1

গল্প - মনোজ কর

Posted in




















১৫ পর্ব

রাজ কোষাগার লুন্ঠন এবং ধনরাশির অসমবন্টন।

যখন ধনসম্পত্তি এবং তার বন্টনের পদ্ধতি শুরু হয় তখন অনিয়ম এবং অসমবন্টন খুব স্বাভাবিক এবং সাধারণ ঘটনা। তার ওপর এই ধনসম্পত্তি যখন লুন্ঠিত ধনসম্পত্তি হয় তখন তো আর কথাই নেই। ছলে বলে কৌশলে যে যত পারে কুক্ষীগত করতে চায়। পলাশির যুদ্ধের পর লুন্ঠিত রাজকোষাগারের ক্ষেত্রেও ভিন্ন কিছু হবে এমন ভাবাটা অযৌক্তিক।

সিরাজের মৃত্যর পর প্রথম রাজকোষাগারে যারা ঢুকেছিল তারা হলো জন ওয়ালশ, ওয়াটস, দিওয়ান রামচাঁদ এবং মুন্সী ও ফারসি ভাষাবিদ নবকৃষ্ণ যিনি পরবর্তীকালে রাজা নবকৃষ্ণ দেব বলে পরিচিত হন। লোকমুখে শ্রুত তারা রাজকোষাগারে যে ধনসম্পদের সন্ধান পেয়েছিল তার পরিমাণ এইরকম- এক কোটি ছিয়াত্তর লক্ষ টাকা মূল্যের রৌপ্যমুদ্রা, বত্রিশ লক্ষ টাকা মূল্যের স্বর্ণমুদ্রা, দু’টি বড় সিন্দুকভর্তি সোনার বাট, চারটি বড় সিন্দুকভর্তি মণিমাণিক্যখচিত অলঙ্কার এবং দু’টি ছোট সিন্দুকভর্তি বিভিন্নরকমের রত্ন। লোকমুখে এও জানা যায় এটা অবশিষ্ট যেটুকু পড়েছিল সেটা। ওয়ালশ ও তার দলবল রাজকোষাগারে ঢোকার আগেই বেশিরভাগ ধনসম্পদ সরিয়ে ফেলা হয়েছিল। ব্রিটিশদের এই বাঙলার ধনসম্পত্তি লুঠ করাকে তাদের ভারতবর্ষ লুন্ঠনের সূচনা হিসাবে ধরা হয়। এই অর্থের মধ্যে সাতাশ লক্ষ পঞ্চাশ হাজার পাউন্ড মিলিটারি এবং সিলেক্ট কমিটির সদস্যদের দেওয়া হয়েছিল।

রায়দুর্লভ, যার ওপর কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি তৈরি করা এবং রক্ষা করার দায়িত্ব ছিল তার হিসাব অনুযায়ী রাজকোষাগারের ধনসম্পত্তির পরিমাণ ছিল মাত্র এক কোটি চল্লিশ লক্ষ টাকা। ২৬শে জুন ক্লাইভের বাহিনী যখন মিরজাফরের সভা শেষ করে প্রবল বৃষ্টিতে মইদাপুরে আশ্রয় নিয়েছে তখন ওয়াটস রায়দুর্লভকে কড়া ভাষায় আক্রমণ করে জানিয়ে দেয় যে চুক্তিতে যে অঙ্কের উল্লেখ আছে তা যেন কড়ায় গন্ডায় মিটিয়ে দেওয়া হয়। যদি রাজকোষাগারে অর্থের ঘাটতি থাকে তাহলে জগৎশেঠ মাধবরাই এবং তার পরিবার যেন অগ্রিম হিসাবে ঘাটতির সমপরিমাণ অর্থ দিয়ে দেয়। রায়দুর্লভ এই প্রস্তাব সম্পূর্ণ অস্বীকার করে পরিষ্কার জানিয়ে দেয় যে জগৎশেঠের পক্ষে কোটি কোটি টাকা অগ্রিম দেওয়া সম্ভব নয়। সেই সন্ধ্যায় ওয়ালশ এবং ওয়াটস ক্লাইভের কাছে চিঠি পাঠালো।

-‘আজ নবাবের দরবারে দু’ঘন্টা কাটানোর পর আমরা যখন রায়দুর্লভের সঙ্গে বাইরে আসি তখন পথের মধ্যে রায়দুর্লভ ও তার হিন্দু সাঙ্গপাঙ্গরা আমাদের জানায় যে কোষাগারে মাত্র এক কোটি চল্লিশ লক্ষ আছে এবং জগৎশঠের পক্ষে বাকি টাকা অগ্রিম দিয়ে আমাদের চুক্তি মান্য করা সম্ভব নয়। উপযুক্ত তথ্যের অভাবে আমরা রায়দুর্লভের সঙ্গে বিতর্কে যেতে পারিনি। আমাদের প্রস্তাব আসল তথ্য জানার জন্য মোহনলালকে আমাদের সামনে হাজির করা হোক। আমরা অনেক বুঝিয়ে রায়দুর্লভের অনিচ্ছাসত্ত্বেও তার সম্মতি আদায় করেছি। কিন্তু এইমুহূর্তে সে কোনও উদ্যোগ নিতে রাজি নয়। আমাদের অনুরোধ আপনি যদি উমিচাঁদকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এই সংক্রান্ত তথ্য জোগাড় করতে পারেন তাহলে তা টাকা আদায়ের ক্ষেত্রে সাহায্য করতে পারে। আমরা জানি যে রাজকোষাগার ছাড়াও অনেক গুপ্তস্থানে রাশি রাশি ধনসম্পদ গচ্ছিত আছে। এই খবর সর্বজনবিদিত।‘

আসলে ওয়াটস এবং তার বাহিনী ঐ বিশাল ধনসম্পত্তির আসল সন্ধান না পেয়ে বাইরের পরিমন্ডলেই ঘুরপাক খাচ্ছিল। যখন সে বুঝতে পারে মোহনলালের কাছে অনেক খবর আছে তখন সে ক্লাইভের কাছে চিঠি লিখে মোহনলালকে তার হেফাজতে নিতে বলে। কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। চতুর রায়দুর্লভ জানত যে সিরাজের প্রধানমন্ত্রী মোহনলাল সিরাজের অত্যন্ত বিশ্বাসভাজন ছিল। মোহনলাল এতটাই ক্ষমতাবান ছিল যে অন্যান্য সেনাপতিরা এমনকি রায়দুর্লভও মাথা নিচু করে তার আসনে কপাল ঠেকিয়ে তাকে সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করত। মোহনলালের অগাধ ধনসম্পত্তি দেখে হিংসায়, ঘৃণায় জ্বলে যেত রায়বল্লভ। ভাগ্যচক্রে বন্দি মোহনলালকে রায়দুর্লভের হেফাজতে রাখা হয়। এই সু্যোগের সদ্ব্যবহার করে মোহনলালের সমস্ত সম্পত্তি করায়ত্ত করে তাকে হত্যা করেছিল রায়দুর্লভ। একথাও শোনা যায় কোনও গোপন জায়গায় মোহনলালকে রেখে পরে লোক পাঠিয়ে তাকে হত্যা করেছিল মিরজাফর। যাই হোক না কেন মোহনলালকে ব্রিটিশদের সামনে দাঁড় করাতে দেয়নি বিশ্বাসঘাতকেরা। ব্রিটিশদের আসল ধনসম্পত্তির সম্বন্ধে কোনও ধারণাই ছিলনা। বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া খবরের ভিত্তিতে আন্দাজ করা হয় যে কেবল রাজকোষাগারেই আসল সম্পত্তির পরিমাণ ছিল আট কোটি টাকার বেশি এবং যার বেশিরভাগটাই প্রাসাদের অভ্যন্তরে নারীদের শয়নকক্ষে রাখা হতো।

এই খবর চিরকাল ব্রিটিশদের অগোচরেই রয়ে গেল । তাদের বিন্দুমাত্র ধারণা ছিলনা যে এই সমস্ত অর্থ এবং ধনসম্পদ রাজপ্রাসাদে প্রবেশের অধিকার পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মিরজাফর হস্তগত করেছিল। মিরজাফরের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল তার বিশ্বস্ত অনুচর আমিন বা ওমর বেগ এবং দু’জন ব্রিটিশদের অতি বিশ্বস্ত বাঙালি কর্মচারি, রামচাঁদ এবং নবকৃষ্ণ যাদের ব্রিটিশরা নিযুক্ত করেছিল টাকা পয়সার হিসাব নিকাশের জন্য। এদের মধ্যে নবকৃষ্ণ ফারসি ভাষায় লেখা কাগজপত্রের অর্থোদ্ধারে পারদর্শী ছিল। প্রচুর ধনসম্পদ দিয়ে মিরজাফর এদের মুখ বন্ধ করেছিল। যে রামচাঁদ মাসিক মাত্র ষাট টাকার কর্মচারী ছিল সেই রামচাঁদ যখন পলাশি যুদ্ধের দশ বছর পরে দেহত্যাগ করে তখন তার জমিজমার আর্থিক মূল্য তিয়াত্তর লক্ষ টাকা। এছাড়াও তিনশ’র অধিক রুপোর এবং আশিটি সোনার কলসি, প্রায় আঠারো লক্ষ টাকা মূল্যের অন্যান্য সম্পত্তি ও কুড়ি লক্ষ টাকা মূল্যের অলঙ্কার। শোনা যায় রামচাঁদের জমিজমার আসল অর্থমূল্য তখন ছিল প্রায় এক কোটি কুড়ি লক্ষ টাকা। কিন্তু খাতায় কলমে তিয়াত্তর লক্ষ দেখানো হয়েছিল। যদিও ১৭৫৯ থেকে ১৭৬৪ সাল অবধি রামচাঁদ বাঙলার গভর্নর হেনরি ভানসিতার্তের দিওয়ান ছিলো তবুও কেবল মাসমাইনের টাকায় এত সম্পত্তি করা সম্ভব নয়। প্রভূত ক্ষমতাসম্পন্ন ভানসিতার্ত নিজেই চাকরির শেষে মাত্র দশলক্ষ টাকা নিয়ে বাঙলা ছেড়েছিল। সুতরাং সিরাজের সম্পত্তির বেশ কিছু ভাগ যে রামচাঁদ পেয়েছিল সে কথা অবিশ্বাস করা যায় না। আরও শোনা যায় যে আরেক ষাট টাকা মাসমাইনের কর্মচারী নবকৃষ্ণ তার মায়ের শ্রাদ্ধে ন’লক্ষ টাকা খরচ করেছিল।

একই অভিযোগ শোনা যায় নর্তকি মুন্নি বেগমের নামেও। এই নর্তকি প্রথমে মিরজাফরের রক্ষিতা এবং পরবর্তীকালে প্রভাবশালী দ্বিতীয় বেগম হিসাবে পরিচিতি লাভ করে। মিরজাফরের মৃত্যুর পর এই মুন্নি বেগম তার ছেলেদের মধ্যে কাউকে নবাব করার জন্য ব্রিটিশদের কাছে আর্জি জানায়। ১৮১৩ সালে তিরানব্বই বছর বয়সে দেহত্যাগ করার সময় তার সম্পত্তির পরিমাণ ছিল কয়েক কোটি। মিরজাফর মারা যাবার সময় কিছু রেখে যায়নি। ঋণভারে জর্জরিত মিরজাফর শেষ বয়সে বেতন দিতে না পারার জন্য নিজের সৈন্যবাহিনীর দ্বারা বারবার আক্রান্ত হয়েছিল এবং সেনাবাহিনীর সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে তার জামাই মিরকাশিম তাকে গদিচ্যুত করে। তা সত্ত্বেও মুন্নি বেগমের কাছে এত সম্পত্তি কোথা থেকে এলো?

কান্তবাবু এবং নবকৃষ্ণ দেব এই দু’জনের ব্যাপারে একটু বিশদে আলোচনা করা যেতে পারে। কান্তবাবু ছিল ওয়ারেন হেস্টিংসের খুব কাছের লোক। পলাশির যুদ্ধের সময় ঘটে যাওয়া অনেক গোপন নাটকের কুশীলব এই কান্তবাবু। এই কান্তবাবুর আসল নাম কৃষ্ণকান্ত নন্দী যিনি কাশিমবাজার রাজবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা বলে পরিচিত। কান্তবাবুর বাবা ছিল ছোটখাট দোকানদার । সিল্ক, সুপারি এবং ঘুড়ির দোকান চালাত কান্তবাবুর বাবা। কাশিমবাজার ফ্যাক্টরিতে শিক্ষানবিশ হিসাবে যোগ দেয় ঘুড়ি ওড়াতে দক্ষ কান্তবাবু। তারপর ঐ ফ্যাক্টরির করণিক হয়ে হেস্টিংসের কাছাকাছি আসার সুযোগ পায়। হেস্টিংস মুর্শিদাবাদে আসে ১৭৫৩ সালে।এর তিনবছর পরেই করণিক কান্তবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ হয় ভাবী গভর্নর জেনারেল হেস্টিংসের। সিরাজ যখন কাশিমবাজার আক্রমণ করে তখন হেস্টিংসকে জেলে বন্দি করা হয়। বন্দি হেস্টিংসকে জেল থেকে পালাতে সাহায্য করে এই কান্তবাবু। প্রথমে নিজের বাড়িতে লুকিয়ে রেখে তারপর নদীপথে নৌকায় গোপনে হেস্টিংসকে নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে দিয়েছিল কান্তবাবু। কৃতজ্ঞতাস্বরূপ হেস্টিংস কান্তবাবুকে একটা চিঠি দিয়ে বলে যান যদি ভবিষ্যতে কোনদিন কান্তবাবুর সঙ্গে তার দেখা হয় তাহলে এই চিঠিটা দেখালেই সে তাকে চিনতে পারবে। কথিত আছে অনেক পরে যখন হেস্টিংস ক্ষমতায় আসে তখন অনেক লোক নিজেদের কান্তবাবু বলে পরিচয় দিয়ে হেস্টিংসের সঙ্গে দেখা করতে চায়। কিন্তু চিঠির কথা শুনে সবাই পালিয়ে যায়। পরে কান্তবাবু যখন চিঠি নিয়ে দেখা করতে চায় হেস্টিংস তাকে খাজনা আদায়ের কাজে নিযুক্ত করে। খাজনা তুলে সরাসরি হেস্টিংসের হাতে তুলে দেওয়াই ছিল তার কাজ। হিসাববহির্ভূত টাকা লেনদেনের এই সুযোগে প্রভূত অর্থের মালিক হয় হেস্টিংস এবং কান্তবাবু দু’জনেই। এই সময়েই কান্তবাবু হেস্টিংসের সহযোগী এবং বন্ধু ফ্রান্সিস সাইকসের কাছাকাছি আসে। হেস্টিংসের এই অসদুপায়ে অর্জিত বা লুন্ঠিত অ্রর্থ রক্ষা এবং হিসাবের দায়িত্ব ছিল ফ্রান্সিসের। ফ্রান্সিস দেশে ফেরার সময় তার নিজের সংগৃহীত অর্থের পরিমাণ ছিল তখনকার সময়ে সাতলক্ষ পাউন্ড যার পরিমাণ আজকের দিনে সাতকোটি পাউন্ড বা সাড়ে ছ’শ কোটি টাকা। এই দুটি ঘটনা কান্তবাবুর জীবনের গতি পালটে দেয়। এই কান্তবাবু এবং নবকৃষ্ণ দেবকে ভারতবর্ষে ইউরোপিয় সাম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠার প্রথম ভারতীয় সাহায্যকারী হিসাবে গণ্য করা হয়।

ক্লাইভ এবং হেস্টিংসের দপ্তরের একজন সামান্য অনুবাদক এবং হিসাবরক্ষক থেকে নবকৃষ্ণ কী করে কয়েক বছরের মধ্যে মহারাজ নবকৃষ্ণ দেব হয়ে শোভাবাজারের রাজপ্রাসাদ এবং বিশাল সম্পত্তির মালিক হয়ে উঠলো সে কথা আজও অজানা। তবে লোকমুখে কথিত আছে নবকৃষ্ণ ছিল ক্লাইভের বিশ্বস্ত গুপ্তচর ও গোপন সংবাদবাহক যে পলাশির চক্রান্তে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এই কাজের সুযোগে চতুর নবকৃষ্ণ সিরাজের গোপন ধনাগারের সন্ধান পেয়েছিল। সেই ধনাগারের সন্ধান মিরজাফর এবং নবকৃষ্ণ ছাড়া আর কেউ জানতো না। এই বিপুল ধনরাশির সন্ধান ব্রিটিশদের গোচরে আসার আগেই নবকৃষ্ণ এবং মিরজাফর নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়। ঐতিহাসিকেরা বলেন সিরাজের ধনাগার থেকে গোপনে লুন্ঠিত অর্থ যেমন ইংরেজদের বোকা বানিয়ে মিরজাফরকে সামনে রেখে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছিল নবকৃষ্ণ তেমনি আবার মিরজাফরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা এবং পলাশি পরবর্তী সময়ে রাজপ্রাসাদে যাতায়াতের সুযোগে তার অভ্যন্তরের অনেক খবর, তাদের রীতিনীতি, তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা , অন্তর্দন্দ্ব এবং সর্বোপরি অন্দরমহলের অনেক গোপন সংবাদ অনেক ঝুঁকি নিয়ে , এমনকি জীবন বাজি রেখেও ক্লাইভ আর হেস্টিংসের কাছে পৌঁছে দিয়ে তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করেছিল নবকৃষ্ণ । শান্ত, সৌম্যদর্শন নবকৃষ্ণকে দেখে বোঝাও যেত না জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এই দ্বিচারিতা সে চালিয়ে গেছে অনেকদিন ধরে। দু’দিক থেকেই লুন্ঠনের ভাগ পেয়েছে সে। সঠিক না জানলেও অনুমান করা হয় যে ১৭৩২ সালে জন্ম হয়েছিল নবকৃষ্ণের। আর ঠিক সেই বছরেই জন্ম নিয়েছিল তারই ভাগ্যনির্মাতা ওয়ারেন হেস্টিংস। ক্লাইভের বয়স তখন সাত। যে গোবিন্দপুরে জন্ম হয়েছিল নবকৃষ্ণের সেই গোবিন্দপুরকে কেন্দ্র করেই পরবর্তীকালে গড়ে উঠেছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্য। কে জানে যে ভূমিখন্ডে ভূমিষ্ঠ হয়েছিল নবকৃষ্ণ হয়তো সেই ভূমিখন্ডেই স্থাপিত হয়েছিল ফোর্ট উইলিয়মের ভিত্তিপ্রস্তর। হয়তো নিয়তিনির্দেশিত ছিল এই ব্রিটিশস্তাবকতা। সেই নিয়তির ডাকেই ১৭৫০ সালে ঘটনাচক্রে অষ্টাদশবর্ষীয় দরিদ্র নবকৃষ্ণ সমবয়সী হেস্টিংসের বাংলা ও ফারসি ভাষার শিক্ষক হিসাবে নিযুক্ত হন। কৃষ্ণবল্লভ যখন সিরাজের ভয়ে প্রভূত অর্থসহ ব্রিটিশদের কাছে আশ্রয়ের জন্য অনুরোধ করে তখন ড্রেক তাকে জানায় যে যদি সিরাজের দরবারের মন্ত্রী এবং সর্দারেরা তাকে নিশ্চিন্ত করে যে এই কারণে সিরাজের কাছ থেকে কোনও বাধা আসবে না তাহলে ব্রিটিশরা তাকে বিপৎকালীন আশ্রয় দিতে পারে। কৃষ্ণবল্লভের বাবা রাজবল্লভ তখন সিরাজের কারাগারে বন্দি। কিন্তু জেলে বসেই সিরাজের দরবারের কয়েকজন মন্ত্রী এবং সেনাপতির স্বাক্ষরসম্বলিত সম্মতিপত্র রাজবল্লভ ড্রেকের কাছে পাঠাবার ব্যবস্থা করে। এইসব মন্ত্রী সেনাপতিরা নিজেদের পথ খুলে রাখার জন্যই রাজবল্লভের প্রস্তাবে রাজি হয়। যে পত্রবাহক চিঠিটি নিয়ে আসে সে জানায় যে চিঠিটি ফারসি ভাষায় লেখা এবং চিঠিটি যেন কোনও মুসলমানের হাতে না পড়ে। ফারসি জানা হিন্দু মুন্সির খোঁজে বেরিয়ে ড্রেকের বাহিনী বড়বাজারে নবকৃষ্ণের খোঁজ পায়। নবকৃষ্ণ এসে সেই চিঠির অর্থ ব্যখ্যা করে উত্তর লিখতে সাহায্য করে নবকৃষ্ণ। পরবর্তীকালে সিরাজ যখন কলকাতা আক্রমণ করে তখন কয়েকজন ব্রিটিশ অফিসারকে নবকৃষ্ণ ডায়মন্ডহারবারে লুকিয়ে থাকার ব্যবস্থা করে এবং তাদের কাছে সে অনেক গুরুত্বপূর্ণ খবর পৌঁছে দিয়েছিল।এছাড়াও সিরাজ যখন দ্বিতীয়বার কলকাতা আক্রমণ করে এবং উমাচাঁদের বাগানবাড়িতে আশ্রয় নেয় তখন ক্লাইভ নবকৃষ্ণকে উপঢৌকন এবং শান্তিপ্রস্তাব নিয়ে সিরাজের কাছে পাঠায়। এই সুযোগে প্রচুর ঝুঁকি নিয়ে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ খবর সংগ্রহ করে ক্লাইভকে দেয় নবকৃষ্ণ। এই সমস্ত খবর পরবর্তী সময়ে ক্লাইভকে অতর্কিত আক্রমণে সিরাজকে পর্যুদস্ত করতে প্রচুর সাহায্য করেছিল। এইসব কারণেই নবকৃষ্ণ ক্লাইভ এবং হেস্টিংসের অত্যন্ত বিশ্বাসভাজন হয়ে ওঠে এবং বানিয়া হয়ে ওঠে। বানিয়া সেই শ্রেণীর ভারতীয়দের বলা হত যারা ব্রিটিশ প্রভুদের বাড়ি এবং দপ্তর দু’জায়গার কাজেই সহায়তা করতো। খাজনা আদায়ে সাহায্য করা ছাড়াও এই দেশে বাস করার জন্য প্রভুকে উপযোগী করে তোলাই এদের মূল কাজ। সেই কারণে প্রভুর বাড়িতে এবং দপ্তরে অবাধ যাতায়াত ছিল এই বানিয়াদের। প্রভুরাও তাদের অন্যায়ভাবে উপার্জিত খাজনা এবং অন্যান্য বেআইনি ব্যবাসায় অর্জিত টাকার একটা ভালো অংশ দিত এই বানিয়াদের। প্রভুর ক্ষমতায় বলীয়ান হয়ে এক সমান্তরাল রাজ্য চালাত এই বানিয়ারা। নবকৃষ্ণ ছিল ক্লাইভ এবং হেস্টিংসের এমনই এক বানিয়া এবং অবাধ লুন্ঠনের অন্যতম সহায়ক। ১৭৫৭ সালের শেষের দিকে পলাশির যুদ্ধজয় উপলক্ষ্যে প্রভু ক্লাইভের সম্মানে এক বিশাল দূর্গাপূজার আয়োজন করে নবকৃষ্ণ। অফুরন্ত মদ্য-মাংস সহযোগে সুবিশাল দূর্গাপূজা পালিত হয় নবকৃষ্ণের বাড়িতে।

এতবড় একটা যুদ্ধজয় এখনও পর্যন্ত কোনও ঐশ্বর্য্যের সন্ধান দিতে না পারায় ক্লাইভ রীতিমত অধৈর্য হয়ে উঠলো। চুক্তি অনুযায়ী বিশ্বাসঘাতকদের যে পরিমাণ অর্থ ক্লাইভের হাতে তুলে দেওয়ার কথা ছিল তার কিছুই পাওয়া যায়নি। সিরাজের সম্পত্তির পরিমাণ বেশি করে দেখানো এবং সেই সম্পর্কে ভুল তথ্য দেওয়ার জন্য ওয়াটস এবং ওয়ালশের অভিযোগ আর তার সঙ্গে রায়দুর্লভের ঔদ্ধত্য ক্লাইভকে ক্রোধান্বিত করে তুললো। অভিযোগের জবাবে ক্লাইভ জানালো যে পরেরদিন অর্থাৎ ২৭শে জুন সে মিরজাফর এবং জগতশেঠের সঙ্গে দেখা করে এই ব্যাপারটার ফয়সালা করবে। রায়দুর্লভ কী করে বলতে পারে যে কোষাগারে সম্পত্তির পরিমাণ মাত্র এক কোটি চল্লিশ লক্ষ টাকা? কিন্তু আদতে যা হলো তা হচ্ছে ক্লাইভ পরেরদিন মিরজাফরের কাছে গেলনা। ২৮শে জুন বিশাল ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনী কাশিমবাজারে এসে পৌঁছলো। ওয়াটস মারফৎ ক্লাইভের কাছে খবর এলো যে সম্পূর্ণ নিরাপত্তা ছাড়া মিরজাফরের কাছে যাওয়া ঠিক হবে না। মিরজাফরের ছেলে মির মিরান, জামাই মিরকাশিম এবং রায়দুর্লভ ক্লাইভকে হত্যার পরিকল্পনা করছে। জগৎশেঠের কাছ থেকে এরকম খবরই এসেছে ওয়াটসের কাছে। জগৎশেঠের একান্ত অনুগত রঞ্জিত রায় ওয়াটসের সঙ্গে দেখা করে এই খবর দিয়েছে। সে এও জানিয়েছে যে জগৎশেঠ পরের দিন ক্লাইভের সঙ্গে দেখা করবে এবং এই কথা যেন কাকপক্ষীতেও টের না পার পায়। ক্লাইভ যেন অসুস্থতার অজুহাতে বাড়ি থেকে না বেরোয়। একথাও জানা গেছে যে সিরাজের প্রচুর ধনসম্পত্তি এবং অলঙ্কার গোপনে ভগবানগোলার উত্তর-পূর্বে গঙ্গা-পদ্মার অপর পারে গোদাগিরিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই কাজ কে করেছে তা এখনও স্পষ্টভাবে জানা যায়নি। হতে পারে সিরাজ প্রাসাদ ছাড়ার আগে এই সব ধনসম্পত্তি ও অলঙ্কার পাঠিয়ে দিয়েছিল। ছেলে, জামাই আর রায়দুর্লভের সহযোগিতায় এ কাজ মিরজাফরেরও হতে পারে।

২৮শে জুন পুরোদিন ক্লাইভ কাশিমবাজারেই বসে রইলো। ষড়যন্ত্রীদের পরিকল্পনা ভেস্তে গেল। ভাগ্যক্রমে জগৎশেঠের সংবাদ এবং ওয়াটসের সাবধানবাণী ঠিক সময়ে এসে গিয়েছিল। যারা সিরাজের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে তারা ক্লাইভের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবে না সে কথা কে জোর দিয়ে বলতে পারে? সেদিন রাত্রে কোনও গুপ্ত খবরের ভিত্তিতে ক্লাইভ পরের দিন অর্থাৎ ২৯শে জুন মিরজাফরের কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলো। তবুও সাবধানের মার নেই। কোথায় যে কী ফাঁদ পাতা আছে কে জানে? ২৯শে জুন মেজর গ্রান্টের নেতৃত্বে ১০০ সৈন্য এবং ৩০০ সেপাই নিয়ে ক্লাইভ মুর্শিদাবাদ পৌঁছলো।

1 comment:

  1. মনোজের লেখা পড়ে এক ভালোলাগা বোধ করি। পুরো ইতিহাস টা যেন চোখের সামনে ফুটে ওঠে।
    বাহবা লেখক কে

    ReplyDelete