0

প্রবন্ধ - সুজন ভট্টাচার্য

Posted in


প্রবন্ধ


বাঙালীর পারিবারিক সম্পর্কের ডাক ও ভাষা রাজনীতি (২য় পর্ব)
সুজন ভট্টাচার্য



বাংলা বা বাঙালীর বাসভূমি বলতে আমরা বুঝি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসামের বরাক উপত্যকা, ত্রিপুরা, উত্তর-পূর্ব বিহার, ঝাড়খণ্ড ও উড়িষ্যার পূর্বপ্রান্ত এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্র। ভারতীয় উপমহাদেশের পূর্বপ্রান্তের এই অঞ্চলের মানুষের ভাষা অর্থাৎ বাংলা ভাষার জাতি নিরূপণের আগে এই অঞ্চলে জনবসতির ইতিহাস এবং বাসিন্দাদের নৃতাত্ত্বিক গঠনবুঝে নেওয়া দরকার। এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলে যারা বাস করেন, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া তাঁরা মধ্যমাকৃতি, গায়ের রঙ পীত অথবা কৃষ্ণ-পীত, নাক চওড়া অথবা ছোট, হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলির একদম উপরের পর্ব চওড়া। এর ভিত্তিতেইনৃতাত্ত্বিকরা অস্ট্রিক অর্থাৎ কোল, সাঁওতাল ইত্যাদি বনচারী জনজাতি এবং টিবেটো-বার্মিজ অর্থাৎ পার্বত্য মঙ্গোলয়েড জাতিকেই বাঙালী জনসত্ত্বার মৌলিক উৎস বলে মনে করেন। এর সাথে মিশ্রআর্য উপাদানও যেমন সময়ের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, তেমনি মিশেছে তাতার, তুর্ক, ইরানি, আরবির মতো সেমেটিক বা মিশ্র মঙ্গোলয়েড রক্ত। তাহলে প্রাথমিকভাবে এটা বুঝে নেওয়া যায় যে নৃতাত্ত্বিক বিচারে বাঙালী মূলগতভাবে অনার্য জাতি। 

পরবর্তী প্রশ্ন, এই অঞ্চলে জনবসতির ইতিহাস কী? প্রাক-ঋকবৈদিক যুগে কি এখানে জনবসতি ছিল? নাকি আর্যদের প্রসারের পরবর্তীকালে এখানে জনাগম ঘটে? প্রথম পর্বে আমরা আলোচনা করেছি, মৌখিক সাহিত্য হিসাবে ঋকবেদের সূচনা খ্রীষ্টপূর্ব ১৫০০ অব্দে। এবং সম্ভবত আর্যদের ভারতে প্রবেশের আগেই ঋকবেদের সূচনা হয়েছিল। ঋকবেদে সরস্বতীর স্তুতিতে বলা হয়েছে “অম্বিতমে নদীতমে দেবিতমে সরস্বতী/ অপ্রাশস্তা ইভ স্মসি প্রশস্তিম অম্ব নস কৃধি”। বাঙলায় এর অনুবাদ এমনটা করাই যায় –“সরস্বতী, মাতাশ্রেষ্ঠা, নদীশ্রেষ্ঠা, শ্রেষ্ঠা দেবী তুমি/অপ্রকাশ আমাদের জন্য, হে মাতা, তুমিই প্রকাশের জন্মদাত্রী”। এই স্তোত্রে সরস্বতী একাধারে নদী, মাতা ও দেবী। এর থেকেই অনুমান করা যায় প্রাথমিক বৈদিক সভ্যতা সরস্বতী নামক কোনও এক নদীর তীরেই গড়ে উঠেছিল। সভ্যতার প্রাণস্বরূপা সেই নদীকে মা কিংবা দেবী হিসাবে কল্পনা করে নেবার মধ্যে অস্বাভাবিকত্ব কিছুই নেই। 

কেউ কেউ মনে করেন হিমাচল প্রদেশের শিবালিক পর্বতে সৃষ্ট এবং হরিয়ানা-পাঞ্জাবের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ঘগগর-হরকা নদীতন্ত্রই আসলে সেই সরস্বতী নদী। সাম্প্রতিককালে ঘগগর-হরকা অববাহিকায় রাখিগড়িতে খননকার্যের ফলে পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনের প্রাপ্তিকে তাঁরা এই মতের প্রমাণ বলেই বিবেচনাকরেন। এই বিচারে খানিকটা বিভ্রান্তি আছে। কেননা, রেডিও-কার্বন পরীক্ষায় রাখিগড়িতে প্রাপ্ত মানবকঙ্কালগুলি খ্রীষ্টপূর্ব ৪০০০ অব্দের কাছাকাছি বলেই মনে করা হয়। আবার রাখিগড়ির সভ্যতার সাথে সিন্ধু সভ্যতার মিলটাই অনেক বেশি। তাই ঘগগর-হরকা অববাহিকার সাথে বৈদিক সভ্যতার কোনও সম্পর্ক ছিল বলে মনে হয় না। ঐতিহাসিকদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই কিন্তু ঘগগর-হরকার তীরে বৈদিক সভ্যতার বিকাশ হয়েছিল মেনে নিতে রাজি নন। পারস্যের জরথ্রুষ্টিয় ধর্মের মূল ধর্মগ্রন্থ ঝিন্দ-আবেস্তায় একটি মহতী নদীর কথা বলা হয়েছে, যার নাম হরক্সাবতী। পারস্যে শব্দের আদি স হ-আকার নেয়। সেই হিসাবে হরক্সাবতীই সরক্সাবতী বা সরস্বতী বলে তাঁরা মনে করেন। আফগানিস্তানের হেলমন্দ নদীকেই হরক্সাবতী বলে গণ্য করা হয়। সেই বিচারে হেলমন্দই হল সরস্বতী নদী। পারস্যের জরথ্রুষ্টিয় ধর্মে ও ঋক বেদে বহু শব্দেরসাদৃশ্য থাকায় এই মতটাই অনেক যৌক্তিক বলে মনে হয়। 

সরস্বতীর অবস্থান যেখানেই হোক না কেন, ভারতের বৈদিক সভ্যতার প্রসার যে উত্তর-পশ্চিম দিক থেকেই শুরু হয়েছিল, এটা অনস্বীকার্য। সেক্ষেত্রে একদম বিপরীত প্রান্তের এই গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় যে তার বিস্তার হবে অনেক পরে, সেটাই স্বাভাবিক। তাহলে এই অংশের পরিস্থিতি কী ছিল? এখানে কি আর্যদের বিস্তারের মাধ্যমেই জনবসতির সূচনা হয়? নাকি তার আগে থেকেই মানুষের বসবাস ছিল? যদি থাকে, তাদের চরিত্র বা বৈশিষ্ট্য কী? এই আলোচনায় ঢোকার আগে মানুষ নামক বিশেষ প্রজাতির সৃষ্টির ইতিহাসকে একবার ছুঁয়ে গেলে ভালো হয়। কেননা, প্রায়শই রাজনৈতিক প্রচারের স্বার্থে নৃতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিকদের দ্বারা সাধারণভাবে স্বীকৃত তত্ত্ব ও তথ্যকে বিকৃত করে দেওয়া হয়। এবং সাধারণ মানুষের কাছে সেইসব তত্ত্ব ও তথ্যের হদিশ না থাকায়, তাঁরাও প্রভাবিত হয়ে যান।

মানুষ বলতে আমরা নিজেদের যেভাবে বুঝি, সেই প্রজাতির বৈজ্ঞানিক নাম হলো হোমো স্যাপিয়েন্স। পৃথিবীর বর্তমান সমস্তস্তন্যপায়ী প্রজাতির মধ্যে হোমো স্যাপিয়েন্সই হলো নবীনতম। কিন্তু এই প্রজাতিও ঈশ্বরের বরপুত্রের মতো রাতারাতি আকাশ থেকে আসে নি। হোমো স্যাপিয়েন্সের সবথেকে বড় বৈশিষ্ট্য হল চার পায়ের বদলে দুই পায়ে চলার ক্ষমতা, সোজা হয়ে দাঁড়ানো, দুই হাতের সুনির্দিষ্ট ব্যবহার এবং মস্তিষ্কের আকার ও সক্রিয়তা। স্থলচর স্তন্যপায়ী প্রাণীদের নানান বিবর্তনের মধ্য দিয়ে এক ধরণের প্রাণীগোষ্ঠীর জন্ম হয়, যারা পূর্বতন প্রাণীদের থেকে বেশি বুদ্ধি রাখে এবং সামনের দুই পা চলাফেরা ছাড়াও অন্য কাজে ব্যবহার করতে পারে। এই ধরণের প্রাণীগোষ্ঠীকে বলা হয় প্রাইমেট। এদের মধ্যে আছে বাঁদর, লেমুর, শিম্পাঞ্জি, গোরিলা, ওরাং ওটাং ইত্যাদি। আবার বাঁদর বা লেমুরের চেহারা ছোট, বড় লেজ আছে এবং প্রয়োজনমতো চার পা ও দুই পায়ের সাহায্যে চলাফেরা করতে পারে। শিম্পাঞ্জি, গোরিলা বা ওরাং ওটাঙয়ের চেহারা অনেক বড়ো, লেজ নেই অথবা খুব ছোট এবং মূলত দ্বিপদ চলনে অভ্যস্ত। দ্বিতীয় দলের যে গণ বা জেনাস, তাকে বলা হয় এপ বা নরসম। বোঝাই যাচ্ছে, আধুনিক মানুষও আসলে এপ জেনাস এবং সেইসূত্রে প্রাইমেট অর্ডার বা ক্রমের অন্তর্ভূক্ত। 

বাইপেডালিজম, অর্থাৎ দুই পায়ের সাহায্যে হাঁটতে পারে এবং মাথার খুলির ভিতরে মস্তিষ্ক দ্বারা পূর্ণ,এমন প্রাইমেটদের উদ্ভব হয়েছিল আনুমানিক ৫০ লক্ষ বছরেরও আগে। এদের বলা হয় হোমিনয়েড। বিবর্তন-বিজ্ঞানীদের অনুমান, ৮০ থেকে ৬০লক্ষ বছর আগের আফ্রিকার জঙ্গলে বসবাসকারী কোনও এক অভিন্ন পূর্ব-প্রজাতি থেকেই মানুষ এবং গোরিলা ও শিম্পাঞ্জির পৃথকপৃথক বিবর্তন শুরু হয়। ৪০ লক্ষ বছর আগে আফ্রিকাতেই হোমিনয়েডদের একাংশের মধ্যে আরও বিবর্তনের ফলে দেখা দিল অস্ট্রালোপিথেকাস, যাকে এপ ও মানুষের মধ্যে এক অন্তর্বর্তী পর্যায় বলা যায়। অস্ট্রালোপিথেকাসের চেহারাও ছিল বড়সড় মাপের; কিন্তু দ্বিপদ চলনের স্বাচ্ছন্দ ছিল অনেক বেশি। এই অস্ট্রালোপিথ থেকে হোমো জেনাস বা গণের উৎপত্তি হয়, যাদের মস্তিষ্কের মাপ অস্ট্রালোপিথের থেকে অনেকটাই বেশি। হোমো গণের প্রথম প্রজাতি ছিল হোমো হ্যাবিলিস। 

২৯ লক্ষ বছর আগে আফ্রিকাতেই হোমো হ্যাবিলিসের জন্ম হয়। এদের পা ও হাতের গড়ন অনেকটাই মানুষের কাছাকাছি। ফসিলের কাছাকাছি পাথরের যন্ত্রের উপস্থিতি প্রমাণ করে, হোমো হ্যাবিলিস পাথরের যন্ত্র ব্যবহারে অভ্যস্ত ছিল। আরো কতগুলি অন্তর্বর্তী প্রজাতির স্তর অতিক্রম করে ২০ লক্ষ বছর আগে দেখা দিল হোমো ইরেকটাস, যাকে আজকের মানুষের সবথেকে কাছের পূর্বজ বলে গণ্য করা হয়। এর আগে পর্যন্ত যাবতীয় প্রাক-মানব প্রজাতির ফসিল আফ্রিকাতেই পাওয়া গেছে। এই কারণেই আফ্রিকাই যে মানব বিবর্তনের রঙ্গমঞ্চ, এ বিষয়ে সবাইই একমত। কিন্তু হোমো ইরেকটাসের ফসিল আফ্রিকার বাইরেও দক্ষিণ এশিয়ায় পাওয়া যায়, যেগুলো ১৯ থেকে ১৬ লক্ষ বছরের পুরোনো বলে জানা গেছে। এর অর্থ, হোমো ইরেকটাস আফ্রিকা থেকে এশিয়ার দিকে যাত্রা শুরু করেছিল। 

