১৬
ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে আমেরিকান ভদ্রমহিলা যেখানে থাকেন, সেই গেস্ট হাউসে পৌঁছাতে গেলে মেট্রোতে যাতায়াত করবার প্রয়োজন নেই। ইংলিশ চার্চের কাছেই জায়গাটা, এভেন্যু জর্জ ফাইভের মত শান্ত এবং অভিজাত এলাকাতে। বের্নহার্ড সেখানে পৌঁছে কেয়ারটেকারকে ঘরের নাম্বারটা জানালো। তারপর কেয়ারটেকার ভদ্রমহিলাকে টেলিফোনে জানাল বের্নহার্ডের কথা এবং একজন কিশোর, চাপরাশিদের মত বাদামী রঙের পোশাক পরা, সে তাঁকে সঙ্গে করে নিয়ে গেল লিফটের দিকে। লিফট থেকে নেমে কিশোরটি মাথায় সোনালি পাড় বসানো টুপির প্রান্ত কেতাদুরস্ত ভঙ্গিতে ধরে নিঃশব্দে হেঁটে যেতে লাগল কার্পেট মোড়া এক লম্বা করিডোর ধরে। হাতে সঙ্গীতের ফাইলটি নিয়ে বের্নহার্ড ওই কিশোরকে অনুসরণ করল।
আমেরিকান ভদ্রমহিলার ঘরে গ্রামোফোন বেজে যাচ্ছে। তারা বেশ জোরে জোরে টোকা দিল দরজায়; তারপর মাথা নুইয়ে দরজায় কান পেতে শুনবার চেষ্টা করল যে ভিতর থেকে আর কোনও শব্দ আসে কি না। তৃতীয়বার টোকা দেবার পরেও যখন কোনও উত্তর এল না, তখন সেই কিশোর দ্বিধাগ্রস্তভাবে বের্নহার্ডের দিকে একবার তাকিয়ে দরজার হাতল চেপে ধরে জোরে জোরে দরজার পাল্লার নিচের দিকে ধাক্কা দিল। ভেতর থেকে কেউ চেঁচিয়ে উঠল, ‘কাম ইন, প্লিজ!’ কিশোর তখন দরজাটা পুরোপুরি খুলে ধরে একটুখানি বাও করে পিছিয়ে দাঁড়াল।
বের্নহার্ড ঘরের মাঝখানে একটু বিস্মিত এবং অপ্রস্তুত ভাবে দাঁড়িয়ে চারদিকে দেখতে লাগল।
ঘরের দেওয়ালগুলো সবুজ সিল্কে ঢাকা। উজ্জ্বল রঙের অনেকগুলো কুশন রাখা আছে একটা বড় ডিভানের উপর। গৃহসজ্জায় উজ্জ্বল রঙের ব্যবহারে বেশ আধুনিকতার ছাপ। ডিভানের পাশে একটা টেবিল। টেবিলের উপরে রাখা গ্রামোফোন থেকে বীভৎস শব্দের হুল্লোড় ভেসে আসছে। সেই শব্দগুলোর একটাও বের্নহার্ডের পক্ষে উচ্চারণ করা সম্ভব নয়।
একজন যুবতী উঠে দাঁড়াল, যে গ্রামোফোনের পাশে একটা সোফার উপরে এলিয়ে বসেছিল। হাসিমুখে বের্নহার্ডের দিকে তাকাল সে। বের্নহার্ডের মনে পড়ল যে সে শুনেছিল যে এই যুবতী জার্মান ভাষা বুঝতে পারে; “গুটেন আবেন্ড!”১ বলে একটু ঝুঁকে বাও করল সে।
‘ওঃ, কোনও ব্যাপার নয়!’ বলে উঠল ভদ্রমহিলা। হাসিতে ঝলমলে চোখমুখের মত তাঁর কণ্ঠস্বরটিও বেশ মানানসই ধরনের খুশি ঝলমলে। তারপর সে ঘুরে দাঁড়িয়ে বিলি বলে একজন যুবককে ডাকল। বিলিকে বের্নহার্ড প্রথমে খেয়াল করেনি। বিলি জার্মান বলতে পারে না; কিন্তু সে যথেষ্ট উষ্ণভাবে বের্নহার্ডের সঙ্গে করমর্দন করল। হাত মেলানোর সময়ে বের্নহার্ড বুঝতে পারল যে বিলির গায়ে বেশ জোর এবং বিলিকে দেখতেও খুব বলশালী। তাঁকে দেখে ফ্যাশন ম্যাগাজিনের বিশাল কাঁধ আর সরু নিতম্বের যুবক মডেলদের কথা মনে পড়ল বের্নহার্ডের। বিলির পরনে চওড়া ঢিলা ট্রাউজার, সোয়েটারের উপরে মোটা জ্যাকেট, হালফ্যাশানের পোশাক মডেলের মত চেহারায় বেশ মানিয়েছে।
কিন্তু বিলির সঙ্গে সত্যিই সেরকম কোনও ব্যাপার নেই। সবার আগে এই যুবতী ভদ্রমহিলা, বেটসির সঙ্গেই বের্নহার্ডের কাজ। বেটসি আগ্রহভরে বের্নহার্ডের হাত থেকে ফাইলটা নিয়ে নিল এবং অমায়িকভাবে জিজ্ঞাসা করল যে সে তার গা থেকে গরম কোটটা খুলে রাখতে চায় কি না।… ‘হি ইজ কোয়াইট আ চাইল্ড!’ তার সম্বন্ধে হয়তো বলল, তারপর আবার জিজ্ঞেস করল যে সে ইংরেজি বোঝে কি না।
বের্নহার্ড নিঃশব্দে মাথা নাড়ল ইতিবাচকভাবে। ভদ্রমহিলার সোফা ও গ্রামোফোনের উল্টোদিকে রাখা একটা বড় আরামকেদারাতে বসল সে। বেটসি তার সামনে সিগারেট, চকলেট, পোর্ট ওয়াইন, ছোট কেক এসব সাজিয়ে গুছিয়ে রেখে দিল। বেটসি যখন এগুলো গোছাচ্ছিল, তখন সে আরেকটু সামনে থেকে এই যুবতী ভদ্রমহিলাকে নিরীক্ষণ করবার সময় পেয়েছিল। বেটসির বয়স একেবারেই বেশি নয় এবং সে খুবই সুন্দরী। তাঁর দাতগুলো এত ঝকঝকে সাদা যে বের্নহার্ডের টুথপেস্টের বিজ্ঞাপনের কথা মনে পড়ল। বিলিকে দেখে অবশ্য সঙ্গে সঙ্গেই তার ফ্যাশন ম্যাগাজিনগুলোর কথা মনে পড়েছিল।
যারা বিজ্ঞাপন বানায়, নির্ঘাত তারা শুধু আমেরিকান মডেলদের আদর্শ ভেবেই বানায়। বের্নহার্ড ভাবছিল… ভাবতে ভাবতে বেশ অপ্রতিভভাবে সে একটা সিগারেট ধরাল।
বেটসির চোখে মুখে সবসময় একটা খুশি ঝলমল করছে। খুশি ছাড়া আর বিশেষ কোনও সূক্ষ্ম অভিব্যক্তি বের্নহার্ডের নজরে এল না। যাই হোক, বেটসির লাল রঙে রাঙানো বাঁকা ঠোঁটের সঙ্গে এই খুশি খুশি ব্যাপারটা বেশ ভাল মানিয়েছে। মনে হচ্ছে যেন এক শিশু আনন্দে বিস্ময়ে মুখ অল্প খুলে হাঁ করে আছে। শুধু ঠোঁট নয়, বেটসির হাতের নখগুলোও লাল রঙে রাঙানো। মনে হচ্ছে সাদা সাদা হাতের আঙ্গুলের ডগায় লাল লাল ফোঁটা দেওয়া আছে। বের্নহার্ডের স্বভাবই হল মানুষের হাতের দিকে তাকিয়ে হাতের গড়ন, আঙুলের আকার এসব খুঁটিনাটি লক্ষ্য করা। ফলে মানুষের হাতের দিকে তাকিয়ে মানুষ সম্বন্ধে একটা ধারণা তৈরি করার ব্যাপারে সে বেশ আত্মবিশ্বাসী। এরই মধ্যে অবশ্য সে বিলির হাতগুলিও একঝলক দেখে নিয়েছে। বিলির হাত বেশ বড়সড়, শক্তিশালী। যদিও আঙুলগুলো সেরকম সুন্দর নয়, ডগার দিকটা একটু থ্যাবড়া ধরনের… তবে আঙুলগুলোর মধ্য দিয়ে বেশ ইতিবাচক লক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছে। বিলির হাত দেখে মনে হয় যে মানুষটা ভাল, সরলসোজা। বেটসির হাতগুলো খুব সাদাটে এবং দেখে মনে হচ্ছে যে তার হাতের নিয়মিত পরিচর্যা করে সে। হাতের উপরের ভাগ সরু, সুগঠিত এবং দৃঢ় হলেও আঙুলগুলি ভারি কোমল। না চাইলেও ইনেসের হাতের কথা মনে পড়ে বের্নহার্ডের। ইনেসের হাতও ভারি সুন্দর আকারের এবং সুগঠিত। অবশ্য এভাবে তুলনা করা একেবারে অর্থহীন। তাই বের্নহার্ড নিজের পর্যবেক্ষণ চালিয়ে যায় এবং এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে বেটসি একজন ভারি লাবণ্যময়ী, স্বাস্থ্যবতী, সুন্দরী যার পায়ের গড়ন বেশ দৃঢ় এবং সুগঠিত হলেও সে এক নরমশরম যুবতী। কাঁধের গঠন গোল ধরনের, বালিকার মত ভরাট গাল এবং গোল চিবুক।
বের্নহার্ডের মনে এই গায়িকা ভদ্রমহিলা সম্বন্ধে একটা অন্যরকম চিত্র আঁকা হয়েছিল। কারণ, আমেরিকান মহিলাদের সে আগে দেখেনি।
সঙ্গীতশিক্ষার সূচনা হিসেবে বের্নহার্ড সেদিন প্রস্তাব দিয়েছিল যে বেটসি একটা গান গাইবে এবং সে বাজাবে। দেখা গেল যে ওই ঘরের মধ্যেই একটা বিশাল পিয়ানো আছে। সবুজ সিল্কে ঢাকা দেওয়াল শোভিত ঘরটার মধ্যে ঠেসেঠুসে এক কোণে রাখা আছে বাদ্যযন্ত্রটা, যদিও সেটা এখন ফুলদানি রাখবার স্ট্যান্ড হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। নানা চেষ্টাচরিত্র করে ফুলদানি এবং ফুলের বোকেগুলি সরিয়ে পিয়ানোর ঢাকা খোলা হল।
বেটসি ‘ডি ফোরেল্লে’২ গাইতে চেয়েছিল। তবে বের্নহার্ড বারণ করেছিল। সে কোনও সহজ গান দিয়ে প্রথম দিন শুরু করতে চেয়েছিল। কিন্তু বেটসি সেসবে কর্ণপাত করল না। বেটসি ভয়াবহ ভুলভাল সুরে গাইল; একটা পর্যায়ে যে কারো মনে হতে পারে যে গানটা গায়িকার নিজেরই রচনা। তবে বেটসির কণ্ঠস্বর সুন্দর, পরিষ্কার এবং তাল, লয় ইত্যাদির জ্ঞান বেশ পাকা। কিছুক্ষণ অভ্যাস করবার পরে বেটসি ক্লান্ত হয়ে পড়ল এবং প্রস্তাব দিল বাইরে কোথাও গিয়ে কিছু খেয়ে আসবার জন্য। বিলি এবং বের্নহার্ড দু’ জনেই যেতে রাজি হল। রাত প্রায় ন’টা বাজে। অবশেষে বের্নহার্ড আর নিজের কৌতূহল সংবরণ করতে না পেরে বেটসিকে জিজ্ঞাসা করেই ফেলল যে তার কোনও পোষা বাঁদর আছে কি না। সে কথা শুনে বেটসি ভীষণ খুশি হল। চানঘরের দরজা খুলে সে ভারি নরম স্বরে ডাক দিল… ‘ক্ন্যাগিইই!’ সঙ্গে সঙ্গে শরীরে আটকানো একটি শিকলের ঝনঝন শব্দের প্রচণ্ড কোলাহলের মধ্য দিয়ে একটি ছোট, কুৎসিত প্রাণী ঘরে প্রবেশ করল। এক উড়ন্ত দানবের মত কুশনগুলির উপর দিয়ে, গ্রামোফোন মেশিনের উপর দিয়ে বেশ কয়েকটা ফুলদানি উল্টে ফেলে লাফিয়ে গেল সে। তারপর ভয়ে ভীত হয়ে একটা চেস্ট অফ ড্রয়ারের পেছনে গিয়ে লুকিয়ে পড়ে অবশেষে আবার চানঘরে ঢুকে গেল প্রাণীটি। মুহূর্তের মধ্যে সবুজ সিল্কে ঢাকা দেওয়ালে সজ্জিত ঘরটা একেবারে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল।
বেটসি আপ্লূত ভঙ্গিতে বারবার বলতে লাগল, … ‘কী মিষ্টি! কী সুন্দর না ও?’ তারপর আবেগের বশে এত হাসতে লাগল যে তার চোখ থেকে আনন্দাশ্রু গড়াতে শুরু করল। এসব কাণ্ডকারখানা দেখে বের্নহার্ড এতটাই বিস্মিত হয়েছিল যে অনেকক্ষণ পর্যন্ত কোনও কথা বলতে পারছিল না সে।
(চলবে)
১. জার্মান ভাষায় “গুটেন আবেন্ড!” শব্দবন্ধের অর্থ শুভ সন্ধ্যা।
২. ‘ডি ফোরেল্লে’… ঊনবিংশ শতকের শুরুর দিকে অস্ট্রিয়ান সঙ্গীতজ্ঞ ফ্রান্জ শুবার্ট রচিত একটি সঙ্গীত।

No comments:
Post a Comment