প্রবন্ধ - ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়








অটবী অর্থে বন। আটবিক, অর্থাৎ যা বনজ, বনে বসবাস করে ইত্যাদি। অরণ্য সম্প্রদায়ের মানুষজনকেও আমরা আটবিক বলে থাকি। জনজাতি-জনগোষ্ঠী সমাজের মানুষজন যারা অরণ্যচারী তাদেরও আটবিক বলা যেতে পারে। রামায়ণ মহাভারতের মত সুবিশাল দুই মহাকাব্যেও অরণ্যে বসবাসকারী কিছু চরিত্রের উল্লেখ আমরা পেয়ে থাকি। অরণ্যে যেমন বনস্পতি, বৃক্ষসকল আছে তেমনি আছে অজস্র গুল্ম-লতার ছড়াছড়ি যা সকল নিয়েই এই বনজ সম্পদ। মহাভারত-রামায়ণের মত মহারণ্যেও বৃক্ষ, লতা-গুলমের সংখ্যা কিছু কম নয়। অর্থাৎ অজস্র উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ, প্রধান চরিত্রের পাশাপাশি কিছু অন্য ধরনের চরিত্রের উল্লেখও এখানে পাওয়া যায়। বহু চরিত্রের সংমিশ্রণ এই মহাকাব্যগুলি। রাজা-রাজড়া, ব্রাহ্মণ, মুনি-ঋষি থেকে শুরু করে অরণ্যচারী, অনার্য, রাক্ষস, দানব বহুকিছুর সমাবেশ ঘটেছে। আবার এইসব অনার্য-রাক্ষস আটবিক চরিত্রগুলিও কেউ কেউ অরণ্যের রাজা, অরণ্যবাসীদের রাজা এমনও পাই। মহাভারতের হিড়িম্বার কথাই ধরা যাক। একজন রাক্ষস জাতির কন্যা হয়েও তিনি ছিলেন চেদিরাজের কন্যা। চেদি রাজ্যটি ছিল পর্বত সানুদেশে গভীর অরণ্যে।
মহাকাব্যগুলিতে মূল ও প্রধান চরিত্রের পাশাপাশি আছে অনেক এমন কিছু চরিত্র যা আপাতদৃষ্টিতে মূল্যহীন মনে হলেও মহাকাব্যের কাহিনিতে তার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ এবং অনস্বস্বীকার্য।
রামায়ণ মহাকাব্যে তেমনই একটি চরিত্র হল শূর্পনখা। আমাদের আলোচ্য বিষয়ও তিনিই।

রামায়ণে শূর্পনখার চরিত্রটি কি আটবিক বলা যায়? যদিও মাঝে মাঝে তিনি অরণ্যবাসী হন, কিন্তু রামায়ণে বর্ণনা করা হয়েছে তিনি লঙ্কার রাজা রাবণের ভগিনী অর্থাৎ রাজপরিবারের একজন। লঙ্কা সেইসময়ে অত্যন্ত সমৃদ্ধ এক রাজ্য এবং লঙ্কাপুরী সুসজ্জিত ও সুঅলঙ্কৃত। সুতরাং তিনি জাতিতে রাক্ষস হলেও তাঁকে আটবিক বলা যায় না। শূর্পনখার চরিত্রটি রামায়ণ মহাকাব্যে বিশেষ বিস্তৃতি লাভ করেনি। রামায়ণ রচয়িতাগণও অতি সামান্যই শূর্পনখা সম্বন্ধে আলোচনা করেছেন। কিন্তু একটি কথা ভুললে চলবে না, শূর্পনখা চরিত্রটির জন্যই রাম-রাবণে বিবাদ। নতুবা তার আগে রাম সম্পর্কে রাবণের কোন বৈরিভাব ছিলনা। সেই অর্থে চরিত্রটির গুরুত্ব কোন অংশে কম নয়। এ হেন চরিত্রটি সম্বন্ধে আমরা কি জানি?

বিভিন্ন রামায়ণ রচনাকারের রচনা, পরবর্তী লেখকদের আলোচনা,পর্যালোচনা ইত্যাদি থেকে যা জানতে পারি তা হল এই যে শূর্পনখা ছিলেন রাবণের ভগিনী। তিনি পঞ্চবটি বনে রামের শৌর্য-বীর্যের কথা শুনে পঞ্চবটি বনে রামকে দেখতে আসেন এবং দেখে মুগ্ধ হন। মুগ্ধ শূর্পনখা রামের পাণি প্রার্থনা করলে রাম বিবাহিত পুরুষ এবং স্ত্রী বর্তমান থাকতে অপর বিবাহ সম্ভব নয় একথা জানালে শূর্পনখা লক্ষণের প্রেম ও পাণি প্রার্থনা করেন। লক্ষণ অরাজী হলে শূর্পনখা তাঁর ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে সীতাকে হত্যা করতে উদ্যত হলে লক্ষণ তরোয়ালের আঘাতে তার নাক কেটে ফেলেন। ফলে শূর্পনখা অপমানে ফিরে যান ভ্রাতা রাবণের কাছে এবং তার এই অপমানের প্রতিশোধ নিতে বলেন। এই ঘটনার পরবর্তীকালে রাবণের পঞ্চবটিতে আগমন, ক্রমে সীতাকে দেখে তাঁর রূপে মুগ্ধ হয়ে সীতাহরণ এবং বাকি রামায়ণে রাম-রাবণের যুদ্ধ ও সীতা উদ্ধারের কাহিনি আমরা পাই। শূর্পনখাকে নিয়ে কাহিনি ও আলোচনা রামায়ণেও আমরা এটুকুই জানতে পারি। কিন্তু রামায়ণ ভালো করে বুঝতে গেলে আমাদের মনে রাখা দরকার যে, শূর্পনখার নাসিকাচ্ছেদের ঘটনা না হলে রাম-রাবণের যুদ্ধের কোনই প্রয়োজন ছিল না। সেক্ষেত্রে রাম হয়তো চোদ্দ বৎসর পঞ্চবটিতে শান্তিতে কাটিয়ে অযোধ্যায় ফিরে যেতে পারতেন। শান্তিতে বনে বাসও করতে পারতেন। সুতরাং এখানেই আমাদেরও শূর্পনখা সম্বন্ধে কিছু জানা প্রয়োজন হয়ে পড়ে।

তাঁর জন্মবৃতান্ত আমাদের কিছুটা জানা আছে। যেমন তিনি ছিলেন জাতিতে রাক্ষস অর্থাৎ অনার্য রমণী। শূর্পনখার পিতা ছিলেন মহর্ষি বিশ্রবা এবং মাতা ছিলেন অনার্য রাক্ষস রমণী কৈকেসী। যদিও অনেক স্থানে কৈকেসীকে মাতা বলা হয়, কিন্তু আদতে তারও পিছনে এক কাহিনি আছে। কি সেই কাহিনি?
প্রকৃতপক্ষে লঙ্কার রাজা ছিলেন কুবের। অনেক পরে রাবণ কুবেরের কাছ থেকে লঙ্কা দখল করে নিলে লঙ্কার রাজা হন। লঙ্কেশ্বর কুবের তার পিতা বিশ্রবা মুনির পরিচর্যার জন্য তিনজন পরিচারিকা পাঠিয়েছিলেন। তারা হলেন—পুষ্পোৎকটা, রাকা এবং মালিনী। এই তিনজন রমণীই বিশ্রবা মুনির সংস্পর্শে আসেন ও সন্তানসম্ভবা হলে পুষ্পোৎকটার গর্ভে জন্মলাভ করেন রাবণ ও কুম্ভকর্ণ, রাকার গর্ভে জন্মলাভ করেন খর ও শূর্পনখা এবং মালিনীর সন্তান বিভীষণ। শূর্পনখা’ নামের এক বিশেষ অর্থ ছিল। শূর্পনখা অর্থাৎ এমন যে রমণী যার নখ ছিল কুলোর মত বড়, বৃহৎ আকারের। শূর্পো শব্দের অর্থ হল কুলো। তিনি রাক্ষসী, কুৎসিত,কদর্য চেহারার রমণী ছিলেন। রামায়ণ রচনাকারেরাও শূর্পনখাকে সেই রূপেই চিত্রিত করেছেন। কিন্তু শূর্পনখা একটি বিশেষ গুণের অধিকারিণী ছিলেন। তিনি ইচ্ছামত রূপ ধারণ বা পরিবর্তন করতে পারতেন। বিভিন্ন রামায়ণে শূর্পনখার রূপ নিয়ে একাধিক আলোচনা আছে। আলোচনায় দেখা যায়, শূর্পনখা ছিলেন পরমাসুন্দরী যিনি লক্ষণের কাছে প্রেম নিবেদন ও ভিক্ষা করেছিলেন। বস্তুত, তাঁর বিশেষ গুণটির জন্যই তিনি বেশ ও রূপ পরিবর্তন করে সাময়িকভাবে সুন্দরী রমণীতে পরিবর্তিত হয়েছিলেন। শূর্পপনখার কন্ঠ ছিল অত্যন্ত কর্কশ। যে কারণে তাঁকে ’পিতলকণ্ঠী’ বলেও অভিহিত করা হয়। পিতলে ঘর্ষণ লাগলে যেমন ঝন্‌ঝন্‌ আওয়াজ হয়, শূর্পনখার কন্ঠস্বর ছিল তেমনি শ্রুতিবিদারক। তাঁর ভঙ্গিও ছিল অশালীন। আবার কণ্ব রামায়ণে শূর্পপনখাকে পরমাসুন্দরী রমণী বলে ব্যখ্যা করা হয়েছে।
জন্মের পর শূর্পনখার নাম হয়েছিল মীনাক্ষি (মীনের মতো অক্ষি যাহার)।
শূর্পনখার বিবাহ হয় দশবুদ্ধি, মতান্তরে দুষ্টুবুদ্ধি নামে একজন অসুরের সাথে। শূর্পনখা লঙ্কার রাজা রাবণের ভগিনী হওয়ার সুবাদে অসুর দশবুদ্ধি (অথবা দুষ্টুবুদ্ধি) প্রভূত ক্ষমতা ও সম্মানের অধিকারী হন। রাবণ ভগিনী ও জামাতা উভয়কেই সাদরে রাখেন। কিন্তু দুষ্টুবুদ্ধির ছিল ক্ষমতার লোভ এবং অত্যন্ত ক্রুর প্রকৃতির ছিলেন। ক্রমে রাবণের সঙ্গে যে সৌহার্দ্য ছিল তা নষ্ট হয় এবং রাবণ দুষ্টুবুদ্ধিকে হত্যা করেন। কথিত, শূর্পনখা গোপনে দানবরাজ কালকেয়র পুত্র বিদ্যুৎজিহবাকে বিবাহ করেন। দানব রাজ চিরকালই ছিলেন লঙ্কার রাজার শত্রু। লঙ্কার সঙ্গে দানবদের শত্রুতা ছিল চরমে। রাবণ এই বিবাহের কথা জানতে পেরে দানবদের সঙ্গে এক ভীষণ যুদ্ধে লিপ্ত হন। যুদ্ধে কালকেয় এবং তার পুত্র বিদ্যুৎজিহবা উভয়কেই রাবণ হত্যা করেন। শূর্পনখাকেও হত্যা করতে উদ্যত হলে স্ত্রী মন্দোদরী এবং ভ্রাতা বিভীষণের অনুরোধে নিরস্ত হন এবং শূর্পনখা প্রাণে বাঁচেন। মন্দোদরী শূর্পনখাকে নিজের পছন্দমতো স্বামী নির্বাচন করে সুখে শান্তিতে থাকার পরামর্শ দেন। সেইমত শূর্পনখা লঙ্কা ও দক্ষিণের নানান রাজ্যে দিন অতিবাহিত করতে থাকেন। মাঝে মাঝে খর ও দূষণ নামে দুই ভাইয়ের সাথে বনবাসও করতে থাকেন। এই বনবাস পর্বেই একদিন সূর্পনখা পঞ্চবটি বনে ভ্রমণে এলে রামের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় এবং পরবর্তী কাহিনি আমরা সকলেই জানি।

শূর্পনখার পরবর্তী জীবন সম্বন্ধে বিশেষ কিছুর উল্লেখ নেই। জৈন রামায়ণ এবং দক্ষিণ-পূর্বএশিয়া কাব্য ও পুতুলনাচে দেখা যায় শূর্পনখা একটি পুত্রসন্তানের জননী হয়েছিলেন। তার নাম শম্বুক। যদিও নিম্নসমাজের অন্তর্ভুক্ত শম্বুক বাল্মীকি রামায়ণে স্থান পায়নি। শম্বুক ঋষি হওয়ার বাসনা প্রকাশ করলে রামচন্দ্র তাকে হত্যা করেন।
আবার একথাও জানা যায় যে, লক্ষণ বনবাসের সময় ঘুরতে ঘুরতে একটি ভাসয়মান তলোয়ার দেখতে পান,যা দিয়ে তিনি বাঁশের অগ্রভাগ ছেদন করছিলেন। এবং এইভাবেই শম্বুকের মৃত্যু হয় লক্ষণের হাতে।
রাবণের মৃত্যুর পর বিভীষণ লঙ্কার রাজা হলে শূর্পনখা লঙ্কাতেই বসবাস করতে থাকেন। সেখানেই সমুদ্রে ডুবে তার মৃত্যু হয়। শূর্পনখা সম্বন্ধে আর কোন তথ্য পাওয়া যায় না।
রামায়ণে যে চরিত্রটির জন্য রাম-রাবণের বৈরিতার সূচনা এবং পরবর্তীকালে রাম-রাবণের যুদ্ধ পর্যন্ত হয়, সেই চরিত্রটি রামায়ণের মতো মহাকাব্যে এত কম প্রাধান্য পাওয়ার জন্য বিস্মিতবোধ করি।

No comments:

Post a Comment