Next
Previous
Showing posts with label গল্প. Show all posts
0

গল্প - মনোজ কর

Posted in








পর্ব ২০

বণিকের মানদণ্ড দেখ দিল রাজদণ্ডরূপে

(সময়ানুক্রমিক সংক্ষিপ্ত বিবরণী)-প্রথম অংশ

ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত্তিস্থাপন হয়েছিল বাঙলাতেই। এশিয়াতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ব্যবসার ষাট শতাংশ উপকরণই ছিল বাঙলার। ভারতবর্ষে কোম্পানির ব্যবসা ত্বরান্বিত হতে থাকল যখন আওরঙ্গজেব ১৬৯০ সালে বার্ষিক তিনহাজার টাকার বিনিময়ে কোম্পানিকে নিঃশুল্ক ব্যবসার অনুমতি দিল। ১৬৯৬ সালে কলকাতায় দূর্গ নির্মানের অনুমতি এবং তার দু’বছর পরে কলিকাতা, সূতানুটি এবং গোবিন্দপুর গ্রামের জমিদারি কোম্পানিকে লিখে দিল মোগলসম্রাট আওরঙ্গজেব। ১৭০৭ সালে আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর সাময়িকভাবে কিছু সমস্যা দেখা দিলেও ১৭১৭ সালে সম্রাট ফাররুক্সিয়ার আবার নিঃশুল্ক ব্যবসার এবং কলকাতার নিকটবর্তী আটত্রিশটি গ্রামের জমিদারির অনুমতি দিল কোম্পানিকে।সেই সঙ্গে নবাবের ট্যাঁকশাল ব্যবহারের অনুমতি পেল কোম্পানি। কিন্তু অনতিবলম্বেই এই অনুমতি নিয়ে কোম্পানির বিবাদ শুরু হলো বাঙলার নবাব মুর্শিদকুলি খানের সঙ্গে। কোম্পানির আধিকারিকেরা কোম্পানির ব্যবসার বাইরে নিজেদের ব্যক্তিগত ব্যবসাও চালাত। এই ব্যক্তিগত ব্যবসাগুলিকে নিঃশুল্ক ব্যবসার বাইরে রাখার জন্য কড়া আইন প্রবর্তন করলো মুর্শিদকুলি। কোম্পানি আধিকারিকরা কিন্তু নানা ছলছুতোয় নিজেদের ব্যক্তিগত ব্যবসাগুলির থেকে কর ফাঁকি দিতে থাকলো। ক্রুদ্ধ মুর্শিদকুলি আটত্রিশটি গ্রামের জমিদারি এবং ট্যাঁকশালের ব্যবহার সম্পর্কিত আদেশনামা প্রত্যাহার করে নিল। ১৭১৭ সাল থেকেই বাঙলার নবাব এবং কোম্পানির মধ্যে বৈরিতার সূত্রপাত।

১৭৪০ সালে অস্ট্রিয়া উত্তরাধিকার যুদ্ধের ফলস্বরূপ ভারতবর্ষে ব্রিটিশ এবং ফরাসিদের মধ্যে বিবাদ শুরু হয়। বাঙলার নতুন নবাব আলিবর্দি খান ব্রিটিশ এবং ফরাসি উভয়পক্ষকেই কড়া নিয়ন্ত্রনে রাখে এবং কোনওরকম যুদ্ধবিগ্রহ থেকে বিরত থাকার জন্য নিষেধাজ্ঞা জারি করে। কিন্তু দাক্ষিনাত্যে ফরাসিদের বিজয়লাভ ব্রিটিশদের বাঙলার ফরাসিদের প্রতি সন্দিহান করে তোলে। যদি কোনওভাবে ফরাসিদের হাতে ব্রিটিশরা আক্রান্ত হয় সেক্ষেত্রে আলিবর্দি কতটা তাদের সাহায্য করতে পারবে সে ব্যাপারেও অনিশ্চয়তায় ভুগতে থাকতে থাকে ব্রিটিশরা। এছাড়াও ব্যবসার ক্ষেত্রে এশিয়ার ব্যবসায়ীদের সাহচর্যে ফরাসিদের ব্যবসাও বৃদ্ধি পেতে থাকায় কোম্পানির ব্যবসাও বেশ বড়রকমের ধাক্কা খেয়েছে। সব মিলিয়ে ফরাসিদের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক উত্থানে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে ১৭৫৫ সালে নবাবের অনুমতির তোয়াক্কা না করে কলকাতা দূর্গকে আরও শক্তিশালী করার জন্য খনন এবং নির্মাণের কাজ শুরু করে ব্রিটিশরা। এমনকি নবাবের দরবার থেকে বহিষ্কৃত এবং পলাতক লোকেদেরও কলকাতায় নিরাপদ আশ্রয় দিতে থাকে ব্রিটিশরা। বাঙলার নবাবের সঙ্গে বিরোধ চরম আকার নেয় যখন ১৭৫৬ সালে সিরাজদ্দৌল্লা নবাবের আসনে বসে। সিরাজ কোম্পানি আধিকারিকদের ব্যক্তিগত ব্যবসাকে নিঃশুল্ক ব্যবসার অন্তর্ভুক্ত না করার জন্য নতুন করে আদেশ জারি করে। সিরাজের সঙ্গে বিরোধিতা চরম পর্যায়ে পৌঁছোয় মূলতঃ দু’টি কারণে প্রথমত রাজস্ব আত্মসাৎ করার দায়ে অভিযুক্ত কৃষ্ণবল্লভকে আশ্রয়দান এবং দ্বিতীয়ত নবাবের অনুমতির তোয়াক্কা না করে দূর্গ নির্মাণের কাজ শুরু করা। এই দু’টিকেই রাজদ্রোহিতার সামিল বলে ঘোষণা করে সিরাজ। সিরাজের সাবধাবাণীতে কর্ণপাত না করার শাস্তি হিসাবে সিরাজ কাশিমবাজারে কোম্পানির ফ্যাক্টরি দখল করে নেয়। সিরাজের ক্ষমতা সম্পর্কে গভর্নর ডেকের ধারণাকে ভ্রান্ত প্রমাণ করে ২০শে জুন সিরাজ কলকাতা দখল করে নেয়।

এই সঙ্কটের হাত থেকে ব্রিটিশদের রক্ষা করতে মাদ্রাজ থেকে বিশাল সৈন্যসমভিব্যাহারে কলকাতায় এসে পৌঁছোয় রবার্ট ক্লাইভ। ব্রিটিশদের ভয় ছিল যে সিরাজ ফরাসিদের সহায়তায় তাদের ব্যবসার ক্ষতি করতে পারে এবং ফরাসিদের সঙ্গে মিলে তাদের ওপর আক্রমণ করতে পারে। তাই কোনওরকম ঝুঁকি না নিয়ে রবার্ট ক্লাইভ আক্রমণের রাস্তা বেছে নেয় এবং হুগলি ও চন্দননগর ফরাসিদের কাছ থেকে দখল করে নেয়। আবদালির নেতৃত্বে আফগান আক্রমণের আশঙ্কায় সিরাজ ব্রিটিশদের সঙ্গে আলাপ আলোচনার মধ্যে দিয়ে মীমাংসা প্রক্রিয়া শুরু করতে চাইলে ক্লাইভ তা প্রত্যাখ্যান করে এবং যুদ্ধের পথেই থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। কোম্পানির আধিকারিকেরা কোনওভাবেই কমবয়সী সিরাজের অত্যাচারের কাছে মাথা নত করে নিজেদের ব্যবসা এবং উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সঙ্গে আপস করতে রাজি হলোনা। এছাড়াও নবাবের দরবারে সিরাজের বিরুদ্ধে একটা শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠছিল। সিরাজের ঔদ্ধত্য এবং অপমানজনক ব্যবহারে বীতশ্রদ্ধ হয়ে তাকে সিংহাসনচ্যুত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে বেশ কিছু ব্যবসায়ী এবং জমিদার ক্লাইভের সঙ্গে হাত মেলালো। এদের মধ্যে প্রধান ছিল জগতশেঠ মোহতাব রাই, স্বরূপচাঁদ, রাজা জানকিরাম, রাইদুর্লভ, রাজা রামনারায়ণ, রাজা মাণিকচাঁদ প্রমুখ। তাছাড়া অনেক ভারতীয় ব্যবসায়ী ব্রিটিশদের সঙ্গে যৌথভাবে ব্যবসায় নিযুক্ত ছিল এবং অনেকে ব্যবসার জন্য ব্রিটিশ জলযান ব্যবহার করতো। এরা সকলেও ব্রিটিশদের পক্ষে ছিল। জগতশঠের কথামতো সিরাজের জায়গায় তার অন্যতম সেনাধিপতি মিরজাফরকে নবাব করার পরিকল্পনা করে চক্রান্ত দানা বেঁধে উঠলো। নবাবের দরবারে চক্রান্ত আগে থেকেই চলছিল যার সদ্ব্যবহার করেছিল ব্রিটিশরা না ব্রিটিশরাই এই ষড়যন্ত্র শুরু করেছিল সে প্রশ্ন অবান্তর। এই ষড়যন্ত্রের ফলস্বরূপ ১৭৫৭ সালের জুন মাসে পলাশির যুদ্ধে ক্লাইভের হাতে পরাজিত হলো সিরাজ। পলায়নরত সিরাজকে বন্দি করে নৃশংসভাবে হত্যা করা হলো এবং ব্রিটিশদের হাতের পুতুল মিরজাফরকে নবাবের আসনে বসালো ক্লাইভ। এখানেই শুরু হলো ভারতবর্ষে ব্রিটিশদের রাজনৈতিক উত্থানের ইতিহাস।

এরপরে শুরু হলো বহু আলোচিত ‘পলাশি পরবর্তী লুন্ঠন’ । যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই তখনকার হিসাবে ২,৭৫,০০০ পাউন্ড ভাগ করে দেওয়া হলো জল এবং স্থলবাহিনীর সৈন্যদের মধ্যে। ১৭৫৭ থেকে ১৭৬০সালের মধ্যে কোম্পানি মিরজাফরের কাছ থেকে আদায় করলো তখনকার হিসাবে আড়াই কোটি টাকা। ক্লাইভ ব্যক্তিগতভাবে মিরজাফরের কাছ থেকে যে ভূখন্ডের জায়গিরদারি পেয়েছিল তার মূল্য তখনকার হিসাবে প্রায় ৩৫০০০ পাউন্ড। কোম্পানি তাদের ব্যবসার ক্ষেত্রে বেশ বড় রদবদল নিয়ে এলো। ১৭৫৭ সালের আগে কোম্পানি বাঙলায় ব্যবসা করার জন্য দেশ থেকে বুলিয়ন আমদানি করতো। পলাশি যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই শুধু বুলিয়ন আমদানি বন্ধ হলো না , তার পরিবর্তে বাঙলা থেকে চিনে এবং ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলে বুলিয়ন রপ্তানি শুরু হলো। ব্রিটিশরা এর ফলে অন্যান্য ইউরোপিয়নদের থেকে বেশি সুবিধাজনক অবস্থায় পৌঁছে গেল। অন্যদিকে পলাশি যুদ্ধের পর কোম্পানি আধিকারিকদের সৌভাগ্যের দরজা খুলে গেল। প্রজাদের ওপর সরাসরি নিপীড়ন ছাড়াও নিজেদের ব্যক্তিগত ব্যবসায় কোম্পানিকে প্রদত্ত কর সংক্রান্ত সুযোগ সুবিধার অপব্যবহার করে টাকার পাহাড় গড়ে তুললো। কিছুদিনের মধ্যেই মিরজাফরের পক্ষে কোম্পানির ক্রমবর্ধমান আর্থিক চাহিদা মেটানো অসম্ভব হয়ে পড়লো। ১৭৬০ সালের অক্টোবর মাসে মিরজাফরকে সরিয়ে মসনদে বসানো হলো তার জামাতা মিরকাসিমকে। অল্পদিনের মধ্যেই আবার দ্বন্দ্বের শুরু হলো কোম্পানিকে দেওয়া করছাড়ের সুযোগের ব্যক্তিগত ব্যবসায় যথেচ্ছ অপব্যবহারকে কেন্দ্র করে। উপায় না দেখে মিরকাসিম করপ্রথা বিলোপ করে দিল যাতে ভারতীয় ব্যবসায়ীরাও সমান সুযোগ পায়। ব্রিটিশরা নবাবের এই স্বাধীন সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারলো না। ফলস্বরূপ মিরকাসিমকে সরিয়ে আবার মিরজাফরকে নবাবের আসনে বসানো হলো।

১৭৬৩ সালের ডিসেম্বরে মিরকাসিম বাঙলা থেকে পালিয়ে মোগলসম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম এবং অবধের রাজা সুজাউদ্দৌল্লার সঙ্গে জোট বাঁধলো। যুবরাজ দ্বিতীয় শাহ আলম পূর্ব ভারতে স্বাধীন সাম্রাজ্য গড়ার লক্ষ্যে ১৭৫৮ সালে দিল্লী ছেড়ে পালিয়ে যায়। ১৭৫৯ সালের ডিসেম্বরে পিতার হত্যার সংবাদ পেয়ে সে নিজেকে সম্রাট বলে ঘোষণা করে এবং সুজাউদ্দৌল্লাকে নিজের উজির হিসাবে নিযুক্ত করে। মিরকাসিম যখন বাঙলা থেকে পালিয়ে তার কাছে আশ্রয় চায় তখন দীর্ঘ আলোচনার পর তারা যৌথভাবে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সহমত হয়। সুজাউদ্দৌল্লা বিহারের রাজত্ব, রাজকোষের পূর্ণ অধিকার এবং যুদ্ধজয়ের পর নগদ তিন কোটি টাকার শর্তে যুদ্ধে যোগদান করতে রাজি হয়। ১৭৬৪ সালে বক্সারের যুদ্ধে এই তিনজনের জোট ব্রিটিশদের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে ব্রিটিশরা পরাজিত সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমকে যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শনের সঙ্গে কারারুদ্ধ করে। যথাযোগ্য সম্মানের সঙ্গে মুক্তিলাভের পরিবর্তে ১৭৬৫ সালে এলাহাবাদ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যাতে সম্রাট বাঙলা, বিহার এবং উড়িষ্যার দিওয়ানি ব্রিটিশদের লিখে দেয়। এই চুক্তির বলে ব্রিটিশরা বাঙলা, বিহার এবং উড়িষ্যার রাজস্ব আদায়ের একচ্ছত্র অধিকার কায়েম করে। মুর্শিদাবাদের দরবারে ব্রিটিশরা এসে গেল ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে এবং ১৭৭২ সালে বাঙলায় পরোক্ষভাবে কোম্পানিরাজ চালু হয়ে গেল। এলাহাবাদ চুক্তির শর্তানুযায়ী সুজাউদ্দৌল্লা এবং ব্রিটিশরা নিজ নিজ সাম্রাজ্যরক্ষার জন্য পরস্পরের সঙ্গে সহযোগিতা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকলো এবং সম্মানের সঙ্গে মুক্তিলাভের বিনিময়ে সুজাউদ্দৌল্লা ব্রিটিশদের ৫০ লক্ষ টাকা নজরানা দিল। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী অবধের দরবারে একজন ব্রিটিশ প্রতিনিধি নিযুক্ত হলো এবং কোম্পানি অবধে নিঃশুল্ক ব্যবসার অধিকার লাভ করলো। চুক্তির এই বিশেষ শর্তের কারণেই পরবর্তীকালে অবধ সাম্রাজ্যের বিলুপ্তি ঘটে।

১৭৬৫ সালে পূর্ব ভারত কোম্পানির সম্পূর্ণ অধিকারে আসে এবং দক্ষিণ ভারতে ব্রিটিশ আগ্রাসনের প্রস্তুতি শুরু হয়। ব্রিটেন-ফ্রান্স বিরোধ এই আগ্রাসনে অণুঘটকের কাজ করে। ইউরোপিয়ানদের মধ্যে ফরাসিরা সবার শেষে ভারতে আসে এবং সর্বপ্রথম এই উপমহাদেশে নিজেদের শাসন কায়েম করার পরিকল্পনা শুরু করে। ফরাসিদের মূল কেন্দ্র পন্ডিচেরিতে স্থাপিত হয় ১৬৭৪ সালে। ডুপ্লেইক্সের গভর্নর জেনারেল থাকার সময় ফরাসিরা রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠে। ১৭৩১ সালে ডুপ্লেইক্স প্রথমে চন্দননগরের গভর্নর হয়। দশ বছরের মধ্যে এই অঞ্চলে ফরাসি ব্যবসা ফুলেফেঁপে ওঠে। ডুপ্লেইক্স কাজপাগল লোক ছিল। যদিও ভারতবর্ষকে সে ঘৃণার চোখেই দেখতো তবুও এই সুযোগে নিজের প্রভাব কাজে লাগিয়ে ব্যক্তিগত ব্যবসা থেকে প্রচুর অর্থ উপার্জন করে ডুপ্লেইক্স। ১৭৪২ সালে পন্ডিচেরির দায়িত্ব পায় ডুপ্লেইক্স। কালবিলম্ব না করে ডুপ্লেইক্স নিজের ব্যবসা এবং রাজনৈতিক কার্যকলাপকে দ্রুততার সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে চলে। ডুপ্লেইক্সই প্রথম ইউরোপিয়ন রাজনীতিক যে ভারতীয় শাসকদের অন্তর্কলহকে ব্যবহার করে নিজের রাজনৈতিক প্রতিপত্তি বিস্তার করে। পরবর্তীকালে তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ব্রিটিশরাও একই পথ অনুসরণ করে নিজেদের প্রতিপত্তি কায়েম করে।১৯৭০ সালে ইউরোপে অস্ট্রিয়ান উত্তরাধিকার যুদ্ধ ব্রিটিশ এবং ফরাসিদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে। সেই বিভেদের প্রভাব ভারতবর্ষেও এসে পৌঁছোয়। বাঙলায় এই বিভেদকে কড়া হাতে দমন করে আলিবর্দি খান। কিন্তু দক্ষিণ ভারতে মরিশাস থেকে আগত নৌসেনা ফরাসিদের হাত শক্ত করে এবং ফরাসিরা মাদ্রাজে ব্রিটিশদের ওপর আক্রমণ চালায়। ব্রিটিশরা ফরাসিদের হাতে মাদ্রাজ সমর্পণ করে এবং কর্ণাটকের নবাবের কাছে আশ্রয় ভিক্ষা করে। নবাব ফরাসিদের আক্রমণের জন্য সৈন্য পাঠায় কিন্তু সেই সৈন্যবাহিনী পরাজিত হয়ে ফিরে আসে। কিন্তু এই সময়ে ডুপ্লেইক্স এবং মরিশাস থেকে আগত অ্যাডমিরাল লা বোরদোনেয়ার্সের মধ্যে তীব্র মতবিরোধ হয় এবং বোরদোনেয়র্স ব্রিটিশদের হাতে মাদ্রাজ সমর্পণ করে মরিশাস ফিরে যায়। ১৭৪৬ সালে ডুপ্লেইক্স আবার মাদ্রাজ আক্রমণ করে এবং দক্ষিণ পন্ডিচেরিতে ব্রিটিশ অধিকৃত সেন্ট ডেভিড ফোর্ট দখল করে নেয়। ইতিমধ্যে আইক্স লা চ্যাপেল চুক্তির মাধ্যমে ব্রিটিশ এবং ফরাসি বৈরিতার সমাপ্তি ঘটে। চুক্তি অনুযায়ী ব্রিটিশরা ভারতে তাদের ফরাসিদের হাতে হারানো অধিকার ফিরে পায় এবং উত্তর আমেরিকায় ফরাসিরা তাদের ব্রিটিশদের হাতে হারানো অধিকার ফিরে পায়। যুদ্ধ আর আগে এগোতে পারেনা।

ভারতবর্ষে সিংহাসন দখলের জন্য পারিবারিক বিবাদ সর্বজনবিদিত। সেই বিবাদের কারণেই ব্রিটিশ এবং ফরাসিদের মধ্যে বিবাদ বাড়তে থাকে দক্ষিণ ভারতে। কর্ণাটক এবং হায়দ্রাবাদে উত্তরাধিকার সংক্রান্ত বিবাদের সুযোগ নিয়ে অর্থনৈতিক সুবিধা আদায় করে নেয় ফরাসি গভর্নর জেনারেল ডুপ্লেইক্স। কর্ণাটকে চন্দা সাহিব এবং হায়দ্রাবাদে মুজফফর জংকে রাজা হবার লড়াইতে সমর্থন করে ফরাসিরা। ব্রিটিশরা সমর্থন করে এদের বিরোধি নাসির জং এবং মহম্মদ আলিকে। ফরাসি সমর্থিত দু’জনেই বিজয়ী হয় এবং নাসির জং-এর মৃত্যু হওয়ায় হায়দ্রাবাদের নতুন নিজাম হয় মুজফফর জং। মুজফফর ফরাসিদের মাসুলিপটম এবং আরও বেশ কয়েকটি গ্রামের জায়গির দান করে। এমনকি নিজের দরবারেও ফরাসি প্রতিনিধির জন্য একটি আসন নির্দিষ্ট করে দেয়। অবশ্য মুজফফর জংও বেশিদিন রাজত্ব করতে পারেনি। ১৭৫১ সালের ফেব্রয়ারিতে মুজফফর মারা যায় এবং সালাবত জং নতুন নিজাম হয়। আতঙ্কিত ব্রিটিশদের সহায়তার জন্য কলকাতা থেকে রবার্ট ক্লাইভের নেতৃত্বে বিশাল বাহিনী কর্ণাটক এসে পৌঁছোয় এবং ১৭৫২ সালের শুরু হয় দ্বিতীয় কর্ণাটকি যুদ্ধ। ব্রিটিশরা জয়ী হয় এবং মহম্মদ আলি কর্ণাটকের সিংহাসনে বসে। ডুপ্লেইক্স দক্ষিণ ভারত পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চালাতে চায় কিন্তু প্রচুর অর্থনৈতিক লোকসানের কারণে ফরাসি সরকার ডুপ্লেইক্সকে যুদ্ধ বন্ধ করে দেশে ফিরে যেতে বলে । ১৭৫৪ সালে ডুপ্লেইক্স দেশে ফিরে যায়। নতুন গভর্নর জেনারেল হয় চার্লস গডেহিউ। গডেহিউ ১৭৫৪ সালেই ব্রিটিশদের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করে এবং মুজফফর প্রদত্ত জায়গির এবং রাজদরবারের আসন নিজেদের জন্য সংরক্ষণ করে।

১৭৫৬ সালে ইউরোপে সপ্তবর্ষীয় যুদ্ধ শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গেই ভারতবর্ষে আবার ব্রিটিশ ফরাসি বিরোধ শুরু হয় এবং তৃতীয় কর্ণাটকি যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটে। ফরাসিদের আর্থিক দুর্বলতার কারণে সৈন্যদের বেতন দেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। ফরাসি সরকার উপায়ান্তর না দেখে কাউন্ট ডি লালির নেতৃত্বে সৈন্যবাহিনী পাঠায় ভারতবর্ষে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ফরাসিরা একের পর এক জায়গা হারাতে থাকে ব্রিটিশদের হাতে। প্রথমে হাতছাড়া হয় চন্দননগর। বাসিকে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয় লালিকে সাহায্যের জন্য কিন্তু নর্দান সরকারের অন্তর্গত বিস্তীর্ণ অঞ্চল, মাসুলিপটম, ইয়ানাম এবং পার্শ্ববর্তী এলাকা ফরাসিদের হাত থেকে দখল করে নেয় ব্রিটিশরা।১৭৬০ সালের জানুয়ারিতে তৃতীয় কর্ণাটকি যুদ্ধের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ ওয়ান্ডুইশ যুদ্ধে ফরাসিদের পরাজয়ের অব্যবহিত পরেই ব্রিটিশরা পন্ডিচেরি দখল করে। মালাবার উপত্যকার মাহে এবং কর্ণাটকের জিঞ্জি ও থিয়াগড়ের পতনের সঙ্গে সঙ্গেই ফরাসিদের পায়ের তলার মাটি বরাবরের মত সরে যায়।

ফরাসিদের পরাজয়ের মূল কারণগুলি হল, প্রথমত কাউন্ট ডি লালির ঔদ্ধত্য এবং অসংযত আচরণ যে কারণে পন্ডিচেরির অন্যান্য ফরাসি আধিকারিকারেরা লালির থেকে দূরে সরে যায় এবং কার্যত নিষ্ক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করে। দ্বিতীয়ত প্রচন্ড অর্থাভাবের কারণে সামরিক ব্যবস্থার চূড়ান্ত বিপর্যয়। তৃতীয়ত বাসিকে দক্ষিণ ভারত থেকে সরিয়ে নেওয়ার ভুল সিদ্ধান্ত এবং সর্বোপরি সদ্য যুদ্ধজয়ী ব্রিটিশ নৌবাহিনীর দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়। ১৭৬৩ সালের ১০ই ফেব্রুয়ারি স্বাক্ষরিত হয় প্যারিস চুক্তি এবং সেই চুক্তি অনুসারে ফরাসিরা ১৭৪৯ সালের আগে নির্মিত সমস্ত কারখানা এবং অন্যান্য সম্পত্তি ফেরত পায়। শুধুমাত্র চন্দননগরের দূর্গনির্মাণ সংক্রান্ত কোনও রকম কাজের অধিকার ফরাসিদের দেওয়া হলোনা। ক্ষমতার এই নতুন বন্টনের অবশ্যম্ভাবী ফলস্বরূপ ব্রিটিশ কোম্পানির অগ্রগতি ঘটতে থাকলো অত্যন্ত দ্রুতগতিতে এবং ভারতবর্ষ থেকে ফরাসি কোম্পানি ১৭৬৯ সালে সম্পূর্ণভাবে অবলুপ্ত হয়ে গেল। ব্রিটিশরাই কার্যত কর্ণাটকের আধিপত্য লাভ করলো যদিও প্যারিস চুক্তির শর্তানুযায়ী নবাবকেই তার সমস্ত সম্পত্তির অধিকার দেওয়া হল। নবাবের জীবদ্দশায় ব্রিটিশরা তাকে নবাবের স্বীকৃতি ও প্রাপ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত না করলেও ১৮০১ সালে তার মৃত্যুর পরে তার সাম্রাজ্য ব্রিটিশরা দখল করে নিল এবং নবাবের উত্তরাধিকারীদের জন্য ভাতা ব্যবস্থা চালু হল। হায়দ্রাবাদের নিজাম শক্তিশালী প্রতিবেশীদের হাত থেকে বাঁচার জন্য ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সাহায্য নিতে বাধ্য হল এবং তার পরিবর্তে নর্দার্ন সরকারের অধিকার ব্রিটিশদের দান করে দিল। ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর শক্তি যেহেতু ভারতবর্ষের অন্য সমস্ত প্রদেশের মিলিত শক্তির চেয়ে অনেক বেশি ছিল সেইজন্য ভারতবর্ষে ক্ষমতার ভারসাম্য ব্রিটিশদের দিকেই ঝুঁকে রইলো।

অষ্টাদশ শতকে ভারতবর্ষের প্রদেশগুলি ছিল পারষ্পরিক দন্দ্বে বিদীর্ণ। প্রদেশগুলি রাজস্ব বৃদ্ধি করার জন্য একে অপরের অঞ্চল অধিকার করার জন্য সবসময়ে যুদ্ধে মেতে থাকতো। সমস্ত প্রদেশ একত্রিত হয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করা সেই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে একেবারেই সম্ভব ছিল না। বরঞ্চ পার্শ্ববর্তী প্রদেশকে দখল করার জন্য অনেকেই কোম্পানির দ্বারস্থ হত। ব্যবসায়িক স্বার্থ ছাড়াও প্রদেশগুলির মধ্যেকার এই পারষ্পরিক বৈরিতা ব্রিটিশদের সুযোগ করে দিল ভারতবর্ষের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করার।
0

গল্প - অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

Posted in






আজ পয়লা এপ্রিল। আজ থেকেই শুরু করব খেলাটা। আমার বেডসাইড টেবিলে একটা স্বচ্ছ কাঁচের শিশি। শিশির মধ্যে একই রকম দেখতে তিরিশটা ক্যাপসুল। রাত বারোটায় প্রতিদিন শুতে যাওয়ার আগে একটা করে ক্যাপসুল খাব। তারপর টেবিলেই রাখা ডেস্ক-ক্যালেন্ডারে সেই তারিখের পাশে একটা টিক দিয়ে শুয়ে পড়ব। খেলাটায় একটা সাসপেন্স আছে। কতগুলো তারিখে টিক পড়বে তা অনিশ্চিত। একটা মাত্র পড়তে পারে আবার তিরিশটাও পড়তে পারে। তবে ক্যালেন্ডারের এই পাতাটা ওলটাতে হবে না কোনোদিনই। পয়লা মে আমাকে দেখতে হবে না সেটা নিশ্চিত। এই তিরিশটার মধ্যে ঊনত্রিশটা ভিটামিন ক্যাপসুল হলেও একটার খোলে ভরা আছে পটাসিয়াম সায়ানাইড।

***

ইন্ডিয়ান সায়েন্স অ্যান্ড রিসার্চ ইন্সটিটিউটে সিনিয়ার সায়েন্টিস্ট হিসাবে কাজ করছি আজ প্রায় পনের বছর হয়ে গেল। তার আগে এখানেই জুনিয়ার সায়েন্টিস্ট পদে ছিলাম পাঁচ বছর। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার বছরখানেক পর আমাকে সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি মন্ত্রকের প্রধান সচিব পদে যোগদানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। আমি সেই পদ নিতে অস্বীকার করে আমার পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। সরকার পদত্যাগপত্র গ্রহণ না করে বিশেষ বেতনক্রম দিয়ে আমাকে এই পদেই রেখে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এটা প্রায় তিন বছর আগের কথা। বিশেষ বেতনক্রম দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকার আমকে একটি বিশেষ প্রোজেক্টের দায়িত্বও অর্পণ করে। চূড়ান্ত গোপনীয় প্রোজেক্ট। তিন মাস অন্তর এই প্রোজেক্টের প্রোগ্রেস রিপোর্ট বিভাগীয় মন্ত্রীর হাতে আমাকে নিজে গিয়ে দিয়ে আসতে হবে। কাজ শুরুর আগে এই গবেষণায় আমার সহকারী হিসাবে একজন জুনিয়ার বিজ্ঞানীকে নিযুক্ত করেছে সরকার। নিয়ম অনুসারে ইউপিএসসি একটি ইন্টারভিউ বোর্ড গঠন করেছিল ঠিকই। কিন্তু বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসাবে সেই পদে উপযুক্ত প্রার্থী বাছাই করার সম্পূর্ণ অধিকার ও দায়িত্ব আমাকেই দেওয়া হয়েছিল। কোনো সন্দেহ নেই আমিই পছন্দ করেছিলাম মধুমিতাকে। সে অক্সফোর্ডের ডক্টরেট। অবশ্য সে ছাড়া আরও দুজন প্রার্থী বিষয়ের উপর যাবতীয় প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর দিয়েছিল। কিন্তু কোঁকড়ানো চুলের মেয়েটির হাই-পাওয়ার চশমার পিছনে বুদ্ধিদীপ্ত দুই চোখের আত্মবিশ্বাসী চাহনিই শেষ পর্যন্ত পার্থক্যটা গড়ে দিল। কাজ শুরু হওয়ার পর উপলব্ধি করেছিলাম আমার প্রার্থী-নির্বাচন নির্ভুল। মধুমিতা মেধাবী, পরিশ্রমী, দায়িত্ববান এবং বিষয়ের উপর যথেষ্ট দখল আছে তার। আমি ভাবতেই পারিনি সে আমার বিশ্বাসভঙ্গ করতে পারে।

***

আমি নিজেও বুঝি আর পাঁচজন মানুষের সঙ্গে আমার মিলের চাইতে অমিল অনেক বেশি। আমি অমিশুক, সামাজিকতায় স্বচ্ছন্দ নই, এবং কোনো ঘনিষ্ঠ বা আন্তরিক সম্পর্কে ঢুকে পড়ায় আমার স্বাভাবিক অনীহা আছে। আমার বাল্য ও কিশোরকাল অত্যন্ত অবহেলায় কেটেছে বলেই হয়তো আমার চরিত্রটা এমনই গড়ে উঠেছে। অত্যন্ত ছোটবেলায় মা-বাবাকে হারিয়ে অনাগ্রহী কাকার পরিবারে আশ্রয় জুটেছিল। সেখানে দুবেলা খাওয়ার বিনিময়ে সংসারের বহুরকম কাজ করতে হত। আত্মীয়স্বজনের কাছে মুখ রাখতে বাড়ির কাছে একটা স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলেন কাকা। ভাগ্য ভালো, মেধা আর ইচ্ছের জোরে পড়াশুনাটা অব্যাহত ছিল। হায়ার সেকেন্ডারিতে অসাধারণ রেজাল্ট করার পর আমাকে আর ভাবতে হয়নি। কাকার বাড়ি ছেড়ে ছাত্রাবাসে উঠেছিলাম। সেখানে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও একজন স্বাভাবিক তরুণের মতো হয়ে উঠতে পারলাম না। পড়াশোনার জগতে একা একা কাটানোই আমার নিয়তি হয়ে উঠল। একজন সাধারণ মানুষের মতো বিয়ে-থা, সংসার ইত্যাদির চিন্তা কোনোদিনই আমার মনে ঠাঁই পায়নি। এই করেই প্রৌঢ়ত্বে প্রায় পৌঁছে গেলাম। আগামী পয়লা মে পঁয়তাল্লিশে পা দেওয়ার কথা। সেদিন আমার এই প্রোজেক্টের কাজের সময়সীমাও অতিক্রান্ত হবে। আর ঠিক তিরিশ দিন বাকি আছে সেই দিনটি আসতে। সে-পর্যন্ত যেতে পারলে জন্মদিনই হতে পারে আমার মৃত্যুদিন। কিন্তু সেই সম্ভাবনা তিরিশের মধ্যে মাত্র এক।

***

এই ইন্সটিটিউটে মধুমিতার যোগদান করার দিন থেকেই আমি প্রোজেক্টের কাজ শুরু করেছিলাম। এর জন্যে বিশেষভাবে তৈরি ল্যাবরেটরিটি ইন্সটিটিউট-চত্বরের এক প্রান্তে অবস্থিত। এখানে আমরা দুজন ছাড়া আর কারও প্রবেশাধিকার নেই। কেন্দ্রীয় সরকারের গোয়েন্দা বিভাগের একজন সিনিয়ার ইনস্পেকটরকে এই পরীক্ষাগারের সুরক্ষা-ব্যবস্থা তদারকি করার জন্য নিয়োগ করা হয়েছে। আমার থাকার জন্য পরীক্ষাগারের লাগোয়া দুই-ঘর বিশিষ্ট একটি আবাসও আছে। খাবারের ব্যবস্থা ইন্সটিটিউটের ক্যান্টিনে।

প্রথম বছরটা প্রায় শেষ হয়েছিল গবেষণার কাজে নিমগ্ন থেকে। আমার স্বভাব অনুযায়ী মধুমিতার সঙ্গে সম্পর্কটা কাজের স্তরেই আটকে ছিল। মধুমিতা চেষ্টা করেও আমার নিরাসক্তির বর্মে আঁচড় কাটতে পারেনি। আমি তার কাজে পুরোপুরি সন্তুষ্ট ছিলাম কিন্তু সে ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ তোলার উপক্রম করলেই আমার দীর্ঘকালীন অভ্যাসে রপ্ত করা উদাসীন চাহনিটি ঝুলিয়ে দিতাম চোখে।

আমার রক্ষণ আলগা হতে শুরু করল ঠিক দশ মাসের মাথায় যখন অপ্রত্যাশিত অল্প সময়ে প্রোজেক্টের প্রথম ধাপে সফলতা এসে গেল। এই ধাপে আমার লক্ষ্য ছিল মানুষের জেনোমে এমপ্যাথি বা সহমর্মিতার জিনগুলিকে শনাক্ত করা। পৃথিবীর তাবৎ প্রাণীদের মধ্যে একমাত্র মানুষই ‘অপর’ একজনের সুখ, দুঃখ, আনন্দ, ব্যথাযন্ত্রণাইত্যাদি নিজের মধ্যে অনুভব করতে পারে। তার জন্যে যে-জিনগুলি দায়ি সেগুলিই হল এমপ্যাথির জিন। এগুলো শনাক্ত করা খুব সহজ কাজ ছিল না। আমার অবশ্য একটা সুবিধে ছিল যে আমার পুরনো কাজের সূত্রেই আমি নিশ্চিত ছিলাম এই জিনগুলো কেবলমাত্র মস্তিস্কের নিওরন-কোষেই অবস্থান করে। ফলে আমার অনুসন্ধানের কাজটা একটা নির্দিষ্ট ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ ছিল। তা সত্ত্বেও আমার ধারণা ছিল প্রোজেক্টের সিংহভাগ সময় নেবে এই শনাক্তকরণ। দ্বিতীয় ধাপের কাজটা তুলনায় সহজ। এই ধাপে এমপ্যাথির জিনে মিউটেশন ঘটিয়ে সেগুলোকে স্থায়ীভাবে নিষ্ক্রিয় করে ফেলতে হবে। এটা সহজ, কারণ মাইক্রোইভোলিউশন ন্যাচারাল সিলেকশনের একটা অঙ্গ, যার ফলে কোনো কোনো কার্যক্ষম জিন নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়, আবার উলটোটাও ঘটে থাকে। অর্থাৎ, যেটা স্বাভাবিকভাবে এবং দীর্ঘ সময়ান্তরে ঘটে সেটা আমাকে কৃত্রিমভাবে একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে করতে হবে।

যেদিন এই শনাক্তকরণ নিঃসংশয়ে প্রতিষ্ঠিত হল, সেদিন আনন্দের আতিশয্যে আমি বোধহয় খানিকটা লঘুচিত্ত হয়ে পড়েছিলাম। সেই সুযোগে মধুমিতা আমার কাছে একটা প্রস্তাব রেখেছিল। বলেছিল, - এই সাফল্যটা আমাদের সেলিব্রেট করা উচিত স্যার।

সেদিনই সম্ভবত প্রথম আমি সম্পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে মধুমিতাকে লক্ষ করলাম। তার দৃষ্টিতে একটা সহজ আন্তরিকতা ছিল, সে উন্মুখ হয়ে তাকিয়ে ছিল আমার দিকে। চশমা খোলার জন্যেই কি না জানি না, তার চোখের পাতা ভারী, দৃষ্টি গভীর। সহসা তার মুখটিকে আকর্ষণীয় মনে হল আমার। উদার হয়ে বললাম, - বেশ, কী করতে চাও বলো।

সে বলল, - কাল কোনো কাজ নয়, আমাদের অনেক ছুটি পাওনা হয়ে গেছে। ক্যান্টিনে খেতে খেতে আপনার জিভে নিশ্চয়ই কড়া পড়ে গেছে। কাল বাড়ি থেকে আমাদের দুজনের জন্য একটা স্পেশাল ডিশ বানিয়ে এনে একসঙ্গে বসে খাব। আর সারাদিন গল্প করব। কাজের কথা কিন্তু নয় স্যার। সেটা বাদ দিয়ে আমাদের দুজনের যা ইচ্ছে হবে সেসব নিয়েই কথা হবে।

আমার অস্বস্তি হলেও আপত্তি জানাতে পারলাম না।

***

সেই শুরু। আস্তে আস্তে দেখা গেল প্রতি সপ্তাহে একটা দিন তার বাড়ির রান্না-করা খাবার নিয়ে এসে একসঙ্গে খাওয়াটা রুটিন করে ফেলেছে মধুমিতা। সেই সঙ্গে ব্যক্তিগত কথাবার্তার আদানপ্রদান খুবই সহজ ও স্বাভাবিক হয়ে উঠতে লাগল। একদিন সে দুম করে জিজ্ঞেস করে বসল, - আপনি বিয়ে করেননি কেন স্যার?

এই প্রশ্নের কোনো উত্তর আমার জানা ছিল না। আমি চুপ করে বিষয়টা নিয়ে ভাবছিলাম। সেই অবসরে আমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে টুকটাক প্রশ্ন করে যাচ্ছিল মধুমিতা। আমি আনমনা হয়ে উত্তর দিয়ে চলেছিলাম। পরে বুঝলাম আমার ছেলেবেলা থেকে শুরু করে এ-পর্যন্ত আমার জীবনকাহিনির পুরোটাই জেনে নিল সে। আমার বিয়ে না করা নিয়ে আর কোনোদিন কোনো প্রশ্ন সে করেনি। খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার যে মধুমিতার ব্যক্তিজীবন নিয়ে আমারও একটা আগ্রহ জন্মাচ্ছিল। জানতে চাওয়ার ব্যাপারে আমি সংকোচহীন হতে পারিনি ঠিকই কিন্তু মধুমিতা যেন টের পেয়ে গিয়েছিল আমার আগ্রহটা। ফলে ধীরে ধীরে জেনে গেলাম তার মা-বাবা কর্মসূত্রে ইউ কে-তে আছেন দীর্ঘকাল। মধুমিতার স্কুলশিক্ষা কলকাতায় হস্টেলে থেকে সমাপ্ত হলেও গ্র্যাজুয়েসন, মাস্টার্স এবং ডক্টরেট ডিগ্রি সে অক্সফোর্ড থেকে করেছে। কিন্তু তারপরেই সে মা-বাবার ইচ্ছের বিরুদ্ধে এদেশে চলে এসে কর্মজীবন শুরু করে আজ থেকে বছর ছয়েক আগে। এখানে সে পৈতৃক ফ্ল্যাটে একাই থাকে। একদিন বলল, - আপনি তো বাইরে বেরনই না। চব্বিশ ঘণ্টা কাজ আর পড়াশোনা নিয়ে থাকতে একঘেয়ে লাগে না? একদিন চলুন না আমার ফ্ল্যাটে?

আমি বললাম, - তুমি একা থাকো – যাওয়াটা বোধহয় ঠিক হবে না।

মধুমিতা কৌতুকের সুরে বলল, - একা থাকি না স্যার। সঙ্গে থাকে একজন। তার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব। চলুন না –

একটি যুবতী মেয়ের প্রাইভেট লাইফ নিয়ে কৌতূহল হওয়া ঠিক নয় কিন্তু অন্যায্যভাবে সেটাই জেগে উঠল মনে।

একদিন সে নিয়ে গেল তার ফ্ল্যাটে। আশ্চর্য হয়ে দেখলাম তার সেই ‘একজন’-কে। পাঁচ-ছ’ বছরের ছোট্ট একটি মেয়ে। ঢলোঢলো মুখে মায়াভরা চোখ নিয়ে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল সেই মেয়ে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, - কে?

একচোখ হাসি নিয়ে মধুমিতা বলল, - আমার মেয়ে।

--তুমি বিবাহিতা – বলোনি তো –

--মা হতে গেলে বিবাহিত হতেই হবে স্যার?

--না – মানে – আমি কথা খুঁজে গেলাম না।

মাধুমিতার ফ্ল্যাটে একজন সাহায্যকারীও আছেন। একজন মধ্যবয়স্ক মহিলা। চব্বিশ ঘণ্টাই থাকেন। মধুমিতা জানাল তিনি প্রশিক্ষিত পালিকা। মেয়ের দেখাশোনা করাই তাঁর প্রধান কাজ। চুক্তির বাইরে গিয়ে গৃহকর্মের কাজেও সাহায্য করেন। মেয়ের সঙ্গে স্কুলে যাতায়াত তাঁকেই করতে হয় বেশির ভাগ সময়।

সেদিন তার বাড়িতে দুপুরের খাওয়া শেষে তার মা হওয়ার গল্প শোনাল মধুমিতা। অক্সফোর্ডের পড়াশুনা শেষ করে মা-বাবার সঙ্গে এক মাসের ছুটিতে দেশে এসেছিল মধুমিতা। ওখানে কয়েকটা কাজের অফার ছিল। ফিরে গিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে এমনটাই ঠিক ছিল। এখানে থাকতে একদিন পুরনো বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে সুন্দরবন ঘুরতে গিয়েছিল মধুমিতা। একটা লঞ্চ ভাড়া করে তিনদিনের ভ্রমণ। সেই লঞ্চে চালকের সহযোগীদের মধ্যে তার বউও ছিল। বউ-এর কোলে তিন-চার মাসের একটা বাচ্চা। মধুমিতা লক্ষ করল বয়স্ক চালকের যুবতী বউটি প্রায়ই বাচ্চাটাকে ইঞ্জিন ঘরের মেঝেতে শুইয়ে রেখে অন্য একজন তরুণ সহযোগীর সঙ্গে হাসিগল্পে মজে থাকছে। বাচ্চাটা তারস্বরে কেঁদেই চলেছে, কোনো হুঁশ নেই বউটার। বাচ্চাটার কান্না মধুমিতার বুকে এসে বিঁধতে লাগল। থাকতে না পেরে বউটাকে গিয়ে ধরল, - তোমার বাচ্চা কাঁদছে, শুনতে পাচ্ছো না?

বউটা বলল, - আমার বাচ্চা কেনে হবে, ননদটা বিয়োতে গিয়ে মরেচে, তার সোয়ামিটাও খ্যাপাপাগলা। কেউ দায়িত্ব নিলনিকো – আমার ইনি সাধু সেজে মেয়েটাকে আমার ঘাড়ে চাইপ্পে দিল। আমার নিজেরই তিনটা আছে। সেগুলাকে ঘরে থুয়ে এসচি, এই কচিটার ভার কে লেবে? খিদার জ্বালায় কেন্দে মচ্চে, কত আর দুধ গুলে খাওয়াই!আমার মাই তো শুককে গেছে।

বাচ্চাটার কান্না মধুমিতার বুকে স্থায়ী হয়ে গেল। ফেরার সময় চালকের সঙ্গে কথা বলে তার ফোন নম্বর নিয়ে এসেছিল। কলকাতায় ফিরেই একজন অ্যাডভোকেটের সঙ্গে যোগাযোগ করল। দত্তক নেওয়ার আইনকানুন বুঝে নিয়ে চালককে সব জানাল। এদিকে লন্ডনে ফেরার সময় এসে গিয়েছিল। মধুমিতা গেল না। এই নিয়ে মা-বাবার সঙ্গে তিন দিন ধরে বাদানুবাদ চলল। মধুমিতা সংকল্প থেকে নড়ল না। তাঁরা ফিরে যাওয়ার পর দত্তক দলিল তৈরি হল। নির্দিষ্ট দিনে চালক মেয়েটাকে নিয়ে একাই এসেছিল। রেজিস্ট্রি হওয়ার পর লোকটির চোখে জল। বলল, - আমার অভাগী বুনের আত্মাটা শান্তি পাইল মা। একটা সোন্দর জীবন অনাথ মেয়েটার কপালে লেখা হয়ে গেল।

একটা বিখ্যাত পালিকা কেন্দ্রের সঙ্গে আগেই যোগাযোগ করেছিল মধুমিতা। এই ভদ্রমহিলা সেদিন থেকেই বাচ্চাটির দায়িত্ব বুঝে নিয়েছেন।

***

প্রোজেক্টের দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ বেশ উৎসাহের সঙ্গে শুরু করেছিলাম। একের পর এক উৎসেচকের ব্যবহার এবং ডিএনএ-এর বেস বদল করতে করতে এগিয়ে চলেছিলাম। আমি নিশ্চিত ছিলাম এই পদ্ধতিতেই জিন ফ্রিকোয়েন্সির এমন পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব যাতে উদ্দিষ্ট জিনগুলি স্থায়ীভাবে নিষ্ক্রিয় হবে। বছরখানেকের মধ্যেই আংশিক সফলতা এল। এমপ্যাথির জিন নিষ্ক্রিয় হল কিন্তু চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই সেগুলো আবার সক্রিয় হয়ে উঠল। আমি বিভিন্ন ভাবে চেষ্টা চালিয়েও নিস্ক্রিয়তাকে স্থায়ী করতে পারছিলাম না। দিনের পর দিন একই ফল পেতে পেতে আমার মনে একটা সন্দেহ দানা বাঁধল। ভালো করে খতিয়ে দেখে মনে হল, নিষ্ক্রিয় জিনের সক্রিয় হয়ে ওঠা স্বাভাবিক নয়, কেউ যেন এদের উপর রিভার্স পদ্ধতি অ্যাপ্লাই করছে। একটু ভাবতেই যেন ইলেকট্রিক শক লাগল মাথায়! মধুমিতা ছাড়া আর কারোর পক্ষে এটা করা সম্ভব নয়। তবে কি মধুমিতাই! কিন্তু কেন?

নিমেষেই মনে পড়ে গেল মধুমিতা একদিন কথাপ্রসঙ্গে বলেছিল, - এই প্রোজেক্টের পিছনে সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে ভেবেছেন স্যার? সহমর্মিতাহীন মানুষ মানে তো ভয়ংকর এক জীব। তাদের বুদ্ধি থাকবে, দক্ষতা থাকবে অথচ মানবিক বোধ থাকবে না। যে কোনও ধরনের পৈশাচিক কাজে তাদের ব্যবহার করতে পারবে সরকার। ধরুন এদের নিয়ে কোনো গুপ্ত বাহিনী গঠন করল সরকার। তারপর সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের সব ধরনের প্রতিবাদ, বিক্ষোভে এদের ব্যবহার করতে লাগল।

আমি বলেছিলাম, - এসব তো রাজনীতির কথা। আমরা বিজ্ঞানী, প্রকৃতির রহস্য উন্মোচন করাই আমাদের একমাত্র কাজ।

তর্ক না বাড়িয়ে চুপ করে গিয়েছিল মধুমিতা। প্রসঙ্গ পালটে অন্য কথায় ঢুকে পড়েছিল। এই মুহূর্তে ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেল আমার কাছে। মধুমিতা আগেভাগেই আমাকে সন্দেহপরায়ণ করে তুলতে চায়নি। তাহলে তাকে গবেষণা থেকে ছেঁটে দেওয়ার সম্ভাবনা ছিল।

প্রোজেক্টের সময়সীমা শেষ হতে দুটো মাসও বাকি নেই। মধুমিতাকে ছেঁটে দিয়ে নতুন করে আরম্ভ করার সুযোগ মিলছে না। আমার ক্যারিয়ারে এর আগে কোনোদিন ব্যর্থতার মুখ দেখতে হয়নি। সরকারের অগাধ আস্থা ছিল আমার উপর। সেটা তো গেলই, সেই সঙ্গে বিজ্ঞানী হিসাবে আমার বিশ্বাসযোগ্যতাও প্রশ্নের মুখে। এতখানি বিশ্বাসঘাতকতা করল মধুমিতা! নিমেষে সব রক্ত যেন মাথায় উঠে গেল আমার। রাগে উন্মত্ত হয়ে উঠলাম। দ্রুত পায়ে ল্যাব থেকে বেরিয়ে অফিস ঘরে ঢুকলাম। মধুমিতা তার চেয়ারে বসে কিছু একটা করছিল। আমি তার হাত ধরে হ্যাঁচকা টানে দাঁড় করিয়ে দিলাম, তারপর ডান আর বাঁ হাত দিয়ে সপাটে চড় কষাতে লাগলাম তার দুই গালে।

কতক্ষণ পরে থেমেছিলাম জানি না। মধুমিতা বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেনি, যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেখান থেকে এক চুলও সরেনি। আমি থামার পর ধীরে ধীরে বসল চেয়ারে। তার রক্তলাল দুই গাল বেয়ে ঝরে চলল অশ্রুধারা। তার ভেজা চোখ তখনও নিবদ্ধ আমারই দু-চোখে। জানি না সহসা কী দেখলাম সেই দৃষ্টিতে, তীক্ষ্ণ কিছু একটা এসে বিঁধে গেল আমার বুকে। আর আমার মন জুড়ে অনুভবের পরিব্যক্তি ঘটে চলল। আমি মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে মধুমিতার কোলে মুখ গুঁজে দিলাম।

***

সেদিনের পর মধুমিতা আর আসেনি। ক্যুরিয়ার মারফৎ তার পদত্যাগপত্র আমার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে। সেটা আজ অব্দি আমার ড্রয়ারেই পড়ে আছে। ইতিমধ্যে ঠাণ্ডা মাথায় আমি একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি। ল্যাবে উপাদান ছিলই। পটাসিয়াম সায়ানাইড তৈরি করতে সময় লাগেনি। দোকান থেকে পঞ্চাশটা ক্যাপসুলের একটা শিশি কিনলাম। ল্যাবে গিয়ে কুড়িটা ক্যাপসুল বের করে বাস্কেটে ফেলে দিয়ে একটা ক্যাপসুলের খোল খুলে সেটা খালি করে তার মধ্যে পটাসিয়াম সায়ানাইড ভরে নিলাম। শিশির বাকি ঊনত্রিশটা ক্যাপসুলের সঙ্গে সেটা মিশিয়ে বিছানার পাশের টেবিলে রেখেছি। বিজ্ঞানী হিসেবে আমি অনির্দেশ্য তত্ত্বে বিশ্বাসী। মৃত্যু নিশ্চিত করেছি বলে তার দিনক্ষণ নির্দিষ্ট করার অধিকার আমার নেই।

আজ পয়লা এপ্রিল। বেশ কিছুক্ষণ আগে সন্ধ্যা হয়েছে। ফাঁকা মগজ, শরীরময় আলস্য। মোবাইল বেজে উঠল। হাতে নিয়ে দেখি এখানের সুরক্ষার দায়িত্বে থাকা ইনস্পেকটর। বললেন, - মধুমিতা ম্যাডাম এসেছেন, কিন্তু সঙ্গে একটি ছোটো মেয়ে। কোনো অসুবিধে নেই তো স্যার?

অবাক হওয়ার উদ্যমও বুঝি অবশিষ্ট নেই আমার। একটি পরেই মধুমিতা তার মেয়েকে নিয়ে ঢুকল। আমি তাদের শোয়ার ঘরে নিয়ে এসেই বসালাম। নিচু হয়ে মেয়ের কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালাম। মধুমিতা বলল, - সরি স্যার।

কেন দুঃখপ্রকাশ জানতে চাইলাম না। মধুমিতা বলল, - সেকেন্ড ফেজের কাজ নতুন করে শুরু করেছেন তো স্যার। আমার মনে হয় বাকি এই এক মাসেই আপনি লক্ষ্যে পৌঁছে যেতে পারবেন।

মধুমিতা সোফায়। মেয়েটি আমার গা ঘেঁষে বিছানায় বসেছে। আমি তার চুলে হাত ডুবিয়ে বললাম, - মন্ত্রকে আবেদন করে সময় বাড়িয়ে নেওয়াও অসম্ভব হবে না, কিন্তু আমি সিদ্ধান্ত বদল করেছি মধুমিতা। তোমার মতো আমিও পদত্যাগপত্র লিখে রেখেছি। দুটো চিঠি একসঙ্গেই অফিসের ড্রয়ারে রাখা আছে। দুটোর স্বাক্ষর একই তারিখের। আমি দৈবাৎ ভুলে গেলে তুমি মন্ত্রকের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিও।

মধুমিতার চোখে যেন একটা চমক দেখলাম। তারপরেই তার চঞ্চল দৃষ্টি সারা ঘরে ঘুরতে লাগল। এই প্রথম এই ঘরে ঢুকেছে সে। তাই কি খুঁটিয়ে দেখছে? একটু পরে সোফা আর বিছানার মাঝখানে রাখা টেবিলে তার দৃষ্টি স্থির হল। সামান্য অস্বস্তি বোধ করলাম আমি। সে একটু ঝুঁকে ক্যাপসুলের শিশিটা খুঁটিয়ে দেখল। বলল, - রোজ খান?

উত্তর দিতে গিয়ে একটু থমকালাম। সামলে নিয়ে বললাম, - মাঝে মাঝে।

কয়েক মিনিট নীরবতা। মধুমিতার মেয়ে একটা মোটা বই খুঁজে বের করেছে। রঙিন ছবিওলা অ্যানাটমির বই। একমনে পাতা উলটে উলটে ছবি দেখে চলেছে। খুব শান্ত স্বভাবের মেয়ে। হঠাৎ মধুমিতা উঠে দাঁড়াল। বলল, - একবার ল্যাবে যেতে পারি স্যার?

আমি হাসলাম, - যাও না – স্যাবোটেজ করার কোনো সুযোগ তো আর নেই।

কোনো কথা না বলে দ্রুত বেরিয়ে গেল মধুমিতা। তখনই আমার মাথায় একটা দুশ্চিন্তা ঢুকল। ক্যাপসুলের কাজ করে আসার পর থেকে আর তো যাইনি ল্যাবে। সব এলোমেলো পড়ে আছে। বাস্কেটে অতগুলো ক্যাপসুল - কেসিএন তৈরির কোনো ক্লু ছেড়ে আসিনি তো?

বোধহয় মিনিট পনেরো পরে ফিরে এল মধুমিতা। সোফায় বসে খানিক আনমনা স্বরে বলল, - আপনার কোনোদিন কোনো মেজর অপারেশন হয়েছে স্যার?

--হঠাৎ এই প্রশ্ন?

--না, অচেতন থেকে চেতনায় ফেরার কথা ভাবছিলাম। একটা অপূর্ব অভিজ্ঞতা!

--তুমি কী অর্থে বলছো?

মধুমিতা কেমন যেন একটা হাসল। বলল, -- না না, অন্য কিছু নয়। মেজর অপারেশনের আগের অ্যানেস্থেসিয়ার কথাই বলছি। আমার হয়েছিল। লন্ডনে। তখন মাস্টার্স করছি। য়ুফেরেক্টমি, সিস্টের জন্য ওভারি বাদ দিতে হল। দুটোই।

আমি হতভম্ব। যতোটা না এই নিদারুণ সংবাদে, তার চেয়ে বেশি সেটা জানানোর সময় বাছার জন্য। কোনো একটা কার্যকারণ সম্পর্কের হদিশ হাতড়াচ্ছিলাম। তখনই সোফা থেকে উঠে এল মধুমিতা। যেন ছোঁ মেরে ক্যাপসুলের শিশিটা তুলে নিল হাতে। আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই শিশি হাতে ঘরের লাগোয়া বাথরুমে ঢুকে গেল। একটু পরেই ফ্লাশ টানার শব্দ পেলাম। চোখের সামনে দ্বিতীয় অন্তর্ঘাতটি ঘটাল মধুমিতা।

***

বারটা বাজল বোধহয়। ইংরাজি ‘বোকা দিবস’ অস্তে গেল। পয়লা মে যে আমার জন্মদিন সে-খবরটাও মধুমিতার জানা। এই মুহূর্তে সে সোফায় আধশোয়া। তার মেয়ে আমার কোলে মাথা রেখে বহুক্ষণ আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি মধুমিতা এবং আমার মাঝখানে থাকা টেবিলের শূন্যজায়গাটার দিকে তাকিয়ে মধুমিতার চূড়ান্ত অন্তর্ঘাতের প্রতীক্ষা করছি।


সৃষ্টির একুশ শতক, মার্চ ২০২১
0

গল্প - গান্ধর্বিকা ভট্টাচার্য

Posted in







কে? কে ওখানে?

হাল্কা সুতির পর্দার ওপারে কার যেন অবয়ব দেখা যাচ্ছে। রামেসিস একটু খাড়া হয়ে উঠে বসল।

কে?…তিয়ে! তিয়ে তুমি এসেছ? সত্যি? দূরে দাঁড়িয়ে কেন? আমার কাছে এস।

বয়সের সাথে বোধহয় মানুষের বুদ্ধিও ভোঁতা হয়ে যায়। নাহলে রামেসিস কখনও তিয়ের গায়ের সুগন্ধি চিনতে না পারে!

কি হল তিয়ে, কাছে আসবে না?

তিয়ে যেন একটু ইতস্তত করছে। তারপর ধীরে ধীরে পর্দা ঠেলে বেরিয়ে এল। যেন নববধূটি।

রামেসিস নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে থাকে। আজও তিয়ের রূপ তাকে পাগল করে দেয়। সেই কাজলটানা মদির চোখ, পাটে বসা সূর্যের চেয়েও লাল ঠোঁট, গোলকধাঁধার মতো রহস্যময় হাসি...

কি এক দুঃখ হঠাৎ তীর হয়ে তার বুকে বিঁধে যায়।

তুমি আর আমার কাছে আস না কেন, তিয়ে?

তিয়ে ধীরে ধীরে রামেসিসের কাছে এসে দাঁড়াল। আবার সেই রহস্যের চেয়েও গভীর হাসি – যা সহজ উত্তরকেও গোলমাল পাকিয়ে দেয়।

“তুমি জান না কেন আসি না?”

রামেসিস তিয়ের হাত দুটো টেনে একেবারে নিজের কোলের কাছে বসিয়ে নিল।

“জান তিয়ে, তোমাকে প্রথম যেদিন দেখেছিলাম পদ্মপুকুরের ধারে…পড়ন্ত সূর্যের আলো এসে পড়েছিল তোমার মুখের ওপর, সন্ধের হাওয়া তোমার চুলের সুগন্ধ সারা বাগানে ছড়িয়ে দিয়েছিল...আমার মনে হয়েছিল তোমার চেয়ে সুন্দর এই পৃথিবীতে কেউ নেই!”

তিয়ের চোখে বিদ্যুৎ খেলে গেল।

“সত্যি? আমি এত সুন্দর? কিন্তু ইতিহাসের পাতায় তো আইসিস আর তিয়িতির নাম লেখা হবে বলে শুনছি।”

রামেসিস তিয়েকে নিজের হাতের মধ্যে জড়িয়ে নেয়। ইয়ামোসে যেমন করে হাতে সাপ জড়িয়ে খেলা দেখায়।

“তুমি সাধারণ গৃহবধূ নও তিয়ে। তুমি রাজার স্ত্রী। এইসব কথা কি তোমার মুখে মানায়? আইসিসকে আমার বিয়ে করতে হয়েছিল রাজনৈতিক কারণে। আর তিয়িতি আমার বোন, তাকে তো স্বীকৃতি দিতেই হবে। সেসব তো প্রেমের বিয়ে নয়, তুমি সেকথা ভালোভাবেই জান।”

“তোমার অন্তঃপুরে কি শুধু আমরা তিনজনেই আছি?”

রামেসিস হেসে ফেলে। আজও মেয়েটার ছেলেমানুষী গেল না।

“আরো অনেকে আছে। কিন্তু তুমি আমার নেফারতারি। নেফারতারি তার স্বামীর সবচেয়ে প্রিয় স্ত্রী ছিল, জান তো? আমিও তোমার চোখে চাঁদ সূর্য উঠতে দেখি!”

তিয়ে এদিক ওদিক চোখ ঘোরাল।

“কই, নেফারতারির মতো আমার কোন মন্দির তো এখানে দেখছি না। আমাকে দেবী হাথরের প্রতিমূর্তি বলে আঁকা কোন ছবিও দেখছি না।”

“যার নামে আমার নামকরণ হয়েছিল, সেই রামেসিসও কি নিজের রাজধানীতে নেফারতারিকে স্বীকৃতি দিতে পেরেছিলেন? তাই তো মরুভূমি পেরিয়ে অতদূর যেতে হয়েছিল মন্দির বানানোর জন্য।”

তিয়ির চোখে ছায়া নেমে আসে।

“আমাদের ছেলেও তো শুনলাম রাজা হবে না।”

রামেসিসের হাতের বাঁধন শিথিল হয়ে আসে।

“নিয়ম অনুযায়ী আমার বড় ছেলেই রাজা হবে। এ নিয়ে তুমি আর জেদ ক'র না।”

“বড় ছেলে, তাই রাজা হবে, না তিয়িতির ছেলে তাই রাজা হবে?”

“এসব ঈর্ষা মনে পুষে রেখে তুমি কি পাচ্ছ, তিয়ে? দিন দিন তোমার আর আমার মধ্যের দূরত্ব বেড়েই চলেছে। পেন্তাওয়ারেতকে আমিও ভালোবাসি। সে আমারও ছেলে। কিন্তু ঐতিহ্য আর যোগ্যতা, দু'দিক থেকেই এই রাজ্য রামেসিসকেই যুবরাজ বলে দাবি করছে।”

তিয়ে রামেসিসের হাতের ওপর আঙুল বোলায়।

“তোমার আর আমার মধ্যের সব সমস্যা ওই সিংহাসনকে ঘিরে। তুমি আমার ছেলেকে যুবরাজ ঘোষণা করে দাও, আমি আবার আগের মতো তোমার কাছে ফিরে আসব। তুমি চাও না, আমি আবার আসি?”

“চাই…খুব চাই…”

কিন্তু…

“তুমি জান না তুমি কি চাইছ, তিয়ে। সিংহাসন চেয়ে তুমি পেন্তাওয়ারেতের জন্যে সুখের চাবিকাঠি কিনছ না।”

আমি রাজ্য অধিকার করে নিয়েছি, কিন্তু তোমাকে সুখের চাবিকাঠি দিয়ে যেতে পারব না...

হঠাৎ করে তিয়ের মুখটা পালটে গিয়ে বাবার মুখ হয়ে যায়। কিভাবে তা সম্ভব হল তা নিয়ে রামেসিস প্রশ্ন করে না। বরং ভাবে, কতদিন বাবাকে দেখেনি! তিরিশ বছরের ওপর তো বটেই।

“চারিদিকে শত্রুরা থাবা মেরে বসে আছে। রাজ্যের মানুষ যুদ্ধে যুদ্ধে জর্জরিত। বাড়িঘর ছেড়ে সবাই যুদ্ধক্ষেত্রে পড়ে আছে। এই সময়টা সিংহাসন কেড়ে নেওয়ার পক্ষে প্রশস্ত, সিংহাসন ধরে রাখার পক্ষে নয়। পারবে তুমি, নিজের পুরুষকার দিয়ে পরিস্থিতির গতি বদলে দিতে?”

“পেরেছি।”

নিজের গলা শুনে রামেসিসের কেমন অসঙ্গতি বোধ হয়। তারপর বুঝতে পারে। বাবা যখন মৃত্যুশয্যায় এই কথাগুলো বলেছিল তখন তা শুনেছিল তরুণ রামেসিস। আজ বর্ষিয়ান রামেসিস তার জবাব দিচ্ছে – যার যুদ্ধ জেতা বলিষ্ঠ হাত এখন কুঁচকে গেছে, দাড়িতে পাক ধরেছে, পেটের ডানদিকে চিনচিনে ব্যথা। রাজবৈদ্য গোপনে জানিয়েছে, রাজার দিন এখন হাতে গোনা মাত্র।

সেতনাখতে সামনে রাখা মদের পাত্র তুলে নিলেন। ঈষৎ ভুরু নাচিয়ে ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন,

“বটে? পেরেছ? তা কিভাবে পারলে?”

রামেসিস সামান্য ঝুঁকে বসল। এটা বাবার মৃত্যুশয্যা নয়। বরং দু'জন রাজা মুখোমুখি দুটো আরামকেদারায় বসে আছে, শুধুই খোশগল্প হচ্ছে।

“তুমি মারা যাওয়ার পরে রাজ্য জুড়ে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি ছিল।”

সেতনাখতে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন।

“রাজ্য দখল করেছিলাম শুধু। শাসন করার সময় পাইনি।”

“সেই জন্যই তো প্রথম কিছু বছর যুদ্ধ, বাণিজ্য, সবকিছু মুলতবি রেখে রাজ্যে ঐক্য আনার আর সেনাকে মজবুত করার কাজে লেগে পড়ি। পাঁচ বছর বাদে যখন লিবিয়ার শত্রুরা আক্রমণ করে, আমাদের সেনা তখন প্রস্তুত। সহজেই তাদের হারিয়ে দেয়। সেখান থেকে শুরু।”

সেতনাখতের মুখে কৌতুক ঝিলিক দিল।

“ওহো! লিবিয়ার ওরা আবার হেরে বাড়ি গেল বুঝি? জান নিশ্চয়ই, রাজা মারনেপ্টাহের সময়েও একই ব্যাপার হয়েছিল।”

রামেসিসের সামনেও ভেল্কির মতো মদের পাত্র এসে গেছে। সে চুমুক দিয়ে গলা ভিজিয়ে নিল।

“সে তো কিছুই না। আসল বিপদ ঘটল যখন সমুদ্র মানবরা আক্রমণ করল।”

“সমুদ্র মানব? কারা তারা?”

“পেলেসেত, দেনিয়েন, শারদানা, মেশোয়েশ – অসভ্য বর্বর জাতি সব। শুনেছি অনেক বড় বড় সভ্যতাকে নষ্ট করতে করতেই আসছিল। রাজ্যে এসে প্রথমে তারা স্থলপথে আক্রমণ করেছিল। জাহির যুদ্ধে তাদের হারিয়ে দিই। তখন তারা জলপথে আক্রমণ করে।”

“সেকি! আমাদের নৌবাহিনী তো খুবই দুর্বল! তুমি কি তাদেরও মজবুত করেছ?”

রামেসিস মাথা নেড়ে 'না' বলল।

“সেই সুযোগ পাই নি। আক্রমণের কথা জানতে পেরেই রাজ্যের সব জাহাজকে হুকুম দিলাম নীলনদের মোহনার মুখে চলে যেতে। সেনা না পৌঁছনো অবধি কেউ যেন জায়গা থেকে না নড়ে। জাহাজের পেছনে তীরন্দাজদের দাঁড় করিয়ে দিলাম। শত্রুর জাহাজ আসামাত্র তীরন্দাজরা নির্মম আক্রমণ শুরু করল। শত্রুপক্ষ তীরের জবাব দিতে ব্যস্ত এমন সময়ে আমাদের নৌসেনা ওদের জাহাজে উঠে পড়ে হাতাহাতি যুদ্ধ শুরু করে দিল। ওরা পালানোর পথ পেল না।”

“সাবাশ! এতো ঐতিহাসিক বিজয়!”

রামেসিস মনে মনে সম্মতি জানায়। আবার মদে চুমুক দেয়।

“লিবিয়ার নির্লজ্জগুলো আরেকবার আক্রমণ করেছিল, আবার গোহারান হেরে ফেরত গেছে। তারপর থেকে সীমান্ত সুরক্ষিতই রয়েছে।”

সেতনাখতে নাকের ডগাটা চুলকে নিলেন। রামেসিসের মনে পড়ল, কোন অপ্রিয় প্রসঙ্গ তোলার আগে এটা করা বাবার অভ্যেস ছিল।

“তা, রাজ্যের লোকজন এসব ঘটনার ব্যাপারে কি মনে করে?”

“যুদ্ধ হলে স্বাভাবিকভাবেই ভাণ্ডারে টান পড়ে। সবাই তাই নিয়ে খুশী হয় না। বিশেষ করে যুদ্ধ যখন নিজের সীমান্তে হয় তখন ক্ষয়ক্ষতির আকড় লুকিয়ে রাখা একটু মুশকিল হয়ে যায়। তার ওপর ভালো শস্য না হওয়ার দরুন সেত মা'আত হের ইমেনতি ওয়াসেতের কবর খননকারী আর চিত্রশিল্পীদের মাইনে আর খাবার পৌঁছাতে কিছু দেরি হয়েছিল।”

“তাই নিয়ে তারা বিদ্রোহ শুরু করে?”

“বিদ্রোহ ঠিক নয়, কর্মবিরতি বলতে পার। মন্দিরের সামনে ধর্না দিয়েছিল বলে শুনেছি।”

“কর্মবিরতি? ধর্না? এমন অদ্ভুত কথা জীবনে শুনিনি!”

“সব খবর আমার কানেও আসেনি। আমার মন্ত্রীরাই সামলে নিয়েছে।”

“এখন পরিস্থিতির কিছু উন্নতি হয়েছে?”

রামেসিস আরামকেদারায় হেলে বসল।

“সমস্যা এখনো চলছে। কিন্তু পুন্তের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক রেখেছি। তিমনার খনি থেকে প্রচুর পরিমাণ তামা আনিয়েছি। সাইনাই থেকে দামী পাথর এসেছে।”

“আর মন্দির? নতুন স্থাপত্য কিছু বানিয়েছ?”

“আমার জন্য 'তৃতীয় রামেসিসের কোটি বছরের আবাসন, চিরকালের জন্য আমুন ভগবানের রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত' বানিয়েছি। তাছাড়া রাজ্যের অনেক মন্দিরে জমি দান করেছি, সোনার মূর্তি বসিয়েছি।”

“তার মানে আমি রাজ্যকে যে অবস্থায় রেখে গেছিলাম তুমি তার আমূল পরিবর্তন করে ফেলেছ। তোমার ছেলের জন্য সুরক্ষিত, শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি রেখে যাচ্ছ, যা আমি তোমার জন্য করে যেতে পারিনি।”

রামেসিস গালের ওপর হাত বুলিয়ে নিল।

“জানিনা, বাবা। রামেসিস বার বছর বয়স থেকেই যুবরাজ হয়েছে। অনেক কাজ শিখেও উঠেছে। কিন্তু রাজা হওয়ার অভিজ্ঞতা নেই। মোটে একুশ বছর বয়স ছেলেটার। ও কি পারবে সামলাতে?”

“আলবাত পারবে!” সেতনাখতে হাঁটুতে চাপড় মেরে বলেন। “একুশ বছর বয়সে জানার আগ্রহ থাকে, শেখার আগ্রহ থাকে। রাজার ভূমিকা পালন করতে করতে অভিজ্ঞতা আপনেই এসে যাবে। কিন্তু তুমি…”

দেখতে দেখতে সেতনাখতের মুখ এক দিব্য আভায় ভরে উঠল।

“তুমি যেভাবে আমার বংশে গরিমা এনেছ, যেভাবে আমাদের মুখ উজ্জ্বল করেছ, তার জন্য ইতিহাস তোমাকে চিরকাল মনে রাখবে। আমার আশির্বাদ আর মা'আতের কৃপায় তুমি অনন্তকাল আমুনের রাজ্যে বাস কর।”

“সত্যি? সত্যি বলছ?”

কিন্তু সেতনাখতে ততক্ষণে মিলিয়ে গেছেন। তাঁর জায়গায় রাখা আছে তুলাদণ্ড। তার একদিকে মা'আতের পালক। অন্যদিক ফাঁকা। রামেসিসের হৃৎপিণ্ড সেখানে রেখে যাচাই করা হবে। সামনে আনুবিস দাঁড়িয়ে৷ আর কিছু দূরে হোরাস।

এ তো শেষের বিচার…

“রামেসিস,” আনুবিস গম্ভীর গলায় ডাক দেন, “তুমি কি পেরেছ রাজা হিসেবে সফল হতে? মা'আতকে ধরে রাখতে পেরেছ? তুমি দেশের রাজা – অন্য সব পরিচয়ের থেকে এটাই কি তোমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিচয় হয়েছে?”

রামেসিস ভুরু কুঁচকে চিন্তা করে। চোখের সামনে এক এক করে ছবি ভাসতে থাকে – সমুদ্র মানবদের বিরুদ্ধে লড়াই, লিবিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই, রামেসিসকে যুবরাজ ঘোষণা করা, দুর্নীতিবাজ মন্ত্রীদের বরখাস্ত করা, মন্দির বানানো…

তারপর হঠাৎ করে সব মুছে গিয়ে তিয়ের মুখটা ভেসে ওঠে।

“তোমার বাবার প্রশংসার এখানে কোন জায়গা নেই,” আনুবিস কঠোর স্বরে বলে চলেন, “তোমার নিজের হৃদয়কে যাচাই করে দেখ, তুলাদণ্ডে ফেললে তার কি পরিণতি হবে।”

রামেসিস তিয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। নিষ্পলক।

প্রিয়তমা স্ত্রী তিয়ে…আমার নেফারতারি…

কিন্তু…

রামেসিস আর তিয়ের মধ্যে যোজনব্যাপী দূরত্ব তৈরী করা সেই 'কিন্তু'…

আমাকে ক্ষমা কর তিয়ে, শুধু তোমার স্বামী হয়ে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তোমাকে যতই ভালোবাসি না কেন, রাজার কর্তব্যকে অবহেলা করে তোমার অন্যায় আবদার মানতে পারব না।

“এটাই কি তোমার সিদ্ধান্ত?” আনুবিস প্রশ্ন করেন।

“…হ্যাঁ…”

পর্দার আড়ালে টুংটাং আওয়াজ ওঠে। ঘরের মধ্যে পদ্মের সুগন্ধ ফেলে রেখে তিয়ের অবয়ব মিলিয়ে যায়। শুধু তেরচা করে আসা চাঁদের আলো রামেসিসের বন্ধ চোখের ওপর আলতো করে আঙুল বোলায়।

রাত আরো গভীর হলে ধারাল অস্ত্র হাতে আততায়ীর দল রাজার ঘরে ঢুকে আসে। রাজা তখন আরামের বিছানায় অঘোরে ঘুমিয়ে। মুখে প্রশান্তির হাসি।

****

সেদিন সন্ধেবেলায় গুপ্তচর এসেছিল। রামেসিস তখন রাজ্যের করব্যবস্থা দেখতে মগ্ন। গুপ্তচরকে দেখে ভুরু তুলে জিজ্ঞেস করলেন, কি সংবাদ?

গুপ্তচর কয়েক পা এগিয়ে এল। গলা নীচু করে বলল,

“সংবাদ ভালো নয়, মহারাজ। রানী তিয়ে তাঁর ছেলে রাজপুত্র পেন্তাওয়ারেতকে রাজা করার জন্য চক্রান্ত করছেন। রাজপ্রাসাদেরই কয়েকজন সদস্য চক্রান্তের মধ্যে আছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।”

“কেমন চক্রান্ত?”

গুপ্তচর গলা আরো নামিয়ে আনল।

“মহারাজের প্রাণ সংশয় হতে পারে।”

“কবে?”

“সে খবর এখনো পাইনি। সম্ভবত কিছু ঠিক হয়নি এখনো।”

“বুঝলাম।”

রামেসিস চোখ বন্ধ করে বসে রইল।

তিয়ে? শেষটায় তিয়ে আমাকে মারতে চায়?

সেটা অবশ্য বিষ্ময়কর নয়। খুব ঈর্ষা, খুব অভিমান তার। আর উচ্চাকাঙ্ক্ষাও খুব। নিজেই কতবার বলেছে পেন্তাওয়ারেতকে রাজা করার কথা। রামেসিস প্রত্যেকবার হেসে উড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু… এবার তো মহা ফ্যাসাদ হল।

“ইহজগতের দুঃখ আর আপনাকে বেশীদিন ভোগ করতে হবে না।”

রাজবৈদ্যের বলা কথাগুলো রামেসিসের কানে বাজতে থাকে।

কারা চায় না আমার পরে রামেসিস রাজা হয়? যুদ্ধ-বিগ্রহের কারণে রাজভাণ্ডার খালি হয়ে যাচ্ছে বলে যারা অনুযোগ করছে তারা? নাকি তাদের অন্য কোন দাবি আছে? তাদের বিরুদ্ধে, বিশেষতঃ তিয়ে আর পেন্তাওয়ারেতের বিরুদ্ধে প্রমাণ জোগাড় হওয়ার আগেই যদি আমার দিন ফুরিয়ে যায়?

তাহলে আমার মৃত্যুর পরে গৃহবিবাদ লেগে যাবে। রামেসিসের বিরুদ্ধে পেন্তাওয়ারেতকে সদস্য খাড়া করে চক্রান্ত চলতে থাকবে। আমার অন্য ছেলেরাও সুযোগ বুঝে দাঁও মারার চেষ্টা করবে। রামেসিসের মাত্র একুশ বছর বয়স। এই বয়সে রাজার দায়িত্ব বুঝে নিতেই ওর সময় চলে যাবে। তার ওপর গৃহবিবাদ সামলানো ওর দ্বারা সম্ভব হবে না। আর এসব খবর বাইরে গেলে শেয়াল কুকুরের দলের থাবা মারতে ছুটে আসতে সময় লাগবে না। আমার সারা জীবনের চেষ্টায় রাজ্যে যে শান্তি, যে সুরক্ষা এনেছি, এক মূহুর্তে তা নষ্ট হয়ে যাবে।

টুকরো টুকরো ছবি পরপর বসে গালিচা বনে যায়। রামেসিসের মাথায় সমাধানটা স্পষ্ট হয়।

নাঃ, আমাকে তিয়ের চক্রান্তেই মরতে হবে। আর তিয়ে আর পেন্তাওয়ারেতকে আমার সঙ্গে মরতে হবে। রাজদ্রোহের দায়ে তাদের মৃত্যুদণ্ড পেতে হবে। গুপ্তচরের খবর এতক্ষণে রামেসিসের কাছেও পৌঁছে গেছে। কাল আমার মৃতদেহ পাওয়া গেলে রামেসিস অনুসন্ধান শুরু করতে পারবে। উত্তরাধিকারের লড়াই তখন খুনের মামলায় রূপান্তরিত হবে। চক্রান্তকারীরা হয়ে যাবে রাজদ্রোহী। তবেই রামেসিসের হাতে সুরক্ষিত রাজ্য তুলে দিতে পারব। আমার পূর্বপুরুষদের কাছে মুখ দেখাতে পারব। বলতে পারব, নিজের পুরুষকার দিয়ে ভাগ্যের প্রতিকুলতাকে জয় করতে পেরেছি।

রামেসিস যখন চোখ খুলল ঘর তখন খালি। গুপ্তচর রাতের অন্ধকারে মিলিয়ে গেছে। কিছুক্ষণ চিন্তা করে সে প্রধান পরিচারক পেবেক্কামেনকে ডেকে পাঠাল।

তিয়ে যদি সত্যিই আমার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করে থাকে, তাহলে আমার প্রধান পরিচারককে দলে না নিয়ে তার উপায় নেই। একটা হিসেবের খেলা খেলে দেখি, কি হয়।

“মহারাজ ডেকেছেন?” মার্জিত দূরত্বে দাঁড়িয়ে পেবেক্কামেন মাথা নোয়াল।

“হ্যাঁ। আজ আমার রাতের খাবারের পরে তুমি মদের ব্যবস্থা করবে।”

“যথা আজ্ঞা।”

“সে মদ যেন এমন হয় যে হাজার ডাকাডাকিতেও আমার সারারাত ঘুম না ভাঙে।”

মূহুর্তের জন্যে পরিচারকের মুখের অভিব্যক্তি কি পালটে গেল, না তা শুধুই রাজার কল্পনা?

“অবশ্যই, মহারাজ।”

“যাও, প্রস্তুতি শুরু কর।”

পেবেক্কামেন চলে গেলে রাজা মিটিমিটি হাসে। সুখের চাবিকাঠি পরপারের সম্পত্তি। এই পৃথিবী শুধুই দুঃখ ভোগ করার জন্য। একদিন চলে যেতে হবে সবাইকেই।

কিন্তু রাজার চাল চেলে যাওয়ার মতো সৌভাগ্য হয় ক'জনের?



· হারেম চক্রান্ত : প্রাচীন মিশরের রাজা তৃতীয় রামেসিসের স্ত্রী তিয়ে এবং রাজার হারেম এবং প্রাসাদের কিছু সদস্য মিলে রাজাকে হত্যা করেন, তিয়ের ছেলে পেন্তাওয়ারেতকে রাজা করার জন্য। কিন্তু চক্রান্তকারীরা ধরা পড়ে যান, এবং অধিকাংশই মৃত্যুদণ্ড পান। তৃতীয় রামেসিসের হত্যার পর তাঁর ছেলে চতুর্থ রামেসিসই রাজা হন।
0

গল্প - বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায়

Posted in






সে বালিকা না কিশোরী সে নিজেই জানে না। অট্টালিকার প্রাচুর্য তাকে টানে না। কিন্তু এই হর্ম্যের রহস্য তাকে আকর্ষণ করে।কেন করে সে বোঝেনা।
এই যে পাখিটি বারান্দায় উড়ে এসে জুড়ে বসল তার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে হয়... তার গায়ে এত রঙের বাহার।সে এগিয়ে যায়।তার কৌতুহল আন্তরিক। পাখি তাকে বিশ্বাস করেনা।সে একটা বিচিত্র শব্দ করে উড়ে যায়। সকালের অপরূপ সৌন্দর্য ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে। উদ্যান পরিপাটি। তার চোখে মুখে মৃদু আনন্দ ও বিস্ময়।সে এখন কী করে? প্রত্যেক নারী কি এই সংশয়ে ভোগে? সদ্য বালিকার সব প্রশ্নের উত্তর হয়না।
সে নিজের দিকে তাকিয়ে বিস্মিত হয়। তৎক্ষণাৎ ছুটে গিয়ে নিজের কক্ষে দর্পণে নিজেকে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে।তার চোখ এতো গভীর আর টানা টানা? ভুরু আর চোখের পাতা এতো সুন্দর?এতো দীর্ঘ আর কালো তার চুলের ঐশ্বর্য?সে এখনই ৫ ফুট ৫, আরও লম্বা হবে?,,,তার আঙুল, তার নখ,তার কটিদেশ, তার পায়ের গড়ন এ সব কবে হল? কীভাবে হল?সে রঙ লাগায় না। তবু তার ওষ্ঠ, তার হাত ও পায়ের নখগুলো এতো উজ্জ্বল।সদ্য অঙ্কুরোদগম হয়েছে তার। ব্যথা লাগে কোথাও তবু সে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সেই সামান্য উদ্ভাসিত মুকুলের দিকে।যেন এক মহা সমারোহে প্রকৃতির মতো সেও বেড়ে উঠছে। শুধু সেই অদৃশ্য জায়ফলটিকে সে চেনেনা।
তার একটাই অভাব যে তার কোনো অভাব নেই।
স্নানের ঘর থেকে পরিচ্ছন্ন হয়ে আসার পর সে‌ কিছুক্ষণের জন্য একাকীত্ব হারিয়ে ফেলবে। এটাই এ বাড়ির নিয়ম। প্রাতরাশ টেবিলে সাজিয়ে রাখা টাটকা ফল,ফলের রস,দুধ, ডিমের পোচ, ওটস ইত্যাদির মধ্যে সে পছন্দ মতো খাবার বেছে নিতে পারে। সেই স্বাধীনতা সে অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে দুবছর আগে।
তার মা একজন গরিষ্ঠ সমাজ কর্মী.. ব্যস্ত মানুষ।
তার বাবা এই উপনগরীর সম্মানীয় আইনজীবী।সে একমাত্র সন্তান। পৈতৃক সূত্রে অর্জিত এই সুরম্য অট্টালিকা রক্ষা করতে লোকবল ও অর্থ লাগে।যা তাদের আছে।
সে এখানকার সবচেয়ে অভিজাত বালিকা বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে।
গাড়িতে করে ইস্কুলে যাওয়া আসার ফাঁকে সে দেখতে পায় পায়ে হেঁটে, সাইকেল রিক্সায় , ভ্যানে চেপে মেয়েরা ইস্কুলে যায়। তাদের বিনুনির মধ্যে খেলা করে হালকা রোদ্দুর,পাশ থেকে উড়ে আসে পতঙ্গের মৃদু গুঞ্জন।দূর থেকে এসব দেখতে ভালোই লাগে।
এই বালিকার কোনো নাম নেই? অবশ্যই আছে। নামে কি আসে যায়?

তার ক্লাসে মহিমা নামে একটি বালিকা আছে। তথাকথিত সুন্দরী নয়। কিন্তু পড়াশোনায় তুখোড়।সে অবলীলায় প্রথম হয় পরীক্ষায়.. অবহেলায় সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে।
মহিমার সঙ্গে তার সহজ সম্পর্ক। অথচ কোথায় একটা দূরত্ব আছে।
1

গল্প - মনোজ কর

Posted in




















১৯ পর্ব

ব্রিটিশদের লুন্ঠন এবং ছিয়াত্তরের মন্বন্তর

ব্রিটিশের এই লুণ্ঠন চলতে থাকে দীর্ঘ সময় ধরে। ঐতিহাসিকেরা বলেন ১৭৫৭ থেকে ১৮১৫ সাল (পলাশি থেকে ওয়াটারলু) পর্যন্ত লুন্ঠনের পরিমাণ তখনকার হিসাবে প্রায় ১০০ কোটি পাউন্ড যার আজকের হিসাবে অর্থমূল্য ২২৫০০ কোটি পাউন্ড অথবা কুড়িলক্ষ কোটি টাকা!! (তথ্যসূত্র পি জে মার্শাল রচিত প্রবলেমস অফ এম্পায়ার –ব্রিটেন এন্ড ইন্ডিয়া-১৭৫৭-১৮১৭)। ঈশ্বরপ্রেরিত এই সম্পদে একেবারে ফুলে ফেঁপে উঠলো ব্রিটেন।বাংলার শরীর থেকে নির্গত রক্তের রঙ লাল থেকে সাদা হয়ে প্রবাহিত হতে থাকলো ব্রিটেনের দিকে বছরের পর বছর ধরে। ইতিমধ্যে ১৭৬৯-৭০ এ প্রকৃতি বাধ সাধলো।বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে যাওয়ার কারণে সে বছর ধান এবং অন্যান্য শস্যের ফলন ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হলো। চাষীদের ঘরে হাহাকার উঠলো। নদীয়ার উত্তর থেকে বিহারের বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্রায় শস্যহীন হয়ে পড়লো। ভারতীয় এবং ব্রিটিশ ব্যবসায়ীরা যারা আগে থেকে আন্দাজ করতে পেরেছিল যে শস্যাভাবে এবং খাদ্যাভাবে ধুঁকতে শুরু করবে বাংলা এবং বিহারের বিস্তীর্ণ অঞ্চল তারা আগেভাগে ধান এবং শস্য কমদামে কিনে গুদামে মজুত করে রাখলো। এই রক্তচোষা মজুতদারেরা বারে বারে দুর্ভিক্ষ এবং যুদ্ধের সুযোগ নিয়ে মুনাফার পাহাড় বানিয়েছে। পরে সেই মজুত করা শস্য দ্বিগুন তিনগুন দামে বিক্রি করতো এই মজুতদারেরা। ১৭৭০ সালের গ্রীষ্মে অবস্থা চরমে উঠলো। শ’য়ে শ’য়ে মানুষ মারা যেতে শুরু করলো। নিরুপায় মানুষ তাদের গরু ছাগল, চাষের সরঞ্জাম দুমুঠো ভাতের জন্য জলের দরে বিক্রি করে দিল মজুতদারদের কাছে। নিজেরা বাঁচার জন্য নিজের ছেলে মেয়েদের বিক্রি করে দিতে লাগলো মানুষ। অবশেষে যখন আর ছেলে মেয়ে বিক্রি করার জন্য খদ্দের পাওয়া গেলনা তখন গাছের পাতা চিবিয়ে খেতে শুরু করেছিল মানুষ শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্য। মানুষের মৃতদেহ শিয়াল কুকুরের সঙ্গে ভাগ করে খেয়েছিল মানুষ। ত্রিশলক্ষ দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের মধ্যে দশলক্ষ মানুষ মারা গিয়েছিল কয়েকমাসে। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে এই ভয়ঙ্কর সময়ে কোম্পানি ডিরেক্টররা প্রশাসনের কাছে কম খাজনা আদায়ের জন্য কৈফিয়ত চেয়ে চিঠি পাঠালো । সেইসময় খাজনা আদায়ের প্রধান আধিকারিক ওয়ারেন হেস্টিংস যে পরবর্তীকালে ১৭৭৩ সালে বাংলার গভর্নর জেনারেল পদে আসীন হয়েছিল সে নিশ্চিত করেছিল যে খাজনা আদায়ের পরিমাণ তার আগের বছরের চেয়ে যেন কম না হয়। কিছু কিছু জেলায় আদায়ের পরিমাণ কম হলেও মোট আদায়ের পরিমাণ একই ছিল বলে জানা যায়। ত্রাণের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে খরচের পরিমাণ ছিল ৯০০০ পাউন্ড অর্থাৎ আজরের হিসাবে কুড়িলক্ষ পাউন্ড অথবা ১৮ কোটি টাকা।

মিরকাশিমের হাতে জগতশেঠ মাধবরাই আর তার ভাইপো মহারাজ স্বরূপচাঁদ নিহত হবার পর জগৎশেঠেরা আর তাদের হৃতগৌরব ফিরে পায়নি। মাধবরাই এর বংশধরেরা আরও বেশ কিছুদিন ব্যবসায় টিকে থাকার চেষ্টা করেছিল। এমনকি ১৭৬৪ সালে ব্রিটিশ সরকার তাদের কাছ থেকে পাঁচ লক্ষ টাকা ধারও নিয়েছিল। সম্পর্ক আরও কিছুদিন চলেছিল যদিও স্পষ্টতই জগৎশেঠেদের ব্যবসা পরিকল্পিত ভাবেই ব্রিটিশরা খতম করে দিচ্ছিল। পলাশি পরবর্তী সময়ে কোম্পানির আর্থিক উন্নতি এমন পর্যায় গিয়ে পৌঁছোয় যে ইউরোপ থেকে বুলিয়ন নিয়ে আসার আর কোনও প্রয়োজন ছিল না। জগৎশেঠেরা এই সুবিধা ছাড়তে চাইছিল না। ১৭৫৮ সালে কাউন্সিল অফ কলকাতা মোগলরাজের কাছে নালিশ করলো যে তাদের ট্যাঁকশাল ব্যবসার জন্য আর কোনও কাজে লাগছে না। এর প্রথম কারণ ইউরোপ থেকে কোনও বুলিয়ন আসছে না। দ্বিতীয়ত জগৎশেঠেদের কাছে সঞ্চিত বিপুল পরিমাণ মুদ্রা ব্যবসায় বিনিয়োগ না হওয়ার জন্য সিক্কার বিনিময়মূল্য ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। ১৭৫৯ সালে ক্লাইভ নিজে ১৭৭৩৪ টাকা খরচ করে হীরা -জহরতসহ প্রচুর উপঢৌকন দিয়ে জগতশেঠকে অ্যাপ্যায়িত করেও কোনও কাজ হয়নি। অবশেষে ১৭৬০ সালে ট্যাঁকশাল হস্তান্তরের আদেশনামার সর্ত্তে মিরকাশিমকে মিরজাফরের ওপরে বসাল ব্রিটিশরা। সেই দিন থেকে মুর্শিদাবাদের ট্যাঁকশালের পতন শুরু হল এবং কিছুদিনের মধ্যেই মুর্শিদাবাদ থেকে চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে গেল ট্যাঁকশাল। তার সঙ্গে সঙ্গেই জগৎশেঠেদের সৌভাগ্যসূর্য অস্তমিত হয়ে গেল ভাগীরথীর জলে। কোম্পানি আর ব্রিটিশদের সৌভাগ্যসূর্য বিরাজ করতে শুরু করলো মধ্যগগনে। ট্যাঁকশালের ওপর জগৎশেঠেদের একাধিপত্য বিলুপ্ত হওয়া সত্ত্বেও কোম্পানির কোর্ট অফ ডিরেক্টরস সিদ্ধান্ত নিল যে সরকার যে টাকা জগৎশেঠেদের কাছ থেকে ধার নিয়েছিল তা ফিরিয়ে দেওয়া হবে। বলা হলো- যে পরিবার কোম্পানির উন্নতির জন্য এত সাহায্য করেছে তাদের রক্ষার দায়িত্ব কোম্পানির কর্তব্য। অনতিবিলম্বেই ব্রিটিশ ব্যবাসায়ীরা এজেন্সি হাউস তৈরি করে অন্যান্য ব্যবসার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাঙ্কিং ব্যবসায় নেমে পড়লো। ইউরোপিয়ন ব্যবসায়ীরা তাদের ক্রমবর্ধমান পুঁজি সঞ্চিত রাখার জন্য নিরাপদ ব্যাঙ্কিং এজেন্সির সন্ধানে ছিল এতদিন। নতুন এজেন্সি হাউস ব্যবসায়ীদের পুঁজির টাকা গচ্ছিত রেখে ধার দেবার কারবার শুরু করলো। ১৭৭০ সালে তৈরি হলো পশ্চিমি কায়দায় তৈরি নতুন ব্যাঙ্ক –ব্যাঙ্ক অফ হিন্দুস্তান। অবশেষে ১৭৯৯ সালে ট্যাঁকশালের যন্ত্রপাতি এবং বাড়ি নিলাম করে দেওয়া হলো। জগৎশেঠেদের বিপুল সম্পত্তির এক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ এখনও আছে মুর্শিদাবাদে যা দেখবার জন্য ভারতের লোকেরা ১৫ টাকার আর বিদেশিরা ১০০ টাকার টিকিট কিনে ভিতরে প্রবেশ করে এখন।

খোশবাগ একসময় ছিল মুর্শিদাবাদের রাজা মহারাজা আর বর্ধিষ্ণু লোকেদের নৌকাবিহারের কেন্দ্র। ১৭৪০ সালে নির্মিত এই বিলাস উদ্যানের সংলগ্ন নদীর ঘাটে বড় বড় লোকেদের ময়ূরপঙ্খী এসে ভিড়ত সন্ধ্যাবেলা। বিলাসব্যসনে মত্ত হয়ে উঠত মুর্শিদাবাদের ধনী সম্প্রদায়। আজ সেই বাগানে সারি সারি মৃত মানুষের সমাধি। তারা কেউ প্রেমিক, কেউবা চক্রান্তকারী আবার কেউবা বিশ্বাসঘাতক। প্রথম সমাধিগুচ্ছে কারও নাম লেখা নেই। সেখানে শায়িত আছে আলিবর্দির পত্নী, সিরাজের মাতামহী সার্ফুন্নিসা। অনতিদূরেই আলিবর্দির জ্যেষ্ঠাকন্যা, সিরাজের বড় মাসি ঘসেটি বেগমের সমাধি। এই ঘসেটি বেগম তার অন্য এক বোনের ছেলে পূর্ণিয়ার নবাব শওকত জংকে সিরাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে উস্কানি দিয়েছিল এবং যার ফলস্বরূপ অকালে সিরাজের হাতে প্রাণ দিতে হয়েছিল শওকত জংকে। তাছাড়াও সিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে ক্লাইভকে যুদ্ধজয়ে সাহায্য করেছিল এই ঘসেটি বেগম যার পোশাকি নাম ছিল মেহেরুন্নিসা। তার পাশেই শায়িত ঘসেটি বেগমের ছোট বোন , সিরাজের মাতা, আমিনা বেগম।

এই সমাধিগুচ্ছ থেকে একটু দূরে সতেরটি সমাধি। এরা সবাই সিরাজের পরিবারের লোক যাদের এক অভিশপ্ত নৈশভোজে খাদ্যে এবং পানীয়ে বিষ মিশিয়ে হত্যা করেছিল মিরজাফরের পুত্র মিরান। সিংহাসনের অন্য কোনও দাবিদার থাকার সম্ভাবনাকে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করে দেওয়ার জন্য সিরাজকে হত্যার অব্যবহিত পরেই এই নৈশভোজের আয়োজন করেছিল মিরান।একটু দূরে বাঁদিকে ফকির দানা শাহের সমাধি। পলায়নরত ক্ষুধার্ত সিরাজ ক্ষণিকের জন্য ছদ্মবেশে আশ্রয় নিয়েছিল এই ফকিরের দাতব্য সরাইখানায়। কিন্তু দানা শাহ সিরাজকে চিনতে পেরে অর্থের লোভে নিদ্রিত সিরাজকে তুলে দেয় মিরকাশিম আর মিরানের হাতে। উপহারস্বরূপ এক হাজার টাকা উপহার দেওয়ার পর দানা শাহকে হত্যা করে মিরান।

এর পরে চারদিক ঘেরা কাঠের থাম এবং প্লাস্টারের ছাদবিশিষ্ট একটি হলঘরে সিরাজের সমাধি। তারই পাশে সিরাজের বিশ্বস্ত অনুচর গুলাম হোসেনের সমাধি। এই গুলাম হোসেনের সঙ্গেই পোশাক বিনিময় করে ছদ্মবেশ ধারণ করে সিরাজ। কিন্তু তার পায়ের জুতো দেখে তাকে চিনতে পেরে যায় দানা শাহ। গুলাম হোসেনের সমাধির দু’পাশে শায়িত আছে সিরাজের হারেমরক্ষক দুই খোজা। মিরান এদেরও হত্যা করেছিল।

সিরাজের নিরাভরণ সমাধির ওপর কোনও কোনও দর্শনার্থীর রাখা গোলাপ, গাঁদা বা অন্য কোনও একটি দু’টি ফুল ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না। বোঝাই যায়না এখানেই শায়িত আছে ব্রিটিশের ত্রাস , দোর্দন্ডপ্রতাপ নবাব সিরাজদ্দৌল্লা। সিরাজের সমাধির পায়ের কাছে শায়িত তার পত্নী লুৎফুন্নিসা। তার ডানদিকে সিরাজের একসময়ের প্রেমিকা, নর্তকী এবং সিরাজের বিশ্বস্ত সেনাপতি মোহনলালের বোন আলিয়ার সমাধি। সিরাজের মৃত্যুর পর তার মা, মাসি, স্ত্রী, কন্যা জোহরা এবং আরও কয়েকজন আত্মীয়া ও পরিচারিকাকে ঢাকার জিঞ্জিরা প্রাসাদে পাঠিয়ে দেয় মিরান। সেখানে থেকে নৌকাবিহারের নাম করে বুড়িগঙ্গায় নিয়ে গিয়ে কয়েকজনকে জলে ডুবিয়ে হত্যা করে মিরান। সিরাজের মা এবং মাসি কী ভাবে মারা যায় তা এখনও অজ্ঞাত। কিন্তু কথিত আছে সিরাজের মৃত্যুর পর মিরজাফর এবং মিরান দু’জনেই লুৎফুন্নিসার পানিপ্রার্থনা করে। পিতা এবং পুত্র দু’জনকেই প্রত্যাখ্যান করে সে। ১৭৬৫ সালে কোম্পানি লুৎফুন্নিসা এবং তার মেয়েকে মুর্শিদাবাদে ফিরিয়ে নিয়ে এসে মাসোহারা ও খোশবাগেই থাকার ব্যবস্থা করে। লুৎফুন্নিসা তার বাকি জীবনের প্রতিটি দিন সিরাজের সমাধিতে মোমবাতি জ্বালিয়ে মাথা ঠেকিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিত। এমনি ভাবে পঁচিশ বছর কাটিয়ে পতিশোকে অর্ধোন্মদিনী লুৎফুন্নিসা ১৭৯০ সালে মারা যায়। একেবারে বাঁদিকের সারির প্রথমে আলিবর্দির সমাধি।তার নিচে সিরাজের কন্যা জোহরার সমাধি। আলিবর্দির বাঁদিকের দু’টি সমাধি শওকত জং এবং তার স্ত্রী মোতি বেগমের। মিরজাফর, ঘসেটি বেগম এবং অন্যান্য চক্রান্তকারীদের উস্কানিতে শওকত জং সিরাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং সিরাজের মৃত্যুর একবছর আগে সিরাজের হাতেই নিহত হয়। এই খোশবাগেই শায়িত আছে আলিবর্দি এবং সিরাজের সমগ্র পরিবার ও পরিজন।

ভাগীরথীর অপরপ্রান্তে জাফরগঞ্জে আছে মিরজাফরের প্রাসাদের অবশিষ্টাংশ। প্রবেশপথের ওপর ভাঙ্গা ফটকটিকে স্থানীয় মানুষেরা নিমকহারাম দেউড়ি বলেই ডাকে। মিরজাফরের সমাধিক্ষেত্রে টিকিট কিনে ঢুকতে হয়। মিরজাফর ছাড়াও এখানে আছে মিরকাশিম এবং মিরানের সমাধি। তাছাড়া আছে চার প্রহরী এবং হিসাব রক্ষকের সমাধি। কথিত আছে আরও অনেক নাম না জানা মানুষের সমাধির মধ্যে একটি মিরানের প্রিয় টিয়াপাখির। এই সমাধিক্ষেত্রের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সরকারি বরাদ্দ এগারো টাকা অনাদিকাল থেকে এখনও পর্যন্ত চলে আসছে। হতভাগ্য রক্ষণাবেক্ষণকারীরা ভ্রমণকারীদের কাছ থেকে ভিক্ষা করে সমাধিক্ষেত্রের রক্ষণাবেক্ষণ এবং সংসার প্রতিপালন করে। শোনা যায় এরা মিরজাফরের বংশধর এবং স্থানীয় মানুষেরা এখনও তাদের ঘৃণার চোখে দেখে। মিরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতার অভিশাপ আর কতো প্রজন্মকে বহন করতে হবে একমাত্র ভবিষ্যৎই তার উত্তর দিতে পারবে।
0

গল্প - সুমন্ত চ্যাটার্জী

Posted in







তীব্র গতিতে পাথর আর লাইন পেরোতে দেখে মাথাটা ছ্যাঁৎ করে ঘুরে যায় ত্রৈলোক্যবাবুর! পিছিয়ে আসেন, কিছুটা ভয়ে, কিছুটা দ্বিধায়! কিন্তু এগিয়ে যান আবার, লোকাল ট্রেনের দরজায়! সাহস করে ঝুঁকবেন বলে যখন ফের প্রস্তুত হচ্ছেন, সেইসময়েই একটা হাত এসে চেপে ধরে ওনার খাদির পাঞ্জাবীটা!

-"পড়ে যাবেন যে! নামবেন নাকি?"

একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে ত্রৈলোক্যবাবু ঘাড় নেড়ে জানান "না"!

-"নামবেন না যখন, একটু সরে দাঁড়ালে ভালো হয়! আমরা এখানে একটা রীল বানাবো।"

বাধ্য ছাত্রের মত চুপচাপ দরজা থেকে সরে এসে একটা সীটে বসে পড়েন ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়। বছর সত্তর-বাহাত্তরের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মহাশয় ছেলে তুষারের ফ্ল্যাটে থাকেন একমাত্র পুত্র, পুত্রবধূ রঞ্জনা ও নাতনী রাহী'র সাথে। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর থেকেই একের পর এক সমস্যা আসতে শুরু করে ভদ্রলোকের জীবনে। সর্বশেষ সমস্যাটা ছিল, পুত্রবধূ রঞ্জনার আধুনিক, স্বেচ্ছাচারী জীবনযাপন, যা খুবই "উচ্ছৃঙ্খল আর অসংযমী" মনে হয়েছিল আদর্শবান, নিয়মনিষ্ঠ একসময়ের সংষ্কৃত শিক্ষক মহাশয়ের চোখে। সেই নিয়ে বাড়িতে প্রায়শই লেগে থাকতো অশান্তি! তুষার প্রথমদিকে এই দ্বন্দ্বটাকে সামলানোর চেষ্টা করেছিল বটে, কিন্তু রঞ্জনার জেদের কাছে নতিস্বীকার করতেই হয়েছিল। কিন্তু আজ দুপুরের ঝগড়ায় যেরকম শাপ শাপান্ত, বাপ বাপান্ত চললো শ্বশুর আর বৌমার মধ্যে, তাতে ত্রৈলোক্যবাবু ঠিক করেই ফেলেছিলেন, আজ ট্রেন থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যাই করবেন! সেইমতো সারা বিকেলটা শুনশান গঙ্গার ধারে কাটিয়ে, সন্ধ্যায় এ রাস্তা সে রাস্তা হেঁটে রাতের লোকাল ট্রেনটা ধরেছিলেন। কিন্তু বাধ সাধলো রঞ্জনার বয়সীই আরেকটি মেয়ে! সে ত্রৈলোক্যবাবু'কে দরজা থেকে সরিয়ে দিয়ে আধপাগলের মত হাত-পা নাড়িয়ে কিসব অঙ্গভঙ্গি করছে আর মোবাইলে তার ভিডিও করছে একটি শীর্ণকায় ছেলে! তাদের ভিডিও করা শেষ হলে মেয়েটি এগিয়ে এসে বললো, "আপনাকে বেশ অসুস্থ দেখাচ্ছে দাদু! কোথায় যাবেন?"

-জানি না মা!

-কিছু খাবেন?

-নাহ!

-চলুন, আপনাকে বাড়িতে ড্রপ করে দিই?

-না না, আমি নিজেই চলে যেতে পারবো!

এবার পাশ থেকে ছেলেটি বলে উঠলো, "আমরা জানি, আপনি চলে যেতে পারবেন। কিন্তু আমরা যে পারবো না আপনাকে একা ছেড়ে দিতে ... "

বারকয়েকের জোরাজোরিতে শেষমেশ রাজী হতেই হল ত্রৈলোক্যবাবু'কে। ট্যাক্সি ভাড়া করে ওরা ভদ্রলোক'কে নামিয়ে দিয়ে গেল ওনার বাড়ির সামনে, আর ট্যাক্সিটা ছাড়ার সময় মেয়েটি বললো, "দাদু, আমরা নতুন যুগের মানুষ! একটু আলাদা হতে পারি আপনার থেকে, কিন্তু দিনের শেষে আমরাও তো মানুষই, তাই না? ভুল বুঝবেন না! এই রইলো আমার মোবাইল নম্বর, সমস্যায় পড়লে নিজের মেয়ে মনে করে কল করবেন, চেষ্টা করবো সাধ্যমত ..."

ততক্ষণে বাড়ির ভেতর থেকে রাহী ছুটে এসে জড়িয়ে ধরেছে তার দাদু'কে। মাঝরাতের ভেপার আলোর সীমানা পেরিয়ে ট্যাক্সিটা বহু দূরে মিলিয়ে যেতেই আদুরে নাতনি ত্রৈলোক্যবাবুর গলা জড়িয়ে ধরে বলে,"তুমি কোথায় চলে গেছিলে দাদু? মা আর বাবা সেই সন্ধ্যে থেকে তোমায় কত খুঁজছে আর কাঁদছে!"
0

গল্প - মনোজ কর

Posted in




















১৮ পর্ব

ক্লাইভের তৃতীয় এবং শেষ ভারত আগমন এবং অন্তিম প্রত্যাবর্তন।

ক্লাইভ ইংল্যান্ডে ফিরে যাওয়ার পর সেখানে সকলে তাকে বিজয়ী বীরের মর্যাদায় স্বাগত জানালো। মাত্র পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে ব্যবসা এবং যুদ্ধ উভয় ক্ষেত্রেই যে পারদর্শিতা সে দেখিয়েছে তাকে যথাযোগ্য সম্মান জানালো ব্রিটিশ সরকার। উইলিয়ম পিট যে পরবর্তীকালে ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিল ক্লাইভকে ‘ঈশ্বর প্রেরিত সেনাপতি’ আখ্যানে ভূষিত করলো। ১৭৬১ সালে নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্লাইভ স্রুইসবেরির সাংসদ হিসাবে শপথ গ্রহণ করে। ১৭৬২ সালে ক্লাইভ ব্যারন উপাধিতে ভূষিত হয় এবং তার দু’বছর পরে তাকে নাইটহুড প্রদান করা হয়। পলাশি যুদ্ধোত্তর পর্যায়ে প্রশাসনিক দূর্বলতা এত প্রকট হয়ে উঠলো যে ব্রিটিশ সরকার ক্লাইভকে ১৭৬৫ সালের মে মাসে ভারতবর্ষের সর্বময় কর্তা হিসাবে পুনরায় প্রেরণ করলো। ব্যবসা, প্রশাসন এবং সেনাবাহিনীর সর্বময় কর্তা হিসাবে ক্লাইভ ভারতবর্ষে ফিরে এল।

ক্লাইভ ফিরে এসে দেখলো মিরজাফরের দ্বিতীয় পুত্র ১৫ বছর বয়সী নাজামুদৌল্লা মসনদে আসীন। এই মসনদ দখলের অনুমতির মূল্য হিসাবে সে ১লক্ষ ৪০ হাজার পাউন্ড অর্থাৎ প্রায় ১১ লক্ষ টাকা কলকাতা কাউন্সিলের সদস্যদের ভাগ করে দিয়েছে। সেই বছরই অনিচ্ছাসত্ত্বেও কিছুটা বাধ্য হয়েই বক্সারের যুদ্ধে পরাজিত এবং পলায়নরত সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার দিওয়ানি তুলে দিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে। তা না করলে নিজের জায়গা উত্তরপ্রদেশকেও হারাতে হতো তাকে। নিজেদের খুশীমত ব্যবসা করার সঙ্গে সঙ্গে খাজনা আদায়ের অধিকারও চলে গেল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে। মোট আদায়ীকৃত খাজনার পরিমাণ তখন ছিল আজকের হিসাবে ৭০০০ কোটি টাকা। মুর্শিদাবাদের রাজদরবারের নিয়ন্ত্রক থেকে নবাবে পরিণত হলো কোম্পানির সর্বময় কর্তা লর্ড ক্লাইভ। ক্লাইভ প্রবর্তন করলো দ্বৈত শাসনব্যবস্থা। রাজ্যশাসনকে দু’ভাগে ভাগ করা হলো। আইন কানুন রক্ষা এবং বিচারের দায়িত্বে থাকবে ‘নবাব’ এবং রাজস্ব আদায়ের দায়িত্বে থাকবে ‘দেওয়ান’। ১৭৬৬ সালের মে মাসে যখন খাজনা আদায়ের বার্ষিক হিসাব নিকাশের সভা হয় তখন পুতুল নবাব নাজামুদৌল্লার ডানদিকে দেওয়ানের আসনে ছিল লর্ড ক্লাইভ। এই প্রথম দেওয়ানের আসনে দেখা গেল এক ব্রিটিশকে। অদূর ভবিষ্যতে নবাবের আসনেও যে ব্রিটিশদের দেখা যাবে এই দৃশ্য তারই সুস্পষ্ট ইঙ্গিত। এই অনুষ্ঠানের অব্যবহিত পরেই ক্লাইভের সম্মানে আয়োজিত এক অজানা জ্বরে মারা যায় নাজামুদৌল্লা। পরের বছর অর্থাৎ ১৭৬৭ সালে এই বার্ষিক অনুষ্ঠান পালিত হয় আরও জাঁকজমকের সঙ্গে। সেই অনুষ্ঠানে নবাবের পাশে আসীন ছিল বাংলার নবনিযুক্ত গভর্নর হ্যারি ভেরেলস্ট। নবাবের আসনে ছিল মিরজাফরের আর এক পুত্র সৈফুদৌল্লা। নবাবের আসনে বসার জন্য সৈফুদৌল্লা যে রীতি অনুযায়ী বিশাল অঙ্কের টাকা কাউন্সিলের সদস্যদের দিয়েছিল তার সঠিক হিসাব পাওয়া যায়নি। ক্লাইভের ভারত অধ্যায় এখানেই শেষ। ১৭৬৭ সালে ক্লাইভ দেশে ফিরে বাকি জীবন সমান মর্যাদা , খ্যাতির সঙ্গে রাজনীতির অঙ্গনে অতিবাহিত করে। ১৭৭৩ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ভারতবর্ষে ক্লাইভের অপশাসন এবং ব্যক্তিগত সম্পদবৃদ্ধির অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত শুরু করে। ক্লাইভ সেখানে জানায় যে সে অবাক হয়ে যাচ্ছে যে আত্মত্যাগের এবং সংযমের যে পরাকাষ্ঠা সে ভারতবর্ষে সে প্রদর্শন করেছে তারপরেও তাকে অপশাসন এবং দূর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত হতে হচ্ছে। প্রত্যাশিতভাবেই সেই তদন্তের ফলাফল ক্লাইভের পক্ষে যায়। কিন্তু তারপর ক্লাইভের শরীর দুর্বল হতে শুরু করে এবং কথিত আছে সে নাকি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। অনেক ঐতিহাসিক বলেন ক্লাইভ নাকি ঐ সময় আফিমে আসক্ত হয়ে পড়েছিল। ১৭৭৪ সালের ২২শে নভেম্বর মাত্র ৪৯ বছর বয়সে ক্লাইভের বার্কলে হাউসের বাড়ি থেকে কন্ঠনালী কাটা অবস্থায় তার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। এটি আত্মহত্যা না হত্যা সে বিষয়ে মতভেদ আছে। তার মৃত্যুর পর লন্ডনের একটি দৈনিকে তাকে লর্ড ভালচার হিসাবে চিত্রায়িত করা হয় যাতে দেখানো হয় একটি শকুনি মন্বন্তরে মৃত এক ভারতবাসীর হাড় ঠোঁটে করে তুলে নিচ্ছে।

১৭৬০ সালে পলাশির যুদ্ধের পর ক্লাইভ যখন দেশে ফিরে যায় তখন যে বিপুল পরিমাণ অর্থ সে সঙ্গে করে নিয়ে যায় আজকের হিসাবে তার পরিমাণ ৬ কোটি পাউন্ড বা ৬০০ কোটি টাকা। সেই সময় ভারতবর্ষে তার ব্যক্তিগত মালিকানাধীন জমি ও সম্পত্তি থেকে তার বার্ষিক আয়ের পরিমাণ ছিল আজকের হিসাবে ৫২ কোটি টাকা। ১৭৬৫ সালের ৩রা মে ক্লাইভ যখন তৃতীয়বারের জন্য কলকাতা এসে পৌঁছোল তখন খবর পেল যে মিরজাফর ব্যক্তিগতভাবে তার জন্য বিপুল অর্থ রেখে গেছে যার পরিমাণ আজকের দিনে প্রায় ১২৫ কোটি টাকা। একমাত্র ক্লাইভ একাই যদি এত অর্থ ব্যক্তিগত ভাবে ভারতবর্ষ থেকে নিয়ে যায় তাহলে কী বিপুল পরিমাণ অর্থ এদেশ থেকে লুন্ঠিত হয়েছিল তা ভাবতে গেলেও বিস্মিত হতে হয়। ক্লাইভ যে দ্বৈত শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন করেছিল ১৭৭২ সালে তা অবলুপ্ত করে দেওয়া হয়। বাংলা ,বিহার এবং উড়িষ্যার শাসনব্যবস্থায় নবাবের আর কোনও ভূমিকা রইলো না। ১৭৭৩ সালে ক্ষমতা এবং সিদ্ধান্তগ্রহণের কেন্দ্র স্থানান্তরিত হয়ে চলে গেল কলকাতায়। এর পরের প্রায় দু’শ বছরের ইংরাজ শাসন এবং ভারতবর্ষের পরাধীনতার ইতিহাস শেষ হল ১৯৪৭ সালে। বর্মা এবং শ্রী লঙ্কার ব্রিটিশ শাসন শেষ হয় ১৯৪৮ সালে। পলাশির যুদ্ধে জয়লাভ করে ফরাসিদের বাংলা এবং দাক্ষিনাত্য থেকে নির্মূল করে দেয় ব্রিটিশেরা। বক্সারের যুদ্ধে মোগল সম্রাটকে হারিয়ে বাংলা এবং বিহারের খাজনা আদায়ের অধিকার হাতে পেয়ে এই উপমহাদেশে ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণ করেছিল ব্রিটিশ। ১৭৭২ সালে হ্যারি ভেরেলস্টের উত্তরসূরী হিসাবে ওয়ারেন হেস্টিংস গভর্নর পদে নিযুক্ত হয়। ১৭৭৩ সালে তার পদোন্নতি হয় গভর্নর জেনারেলের পদে। ভারতবর্ষের দন্ডমুন্ডের কর্তা হেস্টিংস একদিকে ছোট ছোট রাজ্য এবং অঞ্চলের স্থানীয় রাজা, জমিদারদের বুঝিয়ে সুঝিয়ে অথবা বলপ্রয়োগের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তরের চুক্তিস্বাক্ষর করাতে বাধ্য করতে লাগলো এবং অন্যদিকে শাসনব্যবস্থায়, শিক্ষায় এবং সংস্কৃতিতে ব্রিটিশ ব্যবস্থার অনুপ্রবেশ ঘটাতে লাগলো। পরবর্তী বারো বছরে ব্রিটিশ আইনানুসারে সুপ্রিম কোর্ট স্থাপন, মন্বন্তরের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ন্ত্রণ করে খাজনা আদায়ের প্রক্রিয়া পুনরারম্ভ এবং মাইসোরে মারাঠাদের এবং রোহিলখন্ডে পাঠানদের বিদ্রোহকে দমন করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে বাংলা বিহারের সীমানা অতিক্রম করে পশ্চিমে মুম্বাই, দক্ষিণে চেন্নাই এবং উত্তরে প্রায় দিল্লী অবধি সম্প্রসারণ ছিল হেস্টিংসের মূল সাফল্য।

পলাশির যুদ্ধের পর আজকের হিসাবে ৫০০০ কোটি টাকা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল মিরজাফর। মিরজাফর কথা রাখতে পারেনি বলে তার জায়গায় নিযুক্ত করা হয়েছিল তার জামাতা মিরকাশিমকে। নিজের নবাব হবার মূল্য ছাড়াও বর্ধমান, মেদিনীপুর এবং চট্টগ্রাম জেলার খাজনা আদায়ের সম্পূর্ণ অধিকার মিরকাশিম দিয়েছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি খাজনা আদায়ের বরাত দিয়েছিল কয়েকজন জমিদারকে যারা অন্যদের চেয়ে বেশি টাকা তুলে দেবার লিখিত প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। পলাশি যুদ্ধের এক দশক পরে কোম্পানি সমগ্র বাংলার খাজনা আদায়ের অধিকার লিখিয়ে নেয় তৎকালীন মোগলরাজের কাছ থেকে। এই খাজনার পরিমাণ ছিল আজকের হিসাবে আনুমানিক ৭০০০ কোটি টাকা। এই খাজনার মাত্র ৫-৭ শতাংশ দেওয়া হতো দিল্লীর মোগলসম্রাটকে আর বাকি টাকা যেত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পকেটে।
0

গল্প - চন্দন মিত্র

Posted in







ওড়িশার পিপিলি ব্লকের বেশ কিছু গ্রামের মানুষ তাদের পৈতৃক ভিটেমাটি ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছেন দূরবর্তী আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে বা ভিন্ন কোনো আশ্রয়ে। সোশ্যাল মিডিয়ার সৌজন্যে আপনারা অনেকেই ঘটনাটি জেনে ফেলেছেন। পিপিলি ব্লকের মানুষগুলি যে কারণে ঘরছাড়া হয়েছেন, তা জেনে আপনারা অনেকেই আশ্চর্য হয়ে ভেবে নিয়েছেন— ফেক নিউজ হবে বোধহয়। কিন্তু বিষয়টা মোটেও বানোয়াট নয়, কারণ এহেন খবর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলে সহায়ক ভূমিকা রাখার মতো তেজস্ক্রিয় নয়। সামান্য বুনো পিঁপড়েদের দলে দলে গ্রাম ঘিরে ফেলার ফলশ্রুতিতে এই অভূতপূর্ব অঘটনটি ঘটেছে। কামাখ্যাফেরত বাঘা বাঘা তান্ত্রিকের মারণ-উচাটন, গ্রামগুলির চৌহদ্দিতে আগুন জ্বালিয়ে রাখা, গ্রামের বাইরে পিঁপড়েদের পঙক্তিভোজনের ব্যবস্থা করা, সরকারি তরফে কীটনাশকবর্ষণ ইত্যাদি কোনো পদ্ধতিই সুফলদায়ী হয়ে ওঠেনি। ভাবুন একবার, তুচ্ছ পিঁপড়ের ভয়ে মানুষ গৃহ-গৃহসামগ্রী-তৈজসপত্রাদি ত্যাগ করে এককাপড়ে বেরিয়ে পড়েছেন। একে ঘোর কলিকাল বা মহাপ্রলয় বা রোজ কেয়ামতের সংশয়াতীত ইশারা ছাড়া আর কীই বা বলবেন ! আপনি যদি গ্রামের মানুষ হন, তাহলে সর্বাপেক্ষা বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিকে শুধিয়ে দেখুন,,তিনি বলবেন কস্মিনকালেও এমন ঘটনার কথা শোনেননি। ভাবুন, নগণ্য পিঁপড়ের অভিযানে যদি এমন অবস্থা হয়, সুচতুর হায়েনার হামলা হলে তাহলে কী ঘটত !

ভাবছেন, আমি পিঁপড়ের কিসসা শুরু করে ধান ভানতে শিবের গীতের মতো অকস্মাৎ কেন হায়েনার প্রসঙ্গে ঢুকে পড়লাম ! আসলে পিপিলির পিপীলিকা দঙ্গলের মনুষ্য-বিতাড়নের অনুষঙ্গে যূথবদ্ধ হায়েনার তাড়নায় বাস্তুচ্যুত মানুষের কচুরিপানার মতো ভেসে চলার একটি কিসসা মাথায় এসে গেল যে। এই যে কচুরিপানার কথা বললাম, জানেন তো কচুরিপানাও আদতে ছিন্নমূল; তিনি এসেছেন আমাজনের অগম জলের স্মৃতি বুকে নিয়ে। এসেছেন বললে ভুল হবে, আনীত হয়েছেন। প্রায় দেড়শো বছর আগের কথা; তখন বাংলায় চলছে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির শাসন। জনৈক স্কটিশ নাগরিক জর্জ মর্গান, পাটের ব্যবসা করতে এলেন মদীয় দেশে। তিনি ঘোর সবুজ পাতার মায়াবী গড়ন আর তার অবর্ণনীয় রঙের সুবিন্যস্ত পুষ্পমঞ্জরীর মোহে এমন মোহিত ছিলেন যে, তাঁকে ছেড়ে থাকার কথা ভাবতে পারেননি। জাহাজে ওঠার আগে তাঁকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে সযত্নে ঝোলায় ভরে ফেলেছিলেন। মর্গানসাহেব থিতু হয়েছিলেন বঙ্গীয় এক বাগানবাটিতে; তাঁর উদ্যানের পরিখায় ডানা মেলা প্রজাপতির মতো ভেসে বেড়াতেন সেই বহুবংশবিস্তারী সপুষ্প সুন্দরী। কালক্রমে তাঁর সন্তানসন্ততিরা বাংলার জলায় জলায় ভাগ্যান্বেষণে ভেসে পড়েছিলেন। আজও তাঁদের যাত্রা অপ্রতিরোধ্য। হয়তো তাঁদের কেউ কেউ বাউল-ভাটিয়ালিমাখা শরীর নিয়ে পৌঁছে গেছেন আমাজনের গহীনে। বস্তুত, পরিযান হল জীবের নিয়তি; তা স্বেচ্ছায় হোক বা বাধ্যতামূলক। পিপলির মানুষগুলো যদি না তাঁদের বাস্তুভিটে উদ্ধার করতে পারেন, তাঁদেরও খুঁজতে হবে নতুন বাসভূমি; তবে জন্মভিটের সুগন্ধ যে তাঁদের আমৃত্যু তাড়িয়ে বেড়াবে, সে বিষয়ে সন্দেহ না-রাখাই ভালো।

পিপলির মানুষগুলোর আয়ুরেখা বোধহয় দীর্ঘ ও গভীর এবং বৃহস্পতিও হয়তো তুঙ্গে, তাই তাঁরা হন্যমান হায়েনার কবলে পড়েননি। নগণ্য বুনো পিঁপড়ের সঙ্গে হায়েনার তুলনাই হয় না। হায়েনার কথা আপনাদের নতুন করে কী আর বলব, তাদের সম্পর্কে আপনারা প্রায় সকলেই কমবেশি ওয়াকিবহাল। তবে জেনে অবাক হবেন যে, হায়েনারা বিশ বা বাইশ মিলিয়ন বছর আগে পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছে। তখনও পৃথিবীতে হোমো সেপিয়েন্স সেপিয়েন্স প্রজাতিটি জন্মায়নি। ফলে তাদের রক্ষাকর্তা হিসাবে তখনও ইশ্বর–আল্লা-গড প্রভৃতি ভূমিষ্ঠই হননি। কোনোরকম অতিলৌকিক আশীর্বাদ ছাড়া, কেবল দলবদ্ধতা এবং সুতীক্ষ্ণ দাঁত-নখ ও নিখাদ হিংস্রতায় পরিপূর্ণ জন্মান্ধ মননের গুণে হায়েনারা এই একবিংশ শতাব্দীতেও ধরণীর প্রাণদায়ী ভূমিতে সমানে দন্তবিকীর্ণ করে চলেছে। আর একটি আশ্চর্য তথ্য এই যে, প্রাণিকুলের মধ্যে সম্ভবত মানুষ ছাড়া কেবল এই হায়েনারাই হাসতে পারে। হ্যাঁ নিছক হাসতেই পারে, অন্যকে ছিন্নভিন্ন করে তার আত্মানাশ করার মুহূর্তেও। যদি তারা কাঁদতে পারত, সেটাও খুব একটা সুবিধের হত না শিকারের পক্ষে। কারণ কেউ হাসতে হাসতে তাকে ছিঁড়ে খাচ্ছে এ দৃশ্য সহ্য করা সহজ হলেও, কেউ কাঁদতে কাঁদতে তার কলজে উপড়ে নিচ্ছে এটা যথেষ্ট চাপের হত গোবেচারা শিকারের কাছে।

হায়েনা কবলিত ভূভাগ কতটা বীভৎস, কতটা শ্বাসরুদ্ধকর, কতটা অপমানের, কতটা অনিশ্চয়তার, অনভিজ্ঞের কাছে সে অভিজ্ঞতা চিরকাল অধরাই থেকে যাবে। আপনারা যাঁরা জন্মসূত্রে সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা ভূখণ্ডে বাস করেন, হায়েনার সঙ্গে সহবাস করা দূরের কথা, কোনোদিন হায়নার সমবেত দন্তঘর্ষণের উচ্চকিত কিচিকিচি শীৎকার কর্ণকুহরে নেননি, ঘ্রাণে নেননি তাদের বিবমিষা উদ্রেককারী ঐতিহ্যবাহী বদগন্ধ, তাঁরা হায়েনাহতদের আত্মার রক্তক্ষরণের বিমর্ষ সংগীতের রাগিণী সম্পর্কে চিরকাল অনবগত থেকে যাবেন। অবশ্য সেটাকে আশীর্বাদ হিসাবেই আপনাদের নেওয়া উচিত এবং আপনাদের নিজ নিজ সৃষ্টিকর্তা ও সৃষ্টিকর্ত্রীর প্রতি এইজন্য নতজানু হওয়া উচিত যে, তাঁরা আপনাদের সৃজনের জন্য এক সুরক্ষিত স্থানই নির্বাচন করেছিলেন। দান্তের ইনফার্নো থেকে শুরু করে বিবিধ কিসিমের ধর্মশাস্ত্রে যে নরক নামের পূতিগন্ধময় কল্পস্থানের বর্ণনা আছে, তা বোধহয় হায়েনাকবলিত ভূমির প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অভিজ্ঞতাসঞ্জাত স্মৃতিচারণ। আমাদের গৌরচন্দ্রিকা বা মুখবন্ধ যেহেতু এখানেই থেমে যেতে চাচ্ছে, সেহেতু আমরা এখন আমাদের কিসসার চলার পথটি উন্মুক্ত করে দেব। এতক্ষণ যে বাক্যসম্ভার উপস্থাপিত হল, বস্তুত তা নিছক ভণিতামাত্র নয়; আশা করি এতক্ষণে আপনারা তা অনুমান করতে পেরেছেন।

আদতে আমাদের এই ভূভাগের কোথাও নিখাদ হায়না অধ্যুষিত দেশ নেই। যে-কোনো দেশই যে-কোনো মুহূর্তে হায়েনার নখেদাঁতে ছিন্নভিন্ন রক্তাক্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের দিকে এগিয়ে যেতে পারে। তেমনই একটি মুমূর্ষুপ্রায় দেশের পটভূমিতে আমি কিসসাটি বুনতে চলেছি। কিসসার অন্দরমহলে ঢুকে দৈবাৎ যদি আপনাদের মননে সাদৃশ্যবশত কোনো বাস্তবিক স্থানকাল ইত্যাদির ভূত উঁকি মারে, তা নেহাতই কাকতালীয়। আপনারা এমন এক নদীমাতৃক দেশের কথা কল্পনা করুন, যেখানে মাটি নদীর স্নেহময় সান্নিধ্যে উর্বর; যেখানে গৃহস্থকে নিশ্চিন্তে রাখে গোলাভরা ধান, গোয়ালভরা গরু আর পুকুরভরা মাছ। সে দেশে এক প্রসন্ন গৃহস্থবাড়িতে ছিল পিতা-মাতা, তাঁদের দুই পুত্র ও এক কন্যা। বুনিয়াদি শিক্ষানিকেতনের পণ্ডিতমশাই পিতৃদেব যখন ইহলীলা সংবরণ করলেন, কিয়ৎক্ষণ পরে তাঁর অর্ধাঙ্গিনীটিও স্বামীর পদাঙ্ক অনুসরণ করে পৌঁছে গেলেন সাধনোচিত ধামে। বিশ্ববিদ্যানিকেতনে পাঠরত জ্যেষ্ঠপুত্রটি বিপন্নের মতো সেই ঝটিকাপ্রবাহে সংসারনৌকার হালটি প্রাণপণে ধারণ করলেন। ‘বড়ো গাছেই ঝড় লাগে’, প্রবাদটি আপনারা শুনে থাকবেন আশা করি। জ্যেষ্ঠবৃক্ষটি মস্তকে সমূহ ঝটিকাবেগ ধারণ করে রক্ষা করলেন কনিষ্ঠ ভ্রাতা ও ভগিনীকে।

ইতোমধ্যে ইতিহাসের অনেকগুলি প্রসঙ্গ আমার মাথার ভিতরে মাথাচাড়া দিতে শুরু করেছেন, তাঁদের দাবি এই কিসসায় তাদেরও স্থান দিতে হবে। সত্যি কথা বলতে কী ইতিহাসে এত সালতামামি, এত রাজরাজড়াদের চরিতকথা যে সেগুলি মুখস্থ করা ছাড়া উপায় থাকে না। আমি আবার ওই বিদ্যায় নিতান্ত অপারগ। তাই একটা অজুহাত খাড়া করে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে তাঁদের বললাম, হে আমার ইতিহাসের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় অবস্থানরত প্রিয় ভাই ও বোনেরা আপনাদের আবদারে যথেষ্ট যুক্তি থাকা সত্ত্বেও এই স্বকপোলকল্পিত কিসসার কলেবর বৃদ্ধির আশঙ্কায় আমি আপনাদের যথাযোগ্য সমাদর জানাতে পারছি না, এজন্য আমি দুঃখিত। তাঁরা কী বুঝলেন জানি না, শেষমেশ আমাকে সানন্দে নিস্তার দিয়ে বাধিত করলেন। ঐতিহাসিক দায়ভার এড়াতে পেরে আমার কাজটাও অনেক সহজ হয়ে গেল। দেখুন এবার আমার চিন্তাতরঙ্গের মাথায় লাফাতে লাফাতে কেমন তরতরিয়ে এগিয়ে যায় কিসসার সাম্পান।

জ্যেষ্ঠপুত্রটি আইনের বদান্যতায়, কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছায় এবং কনিষ্ঠভ্রাতার যারপরনাই উদ্যোগ থাকা সত্ত্বেও উপযুক্ত যোগ্যতা না-থাকায় পিতার চাকরিতে বহাল হলেন। হাসিমুখে তিনি সংসারের যাবতীয় দায়দায়িত্ব নিজের কাঁধে চাপিয়ে নিলেন। কনিষ্ঠভ্রাতাটি অক্ষরভীতু, আকাট ও আদ্যোপান্ত বয়ে যাওয়া বখাটে ছেলে; কিন্তু যথেষ্ট হিসাবি। পিতার চাকুরিটি যখন হাতছাড়া হল, সে জমিজমা, ফলের বাগান, মাছের পুকুর স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে দেখভাল শুরু করে দিল। কয়েক বছর যেতে-না-যেতে সে বিয়ে করে আনল তার পছন্দের এক পাত্রীকে। কালক্রমে তার সংসার দুই শিশুপুত্রের কলরোলে মুখরিত হয়ে উঠল। এদিকে উচ্চবিদ্যালয়ে পাঠরতা বোনটিও স্থানিক ও কালিক বিচারে বিবাহযোগ্যা হয়ে উঠেছে ততদিনে। ক্রমে অকৃতদার জ্যেষ্ঠভ্রাতার চোখে উঠল চশমা, পাক ধরল চুলে। আত্মপরের ভেদজ্ঞানরহিত, সহজসরল, সৎ ও পরোপকারী মানুষটি পিতার মতো ‘পণ্ডিতমশাই’ আখ্যা পেয়ে গেলেন আপামরের কাছে। এভাবেই চলছিল দিনকাল, অতঃপর ঘনিয়ে এল মানুষের সর্বনাশ ও হায়েনাদের পউষমাসের কালো অধ্যায়ের করুণ দিনাবলি।

কানাঘুষো চলছিল বেশ কয়েকদিন ধরে, হায়েনাদের দল নাকি মানুষের মহল্লায় হানা দেওয়ার ছক সাজাচ্ছে। কিন্তু উদারমতি জ্যেষ্ঠভ্রাতা বিশ্বাস করতে চাননি, সেসব আতঙ্ক-খচিত অযাচিত কথামালাকে। কনিষ্ঠটির কান ছিল সজাগ, সে নিজেকে এবং স্ত্রীপুত্রকে আড়াল করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল গোপনে গোপনে। তাহলে আমাদের কিসসায় অরক্ষিত থাকল দুই জন, জ্যেষ্ঠভ্রাতা ও অনূঢ়া ভগিনি; বাস্তবে কয়েক সহস্র অসহায় নরনারী। তাদের কান্না-ঘাম-রক্ত-ইজ্জত-আব্রু এ কিসসায় স্থান পাবে না; কারণ তা নিছক কল্পনা নয়, কল্পনাতীত। ফলে তারা আপাতত কিসসা-বৃত্তের বাইরে অবস্থান বিক্ষোভ দেখালে দেখাক।

সকাল দেখে বোঝা যায় দিনটি কেমন যাবে, এই মর্মে একটি ভুবনবিদিত প্রবাদ আছে ইংরেজি ভাষায়। কিন্তু সবসময় যে এই সূত্রটি খাটে না সেদিনের প্রশান্ত সকালটিকে অশান্ত সন্ধ্যা বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তা বুঝিয়ে দিয়েছিল। ঘাসের ডগায় শিশিরের বিন্দুতে কাঁচাসোনারোদ জ্বলে উঠে সকালকে অভিনন্দিত করল। বাতাস ভাসিয়ে নিয়ে চলল জামির ফুলের স্মৃতি-জাগানিয়া সুবাস। আকাশের নীল গাঙে ভেসে বেড়াতে লাগল দুধসাদা মেঘেদের পলকা পানসির দল। সন্ধ্যায় উদিত হবে সোনার থালার মতো চাঁদ; নিকোনো উঠোন-খামারকে মনে হবে অতিকায় ক্যানভাস, তাতে ছায়াছবি আঁকবে সুপুরিগাছের সারি। পুকুরের জলে আলপনা এঁকে দেবে ঝরে পড়া হিজলফুলের লালিমা, বাদুড়েরা ঊর্ধ্বপদ হেঁটমুণ্ডে দোল খাবে অপেক্ষাকৃত অন্ধকার শাখায়। এমনিতে পূর্ণচন্দ্রের উদয় আকাশের মতো মানুষের মনের ভিতরে যে শূন্যতা আছে যেখানে সময়ে সময়ে চিন্তার সাদাকালোরঙিন মেঘের তরঙ্গ ভেসে যায়, সেখানেও জ্বেলে দেয় অনির্বচনীয় আনন্দবাতি; পরব থাকলে তো আর কথাই নেই। গৃহে গৃহে সাড়া পড়ে যায়, সুখাদ্য প্রস্তুত হয়, সহজ শিল্পকর্মে ভরে ওঠে আঙিনা-দেয়াল, পাড়ায় পাড়ায় বেরোন অবসরপ্রাপ্ত হারমোনিয়াম, মৃদঙ্গ, করতাল প্রমুখ। এমনই হওয়ার ছিল যে তিথিটি সন্ধ্যা ও রাতের উদার প্রশ্রয়ে, কিন্তু সন্ধ্যাটি অকস্মাৎ নিহত হল, যেন গপ করে চাঁদটাকে গিলে খেল কেউ। ঝোপঝাড়ে বিষাক্ত লালা ছড়িয়ে মহল্লায় ঢুকে পড়ল সার সার শ্বাপদ হায়েনা। তাদের নখেদাঁতে ফলফুল সম্ভাবনা লোপাট হতে থাকল; বৃন্দগানের বদলে হায়েনাদের দাঁতের ঘর্ষণজাত কিচকিচ ধ্বনিমালা পাড়াগাঁর বাতাসকে বিষিয়ে দিল।

হাতে ধরা দীপাধারসহ ভগিনী আছড়ে পড়ল আলোছায়ামাখা আঙিনায়, তার বুকের উপর গুটিকয়েক হায়না ঝাঁপিয়ে পড়ল, যেন তাদের সন্ধানে আছে বক্ষস্থানে লুকোনো কোনো গুপ্তধন। ঘটনার আকস্মিকতায় বারান্দায় বসে পুথিপাঠরত জ্যেষ্ঠভ্রাতা হতভম্ব হয়ে গেলেন। তিনি একপ্রকার লাফ দিয়ে আঙিনায় নামতেই তাঁকে ঘিরে ধরল একঝাঁক দপদপে চোখের হিংস্র জানোয়ার। তাদের থাবার তলায় শুয়ে শুয়ে তিনি দেখলেন ভগিনীর রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত দেহটিকে খনি ভেবে খননকর্মে লিপ্ত হয়েছে পিশাচেরা। ভাগ্যিস জ্যোৎস্নায় লাল রং ঠিক ফোটে না, না-হলে দৃশ্যটি মাত্রাতিরিক্ত বীভৎস রসে ভরে উঠত। অকস্মাৎ নাওয়ের লগি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন প্রৌঢ় মাঝি। তিনি কৈশোর থেকে পণ্ডিতবাড়ির পারিবারিক নৌযানটির কর্ণধার। তাঁর কোলেপিঠে বড়ো হয়েছে বাড়িটির ছেলেমেয়েরা। প্রৌঢ় হলেও আপৎকালে মাঝির পেশিতে বিদ্যুৎ খেলে যেত; তাঁর লগুড়ের তাড়নায় মুক্ত হলেন জ্যেষ্ঠভ্রাতা। তিনি হ্যাঁচকা টানে তাঁকে কাঁধে তুলে নিয়ে দৌড় দিলেন পুকুরের পাড় ধরে নিকটস্থ নদীটির দিকে। ‘বোনটি যে পইড়্যা থকে, ভাই, ভ্রাতুষ্পুত্র, বউমা’ বলে ডুকরে কেঁদে উঠলেন জ্যেষ্ঠভ্রাতা। নৌকায় উঠে তিনি বিস্মিত নয়নে দেখলেন ছইয়ের ভিতর সংসার নিয়ে বসে আছে কনিষ্ঠ ভাইটি। তিনি হিসাব মেলাতে পারলেন না, ভাবলেন স্বপ্ন বোধহয়; হায়েনার আক্রমণসৃষ্ট ক্ষত থেকে চুইয়ে পড়া রক্তে আর্দ্র তিনি। মাঝি তাঁকে নৌকার প্রশস্ত পাটাতনের একদিকে শুইয়ে দিলেন। চেতন-অবচেতনের লীলা শুরু হল জ্যেষ্ঠভ্রাতার মনের আঙিনায়। সেখানে এসে দাঁড়ালেন প্রাজ্ঞ পিতৃদেব। তিনি বললেন, ‘বড়োখোকা তোকে কৈশোরে কতবার কয়্যা ছিলাম, অন্তত লাঠিখান ধরা শিখ্যা নে। তুই কয়্যা ছিলা, বাবা আমি বড়ো বড়ো পুথি পইড়্যা পণ্ডিত হইব। তুই সেদিন লাঠি ধর‍্যা শিখ্যা নিলে বোনটারে হয়তো বাঁচাইতে পারতা। খোকা আমিও পড়াইতাম অসির চেয়ে মসী বড়ো। কিন্তু যদি জানটাই চলি যায়, মসী রইব কোথা ?’ জ্যেষ্ঠভ্রাতা পিতার পদযুগল হাতড়াতে হাতড়াতে বললেন, ‘বাবা, আমি আজ বুঝছি আত্মকে রক্ষা করার বিদ্যা জানা না-থাকিলে সকল বিদ্যা মিথ্যা হইয়া যায়।’ নৌকা স্রোতের মুখে পড়ে ছিন্নমূল কচুরিপানার মতো ভেসে চলল। জ্যেষ্ঠভ্রাতা ঘোরের ভিতরে বিড়বিড় করতে লাগলেন, ‘হেথা নয়, হেথা নয় অন্য কোথা অন্য কোনোখানে...’