0

সম্পাদকীয়

Posted in



একজন কবি এক বিপ্লবীর হত্যার প্রতিক্রিয়ায় লিখেছিলেন, 'চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়'। লিখেছিলেন, 'আমারও কথা ছিল হাতিয়ার নিয়ে তোমার পাশে দাঁড়াবার'। সশস্ত্র বিপ্লবের প্রতি সমর্থন কবিতাটির ছত্রে ছত্রে। রাষ্ট্রশক্তি, যা কখনও, কোনও কালে বিপ্লবের হাত ধরতে পারে না, দমন এবং নিপীড়নই কেবল করতে পারে, দ্বিধাহীনভাবে তার বিরোধিতা করেছিলেন সেই কবি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হাতিয়ার কিন্তু তিনি তুলে নিতে পারেননি। দ্ব্যর্থহীন উচ্চারণে তাঁর ব্যর্থতা ঘোষণা করেছিলেন।

সময়টা ছিল ১৯৬৭-র পরবর্তী। বলিভিয়ার জঙ্গলে চে গেভারার শরীরকে রাষ্ট্রের বুলেট ছিন্নভিন্ন করে দেওয়ার পর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছিলেন লাইনগুলি।

প্রায় ষাট বছর পর দেখা গেল হাতিয়ার তুলে নিলেন সত্তরোর্ধ এক কবি। সম্প্রতি স্লোভাকিয়ার প্রধানমন্ত্রী রবার্ট ফিকোর শরীরে নির্ভুল নিশানায় নিজের লাইসেন্সড রিভলবার থেকে পাঁচ - পাঁচটি বুলেট পাঠিয়ে দিলেন ইউরায়ি জিন্টুয়া, যিনি কবি হিসাবে সেদেশে সুপরিচিত। অতীতে বিশ্বব্যাপী দক্ষিণপন্থী আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে বারবার সোচ্চার হয়েছেন তিনি। বাকি সব রাস্তা ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে আসছে বলেই কি আগুনের জবাব আগুন দিয়েই দিতে চাইলেন জিন্টুয়া? তাঁর জীবনের যাবতীয় লিখিত শব্দ যে বার্তাটি পৌঁছে দিতে পারেনি, ওই পাঁচটি বুলেট যে সেই কাজটি সম্পূর্ণ করতে পারলো, এমন ভাবা হয়ত একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে, কিন্তু এক কবি কোনও একদিন যা করতে চেয়েছিলেন, যা না করতে পারা জন্ম দিয়েছিল অবিস্মরণীয় কয়েকটি পংক্তির, সেই অসম্পূর্ণ কর্মটিই যেন নতুন এক মাত্রা পেল এই ঘটনায়।

সুস্থ থাকুন। সৃজনে থাকুন।

শুভেচ্ছা নিরন্তর।

0 comments:

0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - রঞ্জন রায়

Posted in




















“ধর্মাবতার,

আপনি কি জানেন

আমাদের জনগণমনে

আপনার আসন রয়েছে পাতা ঈশ্বরের কাছাকাছি

হয়তো বা ঈশ্বরের দেড় ইঞ্চি নীচে।


অনেক বিলকিস আজও আপনার নামের মালা জপে

প্রতীক্ষায় আছে;

অনেক উঁচুতে আপনি

-- ঈশ্বরের কাছাকাছি,

ঈশ্বরের দেড় ইঞ্চি নীচে”।


কিসসা - ইলেক্টোরাল বণ্ড

[ইলেক্টোরাল বণ্ড নিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। কোন রাজনৈতিক দল কত কোটি টাকার বণ্ড উপহার পেয়েছে এবং কোন কোন কোম্পানি নিজেদের লাভের চেয়েও বেশি টাকা বিশেষ রাজনৈতিক দলকে চাঁদা দিয়েছে –এসব এখন প্রিন্ট এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার কল্যাণে সবাই জানেন।

কিন্তু এর অনৈকতা বুঝতে হলে, অর্থাৎ কীভাবে একটি ঘুষ দেওয়ার প্রকল্পকে আইনের চোলা পরিয়ে দেওয়া হল—সেটা বুঝতে পড়ুন এই লেখাটি]

গত ১৫ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচুড়ের নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চ পাঁচ বছর ধরে লটকে থাকা ‘ইলেক্টোরাল বণ্ড স্কীম ২০১৮’ এর সাংবিধানিক যুক্তিযুক্ততার প্রশ্নে করা রিট পিটিশনের রায় ঘোষণা করে । ওই রায়ে সর্বসম্মতিতে ফাইনান্স অ্যাক্ট ২০১৭ এবং তার অন্তর্গত ওই নির্বাচনী বণ্ড যোজনাটিকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হয় যা তৎকাল প্রভাবশীল হয়।

ঐতিহাসিক রায়টিতে বলা হয় যে কেন্দ্রীয় সরকারের ২০১৮ সালের নামহীন ক্রেতার নির্বাচনী বণ্ড (Electoral Bond 2018) সংবিধানের আর্টিকল ১৯(১) --জানবার অধিকার-- এবং ১৯(১)(ক) -- মতপ্রকাশের অধিকার--এর পরিপন্থী।

অতএব, ওই আইন খারিজ করে স্টেট ব্যাংককে নতুন কোন বণ্ড জারি করতে নিষেধ করা হচ্ছে এবং তাকে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে যে অবিলম্বে আজ অব্দি জারি করা সমস্ত বন্ডের ক্রেতার নাম, কেনার তারিখ, কার জন্যে এবং কত টাকার—সব বিস্তারিত তথ্য নির্বাচন কমিশনের হাতে তুলে দিতে হবে যাতে ওরা আগামী ১৩ই মার্চের মধ্যে ওদের সাইটে সমস্ত তথ্য জনসাধারণের গোচরে পেশ করতে পারে। তাহলে সাধারণ ভোটার, সরকারের পলিসি এবং তার সঙ্গে কোন বিশেষ দানদাতা কর্পোরেট হাউসের স্বার্থ জড়িত আছে কিনা (quid pro quo), সেটা নিজেরা দেখে বিচার করে নির্ণয় নিতে পারবে।

এই রায় পাঁচজন বিচারপতির বেঞ্চের সর্বসম্মতিতে জারি করা হয়েছে। ফলে এর বিরুদ্ধে আপিল হতে পারবে না। বড়জোর সরকার বর্তমান রায়ের পুনর্বিচার (revision) চেয়ে আবেদন করতে পারে। সেটার শুনানি ওই একই পাঁচ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চের কাছে হবে।

উক্ত রিট পিটিশনের চার আবেদনকারীরা হলেন মানবাধিকার সংস্থা The Association of Democratic Reforms (ADR), কংগ্রেস নেত্রী জয়া ঠাকুর, Communist Party of India (Marxist) এবং আরেকটি মানবাধিকার সংস্থা Common Cause।

প্রথম ভাগ

বণ্ডের উদ্দেশ্য এবং বিধেয়ঃ

বিগত ২০১৭ সালের কেন্দ্রীয় বাজেট অধিবেশনের সময় তৎকালীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অরুণ জেটলি ফাইনান্স অ্যাক্ট ২০১৭ বিলের অন্তর্গত এই ‘অনামা দাতাদের ইলেক্টোরাল বণ্ড যোজনা’ লোকসভায় পেশ করেন।

তখন তিনি বলেছিলেন যে রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ফান্ডে দানের ব্যাপারটা স্বচ্ছ না হলে নির্বাচন অসম প্রতিযোগিতা হয়ে যাচ্ছে। আর সবার জন্য সমান খেলার মাঠ ( level playing ground) আমাদের সংবিধানের মূল ভাবনার (basic feature) অনুরূপ। এটি প্রদান করা রাষ্ট্রের কাজ। অথচ বিগত ৭০ বছর ধরে এ’বাবদ কিছুই হয়নি। এবার এই বণ্ডের মাধ্যমে স্বচ্ছতা আসবে, দানদাতারা সুরক্ষিত থাকবে। তাদের অপছন্দের দল জিতে সরকার বানালে প্রতিহিংসা নেবে, ব্যবসায়ে বাধা দেবে –এই ভয় থাকবে না। তাদের পরিচয় গোপন থাকবে এবং তারা নির্ভয়ে নিজের নিজের পছন্দের দলকে চাঁদা দিতে পারবে।

এই বন্ড জারী করার সময় সরকার পক্ষের আরও বক্তব্য ছিল যে এর উদ্দেশ্য রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী প্রচারে কালো টাকার প্রভাব বিদেয় করে সাদা টাকার ব্যবহার প্রচলনে আনা। বিশেষ করে নগদ টাকার ব্যবহার প্রায় বন্ধ করে ব্যাংকের এবং ডিজিটাল মাধ্যমে নির্বাচনী ব্যয়কে স্বচ্ছ করা।

মনে রাখা দরকার, তার মাত্র কয়েক মাস আগে অক্টোবর ২০১৬এর এক রাত আটটায় দু’বছর আগে নির্বাচিত নতুন প্রধানমন্ত্রী ৫০০ এবং ১০০০ টাকার নোটের বিমুদ্রীকরণের (demonitization) নাটকীয় ঘোষণা করেন।

এই নতুন বিত্তীয় ইন্সট্রুমেন্ট হবে ধারক বণ্ড (bearer bond)। এর বৈশিষ্ট্য হবে বিনা সুদের promissory note ধরণের। এগুলো হবে পাঁচ রকম মূল্যের গুণিতকে—একহাজার, দশ হাজার, এক লাখ , দশ লাখ এবং এক কোটির।

দানদাতা স্টেট ব্যাংকের যে কোন শাখা থেকে এই বণ্ড কিনে নিজের পছন্দের এক বা একাধিক রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী তহবিলে সেটি দান করতে পারে।

এই বিল কী করে রাজ্যসভায় পাশ হল? ২০১৭ সালে বর্তমান শাসক দল বিজেপি রাজ্যসভায় একক সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল না তো?

সত্যি কথা। তাই বিলটি রাজ্যসভায় পেশ করা হয় নি। লোকসভায় মানি বিলের মোড়কে পেশ করা হয়েছিল। ‘মানি বিল’এর জন্যে রাজ্যসভার অনুমোদন লাগে না। তবে একে মানি বিলের তকমা দেওয়া কতখানি আইনসম্মত সে’নিয়ে বিতর্ক আছে। এই নিয়ে সুপ্রীম কোর্টে রিট ঝুলে আছে। কিন্তু ইলেক্টোরাল বণ্ড আইনটিই বাতিল হয়ে যাওয়ায় ওই প্রশ্ন এবং পিটিশন হয় তো তামাদি হয়ে গেছে।

কে কিনতে পারে?

দেশের যে কোন নাগরিক বা ভারতে গঠিত কোন কর্পোরেট সংস্থা এটি কিনতে পারে। এমন কি বিদেশের কোন কোম্পানির ভারতে রেজিস্টার্ড কোন সাবসিডিয়ারিও স্টেটব্যাংক থেকে এই বন্ড কিনতে পারবে। এর জন্য কোন আয়কর দিতে হবে না, উলটে ১০০% ছাড় পাবে। আয়কর অধিনিয়মের ধারা 80 GGC অনু্যায়ী রাজনৈতিক দল বা নির্বাচনী ট্রাস্টে চাঁদা দিলে পুরোটাই আয়কর ছাড় পাওয়ার যোগ্য।

তাকে শুধু স্টেট ব্যাংকের কোন শাখায় এই বন্ড কেনার জন্য একটি বিশেষ অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে এবং তার জন্য আবশ্যক শর্ত পূরণ (KYC norms) করতে হবে।

এক ব্যক্তি বা কোম্পানী অধিকতম কত টাকার বণ্ড কিনতে পারে?

--যে কোন পরিমাণ, কোন উর্ধসীমা নেই।

আগে কী ছিল?

---আগে ব্যবসায়ী সংস্থার জন্যে নিয়ম ছিল যে কেবল কোন মুনাফা অর্জনকারী সংস্থাই রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী তহবিলে চাঁদা বা দান দিতে পারে। কিন্তু সেই টাকা কোনমতেই তার মুনাফার ৭.৫% এর বেশি হবে না। কিন্তু ২০১৮ সালের বণ্ডের সময় কোম্পানী অ্যাক্টে সংশোধন করে সেই লক্ষণরেখা মুছে দেওয়া হয়েছে।

ফলে যে কোন সংস্থা, এমনকি যার মুনাফা নেই বা লোকসানে চলছে, সে’ও অসীমিত পরিমাণ রাশির ইলেকশন বণ্ড গোপনে কিনতে পারে। আয়কর বিভাগ বা ইডি কোন প্রশ্ন করবে না।

এই চাঁদার রাশির বিস্তৃত বিবরণ কি কোম্পানীর ব্যালান্স শীটে দেখা যাবে?

--না, শুধু কোন বছরে মোট কত টাকা নির্বাচনী চাঁদা দেওয়া হয়েছে তা দেখাতে হবে; কতভাগে এবং কাকে কাকে কবে দেওয়া হয়েছে সেটা গোপন থাকবে।

এই বণ্ড ভাঙানোর সময়সীমা কতটুকু ?

--১৫ দিন। তারপর সেটি তামাদি হয়ে যাবে।

ওই সময়ের মধ্যে যদি কোন বণ্ড ভাঙানো না হয়, তখন সেই বণ্ডের টাকার কী গতি হবে?

--- সোজা পিএম কেয়ার ফান্ডে জমা হবে।

সত্যিই কি এই বণ্ডের ক্রেতা ও প্রাপকের নাম গোপন থাকে?

ওই বণ্ড কিনতে হলে স্টেট ব্যাংকের কোন শাখায় ‘ডেজিগ্নেটেড অ্যাকাউন্ট’ খুলতে হবে , অর্থাৎ যা শুধু ঐ বণ্ড কিনতেই ব্যবহৃত হবে এবং তার জন্যে KYC norm (Know Your Client) পূর্ণ করতে হবে। ফলে স্টেট ব্যাংকের কাছে ক্রেতার ঠিকুজি কুষ্ঠি পুরো থাকবে, এবং সেই তথ্য দরকারমত সরকারের কাছে পৌঁছে যেতে পারে।

কিন্তু নির্বাচন কমিশন জানতে পারবে না ওই বণ্ডের অন্তিম ‘লাভার্থী’ কোন রাজনৈতিক দল। কে কত টাকার বণ্ড কিনে কোন দলকে কত দিল সেই তথ্য “দাতাদের স্বার্থে” নির্বাচন কমিশনের কাছেও অজানা থাকবে।

আগে কী হত?

--- এর আগে সমস্ত রাজনৈতিক দলকেই তাদের আয়কর রিটার্ন জমা করার সময় নির্বাচনী তহবিলে ২০,০০০/- টাকার চেয়ে বেশি চাঁদা দেওয়া লোকের নামধাম নির্বাচন কমিশনকে জানাতে হত ।

কিন্তু ইলেক্টোরাল বন্ড কিনলে সেসব জানানোর প্রয়োজন নেই। বছরে মোট কত টাকা বণ্ডের মাধ্যমে পাওয়া গেছে সেটা জানালেই হল। বণ্ড ক্রেতার নাম কোনরকমেই ব্যাংক ও রাজনৈতিক দল ছাড়া কেউ জানবে না।

এইরকম “অনামাদাতা” ইলেক্টোরাল বণ্ডকে ২০১৮তে কার্যকরী করতে কোন কোন আইনে সংশোধন করতে হয়েছে?

উপরোক্ত উদ্দেশ্যে ফাইনান্স অ্যাক্ট ২০১৭তে তিনটে গুরুত্বপূর্ণ আইনে সংশোধন করা হয়। যথা, জনপ্রতিনিধি আইন, ১৯৫১ (আর পি এ), আয়কর আইন, ১৯৬১ এবং কোম্পানি আইন, ২০১৩।

জনপ্রতিনিধি আইন, ১৯৫১ ধারা ২৯সি অনু্যায়ী প্রত্যেক রাজনৈতিক দলকে একটি আর্থিক বছরে কুড়ি হাজার টাকার বেশি যত দান পেয়েছে সেটা ঘোষণা করতে হত। বিশেষ করে জানাতে হত যে কোনগুলো ব্যক্তির থেকে পাওয়া আর কোনগুলো কোম্পানির থেকে।

ফাইনান্স অ্যাক্ট, ২০১৭ সংশোধনী জুড়ে দিল যে এই নিয়ম ইলেক্টোরাল বণ্ডের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না।

আয়কর আইন, ১৯৬১ ধারা ১৩ এ (বি) অনুযায়ী রাজনৈতিক দলকে সদস্যদের চাঁদার বাইরে কারও স্বেচ্ছায় দেওয়া চাঁদা বার্ষিক মোট আয়ের মধ্যে গুণতে হবে না। কিন্তু একটি রেজিস্টারে ২০০০০ টাকার চেয়ে বেশি চাঁদার পুরো রেকর্ড রাখতে হবে। তাতে অমন দানদাতাদের নাম-ঠিকানা সব নথিবিদ্ধ করতে হবে।

ফাইনান্স অ্যাক্ট, ২০১৭ সংশোধনী জুড়ে দিল যে এই নিয়ম ইলেক্টোরাল বণ্ডের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না।

কোম্পানি আইন, ২০১৩ ধারা ১৮২(১) অনুযায়ী কোন কোম্পানি একটি আর্থিক বছরে কোন রাজনৈতিক দলকে তার গত তিন আর্থিক বছরের শুদ্ধ মুনাফার (net profit) গড় রাশির ৭.৫% এর বেশি চাঁদা/দান দিতে পারবে না।

ধারা ১৮২(৩) অনুযায়ী সমস্ত কোম্পানি যা যা চাঁদা/দান যে যে রাজনৈতিক দলকে দিয়েছে সব জানাতে বাধ্য, মায় দলের নাম এবং কাকে কত টাকা।

ফাইনান্স অ্যাক্ট, ২০১৭ ওই দুটো ধারাই বাতিল করে বলল যে কোন কোম্পানি কোন রাজনৈতিক দলকে যতখুশি টাকা দিতে পারে, এবং সেইসব গ্রাহক দলের নাম ও কাকে কত টাকা কিছুই জানানোর দরকার নেই। খালি আর্থিক বছরে মোট কতটাকা রাজনৈতিক দলকে চাঁদা দিয়েছে সেটুকু ব্যালান্স শীটে দেখালেই হবে। তাতে ১০০% আয়কর ছাড় পাওয়া যাবে।

সুপ্রীম কোর্ট তাদের বর্তমান রায়ে ফাইনান্স অ্যাক্ট ২০১৭র মাধ্যমে করা উপরোক্ত তিনটি আইনের সংশোধন বাতিল করে আগের স্থিতাবস্থা ফিরিয়ে এনেছে।

২ জানুয়ারি ২০১৮ থেকে গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সর্বাধিক বণ্ড বিক্রি হয়েছে কোলকাতায়। গত ৬ বছরে কোলকাতার স্টেট ব্যাংক অফ ইণ্ডিয়ার শাখাগুলো থেকে বিক্রি হয়েছে ৭৮৩৪ বণ্ড। মুম্বাই ৫৪২৬, হায়দ্রাবাদ ৪৮১২, দিল্লি ৩৬৬২, চেন্নাই ১৮৬৯, গান্ধীনগরে ১১৮৯। সবচেয়ে কম পাটনায়, মাত্র ৮টি।

এই বন্ডের মাধ্যমে কোন রাজনৈতিক দল কত টাকার চাঁদা পেয়েছে?

কিছুদিন ইলেকশন কমিশনের সাইটের নামে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি পোস্ট ঘুরছিল। তাতে দেখান হয়েছে যে সিপিএম দলও ৩৬৭ কোটি টাকার বণ্ডের চাঁদা পেয়েছে। সত্যিটা কী?

--- লাইভ ল’ সাইট অনুযায়ী সুপ্রীম কোর্টে প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচুড় অন্যতম পিটিশনার সিপিএমের উকিল ফরসাতকে প্রশ্ন করেন—এ ডি আর এর রিপোর্ট অনুযায়ী আপনারাও তো কিছু ইলেক্টোরাল বন্ড পেয়েছেন।

ফরসাত—না ধর্মাবতার। আমরা বিবৃতি দিয়ে স্পষ্ট করেছি যে আমরা কোন বণ্ড নিই নি।

গত ফেব্রুয়ারি ১৫ , ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সিট) এর সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি দিল্লিতে সংবাদ সংস্থা এ এন আইকে বলেন যে সিপিএমই একমাত্র রাজনৈতিক দল যে ইলেকশন বণ্ডের মাধ্যমে চাঁদা দেওয়াকে আর্থিক দুর্নীতিকে আইনের জামা পরিয়ে দেওয়া বলে ঘোষণা করে । এমনকি আইন অনুয়ায়ী স্টেট ব্যাংকে যে ডেজিগ্নেটেড আকাউন্ট খোলার কথা তা’ও খোলে নি। বাকি অপপ্রচার। সিপিএমের উকিল চিফ জাস্টিসকে সেটাই বলেছেন। সিপিএম ইলেকশন বণ্ড মামলায় সুপ্রীম কোর্টে অন্যতম পিটিশনার।

Funds received through electoral bonds from 2017-18 to 2022-23

In Rs. Crore

BJP 6566

Cong 1123

TMC 1093

BJD 774

DMK 617

BRS 384

YSRCP 382

TDP 147

Shiv Sena 107

AAP 94

NCP 64

JD(S) 49

JD(U) 24

SP 14


Source: Supreme Court, Created with Datawrapper



দ্বিতীয় ভাগ

আইনের মারপ্যাঁচ

এই বিল তৈরির সময় কোন সরকারি সংস্থা বিত্ত মন্ত্রকের কাছে আপত্তি করেনি?

--করেছে তো! রিজার্ভ ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া ও তৎকালীন নির্বাচনী কমিশন কড়া আপত্তি করেছিল, শোনা হয় নি।

কী তাদের আপত্তি?