আমরা আগেই বলেছি হোমো হ্যাবিলিস পাথরের হাতিয়ার ব্যবহারে অভ্যস্ত ছিল। স্বভাবতই পরবর্তী প্রজাতিগুলিও তার থেকে আলাদা ছিল না। বরং হোমো ইরেকটাস প্রজাতির পাথরের অস্ত্রগুলো ছিল তুলনায় উন্নত ও আরো কার্যকরী। হোমো ইরেকটাসই প্রথম আগুন ব্যবহার শুরু করেছিল। হাতিয়ার ব্যবহারই সম্ভবত হোমো ইরেকটাসের বিবর্তনকে আরও ত্বরান্বিত করে। ১২ লক্ষ থেকে ৬ লক্ষ বছরের মধ্যে হোমো হেইডেলবার্গেনসিস নামে নতুন প্রজাতির জন্ম হয়।¹ সম্ভবত ৫ লক্ষ বছর আগে জন্ম নেয় হোমো নিয়েন্ডার্থাল প্রজাতি। নিয়েন্ডার্থালই সম্ভবত প্রথম সাংস্কৃতিক মনোবৃত্তির পরিচয় রাখে। ইরাকের শানিদার গুহায় ৩৫ থেকে ৬৫ হাজার বছরের পুরনো ১০টি নিয়েন্ডার্থাল ফসিল পাওয়া গেছে, যাদের মধ্যে অন্তত দুটিকে যে কবর দেওয়া হয়েছিল, বোঝা যায়। আফ্রিকাতেই ১ লক্ষ ৯৫ হাজার বছর আগে জন্ম নেয় নবীনতম প্রজাতি, হোমো স্যাপিয়েন্স। ৯০ হাজার বছর আগে এই নতুন প্রজাতি এশিয়ার দিকে যাত্রা করে। ৬০ হাজার বছর আগে সেখান থেকেই তারা ইউরোপে পৌছোয়। হোমো স্যাপিয়েন্সের আবির্ভাবের পর নিয়েন্ডার্থাল প্রজাতি আস্তে আস্তে অবলুপ্ত হয়ে যায়। 

আমরা দেখলাম যে হোমো হ্যাবিলিসই প্রথম পাথরের হাতিয়ার ব্যবহার করতে শুরু করে। অর্থাৎ প্রস্তর যুগ বলতে আমরা যাকে বুঝি তার শুরু মোটামুটি ৩০ লক্ষ বছর আগে। প্রস্তর যুগকে তিন ভাগে ভাগ করা হয় – আদি, মধ্য ও নব্য প্রস্তর যুগ। আদি প্রস্তর যুগ মোটামুটি ৩০ থেকে ২ লক্ষ বছর আগে পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল, যে সময়ে পরপর হোমো হ্যাবিলিস, হোমো ইরেকটাস, হোমো হাইডেলবার্গেনসিস ও হোমো নিয়েন্ডার্থালদের রাজত্ব ছিল। ২ লক্ষ থেকে ৩০ হাজার বছর আগে পর্যন্ত ছিল মধ্য প্রস্তর যুগ। অর্থাৎ মধ্য প্রস্তর যুগেই হোমো স্যাপিয়েন্সের উদ্ভব। নব্য প্রস্তর যুগ ৩০ হাজার থেকে ১১৭০০ বছর আগে পর্যন্ত বিস্তৃত। তারপরেই তুষার যুগের পরে পরেই এল তাম্র যুগ, অর্থাৎ মানুষ তামা নিষ্কাশন ও তার সাহায্যে যন্ত্র বানাতে শিখল। 

প্রাক-বিভাজন ভারতবর্ষে প্রাচীনতম প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া গেছে বালুচিস্থানের মেহেরগড়ে। মেহেরগড়ে প্রাপ্ত মানবকঙ্কাল ২২ হাজার বছর আগের বলেই জানা গেছে অর্থাৎ নব্য প্রস্তর যুগের। হরপ্পা-মোহেঞ্জোদাড়োর সভ্যতা পরবর্তীকালীন তাম্র যুগের সভ্যতা। অবিভক্ত বাংলার নোয়াখালির ছাগলনাইয়া, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড কিংবা সিলেটের চাকলাপুঞ্জিতে পাথরের কুঠার ও অন্যান্য হাতিয়ার পাওয়া গেছে। এর থেকেই বুঝে নেওয়া যায় যে নব্য প্রস্তর যুগে এখানেও মানুষের বসবাস ছিল। তাহলে তারা কি আর্য হতে পারে? সহজ উত্তর হলো, না; তারা আর্য নয়। আমরা দেখেছি, নৃতাত্ত্বিক বিচারে বাঙালী জনসত্ত্বার মৌলিক উপাদান হলো অস্ট্রিক ও মোঙ্গলয়েড। সেই হিসাবে এখানকার নব্য প্রস্তর যুগের বাসিন্দারাও চরিত্রগত বিচারে তেমনটাই হওয়া উচিৎ। একইভাবে উত্তর চব্বিশ পরগনার দেগঙ্গার কাছে আবিষ্কৃত চন্দ্রকেতুগড়ের সভ্যতাও ৪০০০ থেকে ২৫০০ বছরের পুরোনো তাম্র যুগের সভ্যতা বলেই প্রমাণিত। 

এবারে দেখা যাক, বাঙলার সম্বন্ধে আর্য সভ্যতার দৃষ্টিভঙ্গী কী ছিল। মহাভারতের বনপর্বেদেখা যায়, ভীম ছদ্মবেশে অঙ্গদেশে উপস্থিত হন।² অঙ্গ মানে কোশী ও গঙ্গার মধ্যবর্তী মিথিলাঞ্চল। ভীম আরো পূর্বদিকে এগোতে চাইলে সেখানকার ব্রাহ্মণেরা তাঁকে বারণ করেন। তাঁরা বলেন, গঙ্গার পূর্ব তীরের সেই অরণ্যে যারা থাকে, তারা পাখির মতো কিচিরমিচির করে দুর্বোধ্য এক ভাষায় কথা বলে; আবার পাখির মতই তারা নিয়মকানুন না মেনেই এদিকওদিক ঘুরে বেড়ায়। না, ভীম আর পূর্বদিকে এগোননি। মহাভারতের যুদ্ধে বঙ্গের কোনও প্রতিনিধির দেখা পাওয়া যায়নি। হ্যাঁ, উত্তরবঙ্গের পুণ্ড্ররাজ বাসুদেব মগধের সম্রাট জরাসন্ধেরবন্ধু ছিলেন। যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের আসরে শ্রেষ্ঠ মানব হিসাবে কাকে বরণ করা হবে, এই প্রশ্ন উঠলে ভীষ্ম বাসুদেব অর্থাৎ কৃষ্ণের নাম প্রস্তাব করেন। তৎক্ষণাৎ দুর্যোধন পৌণ্ড্রক বাসুদেবকে সামনে এগিয়ে দিয়ে বলেন, হ্যাঁ, ইনিই উপযুক্ত। কেউ হয়তো এই ঘটনাকে পুন্ড্রের প্রতি উত্তর ভারতের সম্মান প্রদর্শন বলেই মনে করতে পারেন। কিন্তু বাস্তবে এটা ছিল কৃষ্ণের প্রতি দুর্যোধনের অবজ্ঞারই প্রকাশ। এর মাধ্যমে দুর্যোধন এটাই বোঝাতে চেয়েছিলেন, কৃষ্ণ পৌণ্ড্রক বাসুদেবের থেকেও নিকৃষ্ট।³আবার বৌধায়নের ধর্মসূত্রে বলা হয়েছে বঙ্গভ্রমণ করে ফিরে এলে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। 

হরিবংশে বলা হয়েছে, দানবরাজ বলির পালিত পুত্র বঙ্গ এইখানে রাজত্ব স্থাপন করেন। তাঁর নাম থেকেই এই অঞ্চলের নাম হয় বঙ্গ। বৈদিক বা উত্তর বৈদিক কৃষ্টিতে অসুর আর দানবরা অপশক্তি বলেই চিত্রিত; সুর অর্থাৎ আর্যদের সাথে তাদের নিত্য লড়াই। কাজেই স্বচ্ছন্দে ধরে নেওয়া যায়, এরা হলো অনার্যদের প্রতিনিধি।আবার দানবরাজ বলিকে বিষ্ণু নাকি তাঁর বামন অবতারে পরাস্ত করেন। সেই বলির পালিত পুত্র বঙ্গ নিশ্চয়ই আর্য কৃষ্টিতে খুব প্রশংসনীয় চরিত্র হতে পারেন না।⁴ যাই হোক না কেন, এই আখ্যান থেকে এটাই বোঝা যায় যে বঙ্গ অঞ্চলে অনার্যদেরই প্রাথমিক বসবাস ছিল। প্রসঙ্গত বঙ্গ শব্দটি বোঙ্গা থেকেই এসেছে বলে অনেক গবেষক মনে করেন। বোঙ্গা হলো অস্ট্রিক সভ্যতার সূর্যদেবতা। হরিবংশের ব্যাখ্যা আর এই অভিমতের মধ্যে একটাই সাধারণ সূত্র আছে। সেটি হলো এই যে, এই অঞ্চল আসলে ছিল অস্ট্রিক-অধ্যুষিত অঞ্চল। 

তাহলে এই অস্ট্রিক জনগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা নিশ্চয়ই ছিল, যাকে মহাভারতে পাখির মতো কিচিরমিচির বলে বলা হয়েছে। সেই জনগোষ্ঠী নিশ্চয়ই রাতারাতি উবে যায় নি। বরং এটা বলাই ঐতিহাসিকভাবে সঠিক হবে যে তারাই অন্যান্য জনগোষ্ঠীর সাথে মিশ্রিত হয়ে বর্তমান বাঙালী জনগোষ্ঠীর চেহারা নিয়েছে। উত্তর ভারতে যখন মহাজনপদের উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে, তখন কিন্তু পূর্ব ভারতের এই প্রান্তে কোনও উল্লেখ নেই। যদিও কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে পুণ্ড্র, প্রাগজ্যোতিষপুর কিংবা মণিপুরের রাজাদের ভূমিকা দেখে এটা অনুমান করা যায় যে উত্তর ভারতের সাথেতাঁদের যোগাযোগ ছিল। এবং গঙ্গার পূর্ব তীরে পা না রেখেই এই অঞ্চলগুলোর সাথে যোগাযোগ বজায় রাখা অবশ্যই সম্ভব ছিল। সেই হিসাবে মহাভারতের আখ্যানের একটা যৌক্তিক ব্যাখ্যাও পাওয়া যায়। মোদ্দা কথা, উত্তর বৈদিক সভ্যতার কাছে বঙ্গভূমি ছিল অবহেলিত। এই জনপদকে প্রভাবিত বা পরাজিত করা যায়নি বলেই হয়তোআর্যরা তাকে অচ্ছুৎ করে রেখেছিলেন।

বঙ্গ অঞ্চলের উল্লেখ পাওয়া গেল আলেকসান্দারের সময়ে। তখন মগধে নন্দ বংশের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। গ্রীক ঐতিহাসিক দিওদোরাস সিকুলাসের বিবরণ অনুযায়ী পুরুকে পরাজিত করার পর আলেকসান্দার জানতে পারেন পূর্ব অভিমুখে রয়েছে প্রাসী (প্রাচী?) রাজ্য এবং গঙ্গানদীর অপরপ্রান্তে রয়েছে এক প্রবল পরাক্রান্ত রাজ্য গঙ্গারিদেই অর্থাৎ গঙ্গাহৃদি। সেই গঙ্গাহৃদির রাজা সেন্দ্রামের বিশাল সেনাবাহিনীর ভয়েই নাকি আলেকসান্দার ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। গ্রীক ভাষায় যাকে সেন্দ্রাম বলা হয়েছে, তাকে স্বচ্ছন্দে চন্দ্রম বা চন্দ্রকেতু বলে ধরে নেওয়াই যায়। চন্দ্রকেতুগড়ের কথা আমরা আগেই বলেছি, যাকে আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগের জনপদ বলে গণ্য করা হয়। আলেকসান্দার ভারত আক্রমণ করেন খ্রীষ্টপূর্ব ৩২৬ অব্দে। সেই হিসাবে দিওদোরাস সিকুলাসের বিবরণের সাথে চন্দ্রকেতুগড় ও আলেক্সান্দারের সময়টা কিন্তু মিলেই যায়। 

সম্রাট অশোকের⁵ সময়ে আসা গ্রীক পর্যটক মেগাস্থিনিস তাঁর বিবরণীতে গঙ্গাহৃদি রাজ্যের বিশালতা ও সামরিক ক্ষমতা সম্পর্কে বিস্তারিত বলেন। তিনি একথাও বলেন, কোনও বৈদেশিক শক্তি কোনদিন গঙ্গাহৃদি জয় করা তো দূরস্থান, আক্রমণ করার সাহসও দেখায়নি। আবার প্লিনির বিবরণ অনুযায়ী প্রাসীর রাজধানী ছিলপালিবোথরা (পাটলিপুত্র)। এখান থেকেই পাটলিপুত্র, অর্থাৎ মগধের নন্দ বংশ এবং গঙ্গাহৃদির মধ্যে গ্রীকবিরোধী একটা জোট যে তৈরি হয়েছিল, বোঝা যায়। আবার এটাও ঘটনা, মেগাস্থিনিসের বিবরণ অনুযায়ী অন্তত অশোকের সময় পর্যন্ত গঙ্গার পূর্বতীরে আর্য অনুপ্রবেশ ঘটেনি; এই অঞ্চল ছিল “পাণ্ডববর্জিত”। প্লিনি এমনও বলেছেন, গঙ্গাহৃদির অধিবাসীদের গাত্রবর্ণ সূর্যের তাপে পোড়া, যদিও তারা ইথিওপিয়ার লোকেদের মতো কৃষ্ণবর্ণ নয়। 

বঙ্গে যদি আর্য অনুপ্রবেশ নাই ঘটে থাকে, তাহলে এখানকার তৎকালীন ভাষার উপর আর্যদের ভাষার প্রভাব পড়ার কোনও কারণই থাকতে পারে না। অবশ্য যদি দুই সভ্যতার মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক থাকে, তাহলে প্রভাব পড়তে পারে। টলেমি গঙ্গাহৃদি রাজ্যের সমুদ্রবন্দর সোওনাগৌড়ার কথা বলেছেন। আবার বর্তমান বাংলাদেশের নরসিংদী অঞ্চলের উয়ারী-বটেশ্বর গ্রামে ব্রহ্মপুত্রের পরিত্যক্ত খাতের মধ্যে খননকার্য চালিয়ে ২৫০০ বছর আগের নগর-দূর্গের সন্ধান পাওয়া গেছে। এমনকি চন্দ্রকেতুগড়ের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে জাহাজ-অঙ্কিত মুদ্রা বা সিলমোহর প্রচুর পাওয়া গেছে। এর থেকেই অনুমান করা যায়, গঙ্গাহৃদি রাজ্য সমুদ্রবাণিজ্যেও অভ্যস্ত ছিল। গ্রীক উপকথায় বলা হয়েছে টিউটন তৃতীয় পার্সের বাহিনীতে দাতিস নামক গঙ্গাহৃদির এক সামরিক নায়ক ছিলেন।ভার্জিল তাঁর জর্জিক্স কাব্যেও গঙ্গাহৃদির সোনা ও হাতির দাঁতের উল্লেখ করেছেন। এমনকি রোমানবাহিনীর সাথে গঙ্গাহৃদির যে যুদ্ধ হয়েছিল, তারও উল্লেখ করা হয়েছে।

গঙ্গাহৃদির সমুদ্রযাত্রার প্রমাণ আরেকটি তথ্য থেকেও পাওয়া যেতে পারে। শ্রীলঙ্কার বৌদ্ধ শ্রমণদের দ্বারা লিখিত মহাবংশ বিবরণী অনুযায়ী বুদ্ধের মহানির্বাণের প্রায় সমসময়ে (খ্রীষ্টপূর্ব ৪৮৩ অব্দ) বঙ্গের নির্বাসিত রাজকুমার বিজয় সিংহ শ্রীলঙ্কা দখল করে তার নাম রাখেন সিংহল। বিজয় সিংহকেই সিংহলের প্রথম রাজা বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। গাঙ্গেয় সমভূমি থেকে সিংহলে যেতে হলে সমুদ্রযাত্রা অবশ্যম্ভাবী। যদি নিয়মিত অভিজ্ঞতা না থাকে এবং সঙ্গে যদি একটি পরাক্রমী সেনাদল না থাকে, তাহলে বিজয় সিংহের পক্ষে শ্রীলঙ্কা দখল সহজ হতো না। অবশ্য এমনটা হওয়াও সম্ভব যে বিজয় সিংহ একটি জনমানবহীন দ্বীপেই আপন অস্ট্রিক রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। সেক্ষেত্রে রামায়ণের কাহিনীর সাথে একটা সাযুজ্যও পাওয়া যায়। রামায়ণ যে খ্রীষ্টপূর্ব পঞ্চম থেকে দ্বিতীয় শতাব্দীর মধ্যে রচিত হয়েছে, অধিকাংশ ঐতিহাসিক সেটাই মনে করেন। কাজেই সিংহলের অস্ট্রিক সভ্যতার উপর আর্য আগ্রাসণ হিসাবে এই কাহিনীকে ব্যাখ্যা করাই যায়।

যাই হোক, সম্ভবত গঙ্গাহৃদির এই সামরিক দাপটের কারণেই আর্যরা সহজে বঙ্গে ঢুকতে পারেনি। সমুদ্রগুপ্তের আমলেই প্রথম বঙ্গভূমি আর্যাবর্ত্যের অধিকারে আসে। সেও হলো চতুর্থ শতাব্দীর ঘটনা। আবার দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের সময় বঙ্গের রাজাদের মিলিত বাহিনীর সাথে গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রবল যুদ্ধ হয়। সেটি পঞ্চম শতাব্দীর একদম শুরুর দিকের ঘটনা। এই সময়ের আগে পর্যন্ত যে বঙ্গের উপর আর্য প্রভাব ছিল না, ইতিহাস সেটাই প্রমাণ করে। আবার এটাও ঘটনা, এই সময় পর্যন্ত বঙ্গের ভাষা সম্পর্কে কোনও ধারনা পাওয়া যায় না। তবে যেহেতু এই অঞ্চলে অস্ট্রিক আধিপত্য ছিল, ফলে অস্ট্রিক ভাষার তদানীন্তন রূপই যে বঙ্গের ভাষা ছিল, এটা ধরে নেওয়া ভুল হবে না। কিন্তু বিশ্বের কোন অঞ্চলেই ভাষা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে অপরিবর্তিত থাকে না। কাজেই বঙ্গের ভাষাও যে অপরিবর্তিত থাকে নি, সেটাও অনুমান করে নেওয়া যায়।

প্রথম পর্বে আমরা দেখেছি, খ্রীষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে মহাবীর ও বুদ্ধ বিহারের মগধ অঞ্চলে পালি ভাষাতে তাঁদের বাণী প্রচার করেছিলেন। সম্রাট অশোকের সময়ে এই পালি ভাষাও পরিবর্তিত হয়ে মগধী প্রাকৃতের চেহারা নিয়ে ফেলে। কিন্তু মাথায় রাখতে হবে, এই সময়ে মগধ ছিল আর্যাবর্ত্যের প্রাণকেন্দ্র। ফলে সেখানে জনগণের ভাষা ও রাজশক্তির ভাষার মধ্যে সম্পর্ক তৈরি হওয়াটা ছিল খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু বাঙলার ক্ষেত্রে এই সম্পর্কের জন্য আমাদের চতুর্থ শতাব্দী পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হলো। ইতিমধ্যে মগধী প্রাকৃত কিন্তু অনেকদূর অগ্রসর হয়ে গেছে। এতদিন পরে সংস্কৃতের সংস্পর্শে এসে বাংলার ভাষা - যা আবার আদতে একটি অস্ট্রিক ভাষা - মগধী প্রাকৃতের রূপ ধারণ করবে, এটা ধরে নেওয়াটা খুব অযৌক্তিক। বরং স্থানীয় অস্ট্রিক ভাষা, মগধী প্রাকৃত ও সংস্কৃতের পারষ্পরিক সম্পর্কের মধ্য দিয়ে একটা নতুন ধরণের প্রাকৃত ভাষা গড়ে ওঠাটাই ছিল খুব স্বাভাবিক। 

ডঃ মহম্মদ শহীদুল্লাহ এক্ষেত্রে যে গৌড়ীয় প্রাকৃতের প্রস্তাবনা করেন, সেটি অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য। ভাষাতাত্ত্বিক প্রমাণ না পাওয়া গেলেও, ইতিহাস ও যুক্তির বিন্যাস মগধী প্রাকৃতের বদলে গৌড়ীয় প্রাকৃতের বাস্তবতাকেই বৈজ্ঞানিক বলে দেখায়। আবার স্থানীয় ইতিহাসের ভিত্তিতে মগধী প্রাকৃতের তুলনায় গৌড়ীয় প্রাকৃত নবীনতর হওয়াটাই উচিৎ। ফলে তার গঠন অনেকটাই এগিয়ে থাকাও যুক্তিযুক্ত। সব মিলিয়ে আপাতত এটুকুই বলা যায়, বাংলা ভাষার উৎপত্তি ও বিবর্তনের প্রাথমিক পর্যায়ে সংস্কৃতের ভূমিকা অনেকটাই সীমায়িত। এই সিদ্ধান্তের ভিত্তি হিসাবে এরপরে আমরা তদানীন্তন বাঙলার ধর্মীয় চেহারাটা একবার আলোচনা করবো।

1. হোমো হাইডেলবার্গেনসিসের উদ্ভব আনুমানিক ২০ লক্ষ থেকে ৬ লক্ষ বছর আগের মধ্যে।

2. ভীম মহাভারতের সভাপর্বে পূর্ব দিকে গিয়েছিলেন যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের কর আদায় করতে এবং সেখানে ছদ্মবেশের কোনও প্রসঙ্গ নেই।

3. ইন্দ্রপ্রস্থে রাজসূয় যজ্ঞকালীন পৌণ্ড্রক বাসুদেবের উপস্থিতির কোনও উল্লেখ মহাভারতে নেই। কৃষ্ণকে গালাগাল দেবার সময় শিশুপাল একবার পৌণ্ড্রক বাসুদেবের কথা বলেছিলেন, দুর্যোধন নন।

4. দানবরাজ বলি আর অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুণ্ড্র, সুহ্মের পালক পিতা এক লোক নন। এই বলি গঙ্গা-যমুনার দোয়াব অঞ্চলে কোথাও রাজত্ব করতেন। তাঁর স্ত্রী সুদেষ্ণার গর্ভে অন্ধ ঋষি দীর্ঘতমার ঔরসে এই পাঁচজনের জন্ম হয়।

5. মেগাস্থেনিস ভারতে এসেছিলেন এবং পাটলিপুত্রে ব্যাকট্রিয়ান সম্রাট সেলুকাস নিকেটরের দূত হিসেবে অবস্থান করেছিলেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের রাজত্বকালে।

0 comments: