গল্প - মনোজ কর





















চতুর্দশ পর্ব

সিরাজের পলায়ন এবং শেষ পরিণতি

যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে সারারাত ঘোড়া চালিয়ে সিরাজ মুর্শিদাবাদ এসে পৌঁছোয় পরেরদিন সকাল ৮টায়। বেশ কিছু সৈনিক তার আগেই পালিয়ে এসেছে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে। কয়েকজন বিশ্বাসী সৈন্য এবং প্রহরীদের সঙ্গে নিয়ে সিরাজ প্রথমে গেল তার প্রাসাদ হীরাঝিলে। প্রাসাদে পৌঁছে সিরাজ বুঝতে পারল যে ক্ষমতা হারালে মানুষ কত অসহায় হয়ে পড়ে। যে সব সেনাপ্রধানরা একদিন তার কথায় উঠত বসত আজ তারা কেউ সিরাজের অনুরোধে কর্ণপাত করলো না। সিরাজ অনুরোধ করেছিল যেটুকু সময়ে সে সামান্য বিশ্রাম নিয়ে তার পরবর্তী পদক্ষেপ স্থির করছে সেটুকু সময়ে যেন তার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু পরাজিত নবাবের কথায় কান দেবার সময় কার আছে? একদা তারই বেতনভুক সেনাপতিরা সিরাজকে বিপদের মধ্যে ফেলে যে যার নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল। উপায় না দেখে সিরাজ তার শ্বশুরমশাই মহম্মদ ইরাজ খানের পদতলে নিজের রাজমুকুট নামিয়ে রেখে অনুরোধ করল যে রাজমুকুটের বিনিময়ে যদি তিনি কিছু সৈন্যসামন্ত জোগাড় করে তাকে একটু নিশ্চিন্ত বিশ্রামের এবং প্রয়োজন পড়লে সম্মানের সঙ্গে রাজপ্রাসাদ ছেড়ে চলে যাওয়ার ব্যবস্থা করা যায় তবে সে বাকি জীবন তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে। জামাতার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে নিজের পথে রওনা দিল মির্জা ইরাজ। উপায়ান্তর না দেখে সিরাজ নির্দেশ দিল যে তার নিরাপত্তার জন্য প্রাসাদের পাহারার কাজে যারা রাজি হবে তাদের যেন কোষাগার থেকে তাদের চাহিদামত অর্থ বিনাপ্রশ্নে দিয়ে দেওয়া হয়। দেখতে দেখতে কোষাগারের সামনে সৈনিকদের ভিড় জমে গেল। সিরাজ হুকুম দিল সমস্ত সৈনিককে যেন তিনমাসের বেতন অগ্রিম দিয়ে দেওয়া হয়। দরবারের অনেকে পরামর্শ দিল যে ইংরেজদের কাছে আত্মসমর্পণ করাই এই মুহূর্তে সঠিক সিদ্ধান্ত। সিরাজ রাজি হলনা। সে বললো আত্মসমর্পণ বিশ্বাসঘাতকতার নামান্তর। আত্মসমর্পণ করার হলে অনেক আগেই তা করা যেত। দরবার ভেঙে দিল সিরাজ। জানালো যে কারও পরামর্শের কোনও দরকার নেই তার। পরবর্তী পদক্ষেপের সিদ্ধান্ত সে একাই নেবে কিন্তু কোনওমতেই আত্মসমর্পণ সে করবে না। দরবার থেকে বেরিয়ে সিরাজ হারেমে পৌঁছে জানাল যে সকলে যেন প্রাসাদ ছাড়ার জন্য তৈরি হয়ে নেয়। নিজেদের অলংকার এবং মূল্যবান সামগ্রী ছাড়া আর কিছু যেন সঙ্গে না নেয়। তারপর ভগ্ন্যোদ্যম বিশ্বাসী সেনাপতি মোহনলালকে ডেকে তাদের সকলকে এবং পঞ্চাশটি হাতিতে আসবাব এবং মালপত্র নিয়ে রাজপ্রাসাদ ছেড়ে পূর্ণিয়া চলে যেতে বলল। সেদিন গভীর রাতে সিরাজ তার প্রধান মহিষী লুতফুন্নিসা, তার কয়েকজন পরিচারিকা, হারেমের অতিবিশ্বস্ত এক খোজা এবং বহু মূল্যবান রত্ন এবং রত্নালঙ্কার সঙ্গে নিয়ে মুর্শিদাবাদের ২০কিমি উত্তর-পূর্বে ভগবানগোলার উদ্দেশ্যে রওনা দিল। আলিবর্দি খানের আমলে প্রয়োজনে গঙ্গা দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার জন্য যে ঘাট নির্মাণ করা হয়েছিল সেই ঘাট থেকে নৌকাযোগে ভগবানগোলার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলো সিরাজ। পিছনে পড়ে রইল প্রাসাদ হীরাঝিল আর বিস্তীর্ণ সাম্রাজ্য।

মিরজাফর সেদিন মুর্শিদাবাদ পৌঁছেছিল সন্ধ্যা নাগাদ। হয়ত সেই কারণেই সিরাজকে মুর্শিদাবাদ ছাড়ার ব্যাপারে তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল। মুর্শিদাবাদ পৌঁছেই মিরজাফর সিরাজের খোঁজ করতে দিকে দিকে সৈন্য পাঠাল। মিরজাফর চাইলে আরও আগে মুর্শিদাবাদ পৌঁছতে পারত এবং তাতে হয়ত সিরাজকে আরও তাড়াতাড়ি অর্থাৎ মুর্শিদাবাদ ছাড়ার আগেই বন্দি করা যেত। কিন্তু মিরজাফর হাওয়া না বুঝে মুর্শিদাবাদ আসতে চায়নি। সাধারণ মানুষ তাকে সমর্থন করছে না করছে না সেটা আন্দাজ করার চাইতেও মিরজাফরের অনেক বেশি দরকার ছিল মানুষ তখনও সিরাজের প্রতি সহানুভূতিশীল কিনা সেটা আন্দাজ করা। এক সাধারণ মানুষের বেশে মুর্শিদাবাদ ছাড়তে হলো সিরাজকে। পরেরদিন সকাল আটটায় মিরজাফর ক্লাইভকে জানাল যে সিরাজ প্রাসাদে নেই কিন্তু যে ভাবেই হোক তাকে খুঁজে বের করে ক্লাইভের হাতে তুলে দিতে সে বদ্ধপরিকর। কিন্তু সন্ধ্যাবেলা মিরজাফরের কাছ থেকে আর একটি চিঠি এসে পৌঁছলো ক্লাইভের কাছে। তাতে লেখা আছে সিরাজ প্রাসাদেই আছে এবং তাকে গ্রেপ্তার করার জন্য ক্লাইভ যেন সৈন্যবাহিনী পাঠানোর আদেশ দেয়। পরেরদিন ক্লাইভের উপস্থিতিতে তাকে বন্দি করে তার হাতে তুলে দেওয়া হবে।

মিরজাফরের উপর কোনও সময়েই সম্পূর্ণ আস্থা ছিল না ক্লাইভের। পলাশির যুদ্ধে মিরজাফরের নিষ্ক্রিয়তা তাকে মিরজাফর সম্বন্ধে আরও সন্দিহান করে তুলেছিল। ক্লাইভের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল সিরাজকে সরিয়ে ব্রিটিশের অনুগত এক পুতুল নবাবকে সিংহাসনে বসানো। সেই পুতুল নবাব মিরজাফর। মিরজাফরের ব্যাপারে যাবতীয় অস্বস্তি দূরে সরিয়ে রেখে বিশ্বস্ত অফিসার স্ক্র্যাফটনকে পাঠাল মিরজাফরের কাছে। সঙ্গে পাঠাল একটি চিঠি যাতে লেখা আছে,’ যুদ্ধজয়ের জন্য আপনাকে অভিনন্দন। এই জয় আমার নয় , আপনার। আপনি যদি কাল দাউদপুরে আসেন এবং আমার বিজয়যাত্রার সঙ্গী হন তাহলে আমি খুব আনন্দিত হবো। মিঃ স্ক্র্যাফটন আমার পক্ষে আপনাকে অভিনন্দন জানাবেন। সর্বসমক্ষে আপনাকে নবাব ঘোষণা করার সৌভাগ্যজনক মুহূর্তের অপেক্ষায় রইলাম।‘ পরের দিন সকালে স্ক্র্যাফটনকে মুর্শিদাবাদ পাঠানো হল মিরজাফরকে সঙ্গে করে দাউদপুরে ক্লাইভের তাঁবুতে নিয়ে আসার জন্য। মিরজাফরের মনে হলো এত সব আয়োজন তাকে খতম করার জন্য নয়তো! সে নিজেও জানে পলাশির যুদ্ধে সে সিরাজকে সাহায্য করেনি কিন্তু সক্রিয়ভাবে ব্রিটিশদেরও সাহায্য করেনি। তা সত্ত্বেও তাকে নবাবের পদে অভিষিক্ত করার লোভ দেখিয়ে ডেরায় ডেকে নিয়ে গিয়ে ক্লাইভ তাকে একেবারে সরিয়ে দিতে চাইছে না তো ? একরাশ ভয় আর সন্দেহ বুকে নিয়ে মিরজাফর হাতির পিঠে চেপে ক্লাইভের উদ্দেশ্যে রওনা দিল। সঙ্গে চললো তার ছেলে মির মিরান।

ব্রিটিশ তাঁবুতে প্রবেশ করে হাতির পিঠ থেকে নিচে নামতেই বন্দুকধারী সৈন্যরা তাদের বন্দুক নামিয়ে মিরজাফরকে অভিবাদন জানাল। মিরজাফরের অপরাধী মন। তার মনে হলো এসব তাকে হত্যা করবার প্রস্তুতি। ভয় গেল যখন ক্লাইভ এসে তাকে আলিঙ্গন করলো এবং স্যালুট জানালো। তারপর দু’জনের মধ্যে প্রায় একঘন্টা আলোচনা চললো। ক্লাইভ তাকে মুর্শিদাবাদে ফিরে গিয়ে সিরাজ যাতে পালিয়ে যেতে না পারে তা নিশ্চিত করতে এবং দেখতে যে এই সুযোগে সিরাজের কোষাগার এবং ধনসম্পত্তি যাতে লুন্ঠিত না হয়ে যায়। রাজনৈতিক চক্রান্ত ফলপ্রসূ হয়েছে বলা যেতে পারে। এবার চক্রান্তের অর্থনৈতিক দিকটা দেখার সময়। মিরজাফর মুর্শিদাবাদ ফিরে গেল।

ওদিকে সিরাজ ভগবানগোলা পৌঁছে সেখান থেকে নৌকা বদল করে তার একান্ত অনুগত প্রাক্তন ফরাসি প্রধান ল-এর উদ্দেশ্যে রওনা দিল। একসময় নিজে ব্রিটিশদের রোষ থেকে বাঁচার জন্য সিরাজ এই ল-কে কাশিমবাজার থেকে চলে যেতে বলেছিল। সিরাজের উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশদের ভয়ে লুকিয়ে থাকা ল-এর সঙ্গে দেখা করে একত্রে পাটনার উদ্দেশ্যে রওনা দেবে। সেখানকার গভর্নর রামনারায়ণ এত কিছুর পরেও সিরাজের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও আনুগত্য প্রদর্শনে কার্পণ্য করেনি। এর কারণ সম্ভবত রামনারায়ণের তীব্র ব্রিটিশবিরোধিতা।

সন্দেহমনস্ক ক্লাইভ মুর্শিদাবাদে প্রবেশ করার ঝুঁকি নিতে চাইলো না। শহরের বাইরে দলবল নিয়ে পৌঁছনোর পর ওয়াটস এবং জন ওয়ালশকে একশ সেপাই সহযোগে মিরজাফরের কাছে পাঠিয়ে শহরের বাইরে অপেক্ষা করতে থাকলো। ওয়াটস এবং ওয়ালশ বিকাল তিনটে নাগাদ মিরজাফরের কাছে উপস্থিত হলো। তার একটু পরেই বিশাল ব্রিটিশবাহিনী সিরাজের খোঁজে বেরিয়ে পড়ল। সিরাজের পালিয়ে যাওয়ার খবর শহরবাসীদের গুজব মনে হলেও ওয়াটস এবং ওয়ালশের সসৈন্যে শহরে আসা দেখে শহরবাসীদের বুঝতে অসুবিধে হলোনা যে ক্ষমতা সিরাজের হাত থেকে ব্রিটিশদের হাতে চলে গেছে। কিন্তু ব্রিটিশরা তখনও খাতায় কলমে রাজত্বের অধিকার পাওয়া থেকে অনেক দূরে।

চক্রান্তকারীদের পরবর্তী পদক্ষেপ হলো যে শূন্যস্থান সিরাজ নিজে তৈরি করে গেছে তা অবিলম্বে পূরণ করা। মিরজাফরকে বসানো হবে বাংলা, বিহার , উড়িষ্যার মসনদে। মিরজাফর অনতিবিলম্বেই নিজেই নিজেকে নবাব বলে ঘোষণা করে জামাতা মিরকাশিম এবং রাজমহলের ফৌজদার ভাই মিরদাউদকে সিরাজের সন্ধানে পাঠিয়ে দিল। মিরজাফর জানতো যে ক্ষমতাহীন সিরাজকে বন্দি করা শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষা। ২৫শে জুন বিকালে ধরা পড়ল মোহনলাল এবং তার সঙ্গে পলায়নরত সিরাজের কয়েকজন আত্মীয়। মিরজাফর ক্লাইভকে জানাল যে মোহনলাল এবং তার পুত্রকে বন্দি করা হয়েছে। সিরাজের খোঁজ চলছে এবং আশা করা যাচ্ছে খুব তাড়াতাড়ি সিরাজকে বন্দি করা যাবে।

সিরাজের নৌকা তিনদিনব্যাপী অবিশ্রাম যাত্রার পর রাজমহলের কাছেই একটি ঘাটে নোঙ্গর করলো। ক্লান্ত এবং অভুক্ত মাঝিমাল্লারা এবং সিরাজের সঙ্গীরা অর্থাৎ স্ত্রী, কন্যা এবং অন্যান্য পরচারিকারা গ্রামের এক পরিত্যক্ত বাগানে আশ্রয় নিল। দানা শাহ নামে এক ফকির ঐ গ্রামে অভুক্ত পথযাত্রীদের এবং নৌকাযাত্রীদের বিশ্রাম এবং খাবারের ব্যবস্থা করত। আর সকলের মত দানা শাহ সিরাজ এবং তার সহযাত্রীদের জন্য খিচুড়ি এবং বিশ্রামের ব্যবস্থা করতে গিয়ে লক্ষ্য করলো যে এদের পরণের বসন মলিন হলেও পায়ের জুতো রাজকীয়। দানা শাহের মনে সন্দেহের উদ্রেক হলো। মাঝিদের সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারলো এরা কারা। প্রায় একবছরেরও কিছু সময় আগে নিজের ভাই সওকত জঙ্গের সঙ্গে যুদ্ধের সময় কোনও এক অজ্ঞাতকারণে এই ফকিরের কান এবং নাক কেটে নেওয়ার আদেশ দিয়েছিল সিরাজ। এমন ঈশ্বরপ্রেরিত সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইলো না দানা শাহ। ফকির নবাব সিরাজকে সাদর আমন্ত্রন জানিয়ে পরম যত্নে সুস্বাদু খিচুড়ি পরিবেশন করার আগেই সিরাজের এখানে আসার খবর গোপনে পাঠিয়ে দিল মিরদাউদের কাছে। মিরদাউদের বাহিনী তখন রাজমহলের আশেপাশেই ছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই মিরদাউদের বাহিনী এসে সিরাজ ও তার সঙ্গীদের বন্দি করে রাজমহলে নিয়ে এল। সেখান থেকে মিরকাশিম সিরাজকে নিয়ে এল মুর্শিদাবাদে।সিরাজের কাতর প্রার্থনায় কেউ কর্ণপাত করলো না। পথের মধ্যে মিরকাশিম লুতফুন্নাসার উপর কখনও ভালো কথায়, কখনও ভয় দেখিয়ে চাপ সৃষ্টি করতে আরম্ভ করলো। জানতে চাইলো কোথায় লুকোনো আছে সেই মহামূল্যবান রত্নভান্ডার যে রত্নভান্ডার সিরাজ প্রাসাদ ছাড়ার সময় সঙ্গে নিয়ে বেরিয়েছিল। ওদিকে মিরদাউদ সিরাজের পরিচারিকাদের উপর অত্যাচার শুরু করলো রত্নভান্ডারের খোঁজ পাওয়ার জন্য। খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লুট হয়ে গেল সিরাজের রত্নভান্ডার যার বেশিরভাগটাই গেল মিরকাশিম আর মিরদাউদের দখলে। ২৬শে জুলাই লন্ডনে কোর্টকে ক্লাইভের লেখা চিঠি অনুযায়ী আর কয়েকঘন্টা দেরি হলে সিরাজকে বন্দি করা সহজ হতো না। সিরাজ বন্দি হবার প্রায় তিনঘন্টা পরে ল এবং তার দলবল রাজমহলে পৌঁছোয়। সেখানে সিরাজের বন্দি হওয়ার খবর শুনে দ্রুত পাটনার দিকে রওনা দেয়। ল পরবর্তী কালে জানতে পারে যে পলাশির যুদ্ধের আগে থেকেই রাজমহলের ফৌজদার মিরদাউদ সিরাজের পত্রবাহকদের আটক করতে শুরু করে। মুর্শিদাবাদ ফিরে আসার অনুরোধ করে ১৩ই জুন ল’কে লেখা চিঠি পৌঁছোয় ২২শে জুন অর্থাৎ পলাশির যুদ্ধের ঠিক আগের দিন।সিরাজকে লেখা ল’ এর চিঠি সিরাজের কাছে পৌছোয়নি।

সিরাজকে মুর্শিদাবাদে নিয়ে আসা হয় ২রা জুলাই।সিরাজকে বন্দি করা হবে না নির্বাসনে পাঠানো হবে না হত্যা করা হবে সে বিষয়ে একঘন্টাব্যাপী আলোচনায় কিছু স্থির করা গেল না। এর আগের দিন অর্থাৎ ১লা জুলাই জগৎশেঠের সহায়তায় রাজকোষাগার অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছিল ক্লাইভের লোকজনেরা। ৪ঠা জুলাই পাঠানো হলো প্রথম দফার অর্থভান্ডার যার পরিমাণ ছিল ৭৫লক্ষ টাকা। এই টাকার ভাগ কে কত পাবে তা নির্ধারিত ছিল আগে থেকেই। জলবাহিনী, স্থলবাহিনীর সৈনিক এবং সেনাপতিরা , কয়েকজন ইউরোপিয়ান অফিসার এবং কয়েকজন ভারতীয়ের মধ্যে এই অর্থ ভাগ করে দেওয়া হবে। ১০০টি নৌকায় ৭০০টি ট্রাঙ্কে সেই মুদ্রা বোঝাই করে স্ক্র্যাফটনের নেতৃত্বে এক বিশাল বাহিনী রওনা হয়ে গেল কলকাতার দিকে। হুগলি নদীতে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে আরও দু’শো নৌকা এই শোভাযাত্রায় যোগ দেয়। তিনশ নৌকার এই বিশাল শোভাযাত্রা বাজনা বাজিয়ে, ঢাক পিটিয়ে,পতাকা উড়িয়ে ফরাসি এবং পর্তুগিজদের নাকের ডগা দিয়ে কলকাতার দিকে চলে গেল।

সিরাজকে যেদিন মুর্শিদাবাদে নিয়ে আসা হলো সেদিন ফোর্ট উইলিয়মে পাঠানো এক চিঠিতে ক্লাইভ লিখলো যে সেই সন্ধ্যায় তার উপস্থিতিতে মিরজাফরের সামনে সিরাজকে হাজির করা হবে এবং সে আশা করে যে মানবিক, উদার এবং শিষ্টাচারী নবাব মিরজাফর সিরাজকে বন্দি করে কারাগারে প্রেরণ করবে। কারাগারের নিয়ম অনুযায়ী সমস্ত রকম সুযোগ সুবিধা সিরাজকে দেওয়া হবে। কিন্তু পরেরদিন অর্থাৎ ২রা জুলাই আর একটি চিঠিতে যেটি সম্ভবত আগেরদিন রাত্রে লেখা হয়েছিল ক্লাইভ জানালো যে ২রা জুলাই সিরাজকে বন্দি অবস্থায় দেখে সিরাজের অনুগত কয়েকজন জমিদার এবং কিছু সৈনিক গন্ডগোল শুরু করলে সিরাজকে তাড়াতাড়ি সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপরে ৪ঠা জুলাই ফোর্ট উইলিয়মে তার সহকর্মীদের লেখা চিঠিতে ক্লাইভ জানালো যে সিরাজ আর নেই। যদিও নবাব মিরজাফর তাকে কারাগারে পাঠাতে চেয়েছিলেন তার ছেলে মির মিরান এবং আরও কিছু সভাসদ নবাবকে এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে যে সিরাজকে জীবিত রাখলে তাকে মুক্ত করার জন্য সেনা অভ্যুত্থান ঘটতে পারে। সেইজন্য সিরাজকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত দ্রুত কার্যকারী করে ৪ঠা জুলাই সর্বসমক্ষে খোসবাগে আলিবর্দি খানের সমাধির পাশে তার মরদেহ সমাধিস্থ করা হয়েছে।

২রা জুলাই বন্দি সিরাজকে নিয়ে আসা হয় তারই নিজের প্রাসাদে যেখানে তারই সিংহাসনে বসে ছিল নতুন নবাব মিরজাফর। আলিবর্দির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রদর্শনের জন্য মিরজাফর চেয়েছিল সিরাজকে জীবিত রাখা হোক। বাকি জীবন কারাগারের অভ্যন্তরেই কাটাতে হবে তাকে। দরবারে উপস্থিত অনেকে চাইলো সিরাজকে নির্বাসনে পাঠাতে। ভীত সন্ত্রস্ত সিরাজ বারবার করজোড়ে তাকে জীবিত রাখার জন্য অনুনয় বিনয় করতে লাগলো। কিন্তু মিরজাফরের ছেলে মির মিরান এবং কয়েকজন সভাসদ তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে সিরাজকে হত্যার পক্ষে সওয়াল শুরু করলো। বললো সিরাজকে এই মুহূর্তে হত্যা না করলে সেনা অভ্যুত্থানের সমূহ সম্ভাবনা । সতের বছর বয়সের মির মিরান নিষ্ঠুরতায় সিরাজকেও অতিক্রম করে গিয়েছিল। তার পোষাক-আশাক, শরীরের ভাষা, কথাবার্তায় তার নিষ্ঠুরতা ফুটে বেরতো প্রতি মুহূর্তে। মানুষ হত্যার নেশা ছিল মির মিরানের। সিরাজের অনেক অনুনয় বিনয় সত্ত্বেও মিরজাফর তার ছেলের প্রস্তাবের বিরোধিতা করলো না, চুপ করে রইলো।

মিরজাফর এবং অন্যান্য সভাসদেরা দরবার ছেড়ে চলে যাবার পর সিরাজকে হীরাঝিলের এক নির্জন কক্ষে (মতান্তরে জাফরগঞ্জে মিরজাফরের প্রাসাদে ) নিয়ে যাওয়া হয়। মৃত্যু আসন্ন বুঝতে পেরে সিরাজ আর্তনাদ করে ওঠে। কিছুক্ষণ পরে সিরাজ নিজের হাত-পা ধুয়ে শেষবারের মত প্রার্থনা করার অনুরোধ জানায়। নিষ্ঠুর মির মিরান সিরাজের শেষ নামাজের এমনকি শেষ তৃষ্ণা নিবারণের জন্য একটু জলের জন্য কাতর প্রার্থনায় কর্ণপাত না করে মামুদ বেগ নামে তার এক বিশ্বস্ত অনুচরকে সিরাজকে অবিলম্বে হত্যা করার আদেশ দেয়। তারই প্রাসাদের অন্নভুক, একদা আলবর্দি খানের এবং সিরাজের বাবার স্নেহভাজন পারিবারিক পরিচারক মামুদ বেগের হাতে মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে নিহত হতে হলো হতভাগ্য নবাব সিরাজদৌল্লাকে।

No comments:

Post a Comment