0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in


ধারাবাহিক


গার্ড (অনুবাদ গল্প) 
নন্দিনী সেনগুপ্ত 



১০ 

‘ও বেঁচে আছে! বেঁচে আছে! ঈশ্বর মঙ্গলময়...’ ঠীল বিড়বিড় করতে লাগলো। সিগন্যালের পরেই ট্রেনটা আসছে বুঝতে পারলো সে। এঞ্জিনের বাষ্পের দমকা টানে সে ট্র্যাকের পাশের জমিতে উল্টে পড়ে গেলো। কালো ধোঁয়ায় ঢেকে গেলো চারিদিক। এঞ্জিনটা একটা রুগ্ন দৈত্যের মত হাঁপাতে হাঁপাতে আর্তনাদ করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছে। এক শীতল সাঁঝবেলার অন্ধকার ছড়িয়ে যাচ্ছে চতুর্দিকে। 

ধীরে ধীরে ধোঁয়া কেটে যাবার পরে সে বুঝতে পারলো এটা যাত্রীবাহী ট্রেন নয়, মালগাড়ি। সকালের দিকে শ্রমিকরা রেলের কাজের জন্যই নুড়িপাথর বোঝাই করে নিয়ে গিয়েছিল এই গাড়িতে, এখন খালি গাড়িতে দিনের শেষে তারাই ফিরছে। এই ট্রেনটার সময়সীমা অনেক বেশি দেওয়া আছে। এটা প্রয়োজনমত থামে যেকোনো জায়গায়; যেখানে শ্রমিকরা খাটে, সেখানে তাদের নামিয়ে দেয়, কিংবা কাজের শেষে সেখান থেকে তাদের তুলে নিয়ে আসে। ঠীলের কেবিনের অনেকখানি আগেই ট্রেনটা ব্রেক কষেছে, এটা সে বুঝতে পারলো। ধীরে ধীরে ক্যাঁচক্যাঁচ, ঘর্ঘর, ঢংঢং – নানা রকমের আওয়াজ তুলে সন্ধেবেলার নৈঃশব্দ ভঙ্গ করতে লাগলো ট্রেনটা। তারপর একটা ধীরলয়ের হিস্‌হিস্‌ আওয়াজ তুলে একেবারে থেমে গেলো। 

প্রায় জনাপঞ্চাশ শ্রমিক আর কর্মী আছে ট্রেনটাতে। আজ সবাই অদ্ভুতভাবে স্থির, সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেদের অনেকের মাথায় টুপি নেই। একটা অদ্ভুত নিশ্চুপ ভাব সবার মধ্যে। যখনই তারা গার্ড ঠীলকে দেখতে পেলো, কি যেন ফিসফিস করতে লাগলো। বুড়ো মানুষগুলো হলদে দাঁতের ফাঁক থেকে পাইপ বের করে হাতে ধরে রইল, মেয়েরা নিজেদের মধ্যে অস্ফুটে বলাবলি করতে শুরু করলো। এঞ্জিন ড্রাইভার সিঁড়ি দিয়ে এঞ্জিন থেকে নেমে ঠীলের দিকে এগিয়ে গেলো। সবাই দেখলো যে ঠীল গম্ভীরমুখে মাথা নাড়ছে। দেখা গেলো যে ট্রেনের শেষ বগিটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সে, কিন্তু কেমন যেন মিলিটারি কুচকাওয়াজের মত কাঠকাঠ তার হাঁটবার ধরন! সব্বাই একদৃষ্টে ঠীলের দিকে তাকিয়ে রইলো। সব্বাই ওকে চেনে, কিন্তু আজ ওকে ডেকে, ওর সঙ্গে কথা বলা... নাহ, কারো সাহসে কুলোচ্ছেনা! শেষ বগি থেকে ছোট্ট টোবিয়াসকে নামানো হলো। নামানো হলো টোবিয়াসের প্রাণহীন দেহ। 

পেছন পেছন নামলো লেনা। লেনার মুখ ফ্যাকাসে নীলচে হয়ে গেছে; বসে যাওয়া চোখের নিচে বাদামী ছোপ। ঠীল লেনার দিকে তাকাচ্ছিলো না। কিন্তু লেনা ঠীলকে দেখে চমকে উঠলো। বসে যাওয়া গাল, ভিজে চোখের পাতা আর গোঁফ, গালে শুকিয়ে যাওয়া চোখের জলের দাগ, সব মিলিয়ে ঠীলকে অদ্ভুত দেখাচ্ছে। মাথার চুল কয়েক ঘণ্টায় আরও সাদা হয়ে গেছে। চোখে একটা অস্বাভাবিক চাহনি, যেন এক আতঙ্ক গ্রাস করে ফেলেছে তাকে। 

স্ট্রেচারটা সঙ্গে নিয়ে আসা হয়েছে ওর ছোট্ট শরীরটা বয়ে আনবার জন্য। এক অদ্ভুত স্তব্ধতা চারিদিকে। ঠীলকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে একেবারে ভেঙে পড়েছে সে। ধীরে ধীরে অন্ধকার নেমে আসছে। জঙ্গল থেকে বেরিয়ে একদল হরিণ ট্রাকের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। দলপতি হরিণটি ট্র্যাকের উপরে উঠে ঘাড় ঘুরিয়ে কি যেন দেখতে শুরু করলো কৌতূহলের সঙ্গে। ট্রেন একটা হুইস্‌ল দেওয়ামাত্র গোটা দল লাফাতে লাফাতে মুহূর্তের মধ্যে আবার ঢুকে গেলো জঙ্গলে। 

ট্রেনটা আবার যেইমাত্র চলতে শুরু করলো, ঠীল একবারে মূর্ছা গেলো। 

ট্রেনটা আবার থেমে গেলো। সবাই ভেবে পাচ্ছিলনা যে কি করবে! টোবিয়াসের দেহ কিছুক্ষণের জন্য গার্ড কেবিনে রেখে দেওয়া হবে, নাকি একেবারে ওর বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হবে, সেটা কেউ স্থির করতে পারছিলো না। 

তারপর ব্যাপারটা এরকম দাঁড়ালো; টোবিয়াসের দেহ কেবিনে রেখে দেওয়া হল। দুজন লোক অজ্ঞান ঠীলকে স্ট্রেচারে করে বয়ে নিয়ে গেলো বাড়িতে। পেছন পেছন লেনা নিজের দুধের বাচ্চাকে গাড়িতে বসিয়ে কাঁদতে কাঁদতে সঙ্গে গেলো। 

রেলওয়ে ট্র্যাকটা যেখানে দিগন্তে মিশে গেছে, হাল্কা বেগুনী রঙের গোলকের মত চাঁদটা অনেকক্ষণ সেখানে আলসেমি করে শুয়ে ছিল। তারপর ধীরে ধীরে উপরের দিকে উঠতে শুরু করল, ছোট হয়ে লাগল সেটা। ট্রাফিক সিগনালের আলোর মত ছোট হয়ে সেটা জঙ্গলের মাথার উপরে ঝুলে রইলো। গাছগুলোর মাথায়, পাইনগাছের মুকুটে আর যারা চাঁদের দিকে দেখছিলো, সবার মুখে গলিত রূপার মত জ্যোৎস্না চুইয়ে পড়তে লাগলো। 

ওরা খুব সাবধানে ঠীলকে নিয়ে যাচ্ছিল। সন্ধেবেলায় জঙ্গলের মধ্য দিয়ে স্ট্রেচারে করে একজনকে বয়ে নিয়ে যাওয়া, কাজটা মোটেই সহজ ছিলনা। কখনো সে ঘোরের মধ্যে সে মুঠি পাকাচ্ছিল, কখনো আবার খিঁচুনি উঠছিল। চোখ বোজা অবস্থায় লাফিয়ে উঠছিল। গহন জঙ্গলের মধ্যে ছেঁড়া ছেঁড়া চাঁদের আলোর ভেতর দিয়ে ওরা যাচ্ছিল। মাঝে মাঝে দাঁড়াতে বা ফিরে যেতে হচ্ছিল, কারণ লেনা তার বাচ্চাকে নিয়ে পিছিয়ে পড়ছিল। 

জঙ্গলের টিলা পেরিয়ে যাবার পরেই ওদের সঙ্গে গ্রামের এক দু জন লোকের দেখা হলো। ব্যস, কথায় কথায় এই বিপর্যয়ের কথা আর দুঃসংবাদ ছড়িয়ে গেলো। ওরা পৌঁছাতে পৌঁছাতে গোটা গ্রাম যেন ভেঙে পড়লো। চেনা পরিচিত মুখ দেখে লেনা আবার হাহাকার করে, চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো। 

তাড়াতাড়ি ঠীলকে নিয়ে গিয়ে একেবারে শোবার ঘরে বিছানায় শুইয়ে দেওয়া হল। লোকগুলি আবার স্ট্রেচার নিয়ে ফিরে গেলো ছোট্ট টোবিয়াসের দেহ নিয়ে আসবার জন্য। 

অভিজ্ঞ বয়স্ক প্রতিবেশী মহিলারা পরামর্শ দিলো ঠীলের মাথায় ঠাণ্ডা সেঁক দেওয়ার জন্য; লেনা অক্ষরে অক্ষরে সব কথা শুনতে লাগলো। বরফ ঠাণ্ডা জলে তোয়ালে ভিজিয়ে অসুস্থ ঠীলের জ্বরতপ্ত কপাল মুছিয়ে দিতে লাগলো সে। তোয়ালে গরম হয়ে গেলে আবার ভিজিয়ে নিচ্ছিল। উদ্বিগ্নভাবে লেনা ঠীলের শ্বাসপ্রশ্বাসের দিকে নজর রাখছিলো। ধীরে ধীরে তার শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে আসছিলো। 

সারাদিনের এই বিপর্যয় এবং ধকলে প্রচণ্ড ক্লান্ত লেনা ভাবছিল যে একবার ঘুমিয়ে নেবে কিনা কিছুক্ষণের জন্য; কিন্তু সে কিছুতেই দুচোখের পাতা এক করতে পারছিলনা। তন্দ্রা ছিঁড়ে ছিঁড়ে যাচ্ছিল তার। চোখ খুলে রেখে হোক বা বন্ধ করেও, গত কয়েক ঘণ্টা বারেবারে তার চোখের সামনে ফিরে ফিরে আসছিল। দুধের বাচ্চাটা ঘুমিয়ে গেছে। এই মুহূর্তে লেনা তার দিকে খুব একটা মনোযোগ দিচ্ছেনা, যা তার স্বভাবের একেবারে বিপরীত। লেনা বরাবর নিজের বাচ্চাকে নিয়ে অতিরিক্ত সতর্ক। সে একেবারে বদলে গেছে ভিতরে ভিতরে কোথাও। তার স্বভাবগত ঔদ্ধত্যের কোনো চিহ্ন যেন আর অবশিষ্ট নেই। অসুস্থ, ফ্যাকাসে মুখের ঠীল বার বার লেনার স্বপ্নে ফিরে আসতে লাগলো। 

একটা মেঘ এসে ধীরে ধীরে চাঁদকে ঢেকে দিতে শুরু করলো। বড্ড অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে ঘরটা, শুয়ে শুয়ে ভাবছিল লেনা। ঠীলের ভারি হয়ে যাওয়া শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছিল ঘরে। লেনা একবার ভাবলো যে উঠে একটা বাতি জ্বালাবে কিনা! উঠবার চেষ্টা করতে গিয়ে অনুভব করলো যে তার শরীর যেন একেবারে সীসের বস্তার মত হয়ে গেছে, চোখের পাতা ভারি হয়ে আসছে; লেনা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লো। 

কয়েক ঘণ্টা পরে যখন লোকগুলো টোবিয়াসের দেহ নিয়ে আবার ফেরত এলো, দেখতে পেলো বাড়ির সদর দরজা একেবারে হাট করে খোলা। অবাক হয়ে তারা সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে দেখলো শোবার ঘরের দরজাও খোলা। 

অনেকবার গৃহকর্ত্রীকে ডাকাডাকি করে কোনো সাড়া পাওয়া গেলো না। তারপর অন্ধকারে একজন একটা দেশলাই কাঠি ধরাবার পরে ঘরের ভেতরকার বীভৎস অবস্থা তাদের চোখে পড়লো। 

‘খুন,... খুন!’ 

লেনা রক্তের নদীতে শুয়ে আছে। তার মুখটা চেনা যাচ্ছেনা এত বিকৃত হয়ে গেছে! মাথার খুলিটা কেউ ভেঙে দিয়েছে। 

‘লোকটা ওর বউকে খুন করেছে... খুন করেছে লোকটা!’ 

প্রচণ্ড চিৎকারে আশেপাশের আরও প্রতিবেশী ছুটে এলো। ঘরে ঢুকে অবস্থা দেখতে দেখতে আরেকজন দোলনার কাছে গিয়ে ‘হায় ভগবান’ বলে আর্তনাদ করে উঠল। দুধের বাচ্চাটার গলা কাটা। ঠীল কোথাও নেই। সে পলাতক। 

সেই রাত্তিরে ঠীলকে অনেক খোঁজাখুজি করেও কোথাও পাওয়া গেলোনা। পরের দিন সকালে যে গার্ডের ডিউটি ছিল, সে ঠীলকে দেখতে পেল রেলওয়ে কেবিনের কাছে। দেখা গেলো ঠীল রেলওয়ে ট্র্যাকের উপরে বসে আছে; যেখানে টোবিয়াসের অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল, ঠিক সেইখানে। ঠীলের হাতে টোবিয়াসের সেই ফারের বাদামী রঙের বড় বড় কানওয়ালা খরগোশ-টুপিটা। ঐ টুপিটাকে ঠীল এমনভাবে আদর করছিল, যেন সেটা জীবন্ত! 

সেই গার্ড তার কাছে গিয়ে এক-দুটো কথা জিজ্ঞেস করে কোনও উত্তর পেলো না এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝতে পারলো যে ঠীল বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছে। 

তারপর সেই গার্ড টেলিগ্রাফের মাধ্যমে সাহায্য চেয়ে আরও লোকজন ডেকে নিয়ে এলো। সবাই মিলে ভুলিয়ে, ভয় দেখিয়ে নানা চেষ্টা করেও ঠীলকে রেলওয়ে ট্র্যাকের উপর থেকে সরাতে পারছিল না। এইসব কাণ্ডকারখানার জেরে সেদিন এমনকি এক্সপ্রেস ট্রেনটাও থামাতে হল। কিছুক্ষণের জন্য সবাই মিলে গায়ের জোরে অসুস্থ ঠীলকে ট্র্যাক থেকে তুলে দেবার পরে, তবে ট্রেনটা গেলো। ট্রেন চলে যাবার পরে আবার ঠীল ট্র্যাকের উপরে গিয়ে বসে পড়ল। 

তারপরে জোর করে হাত-পা বেঁধে পুলিশের হেফাজতে দেওয়া হল তাকে। তারা তাকে চালান করে দিলো বার্লিনের হাজতে। সেখানে প্রথমদিনেই কেস দেবার পরে, অপরাধী সাব্যস্ত হলেও, জেলে নয়- তাকে পাঠানো হল পাগলা গারদে। সে এখনো সেখানেই আছে; তবে পরম মমতায় সতর্কভাবে সে সামলে রেখেছে তার হাতের সেই বাদামীরঙের খরগোশ টুপিটা। 



[শেষ] 

[গেরহার্ট হাউপ্টমান রচিত ‘বানভ্যার্টার ঠীল’ গল্প অবলম্বনে রচিত] 



0 comments: