পথে প্রান্তরে - রঞ্জন ঘোষ দস্তিদার
Posted in পথে প্রান্তরেদ্বিতীয় পর্ব
গাড়ি ঠিক সাতটায় এল। আমরা বেরিয়ে পড়লাম সোয়া সাতটায়। সেই একই রাস্তা। চেম্বুর হয়ে পুনার রাস্তা ধরো। আমরা সকালে বেড়িয়েছি। হ্যাঁ, এখানে সাতটা সকালই। আমি এখানে কাজ করেছি, থেকেছি। জানি। সকালে বেরোলে একটু তাড়াতাড়ি যাওয়া যায়। বম্বে থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। একবার জ্যামে পড়লে রক্ষে নেই। তাও গাড়ি চলছে ৪০এ। মাঝে মাঝে ৩০।
মহারাষ্ট্রের একটা পর্যটন কেন্দ্র। এখানে ভগবান, প্রকৃতি আর অ্যাডভেঞ্চার সব পাওয়া যাবে একসাথে। গ্রামে ভোরগিরি মন্দির আছে। সেখানে শঙ্কর মহাদেব বসে আছেন। ট্রেক করে – ট্রেক বললে মড মড লাগে—আসলে হেঁটে নেমে যাও। ৫/৬ ঘন্টা লাগবে নীচের গ্রামে পৌঁছোতে। পা ধরে গেলে হনুমান লেকের পাশে বসে যাও। বন জঙ্গলে ঘোরার সাধ থাকলে গাড়ি নিয়েই ঢুকে পড়া যায়। বড় কাঠবেড়ালি, প্যাঙ্গোলিন আর সাপ খোপ। এর বেশি প্রত্যাশা রাখলে ঠকতে হবে বলে দিলাম। সঙ্গি থামলেন।
পাথরের মাঝখান থেকে লিঙ্গটি মাথা তুলে আছে। ছোঁয়া যায়। তার চারপাশ দিয়ে জল বইছে।
পুনা থেকেও যাওয়া যায়। আমরা কিন্তু পুনা পর্যন্ত যাবো না। তার আগেই ‘চাকান’ থেকে বেঁকে যাব বাঁয়ে। এক দিন দু রাত যথেষ্ট। বম্বের অনেকের উইকেন্ড বেড়ানোর পছন্দের জায়গা।
কেমন যেন গা ছাড়া জানকারি।
দাও দাও, খাবার দাবার কিছু এনেছ কি সাথে?
বেশ চলছিলাম আমরা। বাঁয়ে ঘোরার পরই পাল্টে গেল আশপাশ। ফ্যাক্টরি এলাকা। আমার কিন্তু বেশ লাগে। জাতে মিস্ত্রি কিনা। চেনা শোনা নাম দেখলে ভেতরে একটা কথা উঠে আসে “ ও, এখানে তোমাদের আস্তানা বুঝি ?” ছোট ছোট টিলা সমান করে দিয়ে কারখানা সব। সার সার মোটর সাইকেল। মনে এল এরা সব থাকে কোথায়? কতদূর থেকে যাতায়াত করে? চোখে পড়ল বাবা ছেলেকে নিয়ে যাচ্ছে স্কুলে। হেলমেট নেই। অবশ্য রাস্তায় তেমন গাড়িও নেই। আমাদের আগেও নেই, পেছন থেকেও কেউ ওভারটেক করেনি এখনও। মজার মধ্যে একটা টিলা থেকে নামছি, আর একটায় উঠছি। পাহাড়ি রাস্তায় চলছি অথচ সবুজ নেই। রুক্ষ চারপাশ। চোখের আরাম সুন্দর সুন্দর কারখানা। অনেক লোক কাজ করছে।
মন খারাপ করে। আমার চোখের সামনে কেমন করে পুনার চারপাশ কারখানাময় হয়ে গেল। আমাদের বাংলাটা হল না। সিঙ্গুর, টাটা এই সব মনে ভাসছে।
সব ভালো, রাস্তা ভালো না। এত ভালো গাড়ি তাও বেশ ঝাঁকুনি।
একটু কথা বার্তা হচ্ছিল ভেতরে। বাইরে তাকিয়ে দেখি পাল্টে গেছে আশপাশ। আমাদের মন বুঝেছে প্রকৃতি। একটা পাহাড়ি নদি --- নদি বলব? নাকি ঝোরা? সোঁতা? ছোট্ট একটা গাঁ। সবাই সবার বন্ধু। একজন হাঁটু জলে নেমে হুস করে ঘুরিয়ে ফেলল জাল। এই একটা ছবি দারুন একটা ভারতনাট্যম মুদ্রার থেকেও ভালো লাগে আমার। তারপর সাসপেন্স। নর্তক জালের মাথা ছোট করছে আর দড়ি গোটচ্ছে হাতে। খুব সাবধানী গুটি গুটি হাঁটছে আর একটু, আর একটু করে আরো একটু গভীরে । দারুন একটা সাস্পেন্স থ্রিলার। কি মাছ উঠবে? কত মাছ উঠবে? উঠবে কি?
কোচির গল্প মনে পড়ল। মেরিন ড্রাইভ এ একটা মস্ত তেকোনা জাল টাঙ্গানো আছে বাঁশের মাথায়। একটু লোক জমলে জাল ফেলে তুলে আনে। আমাদের দেখে ফেলল। অ বাবা, তিন খানা চিংড়ি, একটা কাঁকড়া। হেসে বাঁচি না।
একটু এগোতেই দেখা গেল “কোন এক গাঁয়ের বধু” বসেছে কাপড়ের ডাই নিয়ে। গল্প করছে। কার সাথে? ঝোরার সাথে। মনের কথা নাকি নদিকে বলে দিতে হয়। মন একদম হাল্কা হয়ে যায়।
এই যাহ। তোমার যত বানানো কথা।
এই দেখ, তোমরা না জানলেই সেটা গাঁজাখুরি হবে?
দেখ, ওর হাত চলছে আর মুখও চলছে। বেলা বাড়ছে যে। এই স্নান সেরে ঠাকুরের পায়ে দুটি ফুল দিয়ে ওদের খেতে দিতে হবে না ?
ছোট্ট একটা সাঁকো --- এই, এই সাঁকোর ওপর দিয়ে কি গাড়ি যায়? এইবার খেতি দেখা যাচ্ছে। আমি সামনে ছিলাম ড্রাইভারের পাশে। আমি তো মোহিত হয়ে দেখছি, বলছি আর শুনছি গাঁয়ের কথা। ও আমায় বলল
“থামব সাব ছবি তুলবেন না”?
ঠিক কথা। ছবি তোলা উচিত। এই বার সবাই ছবি তুলতে শুরু করল। টিলার গায়ে ধাপে ধাপে নামছে খেতি।
“ঝুম চাষ, ঝুম চাষ”।
“মোটেও না। পরিযায়ী মানুষজন ঝুম চাষ করে জঙ্গল, গাছপালা জ্বালিয়ে দিয়ে। ঐ জ্বালিয়ে দেওয়া ছাই ওদের সার”।
আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল নেকলেস পরা পাহাড়ের অপরূপ দৃশ্য। বম্বে থেকে গুজরাটের দিকে আমাকে প্রতিদিন গাড়ি নিয়ে যেতে হত। যেদিন সন্ধ্যের মুখে পাহাড় এর ঢালে গাড়ি চালাতে হত, কপাল ভালো থাকলে বা সময়টা ঠিক হলে দেখতে পেতাম সন্ধ্যের ধূসর আকাশের ঘোমটা টেনে পাহাড় দাঁড়িয়ে। কালো। তার গলার কাছে সোনার কাজ করা নানান নকশার হার। দাঁড়িয়ে যেতাম চাবি বন্ধ করে। যে দেখেনি, বা দেখার সুযোগ হয়নি যার, সে ভাবতেও পারবে না পাহাড়ের সে রূপের কি মোহ!
ঝুম চাষের শুরু।
ছবি তোলা হল।
এসব ধাপ চাষ। দেখছ না ধাপে ধাপে নেমে গেছে সবুজের সারি। বললাম দাঁড়িও না। রাস্তা যা খারাপ গাড়ি চলছেই না। কেউ যেন কুড়ি কিলোমিটার বাঁচাবার জন্য এই পথ না ধরে। হেঁটে যাও, চলবে। গাড়ি এনো না এ পথে।
দাঁড়াতেই হল। ফুলের হাতছানি। মাদাম নেমেই গেলেন। ফুলেরা সভা করছে। সেখানে তিনি গেলেন তাঁর বক্তব্য পেশ করতে। আমিও নামলাম। একজন চেনা, সূর্যমুখির কুট্টি বোন। এনাদের সভাতেই গেছেন মাদাম। অন্যজন ভারি ছোট, ছোট্ট কন্যে। একদম কাছে যেতে হল ওনার সাথে কথা বলতে। আলাপ হল, সঙ্গে চলল আমার।
নির্নিমেষ চেয়ে রইলাম ধাপ চাষের দিকে। একটা হাতছানি দিয়ে ঘুরে গেছে রাস্তাটা। একটা মোটর সাইকেল দেখা যাচ্ছে না? এই দেখ দেখ, একটা বাড়িও দেখা যাচ্ছে না মোড়ের মাথায়? বেট, মোটর সাইকেল ঐ বাড়িতেই থামবে।
ছবিকে পূর্ণতা দিয়েছে এখানে ওখানে ঝাঁকড়া মাথা গাছ। রঙের খেলাও আছে। ধুসর, গাঢ় সবুজ, সবুজ, কচি সবুজ, কালো রাস্তা। একটু ডান পাশ ঘেঁষে একা দাঁড়িয়ে একটা পোল। একজন তো থাকতে হবে দর্শক। নতুবা প্রশংসা করবে কে!
‘সেই পথ এসে মিলে গেল শেষে’ --- পাক্কা হাইওয়েতে। যদি ঠিক ঠাক মনে পরে এস এইচ ৫৪। স্টেট হাইওয়ে ৫৪। এটা পুনা থেকে আসছে। একদম পাটা রাস্তা। গাড়ি এবার শোঁ শোঁ করে ছুটছে।
0 comments: