Next
Previous
Showing posts with label প্রবন্ধ. Show all posts
0

প্রবন্ধ - সমরেন্দ্র বিশ্বাস

Posted in








হাসান আজিজুল হকের লেখা যত পড়ি, বিস্মিত ও শ্রদ্ধাবনত হই, কি বিশাল মাপের লেখক তিনি! নিঃসন্দেহে হাসান আজিজুল হক বাংলা কথাসাহিত্যের কিংবদন্তিতুল্য একজন ধীমান পুরুষ। তাঁর হাতে বাংলা গদ্যসাহিত্য নতুন মাত্রা পেয়েছে। বড়ো দুঃখের কথা, নভেম্বর-২০২১এ, তিনি আমাদের সবাইকে ছেড়ে প্রয়াণের পথে চলে গেলেন!
তার সম্পর্কে প্রাবন্ধিক, গবেষক অধ্যাপক আনিসুজ্জামান যথার্থই বলেছেন, হাসান আজিজুল হক যে-কোনো মানদন্ডে একজন বড় গল্পকার। ...তাঁর দৃষ্টি অন্তর্ভেদী। সে-দৃষ্টি শাণিত হয়েছিল তাঁর বামপন্থী বোধের দ্বারা।
হাসান আজিজুল হকের চোখের সামনে লক্ষ কোটি মানুষ দেশান্তরিত ও উদ্বাস্তু হয়েছে। হাজার হাজার মানুষের জীবনহানি ঘটেছে। সর্বস্ব গিয়েছে। অর্থ সম্পদ, সহায় সম্পদ চিরকালের জন্য বিনষ্ট হয়েছে, মানুষেরা নিজের আকাশ মাটি জমি থেকে উৎখাত হয়েছে, এক একটা সম্প্রদায় ভয়ানক সংকটের সন্মুখীন হয়েছে। এই ব্যাপারটা আজীবন তার বিবেককে খন্ড খন্ড করেছে, দগ্ধ করেছে! এই দেশভাগের কারণে মানুষের মর্যাদা গেছে, ইজ্জত গেছে, মানুষ হিসেবে তাদের নিম্নতম স্বীকৃতিও জোটেনি। মনে মনে এই কষ্টকর বিশ্বাসটুকু হাসান আজিজুল হককে ধারণ করে রাখতে হয়েছে, দেশভাগের একটা বিশাল মানবিক বিপর্যয় তার মনে গভীর ক্ষত তৈরী করেছে, সেটা আজীবন আরোগ্যহীন। তার লেখাতেও বার বার প্রতিফলিত হয়েছে দেশের এই দ্বিধাভক্ত রাজনৈতিক অস্থিরতা, দেশের কষ্টকর আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি!
হাসান আজিজুল হকের জন্ম ১৯৩৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারি, অবিভক্ত এপার বাংলায়, বর্তমান ভারত/পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার যবগ্রামে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের পড়াশোনা নিজের গ্রামেই করেছেন। তিনি ১৯৫৪ সালে যবগ্রাম মহারানী কাশীশ্বরী উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পাশ করেন। তারপরে সপরিবারে তাদেরকে খুলনায় উদ্বাস্তু হয়ে চলে আসতে হয়। ১৯৫৬ সালে খুলনার দৌলতপুরের ব্রজলাল কলেজ থেকে তিনি উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন এবং এখান থেকেই দর্শণ শাস্ত্রে অনার্স গ্রাজুয়েট হন। ১৯৬০ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
রাজশাহী সিটি কলেজ, সিরাজগঞ্জ কলেজ, খুলনা গার্লস কলেজ, ব্রজলাল কলেজ - এরকম কয়েকটি কলেজে তিনি অধ্যাপনা করেন। এর পরে তিনি, ১৯৭৩ থেকে খ্যাতি ও জনপ্রিয়তার সাথে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন শাস্ত্রের অধ্যাপনায় নিযুক্ত ছিলেন। ২০০৪ সালে সেখান থেকেই তিনি সুনামের সাথে অবসর নেন।
তার প্রথম প্রকাশিত গল্পের বই ‘সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য’ (১৯৬৪)। এর পরে ধীরে ধীরে তার সমস্ত বইগুলো প্রকাশিত হতে থাকে – আত্মজা ও একটি করবী গাছ (১৯৬৭), জীবন ঘষে আগুন (১৯৭৩), নামহীন গোত্রহীন (১৯৭৫), পাতালে হাসপাতালে (১৯৮১), লালঘোড়া আমি ( কিশোর উপন্যাস / ১৯৮৪), নির্বাচিত গল্প (১৯৮৭), আমরা অপেক্ষা করছি (১৯৮৮), রাঢ়বঙ্গের গল্প (১৯৯১), বৃত্তায়ন (১৯৯১), রোদে যাবো (১৯৯৫), হাসান আজিজুল হকের শ্রেষ্ঠ গল্প (১৯৯৫), মা মেয়ের সংসার(১৯৯৭), ছোটদের জন্যে লেখা ‘ফুটবল থেকে সাবধান’ (১৯৯৮)।
হাসান আজিজুল হকের হাতে আমাদের গদ্য সাহিত্য নতুন মাত্রা পেয়েছে। গদ্যের জন্যে যাঁরা ভাষা নির্মাণ করেছেন তিনি তাঁদের পুরোধা। শকুন, আত্মজা ও একটি করবী গাছ, মারী, আমৃত্যু আজীবন, তৃষ্ণা, উত্তর বসন্তে, পরবাসী, শোণিত সেতু, জীবন ঘষে আগুন, জননী, ঘর ঘেরস্থি, খনন-এর মতো অসংখ্য গল্পে এই সত্য উদ্ভাসিত।
আগেই বলেছি, তার ‘শকুন’ গল্পটি সে সময়ে পাঠকমহলে প্রচুর সাড়া ফেলে। কয়েকটি কৌতূহলী কিশোরের একটি শকুনকেন্দ্রিক সন্ধ্যা ও রাত্রিযাপনকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় পুরো গল্পটা। একদল কিশোরের জীবন আর ভাগাড়ের মুমুর্ষু একটা শকুনের শেষকালীন সময় একই ফ্রেমে আঁটা হয়, প্রশ্ন আসে মানুষের জীবনটা কি তা’হলে এমনি শকুনেরই মতো? এই গল্পে আবার শকুনকে চিহ্নিত করা হয় সুদখোর মহাজনের প্রতিরূপ হিসেবে। এ ভাবেই মুমুর্ষু শকুনটার প্রতি কিশোরদের নিষ্ঠুর অত্যাচারটা একটা সামাজিক প্রতিশোধ, মহাজনদের বিরুদ্ধে জনতাদের একটা নির্দয় আচরণ হিসেবে এই গল্পে উঠে আসে। ‘শকুন’ গল্পটিতে ঈঙ্গিত দেয়া হয় রাতের আঁধারে নরনারীরা অবৈধ ভাবে মিলিত হচ্ছে, তার পরিণামে জন্ম নিচ্ছে বেওয়ারিস সন্তান। শকুনের মৃত দেহের পাশে, এই গল্পে আমরা দেখি পরিত্যক্ত একটি ফুটফুটে নবজাতক শিশুকে, যাকে ঠুকরে খাবার জন্যে আকাশ থেকে নেমে আসছে জীবন্ত শকুনের দল! গ্রামীন জীবনের পটভূমিকায় এভাবেই ‘শকুন’টি হয়ে ওঠে সাড়া জাগানো, একটি অত্যন্ত শক্তিশালী গল্প!
হাসান আজিজুল হকের আরেকটি গল্প ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ নিয়ে সামান্য আলোচনা করা যাক। এই গল্পটিতে দেখি তিনজন উদভ্রান্ত বখে যাওয়া যুবক রাতের অন্ধকারে বেরিয়েছে। অন্ধকারের মধ্যে তারা হেঁটে যাচ্ছে গ্রামের প্রত্যন্তে। তারা এসে পৌঁছায় একজন অসুস্থ বুড়োর দাওয়ায়। তাদের দীনহীন কুঠিরের আঙ্গিনায় লাগানো আছে একটা করবী গাছ। বখে যাওয়া তিনজনের মধ্যে দুজন যুবকের পকেটে আছে চুরি করে আনা টাকা - মাত্র দুটো করে টাকা। সেই টাকা বুড়ো বাপটাকে দিয়ে ওরা দুজনে রুকুর শরীর ভোগ করবে। এই রুকুই অসুস্থ বুড়ো বাপের মেয়ে, একমাত্র অবলম্বন। কত নিরুপায় হলে বাপ চোখের সামনে নিজের মেয়েকে অন্য ছোকরাদের সাথে শুতে পাঠায় তা বোঝা যাবে গল্পের পরিণতিতে। বুড়ো বাপটা বলছে – ‘এখানে যখন এলাম ... আমি একটা করবী গাছ লাগাই, বুঝলে? ... বিচির জন্যে। চমৎকার বিষ হয় করবী ফুলের বিচিতে।’ বিষকে খুঁজে নেয়ার তাড়নায় বুড়োর অসহায় উদ্বাস্তু জীবনের কান্নাগুলো যখন হু হু করে বেরিয়ে আসে – ঠিক তখনই কুঠিরের ভেতরের ঘরে তার মেয়ে রুকুর শরীর বিক্রি হচ্ছে দুদুটো বখাটে ছিন্নমূল যুবকের কাছে – মাত্র দু দু টাকার বিনিময়ে!
তার লেখা বিভিন্ন গল্পের বিশ্লেষণের নিরিখে, আমাদের এপার বাংলার পরিচিত গল্পকার সাধন চট্টোপাধ্যায়ের কিছু মন্তব্য এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। বাংলাদেশের কথাকার হাসান আজিজুল হকের সম্পর্কে তিনি লিখেছেন – “লেখকের আখ্যান নির্মাণের টেকনিক্‌টি সরল ভঙ্গির। কোনো জটিলতা বা মারপ্যাঁচ নেই। অথচ, শব্দ নির্মাণে, বলবার ভঙ্গিতে, বিমূর্তকে বিশেষণ যোগে আকৃতি দিতে এবং অদ্ভুত নৈর্ব্যক্তিকতায় পাঠকের হৃদয় ও বুদ্ধিকে আমূল শলাকাবিদ্ধ করতে, হাসানদার জুড়ি মেলা ভার। ঘটনায় তেমন সাসপেন্স নেই, রগরগে যৌনতাকে লেখক আখ্যানে আহ্বান জানান না ...... - তবুও আখ্যানের চোরাটানে সর্বক্ষণ পাঠককে কৌতুহলে টানটান থাকতে হয়। এটা আমি তার প্রথম পর্বের গল্প ‘শকুন’ থেকেই লক্ষ্য করেছি।
দ্বিতীয়ত, তার গল্পে প্রকৃত অর্থে কোনো ‘গল্প’ বা জমজমাট ঘটনা নেই, যা পাঠক পড়ে অন্যকে শোনাতে পারে। যদি শোনাতে চায় – একটি বা দুটি বাক্যে শেষ হয়ে যাবে।” [শুভশ্রী, বাংলাদেশের গল্প/গল্পকার সংখ্যা – ২০১৭-১৮ সাল।]

তার ‘আগুনপাখি’(২০০৬)উপন্যাসটি খুবই বিখ্যাত, এতে তার শৈশবের গ্রাম, পরিবার আর তার মায়ের কথা তিনি তুলে এনেছেন। এই হৃদয়গ্রাহী বইটা পড়লে বোঝা যাবে, তিনি ও তার পরিবার দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে বাংলা দেশের বিভাজন কোনো মতেই মেনে নিতে পারেন নি। ‘আগুনপাখি’র পর তার অন্য প্রকাশিত উপন্যাসগুলো – শিউলি (২০০৬), সাবিত্রী উপাখ্যান (২০১৩)।
হাসান আজিজুল হকের আত্মজীবনী মূলক লেখা ‘ফিরে যাই ফিরে আসি’ (২০০৯) ও ‘উঁকি দিয়ে দিগন্ত’ (২০১১)।
কথাসাহিত্যে অনবদ্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার, পদক ও সম্মাননা। এর মধ্যে রয়েছে আদমজী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৭), বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৭০), অগ্রণী ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৪), কাজী মাহবুব উল্লাহ ও বেগম জেবুন্নিসা পুরস্কার, ইত্যাদি আরো অনেক। এছাড়া ১৯৯৯ সালে 'একুশে পদক'এ ভূষিত হন হাসান আজিজুল হক। ভারতবর্ষে 'আগুনপাখি' উপন্যাসের জন্য তিনি পেয়েছেন আনন্দ পুরস্কার।
হাসান আজিজুল হকের কথা উঠলেই আমার সামনে একটা অগ্নিদগ্ধ পাখির চেহারা ফুটে ওঠে। তার ‘আগুন পাখি’ উপন্যাসটি পড়তে পড়তে স্তব্ধ হয়ে যাই। এখানে তিনি লিখেছেন স্বাধীনতা-পূর্ব একটি গ্রাম জীবনের চলমান চালচিত্র। ‘আর হুজুগের শ্যাস নাই।..... মাঠে ঘাটে ছেলে-ছোকরারা গাইছে, সারেগামাপাধানি, বোম ফেলেছে জাপানি।...... জাপানিরা বোমা ফেলবে এই হুজুগ ওঠার পর থেকে অ্যাকন আবার লোকে পেরায় সব সোমায় আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।’ [আগুন পাখি / দে’জ পাব্লিশিং / মে ২০০৮ সংস্করণ / পৃষ্ঠা – ১৫৯-১৬০]
যুদ্ধ আর আকাল হাত ধরাধরি করে চলছে। মানুষদের কি দুর্বিসহ অবস্থা। কোনটা আগে? আনহারে মৃত্যুর ভয়, নাকি যুদ্ধের আঘাতে মৃত্যু? আকাশে ঘন ঘন হানা দিচ্ছে বোমারু বিমান। ওদিকে অনাহার, দুমুঠো খাবারের সংস্থান নেই। কোথাও কোথাও যুদ্ধের চাইতেও ভীতিপ্রদ হয়ে উঠেছে দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতা।
দেশব্যাপী এই আকালের কথা তার উপন্যাসে কতোগুলো করুণ ছবি রেখে গেছে। যেমন - ‘আক্‌লি’ একটি দরিদ্র গ্রামের মেয়ে, তার পরিবারে কেউ নেই। সে তার বুড়ি দাদির সাথে থাকে। ঘরে খাবার নেই। কয়েক দিন ধরে টানা বৃষ্টি চলছে। ক্ষুধার তাড়নায় এই আক্‌লি বৃষ্টি দিনে, অর্দ্ধ-উলঙ্গ অবস্থায় অন্যের ঘর থেকে পান্তাভাত চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে। লেখকের কলমে তার কি নির্মম বর্ণনা! - ‘একবার যেন মনে হলো খিড়কি-পুকুরের কোনের বাড়ি থেকে পানি দিয়ে তৈরি একটো মেয়ে বেড়িয়ে এল। পানির ভেতর দিয়ে ছপ ছপ করে হাঁটছে। ...... আক্‌লিই বটে। বিয়ে হয় নাই, এক বুড়ি দাদি ছাড়া এই দুনিয়ায় আর কেউ নাই তার। ভেজা জবজবে মোটা একটো চট বুক থেকে পা পর্যন্ত ডান হাত দিয়ে ধরে আছে। খেতে পায় না, তবু এত বড় বড় দুটো বুক ক্যানে যি তার, কি কাজে লাগবে আল্লা জানে! অমন করে চটটো হাত দিয়ে ধরে আছে মেয়েমানুষের শরম বাঁচাইতে কিন্তুক তবু ঢাকা পড়ে নাই ওই পব্বতের মতো বুক। বাঁ হাতে মাটির শানকি ভরা বাসি ভাত, তার আদ্দেক গলা। এক শানকি ভাত। হেঁশেলে ভাতের হাঁড়িতে গত রেতের পানি দেয়া যা ভাত ছিল তা বোধ হয় সবটাই নিয়েছে শানকি ভরে।
আমরা দুজনা মুখোমুখি তাকিয়ে থাকলম। ...... কতক্ষণ বাদে আক্‌লি ফিসফিস করে বললে, তিনদিন তিনরাত কিছুই খাই নাই, দাদি ঘরেই আছে, বোধায় আজ মরতে পারে।’ [ পূর্বোক্ত / পৃষ্ঠা – ১৬৮-১৬৯]
ভারত পাকিস্থান দেশ বিভাগের জন্যে কারা দায়ী? কোন মতে বেঁচে থাকা সাধারণ মানুষ, যারা অর্ধ উলঙ্গ, যারা লতা পাতা শামুক গুগলি খেয়ে বেঁচে আছে? সত্যি কথা বলতে কি – এইসব সাধারণ প্রান্তিক মানুষদের কল্পনায় দেশ বিভাগের কথা আসে না! এই দেশ বিভাগের ব্যাপারটা রাজনৈতিক নেতা, বড়ো বড়ো মানুষদের মস্তিষ্কপ্রসূত। দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ বিভাজনের আক্ষেপটা তার উপন্যাসে বার বার খেদোক্তি হয়ে উঠে আসে – ‘হিঁদু-মোসলমান সম্পক্ককে বিষ বিষ করতে হবে ক্যানে?’ [ পূর্বোক্ত / পৃষ্ঠা – ২১৬] কিংবা
‘আর য্যাত লড়ালড়ি, খুনোখুনি হচে তো শুদু হিঁদু-মোসলমান বলে। এক হিঁদু মায়ের পুতকে মারছে একজনা মোসলমান আবার এক মোসলমান মায়ের পুতকে মারছে একজনা হিঁদু। আঃ হায়রে! মানুষ লিকিন বুদ্ধিমান পেরানি।’[ পূর্বোক্ত / পৃষ্ঠা – ২১৯]
দেশ বিভাগের ফলে পূর্ব পাকিস্তান থেকে দলে দলে উদ্বাস্তুরা ভারতে আসছে। তার উল্টোটাও হচ্ছে। আগুনপাখি উপন্যাসের প্রধান চরিত্র হিসেবে ভারতে বসবাসকারী হাসান আজিজুল হকের নিজের মা-এর কথা উঠে এসেছে। জাতিতে তারা মুসলমান। জাতি দাঙ্গা ও উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে তাদের পরিবারের সবাই ধীরে ধীরে একে একে নিজেদের আজন্ম লালিত ঘর বাড়ি ছেড়ে পূর্ব পাকিস্থানের এক নতুন পরিস্থিতি, হয়তো বা কোন এক অনিশ্চয়তার মধ্যে চলে যাচ্ছে, চলে যেতে হচ্ছে। কিন্ত আগুনপাখি উপন্যাসের সেই একজন ‘মা’ গোঁ ধরে বসে আছে! কেন সে নিজের দেশ ছাড়বে? এই একজন ‘মা’র দুর্দান্ত কথাবার্তা ও উদ্বেগভরা প্রশ্ন হাসান আজিজুল হকের উপন্যাসের মূল মর্ম বস্তু। তারই কিছুটা বইএর পাতা থেকে তুলে দেয়া যাক –
‘একই দ্যাশ, একইরকম মানুষ, একইরকম কথা, শুধু ধম্মো আলেদা সেই লেগে একটি দ্যাশ একটানা যেতে যেতে একটো জায়গা থেকে আলেদা আর একটো দ্যাশ হয়ে গেল, ই কি কুনোদিন হয়? এক লাগোয়া মাটি, ইদিকে একটি আমগাছ একটি তালগাছ, উদিকেও তেমনি একটি আমগাছ একটি তালগাছ! তারা দুটো আলেদা দ্যাশের হয়ে গেল? কই ঐখানটোয় আসমান তো দুরকম লয়।’ [ পূর্বোক্ত / পৃষ্ঠা – ২৪৯]
‘তাইলে আলেদা কিসের? আমাকে কেউ বোঝাইতে পারলে না যি সেই দ্যাশটো আমি মোসলমান বলেই আমার দ্যাশ আর এই দ্যাশটি আমার লয়।’ [ পূর্বোক্ত / পৃষ্ঠা – ২৫২]
মানবিক বোধে উজ্জীবিত হাসান আজিজুল হক আদপেই কোনো সংকীর্ণ স্বাদেশিক ব্যাক্তিত্ব নন। তার নিজস্ব বামপন্থী বিশ্বাসই তাঁকে আন্তর্জাতিক করেছে। জীবন কেমন তা তিনি দেখেছেন; কেমন হওয়া উচিত ছিল, তা উপলব্ধি করেছেন। এমনি ভাবেই তার ভেতরে ভেতরে তৈরি হচ্ছিল স্বপ্ন, জন্মেছিল ক্রোধ, জাগছিল পরিহাস-প্রবনতা। তাঁর বিভিন্ন লেখায় আমরা দেখি মার্কসবাদী দার্শনিকতা, যদিও নিজেকে তিনি মার্কসবাদী লেখক হিসেবে কখনো দাবী করেন নি।
অসামান্য লেখক হাসান আজিজুল হককে সামান্য যেটুকু বুঝেছি, এই নিবন্ধটির মধ্যে তারই অল্পস্বল্প কিছু উল্লিখিত হয়েছে। লেখার পরিসমাপ্তিতে একটি সাক্ষাৎকারে নেয়া লেখক হাসান সাহেবের নিম্নোক্ত ভাবনাটুকুর উল্লেখ করতে চাই – ‘ধর্মীয় গোড়ামী ও কুসংস্কার সব কিছুরই অন্তরায়। সবচে’ কঠিন এবং সবচে’ পশ্চাদমুখী গোড়ামী হচ্ছে ধর্মীয় গোড়ামী। এটা মানুষের বৃদ্ধিও বন্ধ করে দেয়। সমাজ সভ্যতার গতিকে স্থবির করে দেয়।’[তথ্যসূত্র – সাক্ষাৎকার : প্রকৃতি ও মানুষের কবি হাসান আজিজুল হক - ইকবাল হাসান / গল্পপাঠ ব্লগ]
পরিশেষে জোর দিয়ে বলতে চাই, আজকের কিছু অসুস্থ মানসিকতার পরিপ্রেক্ষিতে, হিন্দু-মুসলমান ইত্যাদি সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের দিনে হাসান আজিজুল হক ভীষণ ভীষণ ভাবেই প্রাসঙ্গিক।

0

প্রবন্ধ - মনোজিৎকুমার দাস

Posted in










বিমল কর (১৯২১-২০০৩) এর যাত্রাশুরু ছোটগল্প দিয়ে অন্য সব খ্যাতিমান লেখকদের মতই। ‘বরফ সাহেবের মেয়ে’ তাঁর প্রকাশিত প্রথম ছোটগল্প। ছোটগল্পের পথ ধরে তিনি উপন্যাস রচনায় ব্রতী হয়ে এক সময় বাংলা গল্প- উপন্যাস সাহিত্যে ঋদ্ধতার স্বাক্ষর রাখেন।
বাংলা সাহিত্যের গল্প-উপন্যাসের ব্যতিক্রমী ধারার শিল্পী হওয়ার পেছনে ইতিবৃত্ত জানতে হলে আমাদেরকে মানুষ বিমল কর এর ব্যক্তি জীবনের প্রতি অবশ্যই আলোকপাত করতে হয়।
বিমল কর এর জন্ম ১৯২১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর তারিখে পশ্চিম বাংলার ২৪ পরগণা জেলার টাকির কাছের এক গ্রামে। তাঁর শৈশব আর কৈশোর কাটে টানা পোড়েনের মাঝে। কলেজ জীবনে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত ছোটবেলা ও কিশোরবেলা কেটেছে ধানবাদ, আসানসোল, কালিপাড়ায়, বরাকর, কুলটি অঞ্চলে। তাঁর ছোটবেলার অনেকটা সময়ই কেটেছে নিঃসঙ্গতায় আর পড়াশুনোয়। তাছাড়াও অসুস্থতা তার ছোটবেলায় নিত্যসঙ্গী হওয়ায় বিড়ম্বনার শিকার তাকে কম হতে হয়নি। কলকাতায় পড়াশোনাকালে তাঁর জীবনে অস্থিরতা কম ছিল না। মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েও ডাক্তারী পড়া হয়ে উঠেনি তাঁর। তিনি মেডিকেল কলেজ ছেড়ে শ্রীরামপুর টেক্সটাইল কলেজে ভর্তি হয়েও তা ছেড়ে দিয়ে শেষে ভর্তি হন বিদ্যাসাগর কলেজে। ছাত্রজীবনের টানাপোড়েনের মাঝে তার জীবনে বন্ধুবান্ধব, বই, যাত্রা-নাটক ও সিনেমা জায়গায় করে নেয়। কলেজে পড়াকালে তিনি গল্প লিখতে শুরু করেন এবং সম্পৃক্ত হন লিটিল ম্যাগ প্রকাশনার সাথে। এক সময় শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। বিমল যোগদান করেন এ.আর. পি তে। তারপর আসানসোলে অ্যামিউনিশন প্রেডাকশন ডিপোতে। সেখান থেকে কাশীতে রেলের অ্যাকাউন্ট হিসেবে যোগদান করেন। তারপর এক সময় এলো যখন তিনি সবকিছু ছেড়েছুড়ে যোগদান করলেন ‘দেশ’ পত্রিকায়।

প্রায় আটাশ বছর ‘দেশ ‘পত্রিকার সাথে সম্পৃক্ত থাকায় সাহিত্যাঙ্গনে তাঁর প্রতিষ্ঠা পাবার পথ সুগম হয়। ‘দেশ’ পত্রিকার সাহিত্য বিভাগের গল্প-উপন্যাসের সাথে ঘনিষ্ট ভাবে সংযুক্ত হবার পরে তিনি বাংলাসাহিত্যের প্রখ্যাত লেখক-লেখিকাদের লেখার সাথে বিশেষভাবে পরিচিত হলেন। তার ফলেই তিনি গল্প-উপন্যাসের বহুমাত্রিক অনুষঙ্গের সাথে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে নিজেকে নতুন রীতির নিরীক্ষাধর্মী লেখাতে সচেষ্ট হন। গ্রামজীবন থেকে উঠে আসা একটা মানুষ কলকাতার জীবনের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করেও গ্রামজীবনকে ভুলতে পারেনি, ভুলতে পারেনি তিনি তাঁর ছোটবেলার কিশোর জীবনকে। বিমল কর তাঁর লেখা ছোট গল্প-উপন্যাসে গ্রামের মানব-মানবী, গাছপালা বৃক্ষলতা আর প্রকৃতির সাথে মিশে থাকা নানা অনুষঙ্গকে গভীর মমতায় তুলে এনেছেন, যাতে লেখকের গভীর অর্র্ন্তদৃষ্টি, মেধা মনন ও চিন্তা চেতনার আভাস ফুটে উঠেছে। বিমল কর তাঁর সমগ্র সাহিত্যকর্মে জীবন জিজ্ঞাসাকে উপস্থাপন করেছেন বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে। মানুষের অন্তরের কথা তিনি তাঁর লেখা গল্প-উপন্যাসে কতটা গভীর মমতায় তুলে এনেছেন তা দেখার জন্য আমরা তাঁর লেখা কয়েকটি ছোটগল্পের ওপর দৃষ্টিপাত করতে পারি।

বাংলা গল্পসাহিত্য নবতর মাত্র পেয়েছে বাংলা সাহিত্য জগতের বেশ কয়েকজন খ্যাতিমান গল্পকারের লেখা নিরীক্ষাধর্মী ব্যতিক্রমধর্মী ধারার গল্পের মাধ্যমে একথা না বললেই চলে নয়। জগদীশ গুপ্ত, প্রেমেন্দ্র মিত্র, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সুবোধ ঘোষ, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী প্রমুখ বাংলা ছোটগল্প নির্মাণে নবতরমাত্র যোগ করেন ,যা বোদ্ধা ও মনোযেগী পাঠকদের অজানা নয়। বিমল করের লেখায় নিঃসন্দেহে তাঁর অগ্রজ ওই সব লেখকদের রচনার ছায়া অবশ্যই কোন না কোন ভাবে পড়েছে। তবে এ কথা নির্দ্ধিধায় বলা যায় বিমল কর শুধুমাত্র তাদের রচনার অনুপ্রেরণা থেকেই দায়সারা গোছের লেখালেখি করে খান্ত হননি।

বিমল কর তাঁর লেখা গল্পে তাঁর নিজস্ব চিন্তাভাবনাকে প্রতিষ্ঠা করতে প্রয়াসী হয়েছেন মনস্তাত্তি¡ক অনুষঙ্গে। তাঁর ছোটগল্পের উপর আলোচনা করতে গিয়ে বলতে হয় তাঁর প্রকাশিত প্রথম গল্প ‘বরফ সাহেবের মেয়ে’ গল্পে ভদ্রসমাজের নৈতিকতার মুখোশ উন্মোচনের প্রয়াস দেখতে পাওয়া যায়। একটা খৃষ্টান মেয়ে চরম অসহায় অবস্থায় পড়ে এক পর্যায়ে একজন আলুর দোকানদারকে বিয়ে করে আত্মনিগ্রহের শিকার হয়। এ গল্পে গল্পকারের অন্তর্মুখিতার আভাস প্রথম থেকেই পাওয়া যায়। বিমল কর এর অনেক লেখাতে অন্তর্মুখিতা প্রকটভাবে দৃশ্যমান তা আমাদের এ আলোচনায়ই উঠে আসবে। এখানে বলে রাখা ভাল যে বিমল কর নিজেই এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমি মূলত ইন্ট্রোভার্ট লেখক এবং আমার লেখার বিষয়ও অনেক সময় কোন মানুষের আত্মসমস্যা ও দার্শনিক জিজ্ঞাসা থেকে দেখা।’

বিমল কর এর লেখা নাম করা গল্পের মধ্যে মানবপুত্র, বসন্তবিলাপ, বালিকাবধূ, পিঙ্গলার প্রেম, বন্ধুর জন্য ভূমিকা, নিরুদ্দেশ যাত্রা, আমরা তিন প্রেমিক ও ভুবন, পলাশ, বকুল গন্ধ, উদ্ভিদ, অলৌকিক বিষণ্ণ, জননী, নিষাদ, সংশয়, উদ্বেগ, কাঁচঘর, সোপান, আঙুরলতা, নিগ্রহ, সে, শীতের মাঠ, সত্যকাম, কামকামিনী, ফুটেছে কমলকলি, নদীর জলে ধরা ছোঁয়ার খেলা, উপাখ্যানমালা ইত্যাদি।
বিমল কর-এর নিরীক্ষাধর্মী গল্প ‘আমরা তিন প্রেমিক ও ভুবন’। এই গল্পে লেখক নারী সংসর্গজাত অনুভূতির বিচিত্র নিরীক্ষা উপস্থাপন করেছেন। শিবানীকে ঘিরে চারজন পুরুষ, তিনজন প্রেমিক আর একজন তার স্বামী ভুবন। তিন প্রেমিক শিবানীকে যেভাবে পেয়েছিল চতুর্থজন তার স্বামী ভুবন তাকে সেভাবে পায়নি। তিনজন পুরুষের যে সমস্যা চতুর্থ পুরুষ তার স্বামী ভুবনের সমস্যা আলাদা। শেষ পর্যন্ত শিবানীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে তিন প্রেম বিলাসী বন্ধুর সামনে ভুবনের কর্তব্য নিষ্ঠা ও প্রেমের শুদ্ধতার একটা সম্ভাব্যরূপকে যেন অনায়াসেই তুলে ধরছেন বিমল কর। শিবানীর মৃত্যুতে স্বামী ভুবনের মাঝে যে শুদ্ধতা নেমে আসে তা দেখে মনে হয় সে অন্য আর এক ভুবন।

বিমল কর এর উপন্যাস লেখার ভিত রচিত হয় তার লেখা অনেক গল্প থেকে, উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় তাঁর ‘সুধাময়’ গল্পের মতো গল্প থেকেই তিনি উপন্যাস লিখতে উদ্বুদ্ধ হন। এই গল্পের নায়কের আত্ম-অন্বেষণের ভঙ্গিটিই বিমল কর এর অনেক উপন্যাসের নায়কের চরিত্রে ফুটে তুলেছেন । বিমল মনস্তাত্তি¡ক দৃষ্টিভঙ্গিতে রচনা করেন অপেক্ষা, সংশয়, উদ্বেগ, আঙুরলতা, কাঁচঘরের মতো গল্প। আঙুরলতা তাঁর বিখ্যাত গল্প, বহুল পঠিত ও বহুল আলোচিত। আঙুরলতা গল্পে পতিতা আঙুরলতার সাথে নন্দর সম্পর্কটা প্রেমভালবাসা আর ঘৃণায় মেশানো। মনস্তাত্তি¡ক দৃষ্টিভঙ্গি থাকলেই একজন গল্পকার আঙুরলতার মতো গল্প লিখতে পারেন।

বিমল কর এর দু’একটা গল্প-উপন্যাস পড়ে তাঁকে বিষণœ লেখক হিসাবে ভেবে নেবার অবকাশ নেই। তাঁর বেশ কিছু গল্পে বিষণœতা বিশেষ অনুষঙ্গে উঠে এলেও তা নিঃসন্দেহে বাস্তবতা বর্জিত নয়। যেমন তাঁর শীতের মাঠ গল্প পড়ে মনে হবে বিষণœ মৃত্যু ভয় তাড়িত স্বামীর প্রেম শুদ্ধতায় উত্তীর্ণ। তিনি যে শুধু বিষণœতার অনুষঙ্গে গল্প লেখেননি তার উদাহরণ ‘সুখ’ গল্পটি। তাঁর লিখেছেন বাস্তবতা অভিজ্ঞতার আলোকে। গত শতকের ষাট শতকের পশ্চিম বাংলার রাজনৈতিক আন্দোলনের ফলে যে অস্থিরতা দেখা দেয় তার ছাপ আমরা লক্ষ্য করি তাঁর লেখা ‘নিগ্রহ’ ও ‘সে’ গল্পে। নব্বই দশকে প্রকাশিত ‘উপাখ্যানমালা গল্প সংকলনে পাঁচটি গল্প ‘সত্যকাম’, ‘কাম কামিনী’, ‘ফুটেছে কমল কলি’, ‘নদীজলে ধরা ছোঁয়ার খেলা।’ উপাখ্যান। বিমল কর নব্বই দশকে লেখা গল্পগুলোতে নতুনমাত্রা যোগ করতে সচেষ্ট হয়েছেন। এ পর্বের গল্পগুলোতে লৌকিক অনুষঙ্গের বাতাবরণ সৃষ্টি করলেও আধুনিক মন কিংবা মানসিকতার পরিচয় উপস্থাপন করেছেন। এখানে ‘ফুটেছে কমল কলি’ গল্পের কিছু কথা তুলে ধরা যেতে পারে। বিমাতার মেয়ে কনক খুব ভালবাসে নীলকমলকে, সে তা বুঝতেই দেয়নি নীলমণিকে। সংস্কারই তাকে বোধশক্তিকে প্রতিহত করেছে। দোলের উৎসবের দিন বিমাতা ইন্দু নীলমণিকে বলে বসে, ‘ওই মেয়ের সঙ্গে তোমার রক্তের সম্পর্ক নেই, ওর বাবা তোমার বাবা নয়।’

বিমল কর এ গল্পে ভালবাসার অনুষঙ্গ কত গভীর মাত্রায় উপস্থাপন করেছেন তা দেখতে গেলে এ গল্পের পরবর্তী অংশ উদ্ধৃত করতে ‘নীলমণি নানা ভাবে এর মাঝেই চেষ্টা করেছে কনককে বিয়ে দেবার। কিন্তু কনকের বিয়ে হয়নি। দোল পূর্ণিমার উৎসবে চলে যায়। এক বন্ধু ইন্দ্র নীলমণির চোখ খুলে দেয়। চশমা পরা থাকলে দেখা যায় না এমন একটা ইঙ্গিত দিলে নীলমণি বলে, “চশমা তো আমি পরি না।, ইন্দরদা।” ইন্দরদা বলে, “ওটা ঘসা কাঁচের চশমা। তোমার চোখ দুটো ওই রকম ছিল। অন্ধ তুমি। কাছের জিনিস দেখার চোখ তোমার ছিল না।” ইন্দ্র নীলমণিকে বুঝিয়ে দেয় “দেখ তারা সমুদ্রমন্থন করে অমৃত তুলতে চেয়েছিলেন। ভালবাসাও যে মন্থন করে তুলতে হয়গো।” আগের ভালবাসার স্বরূপটি ধরে দিতে চেয়েছিল সে নীলমণির মধ্যে: “ভালবাসার তত্ত¡টি দেহ থেকে আসে। মুশকিলটা কোথায় হয় জান? ভালবাসা যখন দেহ ছাড়া আর কিছু দেখে না- তখন সেটি কাঁচা ভলোবাসা।” ইন্দ্রের মুখ দিয়ে লেখক যে কথাটি বলেছেন তার মাঝে একটা দুর্লভ অনুভব লুকিয়ে আছে তা পাঠকের বুঝতে মোটেই কষ্ট হয় না। বিমল কর অন্যধারার গল্প ও লিখেছেন সে প্রসঙ্গের আগে তার উপন্যাসের ওপর স্বল্পপরিসরে আলোচনা করা যেতে পারে।

আগেই বলা হয়েছে তিনি ছোটগল্প লেখার মাঝ দিয়ে এক সময় নতুন মাত্রার উপন্যাস লিখে বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে নিজের পারঙ্গমতার পরিচয় রাখতে সক্ষম হয়। তার লেখা উপন্যাসগুলোর নাম এখানে তুলে ধরা অপ্রাসঙ্গিক হবে না বলে মনে করি। ‘অপরাহ্ন’, ‘যদুবংশ’, ‘দেওয়াল’ (১৯৫৬), ‘সান্নিধ্য’ (১৯৭৩) প্রচ্ছন্ন (১৯৭৭) ‘নিমফুলের গন্ধ’ (১৯৮৬) ‘খোয়াই’, ‘অসময়’ (১৯৭৩), ‘শমীক’ (১৯৯৫) ‘ত্রিপদী’, ‘নতুন তারা’ (১৯৮৯) ‘এক অভিনেতার মৃত্যু’ (১৯৯২) ‘ভুবনেশ্বরী’, ‘খড়কুটি’, ‘পূর্ণ’, ‘অপূর্ণ’ ইত্যাদি। বিমল কর এর উপন্যাস ‘অসময়’ ১৯৭৫ সালে সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরষ্কার লাভ করে। তাঁর লেখা উপন্যাস গুলোর মধ্যে দেওয়াল ও অসময় বাদ দিলে ছোট উপন্যাসের সংখ্যাই বেশি। তিনি ছোট উপন্যাস লিখতে বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন তা তিনি নিজেই বলেছেন, “বেশির ভাগ উপন্যাস ঝযড়ৎঃ ঘড়াবষ-এর অর্ন্তভুক্ত। আসলে আমি সে ধরনের উপন্যাস লিখতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি যা বিশেষ একটা ধারণাকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করবে। আর এগুলো আকারে ছোট হলেও অনেকক্ষেত্র বিষয়গত ভাবে খানিকটা জটিল।”
0

প্রবন্ধ - বেবী সাউ

Posted in







কবি মণীন্দ্র গুপ্ত পাঁচ-এর দশকের শেষের ও ছ’য়ের দশকের শুরুর দিকে কবিতা লিখতে শুরু করলেও, আধুনিকতার যে ইয়োরোপীয় ভাবনায় তাঁর সমসময়ের সাহিত্য রচিত হচ্ছিল, তিনি তার থেকে একটু আলাদা ছিলেন। এমনটা নয়, তিনি তাঁর কাব্যভাষায় ও কাব্যদর্শনে প্রাচীনের দিকে ঝুঁকে পড়েছিলেন। বরং, তিনি তাঁর সারাজীবনের কাব্যকৃতি এবং কাব্যদর্শনে চিরায়ত সংস্কৃতিকে ধরতে চেয়েছেন দেশজ সংস্কৃতির প্রেক্ষাপটে। তিনি পুরনোকে অবিকল হাজির করেননি, কিন্তু পুরনোকে তার ঐতিহাসিক ভিত্তির জায়গা থেকেই নতুন ভাবে দেখেছেন। তাই বিভিন্ন লোকসাহিত্য, লোককথা, পুরাণ, টোটেম, প্রতীক ফিরে এসেছে তাঁর কবিতায় আধুনিকতার অনুষঙ্গে। আমার এই গবেষণা পত্রের কাজই হল, ষাট দশকের কবিদের পাশাপাশি মণীন্দ্র গুপ্তের কাব্যভুবন কীভাবে আলাদা, তার এক পর্যালোচনা করা।

মণীন্দ্র গুপ্তের প্রয়াণের পরে ‘স্বকাল পত্রিকা’ ও ‘আদম পত্রিকা’ মণীন্দ্র গুপ্ত সংখ্যা প্রকাশ করেছে ২০১৮ সালে। সেখানে তাঁকে নিয়ে প্রচুর নিবন্ধ লিখেছেন বিভিন্ন সময়ের কবি ও লেখকরা। এ ছাড়া মণীন্দ্র গুপ্তকে নিয়ে তেমন ভাবে কোনও আলোচনা বা গবেষণা হয়নি। সেভাবে বলতে গেলে, এই গবেষণাপত্রই বাংলা সাহিত্যের এই প্রখ্যাত কবিকে নিয়ে প্রথম গবেষণাপত্র।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বা প্রণবেন্দু দাশগুপ্তের কবিতার মধ্যে যে স্মার্ট নাগরিকতা এবং বিপন্ন অস্তিত্বের ভাষ্য আমরা খুঁজে পেলাম, তার একধরনের পরিবর্ধন দেখা যেতে লাগল ষাটের বা ছ-এর দশকে। আমরা পেলাম ‘বালক জানে না’-এর কবি সুব্রত চক্রবর্তীকে, পেলাম ‘ব্যান্ডমাস্টার’-এর কবি তুষার রায়কে, ‘অন্ধ স্কুলে ঘন্টা বাজছে’-এর কবি দেবারতি মিত্রকে এবং 'অবশ্যই শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা'-এর কবি ভাস্কর চক্রবর্তীকে। সঙ্গে এ কথাও মাথায় রাখতে হবে, পাঁচ-এর দশকের কবিদের কবিতা অনেক বেশি সংহত রূপ ধারণ করল এই ছয়ের দশকেই। পাঁচ-এর দশকের অনেকের-ই প্রথম কবিতার বইও এই ছয়ের দশকেই বেরোন। ফলে, এ কথাও বলা যেতে পারে, যে ছয়ের দশক হল পাঁচ-এর দশকের কবিদের নিজেদের ভাবনা ও কাব্যভাষা খুঁজে পাওয়ার দশক। অনেকটা আশ্চর্যরকম ভাবেই, ভাস্কর চক্রবর্তী এবং তুষার রায় তাঁদের প্রথম কাব্যগ্রন্থেই খুঁজে পেয়েছিলেন এক অনন্য কাব্যভাষা। একদিকে তুষার রায়ের 'ব্যান্ড মাস্টারে' যেমন ছিল এক নাগরিক কবির প্রবল অস্তিত্বসংকটের ভাষ্যের সঙ্গে মৃত্যুবোধের অমোঘ মিথষ্ক্রিয়া, তেমন আরেকদিকে ভাস্করের কবিতায় ছিল জীবনানন্দ কথিত বিপন্ন বিস্ময়ের এক নাগরিক যাপনের ভাষ্য। 'শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা'র পরবর্তী কাব্যগ্রন্থগুলিতে যেমন ভাস্কর অনেক বেশি তীক্ষ্ণ হয়েছেন। ছয়ের দশকের এই কাব্যচর্চায় কীভাবে মণীন্দ্র গুপ্তের কবিতা ভিন্ন এক দিগন্ত তুলে ধরেছে , তা-ই এই গবেষণায় অন্যতম সূচনাবিন্দু।


কেমন ছিল তাঁর কবিকৃতি? ষাট দশকের আশেপাশে তিনি যখন কবিতা লিখতে শুরু করেন, তখন তাঁর পাশাপাশি রয়েছে কৃত্তিবাসের কবিরা। সহজেই তিনি প্রভাবিত হতে পারতেন তাঁদের দ্বারা। প্রভাবিত হতে পারতেন কৃত্তিবাসের পাশাপাশি শতভিষা পত্রিকার আবহমান নীচু স্বরে গুরুত্বপূর্ণ কাব্যব্যক্তিত্ব দ্বারাও।

কিন্তু কবি মণীন্দ্র গুপ্তের মধ্যে ছিল এক নতুন কাব্যভাষার খোঁজ। আর মানসিক ভাবে তিনি বহুস্বরে বিশ্বাসী এক কবি ছিলেন। যখন নাগরিকতার চিত্রকল্প, একাকী মানুষের বিষাদ এবং প্রকৃতির সঙ্গে উচ্ছসিত যাপনের এক ধারাবাহিক লেখার পৃথিবী ক্রমশ ছড়িয়ে যাচ্ছে বাংলা কবিতায়, তিনি একটু অন্য পথে হাঁটা শুরু করলেন। বাংলার দেশজ চিত্রকল্পের কাছে ফিরে গেলেন। ফিরে গেলেন মানুষের কাছে। মানুষের কথ্য ভাষায় ব্যবহৃত নানা ঘটনা, লোককথা, লোকসংস্কৃতি, প্রবাদ, ধর্মীয় বিশ্বাস, টোটেম, আর এ সমস্ত কিছুর অনাবিল শব্দভাণ্ডার তাঁর জীবনকে এবং কাব্যভাষাকে গড়ে তুললো। তিনি অন্বেষণ করতে লাগলেন এমন সব শব্দের, এমন সব চিত্রকল্পের, যা আবহমান কাল ধরে বাংলার সংস্কৃতিকে পুষ্ট করেছে। সেই সব শিকড়ভেজা শব্দগুলিকে তিনি নতুন করে প্রাণ দিলেন তাঁর কবিতায়।


যেমন, তাঁর এই কবিতাটির মধ্যেই তাঁর স্বতন্ত্র কাব্যভাষা স্পষ্ট-


কিন্তু ফ্যাকাশে চাঁদের আলোয় দেখা যায়, সেই ভূত একলা

ভিখারিনীর মতো দাঁড়িয়ে আছে।

এদিকে শেয়ালনী ছোট্ট মাথাটিকে দুই পায়ের মধ্যে রেখে

কাঁকড়া খাবার মতো করে এক কামড়ে ভেঙে দিলে

বাচ্চাটা ককিয়ে উঠল: মা!

শেয়ালনী করুণ স্বরে ‘বাছা, এই তো আমি— ’ বলে

ঘুমপাড়ানি গান গাইতে গাইতে খেতে লাগল।

(মাহাতদের মরা শিশু, লাল স্কুলবাড়ি,১৯৭৮)



কিন্তু এই প্রাণপ্রতিষ্ঠা পুরনোর কাছে ফিরে যাওয়া হল না। বরং পুরনোকে, শিকড়কে নতুন ভাষার, নতুন ব্যাখ্যার এবং নতুন দৃষ্টিকোণের প্রেক্ষিতে হয়ে উঠলো প্রকৃতই উত্তরাধুনিক এক কাব্যবীক্ষা। আলোচ্য গবেষণায় মণীন্দ্র গুপ্ত কীভাবে তাঁর অধুনান্তিক কাব্যভাষা গড়ে তুলেছিলেন এবং কেনই বা তাঁর কাব্যভাষাকে আধুনিকতার গণ্ডী ছাড়িয়ে অধুনান্তিকতার পথে উত্তীর্ণ বলে গবেষকের মনে হচ্ছে, তার এক যুক্তিগ্রাহ্য অনুসন্ধান থাকবে। এই আলোচনার পরিসরে আলোচিত হবে তাঁর প্রথম থেকে শেষতম কাব্যগ্রন্থ, তাঁর কাব্যভাবনা, কবিতা সংক্রান্ত গদ্য এবং প্রবন্ধ। আধুনিকতা নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি লিখেছিলেন, “আধুনিকতা কাকে বলে? আমি অন্তত তার সংজ্ঞা জানি না। ‘আধুনিকতা’ এই ধারণাটিকে যদি প্রগতির সঙ্গে যুক্ত করি, কিংবা উত্তরোত্তর আধুনিকের লক্ষণ অনুসন্ধান করি তবে শব্দটি ও তার অর্থ অনিত্য ও অস্থির হয়ে যাবে।

আধুনিকতার সঙ্গে আমি সময়ের স্রোত যোগ দিতে চাই না। সমকালীনতা না, ধ্রুবতাও না। আমি ভাবি ফুরফুরে চিরকালের নির্যাস— চির-জীবনবোধের তন্মাত্র, তার আভা।

এ কথা অন্য সব বিষয়ে যেমন, কবিতাতেও তেমনি। ধরা যাক পোশাকের কথা— ইন্দ্রের চক্ষুর মতো পকেটময় একালীন জিনস না কি সন্ন্যাসীর কপনি-বহির্বাস-সাপি, সীবনহীন আর্য ধুতি চাদর, রোমান টোগা, সেমাইট আলখাল্লা বা মায়া পন্‌চো? আমার তো মনে হয়, শত শত জগঝম্প জরদ্গ‌ব পোশাকের (মিউজিয়ম, রাজ্যাভিষেক ও পার্টি দ্রষ্টব্য) বিপরীতে ঐ সব পোশাকই আধুনিক। সন্ন্যাসীর কপনি আধুনিকেরও আধুনিক।

গ্রীকরা তো শেষ লড়াইয়ে যেতেন পুরো বিবস্ত্র হয়ে। তেমনি শেষ কবিতার বেলায় কোনো আভরণ, আড়াল থাকবে না। এতদিনের এত যে যুদ্ধ শেখা তা কেবল ঠিক লক্ষ্যে আঘাত করার জন্যে। হত্যার মতো মৌলিক, মৃত্যু পেরিয়ে আসার মতো সহাস্য— এ শুধু পাওয়া যাবে যদি শরীর দিয়ে শরীরকে আঘাত করি, অস্ত্রাঘাত করি এবং করতে দিই সোজা নিরাবরণ চামড়ায়।

ঐ মরণপণ যুদ্ধের কথা ভাবলে আধুনিকতার ধারণা খুঁজে পাই। নিপুণ, নির্ভয়, অপ্রমত্ত, সংস্কারশূন্য ঐ সংঘর্ষের সঙ্গে ও শেষে আছে তার প্রাপণীয়: জীবন ও জগৎ উপভোগের অনিঃশেষ আনন্দ। অবস্থাটা একটি গল্প দিয়ে স্বচ্ছ করি:

জেন গুরু রিয়োকান নির্জন পাহাড়তলিতে ছোট একটি কুটিরে সরলতম জীবন যাপন করতেন। একদিন তিনি বাড়ি নেই। সন্ধেবেলায এক চোর এসে দেখল, চুরি করার মতো কিছুই নেই সেখানে। ইতিমধ্যে রিয়োকান ফিরে এলেন এবং চোরকে ধরলেন। ‘তুমি হয়তো দীর্ঘ পথ হেঁটে আমাকে দেখতে এসেছ’, সেই নিঃশব্দচরকে বললেন তিনি, ‘তোমাকে শূন্য হাতে ফিরিয়ে দেওয়া যায় না। অনুগ্রহ করে আমার পোশাকটিই উপহার হিসেবে নাও।’

প্রাসঙ্গিক ভাবেই, তাঁর সাক্ষাৎকারও আলোচিত হবে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাঁর গদ্য থেকেও তুলে আনা হবে এই গবেষণার উপযোগী বিষয়। আমার এই গবেষণার উদ্দেশ্য মণীন্দ্র গুপ্ত-র এই কাব্যভুবন ও কাব্যমানচিত্রকে অনুসরণ করা। বাংলা কবিতার সরণ মণীন্দ্র গুপ্ত-র কাব্যভাষার হাত ধরেই আগামী কাব্যভাষায় প্রবেশ করতে চলেছে। তার বীজ এবং আলোকবর্তিকা রয়েছে মণীন্দ্র গুপ্তের কবিতাতেই।
কেন ছয়ের দশকের কবিদের থেকে মণীন্দ্র গুপ্তের কবিতার স্বর ভিন্ন, শুধু সে কথাই নয়, আমরা আলোচ্য গবেষণায় দেখব কীভাবে মণীন্দ্র গুপ্তের কবিতা আগামী পাঁচ দশকের বাংলা কবিতার জগতে এক ভিন্ন স্বর আনয়ন করল।


কিন্তু ছয়ের দশকের এই কবিতাগুলির বিপ্রতীপে যেন অবস্থান করছে মণীন্দ্র গুপ্তের কবিতা। এর একটা কারণ কবি মণীন্দ্র গুপ্ত প্রথম থেকেই এই নাগরিক বিপন্নতার বাইরের লোক ছিলেন। আর আরেকটা কারণ কবি মণীন্দ্র গুপ্তের ভাবনার ভিতরে কাজ করেছিল একধরনের অন্য বিপন্নতা। আর সেই বিপন্নতার নাম মৃত্যুবোধ। কিন্তু এই মৃত্যুবোধ কবি মণীন্দ্র গুপ্তকে মৃত্যুবিলাসী করে তোলেনি। বরং অনেক বেশি করে টেনে নিয়ে গেছে বাংলার স্বতন্ত্র ধারার যাপনের কাছে। মানুষের ভাবনা, চিন্তা, দর্শন, সংস্কৃতি, রীতি, আচার এবং নিজস্ব এক দর্শনের জগতে তিনি অবগাহন করেছিলেন। যেমন, আমরা উদাহরণ হিসেবে তাঁরই কবিতা থেকে তুলে আনতে পারি তেমনই মণিমুক্তো-

যেমন-
এক লক্ষ বছর সঙ্গে থাকার পর সাব্যস্ত হবে, তুমি আমার কি না।
এখন ওসব কথা থাক।
এখন চলো মিকির পাহাড়ে বুনো ফুল পেকেছে, চলো খেয়ে আসি।
লাল রুখু চুল
সূর্যাস্তের মধ্যে
অর্কিডের উজ্জ্বল শিকড়ের মতো উড়ছে।
--দেখি দেখি তোমার তামাটে মুখখানা দেখি!


আমরা দেখি মণীন্দ্র কবিতাপাঠ আসলে এক দীর্ঘ যাত্রা। ঠিক ওই মাধুকরীতে বেরিয়ে পড়ার মতো। যার আদি আছে অন্ত নেই।




0

প্রবন্ধ - দীপকরঞ্জন ভট্টাচার্য

Posted in







সিকিম বা দার্জিলিং তুমি কতই তো গেছ -- ম্যাডক্স স্কোয়ার থেকে পুজোর রাত্তিরে সেই যে একবার হেঁটে ফিরেছিলে! কত সময়ের কত উৎসব আর কতই না সব ছবি --- কুয়াশার ঘন পথে বাইসন নেমে আসা পাহাড়ি নদীর খাত, পাহাড় চুড়োয় প্যাগোডা থেকে নানা বর্ণের পাখনা মেলা কত পতাকা, ঝুলন্ত সেতুর ওপর প্রেমিকের গান... কিন্তু কোনো অজ গ্রামে কি কখনো তুমি যেতে চেয়েছ ? ডাঙাজমির পট ঘিরে তালসারির রূপ দেখেছ সেখানে ? মানুষজনের সঙ্গে দুটো কথা বলতে প্রাণ চেয়েছে? -- বিশেষ জায়গা ছাড়া কোথাও খুব একটা যাই না আমরা, তাই না! আমরা নামি পটভূমি খুঁজি, বরফে ঢাকা পাহাড়ের সারি কিংবা সাগরমুখো ঘর চাই। অথচ ড্রয়িংরুমের দেওয়ালে গ্রামের সেই ছবি টাঙাতে ভারি ভালো লাগে আমাদের -- কী অপূর্ব খড় ছাওয়া ঘরগুলো, সামনে একটা দাওয়া, মাটির রাস্তার এক পাশে একটা হেঁটমুণ্ড গরুরগাড়ি! যা দেখায় চোখ জুড়োয়, তাকে নিকট করতে না পারার এক রহস্যময় দূরত্বেই আমাদের বাস।
.
আজকের দিনে খড় ছাওয়া এই ঘরগুলো, তাকে ঘিরে থাকা এই সামান্যের সাজ, আসলে এক অসহায়তারই ছবি। কবি দেখতে পান, 'অসহায় সেইসব ছবি থেকে নেমে আসে কিছু উদোম মানুষ। এক বোকা খাঁদানাক কালো ভগবানও নেমে আসে। সকলের হাতে তির-ধনুক কিংবা উদ্যত বর্শা'! প্রাকৃত স্বপ্নের এইসব মানুষের ঠাঁই হয় না শহুরে কোনো কবিতার উঠোনেই। এদের মুখের ভাষা কেমন হবে, খাঁদানাক কালো ভগবানকে ঘিরে তারা কোন বি-ভাষার বাঁধা শ্লোকে পুজোআচ্চা করবে, এই নিয়ে তখন আরেক ভাবনা! কবিতায় এইসব কথা বাঁধতে গেলে, কবিতার বাঁধনও যায় বদলে, কবির দৃষ্টি যায় বদলে। ... পুরোনো সংস্কৃত নাটকে দেখো না, রাজা আর পুরোহিত কেমন সংস্কৃতে কথা বলছেন, অথচ জেলে ও প্রহরীর কথা হচ্ছে মাগধীতে, অর্থাৎ কেজো রাস্তার ভাষায়! বেশ কয়েক বছর আগে ছোটো নাগপুরে রামগড় পাহাড়ের গায়ে সম্রাট অশোকের সময়ের দুটি প্রত্নলিপি পাওয়া গিয়েছিল। দুটিই কবিতা।একটি শিলালিপিতে সেই কবিতার ভাষা হল পালির কাছাকাছি, ছন্দ বৈদিক, অন্যটার ভাষা, ছন্দ, সমস্তই প্রাকৃত। সেই ছন্দের নাম 'গাথা'। মেয়েদের গানকে তখন 'গাথা' বলা হতো। এত আগে থেকেই যদি লিঙ্গভেদে, শ্রেণীভেদে ভাষা কিংবা ছন্দ বদলে বদলে নিয়ে থাকে তাদের চলন -- আজকের কোনো কবি কি আর ঘ্রাণ নেবেন না তবে সেই ঘাসমাটির, তাকাবেন না মানুষের ভাষার আদল-বদলের দিকে, তাদের চাঁচাছোলা ভণিতাহীন রুক্ষ উচ্চারণের দিকে -- নতুন ছন্দে, নতুন শৈলীতে বিকল্প এক ঈশ্বরের স্বর জাগিয়ে তুলবেন না কেউ! আজ তো পৃথিবী জুড়ে আড়-ভাবুকদেরই দিন! সময়ের তলে তলে আরও এক অতল সময়ের স্রোত!
.
তোমার মনে পড়তে পারে এক সাহিত্যসভার কথা, কল্পিত সেই সভায় 'শেষের কবিতা'র 'অমিত'-র সেই তির্যক অভিমত : 'চাই কড়া লাইনের, খাড়া লাইনের রচনা -- তিরের মতো, বর্শার ফলার মতো, কাঁটার মতো।... খোঁচাওয়ালা কোণওয়ালা গথিক গির্জার ছাঁদে, মন্দিরের মণ্ডপের ছাঁদে নয়। এমনকী যদি চটকল পাটকল অথবা সেক্রেটারিয়েট বিল্ডিংয়ের আদলে হয়, ক্ষতি নেই।' এই কথাগুলো অমিতকে বলতে হচ্ছিল রবিঠাকুরের কোমল লেখালিখির প্রতিবাদে। এর মধ্যে কি সেই সময়ের নিরিখে মাত্রাহীন আধুনিকতায় মেতে ওঠা লেখালিখির বিরুদ্ধে এক ঘুরপথের প্রতিবাদও ছিল না! তাও ছিল। তা-ই বোধহয় ছিল বেশি করে। অমিতর এই প্রতিবাদ তো কোনো শৈলীকে নাকচ করতে বলা নয়, প্রকৃতপক্ষে তাকে শিরোধার্য করার তাগিদেই তার এই উচ্চারণ! একই সঙ্গে অমিতর এই কথাগুলোতে আরো ছিল, সাহিত্যের ভাষাভঙ্গির আদর্শ ছাঁচ নিয়ে তার স্রষ্টার নির্দিষ্ট এক ভাবনার পরিসর -- সৌষম্যই যেখানে পাখির চোখ।
.
সেই রুচি যে আজ একেবারে আকাশ-পাতাল বদলে গেছে, তা কি বলা যাবে? আজও আমাদের বেশিরভাগই মৃদু মেজাজের কবিতা, ছন্দে মিলে মিঠেস্বভাবের কবিতায় স্বচ্ছন্দ। মন্ত্রপাঠের মতো নিবিষ্ট হোক কবিতা, তাতেই আমাদের অনেকের আগ্রহ। কারোর কারোর ভাবনায় কবিতা যেন আমাদের বাড়ির ছোটো মেয়েটি। সে হাঁটলেই নূপুর বেজে ওঠে যেন, সেদিকে তাদের নিরন্তর লক্ষ। অথচ সত্যিই যদি কবিতা অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়ায় -- সেই মেঠো ভগবানের বর্শার ফলার দিকে! তার বি-ভাষার স্বরের মতো! আয়না ঘুরিয়ে আজ মাঠ-জলা-জঙ্গল আর সেই কাদামাটির দেশে হেঁটে বেড়ানো মানুষগুলোর সহজ আলো আর গাঢ় অন্ধকারে কলম ডুবিয়ে যিনি লিখতে বসেন, তাঁর কবিতা নিয়েই আলাপ করব।
.
কোনো কবিকে নিয়ে কথা বলতে গেলে, তাঁর লেখালেখির ভাবনা নিয়েও তো কথা এসে যায়, নিজের মতো করেই তাঁর রচনার আকাশের কথা বলতে হয়, নিজের বোঝাবুঝি নিয়েই তাঁর কবিতাকে পাঠকের দিকে বাড়িয়ে দিতে হয়! কিংবা হয়তো নিজের থেকে কিছুই বলা হল না -- তাঁর বলাটাই রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে নিজের কথাকে বদলে দিয়ে গেল! যাঁর ভাবনার পরতগুলো নিয়ে আমাদের আলাপ ক্রমে তাঁর কবিতার বিস্তারে মিশে যাবে, তিনি, কবি নিত্য মালাকার। --- তিনিই সেই কবি, তাঁরই সেই কবিতা, 'শেষের কবিতা'-র অমিত বাংলা কবিতার যে ছাঁচভাঙা রূপ দেখতে চেয়েছিল! আজ তাঁর যে কবিতার বইটিকে ঘিরে আমাদের কথা হবে, সেটি 'অস্ট্রিক' থেকে প্রকাশিত তাঁর 'কবিতা সংগ্রহ'। কবি নিত্য মালাকারের বাসভূমি উত্তরবঙ্গের মাথাভাঙা অঞ্চলে -- তাঁর নিভৃত উচ্চারণ পাঠকের কাছে তুলে আনছে পূর্ব মেদিনীপুরের এক প্রকাশন -- কবিতায় সবই সম্ভব! গোপন প্যামফ্লেটের মতো এইসব লেখা, নাহলে তোমার আমার মতো পাঠকের কাছে পৌঁছোবে কীভাবে!
.
তাঁর কবিতা জুড়ে নুড়িপাথরের মতো ছড়িয়ে রয়েছে ভাষা ও ভঙ্গির অজস্র জিজ্ঞাসা। 'রোদ ও মাঠের শূন্যতা ভেঙে অচেনা অক্ষর সব ক্রোধে ঝিকিয়ে' উঠুক, এই তাঁর ইচ্ছা ! 'ক্ষুর বা অগ্নির চেয়ে তীব্রতর' হোক ভাষা -- ভাষাবিষয়ে এই তাঁর খাপখোলা প্রস্তাব। 'অলংকার মালা পরানোর দিন নেই আর' --- এই তাঁর বিশ্বাস। 'কাব্যে পুস্তকে ও করে-খাওয়াদের বাক্ রীতিতে আছে ভবিষ্যৎ, এরই ভেতরে পথ করে নিতে হবে; নিজেকেই। রাশি রাশি শূন্য ও সংখ্যার জোরে চলছে যে জগৎ, তাকে বস্তু ভাবো' --- এই তাঁর শ্লেষ জড়ানো আত্মপাঠ।
.
'...উত্তমর্ণদের প্রতি শেষ কর্তব্য চুকিয়ে/ ভেঙে ফেলি শব্দ ও রূপের খাঁচা চর্যাপদ হরিণীর --/ লিখে ফেলি পুনরায় / চণ্ডাল জেনেছে বার্তা, আমি যা জানিনি' --- তাঁর চূড়ান্ত এবং অকপট বিদ্রোহ তাঁকে ভাস্কর্যের মতো গেঁথে নিতে সাহায্য করে তাঁর কবিতার গড়ন। মৃত শব্দের কাঁধে হাত রেখে চলতে আর চান না তিনি। আর যে-মানুষ একা পথ হাঁটেন, জীবনে বা কবিতায় --- গড্ডালিকায় ভেসে থাকা সুধী পাঠক যে তাঁর প্রতি অমনোযোগী হবেন, তা একরকম জানা কথাই। তাঁর লেখা যে হা-মানুষের উপাখ্যান! তাঁর ঈশ্বর যে লৌকিক। তিনি কথা বলেন সহজ ছবি থেকে নেমে আসা হা-মানুষের হয়ে! হয়তো তার নিজের হয়েও, যাকে হা-মানুষেরা দলে নেয় না, নেয় না শহুরে রম্যভব্য লেখকেরাও :
.
'সদর্থক সব শব্দই তো রবীন্দ্রনাথ আর সংবিধানে লেখা আছে... আমি গড়াতে লাগলাম নীচে, মহা নীচে। দেখলাম, জলস্থল ভেদ করে এমন পতন আমি বানিয়েছি, উত্তরণের জন্য শেষ যাত্রা, সার্থক -- কিছুই রাখিনি।'
.
'জন্মে জন্মে শব্দ তার বাচ্যার্থ ভুলতে ভুলতে ব্যঞ্জনার জন্য আরও জটিল, সুন্দর হয়।' --- কবিতার জন্য সম্ভাবনাময় প্রতিটি শব্দ একজন কবির কাছে যতটা মূল্যবান হয়ে উঠতে পারে, সম্ভবত তার কানাকড়িও নয় অন্য কারো কাছে! সেই শব্দ নয় তাঁর গল্পমালার ইঁট, সেই শব্দের ভিতরঘরের জ্বোরো বা শীতল ভাবটুকু, তার অনুভূতি আর অর্থ-পেরোনো আহ্বান নিয়েই কবির জগৎ :
.
'আমি একটি শব্দে বিশ্বাস করি -- শব্দ আমাকে
আমি একটি ব্যাঘ্রে বিশ্বাস করি -- ব্যাঘ্র আমাকে
অথবা একটি পেঁচায় বিশ্বাস করি, পেঁচক আমাকে
বিচরণশীল রাখে -- ভাসমান,আমার ভেতরে
ওই শব্দ ওই বাঘ অথবা সে পেঁচা
স্বপ্নে ঘরবাড়ি গড়ে অথবা তা ভাঙে
আসবাব তৈজসে ভরা বিকারের জাহান্নাম
অথবা সে অমরাপুরীতে
ক্রমশ ডেকেই যায় টিক-টক,
টিক-টক...'
(অংশ)
.
শব্দ এক ছদ্মবেশী বাঘ, সে তোমাকে মুহূর্তে ছিঁড়েখুঁড়ে দিতে পারে, যদি তুমি কবি হও। সেই বাঘের ডাকে তোমার মনে পড়ে যায় দ্রুতধাবমান সময়ের কথা, উন্মত্ত কালসমুদ্রের কথা --- সেই বাঘের ডাকে ঘড়ির কাঁটার 'টিক টক' উঠে আসে একদিন। 'ক্ষুধা ও তৃষ্ণার পদ্য' পিঠে নিয়ে সে ছুটতে থাকে বন-বাদাড় ডিঙিয়ে। জলহীন খাদ বালি আর মানুষের পদছাপে ঘেরা অন্ত্যজদের ত্বকের মতো খসখসে ভূমিতে দাঁড়িয়ে সে ছুঁড়ে ফেলে দেয় অবাস্তব 'খোলাম কুচির স্বপ্ন' --- পেতে চায় চণ্ডালের সহজিয়া সিদ্ধি :
.
'আমি কীভাবে কলম ধরব ভয় হয়, বিভিন্ন শব্দে শিল্প, অনুরাগ
নিয়ন্ত্রণ সহজসাধ্য কি হবে? তাই ভাবি, নাহ্ --
কিছুই বলব না;
বরং এসো ভাতের গল্প করি'।
.
পেঁচার কথায় চলে আসে রাতের কথাও --- তাঁর কবিতা যে রাত্রির ভাষায় কথা বলে! হয়তো কাকজোছনার নীচে নৈশভোজের আসর জমে ওঠে সেখানে। স্বপ্নে ও সংগমে লীন হতে হতে ধু ধু নিঃসঙ্গ জ্যোৎস্নায় হাত ধরে হেঁটে যায় মানুষ শূন্য নদীর বুকে। নারীশরীরের উনোনে জ্বলে রাখ হয়ে যায় পুরুষরূপী কাঠ, লেখার টেবিল থেকে উড়ে যায় নীল পদ্য, ছাতিম গাছের নীচে পুঁতে-রাখা যত কেচ্ছা, ধুয়া আর কালের ইন্ধন'।
.
'চোখের ভেতরে চোখ বুনো মহিষের মতো
নেমে যায় জলে
ধুয়ে নেয় শেষ রিপু তারার আলোয় চিনে চলে যায় দিকশূল' ---
.
'শেকড়, স্বপ্ন ও সাপ আর মহিলাকে ভালোবাসা অন্ধকারেই খুব ক্রিয়াশীল হয়।' এই অন্ধকার তাঁর কাছে এক স্বচ্ছতার পটভূমি: 'অন্ধকার কি এর চেয়ে ভালো নয়, স্বচ্ছ নয়, অর্থপূর্ণ নয়?' মধ্যরাতের হাওয়াবাতাসের মধ্যে হেঁটে বেড়ায় অমৃতকলস-কাঁখে এক জাদুবুড়ি : 'সন্ধ্যায় বাংলোর মুখে যে ঋতুহীন চাঁপাগাছ অভ্যর্থনা করেছিল, মধ্যরাত্রিতে সেই মধুমতী হল'। কখনো আবার আত্মবিষে নীল হতে হতে শ্লেষে, অসহায়তায়, ক্রোধে, বিপন্নতায় তাঁকে বলে উঠতে হয় :
.
'এই রাত্রির যে এক একান্ত ব্যক্তিগত রস আছে তা আমি এইভাবে পাণ্ডুলিপিতে রেখে যাচ্ছি কেন? এত নীচে তলিয়ে যাচ্ছি কেন? কোন অবদমন থেকে এসব আসে? ওই তো টিলার বস্তি থেকে কালো ধোঁয়ার আকারে পাকিয়ে পাকিয়ে উঠছে স্নেহ। কোন অনির্দেশ্যের দিকে তিন জোড়া শিশুকঙ্কালের হাত প্রার্থনা করে? আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি একটি নড়বড়ে কঙ্কালের ঘাড়ের ওপরে আরোপিত জীবন্ত মাথাটি বার বার নুয়ে পড়ছে সামনে। তারই চেতনার রঙে এ পৃথিবী কালো হচ্ছে, মহাশূন্য এদের কোথায় রাখবে?
আমাকে বাঁচার জন্য আরও দূরে সরে যেতে হবে। আমি বাঁচলেই দিব্যদৃষ্টি খুলে যাবে কাকতাড়ুয়ার।'
.
যত দিন গেছে টানা গদ্যের ওপর তাঁর ভর গেছে বেড়ে। তাঁর জোরালো উচ্চারণ, তাঁর বিকল্প ঈশ্বরের সন্ধান না হলে পথ হারাত। এই গদ্যলেখা কিন্তু অনন্য এক শৈলী! গল্প, জার্নাল, বা খবরকাগজের মতো সেটা একেবারেই নয়। তার প্রতিটি পঙ্ ক্তির আছে আগুনফড়িঙের অচেনা দুই বর্ণময় ডানা, ঘটনা পেরিয়ে যা এক কালসমুদ্রের ওপর ভেসে যেতে পারে, বিরহের অন্ধকার আরও গভীর ভাবে ছড়িয়ে দিতে পারে। ওই তো শব্দের সেই বাঘ সামনে ছোটে তাঁর, মাথায় যার আগুনভাণ্ড। -- ধূপ, না কি তার সুরভি, ধোঁয়া-ওঠা শরীরে গাছপালা ভেঙে লতাবিতানে সেজে ওঠে! আহ্ গ্রন্থাতীত! ওই যে শব্দের বাঘ সমানে ছুটে চলেছে। রাত্রির পেঁচা আজ ভয়াবহ ডাক দিয়ে ওঠে। ডেকে যায়, ডেকে নিয়ে যায় তার গর্ভগৃহ অন্ধকারে। কী যেন এক অমীমাংসিত হাওয়া খেলে বেড়াচ্ছে সেখানে...
.
ঋণ :
নিত্য মালাকারের কবিতা সংগ্রহ
অস্ট্রিক প্রকাশন
0

প্রবন্ধ - মনোজিৎকুমার দাস

Posted in








ভারতে হিন্দু পুনর্জাগরণের স্বামী বিবেকানন্দ অন্যতম পুরোধা । তিনি হিন্দু সন্ন্যাসী, দার্শনিক, লেখক, সংগীতজ্ঞ এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর ভারতীয় অতীন্দ্রিয়বাদী রামকৃষ্ণ পরমহংসের প্রধান শিষ্য। তার পূর্বাশ্রমের নাম ছিল নরেন্দ্রনাথ দত্ত।

স্বামী বিবেকানন্দের জীবন দর্শন শিক্ষা , ধর্ম,সমাজ ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে। তিনি একজন সন্ন্যাসী হয়েও
মানুষের শিক্ষা, ধর্ম, সমাজ ইত্যাদিকে নিয়ে তার অমূল্য দর্শনকে তুলে ধরেছেন মানবিক ভঙ্গিতে, যা মানব কল্যাণের জন্য অপরিহার্য। এমনভাবে কোন সন্ন্যাসী মানবতার দর্শন ও সমাজ সংস্কারের বাণী প্রচার করেছেন বলে মনে হয় না।

স্বামী বিবেকানন্দ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে হিন্দুধর্ম তথা ভারতীয় বেদান্ত ও যোগ দর্শনের প্রচারে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। অনেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে বিভিন্ন ধর্মমতের মধ্যে পারস্পরিক সুসম্পর্ক স্থাপন এবং হিন্দুধর্মকে বিশ্বের অন্যতম প্রধান ধর্ম হিসেবে প্রচার করার কৃতিত্ব বিবেকানন্দকে দিয়ে থাকেন। বিবেকানন্দ রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠা করেন।তার সবচেয়ে বিখ্যাত বক্তৃতাটি হল, "আমেরিকার ভাই ও বোনেরা ...," ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোয় বিশ্ব ধর্ম মহাসভায় প্রদত্ত চিকাগো বক্তৃতা, যার মাধ্যমেই তিনি পাশ্চাত্য সমাজে প্রথম হিন্দুধর্ম প্রচার করেন।

জীবনের দর্শন সম্পর্কে আলোচনা করার আগে তার ব্যক্তি জীবনের উপর বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না বলে মনে করি।

বিবেকানন্দের পিতৃপ্রদত্ত নাম ছিল নরেন্দ্রনাথ দত্ত (ডাকনাম ছিল বীরেশ্বর বা বিলে এবং নরেন্দ্র বা নরেন)। ১৮৬৩ খ্রিষ্টাব্দে ১২ জানুয়ারি মকর সংক্রান্তি উৎসবের দিন উত্তর কলকাতার সিমলা অঞ্চলে ৩ নম্বর গৌরমোহন মুখোপাধ্যায় স্ট্রিটে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন।তার পিতা বিশ্বনাথ দত্ত কলকাতা উচ্চ আদালতের একজন আইনজীবী ছিলেন। বিবেকানন্দ একটি প্রথাগত বাঙালি কায়স্থ সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন যেখানে তার নয় জন ভাই-বোন ছিল।তার মধ্যম ভাই মহেন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন বিশিষ্ট লেখক ও বিদেশ ভ্রমণে বিবেকানন্দের সঙ্গী। কনিষ্ঠ ভাই ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন বিশিষ্ট সাম্যবাদী নেতা ও গ্রন্থকার।

ছেলেবেলা থেকেই আধ্যাত্মিকতার দিকে নরেন্দ্রনাথের আগ্রহ ফুটে ওঠে।স্বামী বিবেকানন্দের জীবনদর্শন প্রধানত মানবকেন্দ্রিক। উপনিষদ থেকেই তিনি এ শিক্ষা নিয়েছিলেন। মানুষকে নানা স্তরে বিশ্লেষণ করে, প্রত্যেক স্তরের পূর্ণ মর্যাদা দিয়ে অবশেষে মানুষের নিগূঢ়তম সত্যের পরিচয় প্রদানই উপনিষদের লক্ষ্য। স্বামী বিবেকানন্দ মানুষকে উপনিষদের দৃষ্টি দিয়েই দেখতেন। মানুষের দেহ-মন আশা-আকাঙ্ক্ষা কোনটাই অবহেলা করার নয়- কিন্তু তার অন্তরতম সত্য সর্বাপেক্ষা আদরণীয়। মানুষ যদি এই সত্যকে ভুলে তার বাহিরের সত্যগুলোকেই বড় করে তুলতে চায় তা হলে সে শ্রেয়ের পথ থেকে বিচ্যুত। সে নিজের ব্যক্তিগত কল্যাণকে সম্পূর্ণ সমৃদ্ধ করতে তো পারবেই না উপরন্তু সমাজকল্যাণকেও সে পদে পদে ব্যাহত করবে। কেননা, মানুষের দৈবসত্তাকে বাদ দিলে মানুষ স্বার্থপর হতে বাধ্য। হিংসা, ঘৃণা, লোভ, দম্ভ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়া তার পক্ষে স্বাভাবিক। স্বামী বিবেকানন্দ বিশ্বাস করতেন মানুষের দেবত্ব-উপলব্ধি ব্যাপকভাবে অভ্যাস করার সময় এসেছে। মানুষের শ্রেষ্ঠ সত্য তার জীবনের সর্বস্তরে প্রয়োগ করা যায় এবং করতে হবে। নতুবা মানবসভ্যতার সমূহ সঙ্কট। স্বামী বিবেকানন্দের জীবনদর্শনে এই প্রয়োগের নাম ‘কর্ম-পরিণত বেদান্ত’ । এছাড়া স্বামী বিবেকানন্দের জীবনদর্শনে ‘অভয়’ একটি প্রকৃষ্ট স্থান অধিকার করে আছে। তাঁর মতে, সাহস ও শক্তিমত্তা সর্বস্তরেই মানুষকে অগ্রগতিতে সাহায্য করে। সেজন্য তিনি কি ব্যক্তিগত, পরিবারগত অথবা সমাজগত, শিক্ষাগত কিংবা ধর্মগত সকল ক্ষেত্রেই উদ্যম, সাহস এবং নির্ভিকতার অনুশীলনের কথা বলতেন। তাঁর জীবনদর্শনের অন্যতম প্রতিজ্ঞা—সকল মানুষের অন্তরশায়ী আত্মা যিনি সর্বশক্তির আকর, চিরমুক্ত, চিরস্বচ্ছ, তাঁর জাগরণই মানুষের সকল কল্যাণের নিদান। বলেছেন তিনি, “উপায় শিক্ষার প্রচার। প্রথমত আত্মবিদ্যা—ঐ কথা বললেই যে জটাজূট, দণ্ড, কমণ্ডলু ও গিরিগুহা মনে আসে, আমার বক্তব্য তা নয়। তবে কি? যে জ্ঞানে ভববন্দন হতে মুক্তি পর্যন্ত পাওয়া যায়, তাতে আর সামান্য বৈষয়িক উন্নতি হয় না? অবশ্যই হয়। মুক্তি, বৈরাগ্য, ত্যাগ এসকল তো মহাশ্রেষ্ঠ আদর্শ; কিন্তু ‘স্বল্পমপ্যস্য ধর্মস্য ত্রায়তে মহতো ভয়াৎ’। এই আত্মবিদ্যার সামান্য অনুষ্ঠানেও মানুষ মহাভয়ের হাত হইতে বাঁচিয়া যায়। মানুষের অন্তরে যে শক্তি রহিয়াছে, তাহা উদ্বুদ্ধ হইলে মানুষ অন্নবস্ত্রের সংস্থান হইতে আরম্ভ করিয়া সব কিছুই অনায়াসে করিতে পারি।” “এই শক্তির উদ্বোধন করিতে হইবে দ্বারে দ্বারে যাইয়া। দ্বিতীয়ত সেই সঙ্গে বিদ্যাশিক্ষা দিতে হইবে।” তার শিক্ষা দর্শন অসাধারণ, যা মানব জীবনকে পূর্ণতা দান করে।

স্বামী বিবেকানন্দ মানুষকে শুধু ইতিবাচক শিক্ষা দেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন। কারণ তিনি মনে করতেন, নেতিবাচক চিন্তাগুলি মানুষকে দুর্বল করে দেয়। তিনি বলেছিলেন, যদি ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েদের সবসময় দোষারোপ না করে উৎসাহিত করা হয়, তবে তারা এক সময় উন্নতি করবেই।
নিউ ইয়র্কে বিবেকানন্দ দেখেছিলেন, আইরিশ উপনিবেশ-স্থাপকরা খুবই খারাপ অবস্থায় খুব সামান্য জিনিসপত্র নিয়ে ভয়ে ভয়ে সেখানে এসেছিল, কিন্তু মাত্র ছয় মাসের মধ্যেই তাদের পোষাকপরিচ্ছদ আচারব্যাবহার সব পালটে যায়। তখন তাদের মধ্যে সেই ভয়ভীতির ভাব সম্পূর্ণ তিরোহিত হয়েছিল। এর কারণ খুঁজতে গিয়ে বিবেকানন্দ দেখেন যে, যদি বেদান্তের দৃষ্টিকোণ থেকে এটাকে ব্যাখ্যা করতে হয়, তাহলে বলতে হবে সেই আইরিশেরা স্বজাতীয়দের দেয়ারা পরিবেষ্টিত ছিল এবং সবাই তাকে বলছিল, "প্যাট, তোমার কোনো আশা নেই, তুমি ক্রীতদাস হয়ে জন্মেছো এবং তাই থাকবে।" এই কারণে তার মনে হীনম্মন্যতা এসেছিল। কিন্তু আমেরিকায় আসার পর থেকে সবাই তাকে বলতে শুরু করল, "প্যাট, তুমিও মানুষ আমাদের মতো। মানুষই সব করে। তোমার আমার মতো মানুষেরাই করে। তাই সাহসী হও!" সেই জন্যই সে মাথা তুলে আত্মমর্যাদায় ভর করে চলছে। তাই বিবেকানন্দ বলেছেন, ম্যাকলের শিক্ষাব্যবস্থা ও ভারতীয় বর্ণব্যবস্থা ছেলেমেয়েদের নেতিবাচক শিক্ষা দেয়। এই শিক্ষা থেকে তারা আত্মনির্ভরতা ও আত্মমর্যাদার শিক্ষা পায় না। বিবেকানন্দের মতে, একমাত্র ইতিবাচক শিক্ষাই তাদের দেওয়া উচিত।

স্বামী বিবেকানন্দের জীবন দর্শনের পরিচয় পাই আমরা তার বাণী থেকে।

স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন , “ উপনিষদের প্রতি পাতায় আমাকে যার কথা বলা হয়েছে তা হল সাহস । এইটিই সবচেয়ে মনে রাখবার কথা । আমার জীবনে এই একটি বড়াে শিক্ষাই আমি নিয়েছি । হে মানুষ ! বীর্যবান হও , দুর্বল হােয়াে না ! ”

স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন , “ জাতি হিসেবে আমরা যা কিছু । পেয়েছি সবই আমাদের দুর্বল করেছে । ” মনে হয় সেই সময় জাতির জীবনের একটিই উদ্দেশ্য ছিল , কী করে আমাদের দুর্বল থেকে দুর্বলতর করা যায় । শেষ পর্যন্ত আমরা কেচোতে পরিণত হয়েছি , যে কেউ তরবারি দেখিয়ে আমাদের পদানত করেছে তার । পায়ের তলায় থাকবার জন্যে ।

আমি যা চাই তা হল লৌহনির্মিত পেশী এবং স্বাস্থ্য । শক্ত ধাতুতে নির্মিত মন । পৌরুষের পূজা করাে ।

সব শক্তি তােমার মধ্যে আছে । তুমি সব কিছু করতে পার , তা বিশ্বাস করাে ভেবােনা তুমি দুর্বল । তুমি যা ইচ্ছা তাই করতে পার । কারও নির্দেশ ছাড়াই । সবশক্তি তােমার মধ্যে আছে । উঠে দাঁড়িয়ে | তােমার ভিতরকার দেবত্বকে প্রকাশ করাে ।

তােমার দেশ বীর চায় , বীর হও । পাহাড়ের মত দৃঢ় হও । সত্য সর্বদা জয়ী হয় , দেশের লােক যা চায় তা হল জাতির ধমনীতে বিদ্যুৎ প্রবাহ , দেশের মধ্যে প্রাণশক্তি জাগিয়ে তুলতে হবে । সাহসী হও , মৃত্যু একবারই আসে । হিন্দুদের ভীরু হলে চলবে না । ভীরুতা আমি ঘৃণা করি । মনে গভীর শান্তি বজায় রাখাে । তােমার বিরুদ্ধে বালখিল্যের কী বলল তার দিকে ভ্রুক্ষেপ করাে না । অগ্রাহ্য করাে ! অগ্রাহ্য করাে অগ্রাহ্য করাে ! সমস্ত বড়াে বড়াে কীর্তিই স্থাপিত হয়েছে বিশাল বিশাল বাধা অতিক্রম করে । পুরুষ ব্যঘের মত চেষ্টা করাে ।

বন্ধু , ক্রন্দন করছ কেন ? সমস্ত শক্তি তােমার মধ্যেই আছে , তােমার সর্বশক্তিমান স্বভাবকে জাগ্রত করাে । তাহলে সমগ্র বিশ্ব তােমার পায়ের তলে লুটিয়ে পড়বে । মুর্খরা কাতরস্বরে বলে , “ দুর্বল আমরা দুর্বল ” । জাতি চায় কাজ এবং বৈজ্ঞানিক প্রতিভা । আমাদের প্রয়ােজন মহৎ আত্মা , প্রবল শক্তি এবং অসীম উৎসাহ । উদ্যোগী পুরুষসিংহেরই লক্ষ্মীলাভ হয় । পিছনে তাকানাের প্রয়ােজন নেই , আমরা চাই অসীম প্রাণশক্তি , অসীম উৎসাহ , অসীম । সাহস এবং ধৈর্য । একমাত্র তাহলেই বড়াে কিছু সাধিত হতে পারে ।

বেদ কোনও পাপ স্বীকার করে না , একমাত্র ভুল স্বীকার করে । বেদের মতে সব চেয়ে বড়াে ভুল এ কথা বলা যে তুমি দুর্বল , তুমি । পাপী , এক হতভাগ্য জীব , তােমার কোনও শক্তি নেই , তুমি এই কাজ , কি ওই কাজ করতে পার না ।

শক্তিই জীবন , দুর্বলতা মৃত্যু , শক্তি সুখ , জীবন অনন্ত মৃত্যুহীন । দুর্বলতা সর্বক্ষণের কষ্টভােগ , দুর্বলতা মৃত্যু । সদর্থক মনােভাবসম্পন্ন । হও , শক্তিশালী হও । শৈশব থেকেই এমন সব চিন্তা তােমার মস্তকে প্রবেশ করুক যে চিন্তা সহায়তাকারী । দুর্বলতাই দুঃখ ভােগের । একমাত্র কারণ । আমরা দুঃখভােগ করি , কারণ আমরা দুর্বল । আমরা মিথ্যা বলি , চুরি করি , খুন করি , অন্যান্য অপরাধ করি তার কারণ - আমরা দুর্বল , আমরা যন্ত্রণা পাই কারণ - আমরা দুর্বল । আমাদের মৃত্যু হয় কারণ আমরা দুর্বল । যেখানে দুর্বলতার কারণ । নেই , সেখানে মৃত্যু নেই , দুঃখ নেই , একমাত্র প্রয়ােজন শক্তি । শক্তি । জগতের ব্যাধির ঔষধ । প্রবলের দ্বারা অত্যাচারিত দুর্বলের ঔষধ শক্তি । বিদ্বানের দ্বারা অত্যাচারিত অজ্ঞ ব্যক্তির ঔষধ শক্তি । এক পাপী যখন অন্য পাপীর দ্বারা অত্যাচারিত হয় তার ঔষধ শক্তি । উঠে দাঁড়াও , সাহসী হও , শক্তিমান হও , সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিজের কাঁধে নাও এবং জানাে , যে তুমি তােমার ভাগ্যের নিয়ন্তা । যত শক্তি , যত সহায়তা আমাদের চাই , সব তােমার নিজের মধ্যেই আছে । অতএব নিজের ভবিষ্যৎ নিজে গঠন করাে ।

সারাক্ষণ যদি মনে করি আমরা ব্যধিগ্রস্ত , ব্যাধি সারবে না । দুর্বলতার কথা মনে করিয়ে দিলে বিশেষ সহায়তা হয় না । সারাক্ষণ দুর্বলতার কথা । ভাবলে শক্তি আসে না , দুর্বলতা নিয়ে চিন্তা করলে তাতে দুর্বলতার অবসান হয় না , শক্তি নিয়ে চিন্তা করলে দুর্বলতার অবসান হয় ।

এই জগতে এবং ধর্মের জগতে এই সত্য । ভয়ই অধঃপতনের এবং পাপের নিশ্চিত কারণ । ভয়ই দুঃখকে ডেকে আনে । ভয়ই । মৃত্যুকে ডেকে আনে , ভয়ই অশুভের জন্ম দেয় ।

ভয় কোথা থেকে আসে ? আমাদের স্বভাব সম্পর্কে অজ্ঞতা থেকে । আমরা প্রত্যেকে রাজাধিরাজের অর্থাৎ ঈশ্বরের যুবরাজ । । জেনে রাখাে , সমস্ত পাপ , সমস্ত অশুভকে এক কথায় বলা যায় । দুর্বলতা । সমস্ত মন্দ কাজের পিছনে শক্তি জোগাচ্ছে দুর্বলতা । সমস্ত স্বার্থপরতার উৎস দুর্বলতা । দুর্বলতার কারণেই মানুষ মানুষকে আঘাত । করে , দুর্বলতার কারণেই মানুষ যা নয় নিজেকে সেই ভাবে দেখায় ।

আমাদের জনসাধারণের এখন যা প্রয়ােজন তা হল লােহার পেশী , ইস্পাতের স্নায়ু , প্রচণ্ড এক ইচ্ছা শক্তি , যাকে কিছুতেই প্রতিরােধ করতে পারে না , যা বিশ্বের রহস্য ভেদ করে নিজেদের উদ্দেশ্য সাধন করতে পারে , যে কোনােভাবেই হােক , তার জন্যে যদি সাগরের তলে যেতে হয় , মৃত্যুর মুখােমুখি দাঁড়াতে হয় , তবুও ।

আমরা অনেক দিন ক্রন্দন করেছি , এখন নিজের পায়ে দাড়াও , মানুষ হও । আমাদের প্রয়ােজন এমন ধর্ম যা মানুষ তৈরি করে । আমাদের প্রয়ােজন এমন তত্ত্ব যা মানুষ তৈরি করে । আমাদের এমন সর্বাঙ্গীণ শিক্ষা প্রয়ােজন যা মানুষ তৈরি করে এবং এইখানেই সত্যের পরীক্ষা । যা কিছু তােমাকে শারীরিকভাবে , বুদ্ধি বৃত্তিকে আত্মিক শক্তিকে দুর্বল করে , তাকে খারিজ করাে । যাতে প্রাণ নেই , তা সত্য হতে পারে না । সত্য শক্তি দেয় , সত্য পরিত্রাতা , সত্য । সকল জ্ঞান । সত্য অবশ্যই শক্তিদাতা আলােকদাতা ।

আমরা তােতা পাখির মতাে অনেক কথা বলি , কিন্তু কাজ করি । । কথা বলা , কাজ না করা আমাদের স্বভাবে পরিণত হয়েছে । তার কারণ কী ? শারীরিক দুর্বলতা । এরকম দুর্বল মস্তিষ্ক কোনও কাজ করতে পারে না । মস্তিষ্কের শক্তি আমাদের বাড়াতে হবে । সর্ব প্রথম আমাদের যুবকদের সবল হতে হবে । ধর্ম আসবে তার পরে , কৃষ্ণের । বিশাল প্রতিভা ও বিশাল শক্তি তােমরা তখনই উপলব্ধি করতে পারবে যখন তােমাদের ধমনীতে শক্তিশালী রক্ত প্রবাহিত হবে । । তােমরা উপনিষদ এবং আত্মার মহিমা আরও ভাল করে বুঝতে পারবে , যখন তােমাদের শরীর তােমাদের পায়ের উপর শক্ত হয়ে । দাঁড়াতে পারবে এবং তােমরা অনুভব করবে যে তােমরা মানুষ ।

নীতি - পরায়ণ হও , সাহসী হও , সর্বান্তঃকারণে কঠোরভাবে নীতি - পরায়ণ মানুষ হও , সাহসী হও , বেপরােয়া হও । কাপুরুষেরা পাপ করে , সাহসীরা কখনােই নয় । প্রত্যেককে , সকলকে ভালােবাসার চেষ্টা করাে ।

উঠে দাঁড়াও , জোয়ালে কাঁধ লাগাও । জীবন কত দিনের ? একবার যখন পৃথিবীতে এসেছ , একটা চিহ্ন রেখে যাও । তা না হলে গাছ আর পাথরের সঙ্গে তােমার তফাৎ কী ? তারাও জন্মায় , তারাও ক্ষয়প্রাপ্ত হয় , মারা যায় ।

সাহসী হও । আমার সন্তানেরা সবার উপরে সাসী হবে । কোনাে কারণে একটুও আপােস নয় । সর্বোচ্চ সত্য শেখাও। সম্মান হারানাের ভয় কোরাে না , অপ্রিয় সংঘাত সৃষ্টি করাকে ভয় করাে । না । জেনে রাখাে , সত্যকে ত্যাগ করার প্রলােভন সত্ত্বেও সত্যের সেবা করতে হবে ।

স্বামী বিবেকানন্দ ছাড়া আর কোন সন্ন্যাসী যুবাদের উদ্দেশ্যে এমন উপদেশ দেননি, এজন্যই তিনি মানবতাবাদী সমাজ সংস্কারক।
0

প্রবন্ধ - রঞ্জন রায়

Posted in











যদি সাংসদ/ বিধায়কেরা ঘুষ খান?

গত মার্চ মাসের তিন তারিখে সুপ্রীম কোর্টের সাত সদস্যের কন্‌স্টিট্যুশনাল বেঞ্চ একটি রায় দিয়েছে যা অনেক সাধারণ নাগরিকের আহত বোধবুদ্ধিতে মলম লাগানোর কাজ করবে।

যখন ১৯৯৮ সালে, একই সুপ্রীম কোর্টের অন্য একটি কন্‌স্টিট্যুশনাল বেঞ্চ (পাঁচ সদস্যের) নরসিংহ রাও বনাম ভারত সরকার(সিবিআই কোর্ট) কেসে, ৩-২ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতে, রায় দিয়েছিল যে আইনপ্রণেতারা আইনসভায় (পড়ুন সংসদে/বিধানসভায়) ভোট দেবার জন্য উৎকোচ নিলে তাঁদের ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের ধারায় শাস্তি দেবার জন্য কোন আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যাবে না, তখন আমরা চমকে উঠেছিলাম।

এ কেমন কথা? ঘুষ নিলে শাস্তি হবে না? ছোটখাটো সরকারি কর্মচারিকেও ঘুষ নেবার অভিযোগ প্রমাণিত হলে জেলে যেতে হয়, চাকরি চলে যায়। আর এঁরা?

আইনপ্রণেতারা?

আমাদের মধ্যবিত্ত মূল্যবোধে এটাই ধরা হত যে তাঁদের তো সীজারের পত্নীর মত সাফসুতরো পবিত্র হওয়া উচিত। কিন্তু দেশের সর্বোচ্চ আদালত রায় দিল যে তাঁরা বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত। আমরা অবাক। তাহলে কি ভোট দিয়ে আমাদের প্রতিনিধিকে নির্বাচিত করি ঘুষ নেবার জন্যে?

আমাদের অন্তরাত্মা না না করে উঠেছিল। বলছিল—দিস ইজ নট ডান্‌।

কিন্তু দেশের সর্বোচ্চ আদালতের বেঞ্চ ওই রায় দিয়েছেন, তাঁদের আইনের ব্যাখ্যা এবং জ্ঞান নিয়ে প্রশ্ন করার এবং অধিকার ও সাহস আমাদের মত হরিদাস পালের কী করে হবে? আবার কখন যে আদালতের গোঁসা হবে এবং আদালত অবমাননার দায়ে কেস খেতে হবে তাই বা কে বলতে পারে!

সেইজন্যেই গত ৩ মার্চের সুপ্রীম কোর্টের রায় আমাদের আহত বিবেকে কিঞ্চিৎ পুলটিস দিয়েছে নিঃসন্দেহে।

এর থেকে দুটো কথা বা দুটো প্রশ্ন উঠে আসে—এক, সর্বোচ্চ আদালতের মহামান্য বিচারকেরা কি সর্বজ্ঞ? দেখতেই পাচ্ছি, তা নয়। নইলে একই আসন থেকে আগের রায় ১৮০ ডিগ্রি বদলে যায় কী করে? ইন্ডিয়ান পেনাল কোডও একই রয়েছে, সংবিধানের মূল ভাবনা বা বেসিক নেচার আজও বদলে যায় নি। তাহলে?

অবশ্যই তাঁরা সর্বজ্ঞ নন, ত্রিকালদর্শী তো নন বটেই, তাহলে তো তাঁরা ভগবানই হয়ে যেতেন। কিন্তু মনে রাখা দরকার, দেশের আইন এবং সংবিধানের ব্যাপারে তাঁরাই শেষ কথা। তাই তাঁদের স্থান ঈশ্বরের ঠিক দেড় ইঞ্চি নীচে।

দুই, আরেকটা ব্যাপার। আম জনতার যে প্রাকৃতিক ন্যায়ের বোধ আছে তাকে শিক্ষিত মননে একেবারে অগ্রাহ্য করা ঠিক নয়। আইনেও এই প্রাকৃতিক ন্যায়ের ধারণার (cannon of natural justice) স্বীকৃতি রয়েছে।

তবু মনটা খচখচ করে। সেই ২৬ বছর আগে, ১৯৯৮ সালে, যাঁরা প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নরসিংহ রাও এবং ঝারখণ্ডের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী শিবু সোরেনের তথাকথিত লেনদেন নিয়ে –যা তখন স্যুটকেস কান্ড নামে কুখ্যাত হয়েছিল—সি বি আইয়ের স্পেশাল কোর্টের রায় বাতিল করে অমন একটা ইউনিক রায় দিয়েছিলেন তাঁরাও তো কিছু ভেবেই অনেক বিচারবিমর্ষ করেই রায় দিয়েছিলেন।

জাজমেন্টে বহু পাতা খরচ হয়েছিল। তাতে সি বি আই কোর্টের রায় কেন ভুল তার চুলচেরা ব্যাখ্যা লিখতে হয়েছিল। তাহলে আইনের বা সংবিধানের কোন নতুন ব্যাখ্যা দিয়ে বর্তমান প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচুড়ের নেতৃত্বে এই সাতজনের সংবিধান পীঠ একমত হয়ে আগের রায়কে উলটে দিল?

সেটা বুঝতে আমরা পুরনো স্মৃতি ঝালিয়ে নিয়ে সেই ঘটনাটির সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেব।

আগের রায়ের যুক্তিগুলো একটু দেখব, তারপরে বর্তমান রায়ের।

ঘটনাটি কী ছিল?

তারিখটি ২৬ জুলাই ১৯৯৩। তখন দেশের প্রধানমন্ত্রী কংগ্রেসের নরসিংহ রাও।

চমৎকার জোড়াতালি দিয়ে অল্পমতের সরকার চালিয়ে যাচ্ছেন। সমস্ত বিতর্কিত বিষয়ে নিষ্ক্রিয় থাকেন। মনে করেন সমস্যা নিজে নিজেই তার সমাধান খুঁজে নেবে। তাঁর হস্তক্ষেপ অনাবশ্যক। মাত্র আট মাস আগে ৬ ডিসেম্বর ১৯৯২ তারিখে তাঁর কথিত নিষ্ক্রিয়তার ফলে কয়েক শতাব্দী পুরনো বাবরী মসজিদ কয়েক ঘন্টায় ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। কুলোকে বলে—এই কথিত নিষ্ক্রিয়তার পেছনে তাঁর মৌন সমর্থন ছিল।

এই টালমাটাল সময়ে সিপিএম দলের এক সাংসদ অজয় মুখোপাধ্যায় ওই তারিখে সংসদে নরসিংহ রাও সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব পেশ করেন। তখন ৫২৮ সীটের সংসদে কংগ্রেসের ছিল ২৫১ জন; আবশ্যক সংখ্যাগরিষ্ঠতার চেয়ে ১৩ কম।

কিন্তু বিপক্ষের ১৪ জন অনাস্থা প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ায় রাও সরকার অল্পের জন্যে বেঁচে গেল। একবছর পরে খবর ছড়িয়ে পড়ল যে ঝারখণ্ড মুক্তিমোর্চার সাংসদেরা অনাস্থা প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার জন্য ঘুষ নিয়েছিলেন। আরও শোনা গেল জনতা দলের নেতা অজিত সিংও (প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী চৌধুরী চরণ সিংয়ের ছেলে এবং বর্তমান রাষ্ট্রীয় লোকদল নেতা জয়ন্ত চৌধুরির পিতা) ভোটাভুটির সময় অনুপস্থিত থাকার জন্যে টাকা নিয়েছিলেন।

সেন্ট্রাল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন ১৯৯৬ সালে তদন্ত শুরু করে এবং প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নরসিংহ রাও, ভারতীয় লোকদল নেতা অজিত সিং এবং ঝারখন্ড মুক্তিমোর্চার ছ’জন সাংসদের বিরুদ্ধে চার্জশীট দাখিল করে। অভিযুক্তরা দিল্লি হাইকোর্টে গেলে হাইকোর্ট তাদের আবেদন খারিজ করে দেয়। তখন তাঁরা সুপ্রীম কোর্টের শরণাপন্ন হন।

সুপ্রীম কোর্টের পাঁচ সদস্যের পীঠের সামনে বিচার্য বিষয় ছিলঃ সংবিধানের আর্টিকল ১০৫(২) এবং ১৯৪ (২) এর হিসেবে আইন প্রণয়নকারীরা , তাদের পদের সুবিধার্থে ক্রিমিনাল প্রসিকিউশন থেকে বিশেষ রেহাই পেতে পারেন কিনা।

বহুসংখ্যক মতের নেতা বিচারপতি ভারুচা এবং বিচারপতি রাজেন্দ্রবাবুর মতে যারা অনাস্থা প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার জন্যে ঘুষ নিয়েছেন তাঁদের আদালতে শাস্তি দেওয়া যায় না। কারণ আর্টিকল ১০৫(২) অনুসারে সাংসদদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যায় না; তাঁরা সুরক্ষিত।

আর্টিকল ১০৫ (২) বলছেঃ সংসদের কোন সদস্যকে আইনসভায় বা কোন সমিতিতে কোন বক্তব্য রাখার জন্য বা কোন বিষয়ে ভোট দেওয়ার জন্য কোন আদালতে দণ্ডিত করা যাবে না।

আর আর্টিকল ১৯৪ (২) একই কথা বলছে, তবে বিধানসভার সদস্যদের জন্যে। এইরকম সুরক্ষা কবচের উদ্দেশ্য কী?

জাস্টিস ভারুচা বলছেন এর উদ্দেশ্য সংসদে সদস্যদের বাক স্বাধীনতাকে সুরক্ষা দেওয়া, যাতে তাঁরা নির্ভয়ে, কোন বদলার আশংকা থেকে মুক্ত হয়ে, স্বাধীনভাবে নিজের ভূমিকা পালন করতে পারেন। তাঁর মতে এর উদ্দেশ্যকে একটু ব্যাপক অর্থে বুঝতে হবে যাতে সাংসদদের -- সংসদে যা বলেন ও করেন তার জন্য-- কোনরকম দেওয়ানি বা ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত না হতে হয়। জাস্টিস জি এন রে এই ব্যাখ্যার সঙ্গে সহমত।

এই রায়ের ফলে ঝারখন্ড মুক্তি মোর্চার সাংসদরা রেহাই পেয়ে গেলেন। কিন্তু অজিত সিং নন। কারণ, উনি সংসদে ভোটও দেন নি, কোন বক্তব্যও রাখেন নি। তেমনি নরসিংহ রাও রেহাই পেলেন না; কারণ উনি ঘুষ নেন নি, দিয়েছেন! তাই জেলে গেলেন।

অর্থাৎ, ঘুষ দিলে শাস্তি, নিলে নয়! আইনের এই ব্যাখ্যায় আমাদের মতন সাধারণ মানুষের মাথা তাঝঝিম মাঝঝিম করে উঠল।

কিন্তু বাকি দু’জন বিচারপতি এস সি আগরওয়াল এবং জাস্টিস ডক্টর এ এস আনন্দ এই ব্যাখ্যায় একেবারেই সন্তুষ্ট নন। তাঁদের মতে ঘুষ খাওয়ার অপরাধে যদি শাস্তি না হয়, উলটে আইনের কূট ব্যাখ্যায় সুরক্ষা কবচ দেওয়া হয় তাহলে আইনপ্রণেতাদের উপর কোন নিয়ন্ত্রণ থাকবেনা। তাঁরা আইনের উর্ধে বিচরণ করবেন। সংবিধানের আর্টিকল ১০৫ (২) প্রণয়নের উদ্দেশ্য তো এমন নয়।

যে সাংসদ সংসদে তাঁর স্বাধীনভাবে ভোট দেওয়ার স্বাধীনতাটি ঘুষের বিনিময়ে বিক্রি করে দিলেন তাঁকে রেহাই দেওয়া মানে আগামী দিনে আরও অপরাধ করার লাইসেন্স দেওয়া। এঁদের মতে সঠিক ব্যাখ্যা হল সংসদে কোন বক্তব্য রাখা বা কোন পক্ষে বিপক্ষে ভোট দেওয়া আর তার আগে ঘুষ নেওয়া—দুটোকে আলাদা করে দেখা এবং বিচার করা। তাহলে ভোট বা বক্তব্যের জন্য দণ্ডিত করা যাবে না, কিন্তু ঘুষ নেওয়ার জন্য যাবে।

বিচারপতি আগরওয়ালের মতেঃ যে মুহুর্তে কেউ ঘুষ গ্রহণ করল সেই মুহূর্তে অপরাধটি সংঘটিত হল। ঘুষ নেওয়ার পরে সাংসদ ঘুষের শর্ত অনুযায়ী ভোট দিলেন কি দিলেন না –সেটা অবান্তর। অর্থাৎ, কেউ যদি ঘুষের টাকা নিয়ে যেমন শর্ত ছিল সেরকম ভোট না দিয়ে নিজের ইচ্ছেমত দেয়, তবু সে ঘুষ নেবার অপরাধের দণ্ড থেকে ছাড় পাবে না। ঘুষ দাতাদের কথামত কাজ করি নি—এই ডিফেন্স চলবে না।

এত কথাও বলার উদ্দেশ্য –সেই সময়ের ওই অল্পসংখ্যকের মতটি আজকে সাতজনের সাংবিধানিক পীঠ মেনে নিয়েছে। ছাব্বিশ বছর আগের বহুসংখ্যকের রায়টি খারিজ করা হয়েছে।

বর্তমান সাংবিধানিক পীঠের ব্যাখ্যাঃ

এঁদের মতে বৃটিশ পার্লিয়ামেন্টে হাউস অফ কমন্সের সদস্যদের বহুযুগ ধরে যে “প্রাচীন এবং নির্বিবাদ” সুবিধেগুলো রয়েছে—সেগুলি ইংল্যাণ্ডের রাজা এবং পার্লিয়ামেন্টের মধ্যে তীব্র লড়াইয়ের ফলে অর্জিত। ভারতে ওগুলো এসেছে ঔপনিবেশিক শাসনের সময় থেকে। স্বাধীনতার পর উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত কথিত সুবিধেগুলো আইনসিদ্ধ করা হয়েছে। আজ দরকার সেগুলোর এমন ব্যাখ্যা যা আজকের ভারতের সংবিধানের মূল ভাবনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। পার্লিয়ামেন্টারি প্রিভিলেজ বা সংসদের বিশেষাধিকারের দুটো ভাগঃ

এক, যা সংসদ সামুহিক রূপে উপভোগ করে। যেমন সংসদের অবমাননার জন্য কাউকে শাস্তি দেওয়া, বা নিজেদের কাজকর্ম নিজেদের নিয়মানুযায়ী পরিচালনা করা।

দুই, সাংসদদের ব্যক্তিগত বিশেষাধিকার। যেমন, সংসদে স্বাধীনভাবে নিজের বক্তব্য রাখার অধিকার। সুপ্রীম কোর্টের মতে এই অধিকার অসীমিত নয়, একে আবশ্যকতার কষ্টিপাথরে (test of necessity) পরীক্ষা করে দেখতে হবে। এই বিশেষাধিকার অবশ্যই এমন হতে হবে যা না থাকলে সাংসদ স্বাধীনভাবে নিজের কাজ করতে পারবেন না।

স্পষ্টতঃ যে অর্থে সংসদে মতপ্রকাশের এবং ভোট দেবার স্বাধীনতা আইনপ্রণেতাদের সফল ভূমিকা পালনের পূর্বশর্ত, সেই অর্থে ঘুষ নেবার অধিকার তাঁদের ভূমিকা পালনের পূর্বশর্ত হতে পারে না। সর্বোচ্চ আদালত আরও বলেনঃ আইনপ্রণেতাদের ভ্রষ্টাচার এবং ঘুষ দেওয়ানেওয়া ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্রের ভিত্তিকে কুরে কুরে খাচ্ছে। এগুলো সংবিধানের আদর্শকে ধ্বংস করছে এবং নাগরিকদের দায়িত্বশীল গণতান্ত্রিক প্রতিনিধিত্বের লাভ থেকে বঞ্চিত করে এক ভ্রষ্ট রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি করছে।

এরপর সুপ্রীম কোর্ট বিচার করল সেই পুরনো প্রশ্নটিক-- quid pro quo!

ধরা যাক, একজন সাংসদ ঘুষ নিল , অথচ ঘুষদাতার নির্দেশ মত ভোট না দিয়ে নিজের বিবেকের হিসেবে ভোট দিল। অর্থাৎ, কোন ক্ষতিকারক লেনদেন (quid pro quo) হল না, তাহলেও কি তার টাকা নেওয়ার কাজটি ঘুষ বলে ধরা হবে এবং দণ্ডনীয় হবে?

সাংবিধানিক পীঠ প্রশ্নটিকে ভ্রষ্টাচার নিরোধক অধিনিয়মের (Prevention of Corruption Act) ধারা ৭ এর প্রেক্ষিতে বিচার করল। এতে “সরকারি কর্মচারিদের ঘুষ নেওয়া বিষয়ক অপরাধে”র ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এই ধারা অনুযায়ী –কোন বিশেষ কাজ ‘করা’ বা ‘না করা’র বদলে কোন অন্যায় সুবিধে নেয়ার জন্যে মাত্র ‘চেষ্টা’ করা বা ‘গ্রহণ’ করাই এই অপরাধ সিদ্ধ হওয়ার জন্যে যথেষ্ট। অতএব, আবশ্যক নয় এটা দেখা কি, যে কাজ করার পূর্বশর্ত হিসেবে ঘুষ দেওয়া হয়েছে সেটা করা হল কিনা। টাকা নেয়াই যথেষ্ট। সরকারি কর্মচারি বা জনপ্রতিনিধিটি শেষে কী করলেন বা, কি করেন নি—সেটা বিচার্য বিষয় নয়।

কিন্তু এই শেষ নয়। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলঃ জনপ্রতিনিধি বা আইনসভার সদস্যদের আদালত বিচার করতে পারে কি ?

পার্লিয়ামেন্টেরও ক্ষমতা আছে ঘুষ নিয়ে সংসদের সম্মানহানির করার জন্যে তার সদস্যদের শাস্তি দেবার। সেটা সংসদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা বা জেলে পাঠানোও হতে পারে। তাহলে কি আদালতের এ’ব্যাপারে নাক গলানো উচিত?

একই অপরাধে দুটো বিচার এবং দু’রকম শাস্তি? এটা কতদূর ন্যায়সংগত?

সুপ্রীম কোর্টের সাংবিধানিক পীঠের রায়ঃ

আইনপ্রণেতাদের ঘুষ নেবার অপরাধের জন্যে আদালত এবং সংসদের বিচার সমান্তরাল ভাবে চলতে পারে। কারণ, সংসদে অপরাধী সাংসদদের শাস্তি দেবার উদ্দেশ্য আলাদা আর দেশের আদালতে পেনাল কোডে বিচারের উদ্দেশ্য আলাদা।


পাঠকদের মনে পড়বে ২০০৫ সালে ১১ জন সাংসদের( ১০ জন লোকসভা, ১ জন রাজ্যসভা) সংসদে প্রশ্ন করার শর্ত হিসেবে টাকা নেওয়ার ভিডিও যা “আজ তক” নিউজ চ্যানেলের স্টিং অপারেশনের ফল। এর মধ্যে ৬ জন বিজেপি দলের, বাকিদের মধ্যে কংগ্রেস, আরজেডি এবং বিএসপি (১) । তখন রাজনৈতিক দলগুলো অপরাধী এমপিদের সাসপেন্ড করে।

কিন্তু তৎকালীন স্পীকার প্রয়াত সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় খুব কড়া মনোভাব নিয়ে দিল্লির পুলিশ কমিশনারকে এর তদন্ত করার নির্দেশ দেন। তাঁর নির্দেশে দোষী সাংসদদের সদস্যপদ হারাতে হয়।

সদস্যেরা ঘুষ নিলে সংসদের সম্মানহানি হয়; নাগরিকদের চোখে সংসদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়। তাই সংসদ দোষীদের নিলম্বিত করে। কিন্তু ঘুষ নেবার অপরাধ দেশের আইনের চোখে গোটা সমাজের বিরুদ্ধে এবং রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপরাধ।

কাজেই সাংসদের ঘুষ খাওয়ার বিচার শুধু সংসদের হাতে ছেড়ে দেওয়া যায়না। আদালতে ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের ধারায় বিচার হওয়া উচিত।


টেলপীসঃ

অজিত সিং এবং পিভি নরসিংহ রাও দুজনেই বহুদিন হল প্রয়াত। অপরাধীর মৃত্যুর সঙ্গে তার ক্রিমিনাল লায়াবিলিটি সমাপ্ত হয়ে যায়। আর নরসিংহ রাও কিছুদিন জেলেও ছিলেন। হঠাৎ খেয়াল হল -বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার, মাত্র ক’দিন আগে, প্রয়াত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নরসিংহ রাওকে মরণোপরান্ত ভারতের সর্বোচ্চ সম্মান ‘ভারত-রত্ন’ প্রদান করেছেন।

জয় হিন্দ্‌ !


(১) টাইমস অফ ইণ্ডিয়া, ১২ ডিসেম্বর, ২০০৫।

0

প্রবন্ধ - ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়

Posted in







অটবী অর্থে বন। আটবিক, অর্থাৎ যা বনজ, বনে বসবাস করে ইত্যাদি। অরণ্য সম্প্রদায়ের মানুষজনকেও আমরা আটবিক বলে থাকি। জনজাতি-জনগোষ্ঠী সমাজের মানুষজন যারা অরণ্যচারী তাদেরও আটবিক বলা যেতে পারে। রামায়ণ মহাভারতের মত সুবিশাল দুই মহাকাব্যেও অরণ্যে বসবাসকারী কিছু চরিত্রের উল্লেখ আমরা পেয়ে থাকি। অরণ্যে যেমন বনস্পতি, বৃক্ষসকল আছে তেমনি আছে অজস্র গুল্ম-লতার ছড়াছড়ি যা সকল নিয়েই এই বনজ সম্পদ। মহাভারত-রামায়ণের মত মহারণ্যেও বৃক্ষ, লতা-গুলমের সংখ্যা কিছু কম নয়। অর্থাৎ অজস্র উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ, প্রধান চরিত্রের পাশাপাশি কিছু অন্য ধরনের চরিত্রের উল্লেখও এখানে পাওয়া যায়। বহু চরিত্রের সংমিশ্রণ এই মহাকাব্যগুলি। রাজা-রাজড়া, ব্রাহ্মণ, মুনি-ঋষি থেকে শুরু করে অরণ্যচারী, অনার্য, রাক্ষস, দানব বহুকিছুর সমাবেশ ঘটেছে। আবার এইসব অনার্য-রাক্ষস আটবিক চরিত্রগুলিও কেউ কেউ অরণ্যের রাজা, অরণ্যবাসীদের রাজা এমনও পাই। মহাভারতের হিড়িম্বার কথাই ধরা যাক। একজন রাক্ষস জাতির কন্যা হয়েও তিনি ছিলেন চেদিরাজের কন্যা। চেদি রাজ্যটি ছিল পর্বত সানুদেশে গভীর অরণ্যে।
মহাকাব্যগুলিতে মূল ও প্রধান চরিত্রের পাশাপাশি আছে অনেক এমন কিছু চরিত্র যা আপাতদৃষ্টিতে মূল্যহীন মনে হলেও মহাকাব্যের কাহিনিতে তার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ এবং অনস্বস্বীকার্য।
রামায়ণ মহাকাব্যে তেমনই একটি চরিত্র হল শূর্পনখা। আমাদের আলোচ্য বিষয়ও তিনিই।

রামায়ণে শূর্পনখার চরিত্রটি কি আটবিক বলা যায়? যদিও মাঝে মাঝে তিনি অরণ্যবাসী হন, কিন্তু রামায়ণে বর্ণনা করা হয়েছে তিনি লঙ্কার রাজা রাবণের ভগিনী অর্থাৎ রাজপরিবারের একজন। লঙ্কা সেইসময়ে অত্যন্ত সমৃদ্ধ এক রাজ্য এবং লঙ্কাপুরী সুসজ্জিত ও সুঅলঙ্কৃত। সুতরাং তিনি জাতিতে রাক্ষস হলেও তাঁকে আটবিক বলা যায় না। শূর্পনখার চরিত্রটি রামায়ণ মহাকাব্যে বিশেষ বিস্তৃতি লাভ করেনি। রামায়ণ রচয়িতাগণও অতি সামান্যই শূর্পনখা সম্বন্ধে আলোচনা করেছেন। কিন্তু একটি কথা ভুললে চলবে না, শূর্পনখা চরিত্রটির জন্যই রাম-রাবণে বিবাদ। নতুবা তার আগে রাম সম্পর্কে রাবণের কোন বৈরিভাব ছিলনা। সেই অর্থে চরিত্রটির গুরুত্ব কোন অংশে কম নয়। এ হেন চরিত্রটি সম্বন্ধে আমরা কি জানি?

বিভিন্ন রামায়ণ রচনাকারের রচনা, পরবর্তী লেখকদের আলোচনা,পর্যালোচনা ইত্যাদি থেকে যা জানতে পারি তা হল এই যে শূর্পনখা ছিলেন রাবণের ভগিনী। তিনি পঞ্চবটি বনে রামের শৌর্য-বীর্যের কথা শুনে পঞ্চবটি বনে রামকে দেখতে আসেন এবং দেখে মুগ্ধ হন। মুগ্ধ শূর্পনখা রামের পাণি প্রার্থনা করলে রাম বিবাহিত পুরুষ এবং স্ত্রী বর্তমান থাকতে অপর বিবাহ সম্ভব নয় একথা জানালে শূর্পনখা লক্ষণের প্রেম ও পাণি প্রার্থনা করেন। লক্ষণ অরাজী হলে শূর্পনখা তাঁর ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে সীতাকে হত্যা করতে উদ্যত হলে লক্ষণ তরোয়ালের আঘাতে তার নাক কেটে ফেলেন। ফলে শূর্পনখা অপমানে ফিরে যান ভ্রাতা রাবণের কাছে এবং তার এই অপমানের প্রতিশোধ নিতে বলেন। এই ঘটনার পরবর্তীকালে রাবণের পঞ্চবটিতে আগমন, ক্রমে সীতাকে দেখে তাঁর রূপে মুগ্ধ হয়ে সীতাহরণ এবং বাকি রামায়ণে রাম-রাবণের যুদ্ধ ও সীতা উদ্ধারের কাহিনি আমরা পাই। শূর্পনখাকে নিয়ে কাহিনি ও আলোচনা রামায়ণেও আমরা এটুকুই জানতে পারি। কিন্তু রামায়ণ ভালো করে বুঝতে গেলে আমাদের মনে রাখা দরকার যে, শূর্পনখার নাসিকাচ্ছেদের ঘটনা না হলে রাম-রাবণের যুদ্ধের কোনই প্রয়োজন ছিল না। সেক্ষেত্রে রাম হয়তো চোদ্দ বৎসর পঞ্চবটিতে শান্তিতে কাটিয়ে অযোধ্যায় ফিরে যেতে পারতেন। শান্তিতে বনে বাসও করতে পারতেন। সুতরাং এখানেই আমাদেরও শূর্পনখা সম্বন্ধে কিছু জানা প্রয়োজন হয়ে পড়ে।

তাঁর জন্মবৃতান্ত আমাদের কিছুটা জানা আছে। যেমন তিনি ছিলেন জাতিতে রাক্ষস অর্থাৎ অনার্য রমণী। শূর্পনখার পিতা ছিলেন মহর্ষি বিশ্রবা এবং মাতা ছিলেন অনার্য রাক্ষস রমণী কৈকেসী। যদিও অনেক স্থানে কৈকেসীকে মাতা বলা হয়, কিন্তু আদতে তারও পিছনে এক কাহিনি আছে। কি সেই কাহিনি?
প্রকৃতপক্ষে লঙ্কার রাজা ছিলেন কুবের। অনেক পরে রাবণ কুবেরের কাছ থেকে লঙ্কা দখল করে নিলে লঙ্কার রাজা হন। লঙ্কেশ্বর কুবের তার পিতা বিশ্রবা মুনির পরিচর্যার জন্য তিনজন পরিচারিকা পাঠিয়েছিলেন। তারা হলেন—পুষ্পোৎকটা, রাকা এবং মালিনী। এই তিনজন রমণীই বিশ্রবা মুনির সংস্পর্শে আসেন ও সন্তানসম্ভবা হলে পুষ্পোৎকটার গর্ভে জন্মলাভ করেন রাবণ ও কুম্ভকর্ণ, রাকার গর্ভে জন্মলাভ করেন খর ও শূর্পনখা এবং মালিনীর সন্তান বিভীষণ। শূর্পনখা’ নামের এক বিশেষ অর্থ ছিল। শূর্পনখা অর্থাৎ এমন যে রমণী যার নখ ছিল কুলোর মত বড়, বৃহৎ আকারের। শূর্পো শব্দের অর্থ হল কুলো। তিনি রাক্ষসী, কুৎসিত,কদর্য চেহারার রমণী ছিলেন। রামায়ণ রচনাকারেরাও শূর্পনখাকে সেই রূপেই চিত্রিত করেছেন। কিন্তু শূর্পনখা একটি বিশেষ গুণের অধিকারিণী ছিলেন। তিনি ইচ্ছামত রূপ ধারণ বা পরিবর্তন করতে পারতেন। বিভিন্ন রামায়ণে শূর্পনখার রূপ নিয়ে একাধিক আলোচনা আছে। আলোচনায় দেখা যায়, শূর্পনখা ছিলেন পরমাসুন্দরী যিনি লক্ষণের কাছে প্রেম নিবেদন ও ভিক্ষা করেছিলেন। বস্তুত, তাঁর বিশেষ গুণটির জন্যই তিনি বেশ ও রূপ পরিবর্তন করে সাময়িকভাবে সুন্দরী রমণীতে পরিবর্তিত হয়েছিলেন। শূর্পপনখার কন্ঠ ছিল অত্যন্ত কর্কশ। যে কারণে তাঁকে ’পিতলকণ্ঠী’ বলেও অভিহিত করা হয়। পিতলে ঘর্ষণ লাগলে যেমন ঝন্‌ঝন্‌ আওয়াজ হয়, শূর্পনখার কন্ঠস্বর ছিল তেমনি শ্রুতিবিদারক। তাঁর ভঙ্গিও ছিল অশালীন। আবার কণ্ব রামায়ণে শূর্পপনখাকে পরমাসুন্দরী রমণী বলে ব্যখ্যা করা হয়েছে।
জন্মের পর শূর্পনখার নাম হয়েছিল মীনাক্ষি (মীনের মতো অক্ষি যাহার)।
শূর্পনখার বিবাহ হয় দশবুদ্ধি, মতান্তরে দুষ্টুবুদ্ধি নামে একজন অসুরের সাথে। শূর্পনখা লঙ্কার রাজা রাবণের ভগিনী হওয়ার সুবাদে অসুর দশবুদ্ধি (অথবা দুষ্টুবুদ্ধি) প্রভূত ক্ষমতা ও সম্মানের অধিকারী হন। রাবণ ভগিনী ও জামাতা উভয়কেই সাদরে রাখেন। কিন্তু দুষ্টুবুদ্ধির ছিল ক্ষমতার লোভ এবং অত্যন্ত ক্রুর প্রকৃতির ছিলেন। ক্রমে রাবণের সঙ্গে যে সৌহার্দ্য ছিল তা নষ্ট হয় এবং রাবণ দুষ্টুবুদ্ধিকে হত্যা করেন। কথিত, শূর্পনখা গোপনে দানবরাজ কালকেয়র পুত্র বিদ্যুৎজিহবাকে বিবাহ করেন। দানব রাজ চিরকালই ছিলেন লঙ্কার রাজার শত্রু। লঙ্কার সঙ্গে দানবদের শত্রুতা ছিল চরমে। রাবণ এই বিবাহের কথা জানতে পেরে দানবদের সঙ্গে এক ভীষণ যুদ্ধে লিপ্ত হন। যুদ্ধে কালকেয় এবং তার পুত্র বিদ্যুৎজিহবা উভয়কেই রাবণ হত্যা করেন। শূর্পনখাকেও হত্যা করতে উদ্যত হলে স্ত্রী মন্দোদরী এবং ভ্রাতা বিভীষণের অনুরোধে নিরস্ত হন এবং শূর্পনখা প্রাণে বাঁচেন। মন্দোদরী শূর্পনখাকে নিজের পছন্দমতো স্বামী নির্বাচন করে সুখে শান্তিতে থাকার পরামর্শ দেন। সেইমত শূর্পনখা লঙ্কা ও দক্ষিণের নানান রাজ্যে দিন অতিবাহিত করতে থাকেন। মাঝে মাঝে খর ও দূষণ নামে দুই ভাইয়ের সাথে বনবাসও করতে থাকেন। এই বনবাস পর্বেই একদিন সূর্পনখা পঞ্চবটি বনে ভ্রমণে এলে রামের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় এবং পরবর্তী কাহিনি আমরা সকলেই জানি।

শূর্পনখার পরবর্তী জীবন সম্বন্ধে বিশেষ কিছুর উল্লেখ নেই। জৈন রামায়ণ এবং দক্ষিণ-পূর্বএশিয়া কাব্য ও পুতুলনাচে দেখা যায় শূর্পনখা একটি পুত্রসন্তানের জননী হয়েছিলেন। তার নাম শম্বুক। যদিও নিম্নসমাজের অন্তর্ভুক্ত শম্বুক বাল্মীকি রামায়ণে স্থান পায়নি। শম্বুক ঋষি হওয়ার বাসনা প্রকাশ করলে রামচন্দ্র তাকে হত্যা করেন।
আবার একথাও জানা যায় যে, লক্ষণ বনবাসের সময় ঘুরতে ঘুরতে একটি ভাসয়মান তলোয়ার দেখতে পান,যা দিয়ে তিনি বাঁশের অগ্রভাগ ছেদন করছিলেন। এবং এইভাবেই শম্বুকের মৃত্যু হয় লক্ষণের হাতে।
রাবণের মৃত্যুর পর বিভীষণ লঙ্কার রাজা হলে শূর্পনখা লঙ্কাতেই বসবাস করতে থাকেন। সেখানেই সমুদ্রে ডুবে তার মৃত্যু হয়। শূর্পনখা সম্বন্ধে আর কোন তথ্য পাওয়া যায় না।
রামায়ণে যে চরিত্রটির জন্য রাম-রাবণের বৈরিতার সূচনা এবং পরবর্তীকালে রাম-রাবণের যুদ্ধ পর্যন্ত হয়, সেই চরিত্রটি রামায়ণের মতো মহাকাব্যে এত কম প্রাধান্য পাওয়ার জন্য বিস্মিতবোধ করি।
3

প্রবন্ধ - অনিরুদ্ধ গঙ্গোপাধ্যায়

Posted in






সদ্য কৈশোরে উপনয়ন পর্বের পর আহ্ণিক উপবাস ইত্যাদি পালন করেছি নিতান্তই গতানুগতিকভাবে। তাতে কিছুটা ছিল একটা নবলব্ধ অভিনবত্বের আস্বাদ, বেশিটাই পারিবারিক বাধ্যবাধকতা। আনুষ্ঠানিক ব্যাপারগুলোই মুখ্য ছিল, তার তাৎপর্য বা গুরুত্ব অনুধাবন করার মত বিচারবুদ্ধি তখন হয়নি।

পরবর্তী সময়ে কিছুটা সচেতন হলেও, বিভিধ ব্যস্ততার জন্যেই হোক বা হয়তো তেমন আগ্রহের অভাবেই হোক, এ সম্বন্ধে বিশেষ কোন অনুসন্ধিৎসা জাগেনি। সম্প্রতি সংবাদে কয়েকটি ঘটনার বিবৃতি পড়ে কৌতুহল জাগল। উপনয়নের প্রক্রিয়া নিয়ে ততটা নয়। বরং যে মন্ত্রে ব্রহ্মচর্যে দীক্ষিত করা হয়, সেই গায়ত্রী মন্ত্র সম্বন্ধে। এই মন্ত্র বিষয়ে কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে যেটুকু জানতে পারলাম, তা যাতে ক্রমে বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে না যায়, তাই মনে হলো তাড়াতাড়ি যেটুকু পারি, লিখে রাখাই যুক্তিযুক্ত। আর হয়তো বা কিছু আগ্রহী পাঠকের সামান্য উপকারেও আসতে পারে, এই ভাবনা থেকেই এই আলেখ্যের অবতারণা।

প্রথমেই একটি সতর্কীকরণ। এই আলেখ্যতে যদি কেউ জাতিবাদ বা বর্ণবাদের গন্ধ খোঁজেন, তা কিন্তু নিতান্তই ভুল হবে। একটি প্রাচীন, এবং জ্ঞানী পন্ডিতদের মতে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ, বৈদিক মন্ত্রের উৎপত্তি, তৎসম্বন্ধীয় পৌরাণিক কাহিনী, তার অর্থ বা গূঢ়ার্থ ইত্যাদি নিয়ে কিছু প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান করতে গিয়ে যা পেয়েছি, তাই এ বৃত্তান্তের অনুপ্রেরণা। তার বেশি কিছু নয়। রামকৃষ্ণ মিশনের শ্রদ্ধেয় স্বামী সমর্পণানন্দ মহারাজ বলছেন, গায়ত্রী মন্ত্র পৃথিবীর যে কোন দেশের, যে কোন ধর্মের, যে কোন জাতি বা বর্ণের মানুষ নির্দ্বিধায় সশ্রদ্ধায় জপ করতে পারেন। কোনরকম বৈষম্য বা বিধিনিষেধের কোন প্রশ্নই নেই।

গায়ত্রী শ্লোকের কথা বলতে গেলে বেদ সম্বন্ধে দু-চার কথা সংক্ষেপে বলতে হয়।

বেদের উৎপত্তিকাল নিয়ে বহু মত আছে। তবে অনেক ভারততত্ববিদদের গবেষণাপ্রসুত মত হল, মোটামুটিভাবে ১৫০০ থেকে ১২০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে ঋগ্বেদ সংহিতার অধিকাংশ রচিত হয়েছিল, এবং এর উৎস স্থল ছিল অধুনা উত্তর-পশ্চিম পঞ্জাবের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে, যার বেশির ভাগ এখন পাকিস্তানে। সেই সময়কাল থেকে শুরু করে ৪০০ থেকে ১৫০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত পর্যায়কে বৈদিক কাল বলা হয়। অর্থাৎ উত্তর কাংস যুগ থেকে লৌহ যুগ জুড়ে। এবং এই সময়ে সমগ্র উত্তর, পশ্চিম এবং অধিকাংশ পুর্ব ভারতে বৈদিক সভ্যতার বিস্তার ঘটে। বৌদ্ধ মহজনপদের আবির্ভাব এবং অধিকতর প্রচলনের সাথে সাথে বৈদিক সাহিত্য স্তিমিত হয়ে পড়ে।

বৈদিক শ্লোকগুলির আবির্ভাব কিভাবে হয়েছিল, তা নিয়ে অনেক তত্ব আছে। সে কথায় পরে আসছি। সে যুগে তো লিখন পদ্ধতি ছিল না। তাই ‘শ্রুতি’ এবং ‘স্মৃতি’, এই দুই সম্মিলিত প্রকারে বেদের সম্প্রচার হয়। অর্থাৎ গুরু থেকে শিষ্য, এক প্রজন্ম থেকে আর এক প্রজন্মে, শুনে, বারংবার আবৃত্তি করে এবং স্মৃতিশক্তির ওপর নির্ভর করে বৈদিক বিদ্যার প্রসার হয়। অনেক পন্ডিতের মতে এর সঙ্গে অভিনয়, মুখভঙ্গি এবং বিভন্ন মুদ্রারও প্রয়োগ হতো। মৌখিক শিক্ষণপদ্ধতি ও আবৃত্তিতে উচ্চারণ, ছন্দ, স্বরবিরাম, অক্ষর বা শব্দবিশেষে জোর দেওয়া ইত্যাদি কৌশল অপরিহার্য ছিল যা কোন লিখিত লিপিতে সম্ভব নয়। বেদগুলি লিপিবদ্ধ করা শুরু হয় আনুমানিক ৫০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ থেকে। ততদিনে দুর্ভাগ্যবশত স্বাভাবিক কারণেই অধিকাংশ শ্লোকই বিস্মৃতির অতলে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

এসব হল একাডেমিক বেদ বিশেষজ্ঞদের মত। হিন্দু অধ্যাত্মবাদী পন্ডিতরা বিভিন্ন পুরান, উপনিষদ এবং মহাভারত ইত্যাদি প্রাচীন মহাকাব্যের ভিত্তিতে বিশ্বাসধারা ও দার্শনিক দৃষ্টিকোণ প্রদান করেছেন। তবে এই সব বিশ্বাস ও দর্শনের মধ্যে কোন এক বিষয়েও বিবিধতা আছে, এবং কখনও কখনও আপাতবিরোধী মনে হলেও, একাধিক মতের সহাবস্থান লক্ষ্য করা যায়।

এই শাস্ত্রজ্ঞদের বিশ্বাস, মহর্ষিদের অনুভুতিপ্রসুত বেদের স্তোত্রগুলি ক্রমবর্ধমান সংখ্যায় অবিন্যস্তভাবে উদ্ভুত হয়ে যাচ্ছিল, শিক্ষার্থীদের শেখানোও হত বিশৃঙ্খলভাবে। কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন নামের এক ঋষি অন্যান্য বেদজ্ঞ জ্যেষ্ঠ ঋষিদের কাছ থেকে সম্পূর্ণ বেদ শিক্ষা করেছিলেন। তাঁর মনে হয়, এই সুবিশাল জ্ঞানভান্ডারকে সুবিন্যস্ত করে, বিষয়ানুসারে বিভক্ত করা প্রয়োজন। পরিনত জীবনে তিনি এই সম্পাদনার কাজে ব্রতী হন, এবং অবশেষে সমগ্র বেদকে চার ভাগে বিভাজন করেন – ঋক, যজুর, সাম এবং অথর্ব। মতান্তরে তিনি প্রথম তিনটি বেদেরই সংকলন করেছিলেন, অথর্ব বেদ পরে সংযোজিত হয়। এই মহৎ কীর্তির জন্য তিনি বেদব্যাস (‘ব্যাস’ শব্দের অর্থ বিভাজন) নামে পরিচিত হলেন। এ ছাড়াও পুরাণ, মহাভারত, ব্রহ্মসুত্র ইত্যাদি গ্রন্থেরও রচয়িতা ব্যাসদেব।

বেদকে বলা হয় ‘অপৌরুষেয়’, অর্থাৎ মনুষ্যসৃষ্ট নয়। তাহলে প্রশ্ন ওঠে, কোথা থেকে এর উৎপত্তি হল ? কেনই বা তবে বিভিন্ন বেদমন্ত্রের শ্রেয় বিভন্ন মহর্ষিদের দেওয়া হয়ে থাকে ? এর এক গভীর তাত্বিক ব্যাখ্যা দেওয়া হয় যা অনেকটা এই রকম।

মানুষের মন বড়ই চঞ্চল। সর্বদাই বহু চিন্তাভাবনায়, নানা আবেগে উদ্বেগে ভারাক্রান্ত থাকে। তবে নিবিড় ধ্যানযোগের মাধ্যমে এই অশান্ত চিত্তকে শান্ত করার প্রকৌশল আমাদের মহর্ষিরা সিদ্ধ করেছিলেন। এখন, যত পার্থিব শক্তি আছে, তার মধ্যে হিন্দু দর্শনে শব্দকে বলা হয় ব্রহ্মস্বরূপ। সৃষ্টির আগের থেকে, আদি, বর্তমান, এমনকি বিলয়ের পরও মহাজাগতিক শব্দতরঙ্গ ছিল, আছে এবং থাকবে। তার কিছু আমাদের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য, অধিকাংশই নয়। তাত্বিকরা বলছেন, সমাহিত চিত্তে এই অধরা ধ্বনিই পুঞ্জীভুত বাক্যসমূহরূপে মহর্ষিদের অন্তরাত্মায় প্রকাশ পেয়েছিল এবং অনুভূত হয়েছিল। সেই জ্ঞানই গীত হয়েছিল বেদবাক্যরূপে। সেই কারণেই বেদের বাণীও শাস্বত, অবিনশ্বর। যুগে য়ুগে আবিষ্কৃত হয়েছে এবং হবে। সমর্পণানন্দ মহারাজ সহজ কথায় বুঝিয়েছেন, মাধ্যাকর্ষণের আবিষ্কর্তা নিউটনকে বলা হলেও মাধ্যাকর্ষণ কিন্তু বরাবরই ছিল এবং থাকবে। তেমনই বেদের জ্ঞান, সনাতন এবং অবিনশ্বর। যে যুগমানব এই জ্ঞান আহরণ করতে পারেন, তিনিই যুগান্তরে ও কালান্তরে সত্যদ্রষ্টা, ব্রহ্মর্ষি।

এমনই এক ঋষি ছিলেন বিশ্বামিত্র। অবশ্য পূর্বাশ্রমে তিনি ছিলেন এক দোর্দন্ডপ্রতাপ ক্ষত্রিয় রাজা। পরে অনেক তপস্যাবলে ঋষি, রাজর্ষি ও দেবর্ষি হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর মন ছিল কলুষিত। ক্রোধ, অহংবোধ, জিগীষা, কামনা, বাসনায় ভরা। জীবনে তিনি বহু কুকর্ম করেছিলেন। তপস্যা করে দুর্লভ বরপ্রাপ্ত হয়েও সে সব শক্তির অপচয় করেন হীন চরিতার্থতায়। বলা বাহুল্য, এই জন্য তিনি বার বার পরাজিতই হলেন, চিত্তশান্তি হল না। অবশেষে, সহস্র বর্ষব্যাপী এক অসাধারণ কৃচ্ছ্রসাধনা ও ধ্যানযোগের পর তিনি এমন এক অবস্থায় পৌঁছলেন, যখন তাঁর মন সম্পূর্ণ ভারশূন্য, চিত্তে আর কোন পার্থিব আকাঙ্খা অবশিষ্ট নেই। এ এক অতুলনীয় রূপান্তর। সেই দিব্য তুরীয় অবস্থায় তিনি পরিনত হলেন এক ব্রহ্মর্ষিতে, যখন তাঁর অন্তরাত্মায় আকুলস্বরে রণিত হল এক অসীম ক্ষমতাশালী, অনন্য প্রার্থনা :

तत्सवितुर्वरेण्यं
भर्गो देवस्य धीमहि
धियो यो नः प्रचोदयात्

[ তৎ সবিতুর্বরেণ্যং
ভর্গো দেবস্য ধীমহি
ধিয়ো য়ো নঃ প্রচোদয়াৎ ]

এই হল গায়ত্রী স্তোত্র, বা ঋগ্বেদে যাকে ঋক বলা হয়। ঋক হল এক একটি শ্লোক। একাধিক শ্লোক সন্নিবেশে গঠিত হয় একটি সম্পূর্ণ সূক্ত। ঋক এবং মন্ত্র অনেক সময় সমার্থক হিসেবে উল্লেখ হয় বটে, কিন্তু এই স্তোত্র কিভাবে মন্ত্রে রূপান্তরিত হয়ে গেল, আর কেমন ভাবে আরও গভীর অর্থবহ হয়ে উঠল, সে আলোচনায় আসছি একটু পরে।

ঋগ্বেদের একাধিক শাখা ছিল বলে মনে করা হয়, যার একটিই মাত্র শাখা, যার নাম ‘শাকল’, এবং অন্য একটি শাখা ‘বাষ্কল’-এর সামান্য অংশ, এ যুগে অবশিষ্ট আছে। এখনকার উপলব্ধ ঋগ্বেদে ১০টি মন্ডল, ১০২৮টি সূক্ত এবং ১০,৬০০টি ঋক পাওয়া যায়। এক একটি মন্ডল এক এক জন ব্রহ্মর্ষির দিব্য অনুভূতির সংকলন। এর মধ্যে দ্বিতীয় থেকে নবম মন্ডল হল সর্বপ্রাচীন বেদ, এবং তৃতীয় মন্ডল ব্রহ্মর্ষি বিশ্বামিত্রের নাম বহন করে। ঋগ্বেদের এই তৃতীয় মন্ডলে ৬২টি সূক্ত এবং ৬১৭টি ঋক আছে। ৬২তম সূক্তের ১০ম ঋক হল গায়ত্রী স্তোত্র।

গায়ত্রী স্তোত্র ঋক অথবা মন্ত্র রূপে ঋগ্বেদে তো আছেই, যজুর্বেদেও চার বার এবং সাম বেদে একবার ব্যবহৃত হয়েছে। এ ছাড়াও বিভিন্ন উপনিষদ, শ্রীমদ্ভাগবদ্গীতা, হরিবংশ, মনুস্মৃতি ইত্যাদি সব প্রাচীন গ্রন্থাবলীতে বারংবার উল্লেখিত হয়েছে। এমন কি, বৌদ্ধ গ্রন্থ সূক্ত নিপাতে ভগবান বুদ্ধ স্বয়ং তাঁর অনুগতদের বলেছেন এই মন্ত্র অধ্যয়ন করতে। এর থেকে ধারণা করা যেতে পারে মন্ত্রটির মাহাত্ম্য কত ব্যাপকভাবে স্বীকৃত। সাম্প্রতিক কালে রাজা রামমোহন রায় প্রতিটি ব্রাহ্ম সভার শুরুতে গায়ত্রী মন্ত্রের সমবেত ধ্যান প্রথার প্রববর্তন করেন।

কিন্তু এই ‘গায়ত্রী’ আদতে কে, বা কী ?

গায়ত্রী আসলে একটি ছন্দের নাম। আগেই জেনেছি, বেদের স্তোত্র মৌখিক গায়ন বা আবৃত্তির মাধ্যমেই প্রচারিত হত। স্বভাবতই ছন্দের প্রয়োগ আবশ্যিক ও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সমগ্র বেদে সাতটি প্রধান ছন্দের দেখা পাওয়া যায়। এগুলি হল গায়ত্রী, উষ্ণিক, অনুষ্টুপ,বৃহতী, পংক্তি, ত্রিষ্টুপ ও অগতী। এগুলির প্রত্যেকটির নিজস্ব কাঠামো আছে। অন্য আরও কিছু কম ব্যবহৃত ছন্দও আছে।

সবথেকে বেশি শ্লোক গঠিত হয়েছে ত্রিষ্টুপ ছন্দে, তারপর গায়ত্রী ছন্দে। কিন্তু মান্যতায় গায়ত্রী সর্বাগ্রে। গীতায় বলা হয়েছে, “ছন্দসমূহের মধ্যে আমিই গায়ত্রী”। আমাদের সময়ে, কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তার রেশ থেকে, বোধহয় সমকালীন কবিতায় ছন্দের অপ্রাসঙ্গিকতা নিয়েই, লিখেছেন, “সকল ছন্দের মধ্যে এই যে গায়ত্রী, তুমি নাও। গায়ত্রীর মত নারী শুয়ে আছে”। ছন্দপতনের জন্যও তিনি গায়ত্রীকেই নির্বাচন করলেন।

সে যা হোক, আমরা তো রয়েছি বৈদিক যুগে। তাই এইখানে গায়ত্রী ছন্দের গঠনটি একটু জেনে নিই। এই ছন্দে সমগ্র শ্লোক রচিত হয় মোট ২৪টি শব্দাংশ বা সিলেবল নিয়ে। এই ২৪টি সিলেবল আবার তিনটি সমান অংশে বিভক্ত হয়, যার প্রত্যেকটিকে বলা হয় এক একটি পাদ। অর্থাৎ প্রত্যেক পাদে ৮টি করে শব্দাংশ বা সিলেবল থাকতে হবে। নীচে এই কাঠামোটি বোঝানো হয়েছে।









অন্যাান্য আরো অনেক দেব-দেবীদের, যেমন বিষ্ণু, কৃষ্ণ, শিব, গণেশ, দুর্গা, সরস্বতী, লক্ষী ইত্যাদি, স্তুতিতে গায়ত্রী মন্ত্র রচিত হয়েছে। কিন্তু গায়ত্রী মন্ত্র বলতে সাধারণত আপামর ভক্তদের কাছে উপরোক্ত স্তোত্রই প্রাধান্য এবং পরিচিতি পেয়ে এসেছে।

অবশ্যই গায়ত্রী নামের এক দেবীও বর্তমান। ইনি পৌরাণিক দেবী। বিভিন্ন পুরাণে এঁর পরিচিতি ও বর্ণনার রকমফের আছে। মৎস্য পুরাণ অনুসারে ব্রহ্মার দেহ ভেদ করে অর্ধেক পুরূষ এবং অর্ধেক নারীরূপে তাঁর জন্ম, শতরূপা নামেও পরিচিত। মদনদেবের কামশরে বিদ্ধ হয়ে ব্রহ্মা এঁকে বিবাহ করেন, এবং মনু-সহ সাত সন্তানের জন্ম হয়। এই দেবীকেই আবার সরস্বতী ও সবিতা নামেও স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। স্কন্দ পুরাণে ব্রহ্মার স্ত্রী ও সরস্বতী পরিচয়ে তো বটেই, পার্বতী রূপেও বিদ্যমান। ব্রহ্মা অজাচারে লিপ্ত হতে গেলে মহাদেব নাকি তাঁকে বধ করেন ও পরে এই গায়ত্রী দেবীর অনুরোধে পুনর্জীবিত করেন। কূর্ম পুরাণে তিনি গৌতম ঋষিকে বরদান করে তাঁর জীবনের বাঁধা-বিপত্তির অবসান করেন। পদ্ম পুরাণের কাহিনীটি অধিক প্রচারিত। ব্রহ্মা একবার এক যজ্ঞ করছিলেন, তখন তাঁর স্ত্রী সাবিত্রী বা সরস্বতীর যজ্ঞস্থলে প্রয়োজন ছিল। কিন্তু কোন কাজে ব্যস্ত থাকায় সাবিত্রী আসতে অসমর্থ হলে, যজ্ঞ সম্পূর্ণ করার জন্য ব্রহ্মা এক সর্বগূণলক্ষণা সুন্দরী অভিরা নারীকে তৎক্ষণাৎ বিবাহ করেন এবং তাঁর সহায়তায় যজ্ঞ সম্পন্ন করেন। এই নারীই গায়ত্রী। স্বাভাবিকভাবেই সাবিত্রী ক্রোধবশে যজ্ঞস্থলে সকলের শাপান্ত করতে লাগলেন। তখন ব্রহ্মা, বিষ্ণু ইত্যাদি সকলে তাঁকে তুষ্ট করলে সাবিত্রী শেষে গায়ত্রীকে ব্রহ্মার দ্বিতীয় স্ত্রী রূপে স্বীকৃতি দেন। আসলে গায়ত্রী নাকি সাবিত্রীরই রূপভেদ। এইভাবে সাবিত্রী, সবিতা, সরস্বতী, গায়ত্রী সব সমার্থক হয়ে গেছেন। প্রধানত ব্রহ্মার স্ত্রীরূপে পরিচিত হলেও শৈব পূরাণগুলিতে আবার অন্য চিত্র পাওয়া যায়। লিঙ্গপুরাণে মহাদেবের অঙ্গ থেকে তাঁর জন্ম, শ্বেতকল্পে শ্বেতবর্ণা, পীতকল্পে পীতবর্ণা, লোহিতকল্পে লোহিতবর্ণা ও কৃষ্ণকল্পে কৃষ্ণবর্ণা। তিনি বেদমাতা। বরাহ পুরাণে আবার ভীষণা রূপ ধারণ করে তিনি বেত্রাসুরকে বধ করেন। শৈব মান্যতায় তিনি সদাশিবের পত্নী মনোমণি। সরস্বতী, লক্ষী এবং পার্বতীর সম্মিলিত রূপ, গায়ত্রী মন্ত্রের দৈবী প্রকাশ। তাঁর পাঁচ মাথা ও দশ হাত, প্রস্ফুটিত লাল পদ্মে আসনা। বর্তমানে উত্তর ভারতে তিনি এই মুর্তিতেই পূজিত হন।

গায়ত্রী মন্ত্রে যাঁর ধ্যান করা হয়েছে, তিনি কিন্তু এই গায়ত্রী দেবী নন, তিনি হলেন সবিতৃ দেব। ইনি বৈদিক দেবতা। এইখানে জানা দরকার যে বৈদিক দেবতা ও পরবর্তী পৌরাণিক দেব-দেবীদের মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। অধিকাংশ পৌরাণিক দেব-দেবীদের কোন উল্লেখ বেদে নেই। যে সব বৈদিক দেবতারা কোন জাগতিক বা প্রাকৃতিক ঘটমান বিষয়ের প্রতিনিধিত্ব করেন, ইনি তাঁদের মধ্যে একজন। সূর্যোদয়ের আগে পূর্ব দিগন্ত যে স্বর্ণাভ আভায় আলোকিত হয়ে ওঠে, সবিতৃদেব হলেন তারই প্রতিভূ দেবতা।

সবিতৃ ঋষি কাশ্যপ ও তাঁর এক পত্নী অদিতির ১২ পুত্রের একজন। তাই তিনি একজন আদিত্য। তাঁর করমন্ডল ও কেশ স্বর্ণাভ। যখন হলুদ বর্ণের পোষাক পরিধান করে সোনার রথে বিচরণ করেন, তখন তাঁর অবয়ব থেকে এক উজ্জ্বল স্বর্ণালী দ্যুতি বিচ্ছুরিত হয়। তিনি মিষ্টভাষী ও শিষ্টাচারী। সকল সদাচারী ব্যক্তিদের তিনি অমৃতলোকের দিকনির্দেশ করেন। তাঁর আগমনে সূর্যোদয় হয়, এবং তাঁরই নির্দেশে সন্ধ্যাগমন ঘটে। তাই উভয়কালে তিনি পূজ্য। সকল জীবের নিদ্রাভঙ্গ ও বিশ্রামকাল নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি। মর্ত্যলোক এবং অন্তরিক্ষের মধ্যবর্তী অঞ্চল তাঁর প্রভাবে চালিত হয়, তাই বায়ুপ্রবাহ ও বৃষ্টিপাতও তিনিই সৃষ্টি করেন।

সবিতৃ ও সূর্য কি অভিন্ন ? এই প্রশ্নের পক্ষে ও বিপক্ষে বিবিধ পন্ডিতের অনেক মত আছে।

ঋগ্বেদের ১১টি সূক্তে এবং অন্যান্য গ্রন্থাদিতে প্রায় ১৭০ বার যে সবিত্রের উল্লেখ রয়েছে, তাঁকে প্রায়শই সূর্য বা সূর্যের নামান্তরের সঙ্গে সমান্তরাল বা সমার্থক বলে মনে হতে পারে। তাঁর যে সব বৈশিষ্ট্য এবং ক্রিয়াদির বর্ণনা রয়েছে, তা সূর্যের সঙ্গে অনেকাংশে মিলে যায়। কিন্তু অনেকে আবার প্রভেদও দেখতে পান। এমনও উদাহরণ আছে যেখানে ইন্দ্রাদি কয়েক অন্য দেবতার সঙ্গেও সবিত্রের একীকরণ করে বোঝানো হয়েছে।

পঞ্চম খ্রীষ্টপূর্বাব্দের নিরুক্তিকার যাস্কের মত হল, আকাশ থেকে রাত্রির অন্ধকার চলে গিয়ে যখন রশ্মি বিকীর্ণ হয়, সেই হল সবিতৃ (বা সবিতা)র কাল। চতুর্দশ শতকের বেদ ভাষ্যকার সায়নাচার্য্য বলছেন, উদয়ের পূর্বে তিনি সবিতা, উদয় থেকে অস্ত পর্যন্ত সূর্য। যাঁরা সবিতৃ ও সূর্যকে এক বলে মানেন, তাঁরা এই দুই টীকাকে সমর্থন মনে করেন। আবার অন্যরা বলেন, সাকার সূর্য এবং নিরাকার রশ্মি, যা শক্তির প্রকাশ, এই দুইয়ের প্রভেদ এখানে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

যাস্ক এও বলেছেন, ‘সু’ ধাতু থেকে সবিতৃ শব্দের উৎপত্তি, তাই সবিতা অর্থে প্রসবিতা। আবার সায়নাচার্য্যের ব্যাখ্যায়, ‘তৎসবিতুঃ’র অর্থ হল জগৎ-প্রসবিতুঃ। সমগ্র বিশ্বজগতের জন্মদাতাই তো পরম ব্রহ্ম। যজুর্বেদের টীকায় আবার সবিতৃকে বলা হয়েছে প্রজাপতি, যা ব্রহ্মর অপর নাম। স্থানান্তরে এমন উল্লেখও আছে যে সমস্ত সৃষ্টিশক্তির ধারক একমাত্র সবিতৃ। শুধু তাই নয়, অন্য দেবতারা তাঁর অমান্যতায় অপারগ। এই সব যুক্তি দিয়ে ব্রহ্মবাদীরা বলেন যে সবিতৃ নেহাতই সূর্য নন, তিনিই সৃষ্টিকর্তা পরমেশ্বর।

বৈদিক ধর্মে যে অর্থই করা হোক, পরবর্তী ব্রহ্মবাদী ঋষিরা কিন্তু নিরাকার একেশ্বর পরমাত্মায় বিশ্বাসী। তাঁরা বেদকেই অবলম্বন করলেন, কিন্তু যোগ করলেন গভীর দার্শনিক তত্ব। আধুনিক কালের পন্ডিতরাও বেদবাণীসমূহের নিজ নিজ দার্শনিক তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেছেন। এখন কথা হল, এই সব বিজ্ঞ ব্রাহ্মণেরা কেমন করে স্বীকার করতে পারেন যে গায়ত্রী মন্ত্রের মাধ্যমে সকাল সন্ধ্যে তাঁরা সূর্যেরই স্তব করে চলেছেন যা এক জড়পদার্থমাত্র ? বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর ‘সবিতা ও গায়ত্রী’ শীর্ষক প্রবন্ধে সুন্দর মীমংসা দিয়েছেন। প্রথমে বিভিন্ন সাক্ষ্য আলোচনা করে তিনি বলছেন, “বোধ হয় এখন স্বীকার করিতে হইবে যে, সবিতা, পরব্রহ্ম নহেন, জড়পিন্ড সূর্য্য”। অবশেষে তিনি বললেন, “ইহাতে ক্ষতি কি ? ব্রাহ্মণেরাই বা লাঘব কি ? গায়ত্রীরই বা লাঘব কি ? যে ঋষি গায়ত্রী প্রণয়ন করিয়াছিলেন, তিনি যে অর্থই অভিপ্রেত করিয়া থাকুন না, যখন ব্রহ্মপক্ষে তাঁহার বাক্যের সদর্থ হয়, আর যখন সেই অর্থেই গায়ত্রী সনাতন ধর্ম্মোপযোগী এবং মনুষ্যের চিত্ত-শুদ্ধিকর, তখন সেই অর্থই প্রচলিত থাকাই উচিত। তাহাতে ব্রাহ্মণেরও গৌরব, হিন্দুধর্ম্মেরও গৌরব। এই অর্থে ব্রাহ্মণ শূদ্র, ব্রাহ্ম, খ্রীষ্টীয়ান্ সকলেই গায়ত্রী জপ করিতে পারে।“

সুতরাং গায়ত্রী মন্ত্রের ব্রহ্মপক্ষে থাকাই যুক্তিযুক্ত। সজাগ পাঠকরা কিন্তু বলবেন, এই রচনায় তো এখনও পর্যন্ত সম্পূর্ণ গায়ত্রী মন্ত্রের অবতারণাই হয়নি। ঠিক কথা। আসলে ঋষি বিশ্বামিত্র প্রণীত সবিতৃ-গায়ত্রীর ঋক থেকেই যাত্রা শুরু। এই ঋক মন্ত্রে রূপান্তরিত হয়েছে আরও পরে। শুক্ল যজুর্বেদ সংহিতার ৩৬তম অধ্যায়ের তৃতীয় মন্ত্র হল সম্পূর্ণ গায়ত্রী মন্ত্র, যেখানে বিশ্বামিত্রের ঋকের পূর্বে যুক্ত করা হল শব্দগুচ্ছ:

ॐ भूर्भुवः स्वः

সুতরাং পূর্ণ রূপে মন্ত্রটি হল: ওঁ ভূর্ভুবঃ স্বঃ তৎ সবিতুর্বরেণ্যং ভর্গো দেবস্য ধীমহি ধিয়ো য়ো নঃ প্রচোদয়াৎ। লক্ষ্যণীয় যে প্রাথমিক এই শব্দগুলি কিন্তু গায়ত্রী ছন্দে বদ্ধ নয়। মন্ত্রাকার সাধনেই এগুলি যুক্ত করা হয়েছে।

এইবার সময় এসেছে এই মন্ত্রের আক্ষরিক অর্থ এবং অন্তর্নিহিত ভাবার্থ বা গূঢ় তত্ব বিশ্লেষণের প্রয়াস করার। প্রয়াস মাত্র। কারণ যে গভীর আধ্যাত্মিক দর্শন এর মধ্যে নিহিত বলে মান্যতা পেয়েছে, তার সম্যক উপলব্ধি সাধারণের কাছে উপস্থাপন করার মত প্রয়োজনীয় যোগ্যতার দাবিদার আমি নই। তা ছাড়া, বিভিন্ন তাত্বিকেরা বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাই এখানে আমরা সায়নাচার্য্যের শরণাপন্ন হব, এবং তাঁর কাছে অগ্রিম ক্ষমাপ্রার্থী হয়ে কিঞ্চিত সরলীকরণের চেষ্টা করব।

প্রথম শব্দ ওঁ। সকলেই জানেন, সৃষ্টির প্রারম্ভে ধ্বনিত তিন আদি স্বর অ, উ এবং ম মিলিত হয়ে ওঁ-কারের উৎপত্তি। হিন্দু ধর্মের পবিত্রতম প্রতীক। যে কোন ঋকের শুরুতে ও শেষে ওঁ ব্যবহার করলে তা মন্ত্রে পরিনত হয়।

পরবর্তী তিনটি শব্দকে বলা হয় ব্যাহৃতি। ব্যাহৃতি নিয়ে বিশদ আলোচনায় না গিয়ে শুধু বলা যায় যে ওঁ-কারের মতই পবিত্র এবং আদি সাতটি শব্দকে ব্যাহৃতি বলা হয়, যার মধ্যে আবার প্রথম এই তিন শব্দ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। মন্ত্রে ব্যাহৃতির প্রয়োগ অনিবার্য। এখানে এই তিন শব্দের স্বতন্ত্রভাবে ব্যাখ্যা প্রয়োজন, কারণ এদের প্রয়োগ মন্ত্রের ব্যাপ্তিকে প্রসারিত করেছে।

ভূ – পৃথ্বীলোক বা স্থূল বা ভৌতিক জগৎ; ভাবান্তরে স্থূল শরীর।

ভুব: - অন্তরীক্ষ লোক; ভাবান্তরে সূক্ষ শরীর, যা না তো সম্পূর্ণ শারীরিক, না আধ্যাত্মিক।

স্ব: - স্বর্গলোক বা কারণ-জগৎ; ভাবান্তরে আত্মার ক্ষীন আবরণ, যার পেছনে আত্মা, পরমাত্মা বা পরমেশ্বর বিরাজমান। বৈদিক আধ্যাত্মবাদ অনুসারে সকলের অন্তরেই পরমেশ্বর আসীন, অজ্ঞানতার কারণে যাঁর উপলব্ধি থেকে মানুষ বঞ্চিত।

তৎ - সেই (দেবতা; ঈশ্বর)।

সবিতু – সবিতা; বা অন্তর্যামী। লক্ষণীয়, যে সবিতৃদেবকে আগে আমরা মর্ত্য ও অন্তরীক্ষের মধ্যাঞ্চলের দেবতা বলেই বর্ণনা করেছিলাম, এই ব্যাহৃতি ত্রয়ী সেখান থেকে তাঁকে ত্রিলোকের অধীশ্বর পরম ব্রহ্মের মর্যাদায় রূপান্তরিত করেছে।

বরেণ্যং – বরণীয়, পূজনীয়।

ভর্গো দেবস্য – এক অর্থে অন্ধকার নাশক দীপ্তির দেবতাকে; ভাবার্থে চেতনার উন্মেষকারী পরমেশ্বরকে। ভর্গ মানে অন্নও হয়। তাই অন্য অর্থে জাগতিক সম্পন্নতা প্রদানকারী দেবতাকে। শব্দটি এই মন্ত্রকে তিন মাত্রায় ব্যবহার করার উপয়োগী করেছে। জাগতিক সম্পদ, পাপনাশক আধ্যাত্মিক শক্তি, এবং সর্বোচ্চ স্তরে অজ্ঞানতার অন্ধকার থেকে চেতনার দ্যুতি, এই সর্বস্ব প্রদান করেন যে ঈশ্বর, তাঁকে।

ধীমহি – ধ্যান করি; ভাবার্থে ধারণ বা প্রতিষ্ঠিত করি।

ধিয়ো – বুদ্ধি; কর্ম ও ধর্মজীবনের প্রজ্ঞা।

য়ো – সেই, অর্থে সেই দেবতা বা পরমেশ্বর।

ন: - আমাদের।

প্রচোদয়াৎ - নিয়ে যান, বা দিগ্দর্শন করান; প্রেরণা প্রদান করেন।

এই সমস্ত শব্দার্থকে একত্রিত করে যদি অতি সাধারণ গদ্যে মন্ত্রটিকে প্রকাশ করার চেষ্টা করি, তবে অনেকটা এইরকম দাঁড়ায়:

“সেই সর্বব্যাপী, বরেণ্য, সর্বস্ব-প্রদায়ী, জ্যোতির্ময় ঈশ্বরের ধ্যান-প্রতিষ্ঠা করি, যেন তিনি আমাদের জ্ঞান ও বুদ্ধির আলোক উন্মোচিত করে দিকনির্দেশ করেন”।

প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বহু গূণী পন্ডিত, দার্শনিক ও সাহিত্যিক অনেক ভাষায় গায়ত্রী মন্ত্রের অনুবাদ বা ভাবানুবাদ করেছেন। কিন্তু অল্প কথায় অনেক কথা বলে যাওয়ার মত দক্ষতা ও শৈলী আমাদের রবি ঠাকুরের মত আর কার ? তাঁর “বেদ: সংহিতা ও উপনিষদ”এ সরল পদ্যে গায়ত্রী ঋকের যে ভাবানুবাদ তিনি করেছিলেন, তা এইখানে উল্লেখযোগ্য:

যাঁ হতে বাহিরে ছড়ায়ে পড়িছে
পৃথিবী আকাশ তারা,
যাঁ হতে আমার অন্তরে আসে
বুদ্ধি চেতনা ধারা –
তাঁরি পূজনীয় অসীম শক্তি
ধ্যান করি আমি লইয়া ভক্তি।

তবে মনে রাখতে হবে যে এই অনুবাদ মন্ত্রের নয়, কারণ এতে প্রারম্ভের ব্যাহৃতি অন্তর্ভুক্ত হয়নি।

শাস্ত্রজ্ঞানী বিদ্বজন গায়ত্রী মন্ত্রকে এক অতি উচ্চ মর্যাদার স্থান দিয়েছেন। তাঁরা বলেন, এই মন্ত্র নিয়মিত জপ করলে অতুল সুফল পাওয়া সম্ভব, অন্য মন্ত্রের প্রয়োজন নেই। গায়ত্রী মন্ত্রের শক্তি নাকি অপরিসীম। আমার এক অগ্রজ সহকর্মী বলতেন, দৈনিক জীবনে যখনই কোন কঠিন পরিস্থিতি এসেছে, মনে মনে গায়ত্রীর শরণাপন্ন হয়ে সর্বদাই তিনি অশেষ মনোবল ও উপকার পেয়েছেন। এই প্রত্যয় নিছকই অটুট বিশ্বাসপ্রসূত, না বাস্তব অভিজ্ঞতানির্ভর, তা বলা মুশকিল। তবে মন্ত্রটির এই আভিজাত্যের কারণ বোধহয় মন্ত্রের মধ্যেই নিহিত।

প্রথমত, এখানে কোন বিশেষ দেবী-দেবতার স্তবগাথা নেই। এই ঈশ্বর যে কোন বিশ্বাসের মানুষের ঈশ্বর হতে পারেন। তাই এই মন্ত্র কোন ধর্ম বা জাতি ভেদে সীমাবদ্ধ নয়, সার্বজনীন।

দ্বিতীয় কারণ, শুধুমাত্র অতি উচ্চমার্গের সাধনা অর্থাৎ ঈশ্বরানুভূতির জন্যেই যে এই মন্ত্র উপযোগী, তা নয়। যে কোন পার্থিব অথবা আধ্যাত্মিক লক্ষ্যে গায়ত্রী মন্ত্রে সমানভাবে নির্ভরশীল হওয়া যায়।

তৃতীয়, এবং সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, এই মন্ত্রে কিন্তু সরাসরিভাবে কোনই চাহিদা নেই, যা সাধারণত আমাদের অন্যান্য পুজা মন্ত্রে থাকে। এখানে ঈশ্বরের কাছে অর্থ-মোক্ষ ইত্যাদির প্রত্যাশা নেই। যা ভিক্ষা করা হয়েছে তা হল অকলুষিত বুদ্ধি। নিষ্কলঙ্ক বুদ্ধিবলে মানুষ যে কোন সাফল্য অর্জনে সক্ষম, কারণ তখন নিরপেক্ষ বিচারে সঠিক পথের সন্ধান মেলে। এমন সুচিন্তিত আবেদন আর কোন প্রার্থনায় আছে বলে আমার জানা নেই।

গায়ত্রী মন্ত্রের শক্তি সর্বসাধারণকে বুদ্ধিবলে বলবান করুক, এই কামনাই করি।