ছোটগল্প - সুজয় চক্রবর্তী



ছোটগল্প


বিকেলে একফালি রোদ্দুর
সুজয় চক্রবর্তী

ধীরে ধীরে কখন যে মারণ রোগ ক্যান্সার বাসা বেঁধেছে শরীরে, তা টেরই পাননি গৌরীদেবী। সকলের 'পাশে আছি' মনোভাব দেখে ইদানীং তাকে একটু সুস্থও মনে হচ্ছে। তবে বড়ো ছেলের বিয়ে দেওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। পাড়াপড়শি যারাই আসছে, তাদের হাতদুটো ধরে বলছেন, 'সুদীপটার জন্য একটা মেয়ে দেখে দাও না, ভাই।' বড়ো ছেলে সুদীপ একটা প্রাইভেট সংস্থায় বেশ বড়ো পদে কর্মরত।

স্বামী হরিপদবাবু নীচতলায় থাকেন। প্যারালিসিসের রোগী। বছর পাঁচেক আগে স্ট্রোক হওয়াতে বাঁ পাশটা অবশ হয়ে গিয়েছিল। নিয়ম মেনে ফিজিওথেরাপি করার পর এখন কিছুটা ভালো। তবে লাঠি তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী। কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মচারী ছিলেন। বছর সাতেক আগে অবসর নিয়েছেন।

গৌরীদেবীর তখনও ক্যান্সার ধরা পড়েনি। দুজনেই তখন নীচতলায় থাকতেন। সবে মাত্র স্ট্রোক থেকে সেরে উঠেছেন হরিপদ। জড়িয়ে জড়িয়ে কথা বলছেন। সেদিন ছেলেরা বাড়িতে কেউ ছিল না। স্ত্রীর হাতে হাতটা রেখে বললেন, 'দেখো গৌরী, আমিই আগে যাবো।' গৌরী তার ঠোঁটে আলতো চড় মেরে বললেন, 'ইস্, কী অলুক্ষণে কথা! যদি আর কখনও বলেছো....ওসব থাক্, তোমার দীঘায় যাওয়ার কথা মনে পড়ে, সে কথা বলো।' ঘাড় নেড়ে সায় দেন হরিপদ। গৌরী বলে চলেন, 'তখন সুদীপের বয়স দশ-এগারো হবে। আর প্রদীপটা চার-পাঁচ। তোমার তো কি ভয়! তুমি সাঁতার জানো না। আমিই জোর করে রাজি করিয়েছিলাম।' হরিপদ মুখটা বেঁকিয়ে হেসে ওঠেন। গৌরীও ঠোঁটের কোণে হাসি রেখে বলে ওঠেন, 'আর সুদীপের আসার খবরটা যখন তোমাকে দিয়েছিলাম, মনে আছে, কি পাগলের মতো করছিলে? আবার সেই সুদীপই যখন বইমেলাতে হারিয়ে গেলো, তখন দুজনেরই কি টেনশন! বইমেলা তখন ময়দানে হতো, মনে পড়ছে?

প্রেসারে ভাত চাপিয়েছিলেন গৌরী। সিটি পড়ার শব্দ শুনেই রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালেন তিনি। বালিশে মাথা রেখে চোখটা বুজলেন হরিপদ। সবটাই তো সুখ-স্মৃতি নয়। দু-একটা মন খারাপের বিকেলবেলাও যে উঁকি মারছে! ছিপ দিয়ে মাছ ধরা হরিপদ'র বরাবরের শখ। অফিস থেকে বাড়ি ফিরে চলে যেতেন সত্যদের পুকুর-ধারে। প্রায় রোজ। সেদিন অনেক কষ্ট করে ছিপ খেলিয়ে খেলিয়ে সবেমাত্র বর্শিতে টান পড়েছে। টেনে তুলতে যাবেন। অমনি পিছন থেকে গৌরী এসে হাঁক পাড়লেন, 'ওগো শুনছো, অভিযান সংঘের মাঠে সার্কাস এসেছে। দেখতে যাবে?' হরিপদ ঘাড় ঘোরাতেই কাতলা 'ফুড়ুৎ'। কী বকাটাই না বকেছিলেন। গৌরীর তো কাঁদো কাঁদো অবস্থা। খুব খারাপ লেগেছিল। রাগও হচ্ছিল নিজের ওপর। বেচারি কত আশা করে এসেছিল! কোথাও তো যায় না। তার কাছে কাতলাটাই বড়ো হয়ে গেল! টানা দু'দিন ধরে চলেছিল মান-অভিমানের পালা। পরে অবশ্য ঠিকঠাক হয়ে গিয়েছিল সব। সার্কাসেও গিয়েছিলেন দুজন।

একই বাড়িতে থাকলেও এখন আর স্ত্রীর সঙ্গে বড়ো একটা দেখা সাক্ষাৎ হয় না হরিপদবাবুর। তবে সুদীপের বিয়ে নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ইদানীং কথা হচ্ছে। মোবাইলে। সুদীপই দুজনকে দুটো মোবাইল কিনে দিয়েছে।

(২)
সুদীপের জন্য পাত্রীর সম্বন্ধটা দিলেন গৌরীদেবীর ছোটো ননদ। পাত্রী সোমার সঙ্গে সুদীপের মানাবেও ভালো। সবকিছু ঠিকঠাক। সামনের মাসেই বিয়ে।

এত চটজলদি বিয়েটা ঠিক হতো না। আসলে গৌরীদেবীর শারীরিক অবস্থার ক্রমশ অবনতি হচ্ছে দেখেই এই সিদ্ধান্তে আসা। মেয়ের বাড়ির লোকজনও তাতে আপত্তি করেনি।

ছেলের বিয়েটা দেখে যেতে পারবেন গৌরী, বেশ আনন্দ হচ্ছে তাঁর। মোবাইলে স্বামীর সঙ্গে এ নিয়ে অল্পস্বল্প কথা হয়েছে। হরিপদবাবুও খুব খুশি। বাড়িতে নতুন বউ আসছে!

একটা ছেলের পর তো মনে প্রাণে গৌরীদেবী মেয়েই চেয়েছিলেন! খুব একটা সাজতেন না তিনি। কপালে একটা লাল টিপ, মুখে একটু স্নো-পাউডার, আর কানে দুটো দুল হলেই চলতো। এ নিয়ে হরিপদ কতবার অনুযোগ করেছেন, "একটু সাজতে-গুজতে পারো না? তোমার কি কোনও অভাব আছে?"
গৌরী তখন বলতেন, "সাজা কাকে বলে, তোমাকে দেখিয়ে দেবো। মেয়েটা আগে হোক।" গৌরী তখন গর্ভবতী। 
মানুষ চায় এক, হয় আর এক। হলোও তাই। গৌরীর কোল আলো করে জন্ম নিল প্রদীপ। ছোটছেলে।

(৩)
পরিবারের প্রথম বিয়ের অনুষ্ঠান। আয়োজন জাঁকজমক করেই হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু গৌরীদেবীর অসুস্থতায় তাতে ভাঁটা পড়েছে।

ছেলের বিয়েতে মাথায় বরণডালা নিয়ে জল সাজতে যাচ্ছেন। সঙ্গে ব্যান্ডপার্টি। সবার আগে আগে চলেছেন তিনি। পাড়ার লোক হাঁ করে দেখছে তাঁকে। এমন দৃশ্য বছরখানেক আগেও কল্পনা করেছেন গৌরী। এখন তা হওয়ার নয়। গতকাল রাতেও শরীরটা বেশ খারাপ করেছিল। জ্বর। ওষুধ খেলেন। দুপুরের দিকে তাপমাত্রাটা স্বাভাবিক হলো।

ছেলের বউকে কী দিয়ে আশির্বাদ করবেন, ঠিক করে রেখেছেন গৌরী। নিজের বিয়েতে পাওয়া চুড়, চেন আর কানপাশাই দেবেন। বালা, মানতাসা আর চুড়িগুলো তোলা থাকবে ছোটছেলে প্রদীপের বউয়ের জন্য।

বিয়ের সময় প্রচুর গয়না পেয়েছিলেন গৌরী। শুধু পরিবার নয়। বংশের মধ্যে তিনিই একমাত্র মেয়ে। তাই সকলেই ভালোবেসে সোনার জিনিসই দিয়েছিল। বড়ো পিসি, ছোটকাকুর অবস্থা তো খারাপ ছিল না! বিয়েতে লোকও হয়েছিল অনেক। পাড়াপড়শি যারা নতুন বউকে দেখতে এসেছিল, তাদেরই একজন সত্য'র মা। বউ দেখে বাড়ি যাওয়ার পথে যাকেই সামনে পেয়েছে, তাকেই বলেছে, 'ভালো সোনা পেল মেয়েটা!'

এইবার সেই সোনা-ই দুই বউকে সমানভাবে ভাগ করে দিয়ে যাবেন তিনি। এরকম ভাবেন ঠিকই, কিন্তু পরক্ষণেই শরীরের কথা চিন্তা করে মনে মনে বলে ওঠেন, 'ওরা যেটা ভালো বুঝবে, তাই করবে।'

(৪)
লগ্ন শুরু ন'টা বারোতে। ঘন্টাখানেকের পথ। বরকে নিয়ে বরযাত্রীর গাড়ি রওনা দিলো সন্ধে সাড়ে সাতটায়।

বাড়ি ফাঁকা। এমনকি কাজের মেয়ে সন্ধ্যা, সেও গিয়েছে বরযাত্রী। শুধুমাত্র দুটো মানুষ শুয়ে আছেন খাটে। একজন একতলায়, অন্যজন দোতলায়। সারাদিন মোবাইলে অনেক কথা হয়েছে দুজনের। চার্জ প্রায় নেই। নিচের জন তবু কল করলেন উপরতলায়। উপরের জন তা রিসিভও করলেন। ছেলের বিয়ে নিয়েই কথা হলো বেশি। এরমধ্যেও দুজনে দুজনের শরীরের খবরও নিলেন। শেষে উপরের জন বললেন, 'সন্ধ্যা তোমার খাবার ঢেকে রেখে গেছে। অল্প দুটো খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়ো। সকাল সকাল উঠতে হবে। বউমা আসবে বাড়িতে।' কথা বলতে বলতে ঘনঘন কাশছিলেন তিনি। নিচের জন তাঁকেও প্রায় একই কথা বললেন। তবে বাড়তি যোগ করলেন, 'কাত হয়ে শুয়ো। বুকের কাছে বালিশ রেখো। ওষুধগুলো ঠিকঠাক খেয়ো। আর ইনহেলারটা যেন পাশে থাকে। শোনো, ব্যাটারি 'লো' দেখাচ্ছে। তুমি....।' কথাটা শেষ হলো না। মোবাইলের সুইচ অফ।

রাত দশটা। উপরতলার আলো নিভে গেলো। নিচের তলায় আলো জ্বলছে। নীচের জন চাদরটা কোনওরকমে গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়লেন। চোখের পাতাদুটো বন্ধ। কিন্তু ঘুম আসছে না। অন্যদিন এই সময় তিনি ঘুমের দেশে। আজকের দিনটা অন্যরকম। আরও কয়েকটা ঘন্টা এভাবেই পার করে দিতে হবে তাঁকে। তারপরই তো সকাল।

আলো নেভালেও উপরের জনের চোখেও ঘুম নেই। কাত হয়েই শুয়েছিলেন। একটা কথা বলার ছিল তাঁর। অন্ধকারে হাতরে হাতরে মোবাইলটা পেলেন। ডায়াল করলেন নীচের জনকে। সুইচঅফ। বেশ খারাপ হয়ে গেল মনটা। খুব রাগ হলো সন্ধ্যাটার উপর।
'মানুষটা ঠিক করে হাঁটতে চলতে পারে না। তুই বাবা, মোবাইলটা পুরো চার্জ দিয়ে রেখে দে। দুটো কথা বলতে গেলে তো তাকে এটারই সাহায্য নিতে হয়! আমারও যে যাওয়ার জো নেই, তা ভালো করেই জানিস!'

নীচের তলায় তখনও আলো জ্বলছে। বিছানায় শুয়ে মানুষটি অস্থির বোধ করছেন। দুটো কথা বলে সময় কাটানোর লোক থাকলেও উপায় নেই।

পাক্কা দু ঘন্টা কোথা দিয়ে যেন কেটে গেল! নীচেরজন ভাবছেন শরীরটা ঠিক থাকলে বরকর্তা হিসেবে তাঁকেই তো যেতে হতো। ভগ্নীপতি সমরেশকে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়েছেন। তাঁর বিশ্বাস সমরেশ ঠিক ম্যানেজ করে নেবে। সর্বক্ষণ ভগবানকে ডাকছেন। ভালোয় ভালোয় সবকিছু যেন মিটে যায়। ঘুম আসছে না। কেবল চোখটা বুজে আছেন।

রাত অনেক। সারা পাড়াই নিঝুম। মাঝেমধ্যে নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে দু-একটা কুকুর ডেকে উঠছে। রাস্তায় টহলদার পুলিশের গাড়ি। চোখটায় সবে ঘুম ধরেছিল নীচের জনের। আর ঠিক সেই সময়েই শব্দটা শুনতে পেলেন। গ্লাস পড়ার শব্দ। বুকের ভেতরটা ধড়পড় করে উঠলো। গৌরী কাশছিল না? ও কি পড়ে গেল? কোনও সাড়াশব্দ পাচ্ছি না কেন?

একরাশ প্রশ্ন মাথার মধ্যে ভিড় করতে লাগলো। অস্ফুটে হরিপদ বলে উঠলেন, 'গৌরী কি হলো তোমার?' কিন্তু ক্ষীণ কণ্ঠস্বর উপরতলা পর্যন্ত পৌঁছালো না। এক অজানা আশঙ্কায় ভয় পেয়ে গেলেন তিনি। কাঁপতে কাঁপতে খাটের ধারে এসে পা দুটো ঝুলিয়ে দিলেন তিনি। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর দু থেকে তিন মিনিট কিভাবে যেন কেটে গেল। কোন এক ঐশ্বরিক শক্তির উপর ভর করে নিচের জন পৌঁছে গেলেন উপরতলায়!

'গৌরী, কি হলো তোমার?'
খুব কাছ থেকে ডাকটা শুনলেন গৌরী। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। কোনওরকমে হাতরে হাতরে বেড সুইচটা অন করলেন। হরিপদবাবু কাঁপছেন। তাঁকে ধরে বসালেন গৌরী। গৌরীর শ্বাসকষ্ট উধাও। কাশিও নেই। সম্পূর্ণ সুস্থ মনে হলো নিজেকে। দরজার বাইরে এসে সিঁড়ির ধাপগুলো দেখে এলেন। এতগুলো সিঁড়ি! ঘামছেন হরিপদ। ফ্যানটা জোরে দিয়ে, গামছা দিয়ে মুখটা মুছিয়ে দিলেন গৌরী। 
বেশ উৎকণ্ঠার সঙ্গেই জিজ্ঞাসা করলেন হরিপদ, 'কই, তোমার কিছু হয়নি তো?'

'না, কাশতে কাশতে গলা শুকিয়ে গিয়েছিল। জল খেতে গিয়েছিলাম। গ্লাসটা....আমি তো ভাবতে পারছি না, লাঠি ছাড়া তুমি উঠলে কি করে!'

---তোমার কোনও সাড়া পাচ্ছিলাম না। ভয় ধরে গেল। তবে কি করে যে উঠলাম, নিজেও জানি না।...যাও, তুমি এবার শুয়ে পড়ো।'

ধীরে ধীরে কোমর টান করছেন হরিপদ। উঠতে যাবেন, গৌরী বাধ সাধলেন, 'কোথায় যাচ্ছো? তুমিও শোও এখানে। আর নিচে নামতে হবে না। তুমি একা নামতে যাও, আর আমার টেনশন বাড়াও। ছেলেরা আসুক। ওরাই তোমাকে নামিয়ে দেবে। আজকে আমরা এক খাটেই শোবো। এই নাও বালিশ।'

হরিপদও সাহস পেলেন না একা নামার। একটু আগেই যে শক্তিটা ভর করেছিল তারঁ উপরে, সেটাকে তিনি যেন হারিয়ে ফেলেছেন!

বহুদিন পর একই খাটে স্বামী-স্ত্রী শুয়ে পড়লেন। পাশাপাশি।

গৌরীদেবী হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন হরিপদবাবুর মাথায়। মোবাইলটা রাখা আছে দু-হাত দূরে। আজকের রাতটা এভাবেই কাটিয়ে দেবেন ওরা। কেননা সকাল হতে তো আর বেশি দেরি নেই!





No comments:

Post a Comment