0

প্রবন্ধ - মনোজিৎকুমার দাস

Posted in








গাথাসপ্তশতী (সত্তাসাই বা গাহা কোশ) প্রাকৃত ভাষায় লেখা কবিতা সংগ্রহ। কবিতাগুলো প্রেম অপ্রেমের। কবিতাগুলোতে সাধারণত একজন বিবাহিত মহিলা বা অবিবাহিত মেয়ের খোলাখুলি প্রেম অপ্রেমের কথা উঠে এসেছে। তারা প্রায়ই তার বন্ধু, মা বা অন্য আত্মীয়, প্রেমিক, স্বামী বা নিজের কাছে তার অপ্রত্যাশিত অনুভূতি ও আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে,যা গাথা সপ্তশতীতে উঠে এসেছে।

প্রচীন ভারতের একটি উল্লেখযোগ্য রাজবংশ ছিল সাতবাহন । সময়কাল: খ্রিস্টীয় প্রথম শতক থেকে তৃতীয় শতক। উত্তর ভারতে নয়- সাতবাহন রাজ্য গড়ে উঠেছিল দক্ষিণভারতে। রাজ্যটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন: সিমুক। সাতবাহন বংশের রাজধানী ছিলতের প্রতিষ্ঠানপুর । হাল ছিলেন সংস্কৃতমনা একজন সাতবাহন রাজা। ইনি কেবল রাজ্যই শাসন করেননি- প্রাকৃতভাষায় লেখা কবিতার একটি সঙ্কলন গ্রন্থনা করেছিলেন, যাতে তাঁর নিজের লেখা কবিতাও ছিল। প্রাকৃতভাষা মানে প্রাচীন ভারতের সাধারণ জনগনের ভাষা- অর্থাৎ উচ্চকোটির সংস্কৃত ভাষা নয়। রাজা হাল কর্তৃক সঙ্কলিত কবিতার সঙ্কলনটির নাম: ‘গাথাসপ্তশতী বা সত্তাসাই বা গাহা ' বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কবির লেখা প্রায় সাতশ স্তবক রয়েছে গাথাসপ্তশতীতে।

সংগ্রহটি ১ম শতাব্দীতে বসবাসকারী রাজা হালা সংগ্রহ করেন । অনেক কবিতায় লেখকদের নাম অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, যার মধ্যে কিছু দক্ষিণ ভারতীয় কবিদের লেখা।

কবিতাগুলো সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়েছে, কখনও কখনও মুছে ফেলা হয়েছে এবং বিভিন্ন কবিতা দিয়ে প্রতিস্থাপিত হয়েছে, যদিও প্রতিটি পাণ্ডুলিপিতে শিরোনামের অর্থের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ৭০০টি কবিতা রয়েছে।

বিস্ময়করভাবে যা ধর্মনিরেপেক্ষ-শুধু ধর্মনিরেপেক্ষই নয়- গাথাসপ্তশতীর স্তবকগুলোতে যৌনতার আভাসও আছে। উদাহরণ দেয়া যেতে পারে।
১)
আমার মনে আছে-
ও আমার পায়ের কাছে বসে।
নিশ্চুপ।
ওর চুল নিয়ে খেলছিল আমার পায়ের পাতা।


২)
প্রেম।
হায়, হারিয়ে যাচ্ছে সবই।
মুঠো করো হাত।
মুখে মধুর স্তন।
একটি ফোঁটাও যেন মাটিতে না পড়ে।

একটি মেয়ের দাঁড়ানোর ভঙ্গিতে কিশোরীর প্রেমকাতর মনোদৈহিক ক্ষুধা এমনই তীব্র ভাবে ফুটে উঠেছে গাথাসপ্তশতীর এই গাথাটিতে। অবশ্যই এই গাথাটিতে আমরা দেখতে পাচ্ছি, ভেজানো দরজার কাছে মেয়েটি যেন কাকে খুঁজছে। রাস্তার দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে সে চেয়ে আছে। তার চাহনির মাঝে অবশ্যই প্রেমকাতরতা আছে।


ভেজানো দরজার কাছে দাঁড়ানো ও মেয়ে।
কাকে খুঁজছ তুমি?
উষ্ণ চোখ, বাদামি বৃন্ত-
রাস্তার দিকে চেয়ে রয়েছে।

প্রেমের আবেগের অনুষঙ্গ আছে। গাথা সপ্তশতী কামসূত্রের সাথে মেলে না। কামসূত্র প্রেম ও যৌনতার একটি তাত্ত্বিক কাজ। অন্যদিকে, গাথা সপ্তশতীতে প্রেমকে জটিল ও আবেগগতভাবে অপূর্ণ বলে মনে হয়।

সৌন্দর্যের বন্দনা ব্যক্ত হয়েছে নিচের স্তবকটিতে। সৌন্দর্যের কারণেই দুটো হৃদয় এক হয়, একজনের অঙ্গ প্রেমিকা বা প্রমিকের অঙ্গের সাথে মিলিত হয়। গাথাসপ্তশতীর নিচের অনুবাদে এ কথাই উঠে এসেছে।

ঈশ্বর ওকে গড়েছে।
ওর সৌন্দর্য আমার মন কেড়েছে।
ওর কথা আমার কানে, ওর হৃদয়ে
আমার হৃদয়; ওর অঙ্গে অঙ্গ
আমার।

অনেক কবিতায় একজন নারীর অনুভূতির রূপক তুলনা করার জন্য হিন্দুধর্মে দেব-দেবীর নামও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে গাথা সপ্তশতীর বিভিন্ন স্তবকে।

যে লোকরা এই কবিতাগুলো রচনা করেছিলেন তারা গ্রামীন জনপদ ও অরণ্যের সীমানার মাঝে বাস করতেন। কৃষি ও শিকার ছিল তাদের প্রধান পেশা। প্রায় ১০০টি কবিতায় ক্ষেত্র, চাষের অধীনে ফসল, চাষের সরঞ্জাম ও আনুষাঙ্গিক যেমন বেড়া দেওয়া, কৃষিকাজ পরিচালনা এবং কৃষি পণ্য সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াকরণের উল্লেখ রয়েছে। একইভাবে প্রায় ১০০টি কবিতায় শিকার করা প্রাণী, শিকারের সরঞ্জাম ও শিকার অভিযানের উল্লেখ রয়েছে।
প্রাকৃত ভাষার কবিতা নীতিবাগীশদের দ্বারা গ্রহণযোগ্য নয় বলে গাথা সপ্তশতীর একজন আক্ষেপ করে লিখেছেন---

এইসব নীতিবাগীশরা কেন প্রাকৃত কবিতা এড়িয়ে চলে?
এড়িয়ে চলে আমাদের গান, আমাদের প্রেম ও অপ্রেম।
ওরাও তো আমাদের গান ও কবিতার নির্যাস চায় জানি
তবে কেন তারা আমাদের প্রেমকে বলে ছাই?

গাথাসপ্তশতীর কয়েকটি স্তবকের অনুবাদ আমরা দেখতে পারি। কৃষক স্বামীটি দিনভর কাজ করে। কৃষকের বউটি স্বামীর জন্য অস্থির মনে হয় নিচের স্তবকটি পড়ে।

সে দিনভর কাজ করে ।
লাঙ্গল চষে জলাভুমির কাছে।
সেই রাতে তার বউ শুয়েছিল। ভারি অস্থির।
চোখ খোলা। বৃষ্টির ফোঁটা গুনছে।

নিচের স্তবকটি লক্ষ্য করুন, নারীটির সৌন্দর্য ফুটে ওঠেছে।আয়ত চোখের কারণে সে সুন্দরী। এই স্তবকটিতে প্রচ্ছন্ন আনন্দের অনুষঙ্গ বর্তমান। তার স্বামী অথবা প্রেমিক তাকে চন্দ্রমুখী সম্বোধন করে বলছেন তার আয়ত নয়নের কারণে রাতকে প্রহরে প্রহরে উপভোগ করবে।

ও চন্দ্রমূখী নারী,
তোমার আয়ত চোখের কারণে-
রাতও গিয়েছে বেড়ে-
আর আমিও সদ্ব্যবহার করি প্রহরের।

আমরা গাথাসপ্তশতীর আরো একটা স্তবকের অর্ন্তনিহীত অর্থ অনুধাবন করতে পারি। বাবা মার একটা অন্তরঙ্গ মূহুর্তের অভিব্যক্তি মেয়ের মুখে উঠে এসেছে। শেষ লাইনের --- ' চাঁদের কলঙ্কের মতন মায়ের চাঁদমুখ ' বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। মায়ের ফ্যাকাশে মুখকে ' চাঁদের কলঙ্ক' বলে কবি উপমা টেনেছেন।


ছোট ঘটনা। তবু মনে আছে।
মা রান্না করছিল। বাবা কী বলল।
মা হাসল। তারপর ছুঁলো নিজের ফ্যাকাশে মুখ।
চাঁদের কলঙ্কের মতন মায়ের চাঁদমুখ।

গাথাসপ্তশতীর আরো কয়েকটি গাথার বঙ্গানুবাদ আমরা তুলে ধরতে পারি, যেগুলো পড়ে প্রেম অপ্রেমের দোলাচল লক্ষ করা যায়।
১)
ও (মেয়েটি) খুবই দ্রুত ভাবতে পারে।
কিন্তু, আজ ও নিজেকে নিল সামলে।
বলল,‘সে তোমাকে দেখতে এসেছে।’
বলে প্রেমিককে দিল স্বামীর দিকে ঠেলে!
মেয়েটির দরজায় সে দাঁড়িয়ে।
সে কেবলি তরমুজ বিক্রি করতে চায় না।
কিন্তু, সে তো আর ছল জানে না।
যে নারকেল নিয়ে এসেছে সে যে বেশি চতুর!

২)
তারা যখন থামে
মেয়েটি গলার হার দেখে লজ্জ্বা পায়।
কিন্তু যেহেতু মেয়েটি কাপড়ের কাছে পৌঁছতে পারে না-
পুরুষটিকে আবার তুলে নেয়।


৩)
যে নারী জানে- কী করে ভালোবাসতে হয় নিজেকে-
জানে কী করে প্রশমিত করতে হয় ক্রোধ
যখন সে একই সঙ্গে শূন্য ও পূর্ন।


৪)
আমি দেখছি নর্তকীদের
কী যে ভালো লাগছে।
চুলের সুগন্ধী
তুমি আমায় পা দিয়েছিলে।


৫)
মেয়েটি বলেছিল আমায় কী করতে হবে।
অথচ সকালে ও কাপড় পড়ল
বাঁশের বেড়ার ওপাশে!

গাথাসপ্তশতীর কবিতাগুলো খ্রিস্টীয় প্রথম শতক থেকে তৃতীয় শতকে লেখা প্রাকৃত ভাষার অমূল্য সম্পদ হিসাবে চিরভাস্বর হয়ে থাকবে।

তথ্যসূত্র:

১) প্রাচীন ভারতের ইতিহাস (দ্বিতীয় খন্ড) - সুনীল চট্টোপাধ্যা
২)হাজার বছরের প্রেমের কবিতা -  অবন্তী স্যান্নাল

0 comments: