0

সম্পাদকীয় : স্বপন দেব

Posted in




অতিথি সম্পাদকের কলমে
স্বপন দেব



বাংলা সাহিত্যকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দিয়েছিল উনিশ শতকের প্রথম পর্বেই, এক ধরনের মুদ্রিত বই, যা বটতলার বই নামে পরিচিত। সস্তা দামে, অনেক সময় দুর্বল প্রোডাকশনে খ্যাত-অখ্যাত লেখকেরা তাঁদের সেলফ আইডেন্টিটিকে সোশ্যাল আইডেন্টিটির সঙ্গে মিলিয়ে প্রকাশ করার সুযোগ গ্রহণ করলেন। আজ যাকে আমরা ‘বাজার’ বলি, উনিশ শতকের সেই বাজারে এলো সেলফ আর সোশ্যালের এক জনপ্রিয় টেক্সট – বটতলা ! 

সমাজ কোনদিন এক জায়গায় থেমে থাকেনা। যুগ বদলায়, আসে নতুন রুচি, নতুন কালচার, নতুন টেকনোলোজি। বটতলা যে বাজার তৈরী করেছিল, তাকে কব্জা করতে উচ্চবর্গের মানুষরা সেদিন থেকে আজ অবধি এই বটতলাকে রুচিহীন অপসংস্কৃতি আখ্যা দিয়ে এবং ঔপনিবেশিক শাসকের আঁতাতে বটতলার মুদ্রণ নিষিদ্ধ করে নিজেদের বই বাজারে চালু করলেন। সেই থেকে শুরু হোল মুদ্রণ শিল্পের অপ্রতিদ্বন্দী জয়যাত্রা। 

পঞ্চাশের দশকের শেষ থেকে লিটল ম্যাগাজিন জনপ্রিয় হলেও এই চালু সাময়িক পত্রিকা গুলির খুব একটা ক্ষতি করতে পারেনি। যুগ আরো এগোল। বিগত তিন দশক ধরে তথ্যপ্রযুক্তিকে হাতিয়ার করে মানব সভ্যতা এবং তার অভ্যাস যে বেগে বদলে যাচ্ছে তার তুলনা ইতিহাসে নেই। এটা এখন এতোটাই বিকশিত যে একে উপেক্ষা করা আর কোনমতেই সম্ভব নয়। 

ইন্টারনেট এর প্রসার আর তার ব্যবহার যে গতিতে এগোচ্ছে, তাতে তাকে একটা “বদল ঝড়” বলা যেতেই পারে আর মুদ্রণ নির্ভর সাহিত্য চর্চার যে প্রচলিত ধারা, তার ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে এই “অন লাইন” মাধ্যম। এই অন লাইনেই প্রকাশিত হচ্ছে নিত্য নতুন বিভিন্ন স্বাদের মাসিক পত্রিকা। ঋতবাক ও একটি অনলাইন বাংলা সাহিত্য নির্ভর মাসিক পত্রিকা। আর ঠিক এইখানেই আমার প্রশ্ন, বাংলা সাহিত্য কাকে বলে ? জানি, আপনারা সহজেই বলে দেবেন, বাংলা ভাষায় রচিত সাহিত্যই ‘বাংলা সাহিত্য’। 

কিন্তু, তাই কি ? তথ্য-প্রযুক্তির বৈপ্লবিক অগ্রগতির ফলে সমগ্র পৃথিবীটাই তো এখন ‘গ্লোবাল ভিলেজ’ এ পরিণত হয়েছে। ঐতিহাসিক কারণেই এখন ইংরাজি ভাষা আর শুধুমাত্র ইংরেজদের নয়। এখন তা ‘গ্লোবাল ভাষা’। তাই দ্রুত বদলে যাওয়া পৃথিবীর সাথে নিজেকে অন্বিত করতে প্রায় প্রত্যেকেই এখন এই ভাষার সাহায্য নিয়ে থাকেন। ইংরাজি জানেন না এমন লোকেরাও কিন্তু মোবাইল, ইন্টারনেট, ফেসবুক, ল্যাপটপ, ডেস্ক টপ, নেটওয়ার্ক, উইন্ডোজ, টিভি, রিচার্জ, সিরিয়াল, কম্পিউটার, ব্যালান্স শব্দগুলি ব্যবহার করেন। স্বয়ং ঋতবাক সম্পাদিকাই ঋতবাকের কভার ফটো দেখে মন্তব্য করেছেন, Grt !! তাহলে কি বাংলা সাহিত্য কে ‘বাংলা ভাষায় রচিত সাহিত্যকর্ম’- এই গণ্ডির মধ্যে বেঁধে রাখতে পারি ? 

আসলে, ভাষা-কেন্দ্রিক সাহিত্যের সময় টা আমরা এক লাফে পেরিয়ে গেছি। তথ্যপ্রযুক্তির বৈপ্লবিক অগ্রগতি মানুষকে আর নির্দিষ্ট ভৌগোলিক গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ থাকতে দিচ্ছেনা। সমস্ত পৃথিবীটাই তার আপন সমাজ। জন্ম নিয়েছে গ্লোবাল সংস্কৃতি। সুতরাং ভাষা নয়, নির্দিষ্ট ভাষাগোষ্ঠীর জীবন হয়ে উঠুক সাহিত্যের বা অন লাইন সাহিত্য পত্রিকার মানদণ্ড। তা যদি মানতে পারি, তবে বাঙ্গালীর জীবনকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ইংরাজী ভাষায় রচিত সাহিত্যও ‘বাংলা সাহিত্য’। 

ঋতবাক এর উদ্দেশ্য খুব প্রাঞ্জল ভাষায় লেখা আছে। কিন্তু উদ্দেশ্য-সাধনের জন্যে চাই প্রচেষ্টা। আর এই প্রচেষ্টায় ঋতবাক জন্মলগ্ন থেকেই সফল। অন লাইন এই মাসিক পত্রিকার দর্শক ও পাঠকের সংখ্যা, নানা স্বাদের সাহিত্য প্রকাশ, এর অলঙ্করণ এবং নাম টি শুধু পাঠকদের নয়, লেখক কবিদের ও আকৃষ্ট করেছে। তাই ঈশানী রায়চৌধুরীর মত প্রতিষ্ঠিত কবি সাহিত্যিকেরাও লেখা পাঠাচ্ছেন ঋতবাক এ। তাই উদ্যোগ এবং প্রচেষ্টার মাপকাঠিতে আমার ঋতবাক কে ১০০য় ১০০ দিতে আপত্তি নেই ! 

আর একটি কথা। সাহিত্য প্রকাশের মাধ্যম যেমন বদলেছে, সাহিত্য রচনার আঙ্গিক ও বদলের প্রয়োজন আছে। মুদ্রণ নির্ভর সাহিত্যে কেবলমাত্র অক্ষর কলমে লিখেই ভাব প্রকাশ করার সুযোগ ছিল। অন লাইন পত্রিকায় কিন্তু আপনি অনেক বেশী সুযোগ পাচ্ছেন ভাব প্রকাশের। আপনার হাতের অ্যান্ড্রয়েড ফোন টি একই সঙ্গে ছবি, ভিডিও ক্লিপিং, বাংলায় লিখে সরাসরি মেল করার সুযোগ দিচ্ছে ! জুড়ে দিন না আপনার সাহিত্যকর্মের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক কিছু ছবি, কয়েক কলি গান কিংবা ছোট্ট একটা ভিডিও ক্লিপিং ! আমি ইতিমধ্যেই এই নতুন আঙ্গিক ব্যবহার করা শুরু করেছি। আজ এই পর্যন্ত। ভালো থাকুন। ভালো ভাবুন ! ভালো লিখুন !!

0 comments:

3

প্রচ্ছদ নিবন্ধ : শ্রীশুভ্র

Posted in



প্রচ্ছদ নিবন্ধ




প্রতিবাদের ভাষা যখন চুম্বন!
শ্রীশুভ্র



সমাজে গেল গেল রব, এ কী দেখি! প্রাকাশ্য রাজপথে শিক্ষার্থীকুল প্রলম্বিত চুম্বনে আলিঙ্গনাবদ্ধ। একি অনাচার! সমাজে শিষ্টাচার আর তবে কিছুই বাকি রইল না? এ কোন অন্ধকার যুগ ঘনিয়ে এল তবে? এরপর আরও কত কি বীভৎস দৃশ্য অবলকোন করতে হবে ভেবে শিহরিত হয়ে উঠতে হয়। আমরা কি কেবলই অন্ধের মতোই পাশ্চাত্যের অনুকরণ করে যাব তবে? হারিয়ে যাবে ভারতীয় মূল্যবোধের সনাতন ঐতিহ্য! ব্যক্তি স্বাধীনতার নামে যাবতীয় অনাচারকে প্রশ্রয় দেওয়াই যদি আধুনিকতার সংজ্ঞা হয়, তবে ধিক্ সেই আধুনিকতা, যা পাশ্চাত্যের অন্ধ নকল নবিশী ছাড়া আর কিছুই নয়। ভাবতে আশ্চর্য লাগে, এই কি মহাত্মা গান্ধীর দেশ? এই কি শঙ্করাচার্যের হিন্দুত্বের উত্তরাধিকার? এই কি রামকৃষ্ণ বিবেকান্দের ভারতবর্ষ? এই কি সেই দেশ যে দেশের বীর রমনীকুল জওহরব্রত করে নারীর সম্মান অটুট রেখে গিয়েছিলেল ইতিহাসের এক ক্রান্তিকালে? যে দেশের পবিত্র ভূমি পতিব্রতা নারীর কতশত আত্মত্যাগের কাহিনীতে মহিমান্বিত! সেই পবিত্র ভারতভূমি আজ এ কাদের কাছে কলুষিত হচ্ছে দিনে দিনে! এরপর তো প্রকাশ্য রাজপথে মৈথুনবিপ্লব সংগঠিত হতেও বুঝি আর বেশিদিন দেরী নাই!

ধন্য নবীন প্রজন্ম! তোমাদের চুম্বন বিপ্লবের আজকের তান্ডবে কাল যে সরলমতি কিশোর কিশোরীদের হাতেখড়ি হবে তাদের অধঃপতনের দায়ভার কে নেবে? সমাজে চারিদিকে এত যে নারী নিগ্রহের ঘটনা কেবলই বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাতেও কি এই পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণের কুফল সম্বন্ধে আমাদের বোধদয় ঘটবে না? আজ থেকে শত বৎসর পূর্বে কই এত তো নারী নিগ্রহের ঘটনা ঘটত না! কারণ তখন সমাজের একটা শাসন ছিল, কোনটা ভালো কোনটা মন্দ সেই বিষয়ে অর্বাচীনদের সতর্ক করে দেওয়ার একটা সামাজিক রেওয়াজ ছিল। শ্লীলতা অশ্লীলতা সম্বন্ধে একটা সামাজিক বোধ ছিল আপামর জনমানসের। তার পরেও কোথাও কোনো অনৈতিক বিচ্যুতি ঘটলে তাকে শাসন করার একটা কার্যকরী সামাজিক অনুশাসনের বন্দোবস্ত ছিল। ফলে সমাজের সর্বস্তরে এমন কলুষতার কালিমা লেপনের সহজ সুযোগ ছিল না। হায় আর আজ, এ কোন সকাল! রাতের চেয়েও অন্ধকার। কচিকাঁচারা বয়স্কদের সম্মান দিতে জানে না। দেশের আইনকে কত সহজেই বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়েও পার পেয়ে যায়! সামাজিক অনুশাসনকে কোনো রকম তোয়াক্কা করে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে সম্মান করতে শেখে না! কোনটা শ্লীল কোনটা অশ্লীল, এদের না আছে সে সম্বন্ধে কোন ধারণা, না কোনো সুশিক্ষা। তবে কি আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যেই কোনো ত্রুটি রয়ে গেল, ভাবতে হবে সেই কথাই। কারণ এরা তো আমাদেরই সন্তান! আমরাই তো এদেরকে প্রকৃত শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠাই। তবে কেন? কোন ছিদ্র পথে ঘটে চলেছে এদের এহেন নৈতিক অধঃপতন? দায় কার!

সত্যিই তো দায় কার? কিন্তু কিসের দায়! নৈতিক অধঃপতনের! ঠিক তো! তবে কি একবার ইতিহাসের দিক চোখ ফেরাবো না আমরা! খুব বেশিদিন আগের কথাও তো নয়। বছর তিনশ হবে! বাল্য বিবাহ, সতীদাহ প্রথা, পুরুষের বহুবিবাহ, মন্দিরে মন্দিরে দেবদাসী প্রথার বহুল প্রচলনে মহিমান্বিত সুমহান ভারতবর্ষ! কুলীন ব্রাহ্মণের পৈতের পাকে পাকে কতশত অনাচার অত্যাচারের জমাট পাঁক। আর সেই জমাট অন্ধকারের মধ্যে প্রথম আলোর সলতে জ্বেলে উঠে দাঁড়ালেন একজন বাঙালি, রামমোহন রায়! সমাজের ঘাড় ধরে দিলেন সজোরে এক রামধাক্কা! নড়েচড়ে বসল ঘুমন্ত অসাড় সমাজ! কিন্তু সেই কাল ঘুম কি সহজে ভাঙার! কতশত শাস্ত্রীয় বিধান ফণা তুলে বিষ ঢালতে উদ্যত হল! সমাজরক্ষার দায় বলে কথা! বিধবা কন্যার নির্জলা উপবাসেই যে সমাজের ঐহিক উন্নতি! কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার পারলৌকিক মুক্তির জন্যেই কুলীন ব্রাহ্মণকুলের উদ্ভব! সে সমাজ কি অত সহজেই আলোর মুখাপেক্ষী হবে? না। হয়ও নি। কিন্তু তাই বলে কি চুপ করে বসে থেকে অন্ধ কুসংস্কারাচ্ছন্ন জড়ভরত সামাজিক বিধিনিষেধের বেড়াজালে আবদ্ধ থাকতে পারে শুভবোধসম্পন্ম মানুষ! তাই তো বিদ্যাসাগরকে এগিয়ে আসতে হল বীর বিক্রমে। বিধবা বিবাহের প্রচলনে তাঁর যুগান্তকারী উদ্যোগকেও সম্মুখীন হতে হল চরিত্রহীন সমাজের বিষাক্ত ছোবলের। কিন্তু তাই বলে তো থেমে থাকলে চলবে না! সমাজের পরতে পরতে জমে থাকা জমাট অন্ধকারের শতাব্দীব্যাপি গিঁট খুলতে কাউকে না কাউকে তো এগিয়ে আসতেই হবে, নয়ত সমাজ এগোবে কি করে?

আসলে আমরা কোন বিষয়েই একটু গভীরে গিয়ে তলিয়ে দেখতে চাই না! সব বিষয়েই একটা চটজলদি ধারণার বশবর্তী হয়ে কোনো না কোনো একটা পক্ষ নিয়ে নিই দ্রুত। ভারতবর্ষের ইতিহাস বহু প্রাচীন ইতিহাস! বস্তুত পৃথিবীর অন্যতম সুপ্রাচীন এই ইতিহাস সবচেয়ে অধিক বৈচিত্রপূর্ণ। অনেকেই ভাবেন ভারতবর্ষের ইতিহাস মানেই আর্য সংস্কৃতি এবং ইসলাম ও বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের ভারত দখলের ইতিহাস। কিন্তু আদপেই তা নয়। আর্যসংস্কতি, ইসলাম ও সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশের প্রভাবের বলেয়ের বাইরেও এক আদি ভারতবর্ষ চিরকাল প্রচ্ছন্ন থেকে গিয়েছে নেপথ্যে। কজন অমরা খোঁজ রাখি সেই ইতিহাসের! ফলে চট করেই যখন আমরা বলে বসি এটা ভারতীয় সংস্কৃতির সাথে খাপ খায় না তখন সতিই কি আমাদের খেয়াল থাকে এই ভারতীয় সংস্কৃতির কতটুকুই বা জানি আমরা? যে পাশ্চাত্য সংস্কৃতিকেই আমরা আধুনিকতার শেষ কথা বলে ধরে নিই, আমরা কি সত্যিই জানি, আধুনিকতার সেই প্রকরণগুলি কোনোকালেই ভারতবর্ষে বিদ্যমান ছিল, কি ছিল না? কিংবা এখনো এই বিশাল ভূখণ্ডের আনাচে কানাচে আমদের শিক্ষিত চোখের পরিধির আড়ালে তা আছে কি নেই? বা থাকলোও তার রূপভেদ কি রকম? 

এই প্রসঙ্গে ইতিহাসের একটি সুস্পষ্ট ছবি একবার অন্তত দেখে নিলে আলোচনার পক্ষে বিশেষ সুবিধে হতে পারে। বস্তুত ভারতে ইসলাম বিজয়ের আগে প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতা তার আর্য ও অনার্য সংস্কৃতির যুগপৎ মিশ্রণ ও স্বাতন্ত্রের যৌথ পরিমণ্ডলে উন্নতি ও আধুনিকতার এক উচ্চতম শিখর স্পর্শ করেছিল ইতিহাসের এক দীর্ঘকাল ব্যাপি পর্বে। সে কথা আমরা অল্পবিস্তর সকলেই জানি। কিন্তু এই প্রসঙ্গেই আমরা অধিকাংশ সময়েই ভুলে যাই যে ইতিহাসের নিয়মেই একদিন কালে কালে অবক্ষয়েরও সূত্রপাত ঘটে ছিল সেই উন্নত সভ্যতার সার্বিক পরিমণ্ডলে। যার ফলস্বরূপ বিদেশী শক্তির অনুপ্রবেশ! ফলে ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণে ইসলামের ভারত বিজয়ের প্রেক্ষিতে, সুপ্রাচীন সেই উন্নত সভ্যতা কালক্রমে তার ভেতরে ধরে ওঠা ঘুণকেই আঁকড়ে ধরে আপন স্বতন্ত্রততা বজায় রাখতে মরিয়া হয়ে উঠল! শুরু হল শুষ্ক ধর্মীয় বিধিনিষেধের বেষ্টনীতে গোটা সমাজকে আটকে রেখে বৈদেশিক ইসলামী সভ্যতা থেকে আপন বৈশিষ্ট বাজায় রাখার প্রয়াস। ইতিহাসের পরবর্তী আর এক পর্বে ঠিক যে ঘটনা ঘটেছিল; সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশের হাতে পরাজিত হয়ে ভারতীয় মুসলিম সমাজের। তখন তারাও তাদের পূর্বের উন্নত সভ্যতার আত্মশক্তিকে সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়ে কেবলমাত্র ধর্ম পুস্তকের সংকীর্ণ পরিধিতে ঘুণে ধরা ধর্মীয় বিধিনিষেধের বেড়াজালে আটকে ফেলল গোটা স‌মাজটাকেই। ফলে দুর্ভাগ্যবশতঃ ইতিহাসের এই দুই পর্বেই ভারতবর্ষের সমাজ ব্যবস্থায় জাঁকিয়ে বসে অন্ধ কুসংস্কার ও অর্থহীন ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের বাড়বাড়ন্ত। 

আর তখনই আমরা শালীনতা অশালীনতার নতুন সজ্ঞা দিতে শুরু করলাম। সামাজিক পরিসরে নারী পুরুষের সহজ স্বাভাবিক স্বচ্ছন্দ মেলামেশার নান্দনিক সৌন্দর্যকে সম্পূর্ণরূপে বিস্মৃত হয়ে নারীকে করে তুললাম পুরুষের ভোগ্যা। তখনই শুরু হল পর্দা প্রথার। কেননা নারী তখন পুরুষের একান্ত অধিকারের সামগ্রী মাত্র! সমাজজীবনে যখন অবক্ষয়ের সূত্রপাত ঘটে, সমাজ তখন বড়ো কিছু করার পথে চলতে পারে না। সে বড়ো কিছু ভাবার ক্ষমতাই রাখে না আর। তাই ইউরোপে যখন শিল্প বিপ্লবের সূচনা ঘটে ভারতবর্ষ তখন অন্ধকারের মধ্যে গুটিয়ে যেতে থাকে ক্রমশই। এই ভাবেই ভারতবর্ষের উপর সামগ্রিক অন্ধকারের অবতরণ! সুপ্রাচীন সেই ভারতীয় সভ্যতা নিজের সমস্ত অর্জন বিস্মৃত হয়ে এরপর একদিকে যেমন চর্চা করতে থাকে সামাজিক অবক্ষয়ের, অন্যদিকে মুষ্টিমেয় একটি শ্রেণী বৃটিশের শাসনে বৃটিশের স্কুলে বৃটিশের ভাষা শিখে তাদেরই হাত ধরে নিতে থাকে আধুনিকতার প্রথম পাঠ! এই তো আমাদের আসল ইতিহাস! 

সেই ইতিহাসের হাত ধরেই আজও আমাদের চিন্তা চেতনার ক্রম ক্রমাগত ঘুরপাক খায় বলেই আমরা বিষয়ের গভীরে গিয়ে মূল বিষয়টিকে অনুধাবনে ব্যর্থ হই বারংবার। সৃষ্টি হয় অনাবশ্যক জটিলতা! তাই চারিদিকে এই গেল গেল রবের সাথে কণ্ঠ মেলালেই হবে না, তার আগে দেখে নেওয়ার প্রয়োজন আমরা ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে আছি, এবং কিভাবে? আমাদের সমাজে জমে ওঠা অন্ধকার দূর করতেই আবির্ভাব ঘটে ছিল রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, অরবিন্দ প্রমুখ যুগাবতার মনীষীদের। তারাই আমাদের প্রথম সচেতন করলেন, কোন ঘোর অন্ধকারকে আমরা আমাদের উত্তরাধিকার বলে ভুল করে হারিয়ে ফেলেছি আমাদের আসল ঐতিহ্য ও আধুনিকতা! সেই সূত্রেই আমাদের ব্যক্তিত্বের নির্মল উদ্ভাসন, আত্মশক্তির পরিপূর্ণ উদ্বোধন, আধুনিক মননশীলতার সাথে শাশ্বত ঐতিহ্য ও মানবিক মূল্যবোধের ঐকান্তিক উত্তোরণের পথনির্দেশ রেখে গেলেন আমাদের জন্য! সেই পথরেখার বিস্তৃত পরিসরে আমরা যদি সত্যিই হাঁটতে সক্ষম হতাম, তাহলে কি এই একবিংশ শতকে এসে কোনটা ভারতীয় সংস্কৃতি আর কোনটা নয়, কোনটা শ্লীলতা আর কোনটা নয়, কোনটা আধুনিকতা আর কোনটা নয়- সেই কূট তর্কে সময়ের অপব্যবহার করতে হতো আমাদের? ভাবতে অবাক লাগে এই আধুনিক যুগেও আমাদের সমাজে এখনো ব্যক্তি স্বাধীনতা কত ভাবেই না ক্ষুণ্ণ হতে থাকে। আঘাত এসে পড়ে ব্যক্তির মৌলিক অধিকারের গোড়াতেই। 

নারী পুরুষের পারস্পরিক সাহচর্যের মধ্যে যে একটি অনিন্দ্যসুন্দর নান্দনিকতা রয়েছে সেইটি আমরা যখন ভুলতে বসি, বুঝতে হবে ঘুণ ধরে আছে আমাদের চেতনার বলয়েই। নরনারী পরস্পরকে আদরের সৌকর্যে বরণ করে নেবে, এইটাই প্রকৃতির বিধান। সেই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে যাদের দৃষ্টি আহত হয়, বুঝতে হবে গন্ডগোল তাদের শিক্ষার গোড়াতেই। আর তখনই বুঝতে পারি ভারতবর্ষের ইতিহাসে অবক্ষয়ের অভিশাপ কাটেনি এখনো! এখানেই এসে দাঁড়ায় শিক্ষার প্রসঙ্গ। ঠিক, গলদ আমাদের শিক্ষার পরিমণ্ডলেই। আমরা এখনো মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতার মৌলিক অধিকারগুলিকে সম্মান দিতে শিখিনি। তাই দুটি নরনারী পারস্পরিক আদরের আলিঙ্গনের মুগ্ধ হবে কখন কোথায়, আমরা সেই ব্যক্তি স্বধীনতার বিষয়েও মাথা না গলিয়ে পারি না। আমাদের সমাজ সংসারের পরিসর থেকেই আমরা অন্যের মৌলিক অধিকারকে খর্ব করার মধ্যেই এক ধরণের ক্ষমতাচর্চার আনন্দ অনুভব করতে শিখে যাই। এমনকি স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসরেও এই প্রবণতা বিশেষ ভাবে পুষ্ট হতে থাকে। যার মারাত্মক প্রকাশ দেখা যায় ইঞ্জীনিয়ারিং কলেজগুলিতে প্রথম বর্ষের ছাত্রছাত্রীর উপর মানসিক ও শারীরীক নির্যাতনের ঘটনায়। এই ভাবেই অন্যের মৌলিক অধিকারের উপর ছড়ি ঘোরানোর বদ অভ্যাস আমাদের সমাজচেতনার মজ্জাগত হয়ে পড়ে। আর সেই বদ অভ্যাসকেই পুষ্ট করতে আত্মপক্ষ সমর্থনে তখন আমরা শ্লীলতা অশ্লীলতার রেখা ধরে টানাটানি করি। হ্যাঁ, ইহাই দীর্ঘদিনের চর্চিত ভারতীয় সংস্কৃতি!

তাই আজ যারা গেল গেল রবে বাতাস কাঁপাচ্ছেন বস্তুত তারাই সমাজের দুষ্ট ক্ষত! আধুনিকতা বিদেশ থেকে আমদানি করলেই হয় না। আধুনিকতা পরিপূর্ণ সুস্থ শিক্ষার্জন ও তার ক্রম প্রসারেই অর্জন সাপেক্ষ এক পরিপূর্ণ জীবনবোধ। সেই জীবনবোধের আলোতে সামাজিক পরিসরে প্রতিটি মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতা ও তার মৌলিক অধিকারকে সুরক্ষিত রাখার দায়বোধ যেদিন প্রতিটি ভারতবাসীর চেতনার অধিগম্য হবে, সেদিনই ভারতবর্ষের শাপমুক্তি ঘটবে। সেদিন আর কোথায় কখন কে কাকে কিভাবে চুম্বনের নিবিড়তায় আদরের আলিঙ্গনে বরণ করে নিচ্ছে, সেইটির দিকেই তাকিয়ে ব্যস্ত হতে হবে না সমাজের স্বঘোষিত মাতব্বরদের! খবরের শিরোনাম ভরে উঠবে না ব্যক্তির মৌলিক অধিকার খর্বের লজ্জাজনক ঘটনাগুলিতে। এবং সেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের কচিকাঁচাদেরও রাজপথে নেমে মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষার্থে সমাজের ঘাড় ধরে এমন সজোরে নাড়া দেওয়ার জন্যে চুম্বনকেই প্রতিবাদের ভাষা করে তুলতে হবে না আর।

3 comments:

0

প্রবন্ধ : ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

Posted in




প্রবন্ধ 




কলকাতার সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা : গোরুর গাড়ি থেকে জেট যুগ
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়



আমাদের স্কুল-কলেজের পাঠ্য ইতিহাসের পাতা ভর্তি হয়েছে রাজা-রাজড়াদের উত্থান-পতন আর যুদ্ধ, খুন ও ষড়যন্ত্রের কাহিনী দিয়ে । সেখানে সামাজিক ইতিহাসের উপাদান খুঁজে পাওয়া যায় না । বেশি দিন আগের কথা বলছি না । তিনশ’ বছর আগেও মানুষ দূর পথে যাতায়াত করতো কি ভাবে ? জানতে কৌতুহল হয় । সর্বকালে, সর্বদেশেই মানুষের দুটি পা ভিন্ন তার যাতায়াতের আদিমতম উপায় ছিল নদীপথ । দুশ’ বছর আগে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তাঁর আট বছর বয়সে পিতার সঙ্গে বীরসিংহ গ্রাম থেকে কলকাতা এসেছিলেন হাঁটাপথে । আরো পনেরো বছর পরে ১৮৪৩এ জর্জ এভারেস্ট, যার নামে হিমালয়ের সর্বোচ্চ শৃঙ্গের নাম, দেরাদুন থেকে বরাবর নদীপথে কলকাতা এসেছিলেন । সময় লেগেছিল ৩৫ দিন । তারও পনেরো বছর পরে ১৮৫৬তে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর কলকাতা থেকে কাশী গিয়েছিলেন নদীপথে নৌকায় । যদিও তখন অল্প-বিস্তর রেল লাইন পাতা শুরু হয়েছিল । সময় লেগেছিল দেড় মাস আর নৌকা ভাড়া লেগেছিল একশ’ টাকা । কিন্তু হাঁটাপথ বা নদীপথ নয়, আমি বলবো কলকাতার সড়কপথে যাতায়াতের কথা, সড়ক পরিবহন বন্দোবস্তের বেড়ে ওঠার কথা ।

আমরা চলতি কথাবার্তায় একটা যমজ শব্দ প্রায়ই বলি ‘গাড়ি-ঘোড়া’ । যেমন, হরতালের দিন রাস্তাঘাট শুনসান, ‘গাড়ি-ঘোড়া’র দেখা নেই – এই রকম । কথায় ঘোড়ার আগে গাড়ি থাকলেও আসলে কিন্তু গাড়ির অনেক আগে ঘোড়া এসেছে । মানুষ বা মালপত্র বইবার জন্য পশুশক্তির ব্যবহার হয়ে আসছে সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকেই । এখনো প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে মাল পরিবহনতো বটেই মানুষ পরিবহনের জন্য গরুর গাড়ির ব্যবহার হয় । এখন এই আধুনিক জেট-গতির যুগে বিস্ময়কর লাগে, প্রায় দেড়শ বছর আগে ১৮৭৮এর সেপ্টেম্বর মাসে স্বামী বিবেকানন্দের মা ভুবনমোহিনী বালক নরেন্দ্রনাথকে নিয়ে বাগবাজার থেকে মধ্যপ্রদেশের (এখন ছত্তিশগড়) রায়পুরে গিয়েছিলেন গোরুর গাড়িতে চেপে । রায়পুরের দূরত্ব প্রায় সাড়ে আটশ’ কিলোমিটার । বিবেকানন্দের পিতা ভুপেন্দ্রনাথ রায়পুরে এটর্নি ছিলেন । স্থলপথে দূর-দূরান্তে যাওয়ার গোরুর গাড়ি ছাড়া আর উপায়ই বা কি ছিল ? সেকথা থাক । গোরুর গাড়ির কথা পরে বলা যাবে । ঘোড়ার কথা বলি ।

আধুনিক কোন শহরে যানবাহন বা পরিবহন ব্যবস্থার বিবর্তন বড় বিচিত্র। কলকাতার কথাই ধরা যাক । বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গতিময় জনবহুল শহর, কি ভাবে আজকের আধুনিক গতি পেল তা জানতে ইচ্ছে করে । কলকাতা প্রাচীন শহর নয় মোটেই । বয়স মাত্র তিনশ’বছর এবং কলকাতার বিকাশও স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় হয়নি । এদেশে বানিজ্য করতে আসা ইংরেজ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী তাদের বানিজ্যকুঠী বানানোর জন্য বেহালার সাবর্ণ চৌধুরীদের কাছ থেকে সুতানূটি, কলকাতা ও গোবিন্দপুর নামে তিনটি গ্রামের জমিদারি সত্ব কিনেছিল । সেই তিনটি গ্রাম মিলেই কলকাতা । এসব কথা স্কুল-কলেজের পাঠ্য ইতিহাসে লেখা আছে, সেটা আমার বলার কথা নয় । একটা শহরের বিকাশ ও আধুনিকতার মাপকাঠি তার জনবিন্যাস, শিক্ষা ব্যবস্থা, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও ব্যবসা-বানিজ্য । ইংরেজ কোম্পানী তিনটি গ্রামের জমিদারি সত্ব কিনেছিল ১৬৯৮এর ১০ই নভেম্বর । ঐ দিনই সাবর্ণচৌধুরী ও কোম্পানীর মধ্যে বিক্রয় দলিল সই হয়েছিল । 

কলকাতার নগরায়ন শুরু হয়েছিল আরো পঞ্চাশ বছর পর থেকে, ১৭৫৭র পলাশীর যুদ্ধের পর, কেননা এরপরই ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী এদেশে তাদের দখলদারি পাকা করেছিল সিরাজদৌল্লাকে পরাজিত ও হত্যা করে । তো এই নতুন ‘নগর কলকাতা’র পত্তনের সময়কার চেহারাটা একবার দেখে নেওয়া যাক । ১৭০৬ খৃষ্টাব্দে মুঘল আমলে কলকাতা, গোবিন্দপুর ও সুতানূটি গ্রামের জরীপের তথ্য অনুযায়ী এই তিনটি গ্রা্ম- যা নিয়ে ‘নগর কলকাতা’, তার মোট জমির পরিমান ছিল ৫০৭৬ বিঘা । যার মধ্যে ১৫২৫ বিঘা ছিল ধানক্ষেত, ৪৮৬ বিঘায় বাগান, ২৫০ বিঘায় কলাগাছ, ১৮৭ বিঘাতে তামাক চাষ ও ১৫০ বিঘায় শাক-সজির চাষ । ১১৬ বিঘাতে ছিল রাস্তা, খাল, পাতকূয়া ও পুকুর আর ১১৪৪ বিঘা ছিল পতিত । এই ছিল পত্তনের সময়কার ‘নগর কলকাতার’ চেহারা । তখন নগর কলকাতায় মাত্র দুটি ‘স্ট্রিট’ আর দুটি ‘লেন’, রোড বা চওড়া রাস্তা একটাও ছিলনা । রাস্তা নেই তো গাড়ি গড়াবে কি করে ? অগত্যা এক গ্রাম থেকে আর এক গ্রামে বা এক পাড়া থেকে আর এক পাড়ায় যাতায়াত করার উপায় ছিল শরু কাঁচা রাস্তা দিয়ে পায়ে হাঁটা, কিংবা গোরুর গাড়ি নয়তো পালকি । এই দুটি যানই স্থলপথে যাতায়াতের জন্য আমাদের আদি গ্রামীণ বন্দোবস্ত । পালকি স্বচ্ছল লোকেদের পক্ষের ব্যবহার করা সম্ভব হ’ত । কলকাতার নগরায়ন শুরু হওয়ার পরও ‘পালকি’ সম্ভ্রান্ত ও অর্থবান বাঙ্গালিদের ও সাহেবদের কাছে ছিল খুব আদরের । এ ছিল আদি ‘নগর কলকাতা’র বাবু কালচারের অন্যতম প্রধান চিহ্ন । সওয়ারি হত দুজন, বইতো ৬জন বেহারা, মালপত্র বওয়ার জন্য কুলি আর রাতের পথে একজন মশালচি ।

সাহেবরা কলকাতা নগরীর পত্তন করলো মানে দ্রুত গতিতে সে এগিয়ে চললো এমন নয় মোটেই । পত্তনের পর আরো একশ বছর কলকাতার চেহারাটা প্রায় একই রকম ছিল । যাতায়াতের জন্য কয়েকটা শরু কাঁচা রাস্তায় গোরুর গাড়ি আর পালকি ভরসা । প্রথম বড় চওড়া খোয়া বাঁধান রাস্তা সার্কুলার রোড তৈরী হয়েছিল ১৭৯৮/৯৯ নাগাদ, ফলে তখন থেকেই ছুটতে লাগল দ্রুত গতির ঘোড়ায় টানা গাড়ি । আর ঘোড়া মানেই গতি, দ্রুত গতির প্রতীক । এরপর, আরো এখশ’ বছর ঘোড়ায় টানা গাড়িই ছিল নগর কলকাতার একমাত্র দ্রুতগতির যানবাহন । যাত্রীবাহী মোটর বাস কলকাতায় চলতে শুরু করেছিল ১৯২২ থেকে । তার আগে অবশ্য ট্যাক্সি চলা শুরু হয়েছে ১৯০৬ থেকে ।

ঘোড়ার গাড়ির চল হওয়া শুরু হতেই কলকাতার জনজীবনে গতি এলো । অনেক রাস্তা তৈরী হল । কলকাতার রাস্তা-ঘাট তৈরী করার জন্য ইংরেজরা একটা ‘লটারি কমিটি’ করেছিল, লটারির টাকায় শহরের নানান উন্নয়ন করা হ’ত । ওয়েলসলি সাহেব তখন গভর্ণর জেনারেল । ১৮৩৬ সালের মধ্যে কলকাতায় অনেক প্রধান রাস্তার নির্মাণ হয়ে গেল । স্ট্রান্ড রোড, কলেজ স্ট্রিট,আমহার্স্ট স্ট্রিট,মির্জাপুর স্ট্রিট, হেয়ার স্ট্রিট প্রভৃতি । ১৮৮৮ পর্যন্ত কলকাতার মোট রাস্তার পরিমান ছিল ১৮২ মাইল । ঐ বছরেই ‘নগর কলকাতা’র আয়তন বাড়লো । এন্টালি, বেনেপুকুর, ট্যাংরা, তপসিয়া, বালিগঞ্জ, ভবানীপুর, কালিঘাট, চেতলা, আলিপুর ও খিদিরপুর । নগর কলকাতার সেইসব রাস্তা এখনকার মত মসৃণ এসফল্ট বা পিচ বাঁধান ছিল না । ছিল খোয়া বাঁধান । কারণ ১৯১০এর আগে এসফল্ট বা বিটুমিন’এর ব্যবহার জানা ছিল না । ঐসব রাস্তা দিয়ে ছুটতো ঘোড়ার গাড়ি । 

গাড়ি টানার কাজে ঘোড়াকে নানান উপায়ে ব্যবহার করা হত। উদ্দেশ্য দ্রুতগতিতে যাতায়াত । ব্রাউনলো নামে এক সাহেব বের করলেন ‘ব্রাউন বেরি’ নামে গাড়ি । সাবেকি পালকিতেই চারটি চাকা বসিয়ে সামনে ঘোড়া জুতে দিয়ে বানিয়ে ফেললো এক ঘোড়ায় টানা ‘ব্রাউনবেরি’ গাড়ি, ১৮২৭এ । ব্রাউন বেরির ভাড়া ছিল প্রথম একঘন্টায় চোদ্দ আনা, পরের প্রতি ঘন্টায় আট আনা আর সারা দিনের জন্য নিলে চার টাকা । নানান ধরনের ঘোড়ার গাড়ি ছিল । সাহেবদের জন্য দামি গাড়ি , সাধারণ কর্মচারিদের জন্য আলাদা গাড়ি । নানান নামের এইসব ঘোড়ার গাড়ি । চেরট, ফিটন, ল্যান্ডো, টমটম, ছ্যাকরা গাড়ি এইরকম । অনেক বড় বড় কোম্পানী হয়েছিল ঘোড়ার গাড়ি তৈরী করার জন্য । এক্কা গাড়ি, টমটম, ছ্যাকরা গাড়ি এসব নামগুলো প্রবাদের মত হয়ে গেছে । বহু যুগ ধরে বাংলা বর্ণমালায় পড়া “এক্কা গাড়ি ঐ ছুটেছে, ঐ দেখো ভাই চাঁদ উঠেছে”, বহুদিন অতীত হয়ে গেছে কলকাতার রাস্তা থেকে । তবু গোড়ার গাড়িই বোধয় কলকাতার সবচেয়ে ‘নস্টালজিক হেরিটেজ’ । এককালে কলকাতার ‘বাবু’রা ফিটনে চেপে ময়দানে হাওয়া খেতেন । আর সেই ঐতিহ্যের পথ বেয়ে এই সেদিনও ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সামনে সারি দেওয়া ফিটন গাড়ি দেখা যেত ময়দানে শখের হাওয়া-ভ্রমণের জন্য । ২৬শে মার্চ ২০১২ থেকে তাদেরও বিদায় করা হয়ে গেছে । 

ইতিমধ্যে ১৮৫৪ সালের অগষ্ট মাস থেকে হাওড়া স্টেশন থেকে হুগলী পর্যন্ত ট্রেন চলাচল শুরু হয়ে গেছে । কিন্তু কলকাতার ভেতরে একসঙ্গে বেশি পরিমান মালপত্র বইবার বা একসঙ্গে অনেক মানুষের যাতায়াতের কোন ব্যবস্থা ছিলনা । সেই অসুবিধা দূর হল, ঘোড়ায় টানা ট্রাম চালু করে । মার্চ ১৮৭০ থেকে তোড়জোড় শুরু করে, শিয়ালদহ স্টেশন থেকে বউবাজার, ডালহৌসি স্কোয়ার, স্ট্রান্ড রোড হয়ে আর্মেনিয়ান ঘাট পর্যন্ত পাতা হল ট্রাম লাইন আর ২৪শে ফেব্রুয়ারি ১৮৭৩ থেকে ঘোড়ায় টানা ট্রাম গাড়ি চলা শুরু করলো । দুটো বলিষ্ঠ ঘোড়া দিয়ে চালানো হত ট্রাম । এরপর অনেক রাস্তায় ট্রাম লাইন পাতা হল, কলকাতা ট্রামওয়েস কোম্পানী গঠন হল । ঘোড়ায় টানা ট্রামই হয়ে উঠলো কলকাতার প্রথম গণপরিবহন ব্যবস্থা । ১৮৯০-৯১ সনে কলকাতায় ট্রাম টানবার জন্য ঘোড়ার সংখ্যা ছিল একহাজার, সবই শীতপ্রধান দেশ থেকে নিয়ে আসা বেশ বলবান ঘোড়া । প্রায় ত্রিশ বছর চালু ছিল ঘোড়ায় টানা ট্রামের ব্যবস্থা । ঘোড়ায় টানা ট্রামের যুগ শেষ হল ১৯০২এ পৌঁছে । ২৭শে মার্চ ১৯০২ এ প্রথম বৈদ্যুতিক ট্রাম চলতে শুরু করলো ধর্মতলা – খিদিরপুর পথে । তার আগে কিছুদিন পরীক্ষামূলক ভাবে কয়েকটি পথে বাষ্পীয় ইঞ্জিন দিয়ে ট্রাম চালানো হয়েছিল । এখন তো কলকাতার কয়েকটা মাত্র পথে ট্রাম চলে । 

১৮৮৬ সনে জার্মানীতে মোটরগাড়ি আবিষ্কার হওয়ার পর দশ বছরের মধ্যেই কলকাতার রাস্তায় মোটর গাড়ি দেখা দিল, আর তার দশবছর পরে ১৮৯৬এ কলকাতায় চলে এলো ট্যাক্সি । ১৯৪০/৪৫ সাল নাগাদ কলকাতায় ট্যাক্সির ভাড়া ছিল কমপক্ষে আট আনা, তারপর প্রত্যেক ১/৪ মাইলের জন্য দু’আনা । তখন যাতায়াতের জন্য কলকাতায় প্রধান উপায় ছিল ট্রাম । কিন্তু শহরের বাইরে, দূরে যাওয়ার সমস্যা ছিল, কারণ ট্যাক্সিতে খরচ বেশি । অবশেষে ১৯২২ সনে কলকাতায় চালু হয়ে গেল যাত্রীবাহী মোটর বাস । এর অনেক আগে - মোটর গাড়ি আবিষ্কারই হয়নি, তখন কিছু দিনের জন্য ঘোড়ায় টানা বাস চলার কথা জানা যায় । ধর্মতলা থেকে বারাকপুর পর্যন্ত ঘোড়ায় টানা বাস চলেছিল ১৮৩০ সনে । কতদিন চলেছিল – এসব তথ্য জানা যায় না । ১৯২২ থেকে মোটর বাসই হয়ে গেল কলকাতার প্রধান গণ পরিবহন ব্যবস্থা । চালু হওয়ার সময় ১৯২৪এ কলকাতায় বাসের সংখ্যা ছিল ৫৫টি । সেই সংখ্যাটা ১৯২৫ সনে হয় ২৮০ । ১৯২৬এ চালু হয় দোতলা বাস । প্রথম দোতলা বাস চলেছিল শ্যামবাজার থেকে কালিঘাট । প্রথম চালু হওয়া দোতলা বাসগুলি বছর কুড়ি আগে দেখা বা ছবিতে দেখা বাসের মত ছিল না । বাসগুলির ওপরে ছাদ বা ছাউনি থাকতোনা । বর্ষায় যাত্রীরা ছাতা মাথায় বসে থাকতেন । ৮০রদশক পর্যন্তও বেশ কিছু প্রধান রাস্তায় দোতলা বাস চলতো । তারপর ১৯৯০ থেকে সেই সময়ের সরকার দোতলা বাস চালান বন্ধ করে দেয় । এখনও অনেকেই দোতলা বাসে চড়ার স্মৃতি রোমন্থন করে তৃপ্তি লাভ করেন । এখন নানা চেহারায় এই যাত্রী পরিবহন ব্যবস্থা – বাস, মিনিবাস, অটো ইত্যাদি । ১৯৪৮ থেকে সরকারী বাস চলাচল ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়, গঠিত হয় স্টেট ট্রানসপোর্ট কর্পোরেশন । এখন অবশ্য সরকারি বাস সামান্যই চলে । ১৯৭৫এ চালু হয় ‘মিনিবাস’ । সেই সময় যারা মিনিবাসে চড়তেন তাদের মনে পড়বে, সেগুলির উচ্চতা বেশ কম ছিল, যার জন্য সাধারণ উচ্চতার যাত্রিকেও দাঁড়িয়ে যেতে হলে সারাক্ষণ ব্যথা সহ্য করেও বাসের মধ্যে ঘাড় নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো । অতয়েব এই গণ পরিবহন ব্যবস্থার বয়স আপাতত একশ’ বছরেরও কম । 

কলকাতা বড় বিচিত্র শহর । এই জেটগতির যুগে দ্রুতগতির আধুনিক পরিবহন বন্দোবস্তের পাশাপাশিই মানুষ টানা রিকশর সহাবস্থান । ২০০৬এ পশ্চিমবঙ্গ সরকার টানা রিকশর চলাচল বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল । তারপর ধীরে ধীরে কলকাতা থেকে এই ঔপনিবেশিক চিহ্নটি বিদায় নেয় । রিকশ'র জন্ম জাপানে, ১৮৬৯ খৃষ্টাব্দে । জাপানী ভাষায় এ গাড়িকে বলা হত জিন-রি-কি-শ , মানে 'মানুষ টানা গাড়ি' । ভারতে প্রথম বলা হত 'জিন রিকশ' । সেটা ছোট হয়ে 'রিকশ' হয়েছে । সিমলা তে এই গাড়ি প্রথম দেখা যায় ১৮৮০তে। লেডি ডাফরিনের আত্মকথায় আছে । কলকাতায় চিনারা প্রথম নিজেদের ব্যবহারের জন্য রিকশ'র প্রচলন করে ১৯০০/১৯০১ সন নাগাদ । তারপর চিনারা, ভাড়ায় রিকশ' চালানো শুরু করে ১৯১৩/১৪ থেকে । ভারতীয়রা রিকশর ব্যবসা শুরু করে ১৯২০ থেকে । ইংরেজ আমলে টানা রিকশ'র ভাড়া ছিল এক মাইল পর্যন্ত - তিন আনা । তার পরের প্রতি মাইলের জন্য তিন আনা। সময়ের হিসাবে একঘন্টার জন্য ছ আনা । এটা দুজনের বসার হিসাব। একজন হলে দেড় আনা প্রতি মাইল , একঘন্টার জন্য তিন আনা । 

স্বল্প দূরত্বের পথে যাতায়াতের জন্য তিন চাকার সাইকেল রিকশ এখনও মানুষের পরিহার্য বাহন । কলকাতার রাস্তায় সাইকেল রিকশ চালু হয়েছিল ১৯৪০ নাগাদ । তার পঞ্চাশ বছর আগেই অবশ্য দুই চাকার ব্যক্তিগত বাহন বাই-সাইকেল প্রচলিত হয়েছিল ১৮৮৯ সালে ।

মানুষ ও মালপত্রের বহন ছাড়াও চিঠিপত্র বা ডাক দূর দূরান্তে পৌঁছে দেবার কিরকম বন্দোবস্ত ছিল এবার সেটাও দেখি । পাঠ্য ইতিহাসে পড়েছি শের শাহ ঘোড়ার মাধ্যমে ডাক চলাচলের ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন । তখন মানুষ ব্যক্তিগত চিঠিপত্র বা ডাকের ব্যবহারই জানতো না । ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর শাসনকালে ডাকব্যবস্থা গড়ে ওঠে । দূর-দূরান্তে, অন্য প্রদেশে ডাক নিয়ে যাবার জন্য মানুষ বওয়ার মত একই রকম ব্যবস্থা ছিল অর্থাৎ পালকি, গোরুর গাড়ি ও ঘোড়ায় টানা পালকি গাড়ি । 

এখন, এই একুশ শতকে যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থা কোন উচ্চ শিখরে পৌঁছে গিয়েছে তা আমাদের নিত্যদিনের অভিজ্ঞতায় দেখছি । সে প্রসঙ্গ আমার বিষয় নয় । আমি শুধু কলকাতার সড়ক পরিবহন ব্যবস্থার আদিপর্বের কিছু তথ্য তুলে এনেছি আর তার বিবর্তনটা বুঝতে চেয়েছি । সর্ব দেশেই সভ্যতার অগ্রগতির ধাপগুলো একই – পেশী শক্তি, পশুশক্তি এবং তারপর যন্ত্রশক্তি । আর এই সবের নিয়ন্ত্রক অবশ্যই মানুষের মস্তিষ্ক । সুতরাং সেই একই ধারায় নগর কলকাতার সড়ক পরিবন ব্যবস্থা নানান ধাপ পেরিয়ে আজকের জেট-গতি যুগে এসেছে । আমি সেই ধাপগুলি ছুঁয়ে যেতে চেয়েছি ।




তথ্যসূত্র -

(১) কলিকাতা দর্পণ / রথীন্দ্রনাথ মিত্র, (২) কলকাতা শহরের ইতিবৃত্ত / বিনয় ঘোষ (৩) সংবাদপত্রে সেকালের কথা / ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়

0 comments:

2

প্রবন্ধ : ঈশানী রায়চৌধুরী

Posted in



প্রবন্ধ 



অনাম্নী অঙ্গনারা
ঈশানী রায়চৌধুরী



অনেকদিন আগে..যখন আমি ইস্কুলের ছাত্রী.."বেতার জগত " পত্রিকায় একটি কবিতা পড়েছিলাম | লিখেছিলেন কবিতা সিংহ | কবিতাটির নাম "নারী"| খুব ছেঁড়া ছেঁড়া কিছু পংক্তি মনে আছে |

" অন্ধকার প্রাক-ইতিহাস
প্রগাঢ় অমার মধ্যে ঈশ্বরতার কোনো সংজ্ঞা নেই
স্তূপ স্তূপ ক্ষুধা আর ঘোর লালসার
উদগ্র আমার থেকে উঠে আসে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ আদিম
পরিতৃপ্ত মাংসল নিদ্রার মধ্য থেকে শ্বদন্তের
কামড় বসায় ক্ষুধা
ক্ষুধার সুতীব্র দাঁত ছিঁড়ে খায় নির্বিচারে
কে কার সন্তান ?"

সত্যিই তাই | আমরা যারা সাজানো গোছানো সুখী গৃহকোণ শোভে গ্রামোফোন মার্কা সংসারে ...তা বাবা , দাদা , স্বামী ..যেই হোক.... তাদের তাঁবে থেকে দিব্যি বাড়া ভাত খাচ্ছি ...আমরা কী জানি যে সব কষ্ট সইয়ে নেওয়া যায়..শুধু পেটের জ্বালা ছাড়া ! আর তা পারা যায় না বলেই প্রিয়জনকে হারিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে মালসাভোগ চড়াই |

ধরা যাক , মঞ্জু নামের একটি মেয়ে |

“ খিদের জ্বালা সইতে পারি না ! যদি পুরুষ হতাম , হয়ত আর কোনো উপায় না থাকলে সুপারি কিলার হতাম | এখন বেশ্যা হয়েছি | এই ভালো | অন্যকে না মেরে নিজেকে রোজ একটু একটু করে মারা | অন্য ভাবে...এত আস্তে, যে চিনচিনে ব্যথাটা থাকে, ঝুঁঝিয়ে রক্ত পড়াটা টের পাই না |
আর যখন ভদ্রবাড়ির মেয়েরা আমাদের দিকে, আমাদের পেশার দিকে আঙুল তোলে, আমরা হাসি | আমাদের ঘর থেকে বেরিয়ে পুরুষেরা যখন ওদের ঘরে ওদের বিছানায় যায়, তখন ওরা নিজেদের বিছিয়ে দেয় | তাও আবার নগদ টাকা ছাড়াই | শুধু ওই ভাত কাপড়ের লোভেই তো ! নাকি গয়না, বেড়ানো...এসবও ? অবশ্য..আমরা বারোভাতারি...ওরা এক | বাঁধা বাবু ! আমরা তবু মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিয়ে বলতে পারি , "আজ ঘরে বাবু বসাবো না | যাও বাপু, বেশি হল্লা ক'র না |" গেরস্ত ঘরের মেয়েরা ? ইচ্ছে হোক, না হোক..বাবু চাইলে বসাতেই হবে ! আমরাই ভালো আছি...হাফ- গেরস্ত মাগী হয়ে ! স্বাধীনভাবে খাচ্ছি, দাচ্ছি...কারো দয়ার দান তো নিচ্ছি না !”

বেশ্যাবৃত্তি আসলে এমনই এক দুষ্টক্ষত , যা আমাদের আর্থসামাজিক পরিবেশের শিকার হয়ে মিশে গেছে পুরোপুরি আমাদের রক্তে | এ এক এমন পেশা, যেখানে আনকোরা অভিজ্ঞতা বা সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞতার দাম সবচেয়ে বেশি | পৃথিবীর আর কোনো পেশায় এটি হয় কি? আর পুরুষ শাসিত সমাজে মেয়েরা বেশি লেখাপড়া শিখলে চাকরি করে চেয়ারে বসে, আর পেটে বিদ্যে কম থাকলে চাকরি করে শুয়ে | বড় বড় নীতিবাগীশদের কাছে দেহদান কোনো ঘৃণ্য ব্যাপার নয়....যদি গ্রহীতাটি বিবাহিত স্বামী হয় !

বেশ্যাবৃত্তি কি অশ্লীল ? আমি তো মনে করি, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা, সমাজব্যবস্থা, অর্থনীতির গঠন অনেক বেশি অশ্লীল..যা আমাদের মেয়েদের বাধ্য করে শরীর বেচে খেতে | আমরা সকলের জন্য দু’মুঠো ভাতের যোগাড় করতে পারি না..অথচ আই পি এল -এ স্পন্সরশিপ পেতে ৩৮৪ কোটি টাকা খরচ করতে পারি, কোটি কোটি টাকা খরচ করে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে পারি | আমরা সেভ দ্য টাইগার, বা গো গ্রীন প্রকল্পে মুক্তহাতে দান করতে পারি ; কিন্তু সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও পরিবার পিছু একটি কন্যাসন্তানকে অনাথাশ্রম থেকে দত্তক নিতে পারি না ! কিংবা, কোনো বেশ্যা যদি সুস্থভাবে বাঁচতে চায়..হয়ত আমার বাড়িতে রান্নার কাজ ক’রে..আমরা মুখ ফিরিয়ে নিই | আমরা দুপুরে কিটি পার্টি করি, পরনিন্দা পরচর্চা করি, বিউটি পার্লারে যাই...মুখ পালিশ করতে, শরীর সাজাতে | কিন্তু ওই ক্ষয়াটে মেয়েগুলো..যারা সন্ধেবেলা রং মেখে গলির মুখে ক্লান্ত চোখ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ..তাদের বাচ্চারা ...যারা দিনের বেলায় মাকে পায়..কিন্তু রাতের বেলায় থাকতে হয়..খোলা পথে বা হয়ত মায়ের ঘরের চৌকির নীচে...মুখটি বুজে...যদি..বাবু জানতে পেরে যায়..যারা বড় হলে..যদি ছেলে হয়..তবে দালাল আর মেয়ে হলে নথভাঙার পর লাইনে নেমে পড়ে..আমরা কিন্তু তাদের সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য কিছুই করি না | আমরা মুখে বলি...ওই দেখো..এন জি ও কত কাজ করছে...কিন্তু নিজেরা গা ঘামাই না | তিন নম্বরের সুধারাণীরা বংশ পরম্পরায় সুধারাণীই রয়ে যায় ! আমরাই, এই সমাজের ওপরতলার মানুষেরাই, পরোক্ষে প্রশ্রয় দিই অজ্ঞানতা, অভাব, অশিক্ষা, আর দারিদ্র্য | বাড়তেই থাকে হু হু করে... এই পতিতাবৃত্তি | মেয়েরা বিকিয়ে যায় অভাবে, অবহেলায় | তারা শরীর বেচা টাকায় ভাত জোগায় সংসারে | টাকায় পাপের ক্লেদ লেগে থাকে না | পেশায় থাকে !

পতিতাবৃত্তি এক সামাজিক ব্যাধি | মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ কিছু সংস্থা এদের নিয়ে সীমিত ক্ষমতায় কিছু কাজ করে, কিছু সুবিচার দেওয়ার, ভদ্রভাবে বেঁচে থাকার সুযোগের ব্যবস্থা করে | কিন্তু ওই পর্যন্তই | তাই আজও মেয়েরা হাটে প্রকাশ্য দিবালোকে, বা রাতের অন্ধকারে গলি ঘুঁজিতে বিক্রি হয়ে যায়, মেয়েদের রিফর্মেশন কেন্দ্রগুলি তকমা পায় নারী পাচার কেন্দ্রের, সমাজের ওপরতলার মানুষ দিনেরবেলায় নারীমুক্তি নিয়ে বুকুনি ঝেড়ে সন্ধেবেলা আলোয়ানে মুখ ঢেকে বেলফুলের মালা হাতে জড়িয়ে বেশ্যাপল্লী গিয়ে টাটকা মাল খোঁজে ! কবিরা, গল্পকাররা এদের উপজীব্য করে লেখেন, এদের নিয়ে সিনেমা হয়, এদের হয়ে মাঝে মাঝে আদালতে অধিকারের লড়াই লড়েন ব্রিফলেস উকিলেরা | ব্যস, হয়ে গেল নারী মুক্তি আর মুক্ত নারী নিয়ে আন্দোলন ! এই পতিতারা ছাড়া আর কোনো শ্রেণী একই সঙ্গে এত ঘৃণা আর নাকে কান্নার শিকার হয়েছে বলে মনে হয় না ! যা আমরা এদের দিতে পারিনি..তা হল...যৌনকর্মী হিসেবে আইনের আশ্রয় আর সামাজিক স্বীকৃতি | পেটের ভাত , বর্ণপরিচয়, পরনের কাপড়..এসব তো অনেক দূরের কথা.. এরা নিজেদের ব্যবস্থা যে নিজেরাই করে নিয়েছে...তাতেও আমরা ন্যায্য অধিকার আর ন্যুনতম সম্মান এদের দিতে পারিনি | এদের ব্রাত্য, অবহেলিত ভেবে অনুকম্পা করেছি, অস্পৃশ্য পেশা ভেবে নিজেদের নিরাপদ দূরত্বে রেখেছি | বরং এভাবে ভাবি না কেন..যে এরা স্বাধীন সত্ত্বার নিখুঁত প্রতীক, যারা পরিস্থিতির শিকার হয়ে উপায়ান্তর না পেয়ে সফল অর্থনৈতিক প্রকল্প স্বেচ্ছা - বিনিয়োগে নিজেরাই বেছে নিয়েছে...যাতে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে ! যতক্ষণ না আমরা সমাজ, অর্থনীতি, শিক্ষা ব্যবস্থায় এমন পরিবর্তন আনতে পারছি, যে এই পেশাটিকে নির্মূল করতে পারব, ততক্ষণ লজ্জার দায়ভাগ না হয় আমরা...এই সমাজের সুস্থ জীবনযাপনে অভ্যস্ত নাগরিকেরাই মাথা পেতে নিই ! ততক্ষণ এটুকুই ভাবি ,

" ভালোবেসেছিলাম একটি স্বৈরিণীকে
খরচ করে চোদ্দ সিকে |
স্বৈরিণীও ভালোবাসা দিতে পারে
হিসেবমতো উষ্ণ নিপুণ অন্ধকারে |
তাকে এখন মনে করি. ...
...কী নাম ছিল ?সঠিক এখন তো মনে নেই :
আয়ুর শেষে স্মৃতি খানিক খর্ব হবেই |
গোলাপী ? না তরঙ্গিনী ? কুসুমবালা ?
যাক গে, খোঁপায় বাঁধা ছিল বকুলমালা ,
ছিল বুঝি দু'চোখে তার কাজলটানা ;
চোদ্দ সিকেয় ছুঁয়েছিলাম পরীর ডানা ;
এখন আমি ডানার গন্ধে কৌটো ভরি |"

( পৌত্তলিক/ অরবিন্দ গুহ)

2 comments:

3

প্রবন্ধ : সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়

Posted in


প্রবন্ধ



মহাকাব্যের নায়ক
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়



মহাকাব্য বলতে আমি এখানে ভারতবর্ষের দুই সনাতন পুরানকাব্যকেই বোঝাচ্ছি। তার বাইরে আর কোনও দেশের মহাকাব্য নিয়ে আলোচনা করার মতন জ্ঞানের পরিধি আমার নেই। এই রকম একটা বিষয় নিয়েও বিশ্লেষণধর্মী প্রবন্ধ লেখা আমার মতন অল্পবুদ্ধি লোকের সাজে কি না, সেটাও বিবেচ্য। তবে আপাতত লোভ সংবরণ করা গেলো না। রচনার দায় অবশ্যই আমার, কিন্তু সেটা পড়ে হজম করার দায়িত্ব সহৃদয় পাঠকের। বদহজম হলে অপরাধ মার্জনীয়।

প্রথমে সহজ বিষয়টাই ধরি। আদিকবির হৃদয়নন্দন দাশরথি রামচন্দ্র যে রামায়ণের অবিসম্বাদিত নায়ক, সেটা আলাদা করে বলার অপেক্ষা রাখে না। যা যা চারিত্রিক বৈশিষ্ট একজন Epical hero কে চিহ্নিত করে এবং মহাকাব্যিক নিয়ম অনুযায়ী জীবনধারা যে যে খাতে বওয়ার প্রয়োজন হয়, সেই সব শর্ত রামচন্দ্রের চরিত্র ও জীবনকাহিনী পূরণ করে। উত্তরকোশলের মতন একটি সমৃদ্ধ রাজ্যের সিংহাসনের ন্যায়সঙ্গত উত্তরাধিকার এবং স্বভাবে ধীরোদাত্ত নায়কের সবকটি গুণের সমন্বয় রামচন্দ্রকে এক পরিপূর্ণ মহাকাব্যিক নায়কের মহিমায় প্রতিষ্ঠিত করেছে রামায়ণের কাহিনীশৃঙ্খলায়। একেবারে কৈশোরকাল থেকেই তিনি মহাবীরের পর্যায়ে উন্নীত। বিশ্বামিত্র যখন রাম-লক্ষ্মণকে তাড়কা এবং তার সহচর রাক্ষসদের দমন করার জন্য নিয়ে যান, তখন এঁরা দু’জন সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ তরুন। বয়স সম্ভবত কুড়ির কোঠাও পার হয়নি। সেই বয়সেই এই দুই বৈমাত্রেয় ভাইয়ের, বিশেষ করে রামচন্দ্রের বীরত্বের যশ আর্যাবর্তে অনেকখানি প্রসিদ্ধ। না হলে এত বীর থাকতে বিশ্বামিত্র এই দুই নবীন যুবককে এমন দুরূহ কাজের জন্য বেছে নেবেন কেন? এবং রাক্ষসবধের কাজ সুষ্ঠুরূপে সম্পন্ন করার অব্যবহিত পরেই রামচন্দ্র যা করেন, অর্থাৎ মৈথিলী জনকতনয়ার স্বয়ংবরসভায় হরধনু ভঙ্গ, তাতে তাঁর অসাধারণ বীরত্বের সংবাদ সম্ভবত আর্যাবর্তের গণ্ডী লঙ্ঘন করে দাক্ষিণাত্য অবধি ছড়িয়ে পড়ে।

রাম মহাবীর, আদর্শ পুত্র, আদর্শ রাজা, সে যুগের নিরীখে আদর্শ স্বামীও বটেন, এবং সর্বোপরি তাঁর জীবন একজন আদর্শ নায়কের প্রায় বাঁধা গতেই বহমান। বিমাতার ষড়যন্ত্রে ও পিতৃসত্য পালনের তাড়নায় রাজ্যচ্যূতি এবং বনবাস, তদুপরি রাবণের মতন একজন মহাপরাক্রম ও প্রভাবশালী রাজা কর্তৃক পত্নীহরণ রামচন্দ্রকে এমন এক বিপন্নতার মুখে ঠেলে দেয়, যা শ্রোতা-পাঠকের হৃদয়ে তাঁর জন্য অপার সহানুভূতি সৃষ্টি করতে বাধ্য। মহাকাব্যিক ভাষায় যাকে heroic isolation বলে, রামচন্দ্রের জীবন এই ধরনের পরিস্থিতিগুলিতে সেই মহিমায় ভাস্বর। সহনায়ক লক্ষ্মণকে সঙ্গে নিয়ে অতঃপর তাঁর অসাধ্যসাধনগুলি আবহমানকাল ধরে ভারতবর্ষ তথা সারা বিশ্বের আবালবৃদ্ধবনিতার মনোরঞ্জন করে এসেছে। নিঃসম্বল অবস্থা থেকে ওইরকম একটি শক্তিশালী সৈন্যবাহিনী সংগঠিত করে লঙ্কার মতন সুরক্ষিত, সমৃদ্ধ দ্বীপরাষ্ট্র আক্রমণ করা এবং রাবণের বিশ্বত্রাস সামরিক শক্তিকে পরাভূত করে স্ত্রীর এবং নিজের হৃত সম্মান পুনরুদ্ধার করা কোনওভাবেই সহজসাধ্য ছিলো না। সেই প্রয়াসে বার দুয়েক তাঁকে ছলনাহত্যার আশ্রয়ও নিতে হয়েছে। কিষ্কিন্ধ্যাপতি বালী এবং লঙ্কার যুবরাজ ইন্দ্রজিৎ মেঘনাদ, যাঁরা দুজনেই অপরাজেয় যোদ্ধা হিসেবে খ্যাত ছিলেন, এই ছলনার শিকার। প্রথমজনের অপসারণ সম্পন্ন না হলে লঙ্কার বিরূদ্ধে কিষ্কিন্ধ্যার সামরিক শক্তিকে ব্যবহার করা সম্ভব হতো না। দ্বিতীয়জন সম্মুখযুদ্ধে রাম-লক্ষ্মণ দু’জনকেই রীতিমতন বেগ দিয়েছেন, এবং ইনি শেষ পর্যন্ত জীবিত থাকলে যুদ্ধের ফলাফলটাই হয়তো অন্যরকম হয়ে যেতো। তাই যে কোনও প্রকারে এই দু’জনের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া রামচন্দ্রের একান্ত প্রয়োজন ছিলো। দু’টি ক্ষেত্রেই দু’জনের দুই পরমাত্মীয়ের বিশ্বাসঘাতকতার সুযোগ সদ্ব্যবহার করেছিলেন রামচন্দ্র।

এই দু’টি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে রামচন্দ্রের বীরত্বের মর্যাদা যতখানি লঙ্ঘিত হয়েছে, তার থেকে কিঞ্চিৎ বেশি বোধহয় তাঁর নায়কোচিত ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছে লঙ্কাজয়ের পর অযোধ্যায় ফিরে এসে সীতাদেবীর প্রতি তাঁর ব্যবহারে। আধুনিক প্রগতিশীলরা তাঁর সেই আচরণে নারীত্বের চূড়ান্ত অবমাননা খুঁজে পেয়েছেন। প্রজাদের নির্বন্ধে স্ত্রীকে অগ্নিপরীক্ষায় প্রবৃত্ত করা এবং তাঁর চরিত্রের উপর অসতীত্বের কলঙ্কারোপ করে গর্ভবতী অবস্থায় তাঁকে নির্বাসন দান জাতীয় আচরণগুলি সত্যিই আজকের দৃষ্টিভঙ্গীতে বড় নিষ্ঠুর, বড় বেশি পৌরুষদুষ্ট মনে হয়। তবে এক যুগের সামাজিক বোধের সঠিক মূল্যায়ন যে আরেক যুগের দৃষ্টিভঙ্গীর নিরীখে করা যায় না, সে কথা তো অনস্বীকার্য। আজ পর্যন্ত যে সত্য এবং ন্যায়ের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত রামরাজ্যের উদাহরণ ভারতবর্ষে দেওয়া হয়, সে রাজ্য যিনি প্রকৃতপক্ষে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তাঁর পক্ষে যে প্রজাবর্গের অভিমতকে উপেক্ষা করা সম্ভব ছিলো না, বা সম্ভব হলেও উচিত ছিলো না, সে কথাও আশা করি অধুনিক পর্যালোচকদের মেনে নিতে অসুবিধা হবে না। দশ বছরের অধিক সময় লঙ্কায় রাবণের বন্দিনী থাকার পর অযোধ্যা প্রত্যাবর্তনের অব্যবহিত পরেই এমন একটা সময়ে সীতার গর্ভাধান হয়েছিলো, যে সেই গর্ভস্থ সন্তানের পিতৃত্ব নিয়েই প্রজারা সন্দিহান হয়ে উঠেছিলো; এবং সেকালের সমাজভাবনায় উত্তরাধিকার ব্যাপারটা, বিশেষত যেখানে সিংহাসনের উত্তরাধিকারের প্রশ্ন, সেটা এতখানিই বংশধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলো, যে গোটা পরিস্থিতিটাই রামচন্দ্রের জন্য রীতিমতন সমস্যাসঙ্কুল হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। সেই অবস্থান থেকে তিনি যা করেছিলেন, তা ছাড়া বোধহয় রাজ্যে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য তাঁর আর উপায়ান্তর ছিলো না।

তবে এই জাতীয় কিছু দ্বন্দ্ব বা উত্তরাধুনিক বিতর্কের অবকাশের বাইরে আপামর ভারতীয় জনমানসে এমন একটি আসনে প্রভু পতিতপাবন শ্রীরামচন্দ্র আসীন, যা অবতারকল্প ভগবত্তার মহিমায় চিহ্নিত। ভারতবাসী ধর্মপ্রাণ। আমাদের দেশে প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে শুরু করে মাত্র কয়েকশো বছর আগে পর্যন্ত যত মানুষের deification বা দিব্যায়ন ঘটেছে, তেমনটা পৃথিবীর আর কোনও দেশে ঘটেছে বলে আমার জানা নেই। বাল্মীকির রামায়ণকে যদি কিয়দাংশেও ঐতিহাসিক বলে মেনে নিতে হয়, তবে তার মূল উপজীব্য দাশরথি রামচন্দ্রের দিব্যায়ন, যে দিব্যায়ন পরিপূর্ণতার মাত্রা পায় তাঁর চিরকালীন একনিষ্ঠ সেবক হনুমানের ভক্তি-আনুগত্যের পরাকাষ্ঠায়।

এই এক অদ্ভূত মহাকব্যিক সম্পর্ক! ভগবানের সঙ্গে ভক্তের। একের বিপন্নতায় অন্যের আর্তি। একের প্রয়োজনে অন্যের নিঃস্বার্থ সহায়তা। রামায়ণে ভক্ত এসেছেন ভগবানের সাহায্যকল্পে। সীতাকে হারিয়ে দিশাহারা রাম-লক্ষ্মণ যখন বনে বনে ভ্রাম্যমান, সেই সময়ে হনুমানের আবির্ভাব। তাঁরই মধ্যস্থতায় কিষ্কিন্ধ্যার নির্বাসিত রাজপুত্র সুগ্রীবের সঙ্গে রামের বন্ধুত্ব, এবং তারপর লঙ্কায় বন্দিনী সীতার কাছে রামের বার্তা বহন করা থেকে আরম্ভ করে লঙ্কাজয় অবধি হনুমানের ভূমিকার কাহিনী ভারতবর্ষের মানুষের আবাল্য পাঠ্য ও শ্রব্য। রামায়ণবর্ণিত এই প্রভু-ভক্তের অনাবিল সম্পর্ক ভারতীয় সংস্কৃতিতে, ভারতবর্ষের মানুষের মনে এতটাই উজ্জ্বল, এতখানি প্রাবাদিক, যে এখনও আনুগত্যের উদাহরণ দিতে হলে রামভক্ত হনুমানের নামই উল্লেখ করা হয়।

দ্বৈপায়ন ব্যাসের কালজয়ী মহাকাব্যে কিন্তু বিষয়টা একটু অন্যরকম। প্রকৃতপক্ষে, পরিস্থিতিটা প্রায় রামায়ণের বিপরীত। এখানে ভক্তের জীবনের  বিপন্ন এক সময়ে ভগবানের আবির্ভাব; এবং তারপর ভক্তের সঙ্গে ভগবানের যে সম্পর্কটি তৈরি হয়, তা ভক্তি বা আনুগত্যের চাইতে অনেক বেশি হৃদ্যতার, আত্মীয়তার । আমি অবশ্যই মহাভারতের দুই পুরুষসিংহ কৃষ্ণ ও অর্জুনের পারস্পরিক সম্পর্কের কথা বলছি। কিন্তু এই সম্পর্কের গভীরে প্রবেশ করার আগে আমাদের মূল প্রসঙ্গে, অর্থাৎ নায়ক নির্বাচনের প্রসঙ্গে, একবার ফিরে যেতে হবে। কারণ মহাভারতের কাহিনী ও তার বহমানতা রামায়ণের মতন সরলরেখ নয়, এবং দ্বৈপায়নের এই অতুলকীর্তির আভ্যন্তরীণ জটিলতার তন্তুগুলি ছাড়িয়ে কোনও একটি চরিত্রকে একক নায়ক প্রতিপন্ন করাও খুব সহজ কাজ নয়।

প্রকৃতপক্ষে, মহাভারতের আদিপর্বের নায়ক দেবব্রত ভীষ্ম। পিতৃদেব মহারাজ শান্তনুর প্রৌঢ় বয়সের প্রেম-কামনা চরিতার্থ করার জন্য যে আত্মত্যাগ তরুণ দেবব্রত করেছিলেন, তা সারা বিশ্বের মহাকাব্যিক পরম্পরায় নজিরবিহীন। তাঁর অনন্ত প্রজ্ঞা ও অসামান্য বীরত্বও প্রায় অনন্যদৃষ্টান্ত। স্বয়ং দ্বৈপায়ন ব্যাসের উদ্ধৃতি অনুযায়ী মহাভারতের ব্যাপ্তি মূলত এই ভারতবংশীয় মহামানবের সুদীর্ঘ জীবনের পরিসর। কিন্তু তবু ভীষ্ম সমগ্র মহাভারতের নায়ক নন। কারণ, যে মুহূর্ত থেকে হস্তিনাপুরের সিংহাসনকে কেন্দ্র করে ধার্তরাষ্ট্র এবং পাণ্ডবদের মধ্যে কুরুবংশীয় জ্ঞাতিশত্রুতা আরম্ভ হয়, সেই মুহূর্ত থেকে একটু একটু করে মহাকাব্যের দৃষ্টিকেন্দ্র বা focus ভীষ্মের উপর থেকে সরে যেতে থাকে। উজ্জ্বলতর হতে থাকেন পাণ্ডবরা, এবং একটা সময়ে গিয়ে মহাভারত হয়ে দাঁড়ায় মূলত পাণ্ডব ভাইদেরই জীবনসংগ্রামের কাহিনী। সে কাহিনীর নায়ক কখনও ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির, কখনও বৃকোদর ভীম এবং অবশ্যই ভারতীয় মহাকাব্যিক পরম্পরার শ্রেষ্ঠ বীর সব্যসাচী অর্জুন।

যুধিষ্ঠিরের ধৈর্য, স্থৈর্য, ন্যায়নিষ্ঠা এবং ঔচিত্যবোধ প্রায় অতিমানবিক পর্যায়ের। এমন এক সার্বজনীন ভালোবাসা, মমত্বের স্রোতও বোধহয় দুই মহাকব্যের আর কোনও চরিত্রের হৃদয় থেকে নিঃসৃত হয় না। ছোটবেলায় পিতৃহীন ভাইদের, যাঁরা কেউই তাঁর থেকে খুব বেশি ছোট নন (যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুনের জন্ম ক্রমান্বয়ে এক এক বছরের ব্যবধানে এবং নকুল-সহদেব অর্জুনের কিছু পরেই যুগ্মজাত), যুধিষ্ঠির প্রায় পিতার স্নেহেই আগলে রেখেছেন। পরম শত্রু দুর্যোধনের বিরূদ্ধেও তাঁর মুখে কোনওদিন কোনও অভিশাপ উচ্চারিত হতে শোনা যায়নি। এমনকি পাণ্ডবদের দ্বৈতবনে বাসকালীন কৌরবরা যখন তাঁদের উত্তক্ত করার জন্য সবাহিনী সপরিবার সেখানে এসে গন্ধর্বদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়লেন এবং তাদের হাতে চূড়ান্ত হেনস্থা হলেন, তখনও যুধিষ্ঠিরেরই নির্দেশে ভীম অর্জুন গিয়ে গন্ধর্বদের হাত থেকে তাঁদের মুক্ত করেন। ধৃতরাষ্ট্রের জামাই জয়দ্রথের দ্রৌপদীহরণের সময়ও যুধিষ্ঠির ক্রোধান্ধ ভীমকে গান্ধারী-দুঃশলাদের কথা স্মরণ করিয়ে জয়দ্রথকে হত্যা করতে নিষেধ করেছিলেন। এই জাতীয় সমদর্শিতা বা সংবেদনশীলতা একজন ক্ষত্রিয়ের চরিত্রে দুর্লভ, কারণ প্রতিশোধস্পৃহা ছিলো সে যুগের ক্ষত্রিয় জাতির মানসিক গঠনের মূলে।

যুধিষ্ঠিরের চারিত্রিক গঠন ক্ষত্রিয়ের থেকে বেশি ব্রাহ্মণসুলভ। যুদ্ধে, অশান্তিতে তাঁর চিরকাল অনীহা। ঋষিব্রাহ্মণদের সঙ্গে আধ্যাত্মালোচনায় কালযাপন তাঁর প্রিয় ব্যসন। চিরশত্রু ধার্তরাষ্ট্রদের সম্বোধনেও তাই তিনি ‘‘অজাতশত্রু’’। যুদ্ধটাও যে তিনি একেবারে করতে জানতেন না, তা নয়। অন্তত কুরুক্ষেত্রে বারকয়েক তিনি দুর্যোধন-দুঃশাসনদের রথযুদ্ধে পর্যুদস্ত করেছেন, এবং যুদ্ধের অন্তিম পর্যায়ে শল্যের মতন মহাযোদ্ধার নিপাতও করেছেন। কিন্তু তবু, প্রখ্যাত সাহিত্যিকরা যতই তাঁকে কৃষ্ণাদ্রৌপদীর পরমদয়িত সাব্যস্ত করে মহাভারতের প্রধান নায়ক প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করুন, যুধিষ্ঠির বস্তুত তা নন। কারণ, মহাবাব্যের নায়ক হওয়ার যা প্রধান শর্ত, সেই বীরশ্রেষ্ঠত্ব তাঁর নেই।

সে বীরত্ব আছে তাঁর অনুজ ভীমসেনের। মহাভারতের জনপ্রিয়তম চরিত্রগুলির মধ্যে ভীমসেন একজন। একজন মানুষের শারীরিক সক্ষমতা কি অবিশ্বাস্য পর্যায়ে পৌঁছতে পারে, ভীম সম্ভবত তার প্রকৃষ্টতম মহাকাব্যিক নিদর্শন। তিনি মহাভারতের দ্রুততম মানুষ। দৌড়ে রথের পশ্চাদ্ধাবন করতে পারেন। তিনি সর্বাধিক শক্তিশালী পুরুষ। মল্লযুদ্ধে তাঁর সমকক্ষ সেযুগে কেউ ছিলো না। নিজের martial art কে ভীম এমন একটা অমানুষিক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন, যে হাতে অস্ত্র থাকলে তাঁর বিরূদ্ধে বাঘ-সিংহ-হাতি-গণ্ডারের মতন ভয়ংকর প্রাণীও বিশেষ প্রতিরোধ সৃষ্টি করতে পারতো না। কুরুক্ষেত্রে তিনি একা গদা হাতে অসংখ্য রণহস্তী বধ করেছিলেন। মৎস্যদেশে অজ্ঞাতবাসকালীন রাজা বিরাট ও তাঁর পরিবারের মনোরঞ্জন করার জন্য ভীম প্রাসাদপ্রাঙ্গনে বন্য পশুদের সঙ্গে একক যুদ্ধ করতেন।

আসলে ভীমের জনপ্রিয়তার প্রধান কারণই তাঁর এই দর্শনদারী gallery performance। তাঁর অতিমানবিক কীর্তিগুলি সবই এই ধরনের মনোরঞ্জক, হাততালি কুড়নো। দণ্ডপ্রদানে তিনি সিদ্ধহস্ত। হিড়িম্ব, বক, জটাসুর, কীর্মির, কীচকদের ভীম চরম শাস্তি দিয়েছেন। তাঁর ক্রোধদৃষ্টিতে কেউ একবার পড়লে তার আয়ুষ্কাল সীমিত হয়ে আসতো। তাঁর প্রতিজ্ঞায় যাদের যাদের মৃত্যুদণ্ড ঘোষিত হয়েছে, তারা কেউ তাঁর হাত থেকে রেহাই পায়নি। দ্যূৎসভায় দ্রৌপদীর চূড়ান্ত লাঞ্ছনার সময় নিরূপায় ভীম শুধু রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে প্রতিজ্ঞা উচ্চারণ করেছিলেন – ধৃতরাষ্ট্রের সবকটি পুত্রকে তিনি রণক্ষেত্রে এর প্রতিদান দেবেন, এবং তিনি তা দিয়েওছেন। একশোজন ধার্তরাষ্ট্রই কুরুক্ষেত্রে ভীমের হাতে নিহত হয়েছেন। দুঃশাসন ও দুর্যোধনের জন্য ছিলো বিশেষ শাস্তির প্রতিশ্রূতি, যে প্রতিশ্রূতিও ভীম অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন, এবং পালনকালে কখনও কখনও ভয়াবহ নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করেছেন।

এই নিষ্ঠুরতাই কিন্তু ভীমকে মহাকাব্যের নায়ক হতে দেয় না। বড় স্থূল আচরণগুলি তাঁর। অতিভোজন, পানাধিক্য, অতিক্রোধ, চূড়ান্ত প্রতিহিংসাপরায়নতা জাতীয় স্বভাবগুলি ভীমসেনের ভিতরকার সরল মানুষটাকে কেমন যেন মোটা দাগের একটি নৃশংস চরিত্রে রূপান্তরিত করে। ভীম, বলরামরা আসলে কৃষ্ণ বা অর্জুনের মার্জিত ক্ষাত্রশক্তির বিপরীতে দাঁড়িয়ে বড় crude, অপরিশীলিত। এঁদের সমগ্র অস্তিত্বগুলি বড় বেশি দৈহিক। শক্তিচর্চাই যেন এঁদের জীবনের মূলমন্ত্র, এবং সে শক্তিও ধনুর্বিদ্যার মতন সূক্ষ্ম সমরশিল্পে কিছুটা হলেও অপারগ। এবং সেই কারণেই এত জনপ্রিয় হওয়া সত্ত্বেও ভীম মহাভারতের পূর্ণপ্রতিম নায়ক হয়ে উঠতে পারেন না।

যিনি পারতেন, তিনি ভীমেরই সহোদর অগ্রজ, বহু মহাভারতপ্রেমীর বেদনায় চিরভাস্বর প্রথম কৌন্তেয় ভাগ্যহত কর্ণ। জন্মলগ্নে পরিত্যক্ত সহজাত কবচকুণ্ডলধারী ভগবান সূর্যের ঔরসে কুন্তীর কন্যাবস্থার গর্ভজাত এই মহাবীরের জন্য মহাকাব্যের নায়কের মঞ্চ যেন প্রস্তুতই ছিলো। তবু যে কর্ণ নায়ক হতে পারলেন না, তার মূলে তাঁর ক্ষত্রিয় জন্ম ও সূত সংস্কারের বৈষম্য। এই বৈষম্য তাঁর চরিত্রে এমন কতগুলি জটিলতার সৃষ্টি করেছিলো, যা তাঁর ঔদার্য ও বীরত্বের বিপরীতে তাঁকে এক দাম্ভিক, আত্মসর্বস্ব, অস্থিরস্বভাব মানুষে পরিণত করে। পালকপিতা সূত অধিরথ কিন্তু তাঁর শিক্ষা-প্রশিক্ষণে কোনও ত্রুটি রাখেন নি। সময় মতন তাঁকে পাঠানো হয়েছিলো হস্তিনাপুরে দ্রোণাচার্যের অস্ত্রপাঠশালায়। কিন্তু সেখানে দুর্যোধনের সাহচর্যে তিনি প্রথম থেকেই হয়ে উঠলেন পাণ্ডবদের প্রতি অকারণে বিমুখ। তার উপর যখন অর্জুন ধনুর্বিদ্যার কৃতিত্বে বাকিদের সঙ্গে সঙ্গে তাঁকেও পিছনে ফেলে এগিয়ে গেলেন, তখন কর্ণের মন তাঁর উপর ঈর্ষায় একেবারে বিষিয়ে উঠলো। সেই বিষের নিরসন তাঁর আর কোনওদিন হলো না। 

দুর্যোধন তাঁকে সব দিয়েছিলেন। বন্ধুত্ব, সম্মান, রাজত্ব, এবং সেই সঙ্গে অসূয়া। শুধুমাত্র দুর্যোধনের সন্তুষ্টিসাধনের জন্য কর্ণ নিরপরাধ পাণ্ডবদের বিরূদ্ধে তাঁর সব ক’টি ষড়যন্ত্রে অংশীদার। নিজের এবং দুর্যোধনের অহংকে তৃপ্ত করার জন্য সর্বক্ষণ তাঁর মুখে দম্ভ। এই দম্ভের কারণেই তিনি ভীষ্ম-দ্রোণাচার্যদের অপ্রিয়ভাজন। দুর্যোধনকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করতেন বলে এঁরাও কর্ণের বিরাগভাজন হয়ে উঠেছিলেন। সর্বসমক্ষে এঁদের অপমান করতেও কর্ণের বাধতো না, এবং দুর্যোধনও তাঁকে নিরন্তর প্রশ্রয় দিয়ে যেতেন। অথচ মোক্ষম প্রয়োজনের সময়ে কর্ণের যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ খুব বিরল ঘটনা ছিলো না। দ্বৈতবনে গন্ধর্বদের সঙ্গে সেই সংঘর্ষের সময় কর্ণ তাদের প্রহার সহ্য করতে না পেরে একসময়ে দুর্যোধনদের চরম বিপদের মুখে ফেলে পলায়ন করেছিলেন। বস্তুত, গোধন ব্যবস্থাপনার নাম করে দ্বৈতবনে গিয়ে নিজেদের সমৃদ্ধি প্রদর্শন করে বনবাসী নিঃসম্বল পাণ্ডবদের জ্বালাতন করার পুরো পরিকল্পনাটাই ছিলো কর্ণের মস্তিষ্কপ্রসূত। এই সংকীর্ণমনস্কতা যেন তাঁর মতন এক মহাবীরের পক্ষে একেবারেই বেমানান। 

যে দুর্যোধনের জন্য কর্ণের এত সম্মান ও সমৃদ্ধি, সেই দুর্যোধনেরই সব চাইতে বড় প্রয়োজনের সময়, অর্থাৎ কুরুক্ষেত্রের সমরাঙ্গনে, শুধুমাত্র নিজের অহং-এর কারণে কর্ণ প্রথম থেকে যুদ্ধ করেননি। ভীষ্মের সঙ্গে ego clash এ জড়িয়ে পড়ে কর্ণ তাঁর সৈনাপত্যে যুদ্ধ করতেই অস্বীকার করেন, এবং তার ফলস্বরূপ কৌরববাহিনী কখনোই পূর্ণশক্তিতে যুদ্ধ করার সুযোগ পায় না। বিরাটপর্বের শেষে অর্জুনের সঙ্গে দ্বৈরথেও কর্ণ বিপর্যস্ত হয়ে একাধিকবার পৃষ্ঠপ্রদর্শন করতে বাধ্য হয়েছিলেন; এবং কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধেও তিনি ভীমের মতন মধ্যমমানের ধনুর্ধরের কাছে বাণযুদ্ধে একবার হলেও পরাজিত হয়েছেন। যদিও এই ঘটনাগুলিতে কর্ণের বীরত্ব লাঘব হয়না। প্রমাণিত হয় তাঁর অস্থিরমতি, lack of concentration। তবু এই আচরণগুলি কোনওভাবেই নায়কোচিত নয়। তাই পাঠকের হৃদয়ে প্রভূত সমবেদনা উদ্রেক করা সত্ত্বেও বসুষেণ কর্ণ মহাভারতের অন্যতম প্রতিনায়ক মাত্রই থেকে যান।

তাহলে এই বিশাল মহাকাব্যের বহুতর উজ্জ্বল পুরুষের সমাবেশের মধ্যে থেকে নায়ক চয়ন করার পদ্ধতি কি? একটু বিশ্লেষণাত্মক দৃষ্টিতে দেখলে, মহাভারতের গভীরে সন্নিবেশিত যে তিনটি মানদণ্ড বা standard খুঁজে পাওয়া যায় শ্রেষ্ঠ পুরুষের নির্ণায়ক হিসেবে, সেগুলি হলো বীরশ্রেষ্ঠত্ব, জ্ঞানীশ্রেষ্ঠত্ব ও প্রেমিকশ্রেষ্ঠত্ব। এই মানদণ্ডগুলির নিরিখে দেখলে মহাভারতের প্রথম পুরুষশ্রেষ্ঠ ভীষ্ম। তাঁর অপরিমেয় বীরত্ব ও প্রজ্ঞার কথা আমরা ইতিপূর্বে আলোচনা করেছি। সে প্রসঙ্গে আর যাওয়ার প্রয়োজন নেই। আমরা ফিরে যাবো যেখান থেকে আমরা মহাভারতের প্রসঙ্গ আরম্ভ করেছিলাম, সেখানে। মহাভারতের যে দুটি অসাধারণ চরিত্র আবহমানকাল ধরে ভারতবর্ষের মানুষের মনের মনিকোঠায় ভাস্বর, সেই কৃষ্ণ ও অর্জুনের প্রসঙ্গে।

বাসুদেব কৃষ্ণ! প্রেমিকশ্রেষ্ঠ, অপরাজেয় যোদ্ধা, পরমদার্শনিক যোগী, অতুলনীয় কর্মবীর! তাঁকে কেন্দ্র করে ধর্ম, সংস্কৃতি, শিল্প, সাহিত্য, স্থাপত্য এবং আরও কত যে প্রতিষ্ঠান সারা বিশ্বে গড়ে উঠেছে, আজও উঠছে, তার সংখ্যা অপরিমেয়। বিশ্বের সব সাহিত্য, সব পুরান, সব মহাকাব্য তন্ন তন্ন করে খুঁজলেও সম্ভবত এমন সর্বাতিশায়ী দ্বিতীয় আরেকটি চরিত্র পাওয়া যাবে না। ভারতবর্ষের শিল্প-কলা-সংস্কৃতির কত বড় একটা অংশ যে এই এক পুরুষোত্তমের জীবন, কার্যকলাপ ও দর্শনের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে, তা ভাবলেও আশ্চর্য হতে হয়। মহাভারতের পরিপ্রেক্ষিতে কৃষ্ণই একমাত্র চরিত্র যিনি এই মহাকাব্যের সুবিশাল পরিসরকেও অতিক্রম করে আরও অনেক, অনেক বড় হয়ে মানব চেতনায় ছড়িয়ে পড়েছেন; একটা গোটা দেশ ও তার সংস্কৃতির প্রাণপুরুষ হয়ে দাঁড়িয়েছেন। দ্বৈপায়নের মহাকাব্যকে যদি ইতিহাস বলে স্বীকার করতে হয়, তাহলে এ কথাও স্বতঃসিদ্ধ হয়ে দাঁড়ায়, যে এমন বিরাট মাপের মানুষ পৃথিবীর আর কোনও দেশে আর কোনও সময়ে জন্মান নি। কৃষ্ণ সব রকমের মানবিক গুন, ক্ষমতা, বোধ ও ব্যাপ্তির শেষ কথা। কিন্তু সে সব কিছুর উর্দ্ধে মধুসূদন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এমন এক ঐশ্বরিক মহিমায় প্রতিষ্ঠিত, যে তিনি শুধুমাত্র অবতার নন। স্বয়ং পুরানপুরুষ শ্রীবিষ্ণুর সঙ্গে তিনি একাত্ম-একাকার। এবং সেই কারণেই কৃষ্ণ মহাভারতের নায়ক নন!

নায়ককে যে বিপন্ন হতে হয়! বঞ্চিত হতে হয়! ভাগ্যবিপর্যয়ের শিকার হতে হয়! না হলে শ্রোতা-পাঠকের মনে তাঁর জন্য সমবেদনা, সহানুভূতি আসবে কোথা থেকে? একটি চরিত্রের সঙ্গে পাঠক একাত্মবোধ না করলে সেই চরিত্রের নায়কত্ব সম্পূর্ণ হয় না। কিন্তু কৃষ্ণের মতন অতিমাত্রিক চরিত্রের সঙ্গে একাত্মবোধ করার অবকাশ কোথায় সাধারণ পাঠকের?

সে অবকাশ আছে কৃষ্ণেরই পরমমিত্র অর্জুনের চরিত্রে। অদ্বিতীয় যোদ্ধা, বহু নারীর হৃদয়হরণ অদ্ভূতকর্মা অর্জুন শৈশব থেকেই নায়কের মহিমায় চিহ্নিত। পরমধার্মিক ও মহাবল দুই সন্তান যুধিষ্ঠির ও ভীমের জন্মের পর পাণ্ডু ও কুন্তী তপস্যা করেছিলেন এক মহাপরাক্রমশালী বীরশ্রেষ্ঠ ইন্দ্রপ্রতিম পুত্রের। সেই তপস্যার ফল স্বয়ং দেবরাজের ঔরসে কুন্তীর গর্ভে অর্জুনের জন্ম। তাঁর জন্মলগ্নেই দৈববাণী হয়, এই শিশু সমগ্র পৃথিবীকে আপন বীরত্বে ও মহত্বে বশবর্তী করবে। সেই দৈবঘোষের সম্পূর্ণ মর্যাদা অর্জুন রেখেছিলেন।

অথচ শতশৃঙ্গ পর্বতে অতিবাহিত শৈশবকালে অর্জুন কিন্তু যুধিষ্ঠির বা ভীমের তুলনায় নিষ্প্রভ। মায়ের সঙ্গে হস্তিনাপুরে এসে পাণ্ডবরা খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বুঝতে পারেন যে তাঁরা তাঁদের জ্ঞাতি ধার্তরাষ্ট্রদের ঈর্ষা-অসূয়ায় বিপন্ন। কিন্তু সেই পরিস্থিতিতে শুধু সুযোগের অপেক্ষা ছাড়া তাঁদের আর বিশেষ কিছু করণীয় ছিলো না। এবং সে সুযোগ আসতেই সর্বাগ্রে যিনি তার সদ্ব্যবহার করেন, তিনি অর্জুন। দ্রোণাচার্যের অস্ত্রপাঠশালায় তিনি প্রথম দিন থেকে উজ্জ্বলতম ছাত্র। সংযম, মনোঃসংযোগ, অধ্যাবসায় ও বিরামহীন অভ্যাসের মাধ্যমে অর্জুন নিজের অস্ত্রক্ষমতাকে দিন দিন পরিশীলন করেছেন, এবং শেষ পর্যন্ত এমন একটি পর্যায়ে উন্নীত করেছেন, যেখানে দাঁড়িয়ে দেবাদিদেব মহাদেবকে পর্যন্ত স্বীকার করতে হয়, যে ন্যায়যুদ্ধে তিনিও অর্জুনকে পরাজিত করতে পারবেন না!

অর্জুনের অবিশ্বাস্য একক পরাক্রমে বিরাটপর্বের শেষে মৎস্যদেশের গোধন হরণ করতে গিয়ে পর্যুদস্ত হয়েছিলো ভীষ্ম‌-দ্রোণ-কৃপ-কর্ণ-অশ্বত্থামা-দুর্যোধন-দুঃশাসন সমন্বিত মহাশক্তিধর কৌরব বাহিনী। কুরুক্ষেত্রের রণাঙ্গনেও অর্জুনই একমাত্র যোদ্ধা, যিনি একটিও দ্বৈরথেও একবারের জন্যও পশ্চাৎপদ হননি, এবং যে সব অত্যাশ্চর্য কৃতিত্ব তিনি সে যুদ্ধে দেখিয়েছেন, তার সঙ্গে তুলনীয় আর কোনও কীর্তি পৃথিবীর কোনও মহাকাব্যে সম্ভবত নেই।

তবু, শুধুমাত্র বীরত্বের মানদণ্ডে অর্জুনের মতন চরিত্রের পূর্ণনায়কত্ব সম্পাদন হয় না। কারণ অর্জুন শুধু বীর নন। তিনি শিল্পী, প্রেমিক, ধীর, উদাত্ত, সংযত, সংবৃতমন্ত্র, মর্যাদাঋদ্ধ, এবং সর্বোপরি, তিনি সেই ঈশ্বরপ্রতিম মানুষটির নিকটতম বন্ধু ও আত্মীয়। 

আবার সেই সম্পর্ক! ভগবানের সঙ্গে ভক্তের। রামায়ণে এ সম্পর্ক একমাত্রিক। শুধুমাত্র ভক্তি-আনুগত্যের। দ্বৈপায়নের অমর কাব্যে এ সম্পর্কের বৈচিত্র বড় মধুর, বড় চিত্তগ্রাহী। পিসতুত ভাই পাণ্ডবদের সঙ্গে কৃষ্ণ-বলরামের প্রথম পরিচয় দ্রৌপদীর স্বয়ংবরসভার পর। ইতিপূর্বে কোনওদিন না দেখলেও স্বয়ংবরসভায় ছদ্মবেশে উপস্থিত পাণ্ডবদের নিজের প্রখর বুদ্ধি ও পর্যবেক্ষণ ক্ষমতায় ঠিক চিনে নিয়েছিলেন কৃষ্ণ, এবং সঙ্গোপনে তাঁদের অনুসরণ করে খুঁজে নিয়ছিলেন কুম্ভকারগৃহে তাঁদের অস্থায়ী আবাস। সেই যে হৃদয়তন্তু জুড়লো, সে বন্ধন আজীবন সযত্নে রক্ষা করে গেছেন দুই যুগপুরুষ কৃষ্ণ ও অর্জুন। বিশেষত এ ব্যাপারে কৃষ্ণের প্রয়াস লক্ষণীয়।

আসলে কৃষ্ণ বুঝতে পেরেছিলেন যে ভাইদের সঙ্গে থাকা সত্ত্বেও অর্জুন কতখানি একা! মহাবীর হওয়া সত্ত্বেও কত অসহায়! স্বয়ংবরসভায় বীর্যশুল্কে অগ্নিসম্ভবা দ্রৌপদী কৃষ্ণাকে লাভ করলেন অর্জুন। কিন্তু তাঁকে সম্পূর্ণ নিজের করে তাঁর আর কখনোই পাওয়া হলো না। সন্তুষ্ট থাকতে হলো তাঁর একপঞ্চমাংশে। বস্তুত, নারদের দেওয়া বিধান অনুযায়ী এক এক বৎসর একেক ভাইয়ের ঘরণী থাকার যে নিয়ম দ্রৌপদীর জন্য ধার্য হয়েছিলো, সেই নিয়মে তাঁকে নিজের অংকে পাওয়ার আগেই ঘটে গেলো অর্জুনের জীবনে চরম বিভ্রাট। ব্রাহ্মণের যজ্ঞকাষ্ঠ উদ্ধারের জন্য অস্ত্রাগারে প্রবেশ করে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় যুধিষ্ঠির-দ্রৌপদীকে দেখে ফেলার অপরাধে বারো বৎসর নির্বাসনের শাস্তি নেমে এলো তাঁর মাথার উপর। বিব্রত যুধিষ্ঠির, স্নেহময় যুধিষ্ঠির অনেক চেষ্টা করলেন নির্দোষ অনুজকে নিবৃত্ত করার। কিন্তু সত্যপালনের অজুহাতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন অভিমানী অর্জুন।

বড় সূক্ষ্ম, বড় নৈর্ব্যক্তিক তাঁর অভিমান। ভাগ্য ছাড়া আর কাউকে দায়ীও করার নেই পরিস্থিতির জন্য। ভবঘুরের মতন ঘুরে ঘুরেই কেটে গেলো তাঁর যৌবন। স্থিত হয়ে বসা আর হলো না কোথাও। শৈশব কেটেছিলো শতশৃঙ্গ পর্বতের অরণ্যময় পরিবেশে। সেখান থেকে মা-ভাইয়েদের হাত ধরে পিতৃরাজ্যে এসে আশ্রিতের পরবাস। তারপর যতুগৃহ থেকে বেঁচে পালিয়ে ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে ভিক্ষাবৃত্তি। অবশেষে আপন কৃতিত্বে দ্রৌপদীকে জয় করা, এবং সেই সূত্রে পাঞ্চালরাজ দ্রুপদ ও যদুকুলচূড়ামনি কৃষ্ণের নৈকট্য, বন্ধুত্ব ও রাজনৈতিক সমর্থনলাভ। কিন্তু সে সাফল্যের স্বাদটুকু ঠিক করে উপভোগ করার আগেই আবার এই বিপর্যয়! কীই বা করতে পারেন অর্জুন তাঁর চিরসাথী ধনুর্বান সঙ্গী করে আবার বেরিয়ে পড়া ছাড়া?

ক্রমাগত ভ্রাম্যমান! ব্যাসের বর্ণনায় তৃতীয় পাণ্ডব। দিগ্বিজয়ী বীর চলেছেন উদ্দেশ্যহীন ঔদাসীন্যে! পথে নাগকন্যা উলূপী ও মনিপুরনৃপদুহিতা চিত্রাঙ্গদার সরস অথচ স্বল্পকালীন সান্নিধ্য। তারপর আবার পথ। বোধহয় নিজের অজান্তেই অর্জুন উপস্থিত হলেন প্রভাস তীর্থে। হয়তো তাঁর বিষন্ন অবচেতন চাইছিলো কোনও সমমনস্ক মানুষের নৈকট্য। তাই তিনি চলে এলেন সেই স্থানে, যেখান থেকে কৃষ্ণের দ্বারকাপুরী অতি নিকটে। দেখা হলো দুই বন্ধুর। কৃষ্ণ যেন তাঁর স্নেহ-ভালোবাসা‌-সহানুভূতির উৎসমুখ খুলে দিলেন চিরভক্ত প্রিয়সখার জন্য। অর্জুনের বিষন্নতা অপনোদন হলো। তারপর যখন তিনি মুগ্ধ হলেন অনবদ্যাঙ্গী সুভদ্রাকে দেখে, কৃষ্ণ বুঝলেন অর্জুনের বুভুক্ষু হৃদয় চাইছে কাউকে নিজের, শুধু নিজের করে পেতে। দ্রৌপদীকে পেয়েও পাননি অর্জুন। উলূপীকে তিনি চাননি। উলূপীই চেয়েছিলেন তাঁকে। চিত্রাঙ্গদাকে চেয়েছিলেন অর্জুন। পেয়েওছিলেন। কিন্তু সে প্রাপ্তি ছিলো শর্তসাপেক্ষ। চিত্রাঙ্গদাকে কোনওদিন নিজের দেশে নিয়ে যেতে পারবেন না অর্জুন। তাঁর পুত্রকে দিতে পারবেন না নিজের ভারতবংশীয় উত্তরাধিকার। তাই তাঁর প্রেমিক হৃদয় আকুল হয়ে ছিলো কাউকে সর্বাংশে পেতে, নিজেকে উজাড় করে দিতে। কৃষ্ণ সে কথা বুঝলেন, এবং অর্জুনকে পরামর্শ দিলেন সুভদ্রাকে বাহুবলে হরণ করে নিয়ে যেতে। নিজে দায়িত্ব নিলেন যাদবগোষ্ঠীকে বোঝাবার, এবং সতর্ক করে দিলেন, যদি যাদবরা শেষ অবধি না বোঝেন, তাহলে তাঁরা অর্জুনের পশ্চাদ্ধাবন করবেন, এবং তাঁদের সঙ্গে আসবেন কৃতবর্মা, সাত্যকি, বলরামের মতন ভয়ংকর যোদ্ধাদের সঙ্গে কৃষ্ণ স্বয়ং!

কৃষ্ণের এই সতর্কীকরণে অর্জুনের অসাধারণ প্রতিক্রিয়া তাঁকে মহাভারতের বাকি সব চরিত্রের থেকে আলাদা করে দেয়। একটু হেসে অর্জুন কৃষ্ণকে বলেছিলেন, ‘‘এসো। দেখা যাবে। শুধু মনে রেখো, আমি অর্জুন।’’

যাদবসেনার সাংঘাতিক পরাক্রম সে যুগে সর্বজনবিদিত ছিলো। বিশেষ করে সেই বাহিনীতে যদি কৃষ্ণ-বলরাম সামিল থাকেন, তবে তাঁদের জয় করার কথা কেউ ভাবতেই পারতো না। এবং সেইখানেই অর্জুন অর্জুন। সব ধনুর্ধরের সেরা ধনুর্ধর অদ্বিতীয় সব্যসাচী! তিনি সুভদ্রাকে নিয়ে চলে যাওয়ার পর কৃষ্ণ যখন যুক্তি দিয়েও যাদবদের সবাইকে, বিশেষত বলরামকে বোঝাতে পারছিলেন না, তখন তিনি শেষ পর্যন্ত তাঁদের নিরস্ত করেন এই বলে, যে অর্জুনের পশ্চাদ্ধাবন করা যেতেই পারে; কিন্তু যদি একাকী তাঁর কাছে পরাজিত হয়ে ফিরতে হয় রণদুর্মদ যাদববাহিনীকে, তাদের গর্ব, অভিমান, অপরাজেয়তার খ্যাতি, সব ভূলুন্ঠিত হবে। তাঁর এই কথায় কাজ হয়েছিলো। এবং তা শুধুমাত্র অন্তঃসারহীন সাবধানবাণী ছিলো না। অর্জুনকে সব থেকে ভালো কৃষ্ণই চিনতেন, এবং জানতেন যেখানে তাঁর বীরত্বের মর্যাদার প্রশ্ন, সেখানে তাঁকে পরাভূত করা অসম্ভব।

এইখানেই অর্জুনের বৈশিষ্ট। যুদ্ধক্ষেত্রে বিপক্ষে আত্মীয়-স্বজন-বন্ধুদের দেখে তিনি নির্বিন্ন হয়ে ওঠেন, কান্নায় ভেঙে পড়েন, যা যুধিষ্ঠিরের মতন মমতাময় মানুষও পড়েন না। আবার যখন সম্মানের প্রশ্ন, তখন তাঁকে জয় করা স্বয়ং ভগবানেরও অসাধ্য। ত্রিভুবনের শ্রেষ্ঠ বীর হয়েও নপুংসকের ছদ্মবেশে রাজকুমারীদের নাচগান শেখাতে তিনি এতটুকু কুন্ঠিত হন না। বরং নিজের শিল্পীসত্ত্বার সেই বিকাশের সুযোগে আনন্দিত হয়ে ওঠেন। আবার সেই অর্জুনই গাণ্ডীবের অপমানে ক্রোধে প্রজ্জ্বলিত হয়ে যুধিষ্ঠিরকেও চরম শাস্তি দিতে উদ্যত হন!

অর্জুনের চরিত্রের আরও অনেকগুলি দিক বা dimension আছে। কিন্তু অত বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ এখানে নেই। প্রয়োজনও নেই। আমাদের যা মূল উদ্দেশ্য, অর্থাৎ মহাকাব্যের নায়ক নির্ণয়ন, তা আপাতত সিদ্ধ হয়েছে। মহাভারতের জটিল ও অন্তহীন পৌরুষেয়তার বিস্তৃতির মধ্যে সম্ভবত সর্বাধিক মানবিক ও নায়কোচিত গুণসম্পন্ন চরিত্র গাণ্ডীবধন্বা তৃতীয় পাণ্ডব ঐন্দ্রেয় অর্জুন। তাই তিনি মহাভারত সূত্রধার মহাকারুণিক ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পরম মিত্র, এবং এই পৃথিবীর সমস্ত যোগ, সব দর্শনের যা সারাৎসার, স্বয়ং ভগবানের মুখনিঃসৃত অমৃতবাণী সেই ভাগবদ্গীতার তিনি এক এবং অদ্বিতীয় শ্রোতা।

3 comments:

0

প্রবন্ধ : মকসুদা হালিম

Posted in




প্রবন্ধ



ছোটগল্পকার রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি ও সৃষ্টির ক্রমবিকাশের স্বরূপ 
মকসুদা হালিম



বাংলা সাহিত্যে সার্থক ছোট গল্পের স্রষ্টা হিসেবে রবীন্দ্রনাথকে শ্রেষ্ঠ শিল্পীর আসন দেওয়া হয়। তাঁর উপন্যাসের জনপ্রিয়তা যেমনই হোক না কেন - ছোট গল্পের ক্ষেত্রে তিনি বিশ্বের যে কোন শ্রেষ্ঠ গল্প লেখকের সমকক্ষ।

তাঁর প্রথম গল্প 'ভিখারিনী' মাত্র ষোল বছর বয়সে লেখা। এরপর লিখলেন, 'ঘাটের কথা', 'মুকুট' ইত্যাদি। এ পর্যন্ত তাঁর ছোট গল্প লেখার প্রস্তুতিপর্ব বলা চলে। এরপর ১২৯৮ বঙ্গাব্দে যখন তিনি আবার নতুন করে ছোটগল্প লিখতে লাগলেন - বাংলা সাহিত্যের ছোটগল্পের শুরু হল, তখন থেকেই।

এই সময়ে রবীন্দ্রনাথকে জমিদারী দেখাশোনার কাজে বাংলার গ্রামাঞ্চলে আসতে হয়েছিল। এটা তাঁর জীবনে এমন একটা ঘটনা - যা তাঁকে ছোটোগল্প রচনায় উদ্বুদ্ধ করেছিল।

পদ্মাতীরে জমিদারী দেখাশোনা করার অবকাশে তিনি বাংলার গ্রামীণ জীবন বিপুল ভাবে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। পল্লীর জীবনযাপন, মামলা-মকদ্দমা, ত্যাগ-ভোগ, নীচতা-স্বার্থপরতা - আবার অনাবিল স্নেহ-ভালবাসা, রবীন্দ্র নাথের সঙ্গী-বিহীন নির্জন মুহূর্তগুলোতে যে ভাবে প্রতিফলিত হয়েছিল - তাদের প্রত্যেকটি একে অপরের সাথে সম্পর্কযুক্ত হয়ে এক একটি কাহিনীর উপাদান রূপে সুন্দর ভাবে রূপ লাভ করেছ। গল্পগুলি শিল্পলক্ষণ হিসেবে যেমন উৎকৃষ্ট তেমনি বাঙালী গ্রামীণ জীবনের চিত্র হিসেবেও এগুলির মূল্য অসাধারণ! 

রবীন্দ্র ছোটগল্পের গঠনরীতি সম্পর্কে বলতে গেলে আমাদের মনে রাখতে হবে যে, তিনিই প্রথম ছোটগল্পের গঠন বাংলায় আনেন। তাঁর এক শ্রেণীর কাহিনী - ঘটনা বিরল, চরিত্র বিরল, অনুভূতি বা আবেগ প্রধান। যেমন, ক্ষুধিত পাষাণ, পোস্ট মাস্টার – ইত্যাদি। অন্য শ্রেণী চরিত্র প্রধান। কোন বিশেষ চরিত্র বা চরিত্রের কোন অজ্ঞাতপূর্ব আভাসমাত্র, এই ধরণের গল্পগুলিকে উপভোগ্য করেছে। যেমন, ‘কাবুলিওয়ালা’ ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’ ইত্যাদি। আবার দেখা যায় তাঁর এক ধরণের গল্প পরিকল্পনা প্রধান। এখানে সবকিছু বিস্ময় বা রহস্য জমা থাকে কাহিনীর শেষে। যেমন- সমস্যা পূরণ, বিচারক, ইত্যাদি। আর এক ধরণের গল্প নিতান্তই কাহিনী এবং তার সাথে কিছু সমস্যাও জড়িত থাকে। যেমন- ‘ঠাকুর দাদা’, ‘দালিয়া’ ইত্যাদি।

গল্পগুলো অত্যন্ত সহজ সরলভাবে বিবৃত হলেও রবীন্দ্র ছোটগল্পের যে বৈশিস্ট্য, পরিমিতবোধ এবং কৌতুকরস—তা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত অব্যহতগতিতে গল্পগুলির মধ্যে বিদ্যমান। তাঁর গল্পের একটি বাক্যও অকারণে বা অপ্রয়োজনে ব্যয় হয়নি। আর তাঁর কৌতুক রসও পেটে খিল ধরানো হাসি নয়, গল্পগুলি পড়তে পড়তে স্মিত হাস্যের প্রসন্নতায় মনটি পরিপূর্ণ হয়ে যায়।

এরপর আসে আঙ্গিকের প্রশ্ন। রবীন্দ্রনাথ গল্প রচনায় কতকগুলি আঙ্গিক অবলম্বন করেছেন। যেমন—

(১) কাহিনীটি তিনি বর্ণনা করেছেন।
(২) কাহিনীটি আরম্ভ করেছেন লেখক-পরে গল্পের নায়ক উত্তম পুরুষে গল্পটি বলে গেছেন। যেমন- নিশিথে।
(৩) পুরো কাহিনীটিই উত্তম পুরুষে বলা। যেমন - অধ্যাপক।
(৪) কাহিনীটি চিঠির আকারে লেখা। যেমন - স্ত্রীর পত্র।
(৫) গল্পের কিছুটা বর্ণনা, কিছুটা চিঠি, যেমন- দর্পহরণ।
(৬) কাহিনীটি নাট্যাকারে বর্ণিত। যেমন - কর্মফল।
(৭) কাহিনীটি রূপকথা বা রূপকথাচ্ছলে লেখা। যেমন - একটি আষাঢ়ে গল্প। ইত্যাদি।

রবীন্দ্রনাথের ছোটোগল্প গুলিকে “গল্পগুচ্ছের” চারখণ্ডে মুদ্রিত করা হয়েছে। রবীন্দ্র ছোটোগল্প সৃষ্টির ক্রমবিকাশের ধারা অনুসরণ করলে দেখা যায়- তিনি যতই অগ্রসর হয়ে গেছেন, গল্পগুলিও ততই অনাড়ম্বর রূপ পালটে ফেলে পরীক্ষানিরীক্ষা মূলক নানান কারুকার্যমণ্ডিত হয়ে ঝকঝকে রূপ নিয়েছে।

প্রথমখণ্ডের গল্পগুলি গ্রামভিত্তিক। গ্রামের সহজ-সরল মানুষের প্রতিচ্ছবি। কিন্তু প্রমথনাথ বিশীর মতে ‘রবীন্দ্রনাথ গ্রামবাংলার কড়া নেড়েছেন মাত্র, ভিতরে প্রবেশ করেন নি।‘ একারণেই হয়তো প্রথমখণ্ডের গল্পগুলিতে কল্পনা, হৃদয়াবেগ ও প্রকৃতির অপ্রতুল ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। দেখা আর না দেখা জগতের মধ্যে, কল্পনা সেতুবন্ধ রচনা করে দিয়েছে। ফলে গল্পগুলি কাব্যিক মাধুর্যমণ্ডিত হয়ে প্রকাশ পেয়েছে। প্রকৃতি এখানে ব্যক্তির সাথে একাত্ম হয়ে গিয়েছে। তিনি চোখ দিয়ে বিশ্বপ্রকৃতিকে অবলোকন করেছিলেন এবং মন দিয়ে অনুভব করে জড় প্রকৃতির মধ্যেও মানবিক গুণ আবিষ্কার করেছেন। যেমন- ‘পোস্টমাস্টারের’ একাকী-নিঃসঙ্গ জীবনের আর্তি প্রকাশ পেয়েছে-বর্ষণক্লান্ত প্রকৃতির সাথে।

কিন্তু দ্বিতীয় খণ্ডের গল্প গুলির স্বরূপ ভিন্ন স্রোতে প্রবাহিত। গল্প গুলি অধিকাংশ শহর কেন্দ্রিক হওয়ায় তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা পুষ্ট হয়ে বিশ্লেষণমুখী রূপ নিয়েছে। অধিকাংশ গল্পে দেশকালের ঘটনা বিবৃত হয়েছে, মনস্তাত্তিক বিশ্লেষণ করা হয়েছে। দ্বিতীয় খণ্ডে হৃদয়াবেগ প্রশমিত, বিবৃতির প্রাধান্য। প্রত্যেকটি চরিত্রের কার্যাবলী- কার্যকারণ সহ ব্যাখ্যাত। এই প্রেক্ষিতে দ্বিতীয় খণ্ডের গল্পগুলিকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়।

সমাজ, পরিবার, রাজনীতি, দেশ কাল সচেতন গল্পঃ

গল্প গুলিতে ঊনবিংশ শতাব্দীর জটিল সমাজ চিত্র, অত্যাধুনিক ব্যক্তিমনের বিকৃতি, রাজনীতির ক্ষেত্রে বাঙালির স্থান ইত্যাদির সাথে সাথে দেখা দিয়েছে ব্যক্তিত্বসম্পন্না নারী চরিত্রের প্রাধান্য। উদাহরণ স্বরূপ উল্লেখ করা যায়- মেঘ ও রৌদ্র, মান ভঞ্জন, বিচারক, উদ্ধার, ইত্যাদি গল্পগুলি।

এ খণ্ডে রবীন্দ্রনাথ ভাষারীতি ও বাক্য-গঠনভঙ্গি নিয়ে পরীক্ষা করেছেন। 'বিচারকের' আগে পর্যন্ত গল্পে দেশজ ভাষা, তৎসম শব্দ এবং বাক্যের মধ্যে পেলবতা রক্ষা করে আসছিলেন, কিন্তু 'বিচারক' থেকে তাঁর ভাষারীতির রূপ পালটে যায়। সমাসবদ্ধ পদের আধিক্য এবং কথ্য ভাষাতেও দীর্ঘ শ্বাসযুক্ত সাধু ভঙ্গি নিয়ে আসেন। আবার ছোটছোট বাক্যদ্বারা সাধু ভাষাতেও কথ্যভঙ্গি দেখা যায়। যেমনঃ ডিটেকটিভ। প্রকৃতি এসেছে উপমা, রূপক, প্রতীক ইত্যাদির মাধ্যমে ব্যক্তির মানসিকতাকে সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করতে।

তৃতীয় ও চতুর্থ খন্ডে পরিণতমনস্ক গল্পকার –গল্প বলার চেয়ে সেগুলো নিয়ে নানান রকম পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়েছেন। ফলে গল্পগুলি কারুময় রূপ নিয়েছে। তাছাড়া ‘সবুজপত্রের’যুগে লিখিত এসব গল্পে নবযুগের সুস্পষ্ট ছাপ লক্ষিত হয়। নারী চরিত্র এখানে ব্যক্তি-স্বতন্ত্রে সমুজ্জ্বল! সে মাতা নয়, জায়া নয়, প্রিয়াও নয় –সে নারী ! ‘হালদার গোষ্ঠী’, ‘স্ত্রীর পত্র’ ইত্যাদি এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য। এ ছাড়া কতকগুলো গল্প, রূপক ধর্মী। যেমন, ‘গুপ্তধন’।

রবীন্দ্রনাথ এখানে ভাষারীতি, আঙ্গিক ইত্যাদি পরিবর্তন করেছেন। এবং ব্যকরণ ঘটিত কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষাও চালিয়েছেন। যেমন বাক্যগুলি ছোট হয়ে এসেছে, কাহিনী বর্ণনায় রূপকথার ভঙ্গী চলে এসেছে। এখানেই তিনি প্রথম চলিত গদ্যের ব্যবহার করেছেন। উপমা প্রয়োগে ব্যক্তিত্বের আরোপ এসেছে। ক্রিয়ার স্থান পরিবর্তনও উল্লেখযোগ্য। যেমন, ‘উঠিল রেগে’, ‘রেগে উঠিল’ নয়। (ক্রিয়াকে আগে নিয়ে আসা)। এগুলো রবীন্দ্রনাথের বিশেষ বৈশিষ্ট্য।

উপমা-অলংকারে রবীন্দ্রনাথের কিছু নিজস্ব সৃষ্টি রয়েছে। যেমন, ‘অনেক বোঝাই গরুর গাড়ির মতোই রামকানাইয়ের নিরুপায় অবস্থা’। অথবা ‘এ নির্বোধ সর্বকান্ডপন্ডকারী নবদ্বীপের বাবা’ ইত্যাদি—বাংলা সাহিত্যে অনবদ্য ও অসাধারণ সংযোজন !

রবীন্দ্র ছোটগল্পের এ সব অসাধারণত্বই একে বাঙালির স্থান-কাল-ঘেরা গন্ডিকে অতিক্রম করে বিশ্বের এবং চিরকালের মানুষের অন্তরের সম্পদ করে দিয়েছে !

0 comments:

2

প্রবন্ধ : ইন্দ্রাণী ঘোষ

Posted in



প্রবন্ধ 


নারী স্বাধীনতা - এক খোঁজ 
ইন্দ্রাণী ঘোষ 



বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ সময়, কল কারখানার শ্রমিক যুদ্ধে গেল, মেশিন চলে না। হাল ধরলেন বিরাঙ্গনারা । সেই শুরু আর্থিক প্রয়োজনে বাইরে বেরনো । ছেলে ভুলানো ছড়া, ঘুম পাড়ানী গান, হেঁশেলের বাইরে এসে কল কারখানার জগতে পদার্পণ । অনেকে বলেন সেই আমাদের মেয়েদের ত্রিশঙ্কু দশা শুরু। তবে ভাবার বিষয় হল ভাল হল না, মন্দ হল ?

স্বাধীনতা আসলে কি? “ স্বাধীনতা কি খায় না মাখে?, স্বাধীনতা কি কেষ্ট না রাধে?” এই কথা বুঝতে ও যুঝতে পেরিয়ে গেল কত দশক । 

ষাটের এবং সত্তর এর দশকে নারী স্বাধীনতার প্রথম বিকাশ। এই আন্দোলনের কিছু বিশেষ দিক ছিল। প্রথমত, স্লোগান দেয়া হল ‘ব্যাক্তিগতই রাজনৈতিক’-অর্থাৎ মেয়েদের ভয়াবহ সামাজিক অবস্থার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক মিটিং মিছিল করা। শুধুমাত্র সরকারের উত্থান পতন নয়,পরিবারতন্ত্রের ভিতরে শাসক পুরুষ ও শাসিত মহিলাদের সম্পর্কের খতিয়ানও বটে। মেয়েদের বিবাহিত জীবনের কর্তব্য ও সন্তানধারণ সম্পর্কে তাঁদের মতামত । আরও পরে গর্ভনিরোধক বড়ির আবিষ্কার তাদের হাতে সন্তান ধারণ সংক্রান্ত সিদ্ধান্তের ভিত্তি মজবুত করে দিল। সন্তান ধারণ একজন নারী করবে বা করবে না, এ বিষয়ে তাঁর মতামত প্রথম গুরুত্ব পাওয়ার অবকাশ পেল। 

দ্বিতীয়ত, হল ‘প্র ওমান লাইন’ অর্থাৎ এই ধারণা যে মহিলাদের ভয়াবহ অবস্থার জন্য তারা নিজেরা দায়ী নয়। পুরুষ শাসিত সমাজ যে ভাবে নারীকে দেখতে চায় সে ভাবেই সে নিজেকে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখে। মেকআপ না নেওয়া যেমন ফেমিমিনিস্ট আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক ছিল । তাঁরা মনে করতেন, পুরুষের চোখে সুন্দর হয়ে তারা নিজেদের শোষণের পথ নিজেরাই প্রশস্ত করছেন । অতএব মেক আপ বর্জন করা হোক। অবশ্য এখন এ ধারণা বদলেছে, মেয়েরা সাজেন অনেক সময় নিজের চোখে সুন্দর লাগতে, নিজের নান্দনিক বোধ চরিতার্থ করতে। এটাও অনেকক্ষেত্রে ঠিক যে মেক আপ পরিহিতা মহিলারা কর্মক্ষেত্রে অনেক সময়তেই বেশি উন্নতি করেন ।

কেন তা বলার দরকার নেই, সব পাঠক এখানে প্রাপ্তবয়স্ক। মিনি স্কার্ট, স্কিন টাইট ফিগার হাগিং টপ বা চোলি কাট ব্লাউজ অনেকেই পড়ে থাকেন, তাঁরা মনে করেন ফ্যাশন জীবনের অঙ্গ তিনি এবং তাঁরা যদি নিজেকে সেই পোশাকে ‘ক্যারি’ করতে পারেন, তবে করবেন নাই বা কেন ? আর শরীর দেখতে পেলেই পুরুষ নেকড়ের দলের ঝাঁপিয়ে পড়ার অধিকার আছে, তাতো নয়। 

তৃতীয়ত ফেমিনিসট বা নারী স্বাধীনতা আন্দোলনকারীরা বললেন,

মহিলাদের পরস্পরের মধ্যে এক বন্ধনের কথা, যা জৈবিক বন্ধনের অনেক উপরে। মেয়েরা নিজেদের মধ্যে এক বন্ধন সৃষ্টি করবেন এবং বজায় রাখবেন যা নারী পুরুষ বন্ধনের চেয়ে আলাদা । নারী স্বাধীনতা আন্দোলনের আরও দুটি দাবী ছিল, যা দুনিয়া অবাক চোখে দেখেছিল । এক, মহিলাদের ভোটের অধিকার ও অপরটি ছিল নারী পুরুষ নির্বিশেষে একই পারিশ্রমিক পাবার অধিকার। এখন অবশ্য এ অবস্থা বদলেছে । বর্তমানে দেখি তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের মর্যাদা পাওয়ার লড়াই । এ আন্দোলনও অনেক দূর এগিয়েছে । মানুষ মানুষের মর্যাদা পাবে, যে কোন আন্দোলনেরই এটাই শেষ কথা; তা সে মানুষ নারী হোক বা ট্রান্স জেন্ডার বা তৃতীয় লিঙ্গই হোক । 

গর্ভপাতের অধিকার নিয়েও নারীবাদীরা আন্দোলন করেছেন। গর্ভপাতের অধিকার শুধুমাত্র উচ্চবিত্ত নয়, নিম্নবিত্তেরও থাকা উচিত এ বিষয় দাবি উঠেছে। তবে খ্রিস্টান ধর্মে গর্ভপাতকে অধর্ম মনে করা হয় এখনও । এখন অবশ্য গর্ভধারণ ও অযাচিত গর্ভের সম্ভবনা কে মহিলারা নিজেরাই শেষ করতে পারেন । নারী মুক্তি আন্দোলনের এ এক বিশাল জয় । 

এরপর আসা যায় ‘কন্সেপচুয়াল আর্ট’ এর প্রসঙ্গে এখানে বলা হয় যে রান্নাঘরের সামগ্রীর দিয়েও মেয়েরা তাদের নান্দনিক তৃষ্ণা মেটাতে পারেন । আমেরিকাতে যখন নারীবাদী আন্দোলন চলছে তখন অন্তরজালের যুগ নয়, অথচ দেখি সেই কবে থেকে মেদিনীপুরের মেয়ে বউরা হয়ত বা নিজেদের অজান্তে নিজেদের নান্দনিক তৃষ্ণা মেটাতে অতি সুক্ষ কাজের গয়না বড়ি তৈরি করছেন। ও দিকে পশ্চিমী মেয়েরা বলছে - কনন্সেপচুয়াল আর্টের কথা । কি অদ্ভুত যোগাযোগ, দৈব যোগাযোগই বোধহয় হবে । 

ঘর সামলানর চেয়ে বড় কাজ মেয়েদের আর কিছু ছিল না এক সময়, কিন্তু যে মুহূর্তে তাঁরা সংসারের গণ্ডীর বাইরে এসে পা রাখলেন সেই তখনি শুরু হল সামঞ্জস্য বজায় রাখার সমস্যা । তা এই সামঞ্জস্য বজায় রাখার খেলাটি বেশ কঠিন । একটা দড়ির উপর দিয়ে হাঁটছে মহিলারা, একটু এদিক ওদিক হলেই পতন অনিবার্য । হচ্ছেও তাই সংসার ভাঙছে, পরের প্রজন্ম কষ্ট পাচ্ছে আবার সম্পর্কের নতুন সংজ্ঞাও তৈরি হচ্ছে । 

সম্পর্কের কথা বলতে গেলে শাশুড়িমাতা ও পুত্রবধূর সম্পর্কের কথা এসেই যায়। পুত্রবধূ কেরিয়ার করবেন, শাশুড়ি মা ঘর সামলাবেন - এ বড় অস্বস্তির কথা যেন । পুত্রবধু কে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা দেয়া হয়েছে, তার চাকরীতে যাওয়ার কি দরকার? ‘সখের চাকরি - ও যেতে হবে না’। তা চাকরি যে শুধু সখ মেটানর জন্যই নয়, এ যে অস্তিত্বের খোঁজ, তা বোঝেন না তাঁরা । অর্থনৈতিক স্বাধীনতা একটি মেয়ের সমাজে দাঁড়ানোর জায়গা বদলে দেয় । চাকরী করা বা না করা সবটাই একটি মেয়ের ব্যাক্তিগত সিদ্ধান্ত, তাতে যে অন্য কারুর কথা বলাটা অনুচিত, এ কথা ভারতীয় শ্বশ্রূমাতার হৃদয়ঙ্গম হয় নি এখনও, অনেক ক্ষেত্রে । তার কারণ, মননের অভাব। (উদারমনা শাশুড়ি মা এমন ভাবেন না) । নিজে করতে পারেন নি, অন্য মেয়েটি বা কেন করবে? তার চেয়ে “চল নিয়ম মতে”। 

তাসের দেশের বাঁধ কিন্তু এখন ভাঙছে । প্রথম দেখি সত্যজিত রায়ের মহানগর ছবিতে, যেখানে শাশুড়ি মা ভাত বেড়ে দিচ্ছেন ছেলে বউমা দুজনকেই অফিস যাওয়ার আগে । এ ছবি জন মানসে হৈ চই ফেলে দিয়েছিল বলেই শুনেছি । আবার হালফিলের ছবি অপর্ণা সেন নির্দেশিত ‘পারমিতার একদিন” এ দেখি বউমা শাশুড়ির এক সখীত্বের সম্পর্ক, যা বজায় থাকে বউমার বিবাহ বিচ্ছেদ এবং দ্বিতীয় বিবাহের পরেও। এই হল নারীত্ব বন্ধনের নতুন সংজ্ঞা । ঋতুপর্ণ ঘোষের ছবি আবহমানে দেখি পুত্রবধূ চোস্ত ইংরেজিতে শাশুড়ি মায়ের বিরুদ্ধে কথা বলেন এবং সেটা মেনে নেয়ার দরাজ দিল দেখান শাশুড়ি মা আভিজাত্যের সঙ্গে । সম্পর্ক যে শুধু ক্ষমতা প্রদর্শন নয়, সম্পর্ক দুটি প্রাণের হয় তা সে দুজন পুরুষই হন বা নারী হন এ কথা যেদিন সকলে বুঝবেন, সেদিন লিঙ্গ বৈষম্য, নারী নির্যাতণ, কন্যা ভ্রুণ হত্যার বীভৎসতা মুছে যাবে। এক নতুন পৃথিবী হবে যেখানে একমাত্র মন্ত্র হবে ভালবাসার মন্ত্র । রাজস্থান, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশের মানুষও মেয়েদের সম্মান দেবে । “সে দিন আর কত দূরে” ?

2 comments:

0

বিশেষ রচনা : সীমা ব্যানার্জী-রায়

Posted in





বিশেষ রচনা



কে আনকালচার্ড?
সীমা ব্যানার্জী-রায়



লুজিয়ানা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পড়বার সময় মাঝে মাঝেই একা হয়ে পড়তাম নতুন পরিচিত বন্ধুদের কাছ থেকে। এইরকম একদিন কলেজ ক্যাফেটেরিয়ার কোণার সীটে বসে আছি। আয়েস করে সবে মাত্র কফির কাপটাতে প্রথম চুমুকটা দিয়েছি। শুনতে পেলাম দুই মিষ্টি নারী -কণ্ঠ। কারণ আমার কণ্ঠ সব সময় আমার কাছে হাঁড়িচাঁচা পাখীর মতন লাগে। তাই কানটা খাড়া করলাম, কারণ তাঁরা ছিলেন সত্যিকারের বাঙ্গালী। যদিও আমি বাঙ্গালী পুরোপুরি হতে পারি নি আজও-এটাই আমার সবচেয়ে দুঃখ।

প্রথমজন বেশ উত্তেজিত, কারণ তিনি বক্তা। আর দ্বিতীয় জন নিরুপায় শ্রোতা মাত্র। -'হুঁ-হাঁ'- দেওয়া ছাড়া আর বিশেষ কিছু করার ছিল না তাঁর। বুঝলাম দুজনেই কলকাতায় জন্মেছেন এবং বড় হয়েছেন। যিনি বক্তা তিনি 'ইগো'র লড়াইয়ে এক্কেবারে ক্ষত বিক্ষত! ভাগ্য আমার ভাল ছিল তাই কোণার টেবিলে ছিলাম। আমাকে তাঁরা কেউই লক্ষ্য করতে পারেন নি। যদিও আমার মধ্যে বাঙ্গালীত্ব-র অভাব বলে জানি, নয়ত সব সময় শুনতে হয় যে, আমি স্প্যানীশ বা পাঞ্জাবী-না কোন হটভট দেশ থেকে আসা এক প্রাণী। যাই হোক, দুকান খাড়া করে বসে থাকলাম।

বক্তাঃ এরা কালচারের জানেটা কি? এসেছে তো সব গ্রাম/মফস্ব্ল থেকে । জানি সবই, বাব্বাঃ। এখানে এসে একেবারে সব নায়ক-নায়িকা হয়ে গেছে। দেখলেই বোঝা যায় কিন্তু। আমি জন্মেছি কলকাতায়, পড়াশুনা করেছি কলকাতায়। থেকেছি দক্ষিণ কলকাতায়। কলকাতার হেঁজো-পেঁজো যায়গা থেকেও আসি নি। জন্মগত ভাবেই -কালচার- কি! আমি জানি। কালচারাল পরিবেশেই আমি 'বর্ন এ্যান্ড ব্রট আপ'। এরা কালচার কি তা জানবে কোত্থেকে- কি বলো?

শ্রোতাঃ- আমিও তো তাই। কলকাতায় জন্মেছি আবার কলকাতায়-ই বড় হয়েছি। নামকরা ইংরেজি স্কুলে পড়াশুনা করেছি। বনেদি বংশের মেয়েরা আমার বান্ধবী ছিল। কোনটাই আমার সাথে মিলছে না দেখে এমন ভাব করলাম যেন, কিছুই শুনছি না।

বক্তাঃ আরে সে-ই তো, সেই জন্যেই তো তোমাকে কথাগুলো বলছি। বলো তো, এরা কালচারের জানে টা কি? জন্মেছে তো সব গ্রামে অথবা মফস্ব্লে। কালচার কি তা এরা জানবে কোত্থেকে- ? কোনদিন কি স্টেজে উঠেছে? 

শ্রোতাঃ স্টেজে ওঠা তো দূরের কথা-স্টেজের কাছাকাছি ই গেছে কিনা সন্দেহ। অথচ এখানে সব কালচারাল সেক্রেটারী। গা জ্বলে যায় এইসব দেখে।

চা খাওয়া আর হল না, জুড়িয়ে ঠান্ডা হয়ে গেল। আমি আবার কোন কথা মন দিয়ে শুনতে শুরু করলে যদি অন্য দিকে মন দি - এক্কেবারে শুনতে পারি না। লোকে আমাকে কালা ভেবে বসে। এইভাবে বসে বসে “ কালচার্ড -আনকালচার্ড--' শহর/ নগর, গ্রাম /মফস্বল, বাংলা/ইংলিশ এই শব্দ গুলো নিয়ে মনে মনে নাড়াচাড়া করতে করতে ফিরে এলাম ক্লাসে । ক্লাসের নোট নেওয়া তো দূরের কথা-মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগল-সেই দুই কলকাতার কালচার্ড-দের কথা। বাড়ি ফিরে এলাম। খাতাটা টেনে নিয়ে বসলাম টেবিলে। খাতার ওপরে পেনটা রেখে ভাবতে লাগলাম কে কালচার্ড?......কারা কালচার্ড? সত্যি তো কোনদিন মনেও আসে নি এই প্রশ্নগুলো?

মনে পড়লো বন্ধু প্রিয়নাথ সেনকে লেখা রবীন্দ্রনাথের এই লাইনটা- “ আমার কলকাতা ছেড়ে পালাতে ইচ্ছে করে।” মনে পড়ল কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ-এর কলকাতা সম্পর্কে প্রকাশ করা নানা উপলব্ধি- “ পৃ্থিবী বাস্তবিক কী আর্শ্চয্য সুন্দরী তা কলকাতায় থাকলে ভুলে যেতে হ্য়।”

রবীন্দ্রনাথ কলকাতায় জন্মেছিলেন কিন্তু কলকাতায় থাকতে চাননি। তিনি কোথায় জীবনের অধিক সময় কাটিয়েছেন সে কথা আশা করি বাঙ্গালীদের অজানা নয়। শহরের যান্ত্রিকতা-কৃ্ত্রিমতা তাঁকে আনন্দ দিতে পারেনি একটুও। ইংরেজি পাঠশালায় তিনি পড়েননি। যদিও ইংরেজি মাধ্যমে পড়নেওয়ালাদের থেকে অনেক বেশি ইংরেজি পড়েছিলেন। তাদের থেকে অনেক বেশি নির্ভূল ও সুন্দর ইংরেজি তিনি জানতেন। একটা শিশুর শিক্ষার মাধ্যম তার মাতৃভাষাই হওয়া উচিত, একথাও তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন। তবে কি তিনি কালচার্ড ছিলেন না? 

এতো গেল রবি ঠাকুরের ব্যাপার। অন্যরা সব কোথায় জন্মেছিলেন? চুপচাপ বসে ভাবতে লাগলাম। দেখি কখন এসে আমার সামনে দাঁড়িয়েছেন রাজা রামমোহন রায় এবং পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।

আমার সামনে রাখা খাতাটাতে রামমোহন রায় বড় বড় করে জন্মস্থান লিখলেন -হুগলী জেলার রাধানগর গ্রাম। 

বিদ্যাসাগর হেসে তাঁর হাত থেকে পেনটা নিলেন। জন্মস্থান লিখলেন -মেদিনীপুরের বীরসিংহ গ্রাম। তাকিয়ে দেখি আমার সামনে তো বিরাট ভীড়। একে একে সকলে পরস্পরের হাত থেকে পেন নিচ্ছেন আর লিখছেন। 

বিদ্যাসাগরের হাত থেকে পেনটা নিয়ে মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত জন্মস্থান লিখলেন-যশোর জেলার কপোতাক্ষ নদীর তীরবর্তী সাগরদাড়ী গ্রাম। নাট্যকার দিনবন্ধু মিত্র জন্মস্থান লিখলেন-নদীয়ার চৌবেড়িয়া গ্রাম। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় জন্মস্থান লিখলেন-নদীয়ার কৃষ্ণনগর।

সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় জন্মস্থান লিখলেন-নৈহাটির কাঁঠালপাড়া গ্রাম। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় জন্মস্থান লিখলেন-হুগলী জেলার দেবানন্দপুর গ্রাম। তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায় লিখলেন জন্মস্থান – বীরভূমের লাভপুর গ্রাম। বিভূতি ভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় কে দেখেই আমি বলে ফেললাম- “ আমরা জানি আপনি নিজেই সেই গ্রামের 'অপু'।”

কবি জীবনানন্দ দাসকে দেখে না বলে থাকতে পারলাম না - “রূপসী বাংলার ওই রূপ কি কেউ শহরের নিষ্প্রাণ পাথরে জন্মে দেখতে পায়? সব তো ইঁটের পাঁজরে বলি হয়ে যায়।”

বাংলা সাহিত্যের ধ্রুবতারা-কবি নীরদচন্দ্র চৌধুরী জন্মেছিলেন কিশোরগঞ্জ শহরে।

তখনও কিন্তু ভীড় কমেনি। খাতার কাছে এগিয়ে আসার জন্য রীতিমত ঠেলাঠেলি চলছে। 

কিন্তু কে যেন চেঁচিয়ে উঠল। ঘুমটা গেল ভেঙ্গে। দেখি আমার বৌ্দি চায়ের কাপ হাতে।

-এখনও ঘুমাচ্ছিস?

-ঘুমুচ্ছি না তো, দেখছি আনকালচার্ড কে?

বৌ্দি অবাকঃ “কে আবার আনকালচার্ড?”

আমি বললামঃ “সেটাই তো আমার জিজ্ঞাসা। তুমি কি জানো?”

আমি আমার বঙ্গজননীকে যেন বললাম-

“আমার না-বলা বাণীর ঘন যামিনীর মাঝে 
তোমার ভাবনা তারার মতন বাজে।
নিভৃত মনের বনের ছায়াটি ঘিরে
না-দেখা ফুলের গোপন গন্ধ ফিরে,
আমার লুকায় বেদনা অঝরা অশ্রুনীরে-
অশ্রুত বাঁশী হৃদয় গহনে বাজে।।”

0 comments: