0

প্রবন্ধ - মনোজিৎকুমার দাস

Posted in

সমরেশ মজুমদার লৌকিক প্রয়াণে তাঁর গল্প-উপন্যাসের বোদ্ধা পাঠকরা দুঃখে ম্রিয়মাণ হবে এটাই স্বাভাবিক। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শাখা গল্প-উপন্যাসে ও সাহিত্যের বিভিন্ন শাখা যেমন — ভ্রমণকাহিনি, গোয়েন্দাকাহিনি, কিশোর উপন্যাসের মতো শাখাগুলোতেও রয়েছে তাঁর উজ্জ্বল স্বাক্ষর। বাংলা সাহিত্যে তিনি যে ঋদ্ধতার স্বাক্ষর রেখে গেছেন তা কিন্তু বাঙালি সাহিত্য প্রেমিক বোদ্ধা পাঠকের মন থেকে মুছে যাবে না কোন দিনই।

বহুমাত্রিক বর্ণিল প্রতিভার অধিকারী লেখক হিসেবে সমরেশ মজুমদার তাঁর প্রত্যেকটি লেখার বিষয় ভিন্ন, রচনার গতি এবং গল্প বলার ভঙ্গি ও প্রেক্ষাপটের নান্দনিকতা পাঠকদের আন্দলিত করে।

বাংলা কথাসাহিত্যের পাঠকদের সমরেশ মজুমদার তাঁর লেখনির বর্ণিল প্রতিভা দ্বারা প্রবলভাবে টানে।

সমরেশ মজুমদারের দীর্ঘ সাহিত্য কর্মকান্ডের শুরু যে উপন্যাসটি দিয়ে সেটির নামটি দৌড়। উপন্যাসের উৎসর্গে লিখেছিলেন — ‘দৌড় আমার প্রথম উপন্যাস, প্রথম প্রেমে পড়ার মতো’। এ উপন্যাসের শেষটাও মনে রাখার মতো: ‘মেয়েদের চোখের দৃষ্টি মাঝে মাঝে এক হয়ে যায় কি করে! মায়ের, নীরার অথবা এখন এই জিনার? যে চোখ শুধুই বলে — ভালো থেকো, ভালো থেকো, ভালো-ঈশ্বর, তবে কেন বুক জ্বলে যায়!’

তিনি তাঁর উপন্যাস ‘দৌড়’ লেখার পর থেকে আর থামেননি। একের পর এক লিখেই চললেন, যা সে সময়ের জনমানসের বিশেষ করে তরুণ সমাজের অস্থিরতার বাস্তব চিত্র।

বাংলা সাহিত্যে তাঁর অমর ট্রিলজি ‘উত্তরাধিকার’, ‘কালবেলা’, ‘কালপুরুষ’ তাঁর অমর সৃষ্টি। অবশ্য এর সঙ্গে ‘মৌষলপর্ব’ যুক্ত করে চতুর্ভুজ হিসেবে আখ্যা দেন অনেকেই।

সাতকাহন, গর্ভধারিণী, অগ্নিরথ, সিংহবাহিনী, এত রক্ত কেন, কলিকাতায় নবকুমার, তেরো পার্বণ, স্বপ্নের বাজার, উজান, গঙ্গা, বুনোহাঁস, ভিক্টোরিয়ার বাগান, আট কুঠুরি নয় দরজা ইত্যাদি তাঁর লেখা সমসাময়িক কালের ঘটনা প্রবাহের উজ্জ্বল সৃষ্টি।

নকশাল আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে লেখা উপন্যাস “কালবেলা”। এর স্রষ্টা হিসেবেই তিনি পাঠকের কাছে অধিক প্রিয়। কালবেলার অমর দুই চরিত্র অনিমেষ ও মাধবীলতা। সমরেশ এই উপন্যাসে দুটি চরিত্র সৃজন করেছেন অভিজ্ঞতার আলোকে। নির্দ্বিধায় বলা যায়, তার লেখা কালবেলা উপন্যাস তার মাস্টারপিস।

কালবেলা গত শতাব্দীর আটের দশকের শুরুতে প্রথমে কলকাতার একটা সাপ্তাহিক পত্রিকায় ধারাবাহিক হিসেবে প্রকাশিত হয়। এই প্রকাশনাকালে তার জনপ্রিয়তার আঁচ টের পাওয়া যায়। সেটা প্রবল তাপ ও চাপ নিয়ে আবির্ভূত হয় যখন বই আকারে প্রকাশিত হয়। কালবেলার যে ত্রিভুজ কিংবা চতুর্ভুজ সেখানে মার্কসবাদী চেতনা মুখ্য হয়ে উঠেছে। পুরো ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গ বিশেষ করে উত্তরবঙ্গের সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির চালচিত্র হাজির রয়েছে। তখন পশ্চিমবঙ্গের ভোটের রাজনীতিতে সবেমাত্র কংগ্রেসকে হটিয়ে সিপিআই (এম) ক্ষমতাসীন হয়েছে। মার্কসবাদ, সমাজতন্ত্র সবই তখন তরুণদের মধ্যে ভীষণভাবে জাগরুক। সমরেশ এই সময়ের কথা বলছেন না ঠিকই। বলছেন আরও একদশক কিংবা তারও আগের কথা। কিন্তু সেসবকে তরুণরা এবং ওই সময়ের অন্যান্য বয়সীরাও দারুণভাবে যুক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন।

সমরেশ মজুমদার এর কালবেলা উপন্যাসের প্রধান চরিত্র অনিমেষ ও মাধবীলতা। অনিমেষ ও মাধবীলতা কে ঘিরে এই উপন্যাসটি আবর্তিত।

কালবেলা’র এইসব সুযোগ তাকে আপনার ক্ষেত্রটাকে বিকশিত হয়ে ওঠার সুবিধা দেয়। এ বাংলা, ও বাংলা দুই জায়গাতেই অনিমেষ ও মাধবীলতার ভেতর দিয়ে তরুণরা তো বটেই অন্যবয়সীরাও যেন আদর্শিক একটা জায়গা খুঁজে পায়। প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির ঘেরাটোপের বাইরে গিয়ে এই আদর্শ তাদের কাছে গুরুত্বও পায়। যে কারণে কালবেলা’র চরিত্রদ্বয় ফিকশন বা কল্প জগতের মানুষ হয়েও বাস্তবের মানুষের উপর প্রভাবিত করে।

পাঠকপ্রিয়তার তুঙ্গস্পর্শী এক উপন্যাস। রাজনীতিতে অনিমেষের কঠিনভাবে জড়িয়ে পড়া, আদর্শের সঙ্গে বাস্তবতার বিপুল ফারাক উপলব্ধিজনিত হতাশা এবং তারপর তার জীবনের এক উজ্জ্বল উদ্ধার, যার নাম মাধবীলতা। মাধবীলতা যেন তার জীবনের ধ্রুবতারা; ঝড়, ঝঞ্ঝা, সমস্ত প্রতিকুলতার মধ্যে যে অনিমেষকে স্থিতধী করে রাখে। কালবেলা আমাদের জানায়, বিপ্লব ও প্রেম পরস্পরবিরোধী হতেই হবে এমন কথা নেই, পরম বিশ্বাসে একে অন্যের হাতে হাত ধরেও তারা চলতে পারে। কালবেলার পাঠকরা কি কখনও ভুলতে পারবেন সেই উক্তি: বিপ্লবের আরেক নাম মাধবীলতা!

তাঁর লেখা পড়ে মনে হয়, মার্কস, লেনিন, মাওয়ের আদর্শে অনুপ্রাণিত নকশালিস্টদের সে সময়ের কর্মকান্ডকে কাছ থেকে দেখে অভিজ্ঞতার আলোকেই রচনা করেন কালবেলা। শুধু এতটুকু জানা আছে যারা অনিমেষ এবং মাধবীলতা হয়ে উঠতে চেয়েছিল, হয়েওছিলেন তারা শেষাবধি কিন্তু সেটাকে কনটিনিউ করলেন না, ব্যতিক্রম আছে কি না জানা নেই। অনিমেষ-মাধবীলতারা শেষাবধি কেন অনিমেষ, মাধবীলতা থাকেননি, তার কারণ জীবনের দৌড় সেটাকে সমর্থন করে না। সমরেশ মজুমদাররা জীবনের রেখায় কালবেলার পরিভ্রমণকে সমাপ্তি দেন না। বাস্তবের সঙ্গে কল্পনার-উপন্যাসের ফারাক যেন জীবনের গদ্যকেই প্রস্ফুটিত করে।

সমরেশ মজুমদার যে শুধু বাংলা সাহিত্যের প্রতি অনুরাগী ছিলেন তা নয়, সাহিত্যিক জীবনের শুরু থেকেই মঞ্চ নাটক ও গ্রুপ থিয়েটারের প্রতি সমরেশ মজুমদারের ঝোঁক ছিল প্রবল। তাঁর প্রথম গল্প ‘অন্যমাত্রা’ লেখা হয়েছিল মঞ্চনাটক হিসেবে এবং এই গল্পটি ১৯৬৭ সালে ‘দেশ’ পত্রিকায় গল্প হিসেবে ছাপা হয় আর সেখান থেকেই শুরু হয় তাঁর লেখকজীবনের জয়যাত্রা। পাঠকের সামনে উপন্যাসিক হিসেবে এই অসামান্য প্রতিভার আবির্ভাব ১৯৭৫ সালে, সে বছরেই সমরেশ মজুমদারের প্রথম উপন্যাস ‘দৌড়’ ছাপা হয়েছিল ‘দেশ’ পত্রিকাতেই।

সমরেশ মজুমদারের লেখায় সাবলীলতা, স্পষ্ট ঘটনার বিস্তার ও নিপুণ পরিমিতিবোধ তাঁকে আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্যে খ্যাতি এনে দিয়েছে। জন্মসূত্রে তিনি উত্তরবঙ্গের লোক। কিন্তু তাঁর লেখার সঙ্গে একটা আত্মীয়তা অনুভব করে পূর্ববাংলা তথা অধুনা বাংলাদেশের মানুষ। তাঁর রচিত এমন বহু সাহিত্য রয়েছে যার মাধ্যমে সরাসরি পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের প্রক্ষাপট এসেছে একান্নবর্তী পরিবারের মতো। তাই একজন সমরেশ মজুমদার পশ্চিমবঙ্গ নাকি বাংলাদেশে বেশি জনপ্রিয়? —এমন প্রশ্নের উত্তর খোঁজা যে কারও পক্ষে কঠিন কাজ হয়ে দাঁড়াবে। তবে জীবনের শেষ পর্বে এসে তিনি যত সৃষ্টি রচনা করেছেন তার মধ্যে কী উপন্যাস কী ছোটগল্প, তিনি ফিরে গেছেন তাঁর নিজের জন্মভূমিতে, উত্তরবঙ্গে। সমরেশ মজুমদার তাঁর জীবনের শেষ সময়ের রচনাগুলোতে উত্তরবঙ্গের প্রক্ষাপট ফুটে উঠেছে প্রাণবন্ত হয়ে।

উত্তরাধিকার, কালবেলা, কালপুরুষ — এই ত্রয়ী উপন্যাসের ওপরই বোধ করি দাঁড়িয়ে আছে সমরেশ মজুমদারের পাঠকপ্রিয়তার সৌধ। অনিমেষ আর মাধবীলতা, সমরেশের পাঠকের কাছেই প্রিয় দুটো নাম। অনিমেষ নামে এক মফস্বলী তরুণের উচ্চশিক্ষার জন্য কলকাতায় পা রাখা, রাজনীতির অগ্নিগর্ভ পরিবেশের সঙ্গে পরিচিত — সেই সঙ্গে আত্ম-অনুসন্ধানের গল্প উত্তরাধিকার। বাস্তবতা সম্বন্ধে ধারণাহীন সহজসরল এক তরুণের উপলব্ধির উন্মেষকালের গল্প উত্তরাধিকার। তারপর কালবেলা।

সমরেশ মজুমদার তার কালবেলা উপন্যাসের অনিমেষ ও মাধবীলতা এই দুটি চরিত্র যুব মানসের উপর ভর করে।

বাংলা সাহিত্যে আর কোন উপন্যাসের চরিত্র এভাবে পাঠককে উপর ভর করতে পারিনি। আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলতেও পারেননি। এই ক্ষমতাকে ব্যবহার করতে পেরেছিলেন সমরেশ মজুমদার। তখন যারা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন, তাদের একটা বড়ো অংশ অনিমেষ ও মাধবীলতার মায়ায় নিজেকে বেঁধে আনন্দিত হয়েছেন। প্রত্যেকের ছদ্মনাম হয়ে উঠেছে ওই দুই নাম। যারা ডয়েরি লিখছেন সেখানে নিজেদেরকে ওই নামে প্রকাশ করছেন। প্রেমিক প্রেমিকা আড়ালে আবডালে নিজেদেরকে সম্বোধিত করছেন অনিমেষ ও মাধবীলতারূপে।

সমরেশ মজুমদারের শৈশব কেটেছে ডুয়ার্সের গয়েরকাটা চা বাগানে, সেখানেই শিক্ষাজীবনের শুরু, এরপর কলকাতায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জীবনের সমাপ্তি টেনে সেখানেই জীবিকার তাগিদে স্থায়ী হয়েছিলেন। তাই চা বাগানের মদেসিয়া সমাজ থেকে কলকাতার নিম্নবিত্ত মানুষেরা বারবার তাঁর কলমে উঠে এসেছেন বাস্তবতার রক্তমাংস নিয়ে।

সমরেশ মজুমদার উত্তরবঙ্গের সন্তান হাওয়ায় নকশালবাড়ি আন্দোলনে অবলোকন করেছিলেন। সেই আলোকেই তিনি সে সময়ের নকশাল বাড়ি আন্দোলনের প্রেক্ষাপট, বিস্তৃতি ও পরিণতিকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল বলে মনে হয়। আর সেই আলোকেই তিনি আমার সৃষ্টি কালবেলা উপন্যাস রচনা করেন এবং এই উপন্যাসের অনিমেষ ও মাধবীলতাকে তুলে ধরেছেন অভিজ্ঞতা আর কল্পনার মিশেলে। সেই অস্থির সময়ের বাস্তব চিত্র তার কালবেলা উপন্যাসে বাস্তবতার নিরিখে উপস্থাপিত হয়েছে।

বহুমাত্রিক বর্ণিল প্রতিভার অধিকারী লেখক হিসেবে সমরেশ মজুমদার তাঁর লেখনি শুধুমাত্র গল্প বা উপন্যাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি; এ কথার আভাস আগেই দেওয়া হয়েছে।

সাহিত্যে আলোচনা, খ্যাতি, সমালোচনা এসব থাকবেই। কিন্তু একজন দৃঢ় মনস্ক সাহিত্য হওয়ার জন্য যে স্পৃহা দরকার জীবনজুড়ে, তার পুরোটাই দেখিয়ে গেছেন সমরেশ মজুমদার। তাই তিনি একজন সমরেশ মজুমদার হয়েই বেঁচে থাকবেন পাঠকের হৃদয়ে। যারা নিয়মিত বর্তমান সময়ের বাংলা সাহিত্য পড়েন, গবেষণা করেন বা অন্ততপক্ষে খোঁজখবর রাখেন তাদের কাছে এ কথা নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই যে, সমরেশ মজুমদার বাংলা কথাসাহিত্যের এক উজ্জ্বল প্রতীক, এক দীপ্তিমান নক্ষত্র। পাঠকপ্রিয়তার তুঙ্গস্পর্শী তাঁর লেখা গল্প উপন্যাস ও অন্যান্য লেখায়। বাংলা সাহিত্যঙ্গনে চিরকালের জন্য অমর হয়ে থাকবেন।

0 comments: