0

সম্পাদকীয়

Posted in


































যুদ্ধ নয় শান্তি চাই। এ তো শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের চিরকালীন স্বপ্ন। আমাদের 'সভ্য' হয়ে ওঠার ইতিহাস অবশ্য অন্যকথা বলে। যুদ্ধ ছাড়া মীমাংসা হয়নি কোনও বড় সংকটের। তা সে ট্রয়ের যুদ্ধই হোক বা কুরু-পাণ্ডবের। এসবই আমরা 'ন্যায়ের যুদ্ধ' বলে মহিমান্বিত করেছি। তালিকাটি ফুরোবার নয়।

সম্প্রতি একটি ঘটনাক্রম আবার উস্কে দিল এই বিতর্ককে। গতমাসে এক বর্বরোচিত সন্ত্রাসের শিকার হয়েছিল নিরপরাধ কিছু মানুষ। পরিজনের সঙ্গে নিভৃত কিছু মুহূর্ত কাটানোর মাঝে অতর্কিতে নেমে এসেছিল সেই হামলা। দেশজোড়া পরবর্তী পরিবেশ হয়ে উঠেছিল থমথমে। কিছু একটা যে ঘটতে চলেছে, আমরা অনুমান করছিলাম কিন্তু কী সেই 'কিছু', তা নিয়ে স্পষ্ট ধারণা না থাকলেও চায়ের কাপে ঝড়ও কিছু কম ওঠেনি।

অবশেষে ঘটল সেই প্রত্যাঘাত। অবশ্যম্ভাবীভাবে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ল সংশ্লিষ্ট সকলে। আবার ফিরে এল মূল সেই জিজ্ঞাসা। সত্যিই কি দরকার ছিল পাল্টা এই আগ্রাসন? যুদ্ধের জিগির? এখানেই যুক্ত হয়ে যায় সেই যুক্তি, আত্মরক্ষার্থে যদি গড়ে তোলা হয় প্রতিরোধ, যার পরিণতি আক্রমণে, তার সঙ্গে অন্যায় চক্রান্ত আর আগ্রাসনকে কি একই আসনে বসানো উচিত? অন্যদের তো বটেই, 'শুভবুদ্ধি সম্পন্ন' মানুষরদের মনেও এই ধন্দের নিরসন কি খুব কঠিন?

বিষয়টা আদপে তাই যুদ্ধের স্বপক্ষে কিংবা যুদ্ধবিরোধী নয়, ধারাবাহিক এক অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর। তথাকথিত বুদ্ধিজীবী মহল এই সত্যটি মেনে না নিলে বা সেটিকে তাৎক্ষণিক রাজনীতির হাতিয়ার করে তুললে, তার পরিণাম হতে পারে ভয়ংকর!

সুস্থ থাকুন। দায়বদ্ধ থাকুন।

শুভেচ্ছা অফুরান।

0 comments:

0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - সঞ্চিতা বসু

Posted in







দ্বারকেশ্বর নদীর ধারে বালি-দেওয়ানগঞ্জ, আরামবাগের গোঘাট অঞ্চলের একটি গ্রামই বলা চলে। গোঘাটেরই একটি অঞ্চল কামারপুকুর। ১৮৮০ সালে এই বালি-দেওয়ানগঞ্জে বাড়ি বানিয়েছেন শ্রীরামকৃষ্ণ-ভক্ত বংশীধর মোদক। নতুন বাড়িতে যাওয়ার আগে তাঁর ইচ্ছা ঠাকুর ও মা তাঁর বাড়িতে একবার পদার্পণ করুন, সুযোগের অপেক্ষা করছেন। এল সুযোগ! একদিন ভাগ্নে হৃদয়ের সঙ্গে শ্রীমাকে নিয়ে ঠাকুর কামারপুকুর যাচ্ছেন, পথে প্রচণ্ড বৃষ্টি প্রচণ্ড বৃষ্টি! নৌকো এসে ভিড়ল বালি-দেওয়ানগঞ্জে, সম্ভবত দ্বারকেশ্বর নদীতেই। ঠাকুর, শ্রীমা ও হৃদয়কে নিয়ে তিন দিনের জন্য থেকে গেলেন বংশীধর ও তাঁর স্ত্রী গিরিবালার বাড়ি। স্থানীয়দের সঙ্গে শাস্ত্রালাপে ও আনন্দে কেটে গেল তিন দিন, ধন্য হল বংশীধরের বালি-দেওয়ানগঞ্জের তৎকালীন নতুন বাড়িটি। এই স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য বংশীধরের বাড়ির একটি ঘরে রয়ে গেল, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ, মা সারদা ও স্বামী বিবেকানন্দর ছবি, তিন দিনের স্মৃতিচিহ্ন ও আজীবনের অভিজ্ঞান। তাছাড়া রামকৃষ্ণ মিশন ও মঠের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সেবামূলক কাজ বালি দেওয়ানগঞ্জে এখনও নিয়মিত সংগঠিত হয়।

এবার আসা যাক অন্য প্রসঙ্গে। বালি-দেওয়ানগঞ্জ আরামবাগের একটি বিখ্যাত মন্দির অঞ্চল। একাধিক মন্দির স্থাপত্য ও ভাস্কর্যর বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায় এই অঞ্চলে। ১৯৭২-এ David McCutchion, তাঁর ‘Late Mediaeval Temples of Bengal: Origin and Classification’ বইতে এই অঞ্চলের মন্দিরগুলির বৈশিষ্ট্যর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। শুধু বৈশিষ্ট্যই নয়, মন্দিরগুলির মাপও তিনি উল্লেখ করেছিলেন। বালি-দেওয়ানগঞ্জের চারটি মন্দিরের উল্লেখ করতেই হয়।

১. দুর্গা মন্দির, ২১’১০’’ স্কোয়ারফিট স্থান জুড়ে জোড়-বাংলা রীতির ওপর নবরত্ন মন্দির (আনুমানিক উনিশ শতক)১
২. সর্বমঙ্গলা মন্দির বা বিষ্ণু মন্দির (বা দামোদর মন্দির David McCutchion-এর উল্লেখ অনুযায়ী), ২২.৫’’ স্কোয়ারফিট স্থান জুড়ে পঞ্চরত্ন মন্দির (আনুমানিক উনি শতক)২
৩. দামোদর মন্দির, ২২’ x ১৯.৫’ স্কোয়ারফিট স্থান জুড়ে ঘোষ পরিবারের উনিশ শতকীয় মেদিনীপুর ঘরানার আটচালা রীতির মন্দির (১৮২২)৩
৪. মঙ্গলচণ্ডী মন্দির, ত্রিতল ত্রয়োদশরত্ন, কিন্তু প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত (ফলে David McCutchion-এর উল্লেখ অনুযায়ী এটি কথিত তথ্য)৪

দুর্গামন্দিরের পাশের মন্দিরটি এই মুহূর্তে লোকমুখে সর্বমঙ্গলা মন্দির বা স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে বিষ্ণু মন্দির হিসেবে পরিচিত, কিন্তু David McCutchion তাঁর বইতে মন্দিরটিকে রাউতপাড়ার দামোদর মন্দির২ হিসেবেই উল্লেখ করেছেন। কিন্তু এ তথ্য আর অন্য কোনো সূত্র দ্বারা সমর্থিত নয় বলেই আমরা মন্দিরটিকে সর্বমঙ্গলা বা বিষ্ণু মন্দির বলে উল্লেখ করছি। বালি-দেওয়ানগঞ্জের মন্দিরের মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ দুর্গা মন্দিরটি। কারণ এর স্থাপত্য। মন্দিরটির নীচের অংশ জোড়-বাংলা রীতিতে গঠিত, অর্থাৎ পাশাপাশি দুটি দোচালা মন্দিরকে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। দুটি আয়তাকার দোচালাকে জুড়ে দিয়ে যেন একটি বর্গাকার মন্দিরভিত্তি প্রস্তুত হয়। দোচালা রীতি স্বভাবতই পশ্চিমবঙ্গের গ্রামের মাটির বাড়ি ও মাথায় ঢালু হয়ে নিচের দিকে নেমে আসা খড়ের ছাউনিকে মনে পড়িয়ে দেয়। দোচালা মন্দিরকে একবাংলা রীতির মন্দিরও বলা যায়।৫ সেই হিসেবেই পাশাপাশি দুটি দোচালা মন্দিরই হল জোড়-বাংলা। পশ্চিমবঙ্গের কোনো কোনো মন্দির শুধুমাত্রই দোচালা বা জোড়-বাংলা রীতিতে গঠিত। কিন্তু বালি-দেওয়ানগঞ্জের এই মন্দিরটিকে স্বতন্ত্র করে তুলেছে এই জোড়-বাংলা রীতির মন্দিরের ওপরের নবরত্ন স্থাপত্যটি। দুটি দোচালার মাঝের অংশ দিয়ে উঠে গেছে এই নবরত্ন স্থাপত্য। এর জন্য জোড়-বাংলার ওপরে আরো দুটি তল নির্মাণ করতে হয়েছে। জোড়-বাংলা অংশের ঠিক ওপরে রয়েছে ত্রিখিলান যুক্ত একটি অংশ, যার চারদিকে রয়েছে চারটি রত্ন। এরও ওপরে রয়েছে আরো একটি ত্রিখিলান-যুক্ত তল, সেখানেও চারদিকে রয়েছে চারটি অপেক্ষাকৃত ছোটো রত্ন। আর এই অংশটির মাথার ওপর দিয়ে উঠে গেছে নবম রত্নটি, যেটি আকারে সব থেকে বড়ো। প্রতি তলের ছাদগুলি ঢালু। ত্রিখিলান-যুক্ত প্রবেশ পথের মধ্যে মাঝে সমান দূরত্বে দুটি পূর্ণ খিলান আর দুপাশে দুটি অর্ধ-খিলান দেখতে পাওয়া যায়। যেন মনে হয় তিনটি দরজা। জোড়-বাংলার ওপরে নবরত্ন মন্দির হিসেবে এই দুর্গা মন্দির আলাদা। তাছাড়া, এটির অনন্য হয়ে ওঠার অন্যতম কারণ, জোড়-বাংলা অংশের মন্দিরগাত্রের টেরাকোটা প্যানেল। অনেক গুলি ছোটো ছোটো প্যানেল ছাড়াও মন্দিরের ত্রিখিলান প্রবেশ পথের ওপরের জ্বলজ্বল করছে টেরাকোটার দুর্গাপ্যানেল, সঙ্গে লক্ষ্মী-সরস্বতী-গণেশ-কার্তিক। সম্ভবত এটিই পশ্চিমবঙ্গের মন্দিরগাত্রের সবথেকে বড়ো টেরাকোটার দুর্গা প্যানেল। এখানে দুর্গা ও তার চারটি পুত্রকন্যা একই সঙ্গে সন্নিবিষ্ট নন। প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা মন্দিরাকৃতির কারুকার্য খচিত বর্ডার তৈরি করা হয়েছে, যাকে বলা যেতে পারে স্টাকোর কাজ। প্রতিটি মূর্তির নির্মাণশৈলী ত্রিভঙ্গ স্টাইল বা নাচের মুদ্রার মতো, যা খুবই শিল্পসম্মত। চারটি মূর্তি যেন পাশাপাশি চারটি আলাদা মন্দিরের কারুকার্য খচিত বর্ডারের মধ্যে নৃত্যরত, দুর্গা মূর্তিটি অন্য মূর্তিগুলির থেকে একটু বড়ো। দুর্গা মূর্তি যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত, অন্য মূর্তিগুলি তুলনায় ভালো অবস্থায় রয়েছে। দুর্গা, গণেশ ও কার্তিকের বাহন থাকলেও লক্ষ্মী, সরস্বতীর বাহন নেই, লক্ষ্মীর হাতে পদ্ম দেখতে পাওয়া গেলেও সরস্বতীর বীণা মনে হয় এখন ক্ষতিগ্রস্ত, শুধু বীণা ধরার ভঙ্গিটি পরিলক্ষিত হয়। প্রতিটি মন্দির চূড়ার মাথায় একটি করে ছোটো লাল পতাকা উড়ছে। একদম ওপরের অংশে কয়েকটি পুরুষমূর্তি মন্দির গাত্রে চুন-সুড়কি দিয়ে খোদিত, যাকে অমিতাভ গুপ্ত বলছেন স্টাকোর কাজ, যেন তারা মন্দিরের রক্ষী, হাতে অস্ত্র নিয়ে পাহাড়া দিচ্ছে মন্দিরকে। জোড়-বাংলা অংশের মন্দিরের গায়ে ছোটো ছোটো অনেকগুলি টেরাকোটা প্যানেল রয়েছে। এই সব প্যানেলে দেব-দেবীর মূর্তির প্রাধান্যই বেশি, অল্প কিছু সাধারণ নর-নারীর মূর্তিও রয়েছে। তারাপদ সাঁতরা উল্লেখ করছেন এই প্যানেলের মধ্যে ভগীরথের গঙ্গা আনয়নের দৃশ্যর কথা। এছাড়া, শিব-পার্বতী, কালী, মৈথুনরত নরনারী, গঙ্গা, গণেশজননী, হুঁকো খাওয়ার দৃশ্য রয়েছে। হুঁকোসেবনের প্যানেলে অনেকেই শৈব প্রভাব খুঁজে পেতে পারেন। এছাড়াও একাধিক প্যানেল ক্ষতিগ্রস্ত। তবে দেবদেবী, নরনরী মূর্তির প্রাধান্যই বেশি। একটি প্যানেলে টুপি পরা এক সাহেবের সঙ্গে এক দেশিয় ব্যক্তিকে মুখোমুখি বসে থাকতে দেখা যায়। প্যানেলের বিষয়ের দিক থেকে এগুলিই জনপ্রিয় বলা যেতে পারে।

আরো একটি কারণে মন্দিরটি মনে রাখার মতো। সেটি হল ত্রিখিলান যুক্ত অংশের ঠিক ওপরে উল্লম্ব অবস্থানে থাকা তেকোনা বর্শা ফলক বা মৃত্যুলতা প্যানেল। এই মন্দিরে চারটি বর্শা ফলক বা মৃত্যুলতা প্যানেল আছে। যার মাঝের প্যানেলগুলিতে নরনারীর মূর্তি এবং ধারের দুটি প্যানেলে অশ্বপৃষ্ঠে সৈনিক বা জীবজন্তু বা নারীমূর্তি খোদিত রয়েছে। এই বর্শা ফলক সম্পর্কে জরুরি তথ্য দিয়েছেন তারাপদ সাঁতরা।৬ তাঁর মতে রত্নশৈলীর ধরনটির সঙ্গে রথের গঠন কৌশলের মিল আছে। রথ নির্মিত হত কাঠ দিয়ে। কাঠখোদাইয়ের ভাস্কর্যের ছাপ পড়েছে রত্ন রীতিতেও।

“কাঠের রথের প্রতি কোণে কোণে (সূত্রধর স্থপতিদের পরিভাষায় যা ‘বর্শা’ নামে খ্যাত) খাড়াভাবে উৎকীর্ণ করা তিনকোনা আকারের যে কৌণিক ভাস্কর্যটি দেখা যায়, সেটিতে রূপায়িত হত হাতি, ঘোড়া, বাঘ, সিংহ, হরিণ ও মোষ প্রভৃতি জন্তুজানোয়ারের মিছিলের উপর সন্নিবদ্ধ বর্শা হাতে কোনো অশ্বারোহী সৈন্য অথবা কোনো নর্তকী বা নারী প্রভৃতি খোদিত মূর্তি। রথের এই কৌণিক ভাস্কর্যের মতোই বিশেষ করে বাংলার রত্ন মন্দিরের অলংকরণ সজ্জা হিসাবে মন্দিরের চারকোণে এই ধরনের ‘বর্শা’ ভাস্কর্য প্রযুক্ত হয়েছে...।”৭

খেয়াল করার দুর্গা মন্দিরের জোড়-বাংলা অংশের চার কোনায় নয়, খিলানের ওপরের চারটি অংশে বর্ষা ফলক বা মৃত্যুলতা খোদিত রয়েছে। যেন মন্দিরে প্রবেশ ও প্রস্থানের সময় মোহমুক্তির দিক নির্দেশ করবে এই প্যানেলগুলি। হাতে বর্শা নিয়ে সৈন্যরা যুদ্ধরত, এজন্যই হয়ত নাম বর্শা ফলক। আবার যেন মৃত্যুকেই এই ফলকগুলি মনে করিয়ে দিচ্ছে, লতার মতো মন্দিরগাত্রে উল্লম্ব ভাবে সজ্জিত, তাই এর নাম মৃত্যুলতা, তাও হতে পারে।

দুর্গা মন্দিরের ঠিক পাশের রয়েছে সর্বমঙ্গলা মন্দির। একে স্থানীয়রা বিষ্ণুমন্দিরও বলে থাকেন। আবার David McCutchion-এর মতানুযায়ী এটি দামোদর মন্দির। কিন্তু আপাতত এটিকে সর্বমঙ্গলা মন্দির বলে উল্লেখ করা গেলেও, David McCutchion-এর আরো একটি উল্লেখ এখনকার দৃশ্যর সঙ্গে মেলে না। তাঁর মতে এটি পঞ্চরত্ন মন্দির। কিন্তু মাঝের রত্নটি ছাড়া এই মন্দিরের অন্য কোনো রত্ন অবশিষ্ট নেই, এমনকি মন্দিরগাত্রের টেরাকোটা কাজগুলিও নেই। তবে কোনো এক সময়ে এটি সে একটি সুসজ্জিত মন্দির ছিল, তার ছাপ এখনো রয়ে গেছে। এই মন্দির গুলির পেছনের অংশের রয়েছে মঙ্গলচণ্ডীর মন্দির। যেটি ত্রয়োদশ রত্ন বলে লোকমুখে কথিত, কিন্তু যার ভগ্নাবশেষটুকুই এখন অবশিষ্ট, এবং David McCutchion-ও এই ভগ্নাবশেষের উল্লেখই করেছেন। চারটি মন্দিরের মধ্যে এটিই সবথেকে ক্ষতিগ্রস্ত, যার ইঁটগুলিই শুধু এখন দেখা যায়, মন্দিরের দেওয়ালে। শুধু মাত্র একটি অর্ধভগ্ন রত্ন কোনোরকমে দাঁড়িয়ে আছে। খুব সামান্য ভাস্কর্যই দেখতে পাওয়া যায় মন্দিরের ওপরের ও নিচের দিকের অল্প অংশে। মঙ্গলচণ্ডী মন্দিরের ঠিক উল্টোদিকে রয়েছে দামোদর মন্দির। এর গঠনে উনিশ শতকীয় মেদিনীপুরের চালা রীতির ধরন দেখতে পাওয়া যায়। David McCutchion এই মন্দিরটিকে আটচালা ধরনের মন্দির বলেছেন, যার রীতি মেদিনীপুরের আটচালার মতো। তিনি আটচালা মন্দিররে দুটি আলাদা শৈলী লক্ষ করেছিলেন, যেটি হুগলি, হাওড়া ও দুই চব্বিশ পরগণায় দেখতে পাওয়া যায় যেটি তাঁর মতে আঠারো শতকের হুগলি-বর্ধমান রীতির অন্তর্গত আটচালা, অন্যটি উনিশ শতকের মেদিনীপুরের ধরন। এক্ষেত্রে চারচালা মন্দিরের মতো ‘রথপগ’ বিন্যাসটি আটচালা মন্দিরের ক্ষেত্রেও পরিলক্ষিত হয়। এই ‘রথপগ’ বিন্যাসের আটচালা রীতিকেই McCutchion উনিশ শকের মেদিনীপুরের রীতি বলতে চেয়েছিলেন। বালি-দেওয়ানগঞ্জের এই দামোদর মন্দিরটির সামনের অংশে একটি টিনের ছাউনি অনেক পরে লাগানো হলেও, এর বেশ কিছু টেরাকোটা প্যানেল এখনও বেশ অক্ষত অবস্থায় রয়েছে। মন্দিরের ওপরের অংশের কারুকার্যও অনেকটাই দেখতে পাওয়া যায়। প্যানেলগুলির মধ্যে অনেকগুলিতেই বিষ্ণুর দশাবতারকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব। তারাপদ সাঁতরা এই মন্দিরের ষষ্ঠীদেবীর মূর্তির প্রতি আলাদা করে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।৮ কারণ তাঁর মতে পৌরাণিক দেবদেবীর প্রাধান্য থাকলেও লৌকিক দেবদেবীকেও শিল্পী পুরোপুরি অগ্রাহ্য করতে পারেননি।

নিঃসন্দেহে মন্দিরগুলি ধ্বংসপ্রাপ্ত, এবং তার রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজন। পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের একটি সাইনবোর্ড মন্দির সংলগ্ন অংশে দেখতে পাওয়া গেলেও, প্রশ্ন থেকেই যায় সংরক্ষণ নিয়ে। এই লেখাটি ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসের। পরবর্তী পাঁচ বছরে মন্দিরের কিছু সংরক্ষণ হয়েছে বটে। তবে তাকে ইতিবাচক অর্থে গ্রহণ করা যাবে কিনা সন্দেহ আছে। কারণ, ইউ টিউবের বিভিন্ন ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে বর্তমানে মন্দিরটি রঙ করা হয়েছে এবং কিছু অংশ সারানো হয়েছে। সমস্যা হল, এ ধরনের মন্দির সারানোর জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। কিন্তু ভিডিওগুলি দেখে মনে হচ্ছে সারানো হলেও দুর্গামন্দিরের ওপরের নবরত্ন অংশটির সূক্ষ্ম কারুকার্য আর দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না বা নতুন করা রঙের আড়ালে তার বেশ কিছুটা অদৃশ্য। এমনভাবেই রঙ করা হয়েছে যে, অপরের নবরত্ন অংশটির সঙ্গে নিচের জোড়-বাংলা অংশের রঙের সাদৃশ্য নেই, বেশ একটু বেমানান লাগছে। অনেক পর্যটকেরই মনে হতে পারে, আশেপাশের মানুষজনের আনাগোনা মন্দিরটির ক্ষতি করছে, হয়ত কিছুটা সত্যিই। কারণ মন্দিরের সামনের অংশ ও সামনের প্রাচীর স্থানীয়দের অবাধ ব্যবহার্য, তা ওপরের তোলা ছবি থেকেই পরিস্কার। তবে এখন সামনের অংশ রেলিং দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছে, তাতে কতটা উন্নতি হয়েছে তা জানা যায় না। তাছাড়া মন্দিরের দেখভাল যে স্থানীয় মানুষেরাই করেন, এ বিষয়ে সংশয় নেই। মন্দিরের পুজোর আয়োজনও তাঁরাই করেন। মন্দিরগুলির ভেতরের দেবদেবীর মূর্তি দেখার সৌভাগ্য হয়নি ২০১৯-এ, বাইরের কারুকার্য দেখেই মন ভরাতে হয়েছিল, তা এতই দৃষ্টি আকর্ষণকারী ছিল। তাছাড়া, মন্দিরগুলি বিখ্যাতই হয়েছে মন্দিরের বহির্ভাগের কারুকার্যের জন্য।

বালি-দেওয়ানগঞ্জ নামটি অনেকের কাছেই পরিচিত নয়। রাস্তা খুঁজে রাউতপাড়ার মন্দির পর্যন্ত পৌঁছতে ২০১৯-এ বেশ অসুবিধেই হয়েছিল। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মন্দির নিয়ে যাঁরা কাজ করেছেন, তাঁদের লেখায় এই অঞ্চল এবং দুর্গা মন্দিরের কথা একাধিকবার উঠে এসেছে, এবং খুবই পরিচিত নাম। কারণ এত অনন্য স্থাপত্য ও ভাস্কর্য। তাছাড়া কামারপুকুর থেকে খুব বেশি দূরে অবস্থিত না হওয়ার কারণে এবং রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সেবামূলক কাজের জন্য জায়গাটির পরিচিতি ক্রমশ বাড়ছে। মন্দির সংরক্ষণের দিকটিতে আরো একটু মনোযোগ দেওয়া গেলে হয়ত জায়গাটি আরো সমৃদ্ধ হয়ে উঠতে পারে। শ্রীরামকৃষ্ণ যখন উনিশ শতকের শেষভাগে বালি-দেওয়ানগঞ্জে এসেছিলেন, মন্দিরগুলির অস্তিত্বও তখনও ছিল হয়ত, অন্তত গবেষকদের হিসেব তাই বলছে। মন্দির সংলগ্ন অংশ থেকে দ্বারকেশ্বর নদী খুব দূরে নয়। সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সময়ের লাল আভা, নদীর ধারের লাল মাটি, দ্বারকেশ্বরের জল ও চারপাশকে যখন রাঙিয়ে দেয়, তেমনই সূর্যরশ্মি রাঙিয়ে দিয়ে যায় মন্দির চত্বর। ঠিক সেই মুহূর্তগুলিতে পশ্চিমবঙ্গের সম্ভবত সবথেকে বড়ো দুর্গা প্যানেলের ওপরের উড়ন্ত লাল পতাকা তাতে যে আরো একটু রঙ যোগ করে তাতে কোনো সন্দেহই নেই।



তথ্যসূত্র:

১. McCutchion, J, David, Late Mediaeval Temples of Bengal: Origin and Classification, The Asiatic Society, Kolkata, 1972, Page – 28-29
২. Ibid, Page – 47
৩. Ibid, Page – 36
৪. Ibid, Page – 55
৫. সাঁতরা, তারাপদ, পশ্চিমবাংলার ধর্মীয় স্থাপত্য মন্দির ও মসজিদ, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, কলকাতা, জানুয়ারি ২০১৮, পৃষ্ঠা – ১৭
৬. ঐ, পৃষ্ঠা – ২৬
৭. ঐ, পৃষ্ঠা – ২৬
৮. ঐ, পৃষ্ঠা - ৬০

সহায়ক গ্রন্থ:

১. সান্যাল, হিতেশরঞ্জন, বাংলার মন্দির, কারিগর, কলকাতা, জানুয়ারি ২০২৩
২. সাঁতরা, তারাপদ, পশ্চিমবাংলার ধর্মীয় স্থাপত্য মন্দির ও মসজিদ, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, কলকাতা, জানুয়ারি ২০১৮
৩. সাঁতরা, তারাপদ, কলকাতার মন্দির-মসজিদ: স্থাপত্য-অলংকরণ-রূপান্তর, আনন্দ, কলকাতা, নভেম্বর ২০১৬
৪. রায়, প্রণব, বাংলার মন্দির: স্থাপত্য ও ভাস্কর্য, পূর্বাদ্রী প্রকাশনী, তমলুক, জানুয়ারী, ১৯৯৯
৫. McCutchion, J, David, Late Mediaeval Temples of Bengal: Origin and Classification, The Asiatic Society, Kolkata, 1972
৬. Michell, George (Edited), Brick Temples of Bengal: From the Archives of David McCutchion, Princeton University Press, Princeton, December 1983
৭. Companions and Followers of Sri Ramakrishna, Advaita Ashram, Uttarakhand, March 2021

সহায়ক ওয়েবলিঙ্ক:

১. Bali Dewanganj, Holy Trio Footprints.com, A Virtual Pilgrimage
২. Datta Rangan, Bali Dewanganj: Terracotta at its Best, Wordpress.com
Date: 2.1.2022
৩. Gupta, Amitabha, The Most Unique Brick Temple of Bengal, Wordpress.com
Date: 2.1.2022
৪. Bansidhar Modak and Giribala – Biographies, biographies.rkmm.org
Date: 22.09.2024

0 comments:

0

প্রবন্ধ - মনোজিৎকুমার দাস

Posted in

সমরেশ মজুমদার লৌকিক প্রয়াণে তাঁর গল্প-উপন্যাসের বোদ্ধা পাঠকরা দুঃখে ম্রিয়মাণ হবে এটাই স্বাভাবিক। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শাখা গল্প-উপন্যাসে ও সাহিত্যের বিভিন্ন শাখা যেমন — ভ্রমণকাহিনি, গোয়েন্দাকাহিনি, কিশোর উপন্যাসের মতো শাখাগুলোতেও রয়েছে তাঁর উজ্জ্বল স্বাক্ষর। বাংলা সাহিত্যে তিনি যে ঋদ্ধতার স্বাক্ষর রেখে গেছেন তা কিন্তু বাঙালি সাহিত্য প্রেমিক বোদ্ধা পাঠকের মন থেকে মুছে যাবে না কোন দিনই।

বহুমাত্রিক বর্ণিল প্রতিভার অধিকারী লেখক হিসেবে সমরেশ মজুমদার তাঁর প্রত্যেকটি লেখার বিষয় ভিন্ন, রচনার গতি এবং গল্প বলার ভঙ্গি ও প্রেক্ষাপটের নান্দনিকতা পাঠকদের আন্দলিত করে।

বাংলা কথাসাহিত্যের পাঠকদের সমরেশ মজুমদার তাঁর লেখনির বর্ণিল প্রতিভা দ্বারা প্রবলভাবে টানে।

সমরেশ মজুমদারের দীর্ঘ সাহিত্য কর্মকান্ডের শুরু যে উপন্যাসটি দিয়ে সেটির নামটি দৌড়। উপন্যাসের উৎসর্গে লিখেছিলেন — ‘দৌড় আমার প্রথম উপন্যাস, প্রথম প্রেমে পড়ার মতো’। এ উপন্যাসের শেষটাও মনে রাখার মতো: ‘মেয়েদের চোখের দৃষ্টি মাঝে মাঝে এক হয়ে যায় কি করে! মায়ের, নীরার অথবা এখন এই জিনার? যে চোখ শুধুই বলে — ভালো থেকো, ভালো থেকো, ভালো-ঈশ্বর, তবে কেন বুক জ্বলে যায়!’

তিনি তাঁর উপন্যাস ‘দৌড়’ লেখার পর থেকে আর থামেননি। একের পর এক লিখেই চললেন, যা সে সময়ের জনমানসের বিশেষ করে তরুণ সমাজের অস্থিরতার বাস্তব চিত্র।

বাংলা সাহিত্যে তাঁর অমর ট্রিলজি ‘উত্তরাধিকার’, ‘কালবেলা’, ‘কালপুরুষ’ তাঁর অমর সৃষ্টি। অবশ্য এর সঙ্গে ‘মৌষলপর্ব’ যুক্ত করে চতুর্ভুজ হিসেবে আখ্যা দেন অনেকেই।

সাতকাহন, গর্ভধারিণী, অগ্নিরথ, সিংহবাহিনী, এত রক্ত কেন, কলিকাতায় নবকুমার, তেরো পার্বণ, স্বপ্নের বাজার, উজান, গঙ্গা, বুনোহাঁস, ভিক্টোরিয়ার বাগান, আট কুঠুরি নয় দরজা ইত্যাদি তাঁর লেখা সমসাময়িক কালের ঘটনা প্রবাহের উজ্জ্বল সৃষ্টি।

নকশাল আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে লেখা উপন্যাস “কালবেলা”। এর স্রষ্টা হিসেবেই তিনি পাঠকের কাছে অধিক প্রিয়। কালবেলার অমর দুই চরিত্র অনিমেষ ও মাধবীলতা। সমরেশ এই উপন্যাসে দুটি চরিত্র সৃজন করেছেন অভিজ্ঞতার আলোকে। নির্দ্বিধায় বলা যায়, তার লেখা কালবেলা উপন্যাস তার মাস্টারপিস।

কালবেলা গত শতাব্দীর আটের দশকের শুরুতে প্রথমে কলকাতার একটা সাপ্তাহিক পত্রিকায় ধারাবাহিক হিসেবে প্রকাশিত হয়। এই প্রকাশনাকালে তার জনপ্রিয়তার আঁচ টের পাওয়া যায়। সেটা প্রবল তাপ ও চাপ নিয়ে আবির্ভূত হয় যখন বই আকারে প্রকাশিত হয়। কালবেলার যে ত্রিভুজ কিংবা চতুর্ভুজ সেখানে মার্কসবাদী চেতনা মুখ্য হয়ে উঠেছে। পুরো ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গ বিশেষ করে উত্তরবঙ্গের সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির চালচিত্র হাজির রয়েছে। তখন পশ্চিমবঙ্গের ভোটের রাজনীতিতে সবেমাত্র কংগ্রেসকে হটিয়ে সিপিআই (এম) ক্ষমতাসীন হয়েছে। মার্কসবাদ, সমাজতন্ত্র সবই তখন তরুণদের মধ্যে ভীষণভাবে জাগরুক। সমরেশ এই সময়ের কথা বলছেন না ঠিকই। বলছেন আরও একদশক কিংবা তারও আগের কথা। কিন্তু সেসবকে তরুণরা এবং ওই সময়ের অন্যান্য বয়সীরাও দারুণভাবে যুক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন।

সমরেশ মজুমদার এর কালবেলা উপন্যাসের প্রধান চরিত্র অনিমেষ ও মাধবীলতা। অনিমেষ ও মাধবীলতা কে ঘিরে এই উপন্যাসটি আবর্তিত।

কালবেলা’র এইসব সুযোগ তাকে আপনার ক্ষেত্রটাকে বিকশিত হয়ে ওঠার সুবিধা দেয়। এ বাংলা, ও বাংলা দুই জায়গাতেই অনিমেষ ও মাধবীলতার ভেতর দিয়ে তরুণরা তো বটেই অন্যবয়সীরাও যেন আদর্শিক একটা জায়গা খুঁজে পায়। প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির ঘেরাটোপের বাইরে গিয়ে এই আদর্শ তাদের কাছে গুরুত্বও পায়। যে কারণে কালবেলা’র চরিত্রদ্বয় ফিকশন বা কল্প জগতের মানুষ হয়েও বাস্তবের মানুষের উপর প্রভাবিত করে।

পাঠকপ্রিয়তার তুঙ্গস্পর্শী এক উপন্যাস। রাজনীতিতে অনিমেষের কঠিনভাবে জড়িয়ে পড়া, আদর্শের সঙ্গে বাস্তবতার বিপুল ফারাক উপলব্ধিজনিত হতাশা এবং তারপর তার জীবনের এক উজ্জ্বল উদ্ধার, যার নাম মাধবীলতা। মাধবীলতা যেন তার জীবনের ধ্রুবতারা; ঝড়, ঝঞ্ঝা, সমস্ত প্রতিকুলতার মধ্যে যে অনিমেষকে স্থিতধী করে রাখে। কালবেলা আমাদের জানায়, বিপ্লব ও প্রেম পরস্পরবিরোধী হতেই হবে এমন কথা নেই, পরম বিশ্বাসে একে অন্যের হাতে হাত ধরেও তারা চলতে পারে। কালবেলার পাঠকরা কি কখনও ভুলতে পারবেন সেই উক্তি: বিপ্লবের আরেক নাম মাধবীলতা!

তাঁর লেখা পড়ে মনে হয়, মার্কস, লেনিন, মাওয়ের আদর্শে অনুপ্রাণিত নকশালিস্টদের সে সময়ের কর্মকান্ডকে কাছ থেকে দেখে অভিজ্ঞতার আলোকেই রচনা করেন কালবেলা। শুধু এতটুকু জানা আছে যারা অনিমেষ এবং মাধবীলতা হয়ে উঠতে চেয়েছিল, হয়েওছিলেন তারা শেষাবধি কিন্তু সেটাকে কনটিনিউ করলেন না, ব্যতিক্রম আছে কি না জানা নেই। অনিমেষ-মাধবীলতারা শেষাবধি কেন অনিমেষ, মাধবীলতা থাকেননি, তার কারণ জীবনের দৌড় সেটাকে সমর্থন করে না। সমরেশ মজুমদাররা জীবনের রেখায় কালবেলার পরিভ্রমণকে সমাপ্তি দেন না। বাস্তবের সঙ্গে কল্পনার-উপন্যাসের ফারাক যেন জীবনের গদ্যকেই প্রস্ফুটিত করে।

সমরেশ মজুমদার যে শুধু বাংলা সাহিত্যের প্রতি অনুরাগী ছিলেন তা নয়, সাহিত্যিক জীবনের শুরু থেকেই মঞ্চ নাটক ও গ্রুপ থিয়েটারের প্রতি সমরেশ মজুমদারের ঝোঁক ছিল প্রবল। তাঁর প্রথম গল্প ‘অন্যমাত্রা’ লেখা হয়েছিল মঞ্চনাটক হিসেবে এবং এই গল্পটি ১৯৬৭ সালে ‘দেশ’ পত্রিকায় গল্প হিসেবে ছাপা হয় আর সেখান থেকেই শুরু হয় তাঁর লেখকজীবনের জয়যাত্রা। পাঠকের সামনে উপন্যাসিক হিসেবে এই অসামান্য প্রতিভার আবির্ভাব ১৯৭৫ সালে, সে বছরেই সমরেশ মজুমদারের প্রথম উপন্যাস ‘দৌড়’ ছাপা হয়েছিল ‘দেশ’ পত্রিকাতেই।

সমরেশ মজুমদারের লেখায় সাবলীলতা, স্পষ্ট ঘটনার বিস্তার ও নিপুণ পরিমিতিবোধ তাঁকে আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্যে খ্যাতি এনে দিয়েছে। জন্মসূত্রে তিনি উত্তরবঙ্গের লোক। কিন্তু তাঁর লেখার সঙ্গে একটা আত্মীয়তা অনুভব করে পূর্ববাংলা তথা অধুনা বাংলাদেশের মানুষ। তাঁর রচিত এমন বহু সাহিত্য রয়েছে যার মাধ্যমে সরাসরি পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের প্রক্ষাপট এসেছে একান্নবর্তী পরিবারের মতো। তাই একজন সমরেশ মজুমদার পশ্চিমবঙ্গ নাকি বাংলাদেশে বেশি জনপ্রিয়? —এমন প্রশ্নের উত্তর খোঁজা যে কারও পক্ষে কঠিন কাজ হয়ে দাঁড়াবে। তবে জীবনের শেষ পর্বে এসে তিনি যত সৃষ্টি রচনা করেছেন তার মধ্যে কী উপন্যাস কী ছোটগল্প, তিনি ফিরে গেছেন তাঁর নিজের জন্মভূমিতে, উত্তরবঙ্গে। সমরেশ মজুমদার তাঁর জীবনের শেষ সময়ের রচনাগুলোতে উত্তরবঙ্গের প্রক্ষাপট ফুটে উঠেছে প্রাণবন্ত হয়ে।

উত্তরাধিকার, কালবেলা, কালপুরুষ — এই ত্রয়ী উপন্যাসের ওপরই বোধ করি দাঁড়িয়ে আছে সমরেশ মজুমদারের পাঠকপ্রিয়তার সৌধ। অনিমেষ আর মাধবীলতা, সমরেশের পাঠকের কাছেই প্রিয় দুটো নাম। অনিমেষ নামে এক মফস্বলী তরুণের উচ্চশিক্ষার জন্য কলকাতায় পা রাখা, রাজনীতির অগ্নিগর্ভ পরিবেশের সঙ্গে পরিচিত — সেই সঙ্গে আত্ম-অনুসন্ধানের গল্প উত্তরাধিকার। বাস্তবতা সম্বন্ধে ধারণাহীন সহজসরল এক তরুণের উপলব্ধির উন্মেষকালের গল্প উত্তরাধিকার। তারপর কালবেলা।

সমরেশ মজুমদার তার কালবেলা উপন্যাসের অনিমেষ ও মাধবীলতা এই দুটি চরিত্র যুব মানসের উপর ভর করে।

বাংলা সাহিত্যে আর কোন উপন্যাসের চরিত্র এভাবে পাঠককে উপর ভর করতে পারিনি। আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলতেও পারেননি। এই ক্ষমতাকে ব্যবহার করতে পেরেছিলেন সমরেশ মজুমদার। তখন যারা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন, তাদের একটা বড়ো অংশ অনিমেষ ও মাধবীলতার মায়ায় নিজেকে বেঁধে আনন্দিত হয়েছেন। প্রত্যেকের ছদ্মনাম হয়ে উঠেছে ওই দুই নাম। যারা ডয়েরি লিখছেন সেখানে নিজেদেরকে ওই নামে প্রকাশ করছেন। প্রেমিক প্রেমিকা আড়ালে আবডালে নিজেদেরকে সম্বোধিত করছেন অনিমেষ ও মাধবীলতারূপে।

সমরেশ মজুমদারের শৈশব কেটেছে ডুয়ার্সের গয়েরকাটা চা বাগানে, সেখানেই শিক্ষাজীবনের শুরু, এরপর কলকাতায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জীবনের সমাপ্তি টেনে সেখানেই জীবিকার তাগিদে স্থায়ী হয়েছিলেন। তাই চা বাগানের মদেসিয়া সমাজ থেকে কলকাতার নিম্নবিত্ত মানুষেরা বারবার তাঁর কলমে উঠে এসেছেন বাস্তবতার রক্তমাংস নিয়ে।

সমরেশ মজুমদার উত্তরবঙ্গের সন্তান হাওয়ায় নকশালবাড়ি আন্দোলনে অবলোকন করেছিলেন। সেই আলোকেই তিনি সে সময়ের নকশাল বাড়ি আন্দোলনের প্রেক্ষাপট, বিস্তৃতি ও পরিণতিকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল বলে মনে হয়। আর সেই আলোকেই তিনি আমার সৃষ্টি কালবেলা উপন্যাস রচনা করেন এবং এই উপন্যাসের অনিমেষ ও মাধবীলতাকে তুলে ধরেছেন অভিজ্ঞতা আর কল্পনার মিশেলে। সেই অস্থির সময়ের বাস্তব চিত্র তার কালবেলা উপন্যাসে বাস্তবতার নিরিখে উপস্থাপিত হয়েছে।

বহুমাত্রিক বর্ণিল প্রতিভার অধিকারী লেখক হিসেবে সমরেশ মজুমদার তাঁর লেখনি শুধুমাত্র গল্প বা উপন্যাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি; এ কথার আভাস আগেই দেওয়া হয়েছে।

সাহিত্যে আলোচনা, খ্যাতি, সমালোচনা এসব থাকবেই। কিন্তু একজন দৃঢ় মনস্ক সাহিত্য হওয়ার জন্য যে স্পৃহা দরকার জীবনজুড়ে, তার পুরোটাই দেখিয়ে গেছেন সমরেশ মজুমদার। তাই তিনি একজন সমরেশ মজুমদার হয়েই বেঁচে থাকবেন পাঠকের হৃদয়ে। যারা নিয়মিত বর্তমান সময়ের বাংলা সাহিত্য পড়েন, গবেষণা করেন বা অন্ততপক্ষে খোঁজখবর রাখেন তাদের কাছে এ কথা নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই যে, সমরেশ মজুমদার বাংলা কথাসাহিত্যের এক উজ্জ্বল প্রতীক, এক দীপ্তিমান নক্ষত্র। পাঠকপ্রিয়তার তুঙ্গস্পর্শী তাঁর লেখা গল্প উপন্যাস ও অন্যান্য লেখায়। বাংলা সাহিত্যঙ্গনে চিরকালের জন্য অমর হয়ে থাকবেন।

0 comments:

2

ধারাবাহিক - শৌনক দত্ত

Posted in








সিলভিয়া প্লাথের কবিতা ও আত্মসন্ধান




সুপরিচিতা
সুস্মি,

তোমার ডাকে শান্তিনিকেতন যাওয়া হয়নি। তোমার কাছে অজুহাত মনে হতেই পারে। তবে সত্যিই আমি অসুস্থ ছিলাম। তোমাকে যখন লিখছি বাইরে তখন কালবৈশাখী। খানিক আগেও আকাশ ঝলমল করছিল। চোখের পলকে সকালের আলো নিভে গিয়ে সন্ধ্যার মতন অন্ধকার। জীবন তো এমনই তাই না? তোমার চিঠি পড়তে পড়তে সিলভিয়া প্লাথের ডেথ এন্ড কোং কবিতার কয়েকটা লাইন বহুদিন পরে মনে পড়ে গেলো। Two, of course there are two. It seems perfectly natural now — The one who never looks up, whose eyes are lidded And balled, like Blake’s, Who exhibits…

কতটা রিলেট করতে পারছো জানিনা। তবে কলেজ থেকে ফেরার পথে পাদ্রী সাহেবের গির্জার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দিনগুলোর কথা মনে পড়ছে খুব। বিশ্বাস করবে কিনা জানিনা এইটুকু লিখতেই জীবনবাবুর কবিতা মনে পড়ল- চোখের পাতার মতো নেমে চুপি কোথায় চিলের ডানা থামে- সোনালি সোনালি চিল- শিশির শিকার করে নিয়ে গেছে তারে- কুড়ি বছর পরে সেই কুয়াশায় পাই যদি হঠাৎ তোমারে ! আমাদেরও দেখা হয়না কুড়ি বছর হলো। আবার অবাক করা কান্ড দেখো যে দুজনের কবিতা মনে হলো দুজনই যেন মিলেমিশে একজন। যাপনে, ভাবনায় এবং মরনেও! যদিও আমি জীবনানন্দ কে এগিয়ে রাখবো। তবুও অস্বীকার করার জায়গা নেই বিশ্বসাহিত্যে নারী কবি হিসেবে যারা সুপরিচিত তাঁদের মধ্যে মার্কিন কবি সিলভিয়া প্লাথ (১৯৩২-১৯৬৩) অন্যতম। অথচ দেখো এই অমর কবি জীবনের কাছে প্রতারিত হয়েছেন, জীবন তাঁকে ক্রমাগত এক বিষণ্ণ, বেদনার্ত পরিণতির দিকে ঠেলে দিয়েছে। জীবনের করুণ জাতাকলে নিষ্পেষিত হয়েছেন। বেঁচে থাকার একঘেয়েমি কিংবা বেঁচে থাকার লড়াই তাঁকে ক্লান্ত করেছে। জীবন-মৃত্যুর দোলাচল তাঁর কবিতা আর জীবনকে ঘিরে থাকে তার মীমাংসা আমরা করতে পারি না। কেবলই পার্থিব জঞ্জাল আর বেদনাই তাঁকে অপার্থিব জগতে আকৃষ্ট করে।

জীবনানন্দকে গভীর মনোযোগ সহ নিরীক্ষণ করলেও দেখবো , কবির কাব্যশরীরে অন্ধকার প্রসঙ্গ এবং মৃত্যুচেতনার বারবাড়ন্ত যেন একটু গভীর নিকষ কালোর মত লেপ্টে রয়েছে। সিলভিয়া প্লাথের মৃত্যু চেতনা ঠিক জীবনানন্দ দাশের মৃত্যু চেতনার মতো নয়। মৃত্যুকে জীবনানন্দ প্রেয়সী হিসাবে দেখতে চেয়েছেন প্লাথের ক্ষেত্রে মৃত্যু সর্বরোগহরা ওষুধমাত্র। সিলভিয়া শুধু জীবনাচরণে নন, বরং লেখার মেজাজে অনেকটাই কাছাকাছি থাকেন। এক অন্ধকার জগতে তাঁর কবিতার বসবাস। তবে তাঁর আঁধার জগৎ এডগার অ্যালান পোর অন্ধকার জগৎ নয়। রহস্য, রোমাঞ্চ নয়, বরং তার অন্ধকারের আড়ালে আছে ব্যথা ও বিদ্রোহের সুর। তাঁর কবিতার স্বরে নারী যন্ত্রণা, বেদনা ও মুক্তির গান খুঁজে পাওয়া যায়। অথচ সিলভিয়া বিশ্ব কবিতায় এমন এক শক্তিশালী কণ্ঠস্বর, যাঁর শক্তির উৎস নারীর অহম, বেদনা, গর্ব ও গর্ভ।

সিলভিয়া নিজের নারী এবং কবিসত্তার ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। মাকে লেখা এক চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, ‘আমি হব পৃথিবীর কতিপয় নারী কবিদের অন্তর্গত এমন একজন সম্পূর্ণত আনন্দিত নারী, কোনো তিক্ত, হতাশ, বিকৃত পুরুষ-অনুকারক নয়, যে অনুকরণ অবশেষে নারী কবিদের সর্বনাশের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আমি নারী এবং নারীজন্মে আনন্দিত। আমি গান গাইব পৃথিবীর উর্বরতার, ক্ষয়-শোক-মৃত্যুর মধ্যে মানুষের উর্বরতার গান। আমি গায়িকা হব। টেড আর আমার সুন্দর মিলিত জীবন হবে’ (উদ্ধৃতি: ভাবনার ভাস্কর্য, কেতকী কুশারী ডাইসন)।

সিলভিয়া উচ্ছল-উদ্যম জীবনযাপন করলেও তাঁর নিজের কাছেই নিজের জীবনটা খুব অদ্ভূত মনে হতো। ১৯৫২ সালে যখন স্মিথ কলেজে সদ্য ভর্তি হলেন তখন নিজের প্রতিই সিলভিয়ার প্রশ্ন ছিল—‘You walked in, laughing, tears welling confused, mingling in your throat. How can you be so many women to so many people, oh you strange girl?’ প্রথাগত কবিতার বাইরে গিয়ে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও অভ্যন্তরীণ অনুভূতির সমন্বয়ে স্বীকারোক্তিমূলক কবিতায় নতুন একটা আবেগ উগরে দেন প্লাথ। এটা কবির মানসিক অবস্থানও বলা যায়। সিলভিয়া প্লাথের স্বীকারোক্তিমূলক কবিতায় (Confessional Poetry) অবলীলায় বলে দিয়েছেন অনেক গোপনীয় বিষয়। তাঁর স্বীকারোক্তিমূলক কবিতা সংখ্যাগত দিক থেকে অনেক বেশি। এবং ভাষা ও চিত্রনির্মাণ অনেক শক্তিশালী ও উন্নত। এখানে তিনি নির্ভীকভাবে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, আবেগ, সংগ্রাম প্রকাশ করেছেন। এসব কবিতার সফল অগ্রদূত বলা যায় তাঁকে। তাঁর আগে বিচ্ছিন্নভাবে অনেকে স্বীকারোক্তিমূলক কবিতা লিখে থাকলেও ধারাবাহিকভাবে অনেক শৈলীগত দিক, বক্তব্য-পষ্টীকরণ ও শক্তিশালীকরণ ইত্যাদি দিক থেকে সিলভিয়া প্লাথ আলোচনার মূলকেন্দ্র। তিনি নারী হওয়ায় ও বাস্তব অভিজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ (বাস্তবতা আরও বেশি ও ঝাঁজালো) করে বিশ্বের নারীবাদীদের ভরকেন্দ্রে রয়েছেন। বলে রাখি কনফেশনাল পোয়েট্রি মুভমেন্ট আমেরিকায় ১৯৫০ দশকের মাঝামাঝি শুরু হয়। রবার্ট লয়্যাল, সিলভিয়া প্লাথ, অ্যানি সেক্সটন এ-আন্দোলনের প্রবক্তা। টি. এস এলিয়ট, ডব্লিউ. বি ইয়েটস প্রমুখ এ-আন্দোলনে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। এরা সবাই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা কবিতায় প্রকাশ (কিছুক্ষেত্রে রাখঢাক না করেই) করেছেন। আজকের ‘মি টু’ ইত্যাদি আন্দোলন অনেকটা এ ধারাবাহিকতার নতুন সংস্করণ।
মাত্র ৩০ বছরের জীবন তাঁর। ব্রিটিশ কবি টেড হিউজ তাঁর স্বামী ছিলেন। কিন্তু পরিবার ও সমাজের পাশাপাশি স্বামীর সংসারে সুখে ছিলেন বলা যায় না! ফলে সহজেই কবিতা ও লেখায় নারীর অবজ্ঞা, অবহেলা, নেতিবাচক-ধারণা ইত্যাদি বাস্তবজীবনের সঙ্গে মিশিয়ে নারীদের স্কেচ সৃষ্টি করতে পেরেছেন। Daddz, Ladz Layarus, Ariel, The Applicant, Kindness, The Arrival of the Bee Box ইত্যাদি কবিতায় নারীর অন্তর্নিহিত শক্তি, বিবাহপরবর্তী নারীর নির্ভরশীলতা, নারীর স্বকীয়তা ও সৃষ্টিশীলতা, পুরুষের ওপর নারীর প্রতিশোধ, নারীর স্বাধীনতা সর্বোপরি নারীপ্রগতি ও নারী-উন্নয়নের চিত্র ফুটে উঠেছে। ছোট ছোট বাক্য, সরল শব্দ ব্যবহার করলেও সিলভিয়ার কবিতায় বহু প্রতীক, পুরাণের ব্যবহার আছে। অন্যদিকে ছোট ছোট শব্দ দিয়েই তিনি অনেক কিছু বলার চেষ্টা করেন, পুরো বাক্য বলেন না। ফলে প্রায়শই তাঁর কবিতা সহজপাঠ্য নয়। প্রায়শই তাঁর কবিতা বাড়তি মনোযোগ দাবি করে, ব্যাখ্যার অবকাশ রাখে। নারীবাদী কবিতা, নারীর প্রতি অবহেলা, নারী প্রগতি ও উন্নয়নের কবিতা সিলভিয়া প্লাথকে আলাদা ও সাফল্যমণ্ডিত করেছে। তাঁর কবিতায় নিজের মানসিক অবস্থা, মাতৃত্ব, পরিবার এবং বিভিন্ন সম্পর্ক সূক্ষ্মভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। তাঁর কবিতা অসামান্য এবং দক্ষতাপূর্ণে নান্দনিক ভাষা দিয়ে সৃষ্টি। কখনওবা তিনি বিভিন্ন প্রতীকীর আশ্রয় নিয়েছেন। তাঁর কবিতা পরিচিত বোধের চেনা পরিমণ্ডলকে বারবার আক্রমণ করেছে। চির অস্থিরতার চোরা স্রোত বয়ে চলে প্রতিটি শব্দ আঁকিবুঁকিতে। শ্লেষ্মা ছিটানো গলায় প্লাথ বলেন : And I wear the wry-faced pucker The sour lemon moon. প্লাথের Ariel কবিতা-সংকলন ব্যক্তিগত মানসিক-যন্ত্রণার বিষয়াদি জোরালোভাবে উঠে এসেছে। ১৯৬২ সালে ‘দ্য নিউ ইয়র্কারে’ প্রকাশিত প্লাথের টিউলিপস কবিতায় একটি হাসপাতালে টিউলিপের তোড়া গ্রহণকারী একজন মহিলাকে চিত্রিত করা হয়েছে। নার্সরা ‘উজ্জ্বল-সুচ’ দিয়ে মহিলাকে অসাড় করে। তিনি অ্যানেস্থেসিয়ায় আত্মহত্যা করেন। কবির কাছে সূর্যের চোখ এবং টিউলিপের চোখ যেন একই সমান্তরালে। যেন টিউলিপগুলি তাকে আঘাত করছে, তাকে দেখছে এবং তার অক্সিজেন চুষে নিচ্ছে। ''টিউলিপ''-এ শব্দের ক্ষমতায় কবিতা সত্যিই যেন দেওয়াল বেয়ে চলা সরীসৃপ। ফুলগুলোর জীবন্ত শ্বাসপ্রশ্বাস তার রোগী মনকে আরো অস্থির করে তোলে। কবিতাগুলির জীবন্ত ধুকপুক হাতের মুঠোয় ধরা যায়। টিউলিপের চোখ ফোটে লেখনীর ছোঁয়ায়। ভেসে ওঠে হাসপাতাল ঘর, শীতলতা, ওষুধের গন্ধ—কেবলমাত্র শব্দের গঠনে। খুব সহজেই শরীরের দখল ছেড়ে দেওয়ার মধ্যে এক গভীর প্রতিবাদ লুকিয়ে থাকে। অভিমান কিভাবে বিশ্বজনীনতা ছুঁতে পারে প্লাথ না পড়লে বোঝা যায় না। নিজেকে জগৎ স্রষ্টার সাথে তুলনা করার দাপট তিনি দেখিয়েছেন—

I shut my eyes and the world drops dead.

গতানুগতিকতার বেড়ি মনে ও পায়ে তিনি কখনোই পরতে চান নি। অসম্ভব তেজিয়াল এক প্রেমিক সত্তা সমাজের মুখোশ, কৃত্রিম মানব সম্পর্কের জাল ছিঁড়তে চায় বারংবার। তার যন্ত্রণা তৎকালীন সামাজিক, রাজনৈতিক পটভূমির সাথে হাত মিলিয়ে জন্মায়—

"The Times are Tidy : Unlucky the hero-born In this province of the stuck record Where the most watchful cooks go jobless"

প্লাথের মধ্যে এক অদ্ভুত প্রকৃতিপ্রেম খুঁজে পাওয়া যায়, যা ঠিক রোমান্টিক কবিদের মতো না হলেও কবির বুকের অসহায়ত্ব ও আশ্রয় পাবার গভীর আকুতি ধ্বনিত করে। 'The Moon and the Yew tree' এই সত্য তুলে ধরেছে। অনির্বচনীয় সন্তান স্নেহ মেলে ধরেছে Plath-এর মধ্যেকার এক মাকে :

"I want to fill it with color ducks,"

আয়নার আলোতে এগিয়ে আসে আরেক মায়ের প্রতিবিম্ব যার প্রতি একাধারে নির্ভরতা আরেক দিকে বিদ্বেষ, ঘৃণা লক্ষণীয়। Mirror—"I am important to her. She comes and goes,/ Each morning it is her face that replaces the darkness,/ In me she has drowned a young girl and in me old woman".

সিলভিয়া প্লাথ ভালো চিত্রকরও ছিলেন, ছবিতে রঙের ব্যবহার ছবিকে যেমন অনেক বেশি ধ্রুপদী করে তোলে তাঁর কবিতাতেও সেই রঙের ব্যবহার দেখতে পাই খুব নিপুণভাবে। ধারণা করা হয় ১৯৬৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারিতে লেখা ‘প্রান্তরেখা’ (Edge) কবিতাটিই সিলভিয়া প্লাথের লেখা সর্বশেষ কবিতা। আত্মহত্যার মাত্র ছয় দিন আগে লেখা এই কবিতাটি তার ‘সুইসাইড নোট’ বলা যায়। আত্মহত্যাপ্রবণ মানুষের মানসিকতার একটা উৎকৃষ্ট নমুনা এই কবিতা। এই কবিতায় সিলভিয়া নারীর অর্থহীন জীবনকে তুলে ধরেছেন। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পুরুষের ইচ্ছা ছাড়া নারী কিছুই করতে পারে না। আবার নারীর সব কাজকেই বিশেষত গৃহকর্মকে গুরুত্বহীন, অর্থহীন মনে করা হয়। প্লাথ তাই এমন এক মৃত নারীর কথা বলেছেন যার পূর্ণতা প্রাপ্তি হয় কেবল মৃত্যুতে। তাঁর ভাষায়, মৃত্যুতেই ‘নারীটি স্বার্থক পূর্ণতা পেয়েছে’। নারীর শরীর মৃত্যুর পর হেসে উঠেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, ‘প্রান্তরেখা’ সিলভিয়া প্লাথের সবচেয়ে তমসাচ্ছন্ন কবিতা (darkest poem)। এই কবিতার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক রঙের ব্যবহার। সাদা, লাল আর কালো এই তিনটি রং এখানে রবার্ট গ্রেভসের ‘সাদা দেবীগণ’ তত্ত্ব দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ব্যবহৃত হয়েছে। বিশ শতকের মাঝামাঝি পুরাণবিদ গ্রেভস রচনা করেন ‘দ্য হোয়াইট গডেস’। তিনি ইউরোপীয় মূর্তি পূজারিদের দেবীদের সম্পর্কে আলোচনা করে দেখান যে আসলে একজন দেবীই নানা নামে ও পরিচয়ে প্রতিষ্ঠিত ছিল। জন্মদান, জীবন ধারণ আর মৃত্যু আদতে একই নারী সত্তার কুমারীকাল, মাতৃত্বকাল এবং বৃদ্ধাকালের রূপান্তরিত চেহারা। এই তত্ত্ব মতে, সাদা হলো কুমারীর রং, লাল হলো মাতৃত্বের রং আর কালো হলো বয়োবৃদ্ধ কিংবা মৃত্যুর রং। সিলভিয়া এই প্রতীক দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েই তার শেষ কবিতায় ‘সাদা সাপ’ ‘দুধের পাত্র’, ‘গোলাপ’, ‘রক্তাক্ত সৌরভ’, ‘রাত্রি’, ‘চাঁদ’, ‘কৃষ্ণতা’ ইত্যাদি চিত্রময়তা ব্যবহার করেছেন। সিলিভিয়ার সমগ্র কবিতাতেই রঙের প্রতীকী ব্যবহার দারুণভাবে করা হয়েছে। আরেকটি বিখ্যাত এবং জটিল কবিতা ‘লেডি ল্যাজারাস’। সিলভিয়া প্লাথের রচনারীতি বোঝার জন্য এটি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কবিতা। ‘ড্যাডি’র মতো এ কবিতাতেও নাৎসি বাহিনীর অত্যাচার আর হতাকাণ্ডের চিত্র ফুটে উঠেছে। নাৎসিরা বন্দীদের চামড়া থেকে সাবান আর ল্যাম্পের শেড বানাত—কবিতার চতুর্থ ও পঞ্চম লাইনেই সে কথা মনে করিয়ে দিচ্ছেন সিলভিয়া। অন্যদিকে প্লাথের আত্মহত্যাপ্রবণতা, ক্রমাগতে মরতে চাওয়ার চেষ্টা এই কবিতা এসেছে। ‘ড্যাডি’ কবিতার মতোই এ কবিতাতেও জার্মান ভাষার ব্যবহার রয়েছে তার পিতার উত্তরসূরি সূত্রেই। অন্যদিকে জনাব শত্রু বলতে স্বামী টেড হিউজকে বুঝিয়েছেন তিনি। পুরুষ বলতেই পিতা ও স্বামীর কথা এসেছে তার কবিতায় বারবার। পুরাণের আগুনপাখি ফিনিক্স এ কবিতায় প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। ফিনিক্স সেই পাখি, যাকে জ্যান্ত আগুনে পুড়িয়ে মারা হয় এবং পোড়া ছাই থেকে তার বারবার জন্ম হয়। সিলভিয়া প্লাথও যেন বারবার মৃত্যু থেকে ফিরে আসেন। তিনি এ কবিতা যেন ডাক্তার মহাশয়ের উদ্দেশে লিখেছেন। প্রতি দশ বছরে একবার করে মরতে চাওয়া সিলভিয়াকে বারবার ডাক্তাররাই ফিরিয়ে এনেছে। তাই পরেরবার যখন সে মরার প্রস্তুতি নেবে তখন ডাক্তার আর পুরুষদের আগে খাবে।

১৪৩২ বঙ্গাব্দের প্রথম দিনে তোমাকে কি আর দিতে পারি বলো- কলেজ দিনে যেমন কবিতা পাঠাতাম তেমনি কবিতা পাঠালাম তবে আমার লেখা নয়, সিলভিয়া প্লাথের কবিতার ভাবানুবাদ করে পাঠালাম। নিরন্তর ভালো থেকো।


পরিত্যক্তা (Jilted)

ভাবনাগুলো আজ শুকনো পাতার মতো—
কোনো এক হলদে বিকেলের স্তব্ধতায় ভেজা,

চোখ জুড়ে অম্ল জল

তিতকুটে চাহনির এক বিষণ্ণ, টক-হলুদ তারা
কাঁপছে নিঃশব্দ বিষাদের জ্বালায়।

রাতের হাওয়া ফিসফিসে—
ভালোবাসা নামে গুজব বয়ে আনে,
চাঁদের মুখে দেখি নিজের ছায়া—
এক পেকে না-ওঠা পাতিলেবুর ভাঁজ।

হৃদয়—
গ্রীষ্মের কাঁচা বরই,
ঝুলে আছে
শুকনো এক ডালে—
ছোট, সবুজ, তেতো।


রাত তিনটার মনোলগ (Monologue At 3 AM)

বরং অস্তিত্বের সব তার ছিঁড়ে যাক
উফ, মাথার ভেতর কী কষ্ট
রক্ত শুধু রক্ত ছিটকে পড়েছে
রক্তে ভিজে যাচ্ছে উজ্জ্বল চৌকি, কার্পেট, মেঝে —
আর দেয়ালের পাশে ঝুলে থাকা সাপ মার্কা বর্ষপঞ্জিকা সাক্ষ্য দেয় —
তুমি বহুদূর —মাঝখানে অস্তিত্বের একদিকে আমি অন্যদিকে তুমি
তুমি বেশ আছো সতেজতায় আর আমি —
এই নিঃশব্দ তারাদের নিচে কালো সময়ের অভিশাপ,
বিদায় সম্ভাষণ, জ্বালা করা চোখে বিদায়ী রেলগাড়ির স্মৃতি জড়িয়ে ধরে
সব হারিয়ে,
তোমার দিকেই তাকিয়ে আমার জগৎ
মুখের উপর দরজা বন্ধ করেছে
আমি তোমাকে ক্ষমা করেছি আবারও।


ইতি—

বাসু
১৫ এপ্রিল,২০২৫

2 comments:

0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in



















১০

জেরাল্ডের এপার্টমেন্টটার কথা আগেই লিখেছি। তবে সেটার খুঁটিনাটি বর্ণনা এখন থাক। পরে যখন বের্নহার্ড সেখানে যাবে, তখন নাহয় তার চোখ দিয়েই আমরা সেখানকার ব্যাপারস্যাপার জেনে নেব।

আসলে সবারই টাকাকড়ির প্রয়োজন। অদ্ভুত এইসব ছেলেমেয়েগুলো যারা বাড়িঘর ছেড়ে এসে শহরে পড়ে আছে, যাদের এখনও কোনো চাকরিবাকরি জোটেনি, অথচ সবার প্রতিভা আছে। প্যারিসে আসবার পর প্রথম প্রথম সবার বেশ আত্মবিশ্বাস থাকে; কিন্তু কিছুদিন পরে আর ভেবে কূলকিনারা পায় না যে কী ভাবে কোন কাজ করা উচিত। নিজেদের দুর্ভাগা মনে করতে শুরু করে তারা, এবং এই পরিস্থিতি যদি অনেকদিন ধরে চলে, তাহলে যেভাবে হোক টাকাকড়ি রোজগার করে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাটাই তখন তাদের জীবনের প্রধান উদ্দেশ্যে পরিণত হয়।

ব্যাপারটা খুব অস্বাভাবিক নয়, কিন্তু আবার খুব অনায়াস সুন্দরও নয় যখন মানুষ নিজের সহজাত প্রবৃত্তিতেই অস্তিত্বরক্ষার লড়াইতে নেমে পড়ে। পুরো প্রক্রিয়াটা সাধারণত স্থূল প্রকারের হয়; তাছাড়া এই প্রক্রিয়াটা অবিরত চলতে থাকে। সবকিছু হঠাৎ নগ্ন এবং বেয়াব্রু হয়ে পড়ে এবং মানুষ অদ্ভুত উদ্ধত এবং হিংস্র আচরণ করতে শুরু করে। বের্নহার্ড নিজের স্কুলে বা সঙ্গীতবিদ্যালয়ের ছেলেদের মধ্যে এর আগে এরকম ব্যাপার দেখেছে। ফার্দিনান্দের মাসের শেষের দিকে পয়সা ফুরিয়ে যেত। তখন সসেজ আর বাঁধাকপির স্যালাদ খাবার জন্য সে অন্যের কাছ থেকে ধার করত। কিন্তু সবসময় কাছাকাছি কোনো না কোনও অভিভাবক থাকতেনই, বাবা মা কিম্বা মাসি কিম্বা পরিবারের অন্য কোনো সদস্য বা পারিবারিক বন্ধু। কোথাও না কোথাও একটা অবলম্বন বা নির্ভরতা থাকত। কিন্তু এখানে, মানে প্যারিসে, সে এমন অনেককে দেখেছে, যারা বলে যে “জে নে তু সাঁপ্লুমো পেরসোঁ” মানে তাদের একেবারে কেউ নেই। এই “Je n'ai tout simplement personne” শব্দটা, মানে দুনিয়ায় একেবারে কেউ না থাকার ব্যাপারটা বের্নহার্ড প্রথম শুনেছিল এক তরুণ রাশিয়ানের কাছে, যে লাঞ্চ করবার পরে তাকে বলেছিল টাকাটা দিয়ে দিতে, কারণ সে একেবারে কপর্দকশূন্য।

বের্নহার্ডের বাড়িওয়ালী মাদাম দুবোয়ার কাছে আরও একজন ছাত্র থাকে, চার্লস, যে নিজের স্নাতক পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। ছেলেটা বেশ লক্ষ্মীছাড়া ধরনের, উনিশ বছর বয়স, গতবছরের দ্বিতীয় সেমিস্টারে ফেল করেছে। ছেলেটার বাবা একটা ছোট মফস্বল শহরে থাকেন। প্রতি মাসে তিনি ছেলেকে একটা করে চিঠি লেখেন। তিনি মাদাম দুবোয়ার কাছে সরাসরি টাকা পাঠিয়ে দেন। মাদাম দুবোয়া সেই টাকা থেকে মাসে চার বার করে প্রতি সপ্তাহে চার্লসের হাতে দরকারি টাকাকড়ি দেন; অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে হিসেব করে তিনি এই কাজটা করেন এবং অগ্রিম একেবারেই দিতে চান না। তাছাড়া তিনি সব কাপড়জামা ধুয়ে ভাঁজ করে গুছিয়ে রাখেন, যদিও সেসব করতে তিনি একেবারেই বাধ্য নন। চার্লসকে তিনি মায়ের মতই যত্নআত্তি করেন। বের্নহার্ড এখানে আসবার আগে সে একাই ছিল মাদাম দুবোয়ার বাড়িতে। কিন্তু এই তরুণ গাঢ় ব্লন্‌ড চুলের জার্মান এই বাড়িতে এসে তার রাজত্বে ভাগ বসিয়েছে। মাদাম দুবোয়ার হৃদয়ে সম্ভবত চার্লসের জন্য আগের মত স্নেহ আর নেই। অনেক কিছু ঘটেছে। এই নতুন ছেলেটা শুধু যে নিজের ঘরদোর ঠিকমত গোছগাছ করে রাখে, তাই নয়, দেখা হলেই খুব সুন্দর করে মাদাম দুবোয়ার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ স্বরে সুপ্রভাত জানায় এবং জিজ্ঞেস করে যে কেমন আছেন তিনি। মাদাম দুবোয়া চার্লসের জামাকাপড়, স্যুট ধুয়ে ইস্ত্রি করে দিলেও সে কখনই উল্টে কিছু বলে না, বরঞ্চ এমন ভাব করে যেন এসব তার জন্মগত অধিকার। এদিকে বের্নহার্ডকে মাদাম দুবোয়া যে কোনও কিছু পরিষেবা দিলেই সে সঙ্গে সঙ্গে ধন্যবাদ জানায়।

এছাড়াও চার্লসের বেশ কিছু বদ অভ্যাস আছে, যে কারণে ক্রমশ মাদাম দুবোয়ার স্নেহের জায়গাটা থেকে সে সরে যাচ্ছে। প্রতি রাতে সে দেরি করে ফেরে বাড়িতে। এপার্টমেন্টের দরজাটা খুলে ঢুকবার সময় প্রচুর আওয়াজ করে এবং সাধারণত করিডোরের আলোটা নেভাতে ভুলে যায়। মাঝরাত অবধি নিজের ঘরে বসে সিগারেট খায়, তারপর সিগারেটের পেছনের অংশটা অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে ঘরের মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে। বাইরে থেকে খাবার কিনে এনে ঘরে বসে খায় তারপর বাকি খাবার কাগজে মুড়ে ড্রেসিং টেবিলে রেখে দেয় দিনের পর দিন। এইসমস্ত বদ অভ্যাস বাড়িওয়ালীকে সহ্য করতে হয়। তবুও এমনিতে সব মিলিয়ে তার ব্যবহার খারাপ নয় বলে মাদাম দুবোয়া তার এই বদ অভ্যাসগুলিকে ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখে থাকেন। তিনি তলিয়ে ভেবে দেখেছেন যে হয়তো শিশুকালের কিম্বা সাম্প্রতিক কোনও যন্ত্রণাকাতর অভিজ্ঞতার ফলেই চার্লস এত অগোছালো আর বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এইসব পর্যবেক্ষণ করে মাদাম দুবোয়ার হৃদয় স্নেহে দ্রব হয়ে যায়, আবার একই সঙ্গে তিনি কিছুটা অপরাধবোধেও ভোগেন; কারণ তিনি এরই মধ্যে সুন্দর এই জার্মান কিশোর বের্নহার্ডকে এই অগোছালো তরুণ চার্লসের থেকে একটু বেশি স্নেহ করতে শুরু করেছেন।

একদিন সকালে দু’জনের দেখা হল সিঁড়িতে। চার্লস থেমে দাঁড়িয়ে বের্নহার্ডকে বলে, ‘আপনার সঙ্গে কিছু কথা ছিল।’ বের্নহার্ড বিনীতভঙ্গিতে বলে ‘নিশ্চয়ই’। তারপর চার্লসের পিছুপিছু তার ঘরে যায়। চার্লসের ঘর তার ঘরের উল্টোদিকেই। চার্লস তার ঘরের জানালা বন্ধ করে একটা চেয়ার এগিয়ে দেয়। বের্নহার্ড ঘরের চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখে যে বেশ কিছু বই চারদিকে ছড়ানো ছেটানো রয়েছে। বেশির ভাগ পাঠ্য বই, কুর্স সুপেরিয়া অথবা মধ্যযুগের ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। চার্লসের মেজাজমর্জির সঙ্গে বইগুলো ঠিক খাপ খাচ্ছে না…

দু’জনে মুখোমুখি বসে। তাদের হাত টেবিলের উপরে রাখে। টেবিল ল্যাম্পের আলো পড়ে তাদের মুখে।

চার্লসকে খুব অস্থির দেখাচ্ছে। দুই চোখ দিয়ে যেন সে গোটা দুনিয়াটা গিলে নেবে। প্রতিটি কথার সঙ্গে এলোমেলো নিঃশ্বাস পড়ছে। সে যেভাবে কথা বলছে, নিজের মনের ভাব প্রকাশ করবার চেষ্টা করছে, এই পুরো প্রক্রিয়াটা ভয়ানক ক্লান্তিকর। সে যেন সঠিক শব্দটি খুঁজে পাচ্ছে না কথা বলতে গিয়ে, নিজস্ব বক্তব্যের মধ্যে স্বচ্ছতা আর ব্যাপ্তি আনবার চেষ্টা করতে গিয়ে যেন ক্রমাগত লড়াই করে চলেছে এই তরুণ। প্রথম সাক্ষাতে তার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বের্নহার্ডের বেশ অস্বস্তি হচ্ছিল। সে বুঝতে পারছে না যে চার্লস তার কাছ থেকে কী চায়। হঠাৎ তার নিজের স্কুলের বন্ধু কার্লের কথা মনে পড়ল, যার সঙ্গে মিলেমিশে সে লাতিন ক্লাসের প্রজেক্টগুলো করত। কার্লেরও ভাল নাম চার্লস, যদিও এই সামনে বসে থাকা ফ্যাকাসে, ভয়ঙ্কর প্রলাপ বকে যাওয়া ঘোরগ্রস্ত মানুষের সঙ্গে কার্লের তেমন কোনও মিল নেই।

কিন্তু চার্লস তার কাছে ঠিক কী চায়? বের্নহার্ড জানে না যে তার পক্ষে আদৌ কতখানি করা সম্ভব চার্লসের জন্য। চার্লস যে ভীষণ বাড়াবাড়ি রকমের অস্বাভাবিক আচরণ করছে, নিশ্চয়ই তার পেছনে কোনও কারণ আছে: চার্লসের জীবনে নিঃসন্দেহে বিপজ্জনক কিছু ঘটে গেছে। সেগুলোর মুখোমুখি হতে পারছে না সে, কিন্তু ধীরে ধীরে নিজেকে সামলে নেবার চেষ্টা করছে। অপ্রত্যাশিতভাবে সে বিস্মিত হয়েছে, নিজেকে প্রতারিত মনে হচ্ছে তার, অসহায় বোধ করছে সে। তার মনে হচ্ছে যে তার পাশে এখন কেউ নেই।

পুরো ঘটনাতে অবশ্যই তার নিজের দোষ আছে। অদ্ভুত অযৌক্তিক এক জীবন সে যাপন করছে। কোনও কিছুতে পরোয়া নেই, লজ্জা নেই। নিজের শরীরের যত্ন নেই, অথচ সে যে শারীরিকভাবে খুব শক্তিশালী বা সুস্থ, ব্যাপারটা এমনও নয়। শুধু শরীর নয়, তার আত্মাও ভুগে চলেছে তার অতিরিক্ত চাহিদার কারণে। চার্লসকে বাইরে থেকে যতই রুক্ষ এবং নির্মম দেখাক না কেন, ভেতরে ভেতরে সে অত্যন্ত আবেগপ্রবণ এবং সংবেদনশীল। সে যে কাজেই হাত দেয়, সেটা করতে গিয়ে তার কোনও মাত্রাজ্ঞান থাকে না। যে কোনো বিপদ, যে কোনও অ্যাডভেঞ্চারের মধ্যে আগ বাড়িয়ে এগিয়ে যায় এবং তারপর বিপজ্জনক ভাবে তার মধ্যে ফেঁসে যায়। যদি কেউ তাকে জিজ্ঞেস করে যে সে কেন এমন করছে, কারণ সে যথেষ্ট বুদ্ধিমান হওয়া সত্ত্বেও এক অর্থহীন জীবন যাপন করছে, তাহলে হয়তো উত্তরে সে বলবে যে সে নিজেকে নিজেই ঘেন্না করে।

‘জে মি দিতেস্ত’ (Je me déteste)… ‘আমি নিজেকে ঘেন্না করি’ এই হল তার প্রতিদিনের লব্জ। যদিও এইসব কথা সাধারণত মানুষ ধর্তব্যের মধ্যে আনে না, তবুও এইসব কথা থেকেই পরিষ্কার হয়ে যায় তার আত্মধ্বংসী মানসিকতা।

(চলবে)

0 comments:

0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in



















২০.২

ওই তিন নম্বর কিসসার জাদুতেই রঙ্গনাথ আজকাল ভয়ডর শিকেয় তুলে বেলাকে নিয়ে কল্পনা করতে শুরু করেছে। ক’দিন আগে মেলা থেকে ফেরার সময় রুপ্পনবাবুর প্রেমপত্র নিয়ে যে কিসসাটি শুনেছিল তারপর আর রুপ্পনের সঙ্গে এ’নিয়ে কোন কথাবার্তা বলার হিম্মৎ হয়নি। এখন এই খালি সময়ে বেলাকে নিয়ে ওর মনে যে ঝড় উঠেছে সেটা শান্ত করতে ওর সহায় শুধু কল্পনা, হস্তমৈথুন আর কুন্ঠা ছাড়া উপায় কি! তবে এইসব যুগে যুগে শিল্পীদের প্রেরণা যুগিয়েছে। তাই এখন রঙ্গনাথ এক শিল্পীর জীবনযাপন করছে বলা যেতে পারে।

ও দেখতে কেমন?

“মধুমতী” সিনেমার বৈজয়ন্তীমালার মত? নাকি “গোদান”এর শুভা খোটে? অথবা “অভিযান” এর ওয়াহিদা রহমান? না না, এরা সব তো অনেক আগেই ভারতমাতা হয়ে গেছে। বেলা এখনও বেশ তাজা। কেমন হবে? জানা নেই। কিন্তু যাই হোক, যেমনই হোক, হবে তো “ খুদা কী কসম লাজবাব”! চৌধবী কা চাঁদ সিনেমার গানের কলি রঙ্গনাথের গলায় হাড়ের মত আটকে গেছে, তবু মুখে হাসি ফুটেছে। অন্ধকারে প্রায় দেড় ইঞ্চি চওড়া মুচকি হাসি, বড় মধুর।

বেলাকে নিয়ে অনেক ভেবেছে। এত ভেবেছে যে নানান মাপের এবং ওজনের শ’খানেক নিতম্ব ও স্তন ওর মাথায় ভাসছে আর ডুবছে। ওগুলো জোড়ায় জোড়ায় হাজির হয়, গোছা গোছা ফুটে ওঠে, তারপর একে অন্যকে ধাক্কা দিয়ে পালিয়ে যায়। রঙ্গনাথের খুব ইচ্ছে যে এগুলো থেকে একটা ভরন্ত নারী শরীর দেখা দিক, কিন্তু সে গুড়ে বালি! ওর কল্পনায় একবার একটি নারীদেহ এল বটে, কিন্তু তাতে চেহারা গায়েব! ওর মনে খানিকক্ষণ কুছ বাতিল স্তনের গোলা আকার খেলা করতে লাগল। শেষে, উত্তিষ্ঠত-জাগ্রত শরীরকে ঢিলে করার পর ও লেপের ভেতর সেঁধিয়ে গেল।

পরের রাত। রঙ্গনাথ ছাতে একা শুয়ে রয়েছে। কিন্তু বেলার কথা ভুলে গিয়ে ওর মামা বৈদ্যজীর ক্রোধে তমতম করা বীর্যময় চেহারা মনে পড়ছে।

দিনের বেলা শনীচর আর কালিকাপ্রসাদের চেষ্টায় তৈরি কো- অপারেটিভ ফার্মের উদ্বোধন হয়েছিল। মুখ্য অতিথি হয়ে যে অফিসার এসেছিলেন বৈদ্যজী তাঁকে নিজের সমবায় ইউনিয়নে টাকা তছরুপের ঘটনার উল্লেখ করলেন। তারপর ওনাকে মনে করিয়ে দিলেন যে তছরুপ হওয়া টাকা যাতে সরকার অনুদান হিসেবে সমবায় ইউনিয়নকে দিয়ে দেয় সে’ বাবদ একটি প্রস্তাব ওনাদের দপ্তরে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।

বৈদ্যজী শীতল স্বরে ওনাকে বোঝাতে চাইলেন যে সরকার ওই অনুদান না দিলে এটাই বোঝা যাবে যে সরকারি আমলারা সমবায় আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে উৎসুক নন।

অফিসারটি বোধহয় ডেল কার্নেগীর বিখ্যাত “প্রতিপত্তি ও বন্ধুলাভ” বইটি সদ্য সদ্য পড়েছেন। উনি বৈদ্যজীর প্রত্যেকটি কথায় বলতে লাগলেন “আপনি ঠিক বলেছেন, কিন্তু ----“। এই বাক্যটি উনি সাতবার আউড়েছিলেন। আটবারের সময় ওনার গলার থেকে “আপনি অনুদান পেয়ে যাবেন” গোছের সুমধুর গান ঠিক বেরয় নি। বরং সেই পুরনো হেজে যাওয়া বাক্য-- “আপনি ঠিক বলেছেন, কিন্তু—“।

এবার শোনামাত্র বৈদ্যজীর মধ্যে দুর্বাসা মুনির ক্রোধ, হিটলারের একনায়কত্ব এবং নেহেরুর বিরক্তি একসঙ্গে জেগে উঠল। আর উনি সেই অফিসারের আদ্যশ্রাদ্ধ করতে লাগলেন—“এভাবে দেশোদ্ধার করবেন? এইসব ‘কিন্তু’,’পরন্তু’, ‘অধিকন্তু’, ‘তথাপি’ দিয়ে? এসব কী? শ্রীমান্‌ এগুলো নপুংসকের ভাষা। অকর্মণ্য ব্যক্তি এভাবেই নিজেকে এবং দেশকে বঞ্চিত করে থাকে। আপনার নির্ণয় স্পষ্ট হওয়া উচিত। কিন্তু! পরন্তু! থুঃ”!

বৈদ্যজী থামলেন না। দেশের দুর্দশা নিয়ে এক পেল্লায় লেকচার ঝাড়লেন। তাতেও পুরোপুরি শান্ত না হয়ে খানিকক্ষণ গজগজ করতে লাগলেন। অফিসারটিও অনেক বিনম্র, কিন্তু খানিকক্ষণ গজগজ করলেন। তারপর বাকি সবাই গজগজ করতে লাগল। শনিচরের জলসা তো অনেক আগেই শেষ। কাজেই এই সব গজগজানিতে ওর সাফল্যে কোন কলংকের দাগ লাগেনি। তবে শেষ পর্য্যন্ত গজগজানিরই জয়!

রঙ্গনাথ ওর শহরবাসের সময় এ’ধরণের গজগজানি অনেক শুনেছে। সব সময়, সব জায়গায়। ও জানত যে আমাদের দেশ হল গজগজানির দেশ। অফিসে, দোকানে, কলকারখানায়, পার্ক এবং হোটেলে, খবরের কাগজে, গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধে—যেদিকে তাকাও লোক গজগজ করছে তো করছেই। ও ভাল করে বুঝে গেছল—এটাই আমাদের যুগের চেতনা।

তবে এখানে গাঁয়ে এসেও সেই গজগজানি! চাষিরা সরকারি আমলাদের নিয়ে গজগজ করে। আমলারা প্রথমে জনতার থেকে নিজেকে আলাদা করে নিয়ে জনতার বিরুদ্ধে গজগজ করে। তারপর এক নিঃশ্বাসে নিজেকে সরকার থেকে আলাদা করে সরকারের বিরুদ্ধে গজগজ করে। সবারই কোন না কোন কষ্ট, কিন্তু কেউ দুঃখকষ্টের মূলে যেতে রাজি নয়। কষ্টের যা কিছু তাৎক্ষণিক কারণ চোখে পড়ছে শুধু সেটা নিয়েই যত গজগজানি!

কিন্তু বৈদ্যজী ছিলেন ব্যতিক্রম, কখনও গজগজ করতেন না। আজ রঙ্গনাথের বুক ভেঙে গেল। ও ভেবেছিল মামাজী প্রথমে পবিত্র ক্রোধে গর্জে উঠবেন, ফের শুরু হবে প্রচন্ড বৃষ্টি, মুষলাধার। উনি গর্জে তো উঠেছিলেন, ফের গজর গজর করে বসে পড়লেন।

কেন?

ওই অফিসারটি লেজ নাড়াতে নাড়াতে এবং গজগজ করতে করতে ইশারা করল যে কো-অপারেটিভের তবিল তছরুপের ব্যাপারে স্পেশ্যাল অডিট করানো জরুরী।

রঙ্গনাথ ভাবল—এটা গর্জে ওঠার নয়, বরং গজর গজর করার দেশ।


রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে এক স্থুল কর্কশ আওয়াজ রঙ্গনাথের কানে থাপ্পড়ের মত আছড়ে পড়ল। কুশহরপ্রসাদ নিজের ঘরের চৌকাঠে বসে কাউকে গাল পাড়ছে। ও গজগজকরার দলের বুড়ো নেতা বটেন। কিন্তু ও কান্নাকাটি করছে না এবং ওর গালাগালের লক্ষ্য ওর ছেলে ছোটে পালোয়ান নয়, অন্য কেউ। কাকে গালি দিচ্ছে বোঝা মুশকিল। কারণ, কুশহর যখন ছোটেকে গালি না দিয়ে অন্য কাউকে দেয়, তখন অস্পষ্ট ভাববাচ্যে বলে। যেমন জঙ্গলে ময়ুর নাচে, উদবোধনের সময় নেতাগণ বলে থাকেন।

শব্দ! নিতান্ত জুমলা মাত্র। কুশহরপ্রসাদ থেকে থেকে গরজায়, ফের চুপ মেরে যায়। গাঁয়ের অন্য মুড়োয় একটা নেড়ি কুকুর ভৌ ভৌ করে, তারপর হঠাৎ ক্যাঁ ক্যাঁ করে ওঠে। মনের ভেতর কুকুরটার যে ছবি ফুটে ওঠে তাহল-- লেজ পেছনের দু’পায়ের ফাঁকে, মুখটা বুকের উপর ত্যাড়া হয়ে লটকে আছে, আর ডানদিক থেকে কারও লাঠির বাড়ি খেয়ে এঁকে বেঁকে চলছে। আরও ক’টা কুকুর ডেকে ওঠে।

রামাধীন ভীখমখেড়বী’র বাড়ির দরজা থেকে কোন নবযুবকের চড়া সুরে মিনমিন করে গাওয়া গান ভেসে আসছে। কান পেতে শুনলে বোঝা যায় ওটা কোন যাত্রাপালার গানের কলি।

“তোর মুখের কথা শুনে আমি এই বুঝেছি সার,

প্রেমে পড়েছিস কোন কাঙালের—চিত্ত চমৎকার”।

ও বারবার ওই একটা লাইন গেয়ে চলেছে। গাইতে গাইতে ওর গলা ধরে যায়, স্বর কেঁপে ওঠে। এটা হয়ত দেশি চোলাইয়ের প্রভাব, অথবা সত্যিই সে নিজের প্রেমিকার দুর্ভাগ্যে কাঁদছে। কেন যে এক ভিখিরির প্রেমে পড়ল! গাঁয়ের চার-পাঁচটা বখাটে ছোঁড়া নীচের গলি দিয়ে চলে গেল। গয়াদীনের ঘরে চুরি হওয়ার পর থেকে ওরা পালা করে রাত-পাহারা দেয়। আর “জাগতে রহো” হাঁক পাড়তে পাড়তে কিছু নতুন শ্লোগান তৈরি করে নেয়।

“জাগতে রহো!

সিকি আধুলি রূপোর চাঁদি,

জয় হোক তোমার মহাত্মা গাঁধী”!

সব শ্লোগানই মহা ফালতু। এখন সিকি আধুলির চলন কোথায়? সব তো পঁচিশ আর পঞ্চাশ নয়া পয়সা। সিকি খতম, আধুলি খতম, মহাত্মা গান্ধীও খতম। এরা বুঝে না বুঝে, কিছু না ভেবে স্লোগান দিয়ে যায়। কোথাও একটা রেলগাড়ি যাচ্ছে। ইঞ্জিনের তীব্র সিটি দূরে মিলিয়ে যেতে যেতে এসব শ্লোগানের উদাত্ত, অনুদাত্ত, স্বরিত স্বরকে খানিকক্ষণ চেপে দেয়।

ক্রমশঃ ফিকে হয়ে আসা আওয়াজ আর গাঢ় অন্ধকারের মাঝে কখন যে ঘুম এসে গেছল! ঘুমের মধ্যে রঙ্গনাথের মনে হল ও একটা লিফটে চড়ে দ্রুত বেশ ক’টা তলা ছাড়িয়ে নীচে নামছে। হঠাৎ লিফট এক ঝটকায় তিন চার তলা ছাড়িয়ে উপরে উঠতে লাগল। রঙ্গনাথ ছটফটিয়ে উঠল।

নারকেল তেল আর কোন শস্তা সেন্টের গন্ধ ওর নাকে ঢুকছে। গন্ধটা না ভাল, না বিচ্ছিরি—শুধু গন্ধ মাত্র। চুড়ির হালকা রিনিঠিনি ওর ঘুমন্ত চেতনায় এক ধাক্কা দিল। এক মুহুর্তে ওর এমন অনুভূতি হল যা সারাজীবন খাজুরাহো কোণার্কের শিল্পকলা অধ্যয়ন করেও মানুষ শিখতে পারে না।

মেয়েটি এসে খাটিয়ার এক কোণায় বসেছে। ওর এক হাত রঙ্গনাথের অন্য পাশে। রঙ্গনা্থে বুকে এক জোড়া স্তনের ভারী চাপ। যদিও ওই যুগল স্তন আর ওর বুকের মাঝখানে স্তন ঢাকা কাপড় এবং রঙ্গনাথের লেপ রয়েছে। তবু স্তনের দৃঢ় স্পর্শ এবং উষ্ণতা সব বাধা পেরিয়ে ওকে স্পর্শ করছে। রঙ্গনাথের নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার জোগাড়।

কেউ রঙ্গনাথের মুখের থেকে লেপ সরিয়ে দিয়েছে। কিন্তু ঘুরঘুট্টি আঁধারে কেউ কাউকে ভাল করে দেখতে পাচ্ছে না। ওর বুকে বারুদ ভরা উষ্ণ স্পর্শের ছোঁয়া আর চাপ যেন আরও বেড়ে গেছে। তখনই ওর গালের উপর এক কোমল রেশমী গাল নেমে এল। কেউ গহন নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল- ওমা, ঘুমিয়ে পড়লে নাকি?

রঙ্গনাথের ঘুম হাওয়া হয়ে গেছে। ও মাথা নাড়ল আর মুখ থেকে এক অস্বাভাবিক স্বর বেরিয়ে এল—কে? কে তুমি?

এক মুহুর্তের জন্য বুকের উপর চেপে বসা যুগল স্তনের ধুকধুকি থেমে গেল। কেউ এক লাফে খাটিয়া থেকে সরে ছাদের এক কোণে চলে গিয়েছে। চাপা গলায় মেয়েলি স্বরে শোনা গেল—‘হায় মেরী মাইয়া’!

ও মাগো!

মাকে স্মরণ করা খুব ভালো। কিন্তু এখন শুধু ঘাবড়ে গিয়ে মুখ থেকে মাতৃনাম বেরিয়েছে। রঙ্গনাথ লেপ ছুঁড়ে ফেলে উঠে বসেছে। কিন্তু ততক্ষণে অজানা অদেখা মেয়েটি এই ছাত থেকে ওই ছাত, সেখান থেকে সেই ছাত করে-টরে আর কোথাও অদৃশ্য হয়ে গেছে।

খোলা দরজা দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে ও বারান্দায় এল। বাইরে ঠান্ডা। ও কান খাড়া করে চেষ্টা করল—যদি কিছু শোনা যায়। কিন্তু হাওয়ার সরসরানি ছাড়া আর কিছু পেল না। যে এসেছিল তার “‘হায় মেরী মাইয়া’ বলে মাতার পবিত্র নাম স্মরণের পরে আর কিছু বোঝার বাকি ছিল না।

দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে ফের খাটিয়ায় শোয়ার সময় ওর কিছু ব্যাপার মাথায় ঢুকল।

প্রথম, কোণার্ক, ভুবনেশ্বর, খাজুরাহোর নারীমূর্তির উরোজ যদি পাথরের রূপ ছেড়ে কারও বুকে চেপে বসে তাহলে কাউকে পাগল করার জন্যে যথেষ্ট।

দ্বিতীয়, পুরাতত্ত্ব এবং ভারতীয় শিল্পকলা নিয়ে আজ অব্দি যা পড়েছে সব ফালতু, ভুলে ভরা।

তৃতীয়, ভারতীয় শিল্পকলায় ডক্টরেট করার চেয়ে সুরলোকের সুন্দরীদের মত দুই জীবন্ত স্তনের আশ্রয় পাওয়া সফলতার পরাকাষ্ঠা।

আর এসব হালকা এলোমেলো কথার আড়ালে যে আসল কথা, যে আফশোস ওকে কুরে কুরে খাচ্ছে তা হল—শ্রীমান, আপনি একটা বোকাপাঁঠা! চেঁচানোর কী দরকার ছিল? ঘাবড়ে গেলে কেন? ওকে আরও কিছু করার সুযোগ দিয়ে দেখতে? তা না---!

শ্রীমান, আপনি শুধু বোকাপাঁঠাই নন, একটা গাধাও বটেন।

শ্রীমান, আপনি ওসব কিস্যু না। শুধু একজন সাধারণ হিন্দুস্তানী ছাত্র, ব্যস্‌। যার কপালে শুধু মেয়েদের ছবিই সম্বল।

অনেক চেষ্টাচরিত্র করেও ঘুম এল না। একবার কিছু না ভেবেই নিজের বুক ছুঁয়ে দেখল। নাঃ, ওখানে কিছু নেই। শুধু নিজের রোমশ বুক।

কে মেয়েটি? ভাবার চেষ্টা করল, কিন্তু বৃথা। ওর চেতনা আচ্ছন্ন করে জোড়া পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে যে!

(চলবে)

0 comments:

0

ধারাবাহিক - সুদীপ ঘোষাল

Posted in



















পঁচিশ

আজ সমীরণ ক্ষীরগ্রাম যাওয়া ঠিক করল।সমীরণ বলল, জনশ্রুতি অনুসারে এই জলাশয়ের দক্ষিণ দিকে দেবী সতীর ডান পায়ের আঙুল পড়েছে। দেবী যোগাদ্যা মায়ের স্থায়ী বাসস্থান এই জলাশয়ের নীচে। একমাত্র বৈশাখ সংক্রান্তিতে দেবীকে জল থেকে তুলে মূল মন্দিরে ভক্তদের সামনে রাখা হয়। এই দিন সবার অধিকার থাকে দেবীকে স্পর্শ করার পুজো দেবার। এই সংক্রান্তিতে সারাদিন ধরে মায়ের পুজো হয় ও গ্রামে মেলা বসে। পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে এই দীঘির ঘাটে মা যুবতীর বেশ ধরে শাঁখা পড়েছিলেন। সেই উপলক্ষে বৈশাখ মাসের উৎসবে মাকে শাঁখা পড়ানো হয় এবং গ্রামের বধূরাও ওই দিন শাঁখা পরে। পুজো শেষ হলে ভোরবেলা দেবীকে আবার ক্ষীরদীঘিতে রেখে আসা হয়। এছাড়াও বছরের অন্যান্য বিশেষ সময়ে দেবীকে জল থেকে তুলে মন্দিরে এনে পুজো করা হলেও ভক্তরা দেবীর দর্শন পান না। একমাত্র বৈশাখ সংক্রান্তির দিনই দেবীর দর্শন করা যায়।

পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে দেবী যোগাদ্যাকে ক্ষীরগ্রামে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন স্বয়ং রাম। লংকায় রাম রাবণের যুদ্ধ চলাকালীন রাবণের ছেলে মহীরাবণ রাম ও লক্ষণকে মায়াজালে আবদ্ধ করে পাতালে নিয়ে আসে বলি দেবার জন্য।এই পাতালে মহীরাবণের আরাধ্যা দেবী ছিলেন ভদ্রকালি তথা দেবী যোগাদ্যা ।প্রতিদিন দেবীর সামনে নরবলি দেওয়া হতো। কিন্তু মহীরাবণের সেই উদ্দশ্য সফল হয় নি। হনুমান মহীরাবণকে পরাজিত করে রাম ও লক্ষণ কে উদ্ধার করেন। মা যোগাদ্যা রামের কাছে থাকতে এবং তার হাতে পুজো নেবার ইচ্ছে জানালে রাম দেবীকে পাতালপুরী থেকে পৃথিবীতে এনে এই ক্ষীর গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেন। এই সব বর্ণনা কবি কৃত্তিবাসের রচনায় পাওয়া গেছে। যারা ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করেন তাদের মতে এই ক্ষীরগ্রাম থেকে বহু প্রাচীন পুঁথি উদ্ধার হয়েছে যেখানে যোগাদ্যা বন্দনার প্রায় ৪০টি পুঁথি পাওয়া গিয়েছে।

দেবী মূর্তিটি কালো কষ্টি পাথরের। দেবীর রূপ দশভূজা ও দেবী মহিষমর্দিনী। বলা হয় প্রাচীন মূর্তি চুরি যাওয়ায় বর্ধমানের রাজা কীর্তিচন্দ দাইহাটের নবীনচন্দ্র ভাস্করকে দিয়ে দশভূজা মহিষমর্দিনীর একটি প্রস্তর প্রতিমা তৈরি করিয়েছিলেন। এই প্রতিমাটিই ক্ষীরদীঘির জলের নীচে রাখা থাকে। তবে মূল মন্দিরে কোনো প্রতিমা নেই। গর্ভগৃহে বেদী রাখা আছে এই বেদীতেই মায়ের নিত্য পুজো করা হয়। মাকে আমিষ ভোগ প্রদান করা হয়। এই মন্দিরের একটু দূরে রয়েছে ভৈরব ক্ষীরকণ্ঠের শিব মন্দির। একসময় এক অলৌকিক ঘটনা ঘটে, হারিয়ে যাওয়া মূর্তিটি নিয়ে। ক্ষীরদীঘি সংস্কারের সময় নতুন মূর্তির সাথে খোঁজ মেলে হারিয়ে যাওয়া মূর্তির। পুরনো মূর্তি ফিরে পাবার আনন্দে গ্রামবাসীরা আরও একটি মন্দির গড়ে তোলেন। এই মন্দিরেই রাখা থাকে পুরনো যোগাদ্যা মূর্তিটি। ফলত এখন গ্রামে গেলে সারাবছরই মায়ের দর্শন পাওয়া যায়। এবং বৈশাখ সংক্রান্তির সময় গ্রামের দুই মন্দিরেই সমান আরাধনা চলে।

0 comments:

0

গল্প - মনোজ কর

Posted in



















 চতুর্থ এবং পঞ্চম পর্ব




 চতুর্থ পর্ব

পানু রায় বড়কালীর অফিসে ঢুকেই দেখলেন ঘর আলো করে সেক্রেটারির টেবিলে বসে আছে এক লম্বা, ফর্সা, নীলচক্ষু, কৃষ্ণকেশী সুন্দরী। বুঝতে অসুবিধে হলনা এই মহিলাই এলিনা রাই, বড়কালীর নতুন সেক্রেটারি। আসবাবপত্রগুলোর অবস্থানের কিছুটা পরিবর্তন করা হয়েছে। টেবিলটা আগে যেদিকে ছিল সেখান থেকে সরিয়ে উল্টোদিকে রাখা হয়েছে। কুচকুচে কালো মেহগিনির প্রেক্ষাপটে এলিনা রাইএর রঙ যেন ফেটে বেরুচ্ছে। পানু রায় বুঝলেন টেবিলের অবস্থান পরিবর্তনের পিছনে অন্য কিছু ভাবনাচিন্তা কাজ করেছে। পানু রায় নিশ্চিত হলেন যখন দেখলেন যে জানালার পর্দার রঙ এমনভাবে নির্বাচন করা হয়েছে যাতে তার থেকে আলো প্রতিফলিত হয়ে ঘরের উজ্জ্বলতা অনেকগুন বেড়ে যায় আর তার সঙ্গে বেড়ে যায় এলিনার সযত্নে প্রসাধন করা মুখের ঔজ্জ্বল্য। পানু রায় দরজা খুলে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে অফিসের ফোন বেজে উঠলো। এলিনা হাসিমুখে পানু রায়কে স্বাগত জানিয়ে ফোনটা তুলে নিল। ঠোঁটের কাছে ফোনটা নিয়ে কয়েক মিনিট এত আস্তে কথা বলল এলিনা যে এত কাছে বসে থেকেও কিছুই শুনতে পেলেন না পানু রায়। শুধু শুনতে পাওয়া গেল ফোন রাখার সময় এলিনা বলল,’ কৃষ্ণকালী শহরে নেই। আমি দুঃখিত। আমি জানিনা উনি কবে ফিরবেন। আপনি কোনও মেসেজ দিতে চান? ও আচ্ছা, অনেক ধন্যবাদ।‘ফোন রেখে এলিনা পানু রায়ের দিকে তাকাল। পানু রায় বললেন,’ আমার নাম পানু রায়।‘

-আপনিই পানু রায়। আপনার কথা স্যারের কাছে শুনেছি। আপনিই ওনার আইনি পরামর্শদাতা, তাই না?’

-ঠিক বলেছেন।

-আপনার অফিস থেকে আপনার সেক্রেটারি একটু আগে ফোন করেছিলেন। বললেন আমি যেন স্যার ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গেই ওনাকে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলি।

-অনেক ধন্যবাদ। আচ্ছা, আপনি কি টেবিলটা সরিয়েছেন? ওটাতো আগে ওখানে ছিল না।

-না আমি সরাইনি।

-কিন্তু মনীষা যখন ছিল তখন ওটা উল্টোদিকে ছিল।

-হ্যাঁ, মনীষা টেবিলটা যেখানে রেখেছিল সেখান থেকে আমি সরিয়েছি। ও টেবিলটা ভুল জায়গায় রেখেছিল। ওখানে আলো ঠিকমত পৌঁছচ্ছিল না।

-মনীষার সঙ্গে আপনার কথা হয়?

-না, সেরকম কথা হয় না। তবে এখানে দু’বার এসেছিল। তার বেশি কিছু নয়।

-ওর নাম আগে মনীষা ঝা ছিল। এখন ওর পদবি কী হয়েছে জানেন?

-ওর সঙ্গে যার বিয়ে হয়েছে তার নাম পরেশ প্রসাদ।

-ঠিক ঠিক। আমার এবার মনে পড়েছে। আচ্ছা এলিনা, কৃষ্ণকালী এখন কোথায়?

-উনি ব্যবসার কাজে বাইরে গেছেন।

-কবে গেছেন?

-উনি গতকাল বিকাল থেকে অফিসে নেই।

পানু রায় তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে এলিনার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কোনও বিশেষ কারণে গেছেন?’

এলিনা বলল,’ না, বিশেষ কিছু নয়। আপনি তো জানেন উনি প্রায়ই ব্যবসার কাজে বাইরে যান। ওনার বিভিন্নরকম ব্যবসা আছে। তাছাড়া নানা শহরে ওনার সম্পত্তিও আছে।

পানু রায় বললেন,’ আপনি নিশ্চয়ই জানেন আমি ওনাকে ব্যবসা সংক্রান্ত বিষয়ে আইনি পরামর্শ দিয়ে থাকি।‘

-হ্যাঁ, আমি ওনাকে আপনার সঙ্গে কথা বলতে শুনেছি।

-আমার যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওনার সঙ্গে যোগাযোগ করার খুব দরকার।

-সেটা কি রেবা কৈরালা সংক্রান্ত কোনও বিষয়ে?

পানু রায় মুখের ভাবে কিছু প্রকাশ না করে জিজ্ঞাসা করলেন,’ কেন? একথা কেন জিজ্ঞাসা করছেন?’

এলিনা বলল,’ দেখুন সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা। আমি চাই না এই আলোচনায় কোনও তৃতীয় ব্যক্তির প্রবেশ ঘটে। আমরা কি এই অফিস সামনে থাকে বন্ধ করে পিছনের দরজা খুলে স্যারের ব্যক্তিগত কেবিনে গিয়ে আলোচনা করতে পারি? সেখানে কেউ আসতে পারবে না।

পানু রায় বললেন,’ অবশ্যই।‘এলিনা চেয়ার থেকে উঠে লম্বা লম্বা পা ফেলে বাইরে বেরিয়ে অফিস বন্ধ করে পিছনের দিক দিয়ে গিয়ে একটা মস্ত দরজা খুলে একটা সুসজ্জিত বিশাল ঘরে ঢুকল। পিছনে পিছনে পানু রায়ও ঢুকলেন। এলিনা কৃষ্ণকালীর মস্ত মেহগিনি টেবিলের ওপর ভর দিয়ে সামনে ঘুরে পানু রায়ের দিকে সোজা তাকিয়ে এমন ভাবে দাঁড়াল যেন মনে হল কোনও সিনেমার শট দিচ্ছে।

- স্যার কিন্তু ভীষণ রেগে যাবেন যদি শোনেন যে আমি আপনার সঙ্গে রেবা কৈরালার ব্যাপারে কোনও কথা বলেছি। আপনি মানুষের চরিত্র ভালোই বোঝেন এবং আপনাকে নিশ্চয়ই বলে দেবার প্রয়োজন নেই যে রেবা কৈরালা একজন অত্যন্ত স্বার্থপর এবং ধুরন্ধর মহিলা।আপনি নিশ্চয়ই জানেন রেবা কৈরালার সঙ্গে স্যারের ছেলে কালীকৃষ্ণের খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল। এখন কালীকৃষ্ণের নজর একটি অন্য মেয়ের দিকে পড়েছে এবং রেবা কৈরালা স্যারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ানোর চেষ্টা করছে। আমি বুঝতে পারছি না রেবার আসল উদ্দেশ্য কী? তবে রেবা নিজের লাভ ছাড়া আর কিছু বোঝে না। আমি রেবার ওপর গোয়েন্দাগিরি করতে চাই না এবং আশা করি আপনিও চান না। কিন্তু একটা কথা আপনাকে বলি, আপনি কিন্তু খতিয়ে না দেখে ওর গল্পে বিশ্বাস করবেন না।

এতটা বলে এলিনা একটু থামল। তারপর বলল,’ স্যার বা কালীকৃষ্ণ যদি ঘুণাক্ষরেও টের পায় যে আমি আপনাকে এসব কথা বলেছি তাহলে আমাকে সঙ্গে সঙ্গে তাড়িয়ে দেবে। অবশ্য তাহলেও স্যারের প্রতি আমার দায়বদ্ধতার কোনও পরিবর্তন হবে না। এখন আপনি বলুন আপনি আমাদের এই আলোচনার গোপনীয়তা রক্ষা করবেন না স্যারকে এই আলোচনার কথা জানিয়ে দেবেন।

পানু রায় বললেন,’ আপনি আমাকে বিশ্বাস করে কথাগুলো বলেছেন। কথা দিলাম সেই বিশ্বাস অটুট থাকবে। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন কোনও তৃতীয় ব্যক্তি ঘুণাক্ষরেও একথা জানবে না।‘

এলিনা পানু রায়ের সামনে এগিয়ে এসে বলল,’ অনেক ধন্যবাদ।‘ তারপর নিজের হাতদু’টো পানু রায়ের দিকে বাড়িয়ে দিল। পানু রায় নিজের দু’ হাতের মধ্যে এলিনার হাতদু’টো নিয়ে বললেন,’ আমার বয়স ১০৫। এখন আমি আসি।‘ বিস্মিত এলিনা অবাক হয়ে দেখল শিরদাঁড়া সোজা করে দৃঢ় পদক্ষেপে দরজার ওপারে অদৃশ্য হয়ে গেলেন পানু রায়।




 পঞ্চম পর্ব

বড়কালীর অফিস থেকে বেরিয়ে পানু রায় সুন্দরীকে ফোন করলেন। জিজ্ঞাসা করলেন,’ মনীষা ঝা মানে এখন মনীষা প্রসাদের ঠিকানা আছে তোমার কাছে?’ ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে সুন্দরী বলল,’দাদু, ধরে থাক। আমি তোমাকে মনীষার ফোন নম্বর কিংবা ঠিকানা দিচ্ছি।‘

-আমার ঠিকানা চাই।

কিছুক্ষণ পরে সুন্দরী পানু রায়কে মনীষার ঠিকানা জানিয়ে বলল,’ মনীষাকে আমার আদর আর শুভেচ্ছা জানিও।‘

‘অবশ্যই’ বলে পানু রায় হাত দেখিয়ে একটা ট্যাক্সি থামিয়ে মনীষার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। প্রায় আধঘন্টা পরে ট্যাক্সি ড্রাইভার বলল,’ এসে গেছি।‘ পানু রায় ভাড়া মিটিয়ে বললেন,’ একটু অপেক্ষা কর। আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরব।‘

ট্যাক্সি থেকে নেমে বাড়িটার কাছে পৌঁছে বেল বাজাতে যাবেন ঠিক তখনই একগাল হেসে দরজা খুলে দাঁড়াল মনীষা। বলল,’ পানু রায়!!! আপনাকে কতদিন পরে দেখলাম। কি যে আনন্দ হচ্ছে আমার! ভেতরে আসুন।‘পানু রায় ঢুকতে ঢুকতে বললেন,’ তোমাকে ভীষণ সুন্দর লাগছে, মনীষা।‘ মনীষা হেসে বলল,’ আপনি আগের মতই রসিক আছেন। আমার সন্তান ভূমিষ্ঠ হতে আর মাত্র দু’ মাস। আমাকে এখন দেখতে হয়েছে হাতির মত। আমি বাড়ির সব কাজ বন্ধ করে দিয়েছি। বসার ঘরটাও পরিস্কার করা হয় না। অপরিচ্ছন্নতা ক্ষমা করবেন। এই চেয়ারটায় বসুন। কী নেবেন চা না কফি? ‘

-না না, ঠিক আছে। আমি এসেছিলাম কৃষ্ণকালী সম্বন্ধে কিছু খবর জানতে।

-কী সংক্রান্ত খবর?

-আমি জানতে চাই কী করে ওনার সঙ্গে যোগাযোগ করা যেতে পারে?

-কেন? উনি কি শহরের বাইরে?

-হ্যাঁ, সেটাই তো সমস্যার কারণ।

-আপনি এলিনার সঙ্গে কথা বলেছেন?

-হ্যাঁ, ওর সঙ্গেই প্রথমে যোগাযোগ করেছিলাম।

-কিন্তু যা জানার ছিল তা জানতে পারলেন না, তাই তো?

-না, আসলে কিছুই জানতে পারলাম না।

মনীষা হেসে বলল,’ আমিও দু’বার অফিসে গিয়েছিলাম।এমনি জানতে সব কী রকম চলছে। কোনও উত্তরই পাইনি। তাই আর যাইনা।

-তোমার সঙ্গে কৃষ্ণকালীর দেখা হয়েছিল?

-না, দু’বারের একবারও না। প্রথমবার আমি জানতাম উনি খুব ব্যস্ত ছিলেন কিন্তু দ্বিতীয়বার এলিনা তো স্যারকে জানাতেই চাইলনা যে আমি ওনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।

-কিন্তু কেন? কিছু আন্দাজ করতে পার?

-আমি জানিনা। আমি স্যারের অফিসে কাজ করেছি প্রায় বারো বছর। বারো বছর সময় ওনার ব্যবসা এবং ওনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হবার পক্ষে যথেষ্ট, তাই না? ওনার স্ত্রীবিয়োগের পর উনি একেবারে ভেঙে পড়েছিলেন। উনি যখন আস্তে আস্তে স্বাভাবিক কাজকর্মে ফিরে আসছিলেন তখনই আমার বিয়ের ঠিক হয়। কিন্তু ওনার এই অবস্থায় আমি কিছুতেই ওনাকে লম্বা ছুটি নেবার কথা বলতে পারছিলাম না। বিশ্বাস করুন আমি বিয়ে প্রায় তিন মাস পিছিয়ে দিলাম যাতে ওনার ব্যবসার কোনও ক্ষতি না হয়।

-তারপর?

- উনিই কী ভাবে বুঝতে পেরেছিলেন যে আমি কিছু একটা ওনাকে বলতে পারছি না। তারপর আমার আঙ্গুলে হীরের আংটি দেখে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন যে আমার বিয়ে কবে। তারপর কথায় কথায় বুঝতে পারলেন যে আমি ওনার কাছে ব্যাপারটা লুকোতে চাইছি। উনি ভীষণ রাগারাগি করলেন। বললেন এটা আমার করা উচিৎ হয়নি এবং আর দেরি না করে বিয়েটা সেরে ফেলতে। না হলে, উনি আমাকে আর অফিসে আসতে দেবেন না। এমন মানুষ আজকের দিনে সত্যিই পাওয়া যায় না।

-যখন তুমি ওখানে ছিলে তখন রেবা কৈরালার কথা শুনেছিলে?

-না, রেবা কৈরালা পরে এসেছে। আমি যখন ছিলাম তখন কালীকৃষ্ণের প্রেম চলছিল এলিনা রাইএর সঙ্গে। কিন্তু সম্পর্কটা আস্তে আস্তে ভেঙে যাচ্ছিল বলে শুনছিলাম। ঘন ঘন সুন্দরী মেয়েদের প্রেমে পড়া কালীকৃষ্ণের স্বভাব। পরে শুনলাম রেবা কৈরালা বলে এক সুন্দরীর আগমণ ঘটেছে কালীকৃষ্ণের জীবনে। তাই এই ভাঙন এলিনার সঙ্গে ভালোবাসার। কালীকৃষ্ণের অনুরোধে স্যার এলিনাকে চাকরিতে বহাল করেন। অফিসের শোভা বৃদ্ধি করা ছাড়া আর কোনও কাজে আসেনি এলিনা। নীতিজ্ঞানহীন এবং নাকউঁচু এক মহিলা। টাইপ করা ছাড়া আর কিছু ওর আসেনা। সারাদিন টিভি আর ভিডিওতে সুন্দরী সেক্রেটারিরা কীরকম পোষাক পরে, কীরকম সাজগোজ করে সেইসব দেখে দেখে সময় কাটায়।

-তাহলে, কৃষ্ণকালীর ব্যবসা কী করে সামলাচ্ছে এলিনা?

-আমিওতো সেটাই জানতে চাই।

-আমার মনে হয় কৃষ্ণকালী কাঠমান্ডুতে আছে। কাঠমান্ডুতে গেলে সাধারণত কোথায় থাকে কৃষ্ণকালী?

মনীষা কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল,’ সাভেরা মোটেলে থাকার সম্ভাবনা নব্বই শতাংশ। ওটা অপেক্ষাকৃত নতুন কিন্তু খুব ভালো বলে শুনেছি। আমি বারদুয়েক বুকিং করে দিয়েছিলাম। কিন্তু এলিনা অবশ্যই জানবে স্যার কোথায় উঠেছেন।

-এলিনা বলল ও কিছু জানেনা।

মনীষা ঘাড় নেড়ে বলল,’ হতেই পারেনা। স্যার বাইরে থাকলেও সবসময়ে অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। এমনকি যখন উনি কাউকে না জানিয়ে কোথাও যেতেন তখনও কিন্তু আমার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। আমাকে জানিয়ে রাখতেন প্রয়োজনে কোথায় ওনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারব।‘

-কিন্তু এলিনা বলল এই ব্যাপারে ও সম্পূর্ণ অন্ধকারে। অবশ্য সত্যি কথা নাও বলতে পারে। হয়ত ইচ্ছে করেই জানাল না।

-মিথ্যে বলছে বলেই আমার মনে হয়, মিঃ রায়।আমি আপনাকে এতটুকু প্রভাবিত করতে চাইনা। আপনি নিশ্চয়ই বোঝেন বিয়ের পর একটা মেয়ের অনেক পরিবর্তন হয়। বাড়িতে অনেক বেশি সময় দেবার দরকার হয়। সম্পূর্ণ নিজের সংসার। সব দায়িত্ব নিজের। তবুও ওই অবস্থায় স্যারকে একেবারে ছেড়ে যাবার কথা ভাবিনি। আমি স্যারকে বলেছিলাম সময় করে মাঝেমধ্যে এসে আমি এলিনাকে আস্তে আস্তে সব বুঝিয়ে দেব যাতে কোনও অসুবিধে না হয়। কিন্তু এলিনা কোনও আগ্রহ দেখাল না। আমি চলে এলাম। ভাবলাম কিছু দরকার হলে নিশ্চয়ই ফোন করবে।তার পরেও ফোন এলনা দেখে একদিন ওই অঞ্চলে কিছু কেনাকাটা সেরে ভাবলাম হাতে যখন একটু সময় আছে অফিসে গিয়ে স্যারের সঙ্গে একবার দেখা করে আসি, অনেকদিন দেখা হয়নি। স্যারের যদি কোনও সাহায্যের দরকার হয় জিজ্ঞাসা করে দেখতে পারি। কিন্তু এলিনা আমার সঙ্গে বাইরের লোকের মতই ব্যবহার করল। বলল স্যারের সঙ্গে দেখা হবে না। উনি নাকি জরুরী মিটিংএ আছেন। ফিরে এলাম। প্রায় দু’মাস পরে আবার একদিন কী মনে হল অফিসে গেলাম। সেদিন এলিনা আমার সঙ্গে একটু বেশি ভদ্রতাই করল। প্রায় দশ পনের মিনিট বসে রইলাম। এলিনার সঙ্গে টুকটাক কথা চালাচ্ছিলাম। ও কিন্তু স্যারকে জানালই না যে আমি দেখা করতে এসেছি। আমি আর এ নিয়ে কথা বাড়াতে চাইলাম না।ফিরে এলাম। ভাবলাম যদি দরকার হয় স্যার নিশ্চয়ই আমাকে ফোন করবেন।

-ফোন এসেছিল?

মনীষা রাগে খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল,’ আমি নিশ্চিত যে আমি চলে আসার পর অন্তত একশ’ সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে ওরা যেখানে আমার সাহায্য দরকার ছিল।আমি বুঝতে পারি ঐ নাটুকে, ন্যাকা এলিনা কেন আমাকে ফোন করেনি কিন্তু আমি সত্যিই বুঝতে পারিনা কেন স্যার আমাকে ফোন করলেন না? যে খবরটা আমার দিতে এক সেকেন্ডও লাগবে না সেই খবর এলিনা ফাইল ঘেঁটে খুঁজেই পাবে না, খবর দেওয়া তো দূরের কথা। কোথায় কোন ফাইল আছে তাই ও ভালো করে জানেনা।

- তুমি কৃষ্ণকালীকে তারপর কখনও ফোন করনি?

-না। আমি ভেবেছিলাম দরকার হলে স্যার আমাকে ফোন করবেন। আমি চাইনি ঐ মেয়েটা তৃতীয়বারের জন্য আমাকে হেনস্তা করুক।

-বেশ, আজ তাহলে আমি আসি। তুমি মাঝেমধ্যে ফোন কোরো। আবার সব স্বাভাবিক হয়ে গেলে আমাদের অফিসে এসো। আমি এবং সুন্দরী খুব খুশি হবো তুমি এলে।ভালো থেকো।আশা করি সবকিছু ভালোয় ভালোয় মিটে যাবে।

-নিশ্চয়ই আসবো। খুব ভালো লাগলো আপনার সঙ্গে অনেকদিন পর দেখা হয়ে।খুব ভালো থাকবেন।

মনীষা দরজায় দাঁড়িয়ে রইল যতক্ষণ না পানু রায় অপেক্ষারত ট্যাক্সিতে উঠে অফিসের দিকে রওনা দিলেন।

0 comments:

0

গল্প - সনাতন সিংহ

Posted in



















।। ১ ।।

কোজাগরী জোৎস্না।মাথার উপর থালার মতো চাঁদ। রুপোলি আলোর প্লাবনে হাবুডুবু খাচ্ছে সারা গ্রাম।গাছগাছালি,ঘর-বাড়ি,মাঠ-ঘাট জ্যোৎস্নায় বিভোর। খিলখিল করছে সর্বত্র।তার আভায় পাড়ার খেলার মাঠও এখন টইটুম্বুর।বউ-ঝি,ছেলে-পুলে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সেখানে।গোটা মাঠ এখন কয়েকটা ভাগে সীমানা তৈরি করেছে।

এই কোণে বউ-ঝিরা।

বউ-বসান্তি খেলছে। ঐ তো, একটা মেয়ে

কিৎকিৎ কিৎকিৎ করে, বউয়ের মাথা ছুঁয়ে, দৌড়ে তাড়া করছে অপর পক্ষের মেয়েটাকে।সেও আঁক-কেটে, বাঁক-কেটে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।তার দলের অন্যরা তখন বউকে মুনে আছে,যাতে উঠে পালাতে না পারে!

মাঠের মাঝে ছেলে-পুলের দল।

কাবাডি খেলছে। অন্যের কোর্টে ঢুকে একজন লাফাচ্ছে আর কাউকে ছুঁয়ে পালিয়ে আসার আপ্রাণ চেষ্টা করছে

-কাবাডি,কাবাডি…

-ভোলা, মেরেই আসবি। দম ফেলবি না। যাহ, মেরে এলেই আমার শালী তোর… মার ভোলা। মেরে আয়য়য়য়…

উত্তর দিকটায় মাঝবয়সীরা গল্প-গুজবে মশগুল।কারো কারো হাতে বিড়ির আগুন জ্বলজ্বল করছে। চাঁদের আলোয় তাদেরই একটা দল আবার তাস খেলছে।

রাস্তার কোলটা বয়স্কদের।ইটের রাস্তায় বসে, পা ঝুলিয়ে আছেন মাঠে।একথায় সেকথায় তাঁরাও চন্দ্রতাপে বার্ধক্যকে বারবার ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন এমন ফেলে আসা কোজাগরী রাতে।

এ গ্রামের বাড়ি বাড়ি লক্ষ্মীপুজো। বলতে গেলে প্রায় সবাই রাত জাগে। ভরা জ্যোৎস্নায় সারারাত খেলে, হুল্লোড়ে, গল্প করে কাটিয়ে দেয়। এটুকুতে সবার ছাড়।কেউ কাউকে বকেও না।এ রাতটার জন্য সমবচ্ছর অপেক্ষা করে তারা।

সন্ধ্যা থেকেই হরিনামের দল, বাড়ি বাড়ি গান গেয়ে বেড়ায়। দু'পাড়ার দুটো দল।যেমন পুরোহিত নিয়ে কাড়াকাড়ি,তেমনি ঐ গানের দলের। পুরোহিত না পেলে নিজেরাই সেরে নেয়,কিন্তু হরিনামের দল লাগবেই।বলতে গেলে তারা সারারাত গান গেয়ে, সব বাড়ি তাই শেষ করে উঠতে পারে না। কার বাড়ি আগে যাবে? সেই নিয়ে রাগারাগি। তবুও পুজোর উপাচার নিয়ে অপেক্ষা করে। কি করবে? হরিনামের দল ছাড়া যে পুজো সম্পূর্ণ হয় না।অগত্যায়,অপেক্ষা করতে করতে কারো চোখ ঢুলুঢুলু। 'পুজো দেখব', 'পুজো দেখব' করে বাচ্চারা ঘুমিয়ে পড়ে শেষে। তবে সারারাত খোল-করতালের আওয়াজের সঙ্গে তাদের সমবেত ক্লান্ত গানও বাতাসে ভেসে ভেসে বেড়ায়।

রাস্তায় লোকজনেরও কমতি থাকে না। এপাড়া ওপাড়া থেকে কচিকাঁচা তো আছেই, সঙ্গে বউ-ঝি-বুড়িরা। প্রসাদ, নাড়ু তো তারা নিচ্ছেই, সঙ্গে কোনো কোনো বাড়ি থেকে বিলিয়ে দেওয়া বাতাসা-খই-মুড়ি। কারো কোঁচড়ে, কারো বা পুটলিতে।

পীযুষদের বাড়ির পুজো-বাতাসা-খই-মুড়ি বিলিয়ে দেওয়া হয়ে গেছে। লুচি, ছোলার ডাল খেয়ে এসে সে সবেমাত্র মাঠে পা দিচ্ছিল।

অম্লান দৌড়ে এল তার কাছে। হাঁপাচ্ছে।

-ও-দা, যা-যাবে না?

-কোথায় রে?

-সে-সেই, ব-বলেছিলে না !

-অহ! কিন্তু এখন তো অনেক রাত !

-তাতে কি হয়েছে? দিনের আলোর মতো তো দেখা যাচ্ছে সব। চলো…

-হ্যাঁরে, পটকা নেই এখানে? ওকেও নয় ডেকে নে?

-দুর, চলো তো।আর কাউকে জোড়াতে হবে না।

আজ লক্ষ্মীপূজোর বাজার করে ফেরার সময় পীযুষ দেখেছিল ব্যাপারটা। সাইকেল থেকে নেমে মাঠের দিকে তাকিয়ে ছিল অপলকে।

-এ মাঠে শালতি নৌকা? তেলেডোঙা ছাড়া এ বস্তু তো দেখা যায় না! এল কোথা থেকে? মাঠের টলটলে জলে শালতিটা তরতর করে চলছে।

-আরে, ওঠা কে? বারুণকা' না?

ধজি জলের ভেতরে চেপে ধরে নৌকার এক মাথা থেকে অন্য মাথায় হেঁটে যাচ্ছে।আবার তুলে নিয়ে সামনের দিকে হেঁটে যাচ্ছে।

তখনই মনটা নেচে ওঠে...

-আজ রাতে যদি ঐ নৌকায় চড়ে সারা মাঠটা ঘোরা যায়? ওহ ,কি যে আনন্দ

হবে! জোৎস্না রাত।ফুরফুরে হাওয়া।জলের ঝিকমিকি !

ওহ,আর সে ভাবতে পারছে না।

-নাহ, আজ রাতে আসতেই হবে। যার নৌকা হোক, আমি চাইলে বরুণকা না করবে না।

পথে অম্লানের সঙ্গে দেখা।তাকেই একথা সে বলেছিল।

-ও দা, নৌকা দেবে তো?

-চল না দেখি।আমি চাইলে হয়তো না করবে না। কিন্তু…

-কিন্তু কি?

-ভরা পূর্ণিমা।তায় আবার এত রাত।

-কার নৌকা জানো?

-না। তবে শুনলাম নাকি রাতে পাহারা দেবার জন্য ওটা ভাড়া করেছে।মাঠে নাকি কারা বেশ কিছুদিন জাল পাতছে। মাছ চুরি হচ্ছে খুব। তাই কাল থেকে রাতে পাহারা দেওয়া শুরু করেছে।

-কারা ভাড়া করেছে?

-আরে, ঐ, স্বর্নজয়ন্তী স্ব-রোজগার যোজনার যে গ্রূপ আছে না,তারাই।ওরাই তো মাছ চাষ করেছে।

কথা বলতে বলতে তারা এখন এপাড়ায়। বরুণদের উঠোনে।

-এরা তো ঘুমিয়ে পড়েছে!

-হ্যাঁ।তাই তো।চল… ফিরে যাই।

-একবার নয় ডেকেই দেখো না? যদি…

-বলছিস। কিন্তু… দাঁড়া, একবার ডেকেই দেখি।…কাকা। ও… কা… কোমর সমান মাটির বারান্দা।একটা বিছানা পাতা রয়েছে। মশারিও খাঁটানো।

ভেতরে কেউ একজন শুয়ে আছে মনে হয়।

পীযুষ হতাশ হয়ে পড়ল।

-নারে, সাড়া দিল না।

-আর একবার ডাকোই না।

আশাভঙ্গের ভয়ে পীযুষ অম্লানের কথা রাখল।

-কাকা, ও কাকা… জেগে আছো? কাকা…

মশারির ভেতর থেকে বিরক্তিকর গলা ভেসে এল

-কে পলাশ? আরে, একটু শুতে দে। ক'টা বাজে? এক্ষনি ডাকছিস?

-সবেমাত্র চোখটা জুড়ে এসেছে।এসে হাজির হলি।

ইতস্তত করছে পীযুষ। আমতা আমতা করে উঠল।

-কা-কাকা আ-আমি। পীযুষ।

এবার মশারির বাইরে মুন্ডুটা বেরিয়ে এল।

-এত রাতে? তোমার তো সেই সন্ধেয় আসার…

-না… মানে… আসলে…

-তোমার কাকীমা তো তোমার জন্য অপেক্ষা করেছিল, যদি আসো। এই তো কিছুক্ষণ আগেই শুয়ে পড়ল।দাঁড়াও।ডাকি?

-না, না। আসলে আমি… নৌকা চড়ব বলে… একটু দেবে?

-দেখো কান্ড!

-দাও না, কাকা… কি বলবে পীযুষকে? মেয়েটা তার কাছে পড়ে। পাড়ার আর পাঁচটা ছেলের মতো নয় সে। বেশ মেধাবী। কলেজে পড়ছে। নিজের খরচা নিজেই চালায় টিউশন করে। বাজে নেশাও নেই।গ্রামে একটা সুনাম আছে তার।ব্যবহারও ভালো। অনেকেই তাকে স্নেহ করে। বরুণও তাদের মধ্যে একজন। নিজের পাড়ার ছেলেরা বলেছিল

-আজ রাতে নৌকাটা দিও। একটু ঘুরব।

কিন্তু তাদের ভাব-গতিক ভালো ঠেকেনি বরুণের।মাল-খেয়ে কোথায় আবার বিপদ বাধিয়ে বসবে… তাই তাদের না করে দিয়েছে। কিন্তু পীযুষ তো তাদের থেকে আলাদা। কি যে বলবে? ভাবছে।

-ও কাকা,কি হল? দাও না…

-ঠিক আছে। এই দেখো, চাবিটা আবার কোথায় রাখলুম?

টর্চ জ্বেলে বিছানা হাতড়াচ্ছে।

-কিন্তু আমাদের তো আবার একটু পরেই বেরতে হবে… আচ্ছা… সে নয় দেখব'খন।

চাবিটা নাও। কিন্তু মাঠের মাঝখানে যাবে না। বড় বড় পুকুর। বেশ গভীর। আর ঐ পোতাগুলো ভালো নয়। দূরে থেকো। আর সাবধান, ঘোর পূর্ণিমা কিন্তু। সঙ্গে আমি নয় যেতুম। কে আছে আর? সবেমাত্র শুয়েছি। চোখ জ্বালা জ্বালা করছে। একটু না ঘুমলে…

-আমি আর অম্লান। ঠিক আছে,

মনে থাকবে।

চাবিটা হাতে নিল পীযূষ। আহ্লাদে তাদের পা যেন মাটিতে পড়ছে না। এগিয়ে গেল রাস্তার দিকে।

দুটো বাড়ির পরেই মাঠ। শালতিটা শিকল দিয়ে রাস্তার গাছের সঙ্গে বাঁধা। তালা লাগানো।

অম্লান আগেই উঠে গেছে। পীযুষ তালা খুলে শিকল ছুঁড়ে দিল নৌকায়। দু-হাতে নৌকা ঠেলে লাফিয়ে পড়ল তার খোলে।


।। ২ ।।

তিনটে গ্রাম। তাদেরকে জুড়ে আছে তিনটে রাস্তা। রাস্তা জুড়ে গাছ আর গাছ। আর তাদের মাঝে কয়েকশ বিঘে জমি ঘিরে এই বিশাল মাঠ। মাঠে কয়েকটা পুকুর। সুতিখাল। সবটা জুড়েই ফিসারি।

পঞ্চায়েতের সহযোগিতা আছে বলে মালিকদের সঙ্গে কোনো-প্রকার আলোচনা ছাড়াই এই মাছচাষ। ইনকাম হলে নাকি রাস্তার কাজে লাগাবে। তাই কাউকে একটা পয়সাও দেয়নি। বর্ষায় অনেকেই জাল পেতে মাছ ধরত। সেটাও বন্ধ। তা নিয়ে অনেকের ক্ষোভ। সকলের সন্দেহ লাভের টাকা নাকি ওরাই মেরে দেবে। তাই লোক চুরিচামারী করে, জাল পাতে।

মাঠের কোথাও এক-মানুষ জল। কোথাও বেশি। দু-এক জায়গায় শোলা-চাষ। ধানগাছ নেই বললে চলে। বর্ষায় সব হেজে গেছে। কোথাও কোথাও ঘাস আর ঘাস। বাদ বাকিটায় কেউ যেন রুপো গলিয়ে ঢেলে দিয়েছে। তবে সারা মাঠের বুকে দুটো উঁচু পোতা, তাল-খেজুর-বাবলাকে বুকে নিয়ে দ্বীপের মতো জেগে আছে তারা।

আলতো আলতো বাতাস বইছে। তিরতির করে ঢেউ উঠছে। তাদের নৌকা চলেছে তরতরিয়ে। আকাশ-গঙ্গায় যেন দুই অচিন নাবিক পরিক্রমায় বেরিয়েছে। এ জলরাশি, নদীর মতো দরাজ বুকে তাদের যেন কাছে টেনে নিয়েছে। নৌকার এক মাথায় বসে আছে পীযূষ। যেন স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্র তার স্বর্গরাজ্যে বিরাজ করছেন। নীরবতায় অবিমিশ্র জ্যোৎস্নায় ধুয়ে যাচ্ছে তার শরীর। অম্লান ধজি চেপে এক প্রান্ত থেকে হাঁটতে হাঁটতে তার কাছে আসছে। প্রত্যেকবার এসে যেন সে প্রণাম ঠুকে যাচ্ছে।

-কিরে অম্লান, কেমন লাগছে বললি না তো?

একটু হাঁপিয়ে গেছে সে। তার প্রাণের মাঝে আনন্দের স্রোত বইছে হু হু করে।

-কি বলব দাদা? পারলে যেন সাঁতার দেই। কি যে ভালো লাগছে! রাতে বাড়ি ফিরব না। ও… বরুণকা যা বলে বলুক। সেই সকালে…

-দূর পাগল। রাতে হিম পড়বে।ঠান্ডা লেগে যাবে।

-ও লাগুক গে।

-লাগুক গে? তারপর তোর বাবা-মা যদি জানতে পারে যে সঙ্গে আমি ছিলাম।আমাকে ছাড়বে?

-ওসব আমি জানি না।

আজ অম্লানকে দেখে পীযুষের খুব ভালো লাগছে।

এই তো ক'দিন আগেই পীযুষই তাকে সবার সামনে মেরেছিল। আর মারবেই না কেন?

তার লেখা চিঠিটা পড়বে তো পড়বে একেবারে সুরমার বাবার হাতে। মেয়েকে প্রেমপত্র? মেনে নিতে পারে? সোজা চলে এসেছিল পীযুষের পড়ানোর জায়গায়। লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে গিয়েছিল

পীযুষের। তার আস্কারাতেই অম্লান নাকি এমন করেছে। এখানে সে নাকি গুপ্ত-বৃন্দাবন তৈরি করেছে! পড়াশোনা বাদ দিয়ে এখানে নাকি এসব শেখানো হয়!

সারা গ্রামে কেউ কোনোদিনই তার দিকে আঙ্গুল তুলতে পারেনি। নিজে অভাব অনটনের মধ্যে দিয়ে এতদূর পর্যন্ত এগিয়েছে।তাও আবার টিউশনি করে। ঠিকমতো মাইনেও দেয় না অনেকেই। তবুও সে কোনোদিন তার দায়িত্ব থেকে সরে আসেনি। অথচ এই লোকটা একঘর ছেলেমেয়ের সামনে তাকে এত বড়ো একটা অপবাদ দিচ্ছে? অপমান করছে?

ডাকিয়ে এনেছিল অম্লানের বাবা-মাকে। তাদের ছেলে এমন করতে পারে সে কথা তারা কিছুতেই বিশ্বাস করছে না।কিন্তু সুরমার বাবা তোড়পে যাচ্ছে সমানে।

অম্লানও কিছুতেই স্বীকার করতে চাইছে না।

প্রথম থেকেই না না করছে। কিন্তু সুরমা? বাবার ভয়ে আর চুপ করে থাকতে পারেনি। সবার সামনে বলেই ফেলল

-হ্যাঁ, ও আমাকে চিঠি দিয়েছিল।

অম্লান মরিয়া হয়ে ওঠে

-এ-এই মি-মিথ্যে কথা একদম বলবি না।

সুরমার পাশেই ছিল পুটু। সে ফুঁসে উঠল।

-মিথ্যে কথা না? ঠিক আছে,এসব বাদ দে। সেদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে তুই ওর গায়ে হাত দেসনি? কিরে বল, এটাও মিথ্যে?

মাথা আর ঠিক রাখতে পারল না পীযুষ। ঠাস ঠাস করে চড়িয়ে দিল অম্লানকে।

-এসব শেখাই এখানে? কিরে? বল? তোর জন্য আমি অপমানিত হব? এতজনের সামনে আমাকে… ছিঃ ছিঃ…

কাল থেকে আর তুই পড়তে আসবি না। বের হ। দূর হয়ে যা…

অম্লানের চোখ বেয়ে টপটপ করে জল পড়ছে। মুখে কোনো কথা নেই। মাথা নিচু করে গ্যাট হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

অম্লানের মা কেঁদে উঠল।

-আর কত জ্বালাবি? তোর জন্য কারো কাছে কি মুখ দেখাতে পারব না? মর না, মর। মরলে তো আমাদের হাড়ে একটু বাতাস লাগে।

-ওহ, তুমি আর গোল পাকিও না। থামো দেখি।

বলতে বলতে অম্লানের বাবা,এগিয়ে গেল সুরমার বাবার কাছে। তার হাত দুটো ধরে বলল

-দাদা, ছেলে মানুষের কাজ। মাপ করে দিও। আমি দায়িত্ব নিচ্ছি, ও আর এমন করবে না। সব ভুলে যাও, দাদা। পাঁচ-কান হলে আরো খারাপ হবে… সুরমা, মা রে, মন খারাপ করিস না।পীযুষ, এখন আসি বাবা, পরে কথা বলব।

সপ্তাখানেক পরে অম্লানের বাবা-মা পীযুষের হাতে ধরে বলেছিল

-বাবা, ওকে একবার ক্ষমা করে দিতে পারো না? স্কুলেও যাচ্ছে না। ঘর বন্ধ করে থাকে। ঠিক মতো খায় না। তুমি একবার আমাদের বাড়িতে যদি যেতে....

-ঠিক আছে কাকিমা, আমি যাবো। এতজনের মাঝে ওকে মেরেছি তো, তাই হয়তো ও খুব কষ্ট পেয়েছে।

অম্লান আবার স্কুলে যেতে শুরু করে। পীযুষ তার সেই দগ্ধ ঘায়ে অল্প অল্প করে প্রলেপ লাগিয়ে দিতে থাকল। সেও পীযুষের আরো কাছের হয়ে উঠল।

এখন দেখলে তা আর মনে হবে না যে, সে ক'দিন আগেই এমন একটা কাজ করেছিল।


।। ৩ ।।

জামা স্যাঁতস্যাঁত করছে। চুল ভিজে ভিজে ভাব। হিম ঝরছে। জোলো হাওয়া বইছে ফুরফুর করে। পীযুষের শীত শীত করছে।

-অম্লান, এবার চল ফিরি। ওরা তো আবার পাহারা দিতে বের হবে। চল।

-আর একটু থাকি না দাদা?

-না, চল অনেকক্ষণ হয়ে গেল। এবার তুই বস। তখন থেকে তো বাইছিস। আমি চালাই।

-তুমি চালাবে? পারবে?

-ধজিটা তো দে.....

-হ্যাঁ হ্যাঁ, নাও। সোজা ঐ পোতায় নিয়ে গিয়ে তোলো। তারপর সেই পুস্কর গুনীনের মতো ভুতে আমাদের আটকে রাখুক সারারাত।

-মন্দ হবে না। কি বলিস?

অন্য গ্রাম ঘেঁষেই চলছিল তারা। পুকুর পাড়ের মাচা মাঠের উপর ঝুলছে, জল ছুঁই ছুঁই ভাব। অম্লান কিছু একটা ধরে টান দিল।

-আরে কি ছিঁড়ছিস? চারদিকে জল। মাচায় কি কোথায় উঠে থাকবে কে জানে?

-ওহ, কত বড় শসা! খাবে?

-না, চল। লোকে খারাপ বলবে।এমন করে?

-তথাস্তু বৎস।

-পাকামি করছিস। ওদিকে বরুণকা'রা হয়তো অপেক্ষা করছে। হ্যাঁ রে সোজা যাব?

অম্লানের মতের অপেক্ষা না করে সোজা বাইতে শুরু করল। পীযুষের অপটু হাতে শালতি এঁকে বেঁকে চলছে। চাইছে সোজা নিয়ে যেতে, কিন্তু বেঁকে যাচ্ছে অন্যদিকে।

অম্লান নৌকার মাথায় ছোট্ট বেদির মতো চৌকোয়, উল্টোমুখ করে বসে, পা ঝুলিয়ে দিয়েছে জলের উপর। পীযুষ নাজেহাল হচ্ছে। সেদিকে তার কোনো খেয়াল নেই। সে আছে নিজের ঘোরে।

অনেকখানি এগিয়ে এসেছে তারা। মাঝমাঠ। পীযুষ অনন্তর পোতা এড়িয়ে যেতে চাইছে, কিন্তু নৌকা যেন সেই দিকেই ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছে। ভয় করছে তার। পোতার লম্বা লম্বা তালগাছগুলো যেন কোন মায়াবলে তাকে টেনে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এখন আর শীত শীত করছে না। পোতার একদম কাছেই এসে পড়েছে।

ধজিটা জোরে চাপল পীযুষ।

-একি! থৈ পেল না কেন? পুকুরে পড়লাম নাতো ?

টান পড়ল ধজিতে। টানার চেষ্টা করছে সে।

-জালে আটকায়নি তো? বোধহয় পুকুরের মুখেই জাল পেতেছিল। একি! ধজিটা নৌকার তলায় ঢুকে যাচ্ছে যে!

প্রাণপনে টানছে সে। জোরে টানতে গিয়ে ঝুঁকে ঝুঁকে পড়ছে।

-অ-অম্লান, আ-আমরা মনে হয় পুকুরে পড়েছি। ধজিটা জালে আটকেছে মনে

হচ্ছে! কিছুতেই ছাড়াতে পারছি না।

পোতার কাছে বড়ো পুকুরের উপর তারা ভাসছে। নৌকা দুলতে দুলতে শ্লথ গতিতে এগোচ্ছে পুকুরের ভেতরে। পীযুষ ঝুঁকে পড়ে ধজিটা টানার চেষ্টা করছে সমানে।

-কই রে? দেখ…

অম্লান এগিয়ে এল পীযুষের কাছ। ধাক্কা মারল সজোরে। ঝপাস করে জলে পড়ল পীযুষ। কেঁপে উঠল পুকুরের জল।

-সবার সামনে আর মারবি আমাকে? বল? সুরমার সামনে তুই চড় মেরেছিলি?

পীযুষ ভুস করে ঠেলে উঠল জলের উপর। হাঁপিয়ে উঠেছে সে। হাত-পা ছুঁড়ে সাঁতরাচ্ছে। নাকে-মুখে জল ঢুকছে।

-এ-এ-এটা কি ক-ক-করলি তু-ই?

সাঁতরে কাছে আসছে সে। অম্লান রাগে ফুঁসছে। হাতে শিকলটা তুলে নিয়ে পাক দিচ্ছে শূন্যে।

তার মূর্তি দেখে পীযুষ শিউরে উঠছে। সাঁতার ভুলে যাচ্ছে সে। তার উপর এই গভীর পুকুর, পোতা, সঙ্গে ভরা পূর্ণিমা-রাত তার শরীরকে অবশ করে দিচ্ছে।

নৌকার কাছে এল পীযুষ। লোহার শিকলটা সপাট করে আড়ছে পড়ল তার মাথায়।

-আ-আ-আ…

ডুবে গেল পীযুষ।

-তোর জন্য স্কুলে সবাই টিটকারী করেছিল। সেই থেকে স্কুলে ঢুকতে পারিনা। রাস্তায় ঘুরে ঘুরে বেড়াই। পাড়ার লোকও আমার দিকে কেমন করে তাকায়। সব, সব তোর জন্য। মর তুই মর…

-অম্লা…

লোহার শিকলের আঘাতে মাথা ঘুরছে পীযূষের। দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। তীব্র যন্ত্রণায় মাথাটা যেন কুঁকড়ে যাচ্ছে। হাত-পা শিথিল হয়ে আসছে। অন্ধকারে সে তলিয়ে যাচ্ছে তো যাচ্ছে…

অম্লানের খিলখিল হাসি ছড়িয়ে পড়ল জোলো মাঠে।

শূন্যে ঘোরানো শিকল আসতে আসতে গতি হারিয়ে নেমে এল তার কাছে। দরদর করে ঘামছে সে।

অপেক্ষা করছে জলের দিকে তাকিয়ে।

নৌকা এখন পুকুরের মাঝখানে ভেসে আছে স্থির হয়ে।

জলের তোলপাড় ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল।

অম্লান জেগে বসে রইল সেখানে।

0 comments: