0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in


ধারাবাহিক


জলরেখা 
নন্দিনী সেনগুপ্ত 

১৭ 

‘ওরা আজ সারারাত উৎসব করবে, জানো?’ ফিস্‌ফিস্‌ করে কানের কাছে বলে উঠল আইয়ম।

‘কিরকম?’ হেসে ওঠে নিরূপ... ‘আমাদের বিয়েতে ওরা সারারাত জাগবে বুঝলাম। সে তো আমাদের বাঙ্গালীদের বিয়েতেও হয়। বাসর জাগে, বরকনের সঙ্গে। কিন্তু ওরা তো আমাদের থেকে দূরে... মানে ওই মাঠের মধ্যে... এই ঠাণ্ডায়... হাওয়ায়... ওরা সারারাত জেগে, আগুন জ্বালিয়ে নাচ-গান করবে?’ 

‘বারে! করবে না? ওরা শুভকামনা করবে আমাদের জন্য। সব্বার কাছে শুভেচ্ছা আর আশীর্বাদ চাইবে... পাহাড়ের কাছে- প্রকৃতি মায়ের কাছে- ঝর্ণার জলের কাছে- বাতাসের কাছে, মেঘের কাছে... 

‘তারপর, তারপর... ঘাসের কাছে... ফুলের সব পাপড়ি, পরাগরেণুর কাছে... ওই জানলার কাচের শার্সির কাছে... এই পর্দার সব'কটা সুতোর কাছে... কৌতুকপূর্ণ মুখে তাকায় নিরূপ।

আইয়ম একটু গম্ভীর হয়... ‘তুমি ঠাট্টা করছ!’ 

নিরূপ হাসিতে ফেটে পড়ে। আইয়ম গুম গুম করে নিরূপের বুকে কিল মারে। ‘উফফফ... বলে চিত হয়ে শুয়ে পড়ে চোখ বোজে নিরূপ। ‘কি হলো, কি হলো?’ বলে উদ্বিগ্ন মুখে নিরূপের উপর ঝুঁকে পড়ে আইয়ম। 

নিরূপ কাতরায়... ‘ওরে বাবা রে, আমার লেগেছে। খুব জোর লেগেছে। কি মারকুটে মেয়ের পাল্লায় পড়লাম, বাবা গো, মাগো... বিয়ের রাতেই আমাকে মেরে ফেললো রে।’

‘সত্যি লেগেছে? যাহ্‌... আমি এমন কিছু জোরে মারিনি।’ কাঁদো কাঁদো হয় আইয়ম।

‘আরে... জোর তো রিলেটিভ ব্যাপার। আমার ভেজাল খাওয়া শহুরে শরীর... আমার জোর আর তোমার জোর? তুমি পরিষ্কার আবহাওয়ায় পাহাড়ে মানুষ... ভেজাল খাবার জন্মে খাওনি। উরে বাবা রে... কি জোর তোমার গায়ে!’... ফের কাতরাতে কাতরাতে আইয়মের দিকে আড়চোখে তাকায় নিরূপ। 

আইয়ম একটু দূরে দাঁড়িয়ে চোখ সরু করে। আবার বলে, ‘সত্যি লেগেছে? তাহলে এত লেকচার দিচ্ছ কিভাবে?’

নিরূপ হাসতে হাসতে উঠে বসে। এবার আইয়ম রেগে হাত- পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে দূরে গিয়ে দাঁড়ায়।

নিরূপ হতাশভঙ্গীতে বলে, ‘এই রে, রেগে গেলে? দেখেছ তো, তোমাকে রাগানো খুব সোজা।’ 

‘কিন্তু কেন? তুমি আমাকে শুধু শুধু রাগাচ্ছো কেন?’ রাগে হাঁপাতে থাকে আইয়ম, ‘বুঝবে না। তুমি বুঝবে না। তোমরা শহরের লোক। তোমরা বোঝো না। কত জরুরী এই প্রার্থনা। ওরা আমাদের জন্যই প্রার্থনা করছে। এই নাচ গান কি আর বন্ধ ঘরে হয়? পাহাড় শুনবে, আকাশের চাঁদ শুনবে, নদী শুনবে... তবে ফল ফলবে সেই প্রার্থনার। প্রকৃতির শুভকামনা ছাড়া কি মানুষ বাঁচতে পারে? বল, জবাব দাও।’ একটানা বলে সে।

নিরূপ এগিয়ে গিয়ে ধরে আইয়মকে দুহাতে। চিবুক নেয় দুহাতের পাতায়। বলে...... ‘এত রাগ করতে নেই আজ। চুপ’... বলে নিজের ঠোঁট চেপে ধরে আইয়মের ঠোঁটে... চুপ করিয়ে দেয় ক্ষুব্ধ এই মানবীকে। 

আইয়ম সরিয়ে দেয় না নিরূপকে, আবার স্পর্শে, চুম্বনে সেভাবে সাড়াও দেয় না। অভিমান কমেনি এখনও এই নারীর, বোঝে নিরূপ। হাতে হাত রাখে তার। বলে, ‘আমি কি বলেছি যে মানুষ প্রকৃতিকে ছাড়া বাঁচতে পারে? আসলে আমার কাছে এই সবকিছুই নতুন, খুব নতুন। তাই অবাক হয়ে যাচ্ছি এসব নানা আচার-ব্যবহারে। দেখবে, তোমাকে যখন আমাদের বাড়িতে নিয়ে যাবো, আমাদের বাঙ্গালীমতে আবার বিয়ে হবে, তোমারও এরকম অনেককিছু মনে হবে উদ্ভট, নতুন, হাসি পাবে। তখন কি আমি রেগে যাবো?’ 

আইয়ম চুপ করে থাকে। জবাব দেয়না। শুধু পূর্ণদৃষ্টিতে চোখ তুলে তাকায় নিরূপের দিকে।

নিরূপ আবার বলে, ‘তবে রেগে গেলে যে তোমাকে আরও সুন্দর, আরও মিষ্টি লাগে, সেটা তো আগেও বলেছি। ধরে নাও সেজন্যই আজ রাগিয়ে দিলাম।’

আইয়ম অন্যদিকে তাকায়। তারপর বলে, ‘এরকম ঠাট্টা আমি বুঝি না, নিরূপ! আমি তোমাদের শহুরে ইয়ার্কি সত্যিই বুঝিনা। কলেজে আমার ক্লাসে অনেক শহুরে মেয়ে পড়ত। আমি ওদের সব কথা সেভাবে বুঝতাম না। ওরা বলে একটা, ভাবে হয়ত অন্য আরেকটা কথা। তুমি কখনও এরকম ঠাট্টা আমার সঙ্গে করো না নিরূপ, যেটা আমি বুঝতেই পারব না, প্লিজ’। 

নিরূপ ওর হাতে চাপ দেয়। বলে, ‘এসব জটিল কথা আজ থাক না। আচ্ছা, দেখতে সুন্দর লাগছে বললাম, কমপ্লিমেন্ট দিলাম, একটা থ্যাঙ্কস অন্তত বলো।’ 

সত্যি সত্যিই আইয়মকে খুব সুন্দর লাগছে বিয়ের সাজে। নিরূপের ঘোর লেগে যায়। ওর নামের অর্থের সঙ্গে যেন মিলে গেছে এই সাজ। সে যেন কোনও পার্থিব নারী নয়। হয়তো বা স্বয়ং বসন্ত ঋতু সোনার সাজ পরে নেমে এসেছে ঘরের মাঝে। গাঢ় লাল ভেলভেটের জ্যাকেটের সঙ্গে সিল্কের পোশাকের হলুদ রঙের চাদরের আঁচল কাঁধে আটকানো পাথরের ব্রোচ থেকে নেমে এসে ভূমি স্পর্শ করছে। গলায় ভারি সুন্দর পাথরের নেকলেস। কানে দুল। মাথায় মুকুটে রঙিন ফুলের গুচ্ছ। হাতে পাথরের ম্যাচিং কঙ্কন। আইয়ম ঘন হয়ে আরও কাছাকাছি আসে নিরূপের। ওর হাতের কঙ্কনে রিনিরিনি শব্দ ওঠে। সেই শব্দ ছাপিয়ে আরও দ্রুতলয়ে দূরে মাঠে ড্রাম বেজে ওঠে; ঢোলকের দ্রিমি দ্রিমি আওয়াজ শোনা যায়। নাচছে গ্রামের লোকেরা। উৎসব করছে। ভেসে আসে বাঁশির সুর। জ্যোৎস্না ধুয়ে দেয় পাহাড়ের ঔদ্ধত্য, অহংকার। 



0 comments: