প্রবন্ধ - দিলীপ মজুমদার











প্রাগৈতিহাসিক রোমিও জুলিয়েত ? ৬ হাজার বছর আগের প্রেমের দৃশ্য ? বিশ্বাস না হলে চলুন যাই উত্তর ইতালির মানতুয়া শহরের কাছে ভালদারো গ্রামে । দেখে আসি এক অবিশ্বাস্য দৃশ্য । মানতুয়ার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আছে । জগতের শ্রেষ্ঠ নাট্যকার উইলিয়াম শেক্সপীয়ার বিখ্যাত করে দিয়ে গেছেন সেই শহরকে । মানতুয়ার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ১৫৯০ সালে লেখা শেক্সপীয়ারের নাটকের পাত্র-পাত্রী রোমিও জুলিয়েতের নাম । নাটকের গল্পটা একটু মনে করুন । টাইবাল্টকে হত্যা করার জন্য শাস্তি দেওয়া হয় রোমিওকে । সে শাস্তি হল নির্বাসন । ভেরোনা থেকে পঁচিশ মাইল দূরে মানতুয়াতে পাঠিয়ে দেওয়া হয় রোমিওকে । পরিবারের সকলে জুলিয়েতকে মৃত ভেবে তাকে পারিবারিক সমাধিতে সমাধিস্থ করে । রোমিও ভৃত্যের কাছে খবর পায় যে জুলিয়েত মৃত । সে মানতুয়া থেকে ছুটে আসে ভেরোনায় । সংগ্রহ করে নেয় বিষ । জুলিয়েত ছাড়া জীবন তার বৃথা । সমাধিগৃহে দেখা হয়ে যায় প্যারিসের সঙ্গে । সে ছিল জুলিয়েতের পাণিপ্রার্থী । রোমিওর হাতে মারা যায় প্যারিস । জুলিয়েতকে চুম্বন করে রোমিও বলে :

Come , bitter conduct, come, unsavory guide !

Though desperate pilot, now at once run on

The dashing rocks thy seasick weary bark !

Here’s to my love –তারপর বিষপান করে রোমিও মারা যায় । আচ্ছন্নতা থেকে জেগে উঠে জুলিয়েত যখন দেখে তার রোমিও মৃত্যুবরণ করেছে , তখন রোমিওর ছুরি দিয়ে সে আত্মহত্যা করে । একই সমাধিতে শায়িত থাকে তারা ।

৬ হাজার বছর আগের প্রেমের দৃশ্য দেখতে হলে যেতে হবে ন্যাশনাল আর্কিওলজিক্যাল মিউজিয়াম অব মানতুয়ায় । ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাড়ি তৈরির জন্য মাটি খুঁড়তে গিয়ে ভালদারো গ্রামে পাওয়া যায় এক প্রাচীন কবরখানা । খবর যায় প্রত্নতাত্ত্বিকদের কাছে । মারিয়া মেনেত্তির নেতৃত্বে আসেন একদল প্রত্নতাত্ত্বিক । মাটি খুঁড়ে তাঁরা ৩০টি কবর আবিষ্কার করেন । ২৯টি কবরে ছিল এক একজনের কঙ্কাল । ব্যতিক্রম শুধু একটি কবর । সে কবরে পাওয়া গেল ২জনের কঙ্কাল ।

ব্যতিক্রমী সেই কবরে যে ২টি কঙ্কাল পাওয়া গেল , তাদের বিশেষত্ব আছে । পরীক্ষা করে দেখা গেল তাদের একজন নারী আর অন্যজন পুরুষ । পুরুষের বয়স আনুমানিক ২০ , নারীর বয়স ১৮ । উচ্চতা ৫ ফুট। পুরুষটি আছে বামদিকে , নারী ডানদিকে । পুরুষের গলার কাছে পাথরের তিরের অগ্রভাগ দেখা যায় । নারীটির উরুর কাছে পাথরের তরবারি, পেটের কাছে ছুরি । দু’জন দু’জনকে হাত ও পা দিয়ে আঁকড়ে আছে। এত বছর পরেও শিথিল হয় নি আলিঙ্গন । এ যেন ‘আমরা দু’জন ভাসিয়া এসেছি যুগল প্রেমের স্রোতে / আদিম কালের অনদি উৎস হতে’ ।

কঙ্কাল দুটি আবিষ্কৃত হবার পরে ২০০৭ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ লিখল : ‘প্রি হিস্টোরিক রোমিও জুলিয়েত ডিসকাভার্ড’ ; রসিকতা করে ‘ডেইলি মেল’ লিখল : ‘ এ যেন শেক্সপীয়ারের গল্পের চমৎকার প্রতিধ্বনি’ । প্রত্নতাত্ত্বিক মেনোত্তি একে ভালোবাসার স্মারক বলেই মনে করেন : ‘It was a very emotional discovery . From thousands of years ago we feel the strength of this love . Yes, we must call it love.’

প্রগৈতিহাসিক যুগের এই প্রেমিক-প্রেমিকার মৃত্যুর কারণ নিয়ে নানা মুনির নানা মত । কারও মতে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়ে মাটি চাপা পড়ে এদের মৃত্যু হয় । কেউ বলেন এদের হত্যা করে কবর দেওয়া হয়েছে । হত্যার কারণ সম্বন্ধে অবশ্য কোন প্রমাণ দেওয়া হয় নি । আবার কেউ বলেন প্রবল শীতের ফলে আলিঙ্গনাবদ্ধ অবস্থায় এদের মৃত্যু হয়েছে ।

পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য চার বছর কঙ্কাল দুটিকে গবেষণাগারে রাখা হয়েছিল । ২০১১ সালে তাদের স্থানান্তরিত করা হয় ন্যাশনাল আর্কিওলজিক্যাল মিউজিয়াম অব মানতুয়ায় । কিন্তু মানতুয়ার মানুষ এতে খুশি নন । প্রাগৈতিহাসিক এই যুগলের জন্য তাঁরা চান একটা নিজস্ব আবাস । এই কাজ করার জন্য তাঁরা গড়ে তুলেছেন একটা সংগঠন , যার নাম ‘অ্যাসোসিয়েশন অব লাভার্স’ । সংগঠনের সভাপতি সিলভিয়া বাগনোলি । নিজেদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ করার জন্য তাঁরা শুরু করে দিয়েছেন তহবিল সংগ্রহ ।

No comments:

Post a Comment