রিজার্ভ ব্যাংকঃ বিত্ত মন্ত্রকের সঙ্গে ইলেকশন বণ্ড নিয়ে কয়েক দফা আলোচনার সময় রিজার্ভ ব্যাংক জানুয়ারি ২০১৭ থেকে সেপ্টেম্বর ২০১৭ নাগাদ যে আপত্তিগুলো করেছিল তা মোটামুটি এইরকমঃ

যদি রিজার্ভ ব্যাংক ছাড়া অন্য কোন বাণিজ্যিক ব্যাংককে অমন ধারক বণ্ড (bearer bond instrument) জারি করতে দেওয়া হয় তাহলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিয়ারার বন্ড জারি করার ‘একমাত্র অধিকার’ ক্ষুণ্ণ হয়ে বিত্তীয় অরাজকতা হবে। অধিক সংখ্যায় জারি ইলেকশন বন্ড বাজারে এলে রিজার্ভ ব্যাংকের জারি টাকার উপরে মানুষের আস্থা কমে যাবে।

( নোটঃ রিজার্ভ ব্যাংক সমস্ত টাকা ইস্যু করে এবং সেসবই বিয়ারার বা ধারক বন্ড, ফলে ইলেকশন বন্ডও হাত ফেরতা হয়ে টাকার ভূমিকা পালন করবে এবং তাতে বাজারে টাকার যোগানের ব্যাপারে রিজার্ভ ব্যাংকের কোন নিয়ন্ত্রণ থাকবে না।)

এটা ঠিক যে বণ্ডের প্রথম ক্রেতা এবং শেষ প্রাপ্তকর্তার পরিচয় ব্যাংকের কাছে গোপন থাকবে না, কিন্তু এর মাঝে যত লোকের হাত ফেরতা হয়ে বন্ড ব্যাংকে ফেরত আসবে, তাদের পরিচয় জানার কোন উপায় নেই। এটা প্রিভেনশন অফ মানি লণ্ডারিং অ্যাক্ট, ২০০২ (টাকার বেনামি হাওলা লেনদেনের বিরুদ্ধে সুরক্ষা কবচ), এর নীতির বিরুদ্ধে।

(নোটঃ ধরুন, ক এক লাখ টাকার ইলেকশন বন্ড কিনল, খ তার থেকে ওই বন্ড নগদ এক লাখ পঁচিশ হাজার দিয়ে কিনে নিল। গ তার থেকে ওই বন্ড দেড় লাখ টাকায় কিনে কোন ‘দেশভক্ত’ দলের অ্যাকাউন্টে জমা করে দিল।

ওই লেনদেনের মাধ্যমে ক এবং খ দুজনেই পঁচিশ হাজার করে কালো টাকা নগদে অর্জন করল এবং গ তার দেড় লাখ কালো টাকা সাদা করে ফেলল।)

রিজার্ভ ব্যাংকের শেষ বক্তব্যটি হল যদি সরকারের উদ্দেশ্য হয় যে নির্বাচনী চাঁদা নগদ বা কালো টাকার বদলে আয়কর দেওয়া সাদা টাকার থেকে আসুক, তাহলে সেটা চেক, ডিমান্ড ড্রাফট বা ইলেক্ট্রনিক এবং ডিজিটাল ট্রান্সফারের মাধ্যমেই ভাল ভাবে সম্পন্ন হতে পারে। অহেতুক আলাদা করে ‘বিয়ারার বন্ড’ জারি করা কেন?

সেপ্টেম্বর ২০১৭ নাগাদ, যখন ইলেকশন বন্ডের ফাইনাল ড্রাফট তৈরি হচ্ছিল তখনও রিজার্ভ ব্যাংক তাদের আপত্তিতে অটল ছিল। আশংকা করছিল যে দেশি-বিদেশি শক্তির নকল (‘শেল’ কোম্পানি) এই বন্ড হাওলা লেনদনে ব্যবহার করবে। এছাড়া বাজারে দেশে বা সীমান্তের ওপার থেকে নকল বণ্ড আসার ভয় রয়েছে।

ইলেকশন কমিশন

কেন্দ্রীয় সরকারের ২০১৭ সালের বাজেটে ফাইনান্স অ্যাক্ট পাশ হওয়ার পর ইলেকশন কমিশন মে’ মাসেই বিত্ত মন্ত্রককে চিঠি লিখে তাদের তিনটে আপত্তির কথা জানাল। তাদের আপত্তি ছিল জনপ্রতিনিধিত্ব আইন, আয়কর আইন এবং কোম্পানি আইনে যে সংশোধন করা হয়েছে তাতে রাজনৈতিক দলের বিত্তপোষণ নিয়ে আবশ্যক স্বচ্ছতার উপর বিরাট ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে।

যে সংশোধনের ফলে রাজনৈতিক দলকে ইলেক্টোরাল বণ্ড থেকে প্রাপ্ত বড় বড় চাঁদা/অনুদানের তথ্য দেওয়া থেকে ছাড় দেওয়া হয়েছে তা একটি প্রতিগামী কদম (retrograde step) সেটা রদ করতে হবে। কারণ, ওটা আবশ্যক স্বচ্ছতার জন্য ক্ষতি করবে।

কোম্পানি আইনে সংশোধনের ফলে কর্পোরেট সংস্থাগুলোকে যে কোন রাজনৈতিক দলকে কে কত চাঁদা দিয়েছে তা গোপন রাখার সুযোগ দেওয়া হয়েছে সেটি বাতিল করে তাদের ‘লাভ-ক্ষতির হিসেবে’ (Profit Loss A/c) সেসব স্পষ্ট করে দেখানোর নির্দেশ দিতে হবে।

আগের নিয়মে একটি কর্পোরেট সংস্থা রাজনৈতিক দলকে মোট কত চাঁদা দিতে পারে তার উর্ধ্বসীমা বাঁধা ছিল। এখন নতুন আইনে কর্পোরেট ফান্ডিং এর অসীমিত ক্ষমতা দেওয়ায় শেল কোম্পানির মাধ্যমে রাজনৈতিক বিত্তপোষণে কালো টাকার ভূমিকা বেড়ে যাবে।

সুপ্রীম কোর্ট বর্তমান রায়ে সরকার পক্ষের যুক্তি না মেনে উপরের আশংকাগুলোর সম্ভাবনাকে স্বীকার করে ফাইনান্স অ্যাক্ট ২০১৭তে উপরোক্ত তিনটে আইনের সংশোধনকে খারিজ করেছে।

সুপ্রীম কোর্টের মূল বক্তব্যঃ

এই বন্ড ভোটারের প্রার্থীর সম্বন্ধে জানবার এবং স্বাধীন বক্তব্য ও মতপ্রকাশের মৌলিক অধিকার -- আর্টিকল ১৯(১)-- হনন করছে।

এই বণ্ডের বা সরকারের উদ্দেশ্য যতই মহান হোক, এটা বাস্তবে আদৌ স্বচ্ছ না হয়ে আরও বেশি অস্পষ্ট (opaque) হয়েছে।

এই বণ্ডে সাধারণ নাগরিকের মৌলিক অধিকারের চেয়ে কর্পোরেট ঘরানার ‘গোপনীয়তা’কে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। একজন ছাত্র, একজন শিক্ষক, কৃষক বা কর্মচারির তুলনায় একজন শিল্পপতি কেন বিশেষ সুবিধে পাবে?

আগে শুধু মুনাফা অর্জনকারী কোম্পানিই নির্বাচন ফান্ডে দান দিতে পারত, তারও মুনাফার উর্ধসীমা ৭.৫% বাঁধা ছিল। এবার সেসব তুলে দিয়ে বিদেশি কোম্পানী , শেল কোম্পানী (জালি) -সবার জন্যে রাস্তা খুলে দেওয়া হয়েছে।

কোন লোকসানে চলা কোম্পানী কেন দান দেবে? কোত্থেকে দেবে? তাও যত ইচ্ছে? অবশ্যই কালো টাকা থেকে। তাহলে নির্বাচনী রাজনীতিতে কালো টাকার প্রবেশের পথ বন্ধ করার বদলে তাকে আইনি জামা পরিয়ে দেওয়া হল। যা সরকারের ঘোষিত উদ্দেশ্যের বিপরীত।

সরকার এটা প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে যে কালো টাকা সাফ করার জন্যে এই ইলেকশন বন্ড জারি করা ছাড়া তাদের কাছে অন্য কোন সহজ এবং স্বচ্ছ বিকল্প ছিল না।

গোপনে বিশাল টাকা কোন কর্পোরেট হাউস কেন দেবে? অবশ্যই বদলে কিছু প্রতিদান (quid pro quo) পাওয়ার আশায়। জনতার জানার অধিকার আছে সরকারের কোন নীতি কি দেশের হিতে নেওয়া হচ্ছে নাকি কোন ব্যবসায়ী ঘরানাকে বিশেষ লাভ পাইয়ে দিতে।

উল্লেখযোগ্য তথ্য হল ২০১৮ সাল থেকে ২০২৩ অব্দি যত বন্ড বিক্রি হয়েছে তার ৯০% এক কোটি মূল্যের। অর্থাৎ এই সবই কেনা হয়েছে খুব বড় বড় কর্পোরেট ঘরানা থেকে।

সুপ্রীম কোর্টের আগের বিভিন্ন রায়ে ( আধার কার্ড, ডিমনিটাইজেশন ইত্যাদি) একটি নীতিকে বারবার জোর দেওয়া হয়েছে। তা হল আনুপাতিক তুলনার পরীক্ষা (Proportionality Test)। অর্থাৎ যদি দুটো মৌলিক অধিকারের মধ্যে বিরোধ বাধে, তাহলে রাষ্ট্রকে কোন দিকে যাওয়া উচিত? যেটায় মৌলিক অধিকারে কম কাটছাঁট হবে সেদিকে। মানে রাষ্ট্র মৌলিক অধিকারে যত কম হস্তক্ষেপ করে তত ভাল। দেখতে হবে ব্যক্তি নাগরিকের গোপনীয়তার অধিকার আর সমাজ, রাষ্ট্র ইত্যাদির সামুহিক কল্যাণে তথ্য জানবার অধিকার—কোনটা বেশি জরুরী।

এখানে প্রশ্ন ছিল দানদাতার গোপনীয়তার মৌলিক অধিকার এবং সাধারণ ভোটারের জানবার মৌলিক অধিকারের মধ্যে তুল্যমূল্য বিচারের। সরকার জোর দিচ্ছিল কর্পোরেট হাউসের দাতাদের গোপনীয়তা রক্ষার দিকে, কিন্তু সুপ্রীম কোর্টের মতে সাধারণ ভোটারের জানবার অধিকার বেশি গুরুত্বপূর্ণ। জাস্টিস খান্না তাঁর আলাদা লিখিত রায়ে বলেছেন—দানদাতার গোপনীয়তা রক্ষা রাষ্ট্রের ন্যায়সংগত লক্ষ্য হতে পারে না এবং ভোটারের জানবার অধিকার রাজনৈতিক ফান্ডিং এর গোপনীয়তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

অতএব এই আইন বাতিল করে স্টেট ব্যাংককে নতুন কোন বণ্ড জারি করতে নিষেধ করা হচ্ছে এবং তাকে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে যে অবিলম্বে আজ অব্দি জারি করা সমস্ত বন্ডের ক্রেতার নাম, কেনার তারিখ, কার জন্যে এবং কত টাকার—সব বিস্তারিত তথ্য নির্বাচন কমিশনের হাতে তুলে দিতে যাতে ওরা ওদের সাইটে সমস্ত তথ্য প্রদর্শন করে জনসাধারণকে সরকারের পলিসি এবং quid pro quo দেখে নিজেরা বিচার করে নিতে পারে।

উপসংহার

এর পর কী হবে?

একটি আলোচনা চক্রে সুপ্রীম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি মদন লোকুর বলেন যে ওই রায়ের নির্দেশগুলো ঠিকমত কার্যকর না হলে এই ঐতিহাসিক রায় একটি ‘অ্যাকাডেমিক এক্সারসাইজ’ হয়ে ইতিহাসে স্থান পাবে।

কেন্দ্রীয় সরকার ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারবে না ঠিকই, কিন্তু একই সাংবিধানিক বেঞ্চের কাছে ‘রিভিশন’ এর পিটিশন দায়ের করতে পারে। তাতে শুনানি সম্পূর্ণ হতে হতে সংসদের আসন্ন সাধারণ নির্বাচন সম্পন্ন হয়ে যেতে পারে।

আর যতদিন রায়ের পুনর্বিচারের আবেদন চলছে, ততদিন ব্যাপারটি বিচারাধীন বলে স্টেট ব্যাংক এবং নির্বাচন কমিশন দাতাদের সূচী জনতার সামনে আনার কাজ স্থগিত রাখতে পারে।

সুপ্রীম কোর্টের থেকে আর কী আশা ছিল?

সুপ্রীম কোর্টের অ্যাডভোকেট কপিল সিব্বল বলেন যে নতুন করে ইলেকশন বণ্ড জারি হবে না বটে, কিন্তু আজ পর্যন্ত যা হয়েছে তাতে শাসক দল বিজেপির কাছে ওই বণ্ড বাবদ ৬৫৬৬ কোটি টাকা গচ্ছিত আছে। সেই টাকা বিজেপিকে, এবং অন্যান্য দল যা পেয়েছে সেটা, ডোনরকে ফেরত করে দেওয়া উচিত।

কারণ, বাতিল হওয়া ইলেকশন বণ্ড আইন যদিও সিভিল আইন তবু ওই বন্ড সুপ্রীম কোর্টের আইন অনুয়ায়ী সংবিধান বিরোধী। অতএব সেই বণ্ড কেনাবেচা সংক্রান্ত আর্থিক লেনদেন বে-আইনি লেনদেনের ফল। সুতরাং অন্তিম প্রাপক অর্থাৎ রাজনৈতিক দলকে সে টাকা ফেরত দেওয়া উচিত। এই আদেশ সুপ্রীম কোর্ট জারি করলে ভাল হত।

আমার টিপ্পনীঃ কোন সামান্য নাগরিক বা বেতনভোগী কর্মচারী যদি সরকারের বা ব্যাংকের ত্রুটিতে অন্যায্য কোন টাকা পায়, বা তার অ্যকাউন্টে জমা হয়—তাহলে সেই টাকা তার থেকে ফেরত নেওয়া হয়। তাহলে এখানে কেন তার ব্যতিক্রম হবে?

এই টাকা দলের ফান্ডে গেছে। কিন্তু ইলেকশন ফান্ডের টাকা নির্বাচনেই খরচ হয়েছে কিনা তার প্রমাণ কী? ডিজিটাল খরচের কথা বলা হলেও নির্বাচনে বেশির ভাগ খরচ—গাড়িভাড়া, ভলান্টিয়ারদের পকেট মানি, খাওয়াদাওয়া, পোস্টার ইত্যাদির পেমেন্টের বেশির ভাগ এখনও নগদে হয়। তাহলে?

প্রাক্তন কেন্দ্রীয় নির্বাচনী কমিশনার এস ওয়াই কুরেশি বলেছেন যে নির্বাচন প্রার্থীর ব্যয়ের উর্ধ্বর্সীমা নির্ধারিত আছে –বিধানসভায় ৫৫ লাখ, লোকসভায় ৯০ লাখ। তাদের নির্বাচন শেষ হলেই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে খরচের হিসাব দাখিল করতে হয়, অডিট করাতে হয়।

কিন্তু রাজনৈতিক দলকে পুরনো আইনেও শুধু নির্বাচনী তহবিলে আয়ের হিসেব বা চাঁদার হিসেব দেখাতে হয়, খরচের নয়, তাহলে?

সুপ্রীম কোর্টের অ্যাডভোকেট কপিল সিব্বলের এবং কুরেশির মতে এই মামলাকে গুরুত্ব দিয়ে সুপ্রীম কোর্ট বিশেষ বেঞ্চ গঠন করেছিল। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে মামলাটা ঝুলিয়ে রাখায় বিজেপি ইলেকশন বণ্ডের মাধ্যমে কর্পোরেট হাউসের থেকে নিয়মিত বিশাল টাকা পেয়ে ২০১৯ এর সাধারণ নির্বাচন এবং পরবর্তী বেশ কিছু বিধানসভা নির্বাচনে অন্যদলের তুলনায় বিষমানুপাতিক দরে খরচ করার সুবিধে পেয়ে গেল।

কিন্তু এতে কুইড প্রো কুয়ো গেম খেলাটি কীরকম?

সিব্বলের মতে অনেকরকম।—একটা চোখে পড়ছে, মাত্র গোটা কয়েক কর্পোরেট হাউসের অধিকাংশ মিডিয়া একের পর এক কিনে ফেলা, সেখান থেকে সরকারকে প্রশ্ন করা সাংবাদিকদের সরিয়ে রাজনৈতিক পরিদৃশ্যের একমাত্রিক আখ্যান নিয়মিত প্রচারিত করা এবং বদলে বিশাল অংকের সরকারী বিজ্ঞাপন পাওয়া।

আর কী হতে পারে?

এই রায়ের ফলে সুপ্রীম কোর্টে সাংবিধানিক প্রশ্নে লম্বিত আরও কয়েকটি মামলার সকারাত্মক (positive) রায়দানের সম্ভাবনা বেড়ে গেল, যেমন পিএম কেয়ার ফান্ডের মামলা। যে ফান্ডে ভারত সরকারের লোগো ব্যবহার হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী , গৃহমন্ত্রীরা পদাধিকারী এবং বিভিন্ন সরকারী সংস্থা ওতার কর্মীদের থেকে দান নেওয়া হচ্ছে সে নাকি ‘প্রাইভেট এনটিটি’! অতএব তার তথ্য চেয়ে সুচনার অধিকার ২০০৫ (আর টি আই) আইনে আবেদন করা যাবে না; সরকারি সংস্থার মত অডিটও করা যাবে না!

প্রাক্তন মুখ্য কেন্দ্রীয় কমিশনার (আর টি আই) যশোবর্ধন আজাদ, আইপিএসের আশা যে ইলেকশন বন্ডের রায়ের ফলে আর টি আইকে আবার পুনর্জীবিত করার দিকে এগুনো যাবে। বর্তমানে ওই স্বতন্ত্র সাংবিধানিক পদটিকে আইন পাশ করিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের বেতনভোগী আমলা বানিয়ে দেওয়া হয়েছে।

চণ্ডীগড়ের মেয়র নির্বাচনের ঘোটালা নিয়ে সুপ্রীম কোর্টের সক্রিয় হস্তক্ষেপের পর ওই সম্ভাবনা একটু বেড়েছে। আশায় বাঁচে চাষা।

0 comments:

0

প্রবন্ধ - প্রমিত বসু

Posted in






‘বিশেষ স্থানে গিয়ে, বিশেষ মন্ত্র প’ড়ে, বিশেষ অনুষ্ঠান ক’রে মুক্তিলাভ করা যায়, এই বিশ্বাসের অরণ্যে যখন মানুষ পথ হারিয়েছিল তখন বুদ্ধদেব এই অত্যন্ত সহজ কথাটি আবিষ্কার ও প্রচার করবার জন্যে এসেছিলেন যে, স্বার্থত্যাগ ক’রে, সর্বভূতে দয়া বিস্তার ক’রে, অন্তর থেকে বাসনাকে ক্ষয় ক’রে ফেললে তবেই মুক্তি হয়; কোনো স্থানে গেলে, বা জলে স্নান করলে, বা অগ্নিতে আহুতি দিলে, বা মন্ত্র উচ্চারণ করলে হয় না।

এই কথাটি শুনতে নিতান্তই সরল, কিন্তু এই কথাটির জন্যে একটি রাজপুত্রকে রাজ্যত্যাগ ক’রে বনে বনে, পথে পথে, ফিরতে হয়েছে।’ - এই ছিল বুদ্ধদেবের সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মূল্যায়ন।

প্রতি ২-৩ বছর অন্তর বৈশাখী পূর্ণিমা ঘুরে ফিরে আসে ২৫শে বৈশাখের আশেপাশেই। তবে বর্ষপঞ্জী অনুযায়ী জন্মদিন কাছে থাক বা দূরে--- শাক্যসিংহের প্রভাব রবীন্দ্রমননে যে কতটা প্রসারিত তা একটু তলিয়ে দেখলেই বোঝা যায়।

যে জীবনদেবতার ধারণা রবীন্দ্রনাথের মধ্যে আমরা দেখতে পাই একদম তরুণ বয়স থেকেই, তার তার উৎস বহুবিধ হলেও তাতে বুদ্ধদেবের ভূমিকা ছিল ভীষণ ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সেই জীবনদেবতা যিনি অন্তর্মুখী। মানুষের রোজকারের জীবনের সঙ্গে, তাদের সুখ, দুঃখ, প্রেম, বিরহ, আনন্দ, ক্লেশের সঙ্গে মিলেমিশে সঙ্গী হয়ে থাকেন। ১৯০৫ সালে প্রকাশিত ভারতবর্ষ গ্রন্থের 'মন্দিরের কথা' প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেন 'বুদ্ধদেব যে অভ্রভেদী মন্দির রচনা করিলেন, তাহারই মধ্যে... মানবের মধ্যে দেবতার প্রকাশ, সংসারের মধ্যে দেবতার প্রতিষ্ঠা, আমাদের প্রতি মুহূর্তের সুখদুঃখের মধ্যে দেবতার সঞ্চার ছড়াইয়া পড়িল'।

বৌদ্ধধর্মের সারমর্মে যে বাসনাহীন ত্যাগ আর বিশ্বনিখিলের প্রতি যে প্রেমের কথা বলা আছে তা ছিল রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব দর্শনের সমভাবাদর্শ। অন্য ধর্মে যেখানে পরম ব্রহ্মকে খুঁজে পেতে ভিন্ন উপায়ের কথা ব্যাখ্যা করা হয় সেখানে বুদ্ধ প্রেমকেই ব্রহ্ম বলে মেনে নিতে বলেন। ক্ষেত্রবিশেষে সে প্রেম কখনও হয় করুণা, কখনও বা মৈত্রী, কখনও বা ক্ষমা। কিন্তু তার মূলে আছে বিশ্ব মানবপ্রেমের কথা। এর সাথে যোগ হয় অহং বা স্বার্থ বিহীন ত্যাগ, যা মানুষকে দিতে পারে এক অনির্বচনীয় আনন্দের উপলব্ধি।

এই দর্শনে প্রভাবিত হয়েই জীবনের প্রথম ভাগেই রবীন্দ্রনাথ পালি ভাষা থেকে বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেন 'ধম্মপদ'। যুগ্মগাথা, চিত্তবর্গ, পুষ্পবর্গ - এই রকম অনেক শাখায় এই অনুবাদ নিঃসন্দেহে বাংলা ভাষাকে নতুন করে সমৃদ্ধ করে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যেটা হলো যে এই অনুবাদে শ্লোকের কাব্যগুণ অটুট থাকে, অথচ বুদ্ধের বাণী এবং দর্শনের কোনো বিচ্যুতি ঘটে না।

ভক্তদের জন্য বুদ্ধের মূল বক্তব্যই ছিল "আত্মদীপো ভব, আত্মশরণ্যে ভব", অর্থাৎ কিনা অন্ধ বিশ্বাসের মধ্যে দিয়ে নয়, নিজেই নিজের প্রদীপ হও, জ্ঞানের দীপ্তি জ্বালিয়ে জ্বলে ওঠো। বিশ্বমানবের স্বার্থে নিজের স্বার্থ বিসর্জন দাও, নিজের ক্ষমতায় আস্থা রাখো, নিজেই নিজের শরণ নাও। বুদ্ধ-নির্দেশ্য এই শরণ বা আস্থার কথা খুব স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে উল্লিখিত রবীন্দ্ররচিত কবিতাগুলোর সারমর্মে।

এই দর্শনের প্রভাব ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে রবীন্দ্রনাথের কবিতায়, গানে, নাটকে, প্রবন্ধে। 'শ্রেষ্ঠ ভিক্ষা' বা 'নগরলক্ষ্মী' কবিতাগুলোর মধ্যে এই স্বার্থ বিহীন ত্যাগের কথা খুব পরিষ্কার করে ফুটে ওঠে। যেখানে রাজ শাসনে নয়, বরং আত্ম উপলব্ধির মধ্যে দিয়ে এই ত্যাগের আনন্দ অনুভূত হয়।

নগরলক্ষ্মী কবিতায় শ্রাবস্তীর ভিক্ষুণী সুপ্রিয়া বৌদ্ধধর্মের করুণা ও সেবার মূর্ত প্রতীক মহান আদর্শে বলেন ‘প্রকাশ করে নতুন করে/ আমার ভাণ্ডার আছে ভরে/ তোমা-সবাকার ঘরে ঘরে।/ তোমরা চাহিলে সবে/ এ পাত্র অক্ষয় হবে।/ ভিক্ষা-অন্নে বাঁচাব বসুধা/ মিটাইব দুর্ভিক্ষের ক্ষুধা।’

