0

গল্প - সুব্রত ঘোষ

Posted in



















শরীর আর চলছে না । তিন বছরের এক্সটেনশন  পেয়ে রোজ ঢাকুরিয়া  থেকে  বিবাদীবাগ আসা যাওয়া  করতে সুবলবাবু র এখন ক্লান্তি আসে । ফেরার সময় মিনিবাসে উঠে কেমন যেন ঝিমুনি ধরে। কন্ডাক্টরের চিৎকারে ঝিমুনি থেকে বেরিয়ে কোন রকমে বুকপকেট থেকে ভাড়ার টাকাটা দিয়ে আবার ঝিমুনিতে চলে যান হঠাৎ জ্ঞান ফিরে পেয়ে  আবার কোমায় চলে যাওয়া পেসেন্টের মতো । সীটে বসে আগে পিছে ঘাড় লটকে ঝটকা খেতে খেতে একসময় চোখটাকে নরুনচেরা করে পাশের সহযাত্রীর কাঁধটা জরিপ করে নিয়ে আস্তে আস্তে মাথাটা তার কাঁধেই ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হন। কোন অদৃশ্য কারণে প্রায়ই সুবলবাবুর সহযাত্রী মাঝবয়সী মহিলা হন ,যারা সুবলবাবুর ওই বয়সের ঝিমুনি বা ঢুলুনিকে উদ্দেশ্য- প্রণোদিত না মনে করে নিজেদের একঘেয়ে জীবনের কটূস্বাদের মধ্যে একটু সহানুভূতির মিষ্টতা পাঞ্চ করে তাঁকে কিছুটা প্রশ্রয় দিয়ে নিজেদের কাঁধ অফার করে অস্বস্তির মধ্যেও খুশি থাকেন । ফলে বসার জায়গা পেতে অসুবিধা হয় না । যেমন অসুবিধা হয়নি গত শুক্রবার  ।কন্ডাক্টর ভাড়া চাইলে সুবলবাবু  বুকপকেট থেকে দুহাজারের একটা নোট দুআঙ্গুলের চিমটিতে ধরে চোখ বুজে  বাড়িয়ে দিতে সেটা সপাটে প্রত্যাখ্যান করে ছোট নোট দিতে বলায় দুহাজারের নোটটা চোখ বুজেই  পকেটে গুঁজে পাশপকেট থেকে দশ টাকার নোটটা  বার করে দিতে হলো  সুবলবাবুকে । তারপর যথারীতি পাশের সামান্য  পৃথুলা মহিলার কাঁধটি সর্বংসহা ভার্যার কাঁধ মনে করে নিজের মাথাটি রেখে ঝিমোতে লাগলেন বা বলা যায় ঘুমোতে লাগলেন । আবার কন্ডাক্টরের বদান্যতায় তড়বড়িয়ে নিজের স্টপে নামার সময় দেখতে পেলেন কাঁধ অফার  করা মহিলা যেন ঠোঁট টিপে হাসলেন । যদিও উনি পাত্তা দিলেন না । সেদিন বাড়িতে  ফিরে ফ্রেশ হবার সময় দুহাজারের নোটটা দেখলেন বুকপকেটে নেই । আগামীকাল মেয়ে নাতিকে নিয়ে আসবে তাই ফেরার আগে অবনীর থেকে নিয়েছিলেন ডেবিট কার্ডটা বাড়িতে ফেলে গিয়েছিলেন বলে ।যতোই ঝিমোন ,কন্ডাক্টরের হাত থেকে নোটটা ফেরত নিয়ে বুকপকেটে রেখেছিলেন আর দশটাকার নোটটা দিয়ে  বাসভাড়া মিটিয়েছিলেন সেটা মনে আছে । খালি বাসে পিকপকেটের প্রশ্ন নেই । তবে? একবার মনে হলো পাশের মহিলা যেন উনি নামার সময় মুচকি হেসেছিলো,তাহলে? নাকি ওর মুখটাই হাসিহাসি ;অযথা সন্দেহ করা ।এখন নিজের উপরেই রাগ হচ্ছে বাসে বসে ঢোলা রোগের জন্য । যাইহোক,ব্যাপারটা বাড়িতে চেপে গিয়ে সকালে এ টি এম থেকে টাকা তুলে ম্যানেজ করলেন ।
সোমবার অফিস সেরে সন্ধ্যায় আবার মিনিবাসে ঢাকুরিয়ায় নামলেন ।নেমেই শুক্রবারের সেই মহিলাকে একজন লোকের সঙ্গে পানবিড়ির দোকানের সামনে কথা বলতে দেখলেন । মহিলাও  তাঁকে দেখেছেন ।এগিয়ে এসে সুবলবাবুকে আটকালেন “ একটা কথা ছিলো স্যার” । হকচকিয়ে সুবলবাবু বললেন ‘বলুন ?’ মহিলা ততক্ষণে নিজের ভ্যানিটি ব্যাগ খুলে একটা দুহাজারের নোট বার করে সুবলবাবুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে ‘আপনার এই টাকাটা নিয়ে যান ।সেদিন আপনি বাসে ঝিমোতে ঝিমোতে এটা নিজের পকেটে না ঢুকিয়ে আমার বগলের খাঁজে রেখে দিয়েছিলেন । আপনি নেমে যাবার পর দেখেছিলাম ।প্রথমে মনে হয়েছিল আমাকে চেনেন আর আমার বুকিং এর টাকাটা ওইভাবে দিয়েছেন ।পরে মনে হলো মোবাইল নম্বর ঠিকানা না দিয়ে কেনই বা  টাকা ছাড়বেন।‘
সুবলবাবু তাড়াতাড়ি বলে ওঠেন ‘ না না ওসব নয় । বয়েস হয়েছে , বাসের দুলুনিতে ঘুম এসে যায় -–তাই। যাকগে , ওটাকা তুমি রেখে দাও ।আমার চাই না ।‘ যদিও জানেন এই দুহাজার টাকায় দশদিন সংসার টানা যায় ।
‘ কি করে রাখবো স্যার, ধম্মে সইবে না । গতর খাটিয়ে কামিয়েছি কি? আমি লাইনের  ওপারে বস্তিতে থাকি ।সকালে অফিস পাড়ায় একটা ছোটখাট কাজ করি ।মাইনে কম ।তাই ছুটির পর দুএকজন বন্ধুবান্ধব নিয়ে একটু ফুর্তি করি। উপরি রোজগারে সংসারটা তবু গড়িয়ে  চলে।শরীরটাকে একটু খাটাতে হয় এই যা ।কিন্তু এই টাকাটা তো আমার ন্যায্য পাওনা নয় । আপনার ঝপকি এসেছিলো তাই টাকাটা আমার বগলে গুঁজে দিয়েছিলেন । নিন,ধরুন টাকাটা’ বলে সুবলবাবুর হাতে টাকাটা গুঁজে দিয়ে বললে ‘ বয়েস হয়েছে আর কতদিন জোয়াল টানবেন ? বাড়িতে বসে একটু আরাম করুন । কোথায় থাকেন স্যার ? বলেন তো আপনার বাড়িতে ম্যাডামকে একটু বুঝিয়ে দিয়ে আসি’ । ‘ সুবলবাবু চোখ বড় বড়  করে বলে ওঠেন ‘ না না তার দরকার  নেই । ‘ বলেই  হন হন করে বাড়ির দিকে হাঁটা দেন আর বার বার রুমালে ঘাড় মুখ মোছেন । ওঁনার কেবলই মনে হয় এখানে  নিশ্চয় ওঁনার চেনাজানা অনেকেই আছে যারা মেয়েটাকে চেনে ।তারা হয়তো সুবলবাবুকে ওর সঙ্গে কথা বলতে আর টাকা নিতে দেখে ফেলেছে । কি লজ্জা ! 
এখন আর সুবলবাবু  বাসে খালি সীট পেয়েও বসেন না। ভিড় বাসে সহযাত্রীদের সঙ্গে  গায়ে গা লাগিয়ে  রড ধরে দাঁড়িয়ে  দাঁড়িয়েই যতটা পারেন ঝিমোন । ঢুলতে ঢুলতে মাঝে মাঝে জেগে উঠে চোখ বড় বড় করে আশেপাশে  তাকান ।  হ্যান্ডেল থেকে হাত ফস্কালেও  ভিড়ের চাপে ঠিক দাঁড়িয়ে থাকেন ।তবে বাস ভাড়ার খুচরো টাকাই কেবল পকেটে রাখেন , বড় নোট নিয়ে চলাফেরা করেন না ।

0 comments: