গল্প - সমরেন্দ্র বিশ্বাস








বাজারে যাবার রাস্তা। একপাশে দাঁড়িয়ে দুদুটো কালো গাড়ি। গাড়িগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে জনাচারেক পুলিশ। কয়েকজন সিভিল ড্রেসের মানুষ। ওরা ওসমানের পথ আটকালো।
এদিকে নাসরিন বিবির ফোন - ‘তাড়াতাড়ি আসো, ছেলেটা কাঁদছে। দুধ দিতে হবে।’ কোনমতে সে উত্তর করলো, ‘আসছি!’
ওসমান বাজার থেকে ফিরছিলো। হাতের ব্যাগে কিছু সব্জিপাতি, প্লাস্টিকের প্যাকেটে দু-প্যাকেট দুধ, বগলে একটা খবরের কাগজ – শ্রমিক কৃষক ইস্তাহার।
সিভিল ড্রেসের দুজন যেন ওর অপেক্ষাতেই ছিল। কালো গাড়ির সামনে থেকে এগিয়ে এসে ওরা ওসমানের হাতদুটো ধরলো। - ‘আসুন! এদিকে আসুন! বগলে দেখছি – শ্রমিক কৃষক ইস্তাহার। আপনি তো ঝানু মাল! আসুন!’
ওরা ওসমানের হাত ধরে টানতে টানতে কালো গাড়িটার দিকে নিয়ে গেলো। লোকগুলোর এমন আদবকায়দা আর কথাবার্তায় ওসমান হকচকিয়ে গেলো!
তিনজন সিভিল ড্রেস তাকে জবরদস্তি ঠেলেঠুলে কালো গাড়িটার ভেতর ফেলে দিলো।
‘কি ব্যাপার! আমাকে আপনারা কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? বাজার করে ঘরে ফিরছি। আমি গেলে বাচ্চাটা দুধ খাবে!’
‘দুধের প্যাকেট আমরা আপনার ঘরে পৌঁছে দেবো। আপনার নাম ঠিকানা সব আমাদের কাছে লেখা আছে।’ উর্দিধারী পুলিশটা বললো!
কালোগাড়িটার পেছনের সিটে ওসমানকে বসিয়ে তালা বন্ধ করে দেয়া হলো!
‘কি ব্যাপার? আমাকে আপনারা এভাবে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?’
ওদিকে মোবাইলে নাসরিন বিবির ফোন। কেন ফিরতে দেরী? ফোনে কিছু উত্তর করবার আগেই ওদের একজন ওসমানের ফোনটা কেড়ে নিলো। আরেকজন ওসমানের দুচোখ কাপড় দিয়ে বেঁধে দিলো। ওর দুটো হাতও বেঁধে দিলো।
ওসমান এবার সত্যি সত্যি অসহায় বোধ করলো! তার প্রচন্ড রাগ এলো। চিৎকার করে আবার জিজ্ঞেস করলো – ‘আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? আমি কি করেছি?’
সামনে বসা পুলিশ অফিসারটা বললো – ‘আমরা আপনাকে আয়নাঘর-এ নিয়ে যাচ্ছি! সেখানে বসে বসে আপনি নিজেকে দেখবেন। নিজেকে নতুন ভাবে চিনবেন।’ তার মুখে বিদ্রুপভরা হাসি!
কালো দুটো গাড়ী ছুটে চলেছে। ওসমানের চোখ দুটো শক্ত করে বাঁধা! ঘন্টাখানেক পরে গাড়ী থামলো। গাড়ীর পেছনের ডোর খুলে গেলো। ওর হাতের বাঁধন খুলে দেয়া হলো। কেউ একজন ওর দুটো গালে চারপাঁচটা থাপ্পর লাগালো – ‘শয়তান ইবলিস! জলদি নাম। পুঙীর পুত! আয়নাঘরে যাবি!’
ওসমানকে হাত ধরে গাড়ী থেকে নামিয়ে নেয়া হলো। দুজন দুপাশ থেকে শক্ত করে ওর হাত ধরে আছে। কেউ একজন পেছন থেকে ওর পিঠে সপাং করে লাঠির বাড়ি মারলো। ওসমান কঁকিয়ে উঠলো! সমস্ত শক্তি একত্রিত করে ওসমান কাঁপা গলায় বলে উঠলো – ‘আমি কি করেছি? আমার উপর কেন এমন করা হচ্ছে? আমাকে আমার ঘরে যেতে দিন। আমার বিবি আর বাচ্চা পথ চেয়ে বসে আছে!’
কোনো উত্তরের পরিবর্তে কেউ একজন ওসমানের দুই গালে কষে আবার দুটো থাপ্পর লাগালো! আর কিছু বলবার সাহস পেলো না!
ওসমান আন্দাজ করলো, তাকে কোনো একটা বড়ো বিল্ডিং কমপ্লেক্সে নিয়ে আসা হয়েছে। তাকে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ধীরে ধীরে নীচে নেমে যাচ্ছে ওরা! ডাইনে, বায়ে, কিছুটা ঘুর পথ। আরো কিছুক্ষণ চলার পরে সিঁড়ির কতগুলো ধাপ বেয়ে ওরা উপরে উঠে এলো। চলার পথে ওসমান শুনতে পেলো কেউ একজন কাউকে স্যালুট জানাচ্ছে। একটা লোহার গেট খোলার শব্দ! আরেকটু এগিয়ে আরেকটা লোহার গেট কেউ খুলে দিলো। সেখানে ওসমানকে ঢুকিয়ে দিয়ে তার চোখের বাঁধন খুলে দেয়া হলো।
ওসমান চোখ খুলে দেখলো। এ সে কোথায় এসেছে? প্রায় বারো ফুট লম্বা, সাত ফুট চওড়া একটা কক্ষ। একটা ছোট্ট খাট। ঘরটার এককোনে একটা বাথরুম, পায়খানা আর জলের নল। একটা বালতি আর প্লাস্টিকের মগ। মাথার উপরে বনবন বনবন করে প্রচন্ড আওয়াজে ঘুরছে একটা ফ্যান।
ওসমানের সব কিছু গুলিয়ে যাচ্ছে! ঘরে না ফেরার জন্যে দুশ্চিন্তায় নাসরিন বিবি নিশ্চয়ই এদিক ওদিক দৌড়ে বেড়াচ্ছে! আড়াই বছরের জাকির এখনোও কি অপেক্ষায় আছে, কখন আব্বু দুধ নিয়ে ঘরে ফিরবে?
এই ঘরের নামই কি আয়নাঘর? এতো ইট বালি প্লাস্টার লোহার রডে গড়া একটা ছোট্ট কয়েদখানা! ওসমান আয়নাঘরের চারদিকটা দেখছে। এ ঘরে তো একটাও আয়না নেই! তাহলে এর নাম কেন আয়নাঘর?
বেলা একটার সময়ে ওসমানের জন্যে প্লেট ভর্তি ভাত ডাল তরকারী এলো। খাবার তেমন ইচ্ছে নেই। তবুও সামান্য একটু খেয়ে নিলো, এই বন্দীদশায় ভাতের গ্রাস তো নয়, যেন সে গিলে গিলে খাচ্ছিলো তিতো আগুনের গোলা!
এরপর আবার ওসমানের চোখ বাঁধা হোলো। তাকে পাহারা দিয়ে নিয়ে যাওয়া হোলো আরো একটা আলোকিত কক্ষে! চোখ খুলে দেয়া হোলো। জিজ্ঞাসাবাদ হবে। সেখানে একটা বিশেষ ডিজাইনের তৈরী লোহার ভারী হাতলয়ালা-চেয়ার। ওসমানকে চেয়ারে বসিয়ে চেয়ারের দুটো হাতলের সাথে তার হাতদুটো ক্লাম্প করে দেয়া হলো। চেয়ারের সামনের দুটো পায়ের সাথে তার পাদুটো বেঁধে দেয়া হোলো।
বড়ো অফিসার আবদুল গফর খান জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলো। - ‘ওসমান সাহেব। শুনেছি, আপনি একজন স্কুল মাষ্টার। আমাদের কাছে খবর আছে – আপনি আমাদের সরকারের বিরোধিতা করেছেন! এ নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় লিফলেট বিলি করেছেন! সুতাকল শ্রমিকদের মধ্যে গিয়ে ভাষণ দিয়েছেন। আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা আপনাদের কি ক্ষতি করেছে? আপনারা কি ভাবেন, আমরা সবাই গান্ডুরা এখানে বসে আছি? বলুন দেখি, আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা আপনার কি ক্ষতি করেছে? ……’ এমনি হাজারটা প্রশ্ন, যার তেমন কোনো উত্তর এই মুহূর্তে ওসমানের মগজে নেই!
কেউ একজন তার কানে ইলেকট্রিক কারেন্টের ছোঁয়া লাগালো! হঠাৎ করে ওসমানের শরীরটা ঝাকুনি খেয়ে উঠলো!
‘বলতে পারেন, আমাদের শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আপনাদের এতো বিদ্রোহ কেন?’
ওসমান জানে না, সে কি এমন বিদ্রোহ করেছে? অবশ্যই দেশে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে সে বিভিন্ন সময়ে সরব হোয়েছে। ফেসবুক, টুইটার, নানা ডিজিটাল মিডিয়াতে সে তার বক্তব্য রাখার চেষ্টা করেছে। কটন মিলে শ্রমিকদের সমাবেশে সে বক্তব্য রেখেছে। তার স্কুলের কার্যকরী সমিতির তাবেদারী পচাগলা সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছে।
কয়েক ঘন্টা জিজ্ঞাসাবাদ আর শারীরিক নির্যাতনের পরে তাকে নিয়ে আসা হলো তার জন্যে নির্ধারিত আয়নাঘরে।
সামনের কারারক্ষীটিকে জিজ্ঞেস করলো, ‘আমি কি আমার মোবাইল ফোনটাকে অল্প কিছু সময়ের জন্যে ফেরত পেতে পারি! এই যে আমাকে হঠাৎ করে গুম করে দেয়া হয়েছে, এই যে আমি এখানে চলে এসেছি, এ নিয়ে আমার পরিবার, আত্মীয়স্বজনেরা খুব চিন্তায় আছে। ওরা সবাই হয়তো থানায় রেল স্টেশনে হাসপাতালে মর্গে – সবখানেই আমায় খুঁজে বেড়াচ্ছে!’
ওর কথা শুনে কারারক্ষীটা একটু মানবিক হাসি দিলো। বললো, ‘আপনি নিশ্চিত থাকুন মামলার নিস্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত আপনার মোবাইল ফেরত পাবেন না!’
-‘দয়া করে আপনি যদি আমার এই নম্বরে একবার ফোন করে দেন, বলবেন, ওসমান মিয়া বেঁচে আছে, আমার বিবিকে জানাবেন, আমি আপনাদের আয়নাঘরে আছি ……’
কারারক্ষীটি হাসলো। ‘কিন্তু এ কাজটা করানোর জন্যে আপনাকে পাঁচশো টাকা নগদ দিতে হবে। আমি বাইরের বুথ থেকে ফোন করে আপনার পরিবারকে জানিয়ে দেবো, ওসমান ভালো আছে! তবে আপনি কোথায় আছেন, কোন আয়নাঘরে আছেন, সেসব জানানো সম্ভব না।’
সে তাতেই রাজী হয়ে গেলো। অন্তত নাসরিন বিবি আর তার বাড়ির সবাই তো জানুক, ওসমান নিঁখোজ হলেও, সে এখনো পর্যন্ত বেঁচে আছে।
আয়নাঘরে টিমটিম আলো। রাত্তির আটটায় খাবার এলো। তড়িঘড়ি খেয়ে নিলো। বাথরুমে পেচ্ছাপ সারলো। খাটের বিছানায় নিজের শরীরটাকে এলিয়ে দিলো। মাথার উপরে প্রচন্ড শব্দে ফ্যানের ক্যাচোরকোচোড় আওয়াজ।
গভীর রাত। কটা বাজে সে জানে না। দূরে পাহারাদারের জুতোর মচমচ আওয়াজ। লোহার গেট খোলার আওয়াজ। অন্য গেট দিয়ে কি আরো একজন সন্দেহভাজন নাগরিককে পাশের আয়নাঘরে ঢোকানো হোলো?
প্রবেশদ্বারের লোহার গ্রীলের ফাঁক দিয়ে দেখা গেলো আরো দুজন সান্ত্রী হেঁটে চলে যাচ্ছে। তারপরে আবার নিস্তব্ধতা। মাথার উপর ফ্যানের হাওয়া গর্জন করে ঝড়ের মতো ওসমানকে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে – যেন ওসমান ঘরের দেয়াল ভেঙ্গে পৌঁছে গেছে তার গ্রাম বকুলপুরে। সে পৌঁছে গেছে তার নিজের ঘরে। ঐ তো নাসরিন বিবি এখনো জেগে আছে। তার হাত জাকিরের মাথায়। ছেলেটা হয়তো কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে।
ওসমানের সম্বিত ফিরে এলো। না! সে তো তার বাড়িতে নেই। আজ সকালে বাজার থেকে ফেরার পথে দেশের গোয়েন্দা বাহিনী তাকে জবরদস্তি তুলে এনেছে এই আয়নাঘরে। সে আটকে আছে ১২ ফুট বাই ৭ ফুটের কয়েদখানায়।
ঘুম আসছিল না। নিজের ছেলের কথা, বিবির কথা, মাস্টারি-করা তার নিজের স্কুলটার কথা, কটন মিলের আগামী সমাবেশের কথা – এসব কিছু ভাবতে ভাবতে এক সময়ে ওসমান ঘুমিয়ে পড়লো।
তন্দ্রাচ্ছন্ন ওসমান স্বপ্নের ঘোরে দেখলো তার ১২ ফুট বাই ৭ ফুটের ঘরটা আলোয় ঝকমক করছে। তার ঘরের সিমেন্টের প্লাস্টার ঝুরুঝুরু করে খসে পড়ছে। কক্ষের আগেকার কয়েদীদের নাম, ফোন নম্বর, নখের আচড়ে লেখা অস্পষ্ট শ্লোগানগুলো দেয়াল থেকে খসে খসে পড়ছে, মিলিয়ে যাচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে।
তার ঘরের তিন দিকের সিমেন্টবালির দেয়ালে কারা যেন ফিট করে রেখেছে বড়ো বড়ো আয়না!
ম্যাজিকের মতো তার ঘরের দেয়ালগুলো পুরো ঢেকে গেছে বিশাল বিশাল আয়নায়!
ওসমান উঠে দাঁড়িয়ে আয়নায় নিজের মুখ দেখলো। তার নজরে এলো, একটা নয় দুটো নয়, আয়নার প্রতিফলনে দেখা যাচ্ছে অনেকগুলো ওসমান, অসংখ্য ওসমান!
অনেকগুলো ওসমানের মুখ তার দিকে তাকিয়ে আছে! অনেক অনেক ওসমান! ওসমান কি অন্যায় করেছে? নিজের মতামত প্রকাশ করাটা কি বিদ্রোহ? সামাজিক অন্যায়ের প্রতিবাদ করাটা কি রাজদ্রোহিতা?
অবাক কাণ্ড! অনেকগুলো ওসমানের প্রতিবিম্বিত মুখ হঠাৎ করে এইমাত্র মিলিয়ে গেলো! তার বদলে সে আয়নার প্রতিবিম্বে দেখতে পাচ্ছে, তিন দিক থেকে এগিয়ে আসছে বিপুল সেনাবাহিনী আর পুলিশ! সেনা বাহিনীর হাতে বন্দুক, মর্টার! পুলিশবাহিনীর হাতে দেশের ছেঁড়া সংবিধান! একজন পুলিশকর্তার বুকে দেশনেত্রীর আবক্ষ ফটো ফ্রেম। দেশের প্রধানকে বুকে আগলে অফিসারটা তার দিকেই এগিয়ে আসছে! এই আয়নাঘরে ওসমান কি নিজেকে নিজে নতুন ভাবে চিনতে পাচ্ছে?
ওসমান দেখলো, দেশের নামে কুচকাওয়াজ করতে করতে সবাই এগিয়ে আসছে তারই চোরা কুঠুরিটার দিকে! বামপাশের আয়নায় দেখা গেল দেশের নেত্রী জাতীয় পতাকা উত্তোলন করছে! ডান পাশের আয়নায় দেখা গেলো একজন হিটলারের মতো কেউ মার্চপাষ্ট করে সেনাবাহিনীকে স্বাগত জানাচ্ছে!
এই অবস্থায় সম্বিত হারিয়ে ওসমান সামনের দিকে দৌড় লাগালো। সামনের তালাবন্ধ লোহার গারদে তার মাথা আচমকা ঠুকে গেলো।
জ্ঞান হারিয়ে এখন ওসমান পড়ে আছে তার আয়নাঘরের মেঝেতে! তখন শেষ রাত্তির!

No comments:

Post a Comment