'অভিসার' কবিতায় দেখা যায় সেই বিশ্ব প্রেমের বা মানবতার এক রূপ। সন্ন্যাসী উপগুপ্ত পরিত্যক্তা বাসবদত্তার কাছে ফিরে আসে তার সবথেকে কঠিন সময়ে, তার সেবক হয়ে। এখানে উপগুপ্তর প্রেম অহং বর্জিত, তাই সে সেবার মধ্যে দিয়েই আনন্দের সন্ধান পায়।

তেমনি আবার শ্যামা নাটকে বজ্রসেনের 'ক্ষমিতে পারিলাম না যে/ ক্ষমো হে মম দীনতা' আসলে সেই বুদ্ধের সেই ক্ষমাসুন্দর দর্শনকেই নতুন করে প্রকাশ করে।

বুদ্ধের এই সর্বত্যাগী দর্শন যেমন অনেক সাধারণ মানুষকে টেনে এনেছিল বৈদিক আচার-সর্বস্ব ধর্মাচরণ থেকে, তেমনই এতে আকৃষ্ট হতে দেখা যায় তৎকালীন কিছু শাসককে। ধর্মপ্রচারে তথাগতের জন্য ছিল এটা ছিল ব্যতিক্রমী সাহায্য। এমনকি বিম্বিসারের মতো শাসকদের আনুকূল্য বুদ্ধ পেতে শুরু করেন বোধিলাভের অনেক আগে থেকেই। কিন্তু তা বলে যে প্রথম থেকেই এটা সর্বজনগ্রাহ্য হয়েছিল তা কিন্তু নয়। সমাজের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ, বিশেষ করে রাজ পরিবার বা প্রভাবশালী অংশের মধ্যে এর বিরোধিতাও ছিল যথেষ্ট পরিমাণে। হয়তো তার একটা বড়ো কারণ ছিল এর ধর্মচর্চার দিকটা। ব্রাহ্মণ্যবাদের রীতি থেকে বেরিয়ে এসে বা বিলাসবহুল জীবন থেকে নিজেদের বিচ্যুত করে আক্ষরিক অর্থে সর্বত্যাগী হওয়া সোজা কথা নয়।

এই ত্যাগ ও ভোগের দ্বন্দ্বের পরিসরটা রবীন্দ্রনাথ ব্যাপকাকারে দেখিয়েছেন 'নটীর পূজা'য়। যেখানে রাজমহিষী লোকেশ্বরীর হাহাকার বেরিয়ে আসে তার প্রতিটি নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে। তার আনুকূল্যে বৌদ্ধধর্ম প্রবেশ করে রাজপ্রাসাদে, সে নিজে ভিক্ষুদের অন্নবস্ত্র দান করেছে, নিষ্ঠার সাথে তথাগতের থেকে ধর্মোপদেশ শুনেছে। কিন্তু তার বিনিময়ে আজ সে হয়েছে রিক্ত। রাজা বিম্বিসার সিংহাসন ত্যাগ করেন--- একমাত্র পুত্র বুদ্ধের অনুগামী হয়ে ভিক্ষুজীবন বেছে নেয়, তখন সে নিজেকে সর্বস্বান্ত ভাবে। তাই আবার ফিরে যেতে চায় পুরোনো বিশ্বাসে, ক্রোধে অন্ধ হয়ে বলে ওঠে ‘অহিংসা ইতরের ধর্ম। হিংসা ক্ষত্রিয়ের বিশাল বাহুতে মাণিক্যের অঙ্গদ, নিষ্ঠুর তেজে দীপ্যমান। দুর্বলের ধর্ম মানুষকে দুর্বল করে। দুর্বল করাই এই ধর্মের উদ্দেশ্য। যত উঁচু মাথাকে সব হেঁট করে দেবে।’

কিন্তু সেই দ্বন্দ্ব ঘুচে যায় শ্রীমতীর ভক্তি দেখে, নিবেদিত নিষ্ঠা দেখে। মানবতার প্রেম বিতরণের মন্ত্র শ্রীমতী নিয়েছে, তাই শিয়রে মৃত্যু নিয়েও অকুতোভয় শ্রীমতি নাচের অর্ঘ্য দান করে বুদ্ধের প্রতি, সব শাসন দূরে সরিয়ে গেয়ে ওঠে 'যা-কিছু মলিন, যা-কিছু কালো/ যা-কিছু বিরূপ হোক তা ভালো,/ ঘুচাও ঘুচাও সব আবরণ।/ হে মহাজীবন, হে মহামরণ,/ লইনু শরণ, লইনু শরণ।'

আর বৌদ্ধ ভিক্ষুরা তখন সমবেত হয়ে গেয়ে ওঠে 'সকল কলুষ তামস হর,/ জয় হ'ক তব জয়,/ অমৃতবারি সিঞ্চন কর/ নিখিল ভুবনময়।'

পথের শেষে সবাই এসে আশ্রয় নেয় বুদ্ধ, ধর্ম, সঙ্ঘের ত্রিশরণে। জয় হয় সেই অহিংসার আর মানবতার।

বুদ্ধের দর্শনে সামাজিক সাম্যের কথা যোগ করে এক নতুন মাত্রা, সরাসরি আঘাত হানে সামাজিক বর্ণভেদের ওপর, যা ভাঙ্গন ধরায় ব্রাহ্মণ্যবাদী প্রতিষ্ঠানিক চিন্তাধারাকে। সেই আঘাতের আঁচ এসে লাগে সমাজের অভিজাত শ্রেণীর ওপর। তাই রাজমহিষী বা রাজকুমারীরা মেনে নিতে পারে না যখন দেখে রাজবাড়ীর নটী পেয়ে যায় বুদ্ধের পুজোর দায়িত্ব আর বুদ্ধের অন্য ভিক্ষু বা অনুচররাও আসে সমাজের অন্ত্যজ শ্রেণী থেকে।

প্রকট সেই বৈষম্যের মাত্রা প্রকটতর হয় ‘চণ্ডালিকা’য় এসে। পৃথিবীতে খুব কম ধর্মই আছে যা মান্যতা দেয় জন্মান্তরবাদকে। হিন্দু আর বৌদ্ধ হয়তো তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য। তবে দুই ধর্মের দর্শনে একটা মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। দুই ধর্মেই জন্মান্তরবাদের সাথে জুড়ে আছে কর্মফল। হিন্দুধর্মে এই কর্মফলের সঙ্গে যেখানে জুড়ে রয়েছে বর্ণভেদ, কিন্তু বুদ্ধের দর্শন কখনই কর্মফলের অজুহাতে বর্ণভেদ বা অস্পৃশ্যতাকে অনুমোদন করেনি।

আপাত সাদৃশ্যের আড়ালে অন্তর্লীন বিরোধের চরিত্র পরিস্ফুট হয়ে উঠতে দেখি ‘প্রকৃতি’র বিদ্রোহে। সে দৃপ্ত ঘোষণায় জানায় সে মানে না এই ধর্ম, বলে, ‘যে-ধর্ম অপমান করে সে-ধর্ম মিথ্যে। অন্ধ ক’রে, মুখ বন্ধ ক’রে সবাই মিলে সেই ধর্ম আমাকে মানিয়েছে।’ মরিয়া হয়ে উঠে বলে, ‘যে-বিধানে কেবল শাস্তিই আছে, সান্ত্বনা নেই, মানব না সে বিধানকে।’ হাহাকার করে বলে ওঠে, ‘যে আমারে পাঠাল এই অপমানের অন্ধকারে, পূজিব না, পূজিব না সেই দেবতারে পূজিব না।’

অন্ধকূপের সেই জীবন থেকে বেরিয়ে আসতে সে আশ্রয় চায় আনন্দের কাছে। আনন্দ তাকে বলে 'যে-মানুষ আমি তুমিও সেই মানুষ; সব জলই তীর্থজল যা তাপিতকে স্নিগ্ধ করে, তৃপ্ত করে তৃষিতকে', আনন্দ তাকে নতুন করে জীবনের অর্থ শেখায়, আশ্বাস দিয়ে বলে 'যে মানব আমি সেই মানব তুমি কন্যা।' প্রকৃতি বিহ্বল হয়ে পড়ে, এক জন্মের মধ্যেই তার আরেক নবজন্ম হয়। আরও একবার জিতে যায় মানবধর্ম।

বুদ্ধের জীবন বা ধর্মীয় দর্শনের বাইরে এসে একটা বড়ো দিক হল প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো। যে কোনো প্রতিষ্ঠানে (এক্ষেত্রে ধর্মও একটা প্রতিষ্ঠান)--- বিশেষত কোনো প্রতিষ্ঠান যখন একজন দূরদর্শী মানুষের তৈরী এবং সেই মানুষটির দূরদৃষ্টি যখন নিজ-দর্শনে প্রতিষ্ঠানটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে নিজের সময়ের থেকে অনেক বেশি যুগ ধরে, তখন অনেক কিছুর মধ্যে--- প্রকট হয় কিছু গুরুতর সমস্যা যা প্রতিষ্ঠানকে অনেকটাই আত্মধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়।

তার মধ্যে অতি পরিচিত অথচ প্রচলিত দিক হল নিয়মের বেড়াজাল। যে নিয়ম ভাঙার প্রথা নিয়ে প্রতিষ্ঠান শুরু করেন হোতাগণ, সময়ের সাথে তাঁরা নিজেরাও বাঁধা পড়ে যান এই নিয়মের বেড়াজালে। এই জালে বুদ্ধদেব নিজে পড়েছেন বারেবারে (ঘটনাচক্রে রবীন্দ্রনাথ নিজেও এর শিকার)। সেই বেড়াজাল কাটানোর কথা, তার অচলাবস্থাকে তুলে ধরেছেন ‘অচলায়তন’ নাটকে।

আবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান যখন সাম্রাজ্যলোভে বুদ্ধের দোহাই দিয়ে অন্য দেশ আক্রমণ করে, তখন সেই ধিক্কারে রবীন্দ্রনাথ লেখেন (‘বুদ্ধভক্তি’):

'জাপানের কোনো কাগজে পড়েছি, জাপানি সৈনিক
যুদ্ধের সাফল্য কামনা করে যুদ্ধমন্দিরে
পূজা দিতে গিয়েছিল। ওরা শক্তির বাণ মারছে চীনকে,
ভক্তির বাণ বুদ্ধকে।'

বোধিসত্ত্বের কথা নিখাদ ধর্মকথা নয়, একে ধর্মের কোনো বেড়াজালে বেঁধে রাখা যায় না। এ মানবতার গোড়ার কথা, যা কয়েক সহস্রাব্দ পেরিয়ে এসেও একই রকম প্রযোজ্য, প্রাসঙ্গিকতা হারায় না এতটুকু। আজীবন তাই সেই বুদ্ধদেবকে লালন করে গেছেন রবীন্দ্রনাথ, কোথাও কোনো বিচ্যুতি দেখলে তার সমালোচনা করেছেন, প্রতিবাদ করেছেন। বুদ্ধদেবের কাছে নিজের অর্ঘ্য সাজিয়েছেন তাঁকে ভারতবর্ষের মহামানবের আখ্যা দিয়ে, যিনি জাতির বাইরে বেরিয়ে মানুষের অন্তরাত্মাকে আহ্বান করেছেন। গানের মধ্যে দিয়ে কবি ব্যক্ত করেছেন বুদ্ধের প্রতি তাঁর চিরপ্রণতি:

'দীনতা হতে অক্ষয় ধনে, সংশয় হতে সত্যসদনে,
জড়তা হতে নবীন জীবনে নূতন জনম দাও হে ॥
ভয় হতে তব অভয়মাঝে নূতন জনম দাও হে ॥'

0 comments:

0

প্রবন্ধ - ইন্দ্রনীল মজুমদার

Posted in






আচ্ছা, ভগবান বুদ্ধদেব কি কৃষক ছিলেন? এই প্রশ্নটা শুনে অনেকেই অবাক হতে পারেন। কিন্তু ঘটনাটি একেবারেই সত্য। সেটাই ভগবান বুদ্ধের জন্মমাসে তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে আমরা এই আশ্চর্যের বিষয়টি এখানে আলোকপাত করব।

সেবার ভগবান বুদ্ধদেব মগধের একনাল গ্রামে ছিলেন। সেই গ্রামে বৃষ্টি হয়েছিল এবং সেটা ছিল ঠিক বীজ বপনের সময়। সকালবেলা যখন পাতাগুলো তখনও শিশিরে ভেজা ছিল। সেই সময় বুদ্ধদেব এক ক্ষেতে গেলেন। সেখানে তখন একজন ধনী ব্রাহ্মণ ছিলেন যাঁর নাম ভরদ্বাজ বা কাশী ভরদ্বাজ। তিনি একজন ব্রাহ্মণ কৃষক হলেও ধনবান ছিলেন কেননা তাঁর পাঁচশো লাঙ্গল দিয়ে চাষ করতেন। তা তিনি একবার তাঁর‌ ফসল উৎসব পালন করছিলেন। সেই সময় বুদ্ধদেব তাঁর ভিক্ষার বাটি নিয়ে খাদ্য ভিক্ষা করতে এলেন ভরদ্বাজের কাছে। তথাগত বুদ্ধ যে সময়ে সেখানে পৌঁছে ছিলেন ঠিক তখনই ব্রাহ্মণ ভরদ্বাজ শ্রমিকদের মধ্যে খাবার বিতরণ করছিলেন। তা, গৌতম বুদ্ধ সেখানে ভিক্ষা পাওয়ার আশায় অপেক্ষা করছিলেন। সন্ন্যাসী গৌতম বুদ্ধকে দেখে বেশ কয়েকজন শ্রদ্ধা জানালো। কিন্তু ব্রাহ্মণ ভরদ্বাজ বুদ্ধের ওপর বেশ অসন্তুষ্ট হলেন ও রেগে গিয়ে বললেন, "ওহে শ্রমণ (বৌদ্ধ বা ভিক্ষু), ভিক্ষা করার চেয়ে কাজে যাওয়া আপনার জন্য ভালো হবে। আমি চাষ করি এবং বীজ বপন করি। আর চাষ ও বীজ বপনের পরে খাই। আপনি যদি একই কাজ করতেন, তাহলে আপনিও খেতে পারতেন। হে তপস্বী, আপনিও চাষ করুন এবং বীজ বপুন, তারপর খাবেন।"

তাঁর এই কথা শুনে তথাগত বুদ্ধ উত্তর দিলেন যে, "হে ব্রাহ্মণ, আমিও আপনার মতো চাষ করি এবং বীজ বপন করি আর চাষ ও বীজ বপনের পরে খাই।"

একজন সন্ন্যাসীর মুখে এই ধরণের কথা শুনে ভরদ্বাজ বেশ অবাক ও কৌতূহলী হয়ে বললেন, " আপনি বলছেন যে আপনি চাষ করেন এবং বীজ বপন করেন। অর্থাৎ, আপনি কি নিজেকে কৃষক হওয়ার দাবি করছেন? কিন্তু, আমি তো আপনাকে চাষ করতে তো দেখছি না। আপনি চাষ করলে, আপনার ষাঁড় কোথায়? বীজ এবং লাঙলই বা কোথায়?"

এই কথার উত্তরে বুদ্ধদেব খুব সুন্দর একটা উত্তর দিয়েছিলেন। তথাগত বুদ্ধ বললেন, "বিশ্বাস হল বীজ যা আমি বপন করি। আমার শিক্ষা, ভালো বা সৎ কর্ম হল সেই বৃষ্টি যা তাকে সার দেয় বা উর্বর করে তোলে। জ্ঞান হল ধুরা এবং নম্রতা হল লাঙল বা লাঙ্গলের ফাল। আমার মন হল নিয়ন্ত্রণকারী লাগাম‌ বা দড়ি। মননশীলতা হল লাঙ্গলের ফাল এবং চালনা। আমি ধর্মের হাত ধরে থাকি। আন্তরিকতা হল আমার ব্যবহৃত ঠেলা। আর চেষ্টা হল আমার টানা গরু। আমি কর্মে, কথায় এবং খাদ্যে সংযত। এই চাষ করা হয় মায়ার আগাছা ধ্বংস করার জন্য। এই চাষ যে ফসল দেয় তা হল নির্বাণের অমর জীবন, এবং এইভাবে সব দুঃখের অবসান হয়।" এই নির্বাণ হল বৌদ্ধ সাধনার চরম পরিণতি বা পরম প্রাপ্তি এবং এই জগতের সমস্ত দুঃখ বা জন্ম-মৃত্যুর যে চক্রাকার তার থেকে মোক্ষলাভের শর্ত। নির্বাণ হল তৃষ্ণা বা জাগতিক সমস্ত চাহিদার বিনাশ। এই নির্বাণ হল সেই পরম অবস্থা যেখানে জন্ম-মৃত্যু, জরা, ব্যাধি, শোক, মনস্তাপ, হতাশা— এসব কিছুর স্থান নেই। এমনকি সেখানে পৃথিবী, সূর্য, গ্রহ, তারা, জল, তেজ, বায়ু, অন্ধকার— কোনও কিছুই নেই। এখানে সংসার স্রোতের গতি যেন রুদ্ধ হয়ে গেছে।

এই কথা শুনে ব্রাহ্মণ ভরদ্বাজের মন গলল। তিনি তাঁর ভুল বুঝতে পারলেন এবং খুব খুশি হয়ে গৌতম বুদ্ধের ওপর সদয় হলেন। তিনি একটি সোনার বাটিতে পায়েস ঢেলে বুদ্ধদেবকে উৎসর্গ করলেন। আর বললেন, "হে মানবজাতির গুরু, এই পায়েস গ্রহণ করুন। কারণ, পরম পূজনীয় গৌতম এমন এক চাষ করেন যা মানবজাতিকে অমরত্বের ফল প্রদান করে।"

কিন্তু গৌতম বুদ্ধ তাঁর শিক্ষার বিনিময়ে খাবার গ্রহণ করতে পারবেন না বলে সেই খাবারটি অস্বীকার করলেন। তখন ধনী কৃষক ব্রাহ্মণ ভরদ্বাজ ভগবান বুদ্ধের পায়ে পড়লেন। আর পায়ে পড়ে তিনি বুদ্ধদেবকে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের দলে যোগ দিতে চান তা জানালেন। এই ঘটনার কিছুকাল পরেই, ভরদ্বাজ অর্হৎ অর্থাৎ নির্বাণ প্রাপ্তিলাভ করেছিলেন।

আসলে, সেই বিখ্যাত একটা গান আছে না - “মন রে কৃষিকাজ জানো না, এমন মানব জমিন রইলো পতিত আবাদ করলে ফলত সোনা।” সেই গানের সূত্র ধরেই বলছি বুদ্ধদেব মানুষের মনের চাষ করতেন। সেই চাষের ফলে যাতে সেই মানুষটি সমাজে একটি সোনারূপে প্রকাশিত হত। দেশ ও দশের কাজে যেন লাগে। অঙ্গুরীমালের মতো ডাকাতকে তিনি নিজের মঠের ভিক্ষু বানিয়ে তাকে স্বাভাবিক মানুষের জীবনে এনেছিলেন। আবার অন্যদিকে একজন পতিতাকেও তিনি ঘৃণা না করে তাকে বৌদ্ধ মঠের ভিক্ষুণী বানিয়েছিলেন। যার সন্ন্যাসে মন নেই সংসারে মন তিনি তাকে সন্ন্যাসী জীবন থেকে আবার সংসারে ফিরে কাজ করতে বলেছিলেন। সন্ন্যাস বা সংসারে যেকোনও মাধ্যমে থেকেই কাঙ্খিত নির্বাণ লাভ করা সম্ভব। তিনি তাঁর অসাধারণ বোঝনোর ক্ষমতা ও আধ্যাত্মিক শক্তির দ্বারা কুব্যক্তিকেও সুপথে চালনা করেছিলেন। তিনি জাতি-ধর্ম-বর্ণ ইত্যাদি যাবতীয় বিভেদ মুছে দিয়ে তৎকালীন ভারতবর্ষের বুকে এক নতুন মানবতার ধর্ম প্রচার করেছিলেন। তাঁর বৌদ্ধ ধর্ম প্রথমদিকে হিন্দুধর্মের থেকে হিংসাত্মক প্রতিরোধ পেলেও এই ধর্মের কিন্তু হ্রাস হয়নি বরং ভারতবর্ষের বাইরেও বিভিন্ন দেশে স্বমহিমায় প্রচারিত হয়েছে। এই ব্যাপক প্রচারের পেছনে রয়েছে সমস্ত ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে উঠে সত্য, অহিংস এবং মানবতার বাণী প্রচার করা। আর এই ধর্ম মানবজাতিকে জানিয়েছে চারটে সত্য কথা বা চতুরার্য সত্য আর সেটা হলঃ- ১) এই জগৎ দুঃখের। ২) এই দুঃখের কারণ আছে আর তা হল তৃষ্ণা বা আকাঙ্খা। এই তৃষ্ণা ইন্দ্রিয় সুখের প্রতি বা জীবনধারণের প্রতি বা যেকোনো কিছুর প্রতি হতে পারে। ৩) সেই তৃষ্ণা নিরোধ বা অবসানের মাধ্যমে দুঃখের নিরোধ বা অবসান ঘটানো সম্ভব। ৪) দুঃখ নিরোধ বা অবসানের জন্য একটি পথ আছে আর সেই পথটি আটটি নীতি নিয়ে গঠিত, যাকে ‘অষ্টাঙ্গিক মার্গ’ বলা হয়।

এই দুঃখ অবসানের মার্গ বা উপায়কে অষ্টাঙ্গিক মার্গ বলা হয়। আর এই আটটি মার্গ একত্রে দুঃখের অবসান ঘটিয়ে নির্বাণলাভের দিকে নিয়ে যাবে। এই আটটি মার্গগুলি একে অপরের ওপর নির্ভরশীল এবং পরস্পর সংযুক্ত হয়ে নির্বাণলাভ করার জন্য এক সম্পূর্ণ পথ সৃষ্টি করে থাকে।

সেই অষ্টাঙ্গিক মার্গ হলঃ-

১) সম্যক দৃষ্টি বা সঠিক উপলব্ধি- এর ফলে চতুরার্য সত্যগুলোর প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করতে পারা যায়।

২) সম্যক সংকল্প- অর্থাৎ, দৃঢ় বাসনা রাখা সত্য বা নির্বাণলাভ করার জন্য।

৩) সম্যক বাক্য- কোনোরকম মিথ্যাকথা, কটু বা কঠোর বাক্য, পরনিন্দা, বৃথা আলাপ ও মূর্খের মতো বাক্যালাপ না করা।

৪) সম্যক আচরণ- কোনোরকম প্রাণীহত্যা, চুরি, অন্যায় ও অসংযম আচরণ থেকে সম্পূর্ণভাবে নিজে বিরত থাকা।

৫) সম্যক আজীব- সুস্থ ও সবল থাকার জন্য সদালাপ ও সদাচারে অভ্যস্ত হয়ে সৎ উপায়ে বা সৎভাবে জীবন ধারন করা। সম্পূর্ণভাবে পাপ ও কলূষমুক্ত হয়ে জীবন কাটানো।

৬) সম্যক প্রচেষ্টা- মনকে শুদ্ধ ও পবিত্র রাখার জন্য সব সময় অন্যায় কাজ হতে বিরত থাকার ও ভালো কাজের চেষ্টা করা।

৭) সম্যক স্মৃতি- দেহ ও মনকে সম্পূর্ণ সজাগ ও সচেতন রাখা।

৮) সম্যক সমাধি- পরিপূর্ণ একাগ্রতা বা সমাধি বা ধ্যান। সমাধির চারটি স্তর আছে এবং শেষ স্তরে গিয়ে নির্বাণ লাভ হয়। এই নির্বাণ অবস্থায় মানুষের যাবতীয় মোহ, চাহিদা, লোভ, তৃষ্ণা বা আকাঙ্খা এবং অবিদ্যা চিরতরে দূর হয়ে যায়। সেই ব্যক্তি জন্ম-মৃত্যুর জাল থেকে মুক্তিলাভ করেন এবং তাঁর সমস্ত দুঃখের অবসান হয়।

এইভাবে গৌতম বুদ্ধ কৃষকরূপে আমাদের মনে সত্য ও নির্বাণলাভের আকাঙ্খার বীজ বপন করে আমাদের যাবতীয় ভালো গুণগুলোর চাষ করে আমাদের প্রকৃত মানবতার পথ দেখিয়েছেন এবং সোনার ফসল ফলিয়েছেন। দুঃখ নামক আগাছাকে একেবারে সরিয়ে আমাদের পরম সুখ বা নির্বাণলাভের পথ দেখিয়েছেন। ভগবান বুদ্ধদেব একজন যেন প্রকৃতপক্ষে মানব-জমিনের অন্যতম সেরা কৃষক।

0 comments:

0

অনুবাদ সাহিত্য - মনোজিৎকুমার দাস

Posted in




















ECONBIZ এ প্রকাশিত অমর্ত্য সেনের লেখা প্রবন্ধ Tagore and his India

বঙ্গানুবাদ - মনোজিৎকুমার দাস



বাংলার কন্ঠস্বর

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯৪১ সালে আশি বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি বাংলার হাজার বছরের সাহিত্যের এক বিশাল ব্যক্তিত্ব। যে কেউ তাঁর বিশাল ও সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচিত আছেন। যে কেউ বাংলাদেশে ও ভারতে ঠাকুরের উপস্থিতি উপলব্ধি করে মুগ্ধ হন।

তাঁর কবিতার পাশাপাশি তাঁর উপন্যাস, ছোটগল্প ও প্রবন্ধগুলো ব্যাপকভাবে পঠিত হয়। তাঁর রচিত গানগুলো ভারতের পূর্বাঞ্চল ও বাংলাদেশের সর্বত্র প্রতিধ্বনিত হয়।

অন্যদিকে, বিশ্বের বাকি অংশে, বিশেষ করে ইউরোপ ও আমেরিকায়, বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ঠাকুরের রচনাগুলো যে উত্তেজনা তৈরি করেছিল তা অনেকাংশে বিলুপ্ত হয়েছে। তাঁর কাজকে একসময় স্বাগত জানানো হয়েছিল উৎসাহের সঙ্গে যা ছিল বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তাঁর কবিতার নির্বাচিত সংকলন গীতাঞ্জলি'র জন্য তিনি ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। সেই বছরের মার্চ মাসে লন্ডনে তা ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত হয়েছিল। পুরস্কার ঘোষণার সময় নভেম্বরের মধ্যে তা দশবার পুনর্মুদ্রিত হয়। কিন্তু তিনি এখন পশ্চিমে খুব বেশি পঠিত নন। ১৯৩৭ সালের মধ্যে, গ্রাহাম গ্রিন বলতে সক্ষম হয়েছিলেন: " আমি বিশ্বাস করতে পারি না যে মিস্টার ইয়েটস ছাড়া অন্য কেউ এখনও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতাগুলোকে খুব গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করতে পারে।"


রহস্যবাদী

বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে ঠাকুরের প্রধান উপস্থিতি ও বাকি বিশ্বে তাঁর প্রায় সম্পূর্ণ গ্রহণের মধ্যে বৈপরীত্য সম্ভবত বাংলাদেশে গভীরভাবে প্রাসঙ্গিক এবং বহুমুখী সমসাময়িক চিন্তাবিদ হিসেবে ঠাকুরের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যের চেয়ে কম আকর্ষণীয়। ভারত ও পশ্চিমে তার ভাবমূর্তি পুনরাবৃত্ত ও দূরবর্তী আধ্যাত্মবাদী হিসেবে। গ্রাহাম গ্রিন আসলে ব্যাখ্যা করতে গিয়েছিলেন যে তিনি ঠাকুরকে "চেস্টারটন যাকে থিওসফিস্টদের 'উজ্জ্বল নুড়ি চোখ' বলে থাকেন। নিশ্চিতভাবেই, ইয়েটস, এজরা পাউন্ড ও তার অন্যান্য প্রারম্ভিক চ্যাম্পিয়নদের দ্বারা পশ্চিমের কাছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের "বিক্রয়" করার পেছনে রহস্যবাদের একটি অনুষঙ্গ কিছু ভূমিকা পালন করেছিল। ঠাকুরের পরবর্তী কয়েকজন ভক্তদের একজন আনা আখমাতোভা । ( তিনি ১৯৬০ এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে ঠাকুরের কবিতাগুলো রাশিয়ান ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন) তিনি বলেছিলেন," কবিতার সেই শক্তিশালী প্রবাহ যা হিন্দুধর্ম থেকে গঙ্গা নদীর মতো শক্তি গ্রহণ করায় তাকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলা হয়।"


সংস্কৃতির মিলন

রবীন্দ্রনাথ একটি হিন্দু জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একজন জমিদার ভদ্রলোক,তাদের বেশিরভাগ সম্পত্তির মালিক এখনকার বাংলাদেশে।

আখমাতোভা'রহিন্দুধর্ম এবং গঙ্গা নদীর আহ্বানে যতই প্রজ্ঞা থাকুক না কেন, তা বাংলাদেশের বৃহত্তর মুসলিম নাগরিকদের ঠাকুর এবং তাঁর ধারণার সঙ্গে গভীর পরিচয়ে বাধা দেয়নি।

এটি সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে ঠাকুরের একটি গান - "আমার সোনার বাংলা" যার অর্থ "মাই গোল্ডেন বেঙ্গল " কে তার জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে বেছে নেওয়া থেকে বাধা দেয়নি।

এটি অবশ্যই তাদের কাছে খুব বিভ্রান্তিকর হতে পারে যারা সমসাময়িক বিশ্বকে "সভ্যতার সংঘর্ষ" হিসাবে দেখেন - "মুসলিম সভ্যতা", "হিন্দু সভ্যতা" এবং "পশ্চিমী সভ্যতা" এর সঙ্গে প্রত্যেকে জোর করে অন্যদের মুখোমুখি হচ্ছে।

"তিনটি সংস্কৃতির মিলন : "হিন্দু, মুসলিম এবং ব্রিটিশ"। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিজের বাঙালি পরিবারের বর্ণনা দেখেও তারা বিভ্রান্ত হবেন।

রবীন্দ্রনাথের পিতামহ দ্বারকানাথ আরবি ও ফারসি ভাষার জ্ঞানের জন্য সুপরিচিত ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ এমন একটি পারিবারিক পরিবেশে বেড়ে উঠেছিলেন যেখানে সংস্কৃত ও প্রাচীন হিন্দু গ্রন্থের গভীর জ্ঞান ছিল। ইসলামী ঐতিহ্যের পাশাপাশি ফার্সি সাহিত্য বোঝার ক্ষমতা তাদের ছিল।

এটা ঠিক নয় যে রবীন্দ্রনাথ বিভিন্ন ধর্মের একটি "সমন্বয়" ঘটানোর চেষ্টা করেছিলেন বা উপস্থাপনে আগ্রহী ছিলেন। (যেমন মহান মোগল সম্রাট আকবর যা অর্জন করার জন্য কঠোর চেষ্টা করেছিলেন) কারণ রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অবিরামভাবে অসাম্প্রদায়িক। তাঁর লেখাগুলোর প্রায় দুই শতাধিক বই ভারতীয় সাংস্কৃতির পটভূমির বিভিন্ন অংশের পাশাপাশি বিশ্বের অন্যান্যদের উপর প্রভাব ফেলেছে।


শান্তির আবাস

১৯০১ সালে বাংলার শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। স্কুলটির চারপাশে গড়ে ওঠে ছোট্ট একটি শহর।

তাঁর বেশিরভাগ কাজ ও লেখালেখি শান্তিনিকেতনে (শান্তির আবাস)বসে করা। তিনি সেখানে শুধুমাত্র কল্পনাপ্রসূত এবং উদ্ভাবনী শিক্ষা ব্যবস্থার ধারণাই করেননি, তাঁর লেখা এবং ছাত্র ও শিক্ষকদের উপর প্রভাবের মাধ্যমে তিনি স্কুলটিকে একটি ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করেন এবং তা শিক্ষকদের উপর প্রয়োগ করতে সক্ষম হন। যেখান থেকে তিনি ভারতের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে একটি বড় অংশ হিসাবে গড়ে তুলতে সফল হন।

তিনি গভীরভাবে একজন মৌলিক লেখক। তাঁর মার্জিত গদ্য এবং জাদুকরী কবিতা বাঙালি পাঠকরা ভাল ভাবেই গ্রহণ করে। তিনি লন্ডনে প্রশংসিত - এবং তারপর প্রত্যাখ্যাত হন। তিনি ধর্মোপদেশকারী আধ্যাত্মিক গুরু নন।

ঠাকুর শুধুমাত্র একজন বহুমুখী প্রতিভার কবি ছিলেন না; তিনি একজন মহান ছোটগল্পকার, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক এবং গানের রচয়িতা, সেইসাথে একজন প্রতিভাবান চিত্রশিল্পী ছিলেন। তিনি তাঁর চিত্রগুলোতে উপস্থাপনা ও বিমূর্ততার মিশ্রণের ঘটান। সেগুলো এখন প্রশংসা পেতে শুরু করেছে যা দীর্ঘদিন আগেই প্রাপ্য ছিল। তার প্রবন্ধগুলি সাহিত্য, রাজনীতি, সংস্কৃতি, সামাজিক পরিবর্তন, ধর্মীয় বিশ্বাস, দার্শনিক বিশ্লেষণ, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও আরও অনেক কিছু নিয়ে বিস্তৃত।

ভারতের স্বাধীনতার পঞ্চাশতম বার্ষিকীতে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস ঠাকুরের চিঠিগুলোর একটি নির্বাচিত অংশ প্রকাশের মাধ্যমে কাকতালীয়ভাবে ঠাকুরের চিন্তাভাবনা ও প্রতিফলনগুলোকে সামনে নিয়ে আসে। এই শতাব্দীর প্রথমার্ধেই ভারতীয় উপমহাদেশ উপলব্ধি করে তিনি চিন্তা ও চেতনার ক্ষেত্রে কী ধরনের নেতৃত্ব প্রদান করেছিলেন।


গান্ধী ও ঠাকুর

বিংশ শতাব্দীতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও মোহনদাস গান্ধী ছিলেন দুইজন প্রধান ভারতীয় চিন্তাবিদ, তাই অনেক ভাষ্যকার তাদের ধারণার তুলনা করার চেষ্টা করেছেন। জওহরলাল নেহরু তখন ভারতের একটি ব্রিটিশ কারাগারে বন্দী ছিলেন ,রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর খবর পেয়ে ১৯৪১ সালের ৭ আগষ্ট তাঁর জেল ডায়েরিতে লেখেন;

"গান্ধী ও ঠাকুর তাঁরা দু'জন একে অপরের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তবুও উভয়ই ভারতের আদর্শ, উভয়ই ভারতের মহাপুরুষদের দীর্ঘ লাইনে … এটি কোনও একক গুণের কারণে নয় বরং বিশেষ গুণের সমাহারের কারণে, আমি আজ অনুভব করছি যে বিশ্বের মহাপুরুষদের মধ্যে গান্ধী ও ঠাকুর মানুষ হিসেবে সর্বোচ্চ ছিলেন। আমার জন্য কত সৌভাগ্য যে তাদের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসতে পেরেছি।”্


রোম্যাঁ রোলাঁ

রোম্যাঁ রোলাঁ ঠাকুর ও গান্ধী'র বৈপরীত্য দেখে অভিভূত হয়েছিলেন। তিনি গান্ধীর উপর তাঁর বইটি সম্পূর্ণ করে তিনি ১৯২৩ সালের মার্চ মাসে একজন ভারতীয় শিক্ষাবিদকে লিখেছিলেন, “আমি আমার গান্ধী বইটি শেষ করেছি। আমি আপনাদের দুই মহান নদী-তুল্য আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছি, যা ঐশ্বরিক আত্মা ঠাকুর ও গান্ধী দ্বারা উপচে পড়া।" পরের মাসে, তিনি তার ডায়েরিতে রেভারেন্ড সি.এফ. অ্যান্ড্রুস লিখিত গান্ধী এবং ঠাকুরের মধ্যে কিছু পার্থক্যের একটি বিবরণ লিপিবদ্ধ করেন। ইংরেজ পাদরি এবং পাবলিক অ্যাক্টিভিস্ট অ্যান্ড্রুস উভয় পুরুষের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন ( দক্ষিণ আফ্রিকা তথা ভারতে গান্ধীর জীবনে যার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রিচার্ড অ্যাটেনবারোর গান্ধী চলচ্চিত্রে [১৯৮২]অ্যান্ড্রুস চিত্রিত হয়েছে)।

অ্যান্ড্রুস রোলাঁকে বলেছিলেন, “আলোচনার প্রথম বিষয় ছিল মূর্তি; গান্ধী মূর্তির পক্ষে ছিলেন , তিনি বিশ্বাস করেছিলেন যে জনসাধারণ তাৎক্ষণিক ভাবে বিমূর্ত ধারণাগুলোর জন্য নিজেদের উপস্থাপন করতে অক্ষম। মানুষকে অনন্তকাল শিশুর মতো দেখতে ঠাকুর সহ্য করতে পারেননি। গান্ধী উদ্ধৃত করেন পতাকা দ্বারা ইউরোপের মহান অর্জন একটি মূর্তি হিসাবে ; ঠাকুর এতে আপত্তি করা সহজ মনে করেছিলেন, কিন্তু গান্ধী তার মাটি আঁকড়ে থাকেন ইউরোপীয় পতাকা বহনকারী ঈগলে উপর একটি চরকা রেখে। আলোচনার দ্বিতীয় বিষয় ছিল জাতীয়তাবাদ, যা গান্ধী রক্ষা করেছিলেন। ঠাকুর বলেছিলেন যে আন্তর্জাতিকতা অর্জনের জন্য জাতীয়তাবাদের মধ্য দিয়ে যেতে হয়।, একইভাবে শান্তিতে পৌঁছতে যুদ্ধের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। "

ঠাকুর গান্ধীকে প্রচুর প্রশংসা করতেন, কিন্তু জাতীয়তাবাদ, দেশপ্রেম, সাংস্কৃতিক বিনিময়ের গুরুত্ব, যুক্তিবাদীতা এবং বিজ্ঞানের ভূমিকা, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের প্রকৃতি সহ বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর সঙ্গে ঠাকুরের অনেক মতবিরোধ ছিল।



রবীন্দ্রনাথ জানতেন যে গান্ধী যে রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তা তিনি ভারতকে দিতে পারতেন না, এবং গান্ধী জাতির জন্য যা করেছেন তার প্রশংসায় তিনি কখনই কৃপণ ছিলেন না (আসলে, ঠাকুরই "মহাত্মা" শব্দটিকে জনপ্রিয় করেছিলেন - মহান আত্মা - গান্ধীর বর্ণনা হিসাবে)। তবুও অনেক কিছুর জন্য গভীরভাবে সমালোচিত ছিলেন গান্ধী । মহাত্মা গান্ধী ভারতের বাইরে অতুলনীয়ভাবে বেশি আকৃষ্ট ছিলেন। ভারতের বেশিরভাগ অংশেই গান্ধী-ঠাকুর বিতর্কের "ঠাকুরের পক্ষ" বোঝা গুরুত্ত্বপূর্ণ ছিল।

তার কারাগারের ডায়েরিতে নেহরু লেখেন, "সম্ভবত ঠাকুর এ সময় মারা যাওয়ায় তাঁকে বিশ্বে ও ভারতে ক্রমবর্ধমান পরিমাপে নিচের দিকে নামার আশংকা ও অনেক ভয়াবহতা দেখতে হয়নি।

তবে তিনি অনেক কিছু দেখেছিলেন ফলে ঠাকুর খুবই দুঃখিত ও অসুখী ছিলেন। "

তার জীবনের শেষ দিকে, ঠাকুর প্রকৃতপক্ষে ভারত রাষ্ট্র সম্পর্কে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েছিলেন, বিশেষ করে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের মতো সমস্যার স্বাভাবিক বোঝা, হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে "সাম্প্রদায়িক" সহিংসতার জন্য রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত উসকানি দ্বারা পরিপূরক হয়ে উঠায়।

১৯৪৭ সালে, ঠাকুরের মৃত্যুর ছয় বছর পরে, দেশভাগের সময় ব্যাপক হত্যাকাণ্ড হয়েছিল।

১৯৩৯ সালের ডিসেম্বরে ঠাকুর তাঁর বন্ধু ইংরেজ সমাজসেবী এবং সমাজ সংস্কারক এলমহার্স্টকে লিখেছিলেন। ভারতে গ্রামীণ পুনর্গঠনে তাঁর সঙ্গে তিনি ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছিলেন ।

সুস্পষ্টভাবে রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাগত আদর্শের প্রতি তিনি অনুরক্ত ছিলেন।

তিনি বলেছিলেন,"লক্ষ লক্ষ মানুষের ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন হওয়ার জন্য একজন পরাজয়বাদীর প্রয়োজন নেই, যারা তাদের সমস্ত সহজাত সংস্কৃতি এবং তাদের শান্তিপূর্ণ ঐতিহ্যের সাথে একযোগে ক্ষুধা, রোগ, বিদেশী ও দেশীয় শোষণ এবং সাম্প্রদায়িকতার প্রচণ্ড অসন্তোষের শিকার হচ্ছে।”

আজকের ভারতকে ঠাকুর কীভাবে দেখতেন? তিনি কি সেখানে অগ্রগতি দেখতে পেতেন, নাকি সুযোগ নষ্ট করা সম্ভবত এর প্রতিশ্রুতি এবং প্রত্যয়ের বিশ্বাসঘাতকতা? একটি বিস্তৃত বিষয়ে, তিনি সমসাময়িক বিশ্বে সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতাবাদের প্রসারে কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতেন?


পূর্ব ও পশ্চিম

তাঁর সৃজনশীল কৃতিত্বের বিস্তৃত পরিসরের পরিপ্রেক্ষিতে, সম্ভবত পশ্চিমে ঠাকুরের ভাবমূর্তির সবচেয়ে বিস্ময়কর দিকটি হল এর সংকীর্ণতা; তাকে বারবার "প্রাচ্যের মহান রহস্যবাদী" হিসাবে দেখা হয়, পশ্চিমের জন্য একটি যুক্তিপূর্ণ বার্তা সহ একটি চিত্র, যাকে কেউ স্বাগত জানাবে, অন্যরা অপছন্দ করবে এবং অন্যরা খুবই বিরক্তিকর বলে মনে করবে। অনেকাংশে এই ঠাকুর ছিলেন পাশ্চাত্যের নিজস্ব সৃষ্টি, পূর্ব থেকে বিশেষ করে ভারত থেকে বার্তা খোঁজার ঐতিহ্যের অংশ, যা - যেমন হেগেল বলেছেন - "ইউরোপীয়দের কল্পনায় সহস্রাব্দ ধরে বিদ্যমান ছিল।" ফ্রেডরিখ শ্লেগেল, শেলিং, হার্ডার এবং শোপেনহাওয়ার ছিলেন মাত্র কয়েকজন চিন্তাবিদ যারা একই প্যাটার্ন অনুসরণ করেছিলেন। তারা প্রথমে তত্ত্ব দিয়েছিল যে, ভারত ছিল উচ্চতর জ্ঞানের উৎস। শোপেনহাওয়ার এক পর্যায়ে এমনকি যুক্তি দিয়েছিলেন যে নিউ টেস্টামেন্ট "কোনওভাবে ভারতীয় বংশোদ্ভূত হতে হবে: এটি তার সম্পূর্ণ ভারতীয় নীতিশাস্ত্র দ্বারা প্রমাণিত, যা নৈতিকতাকে তপস্বী, তাঁর হতাশাবাদ এবং তাঁর অবতারে রূপান্তরিত করে," "খ্রিস্টের ব্যক্তি" এ। কিন্তু তারপরে তারা তাদের নিজস্ব তত্ত্বগুলোকে প্রচণ্ড জোরালোভাবে প্রত্যাখ্যান করেছিল, কখনও কখনও তাদের ভিত্তিহীন প্রত্যাশা পূরণ না করার জন্য ভারতকে দোষারোপ করেছিল।

আমরা কল্পনা করতে পারি যে রবীন্দ্রনাথের দৈহিক চেহারা - সুদর্শন, দাড়িওয়ালা, অ-পশ্চিমী পোশাক পরা - কিছুটা হলেও, তাকে বহিরাগত জ্ঞানের বাহক হিসাবে দেখাতে উৎসাহিত করেছে। ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা, সাহিত্যে প্রথম জাপানি নোবেল বিজয়ী, "এই ঋষি-তুল্য কবি" সম্পর্কে তাঁর মধ্য-স্কুলের দিনগুলোর স্মৃতিকে মূল্যবান করে তুলেছিলেন:

তাঁর সাদা চুল তাঁর কপালের দুই পাশে মৃদুভাবে প্রবাহিত হয়; মন্দিরের নীচের চুলের গোড়াগুলিও দুটি দাড়ির মতো লম্বা ছিল এবং তার গালের চুলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তার দাড়িতে অবিরত ছিল, যাতে সে ধারণা দেয়, আমি তখন যে ছেলেটি ছিলাম, কোন প্রাচীন প্রাচ্য জাদুকরের।

এই চেহারাটি পশ্চিমে ঠাকুরকে একজন অতীন্দ্রিয় কবি হিসাবে চিহ্নিত করার জন্য উপযুক্ত ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের আবির্ভাবের বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে ফ্রান্সেস কর্নফোর্ড উইলিয়াম রোথেনস্টাইনকে বলেছিলেন, "আমি এখন একজন শক্তিশালী এবং কোমল খ্রিস্টের কল্পনা করতে পারি, যা আমি আগে কখনও করতে পারিনি।" বিট্রিস ওয়েব, যিনি ঠাকুরকে পছন্দ করতেন না এবং তিনি যাকে "ওয়েবস যে সমস্ত কিছুর পক্ষে দাঁড়ায় তার মধ্যে বেশ স্পষ্ট অপছন্দ" বলে মনে করেছিলেন। (আসলে, খুব কম প্রমাণ রয়েছে যে ঠাকুর এই বিষয়ে অনেক চিন্তা করেছিলেন) তিনি বলেছিলেন"দেখতে সুন্দর" ছিলেন এবং "তাঁর বক্তৃতায় নিখুঁত স্বর ও নাটকীয় সাধুর ধীর মন্ত্রের মতো সংযম রয়েছে।" এজরা পাউন্ড ও ডব্লিউ.বি. ইয়েটস, অন্যদের মধ্যে, প্রথমে ঠাকুরের পশ্চিমা প্রশংসায় আরাধনার কোরাসের নেতৃত্ব দেন এবং তারপর শীঘ্রই উপেক্ষা এবং এমনকি তীব্র সমালোচনার দিকে চলে যান। ১৯১২ সালে ইয়েটসের তার কাজের প্রশংসার মধ্যে পার্থক্য ("এই গানগুলো ... তাদের চিন্তায় এমন একটি বিশ্ব প্রদর্শন করে যা আমি আমার সারা জীবন স্বপ্ন দেখেছি," "একটি সর্বোচ্চ সংস্কৃতির কাজ") এবং ১৯৩৫ সালে তার নিন্দা ("ড্যাম ঠাকুর") আংশিকভাবে ঠাকুরের বহুমুখী লেখার অক্ষমতা থেকে উদ্ভূত হয়েছিল যে সংকীর্ণ বাক্সে ইয়েটস তাকে রাখতে - এবং রাখতে চেয়েছিলেন। নিশ্চিতভাবেই, ঠাকুর প্রচুর পরিমাণে লিখেছিলেন, এবং অবিরামভাবে প্রকাশ করেছিলেন, এমনকি ইংরেজিতেও (কখনও কখনও উদাসীন ইংরেজি অনুবাদে), কিন্তু ইয়েটসও বিরক্ত হয়েছিলেন, এটা স্পষ্ট যে, ঠাকুরের পরবর্তী লেখাগুলোকে ইয়েটসের কাছে উপস্থাপন করার অসুবিধার কারণে। তিনি বলেছিলেন," ঠাকুর ছিলেন একটি সম্পূর্ণ মানুষ, একটি সম্পূর্ণ সভ্যতার, আমাদের কাছে অপরিমেয় সুন্দর এবং তবুও আমরা আমাদের নিজস্ব চিত্রের সঙ্গে দেখা করেছি, বা শুনেছি, সম্ভবত সাহিত্যে প্রথমবারের মতো, আমাদের কণ্ঠস্বর স্বপ্নে।"

ইয়েটস তার প্রথম দিকের প্রশংসাকে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করেননি (যেমন এজরা পাউন্ড এবং আরও অনেকে করেছিলেন), এবং তিনি দ্য অক্সফোর্ড বুক অফ মডার্ন ভার্স-এ ঠাকুরের কিছু প্রাথমিক কবিতা অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন, যেটি তিনি ১৯৩৬ সালে সম্পাদনা করেছিলেন।

গীতাঞ্জলির ইংরেজি সংস্করণে ইয়েটস নিজেই প্রস্তুত করতে সাহায্য করেছিলেন। কবিতা, অবশ্যই, অনুবাদ খুবই কঠিন, এবং যে কেউ তাদের আসল বাংলায় ঠাকুরের কবিতা জানেন তারা যেকোনও অনুবাদে (ইয়েটসের সাহায্য ছাড়া তৈরি) সন্তুষ্ট বোধ করতে পারেন না।

এমনকি তাঁর গদ্য রচনার অনুবাদগুলোও কিছুটা হলেও বিকৃতির শিকার হয়।

ই.এম. ফরস্টার উল্লেখ করেছেন যে ১৯১৯ সালে ঠাকুরের একটি মহান বাংলা উপন্যাস, দ্য হোম অ্যান্ড দ্য ওয়ার্ল্ডের অনুবাদের একটি পর্যালোচনায়: "থিমটি খুবই সুন্দর," কিন্তু আকর্ষণগুলো "অনুবাদে অদৃশ্য হয়ে গেছে।"

ঠাকুর স্বয়ং তার ইংরেজি খ্যাতি অর্জনে কিছুটা বিস্মিত হয়েছিলেন। তিনি অসামান্য আনন্দের সাথে গ্রহণ করেছিলেন ।তারপরে আরও বড় বিস্ময়ের সাথে নিন্দা গ্রহণ করেছিলেন ও বেদনা গোপন করেছিলেন। ঠাকুর সমালোচনার প্রতি সংবেদনশীল ছিলেন। সবচেয়ে সুদূরপ্রসারী অভিযোগে আঘাত পেয়েছিলেন। অভিযোগ ছিল যে তিনি ইয়েটসের কাজের জন্য কৃতিত্ব পেয়েছিলেন।


ঈশ্বর এবং অন্যান্য

ইয়েটস ঠাকুরের লেখায় একটি বড় ধর্মীয় উপাদান দেখতে ভুল করেছিলেন না। জীবন ও মৃত্যু সম্বন্ধে তার কাছে অবশ্যই মজার আকর্ষণীয় কথা বলার ছিল। উইলফ্রেড ওয়েনের মা সুসান ওয়েন ১৯২০ সালে রবীন্দ্রনাথকে লিখেছিলেন, যুদ্ধে যাওয়ার আগে তার ছেলের সঙ্গে তার শেষ কথোপকথন বর্ণনা করেছিলেন যা ছিল তার জীবন সম্পর্কে। উইলফ্রেড "তোমার সেই চমৎকার কথাগুলো" দিয়ে বিদায় জানালেন - 'যখন আমি এখান থেকে যাব, এটা আমার বিচ্ছেদের শব্দ হোক।'" যখন উইলফ্রেডের পকেটের নোটবুক তার মায়ের কাছে ফেরত দেওয়া হয়, তখন তিনি দেখতে পান "এই কথাগুলো তার প্রিয় লেখায় লেখা ছিল - নিচে তোমার নামের সঙ্গে।"

ঈশ্বরের সঙ্গে সরাসরি , আনন্দময় এবং সম্পূর্ণ নির্ভীক সম্পর্কের ধারণা ঠাকুরের অনেক ধর্মীয় লেখায় পাওয়া যায়, যার মধ্যে রয়েছে গীতাঞ্জলির কবিতা। ভারতের বৈচিত্র্যময় ধর্মীয় ঐতিহ্য থেকে তিনি প্রাচীন গ্রন্থ এবং জনপ্রিয় কবিতা উভয় থেকেই অনেক ধারণা পেয়েছিলেন। কিন্তু "থিওসফিস্টদের উজ্জ্বল নুড়ি চোখ" তাঁদের পংক্তি মালার দিকে তাকায় না। গীতাঞ্জলির মূল অনুবাদের প্রাচীন ভাষা থাকা সত্ত্বেও, যা মূলের সরলতা রক্ষা করতে সাহায্য করেনি বলে আমি বিশ্বাস করি, এর প্রাথমিক মানবতা যেকোন জটিল এবং তীব্র আধ্যাত্মিকতার চেয়ে আরও স্পষ্টভাবে আসে।

বাদ দাও এই জপ-গান আর পুঁতির কথা! দরজা বন্ধ করে মন্দিরের এই নিঃসঙ্গ অন্ধকার কোণে তুমি কার পূজা কর?

তোমার চোখ খুলে দেখ তোমার ঈশ্বর তোমার সামনে নেই!

তিনি সেখানে আছেন যেখানে চাষী শক্ত জমিতে চাষ করছে এবং যেখানে পথনির্মাতা পাথর ভাঙছে।

তিনি রোদে ও গোসলের সময় তাদের সঙ্গে থাকেন এবং তাঁর পোশাক ধুলোয় ঢাকা থাকে।

ধর্মীয় অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে একটি অস্পষ্টতা ঠাকুরের অনেক ভক্তিমূলক কবিতার কেন্দ্রবিন্দু, এবং তাদের বিশ্বাস নির্বিশেষে পাঠকদের কাছে আবেদন করে; কিন্তু অত্যধিক বিস্তারিত ব্যাখ্যা ধ্বংসাত্মকভাবে সেই অস্পষ্টতা দূর করতে পারে। এটি বিশেষ করে তার অনেক কবিতার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য যা মানবপ্রেম এবং ধার্মিক ভক্তির চিত্রকে একত্রিত করে। ঠাকুর লিখেছেন:

"আজ রাতে আমার ঘুম নেই। বার বার দরজা খুলে অন্ধকারের দিকে চেয়ে থাকি বন্ধু!

আমার সামনে কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। ভাবি তোমার পথ কোথায়!

কালি-কালো নদীর কোন আবছা তীরে, ভ্রূকুঞ্চিত জঙ্গলের কোন প্রান্তে, কী গভীর অন্ধকারের মধ্য দিয়ে, তুমি কি তোমার পথ বেঁধে আছ আমাকে দেখতে, আমার বন্ধু?"

আমি মনে করি এটি বলা সহায়ক হতে পারে, যেমন ইয়েটস ব্যাখ্যা করতে ত্বরান্বিত করেছেন, যে "খালি বাড়িতে প্রভুর স্বদেশে আসার অপেক্ষায় দাস বা নববধূ" হল "ঈশ্বরের দিকে ফিরে যাওয়া হৃদয়ের চিত্রগুলোর মধ্যে।" কিন্তু ইয়েটসের বিবেচ্য প্রচেষ্টা নিশ্চিত করার জন্য যে পাঠক "মূল বিষয়"হরাবেন না, বাংলা কবিতার রহস্যময় সৌন্দর্যের কিছু হারিয়ে গেছে - এমনকি ইংরেজি অনুবাদের প্রাচীন ভাষা থেকেও যা টিকে ছিল। ঠাকুরের অবশ্যই দৃঢ়ভাবে ধর্মীয় বিশ্বাস ছিল (একটি অস্বাভাবিকভাবে অসাম্প্রদায়িক ধরনের), কিন্তু তিনি অন্যান্য অনেক বিষয়েও আগ্রহী ছিলেন এবং সেগুলি সম্পর্কে বলার মতো অনেকগুলো ভিন্ন জিনিসও ছিল।

তিনি যে ধারণাগুলো উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছিলেন তার মধ্যে কিছু ছিল সরাসরি রাজনৈতিক। সেগুলি তার চিঠি ও বক্তৃতায় উল্লেখযোগ্যভাবে চিত্রিত হয়েছে। তিনি জাতীয়তাবাদ, যুদ্ধ ও শান্তি, আন্তঃসাংস্কৃতিক শিক্ষা, মনের স্বাধীনতা, যুক্তিবাদী সমালোচনার গুরুত্ব, খোলামেলার প্রয়োজনীয়তা ইত্যাদি সম্পর্কে সরলভাবে মতামত প্রকাশ করেছিলেন।


স্বাধীনতায় যুক্তি

ঠাকুরের কাছে এটা ছিল সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ যে মানুষ স্বাধীনভাবে বাঁচার যুক্তিতে সক্ষম হয়। রাজনীতি ও সংস্কৃতি, জাতীয়তাবাদ এবং আন্তর্জাতিকতা, ঐতিহ্য এবং আধুনিকতার প্রতি তার মনোভাব এই বিশ্বাসের আলোকে দেখা যায়। গীতাঞ্জলির কবিতার মতো স্পষ্টভাবে আর তার মূল্যবোধ প্রকাশ করেনি:

চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির,
জ্ঞান যেথা মুক্ত, যেথা গৃহের প্রাচীর
আপন প্রাঙ্গণতলে দিবসশর্বরী
বসুধারে রাখে নাই খন্ড ক্ষুদ্র করি,
যেথা বাক্য হৃদয়ের উৎসমুখ হতে
উচ্ছ্বসিয়া উঠে, যেথা নির্বারিত স্রোতে
দেশে দেশে দিশে দিশে কর্মধারা ধায়
অজস্র সহস্রবিধ চরিতার্থতায়--
যেথা তুচ্ছ আচারের মরুবালুরাশি
বিচারের স্রোতঃপথ ফেলে নাই গ্রাসি,
পৌরুষেরে করে নি শতধা; নিত্য যেথা
তুমি সর্ব কর্ম চিন্তা আনন্দের নেতা--
নিজ হস্তে নির্দয় আঘাত করি, পিতঃ,
ভারতেরে সেই স্বর্গে করো জাগরিত।

জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রতি রবীন্দ্রনাথের যথাযথ সমর্থন ছিল। বিদেশী শাসনের অবাধ বিরোধিতা এই অঙ্গীকার থেকেই এসেছিল। দেশপ্রেম সম্পর্কে তার সংরক্ষণও তাই করেছিল, যা তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন , বাইরের "সংকীর্ণ ঘরোয়া দেয়াল" থেকে ধারণাগুলো জড়িত করার স্বাধীনতা এবং অন্যান্য দেশের মানুষের কারণকে সমর্থন করার স্বাধীনতা উভয়ই সীমিত করতে পারে। স্বাধীনতার প্রতি রবীন্দ্রনাথের আবেগ অযৌক্তিক ঐতিহ্যবাদের প্রতি তার দৃঢ় বিরোধিতাকে অন্তর্নিহিত করে, যা একজনকে অতীতে বন্দী করে তোলে। (হারিয়েছেন, যেমনটি তিনি বলেছেন, "মৃত অভ্যাসের ভীষণ মরুভূমির বালিতে")

ঠাকুর অতীতের অত্যাচারের চিত্র তুলে ধরেছেন তার মজার অথচ গভীরভাবে গুরুতর দৃষ্টান্ত "কর্তার ভূত" ("নেতার ভূত")এ । যেহেতু একটি কাল্পনিক দেশের সম্মানিত নেতা মারা যাচ্ছেন, তার আতঙ্কিত অনুগামীরা তাদের কি করতে হবে তার নির্দেশ দেওয়ার জন্য তার মৃত্যুর পরে থাকার জন্য অনুরোধ করে। তিনি সম্মতি দেন। কিন্তু তার অনুসারীরা দেখতে পায় যে তাদের জীবন আচার-অনুষ্ঠানে পূর্ণ এবং দৈনন্দিন আচরণের প্রতিবন্ধকতা রয়েছে এবং তারা তাদের চারপাশের জগতের প্রতি প্রতিক্রিয়াশীল নয়। অবশেষে, তারা নেতার প্রেতাত্মাকে অনুরোধ করে যাতে তারা তাদের আধিপত্য থেকে মুক্তি দেয়, তখন তিনি তাদের জানান যে তিনি কেবল তাদের মনেই আছেন।

অতীতের প্রতিশ্রুতির প্রতি ঠাকুরের গভীর বিমুখতা ছিল।তা সমসাময়িক কারণে পরিবর্তিত হতে পারে না, এমনকি অতীতের প্রতিশ্রুতিগুলোকে সবসময় পালন করার কথিত গুণ পর্যন্তই প্রসারিত। একবার যখন মহাত্মা গান্ধী শান্তিনিকেতনে ঠাকুরের স্কুল পরিদর্শন করেছিলেন, তখন একজন যুবতী তাকে তার অটোগ্রাফ বইতে স্বাক্ষর করতে দিয়েছিলেন। গান্ধী লিখেছেন: “কখনও তাড়াহুড়ো করে প্রতিশ্রুতি করবেন না। একবার এটি তৈরি করার পরে এটি আপনার জীবনের মূল্য দিয়ে পূরণ করুন।" এই প্রবেশ দেখে ঠাকুর বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। একই বইতে তিনি বাংলায় একটি ছোট কবিতা লিখেছিলেন যে কাউকে "মাটির শিকল দিয়ে চিরকাল বন্দী করা যায় না।" তিনি ইংরেজিতে উপসংহারে গিয়েছিলেন, সম্ভবত যাতে গান্ধীও এটি পড়তে পারেন, "আপনার প্রতিশ্রুতিটি ভুল বলে প্রমাণিত হলে তাড়িয়ে দিন।"

একজন ব্যক্তি এবং একজন রাজনৈতিক নেতা হিসাবে ঠাকুরের মহাত্মা গান্ধীর জন্য সবচেয়ে বেশি প্রশংসা ছিল, কিন্তু তিনি গান্ধীর জাতীয়তাবাদের রূপ এবং দেশের অতীত ঐতিহ্যের বিষয়ে তার রক্ষণশীল প্রবৃত্তির বিষয়েও অত্যন্ত সন্দিহান ছিলেন। তিনি কখনও ব্যক্তিগতভাবে গান্ধীর সমালোচনা করেননি। ১৯৩৮ প্রবন্ধে, "গান্ধী দ্য ম্যান," এ তিনি লিখেছেন:

একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে, একজন সংগঠক হিসেবে, মানুষের নেতা হিসেবে, একজন নৈতিক সংস্কারক হিসেবে তিনি যতটা মহান, একজন মানুষ হিসেবে তিনি এসবের চেয়েও বড়, কারণ এই দিক ও কর্মকাণ্ডের কোনোটিই তার মানবতাকে সীমাবদ্ধ করে না। তারা বরং এটি দ্বারা অনুপ্রাণিত এবং টিকে থাকে।

তারপরও দুজনের মধ্যে গভীর বিভাজন রয়েছে। ঠাকুর তার মতবিরোধ সম্পর্কে স্পষ্টভাবে বলেছিলেন:

আমরা যারা প্রায়শই যুক্তি উপেক্ষা করার প্রবণতাকে মহিমান্বিত করি, তার জায়গায় অন্ধ বিশ্বাস স্থাপন করি, এটিকে আধ্যাত্মিক হিসাবে মূল্যায়ন করি, তারা আমাদের মন এবং ভাগ্যের অস্পষ্টতার সাথে এর মূল্য পরিশোধ করছি। আমি মহাত্মাজিকে আমাদের জনগণের মধ্যে বিশ্বাসযোগ্যতার এই অযৌক্তিক শক্তিকে কাজে লাগানোর জন্য দোষারোপ করেছি, যার ভিত্তি ক্ষয় করার সময় একটি সুপারস্ট্রাকচার দ্রুত ফলাফল হতে পারে। এইভাবে আমাদের জাতির পথপ্রদর্শক হিসাবে মহাত্মাজী সম্পর্কে আমার অনুমান শুরু হয়েছিল এবং এটি আমার জন্য সৌভাগ্যের যে এটি সেখানে শেষ হয়নি।

কিন্তু যখন এটি "সেখানে শেষ হয়নি", দৃষ্টিভঙ্গির সেই পার্থক্যটি একটি শক্তিশালী বিভাজক ছিল। ঠাকুর, উদাহরণস্বরূপ, গান্ধীর জোরপূর্বক ওকালতির যোগ্যতার প্রতি অবিশ্বাসী ছিলেন যে প্রত্যেকেরই ঘরে বসে "চরকা", আদিম চরকা নিয়ে ঘুরতে হবে। গান্ধীর জন্য এই অনুশীলনটি ছিল ভারতের আত্ম-উপলব্ধির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তার জীবনীকার বি.আর. নন্দ লিখেছেন, "ভারতীয় অর্থনীতির গান্ধীয় পরিকল্পনায় গ্রামীণ উত্থানের কেন্দ্র।" রোম্যাঁ রোলাঁ যেমন উল্লেখ করেছেন, রবীন্দ্রনাথ "চরকার সমালোচনা করতে কখনই ক্লান্ত হন না।" এই অর্থনৈতিক বিচারে, ঠাকুর সম্ভবত সঠিক ছিলেন। উচ্চ-মানের কাত কাপড়ের জন্য একটি ছোট বিশেষ বাজার ব্যতীত, গান্ধীর চরকার চেয়ে কম আদিম চাকা দিয়েও হাতের ঘূর্ণনের অর্থনৈতিক ধারণা তৈরি করা কঠিন। একটি বিস্তৃত কার্যকলাপ হিসাবে হ্যান্ড স্পিনিং শুধুমাত্র ভারী সরকারি ভর্তুকির সাহায্যে টিকে থাকতে পারে। যাইহোক, চরকা সম্পর্কে গান্ধীর সমর্থন শুধুমাত্র অর্থনীতির উপর ভিত্তি করে ছিল না। তিনি চেয়েছিলেন যে প্রত্যেকে "উৎসর্গ হিসাবে প্রতিদিন ত্রিশ মিনিটের জন্য চরকা ঘোরাক, এটি এমন লোকেদের জন্য একটি উপায় হিসাবে দেখে যারা নিজেদেরকে কম সৌভাগ্যবান বলে চিহ্নিত করতে পারে। তিনি এই বিষয়টি বুঝতে ঠাকুরের অস্বীকৃতির জন্য অধৈর্য ছিলেন:

কবি আগামীকাল বেঁচে থাকবেন, এবং আমাদেরও তাই করতে চান... "আমি কেন, যার খাবারের জন্য কাজ করার দরকার নেই, ঘুরতে হবে?" প্রশ্ন করা হতে পারে। কারণ আমি খাচ্ছি যা আমার নয়। আমি আমার দেশবাসীর অপমানে বেঁচে আছি। প্রতিটি মুদ্রার উৎস খুঁজে বের করুন যা আপনার পকেটে প্রবেশ করে, এবং আপনি আমি যা লিখছি তার সত্যতা বুঝতে পারবেন। প্রত্যেককে স্পিন করতে হবে। ঠাকুরকে অন্যদের মতো ঘুরতে দিন। সে তার বিদেশী জামাকাপড় পুড়িয়ে দাও; এটাই আজ কর্তব্য। ঈশ্বর আগামীকাল যত্ন নেবেন.--

গান্ধীর যুক্তিতে ঠাকুর যদি কিছু মিস করে থাকেন, তাহলে গান্ধীও কি ঠাকুরের মূল সমালোচনার বিষয়টি মিস করেছেন। এটা শুধু যে চরকা সামান্য অর্থনৈতিক বোধ তৈরি করেছিল তা নয়, ঠাকুর ভেবেছিলেন যে এটি মানুষকে কোনো কিছুর প্রতি প্রতিফলিত করার উপায় নয়: “চরকা কাউকে ভাবতে হয় না; ন্যূনতম বিচার এবং সহনশীলতা ব্যবহার করে কেউ কেবল পুরানো আবিষ্কারের চাকাকে অবিরামভাবে ঘুরিয়ে দেয়।"


ব্রহ্মচর্য এবং ব্যক্তিগত জীবন

ব্যক্তিগত জীবনের প্রতি ঠাকুর এবং গান্ধীর দৃষ্টিভঙ্গিও ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। গান্ধী ব্রহ্মচর্যের গুণাবলীর প্রতি আগ্রহী ছিলেন, এ সম্পর্কে তিনি তাত্ত্বিক ছিলেন।

কিছু বছর দাম্পত্য জীবনযাপনের পর, একটি ব্যক্তিগত প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।তিনি প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছিলেন তার স্ত্রীর সঙ্গে ঘুমানো থেকে বিরত থাকার কথা ।

এই বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ছিল একেবারেই ভিন্ন, কিন্তু তিনি তাদের মতবিরোধের ব্যাপারে চুপ ছিলেন।

গান্ধীজি যৌন জীবনকে মানুষের নৈতিক অগ্রগতির সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ বলে নিন্দা করেছেন, এবং দ্য ক্রুৎজার সোনাটার মতো লেখকের যৌন জীবনেএকটি ভয়াবহতা রয়েছে, কিন্তু তা টলস্টয়ের বিপরীতে, তিনি তার ধরনের যৌনতাকে প্রলুব্ধ করে এমন কোনও ঘৃণার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেননি।

প্রকৃতপক্ষে, নারীদের প্রতি তার কোমলতা তার চরিত্রের সবচেয়ে মহৎ এবং সবচেয়ে সামঞ্জস্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে একটি, এবং তিনি যে মহান আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তার কিছু সেরা এবং সত্যিকারের কমরেডকে তিনি তার দেশের মহিলাদের মধ্যে দেখেন।

ঠাকুরের ব্যক্তিগত জীবন অনেক দিক দিয়েই ছিল অসুখী।

তিনি ১৮৮৩ সালে বিয়ে করেছিলেন,১৯০২ সালে তার স্ত্রীকে হারিয়েছিলেন এবং আর কখনও বিয়ে করেননি।

তিনি ঘনিষ্ঠ সাহচর্য চেয়েছিলেন, যা তিনি সবসময় পাননি। (সম্ভবত এমনকি তার বিবাহিত জীবনেও - তিনি তার স্ত্রী মৃণালিনীকে লিখেছিলেন: " তুমি ও আমি যদি আমাদের সমস্ত কাজে এবং আমাদের সমস্ত চিন্তাভাবনায় কমরেড হতে পারি তবে তা দুর্দান্ত হবে, কিন্তু আমরা যা চাই তা অর্জন করতে পারি না"।)

তিনি তাঁর বড় ভাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সাহিত্য-প্রেমী স্ত্রী কাদম্বরীর সঙ্গে একটি উষ্ণ বন্ধুত্ব ও একটি শক্তিশালী প্লেটোনিক সংযুক্তি বজায় রেখেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ তার বিয়ের আগে কাদম্বরী দেবীকে কিছু কবিতা উৎসর্গ করেছিলেন , আর তার মৃত্যুর পরে কিছু বইও উৎসর্গ করেন । (তিনি পঁচিশ বছর বয়সে, রবীন্দ্রনাথের বিয়ের চার মাস পরে আত্মহত্যা করেছিলেন কি কারণে সম্পূর্ণরূপে বোঝা যায় না।)

জীবনের অনেক পরে, ১৯২৪- ১৯২৫ সালে আর্জেন্টিনা সফরের সময়, রবীন্দ্রনাথ প্রতিভাবান ও সুন্দরী ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর সঙ্গে পরিচিত হন। ওকাম্পো পরে সাহিত্য পত্রিকা সুরের প্রকাশক হন।

তারা ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে ওঠেন। কিন্তু পরে দেখা যায়, রবীন্দ্রনাথ একটি আবেগপূর্ণ সম্পর্কের সম্ভাবনাকে একটি সীমাবদ্ধ বুদ্ধিজীবীতে পরিণত করেন।

তাঁর বন্ধু লিওনার্ড এলমহার্স্ট, যিনি তাঁর আর্জেন্টিনা সফরে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ছিলেন।

তিনি লিখেছেন,"কতাঁর বইগুলো সম্পর্কে গভীর বুদ্ধিবৃত্তি বোঝার পাশাপাশি, তিনি তাঁর প্রেমে পড়েছিলেন - কিন্তু বুদ্ধির ভিত্তিতে বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে সন্তুষ্ট না হয়ে, তিনি তাঁর উপর সেই ধরণের মালিকানার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তাড়াহুড়ো করেছিলেন।

ওকাম্পো এবং এলমহার্স্ট, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে থাকাকালীন, তারা একে অপরের সম্পর্কে যা লিখেছেন তাতে উভয়ই বেশ রুঢ় ছিলেন।

ঠাকুরের উপর ওকাম্পোর বইটি (যার একটি বাংলা অনুবাদ বিশিষ্ট কবি ও সমালোচক শঙ্খ ঘোষ স্প্যানিশ ভাষা থেকে করেছিলেন) মূলত ঠাকুরের লেখার সঙ্গে সম্পর্কিত কিন্তু তাদের সম্পর্কের আনন্দ এবং অসুবিধাগুলি নিয়েও আলোচনা করে, এলমহার্স্টের থেকে একেবারে আলাদা বিবরণ দেয়, এবং কখনোই কোনো ধরনের মালিকানামূলক উদ্দেশ্যের পরামর্শ দেয় না।

ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো অবশ্য এটা স্পষ্ট করেছেন যে তিনি শারীরিকভাবে রবীন্দ্রনাথের কাছাকাছি যেতে চেয়েছিলেন।------ রবীন্দ্রনাথও স্পষ্টতই তার প্রতি খুব আকৃষ্ট ছিলেন।

তিনি তাঁকে "বিজয়া" (ভিক্টোরিয়ার সংস্কৃত সমতুল্য) বলে ডাকেন, তাঁকে একটি কবিতার বই উৎসর্গ করেন, পূরবী - একটি "সন্ধ্যার সুর" এবং তার মনের জন্য অত্যন্ত প্রশংসা প্রকাশ করেন ("দূরের একটি তারার মতো")।

তাকে একটি চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, যেন তার নিজের অযৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করতে:

যখন আমরা একসাথে ছিলাম, আমরা বেশিরভাগই শব্দ নিয়ে খেলতাম এবং একে অপরকে স্পষ্টভাবে দেখার আমাদের সেরা সুযোগগুলিকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতাম ... যখনই বাসাটি আকাশের ঈর্ষান্বিত প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠার ন্যূনতম চিহ্ন থাকে আমার মন, পরিযায়ী পাখির মতো, নেওয়ার চেষ্টা করে ... দূরের তীরে উড়ে যায়।

পাঁচ বছর পরে, ১৯৩০ সালে ঠাকুরের ইউরোপীয় সফরের সময়, তিনি ওকাম্পোকে একটি তারবার্তা পাঠান: "তুমি কি এসে আমাকে দেখা করতে পারবে না।" ওকাম্পো দেখা করেছিলেন।

কিন্তু তাদের সম্পর্ক কথোপকথনের বাইরে অনেক বেশি যেতে পারে বলে মনে হয় না, এবং তাদের কিছুটা অস্পষ্ট চিঠিপত্র বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকে। ১৯৪০ সালে আশি বছর বয়সে তাঁর মৃত্যুর এক বছর আগ শেষ লেখাগুলোর একটি কবিতা তার সম্পর্কে বলে মনে হয়: "কিভাবে আমি আবার সেই বিদেশী ভূমিতে আমার পথ খুঁজে পেতে পারি যেখানে অপেক্ষা করছে।

আমি প্রেমের বার্তা!/... তার ভাষা আমি জানতাম না, কিন্তু তার চোখ যা বলেছে তা চিরকাল তার যন্ত্রণার মধ্যে বাকপটু থাকবে।

রবীন্দ্রনাথ যতই সিদ্ধান্তহীন, বা বিভ্রান্ত, বা বিশ্রী হতে পারেন, তিনি অবশ্যই মহাত্মা গান্ধীর যৌনতা সম্পর্কে সংবেদনশীল মতামত শেয়ার করেননি।

প্রকৃতপক্ষে, যখন সামাজিক নীতির কথা আসে, তখন তিনি গর্ভনিরোধক এবং পরিবার পরিকল্পনার পক্ষে ছিলেন তখন গান্ধী এ বিষয়ে বিরত থাকা পছন্দ করেছিলেন।


বিজ্ঞান এবং মানুষ

গান্ধী এবং ঠাকুর বিজ্ঞানের প্রতি তাদের সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির জন্য মারাত্মকভাবে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন।

১৯৩৪ সালের জানুয়ারিতে, বিহারে একটি বিধ্বংসী ভূমিকম্প আঘাত হানে, যার ফলে হাজার হাজার মানুষ মারা যায়।

গান্ধী তখন অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে গভীরভাবে জড়িত ছিলেন (ভারতের বিভাজনকারী অতীত থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত বর্বর ব্যবস্থা, যেখানে "নিচু মানুষদের" শারীরিক দূরত্বে রাখা হয়েছিল), দুঃখজনক ঘটনা থেকে একটি ইতিবাচক পাঠ নিয়েছিলেন।

"আমার মত একজন মানুষ," গান্ধী যুক্তি দিয়েছিলেন, "এই ভূমিকম্প আমাদের পাপের জন্য ঈশ্বরের দ্বারা প্রেরিত একটি ঐশ্বরিক শাস্তি" - বিশেষ করে অস্পৃশ্যতার পাপের জন্য বিশ্বাস করা যায় না।

"আমার জন্য বিহার বিপর্যয় এবং অস্পৃশ্যতা অভিযানের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ রয়েছে।"

ঠাকুর সমানভাবে অস্পৃশ্যতাকে ঘৃণা করতেন। অস্পৃশ্যতা আন্দোলনে গান্ধীর সঙ্গে তিনিও যোগ দিয়েছিলেন। বিহারে ভূমিকম্পে বিহার বিপর্যয়ের ঘটনার গান্ধীর এই ব্যাখ্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। যা শিশু এবং শিশু সহ অনেক নিরপরাধ লোকের কষ্ট এবং মৃত্যু ঘটিয়েছিল।

তিনি নৈতিক ব্যর্থতার কারণে একটি ভূমিকম্প দেখে জ্ঞানতত্ত্বকেও ঘৃণা করতেন।

"এটি," তিনি লিখেছেন, "এটি আরও দুর্ভাগ্যজনক কারণ [প্রাকৃতিক] ঘটনার এই ধরণের অবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি একটি বড় অংশ দ্বারা খুব সহজেই গৃহীত হয়।

বিজ্ঞানের প্রতি তাদের মনোভাব নিয়ে দুজনে গভীরভাবে বিভক্ত ছিল। যাইহোক, যদিও ঠাকুর বিশ্বাস করতেন যে আধুনিক বিজ্ঞান ভৌত ঘটনা বোঝার জন্য অপরিহার্য, জ্ঞানতত্ত্ব সম্পর্কে তাঁর মতামত ছিল আকর্ষণীয়ভাবে ভিন্নধর্মী। তিনি আধুনিক বিজ্ঞানের সাথে প্রায়শই যুক্ত সরল "বাস্তববাদী" অবস্থান নেননি। ১৯৩০ সালে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ প্রকাশিত আইনস্টাইনের সাথে তার কথোপকথনের প্রতিবেদনটি দেখায় যে পর্যবেক্ষণ এবং প্রতিফলিত ধারণার মাধ্যমে সত্যের ব্যাখ্যা করার ব্যাপারে ঠাকুর কতটা জোরালো ছিলেন। কারো অনুপস্থিতিতে কোনো কিছু সত্য বা অসত্য বলে দাবি করা বা তার সত্যতা উপলব্ধি করা, বা এটি কী তা নিয়ে ধারণা তৈরি করা ঠাকুরের কাছে গভীরভাবে প্রশ্নবিদ্ধ বলে মনে হয়েছিল। যখন আইনস্টাইন মন্তব্য করেছিলেন, "যদি আর কোন মানুষ না থাকত, অ্যাপোলো বেলভেডের আর সুন্দর থাকত না?" ঠাকুর সহজভাবে উত্তর দিলেন, "না।" আরও এগিয়ে গিয়ে - এবং আরও অনেক আকর্ষণীয় অঞ্চলে - আইনস্টাইন বলেছিলেন, "আমি সৌন্দর্যের এই ধারণার সঙ্গে একমত, কিন্তু সত্যের ক্ষেত্রে নয়।" ঠাকুরের প্রতিক্রিয়া ছিল: "কেন নয়? সত্য মানুষের মাধ্যমে উপলব্ধি করা হয়।"


জাতীয়তাবাদ ও উপনিবেশবাদ

ঠাকুর সাম্প্রদায়িক সাম্প্রদায়িকতার (যেমন একটি হিন্দু গোঁড়ামি যেটি ইসলামিক, খ্রিস্টান বা শিখ দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধী ছিল) অনুমানযোগ্যভাবে বিরুদ্ধে ছিলেন। এমনকি জাতীয়তাবাদও তাঁর কাছে সন্দেহজনক বলে মনে হয়েছিল। ইশাইয়া বার্লিন ভারতীয় জাতীয়তাবাদের বিষয়ে ঠাকুরের জটিল অবস্থানের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়েছেন:

ঠাকুর সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে দ্রুত দাঁড়িয়েছিলেন। কঠিন সত্যের প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্বাসঘাতকতা পর্যায়ের ছিল না। তিনি অতীতের সঙ্গে রোমান্টিক অত্যধিক সংযুক্তির নিন্দা করেছিলেন। তিনি অতীতের সঙ্গে ভারতকে বেঁধে রেখেছিলেন "বলির পাঁঠার মতো একটি পোস্টে " এবং তিনি এমন ব্যক্তিদের অভিযুক্ত করেছিলেন যারা এটি প্রদর্শন করেছিল - তারা তাঁকে প্রতিক্রিয়াশীল বলে মনে করেছিল - সত্যিকারের রাজনৈতিক স্বাধীনতা কী তারা তা জানে না। ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে ইংরেজ চিন্তাবিদ এবং ইংরেজি বই থেকে রাজনৈতিক স্বাধীনতার ধারণাটি উদ্ভূত হয়েছিল। কিন্তু মহাজাগতিকতার বিরুদ্ধে তিনি মত বজায় রেখেছিলেন যে ইংরেজরা তাদের নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে এবং ভারতীয়দেরও তাই করা উচিত। ১৯২৭ সালে তিনি আরও একবার 'প্রভুর অপরিবর্তনীয় ইচ্ছার কাছে সবকিছু ছেড়ে দেওয়ার' বিপদের নিন্দা করেছিলেন, তিনি ব্রাহ্মণ বা ইংরেজ হোন না কেন।

বার্লিন যে দ্বৈততার দিকে ইঙ্গিত করেছে তা সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের প্রতি ঠাকুরের মনোভাবের মধ্যেও প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি চেয়েছিলেন যে ভারতীয়রা তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের সঙ্গে আগ্রহী এবং জড়িত থাকাকালীন অন্য কোথাও কী ঘটছে, অন্যরা কীভাবে বাস করে, তারা কী মূল্যবান এবং আরও অনেক কিছু শিখুক। প্রকৃতপক্ষে, তাঁর শিক্ষামূলক লেখাগুলোতে সংশ্লেষণের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেওয়া হয়েছে যা বিদেশে ভারতীয় ছাত্রদের প্রতি তাঁর পরামর্শেও তা পাওয়া যাবে।

১৯০৭ সালে কৃষি বিষয়ে পড়াশোনা করতে আমেরিকা গিয়েছিলেন তাঁর জামাতা নগেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলী।

তাঁকে তিনি লিখেছিলেন,"স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে পরিচিত হওয়া শিক্ষার একটি অংশ। শুধু কৃষি জানাই যথেষ্ট নয়; তুমি আমেরিকাকেও জান। অবশ্যই, যদি আমেরিকাকে জানার প্রক্রিয়ায়, কেউ নিজের পরিচয় হারাতে শুরু করে ও ভারতীয় সমস্ত কিছুকে অবজ্ঞা করে আমেরিকান মানুষ হয়ে ওঠার ফাঁদে পড়ে, তবে তাকে একটি তালাবদ্ধ ঘরে থাকা বাঞ্ছনীয়।

ঠাকুর বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানে ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে দৃঢ়ভাবে জড়িত ছিলেন, বিশেষ করে ১৯০৫ সালের ব্রিটিশদের দুটি বাংলা প্রদেশে বিভক্ত করার প্রস্তাবকে প্রতিরোধ করার আন্দোলনে।একটি পরিকল্পনা যা শেষ পর্যন্ত জনপ্রিয় প্রতিরোধের পর প্রত্যাহার করা হয়েছিল। তিনি ভারতে ব্রিটিশ শাসনের বর্বরতার নিন্দা করেছিলেন ১৩ এপ্রিল, ১৯১৯ এর অমৃতসর গণহত্যার পরে।

একটি শান্তিপূর্ণ সভায় ৩৭৯ জন নিরস্ত্র লোককে সেনাবাহিনী গুলি করে হত্যা করেছিল। দুই হাজার লোক আহত হয়েছিল। ২৩থেকে ২৬ এপ্রিলের মধ্যে, রবীন্দ্রনাথ সিএফকে পাঁচটি প্রতিবাদী চিঠি লিখেছিলেন। অ্যান্ড্রুজ নিজেও অত্যন্ত বিরক্ত ছিলেন, বিশেষ করে ভারতের একজন ব্রিটিশ সিভিল সার্ভেন্ট তাঁকে বলেছিলেন যে এই শক্তি প্রদর্শনের জন্য ধন্যবাদ। ব্রিটিশ রাজের "নৈতিক প্রতিপত্তি" "কখনও বেশি ছিল না।"

গণহত্যার এক মাস পর, ঠাকুর ভারতের ভাইসরয়কে চিঠি লিখেছিলেন, চার বছর আগে তিনি যে নাইট উপাধি গ্রহণ করেছিলেন তা থেকে মুক্তি দিতে বলেছিলেন:

দুর্ভাগ্যজনক লোকদের শাস্তির অসামঞ্জস্যপূর্ণ তীব্রতা এবং তাদের কার্যকর করার পদ্ধতিগুলো আমরা নিশ্চিত যে, সভ্য সরকারের ইতিহাস সমান্তরাল নয়, সাম্প্রতিক এবং দূরবর্তী কিছু ব্যতিক্রম ব্যতীত। নিরস্ত্র এবং সম্পদহীন একটি জনসংখ্যার সঙ্গে এই ধরনের আচরণ করা হয়েছে এমন একটি শক্তির দ্বারা যারা মানব জীবন ধ্বংসের জন্য সবচেয়ে ভয়ঙ্করভাবে দক্ষ সংস্থা রয়েছে তা বিবেচনা করে, আমাদের দৃঢ়ভাবে জোর দিয়ে বলতে হবে যে এটি কোনও রাজনৈতিক সুবিধা দাবি করতে পারে না, অনেক কম নৈতিক ন্যায্যতা … আমাদের জনগণের হৃদয়ে জেগে ওঠা ক্রোধের সার্বজনীন যন্ত্রণা আমাদের শাসকদের দ্বারা উপেক্ষা করা হয়েছে - সম্ভবত তারা যাকে অভিনন্দনমূলক পাঠ হিসাবে কল্পনা করে তা দেওয়ার জন্য নিজেকে অভিনন্দন জানাচ্ছি ... আমি আমার পক্ষ থেকে, সমস্ত বিশেষ বৈষম্যকে ছিন্ন করে, তাদের পাশে দাঁড়াতে চাই আমার দেশবাসী যারা তাদের তথাকথিত তুচ্ছতার জন্য মানুষের জন্য উপযুক্ত নয় এমন অধঃপতন ভোগ করতে বাধ্য।

গান্ধী এবং নেহেরু উভয়েই জাতীয় সংগ্রামে ঠাকুর যে গুরুত্বপূর্ণ অংশ নিয়েছিলেন তার প্রশংসা করেছিলেন। এটা মানানসই যে স্বাধীনতার পরে, ভারত তার জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে ঠাকুরের একটি গান ("জন গণ মন আধিনায়ক", যাকে মোটামুটিভাবে "জনগণের মনের নেতা" হিসাবে অনুবাদ করা যেতে পারে) বেছে নিয়েছিল। যেহেতু বাংলাদেশ পরবর্তীতে ঠাকুরের অন্য একটি গানকে (“আমার সোনার বাংলা”) জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে বেছে নেবে, তাই তিনিই হয়তো একমাত্র যিনি দুটি ভিন্ন দেশের জাতীয় সঙ্গীত রচনা করেছেন।

ভারতের ব্রিটিশ প্রশাসনের বিরুদ্ধে ঠাকুরের সমালোচনা ধারাবাহিকভাবে শক্তিশালী ছিল এবং বছরের পর বছর ধরে তা আরও তীব্র হয়েছে। এই কথাটা প্রায়শই বাদ দেওয়া হয়। তিনি ব্রিটিশ --পাশ্চাত্য - জনগণ এবং সংস্কৃতির যেকোন অবমাননা থেকে ব্রিটিশ রাজের সমালোচনাকে আলাদা করার জন্য একটি বিশেষ প্রচেষ্টা করেছিলেন। মহাত্মা গান্ধীর সুপরিচিত একটি প্রশ্নের উত্তরে, ইংল্যান্ডে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, তিনি পাশ্চাত্য সভ্যতা সম্পর্কে যা ভেবেছিলেন তা ঠাকুরের মুখ থেকে আসতে পারে না। তিনি বুঝতে পারবেন যে গান্ধী যে উস্কানি দিয়েছিলেন - সাংস্কৃতিক অহংকার এবং সেই সঙ্গে সাম্রাজ্যিক অত্যাচার জড়িত।

ডি এইচ লরেন্স একটি চমৎকার উদাহরণ তুলে ধরেছিলেন,: "আমি আরও বেশি অবাক হয়েছি যে, বাস্তবে, আমাদের ইউরোপীয় সভ্যতা প্রাচ্য, ভারতীয় এবং পারস্যের চেয়ে কতটা উঁচুতে দাঁড়িয়ে আছে। যা কখনও স্বপ্ন দেখেছিল …. তাদের দিকে তাকানোর এই প্রতারণা - ঠাকুরের এই জঘন্য পূজার মনোভাব ঘৃণ্য।" কিন্তু, গান্ধীর বিপরীতে, ঠাকুর ঠাট্টা করেও পাশ্চাত্য সভ্যতাকে খারিজ করতে পারেননি।

১৯৪১ সালে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে তাঁর শক্তিশালী অভিযোগের একটি বক্তৃতা তিনি তার শেষ জন্মদিনে দিয়েছিলেন।

যা পরে” সভ্যতার সংকট” শিরোনামে একটি পুস্তিকা আকারে প্রকাশিত হয়েছিল, তিনি পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতার মধ্যে পার্থক্য বজায় রাখতে কঠোরভাবে চাপ দেন। তিনি পশ্চিমা সভ্যতা প্রত্যাখ্যান করেন। যদিও তিনি ভারতকে "ব্রিটিশ প্রশাসনের মৃত ওজনের নিচে চাপা দেওয়া" হিসাবে দেখেছিলেন ("আরেকটি মহান এবং প্রাচীন সভ্যতা যোগ করে যার সাম্প্রতিক ট্র্যাজিক ইতিহাসের জন্য ব্রিটিশরা চীনের দায় অস্বীকার করতে পারে না")।

ঠাকুর স্মরণ করেছেন "আলোচনা কেন্দ্রিক আলোচনা থেকে ভারত কী অর্জন করেছে" শেক্সপিয়ারের নাটক এবং বায়রনের কবিতা এবং সর্বোপরি … উনিশ শতকের ইংরেজ রাজনীতির বৃহৎ হৃদয়ের উদারতাবাদ। ট্র্যাজেডি, যেমনটি ঠাকুর যেটি দেখেছিলেন, এই সত্য থেকে এসেছে যে "তাদের নিজস্ব সভ্যতায় যা সত্যিই সেরা ছিল, মানব সম্পর্কের মর্যাদা বজায় রাখা, এই দেশের ব্রিটিশ প্রশাসনে তার কোনও স্থান নেই।" "যদি তারা তার জায়গায়, হাতে লাঠিসোটা, 'আইন-শৃঙ্খলা' বা অন্য কথায় পুলিশ শাসন প্রতিষ্ঠা করে, সভ্যতার এমন উপহাস আমাদের কাছ থেকে কোনও সম্মান দাবি করতে পারে না।"


দেশপ্রেমের সমালোচনা

স্বাধীনতা আন্দোলন প্রায়শই যে প্রবল জাতীয়তাবাদী রূপ ধারণ করে তার বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ বিদ্রোহ করেছিলেন এবং এটি তাকে সমসাময়িক রাজনীতিতে বিশেষভাবে সক্রিয় অংশ নেওয়া থেকে বিরত রাখে।

বিদেশ থেকে ভারত যা শিখতে পারে - স্বাধীনভাবে এবং লাভজনকভাবে - তার গুরুত্ব অস্বীকার না করে তিনি ভারতের স্বাধীন হওয়ার অধিকার জোরদার করতে চেয়েছিলেন।

তিনি ভীত ছিলেন যে একটি আদিবাসী ভারতীয় ঐতিহ্যের পক্ষে পশ্চিমাদের প্রত্যাখ্যান শুধুমাত্র নিজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়;

এটি সহজেই বিদেশ থেকে অন্যান্য প্রভাবের প্রতি শত্রুতায় পরিণত হতে পারে, খ্রিস্টধর্ম যা চতুর্থ শতাব্দীতে ভারতের অংশে এসেছিল;

ইহুদি ধর্ম, যা জেরুজালেমের পতনের পরপরই ইহুদি অভিবাসনের মাধ্যমে এসেছিল, যেমন পরবর্তীতে (প্রধানত অষ্টম শতাব্দীতে) পার্সি অভিবাসনের মাধ্যমে জরথুষ্ট্রিয়ান ধর্ম এসেছিল এবং অবশ্যই - এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে - ইসলাম, যা ভারতে খুব শক্তিশালী উপস্থিতি রয়েছে দশম শতাব্দী থেকে।

দেশপ্রেমের বিরুদ্ধে ঠাকুরের সমালোচনা তাঁর লেখার একটি অবিচল অনুষঙ্গ । ১৯০৮ সালের প্রথম দিকে, তিনি একজন মহান ভারতীয় বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসুর স্ত্রী আবালা বোসের সমালোচনার জবাবে একটি চিঠিতে সংক্ষিপ্তভাবে তার অবস্থান তুলে ধরেন: “দেশপ্রেম আমাদের চূড়ান্ত আধ্যাত্মিক আশ্রয় হতে পারে না; আমার আশ্রয় মানবতা। আমি হীরার দামে কাঁচ কিনব না এবং যতদিন বেঁচে থাকি ততদিন দেশপ্রেমকে মানবতার উপরে জয়ী হতে দেব না।" তাঁর উপন্যাস ঘরে বাইরে (দ্য হোম অ্যান্ড দ্য ওয়ার্ল্ড) এই বিষয়বস্তু সম্পর্কে অনেক কিছু বলে। উপন্যাসে নিখিল যিনি নারীমুক্তি সহ সামাজিক সংস্কারে আগ্রহী, কিন্তু জাতীয়তাবাদের প্রতি ঠাণ্ডা, ধীরে ধীরে তার উৎফুল্ল স্ত্রী বিমলার সম্মান হারিয়ে ফেলেন, কারণ তিনি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে উৎসাহী হতে ব্যর্থ হন, যা তিনি দেখেন দেশপ্রেমিক প্রতিশ্রুতির অভাব। বিমলা নিখিলের জাতীয়তাবাদী বন্ধু সন্দীপের প্রতি মুগ্ধ হন, যিনি দুর্দান্তভাবে কথা বলেন এবং দেশপ্রেমিক জঙ্গিবাদের সঙ্গে কাজ করেন এবং তিনি তার প্রেমে পড়েন। নিখিল তার মতামত পরিবর্তন করতে অস্বীকার করেন: “আমি আমার দেশের সেবা করতে ইচ্ছুক; কিন্তু আমার উপাসনা আমি সেই অধিকারের জন্য সংরক্ষিত রাখি যা আমার দেশের চেয়ে অনেক বড়। আমার দেশকে দেবতা হিসেবে পূজা করা মানেই এর ওপর অভিশাপ আনা।"

গল্পটি উন্মোচিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সন্দীপ তার কিছু দেশবাসীর সঙ্গে সংগ্রামে যোগ দিতে ব্যর্থ হওয়ার জন্য ক্ষুব্ধ হয় যতটা সে মনে করে যে তা তাদের উচিত। তিনি তাদের নগণ্য ট্রেডিং স্টক পুড়িয়ে এবং তাদের শারীরিকভাবে আক্রমণ করার মাধ্যমে বিদ্রোহীদের সঙ্গে মোকাবিলা করার ব্যবস্থা করেন। বিমলাকে সন্দীপের উদ্দীপ্ত জাতীয়তাবাদী অনুভূতি এবং তার সাম্প্রদায়িক - এবং শেষ পর্যন্ত সহিংস-ক্রিয়াগুলোর মধ্যে সংযোগ স্বীকার করতে হয়। এরপর যে নাটকীয় ঘটনাগুলোর মাধ্যমে (নিখিল তার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য করার চেষ্টা করে) বিমলার রাজনৈতিক রোম্যান্সের সমাপ্তি ঘটে।

এটি একটি কঠিন বিষয়, এবং সত্যজিৎ রায়ের 'দি হোম অ্যান্ড দ্য ওয়ার্ল্ড'-এর সুন্দর চলচ্চিত্রটি গল্পের মানবিক অনুরাগ এবং বিতৃষ্ণা সহ উপন্যাসের উত্তেজনাকে উজ্জ্বলভাবে তুলে ধরেছে। আশ্চর্যের বিষয় নয় যে, এই গল্পে শুধু ভারতে নিবেদিতপ্রাণ জাতীয়তাবাদীদের মধ্যেই নয়, অনেক নিন্দাকারীও রয়েছে। জর্জ লুকাকস ঠাকুরের উপন্যাসটিকে "একটি ক্ষুদে বুর্জোয়া দৃষ্টভঙ্গি" বলে মনে করেন। "ব্রিটিশ পুলিশের বুদ্ধিবৃত্তিক সেবায়" এবং "গান্ধীর অবমাননাকর ব্যঙ্গচিত্র" বলেও মনে করেন। অবশ্যই, সন্দীপকে গান্ধী হিসাবে ভাবা অযৌক্তিক হবে, কিন্তু উপন্যাসটি একটি "দৃঢ় এবং মৃদু" সতর্কবাণী দেয়, যেমন বার্টোল্ট ব্রেখট তার ডায়েরিতে উল্লেখ করেছেন, জাতীয়তাবাদের কলুষতা সম্পর্কে, যেহেতু এটি এক-হাতে নয়। মহাত্মা গান্ধীর মতো বৃহৎ হৃদয়ের জাতীয়তাবাদী নেতাদের মন থেকে এমন অনুভূতি যতই দূরে থাকুক না কেন, একদলের ঘৃণা অন্যদের প্রতি ঘৃণার জন্ম দিতে পারে।


জাপানের প্রশংসা ও সমালোচনা

জাপানে জাতীয়তাবাদের প্রতি ঠাকুরের প্রতিক্রিয়া সম্বন্ধ বিশেষভাবে বলা যায়। ভারতের ক্ষেত্রে, তিনি একজন পরাজিত ও অপমানিত মানুষের আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা দেখেছিলেন, অন্যত্র উন্নয়নের কারণে পিছিয়ে থাকা মানুষদের মধ্যে, যেমনটি ঊনবিংশ শতাব্দীতে জাপানের উত্থানের আগে হয়েছিল। ১৯১৬ সালে জাপানে তার একটি বক্তৃতার শুরুতে ("জাপানে জাতীয়তাবাদ"), তিনি পর্যবেক্ষণ করেছিলেন যে "বন্ধনের সবচেয়ে খারাপ রূপ হল হতাশার বন্ধন, যা পুরুষদের নিজেদের বিশ্বাসের ক্ষতির মধ্যে আশাহীনভাবে শৃঙ্খলিত করে রাখে।" ঠাকুর শিল্প উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে পশ্চিমাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য একটি এশিয়ান জাতির ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য এশিয়ায় ব্যাপক জাপানের প্রশংসা ভাগ করেন। তিনি অত্যন্ত সন্তুষ্টির সঙ্গে উল্লেখ করেছেন যে জাপান "বিশাল অগ্রগতিতে শতাব্দীর নিষ্ক্রিয়তার পিছনে ফেলেছে, বর্তমান সময়কে তার অগ্রণী অর্জনে ছাড়িয়ে গেছে।"

কিন্তু তারপর ঠাকুর জাপানে একটি শক্তিশালী জাতীয়তাবাদের উত্থান এবং একটি সাম্রাজ্যবাদী জাতি হিসাবে এর উত্থানের সমালোচনা করেছিলেন।ঠাকুরের স্পষ্টভাষী সমালোচনা জাপানি শ্রোতাদের খুশি করেনি এবং ই.পি. থম্পসন লিখেছেন, "তাঁর প্রথম আগমনে তাকে স্বাগত জানানো শীঘ্রই শীতল হয়ে গেল।" জাপানে বসবাসকারী, যিনি ভারতের স্বাধীনতার পক্ষে সেখানে তাঁর প্রচেষ্টার জন্য ঠাকুরের অনুমোদন চেয়েছিলেন, যেখানে তিনি জাপান সরকারের সমর্থন পেয়েছিলেন। ঠাকুর উত্তর দিলেন:

আপনার তারবার্তার কারণে আমার অনেক অস্থির ঘন্টা কটেছে, আপনার আবেদন উপেক্ষা করার জন্য আমি খুব কষ্ট পাচ্ছি। আমি আশা করি আপনি এমন একটি কারণে আমার সহযোগিতা চেয়েছিলেন যার বিরুদ্ধে আমার আত্মা প্রতিবাদ করেনি। আমি জানি, এই আবেদন করার সময়, আপনি এশিয়ার বাকি অংশের সঙ্গে আমি জাপানিদের জন্য আমার মহান সম্মানের উপর নির্ভর করেছেন, একবার জাপানের প্রতি প্রশংসা করেছিলেন এবং একবার আশা করেছিলেন যে জাপানে এশিয়া শেষ পর্যন্ত তার চ্যালেঞ্জটি আবিষ্কার করেছে। পশ্চিমের কাছে, জাপানের নতুন শক্তি বিদেশী স্বার্থের বিরুদ্ধে প্রাচ্যের সংস্কৃতিকে রক্ষা করার জন্য পবিত্র হবে। কিন্তু জাপান সেই ক্রমবর্ধমান আশার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে এবং তার বিস্ময়কর, এবং আমাদের কাছে প্রতীকী, জাগরণে তাৎপর্যপূর্ণ মনে হওয়া সমস্ত কিছু প্রত্যাখ্যান করতে বেশি সময় নেয়নি এবং এখন এটি প্রাচ্যের প্রতিরক্ষাহীন জনগণের জন্য আরও খারাপ হুমকি হয়ে উঠেছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের অবস্থানকে কীভাবে দেখবেন তা ভারতে একটি বিভাজনমূলক বিষয় ছিল। যুদ্ধের পরে, যখন জাপানি রাজনৈতিক নেতাদের যুদ্ধাপরাধের জন্য বিচার করা হয়েছিল, বিচারকদের মধ্যে একমাত্র ভিন্নমতের কণ্ঠস্বর একজন বিশিষ্ট আইনজ্ঞ বিচারক রাধাবিনোদ পালের কাছ থেকে এসেছিল। পাল বিভিন্ন কারণে ভিন্নমত পোষণ করেন, তাদের মধ্যে বিজয়ী এবং পরাজিতদের মধ্যে ক্ষমতার অসামঞ্জস্যতার কারণে কোনো সুষ্ঠু বিচার সম্ভব নয়। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের অগ্রহণযোগ্য প্রকৃতির পরিপ্রেক্ষিতে জাপানি সামরিক আগ্রাসনের প্রতি ভারতে দ্ব্যর্থহীন অনুভূতি সম্ভবত অন্যান্য বিচারকদের থেকে ভিন্ন একটি দৃষ্টিভঙ্গি বিবেচনা করার জন্য পালকে প্ররোচিত করে।

আরও বলা যায়, সুভাষ চন্দ্র বসু (রাসবিহারী বসুর কোনো সম্পর্ক নেই), একজন নেতৃস্থানীয় জাতীয়তাবাদী, ব্রিটিশ কারাগার থেকে পালানোর পর ইতালি ও জার্মানির মাধ্যমে যুদ্ধের সময় জাপানে যান; তিনি জাপানিদের ভারতীয় সৈন্যদের ইউনিট গঠনে সাহায্য করেছিলেন, যারা আগে অগ্রসরমান জাপানি সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল, "ভারতীয় জাতীয় সেনাবাহিনী" হিসাবে জাপানিদের পক্ষে লড়াই করার জন্য। রবীন্দ্রনাথ পূর্বে ভারতীয় স্বাধীনতার জন্য একজন নিবেদিতপ্রাণ অসাম্প্রদায়িক যোদ্ধা হিসাবে সুভাষ বোসের জন্য প্রচুর প্রশংসা করেছিলেন। কিন্তু বোসের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড যখন এই মোড় নেয় তখন তাদের পথ বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত, যদিও বোস জাপানে পৌঁছানোর সময় ঠাকুর মারা গিয়েছিলেন।

ঠাকুর জাপানি সামরিকবাদকে দেখেছিলেন,কীভাবে জাতীয়তাবাদ একটি মহান অর্জন এবং প্রতিশ্রুতিপূর্ণ জাতিকেও বিভ্রান্ত করতে পারে। ১৯৩৮ সালে, বিশিষ্ট কবি এবং ঠাকুরের বন্ধু (পাশাপাশি ইয়েটস এবং পাউন্ডের) ইয়োন নোগুচি ঠাকুরকে চিঠি লিখেছিলেন, জাপান সম্পর্কে তার মন পরিবর্তন করার জন্য তাঁর কাছে অনুরোধ করেছিলেন। ১৯৩৮ সালের ১২সেপ্টেম্বর লেখা রবীন্দ্রনাথের উত্তরটি সম্পূর্ণরূপে আপসহীন ছিল:

আমার কাছে মনে হয় যে আমাদের দুজনের একজনের পক্ষে অন্যকে বোঝানোর চেষ্টা করা বৃথা, যেহেতু আপনার সরকারের নীতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে অন্যান্য এশিয়াটিক দেশগুলিকে ধমক দেওয়ার জন্য জাপানের অদম্য অধিকারে আপনার বিশ্বাস আমার দ্বারা ভাগ করা হয়নি .... বিশ্বাস করুন, এটা দুঃখ এবং লজ্জা, রাগ নয়, যা আমাকে আপনাকে লিখতে প্ররোচিত করে। আমি তীব্রভাবে ভুগছি শুধুমাত্র কারণ চীনাদের কষ্টের রিপোর্ট আমার হৃদয়ের বিরুদ্ধে আঘাত করে না, কিন্তু কারণ আমি আর গর্বের সঙ্গে একটি মহান জাপানের উদাহরণ তুলে ধরতে পারি না।

যুদ্ধোত্তর জাপান একটি শান্তিপূর্ণ শক্তি হিসেবে উত্থান হলে তিনি অনেক বেশি খুশি হতেন। তারপরও, যেহেতু তিনি অহংবোধ থেকে মুক্ত ছিলেন না, তাই ঔপন্যাসিক ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা এবং অন্যান্যদের দ্বারা তাঁর ধারণার প্রতি মনোযোগ দেওয়ায় তিনিওখুশি হতেন।


আন্তর্জাতিক উদ্বেগ

ঠাকুর সব সময় আন্তর্জাতিক রাজনীতি সম্পর্কে ভালভাবে অবহিত ছিলেন না। তিনি ১৯২৬ সালের মে-জুন মাসে ইতালিতে একটি সংক্ষিপ্ত সফরে তাঁকে মুসোলিনি কর্তৃক আপ্যায়িত হওয়ার আমন্ত্রণ দেয়া হয় দেওয়া হয় । রোম বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতের অধ্যাপক কার্লো ফরমিচি এই সফরের ব্যবস্থা করেছিলেন। যখন তাকে বেনেদেত্তো ক্রোসের সঙ্গে দেখা করতে বলা হয় তখন ফর্মিচি বললেন, "অসম্ভব! অসম্ভব!"

মুসোলিনি তাকে বলেছিলেন যে ক্রোস "রোমে নেই।" যখন ঠাকুর বলেছিলেন যে তিনি "যেখানেই থাকবেন" সেখানে যাবেন, মুসোলিনি তাকে আশ্বস্ত করেছিলেন যে ক্রোসের অবস্থান অজানা।

এই ধরনের ঘটনা, সেইসাথে রোম্যাঁ রোলাঁ এবং অন্যান্য বন্ধুদের কাছ থেকে সতর্কতা, মুসোলিনির সাথে ঠাকুরের প্রীতির ভাব আরও দ্রুত শেষ হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তিনি দুই নির্বাসিত গায়েতানো সালভেমিনি এবং গাইতানো সালভাদোরির কাছ থেকে ইতালীয় ফ্যাসিবাদের বর্বরতার গ্রাফিক বিবরণ পাওয়ার পরে এবং ইতালিতে কী ঘটছে তা আরও জানতে পেরে, তিনি কি প্রকাশ্যে শাসনের নিন্দা করেছিলেন?

আগস্ট মাসে ম্যানচেস্টার গার্ডিয়ান একটি চিঠি প্রকাশ করে। পরের মাসে, বেনিটো মুসোলিনির ভাইয়ের সম্পাদিত ম্যাগাজিন" পোপোলো ডি ইতালিয়া ”তে উত্তর দিয়েছিল: "কে পাত্তা দেয়? ইতালি তাদের দেখে হাসে, যারা ঠাকুর নামের অসহায় মানুষটিকে আমাদের মাঝে নিয়ে এসেছে ।”

ব্রিটেনের প্রতি তাঁর উচ্চ প্রত্যাশার সঙ্গে, আগ্রাসনের শিকার আন্তর্জাতিক ব্যক্তিদের প্রতি সরকারী সহানুভূতির অভাবের কারণে ঠাকুর বিস্মিত হতে থাকেন । ১৯৪১ সালে তার শেষ জন্মদিনে তিনি যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন তাতে তিনি এই থিমটিতে ফিরে এসেছিলেন:

জাপান যখন নীরবে উত্তর চীনকে গ্রাস করছিল, তখন তার বেপরোয়া আগ্রাসনকে ব্রিটিশ কূটনীতির প্রবীণরা একটি ছোট ঘটনা হিসাবে উপেক্ষা করেছিল। স্প্যানিশ প্রজাতন্ত্রের ধ্বংসের জন্য ব্রিটিশ রাষ্ট্রনায়করা কতটা সক্রিয়ভাবে সম্মত হয়েছিল আমরা দূর থেকেও প্রত্যক্ষ করেছি।

কিন্তু ব্রিটিশ সরকার এবং ব্রিটিশ জনগণের মধ্যে পার্থক্য করে, রবীন্দ্রনাথ "কীভাবে বীর ইংরেজদের একটি দল স্পেনের জন্য তাদের জীবন দিয়েছিল তার প্রশংসার সঙ্গে" উল্লেখ করেছেন।া

সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কে ঠাকুরের দৃষ্টিভঙ্গি অনেক আলোচনার বিষয়। তিনি রাশিয়ায় ব্যাপকভাবে পঠিত ছিলেন। ১৯১৭ সালে গীতাঞ্জলি (ইভান বুনিন দ্বারা সম্পাদিত, পরবর্তীতে সাহিত্যে প্রথম রাশিয়ান নোবেল বিজয়ী) এর বেশ কয়েকটি রাশিয়ান অনুবাদ পাওয়া যায় এবং ১৯২০ এর দশকের শেষের দিকে তাঁর কাজের অনেক ইংরেজি সংস্করণ বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট অনুবাদক দ্বারা রাশিয়ান ভাষায় অনূদিত করা হয়েছিল। তার কাজের রাশিয়ান সংস্করণগুলি প্রদর্শিত হতে থাকে: বরিস পাস্তেরনা ১৯৫০এবং ১৯৬০ এর দশকে তাকে অনুবাদ করেছিলেন।

১৯৩০ সালে ঠাকুর যখন রাশিয়া সফর করেন, তখন তিনি এর উন্নয়ন প্রচেষ্টা এবং দারিদ্র্য ও অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করার জন্য একটি বাস্তব প্রতিশ্রুতি হিসাবে যা দেখেছিলেন তাতে তিনি অনেক বেশি প্রভাবিত হয়েছিলেন। তবে যা তাকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছিল তা হল পুরোনো রাশিয়ান সাম্রাজ্য জুড়ে প্রাথমিক শিক্ষার প্রসার। লেটার্স ফ্রম রাশিয়া, বাংলায় লেখা এবং ১৯৩১ সালে প্রকাশিত, তিনি প্রতিকূলভাবে ব্রিটিশ প্রশাসনের দ্বারা ভারতে ব্যাপক নিরক্ষরতার গ্রহণযোগ্যতাকে শিক্ষার প্রসারের জন্য রাশিয়ান প্রচেষ্টার সাথে তুলনা করেছেন:

রাশিয়ার মাটিতে পা রাখার সময়, প্রথম যে বিষয়টি আমার নজরে পড়েছিল তা হল যে শিক্ষার ক্ষেত্রে, যেভাবেই হোক, কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণী এই কয়েক বছরে এতটা অগ্রগতি করেছে যে আমাদের দেশের সর্বোচ্চ শ্রেণীর কাছেও এর তুলনামূলক কিছুই ঘটেনি। গত একশত পঞ্চাশ বছরের কোর্স… এখানকার লোকেরা সুদূর এশিয়ার তুরকোমানদেরও সম্পূর্ণ শিক্ষা দিতে ভয় পায় না; বিপরীতভাবে, তারা এটি সম্পর্কে সম্পূর্ণভাবে আন্তরিক

১৯৩৪ সালে যখন বইটির কিছু অংশ ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয়, তখন ভারতের আন্ডার সেক্রেটারি পার্লামেন্টে বলেছিলেন যে এটি "ভারতে ব্রিটিশ প্রশাসনকে অবজ্ঞা ও অসম্মানে আনতে তথ্যের বিকৃতি দ্বারা গণনা করা হয়েছিল" এবং বইটি তখনই অবিলম্বে নিষিদ্ধ স্বাধীনতার পর পর্যন্ত ইংরেজি সংস্করণ প্রকাশিত হয় না।


শিক্ষা এবং স্বাধীনতা

ব্রিটিশ ভারতীয় প্রশাসকরা অবশ্য রাশিয়ার প্রতি ঠাকুরের প্রতিচ্ছবিকে দমন করার চেষ্টায় একা ছিলেন না। তাদের সঙ্গে সোভিয়েত কর্মকর্তারা যোগ দিয়েছিলেন। ১৯৩০ সালে ইজভেস্টিয়ার সঙ্গে একটি সাক্ষাৎকারে, ঠাকুর রাশিয়ায় স্বাধীনতার অভাবের তীব্র সমালোচনা করেছিলেন:

আমি আপনাকে অবশ্যই জিজ্ঞাসা করব: আপনারা যাদেরকে আপনাদের শত্রু বলে মনে করেন তাদের বিরুদ্ধে আপনাদের প্রশিক্ষণের ক্রোধ, শ্রেণী-বিদ্বেষ এবং প্রতিশোধপরায়ণতা জাগিয়ে আপনারা কি আপনাদের আদর্শের সেবা করছেন? … সত্য গ্রহণের জন্য প্রয়োজন মনের স্বাধীনতা; সন্ত্রাস আশাহীনভাবে এটিকে হত্যা করে ... মানবতার স্বার্থে আমি আশা করি আপনারা হয়ত কখনও সহিংসতার একটি পৈশাচিক শক্তি তৈরি করবেন না, যা সহিংসতা এবং নিষ্ঠুরতার অন্তহীন শৃঙ্খল বুনতে থাকবে। আপনারা জারিস্টের সময়ের অন্যান্য অনেক মন্দকে ধ্বংস করার চেষ্টা করেছেন। এটাকেও ধ্বংস করার চেষ্টা করবেন না কেন?

১৯৮৮ সাল পর্যন্ত ইজভেস্টিয়া-এ সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়নি – প্রায় ষাট বছর পরে। ১৯৩০ সালের রাশিয়ার প্রতি ঠাকুরের প্রতিক্রিয়া তার দুটি শক্তিশালী প্রতিশ্রুতি থেকে উদ্ভূত হয়েছিল: "মনের স্বাধীনতার গুরুত্বের প্রতি তাঁর আপসহীন বিশ্বাস সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং তার দৃঢ় বিশ্বাস যে মৌলিক শিক্ষার সম্প্রসারণ সামাজিক অগ্রগতির কেন্দ্রবিন্দু। তিনি মৌলিক শিক্ষার অভাবকে ভারতের অনেক সামাজিক ও অর্থনৈতিক দুর্দশার মৌলিক কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন:

আমার দৃষ্টিতে দুঃখের আরোপিত বিষয় আজ ভারতের হৃদয়ে বিরাজ করছে শিক্ষার অভাব । জাতিগত বিভাজন, ধর্মীয় দ্বন্দ্ব, কাজের প্রতি ঘৃণা, অনিশ্চিত অর্থনৈতিক অবস্থাই ভারতের শিক্ষার অবস্থার জন্য দায়ী।

ঠাকুর শুধুমাত্র দেশ জুড়ে শিক্ষার ব্যাপক সুযোগের জন্য উদ্বিগ্ন ছিলেন না (বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় যেখানে স্কুল কম ছিল), তবে স্কুলগুলো আরও প্রাণবন্ত এবং আনন্দদায়ক হয়, তিনি চাইতেন। তিনি নিজে খুব তাড়াতাড়ি স্কুল ছেড়ে দিয়েছিলেন। তিনি বিস্তৃতভাবে লিখেছেন যে কীভাবে স্কুলগুলিকে ছেলে এবং মেয়েদের কাছে আরও আকর্ষণীয় করে তোলা উচিত ও এইভাবে আরও ফলপ্রসূ করা উচিত। শান্তিনিকেতনে তার নিজের সহ-শিক্ষা বিদ্যালয়ের অনেক প্রগতিশীল বৈশিষ্ট্য ছিল। এখানে জোর দেওয়া হয়েছিল শৃঙ্খলার পরিবর্তে স্ব-প্রেরণার উপর, এবং প্রতিযোগিতামূলক শ্রেষ্ঠত্বের পরিবর্তে বৌদ্ধিক কৌতূহল বৃদ্ধির উপর।

রবীন্দ্রনাথের জীবনের বেশিরভাগ সময় কেটেছে শান্তিনিকেতনে স্কুলের উন্নয়নে। স্কুলে কখনই খুব বেশি টাকা ছিল না, যেহেতু ফি খুব কম ছিল। তার বক্তৃতা সম্মাননা ৭০০ ডলার সেইসাথে তার নোবেল পুরস্কারের বেশিরভাগ অর্থে স্কুলটি তিনি চালান। সরকারের কাছ থেকে কোনো সহায়তা পায়নি, কিন্তু বেসরকারি নাগরিকদের কাছ থেকে সাহায্য পেয়েছিল - এমনকি মহাত্মা গান্ধীও এর জন্য অর্থ সংগ্রহ করেন।

ভূমিকম্প নিয়ে মহাত্মা গান্ধীর সাথে বিরোধ এমন একটি বিষয়কে স্পর্শ করেছিল যা ঠাকুরের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল: বিজ্ঞানের পাশাপাশি সাহিত্য এবং মানবিক বিষয়ে শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা। শান্তিনিকেতনে, ক্লাসিক সহ ভারতীয় ঐতিহ্যের উপর জোর দেওয়া এবং শিক্ষার ভাষা হিসাবে ইংরেজির পরিবর্তে বাংলা ব্যবহারে শক্তিশালী "স্থানীয়" উপাদান ছিল। একই সময়ে, চীন, জাপান এবং মধ্যপ্রাচ্যের জন্য উৎসর্গীকৃত বিভিন্ন ধরণের সংস্কৃতির কোর্স এবং অধ্যয়ন প্রোগ্রাম ছিল। অনেক বিদেশী শান্তিনিকেতনে পড়তে বা পড়াতে এসেছিলেন, এবং পড়াশোনার সংমিশ্রণ কাজ করে বলে মনে হয়েছিল।

আমি শান্তিনিকেতনে শিক্ষিত হয়ে ঠাকুরকে একজন শিক্ষাবিদ হিসেবে দেখেছি। স্কুলটি অস্বাভাবিক অসাধারণ ছিল। ল্যাবরেটরি ছাড়া ক্লাসগুলো বাইরে অনুষ্ঠিত হত। আমরা রবীন্দ্রনাথের বিশ্বাস সম্পর্কে যাই ভাবি না কেন যে কেউ শেখার সময় প্রাকৃতিক পরিবেশে থাকার ফলে লাভ হয় (আমাদের মধ্যে কেউ কেউ এই তত্ত্বটি নিয়ে তর্ক করেছেন), আমরা সাধারণত বহিরঙ্গন স্কুলে পড়ার অভিজ্ঞতাকে অত্যন্ত আকর্ষণীয় এবং আনন্দদায়ক বলে মনে করেছি। একাডেমিকভাবে, আমাদের স্কুলটি বিশেষভাবে উত্তেজনাপূর্ণ ছিল না (প্রায়শই আমাদের কোনও পরীক্ষাই ছিল না), এবং এটি স্বাভাবিক শিক্ষাগত মান অনুসারে, কলকাতার কিছু ভাল স্কুলের সাথে প্রতিযোগিতা করতে পারেনি। কিন্তু শ্রেণী আলোচনা ভারতীয় ঐতিহ্যবাহী সাহিত্য থেকে সমসাময়িক তথা ধ্রুপদী পাশ্চাত্য চিন্তাধারায় এবং তারপর চীন বা জাপান বা অন্য কোথাও সংস্কৃতির দিকে নিয়ে যেতে পারে তা নিয়ে উল্লেখযোগ্য কিছু ছিল। স্কুলের বৈচিত্র্যের উদযাপন সাংস্কৃতিক রক্ষণশীলতা এবং বিচ্ছিন্নতাবাদের সাথেও তীব্র বিপরীত ছিল যা সময়ে সময়ে ভারতকে আঁকড়ে ধরেছে।

সমসাময়িক বিশ্ব সম্পর্কে ঠাকুরের দৃষ্টিভঙ্গির সাংস্কৃতিক প্রদান ও গ্রহণ সত্যজিৎ রায়ের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে ঘনিষ্ঠ সমান্তরাল রয়েছে, যিনি শান্তিনিকেতনের একজন প্রাক্তন ছাত্র যিনি ঠাকুরের গল্পের উপর ভিত্তি করে বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র তৈরি করেছিলেন।১৯৯১ সালে শান্তিনিকেতন সম্পর্কে রায়ের কথাগুলো রবীন্দ্রনাথকে অত্যন্ত খুশি করেছিল:

আমি শান্তিনিকেতনে কাটানো তিন বছরকে আমার জীবনের সবচেয়ে ফলপ্রসূ বলে মনে করি। শান্তিনিকেতন প্রথমবার আমার চোখ খুলেছিল ভারতীয় এবং সুদূর প্রাচ্যের শিল্পের বৈচিত্র্যের প্রতি। তখন পর্যন্ত আমি সম্পূর্ণরূপে পাশ্চাত্য শিল্প, সঙ্গীত ও সাহিত্যের অধীন ছিলাম। শান্তিনিকেতন আমাকে পূর্ব এবং পশ্চিমের সম্মিলিত জ্ঞান দান করেছিল।।


ভারত আজ

ভারতের স্বাধীনতার পঞ্চাশতম বার্ষিকীর অর্ধশতাব্দীতে ভারত কী অর্জন করেছিল বা কী করেনি তার হিসাব ছিল যথেষ্ট আগ্রহের বিষয়: "সেই প্রথম পঞ্চাশ বছরের গল্প কী ছিল?" (যেমন শশী থারুর তার ভারতের ভারসাম্যপূর্ণ, তথ্যপূর্ণ, এবং অত্যন্ত পাঠযোগ্য বিবরণে জিজ্ঞাসা করেছিলেন: মধ্যরাত থেকে সহস্রাব্দ পর্যন্ত)।।

ঠাকুর যদি আজকের ভারতকে দেখতেন, স্বাধীনতার অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় পরে, তাহলে সম্ভবত তিনি হতবাক হতেন জনসাধারণের অব্যাহত নিরক্ষরতায়। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় জাতীয়তাবাদী নেতারা যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তার প্রতি সম্পূর্ণ বিশ্বাসঘাতকতা হিসাবে তিনি মনে করতেন।

১৯৪৭ সালের আগস্টে স্বাধীনতার প্রাক্কালে নেহরুর উত্তেজনাপূর্ণ বক্তৃতায় (ভারতের "ভাগ্যের সঙ্গে চেষ্টা") এমন একটি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।

চাইল্ড এডুকেশনের প্রতি ঠাকুরের আগ্রহের পরিপ্রেক্ষিতে, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার অসাধারণ প্রসারের দ্বারা ঠাকুরকে সান্ত্বনা দেওয়া যেত না। তিনি হতবাক হয়ে যেতেন, চীন সহ পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিপরীতে অর্ধেক প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যা এবং দুই তৃতীয়াংশ ভারতীয় মহিলা পড়তে বা লিখতে অক্ষম। পরিসংখ্যানগতভাবে নির্ভরযোগ্য জরিপগুলি ইঙ্গিত করে ১৯৮০ এর দশকের শেষের দিকে বারো থেকে চৌদ্দ বছর বয়সীদের প্রায় অর্ধেক গ্রামীণ মেয়ে তাদের জীবনের একটি দিনও কোনো স্কুলে যায়নি৷।

এই অবস্থাটি গণশিক্ষার প্রতি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অবহেলার ধারাবাহিকতার ফলাফল। ভারতের ঐতিহ্যগত অভিজাতবাদ, সেইসাথে উচ্চ-শ্রেণীর আধিপত্য প্রধান সমসাময়িক রাজনীতি এর জন্য দায়ী। (কেরালার মতো ভারতের কিছু অংশ ছাড়া) ঠাকুর নিরক্ষরতা এবং শিক্ষার অবহেলাকে শুধু ভারতের অব্যাহত সামাজিক অনগ্রসরতার প্রধান উৎস হিসেবেই দেখতেন। এটি একটি বড় বাধা হিসেবেও দেখতেন, ভারতে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সম্ভাবনা ও নাগালকে সীমিত করায়। স্থানীয়ভাবে দারিদ্র্য দূর করার জন্য ঠাকুর একটি বৃহত্তর প্রতিশ্রুতি ও একটি বৃহত্তর জরুরী বোধের প্রয়োজন দৃঢ়ভাবে অনুভব করতেন।

একই সময়ে, ঠাকুর নিঃসন্দেহে ভারতে গণতন্ত্রের টিকে থাকতে, তার তুলনামূলকভাবে মুক্ত সংবাদপত্রে এবং সাধারণভাবে "মনের স্বাধীনতা" থেকে কিছুটা সন্তুষ্টি খুঁজে পেতেন যা স্বাধীনতা-পরবর্তী ভারতীয় রাজনীতি সামগ্রিকভাবে বজায় রাখতে পারে । ঠাকুর জীবিত থাকা কালে ঐতিহাসিক ই.পি. থম্পসনের লেখায় সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছিলেন। (যার বাবা এডওয়ার্ড থম্পসন ঠাকুরের প্রথম প্রধান জীবনী লিখেছিলেন:

বিশ্বের সমস্ত অভিসারী প্রভাব হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান, ধর্মনিরপেক্ষ; স্ট্যালিনবাদী, উদারপন্থী, মাওবাদী, গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক, গান্ধীবাদী মতবাদ এই সমাজের মধ্য দিয়ে চলে। পশ্চিম বা প্রাচ্যে এমন কোনো চিন্তা নেই যা কিছু ভারতীয় মনে সক্রিয় নয়।

১৯৭০-এর দশকে, যখন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ( তিনি শান্তিনিকেতনের একজন প্রাক্তন ছাত্রী) "জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছিলেন, তখন ভারতে মৌলিক স্বাধীনতা এবং রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকারগুলোকে সাধারণভাবে বিলোপ করার একটি সরকারি প্রচেষ্টা দেখে ঠাকুরও খুশি হতেন না। "ভারতীয় ভোটাররা ব্যাপকভাবে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, যার ফলে ইন্দিরা সরকারের দ্রুত পতন ঘটে।

রবীন্দ্রনাথ আরও দেখতে পেতেন যে স্বাধীনতার পর থেকে দুর্ভিক্ষ দূর করার নীতির পরিবর্তনগুলো গণতান্ত্রিক ভারতে শোনার স্বাধীনতার সঙ্গে অনেক বেশি সম্পর্কযুক্ত। ঠাকুরের রাজা ও রানী নাটকে ("রাজা ও রানী"), সহানুভূতিশীল রানী অবশেষে ক্ষুধার্তদের প্রতি রাষ্ট্রীয় নীতির নির্মমতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। তিনি প্রাসাদের বাইরে কুৎসিত শব্দ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতে শুরু ,করেন। কেবলমাত্র তাকে বলা হয় যে শব্দ আসছে " কোলাহলপূর্ণ জনতার থেকে যারা খাবারের জন্য নির্লজ্জভাবে চিৎকার করে এবং প্রাসাদের শান্তি নষ্ট করে।"

ভারতের ভাইসরয়ের অফিস স্বাধীনতার ঠিক আগে, ১৯৪৩ সালের বাংলা তথা ভারতের দুর্ভিক্ষকে প্রতিরোধ করতে পারতো। এই দুর্ভিক্ষে দুই থেকে ত্রিশ লক্ষ লোক মারা গিয়েছিল।


স্বাধীনতায় নির্ভীক যুক্তি।

গান্ধীর বিপরীতে, রবীন্দ্রনাথ ভারতে আধুনিক শিল্পের বিকাশ, বা প্রযুক্তিগত অগ্রগতির ত্বরান্বিত করতে অনাগ্রহী ছিলেন না। কারণ তিনি চাননি যে ভারতকে "প্রাচীন আবিষ্কারের "চরকা" মোড়কে বেঁধে দেওয়া হোক।

ঠাকুর উদ্বিগ্ন ছিলেন মানুষ যন্ত্রের দ্বারা আধিপত্য বিস্তার না করতে পারায়।

ঠাকুর আধুনিক প্রযুক্তির ভাল ব্যবহার করার বিরোধী ছিলেন না। "যন্ত্রের উপর কর্তৃত্ব," তিনি সভ্যতার সংকটে লিখেছেন, "যার দ্বারা ব্রিটিশরা তাদের বিশাল সাম্রাজ্যের উপর তাদের সার্বভৌমত্বকে সুসংহত করেছে, একটি সিল করা বই রাখা হয়েছে, যা এই অসহায় দেশে যথাযথ প্রবেশাধিকার অস্বীকার করা হয়েছে।" পরিবেশের প্রতি রবীন্দ্রনাথের গভীর আগ্রহ ছিল – তিনি বিশেষভাবে বন উজাড়ের বিষয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন এবং ১৯২৮ সালের প্রথম দিকে একটি "বৃক্ষ রোপণ উৎসব" (বৃক্ষ-রোপনা) শুরু করেছিলেন। কিন্তু তিনি এই অবস্থান থেকে আধুনিক শিল্প ও প্রযুক্তির বিরুদ্ধে ছিলেন না।


সাংস্কৃতিক বিচ্ছেদ নিয়ে

রবীন্দ্রনাথ অন্যত্র যেমন ভারতে সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতাবাদের বৃদ্ধি দেখে হতবাক হতেন বেঁচে থাকলে। তিনি যে "উন্মুক্ততা"কে এত মূল্য দিয়েছেন তা এই মুহূর্তে অবশ্যই প্রবল চাপের মধ্যে রয়েছে - অনেক দেশেই। ভারতে ধর্মীয় মৌলবাদের এখনও অপেক্ষাকৃত কম অনুসারী রয়েছে; কিন্তু বিভিন্ন দল তাদের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করছে বলে মনে হচ্ছে। অবশ্যই ভারতের কিছু অংশে (বিশেষ করে পশ্চিম এবং উত্তরে) ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা অনেক বেশি সাফল্য পেয়েছে। ঠাকুর ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার বিস্তারকে সংস্কৃতির একটি কৃত্রিমভাবে বিচ্ছিন্নতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত হিসাবে দেখতেন।

তিনি অনেক সংস্কৃতির মিলন না হয়ে ভারতকে বিশেষভাবে হিন্দু পরিভাষায় সংজ্ঞায়িত করতে দৃঢ়ভাবে প্রতিরোধ করতেন।

এমনকি ১৯৪৭ সালের বিভক্তির পরেও, ভারত এখনও বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ, যেখানে বাংলাদেশের চেয়ে বেশি মুসলমান এবং পাকিস্তানের প্রায় সমান।

শুধুমাত্র ইন্দোনেশিয়াতেই ইসলামের যথেষ্ট অনুসারী রয়েছে।

প্রকৃতপক্ষে, ভারতের সাংস্কৃতিক পটভূমি এবং এর সমৃদ্ধ বৈচিত্র্যময় ইতিহাসের বিশাল ভিন্নতার দিকে ইঙ্গিত করে, ঠাকুর যুক্তি দিয়েছিলেন যে "ভারতের ধারণা" নিজেই একটি সাংস্কৃতিকভাবে বিচ্ছিন্নতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে লড়াই করেছে - "অন্যদের থেকে নিজের লোকদের আলাদা করার তীব্র চেতনার বিরুদ্ধে।

ঠাকুর সেই সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদেরও বিরোধিতা করতেন যা সম্প্রতি ভারতে পাশ্চাত্যের প্রভাবের অতিরঞ্জিত ভয়ের সঙ্গে কিছু জায়গা লাভ করছে। তিনি তার বিশ্বাসে আপোষহীন ছিলেন যে মানুষ গঠনমূলক উপায়ে বেশ ভিন্ন সংস্কৃতিকে শোষণ করতে পারে:

আমরা মানব পণ্যের মধ্যে যা বুঝি এবং উপভোগ করি তা সঙ্গে সঙ্গে আমাদের হয়ে যায়, যেখানেই তাদের উৎপত্তি হতে পারে। আমি আমার মানবতা নিয়ে গর্ববোধ করি যখন আমি অন্য দেশের কবি-শিল্পীদের নিজের বলে স্বীকার করতে পারি। আমাকে অবিকৃত আনন্দের সাথে অনুভব করতে দিন যে মানুষের সমস্ত মহিমা আমার। তাই এটা আমাকে গভীরভাবে কষ্ট দেয় যখন আমার দেশে পাশ্চাত্যের বিরুদ্ধে প্রত্যাখ্যানের আর্তনাদ জোরে জোরে বেজে ওঠে যে পাশ্চাত্য শিক্ষাই আমাদের ক্ষতি করতে পারে।

এই প্রেক্ষাপটে এটা জোর দিয়ে বলা জরুরী যে, রবীন্দ্রনাথ ভারতের নিজস্ব ঐতিহ্য নিয়ে গর্বিত ছিলেন না এবং প্রায়শই এ বিষয়ে কথা বলতেন। তিনি অক্সফোর্ডে বক্তৃতা দিয়েছিলেন, স্পষ্টত সন্তুষ্টির সাথে, ভারতের ধর্মীয় ধারণার গুরুত্ব সম্পর্কে - প্রাচীন গ্রন্থ এবং জনপ্রিয় কবিতা থেকে (যেমন ষোড়শ শতাব্দীর মুসলিম কবি কবিরের শ্লোক) উভয়ের উদ্ধৃতি। ১৯৪০;সালে, যখন তাকে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি সম্মানসূচক ডক্টরেট প্রদান করে, শান্তিনিকেতনে তার নিজস্ব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে ("গ্যাঙ্গেম ডিফ্লুইট আইসিস" অক্সফোর্ড সহায়কভাবে ব্যাখ্যা করেছিল), ভবিষ্যদ্বাণীযোগ্য "ল্যাটিনের ভলি" ঠাকুর উত্তর দিয়েছিলেন "এর দ্বারা সংস্কৃতের একটি ভলি,” যেমনটি রবীন্দ্রনাথের একজন কোয়েকার বন্ধু মার্জোরি সাইকস রিপোর্ট করেছেন। ম্যাচের তার প্রফুল্ল সারাংশ, "ভারত তার নিজের ছিল," ভারতীয় সংস্কৃতিতে ঠাকুরের গর্বের সঙ্গো সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না। পশ্চিমা সভ্যতার প্রতি তার স্বাগতিক মনোভাব এই আত্মবিশ্বাসের দ্বারা শক্তিশালী হয়েছিল: তিনি ভারতের সংস্কৃতিকে ভঙ্গুর এবং পশ্চিমা প্রভাব থেকে "সুরক্ষার" প্রয়োজন দেখেননি।

ভারতে, তিনি লিখেছেন, "পরিস্থিতি আমাদের প্রায় ইংরেজি শিখতে বাধ্য করে, এবং এই সৌভাগ্যজনক দুর্ঘটনা আমাদের বিশ্বের সব কাব্য সাহিত্যের মধ্যে সবচেয়ে ধনীতে প্রবেশের সুযোগ করে দিয়েছে।" ঔপনিবেশিক ও উত্তর-ঔপনিবেশিক অঞ্চলে মুক্তমনা উপায়ে পশ্চিমা সংস্কৃতিকে মূল্যায়ন করার গুরুত্বের (ঔপনিবেশিকতা এটির একটি প্রধান উদাহরণ) ক্ষমতার একটি গুরুতর অসামঞ্জস্যের (ঔপনিবেশিকতাবাদ এটির একটি প্রধান উদাহরণ) অন্যায়ের মধ্যে স্পষ্টভাবে পার্থক্য করার জন্য রবীন্দ্রনাথের যুক্তিতে আমার কাছে যথেষ্ট শক্তি রয়েছে।

রবীন্দ্রনাথ প্রতিটি ইস্যুতে খোলামেলা বিতর্কের উপর জোর দিয়েছিলেন, এবং একটি যান্ত্রিক সূত্রের উপর ভিত্তি করে অবিশ্বাসী সিদ্ধান্তে, সেই সূত্রটি বিচ্ছিন্নভাবে যতই আকর্ষণীয় মনে হোক না কেন (যেমন "এটি আমাদের ঔপনিবেশিক প্রভুদের দ্বারা আমাদের উপর জোর করা হয়েছিল - আমাদের অবশ্যই এটি প্রত্যাখ্যান করতে হবে," "এটি আমাদের ঐতিহ্য - আমাদের অবশ্যই এটি অনুসরণ করতে হবে," "আমরা এটি করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছি - আমাদের অবশ্যই সেই প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে হবে," ইত্যাদি)। তিনি ক্রমাগত যে প্রশ্নটি জিজ্ঞাসা করেন তা হল সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে যা প্রস্তাব করা হচ্ছে তা চাওয়ার যথেষ্ট কারণ আমাদের আছে কিনা। ইতিহাসের মতো গুরুত্বপূর্ণ, যুক্তিকে অতীতের বাইরে যেতে হবে। যুক্তির সার্বভৌমত্বে - স্বাধীনতায় নির্ভীক যুক্তি - যে আমরা খুঁজে পেতে পারি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিরন্তন কণ্ঠস্বরে।

0 comments: