গল্প - সমরেন্দ্র বিশ্বাস








কাঁধে রাইফেল – বর্ডারের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে হেঁটে যাচ্ছে লোকটা। বেনজির খান – ব্যাটেলিয়ান নম্বর ১১, তার ডিউটির জায়গাটা দুই দেশের কাঁটা-তার ঘেরা সীমান্তে। ওর দলের আর পাঁচ জন সীমান্ত রক্ষীর মধ্যে ও ছিল সব থেকে পেছনে, বাকী চার জন অনেকটা এগিয়ে গেছে।
তার-জালের ফাঁক দিয়ে বেনজির দেখছে ওপারের পরিচিত দৃশ্য - একটা প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ, একটু দূরেই গ্রামের মানুষজন, কচিৎ কখনো ওপারের সীমান্তরক্ষীদের আনাগোনা।
টহল দিতে দিতে হঠাৎই বেনজির খানের নজরে এলো। তাদের এলাকাতে একটা বাচ্চা মেয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে। সীমান্তের এপারটা তো জনমানব শূণ্য এলাকা। নিশ্চয়ই বাচ্চাটা সীমান্তের ওপারের জনবসতি থেকে এপারে ভুল করে ঢুকে পড়েছে। কিন্তু ঢুকলোটা কিভাবে?
এদেশের সীমান্তের লোকজন কচিৎ কখনো চোরা পথে এপার ওপার করে। কখনো সস্তা খাবারের লোভে, কখনো বেআইনী কোনো চোরাচালানের উদ্দেশ্যে। কখনো বা সীমান্তের ওপারে নিজের আত্মীয় পরিজনদের সাথে মিলতে যাবার জন্যে। কিন্তু এইটুকু বাচ্চা মেয়ে! এ দেশে কি উদ্দেশ্যে ঢুকলো, আর কি ভাবেই বা ঢুকলো?
কাঁটা তারের বেড়া। বেনজির খান ভেবে কুল কিনারা করতে পারছে না! তারের বেড়া আর জমির মাটির মধ্যে সামান্য ফাঁক-ফোকর আছে। শেষে আন্দাজ করলো, হয়তো বাচ্চাটা মাটিতে শুয়ে শুয়ে নিজের ছয়ইঞ্চি পুরু শরীরটাকে বেড়ার নীচ থেকে গলিয়ে দিয়ে ওপার থেকে এপারে চলে এসেছে! কিন্তু ওর উদ্দেশ্যটা কি?
বেনজির খান মেয়েটার কাছেই থেমে গেলো। কাঁধের বন্দুকটা এক হাতে মাটির উপর দাঁড়া করানো। অন্য হাতের ইশারাতে বাচ্চা মেয়েটাকে ডাকলো – হেই লড়কী উধার সে ইধার কিউ আয়া?
বাচ্চা মেয়েটা জবাব দিলো – পাপাকো ঢুন্ডনে কে লিয়ে। তুম মেরা পাপাকো দেখা?
তাহলে মেয়েটা ওর বাবাকে খুঁজতে ওপার থেকে এপারে এসে পড়েছে। ও তো আর সীমান্তের নিয়ম কানুন জানে না!
‘তুমহারা ঘর কিধার?’
বাচ্চাটা আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো ওপারের সীমান্ত।
‘তুমহারা নাম কেয়া?’
‘মিমি।’
চার বছরের বাচ্চা মেয়েটার মুখ দেখে বেনজির খানের মনে পড়ে গেলো, বাড়িতে তো ওর এমনই একটা বাচ্চা মেয়ে আছে! কতদিন সে সালমাকে দেখে নি! সালমার বয়েস তো এই মিমির মতোই হবে।
বেনজির খান মনে মনে ঠিক করে নিলো। ওর করণীয় কর্তব্যটা কি। এই বাচ্চা মেয়েটা, কি যেন নাম, - মিমি - ওকে যে করেই হোক কাঁটাতারের ওপারে পৌঁছে দিতে হবে। যাতে করে ও নিরাপদে নিজের বাবা-মায়ের কাছে পৌঁছে যায়।
ততক্ষনে বাচ্চাটাকে খুঁজতে খুঁজতে ওপারের গ্রামগুলো থেকে ওর মা তারজালের কাছে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছে। সীমান্তের ওপারে দেখা যাচ্ছে সালোয়ার কামিজ পরা এক মহিলা। ওপারে দাঁড়িয়ে মেয়েলোকটি ‘মিমি – মিমি’ বলে কান্না কাটি শুরু করে দিয়েছে। বারবার বলছে – ‘মিমি এদিকে চলে আয়। ওরে, ওরা তোকেও বন্দুকের গুলিতে শুইয়ে দেবে।’
পুরো সীমান্তটাই লম্বা লম্বা খাম্বা আর তারের জালে ঘেরা। মিমি শুনতে পাচ্ছে মায়ের কান্না। কিন্তু চার বছরের মেয়েটা বুঝতে পারছে না, এপার থেকে ওপারে কি করে নিজের মায়ের কাছে আবার ফিরে যাবে!
বেনজির খান একটা সহজ উপায় বের করলো। কাছেই একটা জায়গায় বর্ডারের ফেন্সিং মেরামতের জন্যে একটা মই আর রশি রাখা ছিলো। মইটাকে তারকাঁটা বসানো একটা খাম্বার উপর হেলান দিয়ে দাঁড় করালো।
মিমিকে বল্লো, ‘গুড়িয়া, ডরো মাত। হাম তুমকো মদত করেগা।’
বেনজির বাচ্চাটার পেট বরাবর একটা রশি বেঁধে দিলো। তারপরে সে বাচ্চাটাকে নিজের কোলে তুলে নিলো। ভয়ে তো মেয়েটা কাঁদছে!
তারপর সীমান্তরক্ষী লোকটা তরতর করে মই বেয়ে উপরে উঠে গেলো। নিজের উর্দি কাঁটায় লেগে হাতের কাছটাতে ছিঁড়ে গেলো। কোন মতে ধীরে ধীরে দড়িটাকে ঝুলিয়ে দিয়ে মেয়েটাকে কাঁটাতারের বেড়ার ওপারে নামিয়ে দিলো। সালোয়ার কামিজ পরা মহিলাটি, মিমির মা, দড়ির বাঁধন খুলে মেয়েটাকে নিজের কোলে তুলে নিলো। নিজের হারিয়ে যাওয়া মেয়েকে ফেরত পাবার এ এক অপূর্ব দৃশ্য!
ইতিমধ্যে সীমান্তের ওপারে তখন আরো কিছু পুরুষ মহিলা জড়ো হয়ে গেছে। ভিন দেশী মহিলাটি নিজের মেয়েটাকে কোলে চেপে ধরেছে। চোখ দিয়ে তার গড়িয়ে পড়ছে জল। ভিন দেশী মা ওপারের সীমান্ত রক্ষীটাকে স্যালুটের ভঙ্গীতে অভিবাদন করলো– ‘থ্যাঙ্ক ইউ ফর ইয়োর কাইন্ডনেস’।
বেনজির খান দেখছে, মিমির মার চারপাশে তখন আরো লোক জমে গেছে। তারাও সমস্বরে সীমান্ত রক্ষীটিকে অভিবাদন জানালো – ‘থ্যাঙ্ক ইউ - থ্যাঙ্ক ইউ’।
ভীড়ের মধ্য দিয়ে একজন মাতব্বর মার্কা পুরুষ লোক এগিয়ে এসে কাঁটা তারে গাল ঠেকিয়ে বেনজির খানকে উদ্দেশ্য করে বললো – ‘খুব ভালো করেছেন! বাপ হারা মেয়ে। ওর বাবা সীমান্তরক্ষীর গুলিতেই মারা গেছে। গত মাসের তেরো তারিখে।’
‘কবে, কোন ডেট বললেন? তেরোই আগষ্ট?’ - বেনজির খান জিজ্ঞেস করলো!
ওই মাতব্বর মার্কা লোকটার সাইডব্যাগে ব্যাগে ভাজ করা একটা পুরোনো খবরের কাগজ, তাতে হিন্দীতে লেখা। সে কাগজটা তাকে দেখিয়ে গড় গড় করে পড়তে লাগলো – ১৩ আগষ্ট - বিনা প্ররোচনায় সীমান্ত রক্ষীর গুলিতে অনেকজন লোক হতাহত।
এইটুকু পড়ে লোকটা একটু থামলো। তারপর একটু জিরিয়ে নিয়ে চোখ বোলালো কাগজের পরবর্তী লাইনগুলোতে। ধীরে ধীরে সীমান্তরক্ষীটাকে শুনিয়ে শুনিয়ে পড়ে যেতে লাগলো খবরের লাইনগুলো - ...... ২৩ নম্বর ওয়াচ টাওয়ারের কাছে পাওয়া গেছে জার্নেল সিং এর লাশ। ... সমঝে ভাইয়া! মিমির মাকে দেখিয়ে লোকটা বললো – ইনি জার্নেল সিং এর ওয়াইফ আর সীমান্তের ওপারে আপনাদের দেশে নিজের বাপকে খুঁজতে গেছিল যে ছোট্ট বাচ্চাটা সে জার্নেল সিং এর মেয়ে – মিমি! মিলিটারি দাদা, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ – আপনি বাবা মরা মেয়েটাকে সময়মতো তার মায়ের হাতে তুলে দিয়েছেন। আল্লাহ আপনাকে অনেক অনেক আশীর্বাদ করবে।
বেনজির খানের হাতের জামা কাঁটাতারে ছিড়ে কনুইএর পেছন দিয়ে যে রক্ত বেরোচ্ছে তা সে তখন টের পেলো না! তার মাথায় ঘুর পাক খেতে লাগলো – দুটো কথা – তেরোই আগষ্ট আর ২৩-নম্বর ওয়াচ টাওয়ার! হ্যাঁ, তার স্পষ্ট মনে আছে তেরোই আগষ্ট তাদের তরফ থেকে একটা এনকাউন্টার করা হয়েছিলো! উপর থেকে আদেশ ছিলো। সন্ধ্যা ৭-৫৫ মিনিটে সীমান্তের ওপার লক্ষ্য করে আচমকা গুলি চালাতে হবে! সেদিনের কথা ভাবলে তার কষ্ট হয়। কেন এমন আদেশ? একেই কি বলে মিলিটারি স্ট্রাটেজি! তার মনে আছে, পরবর্তী সময়তে দুটো পাশাপাশি দেশের সামরিক ক্রিয়া- প্রতিক্রিয়া, সে সব অনেক কথা!
এখন তার চোখের সামনে ভাসছে সীমান্তের ২৩ নম্বর ওয়াচ টাওয়ার! আর বাচ্চা মেয়েটার মুখ, তার কথাগুলো - তুম মেরা পাপাকো দেখা?
বন্দুকটা কাঁধে করে বেনজির খান উলটো দিকে হাঁটা লাগালো। প্রায় আধা কিলোমিটার পেছনে এগোতেই ২৩ নম্বর ওয়াচ টাওয়ার!
সেখানে নিজের দেশের জন মানব শূন্য কাঁটাতারের বেড়ার উপর কাঁধের বন্দুকটাকে হেলান দিয়ে দাঁড়া করিয়ে দিলো। বেনজির খান নিজে মাটির উপরে বসে পড়লো। মাটির দিকে ঝুঁকে আছে তার হেলমেট পরা মাথা। কর্কশ একটা হাতের-পাতা ঘর্মাক্ত কপালের উপর ছোঁয়ানো।
কত দিন সে তার নিজের মেয়ে সালমাকে দেখে নি। কত দিন সে সালমার মা’কে আদর করে নি! কতদিন সে ছুটিতে বাড়ি যায় নি! বেনজির ভাবলো, ওপারের সীমান্তক্ষীর গুলিতে সে যদি নিহত হয়, তাহলে সালমাও কি তার বাপকে খুঁজতে সীমান্তের কাঁটাতার পেরিয়ে ও দেশে পৌঁছে যাবে?
মনে পড়লো তাদের কমান্ডান্টের সেদিনকার স্পেশাল অর্ডারের কথা। সেদিনটা ছিল ১৩ই আগষ্ট। সেদিন এখানেই তার ডিউটি ছিল। এই ২৩ নম্বর ওয়াচ টাওয়ারএর কাছে কাঁটা-তারের ফাঁফ দিয়ে সে তার রাইফেলে যে তিন রাউন্ড বন্দুক চালিয়েছিলো তাতে একটি মাত্র লোকই মারা গেছিল! বেনজিরের কানে এসেছিল একটা অজানা পুরুষ লোকের মৃত্যুকালীন আওয়াজ! – সেই লোকটিই কি তাহলে মিমির বাবা!
বেনজির খানের মনে হলো এক হাজার মিমির কন্ঠস্বর আকাশ থেকে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে মাটির দিকে নেমে আসছে। সেই সম্মিলিত আওয়াজে কাঁদতে কাঁদতে কারা যেন বলছে – ‘সালমা সাবধান! সীমান্ত রক্ষীর গুলি যে কোনো মুহূর্তেই ছুটে এসে ফেলে দেবে তোর আব্বার লাশ। সালমা! তুই তোর বাবাকে বল – বন্দুক জমা দিয়ে এক্ষুনি সে যেন তার ঘরে ফিরে আসে! সালমা সাবধান! সালমা সাবধান!’ আকাশ থেকে ভেসে আসা কন্ঠস্বর সত্যিই কি মিমির, নাকি মিমির মতো আরো অন্য কারোর? ওই হাজার হাজার কন্ঠস্বরের মধ্যে কি তার মেয়ে সালমার কন্ঠস্বরও মিশে নেই?

No comments:

Post a Comment