেলেই বেশ জম্পেশ নেশা হয় । তবে ওটা হল শস্তার নেশাখোরি। আদর্শ ভাঙ তৈরির রেসিপি হল ওর সঙ্গে বাদাম, পেস্তা, গোলাপের পাপড়ি, দুধ-সর মেশানো। ভাঙের পাতাকে এমন পিষতে হবে যে শিল-নোড়া এক হয়ে এ’ওর গায়ে আঠা হয়ে লেগে থাকবে। আর ভাঙের শরবতে চুমুক দেওয়ার আগে ভোলানাথ শিবের বন্দনায় দু’ছত্র শোনাতে হয়। অর্থাৎ, পুরো ব্যাপারটা ব্যক্তিগত না হয়ে সমষ্টিগত বা গোষ্ঠীগত হতে হবে।

শনিচরের কাজ হল বৈদ্যজীর দরবারে ভাঙের সামাজিক চরিত্রকে রূপ দেওয়া। এই সময় ও অন্যদিনের মতই বৈঠকখানার বারান্দায় বসে শিলনোড়ায় ভাঙ পেষায় ব্যস্ত ছিল। এমন সময় ভেতর থেকে কেউ ডাকল—শনিচর!

শনিচর ফোঁস করে ফণা তোলার মত মাথা তুলে তাকালো। বৈদ্যজী বললেন—ভাঙ পেষার কাজটা অন্য কাউকে দিয়ে তুমি ভেতরে চলে এস।

শনিচরের মনে হল যেন ওকে মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করতে বলা হচ্ছে। ও বিরক্তিতে গজগজ করতে লাগল—কাকে দেব? এই কাজটা করার আর কেউ আছে? আজকালকার ছোঁড়াগুলো ভাঙ পেষার কী জানে! হলুদ-লংকা বাটার মত করে পিষে ছাড়বে!

কিন্তু এসব বলে শেষে ও’ একজন অল্পবয়েসীর হাতে শিলনোড়ার দায়িত্ব সঁপে দিল। তারপর হাত-টাত ধুয়ে আন্ডারওয়ারের পেছনে মুছতে মুছতে বৈদ্যজীর সামনে হাজির হল।

তক্তপোষের উপর বৈদ্যজী, রঙ্গনাথ, বদ্রী পালোয়ান এবং কলেজের প্রিন্সিপাল সাহেব বসে আছেন। প্রিন্সিপাল একটু কোণের দিকে সরে গিয়ে বললেন—বসে পড়ুন, শনিচরজী।

এই কথায় শনিচর সতর্ক হয়ে গেল। ওর মুখের ভাঙা দাঁত বাইরে বেরিয়ে এল আর ও খসখসিয়ে বুকের লোম চুলকাতে লাগল। ওর চেহারা এখন একটু বোকা-বোকা লাগছে বটে, তবে, চালাকির মোকাবিলা কীভাবে করতে হয় সেটা ওর জানা আছে। ও মুখ খুলল—আরে প্রিন্সিপাল সাহেব, আপনাদের সঙ্গে একাসনে বসিয়ে আমাকে নরকে পাঠাবেন না।

বদ্রী পালোয়ান হেসে ফেলল। --শালা! গঞ্জহাপনা ঝাড়ছিস্‌? প্রিন্সিপাল সাহেবের সঙ্গে বসলে নরকে যাবি?

তারপর আওয়াজ পরিবর্তন করে বলল—ও’ পাশে গিয়ে বসে পড়্‌।

বৈদ্যজী এবার শাশ্বত সত্য উচ্চারণের ভঙ্গিতে বললেন—এভাবে কথা বলো না বদ্রী। মঙ্গলদাসজী এবার কী হতে চলেছেন তার কোন আভাস পেয়েছ?

মঙ্গলদাস! শনিচর কত বছর পরে নিজের বাপ-মা’র দেয়া নাম শুনল! ও বসে পড়ল এবং বেশ মুরুব্বি চালে বলল—পালোয়ানকে আর কত অপমান করবেন , মহারাজ? কতই বা বয়েস। সময় হলে সব বুঝতে পারবেন।

বৈদ্যজী মুখ খুললেন—তাহলে প্রিন্সিপাল সাহেব, যা বলার বলে ফেলুন।

উনি এবার অবধী বোলিতে শুরু করলেন—বলার আর আছেটা কী? আপনারা সব জানেন।

এরপর খড়িবোলী হিন্দিতে – গ্রামসভার নির্বাচন আসন্ন। সভার প্রধান বা সভাপতি পদমর্যাদায় এখানকার গুরুত্বপূর্ণ লোক। উনি কলেজ-কমিটিরও সদস্য, মানে আমারও অফিসার।

বৈদ্যজী হঠাৎ বলে উঠলেন—শোন মঙ্গলদাস, এ বার আমরা তোমাকেই গ্রামসভার প্রধান করব।

শনিচরের চেহারা বেঁকেচুরে গেল। ও হাত জোড় করল। কোন সতরঞ্জি- বিছানেওয়ালা গুপ্তরোগে পীড়িত তুচ্ছ কার্যকর্তাকে হঠাৎ যদি মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান হতে বলা হয় তাহলে তার যা অবস্থা হয় আর কি! নিজেকে খানিক সামলে নিয়ে বলল—না না মহারাজ! আমার মত নালায়েক অধমকে আপনি যে এই পদের লায়েক ভেবেছেন –তাই যথেষ্ট। কিন্তু আমি এই ইজ্জতের যোগ্য নই।

হঠাৎ করে এত উন্নত ভাষা এবং উর্দু শব্দ মুখে থেকে বেরিয়ে আসায় শনিচর নিজেই হতভম্ব। তবে বদ্রী পালোয়ান বলতে ছাড়ল না।–আবে! এখন থেকেই এত বাতেলা মারিস না। এসব তো লোকে পদ পাওয়ার পর বলে। সেই সুদিনের জন্যে এসব বাঁচিয়ে রাখ।

এতক্ষণ পরে রঙ্গনাথ ময়দানে নামল। শনিচরের কাঁধ থপথপিয়ে বলল—প্রশ্নটা লায়েক-নালায়েকের নয়, শনিচর। আমরা জানি যে তুমি নালায়েক। কিন্তু তুমি কি নিজের ইচ্ছেয় প্রধান হবে? এবার জনগণ তোমাকে ‘প্রধান’ বানিয়ে ছাড়বে। জনগণ যা চাইবে, সেটা মানতে হবে। তুমি-আমি বলার কে?

পালোয়ান উবাচ,-- ছেলে-ছোকরার দল দিনরাত তোমাকে বোকা বানায়। তখন তুমি কর কী? কেবল বোকা সেজে থাকো, এই না?

প্রিন্সিপাল সাহেব শিক্ষিত ব্যক্তির মত বোঝাতে লাগলেন—‘’হ্যাঁ ভাই, দেশে প্রজাতন্ত্র চলছে। সব এভাবেই হয়ে থাকে’। শনিচরকে আরও উৎসাহ দিতে গিয়ে উনি বল্লেন—‘ সাবাস শনিচর! তৈরি হও’! এসব বলে উনি ‘বাঢ় খেয়ে ক্ষুদিরাম হও’ স্টাইলে শনিচরের দিকে তাকালেন। শনিচরের ঘনঘন মাথা নড়া বন্ধ হয়ে গেছে।

প্রিন্সিপাল শেষবারের মত ‘হেঁইও’ করলেন, “কোন হেঁজিপেঁজি প্রধান হতে পারে না। গ্রামসভার প্রধান হয় কোন দমদার লোক। খুব সম্মান। পুরো গাঁয়ের জমিন-জায়দাদের মালিক। চাইলে একদিনেই লাখ টাকা এদিক -সেদিক করতে পারে। ও’ স্থানীয় হাকিমও বটে! ইচ্ছে হলে গোটা গাঁয়ের লোককে ধারা ১০৭ লাগিয়ে চালান করে হাজতে বন্ধ করে দেয়। বড় বড় অফিসার ওর ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে। যার নামে চুকলি করে তার হাতে হ্যারিকেন।

“কাগজে একটা সীল লাগিয়ে যখন ইচ্ছে যত ইচ্ছে তেল আর চিনি বের করে নেয়। ওর সবাই আদেশ ছাড়া গ্রামের কোন লোক নিজের ঘরের পেছনের আস্তাকুঁড়ে ময়লাও ফেলতে পারেনা।

সবাই ওর বুদ্ধিতে চলে। সবার চাবি ওর কাছে গচ্ছিত। ওই হল অনাথের নাথ। কী বুঝলে”?

রঙ্গনাথের মনে হল এসব যেন আদর্শবাদের মাপকাঠিতে কিঞ্চিৎ খেলো হয়ে যাচ্ছে। ও বলল,

“আপনি তো মাস্টারমশাই, গ্রামপ্রধানকে একেবারে ডাকু বানিয়ে ছাড়লেন”।

প্রিন্সিপাল ‘হেঁ-হেঁ-হেঁ’ করে ভাব দেখালেন যেন উনি জেনেবুঝে এইসব বোকার মত কথাবার্তা বলছেন। এটাই ওনার স্টাইল। বোকার মত কথা বলতে বলতে উনি শ্রোতাকে এটাও বুঝিয়ে দেন যে নিজের বোকামির সম্বন্ধে উনি বিলকুল অবগত আছেন এবং তার মানে—উনি আদৌ বোকা নন।

“হেঁ-হেঁ-হেঁ রঙ্গনাথ বাবু। আপনিও ভুল বুঝলেন? আমি তো এখন যিনি গ্রামসভার প্রধান তাঁর কথা বলছিলাম”।

রঙ্গনাথ প্রিন্সিপালকে খেয়াল করে দেখল। এ তো নিজের ক্যাবলামির কাদাও দুশমনের মাথায় লেপে দেয়। তার নামে কলংক রটায়। বুদ্ধির হাতিয়ার দিয়ে শত্রুনিধন সবাই করে। এখানে তো বোকামির হাতিয়ার দিয়ে বিরোধীদের নাস্তানাবুদ করার খেলা চলছে। খানিকক্ষণ খান্না মাস্টার আর তার বন্ধুদের কথা ভেবে রঙ্গনাথের মন খারাপ হয়ে গেল। ও বুঝতে পেরেছে যে প্রিন্সিপালের মোকাবিলা করা এদের কম্মো নয় , আরও অভিজ্ঞ খেলুড়ে চাই।

শনিচর বলছিল-- ‘বদ্রী ভাইয়া, এতসব বড় বড় হাকিম গ্রামপ্রধানের দরজায় আসে। কিন্তু আমার ঘরে তো কোন দরজাই নেই। দেখছ তো, ভাঙা ছাত আর—‘।

বদ্রীর মতে শনিচরের সঙ্গে বেশি মুখ চালানো মানে নিজের ইজ্জত কম করা। ওর সন্দেহ যে আজ সুযোগ পেয়ে ব্যাটা বড্ড গায়ে পড়া ভাব দেখাচ্ছে। ও তক্তপোষ ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। কোমর থেকে খসে পড়া লুঙিটা কষে বাঁধতে বাঁধতে বলল—ঘাবড়াও মৎ, একটা দেশলাইকাঠি তোমার চালে ফেলে দেব, ব্যস্‌--সব চিন্তা দূর।

এসব বলে ও বাড়ির ভেতরে চলে গেল। কথাটাকে ঠাট্টা ভেবে প্রিন্সিপাল সাহেব হেসে উঠলেন। তারপর শনিচরও হেসে ফেলল। কথাটা বুঝতে রঙ্গনাথের কিছু সময় লাগল। ততক্ষণে আলাপ-আলোচনা অন্যদিকে ঘুরে গেছে।

বৈদ্যজী বললেন—কেন? আমার বৈঠকখানা তো রয়েছে। এখানেই মনের আনন্দে বসে কাজ কর। সরকারি আধিকারিকরা এলে এখানেই অভ্যর্থনা করবে। কিছুদিন যাক, পঞ্চায়েতের পাকা ঘর তৈরি হবে। তখন তুমিও ওই ঘরে থাকবে। ওখান থেকেই গ্রামসভার সেবা করবে।

শনিচর ফের নম্রভাবে হাতজোড় করল। শুধু এইটুকু বলল—আমার কী করার আছে? সারা দুনিয়া বলবে –আপনারা থাকতে শিবপালগঞ্জে এক চালচুলোহীনকে----।

প্রিন্সিপাল তাঁর চিরপরিচিত হেঁ-হেঁ-হেঁ এবং অবধী বোলী শুরু করলেন—আবার বাজে বকছেন শনিচরজী! আমার এলাকায় রাজাপুরের গ্রামসভায় ওখানকার ঠাকুরসাহেব নিজের রাঁধুনিকে প্রধান করেছেন। খামোকা কোন বড় মানুষ কেন এইসব ঝামেলায় নাক গলাবে?

প্রিন্সিপাল সাহেব এবার কোন রাখঢাক না করে বলতে লাগলেন—আরও শুনুন, ওই ব্যাটা রাঁধুনি গ্রামসভার চেয়ারম্যান বা সভাপতি হয়ে তামাশা পুরো জমিয়ে দিল। সবাই জানে যে একবার মহকুমায় জলসা হচ্ছিল। ডিপ্টি সাহেব এলেন। গ্রামসভাগুলোর সব প্রধান হাজির। ওদের সবাইকে মাটিতে সতরঞ্চি পেতে বসানো হয়েছে। ডিপ্টি সাহেব বসেছেন চেয়ারে। হঠাৎ ওই রাঁধুনি ব্যাটা বলে উঠল—আমাদের নেমন্তন্ন করে এনে মাটিতে বসিয়েছে আর ডিপ্টি বসেছেন চেয়ারে—এটা কেমন ন্যায়? ডিপ্টি সাহেবও নতুন পাশ করা ছোকরা, উনিও জিদ ধরে বসলেন। এবার দু’পক্ষেরই ইজ্জতের প্রশ্ন। সমস্ত প্রধান রাঁধুনির পক্ষে। ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ শ্লোগান শোনা যেতে লাগল। ডিপ্টি সাহেব নিজের চেয়ারে চেপে বসে খালি হাত তুলে চেঁচাচ্ছেন—শান্তি! শান্তি!

কিসের শান্তি আর কিসের শকুন্তলা! সমস্ত গ্রাম প্রধান সভা ছেড়ে উঠে পড়ল। আর সেই মুহুর্তে রাজাপুরের রাঁধুনি ব্যাটা গোটা মহকুমার নেতা হয়ে গেল। পরের দিন তিনটে পার্টি থেকে অনুরোধ এল—এস, আমাদের মেম্বার হয়ে যাও।

কিন্তু বাবুসাহেবের এক কথা—খবরদার! তাড়াহুড়ো করবি না। আমি যখন বলব যে অমুক দলে যা, তখন সেখানকার সদস্য হবি।

শনিচরের কানে বাজছে—ইনকিলাব জিন্দাবাদ! ও কল্পনায় দেখছে—এক আন্ডারওয়ার পরা অর্ধনগ্ন মানুষ—সে যাচ্ছে সবার আগে। তার পেছন পেছন শ’ দুশ’ লোক হাত মুঠো করে শ্লোগান দিতে দিতে চলেছে।

বৈদ্যজী বললে—“এটা অশিষ্টতা। আমি প্রধান হলে আগেই উঠে চলে আসতাম। ফের মাস-দুই পরে নিজের গ্রামসভায় উৎসবের আয়োজন করতাম। ডিপ্টি সাহেবকে নেমন্তন্ন করে নিয়ে এসে মাটিতে শতরঞ্জি পেতে বসাতাম। তারপর নিজে চেয়ারে বসে লেকচার দিতাম—শোন ভাইসব, আমার চেয়ারে বসতে বড় অসুবিধে হয়, কষ্ট হয়।

কিন্তু কী করব, ডিপ্টি সাহেব নিজে অমুক তিথিতে আমাদের ওঁর মহকুমায় নেমন্তন্ন করে শিখিয়েছেন যে অতিথিদের মাটিতে বসাতে হয়, নিমন্ত্রণকর্তা বসবেন চেয়ারে—এটাই সরকারি দস্তুর। কাজেই আমাকে শত অসুবিধা সত্ত্বেও ওনার শেখানো নিয়মকে সম্মান করে চেয়ারে বসতে হচ্ছে”।

এটা বলে বৈদ্যজী আত্মপ্রসাদের সঙ্গে ঠা-ঠা করে হেসে উঠলেন। রঙ্গনাথের সমর্থনের আশায় বললেন—বল বেটা, এটাই উচিত হত না?

--ঠিক বলেছেন। আমাকেও এইসব প্যাঁচ-পয়জার স্কুলে থাকতে শেয়াল ও সারসের গল্প শুনে শিখতে হয়েছে।

বৈদ্যজী এবার শনিচরকে বললেন—তাহলে তো ঠিক হয়েই গেল। এখন যাও, গিয়ে দেখ ওই মূর্খ ব্যাটা সত্যি সত্যি ভাঙ পিষতে গিয়ে হলুদ বাটা না করে ফেলে। তোমার হাতের ছোঁয়া না লাগলে ভাঙের মৌতাত জমে না।

বদ্রী পালোয়ান দরজার চৌকাঠ থেকে মুচকি হেসে বলল-যাও সালে! গিয়ে ফের ওই ভাঙ ঘুটতে লেগে পড়।

খানিকক্ষণ সব চুপচাপ। প্রিন্সিপাল নীচু গলায় বললেন—আপনার আজ্ঞা হলে এবার খান্না মাস্টারের বিষয়ে কিছু বলি?

বৈদ্যজীর ভুরু কপালে চড়ে গেল। প্রিন্সিপাল উবাচ—একটা ঘটনা ঘটেছে। পরশুদিন সন্ধ্যার সময় গয়াদীনের আঙিনায় একটা ঢিল উড়ে এসে পড়ল। গয়াদীন তখন ‘দিশা ময়দান’ সম্পন্ন করতে বাড়ির বাইরে। বাড়িতে বেলার পিসি ছিলেন। তিনি ঢিল কুড়িয়ে দেখলেন তাতে একটা দোমড়ানো চিঠি। উনি বেলাকে ডেকে বললেন-নে, এটা পড়ে শোনা। কিন্তু বেলা ওটা পড়তে পারল না।

রঙ্গনাথ মন দিয়ে শুনছিল, এবার জানতে চাইল যে ওটা কি ইংরেজিতে লেখা ছিল?

--ইংরেজিতে কেন কেউ লিখতে যাবে? ভাষা তো হিন্দিই ছিল। কিন্তু ওটা প্রেমপত্র, কুমারী মেয়ে কোন মুখে সেটা পিসিকে পড়ে শোনাবে?

বৈদ্যজী চুপচাপ শুনছিলেন। রঙ্গনাথের সাহস হল না যে জিজ্ঞেস করে -চিঠিটা লিখেছিল কে?

প্রিন্সিপাল নিজেই বললেন—কে লিখেছিল জানা যায়নি। তবে আমার মনে হয় ওই খান্না মাস্টারের দলেরই কারও কাণ্ড। সব’কটা গুণ্ডা! একনম্বরের গুণ্ডা! কিন্তু খান্না মাস্টার আপনার বিরুদ্ধে প্রচার শুরু করেছে। বলে বেড়াচ্ছে যে ওই চিঠিটা লিখেছে রূপ্পন বাবু, আপনার ছোট ছেলে! ওর হিম্মত এত বেড়েছে যে আপনার বংশের মুখে কালি দিতেও পিছপা হচ্ছে না।

এই কথার বৈদ্যজীর উপর কোন প্রভাব পড়ল না। তবে উনি এক মিনিট মৌন ধারণ করলেন। তারপর মুখ খুললেন—ও আমার বংশের কী করবে? কলংক লেপছে গয়াদীনের বংশের মুখে—কন্যাটি তো গয়াদীনেরই, নয়?

প্রিন্সিপাল সাহেব খানিকক্ষণ বৈদ্যজীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। কিন্তু কোন ভাবান্তর চোখে পড়ল না। যেন এই প্রসংগ থেকে রিটায়ার করেছেন। প্রিন্সিপাল ঘাবড়ে গেলেন, সেটা ঢাকতে অন্য দিকে তাকিয়ে অবধী বোলীতে শনিচরকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন—লাও ভাই শনিচর! জলদি ঠান্ডাই-ফণ্ডাই লে আও। কলেজ ছুটির সময় হচ্ছে।

(চলবে)

0 comments: