সম্পাদকীয়



সম্পাদকীয়


প্রকাশিত হলো ঋতবাক ষষ্ঠ বর্ষ, অষ্টম সংখ্যা।

কোনও রকম ভনিতা না করেই সরাসরি চলে যাই দু'একটা জরুরি কথায়। বিশ্ব জুড়ে করোনা ভাইরাস এই মুহূর্তে একটা বিধ্বংসী মূর্তি ধারণ করেছে, যাকে বলা হচ্ছে অতিমারী। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ট্যুইটার, প্রভৃতি বিভিন্ন স্যোশাল মিডিয়ায় আমরা তথা প্রযুক্তিকে দাসানুদাস বানানো শিক্ষিত মানুষ এই মহাবৈশ্বিক বিপর্যয় নিয়ে যতই 'খিল্লি' করি না কেন, আমি বিশ্বাস করি, প্রাথমিক সাবধানতাগুলো আমরা সকলেই মেনে চলছি। অযথা নিজে আতঙ্কিত হয়ে আতঙ্ক না ছড়িয়ে সাধারণ সাবধানতাগুলো মেনে চললে আপাতত নিজেকে ও নিজের পরিবারকে, একান্ত আত্মজনকে বিপদের হাত থেকে রক্ষা করা যাবে, এটুকু খেয়াল রাখলেই যথেষ্ট; বিশ্ববাসীর কথা এখনও আর না হয় নাইবা ভাবলেন!

আর সবিনয় অনুরোধ এই যে, সমস্ত কিছুর মধ্যে রাজনীতি খুঁজতে যাবেন না, দয়া করে। অযথা এখনও এখান ওখান ঘুরঘুর না করে কটা দিন না হয় বাড়িতেই রইলেন! এমন কি হয়নি কোনও দিন, যেদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে মনে হয়েছে - উফ্‌, আজ যদি অফিস যেতে না হতো!! তাহলে? 

একটা তথ্য দিই এখানে, এই লেখা যখন লিখছি, অর্থাৎ ২০ মার্চ, ২০২০, আজকের পর বিদেশ থেকে সমস্ত ফ্লাইট আসা সম্ভবত বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। যদি তাই হয়, তাহলে ২১ তারিখের পরে আপাতত আর কোনও বিদেশ থেকে আসা মানুষ ভারতবর্ষে প্রবেশ করতে পারছেন না। পরের দিন সারা দেশে ১৪ ঘন্টার কার্ফ্যু। অর্থাৎ অত্যন্ত জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে যাওয়ার উপরে সরাসরি সরকারি নিষেধাজ্ঞা।  মনে করা হচ্ছে, এই পদ্ধতি অবলম্বন করার মধ্যে দিয়ে প্রায় লক্ষাধিক সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া রোধ করা যাবে; এটাকে একটা কার্যকরী প্রচেষ্টা বলে স্বাগত জানানোই এই মুহূর্তে বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে করছি। 

প্রসঙ্গত, আমার নিজের কথা বলতে পারি। আমার শরীরে করোনা ভাইরাস আছে কি না জানি না। কিন্তু অতি সাবধানতা অবলম্বন করতে গিয়ে আমি পরীক্ষা করাতেও আগেভাগে ততক্ষণ হাসপাতালে দৌড়বো না, যতক্ষণ না আমার শরীরে কোনও উপসর্গ দেখা দিচ্ছে। কারণটা সহজ। এতে করে, একদিকে যেমন আমার শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকলে আমি নিজেই আক্রান্ত হয়ে পড়তে পারি, সে সম্ভাবনা তো থাকছেই; আবার অন্যদিকে যদি আমার শরীরে আগে থেকেই করোনা ভাইরাস থেকে থাকে, আমার শক্তিশালী প্রতিরোধ ক্ষমতার সঙ্গে পাল্লা দিতে না পেরে যে কিনা নিষ্ক্রিয় হয়ে আছে, আমার সংস্পর্শে আসা অপেক্ষাকৃত দুর্বল প্রতিরক্ষাসম্পন্ন কোনও আধার পেলে সে তড়াং করে লাফিয়ে সেখানেও বাসা বাঁধবে। এটাও মোটেই কাম্য নয় কিন্তু!

একটা কথা মনে রাখা দরকার, যুদ্ধে সে-ই জয়ী হয়, সময় মতো যে পিছিয়ে আসতেও জানে। সুতরাং আসুন, এক পা পিছিয়ে দাঁড়াই। আসুন, শৃঙ্খল ছিন্ন করি। মানব সভ্যতার ইতিহাসে এই বোধহয় প্রথমবার। যদিও ফালাফল সেই একই - মানব কল্যাণ!

সচেতন থাকুন, সুস্থ থাকুন

শুভেচ্ছা নিরন্তর 

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - ডঃ সব্যসাচী সেনগুপ্ত



করোনা_কথা


এই মুহূর্তের দুনিয়া কাঁপানো ঘটনাটার শুরুয়াৎ হয়েছিল ২০১৯- এর নিউ ইয়ার্স ইভ-এ। অর্থাৎ, দিনটা ছিল, দু'হাজার উনিশ সালের ক্যালেন্ডারের শেষ দিনটি। 

৩১ শে ডিসেম্বর, ২০১৯

চিন দেশের উঁহ্হান (Wuhan) শহরের মিউনিসিপাল হেল্থ কর্পোরেশন ঘোষণা করল একটি নতুন তথ্য। ২৭ জন রোগীর সন্ধান পাওয়া গেছে হঠাৎ করে, যাঁরা নিউমোনিয়া জাতীয় রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। এবং যাঁদের নিউমোনিয়া রোগটি, ঠিক কোন্ জীবাণুর কারণে হয়েছে, এখনো ধরা যায়নি। এঁদের মধ্যে সাতজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।

তথ্যটি চমকপ্রদ। তবে তার চাইতেও চমকপ্রদ হলো, আরেকখানি লেজুড় ইনফর্মেশন। এই সাতাশ জনের প্রায় সকলেই উঁহ্হানের সী ফুড হোলসেল মার্কেটের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত। হয় তাঁরা সেখানে কাজ করেন, না হয় তাঁরা সেই মার্কেটের খরিদ্দার, আর নয়তো এইরকম কোনো মানুষের আত্মীয় পরিজন। 

এ কয়টি তথ্য, স্বাস্থ্য বিশারদদের কাঁপিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। হোক না রোগীর সংখ্যা মোটে সাতাশ। কিন্তু, ১. তাঁদের রোগের জীবাণুটিকে এখনো চেনা যায়নি। ২. সক্কলেই একটি কমন লিংক/সোর্স দেখাচ্ছেন (সী ফুড হোলসেল মার্কেট)।

পদক্ষেপ নেওয়া হলো তড়িঘড়ি। নতুন বছরের প্রথম দিনেই তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হলো মার্কেটটিতে। 'আইসোলেশন' অর্থাৎ জনগণের থেকে আলাদা করে দেওয়া হলো সাতাশ জনকেই। রাখা হলো হাসপাতালের স্পেশাল ওয়ার্ডে। এবং তারই সাথে জোরদারভাবে খোঁজ শুরু হলো, এই জাতীয় আর কোনো নতুন রোগীর সন্ধান পাওয়া যায় কি না।

সন্ধান মিললো দ্রুত। পাঁচই জানুয়ারির হিসাব বলছে, -- আরো বত্রিশ জনের খোঁজ পাওয়া গেছে। যাঁদের রোগের উপসর্গ (কাশি, জ্বর, নিঃশ্বাসের কষ্ট) শুরু হয়েছে ১২ থেকে ২৯শে ডিসেম্বর ২০১৯ নাগাদ। অর্থাৎ, এই রোগীরা এতদিন ঘাপটি মেরে বাড়িতে বসেছিলেন। 

মোট রোগীর সংখ্যা দাঁড়ালো ৩২+২৭=৫৯

যাঁদের কারোরই রোগের জীবাণুটি ধরা যাচ্ছে না এখনও। এবং এই ছয়দিনে স্বাস্থ্যকর্মীরা মোটামুটি নিশ্চিত যে, এটি অজানা, অদেখা কোনো ভাইরাস অথবা ব্যাকটেরিয়ার কাণ্ড। 

প্রথম জয় এলো নয় তারিখে। নাইন্থ জানুয়ারি, ২০২০। সিডিসি (সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন), সারা পৃথিবীর সামনে ঘোষণা করলো, ৫৯ জনের মধ্যে ১৫ জনের শরীরে পাওয়া গেছে নতুন প্রজাতির করোনা ভাইরাস। (2019 -nCoV)। ২০১৯ নোভেল করোনা ভাইরাস। দশই জানুয়ারি, যে ভাইরাসের 'জিনোম সিকুয়েন্স' তুলে ধরা হলো সমগ্র বিশ্বের সম্মুখে। আর সমস্ত স্বাস্থ্যবোদ্ধারা অবাক হয়ে দেখলেন-- নতুন শত্রুর খোলনলচে।

এর ঠিক একদিনের মাথায় ঘটলো প্রথম পরাজয়। প্রথম মৃত্যু ঘটলো এই নতুন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে। তারপর ষোলই জানুয়ারি, আরো একজনের। 

এবং শেষ খবর পাওয়া অব্দি, এই রোগ আর শুধু চিনদেশের উঁহ্হান শহরে সীমিত নেই। সারা পৃথিবী জুড়ে মোট এক লক্ষ দু হাজার একশো বত্তিরিশ জন আক্রান্ত হয়েছেন করোনা ভাইরাসে। ভারতবর্ষে, ৩১ জন। 

বারোই জানুয়ারীতে নামকরণ করা হয়েছে যে ভাইরাসের --

SARS-CoV-2। সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিনড্রোম করোনা ভাইরাস ২।

কেন ২? কেন ১ নয়? 

সেসবে আসছি পরে।

© ডঃ সব্যসাচী সেনগুপ্ত


দুই

বিশ্বজিৎদা আমার বড্ডো প্রিয় একজন মানুষ। ডঃ বিশ্বজিৎ রায়। প্রথমত, এরকম টগবগে, চনমনে, উৎসাহী, কর্মোদ্যমী মানুষ আমি খুব একটা দেখিনি। দ্বিতীয়ত, এই ভদ্রলোকই আমাকে এক প্রকার জোর করে তুলে এনেছিলেন জলপাইগুড়ি টিবি হাসপাতালে। প্রায় তিন বছরের প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রের একঘেয়ে জীবন ফেলে, শহর জলপাইগুড়ির স্বাদ চাখবার সুযোগ মিলেছিল আমার। 

সময়টা তখন দু হাজার দশের শেষাশেষি। এক হাড় কাঁপানো ঠান্ডার সন্ধ্যাতে সাপ্টিবাড়ি প্রাইমারি হেলথ সেন্টার সংলগ্ন কোয়ার্টারের বারান্দাতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছি আমি তখন। সামনের মাঠে, ঠাসা কুয়াশা। কুয়াশা আমার ওই ব্যালকনিতেও। কপাল, ঠোঁট, নাকের আগা আর হাতের আঙুল ভিজে ভিজে যাচ্ছে হিমশীতল কুয়াশা পরশে। বাদবাকি অংশ, গরম জামা কাপড়ে ঢাকা। সহসা, চরাচর ব্যাপী নিস্তব্ধতা খানখান করে বিচ্ছিরি শব্দে আর্তনাদ করে উঠল আমার নোকিয়া (মডেল নাম্বার ২৩০০) । চমকে উঠে, চায়ের কাপ মাটিতে নামিয়ে, পকেট থেকে ফোনটা বের করতে করতে আবিষ্কার করলাম, আমার হাতগুলো অবশ হয়ে গেছে প্রায় পুরোপুরিই। আর ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট স্ক্রিনে ব্লিংক করছে--'ডি.টি.ও'। অর্থাৎ ডিস্ট্রিক্ট টিবি অফিসার।

পরবর্তী কথোপকথনটা হলো নিম্নরূপ--


-- সব্যসাচী...

-- হ্যাঁ, বলুন, স্যার

-- তোকে ভাবছি সদরে তুলে নিয়ে আসবো। টিবি হাসপাতালে।

-- স্... সদরে? জলপাইগুড়ি?

-- হুম! মাল্টি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট টিবির জন্য এই হাসপাতলটা সিলেক্ট হয়েছে। নর্থ বেঙ্গল মেডিক্যাল কলেজেই হওয়ার কথা ছিল। শিলিগুড়িতে। ওদের মুখের থেকে ছিনিয়ে নিয়েছি আমি। ইট উইল বি অ্যান অনার অ্যান্ড প্রাইড ফর জলপাইগুড়ি। অ্যান্ড... আই ওয়ান্ট ইউ দেয়ার। তোকে চাই আমার এখানে। 

-- জ্.. জলপাইগুড়ি টাউন? সো... সত্যি বলছেন? স্যার?

-- হুম। সি এম ও এইচ-এর সাথে কথা হয়ে গেছে। বণিক স্যার তোকে চেনেন। খোঁজ খবর রাখি আমরা সবাই। ইউ আর দা ম্যান। চলে আয়। অর্ডার হাতে পাবি শিগগিরই।

-- স্যার...

-- অনেক আশা নিয়ে তুলে আনছি সব্যসাচী। আমার নাক কাটাস না। চাপ আছে। প্রচুর চাপ আছে কাজের এখানে। নতুন ইনফ্রাস্ট্রাকচার গড়ে তোলা চাট্টিখানি কথা না কিন্তু! রাজি আছিস?

-- হ্যাঁ.. হ্যাঁ, স্যার

-- গুড। চেপে রাখ খবরটা। কেউ কাঠি করতে পারে। রাখছি। বাই।

এর ঠিক দেড় মাসের মাথায় জলপাইগুড়ির রাণী অশ্রুমতী টি বি হাসপাতালের দায়িত্ব নিই আমি। একা। সিঙ্গল হ্যান্ডেড। পশ্চিমবঙ্গে তখন সদ্য শুরু হয়েছে মাল্টি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট টিবির চিকিৎসা। দক্ষিণে, যাদবপুর কে এস রয় হাসপাতালে। আর উত্তরে, এই আমার এখানে। নির্দিষ্ট কোনো গাইডলাইন তৈরি হয়নি তখনও এম.ডি.আর টিবির চিকিৎসার। যেটুকু যা আছে, সবটাই ফ্লেক্সিবেল। নমনীয়। পরিস্থিতি বুঝে পরিবর্তন ঘটানোর সুযোগ আছে চিকিৎসা পদ্ধতির। পশ্চিমবঙ্গ তো বটেই, সমগ্র ভারতবর্ষ তখনো শিখছে এ রোগের চিকিৎসা। শিখছে, এবং আবারও নতুন করে শিখছে, দৈনিক নিত্য নতুন 'কেস স্টাডি' করে। সেই যুদ্ধের প্রথম দফা থেকে যোগদান করলাম আমিও। 

***

যেহেতু, তখন জাস্ট শুরুয়াৎ, সেইহেতু বিবিধ প্রশ্ন আর বহুবিধ অজানা ভয় কাজ করত আমাদের মনে। বিশেষত, রোগটি যখন প্রাণঘাতী। বিশেষত, রোগটি যখন সংক্রামক। ছড়িয়ে যায় একজনের থেকে অন্যজনের মধ্যে। 

আর ঠিক এইরকম একটা সময়েই ওয়ার্ল্ড হেল্থ অর্গানাইজেশন (WHO) আর ইউনাইটেড স্টেটস ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (USFDA)-এর যৌথ উদ্যোগে, একটা ভিজিট কাম ট্রেনিং হলো আমার হাসপাতালে। 

যাঁরা এসেছিলেন, এবং যাঁরা ট্রেনিং দিয়েছিলেন, সকলেই 'এয়ারবোর্ন ইনফেকশন কন্ট্রোল'/ 'বাতাসে ছড়িয়ে পড়া অর্থাৎ বায়ুবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ' দপ্তরের আন্তর্জাতিক দিকপাল। 

প্রথম ট্রেনিংটা পেলাম হাসপাতালেই।

আর দ্বিতীয়টার জন্য যেতে হলো কোলকাতা। সেইবারেই প্রথম ফাইভ স্টার হোটেলে থাকবার সুযোগ পাই আমি। বদান্যতায়, ওই WHO এবং USFDA।

যা শিখেছিলাম, ঠিক তাই তাই দরকার এই করোনা ভাইরাস আটকাতে হলেও। বস্তুত, যেকোনো রোগ, যা হাঁচি বা কাশির মাধ্যমে ছড়ায়, সে রোগ টিবি হোক বা করোনা, নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি একই। 

আমরা সেসব মেনে চলি না। 

আমরা... সেসবেরই মূল্য চোকাচ্ছি।

© ডঃ সব্যসাচী সেনগুপ্ত


তিন

ট্রেনিং-এর মূল বক্তব্য ছিল খুব সিম্পল। ভালো করে, মন দিয়ে পড়বেন। এই কয়টি মেনে চললেই আপনাদের 'অধুনা আতঙ্ক' করোনা ভাইরাস তো নিয়ন্ত্রিত হবেই, সাথে সাথে থেমে যাবে টিবি রোগও। 

জানেন কি যে, করোনা ভাইরাসে এ যাবৎ সব মিলিয়ে মারা গেছেন ৩৪৮৮ জন? আর টিবি রোগে প্রতিদিন, প্রত্যেকটি দিন মারা যান প্রায় ৪৩২০ জন ?

আসুন, নিয়মগুলি বলি। 

১. নিতান্ত প্রয়োজন না হলে বাড়ির বাইরে যাবেন না।

২. হাঁচি বা কাশির সময়, তালু নয়, বাহু ঢেকে হাঁচুন/ কাশুন, দৈনন্দিন কাজের সময় করতল বারবার ব্যবহার হয়, তাতে সংক্রমণ ছড়ায়।

৩. হ্যান্ডশেক পরিত্যাগ করে, মেক ইন ইন্ডিয়া এবং সত্যজিৎ খ্যাত, "কেমন আছেন, নমস্কার" করুন।

৪. যেখানে সেখানে কফ থুথু ফ্যালা বন্ধ করুন।

৫. কথায় কথায়, নাকে মুখে কিংবা চোখে হাত দেওয়ার অভ্যাস ত্যাগ করুন। এতে ইনফেকশনে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে।

৬. খামোখা সিঁড়ির হাতল ধরে ওঠা নামা করবেন না।

৭. সাধারণ সার্জিক্যাল মাস্ক পরে লাভ নেই খুব একটা। এমনকি N 95 জাতীয় মাস্ক পরেও নয়। কারণ, যদি সঠিক পদ্ধতিতে আপনি N 95 পরেন, অর্থাৎ টেনে ব্যান্ড বেঁধে এবং নাকের ব্রিজ চেপে, তবে এই মাস্ক পরে বেশিক্ষণ থাকা যায় না। দম আটকে আসে। দ্বিতীয়ত, এই মাস্ক পরলেও সংক্রমণ আটকানোর সম্ভাবনা 95%। টিবি কিংবা করোনা 'ড্রপলেট' এর মাধ্যমে ছড়ায়। সেই ড্রপলেট আটকাতে হলে বরং উল্টে, যারা হাঁচি বা কাশিতে ভুগছেন, মাস্ক পরা উচিত তাঁদেরই। সেটা, সাধারণ সার্জিকাল মাস্ক হলেও চলবে।

৮. চেষ্টা করুন খোলা মেলা আবহাওয়ায় থাকতে। বিশেষত, যাঁরা স্বাস্থ্যকর্মী। যাঁদের প্রতিনিয়ত দেখতে হয় হাঁচি কাশিওয়ালা রোগীদের। 

এয়ার কন্ডিশন্ড চেম্বার এড়িয়ে চলুন। দরজা জানালা হোক খোলামেলা। বাতাস যেন চলাচল করতে পারে এপাশ থেকে ওপাশে। 
তথ্য বলছে, কোনো ঘরের বাতাস যদি প্রতি ঘন্টায় দশ থেকে পনেরো বার ফ্রেশ হাওয়া দিয়ে রিপ্লেসড হয়, তবে সেই ঘরে বাতাস বাহিত রোগ ছড়ানোর সম্ভাবনা প্রায় শূন্য। আর তার জন্য চাই খোলামেলা আবহাওয়া। এই একই নিয়ম মেনে চলুন যাঁরা বদ্ধ কামরায় কাজ করেন। আপনার রুমটিতে একবার চোখ বুলিয়ে দেখে নিন। এখনই। আজ্ঞে হ্যাঁ। এই ক্ষণেই। দেখুন, আলমারি বা কোনো চেয়ার টেবিল জানালা ব্লক করছে কিনা। করলে, সেগুলো সরিয়ে অন্যত্র রাখুন। 

দুর্ভাগ্য বশত, আমরা যত আধুনিক হচ্ছি, ততই আমাদের 'এ.সি' প্রীতি বাড়ছে।

যদি সম্ভব হয়, সংশ্লিষ্ট দপ্তরে আবেদন করে এ.সি হঠিয়ে জানালা দরজা খুলে রাখার চেষ্টা করুন। এতে গরম লাগবে। ঠান্ডাও। তবে, প্রাণে বেঁচে যাবেন। করোনা ভাইরাস তো নস্যি বিষয় দাদা। টিবিতে মরে যাবেন নয়তো।

৯. খাওয়ার আগে হাত ধুয়ে নিন সাবান দিয়ে কচলে কচলে। অন্তত কুড়ি সেকেন্ড ঘড়ি ধরে। যদি সাবান না থাকে 'হ্যান্ড স্যানিটাইজার' ব্যবহার করতে পারেন। তবে দেখে নেবেন তাতে যেন মিনিমাম 60% অ্যালকোহল থাকে।

১০. মোটামুটি ৪০ বছরের পর থেকে, বছরে একবার করে সুগার টেস্ট করান। সুগার নরমাল হলে কেয়াব্বাত! চলুন ফাটিয়ে মস্তি করি। কিন্তু সুগার/ডায়াবেটিস ধরা পড়ে যদি, তবে অবিলম্বে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। ডায়াবেটিস নিঃশব্দ ঘাতক। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ধরা পড়ে বেশ দেরিতে। এবং, ডায়াবেটিস রোগীদের শুধু করোনা কেন, যেকোনো সংক্রামক রোগ হওয়ার সম্ভবনা অনেক বেশি।

১১. (এটা ট্রেনিং-এ ছিল না। আমি জুড়েছি। বর্তমান পরিস্থিতির বিচারে)

এইটি, সম্ভবত বর্তমান দুনিয়াতে, সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টের একটা। তাই শেষ পাতে দিলাম। নলেন গুড়ের টাটকা মিষ্টি, লাস্টেই দেওয়া নিয়ম। 

হোয়াটসঅ্যাপে বা মেসেঞ্জারে অনেক মেসেজ পাবেন। করোনা বা অন্যান্য বিষয় নিয়ে। সেইটে চারপাশে ' ফরোয়ার্ড' করে দেওয়ার আগে একটু খতিয়ে দেখুন। জেনে নিন, বিষয়টা গুজব কিনা। ঠিক যেমন গুজব ছড়ায় দাঙ্গা নিয়ে। কিংবা UNICEF/ ইউনিসেফ-এর নামে যেসব গুজব ছড়াচ্ছে করোনা ভাইরাস ঘটিত।

© ডঃ সব্যসাচী সেনগুপ্ত


চার

দু হাজার দুই-তিন সালে ঠিক এইরকমই একটি ঘটনা ঘটেছিল। সেটিরও শুরুয়াৎ চিনদেশে। অনেকেই তাকে চেনেন সার্স নামে। সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিন্ড্রোম। SARS । 

মজার বিষয় একটাই। প্রায় সকল সাধারণ জনতাই ভুলে মেরে দিয়েছেন যে, এই সার্স রোগটিও হয়েছিল করোনা ভাইরাসের কারণেই। তবে সেই ভাইরাসের 'জিনোম'-এর গঠন (খোল নলচে) ছিল কিছুটা আলাদা। 

এই ভাইরাসটি ছড়িয়েছিল বাদুড়ের মাধ্যমে। বাদুড় থেকে রোগ ছড়ায় ভাম জাতীয় বিড়ালে। তারপর সেখান থেকে অন্যান্য জীব জন্তুতে। যেমন ব্যিভার বা রেকুন। চিনদেশে ব্যিভার এবং রেকুন নামের প্রাণীরা খাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত হয়। সেখান থেকেই ছড়িয়ে যায় মানুষের মধ্যে। ছড়ায়, এই সব প্রাণীদের কাটাকুটি করতেন যাঁরা, সেইসব কসাইদের মাধ্যমে। মাংসের মাধ্যমে নয়। হাঁচি বা কাশির মাধ্যমে ছড়াতো এই রোগ। এই করোনা ভাইরাসের নাম দেওয়া হয়েছিল SARS-CoV-1।

এ যাত্রায় তাই নাম দেওয়া হলো SARS-CoV-2। কারণ এই করোনা ভাইরাসের গঠন, পূর্বতন ভাইরাসের থেকে পৃথক।

দয়া করে চিন দেশকে গালি দিতে বসবেন না। চিৎকার শুরু করবেন না---" শালারা যা খুশি খায়"।

মাথায় রাখবেন আপনাদের প্রিয় গরু/ গাউমাতা-র শরীরেও টিবি ব্যাকটেরিয়া ( অ্যাটিপিক্যাল) বসবাস করে।

© ডঃ সব্যসাচী সেনগুপ্ত



পাঁচ

কতকগুলি প্রশ্নোত্তর সেরে নেওয়া যাক শেষপাতে।

প্রঃ কী ভাবে এই রোগ ছড়ায়? মানুষ থেকে মানুষে?

উঃ যে যা খুশী বক্কা মারুক, এ রোগের মোড অফ ট্রান্সমিশন ( ছড়ানোর পদ্ধতি) সঠিক ভাবে জানা যায়নি এখনো। যথেষ্ট তথ্য নেই। তবে, এ যাবৎ প্রাপ্ত তথ্য থেকে অনুমান করা হচ্ছে, এই রোগটি মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায় হাঁচি বা কাশির মাধ্যমে।আর তাই, উপরিউক্ত নিয়মগুলি মেনে চলুন।

প্রঃ এ রোগে মরে যাওয়ার সম্ভাবনা কতখানি?

উঃ সে বিষয়ে মন্তব্য করার মত যথেষ্ট তথ্যও এখনো হাতে আসেনি। এটা বিজ্ঞান। এটা স্ট্যাটিসটিক্স। যা খুশি একটা বকে দিলেই হলো না হোয়াটসঅ্যাপে।

প্রঃ তাহলে কি এ রোগে লোক মরে না? 

উঃ অবশ্যই মরে। তবে এ যাবৎ প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা গেছে যে, এটি ২০০৩ এর করোনা ভাইরাসের থেকে কম ক্ষতিকর। এই করোনা ভাইরাসে মরে সাধারণত বুড়ো বুড়িরাই। মরে প্রধানত তারাই, যাদের ইমিউনিটি কম। এগারোই জানুয়ারি যিনি মারা গিছলেন তাঁর বয়স ছিল একষট্টি বছর। ভদ্রলোকের ক্যানসারও ছিল। ষোলই জানুয়ারি যিনি মারা গিছলেন, তাঁর বয়স ছিল ঊনষাট বছর। এই ভদ্রলোকের সম্ভবত টিবিও ছিল।

প্রঃ কতদিন সময় লাগে এই রোগটি হতে?/ ইনকিউবেশন পিরিয়ড কত?

উঃ এখনো পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে দুই থেকে চৌদ্দ দিন। 

প্রঃ তেরোই ফেব্রুয়ারী এবং তার পর থেকে হঠাৎ করে এই রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে গেল কেন? তার মানে কি আমরা হেরে যাচ্ছি?

উঃ আজ্ঞে না। একথা সত্যি যে তেরই ফেব্রুয়ারীতে ১৫১৪১ জনের নতুন সন্ধান পাওয়া গেছে। যেটা আশ্চর্যই বটে। তবে তাইতে ঘাবড়ানোর কিছু নেই। এর আগে স্রেফ ল্যাবরেটারিতে যাঁদের নমুনাতে করোনা ভাইরাস পাওয়া গেছে, তাঁদেরই রোগী ধরা হতো। তেরই জানুয়ারি থেকে যেকোনো নিউমোনিয়া রোগীকেই সম্ভাব্য করোনা ধরা হচ্ছে চিন দেশে। চিকিৎসা পরিভাষায় যাকে বলা হয় 'চেঞ্জ অফ কেস ডেফিনেশন'। এই 'কেস ডেফিনেশন'-এর আরো একবার পরিবর্তন হয় ২০শে ফেব্রুয়ারি। ফলত, সেইদিন রোগীর সংখ্যা কমে যায় ফট করে। এসব মেডিক্যাল কচকচি। এসবের উপর ভিত্তি করে সাধারণ মানুষের আতঙ্কিত/ উল্লসিত হওয়া অনেকটা ফ্লাইটে বসে " প্লেনটা খুব জোরে উড়ছে মনে হচ্ছে" বলার মতো। অর্থাৎ, বালখিল্য। বাল তুল্য।

প্রঃ এই রোগ আটকে দেওয়ার কি কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়েছে? 

উঃ জি নেহি হুজুর। আজ্ঞে না সাহিবাঁ। ফেসবুক বা হোয়াটসঅ্যাপে আপনি অনেক গুজবই পাবেন। যথা-- গরুর পেচ্ছাপ খেলে/আয়ুষ বা হোমিওপ্যাথি আবিষ্কৃত বড়ি খেলে , করোনা ভাইরাসের মূ্র্তি বানিয়ে পূজা করলে ( কার্টেসি বিশ্ব হিন্দু পরিষদ) , তেলাপিয়া মাছ বা মুরগি না খেলে, চায়নার আবীর না মাখলে করোনা হবে না।
এগুলো সবই... আই রিপিট সবই... ঢপের চপ।

প্রঃ মাংস খাওয়া কি এ সময়ে বিপজ্জনক?

উঃ না। যদি রান্না করে মাংস খান, কোনো বিপদের সম্ভাবনা নেই। চাইলে আমাকে নেমন্তন্নও করতে পারেন। তবে হ্যাঁ, রান্না সুসিদ্ধ, সুপক্ক হওয়া চাই। আধাখ্যাঁচড়া রান্না হওয়া মাংস যাঁরা খান সাহেবি কেতাতে, তাঁদের শুধু এখনই নয়, ভবিষ্যতেও বহুবিধ রোগ হতে পারে।

এ মুহূর্তে পাওয়া তথ্য মোতাবেক, কাঁচা মাংস নিয়ে নাড়াঘাঁটা, যেমন ম্যারিনেশন/ নুন হলুদ মাখিয়ে রাখা অথবা মাংস ধোয়া, এসবে করোনা ছড়াচ্ছে কিনা নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না। তবে এটুকু নিশ্চিত তথ্য যে, কাঁচা মাংস নাড়া ঘাঁটার পর যদি ভালো করে সাবান জল দিয়ে হাত ধুয়ে নেন, তবে আজ আপনার করোনাও হবে না, ভবিষ্যতেও অনেক রোগ থেকে মুক্তি পাবেন।

মোটমাট কথা, শুধু আজকের জন্য নয়, সারা জীবনের জন্য এগুলো মেনে চলুন। এগুলো 'সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি'।

প্রঃ দশ সেকেন্ড নিঃশ্বাস (পড়ুন প্রশ্বাস) আটকে রাখতে পারেন না যাঁরা, তাঁরাই কি এ রোগে আক্রান্ত?

উঃ দাদারা/ দিদিরা, হাসাবেন না। হাসাতে হলে কমেডি সার্কাস দেখুন।

প্রঃ হাঁচি বা কাশি হলে কি ভয়ের ব্যাপার?

উঃ না। ভারতবর্ষে করোনা এখনো সেভাবে হয়নি কিছুই। মহামারী/ এপিডেমিক তো দূরের কথা! তবে হ্যাঁ! হাঁচি, কাশি, জ্বর হলে ডাক্তারের কাছে যান। বাকিটা উনিই বুঝে নেবেন। 

প্রয়োজনে 01123978046 নাম্বারে ফোন করবেন। এটা ন্যাশানাল করোনা হেল্পলাইন নাম্বার। 

© ডঃ সব্যসাচী সেনগুপ্ত


ছয়

সেবার ওই কোলকাতার পাঁচাতারা হোটেলের 'এয়ার বোর্ন ইনফেকশন কন্ট্রোল' সেমিনার থেকে ফিরে আসা ইস্তক আমি আমূল বদলে গেছি। আমি সেই ২০১১ থেকেই মুখ ঢেকে হাঁচি কাশি। অন্যদের শেখাই। রাস্তায় কেউ থুতু ফেললে খিস্তাই। কর্মক্ষেত্রের দরজা জানালা খোলামেলা রাখি। ইনফ্যাক্ট SARS-CoV-2 পয়দা হওয়ার ঢের ঢের আগে থেকেই আমি এ বিষয়ে নাগাড়ে লিখে যাচ্ছি। 

একটা গোপন কথা বলে যাই। আমার হাসপাতালেরর প্রতিটি দরজা জানালা খুলিয়ে রাখি আমি দিনরাত। প্রতিদিন বুঝিয়ে বুঝিয়ে এইটেই এখন জলপাইগুড়ি টিবি হাসপাতালের অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর তাই, আমি আর ওই বিশ্বজিৎ দা (তৎকালীন ডি টি ও) মিলে ষড় করে, সরকারকে দিয়ে গরম মোজা আর মাঙ্কিটুপি কিনিয়েছিলাম। শীতের রাতের খোলা জানালায় পেশেন্টরা কষ্ট পাবে বলে। 

এ হাসপাতাল বাদেও অন্যত্র মাঝে মাঝে এমার্জেন্সি ডিউটি করতে হয় আমায়। আমি ভারী আশ্চর্য হয়ে দেখি, সেসব জায়গাতে রাতের বেলা সব জানালা দরজা বন্ধ করে রোগীরা এবং সিস্টাররা বসে থাকে। আতঙ্কিত হয়ে শুধিয়েওছি আমি সিস্টার বা সে হাসপাতালের ডাক্তারদের বহুবার। সবাই মাছি নাড়ার মত হাত করে বলেছে--" ধুর... এরা বললে শোনে না।" তো, সারা দুনিয়া বদলানো তো আর আমার পক্ষে সম্ভব নয়! তবে অন্য কোনো হাসপাতালের ওয়ার্ডে গেলেই আমি আগে জানালা খোলাই। রোগীরা গড়িমসি করলে, খিস্তি মারি টেনে। 

এসব, আমার রক্তে মিশে গেছে।

© ডঃ সব্যসাচী সেনগুপ্ত


সাত

লেখাটা এবার শেষ করবো। ভালোই হলো। সাতটা চ্যাপ্টার হলো। পোয়েটিক জাস্টিস। কাব্যিক সুবিচার। কারণ, এই করোনা ভাইরাসটি এ যাবৎ পাওয়া সাত নম্বর করোনা ভাইরাস, যেটি মানুষকে আক্রমণ করেছে।

যাক সে কথা। এ লেখা লিখতে লিখতেই ফোন করেছিলাম এক WHO উপদেষ্টাকে। অনিকেত চৌধুরী। তো হাসছিলাম আমি ফোনে--" অনিকেত, এতদিন ধরে আমরা বলে আসছি। কেউ শুনছে না। ভাগ্যিস করোনা এলো। তাই লোকে হাঁচি কাশিতে মুখ ঢাকার কথা শুনছে। অন্তত কিছুদিন হলেও টিবি ইনফেকশন কম ছড়াবে। বলো? জয় করোনা মাইয়া কি।" 

অনিকেতও হাসলো। বললো--" প্রিসাইজলি! মাই পয়েন্ট.."

প্রতি কুড়ি সেকেন্ডে একজন টিবি রোগী মারা যায় এ পৃথিবীতে। সারাদিনে, প্রায় সাড়ে চার হাজার। ভারতবর্ষের তিনভাগের এক ভাগ মানুষের শরীরে টিবির জীবাণু আছে। সে জীবাণু অপেক্ষা করছে ঘাপটি মেরে। ইমিউনিটি এতটুকু কমলেই, সুগার বা ক্যানসার হলেই তেড়েফুঁড়ে উঠবে। তবুও কারো হেলদোল নেই। সব্বাই সেই একই বুলি আউড়ে যাচ্ছে---" ধোর শালা! টিবি হয় রিকশাওয়ালাদের। " আর টিবি বেড়ে চলেছে। এমন ভাবে বাড়ছে যে, যদি এই রেট বজায় থাকে, তবে আপনাদের সব্বার নাতি নাতনির টিবি হবে। 

হাতজোড় করে বলছি, তিন নম্বর চ্যাপ্টারে বর্ণিত সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন সারা জীবন। শেখান সব্বাইকে ঘাড় ধরে। প্রয়োজনে ঝগড়া করুন। যে মানুষ প্রতিদিন দরজায় তালা দিয়ে বাইরে যায়, তার চোরের ভয় নেই। আর আপনারা যেটা করছেন সেটা হলো কতকটা এইরকম-- পাড়ায় নতুন চোর এসেছে! এবার তাইলে ক'টা দিন দরজায় তালা দিই।

ভালো থাকুন। সুস্থ থাকুন।

© ডঃ সব্যসাচী সেনগুপ্ত
০৮/০৩/২০২০

পুনশ্চঃ ডেট অর্থাৎ তারিখটা দিলাম একটাই কারণে। যা লিখেছি, সব ৮ তারিখ পর্যন্ত পাওয়া তথ্যের হিসাব। যেই হেতু এটা বিজ্ঞান, তাই কাল এটা নতুন তথ্যের উপর নির্ভর করে পাল্টে যেতে পারে।

তথ্য ঋণ-- WHO (ওয়ার্ল্ড হেল্থ অর্গানাইজেশন)

[ একাধিকবার নিজের নাম উল্লেখ করেছি আমি। একটাই কারণ। এ লেখার সমস্ত দায়ভার আমার ]

প্রবন্ধ - সুরঞ্জন রায়



ফেলিনির ‘লা দোলচে ভিতা’-য় দান্তের ছায়া


দান্তের ‘কম্মেদিয়া’ পড়তে পড়তে মনে হয়, এ যেন সিনেমার দিকে পা বাড়ানোর এক প্রস্তুতি। রাজনীতির হলাহলে আক্রান্ত কবি ‘ইনফেরনো’-তে প্রবেশ করে দেখলেন, মৃত মানুষেরা জীবিতের মতো ব্যবহার করছে— ছায়াছবির এও এক রীতি। মনে পড়ে যায় অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহের কথাও। চক্রে চক্রে এগিয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা বর্ণিত হয় মন্তাজের ঢঙেই। অনুসৃত হয় ফ্ল্যাশব্যাকের রীতিও। কিন্তু কী ভাবে ঘটল এই জটিল ‘টেকনিক’-এর উদ্ভাসন? মনে রাখতে হবে, দান্তের সময়টা ছিল সামন্ত সমাজের ভাঙনের সময়। সনাতন মূল্যবোধ ভেঙে পড়লেও তখনও গড়ে ওঠেনি কোনও নতুন মূল্যবোধ। কৃষিসমাজের প্রাধান্য সরে গিয়ে গড়ে উঠছিল অভিজাত শ্রেণির আধিপত্য। প্রেমের আকাশে জ্বলে উঠল প্রজ্ঞার আলো:

এমনকি এও হয়তো বলা যায় যে এ দুয়ের সংঘর্ষ ও সমন্বয়ের ওপরই নির্ভর করছিল মধ্যবর্তী স্তরটির অস্তিত্ব, যে স্তর প্রায়ই অতিক্রম করে যাই আমরা। দান্তেকে প্রথমেই মীমাংসা করে নিতে হয়েছিল এই সমস্যার। Francis অথবা Dominic. প্রেমের তাপ নাকি প্রজ্ঞার প্রভা— শেষ পর্যন্ত প্রাধান্য কার? মধ্যযুগের এই প্রশ্নের যে উত্তর আছে দান্তের মধ্যে, তা এ দুয়ের সমবায়ে জাত। তাই তাঁর নিবিড়তম প্রতীক হয় সূর্য, যার মধ্যে পরিপূরক ভাবে রয়ে গেছে আলো আর উত্তাপ, সমানভাবে যা প্রকীর্ণ হয়ে যায় সবার উপর।১

এই প্রবন্ধে শঙ্খ ঘোষ আলো ফেলেছেন দান্তে ও জীবনানন্দের আত্মীয়তার নিবিড় দিকটির ওপর।

দান্তের পর কয়েকশো বছর পেরিয়ে আমরা এসে পৌঁছেছি এমন এক পৃথিবীতে যেখানে মারণাস্ত্র হাতে নিয়ে অল্প কিছু মানুষ নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নিতে চাইছে গোটা দুনিয়াটাকে। ঔপনিবেশিক যুদ্ধে যুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত মানুষ আজ দেখতে পাচ্ছে প্রেম ও প্রজ্ঞা হারিয়ে তার ভুবন লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে দুঃস্বপ্নের অতলে— কানে এসে বাজছে শত শত শূকরীর প্রসব বেদনা।

‘হলোনেস’ বা শূন্যতার এই বোধ আজকের যে কোনও সংবেদনশীল মানুষকেই ক্লিষ্ট করে। আধুনিক শিল্পীদের সৃষ্টিতেই ধরা পড়েছে যার জয়োদ্ধত অমঙ্গলের চেহারাটা। আমরা কিন্তু সঙ্গীত-উপন্যাস-নাটক-চিত্রশিল্পকে ছেড়ে আমাদের দৃষ্টিকে নিবদ্ধ রাখতে চাই কবিতা এবং চলচ্চিত্র শিল্পের দিকেই। বোদলেয়ার, মনতালে, অ্যালুয়ার, এলিয়ট বা ইয়েটসদের কবিতার গঠন-বিন্যাসকে বিশ্লেষণ করলেই বেরিয়ে আসে আজকের মানুষের শিথিলমূল চেহারাটা। আজকের অমঙ্গলতাড়িত এই সমাজটার ছবি আঁকতে গিয়ে কোনও কোনও কবি অনেক সময়ই গ্রহণ করেছেন চলচ্চিত্রের গঠনরীতি। উল্টো দিকে সিনেমাও অনেক সময় কবিতার ঘনিষ্ঠ হতে হতেই হয়ে উঠেছে একটা কবিতাই। চলচ্চিত্রের সাঙ্গীতিক কাঠামো ক্রমেই সরে আসতে চেয়েছে কাব্যিক কাঠামোর দিকে। প্রজ্ঞা ও প্রেমের আলো জ্বলে উঠতেই সিনেমা এগিয়েছে কবিতার দিকে।

চলচ্চিত্রকার ফেদেরিকো ফেলিনি সিনেমার সঙ্গে কবিতার সম্পর্ক নিয়ে ভাবতে গিয়ে বললেন, ‘আজকাল চলচ্চিত্র পেরিয়ে এসেছে গদ্যের বাচনভঙ্গি এবং সরতে সরতে সে চলে এসেছে কবিতার খুব কাছাকাছি। আমি আমার কাজকে নানা সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, সংকীর্ণতা বলে আমি বোঝাতে চাইছি একটি গল্পের শুরু, বিকাশ ও তার পরিসমাপ্তির গণ্ডিটাকেই। এখন ছবিকে এগিয়ে আসতে হবে ছন্দ-অলংকারে ভূষিত হয়েই।’২

ফেলিনির ‘লা দোলচে ভিতা’ বা মধুর জীবন মুক্তি পায় ১৯৫৯ সালে। ‘ইওরোপিয়ান ইকনমিক কমিউনিটি’-র সদস্যপদ গ্রহণ করে ইতালির অর্থনীতিতে তখন ‘মির‌্যাক‌ল’ ঘটতে শুরু করেছে। কিন্তু মানুষের চূড়ান্ত অবক্ষয়ের, তার আত্মিক বিপর্যয়ের চেহারাটা সংবেদনশীল শিল্পীদের কাছে গোপন থাকেনি। এই মর্মান্তিক অমঙ্গলের ছবিটাকেই আমরা প্রত্যক্ষ করলাম ‘মধুর জীবন’-এ। নামের মধ্যে প্রচ্ছন্ন ছিল যে বিদ্রুপ, প্রথম দৃশ্যেই তা হয়ে উঠেছে উচ্চকিত।

আধুনিক রোম নগরী। পরিত্রাতা যিশুর বিশাল মূর্তিকে স্থানান্তরিত করা হচ্ছে। সূর্য তখন মাঝ আকাশে। রোমান ধ্বংসাবশেষের মাথায় ছায়া ফেলে হেলিকপ্টারের সঙ্গে দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে যিশুকে। দরিদ্র বালকরা বিস্মিত, ঊর্ধ্বমুখ, ছুটে চলে পেছন পেছন। সাউন্ডট্র্যাকে কপ্টারের অবিরাম কটকট আওয়াজ। আকাশছোঁয়া অট্টালিকার মাথায় সূর্যস্নাতা অর্ধনগ্না রমণীদের ছুঁয়ে যায় যিশুর ছায়া— কী অসম্ভব অভিঘাত! বিদ্রুপের কশাঘাতে বোধহয় কেঁপে ওঠে আধুনিক নাগরিক সভ্যতারই অন্তরাত্মা!

আধুনিক সমাজ পণ্যশাসিত সমাজ। এখানে নিভে গেছে প্রেম, নিভে গেছে প্রজ্ঞা। ‘ক্যাকোফনি’-তে আক্রান্ত শহর— চারিদিক থেকে ভেসে আসছে শত শত শূকরীর প্রসববেদনা। ফেলিনির ছবির সূচনাদৃশ্য দেখতে দেখতে আমাদের মনে পড়ে যায় এলিয়টের ‘দ্য লাভ সং অব জে আলফ্রেড প্রুফক’-এর কথা:

Let us go then, you and I,
When the evening is spread out against the sky
Like a patient etherised upon a table...

প্রেতলোকের চক্রের পর চক্র পেরিয়ে আসার অভিজ্ঞতাকে মাথায় রেখেই শিল্পী ফেলিনি গড়ে তুলেছেন তাঁর চিত্রনাট্যের শরীর। এক দিন দিগ্‌ভ্রান্ত দান্তে আপন প্রেমের বিভায় খুঁজে পেয়েছিলেন পথপ্রদর্শক ভার্জিলকে। ফেলিনি কিন্তু মহাকবির পথ অনুসরণ করলেও প্রেমহীন নায়ক মার্সেল্লোকে করেছেন নিরালম্ব, নিঃসহায়। মার্সেল্লোর সঙ্গে সঙ্গে আমাদেরও যাত্রা শুরু হয় প্রেতলোকের পথে। দান্তের মতো আমরাও শিউরে উঠি,

এত দীর্ঘ জনস্রোত দেখে মনে হয়
মৃত্যু যে অসংখ্য প্রাণ বিলুপ্ত করেছে
সে কথা বিশ্বাস করা সংগত হয়নি।৩

মনুষ্যত্বের এই মৃত্যু দেখতে দেখতে আমরা পৌঁছে যাই এক চক্র থেকে আর এক চক্রে, পাল্টে যায় দৃশ্যপট। ইট-কাঠ-কংক্রিটে অবরুদ্ধ মানুষের জীবনে যেহেতু নিভে গেছে প্রেম, তাই পুরুষশাসিত সমাজে নারী আজ আর তার কাছে সম্পত্তি নয়, পুরুষের কাছে সে আজ হয়ে উঠেছে পণ্য। আধুনিক নাগরিক মানুষের ধ্বস্ত যাপনের ছবি দেখতে দেখতে ক্রমশ জেগে ওঠে এক বোধ,

পৃথিবী ভঙ্গুর হয়ে নীচে রক্তে নিভে যেতে চায়;
পৃথিবী প্রতিভা হয়ে আকাশের মতো এক শুভ্রতায় নেমে
নিজেকে মেলাতে গিয়ে বেবিলন লন্ডন
দিল্লী কলকাতার নকটার্নে
অভিভূত হয়ে গেলে মানুষের উত্তরণ
জীবনের মাঝপথে থেমে
মহান তৃতীয় অঙ্কে: গর্ভাঙ্কে তবুও লুপ্ত
হয়ে যাবে না কি।

যদিও ‘আবহমান ইতিহাসচেতনা একটি পাখির মতো যেন’, এই কথা ভেবেও কিন্তু—

সূর্যে আরো নব সূর্যে দীপ্ত হয়ে প্রাণ

দাও— প্রাণ দাও পাখি’ বলে শেষ প্রার্থনাটুকু জানাবার মতো শক্তিও আমরা আজ হারিয়ে বসে আছি।

লং শট থেকে কাট করে ক্যামেরা চলে আসে মিড লং শটে। একটি অভিজাত রেস্তোরাঁর অভ্যন্তর। মুখোশ-পরা নৃত্যরত নর্তকদের ওপর থেকে ক্যামেরা ঘুরে চলে আসে মার্সেল্লোর ওপর। ক্যামেরা ছুঁয়ে যেতে থাকে অপচয়ের আয়োজনে ব্যস্ত দামি মানুষদের মুখ। ফেলিনি কি এখানে মার্সেল্লোর মুখোশ খুলে দেখাতে চাইছেন তার মুখকে, না কি আমাদের মতো অপচয়ের স্রোতে ভাসা নাগরিকদের অনাবৃত করে মেলে ধরার জন্যেই এই আয়োজন?

মার্সেল্লোর সঙ্গে দেখা হয়ে যায় বৈভবে লালিত সুন্দরী ম্যাগদালেনার। ধ্বস্ত যাপনের চেহারা ক্রমে স্পষ্ট হয়ে ওঠে বিপ্রলব্ধা নায়িকার আচরণে। যৌন কামনায় অধীর হয়ে দুজনে মোটরে চড়ে কোথাও উধাও হয়ে যায়:

At the violet hour, when the eyes and back
Turn upward from the desk, when the human engine waits
Like a taxi throbbing waiting...

এই ‘ভায়োলেট আওয়ার’-এ এক বারাঙ্গনার ঘরে অতিবাস্তব পরিসর খুঁজে ‘লাভ মেকিং’ সেরে বেরিয়ে আসে চতুর নাগর-নাগরী। মনে পড়ে যায় জীবনানন্দের ‘মহিলা’ কবিতাটির কথা—

না ভেবে মানুষ কাজ করে যায় শুধু
ভয়াবহভাবে অনায়াসে।
কখনো সম্রাট শনি শেয়াল ও ভাঁড়
সে-নারীর রাং দেখে হো-হো করে হাসে।

মন্তাজের ঢঙে ফেলিনি একের পর এক দৃশ্যে ভাসিয়ে নিয়ে চলেন আমাদের। হেলিকপ্টারের বদলে এবার চলে আসে এরোপ্লেন, পরিত্রাতা যিশুর জায়গা দখল করে নেয় ‘সেক্স বুম’ হলিউড স্টার সিলভিয়া। ফেলিনি তাঁর বিশিষ্ট ভঙ্গিতেই চরিত্রদের স্থাপন করেন কত-না বিভিন্ন লোকেশনে— মেলে ধরেন তাদের অন্তর্নিহিত মাত্রাগুলোকে। রোমকে জানতে যাজকের পোশাকে সিলভিয়া দ্রুত এসে পৌঁছয় সেন্ট পিটারের গির্জায়— প্রথম দৃশ্যের বিদ্রুপের ছায়াপাত ঘটে এখানেও। ‘সেক্স গডেস’কে যাজকের পোশাকে এনে আমাদের আত্মিক দীনতাকেই ফুটিয়ে তোলেন শিল্পী।

আধুনিক হৃদয়হীন সমাজ জীবনানন্দকে ক্লান্ত করেছে। হালভাঙা নাবিকের মতোই তিনি অন্বেষণ করেছেন প্রেমের একটু আলো, জ্ঞানের একটু উত্তাপ। স্বপ্ন দেখেছেন সজীব সুগন্ধময় আশ্রয়ের নিবিড় এক আশ্বাস— যান্ত্রিকতাময় বাস্তবে যা খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। কল্পনার রাজ্যে পৌঁছে ইতিহাসচারণা তাই হয়ে ওঠে অনিবার্য। দান্তের লেডি ফিলসফির মতোই কবির কাব্যলক্ষ্মী বনলতা সেন, বতিচেল্লির ভেনাসের মতোই সে কবির চরম চাওয়ার পরম পাওয়া। আর তাই জীবনানন্দের ঘোষণা— সাময়িকতার সংস্কারমুক্ত করে সময়ব্রহ্মের শুদ্ধ স্বরূপের মধ্যে কবি নিয়ে যান তাঁর কবিতা, কিন্তু সে-কবিতার অস্থির ভিতরে থাকবে ইতিহাসচেতনা ও মর্মে থাকবে পরিচ্ছন্ন কালজ্ঞান।

প্রেতলোক পেরিয়ে এসেছেন দান্তে, শুদ্ধিলোকও অতিক্রান্ত প্রায়। ভোরের নরম আলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে এগিয়ে চলেছেন তিনি। নন্দনকাননের সৌরভে ভরে আছে চারিদিক। স্বর্গীয় আশ্বাসের এক স্বপ্ন বুকে নিয়ে গাছগাছালির মধ্যে আনমনে ঘুরতে ঘুরতে দেখতে পেলেন পবিত্র এক জলধারা। হঠাৎ থমকে যায় চোখ, পা চলে না আর— নদীর অপর পারে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে ফুল তুলছেন অপূর্ব সুন্দরী এক নারী। হতবিহ্বল দান্তের ডাকে সাড়া দিলেন নম্র মাধুর্যে পরিপূর্ণ মাতিল্দা। জানালেন, এটাই নন্দনকানন— গার্ডেন অব ইডেন। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে লেথে নদী, যার জল পান করলে অন্তর্হিত হয় সব পাপবোধ। বিভিন্ন লোকেশনকে ছবিতে ব্যবহারের সুযোগ থাকলেও ফেলিনির অন-লোকেশন শুটিংয়ে অনীহা গোটা রোমকেই তুলে আনে স্টুডিয়োর অভ্যন্তরে— শিশুর উত্তেজনায় সৃষ্টি করেন ‘নিজের’ রোম। আর সেখানে প্রমত্ত ঝড়ের মতোই সিলভিয়া মার্সেল্লোকে ছুটিয়ে নিয়ে চলে এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে। ‘প্যাট্রিসিয়া’ সুরের তালে তালে শুরু হয় যুগল নৃত্য। সমস্ত নারীর অধরা মাধুরী নিয়ে গড়ে তোলা সিলভিয়াকে মনে হয় প্রকৃতির আদি সৃষ্টি, উর্বশীর বক্ষলগ্ন হয়েও তাই মার্সেল্লো আত্মহারা! আসলে ফেলিনি শিশুর বিস্ময়ে দেখেন জীবনকে, দেখেন নারীকেও— সিলভিয়া তাই দেহের ডাকে যতটা না মেতে ওঠে, তার চেয়েও বেশি মেতে ওঠে বেড়ালছানা নিয়ে খেলতে খেলতে।

ট্রেভি ফাউন্টেনে চলে আসে তারা। সিক্তা সিলভিয়া কামনামদির করে তোলে মার্সেল্লোকে। দেবীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে নিবিড় হতে এগিয়ে গেলে হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে যায় ঝরনা। চকিতে মনে ভেসে আসে জীবনানন্দ দাশের ‘সুদর্শনা’ কবিতাটি,

একদিন ম্লান হেসে আমি
তোমার মতন এক মহিলার কাছে
যুগের সঞ্চিত পণ্যে লীন হতে গিয়ে
অগ্নিপরিধির মাঝে সহসা দাঁড়িয়ে
শুনেছি কিন্নরকণ্ঠ দেবদারু গাছে,
দেখেছি অমৃতসূর্য আছে।

সবচেয়ে আকাশ নক্ষত্র ঘাস চন্দ্রমল্লিকার
রাত্রি ভালো,
তবুও সময় স্থির নয়,
আরেক গভীরতর শেষ রূপ চেয়ে
দেখেছে সে তোমার বলয়।
এই পৃথিবীর ভালো পরিচিত রোদের মতন
তোমার শরীর, তুমি দান কর নি তো,
সুদর্শনা, তুমি আজ মৃত।

মনে পড়ে যায় শুদ্ধিলোকের অষ্টবিংশ সর্গের কথা। ফেলিনি সচেতন ভাবেই মাতিল্দার কথা মাথায় রেখে গড়ে তুলেছেন সিলভিয়া পর্ব। মাতিল্দা-সুদর্শনা-সিলভিয়াদের দেখে যাত্রী দান্তে, কবি জীবনানন্দ বা সাংবাদিক মার্সেল্লোর মনে জ্বলেছে কামনার আগুন। অতি সূক্ষ্মভাবে কবি দান্তে এর বিচার করেছেন— যার আলো ব্যাপ্ত হয়েছে জীবনানন্দ ও ফেলিনির সৃষ্টিতে। পুরাকালে যে পবিত্রতা অটুট ছিল আদমের স্বর্গভ্রষ্ট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তা বিনষ্ট হয়ে যায়, এখন আর তাকে ফিরে পাওয়া বা নষ্ট করা সম্ভব নয়— ‘সুদর্শনা, তুমি আজ মৃত’। অর্থাৎ, মাতিল্দা-সুদর্শনা-সিলভিয়ারা আদিম পবিত্রতার এক-একটি ফিগার মাত্র— একে পাওয়া যেমন সম্ভব নয়, একে নষ্ট করাও তেমনি সম্ভব নয়। তাই তো ছবিতে দেখি সিলভিয়াকে ভোগ করতে চেয়ে মার্সেল্লো যখন ম্যাগদালেনার কাছে একটু পরিসর খোঁজে, তখন তাকে ব্যর্থ হয়েই ফিরে আসতে হয়।

‘কম্মেদিয়া’য় মাতিল্দা দান্তেকে পান করিয়েছে অমল নদীর জল, ছবিতে কিন্তু কামনা-কাতর মার্সেল্লো ট্রেভি ফাউন্টেনে নেমে সিলভিয়াকে জড়িয়ে ধরতেই স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে জল পড়া। মাতিল্দা ক্লাসিক্যাল তাই মঙ্গলময়ী, মাতিল্দার অনাবিল সরল জীবন থেকে সরে এসে অর্বাচীন সিলভিয়া এসে পৌঁছেছে এক জটিল সময়ে, সব রকম স্থূলতাই যার যুগলক্ষণ— গলার স্বরে মাধুর্যের অভাব এনে ফেলিনি জোর দিয়েছেন সেই ভাবনাতেই।

জীবনের মহা অপচয়ের মধ্যে ভাসতে থাকে আধুনিক মানুষ। জে আলফ্রেড প্রুফকের মতোই নিউরোটিক প্রেমের গ্লানি বয়ে ক্যাস্‌ল দৃশ্য পেরিয়ে অন্তিম অঙ্কে পৌঁছে যায় মার্সেল্লো। এবার নাদিরার ঘরে শুরু হয়ে যায় রিরংসার মত্ততা— বীভৎস যাপনার মধ্য দিয়ে ক্রমে ফুটে ওঠে চূড়ান্ত ব্যভিচারের কদর্য চেহারাটা। ভোরের আলো ফুটতেই দেহটাকে একটু গুছিয়ে নেওয়ার জন্য ওরা ছুটে চলে আসে সমুদ্রতটে। সমুদ্রের সাদা ফেনার মতোই মার্সেল্লোর পরনে তখন সাদা ট্রাউজার্স আর সাদা কোট অগোছালো:

I shall wear white flannnel trousers, and walk upon the beach,
I have heard the mermaids singing, each to each.
I do not think that they will sing to me.

I have seen them riding seaward on the waves
Combing the white hair of the waves blown back.
When the wind blows the water white and black.

We have lingered in the chambers of the sea
By sea-girls wreathed with seaweed red and brown
Till human voices wakes us, and we drown.৪

শুভ্র পোশাকেও ঢাকা পড়ে না মার্সেল্লোর অশুভ যাপনা। সমুদ্রতটে তাই পড়ে থাকতে দেখি অমঙ্গলের প্রতীক এক দানবাকৃতি মাছকে। অমঙ্গলকে প্রতিস্থাপিত করতে এগিয়ে আসে পাওলা— কিন্তু ‘মারমেড’-এর সঙ্গীত প্রবেশ করে না মার্সেল্লোর কানে। আমরা বুঝতে পারি, অপচয়ের অতলে তলিয়ে যাওয়ার অনিবার্য ঝোঁকেই আমরা আজ আমাদের জীবন থেকে নির্বাসন দিয়েছি সুন্দরকে, মঙ্গলকে!



তথ্যসূত্র

১. শঙ্খ ঘোষ, ‘ঐতিহ্যের বিস্তার’, ‘চণ্ডিদাস না দান্তে’
২. An interview with G. Bachmann in Cinema 65, No. 99
৩. Inferno III. 52-57
৪. Quoted by Lilian Rossin, The New Yorker, Oct 30, 1965, p 66

প্রবন্ধ - অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়



বাঙালি এবং বাংলা ভাষায় ধর্ম-সংকট


(তৃতীয় পর্ব)

উনিশ শতকের বাঙালি সাহিত্যিক বঙ্কিমবাবু অনুধাবন করেছেন, বাংলা ভাষা ও বাংলা সাহিত্য নিদারুণ সংকটে। তিনি বঙ্গদর্শনের লিখছেন – “ইংরাজিপ্রিয় কৃতবিদ্যগণের প্রায় স্থির জ্ঞান আছে যে, তাঁহাদের পাঠের যোগ্য কিছুই বাঙ্গালা ভাষায় লিখিত হইতে পারে না। তাঁহাদের বিবেচনায়, বাঙ্গালা ভাষার লেখকমাত্রেই হয়ত বিদ্যাবুদ্ধিহীন, লিপিকৌশলশূন্য; নয়তো ইংরাজি গ্রন্থের অনুবাদক। তাঁহাদের বিশ্বাস যে, যাহা কিছু বাঙ্গালা ভাষায় লিপিবদ্ধ হয়, তাহা হয়ত অপাঠ্য, নয়তো কোনো ইংরেজ গ্রন্থের ছায়ামাত্র; ইংরাজিতে যাহা আছে, তাহা বাঙ্গালায় পড়িয়া আত্মাবমাননার প্রয়োজন কি? সহজে কালো চামড়ার অপরাধে ধরা পড়িয়া আমরা নানারূপ সাফাইয়ের চেষ্টায় বেড়াইতেছি, বাঙ্গালা পড়িয়া কবুল-জবাব কেন দিব!” বঙ্কিমের ভাষায় একটা বিষয় স্পষ্ট – সেসময় বাঙালিদের ইংরেজ-প্রেম ও ইংরেজি ভাষাপ্রেম অবিসংবাদিত হয়ে উঠেছিল। এতটাই অবিসংবাদিত হয়ে উঠেছিল যে, তারা নিজের মাতৃভাষা ও নিজের জাতিকেই ঘৃণা করতে শুরু করে দিয়েছিল। বঙ্কিমচন্দ্র লিখছেন – “লেখাপড়ার কথা দূরে থাক, এখন নব্য সম্প্রদায়ের মধ্যে কোন কাজই বাঙ্গালায় হয় না। বিদ্যালোচনা ইংরাজিতে। সাধারণ কার্য, মিটিং, লেকচর, এড্রেস, প্রোসিডিংস সমুদায় ইংরাজিতে। যদি উভয় পক্ষ ইংরাজি জানেন, তবে কথোপকথনও ইংরাজিতেই হয়; কখন ষোলো আনা, কখন বারো আনা ইংরাজি। কথোপকথন যাহাই হউক, পত্রলেখা কখনই বাঙ্গালায় হয় না। আমরা কখনও দেখি নাই যে, যেখানে উভয় পক্ষ ইংরাজির কিছু জানেন, সেখানে বাঙ্গালায় পত্র লেখা হইয়াছে। আমাদিগের এমনও ভরসা আছে যে, অগৌণে দুর্গোৎসবে মন্ত্রাদিও ইংরাজিতে পঠিত হইবে।…..এক্ষণে ইংরাজিতে না বলিলে ইংরাজে বুঝে না; ইংরাজে না বুঝিলে ইংরাজের নিকট মানমর্যাদা হয় না; ইংরাজের কাছে মানমর্যাদা না থাকিলে কোথাও থাকে না, অথবা থাকা না-থাকা সমান। ইংরাজ যাহা না শুনিল, তাহা অরণ্যে রোদন; ইংরাজ যাহা না দেখিল, তাহা ভস্মে ঘৃত।” এ কৃতিত্ব অবশ্যই শুধু হিন্দু বাঙালিদের। এতে মুসলমান বাঙালিরা ছিলেন বহু যোজন দূরে। হিন্দু বাঙালিদের ইংরেজিপ্রেম আজও অব্যাহত। তবে এটা পরিষ্কার, সে সময় শাসক কে, শাসকের ধর্ম কী, শাসকের জাতি কী তা নিয়ে মোটেই মাথাব্যথা ছিল না। মাথাব্যথা ছিল কতটা দাসত্ব মেনে নিলে কীভাবে শাসকের কাছাকাছি থাকা যায়, কীভাবে রাজানুকূল্য পাওয়া যায়, কীভাবে উপাধি-শিরোপা পাওয়া যায়, তার অক্লান্ত প্রচেষ্টা। হিন্দুদের সেই চরম আনুগত্যে মুসলিম শাসকরা দীর্ঘ ৮০০ বছর এবং ব্রিটিশরা ২০০ বছর ভারত-শাসন করতে পেরেছিল। মুসলমান শাসকদের ব্রিটিশরা ক্ষমতাচ্যুত করেছিল ভারতে ব্রিটিশ-উপনিবেশ করে সম্পদ লুঠ করার জন্যে, আর ব্রিটিশরা ক্ষমতাচ্যুত ভারতীয়দের অন্যায়ভাবে অকথ্য অত্যাচার করার জন্য। ব্রিটিশরা যদি ভারতীয়দের এভাবে অকথ্য অত্যাচার না করত, তাহলে হিন্দুদের সহযোগিতায় হাজার বছর শাসন করাটা অবলীলায় ঘটত। ভারতের ভাষা-সংস্কৃতি-সাহিত্য সব চুলোয় যেত। ভারতে আর-একটা আয়ারল্যান্ড তৈরি হত।

অপরদিকে মুসলমান শাসনকালে মুসলিমরা আরবি-ফারসি ভাষা চর্চা করতই, হিন্দুরাও করত। মুসলমান আমলে কত আরবি-ফারসি শব্দ যে বাংলা হয়ে গেছে, তা আর বলার নেই। জমি থেকে ফসল পর্যন্ত কৃষি সংক্রান্ত প্রায় সব কথাই হয় ফারসি নয় আরবি। জমি ও জমিদারি সংক্রান্ত সব কথাই ওই আরবি-ফারসির দান। আইন-আদালত, ও তার ভাষাও আরবি-ফারসি। ‘আর্জি’ থেকে ‘রায়’ ‘ফয়সালা’ পর্যন্ত মামলার আদ্যোপান্ত সব ভাষাই মুসলমানদের দান। একদা ইংরেজ বিচারপতিরা ডিক্রি দিতেন বটে, কিন্তু তা ‘জারি’ করতে ইংরেজি ছেড়ে ফারসির শরণাপন্ন হতেন। সে সময় থেকেই বাংলা ভাষা বিদেশি ভাষা বেমালুম আত্মসাৎ করেছে। সেকালে বাংলা ভাষা মুসলমানদের কাছ থেকে কর্মের ভাষা নিয়েছিল, পোর্তুগিজ-ফরাসিদের কাছ থেকে নিয়েছিল জিনিসপত্রের নাম, আর ইংরেজি থেকে ও দুই জাতীয় কথা তো নিচ্ছিই, উপরন্তু তার জ্ঞানের ভাষাও আত্মসাৎ করেছি। প্রমথ চৌধুরী ‘আমাদের ভাষা সংকট’ গ্রন্থে লিখেছেন –“মুসলমানরা আমাদের দেশে যেসব নতুন কছমের আদালত-কাছারি আইন-কানুন এনেছে তাদের সঙ্গে তাদের বিদেশি নামও এসেছে। এবং সেই আইন-আদালত যেমন সমাজের উপর চেপে বসেছে, তাদের নামও তেমনি ভাষার ভিতর ঢুকে বসেছে। ফিরিঙ্গিরা যেসব নতুন জিনিস এ দেশে নিয়ে এসেছে আর আমাদের ঘরে ঘরে যার স্থান হয়েছে, তাদের নামও আমাদের মুখে মুখে চলেছে। তাস হিন্দুরা খেলত না, তারা খেলত পাশা; মুসলমানরাও খেলত না, তারা খেলত হয় সতরঞ্চ নয় গঞ্জিফা। ফিরিঙ্গিরা যখন দেশে তাস আনলে তখন শুধু বিন্তি নয় প্রমরা খেলতেও আমরা শিখলুম, ফলে ফরাসি কথা জুয়ো বাংলা হয়ে গেল, আর সেইসঙ্গে জুয়ো-খেলিয়ে বাঙালিরা ফরাসিতে যাকে বলে জুয়াড়ি তাই হয়ে উঠল।”

১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ বাংলায় পাঠান যুগের অবসান হল। শুরু হল মোগল যুগ। মোগল যুগে ফারসি ভাষার চর্চা ব্যাপক বিস্তার লাভ করেছিল। ১৫৭৬ থেকে ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দ – এই দীর্ঘ ১৮১ বছর বৃহৎ বাংলার সাধারণ মানুষ হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে তাদের জীবনযাপনে ফারসি ভাষাকে আত্মীকরণ করতে থাকে। কেন-না জীবনজীবিকার তাগিদে ফারসি ভাষা শিখতেই হত। এখন যেমন হিন্দি ও ইংরেজি ভাষা শিখে নিতে হয়। যদিও হিন্দি ও ইংরেজি ভাষার কোনোটাই ভারতের রাজভাষা বা রাষ্ট্রভাষা নয়, কিন্তু মোগল আমলে ফারসি ভাষাই সরকারি ভাষা বা রাজভাষা ছিল। ফারসি ভাষা এতটা আত্মীকরণ করে নিয়েছিল সাধারণ মানুষ যে, হিন্দু জনগোষ্ঠীর মানুষরাও ‘বিসমিল্লাহ’ উচ্চারণ করে গ্রন্থ পাঠ করত। শুধু ভাষা ক্ষেত্রেই নয়, মুসলিম শাসনকালে হিন্দু জীবনে পোশাক-আশাক, খাদ্যাভ্যাস, নিত্য আচার-অনুষ্ঠানেও ব্যাপক প্রভাব পড়েছিল। যেমন মুসলিম সমাজের বোরখা বা পর্দারীতিতে হিন্দুসমাজে ঘোমটা রীতির প্রচলন হয়েছিল। ঘোমটার দৈর্ঘ্য এতটাই ছিল যে মহিলাদের মুখ দেখাই যেত না। দীর্ঘ ঘোমটা মহিলাদের বলা হত ‘কলাবউ’। মোগল যুগে ফারসি ভাষা চর্চা প্রসঙ্গে ডঃ মোহম্মদ এনামুল হক তাঁর ‘মুসলিম বাঙ্গালা সাহিত্য’ গ্রন্থে লিখেছেন – “শাহি ফরমানা ফারসি, ফৌজদারি ও দেওয়ানি আদালতে ফারসি, রাজস্ব বিভাগে ফারসি, শিক্ষা-দীক্ষা এবং আলাপ-আলোচনায় ফারসি দেদার চলিতে লাগিল। বিদ্যাবত্তা, চাকরি-বাকরি, এমনকি সভ্যতা-ভব্যতার মাপকাঠিও অচিরেই ফারসি হইয়া উঠিল।” বৃহৎ বঙ্গে আরবি-ফারসির চর্চা ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে লর্ড বেন্টিঙ্কের আমল পর্যন্ত মানুষের ভালোবাসার ভাষা হয়ে বিরাজ করলেও ব্রিটিশ তথা ইংরেজদের উপনিবেশ ভারতে জাঁকিয়ে বসতে শুরু করলে আরবি-ফারসি ভাসা দ্রুত সংকুচিত হতে থাকল, বিশেষ করে হিন্দু জনগোষ্ঠীর মধ্যে। হিন্দু জনগোষ্ঠী ইংরেজদের কৃষ্টি-সংস্কৃতি-ভাষা পরমাদরে গ্রহণ করে নব্য ইংরেজ হয়ে ওঠার বাসনা জ্ঞাপন করল। ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে লর্ড ক্লাইভ যখন বাংলা-বিহার-ওড়িশার দেওয়ানি হাতিয়ে নিল, তখন থেকেই ফারসি ভাষা অস্তমিত হতে থাকল। তারপর বাঙালি হিন্দু কে কতটা ইংরেজ হয়ে উঠতে পারল তারই প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল হিন্দুসমাজে। অপরদিকে মুসলিম জনগোষ্ঠী ব্রিটিশ তথা ইংরেজদের গ্রহণ করতে পারল না বা গ্রহণ করল না। ইংরেজরাই ভারত থেকে মুসলিম শাসনের চির-অবসান ঘটিয়েছে, মুসলিমদের ক্ষমতার অলিন্দ থেকে সরিয়ে দিয়েছে। সেই কারণেই বোধহয় মুসলিমরা ইংরেজ সংস্কৃতি বর্জন করেছিল। এর ফলে অবশ্যই মুসলিম সমাজে প্রভূত ক্ষতিসাধন হয়েছিল। হিন্দু জনগোষ্ঠী থেকে শিক্ষা-দীক্ষা-সংস্কৃতিতে মুসলিম জনগোষ্ঠী ক্রমশ পিছিয়ে যেতে থাকল। হিন্দু সম্প্রদায়রা কথ্যভাষা থেকে আরবি-ফারসির বিদায় দিতে সক্ষম হলেও মুসলিমরা আরবি-ফারসির ব্যবহার বেশি বেশি করে করতে থাকল স্বতন্ত্রতা রক্ষার তাগিদে। সেই কারণে বাঙালি হিন্দু আর বাঙালি মুসলিমদের ভাষা বাংলা হলেও অনেকটা পৃথক হয়ে গেল। সৃষ্টি হল হিন্দুয়ানি বাংলা ও মুসলমানি বাংলা। আমরা অনেকেই শুনেছি ‘হিন্দুয়ানি বাংলা’ এবং ‘মুসলমানি বাংলা’ পরিভাষা দুটি। বিশেষ করে পাকিস্তান আমলে রবীন্দ্রচর্চার উপর যখন বিধিনিষেধ আরোপ করল, তখন শাসকগোষ্ঠীর স্বাভাবিক প্রতিক্রয়া থেকেই মুসলমানি বাংলার উপর এক ধরনের ক্ষোভ সৃষ্টি হল। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এটা কি ভাষার সমস্যা, নাকি রাজনীতির? তবে মৌলিক প্রশ্ন হচ্ছে, কোথা থেকে এল এই পরিভাষা দুটি? উপনিবেশের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি ছিল?

সুধাকর গ্রুপের বাইরেও কিছু মুসলিম পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন। মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী (১৮৭৫-১৯৫০) তাঁদের একজন। তিনি তাঁর লেখা ‘ভূগোলশাস্ত্রে মুসলমান’ গ্রন্থ থেকে জানা যায় -- ব্রিটিশ উপনিবেশের বিরুদ্ধে নিজের রাজনৈতিক লড়াইয়ের পাশাপাশি পশ্চিমী ইতিহাসবিদ এবং তাঁদের এদেশীয় হিন্দু দোসরদের দ্বারা পরিকল্পিতভাবে ভারতে মুসলিম শাসনকে দানবীয়ভাবে উপস্থাপনের বিরুদ্ধেও ইসলামাবাদী তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই চালিয়ে গেছেন নিরলসভাবে। এর মাধ্যমে তিনি বেঙ্গলের সাম্প্রদায়িক হিন্দু লেখকদের বর্ণিত ধারার ইতিহাসের বিপরীতে ‘সঠিক ধারা’র ইতিহাস পাঠকদের সামনে তুলে ধরেছেন।

ঊনিশ শতকে খ্রিস্টধর্মের আগ্রাসন থেকে ইসলাম এবং মুসলমানদের বাঁচাতে বাংলায় বই-পুস্তক রচনায় এগিয়ে আসা মুনশি বা মাওলানাদের কেউই ইংরেজি শিক্ষিত ছিলেন না। তাঁদের বেশিরভাগই আরবি এবং ফারসি ভাষা ও সাহিত্যে পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন। ফলে তাঁদের লিখিত বাংলা গদ্য হিন্দু লেখকদের দ্বারা লিখিত গদ্যের চেয়ে ভিন্নতর হওয়া ছিল অবশ্যম্ভাবী। যখন হিন্দুদের লিখিত গদ্য ছিল সংস্কৃত-প্রভাবিত, এমনকি আরবি-ফারসি মৌল থেকে উৎসারিত খুবই পরিচিত শব্দগুলোও তাতে পাওয়া যেত না, তখন মুসলিম লেখকদের লেখা হয়ে ওঠে আরবি-ফারসির বাহুল্য। যতদূর সম্ভব সংস্কৃত শব্দকে এড়িয়ে চলার প্রবণতা স্পষ্ট লক্ষ করা যায় মুসলিম লেখকদের কলমে।

একইভাবে বাক্যগঠন রীতি, শব্দার্থগত দিক এবং উপজীব্যের দিক থেকেও উনিশ শতকে গড়ে ওঠা বাংলা গদ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়ে -- হিন্দুয়ানি এবং ইসলামি। এই বিভক্তি বাঙলার হিন্দু এবং মুসলমানদের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক বিভক্তির দেয়ালকে আরও উঁচু করতে ভূমিকা রেখেছে।

ফারসি মোগল সাম্রাজ্যের ভাষা থাকার কারণে এবং পরবর্তীকালে সম্রাট শাহজাহানের সময়ে সেনাদের মধ্যে ঊর্দুর ব্যবহারের ফলে ইংরেজদের হাতে পড়ার আগেই বাংলায় অনেক আরবি-ফারসি শব্দ ঢুকে পড়ে, পোশাক-ধর্ম পাল্টে, কিংবা আরবি-ফারসি হিসাবেই। আঠারশো শতাব্দীর প্রথমদিকের লেখার নমুনা --- “হোমাঙু বাদসাহের ওফাত হইলে হিন্দোস্তানে বাদসাহ হইতে ব্যাজ হইল, আপনারদের মধ্যে আত্মকলহ কইয়া বিস্তর২ লড়াই কাজিয়া হইল।” পরবর্তী সময়ে বাংলা ভাষায় এই আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহার কমতে শুরু করে। ভারতভাগের পরে খানিকটা ধর্মীয় কারণে সংস্কৃতায়িত বাংলা (যা অনেকে হিন্দুয়ানি বাংলা বলে মনে করে) ছেড়ে আরবি-ফারসি শব্দের আধিক্যে এক ধরনের (এসলামি) বাংলার প্রচলন ঘটে বা ঘটানো হয়। এসময় এরকম ধরনের প্রস্তাবও ছিল যে ‘অনেক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট’ না-লিখে ‘অনেক পিরে মাজেজা নষ্ট’ বলা হোক। বলা হোক, ‘রাখে হরি মারে কে’ পরিবর্তে ‘রাখে আল্লা মারে কে’ ইত্যাদি। মুসলমানি বাংলার আরও দু-একটি উদাহরণ -- “ফজরের আউয়াল ওয়াকতে উঠিয়া ফুফু-আম্মা চাচাজিকে কহিলেন, আমাকে জলদি এক বদনা পানি দাও। আমি পায়াখানা ফিরিয়া গোসল করিয়া নামাজ পড়িয়া নাশতা খাইব।” বা “গোজশ্‌তা এশায়াতে আমরা অতীতে বাংলা ভাষার নানা মোড় পরিবর্তনের কথা মোখ্‌তাসার ভাবে উল্লেখ করেছিলাম।” অথবা “শহর কলকাত্তায় শেফাউল মুল্‌ক্‌ তশরিফ রাখিতেছেন না বহুত রোজের কথা। আর তশরিফ রাখিলেই ফায়দাই-বা কী? সে ছিল এক জামানা। ওজারতের তেজারত আর তেজারতের ওজারতে সুবে বাঙ্গলা ছিল সরগরম।”

সংস্কৃত, আরবি-ফারসি, ফরাসি, পর্তুগিজ, তুর্কি, বর্মি সব ভাষার শব্দ নিয়েই বাংলা ভাষার, তার হিন্দুয়ানিও নেই মুসলমানিও নেই। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের আগের বাংলায় যেমন আরবি-ফারসি ও সংস্কৃত শব্দ পাওয়া যায়, তার পরেও ঠিক তেমনই পাওয়া যায়। বাংলা ভাষার প্রকৃতি বজায় রেখে সহজে খাপ খেয়ে যায় এমন ভাবে বিদেশি শব্দের ব্যবহার বাংলায় ঢের সাহিত্যিকের লেখায় পাওয়া যায়। যদি কোনও ক্ষেত্রে ধর্মীয় কারণে লেখায় বা বাচনে সংস্কৃত বা আরবি-ফারসি শব্দের আধিক্য দেখা দেয়, তাহলে তা ভাষাপ্রকার (register) হিসেবে চিহ্নিত হবে।

বাঙালি হিন্দুরা বলে ‘উপোস’ বা ‘উপবাস’, বাঙালি মুসলিমরা বলে ‘রোজা’। বাঙালি হিন্দুরা বলে ‘নমস্কার’, বাঙালি মুসলিমরা বলেন ‘আদাব’। বাঙালি হিন্দুরা বলে ‘নিমন্ত্রণ’, বাঙালি মুসলিমরা বলেন ‘দাওয়াত’। বাঙালি হিন্দুরা বলে ‘বৈধ’, বাঙালি মুসলিমরা বলেন ‘জায়েজ’। বাঙালি হিন্দুরা বলেন ‘মৃত্যু’, বাঙালি মুসলিমরা বলে ‘ইন্তেকাল’। বাঙালি হিন্দুরা বলেন ‘আকাশ’, বাঙালি মুসলিমরা বলে ‘আসমান’। বাঙালি হিন্দুরা বলেন ‘স্বর্গ’, বাঙালি মুসলিমরা বলে ‘বেহেস্ত’। বাঙালি হিন্দুরা বলেন ‘নরক’, বাঙালি মুসলিমরা বলে ‘দোজখ’। বাঙালি হিন্দুরা ‘প্রাক্তন’ বলে, বাঙালি মুসলিমরা ‘সাবেক’ বলে। বাঙালি হিন্দুরা ‘জলখাবার’ বলে, বাঙালি মুসলিমরা ‘নাস্তা’ বলে। বাঙালি হিন্দুরা ‘স্নান’ বলে, বাঙালি মুসলিমরা ‘গোসল’ বলে। বাঙালি হিন্দুরা ‘জল’ বলে, বাঙালি মুসলিমরা ‘পানি’ বলে। কিন্তু বাঙালি হিন্দুরা একসময় ‘জলপানি’ বলত, এখন সেটা হারিয়ে ‘স্কলারশিপ’ হয়েছে। ‘জলপানি’ শব্দটার ব্যবহার এখন নেই বললেই চলে। জলপানির কথা যখন উঠলই, তখন জল ও পানির তফাৎটা কেন একটু দেখে নেওয়া যাক।

এক শ্রেণির উগ্র বাঙালি হিন্দুত্ববাদী বাঙালি মুসলমানদের প্রশ্ন করে – আপনারা যে নিজেদের বাঙালি বলে জাহির করেন, আপনারা কীসের বাঙালি? আপনারা বাঙালি মোটেই নন, আপনারা মুসলিম। তাই আমরা জলকে ‘জল’ বলি, আপনারা জলকে ‘পানি’ বলেন।” সেইসব উগ্র বাঙালি হিন্দুত্ববাদীরা জানেনই না, প্রাচীন বাংলায় বাঙালিরা জলকে যেমন ‘জল’ বলত, আবার ‘পানি’ও বলত। এই সময়কালে রচিত চর্যাপদে দেখুন ‘পানি’ শব্দের ব‍্যবহার : “তিণ ন চছুপইী হরিণা পিবই ন পাণী।/ হরিণা হরিণির নিলঅ ণ জাণী।।” (সংস্কৃত) পানীয় --> (পালি) পানীয় --> (প্রাকৃত) পাণিঅ --> (বাংলা) পাণি/পাণী --> আধুনিক বাংলা পানি (অতীতে পানী বানানও প্রচলিত ছিল)। পানি ও জল – দুটোই ভারতীয় ও তথাকথিত হিন্দু শব্দ। ‘পানীয়’ শব্দটি (সংস্কৃত ধাতু ৴পা + অনীয়) সামান্য পরিবর্তিত হয়ে ‘পানি’ শব্দটি তৈরি হয়েছে। ‘পানি’ শব্দটির ব্যুৎপত্তি হল সংস্কৃত ধাতু ৴পানি + অ = পানি হচ্ছে। একই প্রাকৃত শব্দ "পাণিঅ" থেকে হিন্দি, ঊর্দু, মারাঠি, গুজরাতি, মৈথিলী ও ওড়িয়া ভাষাতেও ‘পানি’ শব্দটি প্রবেশ করেছে। পানির সঙ্গে আরবি বা ফারসি ভাষার কোনো সম্পর্ক নেই। আরবিতে জলকে বলে ‘মাউন’ এবং ফারসিতে জলকে বলে ‘আব’ (আব থেকেই আবহাওয়া, অর্থাৎ জলহাওয়া। আব থেকে সংস্কৃতে ‘অপ’ – ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম)। সুতরাং ‘পানি’ শব্দটি মুসলমানরা এখন ব‍্যবহার করে বলে এটা অবাঙালি হতে পারে না। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় একসময় এর ব‍্যবহার হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সকল বাঙালিই করতেন। চর্যার পরবর্তী বাংলা সাহিত্যের একটি বড়ো উপাদান হল ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’। সেখানেও জল শব্দের পরিবর্তে পানির ব‍্যবহার লক্ষণীয় -- “কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি কালিনী নই কূলে।/কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি এ গোঠ গোকুলে।/আকুল শরীর মোর বেয়াকুল মন।/বাঁশীর শবদেঁ মো আউলাইলোঁ বান্ধন।/কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি সে না কোন জনা।/দাসী হুআঁ তার পাএ নিশিবোঁ আপনা।/কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি চিত্তের হরিষে।/তার পাএ বড়ায়ি মোঁ কৈলোঁ কোন দোষে।/আঝর ঝরএ মোর নয়নের পাণী।/বাঁশীর শবদেঁ বড়ায়ি হারায়িলোঁ পরাণী।”

বড়ু চণ্ডীদাস ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তন’ কাব্যে এই দুই শব্দ পাশাপাশি ব্যবহার করেছেন – “তোহ্মার বোলে কেহো কাহ্নাঞি না বহিব পাণী।/ উচিত নিফল হৈব তোর জল ভাবি বুঝ চক্রপাণী।।” (যমুনাখণ্ড) বড়ু চণ্ডীদাস অসংখ্যবার পাণী (বা পাণি) ব্যবহার করেছেন জল, পানীয় বা বৃষ্টির প্রতিশব্দ হিসাবে (এখনও মুর্শিদাবাদের মুসলমান জনগোষ্ঠীর কথায় পানি = বৃষ্টি। ‘রোদ হ’চে পানি হ’চে/ খ্যাক শিয়ালের বিহে হ’চে’।)। মধ্যযুগের কবিরা অবলীলায় চয়ন করছেন এই দুটি শব্দ। চণ্ডীমঙ্গলে পাচ্ছি, “বিরহ-জ্বরে পতি যদি মরে/ কোন ঘাটে খাবে পাণী/ কাঁখে হেমঝারি মেনকা সুন্দরী/ জল সাধে ঘরে ঘরে” (কবিকঙ্কণ)। চৈতন্যমঙ্গলে – “এ বোল শুনিয়া পুনঃ প্রভু বিশ্বম্ভর। কান্দয়ে দ্বিগুণ ঝরে নয়নের জল।।” এবং “মুখে নাহি সরে বানী/ দু নয়নে ঝরে পানি...” (লোচনদাস)। এমনকী সৈয়দ আলাওল, যাঁকে আপামর বাঙালি ‘মুসলমান কবি’ হিসাবেই চেনে, তিনিও ‘জল’ ব্যবহার করেছেন। পড়ুন -- “শীর্ষের সিন্দুর নয়ানের কাজল/ সব ভাসি গেল জলে।” অথবা “না ভিজয় জলেত অগ্নিত না পোড়য়” (পদ্মাবতী)। খনা জল ও পানি উভয়ই লিখতেন। খনার বচনে আমরা পাচ্ছি – “খনা বলে শুন হে স্বামী/ শ্রাবণ ভাদরে হবে না পানি” এবং “রান্ধি বাড়ি যেবা নারী পুরুষের আগে খায়/ ভরা কলসীর জল তার তরাসে শুকায়।” অন্যদিকে লোকসাহিত্য যখন যেটা জুতসই মনে করেছে, তখন সেটা ব্যবহার করেছে। যেমন – “থির পানী পাথর সয়” এবং “জলেই জল বাধে”; “হাতি ঘোড়া গেল তল/ মশা বলে কত জল”; “ধরি মাছ, না ছুঁই পানি”; “ধন জন জোয়ানি/ কচু পাতার পানি”; “হালে পানি নেই”।

বাঁকুড়ার এক প্রত‍্যন্ত গ্রামে বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভের বাড়িতে অযত্নে রক্ষিত রাধা-কৃষ্ণের এই লীলাকাহিনিতে মুসলমানরা কী উদ্দেশ্যে উর্দু পানি ঢোকালেন বলতে পারেন? এই পুরানো পুঁথিগুলি আবিষ্কৃত না-হলে মনে হয় বাংলার মুসলমানদের বাঙালিত্ব প্রমাণ করতে জীবন দিতে হত। জল একটি তৎসম শব্দ, যা সংস্কৃত ‘জলম্’ থেকে সরাসরি এসেছে। আদি বাংলায়, প্রাকৃত পানির ব‍্যবহার ছিল প্রমাণিত। তৎসম জলের ব‍্যবহার ছিল কি না প্রশ্নযুক্ত। আর যদি আদিকালে ‘পানি’ ও ‘জল’ দুটি শব্দের ব‍্যবহার থেকেও থাকে, এটা আপনাকে মানতেই হবে তখন বাংলার মানুষ পান করার জন্য ব‍্যবহৃত জলকে পানিই বলত।

আমি তখনের কথা বলছি, যখন ভারতে তথা বাংলায় ইসলাম আসেনি। সেইসব উগ্র বাঙালি হিন্দুত্ববাদীরা ভুলেই যান উত্তর ভারতীয় হিন্দুরা কেউই জলকে ‘জল’ বলে না, ‘পানি’-ই বলে। এমনকি সেইসব উগ্র বাঙালি হিন্দুত্ববাদীরা যখন উত্তর ভারতীয়দের সঙ্গে কথা বলেন, তখন অবলীলায় পরমানন্দে তাঁরা ‘পানি’-ই বলেন। আবার ওড়িয়ারাও ‘জল’ ও ‘পানি’ উভয়ই বলে সবাই, অসমীয়ারাও ‘পানী’ (পানি নয়) বলে। এরা কেউই হিন্দি বলয়ের নয়, আবার মুসলমানও নয়। তাহলে ‘পানি’ কোনোভাবেই মুসলমানি শব্দ নয়। ‘পানি’ বলছে মানে সে মুসলমান, একথাও বলা যায় না। বাঙালি না-হলেও ‘পানি’ হিন্দুরাও ব্যবহার করে। সেক্ষেত্রে অবাঙালিদের মুসলমানদের কোনো সমস্যা নেই। কারণ অবাঙালি হিন্দু-মুসলমান উভয়ই জলকে ‘পানি’ বলে। কিন্তু তারপরেও কথা থেকে যায়, বাঙালির প্রশ্নে বাঙালি হিন্দুরা যেমন ‘পানি’ বলে না, ঠিক তেমনি বাঙালি মুসলমানেরাও জল বলে না। কিন্তু ইংরজির ধর্মের বাঙালিরা একেবারে এক পথে, উভয় ধর্মাবলম্বী মানুষ ইংরেজি ভাষায় জলকে ‘Water’ বলে। এক্ষেত্রে উভয়ের ভাষাই খ্রিস্ট ভাষা – না রইল হিন্দুয়ানি, না রইল মুসলমানি।

তবে মুসলিম সম্প্রদায়ের কিছু মানুষের গোঁড়ামির জন্যে বাংলা ভাষা ও বাঙালি প্রশ্নচিহ্নে মুখে, ধর্মীয়ভাবে বিভাজিত হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের এক লেখকের (লেখকের নামটা কিছুতেই মনে করতে পারছি না। দুঃখিত) বয়ানে একটা ঘটনা বলি -- রবীন্দ্রনাথের ‘আমাদের ছোট নদী’ কবিতাটি হয়তো অনেকের মনে আছে, যার দ্বিতীয় পঙক্তিটি এমন ছিল – “বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল থাকে৷” ক্লাসের স্যার চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কবিতাটি পড়াতেন। এমনিতে সব ঠিকঠাক ছিল। শুধু দুটি বিষয়ে রবীন্দনাথের সঙ্গে স্যারের বিরোধ ছিল। এক : দ্বিতীয় ও দশম পঙক্তিতে তিনি ‘জল’ শব্দ বদলে দিয়ে ‘পানি’ দিয়ে পড়াতেন। তাহলে কী দাঁড়াল? -- “বৈশাখ মাসে তার হাঁটুপানি থাকে”…“গামছায় পানি ভরি গায়ে তারা ঢালে”। এ ব্যাপারে স্যারের একটা ব্যাখ্যাও ছিল। স্যার বলতেন -- হিন্দুরা পানিকে ‘জল’ বলে, মুসলমানেরা ‘জল’ বললে মুসলমানিত্ব চলে যাবে। দুই : এটি ছিল স্যারের ব্যাখ্যামূলক পার্থক্য। কবিতাটির তৃতীয় প্যারার প্রথম লাইন ছিল এ রকম -- “তীরে তীরে ছেলেমেয়ে নাহিবার কালে…”। স্যার বলতেন, ‘নাহিবার কালে’ মানে ‘গোসলের সময়’। জেলেপাড়ার এক সহপাঠী হাত তুলে জিজ্ঞেস করেছিল, “স্যার, ‘সিনানের (স্নান) সুমায়’ বললি হবিনানে?” স্যারের গুরুগম্ভীর উত্তর -- “ওটা কেবল তোরাই বলিস।” এ তত্ত্বে বাংলা ভাষা থেকে এ সকল শব্দ হারিয়ে যায়নি, যাবেও না। কিন্তু, আমাদের অনেকের দৈনন্দিন ব্যবহার থেকে ‘জল’ ও ‘স্নান’ শব্দ দু’টির চিরনির্বাসন হয়ে গেছে। সময়ের সাথে সাথে এ লিস্টে আরও কিছু শব্দ যোগ হতে থাকে -- দাদা-বৌদি (তবে পিতামহ অর্থে ‘দাদা’র ব্যবহার আছে), মাসি, পিসি, ঠাকুরপো, ঠাকুরঝি, জলখাবার, সন্ন্যাসী ইত্যাদি ইত্যাদি। শব্দের ধর্মভেদ -- আজব এক সংস্কৃতি !

পানির সঙ্গে সম্পর্কিত অনেকগুলো বাংলা শব্দ। যেমন -- পানাহার, পান করা, পানকৌড়ি, পান্তা, পানীয়, পানসে, পানিফল ইত্যাদি। আচ্ছা, জল ও পানিতে বাঙালিত্বে যখন এত সমস্যা, তখন পানাহারের পরিবর্তে হিন্দুরা জলাহার বলবে, কিংবা জলকৌড়ি, পান্তার বদলে জলতা, পানীয়র বদলে জলীয়, পানিফলের বদলে জলফল? আচ্ছা, মুসলিমরাও কি মুসলমানিত্ব রক্ষা করতে জলীয়, জলতরঙ্গ, জলজ, জলবায়ু, জলপরী, জাল, জেলে শব্দগুলির পরিবর্তে পানি জুড়ে দেবে? জলপরি কি পানিপরি হয়ে যেতে পারে? কিংবা পানিপুরী হবে কি জলপুরী? না, আসলে আমরা উভয় ধর্মের মানুষরা দৈনন্দিন জীবনে আমি পানি আর জল একাকার করে ফেলি। কেবল ধর্মভেদে নয়, অনেক সময় অঞ্চলভেদেও পানি এবং জল বলায় বৈচিত্র্য দেখা যায়। চট্টগ্রামের হিন্দুরা পানি বলতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন বলে মনে হয়েছে, আবার বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মুসলিমরা জল শব্দটি ব্যবহার করেন। দুটো শব্দই বাঙালিদের আপন। তবে ভারত বিভাজনের রূপরেখা দ্বিজাতিতত্ত্বকে টিকিয়ে রাখার তাগিদ থেকে, জল আর পানিকে ধর্মীয় সীমারেখা টানার একটি উপাদান হিসাবে ব্যবহার করা হয় বলে অনেকে মনে করেন। এই অকারণ জলপান বন্ধ হোক। জল আর পানি ধর্মীয় জায়গায় আটকে না থাকুক। পানির অপর নাম জীবন। জলের অপর নামও জীবন। জীবন কি ধর্মভেদে আলাদা? যদি না হয়, তবে কেন বাঙালির বাঙালিত্ব ধর্মভেদে আলাদা হবে?

‘নাস্তিকের ধর্মকথা’ নামে এক ব্লগে এক আলাপচারিতায় ব্লগার বাঙাল তানেন বাঙালি মুসলমান প্রসঙ্গে কী বলছে, একটু দেখি – ‘‘‘বাঙালি মুসলমান’ শব্দটাতেই আমার আপত্তি। মুসলমান -- ইংরেজ, রাশান, ইন্দোনেশিয়ান, বাঙালি কোনোটাই হতে পারেনা। হওয়া সম্ভব না। ইংরেজ ক্রিকেট টিমের ‘রশিদ’ কিন্তু ইংরেজ হয়ে উঠতে পারেনি, মুসলমানই রয়ে গেছে। তাই তাঁর নামটা ইংরেজদের মতো না, মুসলমানের মতো ‘রশিদ’। অথচ ইংল্যান্ডের অধিবাসী হিসাবে তাঁর ইংরেজ নাম হওয়া উচিত ছিল। একইভাবে বাংলাভাষীদের নাম বাংলায় হওয়ার কথা থাকলেও মুসলমানেরা নামটা পর্যন্ত আরবিতে অর্থাৎ মুসলমানের কথিত ভাষাতেই রাখে। বাংলায় রাখে না। পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষ দেশে দেশে স্ব স্ব কৃষ্টি, ভাষা, জাতি বোধে পরিচিত হলেও একমাত্র মুসলমানেরা পৃথিবীর যেখানেই যাক, যেখানেই থাক কেবলমাত্র মুসলমান পরিচয়েই থাকতে চায়, মুসলমানিত্বই মানতে চায়। তাই মুসলমানের ইংরেজ, রাশান, ভারতীয়, বাঙালি হওয়া হয় না, সে কেবলমাত্র মুসলমানই থাকে ! মুসলমানিত্ব যেমন বাঙালিত্বকে ধারণ করে না, ধারণ করা সম্ভব না। তেমনি মুসলমান যেখানেই যাক বা থাকুক না কেন সেখানকার অর্থাৎ সে মাটির সে হয়ে উঠতে পারে না, আরবের মরু-সংস্কৃতি আমদানি করে মুসলমানিত্বের নামে এবং সেটাকেই তার নিজস্বতা মনে করে। ‘রশিদ’-এর ইংরেজি তর্জমাকৃত নাম গ্রহণ কিন্তু সম্ভব। কিন্তু নেওয়া হবে না, কেন-না এতে করে মুসলমানিত্ব থাকে না। প্রত্যেক আরবি নামের বাংলা তর্জমাকৃত বা সুন্দর সুন্দর নিজস্ব বাংলা নাম গ্রহণ সম্ভব ছিল। অন্তত, বাংলায় বাংলা নামগ্রহণই তো স্বাভাবিক ছিল। ধর্মান্তরিত নিম্নবর্ণের হিন্দুর জন্য কিন্তু সেটা করা হল না কেবলমাত্র 'মুসলমানিত্ব' গ্রহণ করবার কারণে। অর্থাৎ আপনার নিজ অঞ্চলের স্বকীয়তা থেকে আপনার মূলোৎপাটন শুরু করা হল। এভাবে অন্যান্য সকল জায়গাতেই এবং এসবের সবকিছুই ইসলামের কারণে। আমি বলতে চাইছি মুসলমানিত্ব নামের বায়বীয় কিন্তু একরোখা চাপানো মরু-সংস্কৃতির কারনে মুসলমানদের আর ইংরেজ, রাশান, ভারতীয় বা বাঙালি হওয়া হয়ে উঠে না। তাঁরা পৃথিবীর যেখানেই থাকুক কেবলমাত্র মুসলমান হিসাবেই রয়ে যায়।”

একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, মুসলমানদের নামকরণ সবই আরবিতে, বাংলায় নয়। নামগুলি বাংলা হরফে লেখা হয় ঠিকই, কিন্তু উৎস বাংলার নয়। মুসলমানদের এই আরবি নামকরণের জন্য অ-মুসলমানদের কাছে মুসলমানরা বাঙালি হয়ে উঠতে পারল না। সেই কারণেই বোধহয় অ-মুসলিম বাঙালিরা বলে থাকে -- আমরা বাঙালি, ওরা মুসলমান। একজন মুসলমানের নাম শুনে কখনোই অনুমান করা যায় না -- সে কি বাঙালি, সে কি বিহারি, সে কি গুজরাটি, সে কি আফগানি, সে কি তুর্কি, সে কি ইরাকি, সে কি সোদি, নাকি সে আমেরিকান? কিন্তু তিনি যে মুসলমান সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়। কিন্তু নাম-পদবি দিয়ে চেনা যায় কে বাঙালি হিন্দু, কে বিহারি হিন্দু। কে গুজরাটি হিন্দু, কে তামিল হিন্দু ইত্যাদি। বাঙালি বৌদ্ধদেরও সহজেই চিনে নেওয়া যায়। ধর্মান্তরিত হলেও বৌদ্ধদের পূর্ব-পরিচয় হারিয়ে যায় না। ধর্মান্তরের ক্ষেত্রে অমুসলমানের পূর্ব নাম-পদবি সম্পূর্ণ বদলে গিয়ে ইসলামিক হয়ে যায়। অর্থাৎ পূর্ব-পরিচয় আর থাকে না। যেটা খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত হলেও পূর্বনাম সম্পূর্ণ না বদলালেও চলে। যেমন – মাইকেল মধুসূদন দত্ত, কেতকী কুশারী ডাইসন ইত্যাদি। ধর্মান্তরিত হলেও অরিজিন হারিয়ে যায় না। তাই মাইকেল মধুসূদন দত্ত ও কেতকী কুশারী ডাইসন উভয়কেই বাঙালি ভাবতে ভুল হয় না। তবে সময় বদলেছে। ধর্মান্তরিত হলেও পূর্বনাম আজকাল রাখা হচ্ছে। সুমন চট্টোপাধ্যায় ধর্মান্তরিত হয়ে কবীর সুমন হতে পারে। বিবাহ সূত্রে হিন্দু মেয়ে মুসলিম যুবককে বিয়ে করলেও পূর্বনাম হারাচ্ছে না। যেমন -- জারা সোমা, মৌসুমী বিলকিস ইত্যাদি। কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর পরিবারের নামকরণে বাঙালিয়ানা বজায় রাখার চেষ্টা করেছিলেন। ইসলামিক পরিচয়ের সঙ্গে সঙ্গে বাঙালি পরিচয়ও অক্ষুণ্ণ রেখেছিলেন। তিনি বিয়ে করেছিলেন হিন্দু মেয়ে প্রমীলা দেবীকে। প্রমীলা দেবীর নতুন নাম ইসলামিক বিধান অনুসারে নার্গিস আসার খানম হলেও প্রমীলা দেবী হিসাবেই থেকে গিয়েছিলেন। এইখানেই শেষ নয়, তিনি তাঁর সন্তানের নামও খাঁটি বাঙালি রূপে দিলেন। তাঁর সন্তানদের নাম যথাক্রমে – কৃষ্ণ মোহাম্মদ, অরিন্দম খালেদ (বুলবুল), কাজী সব্যসাচী এবং কাজী অনিরুদ্ধ। কাজী নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের জাতীয় কবি হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের নাগরিকরা নামকরণের ক্ষেত্রে নজরুলকে অনুসরণ করেনি। তবে কেউই অনুসরণ করেনি, একথা বললে নির্জলা মিথ্যা বলা হবে। অনেক মুসলমানই খাঁটি বাংলা নাম ব্যবহার করে। বাংলাদেশে আমার বান্ধবী আছেন, তাঁর নাম লতা খানম। পশ্চিমবঙ্গের বেশ কয়েকজন আমি চিনি, যাঁদের নাম খাঁটি বাংলায়। যেমন – মোহম্মদ অনির্বাণ ইসলাম, নীলাঞ্জন সৈয়দ, অনির্বাণ ইসলাম সাগর, মোহম্মদ আলি ইসলাম নির্বাক, মোহম্মদ লিখন ইসলাম, মোহম্মদ রাজু ইসলাম, মোহম্মদ বকুল ইসলাম, আবীর ইমতিয়াজ দাস প্রমুখ। সংখ্যায় কম হলেও বাংলা নামেও নামকরণ মুসলমানরা করেন।

তবে রাসেল, জন, জেনি, জেমি, মিল্টন প্রভৃতি নামও মুসলমানরা ব্যবহার করছেন। আরেকটা চল দেখি, অনেকে নামের প্রথম পার্ট বাংলা শব্দের সঙ্গে পারিবারিক অংশ দিয়েও (যেমন আহমেদ, ইসলাম, চৌধুরী) শেষ করে। নাম রাখার আর্জ তৈরি হলে আরও বেশি বাংলা নাম রাখার রেওয়াজ তৈরি হবে। একসময় সেই আর্জটাই তো ছিল না। ফলে বাঙালি মুসলমানের মধ্যে বাংলা নাম কম দেখা যায়। কেন বিশুদ্ধ বাংলা নাম কম দেখা যায়? দুটো কারণ বলে মনে হয় – (১) একদম শুরুর দিকে নিম্নবর্ণের হিন্দুরাই প্রধানত মুসলমান হয়। তাঁদের ক্ষেত্রে হিন্দু নাম বিদায় দেওয়াটা জরুরি মনে করেছিল বর্ণহিন্দুদের প্রতি ঘৃণা থেকে। হিন্দু-পরিচয়ের নাম-ও-নিশান মিটিয়ে দেওয়ার তাগিদে সম্পূর্ণ আরবি নাম বরণ করে নিয়েছিল। যে হিন্দু নাম তার নিম্নজাতের পরিচায়ক ছিল, যে নিম্নজাতের হওয়ার কারণেই তাদের ধর্মত্যাগ, সেই নাম তারা বহন করবে কেন? সেই জায়গা থেকেই নামের মাধ্যমে মুসলমানদেরও পরিচয়সূচক বৈশিষ্ট্য ধরে রাখার চেষ্টা থাকাটা মোটেই অস্বাভাবিক নয়। (২) বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত যে ইসলামি/ আরবীয় (এমনকি উর্দু, ফারসি) নাম রাখলে আল্লাহ খুশি হবেন, এটা ভেবেও অনেকে বাচ্চাদের জন্যে ইসলামি নাম খোঁজে।

যেসব মুসলমানরা খাঁটি বাংলায় নামকরণ করেন, তাঁরা নিশ্চয় ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠেই করেন। কিন্তু খাঁটি বাংলায় নামকরণ করেন না, তাঁরা নিশ্চয় ধর্মীয় কারণেই করেন না। তাঁরা নিশ্চয় বাঙালি পরিচয়ের আগে ধর্ম-পরিচয় রাখতেই পছন্দ করেন। তাঁরা ভাষায় বাঙালি হলেও নামকরণে বাঙালি হতে একদম রাজি নন। তাহলে মুসলমানিত্ব নষ্ট হয়ে যাবে বলে মনে করেন। বিশেষ করে যেসব মুসলমানরা কওমি বা খারিজি মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেছেন, তাঁরা আরবি নামকে আঁকড়ে ধরেন। কারণ হুজুররা মনে করেন, বাংলা হরফে শয়তানির আছর আছে। এ ভাবনার শুরু ১৯৪৮ সাল থেকে। ১৯৪৮ সালের ১৫ মার্চ শিক্ষক-ছাত্র-জনতার সঙ্গে খাজা নাজিমুদ্দিনের আট দফা চুক্তি হয়। এ চুক্তির পর সরকার লোক-দেখানো কিছু পদক্ষেপ নেয়। আপাত দৃষ্টিতে ভাষা আন্দোলনও কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়ে বলে মনে হলেও ছাত্র-জনতা ভাষা আন্দোলনের চেতনা ঠিকই জিইয়ে রেখেছিল। ওদিকে পাকিস্তান সরকারও বাংলার বিরুদ্ধে তাদের ষড়যন্ত্র চালিয়ে গেল।

প্রবন্ধ - সোমব্রত সরকার



স্বয়ং কাম নিত্যবস্তু রস-রতিময়

জলপূর্ণ সমুদ্রে যেমন নদ-নদীর জলরাশি এসে চারিদিক থেকে পড়ে মিশে যায়, কিন্তু সমুদ্র নিজ মহিমায় অচলরূপে বিরাজ করে, তেমনি যে সংযমী মানবের মধ্যে বিষয়সকল প্রবেশ করে বিলীন হয়ে যায়, কোনওরূপ বিকার উৎপন্ন করে না, তিনিই পরমশান্তি লাভ করেন। যিনি ভাগকামনা করেন, তিনি শান্তি পান না — আপূর্যমাণমচলপ্রতিষ্ঠং সমুদ্রাপঃ প্রবিশন্তি যদ্ব। / তদ্বত্কামা যং প্রবিশন্তি সর্বে স শান্তিমাপ্নোকিত না কামকামী॥

‘শ্রীমদ্ ভাগবত্গীতা’-য় ২/৭০ সংখ্যক শ্লোকে ইন্দ্রিয়সমূহকে অন্তর্মুখ করে তোলার জন্য কামকামীদের অশান্তি অবশ্যশ্মাবিতার পদধ্বনিকে তরঙ্গের সমুজ্জ্বল অন্তহীলনাতর মুখাপেক্ষী এক আধারে বর্ণিত করা হয়েছে। ৬৯-সংখ্যক শ্লোকে বলা হয়েছে, মনের মধ্যে অফুরন্ত রসের স্রোতধারা আবিষ্কার করতে পারলেই যোগীগুরু ব্রহ্মস্বরূপত্ব লাভ করেন।

কথা হচ্ছে, দুই শ্লোকেই তরঙ্গের কম্পমান কুয়াশার আস্তরটুকু কেন রেখে দেওয়া হল? তরঙ্গ এখানে পঞ্চেন্দ্রিয় পরায়ণতা। শারীরিক প্রকাশগুণ— যাকে জলের বা স্রোতধারার নাক্ষত্রিক প্রতীকটিই দেওয়া হয়েছে। এই জল বা স্রোতও সাংকেতিক শরীর পরায়ণতার সচেতন আত্মসম্বিতই। কীভাবে? শ্লোকে বর্ণিত জলপূর্ণ সমুদ্র আসলে হল সাধক শরীরের প্রতীক। নদ-নদী সাধন-সঙ্গিনীর স্বনিয়মী দুর্মর বার্তা— যা দেহবাদী সাধনার ভরকেন্দ্রীয় শাশ্বত ভাবধারা। মনের অফুরন্ত স্রোতধারার তরঙ্গ প্রতীকও হল তূরীয় আনন্দের সৃষ্টিমার্গ— আর এই মার্গই হল দেহসাধনার উদীয়মান রক্তরাগ। জল, স্রোত বা তরঙ্গকে আমরা শরীর পরায়ণতার আধারে বেষ্টিত করে নিয়েছি। এই প্রতীককল্প দেহসাধনার অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক নাক্ষত্রিক বিকাশ— সাধকের বীর্য আর সঙ্গিনীর রজ। যা শরীর পরায়ণতারই নামান্তর। আমাদের সমস্ত প্রধান ও অপ্রধান ধর্মীয় ভাবধারায় দেহকাঠামোকেই সাধনার আধার হিসেবে চিহ্নিত করে এক বহুকেন্দ্রিক পরমকে খোঁজা হয়েছে শরীরে কলকব্জায়। এই পরম কখনও বা সত্য, কখনও সহজানন্দ, আনন্দের স্পন্দিত অরূপ— এইসব নানবিধ বহুমাত্রিক বিশেষণে নক্ষত্র প্রতীকে রূপস্থ হয়েছে। আমাদের হিন্দুশাস্ত্রে যে অবতার চিন্তা তা যথেষ্টই বৈষ্ণব ভাবাপন্ন। তাঁদের ঈশ্বর বা ভগবান— শ্রীবিষ্ণুই যুগে যুগে, সমাজে যখন অন্যায় ব্যভিচার গ্রাস করে, ধর্ম বিপন্ন হয়, অসহায় মানুষ ত্রাহী মধুসূদন বলতে থাকেন তখনই তিনি আসেন তাঁদের উদ্ধার করতে। ঐতিহাসিকরা মত দিয়েছেন এই অবতারের চিন্তা গুপ্ত যুগেই মাথাতে এসেছিল। তবে প্রথম দিকে অবতারের সংখ্যা আজকের মতন দশ ছিল না। একুশজন অবতারের কথা চিন্তা করা হয়েছিল। পরে তা দশে এসে সুচিহ্নিত হয়। আগে শ্রীকৃষ্ণও অবতার হিসেবে চিহ্নিত হতেন। পরে তিনি আর অবতার থাকেন না। হয়ে ওঠেন অবতারী। এই যে বর্তমানে দশ অবতারের রূপস্থ অপার মহিমা, তা কিন্তু আসলে সমাজের, আরও সঠিক অর্থে বললে মানুষের ক্রমবিকাশের চিন্তাকেই শিরোধার্য করে রূপচেতনার অনুষঙ্গ তুলে ধরা হয়েছে। আর সেই রূপে সাধক শরীরকে সমুদ্র চিহ্নিত করার শরীরিকতা আছে। বলা ভাল, দশ অবতারও দেহসাধনার বিষয়ভূত দেহগত আকরই। যা যোগীদেহ-প্রতীক সমুদ্রের রূপান্তরকে সঙ্গে নিয়ে ইন্দ্রিয় পরায়ণতার নাক্ষত্রিক জ্যোতিকেই যথাসম্ভব প্রতিভাত করেছে। আর এক অর্থে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে সাধনার শারীরিক আকুল এক আধার। শরীর শরীরকে কামনাশক করে, সম্ভোগের বা যৌনতার উন্মেষকে দূরে ঠেলে দিয়ে ভাবমণ্ডলের সমাসন্নতা প্রদান করছে। গীতার শ্লোকও সেই শারীরিক ভাবের পরাক্রমের পক্ষেই কথা বলছে যৌনতাকে নিরর্থক ক্ষণভঙ্গুরতার অনুষঙ্গ করে দিয়ে। তাই দেহসাধনার ভাবে যৌনতা তার সংকেতকে বার্তাসহ করছে রূপের দর্শন-স্থবির অহমকে নিজের অন্তর্গত করে।

অবতারদের যে বিভিন্ন রূপ তা কিন্তু মানুষের মানসিক অবস্থারই প্রতিরূপ। মানুষ একসময় নির্ভুল জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। এই জ্ঞান সাধক-শরীরের সেই সমুদ্র চিহ্নিত। জ্ঞান-সমুদ্র হল মানুষের মানসিক ও শারীরিক স্তর। শরীরকে মন্থন করেই জ্ঞানকে, চেতনাকে, সত্যকে, পরমকে জাগ্রত করতে হয়। আর তাতে সামান্য বাধাবিঘ্ন এলেই মত্স্য অবতারের আবির্ভাব হয়ে। এই মত্স্যও শরীর সাধনার প্রাসঙ্গিক এক স্তর। সেখানে প্রসঙ্গক্রমে অবশ্যই আসব। কূর্ম আদতে এক উভচর প্রাণী। জলে ও ডাঙাতে সে বিচরণ করতে পারে। জল হল এখানে সাধকের অন্তর্গত সত্তার পরিপূর্ণ বিকাশ ও তার সামুদ্রিক প্রকাশ। আর ডাঙা ব্যক্তিসত্তার প্রতীক। সাধকের আবয়বিক শরীর রহস্যের উন্মোচিত যে জ্ঞান তা আহরণে সুদূর অভিব্যঞ্জনার শুকনে খটখটে শরীরকেই তো শৈল্পিক উপলব্ধি চেতনার মধ্যে ব্যক্তিগতভাবে সঞ্চারিত করতে হয়। আর তখনই কূর্ম অবতারের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। বরাহও ডাঙায় থাকে আবার প্রয়োজনে জলেও সাঁতার কাটতে পারে। মানুষের জাগৃতির প্রয়োজনেই তাই বরাহ অবতারের জন্ম হয়। নৃসিংহ মানুষের দুই স্তর। পশুর দূরাগত গুঞ্জনের আদিম সত্তা তো তার ভেতরেই। তাই মননলোককে প্রারম্ভিক শারীরিকত্বের মধ্যে এনে অন্তহীন সমুদ্রগামী সংগ্রামের জন্যই নৃসিংহ অবতারের প্রয়োজন হয়। বামন হল মানুষের ক্ষুদ্র মানস সত্তা। যা নিয়েই সৃষ্টি হয় জীব। সাধক সেই ক্ষুদ্রত্বকেই জয় করবার জন্যই আবার বামন অবতারে বশীভূত হন। পরশুরাম হলেন দেহধারী পূর্ণ মানুষ। কিন্তু রামের আগে পশুর অতি জাগ্রত সত্তাকে জুড়ে দিয়ে যেটা বলা হয়েছে, প্রচ্ছন্ন আত্মজ্ঞানকে নিজের ভেতরে সঞ্চার করে দিতে। আর তা করতে পারলেই পরশুরাম অবতার মানব শরীরে অবতীর্ণ হতে পারেন অনায়াসে। রাম— মানুষের সিদ্ধ মানসিক স্তরের গঠনগত রূপ। সাধকের স্থিতধী দশা। যোগে, দেহসাধনায় শান্তির এই তামসিক নির্লিপ্তি এলেই সাধক রাম অবতারের ধারক এবং বাহক। আর এই প্রেক্ষকের উদ্দেশ্যেই আসছেন কৃষ্ণ অবতার। কিন্তু বৈষ্ণবরা তাঁকে অবতার হিসেবে না দেখে অবতারী করে নিয়েছে। তাঁর জায়গাতেই স্থানান্তর হয়েছে বলরামের। বলরাম হলেন হলধর। অর্থাৎ কিনি তিনি আবার সমুদ্র কর্ষক। রামের সম্বোধিত আবহাওয়া ও অনুভূতিকে তিনি কর্ষণ করে সাধক প্রয়াসের অন্তহীনত্বতে চালিয়ে যাবেন শরীরের প্রাণসমুদ্র। সর্বশেষে আসছেন বুদ্ধ অবতার। অর্থাৎ কিনা সাধক, যিনি— জন্ম, মৃত্যু, শোক, দুঃখ, জরাকে পেছনে ফেলে আন্তরিক এই কাহিনিকল্পের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে আসতে পেরেছেন। অবতারের এই যে রূপ ও রূপান্তরের সুচেতনা তা কিন্তু এসেছে শরীরের সব সাধ্যসাধন মীমাংসার জন্য। যেখানে গভীরতর অপেক্ষার কাম বা যৌনতা নিক্ষিপ্ত অহৈতুকত্বকেই চূড়ান্ত বলে মেনে নিচ্ছে।

মান্য প্রতিষ্ঠিত যেসব ধর্মাচরণের বাইরে লোকায়ত সাধনের যে সব নির্বেদগুলো আছে, সেখানেও ইন্দ্রিয়সকলকে বশীভূত করতেই বলা হয়েছে উল্টোস্রোতে। এই প্রক্রিয়াকে বলা যেতে পারে উল্টাসাধন বা উজানসাধন। বিভিন্ন উপনিষদে এই পদ্ধতি বিভিন্ন নামকরণে চিহ্নিত হয়েছে। ‘কঠোপনিষদ’ বলেছে এর নাম প্রত্যাগাত্মন্। ‘বৃহদারণ্যক উপনিষদ’-এ একে বলা হয়েছে উদযান। উল্টাসাধন মানে জৈবিক প্রবাহকে উল্টোদিকে নিয়ে গিয়ে ভ্রূণের আসন্ন যবনিকাকে টেনে দেওয়া। কীভাবে তা হচ্ছে, বা হয়, লোকায়ত গৌণধর্মের দেহাচরণে সেসবে যাবার আগে একটু দেখে নেওয়া যাক উপনিষদ এই প্রক্রিয়া সম্বন্ধে কী ব্যাখ্যা দিয়েছে।

‘কঠোপনিষদ’ বলছে: সমগ্র সংসারই আসলে একটি প্রকাণ্ড বৃক্ষের ন্যায় উল্টো হয়ে নিরন্তর পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে বিবর্তিত হচ্ছে— ঊর্ধ্বমূলোঽবাক্শাখ এষোহস্বতঅথঃ সনাতনঃ। গায়ত্রীমন্ত্রের মধ্যেও সমগ্র দেহ-মনকে অন্তর্মুখে আহরণ করিয়ে একটু একটু করে পরম সত্যস্বরূপের সঙ্গে মিলিত হবে ভাবনাই উদ্ভাসিত হয়েছে।

‘গীতা’-র ২।৬৯ সংখ্যক শ্লোকেই রয়েছে: তমোগুণসম্পন্ন অবিবেকী ব্যক্তি উলুকের (পেঁচার) মত দিনের বেলাতেও দেখতে পান না, অপর দিকে জ্ঞানী ব্যক্তি দিনের আলোতেই অবিদ্যারাত্রির (মায়া, অজ্ঞানতা) গভীর অন্ধকারকে অনায়াসেই চিহ্নিত করতে পারেন।

‘গীতা’-র এই দার্শনিক অধিগত রূপই লব্ধ ও উপলব্ধের মধ্যে দিয়ে ব্যক্তির বিবিক্ত অন্তরে জেগে উঠছে ভারতীয় তন্ত্রে। ‘ব্রহ্মসূত্র’-র প্রথম সূত্রতেই বলা হয়েছে: অথ অতো ব্রহ্ম জিজ্ঞাসা— এখন চূড়ান্ত সত্যকে জানার ইচ্ছে দেখা দিয়েছে। ‘ব্রহ্মসূত্র’ বেশ কয়েক হাজার বছরের প্রাচীন। তন্ত্রে সেই ইচ্ছেই যেন প্রতিভাত হয়েছে। আর এই ইচ্ছে আবর্তিত ও বিবর্তিত

হচ্ছে দেহকে ঘিরেই। দেহই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রতিমূর্তি তন্ত্র সাধনায়। তাই তন্ত্র সাধককে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড থেকে ফিরে আসতে হয় দেহভাণ্ডে। অপর এক সহজিয়া মতেও বলা হয়েছে: দেহভাণ্ডে যা নেই তা ব্রহ্মাণ্ডেও খুঁজে পাওয়া ভার। সেই মতামতের প্রসঙ্গক্রমে যথাসময়েই প্রবেশ করব।

তন্ত্র বা তান্ত্রিকমতে দেহের ভেতরকার মেরুদণ্ডই মেরুপর্বতের মতন করে দেহব্রহ্মাণ্ডের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। এর সর্বনিম্নে অবস্থিত মূলাধার চক্রই হল দক্ষিণ মেরু আর সর্বোচ্চ সহস্রার চক্র উত্তর মেরু হিসেবে কল্পিত। দেহের মধ্যে শক্তি চুপচাপ ঘুমিয়ে থাকেন এই মূলাধারেই। এর নাম কুণ্ডলিনীশক্তি। মূলাধারে সাপের মতো সাড়ে-তিন প্যাঁচে জড়িয়ে থাকে এই কুণ্ডলিনীশক্তি। এর মধ্যে তিনটি পূর্ণ প্যাঁচ হল, তিনটি গুণ (সত্ত্ব, রজ, তম)। কুণ্ডলিনীশক্তি মূলাধারে সাপের মতো কুণ্ডলায়িতা থাকে বলেই একে বলা হয় কুণ্ডলিনী। সাপের মুখের দিকে রয়েছে বাকি অর্ধের প্যাঁচ। এটিকে বলা হয় অহংকারের ক্ষেত্ররূপ। সত্ত্ব হল প্রকৃতি, স্বভাব বা মন। সাধকের অস্তিত্বের বিকাশরূপ হিসেবে তাকে ধরা যেতে পারে। তম হল সেই আমি বা অস্তিত্বেরই তমসাচ্ছন্নতা। রজ হল ধূলি বা পরাগ। বলা ভাল, শরীর সাধনের অভিজ্ঞাত আধিপত্যশীল দিগ্ দশা। তন্ত্রে এই তিন গুণ রপ্ত হয় মদ্য, মাংস, মত্স্য, মুদ্রা ও মৈথুনের বা এই পাঁচটি/পর্শ্বাচারের উপকরণে। স্থূল অর্থের জাগতিক রূপ এসব কখনওই নয়। এ হল পঞ্চ ‘ম’-কারের সাধনা। কুলকুণ্ডলিনীশক্তি যোগক্রিয়ায় যখন মস্তিষ্কে প্রবেশ করে তখন সেখানকার স্নায়ু থেকে যে রস নিঃসৃত হয় তাই হল মদ্য— সোমধারা ক্ষরেদ যাতু ব্রহ্মরন্ধ্রাদ্ বরাননে।/ পিত্বানন্দময় স্তাং যঃ স এব মদ্য সাধকঃ॥ মাংস হল জিহ্বা বা রসনা। বাক্য বা কথা সেই রসনা তুল্য। যে ব্যক্তি বাক্য ভক্ষণ করেন অর্থাৎ কিনা বাক্ সংযম করে মৌন হয়ে থাকেন তিনি মাংস সাধক— মাশব্দাসনা জ্ঞেয়া তদংশান রসনা প্রিয়ান।/ সদা যো ভক্ষয়েদ্দেবি স এব মাংস সাধকঃ॥ মত্স্য হল রজ ও তম নামের দুই মাছ। যা শরীরের দুই প্রধানা নাড়ি, ইড়া (যার রূপ কল্পনা করা হয়েছে গঙ্গা বলে) ও পিঙ্গলা (যমুনারূপী)-র মধ্যে দিয়ে চলাচল করে। মত্স্য সাধক শ্বাসে বা যোগক্রিয়ায় এই দুই গুণকে ভক্ষণ করে ফেলেন। হয়ে ওঠেন মত্স্য সাধক— গঙ্গাযমুনোর্যমধ্যে মত্স্য দ্বৌ চরতঃ সদা।/ তৌ মত্স্য ভক্ষয়েদ যস্তু স ভবেন্মাত্স্য সাধকঃ॥ মুদ্রা হল মস্তিষ্কের যেখানে সহস্রার পদ্মচক্র রয়েছে, তার কর্ণিকার মধ্যে পারদের মত ঢল-ঢল সুনির্মল শ্বেতশুভ্র জ্যোতি আছে— যা সাধক-রূপ-কল্পনায় চন্দ্রসূর্যের জ্যোতির থেকেও জ্যোতিষ্মান। এখানেই রয়েছেন কুণ্ডলিনী আকারে মহাশক্তি। দেহ-সাধক যোগ-বলে ঘনীভূত সেই বস্তুশক্তিকে পরমানন্দময় পরম সত্যের সঙ্গে যুক্ত করে মুদ্রা সাধক হয়ে ওঠেন— সহস্রারে মহাপদ্মে কর্ণিকা মুদিতা চরেৎ।/ আত্মা তত্রৈব দেবেশি কেবলং পারদোপমম।/ সূর্য কোটি প্রতীকাশং চন্দ্র কোটি সুশীতলম।/ অতীব কমনীয়ঞ্চ মহাকুণ্ডলিনী যুতম।/ যস্য জ্ঞানোদয় তত্র মুদ্রা সাধক উচ্যতে॥ মৈথুন হল মস্তিষ্কের ব্রহ্মরন্ধ্রে নাদ ও বিন্দু যুক্ত হয়ে এক পরমপুরুষ বিরাজ করছেন বলে দেহসাধক মনে করে থাকেন। তন্ত্র যেহেতু শিব ও শক্তির উপাসনা— এর বিশেষত্ব হল: প্রত্যেক দেবতার মধ্যেই একটি বামাশক্তি (নারীশক্তি) বিচরণ করছেন। দেবতার এই জাগ্রত প্রকৃতি (সত্ত্ব, রজ আর তম গুণ) তাঁর শক্তি বা স্ত্রী রূপে প্রতিভাত হয়েছেন। শিবের স্ত্রী বা দেবী একটি বিশেষ শক্তিরূপে প্রতিভাত হয়ে যৌনসম্বন্ধ বা মিলনক্রিয়ার ভেতর দিয়ে সাধকমতে অলৌকিক ক্রিয়াকলাপের সাহায্যে তন্ত্রশাস্ত্রকে কার্যকারী করছে, সেহেতুই সাধক এখানে যোগক্রিয়ায় পরম শিবের সঙ্গে মৈথুন করে পারেন, বলা হয়ে থাকে। আর তা করেই তিনি হন সর্বশ্রেষ্ঠ সাধক বা মৈথুন সাধক। মৈথুন এখানে হল শক্তিরূপের সঙ্গেই পরমশক্তির মিলন। যার জন্যই তন্ত্রসাধনে নারী, সঙ্গিনী বা ভৈরবী অনিবার্য। তন্ত্রে মৈথুন সাধক সম্পর্কে বলে হয়েছে: মৈথুন পরমংতত্ত্বং সৃষ্টিস্থিত্যন্তকরণম।/ মৈথুনাজ্জায়তে সিদ্ধির্ব্রহ্মজ্ঞানম সুদুর্লভম।/ রেফস্তু কুঙ্কুমাভাসঃ কুণ্ডমধ্যে ব্যবস্থিতঃ।/ মকরাশ্চ বিন্দুরূপো মহাযোগৌস্থিতঃ প্রিয়ে।/ আকারহংসমারুহ্য একতা চ যদা ভবেৎ।/ তদা জাতং মহানন্দং ব্রহ্মজ্ঞানং সুদুর্লভম॥

কুণ্ডলিনীর অর্ধেক প্যাঁচকে তন্ত্রসাধক অহংকারের ক্ষেত্ররূপ হিসেবে দেখে থাকেন। যার জন্যই তন্ত্রসাধনায় আট পাশকে জয় করার কথা বলা হয়েছে। এই আট পাশ হল— ক্ষুধা, তৃষ্ণা, ঘৃণা, ভয়, লজ্জা, মান, রাগ, দ্বেষ। মতান্তরে, কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মাত্সর্য্য, ক্ষুধা, তৃষ্ণা। এই আট পাশেই অহংকারের ক্ষেত্ররূপটিও জড়িয়ে আছে। সাধককে তা জয় করতে হয় যোগের মাধ্যমে। যার জন্যই শরীরস্থ সহস্রার চক্রের নিচেই কল্পনা করা হয়েছে প্রসিদ্ধ ষট্ চক্রের (স্বাধিষ্ঠান, মণিপুর, অনাহত, বিশুদ্ধ, আজ্ঞা, বিশুদ্ধ)। মূলাধার থেকে নাভিদেশে অবস্থিত মণিপুর পর্যন্ত শক্তির রাজ্য। এখানেই প্রবৃত্তিগুলো ঘোরাফেরা করে। আট পাশের এলাকা এটি। এর ওপরেই নিবৃত্তির কুবেরকল্প। তার জন্যই সাধকের উচাটন আর হা-হুতাশ। কীভাবে পাওয়া যায় এই কুবেরকল্প। নিবৃত্তির পথে পরণ শূন্যতা… সত্য… ব্রহ্ম… বিবিধ সব কাল্পিক বিচিত্র পূর্ণতার আধার। তান্ত্রিক অভিপ্রায়? জাগ্রত শক্তিকে যৌগিক সাধনবলে মূলাধার থেকে ক্রমে-ক্রমান্বয়ে ওপরে তুলতে হয়। শক্তির এই ঊর্ধ্ব থেক ঊর্ধ্বতর চক্রে গমনের ফলে সাধকের সূক্ষ্ম থেকে আরও অতি সূক্ষ্ম তত্ত্বসমূহের উপলব্ধি হতে থাকে। এভাবেই নিম্নস্থ শক্তিকে বিপরীত দিকে ঊর্ধ্বগামিনী করে ঊর্ধ্বস্থ শিবের সঙ্গে মিলিত হয়ে পড়ার তান্ত্রিক দশার নামই উল্টোসাধন। অর্থাৎ কিনা মনের বৃত্তিসমূহকে উল্টোদিকে ফিরিয়ে নেওয়া। তান্ত্রিক পরিভাষআয় এক বলা হয় পরাবৃত্তি।

প্রত্যেক শক্তিরই দুটি প্রকৃতি আছে। এক, শ্বেত বা কৃষ্ণ আর দুই, নম্র বা উগ্র স্বভাব। উমা ও গৌরী শিবের নম্রশক্তির প্রতীক। আবার দুর্গা ও কালী হল রুদ্রশক্তির প্রতীক। শক্তির উপাসক বা শাক্তরা প্রধানত দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত। দক্ষিণাচারী ও বামাচারী। দক্ষিণাচারীরা উগ্র তন্ত্রপুজোর বিরোধী। তাঁরাই মূলত যোগক্রিয়ায় উল্টোসাধনের বাঙ্ময় অনুষঙ্গবাহী প্রতীককে ধরে রাখেন। দেহকে একাঙ্ক দেহাচারে সীমাবদ্ধ রাখেন। অপরদিকে বামাচারীরা উগ্রতা ও নানাবিধ যৌন ও উদ্ভট পদ্ধতিতে উল্টোসাধনের বর্ণাঢ্যত্বকে উজ্জ্বল করে তোলেন। সেখানে নারী-পুরুষের আত্যয়িক বৈপরীত্যে ক্ষণে ক্ষণে শরীরের বহ্নিময় নির্দেশ আধিপত্যশীল হয়ে ওঠে পদ্ধতির ব্যবহার্য পূর্ণতায়। যার জন্যই এখানে ভৈরবী মায়ের দেখা পাওয়া যায়। বাংলার তান্ত্রিক সাধনা মূলত বামাচারীদের সাধিত সৌন্দর্য। সৌন্দর্য এই কারণেই বললাম, এখানে এই সাধনায় যুগল শরীর পরস্পরায়ুক্ত বন্ধনে তান্ত্রিক মতের গূঢ় পরমকে দীক্ষিত করেন। তান্ত্রিক সাধক ভৈরবীর সঙ্গে রীতিমতো সহবাস করেন আবার তাঁকেই মা রূপে সম্বোধন করে থাকেন। তাঁরা বলেন মাতৃভাব আর কামিনীভাব এই দুই-ই হল নারীর আরোপিত ভাব। কামিনী তো প্রথমাবস্থাতেই প্রকৃতি স্বরূপা। সৃষ্টির সম্ভোগার্থেই কামিনী সন্তান ধারণ করে মা হন। আবার পুরুষকে তাঁর শরীরের সর্বাশ্লেষী ক্ষমতা দিয়ে কামাচারে মাতিয়ে রাখতে পারেন। তন্ত্রমতে নারীর শরীরে শক্তিতত্ত্ব ও পুরুষ শরীরে শিবতত্ত্বের প্রকাশাধিক্যের কথা বলা হয়। পুরুষ এখানে শিব বিগ্রহ আর নারী শক্তি বিগ্রহ। তান্ত্রিক সাধক তার সাধিকা বা ভৈরবীর সঙ্গে মিলনের সময় হঠযোগের মাধ্যমে ক্ষরণমুখী জৈবিক ধারাকে (বীর্যপাত) উল্টোদিকের অভিমুখে ঠেলে তুলে সঙ্গিনী বা ভৈরবীর যোনীদ্বারে পতনকে আটকে রাখতে পারেন। তন্ত্রসাধনে চক্রসাধনার কথা বর্তমানে বহুশ্রুত ব্যাপার। ঘোর অমাবস্যাতে শ্মশানে এই ভৈরবীচক্র বসে। ভৈরব-ভারবী একসঙ্গে সব জড়ো হয়। পঞ্চ ‘ম’-কারের স্থূল উপাচার নিয়ে তাঁরা বসেন। মদ্যপান করার সময় চক্রের মূল ভৈরব মূল ভৈরবী-মাকে দিয়ে তা শোধন করার পরে সকলে তা পান করেন। এরপর উলঙ্গ অবস্থাতে ভৈরবের কোলে ভৈরবী মা বসে পড়েন। অই অবস্থায় যুগল মূর্তি হবে আগে ভৈরব মায়ের স্তন ও যোনি সহ সমস্ত প্রত্যঙ্গের পুজো সারেন। একইভাবে মা-ও ভৈরবের লিঙ্গ সহ সমস্ত অঙ্গের পুজো সারেন। মূল ভৈরব-ভৈরবীদের দেখাদেখি চক্রস্থ বাকি যুগলেরাও একই করণক্রিয়া করেন। মাছ-মাংসাদিরও আহার চলে মদের সঙ্গে সঙ্গে। তারপরে শুরু হয় রতিক্রীড়ার মাধ্যমে অদ্ভুত সাধনা। তাঁরা হঠযোগে শ্বাসক্রিয়ায় অতিলৌকিক যুগল হর-গৌরীর মূর্তির মতো একাত্ম হয়ে যান। এই একাত্মতাই নাকি শক্তি সাধনার চূড়ান্ত সার্থকতা। এই সাধনক্রিয়া নিয়ে নানা কিংবদন্তিও প্রচলিত আছে। যেমন— কামাখ্যার পিশাচসিদ্ধ ও তাঁর ভৈরবীর মিথুন মূর্তি নাকি যথার্থই দৃষ্টির আড়ালে চলে যেত। দেখা যেত না তাঁদের আর চূড়ান্ত সম্ভোগক্রীড়ার সময়। মূল ভৈরব-ভৈরবীর সঙ্গের ফলে কোনও রেতঃ (বীর্য-রজ) বাইরে পড়লে চক্রের বৃত্তাকারে অবস্থানকারী বাকিরা সেই রেতঃ তুলে নিয়ে প্রসাদ হিসেবে গ্রহণ করে থাকেন। আট মার্গের ঘেন্না জয়ের এ নাকি এক পন্থা। অঘোরীরা আবার শ্মশানে কোনও মড়া এলে সেই মড়ার মাথার খুলি দাহকার্যের ক্রিয়া তাড়াতাড়ি সম্পন্ন করার সময় যখন তা ফাটিয়ে দেওয়া হয়, তখন সেই খুলি নিঃসৃত রস নাকি ধরে রাখেন। পরে ভাতের সঙ্গে তা মেখে খান। তন্ত্র ঘেন্না জয়ের এইসব উপকরণে কাহিনি-কিংবদন্তির মাধ্যমে আমাদের সামনে এনেছে। এ ধরনের তন্ত্রক্রিয়ায় কতখানি ঈশ্বরলাভ হয় তা অন্য প্রশ্ন। আর বর্তমানে এই ভৈরবীচক্র আদৌ এখনও শ্মশান-মশানে বসে কিনা তাও সন্দেহ। সে যাই হোক, বহুশ্রুত এই ক্রিয়ায় ভগবান কতখানি বাঁধা পড়েন তা-ও সংশয়ের। তবে এ ক্রিয়া রীতিমত যৌনচর্চার নিজস্ব নির্জনতাকেই যেন তুলে ধরে। নারী-পুরুষ ধর্মের প্রকাশময় সমুজ্জ্বল প্রতীক-এ শরীরকে মুখর করে তোলেন। যদিও তাঁরা বলেন, কামের চঞ্চল অর্থবানতার হাত থেকে তাঁরা নিজেদের এই ক্রিয়াকল্পে শত-হাত দূরে রাখেন।

শরীরের ন’টা চক্রকে জাগ্রত করে বায়ুর খেলায় ইন্দ্রিয়কে সজাগ ও বশীভূত করে তাঁরা সম্ভোগের বা মিলন ক্রিয়ার সময় বীর্যপাত ঠেকাতে পারেন ঠিক, কিন্তু এভাবে কতখানি কামকে তাঁরা নিয়ন্ত্রণ করেন; দুই শরীরে এভাবে কতখানি বৈরাগ্য তাঁর এনে দিতে পারেন— এসব যথেষ্ট-ই প্রশ্নসাপেক্ষ ব্যাপার। যুক্তিক্রম তাঁরা একটা দেন, ঠিকই। যোনিদেশকে মাতৃ-অঙ্গ হিসেবে পুজো করেন, ইন্দ্রিয়ের প্রলোভনকে জয় করেন পরমানন্দের সন্ধানের জন্যে। আর তা তাঁরা পান সম্ভোগ মিলনে বীর্যকে ঊর্ধ্বগতি দিয়ে কেবল। কী এই পরম তা তাঁরাই বলতে পারবেন। কিন্তু সেটা তো দেহস্থ শক্তিকে জাগানো কেবল। রিপু জয় করে কামরিপুকেই নানা শৈলীতে, ক্রিয়ায়, নিস্তব্ধতায় আরও যেন গভীর করে সাজানো। এটা হতে পারে যৌনতা এখানে বাঙ্ময় নীরবতায় ধর্মীয় আধারে কামসূত্রের শ্রাব্য ও দৃশ্যের অতিবাস্তবকে উপেক্ষা করছে। যৌনতা এখানে ধর্মের আবেগে, পন্থায়, আকর্ষণে অন্বিষ্ট পরমের অস্তিত্বে মোড়া কেবলই এক সমগ্রতা। যা যোগশাস্ত্রের কিছু ব্যাকরণকে রপ্ত করেছে মাত্র। তা করে যৌনতাকে লোকায়ত সাধনের শরীর সাধনার বাতাবরণে আনুভব্য নীরবতা দিয়েছে। যৌনতাকে হয়তো বিচ্ছিন্ন করতে চেয়েছেন দেহবাদী সাধকেরা। তখন যৌনতার সঙ্গে যেহেতু প্রাণকল্প জড়িত ছিল, নারী-পুরুষের সহবাসে তাকে আর কোনওভাবেই ঠেকানোর উপায় জানা ছিল না তাই তাঁরা যোগকল্পের ধ্বনিকণ্ঠকে যৌনতার অনুষঙ্গ করেছেন মাত্র। যার জন্য বর্তমানে এই শরীর সাধনে চরম ব্যভিচার-ই এখন সর্বাংশে আপাতত নেমে এসেছে। সাধনা হয়ে উঠেছে যৌনচর্চা আর ব্যবসার আধার। ভৈরবী পাশে নিয়ে শ্বাস আর দমের কাজ কিছুটা শিখে বীর্যবস্তুকে ঠেকিয়ে দেহসাধক আজ যোগাচারের ভেল্কি দেখাচ্ছেন মাত্র। তন্ত্রের সর্বমোট ১৯২টির মধ্যে ৬৪টি বাংলার তন্ত্র। এই হিন্দুতন্ত্রের অনুকরণে বৌদ্ধদের মধ্যে বৌদ্ধতন্ত্র রচিত হয়েছিল যে এক সময়ে, সেই তন্ত্রসার এখন তন্ত্রের সাহজিক ও গাঠনিক অস্তিত্বকে খর্ব করে দিয়ে, তন্ত্রের ইহ বা কল্যাণকে খঞ্জ ও বিসর্জন দিয়ে তাকে কেবল অন্তর্ভুক্ত করে রেখেছে আপাতিক কিছু যৌনাচার ও ব্যভিচারে। তন্ত্রের দেহগঠনের স্তব, সংযম, রসায়ন, যোগীসুলভ স্থিতাবস্থা সবই নষ্ট হতে বসেছে দেহাচারে আর ব্যভিচারে। তন্ত্র এখন কিছুটা হলেও আপাতত ভৈরবীসহ বিবাহ-বহির্ভূত যৌনচর্চার ছাড়পত্র। তবে সবক্ষেত্রে কথাটা কোনওভাবেই প্রাসঙ্গিক নয়। না হলে আমাদের দেশে তো এক সময় এমন সব তন্ত্রসাধক এসেছিলেন, যাঁরা মায়া-মোহ এসকল পাশ রূপ বস্ত্র টেনে খুলে অষ্টসিদ্ধিও রপ্ত করে নিয়েছিলেন। অণিমা = অণুর মতন ক্ষুদ্র হওয়ার ক্ষমতা, মহিমা = বৃহৎ হওয়ার ক্ষমতা, লঘিমা = ইচ্ছেমতো হাল্কা হওয়ার ক্ষমতা, গরিমা = ইচ্ছেমতো ভারি হওয়ার ক্ষমতা, প্রাপতি = ইচ্ছেমতো যা-ইচ্ছে তাই রপ্ত করার ক্ষমতা, প্রকাশ্য = ইচ্ছেমতো সব কিছুর ওপরে প্রাধান্য বিস্তারের ক্ষমতা, বশিত্ব = ইচ্ছেমতো যাকে-তাকে যখন-তখন বশ করার ক্ষমতা— এই অষ্টসিদ্ধি ভারতীয় সাধক-সাধিকাদের কাহিনী-কিংবদন্তির অন্তর্গত রয়েছে। যার সাক্ষ্য-প্রমাণ ছড়ানো আছে। সুতরাং তন্ত্রে যৌন অসঙ্গতির যে দৃশ্যরূপ, তাকে সরিয়ে-ও এক গভীরতার আত্মপ্রকাশ রয়েছে। যা হয়তো পুনরুদ্ধারের শ্রী হয়ে আপাতত আর ফুটে উঠছে না।

(ক্রমশ)