সম্পাদকীয়




















একজন বিশ্বখ্যাত ফুটবলারের কলকাতা সফর নিয়ে ধুন্ধুমার। যা ঘটল, তাকে নজিরবিহীন বললেও কিছুই বলা হয় না। শ্রমার্জিত,  এমনকী অনেক ক্ষেত্রে সুদের বিনিময়ে ঋণ করা অর্থ দিয়ে কেনা টিকিট জোগাড় করেও ফুটবল পাগল কিছু মানুষ তাদের কাঙ্খিত পুরুষটির দর্শন থেকে বঞ্চিত হলেন।


এর ফলাফল হল ভয়াবহ। যদিও অনেকের মতে আমরা যা প্রত্যক্ষ করলাম, আরও বেশি সংখ্যায় এবং আরও উগ্র মেসি-সমর্থকের দল সেদিন যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে উপস্থিত থাকলে সামগ্রিক পরিস্থিতি একটা দাঙ্গার চেহারা নিতে পারত।


এই ঘটনার দায় কার? এখনও পর্যন্ত যেটুকু বোধগম্য হচ্ছে তা হল, সংশ্লিষ্ট কোনও বিভাগই সরাসরি সীমাহীন এই অপদার্থতার দায়িত্ব স্বীকার করেনি। কিছু 'ক্ষমা প্রার্থনা', 'দুঃখ প্রকাশ', 'অব্যাহতি চাওয়া' এবং 'কারণ দর্শানো'র মধ্যেই পুরো বিষয়টি সীমাবদ্ধ রয়েছে। একটা তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে অবশ্য। সেই কমিটি কোনও যুক্তিগ্রাহ্য দিশা দেখাতে পারবে কিনা, সেই উত্তর ভবিষ্যতের গর্ভে। আপাতত যে প্রশ্নগুলি উঠে আসে, তার প্রথমটি হল মারাত্মক পরিকাঠামোগত ঝুঁকি জিইয়ে রেখে এধরনের একটি আন্তর্জাতিক (প্রত্যাশিত) মানের অনুষ্ঠান করা যায় কি? কী হতো, যদি প্রবল ভিড় থেকে ঘটে যেত কোনও দুর্ঘটনা, যাতে মেসি আঘাতপ্রাপ্ত হতেন? পুলিশের কাজ নিরাপত্তা দেওয়া। তাঁরা যদি সেখান থেকে সরে এসে নিজস্বী সংগ্রহে মগ্ন হন, সর্বনাশের বাকি কিছু থাকে কি? জনমানসে এখন এমন অনেক ধন্দের ছায়া। সেই ভাবনার অভিমুখটি যদি আসন্ন নির্বাচনের দিকে ঘুরে যায়, তাতে মনে হয় সকলেরই  মঙ্গল!


সুস্থ থাকুন। দায়বদ্ধ থাকুন।

বড়দিন ও নববর্ষের শুভেচ্ছা সকলকে।

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - রঞ্জন রায়






















১.০ প্রস্তাবনা

গত এক শতাব্দী ধরে প্রাচীন ভারতের প্রাক-ইতিহাস (pre-history) চর্চায় দুটো পরস্পর বিরোধী থিওরি একে অন্যকে টক্কর দিচ্ছে। একটা হোল আর্যদের মধ্য এশিয়া থেকে হিন্দুকুশ পেরিয়ে ভারতে আগমনের তত্ত্ব। আরেকটি হল আর্যরা ভারতে বহিরাগত নয়, এখানেই উদ্ভূত ভারতের আদি জনগোষ্ঠী। এই বিতর্কে রাজনৈতিক রঙ লাগায় শুরু হয়ে গেছে ঠান্ডা মাথায় পরস্পরবিরোধী সাক্ষ্যের যুক্তিযুক্ত বিবেচনার বদলে চেরি পিকিং করে আংশিক তথ্য নিয়ে গলাবাজি। ইদানীং কালে হরপ্পা সভ্যতার বেশ কিছু নিদর্শন পুরাতাত্ত্বিক খননের ফলে আবিষ্কার হয়েছে। যেমন গুজরাতের ধোলাবিরা ও লোথাল এবং হরিয়ানার রাখীগড়ী।

যা পাওয়া গেছে তার থেকে কী সিদ্ধান্তে আসা যুক্তিসংগত হবে সে কথায় পরে আসছি।

বলে রাখা ভাল, বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে এ নিয়ে কোন বিতর্ক ছিল না। সবাই মেনে নিয়েছিলেন যে ভারতের সবচেয়ে প্রাচীন সভ্যতা হল হরপ্পা সভ্যতা (মহেঞ্জোদারো এবং হরপ্পা)। এদের বিশিষ্ট পরিচিতি ছিল নগরায়ণ। অন্যদিকে বহিরাগত আর্যরা ছিলেন যাযাবর শিকারী জনগোষ্ঠী। তাঁদের ছিল অশ্ব এবং ব্রোঞ্জের হাতিয়ার, লোহার অস্ত্র পরের দিকে এসেছে। যজ্ঞ ছিল দৈনন্দিন জীবনযাত্রার গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। যুদ্ধ এবং প্রাকৃতিক শক্তির আরাধনা তাঁদের সাংস্কৃতিক পরিচয়।

সৃষ্টির উৎস খোঁজা, আধ্যাত্মিক বিমূর্ত চিন্তা অনেক পরে বিকসিত হয়।

এই হাইপোথেসিসের উৎস হল বৈদিক সাহিত্য , বিশেষ করে ঋগবেদের বিভিন্ন বর্ণনা।

এছাড়া দক্ষিণ ভারতের দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীও বৈদিক আর্যদের আগমনের আগে থেকে ভারতে রয়েছে। রামায়ণের কাহিনীকে অনেক ইতিহাসবিদ উত্তর ভারতের আর্যদের দাক্ষিণাত্য এলাকা বিস্তারের গাথা মনে করেন।

সেই সময় হিন্দুত্ব ধারণার প্রবক্তা সাভারকরও বহিরাগত আর্যদের থিওরির সমর্থক ছিলেন। তাঁর “হিন্দুত্ব” বইয়ে তিনি এটাকে বৈদিক আর্যের উপনিবেশ নির্মাণের প্রমাণ হিসেবে দেখে গর্বিত হয়েছিলেন। বইয়ের উপসংহারে আশা প্রকাশ করেছেন যে আজকের হিন্দু একদিন ফের সমগ্র বিশ্বে উপনিবেশ স্থাপনের অভিযান শুরু করবে।

“হিন্দুস্থানের এবং হিন্দু সংস্কৃতির প্রতি ভালবাসা নিয়ে তারা ছড়িয়ে পড়ুক উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরু, গড়ে তুলুক হিন্দু উপনিবেশ; সমগ্র বিশ্বই তাদের ভৌগলিক সীমা”।

কিন্তু গত শতাব্দীর শেষ পাদে বাবরি মসজিদ ধ্বংস ও খোলাখুলি ভারতকে ধর্মনিরপেক্ষ দেশের বদলে হিন্দুরাষ্ট্র বানানোর আহ্বানের সঙ্গে প্রচার শুরু হয়েছে যে হিন্দুধর্ম হচ্ছে ‘সনাতন’—যার কালসীমা নির্ধারণ করা কঠিন। এবং হিন্দু ছিল বিশ্বগুরু এবং ঈশ্বরের নির্বাচিত ধার্মিক জনগোষ্ঠী। কাজেই ভারতের প্রাচীন সভ্যতা মানেই হিন্দু সভ্যতা যা ভারতে আবহমান কাল থেকে অস্তিত্ববান। অতএব, ‘বহিরাগত’ আর্যদের ভারতে আসার তত্ত্ব খারিজ।

কিন্তু এই হাইপোথেসিসকে শক্ত ভিতের উপর দাঁড় করাতে হলে আগে দেখাতে হবে যে হরপ্পা সভ্যতার নগরায়ণের আগে থেকে ভারতে আর্য বা ইন্দো-ইউরোপীয় সভ্যতার অস্তিত্ব ছিল এবং তা হরপ্পার চেয়ে উন্নত ছিল।

২.০ প্রাক-ইতিহাসের খোঁজঃ তিনটি পদ্ধতি

ক) পুঁথি ও পুরাণভিত্তিক

শুরু হয়েছিল প্রাচীন পুঁথি, সাহিত্য, লোককথা, পুরাণকে সাক্ষ্য এবং উৎস মেনে। কিন্তু দেখা গেল তার সীমা আছে। অনেকগুলিই লেখা হয়েছে ঘটনার অনেক পরে, একটি জনগোষ্ঠীর স্মৃতি , কল্পকথা ও বিশ্বাসকে ভিত্তি করে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাতে পড়েছে অনেকের হাত, মিশেছে লিপিকারের মনের মাধুরী। ফলে কালনির্ণয় কঠিন।

খ) পুরাতত্বভিত্তিক

এবার এল পুরাতত্ব বা পাথুরে প্রমাণ। যা সময়ের দলিল হিসেবে বেশি টেঁকসই। গত শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগ থেকে পুরাতত্ব বিজ্ঞান তার আধুনিক খনন পদ্ধতি, তার থেকে প্রাপ্ত মৃৎপাত্র, হাতিয়ার, জনপদের বাড়িঘরের ধ্বংসাবশেষ এবং ফসিল তথা পুঁথির থেকে কালনির্ণয়ের আধুনিক পদ্ধতির (রেডিও কার্বন ১৪ টেস্ট) মাধ্যমে অনেক ভাল ফল দিচ্ছে। অর্থাৎ প্রাক-ইতিহাসের আলোচনায় পুঁথির চেয়ে পাথুরে সাক্ষ্য বেশি নির্ভরযোগ্য।

রেডিও কার্বন ১৪ টেস্ট

সমস্ত জীবিত উদ্ভিদ এবং প্রাণী বাতাবরণ থেকে কার্বন -১৪ সংগ্রহ করে, কিন্তু মৃত হলে সেটা বন্ধ হয়ে যায় এবং আগে থেকে সংগৃহীত কার্বন ১৪ ক্ষয় হতে হতে নাইট্রোজেন ১৪ হয়ে যায়। প্রতি ৫৭৩০ বছরে একটি স্যাম্পলে জমে থাকা কার্বন ১৪ এর অর্ধেক নষ্ট হয়ে যায়।

বৈজ্ঞানিকেরা স্যাম্পল থেকে কার্বন ১৪ ( নষ্ট এবং বাকি) তুলনামূলক অধ্যয়ন থেকে বের করতে পারেন যে কত বছর আগে এটি মারা গেছে।

এই পদ্ধতিতে ৫০০০০ বছর পুরনো স্যাম্পল অবধি সঠিক ফলাফল দেয়।

আজ পর্যন্ত হরপ্পা-মহেঞ্জোদারো সভ্যতার লিপির সঠিক পাঠোদ্ধার সম্ভব না হলেও এই পদ্ধতির মাধ্যমে শিলালিপি, মূর্তি ও বাস্তুকলার কালনির্ণয় সম্ভব হয়েছে।

সিন্ধু সভ্যতার নিদর্শনগুলো্র মধ্যে হরপ্পা-মহেঞ্জোদারো সমেত অধিকাংশই সিন্ধু অববাহিকার পাকিস্তান অংশে পাওয়া গেছে। কিন্তু এই শতাব্দীর গোড়ায় ভারতের কয়েকটি জায়গায় – লোথাল ও ধোলাভিরা (গুজরাত), কালিবঙ্গান (রাজস্থান) এবং সাম্প্রতিক যে খনন নিয়ে হৈচৈ হচ্ছে, রাখীগড়ি (হরিয়ানা) তা থেকে বেশ কয়েক হাজার বছর আগে এখানে বন্দর , নৌবাণিজ্য, উন্নত জল নিকাশি ও সংরক্ষণ ইত্যাদির প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে।

আর রাখীগড়ি হচ্ছে ভারত-পাক উপমহাদেশে সিন্ধু সভ্যতার সবচেয়ে বড় সাইট।

গ) ডি এন এ বিশ্লেষণ বা জেনেটিক বিজ্ঞানের সাক্ষ্য

প্রাক ইতিহাসের চর্চায় এখন সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি—জিনতত্ত্ব বা ডি এন এ বিশ্লেষণের মাধ্যমে কালনির্ণয়। আজ কয়েক লক্ষ বছর পুরনো ফসিলেরও ডি এন এ বিশ্লেষণ সম্ভব হচ্ছে। ফলে পুরাতত্ব ও জিনতত্ত্ব হাত ধরাধরি করে অনেক অমীমাংসিত প্রশ্নের স্থায়ী সমাধান এনে দিচ্ছে।

কিন্তু এই পদ্ধতিটি বিকসিত এবং উন্নত হয়েছে মাত্র কয়েক দশক আগে। তাই বেশির ভাগ সাধারণ মানুষ এর গুরুত্ব বিষয়ে তেমন অবহিত নন।

এই লেখার সীমিত পরিসরে বোঝার চেষ্টা হয়েছে যে এই অত্যাধুনিক পদ্ধতিটি ভারতে মধ্য এশিয়া থেকে আর্যদের আগমনের তত্ত্ব নিয়ে কী সাক্ষ্য বা প্রমাণ পেশ করছে।

গোড়াতে দরকার বিতর্কটি স্পষ্ট করে বোঝা।


৩.০ কেন বাইরের থেকে কাউকে আসতেই হবে?

আমরা কেন ধরে নিচ্ছি যে ভারতের মাটিতে প্রথম পা রাখা আধুনিক মানুষটি বাইরে থেকে এসেছিল? ভারতের মূল জনগোষ্ঠী এদেশের মাটিতেই উদ্ভূত হয়েছিল—এটা মেনে নিতে বাধা কোথায়? এতদিন তো এটাই ধরে নেয়া হয়েছিল যে আধুনিক মানব বিশ্বের বিভিন্ন অংশে স্বতন্ত্র ভাবে উদ্ভুত এবং বিবর্তিত হয়েছে। তাহলে ভারতের ক্ষেত্রে কেন ব্যতিক্রম হবে? চিনের নৃতত্ববিদেরাও মনে করতেন চিনের মানব বিশ্বের অন্য নরগোষ্ঠীর থেকে আলাদা, উদ্ভূত হয়েছে চিনেরই ভৌগলিক অঞ্চলে।

তবে চার্লস ডারউইন সেই ১৮৭১ সালেই বলেছিলেন যে সমগ্র মানবজাতির একটিই উৎস--আফ্রিকায় এক বিশেষ প্রজাতির শিম্পাঞ্জি।

গত শতাব্দীর শেষ কয়েক দশক থেকে এই প্রশ্নটি শুরু হয়েছে এবং কিছুদিন আগেও মনে করা হত --এটি একটি সংগত প্রশ্ন বটে। কিন্তু আজকে মুষ্টিমেয় কিছু নৃতত্ববিদ ছাড়া সবাই মনে করছেন আফ্রিকা থেকে প্রাপ্ত ফসিলের ডি এন এ বিশ্লেষণ নিশ্চিত ভাবে মানব জনমের উৎস নিয়ে ‘বহুত্ববাদী’ তত্ত্বকে খারিজ করছে।

কীভাবে?

৪.০ শেষ হাসি কি ডারউইনের?

বিবর্তনের ধাপে আধুনিক মানুষের নিকটতম পূর্বপুরুষদের সবরকম বৈচিত্র্যময় ফসিল পাওয়া গেছে শুধু আফ্রিকা মহাদেশে।

যেমন Sahelanthropus tchadensis (৭ মিলিয়ন বছর আগে), Ardipithecus ramidus (৪ মিলিয়ন বছর), Kenyanthropus playtyops (৩.৫ মিলিয়ন), Homo habilis (২.৪ মিলিয়ন) এবং Homo beidelbergensis ( ৭ লক্ষ থেকে ২ লক্ষ বছর আগের)।

আর এসবের ডি এন এ বিশ্লেষণ থেকে চূড়ান্ত প্রমাণ পাওয়া গেছে যে আফ্রিকার বাইরে বিভিন্ন মহাদেশে যে আধুনিক মানব তারা সবাই আফ্রিকা মহাদেশের একটি একক জনগোষ্ঠীর বংশধর (descendants) বা উত্তর পুরুষ। সেই জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ প্রায় ৭০০০০ বছর আগে অভিবাসী (migrants) হয়ে এশিয়ায় প্রবেশ করে। তারপর সেখান থেকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।

সমস্ত আধুনিক আবিষ্কার ও প্রমাণ আমাদের, অর্থাৎ সমগ্র মানবজাতির, আফ্রিকান শেকড়ের ধারণাকে পোক্ত করছে।

দুটো উদাহরণঃ

ইথিওপিয়ায় ওমো কিবিশে খননে প্রাপ্ত দুই মানব করোটির অংশের ফসিল যার বয়স ১,৯৫,০০০, আর ২০১৭ সালে মরক্কোর সাফি শহরের কাছে জেবেল ইরহুদ গুহায় প্রাপ্ত করোটির ফসিল যার ডি এন এ বিশ্লেষণ বলছে বয়স ৩,০০,০০০ বছর। কীভাবে জেনোম সিকোয়েন্সিং (genome sequencing) পদ্ধতির মাধ্যমে দুই আপাত বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠীর মূল সম্পর্ক খুঁজে নিশ্চিত সিদ্ধান্তে পৌঁছনো হয়—তার বর্ণনা এই লেখার সীমার বাইরে। কিন্তু ফসিলের ডি এন এ বিশ্লেষণের উন্নত প্রযুক্তি আবিষ্কার আজ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে স্বতন্ত্র জনগোষ্ঠীর উদ্ভবের তত্ত্বকে পুরোপুরি বাতিল করে দিয়েছে।

৫.০ ভারতে বাইরে থেকে মানুষের আগমন কখন?

পুরাতত্ত্ববিদ বলবেন প্রায় ১,২০,০০০ বছর আগে। কিন্তু জনসংখ্যা নিয়ে কাজ করা জিনতত্ত্ববিদ বলবেন প্রায় ৬৫০০০ বছর আগে।

কে ভুল, কে ঠিক?

দুজনেই ঠিক।

পুরাতত্ত্ববিদ ভারতে মানুষের পদার্পণ বলতে সেই মানুষের কথা বলেন যাদের আগমনের পাথুরে প্রমাণ আছে, কিন্তু তারা এখানে বংশবৃদ্ধি করেছিল এমন প্রমাণ নেই।

আবার জিনতত্ত্ববিদ বলবেন শুধু সেই মানব গোষ্ঠীর কথা যারা এখানে এসে রয়ে গেল এবং বংশবৃদ্ধির জেনেটিক প্রমাণ রেখে গেল।

২০০৯ সালে হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুলের সঙ্গে যুক্ত বিশ্বের প্রায় ৯০ জন ইতিহাস, পুরাতত্ত্ব এবং জিনতত্ত্বের পণ্ডিতেরা মিলে নেচার পত্রিকায় একটি রিসার্চ পেপার প্রকাশ করলেন –বিষয় ভারতের জনগোষ্ঠী নিয়ে নতুন ভাবনা।

২০১০ সালে জানা গেল আধুনিক মানব ও নিয়েন্ডারথালদের মধ্যে প্রজননের কাহিনী এবং ২০১৪ সালে সামনে এল ডেনিসোভান এবং আমাদের পূর্ব পুরুষদের মধ্যে আন্তরিক সম্পর্কের কথা।

তারপর ২০১৭ সালে যুক্তরাজ্যের অধ্যাপক মার্টিন বি রিচার্ডস এবং তাঁর সহযোগীদের রিসার্চ পেপার বেরোল। বিষয় ভারতীয় উপমহাদেশে জনগোষ্ঠীর ছড়িয়ে পড়ার ক্রমাবলোকনের ইতিহাস।

৬.০

ভারতে আর্যদের আগমন নিয়ে দুই বিরোধী তত্ত্বঃ আজকে কী অবস্থা

আজকে হরপ্পার পরে আর্যদের আগমনকে অস্বীকার করতে গিয়ে নতুন কথা বলা হচ্ছেঃ

এক, বিগত ৪০,০০০ বছরে ভারতে বাইরে থেকে কোন অনুপ্রবেশ ঘটেনি।

দুই, আসলে আমাদের দেশে মূলতঃ দুটি আদি জনগোষ্ঠী প্রাচীন কাল থেকেই রয়েছে। তাদের টেকনিক্যাল নাম দেয়া হয়েছে—উত্তর ভারতীয় পূর্বপুরুষ ( Ancestral North Indian or ANI) এবং দক্ষিণ ভারতীয় পূর্বপুরুষ (Ancestral South Indian or ASI)। এদের মধ্যে মেলামেশা থেকেই আমাদের ভারতীয় জনগোষ্ঠী। আর্যদের মধ্যপ্রাচ্য থেকে আগমনের তত্ত্ব ভুল।

মজার ব্যাপার, এই তত্ত্বের দুই প্রবক্তা, ভারতের দুই উচ্চপদে আসীন অধ্যাপক, ২০০৯ সালের নেচার পত্রিকায় হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুলের সৌজন্যে প্রকাশিত গবেষক দলের অংশ এবং স্বাক্ষরকারী। সেখানে তাঁরা এসব না বলে উলটো কথাই বলেছিলেন।

কী বলা হয়েছে নেচার পত্রিকায় প্রকাশিত পেপারে?

ওই পেপারে স্পষ্ট বলা হয়েছে যে দক্ষিণ ভারতে (ASI) নয়, উত্তর ভারতের জনগোষ্ঠী (ANI) ডি এন এ’র বিচারে পশ্চিম এশিয়া, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য এবং ককেশাস অঞ্চল থেকে আগত অভিবাসীদের মিশ্রণজাত। অর্থাৎ এই গবেষণা আর্য আগমনের তত্ত্বে শীলমোহর লাগিয়েছে।

এ বিষয়ে জুন ২০১৭ সালে দি হিন্দু পত্রিকায় প্রকাশিত টনি জোসেফের প্রবন্ধ --‘আর্য আগমন’ তত্ত্বের পুরো বিতর্কের উপর কী ভাবে জিনতত্ত্বের প্রমাণ দিয়ে যবনিকা পতন হোল-- তার চমৎকার সারসংক্ষেপ। এই সিদ্ধান্তের আরও পোক্ত প্রমাণ হিসেবে ২০১৮ সালে বিশ্বের ৯২জন বৈজ্ঞানিকের সম্মিলিত রিসার্চের পেপার প্রকাশিত হোল। তার অন্তিম এবং পরিমার্জিত রূপ সেপ্টেম্বর ২০১৯ সালে সায়েন্স পত্রিকায় বেরোল। এতে প্রাচীন ফসিলের ডি এন এ বিশ্লেষণের ভিত্তিতে মধ্যপ্রাচ্যের স্তেপ অঞ্চল থেকে দক্ষিণ এশিয়ায় আগমনের মজবুত প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। যার ফলে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার ছড়িয়ে পড়ার ব্যাপারটা বোঝা গেল।

রাখীগড়ি খননের তাৎপর্য

হরপ্পা সভ্যতার অন্যতম খনন স্থল রাখীগড়িতে একটি ৪৬০০ বছরের পুরনো মহিলার করোটি পাওয়া গেছে। সেটা নিয়ে ওই একই তারিখে (১৬/৯/২০১৯) ‘Cell’ পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হল। দুই পেপারের অধিকাংশ লেখক এক। কাজেই স্বাভাবিক যে ওঁদের নিষ্কর্ষ একই হবে।

তাতে বলা হোল হরপ্পা অঞ্চলের প্রাপ্ত ওই মহিলার ফসিলের জিন বিশ্লেষণে স্তেপের পশুপালক জনগোষ্ঠী এবং ইরাণীয় কৃষক জনগোষ্ঠীর কোন সম্পর্ক পাওয়া যায় নি।

ব্যস, আর্য আগমন তত্ত্বের বিরোধীরা বললেন—এই তো পেয়েছি! ভারতে স্বয়ম্ভু মানব অস্তিত্বের প্রমাণ! অনেক পত্রপত্রিকা হেডলাইন করল—রাখীগড়ি খনন আর্য আগমনের তত্ত্বকে খারিজ করেছে!

আসলে না বুঝে প্রেক্ষিত বাদ দিয়ে একটা লাইন চেরি পিকিং করলে যা হয়!

পেপারের বক্তব্য এ নয় যে রাখীগড়ী মহিলার ইরাণের জনগোষ্ঠীর সঙ্গে কোন সম্পর্ক ছিল না। বরং এটি ইরাণের ‘কৃষক’ জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। অর্থাৎ এটি এত প্রাচীন যে তখন ইরাণে বা হরপ্পায় কৃষি শুরু হয় নি। এর জেনোম ইরাণ থেকে আগত শিকারী ও খাদ্য সংগ্রাহক গোষ্ঠীর।

ওই পেপারেই পরে স্পষ্ট বলা হয়েছে প্রাচীন কালের ডি এন এ অধ্যয়নের ফলে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর পূর্ব ইউরোপ থেকে মধ্যপ্রাচ্য হয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় সহস্রাব্দের প্রথম ভাগে ছড়িয়ে পড়ার বিস্তারিত খুঁটিনাটির দস্তাবেজ তৈরি সম্ভব হয়েছে।

উত্তর প্রদেশের সিনৌলিতে রথের ভগ্ন অংশ!

দিল্লির কাছে বাগপত জেলার সিনৌলির এক প্রাচীন সমাধিস্থলে তিনটে ভাঙা গাড়ি, সম্ভবতঃ ১৯০০ বি সি ই (before common era) পাওয়া গেছে। কেউ বলছেন ওগুলো আসলে রথের চাকা। স্তেপ মাইগ্রেশনের সময়কাল হল ২০০০ থেকে ১৫০০ বি সি ই। কাজেই এটা মনে হয় ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার লোকজনের প্রথম দলের আগমন চিহ্ন।

কিন্তু ডিসকভারি প্লাস চ্যানেলে ২০২১ সালের গোড়ায় একটি ডকুমেন্টারি ফিল্ম দেখানো হোল—Secrets of Sinauli. তাতে দাবি করা হোল ভারত সরকারের পুরাতাত্ত্বিক বিভাগ সেই মৃতদের কবর দেয়ার প্রাচীন স্থল থেকে একটি কংকালের ডি এন এ রিপোর্ট পেয়েছে। তাতে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের জেনেটিক সম্পর্কের কোন প্রমাণ পাওয়া যায় নি।

কিন্তু ওই ডকুমেন্টারি দেখানোর সময় থেকে আজ অব্দি এমন কোন ডি এন এ রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসে নি!

উপসংহার

ইহুদী, ক্রিশ্চান, আরব সবাই দাবি করে যে তারাই নাকি ঈশ্বরের ‘বেছে নেয়া’ (chosen) জনগোষ্ঠী। এটা বোঝা মুশকিল যে পরম করুণাময় ঈশ্বর কেন তাঁর সন্তানদের প্রতি পক্ষপাত করবেন! তবে এই বিশ্বাস লক্ষ লক্ষ নিরীহ ইহুদীদের হিটলারের গ্যাস চেম্বার থেকে বাঁচাতে পারে নি। জার্মানি-ফ্রান্স-পোল্যান্ডের অধিবাসীদের বিশ্বযুদ্ধের আগুন থেকে রক্ষা করে নি। আজ গাজা ও প্যালেস্তাইনের আরবদেরও গণহত্যা থেকে বাঁচাতে পারছে না।

এখন আমরা ভারতবাসীরা নাকি সেই ঈশ্বরের বিশেষ পছন্দের লোক। তাই আমরা স্বয়ম্ভু, আমাদের দেশে কোন বিদেশীর অনুপ্রবেশ হতে পারে না। আমাদের ভাষা দেবভাষা। তাই ইতিহাস চর্চার সমস্ত মান্য পদ্ধতিকে এক ফুঁয়ে উড়িয়ে দিয়ে আমরা রক্তের বিশুদ্ধতার দাবি করি। তাই গোঁজামিল অবশ্যম্ভাবী।

কিন্তু সাভারকর তাঁর ‘হিন্দুত্ব’ বইয়ের শেষভাগে এটা কী বললেন?

“আসলে সমগ্র বিশ্বে একটিই জাতি—মানব জাতি। একই শোণিত বহমান –মানব রক্ত। বাকি সব রক্তের বন্ধন কাজ চালানোর জন্যে--provisional, a make shift and only relatively true. Nature is constantly trying to overthrow the artificial barriers between race and race. To try to prevent the co-mingling of blood is to build on sand. Sexual attraction has proved more powerful than all the commands of all the prophets put together”

প্রবন্ধ - ইন্দ্রনীল মজুমদার









সে বহুকাল আগের কথা।‌ একজন পর্তুগীজ এই বাংলাকে ভালোবেসে হয়ে উঠেছিলেন বাংলারই এক বিখ্যাত কবিয়াল। কবিয়ালরা কবিগান পরিবেশনা করে থাকে। কবিগান হল বাংলা লোকসঙ্গীতের একটি বিশেষ ধারা যেখানে গায়ককে কবি হতে হয়। সেই গায়ককে মুখে মুখে পদ রচনা করে তাৎক্ষণিকভাবে সুরারোপ করে গেয়ে থাকতে হয়। কবিগানের লোককবিরা প্রতিযোগিতামূলক গানের আসরে অংশগ্রহণ করে থাকেন। এক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয় মূলত কবিগানের একাধিক দলের মধ্যে এবং এই প্রতিযোগিতার নাম হল 'বাদাবাদি'। এই বাদাবাদির নিয়ম হল একদল গান গেয়ে প্রশ্ন করবে যাকে বলা হয় 'চাপান'। আর সেই প্রশ্নমূলক গান শেষ হলে অপর দলটি সেই গানের জবাব গান গাইবে যাকে বলা হয় 'উতোর' (যা চাপানো প্রশ্নের উত্তরই বটে)। প্রতিযোগীতার শেষ পর্যন্ত গানের এই প্রশ্নোত্তরের টক্করে যে দল সবচেয়ে ভালো হিসেবে বিবেচিত হবে সেই দলই জয়লাভ করবে। তা এরকম কবিগানের এক বাদাবাদিতে বাংলার আরেক বিখ্যাত কবিয়াল রাম বসু সেই পর্তুগীজ কবিয়ালের প্রতি চাপান—

“সাহেব! মিথ্যে তুই কৃষ্ণপদে মাথা মুড়ালি

ও তোর পাদরি সাহেব শুনতে পেলে গালে দেবে চূণ কালি।”


এবার সেই পর্তুগীজ সাহেব, যিনি ধর্মে খ্রিস্টান ছিলেন, যা উতোর দেন সেটি হয়ে ওঠে বাংলার তথা দেশের সম্প্রীতির এক সুন্দর অমর বার্তা। তিনি উতোর দেন—

“খৃষ্ট আর কৃষ্টে কিছু ভিন্ন নাইরে ভাই।

শুধু নামের ফেরে মানুষ ফেরে এও কোথা শুনি নাই।।

আমার খোদা যে হিন্দুর হরি সে

ঐ দেখ শ্যাম দাঁড়িয়ে আছে

আমার মানব জনম সফল হবে যদি ঐ রাঙ্গা চরণ পাই।”


সত্যি তো, খৃষ্ট আর কৃষ্টে কিছু ভিন্ন বা তফাৎ তো নেই। মিছে ভেদাভেদ তো মানুষেই করে থাকে। আর কেই বা এই সম্প্রীতির সাধক? তিনি হলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর সেই বিখ্যাত কবিয়াল অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি (অনেকে অবশ্য লেখেন এন্টনি ফিরিঙ্গি)। ওঁর প্রকৃত নাম ছিল হেন্সম্যান অ্যান্টনি (Hensman Anthony)। তখনকার দিনে সাধারণত পর্তুগীজ সহ ইউরোপীয়দেরও 'ফিরিঙ্গি' বলা ডাকা হত। তাই, হেন্সম্যান অ্যান্টনি হয়ে উঠেছিলেন তাঁর গাওয়া অসাধারণ কবিগানের জন্য আমাদের প্রিয় 'অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি' হিসেবে। ১৭৮৬ সালে পর্তুগালে তাঁর জন্ম হয়।


আমরা জানি যে ইংরেজরা আসার বহু যুগ আগে এখানে পর্তুগীজরা এসেছিল ব্যবসার খাতিরে। আমরা খ্রীস্টানদের উপাসনালয় 'চার্চ'-কে বাংলায় বলি 'গীর্জা'। এই গীর্জা কথাটা এসেছে পর্তুগীজ শব্দ 'ইগরেজা' থেকে। পর্তুগীজরা চার্চকে ইগরেজা বলে। সেখান থেকে অপভ্রংশ হয়ে গীর্জা শব্দটি এসেছে। তাঁর পিতা ছিলেন একজন পর্তুগীজ ব্যবসায়ী যিনি ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে কলকাতার কাছে হুগলীর চন্দননগরের ফরাসডাঙায় থাকতে শুরু করেন। তখন চন্দননগর ফরাসি বা ফ্রেঞ্চদের দখলে ছিল। তাই তো নাম ফরাসডাঙা। সে যাই হোক, অ্যান্টনি অল্পবয়স থেকেই কবিগানের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে কবিগান গাইতে শুরু করেছিলেন। আজ কবিগান বিলুপ্তপ্রায় সংস্কৃতি হলেও তাঁর আমলে কলকাতা ও তার আশেপাশে কবিয়ালদের বেশ প্রভাব ও খ্যাতি ছিল বলে জানা যায়। বিখ্যাত কবিয়ালরা যেমন হরু ঠাকুর, ভোলা ময়রা, দাশরথি রায়, রাম বসু প্রমুখ ছিলেন তাঁর সমসাময়িক। অ্যান্টনি অনেক কবিয়ালের সাথে বাদাবাদিতে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ভোলা ময়রা, রাম বসু, ঠাকুর সিংহ প্রমুখ কবিয়ালেরা তাঁর প্রতিপক্ষ ছিলেন। তাঁর গানের বাঁধনদার বা গান-রচয়িতা ছিলেন একজন বাঙালি যাঁর নাম গোরক্ষনাথ। এই গোরক্ষনাথের কোনো কবিগানের দল ছিল না। তিনি প্রধানত অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি সাহেবের দলে গান বেঁধে দিতেন। একবার দুর্গা পুজোর সময় চুঁচুড়ার কোনো এক বিশিষ্ট ব্যক্তির বাড়িতে অ্যান্টনি সাহেবের কবি গানের আয়োজন হয়। তখন অ্যান্টনির থেকে গোরক্ষনাথের অনেক বেতন পাওনা ছিল। গোরক্ষনাথ অ্যান্টনিকে বলেন যে, তাঁর সমস্ত বেতন পরিশোধ করে না দিলে তিনি আর নতুন আগমনি গান বেঁধে দেবেন না। এ কথা শুনে অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি খুব রেগে যান। গোরক্ষনাথ ছাড়াই তিনি নিজে আগমনি গান রচনা করে সে আসর রক্ষা করেন। এর পরে তিনি তাঁর পারদর্শীতায় নিজেই গান বাঁধতেন‌ বা রচনা করতেন।


অ্যান্টনি ফিরিঙ্গির একটি বিখ্যাত বা জনপ্রিয় গান যা তিনি চাপান হিসেবে ব্যবহার করেন তা হল—

“আমি সাধন ভজন জানি নে মা জাতিতে ফিরিঙ্গি।

দয়া করে তরাও মোরে হে শিবে মাতঙ্গী।।” অনেক জায়গায় এই গানটি অবশ্য এইভাবে আছে—

“আমি ভজন সাধন জানিনে মা, নিজে ত ফিরিঙ্গি।

যদি দয়া করে কৃপা কর, হে শিবে মাতঙ্গী।”


এই গানে তাঁর হিন্দুধর্মের প্রতি বিশ্বাসের প্রতিফলন ঘটেছে। কিন্তু সেযুগের গোঁড়া হিন্দুরা একজন ফিরিঙ্গির হিন্দু ধর্মের প্রতি বিশ্বাসকে মেনে নেয়নি। কেননা, এই চাপানের উতোর বিখ্যাত কবিয়াল ভোলা ময়রা দেন এভাবে—

“আমি পারব নারে তরাতে, আমি পারব নারে তরাতে

যীশু খৃষ্ট ভজগে তুই শ্রীরামপুরের গীর্জাতে।”

তাঁর মতো একজন ইউরোপীয়র এই উদারতা ও হিন্দু ধর্মের প্রতি প্রেম, ভালোবাসা ও বিশ্বাস সে যুগের অনেকেই হয়তো বাঁকা চোখে দেখেছেন। তাঁর "জয় যোগেন্দ্রজায়া মহামায়া মহিমা অসীম তোমার" আগমনী পর্যায়ের গানেও তিনি হিন্দুধর্মের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা দেখিয়েছিলেন। তিনি সৌদামিনি (অনেকের মতে প্রমীলাদেবী) নামে এক হিন্দু বিধবা বাঙালি ব্রাহ্মণ-কন্যাকে সতীদাহ হওয়ার থেকে উদ্ধার করে বিবাহ করেছিলেন। যা সেযুগের এক বিস্ময়কর ঘটনা। বলতে গেলে তখন বিধবা বিবাহের তেমন প্রচলনই ছিল না। তার ওপর তখনকার জঘন্য প্রথা সতীদাহ থেকে এক অসহায় বৃদ্ধাকে উদ্ধার করে তাঁকে বিবাহ করা— সত্যি এক অসম সাহস ও মানবিকতার পরিচয়। অনেকের মতে কলকাতার বহুবাজার (জনশ্রুতিতে বৌবাজার) এলাকায় তিনি একটি কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যা 'ফিরিঙ্গি কালীবাড়ি' হিসেবে পরিচিত। এই মন্দির প্রতিষ্ঠার ফলে হিন্দুধর্মের প্রতি তাঁর ভালোবাসা, অনুরাগ ও বিশ্বাস আরও ভালোভাবে প্রকাশ পায়। আবার অনেকের মতে বিপিন বিহারী গাঙ্গুলি স্ট্রিটে অবস্থিত এই মন্দিরটি পাঁচশো বছরের পুরনো আর অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি এই মন্দিরে আসতেন বলে কালীমূর্তিটি 'ফিরিঙ্গি কালী' আর মন্দিরটি 'ফিরিঙ্গি কালীবাড়ি' নামে পরিচিত হয়। অনেকের মতে উক্ত মন্দিরের দেখাশোনা করতেন প্রমীলাদেবী নামক একজন বিধবা নারী। কবিয়াল অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি হিন্দুধর্মের প্রতি অনুরাগের ফলে এই মন্দিরে যাতায়াত করতেন এবং প্রমীলাদেবীর সঙ্গে তিনি প্রণয়ে আবদ্ধ হন।


অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে (১২৪৩ বঙ্গাব্দে)-র অক্টোবর মাসে ৫০ বছর বয়সে মারা যান। তিনি জন্মসূত্র ইউরোপীয় হয়েও বাংলা ভাষা সুন্দরভাবে আয়ত্ত করে বাংলাতেই কবিগান রচনা করতেন। তিনি বাঙালির সমাজ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে যে জ্ঞান অর্জন করেছিলেন তা সেযুগে কোনো বিদেশীর ক্ষেত্রে খুবই বিরল ছিল। এদেশকে ও এদেশের সাংস্কৃতিক জগতকে অকৃত্রিম ভালোবাসার বন্ধনীতে বেঁধেছিলেন। তিনি ভালোবেসে কবিগান গাইতেন। তাঁর গান জাতি, ধর্ম ও বর্ণের ঊর্ধ্বে উঠে মানুষ ও মানবতার কথা মেলে ধরেছিল। তাঁর পরে অনেক বিদেশী ও বিদেশিনী আমাদের এই বঙ্গদেশে এসে এখানকার সংস্কৃতিকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করে গেছেন ঠিকই কিন্তু প্রথম ইউরোপীয় বাংলা ভাষার কবিয়াল হিসেবে অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি এই বাংলায় অমর হয়ে রয়েছেন। তাঁর জীবন নিয়ে চলচ্চিত্র বা ফিল্মও নির্মাণ করা হয়েছে। ১৯৬৭ সালে তাঁর জীবন নিয়ে নির্মিত 'অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি' মুক্তি পায়। যেখানে তাঁর ভূমিকায় অভিনয় করেন মহানায়ক উত্তম কুমার। আর এই সিনেমায় কবিয়াল ভোলা ময়রার সাথে অ্যান্টনি ফিরিঙ্গির কবিগানের লড়াই দেখানো হয়েছিল। এর বহু বছর পর, ২০১৪ সালে বিখ্যাত পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায় মুক্তি পায় তাঁর জীবন ও বর্তমান প্রজন্মে তাঁর পুনর্জন্ম মিলিয়ে একটি চলচ্চিত্র যার নাম 'জাতিস্মর'। এখানে তাঁর চরিত্রে অভিনয় করেন বাংলার বিখ্যাত সুপারস্টার প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়।


আজ যখন কিছু খ্রিস্টান মিশনারিদের বিরুদ্ধে আদিবাসী, গ্রাম্য মানুষদের অন্যায়ভাবে খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত করার অভিযোগ ওঠে এবং তাদের বিরুদ্ধে হিন্দু ধর্ম ও তার দেবদেবীদেরকে অপমান করার অভিযোগও ওঠে আবার অন্যদিকে গোঁড়া হিন্দুত্ববাদীদের চার্চ আক্রমণ করার ও খ্রিস্টান ধর্ম এবং যীশুকে অপমান করার নজির দেখা যায় তখন অ্যান্টনি ফিরিঙ্গির কথা বড়োই মনে পড়ে। ডিসেম্বর পবিত্র উৎসব ক্রিসমাসের মাস। সর্ব ধর্ম নির্বিশেষে বাঙালির কাছে এ যেন এক আনন্দোৎসব। তাই, এই প্রিয় উৎসবের মাঝে, সান্তা ক্লজের গিফ্ট ও কেক খাওয়ার মাঝে দুই ধর্মের গোঁড়া ধার্মিকেরা ভেদাভেদের বিষাদ সুর বাজায় তখন অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি সাহেবের কবিগান "খৃষ্ট আর কৃষ্টে কিছু ভিন্ন নাইরে ভাই" সেই বিষাদকে সরিয়ে দিয়ে আবার আনন্দে চারপাশ ভরিয়ে দেয়। সত্যি তো, দুই ধর্মের গোঁড়া ধার্মিকেরা তফাৎ করলেও কৃষ্ণে আর খৃষ্টে কোনও তফাৎ নেই। দুজনেই দয়া, ক্ষমা, ভালোবাসা, ন্যায়, স্নেহ-মমতা, প্রকৃত মনুষ্যত্বের প্রতীক।


তথ্যসূত্রঃ–

সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান (প্রথম খণ্ড), সাহিত্য সংসদ,
উইকিপিডিয়া,
বাংলাপিডিয়া,
মিলন সাগর ওয়েবসাইট।

প্রবন্ধ - অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়





















শতবর্ষে স্মরণ


হিন্দি চলচ্চিত্র জগতে “রাজপুত্তুর” নামে সুপরিচিত ছিলেন প্রদীপ কুমার। সৌন্দর্য তো ছিলই কিন্তু এই তকমাটি জুটেছিল ‘আনারকলি’ ছবিতে রাজপুত্র সলিম বা জাহাঙ্গীরের ভূমিকায় অভিনয় করে। সেটা ছিল ১৯৫৩ সালে তৈরি ভারতীয় ঐতিহাসিক নাট্য চলচ্চিত্র। পরিচালক ছিলেন নন্দলাল যশবন্তলাল। নাসির হুসেন ও হামিদ বাট যৌথভাবে চিত্রনাট্য রচনা করেছিলেন মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের ঐতিহাসিক কিংবদন্তীর উপর ভিত্তি করে। কিংবদন্তি অনুসারে, আনারকলি নামে এক সাধারণ রাজনর্তকী মেয়ে আনারকলির প্রতি জাহাঙ্গীরের ভালবাসা পিতা আকবর মেনে নিতে না পারায় জাহাঙ্গীর আকবরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন। আনারকলির ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন বীণা রাই। সি, রামচন্দ্র ও বসন্ত প্রকাশের সঙ্গীত এই ছায়াছবিটির সাফল্যের অন্যতম কাণ্ডারি। সেই সাথে লতা মঙ্গেশকরের গান “ইয়ে জিন্দেগি উসি কী হ্যায়” আরও স্মরণীয় করে তুলেছিল। মনে পড়ে উজবেকিস্তানে খিভায় এক রাতে খাটিয়ায় বসা এক বৃদ্ধ হোটেল মালিকের মোবাইলে বাজছিল এই ছবির লতার কন্ঠে বীণা রাইয়ের মুখে গান “দুয়া কর গম-এ-দিল”। প্রচণ্ড বাণিজ্যিক সাফল্য পায় এই ছবিটি এবং সেই বছর সর্বোচ্চ আয় করে (২৩৫ লক্ষ টাকা)। একই বিষয় নিয়ে পরে ১৯৬০ সালে তৈরি হয় ‘মুঘল-ই-আজম’ যদিও গল্প বলা হয়েছে আকবরের দৃষ্টিকোণ থেকে। দিলীপ কুমার অভিনীত এই ছবি আরও বড় বাণিজ্যিক সাফল্যের মুখ দেখে।

অন্য অনেক চলচ্চিত্র অভিনেতার মত প্রদীপ কুমারও তাঁর জন্ম নাম নয়। ১৯২৫ সালের ৪ জানুয়ারি কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন শীতল বটব্যাল। স্কটিশ চার্চ কলেজ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শীতল ছিলেন অত্যন্ত পরিশীলিত, ভদ্র। প্রথম থেকেই গল্প বলা এবং অভিনয়ের প্রতি তাঁর ঝোঁক দেখা যায়। এরই প্রতিফলন মাত্র সতেরো বছর বয়সে তাঁর অভিনয় জগতে আসার মতো সাহসী সিদ্ধান্তে। গত শতকের তিরিশ ও চল্লিশের দশকে কলকাতার সাহিত্য মঞ্চনাট্য এবং নবীন বাংলা চলচ্চিত্র শিল্পের আবহে বেষ্টিত বাংলা সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠেছিলেন শীতল। এই তরুণের মধ্যে এমন এক সহজাত আকর্ষণ ও সম্ভ্রমবোধ ছিল যা চিত্র পরিচালকদের নজর কাড়ে। শীতল বটব্যাল হয়ে ওঠেন প্রদীপ কুমার। এ বছর তিনি শতবর্ষ পূর্ণ করলেন।

কিন্তু এই শীতল থেকে প্রদীপ কুমার হয়ে ওঠা শুধু নামের পরিবর্তন করে নয়, আবার পথও ছিল না সহজ। তার জন্য ছিল একাগ্রতা, অদম্য জেদ এবং কঠোর পরিশ্রম। তবে তিনি ভারতীয় চলচ্চিত্রে এমন একজন অভিনেতা হয়ে উঠলেন যার মধ্যে ছিল রাজকীয় গাম্ভীর্য, মর্যাদা বোধ এবং রোমান্টিক নায়কের উপযুক্ত মশলা। সে সময় মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারে অভিনয়কে পেশা হিসেবে বেছে নেওয়া অত সহজ ছিল না। কিন্তু তিনি শিক্ষা ও সংস্কৃতির নিবিড় সান্নিধ্যে এই পেশাতেই নিমগ্ন হলেন। তাঁর মধ্যে ছিল যথেষ্ট আত্মবিশ্বাস, দৃঢ় সংকল্প এবং সহজাত প্রতিভা।

বাংলা ছবিতে অভিনয়ের মধ্যে দিয়েই তাঁর আত্মপ্রকাশ। দেবকী বসু পরিচালিত বাংলা ছবি ‘অলকানন্দা’য় অভিনয়ের মধ্যে দিয়েই তাঁর চলচ্চিত্র জগতে যাত্রা শুরু। ছবিটি প্রকাশ পায় ভারতের স্বাধীনতার বছরে, অর্থাৎ ১৯৪৭ সালে। তরুণ এই অভিনেতাকে চিনতে ভুল করেন নি স্বনামধন্য পরিচালক দেবকী বসুর জহুরি চোখ। গুরুত্বপূর্ণ একটি চরিত্র দিয়ে অভিনেতার সম্ভাবনাকে শুধু স্বীকৃতিই দিলেন না, আগামী দিনের পথ প্রদর্শক হয়ে রইলেন। রূপোলি পর্দায় সম্ভাবনাময় অভিনেতা হিসেবে প্রদীপ কুমাররের নাম সুপ্রতিষ্ঠিত করে ‘৪২’ ছবিতে তাঁর দৃপ্ত অভিনয়। সেটা ১৯৫১ সাল। প্রথম দিকের এই অভিনয়ের কাজগুলো তাঁর অভিনয় জীবনকে গড়ে তোলার জন্য প্রভূত সহায়তা করেছে। তার সঙ্গে অভিনয় শৈলী পরিমার্জনেও বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। এই প্রাথমিক ভিতের উপর দাঁড়িয়ে তিনি পরবর্তিকালে হিন্দি ছবির নায়ক হিসেবে জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছতে সক্ষম হন।

এরই মধ্যে তিনি বোম্বের (এখনকার মুম্বাই) ফিল্মিস্তান স্টুডিয়ো থেকে ডাক পান এবং ‘আনন্দমঠ’ (১৯৫২) ছবির জীবনানন্দের মত একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রের জন্য নির্বাচিত হন। প্রদীপ কুমারের কর্মজীবনের গতিপথ বাঁক নেয় ক্রমোন্নতির দিকে। পরের বছর ‘আনারকলি’ প্রকাশের পর তিনি প্রথম জনপ্রিয়তার স্বাদ পেলেন। প্রেম এবং বিচ্ছেদ ও বিষন্নতার সংমিশ্রণে চমৎকার অভিনয়ে দর্শকের মন জয় করেন। সেই দশকের সবচেয়ে সফল প্রযোজনা। এরপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। এর পরের বছরেই ‘নাগিন’ (১৯৫৩) ছবিটি প্রকাশের সাথে সাথেই রাজপুত্তুর প্রদীপ কুমার পুরোদস্তুর রোমান্টিক অভিনয় করে সাড়া ফেল দেন। অভিনেত্রী নায়িকা বৈজয়ন্তীমালার সঙ্গে জুটি, অভিনয় আর সেই সাথে হেমন্তকুমারের পরিচালনায় ভুবনভোলানো সঙ্গীত দিয়ে আপামর ভারতীয়র মন জয় করা গান এই ছবিকে সাফল্যের মুখ দেখায় আর সেই সাথে রোমান্টিক প্রদীপ কুমারের জয়যাত্রা শুরু হল।

পঞ্চাশের দশক প্রদীপ কুমারের সিনেমা জগতে কর্মজীবনে স্বর্ণযুগ বলা যায়। সমসাময়িক নায়িকাদের সাথে জুটি বেঁধে একের পর এক হিট ছবি উপহার দেন। মধুবালার সঙ্গে আটটি ছবিতে কাজ করেছিলেন তিনি। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘রাজ হাত’ (১৯৫৬), ‘শিরিন ফারহাদ’ (১৯৫৬), ‘গেটওয়ে অব ইন্ডিয়া’ (১৯৫৭), ‘ইহুদি কি লড়কি’ (১৯৫৭), এবং ‘পাসপোর্ট’ (১৯৬১)। এগুলো সবই ছিল ব্লক ব্লাস্টার। ষাটের দশকে সাতটি অসামান্য ছবিতে তাঁর সঙ্গী ছিলেন মীনা কুমারি। এর মধ্যে ছিল ‘আদিল-ই-জাহাঙ্গীর’, ‘বন্ধন’, ‘চিত্রলেখা’, ‘বহু বেগম’ (১৯৬৭), ‘ভেগি রাত’, ‘নূরজাহান’। ‘ঘুঙ্ঘট’ (১৯৬০), ‘তাজমহল’ (১৯৬৩) এবং ‘আরতি’ (১৯৬২) শুধু উল্লেখযোগ্য নয় আবেগময়ও। নাটকীয় চরিত্রে অভিনয়ের ক্ষেত্রে প্রদীপ কুমারের দক্ষতা ছিল অতুলনীয়। মালা সিংহার সঙ্গে শেক্সপিয়রের হ্যামলেট নাটকের ছায়া অবলম্বনে নির্মিত ছবি ‘হ্যামলেট’ ছাড়াও আরও সাতটি ছবিতে অভিনয় করেছেন যেমন ‘বাদশা’, ‘ডিটেকটিভ’ (১৯৫৮), ‘ফ্যাশন’ (১৯৫৯), ‘এক শোলা’, ‘দুনিয়া না মানে’ এবং ‘মাটি মে সোনা’। তবে ষাটের দশকে বক্স অফিস সাফল্য তেমন আসেনি। ষাটের দশকের সায়রা বানু, সাধনা, ববিতা বা শর্মিলা ঠাকুরের সাথে কাজ করার সুযোগ না পেলেও আশা পারেখের সাথে ‘ঘুনঘাট’ এবং ‘মেরি সুরত তেরি আঁখে’, এবং ওয়াহিদা রহমনের সাথে ‘রাখি’ (১৯৬২) ছবিতে কাজ করেছিলেন। ১৯৬৯ সালে তিনি ‘সম্বন্ধ’ এবং ‘মেহবুব কি মেহেন্দি’ ছবিতে নায়ক না হলেও বিশেষ চরিত্রের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। সেই থেকে চরিত্রাভিনেতার ভূমিকায় সরে যেতে থাকেন এবং সেই হিসেবেও কৃতিত্বের ছাপ রাখেন।

প্রথম দিকের বাংলা ছবিতে উল্লেখযোগ্য অভিনয়ের ছাপ রেখেছেন নরেনের ভূমিকায় ‘স্বামী’, নিমাইয়ের চরিত্রে ‘বিষ্ণুপ্রিয়া’ ও ‘দশ্যু মোহন’ ছবিতে মোহনের ভূমিকায়। এগুলো সবই পঞ্চাশের দশকে। এছাড়াও ‘জেগে থাক’ (১৯৫৬), ‘দুর্গেশ নন্দিনী’, ‘ভারতের প্রবেশদ্বার’, ‘আমার মুখ তোমার চোখ’, ‘জীবন এবং মৃত্যু’ ছবির নামও উল্লেখ করা যায়। ১৯৬৭ সালে বাংলার মহানায়ক উত্তমকুমারের প্রযোজনায় এবং ওনার সহ অভিনেতা হিসেবে ‘গৃহদাহ’ ছবিতে প্রদীপ কুমারের অভিনয় প্রশংসার দাবি রাখে। এর ব্যতিরেকে অনেক ছবিতে চরিত্র অভিনয় করেছেন। ১৯৮৩ সালের ‘জানোয়ার’ ও ‘রাজিয়া সুলতান’ ছবিতে প্রশংসাসূচক অভিনয় করেন। একই বছর আটটি অস্কারপ্রাপ্ত হলিউড চিত্র পরিচালক রিচার্ড অ্যাটেনবরোর জীবনীমূলক ‘গান্ধী’ ছবিতে ভি কে কৃষন মেননের চরিত্রে প্রদীপ কুমারের অভিনয় হলিউডের তাঁর অভিষেক ঘটানোর পাশাপাশি অভিনেতাকে এনে দিয়েছিল আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। বাংলা ও হিন্দি ছাড়াও গুজরাটি ও পাঞ্জাবী ছবিতেও তিনি অভিনয় করেছেন।

রূপোলি পর্দায় অভিনীত তাঁর চরিত্রগুলোর মতোই তাঁর জীবনও ছিল জটিল ও নাটকীয়। জীবনের চিত্রনাট্যে সাফল্যর সাথে সাথে একাকীত্ব ও বিষন্নতাও যোগ হয়েছিল। এরকমই ছিল সমসাময়িক যুগের ছন্দ। দক্ষিণ কলকাতার রাসবিহারীর কাছে প্রতাপাদিত্য রোডে ছিল তাঁর বাড়ি। ছোটবেলায় কে যেন দেখিয়েছিল। কিন্তু তাঁকে কখনও দেখিনি। সে সময় তাঁর অভিনীত ছবিও দেখার সুযোগ হয় নি তবে পরে অনেক ছবিই দেখেছি। মিষ্টভাষী বলে পাড়ায় সুনাম ছিল। প্রদীপ কুমারের চার সন্তান, তার মধ্যে তিন কন্যা রিনা, মিনা ও বীণা এবং একমাত্র পুত্রের নাম দেবীপ্রসাদ। তাঁর সন্তানদের মধ্যে একমাত্র বীণাই, বিবাহসূত্রে বীণা বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিনয় জগতে এসেছিলেন। জনপ্রিয় ধারাবাহিক ‘উত্তরণ’ এবং আরও অনেক টেলিভিশন এবং সিনেমা প্রযোজনায় বহু চরিত্রে অভিনয় করে সুখ্যাতি অর্জন করেন।

তাঁর পারিবারিবারিক জীবন খুব সরল ও সহজ ছিল না যার ফলে সন্তানদের সঙ্গে দূরত্ব ক্রমেই বাড়তে থাকে যা তাঁকে বিশেষ মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে রাখে। পরবর্তিকালে অবশ্য কন্যা বীণার পুত্র সিদ্ধার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় সহকারী পরিচালকের কাজ করেন তাঁর দুটো ছবিতে, ‘হাউসফুল টু’ (২০১২) এবং ‘হিম্মতওয়ালা’ (২০১৩)। বজায় থাকে চলচ্চিত্র শিল্পের সাথে পরিবারের যোগসূত্র। তাঁর অন্যান্য দৌহিত্রদের মধ্যে একমাত্র তানিশার অভিনয় জগতের সাথে যুক্ত হওয়ার কথা জানা যায়।

চলচ্চিত্র থেকে প্রদীপ কুমারকে একসময় চিৎপুর রোডের যাত্রাপাড়ায় যাত্রা দলে অভিনয় করতে দেখা যায়। তাঁর নামেই যাত্রায় উপচে পড়া ভিড় ছিল দেখার মত। তবে খুব বেশি দিন যাত্রার সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারেন নি শারীরিক কারণে। তাঁর শেষ জীবন বেশ সঙ্কটের মধ্যেই কাটে। স্ত্রী আগেই মারা যাওয়ায় শেষ বয়সে চরম একাকীত্ব গ্রাস করেছিল তাঁকে। এক সময় তিনি স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে পক্ষাঘাতে কাবু হয়ে পড়েন। আরও কিছু অসুস্থতা ছিল সেই সাথে। সে সময় তিনি ছিলেন একেবারে একা, নিঃসঙ্গ তবে আত্মীয়স্বজনের বাইরে লোকজনের সাহায্য সহায়তা তিনি পেয়েছিলেন যার মধ্যে জনৈক এক ব্যবসায়ীর নাম শোনা যায়। আর্থিক সঙ্কটও ছিল তাঁর সঙ্গী।

ছিয়াত্তর বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে এক চলচ্চিত্রের অন্যতম প্রবাদপ্রতিম অসামান্য সুদর্শন অভিনেতা প্রদীপ কুমারের জীবনাবসান হয়। দিনটা ছিল ২৭ অক্টোবর ২০০১। প্রদীপ কুমারের অভিনয়কালে অভিনেতারা বেশিরভাগ ছবিতেই প্রায় এক ধরনের অভিনয় করার জন্য জনপ্রিয় হতেন। প্রদীপ কুমার সেই রাজকীয় গণ্ডি পেরিয়ে নিজেকে রোমান্টিক নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতেও সমর্থ হন। এই রোমান্টিসিজম চলচ্চিত্রে রাজা, রাজপুত্র এবং অভিজাত চরিত্রগুলোকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতো বড় পর্দায়। সেই ধারায় অভিনয় করে পরে অনেকে প্রসিদ্ধ হয়েছেন। সারা জীবনে ১২০ টারও বেশি ছবিতে অভিনয়ের স্বাক্ষর রেখে গেছেন।

১৯৯৯ সালে চলচ্চিত্রে সারা জীবন কাজ করার জন্য লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট “কলাকার পুরস্কার” দেওয়া হয় অভিনেতা প্রদীপ কুমারকে।

ব্যক্তিগত দুর্দশা থাকলেও প্রদীপ কুমার নিজের আত্মমর্যাদা, সম্ভ্রম এবং রাজপুত্তুরের মত রাজকীয় জীবনধারা থেকে বিচ্যুত হন নি। কখনও ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে শোনা যায় না বরং এড়িয়েই চলতেন। গণমাধ্যমকেও এড়িয়ে চলতেন। সেই সাথে চলচ্চিত্র জগতের সহানুভূতি। কর্মজীবনের মতোই ব্যক্তিজীবনের শেষ দিকে নিজের শর্তে বেঁচেছেন। একেবারে রাজপুত্তুরের মত।





প্রবন্ধ - দিলীপ মজুমদার











প্রাগৈতিহাসিক রোমিও জুলিয়েত ? ৬ হাজার বছর আগের প্রেমের দৃশ্য ? বিশ্বাস না হলে চলুন যাই উত্তর ইতালির মানতুয়া শহরের কাছে ভালদারো গ্রামে । দেখে আসি এক অবিশ্বাস্য দৃশ্য । মানতুয়ার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আছে । জগতের শ্রেষ্ঠ নাট্যকার উইলিয়াম শেক্সপীয়ার বিখ্যাত করে দিয়ে গেছেন সেই শহরকে । মানতুয়ার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ১৫৯০ সালে লেখা শেক্সপীয়ারের নাটকের পাত্র-পাত্রী রোমিও জুলিয়েতের নাম । নাটকের গল্পটা একটু মনে করুন । টাইবাল্টকে হত্যা করার জন্য শাস্তি দেওয়া হয় রোমিওকে । সে শাস্তি হল নির্বাসন । ভেরোনা থেকে পঁচিশ মাইল দূরে মানতুয়াতে পাঠিয়ে দেওয়া হয় রোমিওকে । পরিবারের সকলে জুলিয়েতকে মৃত ভেবে তাকে পারিবারিক সমাধিতে সমাধিস্থ করে । রোমিও ভৃত্যের কাছে খবর পায় যে জুলিয়েত মৃত । সে মানতুয়া থেকে ছুটে আসে ভেরোনায় । সংগ্রহ করে নেয় বিষ । জুলিয়েত ছাড়া জীবন তার বৃথা । সমাধিগৃহে দেখা হয়ে যায় প্যারিসের সঙ্গে । সে ছিল জুলিয়েতের পাণিপ্রার্থী । রোমিওর হাতে মারা যায় প্যারিস । জুলিয়েতকে চুম্বন করে রোমিও বলে :

Come , bitter conduct, come, unsavory guide !

Though desperate pilot, now at once run on

The dashing rocks thy seasick weary bark !

Here’s to my love –তারপর বিষপান করে রোমিও মারা যায় । আচ্ছন্নতা থেকে জেগে উঠে জুলিয়েত যখন দেখে তার রোমিও মৃত্যুবরণ করেছে , তখন রোমিওর ছুরি দিয়ে সে আত্মহত্যা করে । একই সমাধিতে শায়িত থাকে তারা ।

৬ হাজার বছর আগের প্রেমের দৃশ্য দেখতে হলে যেতে হবে ন্যাশনাল আর্কিওলজিক্যাল মিউজিয়াম অব মানতুয়ায় । ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাড়ি তৈরির জন্য মাটি খুঁড়তে গিয়ে ভালদারো গ্রামে পাওয়া যায় এক প্রাচীন কবরখানা । খবর যায় প্রত্নতাত্ত্বিকদের কাছে । মারিয়া মেনেত্তির নেতৃত্বে আসেন একদল প্রত্নতাত্ত্বিক । মাটি খুঁড়ে তাঁরা ৩০টি কবর আবিষ্কার করেন । ২৯টি কবরে ছিল এক একজনের কঙ্কাল । ব্যতিক্রম শুধু একটি কবর । সে কবরে পাওয়া গেল ২জনের কঙ্কাল ।

ব্যতিক্রমী সেই কবরে যে ২টি কঙ্কাল পাওয়া গেল , তাদের বিশেষত্ব আছে । পরীক্ষা করে দেখা গেল তাদের একজন নারী আর অন্যজন পুরুষ । পুরুষের বয়স আনুমানিক ২০ , নারীর বয়স ১৮ । উচ্চতা ৫ ফুট। পুরুষটি আছে বামদিকে , নারী ডানদিকে । পুরুষের গলার কাছে পাথরের তিরের অগ্রভাগ দেখা যায় । নারীটির উরুর কাছে পাথরের তরবারি, পেটের কাছে ছুরি । দু’জন দু’জনকে হাত ও পা দিয়ে আঁকড়ে আছে। এত বছর পরেও শিথিল হয় নি আলিঙ্গন । এ যেন ‘আমরা দু’জন ভাসিয়া এসেছি যুগল প্রেমের স্রোতে / আদিম কালের অনদি উৎস হতে’ ।

কঙ্কাল দুটি আবিষ্কৃত হবার পরে ২০০৭ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ লিখল : ‘প্রি হিস্টোরিক রোমিও জুলিয়েত ডিসকাভার্ড’ ; রসিকতা করে ‘ডেইলি মেল’ লিখল : ‘ এ যেন শেক্সপীয়ারের গল্পের চমৎকার প্রতিধ্বনি’ । প্রত্নতাত্ত্বিক মেনোত্তি একে ভালোবাসার স্মারক বলেই মনে করেন : ‘It was a very emotional discovery . From thousands of years ago we feel the strength of this love . Yes, we must call it love.’

প্রগৈতিহাসিক যুগের এই প্রেমিক-প্রেমিকার মৃত্যুর কারণ নিয়ে নানা মুনির নানা মত । কারও মতে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়ে মাটি চাপা পড়ে এদের মৃত্যু হয় । কেউ বলেন এদের হত্যা করে কবর দেওয়া হয়েছে । হত্যার কারণ সম্বন্ধে অবশ্য কোন প্রমাণ দেওয়া হয় নি । আবার কেউ বলেন প্রবল শীতের ফলে আলিঙ্গনাবদ্ধ অবস্থায় এদের মৃত্যু হয়েছে ।

পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য চার বছর কঙ্কাল দুটিকে গবেষণাগারে রাখা হয়েছিল । ২০১১ সালে তাদের স্থানান্তরিত করা হয় ন্যাশনাল আর্কিওলজিক্যাল মিউজিয়াম অব মানতুয়ায় । কিন্তু মানতুয়ার মানুষ এতে খুশি নন । প্রাগৈতিহাসিক এই যুগলের জন্য তাঁরা চান একটা নিজস্ব আবাস । এই কাজ করার জন্য তাঁরা গড়ে তুলেছেন একটা সংগঠন , যার নাম ‘অ্যাসোসিয়েশন অব লাভার্স’ । সংগঠনের সভাপতি সিলভিয়া বাগনোলি । নিজেদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ করার জন্য তাঁরা শুরু করে দিয়েছেন তহবিল সংগ্রহ ।

ধারাবাহিক - শৌনক দত্ত





















১৪. অ্যানি এরনো, যার লেখা নিজের স্মৃতিকেই অবিশ্বাসের মুখে দাঁড় করায়





প্রিয় বাসু,

গতকাল তোমার চিঠি পেয়েছি। বেনারস ভ্রমণ শেষ করে নিশ্চয় ফিরে গেছো। খুব ছোটবেলায় বেনারস গিয়েছিলাম বাবা মায়ের সাথে, সে স্মৃতি ফিকে হয়ে এসেছে। বেনারসও নিশ্চয় বদলে গেছে অনেক। কি অবাক কান্ড দেখো তুমি যখন রেলগাড়ির কামরায় বসে ভার্জিনিয়া উলফের আত্মহননের কথা লিখছো আমি তখন পড়ছি অ্যানি এরনোর দ্য ইয়ার্স। ষাটের দশকে, যখন অ্যানি এরনোর বয়স কুড়ি থেকে পঁচিশ, তখন ভার্জিনিয়া উলফ পড়ে পড়ে তার মধ্যে লেখালেখির তীব্র ইচ্ছা ঘনিয়ে উঠেছিল। কাছাকাছি সময়ে আঁদ্রে ব্রেটনের ‘ফার্স্ট ম্যানিফেস্টো অব সুররিয়ালিজম’ পড়ে জীবন এবং লেখালেখির ও জীবনযাপনের একটি পথরেখার সন্ধান পেয়েছিলেন। জারমেইন গ্রিয়ারের ‘দ্য ফিমেইল ইউনাক’ বইটি তার দার্শনিক চিন্তায় নারীর সামাজিক অবস্থানকে প্রবিষ্ট করে দিয়েছিল। ১৯৬৫-তে প্রকাশিত হয় জর্জ পেরেকের ‘ষাটের গল্প : বিষয় আশয়’। জর্জ পেরেকের রচনাকৌশল তাকে ভাবিয়েছিল। এই সবকিছু তাকে চেনা-পরিচিত জগৎকে নতুন করে উপলব্ধির দিকনির্দেশনা দিয়েছিল। ভার্জিনিয়া উলফের মতো তারও মনে হয়েছিল লিখতে হলে প্রথমে বর্ণনাতীত বাস্তবকে তীব্রভাবে অনুভব করে নিতে হবে। লেখালেখির লক্ষ্য হবে হৃদয়ের গভীরে অনুভূত বাস্তবকে সাহিত্যের নতুন কোনো ভাষায় উত্থাপন করা। তুমি অ্যানি এরনোর লেখা পড়েছো কিনা জানি না, আমি এর আগে এই লেখকের কিছুই পড়িনি, আর পড়িনি বলেই আফসোস হচ্ছে। মনে হচ্ছে কত কম জানি আমি! উনাকে যত পড়ছি আমি মুগ্ধ হচ্ছি। দ্য ইয়ার্স বইটি ফ্রান্সের অর্ধ-শতাব্দীর এবং পরিবর্তনের বিবরণ। এর সঙ্গে বিশ্বের উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলো যেমন বিটলস, ৯/১১, ইরাকের যুদ্ধ, ইত্যাদি বিষয়কে ফরাসী দৃষ্টিকোণ থেকে লেখক উপস্থাপন করেছেন। উত্তর-পশ্চিম ফ্রান্সের নরম্যান্ডির ছোট্ট শহর ইভতো-তে ১৯৪০ সালে জন্ম ও বেড়ে ওঠা অ্যানির। আধুনিক সাহিত্যে স্নাতকোত্তর হওয়ার পরে কিছু দিন স্কুল শিক্ষিকার কাজ করেন। তার পরে ১৯৭৭ সালে অধ্যাপিকা হিসেবে যোগ দেন ফ্রান্সের দূরশিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় ‘সিএনইডি’-তে। ২০০০ পর্যন্ত সেখানেই অধ্যাপনা করেছেন তিনি। লেখালিখি শুরু করেন যখন বয়স ত্রিশের কোঠায়। এক সাক্ষাৎকারে অ্যানি বলেছিলেন, ‘‘লেখক হয়ে ওঠার পথটা আদপেই সহজ ছিল না।’’ ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘লে আরমোয়ার ভিদ’। আদ্যন্ত আত্মজৈবনিক এই উপন্যাসটি প্রকাশিত হওয়ার পরেই তার ‘সাহসী’ কণ্ঠস্বরের জন্য সাড়া ফেলে দিয়েছিল। ‘দ্য ইয়ার্স’ গ্রন্থকে ফরাসি জীবনের স্মৃতিচারণার ‘মাস্টারপিস’ বলেন সাহিত্য সমালোচকেরা। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাময়িকী দ্য নিউইয়র্কার ২০২০ সালে লিখেছিল, অ্যানি এরনো তাঁর ২০টির বেশি বইয়ে শুধু একটি কাজ করেছেন: নিজের জীবনের খুঁটিনাটি তুলে আনা।

কয়েকমাস আগেই আমি অ্যানি এরনোর নাম শুনি, তখন থেকেই তাকে নিয়ে যেখানে যা পাচ্ছি তাই পড়ছি। তাঁর কাহিনি কখনও চলে ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণের পথ ধরে। কখনও সেই পথ থেকে দৌড়ে কিছুটা দূরে গিয়ে দাঁড়ান তিনি। ব্যক্তিগত স্মৃতিকেই দেখেন দূর থেকে। নিজের স্মৃতিকে নিজেই অবিশ্বাস করেন। নিজেকে নিজেই প্রশ্নের সামনে দাঁড় করান। ফরাসি ভাষার স্মৃতিচারণ মূলক সাহিত্য চর্চা তিনি করেন। তাই বার বার তাঁর সঙ্গে তুলনা চলে এসেছে প্রায় একই ঘরানার কিংবদন্তি সাহিত্যিক মার্সেল প্রুস্তের। তিনি কি প্রুস্ত দ্বারা অনুপ্রাণিত? যদিও অ্যানি বলেছেন, তাঁর উপর প্রুস্তের প্রভাব খুবই কম। বরং তাঁর উপর অনেক বেশি প্রভাব রয়েছে আমেরিকার সাহিত্যিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ের। খুব সচেতনভাবেই তিনি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন ফরাসি সাহিত্যের সব ধরনের বৈশিষ্ট্য। ভাষাটুকু বাদ দিয়ে তিনি নিজেই হয়ে ওঠার চেষ্টা করেছেন একেবারে স্বতন্ত্র এক ঘরানা। ফরাসি ‘মিঠে বোল’, মেদুরতা, রোম্যান্টিসিজমকে বুড়ো আঙুল দেখাতেই ভালো লেগেছে তাঁর। নিজ ভাষ্যেই তিনি হয়ে উঠেছেন কর্কশ, কঠিন, এবং অবিশ্বাসী। আর সেটিই তাঁকে তাঁর নিজের দেশ, নিজের ভৌগলিক সীমারেখা, নিজের জাতিসত্ত্বার থেকে অনেক দূরে নিয়ে গিয়ে ফেলেছে। আশ্চর্য় বিষয় কি জানো ২০০৮ সালে প্রকাশিত এই বইটিকে ইংরেজি অনুবাদক এলিসন স্ট্রেয়ার এরনোর অন্যান্য রচনাগুলির নিরিখে এক বিচ্যুতি বলেছেন। আপাতভাবে কথাটি যথার্থ। রচনার দৈর্ঘ্যে, বা বহু স্বরের ব্যবহারে এমনকী এর বিশাল ব্যাপ্তিতেও এই বই এরনোর অন্যান্য বইয়ের থেকে আলাদা। কিন্তু নিহিত বিচারে এই বইয়ের মধ্যেও লক্ষ্য করা যায় তাঁর লেখার সাধারণ চিহ্নগুলি। এই বইয়ের মতোই একের পর এক বইতে নিজের অতীতে ফিরে গিয়েছেন এরনো, এটি সম্পূর্ণ অনুভূতিহীন গল্প। লেখক কমই প্রকাশ করেছেন নিজকে। অথচ পুরোটাই ব্যক্তিগত গল্প। পরিবার, সন্তান, লেখকের বিয়ের সমাপ্তি এসেছে, কিন্তু আসেনি প্রেম। অ্যানির মায়ের আলঝেইমার এসেছে, বেড়ালের চোখের দিকে তাকানোর সঙ্গে খেয়াল করা এবং প্রাক্তন প্রেমিকা যখন একজন কম বয়সী সঙ্গীকে খুঁজে পায় - এসব নিয়ে তাঁর ঈর্ষার কথা, কিন্তু অন্যগুলো একেবারেই আবেগহীন। আর সেখান থেকে খনন করে এনেছেন নানান স্মৃতিচিহ্ন, যেগুলিকে জড়ো করে পুনর্নির্মাণ করেছেন একেকটা অধ্যায়। নিজেকে বুঝবার জন্য তো বটেই, একইসঙ্গে নিজেকে ভেঙেচুরে নিজের মাধ্যমে জীবনকে বুঝবার এক বিরামহীন প্রয়াসে ব্রতী হয়েছেন। ভাষাকে ছুরির মতো ব্যবহার করেন তিনি, যা কল্পনার পর্দা ছিঁড়ে ফেলবে। সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ বক্সী, ফেলুদা কিংবা হালের একেন বাবুর অপরাধ দৃশ্য পুনর্নির্মাণ করার মতো তাঁর লিখনপদ্ধতি। যেখানে কেউ সন্দেহের বাইরে নয়, নিজের স্মৃতিকেও বারংবার প্রশ্নচিহ্নের সামনে এনে দাঁড় করাচ্ছেন। সশরীরে ফিরে যাচ্ছেন স্মৃতিবিজড়িত জায়গাগুলিতে। কুড়িয়ে নিচ্ছেন কিছু বস্তুনিষ্ঠ সূত্র, কিছু ইঙ্গিত — কখনো নিজের ডায়েরির পাতা, কখনো কোনো সাদা কালো ছবি, কখনো কোনো বিজ্ঞাপনের সুর, কোনো গানের লাইন, কোনো বন্ধুর করা একটা আলগা মন্তব্য। স্মৃতির ফাঁকফোঁকর দিয়ে যাতে কোনোমতেই মিথ্যার অনুপ্রবেশ না ঘটে, তাই তাঁর এই নিরলস পরিশ্রম।

'ইন আ উওম্যানস্ স্টোরি'তে অ্যানি লেখেন, "আমি কেবল কুড়ুনি মাত্র"। তাই তাঁর লেখায় শুধু নিজের কথাই লেখেননি। সেখানে জড়ো হয়েছে তাঁর প্রজন্ম, তাঁর বাবা মায়ের প্রজন্ম এবং নানান শোষিতের কথকতা। এই বিশাল ব্যপ্তির স্তরে স্তরে গাঁথা যৌনতা ও অন্তরঙ্গতার থিম, সামাজিক বৈষম্য, যন্ত্রণা, লজ্জা— এই ইঁটেদের ফাঁকে ফাঁকে সময় আর স্মৃতির দ্বৈরথ। অথচ এমন থিমের বয়ান অত্যন্ত সাদামাটা গদ্যে। পাঠকের হাত ধরে সেই গদ্য করে তোলে নানান দ্বন্দ্বের মধ্যমণি। সে কারণেই এমন সরল গদ্য বেছে নেওয়া। অথচ এই সরলতার মধ্যেও এরনোঁর নিজস্ব বোধ কাজ করে ক্রমাগত। যে বোধ চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়, কোনও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। তা এক নির্দিষ্ট সমাজ-রাজনীতির অংশ। এই রাজনৈতিক বোধ অভিজ্ঞতাকে 'ব্যক্তিগত' বলে ঝেড়ে ফেলা যায় না। স্মৃতিও পিচ্ছিল। যার একদিক অস্বচ্ছ, অপরিষ্কার, সেদিকটা পক্ষপাতিত্বের ভার জমে জমে ক্রমশ ঝুঁকে গিয়েছে। কাজেই ভরসার অযোগ্য। তাতে ভরসা করলে আছাড় অনিবার্য। সেদিক থেকে তাঁর উক্তির সত্যটা খানিক খাটে বৈকি! কুড়ুনি হিসেবে তাঁর কাজ আদতে নৃতত্ত্ববিদের মতোই। খুঁড়ে খুঁড়ে ধ্বংসাবশেষ টুকু তোলা, ফসিল জমানো, সেই সব টুকরো জীবন তারপর এক তালে বাঁধার চেষ্টা। তাতে এই মহাকালের নিরিখে ব্যক্তির অবস্থান ফুটে ওঠে। যতটা ফোটানো যায় আর কী! তারই চেষ্টা মাত্র। অ্যানি এরনোকে যতটা পড়েছি আমার মনে হয়েছে শুধুমাত্র গল্প ও বিষয়বস্তু নয়, ফর্ম সম্পর্কে বেশি দৃষ্টি দিয়েছেন তিনি। তাঁর গদ্যশৈলীও এই কাজে তাঁর সহায়ক ও পরিপূরক। নির্মেদ, অনাড়ম্বর ঝরঝরে বাক্যগুলো যেন বিজ্ঞানের বস্তুনিষ্ঠা আর সাহিত্যের সত্যের মধ্যে এক আশ্চর্য্য মেলবন্ধন। তাঁকে পড়তে গিয়ে বারবার মনে হয় এই পাঠ ধ্রুব নয়। গতিহীন নয়। পড়ার প্রতিটি বাঁকে, প্রতিটি স্মৃতিচারণে, যতবার সে পাঠের দিকে নজর ফেরে পাঠ বদলে যেতে থাকে। অনবরত নিজের স্মৃতির প্রতি পাঠককে সন্দিগ্ধ করে তোলেন এরনো। নিজ অতীতের ময়নাতদন্তে লেখিকা খোদ পাঠকের ভিড়ে মিশে যান। থেকে থেকে উঠে আসে বিবিধ ধারাবিবরণী। নিজের সম্বন্ধে হোক বা দুনিয়ার, কোনো কিছুই লুকোচ্ছেন না এরনো। শরীরে আগত এই নতুন প্রাণটির প্রতি কোনো দয়ামায়া তার হয়নি, হয়নি অপত্যস্নেহের উন্মেষ। নিজের ডায়েরিতে নিজেকে ‘গর্ভবতী’ বলে উল্লেখ তো করেন নি, জরায়ুর অভ্যন্তরে থাকা প্রাণটিকেও শুধুমাত্র একটি বস্তু হিসেবে দেখেছেন, লিখেছেন ‘জিনিসটা’, ‘ওটা’। কলেজের এক পুরুষ সহপাঠী, সে তখন আন্দোলন করছে মেয়েদের নানা অধিকার নিয়ে, তাকে সবটা বলেছেন, কিন্তু সাহায্য পাওয়া তো দূরস্থান, বরং সেও সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করেছে। এরনো ক্ষোভ প্রকাশ করছেন না, বরং সহজভাবে লিখছেন, “আসলে, ঘটনাটা শুনে ওর মনে আমার সম্পর্কে ধারণাটা পাল্টে গিয়েছিলো, আমি তখন সেই ধরনের মেয়ে যে ‘হ্যাঁ’ বলবে, ‘না’ বলবে না। ছেলেরা তখন এই দুই ভাগেই মেয়েদের ভাগ করতো।” এইসব খোলামেলা স্বীকারোক্তির পাশাপাশি, তাঁর লেখায় অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে খুঁটিনাটি জিনিসের স্মৃতি। ঋতুস্রাবের রক্ত, একটা ছোপ লাগা অন্তর্বাস, একটা সরু লম্বা দণ্ড (যেটা যোনির মধ্যে ঢুকিয়ে গর্ভপাত করা হবে), একটা সাপ্তাহিক পত্রিকা, একটা ওষুধের শিশি — ছোট ছোট এই ছবিগুলি ছড়িয়েছিটিয়ে থাকে তাঁর লেখায়, অতীতকে জ্বলজ্যান্ত করে তোলে। মনে পড়ে যায় টি এস এলিয়টের নৈর্ব্যক্তিকতার তত্ত্ব — objective correlative : কবিতা হলো কবির ব্যক্তিগত আবেগ বা অনুভূতির প্রকাশ নয়, বরং আবেগ থেকে মুক্তি। এই তত্ত্ব অনুসারে, একজন কবিকে ঐতিহ্য ও ব্যক্তিগত প্রতিভার মধ্যে একটি ভারসাম্য রাখতে হয়, যেখানে কবি ঐতিহ্যকে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে অর্জন করেন এবং এর মাধ্যমে তিনি অতীত ও বর্তমানের মধ্যে একটি 'যুগপৎ ক্রম' তৈরি করেন। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কবি একটি 'নৈর্ব্যক্তিক' শৈল্পিক সত্তা তৈরি করেন, যা তাঁর ব্যক্তিগত অনুভূতিকে ছাপিয়ে যায়। কবি তাঁর ‘আমি’কে আনবেন না কাব্যে, তাঁর অনুভূতির, যন্ত্রণার বর্ণনা করবেন না; তিনি শুধু কিছু শব্দ, কিছু বস্তু, কিছু ছবি সাজিয়ে দেবেন, পাঠকের মনে দৃশ্যটি আপনিই ফুটে উঠবে, অনুভূতিগুলি জাগরুক হবে। নারীবাদীরা সঙ্গত কারণেই তাঁকে দলে টেনেছেন। তাঁর লেখায়, যাপনে, দৃষ্টিভঙ্গিতে বুভোয়ার, গ্রিয়ার, মিলেটদের ছাপ অনস্বীকার্য। কিন্তু কোলরিজ যেমনটা বলেছিলেন, প্রকৃত স্রষ্ঠার মন লিঙ্গভেদের ঊর্ধ্বে। এরনোর লেখায় তাই নারীজীবনের কথা মর্মে মর্মে অনুধাবন করতে পুরুষ পাঠকের সমস্যা হয় না। দেশকালের তফাতে অনেক ছোটখাটো রেফারেন্স হয়তো সবসময় ধরা যায় না, কিন্তু একটা জীবনের মধ্যে দিয়ে সময়ের বহমানতা, একজন ব্যক্তির মধ্যে দিয়ে সমাজের গতিপ্রকৃতি, আর সর্বোপরি একজনের স্মৃতির মধ্যে দিয়ে সর্বজনীন সত্যের প্রকাশ পাঠক সহজেই দেখতে পান। তাঁর অ্যাবর্শনের ট্রমা, খেটে খাওয়া পরিবারের মেয়ে হওয়ার লাঞ্ছনা, নিজেকে শিক্ষিত করার অবিরত চেষ্টা পুঙ্খানুপুঙ্খ ফুটে ওঠে কালের কাগজে। পুরুষশাসিত এই দুনিয়ায় নারীর স্বতন্ত্র অস্তিত্ব কতটুকু স্বীকৃত? হয় এক নিমেষে বাতিল করা, ছোট করা নয় নিজের আকাঙ্ক্ষার সামগ্রী হিসেবে আপন করা— এই দুই গত পুরুষের। এর বাইরে নারীকে একজন মানুষ হিসেবে কি আজও স্বীকৃতি দিয়েছেন পুরুষেরা? আত্মনির্ভরতার হিসেব নারীর এখনও বুঝে নেওয়া বাকি— এরনোর 'কুড়ুনিয়া' সাহিত্য আমাদের বারবার এই নগ্ন সত্যের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। প্রলেপের বিন্দুমাত্র চেষ্টা না করেই।

নিজের অতীতকে এতো শীতল, বস্তুনিষ্ঠ গদ্যে ফুটিয়ে তোলা, প্রায় আবেগহীন, বাহুল্যবর্জিতভাবে — এমন উদাহরণ বিশ্বসাহিত্যে বিরল বললেও অত্যুক্তি করা হবে না! আত্মজৈবনিক রচনায় তা আরোই অপ্রতুল। সর্বত্র নিজেকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানোর যুগে, আত্মপ্রেমে ও আত্মগরিমায় হাবুডুবু খাওয়ার, আর অহরহ সত্যের সাথে মিথ্যেকে গুলিয়ে ফেলার এই সময়ে এমন একটি নৈর্ব্যক্তিক, ঋজু ও সত্যনিষ্ঠ স্বর তাই বিশ্বের পাঠককূলের কাছে এক আলোকবর্তিকা হয়ে থাকবে, সন্দেহ নেই। ‘আমি’কে ছাপিয়ে যেতে পারা, নিজের অতীতকে এক নির্লিপ্ত দূরত্ব থেকে দেখতে ও দেখাতে পারা — এটাই বোধয় অ্যানি এরনোর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব, যা তাঁর আত্মকথাগুলিকে সাহিত্যপদবাচ্য করে তুলেছে, এনে দিয়েছে সাহিত্যের সর্বোচ্চ পুরস্কার।

অ্যানি এরনো আমাকে মোহগ্রস্থ করে ফেলেছে। তোমার ভ্রমণ কেমন হলো? বেনারস ছাড়া আর কোথায় কোথায় গেলে? সব কিছু জানার অপেক্ষায় রইলাম। আমার চিঠি তোমার হাতে যাবার আগেই হয়ত তোমার চিঠি পাবো, নিরন্তর ভালো থেকো। মাঝে মাঝে মনে হয় আমাদের গেছে যে দিন সে কি একেবারই গেছে, কিছুই কি নেই বাকি? অ্যানি এরনো পড়তে পড়তে নিজেকে কোথায় খুঁজে পাচ্ছিলাম। আচ্ছা আমাদের ব্রেকাপটা কেন হয়েছিল বলতে পারো? তোমার কি আমাকে দায়ী মনে হয়? অনেক প্রশ্ন ঘিরে ধরছে, ঘড়ির কাটা চার ছুঁই ছুঁই করছে, কাল অফিস আছে তাই আর লিখছিনা।


অন্তে ভালো হোক

সুস্মি

০১.১০.২০২৫

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত





















১৬

ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে আমেরিকান ভদ্রমহিলা যেখানে থাকেন, সেই গেস্ট হাউসে পৌঁছাতে গেলে মেট্রোতে যাতায়াত করবার প্রয়োজন নেই। ইংলিশ চার্চের কাছেই জায়গাটা, এভেন্যু জর্জ ফাইভের মত শান্ত এবং অভিজাত এলাকাতে। বের্নহার্ড সেখানে পৌঁছে কেয়ারটেকারকে ঘরের নাম্বারটা জানালো। তারপর কেয়ারটেকার ভদ্রমহিলাকে টেলিফোনে জানাল বের্নহার্ডের কথা এবং একজন কিশোর, চাপরাশিদের মত বাদামী রঙের পোশাক পরা, সে তাঁকে সঙ্গে করে নিয়ে গেল লিফটের দিকে। লিফট থেকে নেমে কিশোরটি মাথায় সোনালি পাড় বসানো টুপির প্রান্ত কেতাদুরস্ত ভঙ্গিতে ধরে নিঃশব্দে হেঁটে যেতে লাগল কার্পেট মোড়া এক লম্বা করিডোর ধরে। হাতে সঙ্গীতের ফাইলটি নিয়ে বের্নহার্ড ওই কিশোরকে অনুসরণ করল।

আমেরিকান ভদ্রমহিলার ঘরে গ্রামোফোন বেজে যাচ্ছে। তারা বেশ জোরে জোরে টোকা দিল দরজায়; তারপর মাথা নুইয়ে দরজায় কান পেতে শুনবার চেষ্টা করল যে ভিতর থেকে আর কোনও শব্দ আসে কি না। তৃতীয়বার টোকা দেবার পরেও যখন কোনও উত্তর এল না, তখন সেই কিশোর দ্বিধাগ্রস্তভাবে বের্নহার্ডের দিকে একবার তাকিয়ে দরজার হাতল চেপে ধরে জোরে জোরে দরজার পাল্লার নিচের দিকে ধাক্কা দিল। ভেতর থেকে কেউ চেঁচিয়ে উঠল, ‘কাম ইন, প্লিজ!’ কিশোর তখন দরজাটা পুরোপুরি খুলে ধরে একটুখানি বাও করে পিছিয়ে দাঁড়াল।

বের্নহার্ড ঘরের মাঝখানে একটু বিস্মিত এবং অপ্রস্তুত ভাবে দাঁড়িয়ে চারদিকে দেখতে লাগল।

ঘরের দেওয়ালগুলো সবুজ সিল্কে ঢাকা। উজ্জ্বল রঙের অনেকগুলো কুশন রাখা আছে একটা বড় ডিভানের উপর। গৃহসজ্জায় উজ্জ্বল রঙের ব্যবহারে বেশ আধুনিকতার ছাপ। ডিভানের পাশে একটা টেবিল। টেবিলের উপরে রাখা গ্রামোফোন থেকে বীভৎস শব্দের হুল্লোড় ভেসে আসছে। সেই শব্দগুলোর একটাও বের্নহার্ডের পক্ষে উচ্চারণ করা সম্ভব নয়।

একজন যুবতী উঠে দাঁড়াল, যে গ্রামোফোনের পাশে একটা সোফার উপরে এলিয়ে বসেছিল। হাসিমুখে বের্নহার্ডের দিকে তাকাল সে। বের্নহার্ডের মনে পড়ল যে সে শুনেছিল যে এই যুবতী জার্মান ভাষা বুঝতে পারে; “গুটেন আবেন্‌ড!”১ বলে একটু ঝুঁকে বাও করল সে।

‘ওঃ, কোনও ব্যাপার নয়!’ বলে উঠল ভদ্রমহিলা। হাসিতে ঝলমলে চোখমুখের মত তাঁর কণ্ঠস্বরটিও বেশ মানানসই ধরনের খুশি ঝলমলে। তারপর সে ঘুরে দাঁড়িয়ে বিলি বলে একজন যুবককে ডাকল। বিলিকে বের্নহার্ড প্রথমে খেয়াল করেনি। বিলি জার্মান বলতে পারে না; কিন্তু সে যথেষ্ট উষ্ণভাবে বের্নহার্ডের সঙ্গে করমর্দন করল। হাত মেলানোর সময়ে বের্নহার্ড বুঝতে পারল যে বিলির গায়ে বেশ জোর এবং বিলিকে দেখতেও খুব বলশালী। তাঁকে দেখে ফ্যাশন ম্যাগাজিনের বিশাল কাঁধ আর সরু নিতম্বের যুবক মডেলদের কথা মনে পড়ল বের্নহার্ডের। বিলির পরনে চওড়া ঢিলা ট্রাউজার, সোয়েটারের উপরে মোটা জ্যাকেট, হালফ্যাশানের পোশাক মডেলের মত চেহারায় বেশ মানিয়েছে।

কিন্তু বিলির সঙ্গে সত্যিই সেরকম কোনও ব্যাপার নেই। সবার আগে এই যুবতী ভদ্রমহিলা, বেটসির সঙ্গেই বের্নহার্ডের কাজ। বেটসি আগ্রহভরে বের্নহার্ডের হাত থেকে ফাইলটা নিয়ে নিল এবং অমায়িকভাবে জিজ্ঞাসা করল যে সে তার গা থেকে গরম কোটটা খুলে রাখতে চায় কি না।… ‘হি ইজ কোয়াইট আ চাইল্ড!’ তার সম্বন্ধে হয়তো বলল, তারপর আবার জিজ্ঞেস করল যে সে ইংরেজি বোঝে কি না।

বের্নহার্ড নিঃশব্দে মাথা নাড়ল ইতিবাচকভাবে। ভদ্রমহিলার সোফা ও গ্রামোফোনের উল্টোদিকে রাখা একটা বড় আরামকেদারাতে বসল সে। বেটসি তার সামনে সিগারেট, চকলেট, পোর্ট ওয়াইন, ছোট কেক এসব সাজিয়ে গুছিয়ে রেখে দিল। বেটসি যখন এগুলো গোছাচ্ছিল, তখন সে আরেকটু সামনে থেকে এই যুবতী ভদ্রমহিলাকে নিরীক্ষণ করবার সময় পেয়েছিল। বেটসির বয়স একেবারেই বেশি নয় এবং সে খুবই সুন্দরী। তাঁর দাতগুলো এত ঝকঝকে সাদা যে বের্নহার্ডের টুথপেস্টের বিজ্ঞাপনের কথা মনে পড়ল। বিলিকে দেখে অবশ্য সঙ্গে সঙ্গেই তার ফ্যাশন ম্যাগাজিনগুলোর কথা মনে পড়েছিল।

যারা বিজ্ঞাপন বানায়, নির্ঘাত তারা শুধু আমেরিকান মডেলদের আদর্শ ভেবেই বানায়। বের্নহার্ড ভাবছিল… ভাবতে ভাবতে বেশ অপ্রতিভভাবে সে একটা সিগারেট ধরাল।

বেটসির চোখে মুখে সবসময় একটা খুশি ঝলমল করছে। খুশি ছাড়া আর বিশেষ কোনও সূক্ষ্ম অভিব্যক্তি বের্নহার্ডের নজরে এল না। যাই হোক, বেটসির লাল রঙে রাঙানো বাঁকা ঠোঁটের সঙ্গে এই খুশি খুশি ব্যাপারটা বেশ ভাল মানিয়েছে। মনে হচ্ছে যেন এক শিশু আনন্দে বিস্ময়ে মুখ অল্প খুলে হাঁ করে আছে। শুধু ঠোঁট নয়, বেটসির হাতের নখগুলোও লাল রঙে রাঙানো। মনে হচ্ছে সাদা সাদা হাতের আঙ্গুলের ডগায় লাল লাল ফোঁটা দেওয়া আছে। বের্নহার্ডের স্বভাবই হল মানুষের হাতের দিকে তাকিয়ে হাতের গড়ন, আঙুলের আকার এসব খুঁটিনাটি লক্ষ্য করা। ফলে মানুষের হাতের দিকে তাকিয়ে মানুষ সম্বন্ধে একটা ধারণা তৈরি করার ব্যাপারে সে বেশ আত্মবিশ্বাসী। এরই মধ্যে অবশ্য সে বিলির হাতগুলিও একঝলক দেখে নিয়েছে। বিলির হাত বেশ বড়সড়, শক্তিশালী। যদিও আঙুলগুলো সেরকম সুন্দর নয়, ডগার দিকটা একটু থ্যাবড়া ধরনের… তবে আঙুলগুলোর মধ্য দিয়ে বেশ ইতিবাচক লক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছে। বিলির হাত দেখে মনে হয় যে মানুষটা ভাল, সরলসোজা। বেটসির হাতগুলো খুব সাদাটে এবং দেখে মনে হচ্ছে যে তার হাতের নিয়মিত পরিচর্যা করে সে। হাতের উপরের ভাগ সরু, সুগঠিত এবং দৃঢ় হলেও আঙুলগুলি ভারি কোমল। না চাইলেও ইনেসের হাতের কথা মনে পড়ে বের্নহার্ডের। ইনেসের হাতও ভারি সুন্দর আকারের এবং সুগঠিত। অবশ্য এভাবে তুলনা করা একেবারে অর্থহীন। তাই বের্নহার্ড নিজের পর্যবেক্ষণ চালিয়ে যায় এবং এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে বেটসি একজন ভারি লাবণ্যময়ী, স্বাস্থ্যবতী, সুন্দরী যার পায়ের গড়ন বেশ দৃঢ় এবং সুগঠিত হলেও সে এক নরমশরম যুবতী। কাঁধের গঠন গোল ধরনের, বালিকার মত ভরাট গাল এবং গোল চিবুক।

বের্নহার্ডের মনে এই গায়িকা ভদ্রমহিলা সম্বন্ধে একটা অন্যরকম চিত্র আঁকা হয়েছিল। কারণ, আমেরিকান মহিলাদের সে আগে দেখেনি।

সঙ্গীতশিক্ষার সূচনা হিসেবে বের্নহার্ড সেদিন প্রস্তাব দিয়েছিল যে বেটসি একটা গান গাইবে এবং সে বাজাবে। দেখা গেল যে ওই ঘরের মধ্যেই একটা বিশাল পিয়ানো আছে। সবুজ সিল্কে ঢাকা দেওয়াল শোভিত ঘরটার মধ্যে ঠেসেঠুসে এক কোণে রাখা আছে বাদ্যযন্ত্রটা, যদিও সেটা এখন ফুলদানি রাখবার স্ট্যান্ড হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। নানা চেষ্টাচরিত্র করে ফুলদানি এবং ফুলের বোকেগুলি সরিয়ে পিয়ানোর ঢাকা খোলা হল।

বেটসি ‘ডি ফোরেল্লে’২ গাইতে চেয়েছিল। তবে বের্নহার্ড বারণ করেছিল। সে কোনও সহজ গান দিয়ে প্রথম দিন শুরু করতে চেয়েছিল। কিন্তু বেটসি সেসবে কর্ণপাত করল না। বেটসি ভয়াবহ ভুলভাল সুরে গাইল; একটা পর্যায়ে যে কারো মনে হতে পারে যে গানটা গায়িকার নিজেরই রচনা। তবে বেটসির কণ্ঠস্বর সুন্দর, পরিষ্কার এবং তাল, লয় ইত্যাদির জ্ঞান বেশ পাকা। কিছুক্ষণ অভ্যাস করবার পরে বেটসি ক্লান্ত হয়ে পড়ল এবং প্রস্তাব দিল বাইরে কোথাও গিয়ে কিছু খেয়ে আসবার জন্য। বিলি এবং বের্নহার্ড দু’ জনেই যেতে রাজি হল। রাত প্রায় ন’টা বাজে। অবশেষে বের্নহার্ড আর নিজের কৌতূহল সংবরণ করতে না পেরে বেটসিকে জিজ্ঞাসা করেই ফেলল যে তার কোনও পোষা বাঁদর আছে কি না। সে কথা শুনে বেটসি ভীষণ খুশি হল। চানঘরের দরজা খুলে সে ভারি নরম স্বরে ডাক দিল… ‘ক্ন্যাগিইই!’ সঙ্গে সঙ্গে শরীরে আটকানো একটি শিকলের ঝনঝন শব্দের প্রচণ্ড কোলাহলের মধ্য দিয়ে একটি ছোট, কুৎসিত প্রাণী ঘরে প্রবেশ করল। এক উড়ন্ত দানবের মত কুশনগুলির উপর দিয়ে, গ্রামোফোন মেশিনের উপর দিয়ে বেশ কয়েকটা ফুলদানি উল্টে ফেলে লাফিয়ে গেল সে। তারপর ভয়ে ভীত হয়ে একটা চেস্ট অফ ড্রয়ারের পেছনে গিয়ে লুকিয়ে পড়ে অবশেষে আবার চানঘরে ঢুকে গেল প্রাণীটি। মুহূর্তের মধ্যে সবুজ সিল্কে ঢাকা দেওয়ালে সজ্জিত ঘরটা একেবারে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল।

বেটসি আপ্লূত ভঙ্গিতে বারবার বলতে লাগল, … ‘কী মিষ্টি! কী সুন্দর না ও?’ তারপর আবেগের বশে এত হাসতে লাগল যে তার চোখ থেকে আনন্দাশ্রু গড়াতে শুরু করল। এসব কাণ্ডকারখানা দেখে বের্নহার্ড এতটাই বিস্মিত হয়েছিল যে অনেকক্ষণ পর্যন্ত কোনও কথা বলতে পারছিল না সে।

(চলবে)


১. জার্মান ভাষায় “গুটেন আবেন্ড!” শব্দবন্ধের অর্থ শুভ সন্ধ্যা।

২. ‘ডি ফোরেল্লে’… ঊনবিংশ শতকের শুরুর দিকে অস্ট্রিয়ান সঙ্গীতজ্ঞ ফ্রান্‌জ শুবার্ট রচিত একটি সঙ্গীত।

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়
























২৪.১

গাঁয়ের এক পাশে একটা ছোট পুকুর মত ছিল যা দেখলে মনে পড়বে “থাকিলে ডোবাখানা, হবে কচুরিপানা”। নোংরা পাঁক, দুর্গন্ধে বজবজ করছে। কিছু টাট্টু ঘোড়া, ধোপার গাধা, ঘেয়ো কুকুর আর শুয়োর ওটা দেখে খুশিতে ডগোমগো। পোকামাকড়, ডাঁশ, মশা মাছি ফ্যামিলি প্ল্যানিং এর জটিলতার থেকে সরে গিয়ে সমানে অযুত নিযুত হারে বংশবৃদ্ধি করে চলেছে। ওরা বোধহয় আমাদের শিক্ষা দিচ্ছে যে আমরাও যদি ওদের কায়দায় বাঁচতে শিখি তাহলে দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি বলে কোন সমস্যা থাকবে না।

নোংরামি কিছু কম পড়িয়াছে ভেবে গাঁয়ের দু’ডজন ছেলে পেটের স্বেচ্ছাচার থেকে নিস্তার পেতে নিয়মিত এখানে আসে-- সকাল সন্ধ্যে বা দিনের যে কোন সময়। এরা এসে এই ডোবার কিনারে --কঠিন, তরল ও বায়বীয়—তিনরকম পদার্থ ত্যাগ করে হালকা হয়ে ঘরে ফেরে।

কোন পিছিয়ে থাকা দেশেরও যেমন কোন- না- কোন আর্থিক ও রাজনৈতিক গুরুত্ব থাকে, তেমনই এই নোংরা ডোবাটারও বিশেষ গুরুত্ব ছিল। এর আর্থিক বিশেষত্ব হোল গায়ে লাগা ঢালু জমিতে খুব ভাল ঘাস জন্মায় আর গ্রামের এক্কাওলাদের ঘোড়াগুলোর খাদ্যসমস্যা এভাবেই দূর হয়। রাজনৈতিক গুরুত্ব হোল শনিচর এখানে এসে এক্কাওলাদের ভেতর ওর পঞ্চায়েতি নির্বাচনে মোড়ল হওয়ার জন্যে ভোট চাইতে এসেছে।

শনিচর যখন ডোবার কিনারে পৌঁছল তখন দু’জন ঘেসেড়ে ঘাস কাটছিল। ওরা পেশায় ঘেসেড়ে নয়, বরং এক্কাওলা। এমন যে এলাকায় সাইকেল রিকশার চলন হওয়ার পরও প্রাণে ধরে পেশা ছাড়েনি, ঘোড়াগুলোর সঙ্গে এখন অবধি টিকে আছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সাইকেল-রিকশা চালকদের হুজুম যে ভাবে দ্রুত বেড়ে উঠছে তার থেকে এটা প্রমাণিত হয় যে দেশের আর্থিক নীতি খুব ভাল আর দেশের ঘোড়াগুলো কোন কাজের নয়। আর এটাও বোঝা যাচ্ছে যে আমরা সমাজবাদ প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছি। প্রথমে ঘোড়া ও মানুষের প্রভেদ দূর করেছি এখন মানুষে মানুষে ভাগাভাগি দূর করতে হবে।

এসব তো যুক্তি দিয়ে সিদ্ধ করা যায়, কিন্তু এই যে শিবপালগঞ্জ ও শহরের পথে এক ডজন সাইকেল-রিকশা চলছে, তারপরেও দুটো এক্কাগাড়িওলা আর ওদের ঘোড়া এখনও হাপিস হয় নি কেন —তার যুক্তি কী?

মানলাম, ঘোড়াগুলো এই ডোবার পাড়ে ঘাস খেয়ে বেঁচে আছে, কিন্তু এক্কাওলারা? ওরাও কি এদের কায়দাতেই পেট ভরাবে? উঁহু, খাদ্যবিজ্ঞানের সূত্র বলে মানুষের বুদ্ধি মাঝে মাঝে ঘাস খেয়ে পুষ্ট হতে পারে বটে, কিন্তু খোদ মানুষ এভাবে বাঁচতে পারে না।

শনিচর যখন এক্কাওলাদের কাছে গেল তখন ওর মনে এত সব গম্ভীর আর্থিক সামাজিক ভাবনা ছিল না। ওর মাথায় একটাই চিন্তা—ভোট চাই। সুতরাং ও কোন ভুমিকা ছাড়াই সোজাসুজি কাজের কথায় এল।

--দেখ, আমি এবার পঞ্চায়েত প্রধান হবার জন্যে কাগজ জমা করেছি। যদি নিজের ভাল চাও, তো আমাকে ভোট দাও।

একজন এক্কাওলা শনিচরকে উপর থেকে নীচ আর নীচ থেকে উপর অব্দি একনজর মেপে নিয়ে নিজের মনে বিড়বিড় করল—“ এ হবে প্রধান? পোঁদে নেই ইন্দি, ভজরে গোবিন্দি”!

ভোট ভিক্ষায় পথে নামলে অনেক বড় বড় নেতাও নম্র হয়ে যান। আর এ তো শনিচর! জবাব শুনে ওর তেজ গায়েব হোল, দাঁত বেরিয়ে এল। বলল, “আরে ভাই, আমি প্রধান হব নাম-কে-ওয়াস্তে। আসল প্রধান তো বৈদ্যজী মহারাজ। ব্যস, এটা মেনে নাও যে তুমি ভোটটা আমাকে নয় বৈদ্যজীকে দিচ্ছ। ধরে নাও, আমি নই স্বয়ং বৈদ্যজী তোমার কাছে ভোট চাইতে এসেছেন”।

ওরা একে অন্যকে দেখল, তারপর চুপ মেরে গেল। শনিচর বলল, “বল ভাই, কী ভাবছ”?

“বলার কী আছে”? অন্যজন মুখ খুলল, “বৈদ্যজী নিজে ভোট চাইছেন ! ওনাকে কে মানা করবে? আমরা কি ভোট নিয়ে আচার দেব? নিয়ে যান! বৈদ্যজীই নিয়ে যান”।

প্রথমজন উৎসাহিত। “ভোট সালা কোন একশ টাকার চিজ? যে কেউ নিয়ে যাক”।

অন্যজন প্রতিবাদ করল, “যে কেউ কেন নেবে? এই প্রথম বৈদ্যজী আমাদের কাছে কিছু চেয়েছেন। উনিই পাবেন, নিয়ে যান”।

শনিচর বলল, “তাহলে পাকা কথা ধরে নিই”?

দুজনে একসাথে যা বলল তার সার—মরদের কথার নড়চড় হয় না। আমাদের দেবার মত কিছু নেই, তবে বৈদ্যজী কিছু চাইছেন, ওনাকে ‘না’ বলা কঠিন। আশা করি তুমিও প্রধান হয়ে গেলে মাটিতে পা ফেলবে, আকাশে বাঁশ দিয়ে খোঁচাবে না”।

শনিচর চলে গেছে। ওরা দু’জন খানিকক্ষণ চুপচাপ ঘাস কাটতে লাগল। আর মাঝে মধ্যে আজকাল ঘাস কেন কমে যাচ্ছে সে নিয়ে তর্ক জুড়ে দিল। হঠাৎ চোখে পড়ল একজন লোক চলে যাচ্ছে। ওর আসল নাম কেউ জানে না, সেটা শুধু সরকারের কাগজে লেখা রয়েছে। সবাই ওকে বলে “রামাধীনের ভাইয়া”। ও হচ্ছে শিবপালগঞ্জের গ্রামসভার বর্তমান প্রধান। তবে গ্রামের সবাই মনে করত আসল প্রধান হলেন রামাধীন ভীখমখেড়িজী।

বিগত বছরগুলোয় গ্রামের দীঘিগুলোর মাছের নীলাম বেশ উঁচু দরে হয়েছিল। আর পড়তি রুক্ষ জমির পাট্টা জারি করেও সভার আয় বৃদ্ধি হয়েছিল। গ্রাম পঞ্চায়েত কখনও সখনও চিনি আর ময়দার কোটা বিতরণের কাজ করছিল। এইসব মিলে গ্রামসভা বড়লোক হচ্ছিল। তবে শিবপালগঞ্জে সবাই জানত যে গ্রামসভার বড়লোক হওয়া আর সভার প্রধানজীর বড়লোক হওয়া একই কথা। ফলে প্রধানের পদ বেশ লাভপ্রদ হয়ে গেল।

শুধু তাই নয়, প্রধানের পদ বেশ সম্মানেরও বটে। বছরে দু-একবার থানাদার ও তহশীলদার ওকে ডেকে এনে দু’চারটে গাল দেয় বটে, সে দিক গে। আলো-আঁধারিতে গাঁয়ের একাধ গুন্ডা ওকে পাঁচ দশটা ঢিল ছোঁড়ে , তা ছুঁড়ুক গে’। তাতে ওই পদের সম্মান বা মর্যাদায় কোন আঁচ লাগে না। কেননা আমাদের গোটা দেশে এবং শিবপালগঞ্জে সম্মান সেই পায় যে বড়লোক হয়েছে, সে যেভাবেই হোক না কেন! এছাড়া গোটা দেশের মত এখানেও কোন সংস্থার পয়সা ফোকটে হজম করে গেলে বড়লোকের সম্মান কমে যায় না।

এইসব কারণে রামাধীনের বড়দার ইচ্ছে এবারেও প্রধানের গদি আঁকড়ে থাকার।

এখন উনি ওনার ছোলার ক্ষেতের পাশে পড়শির ক্ষেত থেকে একগাদা চারা তুলে ফেলে বড় বোঝা বগলে পুরে ঘরে যাচ্ছিলেন এবং যেতে যেতে উঁচু গলায় গাল পাড়ছিলেন –যাতে লোকে জেনে যায় যে আসলে ওনার ক্ষেত থেকেই ছোলাগাছ চুরি হয়েছে।

উনি ডোবার পাশে এক্কাওলাদের সঙ্গে শনিচরের গুজগুজ দেখতে পেলেন। অমনি পথ বদলে পুকুরপাড়ে চলে এলেন। এক্কাওলারা দেখে নিল শনিচর দূরে চলে গেছে কিনা। তারপর ওনাকে সেলাম ঠুকে বলল, “ভাইয়া, তুমি এবারেও প্রধানগিরির জন্যে ভোটে দাঁড়াচ্ছ তো”?

রামাধীনের বড়দা প্রথমে ক্ষেত থেকে চানাচুরির গল্পটা শোনালেন। তারপর বললেন—দেখছ তো, আমার প্রধানগিরির সময় ফুরিয়ে আসছে, তাই চোর ব্যাটারা আবার সাহস করে পুরনো বদমায়েসি শুরু করেছে। যত্তক্ষণ আমার শাসন ছিল, এরা নিঃশ্বাস বন্ধ করে দিন গুনছিল।

ওনার যুক্তি হোল, এই গঞ্জহা ব্যাটারা (শিবপালগঞ্জের লোকজন) যদি নিজের ভাল বোঝে, সুখ-শান্তি চায় তাহলে শালারা নিজের থেকেই আমাকে ফের প্রধান বানাবে। আমায় কিছু করতে হবে না। শেষে উনি বেপরোয়া ভাব দেখিয়ে বললেন—আচ্ছা, শনিচর ব্যাটা কী বলছিল?

--ভোট চাইছিল।

--তোমরা কী বলেছ?

--বলেছি নিয়ে নিও, ভোট নিয়ে আচার পাতব নাকি?

-- ওকে ভোট দেবে? নিজের ভালমন্দ, উঁচুনীচু সব দেখেটেখে তবে দিও।

--সব দেখে নিয়েছি। তুমি ভোট চাইছ, আচ্ছা, তোমাকেই দেব’খন।

প্রথমজন ফের বলল—আমরা ভোট নিয়ে কি আচার পাতব?

রামাধীনের ভাইয়া বলল—তাহলে শনিচরকে ভোট দিচ্ছ না?

--তুমি বললে ওকেও দিতে পারি। যাকে বলবে তাকেই দিয়ে দেব। আমরা তোমার হুকুমের চাকর। ওই শালার ভোট নিয়ে কিসের আচার—

বড়দা ওর কথার মাঝখানে বলে উঠলেন—শোন, কোন শনিচর ফনিচরকে ভোট দেবে না, ব্যস।

--ঠিক আছে, দেব না।

--আমাকে দেবে।

--দিয়ে দেব। বললাম তো, নিয়ে যাও।


রামাধীনের বড়দা ফের ছোলাচোরের বাপান্ত করতে করতে ঘরের রাস্তা ধরলেন। চলার গতির সঙ্গে ওনার গালির রূপ ও আকার বদলে যেতে লাগল। কারণ, মহল্লা এসে গেছে। ওনার ইচ্ছে লোকজনকে বুঝিয়ে দেয়া যে উনিও একধরণের গুণ্ডা এবং আজ ওঁর মেজাজ খারাপ।




চামারটোলা ও উঁচুজাতের মহল্লার মাঝখানে তৈরি হয়েছে গান্ধী চবুতরা (মণ্ডপ)। অন্যদিন সেটার উপর কুকুর শুয়ে থাকে এবং চেঁচায়। কিন্তু আজ ওখানে মানুষের কন্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে। নির্বাচনের অল্প ক’দিন আগে রামাধীনের ভাইয়া ওটার মেরামত করিয়েছেন। কারণ, নির্বাচনের আইনে বোধহয় এমনটা করার নির্দেশ রয়েছে! অথবা নির্দেশ থাক বা না থাক, সব বড় বড় নেতা, না জানি কেন, নির্বাচনের দুয়েক মাস আগে নিজের নিজের নির্বাচনী এলাকায় মেরামত বা সংস্কার করাতে লেগে যান।

কেউ নতুন পুল বানিয়ে দেন, কেউ রাস্তা; অন্যেরা গরীবদের মধ্যে কম্বল এবং চাল-গম বিতরণ করেন। সেই হিসেবে রামাধীনের বড়দা ওই চবুতরার চেহারা বদলানোর চেষ্টা করেছিলেন।

ওখানে একটা লম্বা-চওড়া নিম গাছ দাঁড়িয়ে আছে। অনেক বুদ্ধিজীবীর মত গাছটাও অনেক শাখা প্রশাখা ছড়িয়েছে বটে, কিন্তু ভেতরটা ফোঁপরা। ভাইয়া ওর নীচে একটা কুয়ো বানিয়েছিলেন। আসলে ওখানে কুয়ো আগে থেকেই ছিল। উনি সেটা মেরামত করিয়ে সরকারি কাগজপত্তরে ‘নবীন কূপ নির্মাণ’ এন্ট্রি করিয়ে দিলেন। উদ্দেশ্য মোটা সরকারি ভর্তুকি হাতিয়ে ফেলা। কাগজাটা হয়ত ঠিক নৈতিক হল না, তবে একরকম রাজনৈতিক তো হল। আগে এই কুয়ো বর্ষার দিনে উঁচু জমি থেকে বয়ে আসা জল নিজের পেটে পুরে গ্রামকে বন্যার হাত থেকে রক্ষা করত। এখন ওর চারপাশে উঁচু বাঁধানো পাড়। বোঝাই যাচ্ছে এর সম্বন্ধ রয়েছে কোন পঞ্চবার্ষিক যোজনার সঙ্গে। এই কথাটা বড় গলায় বলার জন্যে ওই পাড়ের দু’পাশে দুটো উঁচু থাম তোলা হয়েছে। একটার গায়ে রয়েছে এক ‘শিলালেখ’ঃ

‘তৃতীয় পঞ্চবার্ষিক যোজনা। গাঁও-সভা শিবপালগঞ্জ। পশু-চিকিৎসক শ্রী ঝাউলাল এই কুয়োর ‘শিলান্যাস’ করেছেন। সভাপতি শ্রী জগদম্বা প্রসাদ’।

কুয়োর পাড় পাকা করে দেয়ায় বাইরের জল আর কুয়োতে আসে না। কিন্তু ভেতরের জল বাইরে আসে। মানে, ওর ভেতর থেকে শীতল-মন্দ-সুগন্ধ বা পচা জলের গন্ধ নাকে টের পাওয়া যায়। যেন ও গ্রামের লোকজনকে ডাক দিচ্ছে—পেটের কৃমির অভিজ্ঞতা তোমাদের হয়েছে বটে, এবার ওটা ছেড়ে ম্যালেরিয়া আর ফাইলেরিয়াকেও নিয়ে যাও।

কুয়োর মেরামতের সঙ্গে গান্ধী-চবুতরারও কপাল ফিরে গেল। ক’টা নতুন ইঁট জুড়ল আর তার গায়ে এমন সিমেন্ট যে ঠিকেদারের হাতে লাগানোর পনের দিন পরেও খসে পড়ে নি। এই আবহাওয়ায় চবুতরা বেশ আকর্ষণীয় হয়েছে। কলেজের যত ফালতু ছেলে কখনও সখনও এখানে বসে জুয়ো খেলতে লাগল। সন্ধ্যের সময় বদ্রী পালোয়ানের কুস্তির আখড়া থেকে কয়েকজন চ্যালা আসতে শুরু করল। ওদের হাবভাব দেখলে মনে হয় এখানে আসার একমাত্র উদ্দেশ্য বসে বসে গায়ে এঁটে থাকা মাটিকে চুলকে চুলকে তুলে ফেলা।

আজকে গ্রামসভার ভোট। কলেজের ছুটি। নির্বাচন তো অন্য জায়গায় হওয়ার কথা ছিল, নিঃসন্দেহে চামারটোলা থেকে দূরে। কিন্তু আজ গান্ধী-চবুতরায় ভারি ভীড়। আর সবরকম লোক একসাথে মিলেমিশে বসে আছে—যেমনটি গান্ধীজি চাইতেন। জুয়ো-খেলুড়েরা তাস পকেটে পুরেছে। আখড়ার চ্যালারা আজ কুস্তি করেনি, গায়ে মাটি মাখে নি, শুধু তেল মালিশ করে এসেছে। ফলে তার উগ্র গন্ধ দিগবিদিকে ছড়িয়ে যাচ্ছে।


রূপ্পনবাবু আজ যেন ক্লান্ত চরণে আসছেন। মুখের ভাবে রোজকার স্ফুর্তি আর চালাকির ঝলক দেখা যাচ্ছে না। ওনাকে গাব্ধী চবুতরার দিকে আসতে দেখে এক উঠতি পালোয়ান চোখ মেরে বলল, “কহো বাবু, ক্যা হাল”?

জবাবে রূপ্পন বাবু অন্যদিনের মত চোখ মারলেন না বা এটাও বললেন না যে তুমিই বল রাজা! তোমার কী হাল? উনি এমনভাবে মাথা নাড়লেন যার মানে—ঠাট্টা করছ! আমার ভাল লাগছে না। মুড খারাপ।

উনি চোখে কালো চশমা লাগিয়ে গলায় রেশমি রুমাল বেঁধে ধীরে ধীরে এসে চবুতরায় ধপ করে বসে পড়লেন। খানিকক্ষণ উপস্থিত ভদ্রজনের মধ্যে শান্তি বিরাজ করতে লাগল।

ছোকরা পালোয়ানটি অলস ভঙ্গিতে আড়মোড়া ভেঙে কনুই ভাঁজ করল। ওর কনুইয়ের উপরে নেংটি ইঁদুরের মত একটা ছোট্ট মাংসপেশি জেগে উঠল। ও বড় আদর করে ওটাকে বার বার হাত বুলিয়ে ফের রূপ্পন বাবুর কাছে গিয়ে বসল। ও আবার চোখ মারল, তারপর রূপ্পন বাবুর পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, “ কী ব্যাপার বাবু! আজকের রঙ যেন একটু বদরঙ লাগছে”!

শিবপালগঞ্জের বিখ্যাত প্রবাদ—“প্রেমিকের তিন নাম,

রাজা, বাবু, পালোয়ান”।

সে হিসেব ধরলে রাজার বদলে বাবু সম্বোধনে রূপ্পন বাবুর সম্মান কিছু কম হল মনে হতে পারে। তবে শিবপালগঞ্জ এটাও জানে যে এই ছোকরা পালোয়ানকে রূপ্পন বাবু অনেক ছাড় দিয়ে রেখেছেন। যেন গান্ধীজি সর্দার প্যাটেলকে কড়া কথা বলার ছাড় দিয়েছিলেন। সুতরাং দু’জনের নিজেদের মধ্যে এইসব কথাবার্তাকে আমরা ‘মহাপুরুষদের মহারঙ্গ’ বলে ধরে নেব।

কিন্তু রূপ্পন তো তাঁর চ্যালার গায়েপড়া ভাব ও ঠাট্টা খেয়াল করছেন না। একেবারে চুপটি করে মুখটি বুজে রয়েছেন। কলেজের একটি ছাত্র বলল,--গুরু, আমাদের কী করতে হবে? তুমি এখনও কিছু বলনি। এবার রামাধীনের দলে যেমন উত্তেজনা গরমাগর্মি ভাব, শনিচরের দলে তেমন কিছুই নেই’।

রূপ্পন বাবু পাতাল থেকে আসা আওয়াজে বললেন—‘এখন ঠান্ডাগরম নিয়ে কথা বলা বেকার। ভোটের ফলাফল একটু আগে বেরিয়ে গেছে। শনিচর জিতে গেছে’।

ছোকরা পালোয়ানের দল আর কলেজের ছাত্রদের মধ্যে হুলুস্থুল পড়ে গেল। চারদিকে একটাই প্রশ্ন ঘুরতে লাগল, “ আরে কী করে? কী ভাবে? শনিচর ব্যাটা জিতল কোন কায়দায়”?

রূপ্পন বাবুর চ্যালা ছোকরা পালোয়ান চোখ মেরে বলল, ‘ বলো পালোয়ান, শনিচর ব্যাটা জিতল কোন দাঁও লাগিয়ে”?

“মহীপালপুরওলা দাঁও”। রূপ্পন বাবুর গলার স্বরে অসীম ক্লান্তি।

************************************************************************

ভোটে জেতার তিনরকম দাঁও-প্যাঁচ আছেঃ রামনগরওয়ালা, নেবাদাওলা আর তিন নম্বর হোল মহীপালপুরওলা।

একবার গ্রানসভার নির্বাচনে রামনগর গ্রাম থেকে দু’জন ভোটে দাঁড়িয়েছিল—রিপুদমন সিং ও শত্রুঘ্ন সিং। দুজন একই জাতের, ফলে জাতের ভোট ভাগ হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিল। ঠাকুর সমাজের লোকজনের ভারি মুশকিল। ইনিও ঠাকুর, তিনিও ঠাকুর—ভোট দেব কাকে! আবার যারা ঠাকুর সমাজের নয় তারা ভাবল—এরা নিজের জাতের মধ্যেও রেষারেষি করছে, এমন প্রার্থীকে ভোট দিলেই কি, আর না দিলেই কি!

কিছুদিন পরে জানা গেল যে রিপুদমন আর শত্রুঘ্ন --দুটোর মানে একই; অর্থাৎ এমন এক সিংহ যে শত্রুকে গিলে খায়। এটা জানার পর গ্রামের লোকজন গণতন্ত্রের অনুকুল সিদ্ধান্তে পৌঁছল—ওরা একজন আর একজনকে গিলে খাক, অথবা গ্রামসভার প্রধান হোক—আমাদের কী আসে যায়!

নির্বাচনের পাঁচ দিন আগে পর্য্যন্ত ভোটের হাওয়া একদম গায়েব। প্রার্থীরা গাঁয়ে গিয়ে ভোট চাইলে লোকজন বলে দেয়—আমরা ভোট নিয়ে কি আচার দেব? যাকে দিতে বলবে তাকেই ভোট দেব।

ফলে দু’জনেই ভাবল—কেউ ওদের ভোট দেবে না। ওরা ঘাবড়ে গিয়ে গণতন্ত্রের দোহাই দিল, মানুষজনকে ভোটের মূল্য বোঝাতে লাগল। যেমন—তুমি যদি তোমার দামি ভোট ভুল লোককে দাও তাহলে প্রজাতন্ত্রের সমূহ বিপদ! বেশির ভাগ লোকে এসব বড় বড় কথা বুঝল না। যারা বুঝল, তারা বলল—ভুল লোককে ভোট দিলে গণতন্ত্রের কোন বিপদ হয় না। তুমি তোমার ভোট দিতে পারছ, সেটাই গণতন্ত্রের জন্যে যথেষ্ট। ভুল ঠিক তো চলতেই থাকে। দেখ না, আজকাল যা হচ্ছে----।

এধরণের কথা বলার লোক হাতে গোণা যায়। তবে গণতন্ত্রকে ফালতু প্রমাণিত করতে এরাই যথেষ্ট। তখন দুই ক্যান্ডিডেট প্রচারের কায়দা বদলে নিল। বলতে লাগল গ্রামসভার প্রধানের ক্ষমতার কথা। যেমন, প্রধান চাইলে গ্রামের সব পড়তি জমি অন্যদের বিলি করতে পারে এবং যারা বে-আইনি ভাবে পড়তি জমি দখল করে রেখেছে তাদের বেদখল করতে পারে।

যাঁরা প্রেমচন্দের ‘গোদান’ পড়েছেন বা ‘দো বিঘা জমিন’ ফিলিম দেখেছেন তাঁরা জানেন যে কৃষকের সবচেয়ে প্রিয় হল জমি। শুধু তাই নয়, ওদের নিজের জমির চাইতে অন্যের জমি বেশি প্রিয় এবং সুযোগ পেলেই ওদের পড়শির ক্ষেতের দিকে নোলা সকসক করে। এর পেছনে কোন সাম্রাজ্যবাদী উপনিবেশ গড়ার স্বপ্ন নয়, বরং সহজিয়া প্রেমের ভাবনা কাজ করে। সেই প্রেমের তাগিদে ও নিজের ক্ষেতের আলে বস পড়শির ক্ষেতে পশু চরতে দেয়। আখ খাবার জন্যে নিজের ক্ষেত ছেড়ে পাশের ক্ষেত থেকে আখ উপড়ে নেয়, আর সবাইকে দেখিয়ে দেখিয়ে বলে—দেখছ তো, আমার ক্ষেত থেকে কেমন চুরি হচ্ছে!

কথাটা ভুল নয়। কারণ, ওর পড়শিও একইভাবে তার পাশের লাগোয়া ক্ষেত থেকে আখ চুরি করে উপড়ে নেয়। অন্যের সম্পত্তিকে নিজের মনে করার পেছনে কাজ করে সহজিয়া প্রেমের তাড়না।

এই কথাগুলো গোদান উপন্যাসে স্পষ্ট করে বলা হয় নি। আর বোম্বাইয়া সিনেমাতেও—সম্ভবতঃ কৃষণ চন্দর এবং খাজা আহমদ আব্বাসের ভয়ে—অথবা প্রগ্রেসিভ হওয়ার ঝোঁকে অন্ধ হয়ে, কিংবা স্রেফ বদমাইশি করে—খোলাখুলি দেখানো হয় নি। এই জন্যে আমি খানিকটা পরিষ্কার করে বললাম। মানছি, দেশ থেকে জঞ্জাল দূর করার কাজ শিল্পী=সাহিত্যিকের নয়, তবুও---।

হল কি, যেই গাঁয়ের লোকজন বুঝে ফেলল পঞ্চায়েতের সম্বন্ধ জমির লেনদেনের সঙ্গে এবং পড়শির ক্ষেত হাতিয়ে নেয়া সম্ভব, অথবা অমুক কৃষক নিঃসন্তান মারা গেলে নিজেকে ওর উত্তরাধিকারী ঘোষণা করে রাজতিলক পরা যেতে পারে—ব্যস, চাষিদের সহজিয়া প্রেমভাবনা উথলে উঠল। তখন জমির প্রেম ভোটারদের গ্রাম পঞ্চায়েতের দিকে ঠেলা মারল, পঞ্চায়েতের প্রতি প্রেমে ওরা মোড়ল পদের প্রার্থীদের দিকে ধাক্কা দিল। ফলে ওদের মস্তিষ্ক একদম সক্রিয় হয়ে উঠল।

এরপর ওদের সামনে এল সেই সমস্যা যা চিনা হামলার সময় আচার্য কৃপলানী গোটা দেশের সামনে হাজির করেছিলেন। ওরা ভাবতে লাগল নিরপেক্ষ থাকা একদম ফালতু, এতে দুর্বলতা বাড়ে এবং লোকসান হয়। যদি তুমি শান্তিতে থাকতে চাও তাহলে রিপুদমন অথবা শত্রুঘ্নের মধ্যে কাউকে বেছে তার সঙ্গে ঝুলে পড়। আর বেশি নিরপেক্ষ ভাব দেখালে দু’দিক থেকেই মরবে।

গল্প - মনোজ কর










 ত্রয়োদশ পর্ব

ছোটকালীর অফিসের গেট পেরিয়ে একটু এগিয়ে পানু রায় দেখলেন যে সবকটা সেলসম্যানই খদ্দের সামলাতে ব্যস্ত। অফিসের সামনে গাড়ি রেখে প্রায় ছোটকালীর অফিসের দরজার কাছে পৌঁছোবার সঙ্গে সঙ্গেই একটা ছেলে এসে সামনে দাঁড়ালো। বললো,’ স্যার গাড়িটা পাল্টাবেন?’ পানু রায় বললেন,‘না, আমি কালীকৃষ্ণের সঙ্গে দেখা করতে চাই।‘ কিন্তু ছেলেটা ছাড়বার পাত্র নয়। বললো,’ আপনার গাড়িটা ভালো কন্ডিশনেই আছে। যদি ফার্স্ট- হ্যান্ড হয় তাহলে …’ পানু রায় ছেলেটার কথায় কান না দিয়ে এগিয়ে গিয়ে ছোটকালীর সেক্রেটারির দিকে না তাকিয়ে একেবারে দরজা ঠেলে ছোটকালীর ঘরে ঢুকে গেলেন। ছোটকালী মুখ তুলে পানু রায়কে দেখে অবাক হয়ে গেল। পানু রায় বললেন,’ হঠাৎ এভাবে ঢুকে পড়ার জন্য দুঃখিত,কালীকৃষ্ণ । কিন্তু ব্যাপারটা অত্যন্ত জরুরি। আমি তোমার সঙ্গে একান্তে কিছু জরুরি কথা বলতে চাই। এখানে আসি অবধি একটা ছেলে আমার মাথা খারপ করে দিচ্ছে। আমি কী করে এই ছেলেটার হাত থেকে রেহাই পাব?’ ছোটকালী বলল,’ একটাই রাস্তা আছে নিস্কৃতি পাবার। একটা গাড়ি কিনে নিন।‘ পানু রায় ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বললেন,’ আমি ব্যক্তিগত দরকারে এখানে এসেছি। গাড়ি কেনা বা বিক্রীর জন্য নয়।‘ ছোটকালী বলল,’ আপনি নিজের গাড়িতে এসেছেন না ট্যাক্সিতে? ‘ পানু রায় বললেন,’নিজের গাড়িতে।‘ ছোটকালী ছেলেটিকে কাছে ডেকে বলল,’ গাড়িটাকে নিয়ে একটু চালিয়ে দেখ কী অবস্থায় আছে। সেইবুঝে মিঃ রায়কে একটা অফার দাও। মনে রেখ ওনার জন্য আমাদের তরফ থেকে যতটা বেশি সম্ভব ডিসকাউন্ট দেওয়া যায় ততটাই দিও।‘ পানু রায় বললেন,’ ঠিক আছে তাতে যদি কেউ উত্তেজনা কমে তাহলে তাই করো। কিন্তু আমাদের এক্ষুনি অনেকগুলো জায়গায় যেতে হবে। যদি গাড়িটা নিয়ে ওরা বেরোয় তাহলে তোমার ড্রাইভারকে বলো গাড়ি রেডি করতে।‘ ছেলেটি বেরিয়ে গেল। ছোটকালী বলল,’ঠিক আছে, বলুন কী ব্যাপার।‘

-তোমার কাছে বন্দুক আছে?

-কী ব্যাপার বলুন তো?

-আমি জানতে চাই তোমার কাছে বন্দুক আছে কি না। তুমি এখানে বড় অ্যামাউন্টের ক্যাশ রাখ এবং…

-হ্যাঁ, আছে।

-লাইসেন্স আছে?

-অবশ্যই। আপনি ভাববেন না আমি এখানে বেআইনি ব্যবসা চালাই আর কোনও লোক আচমকা ঢুকে পড়লে তাকে বন্দুক দেখিয়ে বের করে দিই।

-বন্দুকটা একবার আমাকে দেখাও।

ছোটকালী খানিকক্ষণ পানু রায়ের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। বোঝার চেষ্টা করল ব্যাপারটা কী ঘটতে চলেছে।কিছু আন্দাজ করতে না পেরে ডানদিকের ড্রয়ারের ওপরের তাক থেকে বন্দুকটা বের করে পানু রায়ের দিকে এগিয়ে দিল। পানু রায় বন্দুকটা হাতের তালুতে নিয়ে বারদুয়েক ওপর- নিচ করে বললেন,’ বেশ ভালো বন্দুক। এটা কি তোমার বাবার কাছে যেটা আছে অবিকল সেটার মতই?’ ছোটকালী বলল,’ আমি সেরা জিনিস ছাড়া ব্যবহার করি না। এটা বাবাই আমাকে দিয়েছে। একেবারে অবিকল…’ কথা শেষ হবার আগেই পানু রায় ট্রিগার টেনে দিলেন। প্রচন্ড শব্দ করে একটা বুলেট মেহিগিনির টেবিলের কোনে ধাক্কা খেয়ে পাশের দেয়ালের মধ্যে আধখানা ঢুকে আটকে গেল। ছোটকালী চিৎকার করে উঠলো,’ আরে আপনার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে ? আচ্ছা লোকতো আপনি। ওটা রাখুন।‘ পানু রায় স্তম্ভিত হয়ে বোকার মত বন্দুকটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। ততক্ষণে দরজা খুলে ছোটকালীর সেক্রেটারি আর তিন চারটে ছেলে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। ওদের চোখে মুখে ভয় এবং উৎকণ্ঠা। একটা ষণ্ডামত ছেলে এগিয়ে এসে পানু রায়কে বলল,’ ওটা এক্ষুনি নিচে ফেলুন। এক্ষুনি ফেলুন না হলে এক ঘুষিতে আপনার চোয়াল ভেঙে দেব!’ পানু রায় অবাক হয়ে বললেন,’ হে ঈশ্বর! আমি জানতাম না ওতে গুলি ভরা আছে।‘ ছোটকালী ছেলেটিকে বলল,’ ঠিক আছে। ইনি মিঃ পানু রায়। আমাদের পারিবারিক বন্ধু এবং বাবার আইনি পরামর্শদাতা।‘ ছেলেটি জিজ্ঞাসা করল,’ ডাকাতি করতে আসেনি?’ ছোটকালী বলল,’না’। পানু রায় টেবিলের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন তারপর বললেন,’ আমি ট্রিগারটা একটু পরীক্ষা করছিলাম। কিন্তু এটা এত মসৃণ যে আমি প্রায় চাপ দেবার আগেই ব্যাপারটা ঘটে গেল।‘

-সেই জন্যই আমি এটাকে এখানে রেখেছি। এটা রোজ তেল দিয়ে পরিষ্কার করা হয়। অত্যন্ত দামি এবং মসৃণ এটা। যেহেতু এটা আত্মরক্ষার জন্য ব্যবহৃত হয় সেজন্য এটাতে গুলি ভরা থাকে। কোনও বুদ্ধিমান লোক ডাকাত ঘরে ঢুকলে খালি বন্দুকের ট্রিগার টেপে না।‘

পানু রায় বন্দুকটা ছোটকালীকে ফিরিয়ে দিয়ে বললেন,’ আমার এটা নিয়ে নাড়াচাড়া করা ঠিক হয়নি।‘ ছোটকালী হেসে বললেন,’ আপনার মাথা এবং কথাই যথেষ্ঠ। আপনার বন্দুকের কোনও দরকার নেই।‘ পানু রায় ছোটকালীর সেক্রেটারি এবং লোকটার দিকে তাকিয়ে বললেন,’ আমি অত্যন্ত দুঃখিত যে আমার জন্য আপনাদের অনেক অসুবিধে হল। একটা মেহগিনির টেবিল আপনাদের পাওনা রইল।‘ ছোটকালী সেক্রটারি এবং ছেলেটিকে বলল,’ যাওয়ার সময় দরজাটা টেনে দিও।‘ ষণ্ডামত ছেলেটা অনিচ্ছাসত্ত্বেও বেরিয়ে গেল। সেক্রেটারি মেয়েটি পিছনে পিছনে বেরিয়ে গিয়ে বাইরে থেকে দরজাটা টেনে দিল। ছোটকালী বলল,’ এবার কী? আপনি যদি পানু রায় না হতেন তাহলে এই ঘটনাটা অনিচ্ছাকৃত বলে বিশ্বাস করতে পারতাম।‘ পানু রায় হাসি চাপতে পারলেন না। বললেন,’ বন্দুকটা পকেটে ঢোকাও এবং আমার সঙ্গে চল।‘

-বন্দুক নিয়ে?

-হ্যাঁ, বন্দুক নিয়ে। দরকার হতে পারে।

-ঠিক আছে। তাহলে আর একটা গুলি ভরে নিই?

-না,না। দরকার নেই। যেরকম আছে ওরকমই থাক।

-ঠিক আছে। কোথায় যাব?

-বেশি দূরে নয়।

-দাঁড়ান, একটা ফোন করে নিই।

ছোটকালী ফোনটা কানে নিয়ে বলল,’ পরেশ, আমি একটু বেরোচ্ছি। কালকে আমরা যে এক্স ৬০ কাজটা নিয়েছি ওটা এক্ষুনি বাইরে বের কর। এক্ষুনি মানে এক্ষুনি।‘ ছোটকালী টেবিলটার দিকে তাকিয়ে বলল,’ টেবিলের ওপরের পালিশটা মোটা মনে হত। এখন দেখছি পালিশটা খুব পাতলা। কিন্তু আসল উদ্দেশ্যটা কী ছিল? মিঃ রায়।‘ পানু রায় বললেন,’ সাধারণ উদ্দেশ্য হল ঐ এক্স ৬০ কাজটা কী আমার একটু বোঝা দরকার।‘

-আপনার দারুণ লাগবে। ভালো না বেসে পারবেন না। এটা স্পোর্টস সংক্রান্ত কাজ। আসলে গাড়ির সাইজের তুলনায় অনেক বেশি পাওয়ারের ইঞ্জিন লাগানো হয় বনেটের নিচে। সাধারণভাবে অত পাওয়ার কাজে লাগে না। কিন্তু যখন আপনি হাইওয়েতে উঠবেন এবং আপনি কাউকে অতিক্রম করতে চাইবেন আপনি মুহূর্তের মধ্যে তাকে অতিক্রম করে আবার নিজের লাইনে ফিরে আসতে পারবেন। এত দ্রুত আপনি ফিরে আসতে পারবেন যে কোনও গাড়ি কোনও বাঁক থেকে সহসা আবির্ভূত হয়ে আপনাকে ধাক্কা মারতে পারবে না।

-আমি সামনে কোনও বাঁক থাকলে ওভারটেক করি না।

-আপনার ওরকম মনে হচ্ছে বা আপনি হয়ত চেষ্টাও করতে পারেন কিন্তু যখন আপনি কোনও অচেনা রাস্তা দিয়ে যাচ্ছেন আপনার মনে হবে সামনের রাস্তা মসৃণ কিন্তু আসলে তা নয়…’

-পরে তোমার ভাষণ শুনবো। আপাতত দেখি জিনিসটা কী ।

সামনেই দাঁড়িয়ে থাকা একটা গাড়ির দরজাটা খুলে ছোটকালী বলল,’ আসুন, মিঃ রায়। স্টিয়ারিং এর সামনে বসুন। আগে চালিয়েছেন এই ধরণের স্পোর্টস কার?’ পানু রায় বললেন, না!’ ছোটকালী বলল,’ তাহলে চালান। ভুলে যান আপনার বয়স একশো বছরের বেশি। ভুলে যান আপনি কোনওদিন এরকম গাড়ি চালান নি।সামান্যই ব্যাপার। এমন গাড়ি আপনি কোনওদিন দেখেন নি এবং চাপেন নি সেকথা বাজি রেখে বলতে পারি। এরকম গাড়িই আপনার দরকার।‘

পানু রায় বললেন,’ কিন্তু সমস্যা একটাই। যেহেতু এটা সবার চেয়ে আলাদা লোকের চোখে এটা পড়বেই। এই ছোট্ট শহরে কিছুদিনের মধ্যেই সকলে জেনে যাবে যে এটা পানু রায়ের গাড়ি। যেখানেই যাই গাড়ি দেখলেই সবাই জানতে পারবে পানু রায় এসেছে।‘

-সেটা দারুণ ব্যাপার হবে না?

-আমার জন্য এর চেয়ে খারাপ আর কী হতে পারে?

-পেশাগত দিক থেকে গোপনীয়তা রক্ষা করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।বিশেষ করে আপনার ক্ষেত্রে। আপনাকে সামলাতে পুলিশ হিমসিম খেয়ে যায়। কিন্তু পানু রায় এই শহরের সবচেয়ে আলোচিত মানুষ সে কথাও তো ঠিক। এই গাড়ি পানু রায়কেই মানায়। আপনি গাড়ি স্টার্ট করুন। আপনি আমাকে যা বলেছেন তাই করেছি।একটা দামি মেহগিনি টেবিলও হারিয়েছি। এবার আমি যা বলছি করুন।যতক্ষণ আপনি না সন্তুষ্ট হচ্ছেন আপনাকে এক পয়সাও দিতে হবেনা। আপনি আগে যতদিন খুশি চালান তারপর যা সিদ্ধান্ত নেবেন তাই মেনে নেব। ইচ্ছে হলে কিনবেন না হলে ফেরৎ দিয়ে দেবেন।

পানু রায় গাড়িতে উঠে স্টার্ট দিলেন। গাড়িটা সামান্য কেঁপে একেবারে শান্ত হয়ে গেল। কোনও আওয়াজ নেই। শুধু ঘড়ির মত একটা টিক-টিক আওয়াজ হতে থাকলো। ছোটকালী বলল,’ গিয়ার দিন। আস্তে চাপুন।‘ পানু রায় চাপ দেবার সঙ্গে সঙ্গে তীব্র গতিতে গাড়িটা এগিয়ে গেল। ছোটকালী বলল,’ আস্তে, খুব আস্তে। শুধু ছুঁলেই হবে, চাপ দেওয়ার দরকার নেই।‘ পানু রায় হাইওয়েতে উঠলেন। ছোটকালী বলল,’ আপনি এখন ঘোড়ায় চেপেছেন। লাগামের সামান্য টানেই কাজ হয়ে যাবে। এই গাড়ি আপনার পছন্দ হতে বাধ্য।‘

-যদি আমি ততদিন বেঁচে থাকি।

-আমরা কোথায় যাচ্ছি? মি রায়।

-গাড়িটা চালিয়ে দেখতে।

-খুব ভালো। একটা দু’টো শার্প টার্ন নিন। স্টিয়ারিং টা ভালো করে বুঝুন। শুধু একটাই সাবধানবাণী শক্তি ব্যবহার করবেন না। স্পর্শেই কাজ হবে। একটু বেশিই সংবেদনশীল এই গাড়িটা।

-কিন্তু এই গাড়িটা আমার চেয়ে অন্তত চল্লিশ-পঞ্চাশ বছরের ছোটদের জন্যই ভালো।

-একেবারে উলটো। এই গাড়ি একমাত্র তাদেরই জন্য যাদের অভিজ্ঞতা আপনার মতোই দীর্ঘ।

-তোমার কী স্পোর্টস কার সম্বন্ধে এটাই ধারণা এবং বিশ্বাস?

-না, না। এসব নিছকই সেলসম্যানশিপ। কিন্তু আমরা যাচ্ছি কোথায়?

-কোথাও না।

-তাহলে গাড়িটাকে একটা ছোট রাস্তায় নিয়ে চলুন। অ্যাক্সিলারেটরটা পরীক্ষা করে দেখে নিন।

-না আমি ঠিক রাস্তাতেই আছি। আমি পরীক্ষা করছি।

-কী পরীক্ষা করছেন? গাড়ি?

-না, সেলসম্যানশিপ!

ছোটকালী হেসে উঠলো। পানু রায় আর একটু এগিয়ে বাঁ দিকে ঘুরে একটা ছোট রাস্তায় ঢুকে পড়লেন। ছোটকালী বলে উঠল,’ আরে আরে, কী করছেন মিঃ রায়?’ পানু রায় গাড়িটা ম্যান্ডেভিলা অ্যাপার্টমেন্টের সামনে দাঁড় করালেন। বললেন,’ আমাদের একটা কাজ আছে।‘

-আমি জানিনা আপনার মাথায় কী খেলছে, আমার উত্তর কিন্তু ‘না!’।

-চলে এসো। সময় কম।

-আমি বিবাহিত, মিঃ রায়।

-সেটা কীরকম অনুভূতি?

-এখনও ঠিক জানিনা।এখনও পর্যন্ত বেশ সুখকর। তবে বুঝতে পারছি সুবিধে এবং অসুবধে দুইই আছে। দেখুন এক অসাধারণ সুন্দরী মহিলার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছে এবং কোনওভাবেই আমি এই সম্পর্কে চিড় ধরতে দেবনা।

-আমিও চাইনা তোমাদের সম্পর্কের কোনও ক্ষতি হোক। আমার সঙ্গে এসো।

-আপনি কী চাইছেন? আমাকে কী কোনও স্টেটমেন্ট দিতে হবে?

-না, আমি চাই তুমি একটাও কথা বলবে না। যদি মনে হয় মাথা নাড়তে পার।

-যদি না মনে হয়?

-তাহলে স্ট্যাচুর নাত দাঁড়িয়ে যা হচ্ছে শুনবে এবং দেখবে।

-আপনি নিশ্চয়ই জানেন আপনি কী বলছেন।

-আশা করি জানি। চল, এবার শুরু করা যাক। সময় নেই হাতে।

পানু রায় এবং ছোটকালী রেবার ফ্ল্যাটের সামনে এসে দরজায় টোকা দিলেন। রেবা কৈরালা ‘কে?’ বলে দরজা খুলে পানু রায়কে সামনে দেখে বলল,’ ও, মিঃ রায়, আসুন।‘ পরক্ষণেই রেবার চোখ পড়ল পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা ছোটকালীর দিকে।ভ্রু কুঁচকে অবাক হয়ে ছোটকালীর দিকে তাকিয়ে রইল রেবা। মুখে রাগ এবং বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট দেখতে পেল ছোটকালী। বলল,’ শোন, রেবা। এসব কিন্তু মিঃ রায়ের প্ল্যান। আমি এই ব্যাপারে কিছু জানিনা।‘ পানু রায় ধমকে উঠলেন,’ চুপ কর। একটাও কথা বলবে না।‘ রেবা ভেতরে ঢুকে গেল। পানু রায় হাত ধরে ছোটকালীকে ভেতরে টেনে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন। রেবা ভেতর থেকে এসে বলল,’ অভিনন্দন, কালীকৃষ্ণ।‘ পানু রায় আবার ধমকে উঠলেন,’ একদম চুপ, দু’জনেই! আমাদের ঝগড়া করার সময় নেই। রেবা, কালীকৃষ্ণ আপনার নিরাপত্তার ব্যাপারে চিন্তিত। যদিও আপনাদের বিবাহ হয়নি এবং কালীকৃষ্ণ অন্যত্র বিবাহ করেছে তবুও সে আপনাকে বন্ধু বলেই মনে করে। যেহেতু কালীকৃষ্ণ আপনার বাবার ব্যাপারটা জানে এবং আমার কাছে ঐ লোকগুলোর সঙ্গে আপনার দরকষাকষির ব্যাপারটা শুনেছে ওর মনে হয়েছে আপনার নিরাপত্তার জন্য আপনার কাছে কোনও অস্ত্র থাকা দরকার।‘

-রেবার নিরাপত্তার জন্য আমি কোথা থেকে অস্ত্র পাব?

-চুপ করো। বন্দুকটা ওনাকে দাও।

ছোটকালী পকেট থেকে বন্দুকটা বের করে। পানু রায় বললেন’ রেবা, আপনি বন্দুকটা রাখুন।‘ রেবা জিজ্ঞাসা করলো,’ আমি কী করব এটা নিয়ে?’ পানু রায় বললেন,’ বালিশের তলায় রাখবেন।‘ ছোটকালী মাঝখান থেকে বলে উঠলো,’এটাতে একটা গুলি ইতিমধ্যে ব্যবহার করা হয়েছে।‘ পানু রায় রেগে গিয়ে বললেন,’আচ্ছা মুসকিল তো! তুমি বললে তুমি কোনও কথা বলবে না। এখন তো দেখছি সব কথা তুমিই বলছো। এবার দয়া করে চুপ করো এবং আমায় বলতে দাও।‘

-রেবা, ছোটকালী আপনার নিরাপত্তার ব্যাপারে যারপরনাই উদ্বিগ্ন।ও চায় যে আপনি আত্মরক্ষার জন্য আপনার কাছে এই বন্দুকটা রাখুন।এ ব্যাপারে কোনও গোপনীয়তা রক্ষা করার দরকার নেই। কেউ যদি আপনাকে জিজ্ঞাসা করে যে এই বন্দুক আপনি কোথায় পেলেন আপনি স্বচ্ছন্দে বলতে পারেন যে কৃষ্ণকালী আপনাকে এটা দিয়েছে বা কেউ যদি আপনাকে বলে যে কৃষ্ণকালী আপনাকে যে বন্দুকটা দিয়েছে সেটা কোথায় তাহলে আপনি তাকে এই বন্দুকটা দেখাতে পারেন। মনে রাখবেন এই বন্দুকটার একটা গুলি ইতিমধ্যেই ব্যবহার করা হয়েছে এবং এইভাবেই বন্দুকটা আপনাকে দেওয়া হয়েছে।আপনি জানেন না এই গুলিটা কে কোথায় ব্যবহার করেছে।কেউ জিজ্ঞাসা করলে বলবেন যে কালীকৃষ্ণ আপনাকে এভাবেই বন্দুকটা দিয়েছে এবং আপনাকে না করে প্রশ্নটা কালীকৃষ্ণকে করতে। আপনার শিষ্টতার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ এবং আপনার নিরাপত্তার কালীকৃষ্ণর এই উদ্যোগ সত্যি প্রশংসাজনক। আমরা তাহলে আসি। এসো কালীকৃষ্ণ।‘ পানু রায় দরজা খুললেন। রেবা পানু রায়ের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো। বন্দুকটা ঘরের মাঝখানে টেবিলটার ওপর পড়ে রইলো। কালীকৃষ্ণ হঠাৎ রেবার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,’ রেবা, কাগজে পড়ার আগেই আমি তোমাকে জানিয়েছিলাম।

-তোমাকে অত ব্যাখ্যা করে বলতে হবে না। তুমি আমাকে যতটা ভাব আমি তার থেকে একটু বেশিই বুঝতে পারি। আমি তোমার অস্থির আচরণ এবং পরিস্থিতি সামলানোর আপ্রাণ চেষ্টা দেখতে ও বুঝতে পারছি। যাই হোক আমাদের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক আমরা মেনে চলতেই পারি।‘

কালীকৃষ্ণ পানু রায়কে সরিয়ে একটু এগিয়ে গিয়ে রেবার হাতটা নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। পানু রায় বললেন,’ তুমি যদি এখানে থাকতে চাও থাকতে পারো। আমি একটা ট্যাক্সি নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছি।‘ কালীকৃষ্ণ রেবাকে বললো,’আসি তাহলে। এই নিষ্ঠুর লোকটাকে আমি একটা গাড়ি বিক্রীর চেষ্টা করছি।‘

-বেশ। তাতে তোমার ক্ষমতা আরও বাড়বে। তোমার দরকারও আছে।

দু’জনে নিচে নেমে বাইরে যাবার দরজার দিকে একটু এগিয়েই হঠাৎ পানু রায় এক ঝটকায় ছোটকালীর হাতটা টেনে নিয়ে বললেন,’ চুপচাপ উল্টোদিকে চলো।‘ উল্টোদিকে খানিকটা এগিয়ে একটা সোফা দেখতে পেয়ে পানু রায় বসলেন এবং ছোটকালীকে পাশে বসিয়ে হাতে একটা বই ধরিয়ে দিলেন। ফিসফিস করে বললেন,’ একাগ্রমনে বইটা পড়তে থাকে ভান করো।‘ নিজে মুখের সামনে একটা খবরের কাগজ ধরে ফাঁক দিয়ে দেখলেন কেলো দারোগা বড় দরজাটা দিয়ে ঢুকে লিফটের দিকে এগোচ্ছে। সঙ্গে আর একজন অফিসার আর সেই ট্যাক্সি ড্রাইভারটা যাকে নিয়ে সেদিন বেরিয়েছিলেন। ওরা লিফটে ঢুকে যেতেই পানু রায় বললেন,’ চলো। আমরা যাই। আশা করি ওরা বাইরে দাঁড়ানো স্পোর্টস কারটা ওরা দেখেনি।‘

-কি যে বলেন মিঃ রায়। আপনি বলতে চান একজন ব্যাঙ্কার বোর্ড মিটিঙে বেসুরো কথাগুলো শুনতে পায়নি।

-শোন কৃষ্ণকালী, আমাকে যদি গাড়ি বিক্রী করতেই হয় তবে একটা পুরনো দিনের কালো সাধারণ গাড়ি জোগাড় করো।

-আমার কাছে আছে। চিন্তা করবেন না। আমি বুঝে গেছি আপনি এমন গাড়ি চাইছেন যা আলাদা করে যেন চিনতে না পারা যায়। বাইরে সাধারণ এবং শান্ত, ভিতরে অসাধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন।

পানু রায় হাসলেন।

তখন বেলা সওয়া দু’টো হবে। পানু রায়ের ফোন বেজে উঠলো।মনীষার ফোন। পানু রায় ফোন কানে দেবার সঙ্গে সঙ্গেই ওপার থেকে ভেসে এলো,’ পানু রায় বলছেন।‘

-মনীষা, বলো। কী ব্যাপার!

-ও, মিঃ রায়। আপনাকে ফোনে পেয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।দু’জন পুলিশ অফিসার আমাদের অফিসে এসেছে। বাইরে অপেক্ষা করছে। বলছে ওদের কাছে সার্চ ওয়ারান্ট আছে। ওরা নাকি রক্তমাখা জামাকাপড় বা অন্য কোনও জিনিস অফিসে লুকোনো আছে কিনা দেখবে। কে একজন শিবুলালের খুনে তল্লাশির জন্য এই খোঁজ। আমি কী করব?

-দু’টো চেয়ারের ধুলো ঝেড়ে ওদের ভেতরে ডেকে বসতে বলো। চা কফি কিছু চাইলে দাও। তারপর বলো যতক্ষণ দরকার তল্লাশি চালাতে। আর বলো যে যাবার সময় অফিস থেকে যদি কিছু নিয়ে যায় তার একটা রসিদ দিয়ে যেতে।

-ঠিক আছে। বুঝে গেছি।

মনীষা ফোন কেটে দিল। পানু রায় সুন্দরীকে জিজ্ঞাসা করলেন,’ জগাই বাড়ি আছে? তুমি ভেতরে গিয়ে ওকে একটু পাঠিয়ে দাও তো।‘ সুন্দরী বললো,’ হ্যাঁ, বাড়িতেই আছে। কোথাও যেতে হবে?’

-আমার শিবুলাল সম্বন্ধে কিছু খবর দরকার। জগাই কাঠমান্ডুতে অনেককে চেনে। দেখি কিভহু জোগাড় করতে পারা যায় কি না। না হলে একবার কাঠমান্ডু যেতে হতে পারে, অবশ্য যদি দরকার হয়।

-নিশ্চয়ই হবে। আমিও সঙ্গে যাব কিন্তু আগে থেকে বলে রাখলাম।

-ঠিক আছে, যাবে। জগাইকে পাঠিয়ে দাও।

সুন্দরী বাড়ির ভিতরে চলে গেল। কিছুক্ষণ বাদে জগাই ভেতরের দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে জিগ্যেস করলো,’ দাদু, আমাকে খুঁজছো? কোনও দরকার আছে?’

-হ্যাঁ , আছে তো বটেই। কিছু খবর জোগাড় করতে হবে।

-কী খবর দাদু?

-শিবুলাল রেগমির ব্যাপারে।

- শিবুলাল মানে কাল যে লোকটা খুন হয়েছে ?

-সুন্দরী সব বলেছে মনে হচ্ছে।

জগাই একটু হেসে বললো,’ ঐ আর কি! সুন্দরীর কাছে শুনে আমি একটু আধটু খোঁজ লাগিয়েছিলাম। লোকটা জুয়াড়ি ছিল।‘

- বড়সড় জুয়াড়ি?

-না, না, সেরকম বড়সড় কিছু নয়।

-দ্যাখ, আর কী খবর জোগাড় করতে পারিস। তোকে কয়েকটা কথা বলে রাখি তাতে তোর সুবিধে হবে। হয়ত সুন্দরীর কাছে শুনেছিস। তোর মনে আছে কিছুদিন আগে প্রসাদ কৈরালা বলে একজন খুন হয়েছিল।

-হ্যাঁ। বেশ মনে আছে। খুব হৈচৈ হয়েছিল। চোরাচালানকারী গুন্ডাদের হাতে খুন হয়েছিল।

-না তা নয়। মানে আমার মনে হয় তা নয় যদিও পুলিশ তাই বলেছিল এবং এ ব্যাপারে বিশেষ কিছু করেনি। যেহেতু শিবুলালের মত প্রসাদ কৈরালারও জুয়ার আড্ডায় যাতায়াত ছিল পুলিশ ওর মেয়ে রেবা কৈরালার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল।

-আমি জানি রেবা কৈরালার ব্যাপারটা তুমি দেখছো। আমি দেখছি কী কী খবর জোগাড় করা যায়। আমি বেশ কয়েকজনকে চিনি যারা এসব খবর জোগাড়ের ব্যাপারে আমাদের সাহায্য করতে পারবে।

-যা দরকার হয় কর। আমার শিবুলাল সম্বন্ধে সব খবর চাই, যা পাওয়া যায় তাড়াতাড়ি জোগাড় করে আমায় দিতে থাক। দিনে অন্তত দু’বার।

জগাই দরজা খুলে বেরিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই সুন্দরী এসে জানালো বাইরে রেবা অপেক্ষা করছে। পানু রায় বললেন,’ আসতে বলো।‘ সুন্দরী রেবাকে নিয়ে এলো। পানু রায় জিজ্ঞাসা করলেন,’ নতুন কোনও সমস্যা?’

-আপনারা বেরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশের লোকেরা এসেছিল।বন্দুকটা তখন টেবিলের ওপরেই ছিল। ওটা বালিশের তলায় রাখতে আমি ভুলে গিয়েছিলাম। পুলিশের লোকেরা আসতে আমি ওটার ওপর একটা স্কার্ফ ছুঁড়ে দিই।

-তারপর কী হলো?

-ওরা বন্দুকটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখলো। নাকের কাছে নিয়ে গিয়ে গন্ধ শুঁকলো। ওটাকে খুলে ফেললো। তারপর জিজ্ঞাসা করলো আমি ওটা কোথা থেকে পেলাম।

-আপনি কী বললেন?

-আমি বললাম মিঃ কে কে চৌধুরী আমাকে ওটা দিয়েছেন এই ভেবে যে যে আমার জীবন বিপন্ন এবং হয়তো ওটা আমার কাজে আসতে পারে।

- আপনি কি বলেছেন কোন কে কে চৌধুরী আপনাকে ওটা দিয়েছে? ছোট না বড়?

-কেন আমার বলা উচিৎ ছিল?

-জানিনা।

-দেখুন যে ভাবে পুরো ঘটনাটা ঘটে গেল তাতে আমি সেই মুহুর্তে এর থেকে বেশি কিছু ওদের বলতে পারিনি। আমাকে প্রায় থামিয়ে ওরা জিজ্ঞাসা করলো যে আমি মিঃ কে কে চৌধুরীকে শেষবার কখন দেখেছি?

-আপনি কী বললেন?

-আমি বললাম সেদিন সকালে। এটা শুনে ওনারা উত্তেজিত হয়ে কাকে ফোন করতে শুরু করলেন এবং কিছু না বলে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেলেন।

-ওনারা আর কিছু জিজ্ঞাসা করেনি?

-না, আর কিছু জিজ্ঞাসা করেনি।

-ওরা কিন্তু আবার আপনাকে প্রশ্ন করতে আসবে বা আপনাকে ডেকে পাঠাবে। আপনাকে তখন একটা কাজ করতে হবে।

-কী কাজ?

-আপনি বলবেন আপনি কোনও প্রশ্নের উত্তর দেবেন না যতক্ষণ না আমি সেখানে পৌঁছচ্ছি।

-তার মানে কী এই নয় যে আমি ওনারা যা বলছেন তা মেনে নিচ্ছি।

-ওরা মনে করতে পারে যে আপনি মেনে নিচ্ছেন। তাতে কিছু আসে যায় না এবং কিছু প্রমাণ হয় না। আপনি মুখ খুলবেন না। এমনকি কোনও সাধারণ প্রশ্ন যেমন আপনার জন্ম কোথায়, কোন স্কুলে পড়েছেন ইত্যাদি প্রশ্নেরও নয়। পারবেন?

-আপনি যদি আমায় বলেন তাহলে…

-আমি বলছি। কারণ কৃষ্ণকালী আমাকে বলেছে আপনার নিরাপত্তা নিশ্চিন্ত করতে।

-মিঃ রায়, গতকাল মিঃ চৌধুরী কাল রাত্রে আবার এসেছিলেন।

-ছোট না বড়?

-বাবা এসেছিলেন।

-এসে কী বললেন?

-বললেন উনি ঘুমোতে পারছেন না। উনি আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইলেন। তারপর অনেকক্ষণ ধরে আমার সঙ্গে কথা বললেন।

-উনি কখন ফিরলেন?

-সেটাই তো। উনি যখন ফিরলেন তখন প্রায় মধ্যরাত্রি।

-ঠিক আছে আপনি কোনও প্রশ্নের উত্তর দেবেন না। নিজেকে একটু দূরে দূরে রাখুন।

-তার মানে?

-সুন্দরী, রেবা যে পোশাকটা পরে আছেন ওটা তোমার ঠিক লাগছে?

সুন্দরী বললো,’ খুব সুন্দর ওটা। আমি তো ওনাকে বলতেই যাচ্ছিলাম।‘

পানু রায় বললেন,’ আমার লাগছে না।আমার মনে হচ্ছে এই পোশাকটা পরে ছবি তুললে ভালো আসবে না। একটা সাদা-কালো পোশাক যেটায় ভালো ছবি ওঠে কিনতে কী রকম সময় লাগবে? সামনেটা ভি কাট, সাদা স্ট্রাইপ যাতে ফিগারটা বোঝা যায়? ‘ সুন্দরী বললো,’খুব একটা সময় লাগার কথা নয়।‘ তারপর পানু রায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,’ তবে একটু সময় লাগতে পারে যদি একেবারে তুমি যেমন চাইছো তেমন পেতে হয়।‘ পানু রায় রেবাকে বললেন,’ আপনি এখন শপিংএ যাবেন। আপনার কাছে টাকা আছে?’ রেবা বললো,’হ্যাঁ, আছে। এখনই যেতে হবে?’

-হ্যাঁ, এখুনি। যখন শপিং করবেন তখন ভীষণ খুঁতখুঁতে ক্রেতার মত আচরণ করবেন। প্রচুর জিনিস নামাবেন। একটাও পছন্দ করবেন না। এত জ্বালাতন করবেন যে সেলসগার্ল যেন আপনাকে মনে রাখে। প্রচুর সময় নেবেন। দোকান বন্ধ হওয়ার আগে দোকান থেকে বেরোবেন না।

-তারপর?

-আমার সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ রাখবেন। আমাকে না পেলে সুন্দরীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখবেন। সুন্দরীর ফোন নম্বর আপনার কাছে না থাকলে নিয়ে নিন।

-আমি তাহলে পুলিশের সঙ্গে কথা বলবো না।

-না পুলিশের সঙ্গে নয়, কোনও রিপোর্টারের সঙ্গে নয় ,কারোর সঙ্গে নয়। আমার অনুপস্থিতিতে কাউকে কোনও প্রশ্নের উত্তর দেবেন না।

-ঠিক আছে, মিঃ রায়।

-আর একটা বন্দুক কোথায়?

-ওটা আমি লুকিয়ে রেখেছি। এমন জায়গায় লুকোনো আছে কেউ খুঁজে পাবে না।

-ঠিক আছে।আপনি শপিংএ ব্যস্ত হয়ে যান। এত ব্যস্ত হয়ে যান যে দোকান বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত আপনার কোনও সময় হবে না।

রেবা কৈরালা বেরিয়ে গেল। সুন্দরী জিজ্ঞাসা করলো,’ সাক্ষ্যপ্রমাণ গোপন করা অপরাধ নয়?’

-অবশ্যই অপরাধ। কিন্তু ক্লায়েন্টকে কথা না বলতে বলা কোনও অপরাধ নয়। জানো সুন্দরী, সবচেয়ে বড় অপরাধ হচ্ছে ক্লায়েন্টের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারা।

সুন্দরী পানু রায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে হাসিতে ফেটে পড়লো।