সম্পাদকীয়







ভাষার সৃষ্টি কেন এবং কীভাবে? মার্কিনী ভাষাতাত্ত্বিক ড্যানিয়েল এভারেট তাঁর চাঞ্চল্যসৃষ্টিকারী গ্রন্থ 'হাউ ল্যাঙ্গুয়েজ বিগ্যান' (How language began)- এর প্রারম্ভে বর্ণনা করছেন একটি ঘটনা। তাঁর প্রপিতামহ সপরিবারে তুলোর ক্ষেতের মধ্য দিয়ে চার্চ থেকে ফিরছেন। টেক্সাসে সেসময় ওই অঞ্চলে সাপের খুব উপদ্রব। বিশেষত রাটলস্নেক। অকস্মাৎ মাটিতে পড়ে গেলেন তিনি। যে বিপদ সম্পর্কে সবাইকে সাবধান করছিলেন, তাঁকে আঘাত হেনেছে সেই অজানা আশঙ্কা। কিন্তু এমনই অদ্ভুত এই প্রাণী যে দংশনের আগে ঘোষণা করে তার উপস্থিতি। তবুও সেই সংকেত আক্রান্তের কাছে পৌঁছয়নি সময়মতো।

অথচ প্রায় ছত্রিশ হাজার বছর আগে আলতামিরার গুহামানব চারকোলের ছোঁয়ায় যখন সেই আশ্চর্য সুন্দর বাইসন অঙ্কনে মগ্ন, কথ্য ভাষার অনুপস্থিতি সত্ত্বেও সংযোগ স্থাপনের নির্দিষ্ট ইঙ্গিত ইথারে ভর করে রওনা দিয়েছিল সুদূর ভবিষ্যতের দিকে। সেদিন সেই শিল্পীর মধ্যে ভবিষ্যত প্রজন্মের সঙ্গে কোনও যোগাযোগের স্পৃহা কাজ করছিল কি? আমরা জানি না। কিন্তু ভাষার প্রয়োজনীয়তার সূত্রপাত কি এইভাবে নয়? বইটির শিরোনাম এমনও দাবী করে, ভাষাই হলো মানবসভ্যতার মহত্তম আবিষ্কার।

নিঃসন্দেহে। সভ্যতার বিবর্তনের ইতিহাস কি ভাষার ক্রমিক উত্তরণের দিনলিপি নয়? অবশ্যই। কারণ ভাষার এই সরণি জন্ম দেয় সার্বভৌমত্বের অধিকারের। ভাষার বুনিয়াদি জমিতে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর আত্মপ্রকাশ করে স্বাধীন এক রাষ্ট্র। তবু ভাষা কেন সন্ত্রাসের উপকরণ?

বিবিধের মাঝে মিলনের মন্ত্র অনুসন্ধানকারী এক দেশ যখন সদ্য স্বাধীনতার বর্ষপূর্তি উদযাপন করে, প্রশ্নগুলি চ্যালেঞ্জসঞ্চারী হয়ে দাঁড়ায় আমজনতার অজান্তেই। কারণ অনেক পথ পেরিয়ে ভাষা এখন আর শুধু যোগাযোগের মাধ্যম নেই, তা পীড়নের হাতিয়ারও। বর্বরতম অত্যাচারের চিহ্ন শরীরে নিয়ে একটি স্বপ্ন যখন অকালে ঝরে যায়, আমরা জানতে পারি সেই নৃশংসতার শুরু ভাষার হাত ধরেই। অধঃপতিত বিবর্তনের এই উত্তরাধিকার আমাদেরই।

সুস্থ থাকুন। সৃজনে থাকুন।

শুভেচ্ছা নিরন্তর!

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - দীপারুণ ভট্টাচার্য








মণিপুরে দুইজন কুকি উপজাতির মহিলাকে প্রকাশ্য দিবালোকে খোলা রাস্তায় মৈতৈ নামক অন্য এক উপজাতির একদল পুরুষ দ্বারা সম্পূর্ণ নগ্ন করে হাঁটানোর ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পরেই বিষয়টা নিয়ে মিডিয়াতে তোলপাড় শুরু হয়। এমন নয় যে এর আগে মণিপুরের হিংসা ও জাতী দাঙ্গার বিষয়টা মিডিয়ার জানা ছিল না। আমরা যাদের ন্যাশনাল মিডিয়া হিসাবে জানি, প্রতিটি রাজ্যে তাদের অফিস, কর্মী কিংবা সংবাদদাতা থাকেন। মিডিয়া হাউস গুলো মূলত তাদের থেকেই সংবাদ সংগ্রহ করেন এবং মানুষের সামনে নিয়ে আসেন। কাজেই এই প্রশ্ন উঠবেই যে মণিপুরের সংবাদদাতারা কি তাদের দিল্লি (নয়ডা) অফিসে কোন সংবাদ পাঠান নি? আর যদি পাঠিয়ে থাকেন তাহলে সেগুলো প্রচার করা হয় নি কেন? মনিপুরের সংবাদ না প্রচার করার জন্যে কি সংবাদ সংস্থা গুলোর উপর কোন চাপ ছিল? কারণ মনে রাখতে হবে যে ঘটনার কথা দিয়ে আমরা লেখা শুরু করেছি সেই ঘটনাটি ঘটেছিল মে মাসের চার তারিখে। এর ৬৪ দিন পর পুলিশের খাতায় প্রথম এফআইআর লেখা হয়। এবং ৭৯ দিন পর মণিপুর বিষয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রী প্রথম সংসদের বাইরে ত্রিশ সেকেন্ডের জন্যে মুখ খোলেন। এবং এরপরই জাতীয় মিডিয়ারা এই বিষয়ে কথা বলতে শুরু করে। তাহলে কি এটা ধরে নিতে হবে যে, যদি ভিডিওটা ভাইরাল না হত এবং সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি না হত তাহলে সরকার এই বিষয়ে মুখ খুলতেন না? আর সরকার মুখ না খুললে জাতীয় মিডিয়ারা বিষয়টা মানুষের সামনে আনতেন না? সরকারের মত না পাওয়া পর্যন্ত বড় বড় মিডিয়ার কার্যত এই চুপ করে থাকার বিষয়টা সম্ভবত মণিপুরের ঘটনার থেকেও ভারতবর্ষের নিরিখে আরও বড় ক্ষতির কারণ। যা আমরা রোজ মেনে নিয়েই চলেছি।

মণিপুরের ঘটনা মূলত শুরু হয়েছিল সেই রাজ্যের হাইকোর্টের এক রায়কে কেন্দ্র করে। বিষয়টা ছিল মৈতৈ উপজাতিকে তপশিলি জাতি ভুক্ত করা যাবে কি হবে না। কোর্ট বলেছিলেন, করা যাবে। (পরে উচ্চ আদালত রায়ের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে।) এই খবরে কুকি উপজাতির কিছু লোক মনে করেন তাদের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হবে। কারণ মণিপুরে মৈতৈ উপজাতিরাই সংখ্যা গরিষ্ঠ। কাজেই সংখ্যা গরিষ্ঠরা যদি সংরক্ষণ পেয়ে যায় তাহলে তাদের ভাগ্যে কিছুই জুটবে না। প্রসঙ্গত বলে রাখা উচিৎ যে মৈতৈ উপজাতিরা মূলত হিন্দু এবং কুকি উপজাতিরা মূলত খ্রিস্টান। যাই হোক, হাইকোর্টের এই রায় আসার পরেই চুরাচাঁদপুর জেলায় দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রথম সংঘর্ষ হয়। এবং পরে তা দ্রুত মণিপুরের অন্যান্য জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। মনে রাখা ভালো যে মণিপুরের প্রায় নব্বই শতাংশ অঞ্চল পাহাড়ি। এই পাহাড়ি অঞ্চলে কুকি ও নাগা উপজাতির বাস। বাকি দশ শতাংশ সমতলে বাস করেন সংখ্যা গরিষ্ঠ মৈতৈরা। কাজেই শুরু থেকেই বিষয়টাকে কুকিরা মৈতৈদের অঞ্চল দখলের লড়াই হিসাবে দেখতে শুরু করেন এবং ইটের বদলে পাটকেল মারতে শুরু করেন। এরপর যে ঘটনা ঘটে তা স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে একেবারে দুর্লভ। মণিপুরের রাজধানী ইম্ফলে পুলিশের একাধিক অস্ত্রাগার থেকে প্রায় পাঁচ-ছয় হাজার আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র সহ প্রচুর বুলেট লুট হয়। বলাই বাহুল্য ইম্ফল মৈতৈ অধ্যুষিত অঞ্চল এবং মণিপুর পুলিশের সিংহ ভাগ কর্মীরা মৈতৈ। কাজেই কুকিদের ধারণা হয়, এ অস্ত্রাগার লুণ্ঠন নয়, বরং উপহার। পুলিশ অস্ত্র গুলো মৈতৈদের উপহার হিসাবে দিয়েছে যাতে তারা সেগুলো দিয়ে কুকিদের খতম করতে পারে। কুকিদের এই ধারণা যে সম্পূর্ণ অমূলক এটা বলা কঠিন। কারণ সত্যি সত্যি পুলিশের অস্ত্রাগার লুণ্ঠন করতে কোন দল এলে তাদের সঙ্গে পুলিশের যে সংঘর্ষ হওয়ার কথা, তেমন কোন ঘটনার খবর এখনো পর্যন্ত জানা যায় নি। কাজেই কুকিদের এই দাবীতে সত্যতা আছে এমনটা ধরে নেওয়া যেতেই পারে। আর সেটা যদি ধরে নেওয়া হয় তবে এটাও ধরে নিতে হবে যে এই ঘটনায় সরকারের মদত ছিল। কারণ তা নাহলে পুলিশের বড় কর্তারা এতদিনে চাকরি খোয়াতেন! এমন খবর কিন্তু সামনে আসে নি। ঐ দুই কুকি মহিলা বলেছেন, পুলিশ নিজেই তাদের দুষ্কৃতিদের হাতে তুলে দিয়েছিল। কোন নিরপেক্ষ তদন্ত যদি কোনদিন এই ঘটনার সত্যাসত্য বিচার করে বিষয়টা মানুষের সামনে আনতে পারেন তাহলেই ঘটনায় সরকারের উদ্দেশ্য ও ভুমিকা সাধারণ ভারতবাসী বুঝতে পারবেন।

মৈতৈদের হাতে অস্ত্র এসেছে খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কুকিরাও পাহাড়ি অঞ্চলের অস্ত্রাগার ও থানা থেকে অস্ত্র লুট করে। এরও কোন তথ্য নিষ্ঠ খবর সংবাদ মাধ্যম প্রচার করে নি। কাজেই এটা জানার কোন উপায় নেই যে কোন দলের হাতে ঠিক কত পরিমাণ অস্ত্র আছে! তবে সাধারণ বুদ্ধিতে এইটুকু মনে হয় যে রাজধানী ও তার আশেপাশের অঞ্চলে যত আগ্নেয়াস্ত্র থাকে প্রত্যন্ত পাহাড়ি অঞ্চলে তার ভগ্নাংশও থাকে না। কাজেই মৈতৈদের হাতেই বেশি আগ্নেয়াস্ত্র আছে এটা ধরে নেওয়া যেতেই পারে। এই যুক্তির সঙ্গে আর একটি ঘটনাকে মিলিয়ে দেখলেই বিষয়টি আমাদের কাছে আরও পরিষ্কার হয়ে উঠবে। দিল্লিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর বাস ভবনের সামনে এবং ভারতের অন্যান্য জায়গায় যেখানেই মণিপুরের বিষয়ে প্রতিবাদ হয়েছে তা করেছেন কুকি উপজাতির লোকেরা। এর থেকে আমাদের ধরে নিতে হবে মূলত তারাই আক্রান্ত। যদি মৈতৈরাও একই পরিমাণে আক্রান্ত হতেন তাহলে নিশ্চয়ই একই রকমের প্রতিবাদ করতে তাদেরও দেখা যেত!

দুইজন কুকি মহিলাকে উলঙ্গ করে হাঁটানোটাই কিন্তু একমাত্র ঘটনা নয়। বরং বলা যেতে পারে এর কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া আরও নৃশংস একটি ঘটনা ইউটিউব নির্ভর কিছু ছোট সংবাদ সংস্থার খবরে উঠে এসেছিল। ঘটনাটি সাত কিংবা নয় বছরের এক কিশোরের। যার বাবা কুকি এবং মা মৈতৈ উপজাতির মহিলা। এই কিশোরের বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হলে সে আহত হয়। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্যে ডাকা হয় অ্যাম্বুলেন্স। হাসপাতালটি মৈতৈ এলাকার মধ্যে। কাজেই পরিবারের লোকেরা ঠিক করেন কুকি কিশোরের সঙ্গে অ্যাম্বুলেন্সে কোন কুকি মানুষ গেলে সমস্যা হতে পারে। বরং মৈতৈ মা তার ছেলেকে অ্যাম্বুলেন্স গাড়িতে করে হাসপাতালে নিয়ে গেলেই বিষয়টা নিরাপদ হবে। অথচ বিষয় হয় সম্পূর্ণ অন্য রকম। মা ও ছেলেকে অ্যাম্বুলেন্স গাড়ির মধ্যেই বন্ধ করে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। জীবন্ত পুড়ে মারা যায় অসহায় মা ও ছেলে। এই ঘটনা দুই কুকি মহিলার ঘটনার মত মানুষের মনে আগুন তৈরি করতে পারে নি। কারণ এর কোন ভিডিও ফুটেজ ভাইরাল হয় নি। হয়তো ভিডিও নেওয়াও হয় নি। আর হলেও সেটা ইন্টারনেটের অভাবে মণিপুরের বাইরে আসতে পারেনি। কারণ চুরাচাঁদপুরের প্রথম বড় হিংসা হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত মণিপুর ইন্টারনেট হীন অবস্থায় পড়ে আছে। (এ জন্যে মণিপুরের সাধারণ মানুষ কি কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে বেঁচে আছেন সেটা আশাকরি পাঠকরা অনুমান করতে পারছেন। এই একই ঘটনা বছরের পর বছর কাশ্মীরে হতে আমরা দেখেছি।) সম্ভবত ঐ দুই কুকি মহিলার ভিডিওটা যিনি রেকর্ড করেছিলেন তিনি কোন ভাবে সেটা মণিপুরের বাইরে পাঠাতে পেরেছিলেন। নইলে দেশের বৃহত্তর নাগরিকরা জানতেই পারতেন না মণিপুরে কি চলছে।

আর একটা বিষয় আমাদের ভেবে দেখতে হবে। ভিডিওটি সামনে আসার পর সংসদ ভবনের বাইরে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, মণিপুরের পাশাপাশি নারী নির্যাতনের ঘটনা আর যেখানে যেখানে হয়েছে যেমন রাজস্থান, পশ্চিমবঙ্গ ইত্যাদি সে গুলোও দেখতে হবে। এই কথায় তিনি যে মণিপুরের ঘটনাকে ছোট করেছেন তাই নয় বরং তার পার্টি ম্যান আর মিডিয়া সাথীদের কথা বলার একটা রূপ রেখা বেঁধে দিয়েছেন। যাতে প্রথম ধাক্কাতেই তারা পড়ে না যায়। এরপর দেশের সুপ্রিমকোর্ট মণিপুরের ঘটনার সঙ্গে অন্য রাজ্যের ঘটনাকে জুড়ে বিষয়টাকে তুচ্ছ করার চেষ্টাকে নিন্দা করার পরেও সরকার পক্ষ এবং তাদের মিডিয়ার সাথীরা কাজটি একই ভাবে করেই চলেছেন। অনেক সাধারণ মানুষ ভেবেছিলেন দেশের প্রথম মহিলা আদিবাসী রাষ্ট্রপতি এই ঘটনায় নীরব থাকতে পারবেন না। কিন্তু তিনি দেশের কোটি কোটি সাধারণ মানুষের ভাবনাকে মিথ্যা প্রমাণ করে দিয়েছেন। এরপর মানুষের প্রত্যাশা মত বিরোধীরা চেষ্টা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রীকে দিয়ে মণিপুর বিষয়ে সংসদের ভিতরে কিছু বলাতে। কিন্তু তাদের সেই চেষ্টাকে সরকার পক্ষ ব্যর্থ করে দিয়েছেন। কাজেই স্বাধীনতার পর দেশে ঘটে যাওয়া সব থেকে বড় জাতি দাঙ্গা বিষয়ে সংসদে কোন আলোচনা হয় নি। কারণ প্রধানমন্ত্রী তার সরকারের কোন ব্যর্থতা বিষয়ে সংসদে কথা বলতে চান না। তিনি চান না তার কোন কথা সংসদের রেকর্ডে থাকুক। যাতে আগামী দিনে তাকে কিংবা তার পার্টির দিকে কেউ আঙুল তুলতে না পারে। ফলে এক রকম বাধ্য হয়েই বিরোধীরা অনাস্থা প্রস্তাব এনেছিলেন। সেখানে সরকারের প্রধান যা বলেছেন তাতে শান্তির কোন আবেদন ছিল না। অবশ্য তিনি শান্তির আবেদন করতে চাইলে মণিপুর গিয়েও সেটা করতে পারতেন। মণিপুরের মোট জনসংখ্যার দুই শতাংশের বেশি মানুষ এখন উদ্বাস্তু শিবিরে রয়েছেন। তবুও রাজ্যের মানুষ দেশের প্রধানমন্ত্রীকে সামনে থেকে দেখতে পেলেন না! স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী একবার গেলেন। কিছুদিনের মধ্যে আবার যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েও, আর গেলেন না। সম্প্রতি স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে প্রধানমন্ত্রী সামান্য কিছু শব্দ ব্যয় করেছেন মণিপুর বিষয়ে। তিনি বলেছেন, মণিপুরে থেকে শান্তির খবর আসছে। তবে তার সরকারের কি কি ইতি বাচক পদক্ষেপের কারণে এটা সম্ভব হচ্ছে সেটা তিনি বলেন নি। অশান্তির কারণ বিষয়েও তিনি নীরব থেকেছেন।

মহিলাদের বিষয়ে দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর মানুষটির এই নীরবতা কিন্তু নতুন কোন ঘটনা নয়। কিছুদিন আগেই অলিম্পিক পদক জয়ী দেশের মহিলা খেলোয়াড়দের সঙ্গে এই সরকারের পুলিশ যে ব্যবহার করেছেন সেটা সবাই দেখেছেন। তারপরও তিনি যে শুধু নীরব থেকেছেন তাই নয়। অভিযুক্ত সাংসদকে ক্ষমতাচ্যুত করে কোন বার্তা দিতেও অস্বীকার করেছেন। দিল্লির রাস্তায় ধর্না দেওয়ার ফল স্বরূপ মহিলা খেলোয়াড়রা যেটা পেয়েছেন সেটা পুলিশের একটা এফআইআর এবং চার্জশিট ছাড়া আর কিছু নয়। আর একটু পিছিয়ে গেলে দেখা যাবে এই সরকারের জন্যেই বিলকিস বানোর ঘর্ষকরা আজ জেলের বাইরে। পাঠকরা জানেন ২০০২ সালে গোধরা-কাণ্ডের পর গুজরাটে ব্যাপক হিংসার ঘটনা ঘটে। ওই বছরের ৩রা মে দাহোড় জেলার দেবগড়ের একটি গ্রামে ভয়াবহ হামলা চালায় দুষ্কৃতীরা। গ্রামের বাসিন্দা বিলকিস বানো সহ তাঁর মা বোনকে গণধর্ষণ করা হয়। পরিবারে ১৪ জন সদস্য সহ মোট ১৭ জনকে খুন করে দুষ্কৃতীরা। ঘটনার তদন্ত শুরু করে সিবিআই। ২০০৮ সালের ২১ জুলাই মুম্বইয়ের বিশেষ সিবিআই আদালত অভিযুক্ত ১১ জনকে দুষ্কৃতীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে। বর্তমান গুজরাট সরকার এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের সুপারিশে সম্প্রতি মুক্তি পায় সেই ১১ জন দুষ্কৃতী। মুক্তির পর এই দুষ্কৃতীদের কিভাবে ক্ষমতাসীন পার্টির লোকেরা ফুল মালা দিয়ে স্বাগত জানিয়েছিলেন সেটা সংবাদ পত্রে কিংবা টিভি চ্যানেলে অনেকেই দেখেছেন। আর একটু পিছিয়ে গেলে বলা যেতে পারে সিদ্দিক কাপ্পানের ঘটনাটা। সিদ্দিক কাপ্পান হলেন কেরালার একজন সাংবাদিক। যিনি উত্তর প্রদেশ সরকারের দ্বারা বেআইনি কার্যকলাপ প্রতিরোধ আইনের অধীনে অভিযুক্ত হওয়া পরে ২০২০ সালের অক্টোবরে থেকে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত জেলে ছিলেন। সিদ্দিকের অপরাধ ছিল কেরালা থেকে উত্তর প্রদেশের হাতরাস গ্রামে যাওয়া। সে গিয়েছিল ১৯ বছরের এক দলিত মহিলার গণধর্ষণ ও হত্যার প্রতিবেদন লিখতে। যে চারজন উচ্চবর্ণের হিন্দু পুরুষ ঐ দলিত মহিলাকে ধর্ষণ ও হত্যা করে, পুলিশ তাদের আটক ও শাস্তির বিষয়ে কতটা তৎপর ছিলেন সেটা পাঠকরা একটু চেষ্টা করলেই মনে করতে পারবেন।

একের পর এক নারী নির্যাতনের এমন উদাহরণ আরও অনেক দেওয়া যেতে পারে। বুল-ডোজার বাড়ি ভাঙ্গতে এসেছে দেখে থানায় গিয়ে কোন সাহায্য না পেয়ে মা ও মেয়ে নিজেদের ঝুপড়ির মধ্যে ঢুকে তাতে আগুন জ্বালিয়ে আত্মহত্যার ঘটনাও উত্তর প্রদেশে সম্প্রতি ঘটেছে। উপরের কোন ঘটনার পরেই সরকারের কোন বড় মাথাকে কিছু বলতে শোনা যায় নি। এমনকি নির্যাতন কারিদের কোন দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি হতেও দেখা যায় নি। যে ঘটনা দিয়ে আমরা শুরু করেছিলাম সেই দুই কুকি মহিলার জঘন্য ঘটনার পরে কতজন গ্রেপ্তার হয়েছে এবং কতজনের শাস্তি হয়েছে আমরা এখনো জানি না। তবে যা জানা গেছে তা হল, যার মোবাইল ফোনে ভিডিওটা রেকর্ড করা হয়েছিল, সে গ্রেপ্তার হয়েছে। কর্তৃপক্ষ কি তার মধ্যমে বাকিদের ধরতে আগ্রহী নাকি তার মাধ্যমে এমন অন্যান্য ভিডিও কারিদের বার্তা দিতে আগ্রহী, সেটা আমাদের জানা নেই।

ইতিপূর্বে আমরা দেখেছি এমন ঘটনা ঘটলেই সরকার বিচলিত হয়ে পড়তেন। কারণ খবরের কাগজে এবং টিভি চ্যানেলে চলতে থাকতো এমন ঘটনার লাগাতার কভারেজ। দিল্লির নির্ভয়া কাণ্ডের সময় এমনটা আমরা হতে দেখেছি। সেজন্যেই বর্তমান সরকার চায় মিডিয়া চুপ করে থাকুক। কিংবা তাদের ইচ্ছানুসারে ছড়িয়ে দিক সাম্প্রদায়িক বিষ। ভেবে দেখুন, ২০০২ এর সময়ে তদানীন্তন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রীর বিবিসি’কে দেওয়া তাঁর সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেছিলেন যে, তাঁর মূল ব্যর্থতা তিনি মিডিয়াকে ম্যানেজ করতে পারেন নি! তবে কি সেই জন্যেই এখন মিডিয়াকে নির্মম ভাবে ম্যানেজ করা হচ্ছে? নাকি তিনি বুঝে গেছেন তাঁর মূল ভোটাররা তাকে উন্নয়ন বা সুরক্ষার নামে ভোট দেয় না। ভোট দেয় ধর্মান্ধতার নামে; হিন্দু রাষ্ট্রের নামে! আশ্চর্য জনক ভাবে নারী নির্যাতনের যে ঘটনা গুলো সামনে আসছে তার সিংহ ভাগই ঘটেছে অহিন্দু এবং দলিত নারীদের সঙ্গে। বিষয়টা নিয়ে আমাদের সকলকে ভাবতে হবে এবং যেটুকু আমাদের পক্ষে করা সম্ভব সেটা করতেই হবে। যেমন পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা, সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে আরও কিছু মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ, পত্র পত্রিকায় লেখা-লিখি কিংবা অন্য কিছু যা আপনি করতে পারবেন। আমাদের মনে রাখতে হবে ঐ দুইজন কুকি মহিলার মধ্যে একজনের স্বামী ভারতীয় সৈন্য বাহিনীর জওয়ান ছিলেন। যিনি কার্গিল যুদ্ধে দেশের হয়ে লড়েছিলেন। তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে এমন বর্বর ঘটনার পর তিনি বলেছেন, ‘আমি কার্গিলে দেশের রক্ষা করেছিলাম কিন্তু নিজের স্ত্রীকে রক্ষা করতে পারলাম না’। এই বিষয়ে এখনো নীরব বসে থাকলে এই আফসোস একদিন আমাদেরও করতে হতে পারে।

প্রবন্ধ - সৈকত মণ্ডল







বাল্মীকি রামায়ণে রাম ও সীতার বিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। মিথিলা জ্ঞান সাধনা সংস্কৃতির প্রানকেন্দ্র - "সাধু সাধ্বিতি শংসন্তো মিথিলাং সমপূজযন্"। অন্যদিকে অযোধ্যা হলো ধর্মের ও বীরত্বের সমৃদ্ধির রাজ্য। মিথিলার জ্ঞান আর অযোধ্যার ঐতিহ্য - এই দুয়ের মেলবন্ধন হলো আর্ষ রামায়ণের আর্য ভারতবর্ষের পূর্ণাঙ্গ প্রতিভা।

এই দুই প্রধান রাজ্যের মধ্যে ধর্মবন্ধন ঘটিয়েছিলেন ঋষি বিশ্বামিত্র। তিনি (ও পরে বশিষ্ঠ) চেয়েছিলেন ভারতের এই পূর্ণপ্রতিভা জাগ্রত হোক। তাই এই বিবাহবন্ধন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কোন বয়সে রাম ও সীতার বিয়ে হয় - এটি একটি রামায়ণের অন্যতম বিতর্কিত একটা বিষয়, যেটা ক্রিটিক্যাল এডিশন (সংক্ষেপে CE; রামায়ণের শুদ্ধ সংস্করণ) ও পর্যন্ত মীমাংসা করতে পারেনি, এত ভিন্ন পাণ্ডুলিপি পর্যবেক্ষণ করা সত্ত্বেও।

অরণ্যকাণ্ডে, প্রচলিত টেক্সটে (ভালগেট) যখন রাবণ সীতার কাছে সাধুবেশ ধারণ করে আসে, তখন সীতা বলছে (৪৭/৪):

উষিত্বা দ্বাদশ সমা ইক্ষ্বাকুণাং নিবেশনে৷
ভুঞ্জানা মানুষান্ভোগান্সর্বকামসমৃদ্ধিনী৷৷

"ইক্ষ্বাকুবংশীয় রাজভবনে বারো বছর বাস করে মনুষ্যোচিত মনোবাঞ্চিত ভোগ্যবিষয়সমূহ ভোগ করলাম..." (গীতা প্রেস অনুবাদ)

এখানে - "দ্বাদশ সমা" - মানে দুই ও দশ বছর। মানে ১২ বছর।

সীতা এটাও বলে: (৪৭/১০)

মম ভর্তামহাতেজা বযসা পঞ্চবিংশকঃ৷৷
অষ্টাদশ হি বর্ষাণি মম জন্মনি গণ্যতে৷

"বনবাস গমনকালে আমার মহাতেজস্বী পতির বয়স পঁচিশ বৎসর (ছিল) আর জন্মের সময় থেকে গণনা করলে আমার বয়স আঠারো।"

তেমনি সুন্দরকাণ্ডে যখন হনুমান সীতার সঙ্গে দেখা করতে আসে, বৈদেহী তাকে বলেন: (৩৩/১৭)

সমা দ্বাদশ তত্রাহং রাঘবস্য নিবেশনে৷৷
ভুঞ্জানা মানুষান্ভোগান্সর্বকামসমৃদ্ধিনী৷

এখানেও আমরা দেখি - "সমা দ্বাদশ" - মানে ১২ বৎসর।

"আমি অযোধ্যায় শ্রীরঘুনাথের অন্তঃপুরে দ্বাদশ বৎসর পর্যন্ত সর্বপ্রকার মানবীয় বিলাস ভোগ করতাম এবং আমার অভিলাষ সর্বদা পরিপূর্ণ হতো।"

এর থেকে এটা পরিষ্কার - যেটা আমাদের বাঙালি অনুবাদক ও অন্যান্য গবেষক রাও ভেবেছেন যেমন Sheldon Pollock - সীতার বয়স বিয়ের সময় ছয় বৎসর ছিল (১৮-১২= ৬).

রামায়ণে টীকা লেখার একটা দীর্ঘ চল ছিল। প্রাদেশিক টীকাকার (মূলত দক্ষিণী) গোষ্ঠী এটিকে সম্মতি দিয়েছে। এর দুটো প্রধান কারণ। ক্রিটিক্যাল এডিশন স্কলার দের মতে দক্ষিণে ধর্মীয় আবেগের ফলে বাল্মীকি রামায়ণের লিখিত টেক্সট খুব যত্ন সহকারে সংরক্ষিত হয়েছে। কবিরা / যারা কপি করেছেন কোনো ভাবেই টেক্সটকে পরিবর্তন হতে দেয়নি। হলেও সেগুলো খুবই সামান্য। দ্বিতীয়ত, এঁরা এই ধর্মীয় কারণেই টেক্সটকে ক্রিটিক্যাল (অর্থাৎ কোনটি সঠিক পাঠ হবে সেটির নির্ণয়) ভাবে দেখতে শেখেননি। অন্যদিকে উত্তর ভারতে (বিশেষ করে গৌড়, মৈথিলি, কাশ্মীর ও নেপাল) বাল্মীকি রামায়ণকে মূলত কাব্য হিসেবে দেখা দেখতো কবিরা। বিহার ও বারাণসী এই অঞ্চল গুলো ছিল সংস্কৃত চর্চার আখড়া। সেখানে তারা অনেকক্ষেত্রেই শুদ্ধ পাঠ বুঝতে পেরে পরিবর্তন করে ও লিখিত রূপে সেটি প্রবেশ করে খুবই প্রাচীন কাল, যেটি পরবর্তী সময়ে অগণিত বার কপি হয়েছে।

নাগেশ ভট্ট, যাঁর 'তিলক' টীকা খুব বিখ্যাত (ওঁর টেক্সটকে প্রচলিত টেক্সট / vulgate ধরা হয়) - তিনি শঙ্করাচার্য্যের অদ্বৈতবাদ দর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন। উনি লিখছেন তিলক টীকাতে:

"পঞ্চবিংশকঃ সাংখ্যসিদ্ধং পঞ্চবিংশং তত্ত্বং চৈতন্যং সো যমেব ৷ এতচ্চৈতন্যেনৈব জগদ্ব্যাপ্তং ন ততো ধিকং কিঞ্চিদস্তীতি সূচযিতুং তথোক্তিরিতি তত্ত্বম্1৷৷"

সরল অনুবাদ: "রামের বয়স ছিল ২৫ যখন তিনি অযোধ্যা ছেড়ে বনে যান। এর কারণ হিসেবে তিনি বলছেন ২৫ হলো সাংখ্য মতে "চৈতন্য পুরুষ"। যেটা স্বয়ং রাম। বালকান্ডতে রামকে বিষ্ণুর অবতার বলা হয়েছে। উনি তাই চৈতন্য পুরুষ, ওঁর মধ্যে সমস্ত বিশ্ব সমাহিত। তার উপর সত্য কিছু নেই। তিনিই জীবন শক্তি।

তেমনি বনবাস গমন কালে (রাবণকে যেটি বলছে, অর্থাৎ ১৮) সীতার বয়স সম্পর্কে তিলক টীকায় আছে:

"মমপঞ্চতন্মাত্রপঞ্চমহাভূতপঞ্চেন্দ্রিযাহঙ্কারবুদ্ধিমনোরূপাণ্যষ্টাদশ বর্ষাণি পর্বাণি জন্মনি কার্যে গণ্যন্ত ইতি তন্মূলীভূতা প্রকৃতিরহমিতি সূচিতম্"

১৮ গুন পঞ্চ তন্ত্র, পঞ্চ মহাভূত, পঞ্চ ইন্দ্রিয়, বুদ্ধি, রূপ ও মন সব কিছুর সমাহার। এটা প্রমান করে সীতাই প্রকৃতি। সীতাই হলো সাংখ্য তত্ত্বের আদিরুপ।"

তেমনি, যখন বিস্বামিত্র রামকে নিয়ে যেতে এসেছেন রাক্ষসদের উৎপাত থেকে ব্রাহ্মণ দের রক্ষা করার জন্য, তখন রাজা দশরথ বিশ্বামিত্র কে বলেছেন: (১/২০/০২)

ঊনষোডশবর্ষো মে রামো রাজীবলোচন:৷
ন যুদ্ধযোগ্যতামস্য পশ্যামি সহ রাক্ষসৈ:৷৷1.20.2৷৷

"আমার কমলনয়ন রামের বয়স এখনো ১৬ বছর হয়নি; সুতরাং রাক্ষসদের সঙ্গে তার যুদ্ধ করার যোগ্যতা আমি দেখছি না।"

এর অর্থ এমন হতেই পারে, রামের বয়স তখন ১৬ হয়নি, কিন্তু ১৬-এর আশেপাশে। তর্কের খাতিরে ধরা যেতে পারে ১৫-১৬ এর মধ্যে।

শিরোমনি টীকা অনুযায়ী - "বযসা পঞ্চবিংশক: পঞ্চবিংশেন যুক্তা: কা: ত্রযো যস্য স" - বনবাসে গমন কালে রামের বয়স ছিল- ২৫+৩ = ২৮.

এটা সীতার কথার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। যদি রামের বয়স ১৫ হয়, এবং সীতাকে যদি সে ১৬ বছর বয়সে বিয়ে করে, এবং ১২ বছর তারপর অযোধ্যায় থাকে, তাহলে বনবাস গমন কালে তার বয়স ২৮ হওয়াটাই স্বাভাবিক।

সীতা বলেছে সে - "অষ্টাদশ হি বর্ষাণি মম জন্মনি গণ্যতে" - তার মানে সে যখন অযোধ্যা ছেড়েছিল তখন তার বয়স ১৮।

এখানে কৌশল্যার বয়ান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অযোধ্যাকান্ডে রানী কৌশল্যা বলছে রামকে, যখন রাম সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছে সে বনে যাবে: (২/২০/৪৫)

দশ সপ্ত চ বর্ষাণি জাতস্য তব রাঘব!
অতিতানি প্রকাঙ্ক্ষন্ত্যা মযা দুঃখপরিক্ষযম্৷৷

"রঘুনন্দন! (আমার) দুঃখের পরিসমাপ্তির আশায় আশায়, তোমার দ্বিজত্ব প্রাপ্তির ১৭ বছর চলে গেল।"

এখানে "জাতস্য" শব্দটি একটা ইঙ্গিত দেয় রামের বয়সের ব্যাপারে।

দশরথ বলছে ঋষি বিশ্বামিত্রকে রামের বয়স ১৬ এর নিচে। ধরা যাক ১৫ বছর বয়সে রাম গিয়েছিল বিশ্বামিত্রের সঙ্গে ও তারপর ১৬ বছর বয়সে বিয়ে করেছে। সীতার বয়ান অনুযায়ী রাম ১২ বছর বিয়ের পর অযোধ্যায় ছিল, তারপর ১৩ বছরের মাথায় দশরথ তার রাজ্যভিষেক করার কথা ভাবেন। তাহলে কোনো ভাবেই রামের বয়স ১৭ হতে পারেনা অযোধ্যা ছাড়ার সময়।

জাতস্য মানে দ্বিতীয় জন্ম। এটাকে ধরা হয়েছে রামের উপনয়নের সময়কে। এটিকে দ্বিতীয় জন্ম ধরা হয়েছে। মনুস্মৃতি বলে উপনয়নের বয়স ১০-১১ বছরের মধ্যে হওয়া উচিত "একাদশে রাজ্যানম"।

সেটা ধরলে, রাম তখন ২৭-২৮ হবে যখন সে অযোধ্যা পরিত্যাগ করে।
---------


এবার আমরা দেখবো ক্রিটিক্যাল এডিশন বা রামায়ণের শুদ্ধ সংস্করণ ও এখান থেকেই শুরু হয় আসল বিতর্ক।

संवत्सरं चाध्युषिता राघवस्य निवेशने
भुञ्जाना मानुषान्भोगान्सर्वकामसमृद्धिनी।। (৩/৪৫/৪)

ক্রিটিক্যাল এডিশন এই শ্লোকটিতে কিছু পরিবর্তন করেছে। প্রচলিত টেক্সটে শ্লোকটি ছিল:

"উষিত্বা দ্বাদশ সমা ইক্ষ্বাকুণাং নিবেশনে৷"

কিন্তু শুদ্ধ সংস্করণ বলছে সীতা ১২ বছর নয়, বরং মাত্র এক বছর ছিল রামের গৃহে বনবাসের আগে।

এখানে MSS (ম্যানুষ্ক্রিপ্ট; পাণ্ডুলিপি) পাঠভেদ বোঝা দরকার।

N1 - একটি নেপালি পাণ্ডুলিপি (manuscript - ms), S1 - একটি সারদা ms, D 1-3 - 3টে দেবনাগরী mss, ও গোটা দক্ষিনের সমস্ত mss এ আছে ১২ বছর। এর মধ্যে N1 - নেপালি (উত্তর ভারতের) যেটা ১০২০ AD তে লিপিবদ্ধ হয়েছে সেটি রামায়ণের সবচেয়ে পুরানো লিপি, সেখানেও বলা আছে ১২ বছর। তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায় কেন ক্রিটিক্যাল এডিশন ওটাকে সরিয়ে দিল?

এখানে আরো একটা জিনিস খেয়াল করার ব্যাপার। ক্রিটিক্যাল এডিশন "ইক্ষ্বাকুণাং" শব্দের জায়গায় "রাঘবস্য" বলেছে।

ক্রিটিক্যাল এডিশন মোট ৪২টি MSS জোগাড় করে অরণ্যকান্ড স্টাডির ক্ষেত্রে। এর মধ্যে থেকে ওরা ২৯টি বেছে নেয় ক্রিটিক্যাল স্টাডির জন্য। অরণ্যকান্ডের এডিটর PC Divanji অসাধারণ যত্নের সঙ্গে এই কাজটি করেছেন।

নর্থ এর mss হল - বাংলা, মৈথিলি, সারদা, নেওয়ারী ও দেবনাগরী। এতে আছে মোট ১৪ খানা mss। সাউথে আছে তেলুগু, গ্রন্থ, মালায়লাম ও দেবনাগরী mss। ওটা মোট ১৫ mss নিয়ে গঠিত।

তাহলে যেটা পেলাম সেটা হলো ১৫টা mss + একটা নেপালি, একটা সারদা (কাশ্মীরি), 3টে দেবনাগরী = ২০/২৯ পাণ্ডুলিপিতে আছে সীতা ১২ বছর ছিল রামের বাড়িতে। মাত্র ৯টি - ২টি নেপালি, ১টি মৈথিলি, গোটা বাংলা ও ২টি দেবনাগরী - mss আছে সীতা এক বছর ছিল বিয়ের পর অযোধ্যায়।

প্রশ্ন ওঠে PC Divanji তাহলে কেন এরকম সিদ্ধান্ত নিলেন? ক্রিটিক্যাল এডিশন (CE) এর আদর্শ অনুযায়ী ১) দক্ষিণের লিপি বেশি প্রাধান্য পাবে, কারণ তাদের মতে এটাই আদিরূপের মূল রিডিং বহন করছে ২) যেখানে দক্ষিণ ও উত্তরের লিপির মধ্যে সংঘাত, সেখানে মূলত দক্ষিণ-ই প্রাধান্য পাবে। ৩) যদি কোনো একটি অংশ দক্ষিণে আছে অথচ উত্তর ভারতের পাণ্ডুলিপি একদমই সাক্ষ্য দেয় না, তখন ঐ শ্লোকগুলি বাদ যাবে। তাই ক্রিটিক্যাল এডিশন একপ্রকার নর্থের টেক্সটকে ব্যবহার করে দক্ষিনের প্রচলিত টেক্সটকে শুদ্ধ রূপ দিয়েছে, এটা বলা যায়।

ক্রিটিক্যাল এডিসন যারা নিরপেক্ষ ভাবে পাণ্ডুলিপি গবেষণা করছে তাদের উচিৎ ছিল ১২ বছর রেখে দেওয়া। কিন্তু Divanji লিখলেন -- এক বছর এই ঘটনার "context" এর সঙ্গে মিশে যায়।

তাহলে ক্রিটিক্যাল এডিসনের এর থিওরি অনেকটা এরকম দাঁড়াচ্ছে।

যখন বিশ্বামিত্র দশরথের কাছে যায়, তখন উনি বলেন রামের বয়স ১৬ হয়নি। ধরা যাক ১৫। রাম ১৬ তে বিয়ে করলো। বিয়ের পর এক বছর তারা অযোধ্যায় থাকলো। ১৭ বছর বয়সে অযোধ্যা ছেড়ে বনে গেল। এটা কৌশল্যার বয়ানের সঙ্গে মিলছে। যদি রাম ও সীতা ১২ বছর কাটায় ও সংসারের আনন্দ উপভোগ করে সেটা রামের মহৎ চরিত্রের সঙ্গে যায় না (রামায়ণ গবেষক কামিল বুল্কে ও এই মত পোষণ করেন) বা বলা ভালো বাকি রামায়ণে রামের যে বিস্তর কর্মকান্ড আমরা দেখি তার সঙ্গে সংসার ধর্ম পালন করে সুখে দিন কাটানো ঠিক যেন রামের চরিত্রের সঙ্গে যায়না। বুল্কে তাঁর গবেষণা মূলক বই - "রামকথা: উৎপত্তি ও বিকাশ" (pg 359) এ লিখেছেন এই ১২ বছর অযোধ্যায় থাকার বয়ানটি তাই প্রক্ষিপ্ত।

Divanji-র পরের যুক্তি এটাকে আরো পোক্ত করে।

সীতা রাবণকে বলছে ১৩ বছরের মাথায় রাজা ঠিক করেন রামের রাজ্য অভিষেক হবে। এবং সুন্দরকাণ্ডে (৫/৩৩/১৭-১৮) সীতা হনুমানকে একই কথা বলছে - যে তিনি ১২ বছর অযোধ্যায় ছিলেন, ও ১৩ বছরের মাথায় রামের অভিষেক হওয়ার কথা।

এখানেও সুন্দরকাণ্ডের critical apparatus বলছে N2 - V1 - B - D6-7 (৯ - ২টি নেপালি, ১টি মৈথিলি, গোটা বাংলা ও ২টি দেবনগরী) এগুলোতে বলা আছে সীতা এক বছর ছিল অযোধ্যায় বিয়ের পর এবং তার পরের বছর রামের অভিষেক হওয়ার কথা ছিল। নর্থের তিনটি প্রধান এডিশন - গোরেসিও ও কলকাতা এডিশন - এক বছর রেখেছে কিন্তু আশ্চর্য এটাই লাহোর এডিশন এই ক্ষেত্রে রামের রাজ্যাভিষেকের শ্লোকটা রাখেই নি।

তাহলে কী দাঁড়ালো? দক্ষিণের ও নর্থ ইস্ট এর পাণ্ডুলিপি ধরলে, রামের বয়স দাঁড়ায় ২৫ রাজ্যাভিষেক এর ঠিক আগে। তেমনি নর্থ ওয়েস্ট ধরলে ওটা ২৭।

বিয়ে ও রাজ্যাভিষেক এর মধ্যে সময়ের ব্যবধান যদি এক বছর হয়, তাহলে কোনো ভাবেই রামের বয়স ২৫-২৭ হতে পারেনা। CE মনে করে এটা পরে যোগ হয়েছে। এক্ষেত্রে সারদা ও নেপালি ২টো স্ক্রিপ্ট প্রাচীন হলেও CE এগুলোকে মান্যতা দেয়নি। কারণ বাল্মীকির লেখার স্টাইল থেকে সরে গিয়ে ২টো স্ক্রিপ্টেই ৩-লাইনে করে শ্লোকটি লিপিবব্ধ হয়েছে। তেমনি CE ওই শ্লোকটি উড়িয়ে দিয়েছে যেখানে সীতা বলে তার বয়স ছিল ১৮ যখন সে অযোধ্যা ছেড়ে বনে চলে আসে।

কিন্তু সমস্যা হলো সুন্দরকান্ডে গিয়ে।

তাহলে ক্রিটিক্যাল এডিশনের কী করা উচিত ছিল? সীতা হনুমানকে যেটা বলছে সেই বক্তব্যের সামঞ্জস্য রাখা উচিত ছিল অরণ্যকাণ্ডের সঙ্গে,অর্থাৎ তিনি এক বছর কাটিয়েছেন রাঘবের সাথে রাজমহলে।

সুন্দরকাণ্ডের এডিটর - GC Jhala - কিন্তু ১২ বছর-ই রেখেছেন। তাহলে কেন ক্রিটিক্যাল এডিশন এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারলো না?

Jhala ক্রিটিকাল নোটে এ লিখেছেন এখানে ১২ বছর রেখে দেওয়া হয়েছে CE এর যে methodology অর্থাৎ শ্লোক নির্বাচনের পদ্ধতি সেটার উপর নির্ভর করে। যখন এই সমস্যা CE এর জেনেরাল এডিটর GH Bhatt কে জানানো হয়, উনি এক বছর রেখে দেন অরণ্যকান্ডে। সমস্ত এভিডেন্স সাপোর্ট না করা সত্ত্বেও (কারণ যেটা আমি আগে লিখেছি) - উনি ও Divanji মনে করেছেন এটা "context" এর সঙ্গে যায় না।

আমি একটু গুছিয়ে সামারী করে দিই:

১) CE এখানে কৌশল্যার কথাকে গুরুত্ব দিচ্ছে, যে অভিষেকের সময় রামের বয়স ছিল ১৭। এখানে কিন্তু "জাতস্য" শব্দের অর্থ ও "context" তারা ধরলো না।

২) যদি রাম ১৫-১৬ বছর বয়সে বিশ্বামিত্রের সঙ্গে বনে যায়, অস্ত্র শিক্ষা লাভ করে ও তাড়কা রাক্ষসীকে বধ করে, নিশ্চই সেখান থেকে ৮ বছর লাগেনি তাদের মিথিলায় যেতে।

৩) CE এখানে ধরছে রামের বয়স ১৭-১৮ ছিল যখন সে বনে গিয়েছিল। আবার, কৌশল্যার কথাকে মান্যতা দিয়ে, সীতার কথাকে এখানে গ্রাহ্য করলো না। শ্লোকটি উড়িয়ে দেওয়া হলো। রামের দ্বিতীয় জন্ম - জাতস্য - এর কনসেপ্ট গ্রাহ্য করলো না, যদিও টেক্সটে পরিষ্কার উল্লেখ রয়েছে। অর্থাৎ CE টেক্সটে অরণ্যকাণ্ডে সীতা বলছে সে রামের বাড়িতে ১ বৎসর ছিল, অন্যদিকে সুন্দরকাণ্ডে আমরা দেখছি সে হনুমানকে বলছে ১২ বৎসর ছিল অযোধ্যায় বিয়ের পরে।

৪) বুল্কের মতে রামকে বিষ্ণুর অবতার বলা হয়েছে -- তাহলে ১২ বছর সময় কেন তিনি নষ্ট করবেন সুখে দিন কাটিয়ে?

৫) এখানে CE যেটা করেছে সেটাকে বলে higher criticism। অর্থাৎ টেক্সটের বাইরে গিয়ে নিজেদের বুদ্ধি কমন সেন্স কাজে লাগিয়েছে। সমস্যা হলো এটা সুন্দরকাণ্ডের ক্ষেত্রে তারা কেন করল না?
--------


আমাদের এখানে তাহলে কীভাবে টেক্সট দেখতে হবে?একটা সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ নিতে হবে। Holistic approach.

ভালগেট / প্রচলিত টেক্সট অনুসারে সীতার বয়স ৬ যখন তার বিয়ে হয়েছে। আমরা ক্রস-রেফারেন্স দেখবো, টেক্সটের মধ্যে।

বৈদিক যুগে, মহাভারতে ও সূত্রগুলিতে বলা হয়েছে একটি মেয়ের বিয়ের আদর্শ বয়স ১৬, বা যখন সে বয়‍‌ঃসন্ধি কাল প্রাপ্ত করে। বাল্য বিবাহের নিদর্শন পাওয়া যায় না।

রাজা জনক ঋষি বিশ্বামিত্রকে সীতার ব্যাপারে বলেছেন:

ভূতলাদুত্থিতাং তাং তু বর্ধমানাং মমাত্মজাম্৷ ১/৬৬/১২)

পরিষ্কার ভাবে উনি বলছেন সীতা "বৃদ্ধিপ্রাপ্ত" হয়েছে।


তিনি এটাও বলেন সীতাকে বীর্যশুল্কা ঘোষণা করার পর অনেক দেশ থেকে রাজারা আসেন ও ধনুক তুলতে ব্যর্থ হন। "হে মুনিপ্রবর! অতঃপর সৎবৎসরকালব্যাপী পীড়ন হেতু আমার সৈন্যাদিসহ যুদ্ধোপকরণ সকল সর্বতোভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত হলে আমি অত্যন্ত বিমর্ষ হয়ে পড়লাম।"

এটা ধরে নেওয়া অন্যায় যে ভারতবর্ষের সমস্ত রাজারা একটি ৩-৫ বছরের নাবালিকাকে পত্নী রূপে পাওয়ার জন্য মারপিট করছিলেন।

তেমনি সীতা ঋষিপত্নী অনসূয়াকে বলেন:

পতিসংযোগসুলভং বযো দৃষ্ট্বা তু মে পিতা৷ (২/১১৮/৩৪)

"কিছুকাল পরে পিতা আমার বিবাহের বয়স হয়েছে লক্ষ্য করে...চিন্তিত হলেন।"

পতিসংযোগসুলভং - যে বয়সে স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে পবিত্র মিলন সম্ভব - সেটা কি কোনোভাবে ৫-৬ বছর বয়সে হতে পারে?

তেমনি সীতা এটাও বলেছে:

সুদীর্ঘস্য তু কালস্য রাঘবোযং মহাদ্যুতিঃ৷
বিশ্বামিত্রেণ সহিতো যজ্ঞং দ্রষ্টুং সমাগতঃ৷৷ (২/১১৮/৪৪)

"সুদীর্ঘকাল পরে মহাদীপ্তিমান রামচন্দ্র সেই ধনুতে জ‍্যা-রোপন যজ্ঞ দর্শনের জন্য মহর্ষি বিস্বামিত্র ও লক্ষ্মণের সঙ্গে মিথিলায় এলেন।"

অর্থাৎ রামের মিথিলায় আগমন হয়েছে সুদীর্ঘকাল পরে। সীতা যে রামকে নিজের হৃদয়ে চিরতরে স্থান দিয়েছিলেন (১/৭৬/১৪) এবং বিয়ের পর সমস্ত দাম্পত্য সুখভোগ করেছেন, এটাই প্রমান করে তিনি নাবালিকা ছিলেন না। আমরা যদি বর্তমান প্রেক্ষাপটে নাও ভাবি, তাহলেও ৬ বৎসরের একটি কন্যা কাউকে নিজের শরীর ও মন দিয়ে ভালোবেসেছে, এটা মানতে বড়ই কষ্ট হয়।

তাহলে, অনেক সম্ভাবনা রয়েই যায়। বিয়ের সময় রামের বয়স ১৬ অথবা ২৪ হতে পারে, কিন্তু সীতার বয়স কোনোভাবেই ৬ বৎসর হওয়া সম্ভব নয়।


Reference:

[1] – Valmiki Ramayana – Hanumanta Rao
[2] – Valmiki Ramayana – Rajsekhar Basu
[3] – Valmiki Ramayana – Upendranatha Mukhopadhyay
[3] Valmiki Ramayana, Critical Edition – Volume 1,3,5
[4] Valmiki Ramayana with Tilaka commentary
[5] Valmiki Ramayana – Gita Press
[6] Manu Smriti – Sacred Text (online)
[7] Valmiki Ramayana, Lahore Edition
[8] Ramkatha – Camille Bulcke
[9] History of Dharmasastra – P.V. Kane
[10] The Riddle of the Ramayana – C.V. Vaidya





ReplyForward

প্রবন্ধ - অনিন্দিতা মণ্ডল







সময়টা ছিল অদ্ভুত! একদিকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের শোষণ। ধর্মীয় ও সামাজিক কৃষ্ণ গহ্বরে বাস করতে করতে মানুষ কেবল পাঁকে মজে চলেছে। অন্যদিকে এসব কিছুকে তোয়াক্কা না করে মানুষের জন্য দেশের জন্য অপার ভালোবাসা নিয়ে কিছু মানুষ দিনকে রাত করে পরিশ্রম করে চলেছেন। সম্বল তাঁদের মেধা মনীষা এবং মানবিকতা। একদিকে বিদেশী মিশনারির প্রচার - ভারতবর্ষ ভূত প্রেত আর সঙ্কীর্ণ ধর্মীয় সংস্কারে ঠাসা এক দেশ। অন্যদিকে কলকাতার নব্য ধর্মের বাবুদের, এদানির ব্রহ্মজ্ঞানীদের বিরুদ্ধ প্রচার। হিন্দু ধর্মের পৌত্তলিকতা, এ ধর্মের শতেক আচার বিচার আসলে সঙ্কীর্ণ এক ধর্মের পরিচয়। ব্রাহ্ম ধর্ম তখন মানুষের ধর্মান্তরকরণ ঠেকাতে এমনই একটি অবস্থান নিয়েছিল। আদি সমাজ তৎকালীন হিন্দু নেতাদের সঙ্গ প্রায় ত্যাগ করেছিল। নববিধানীরা কেশবচন্দ্র সেনের সঙ্গে দক্ষিণেশ্বরের সেই সরল মানুষটির প্রীতিপূর্ণ সম্পর্ক কে স্মরনে রেখে হিন্দু ধর্মের মধ্যে মহৎ দর্শনকে স্বীকার করেছিলেন। তবে সে তাৎক্ষণিক। এই সময় যারা নিজের সমাজ সংস্কৃতি ও ধর্ম সংস্কারের উদ্দেশ্যে জীবন পণ করেছিলেন, স্বামী বিবেকানন্দ তাঁদের অন্যতম। দেশের মানুষের চরম দারিদ্র, দুঃখ দুর্দশা, তাঁকে অহরহ কষ্ট দিত। সেই দুর্দশা নিবারণের জন্য তিনি তাঁর চরিত্রানুগ কর্মক্ষেত্র বেছে নিয়েছিলেন। তাঁর পারিবারিক দুর্ভাগ্য এর সঙ্গে মিলে গিয়ে তাঁকে অস্থির করে তুলেছিল। তিনি শান্তি পাচ্ছিলেন না। অথচ স্বভাবের কারণেই আধ্যাত্মিক চেতনা ছিল প্রবল। তাঁর শৈশব ও বাল্যের বহু কাহিনী আমরা জানি যা তাঁর সেই চেতনার পরিচায়ক। দিন কতক ব্রাহ্ম সমাজে ঘোরাঘুরি করেছিলেন। তারপর দেখলেন স্বয়ং কেশবচন্দ্র গিয়ে পরেছেন দক্ষিণেশ্বরের সেই পুরোহিতের কাছে। কেশবচন্দ্রের মতো জ্ঞানী গুনী বিদ্বান মানুষ কিসের আকর্ষণে গেলেন তাঁর কাছে? সম্ভবত এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই সেদিনের উনিশ বছরের তরুণ গিয়ে পড়েছিলেন তাঁর কাছে। বাকি ইতিহাস। এরপর ভারতের ধর্মজগতে আমরা উজ্জ্বল কতগুলি নক্ষত্রের বিচরণ দেখতে পাই। তা সত্ত্বেও দেশের মানুষের অপমান দুর্দশা ঘোচেনি।

শিকাগো ধর্ম মহাসভা বসেছিল আমেরিকায়। ব্রিটিশদের দেশে নয়। সেখানে ভারতীয়রা দাস বলে চিহ্নিত ছিলোনা। ফলে ধর্ম মহাসভায় যখন স্বামী বিবেকানন্দের জয়জয়কার হলো তখন ব্রিটিশ শাসিত ভারতের পত্রিকা গুলোতে সে সংবাদ কিঞ্চিত রেখে ঢেকে পরিবেশিত হয়েছিল। দাসেদের এই উত্থান তাদের চোখে বিষ ঠেকেছিল নিশ্চয়! স্বামিজীর ধর্ম মহাসভায় যোগদানের উল্লেখ তো ছিলোনা বললেই হয়। কেউ জানতেন না তিনি সেখানে যাচ্ছেন, এমনটি নিশ্চয় নয়! কিন্তু জয়ের খবর যখন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পরল তখন দেশের মানুষের আনন্দ দ্যাখে কে! আজ পর্যন্ত সাহেবদের থেকে দেশীয়দের সম্মান আদায় করতে কি পরিমাণ ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে সে সকলেরই জানা ১।কিন্তু এই প্রথম মানুষ দেখল যে স্বামিজী আত্মসম্মান বজায় রেখে কোনোরকম ত্যাগ স্বীকার না করেই কি বিপুল সম্মান আদায় করেছেন! তাদের মাথা উঁচু করেছেন। সারা প্রতীচ্য জানতে পেরেছে যে ভারতবাসী মাত্রই কিছু অসভ্য বর্বর নয়। তারাও উচ্চতর বিদ্যা ধর্ম ও দর্শনের অধিকারী। ধর্ম মহাসভার ভাষণ শেষে হল থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে এক শ্রোতা বলেছিলেন২ “এদের দেশে মিশনারীরা ধর্ম প্রচার করতে যায়? কেন? এরাই বরং এদেশে মিশনারী পাঠাক!” এই সম্মান এই শ্রদ্ধা স্বামী বিবেকানন্দের ভারতবাসীকে সর্বশ্রেষ্ঠ দান। এর আগে মানুষ মরমে মরে ছিল। মাথা উঁচু করে বাঁচতে তারা ভুলেছিল সেই চৈতন্য নিধনের সময় থেকে। হুজুরের গোলামি করতে করতে ভুলেছিল যে তারা কারোর ক্রীতদাস নয়। তারাও মানুষ। স্বামীজি এই দুঃখ তাঁর স্বদেশবাসীর জন্য বুকে বহন করে গিয়েছেন সারা জীবন। এই দুঃখ থেকেই তিনি তাঁর ব্যক্তিগত সুখ, ব্যাক্তিগত উন্নতি, এমনকি ব্যক্তিগত লক্ষ্যকেও গৌণ জ্ঞান করেছিলেন। এই ভালোবাসাই তাঁকে স্থির থাকতে দিতনা। নয়ত ত্যাগী সন্ন্যাসী স্বদেশে একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে মানুষের মঙ্গলে নিয়োজিত থাকবেন ভেবে বিদেশের পথে পথে বক্তৃতা দিয়ে অর্থ উপার্জনের কথা ভাবতে পারতেন? তাঁর শক্তি মূলত আধ্যাত্মিক। কিন্তু সে ক্ষেত্র সমষ্টির, ব্যষ্টির নয়। এইটি ফুটিয়ে তুলতে একটি উদাহরণ হাজির করা যাক। সবে বিলেত থেকে ফিরেছেন। ১৮৯৭ সালের ফেব্রুয়ারির শেষ। উঠেছেন কাশীপুরে গোপাললাল শীলের বাগানবাড়িতে। তাঁর প্রত্যাবর্তনের দিন স্টেশনে গিয়েছিলেন একটি তরুণ। নাম সুধীর চক্রবর্তী। সেই প্রথম সে স্বামিজীকে দেখেছে। এক অদ্ভুত আকর্ষণে সে হাজির হয়েছিল ওই বাগানবাড়িতে। সেখানে তখন উপস্থিত শরতচন্দ্র চক্রবর্তী। গুরুশিষ্যে আলাপ চলছে। সুধীর শুনছে। তার মনে একটি প্রশ্ন। কিন্তু সাহসে কুলোচ্ছে না স্বামিজীকে জিজ্ঞেস করে। অবশেষে শরতচন্দ্র সাহস জোগানোয় সে প্রশ্ন করল – “অবতার ও মুক্ত বা সিদ্ধপুরুষে পার্থক্য কি? এত ভয়। অথচ স্বামিজী কি অবলীলায়, কত ভালোবেসেই না এই তরুণকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর প্রাণের কথা, তাঁর লক্ষ্য! কি বলেছিলেন তিনি? বলেছিলেন – “বিদেহমুক্তিই যে সর্বোচ্চ অবস্থা, এ আমার সিদ্ধান্ত। তবে আমি সাধনাবস্থায় যখন ভারতের নানাদিকে ভ্রমণ করতুম, তখন কত গুহায় নির্জনে বসে কতকাল কাটিয়েছি, কতবার মুক্তিলাভ হলো না বলে প্রায়োপবেশন করে দেহত্যাগ করবার সঙ্কল্প করেছি, কত ধ্যান কত সাধন ভজন করেছি, কিন্তু এখন আর মুক্তিলাভের জন্য সে বিজাতীয় আগ্রহ নেই। এখন কেবল মনে হয়, যতদিন পর্যন্ত পৃথিবীর একটা লোকও অমুক্ত থাকছে ততদিন আমার নিজের মুক্তির কোনও প্রয়োজন নেই।” এই কথা কটি কি ভীষণ আবেগাপ্লুত হয়ে যে স্বামিজী বলেছিলেন তা ভাবলে বিস্ময় জাগে। আজকের স্বার্থপর লোভী পৃথিবীতে এই আবেগ বিলুপ্ত। তাই আমরা সারাক্ষণ ভাবতে থাকি, চরিত্রে ত্রুটি কোথায়, কোথায় তাঁর এতটুকু স্খলন। তবেই তাঁকে নিজের সঙ্গে সমান করে দেওয়া সম্ভব। অথচ সংসারত্যাগী সন্ন্যাসীর জগতের প্রতিটি মানুষের প্রতি কি অপার মায়া! তিনি একার মুক্তি চাননি। চেয়েছেন সারা জগতের মুক্তি। কখন? যখন ভারতবর্ষ দাসত্ব শৃঙ্খলে বদ্ধ হয়ে এক অপমানিত বন্দীদশা কাটাচ্ছে। মনুষ্যত্বের নিদারুন অপমানের জ্বালা বুকে বয়ে শত শত তরুণ যখন এ থেকে মুক্তির পথ খুঁজছে। সমসাময়িক বিপ্লবীদের জীবন আলোচনা করলে দেখা যাবে তাঁরা অধিকাংশ স্বামিজীর রচনা পড়ে তাঁর বানীতে আকৃষ্ট হয়ে দেশের স্বাধীনতার জন্য আন্দোলনে নামেন। স্বামিজীও মুক্তি চেয়েছিলেন, এঁরাও চেয়েছেন। এঁরা চেয়েছেন ব্যবহারিক মুক্তি। সম্মানের সঙ্গে বাঁচার স্বাধীনতা। আর স্বামিজী চেয়েছিলেন চেতনার মুক্তি। আধ্যাত্মিক মুক্তি। সেই তো প্রকৃত মুক্তি! কিন্তু এহেন মুক্তির সঙ্গে আত্মসম্মানের প্রশ্নটি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে। আর সে সম্মানের শুরু অন্নহীনের শ্রদ্ধার অন্ন পাওয়ার মধ্যে দিয়ে। নিরাশ্রয়ের আশ্রয় পাওয়ার মধ্যে দিয়ে। কারণ – খালিপেটে ধর্ম হয়না, একথা তাঁর পরমপুরুষটি বলে গিয়েছেন। ক্ষুধার্তকে ধর্মকথা শোনানো পাপ। মনুষ্যত্বের অপমান। তাঁর সেই পরমপুরুষের ভাব ছিল একান্ত নির্ভরতার। তিনি জানতেন জগতে যা কিছু ঘটছে তা সবই শক্তির খেলা। এই ঘটমান কালই কালী। সেখানে ‘গাছের পাতাটিও নড়ে তাঁর ইচ্ছেয়’। এই নির্ভরতা থেকে একরকমের নিষ্ক্রিয়তা আসে। কর্মবিমুখতা। বেশি কাজে না জড়ানো। ‘আমি খাই দাই আর থাকি। আর সব মা জানে’। এই যে জীবনের প্রবাহ, তা থেকে একটু সরে দাঁড়ানো। একটু দূরে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করা। এও এক ধরনের বোধ। যে বোধ থেকে তিনি বলেছিলেন – ‘সেবা যারা করে তারা অন্য থাকের লোক’। কারণ মনুষ্য জীবনের একটিই উদ্দেশ্য। তা হলো, ঈশ্বর দর্শন ও ঈশ্বর লাভ। তবে তাঁর প্রধান শিষ্যটি কি আদর্শচ্যুত হলেন? এ বড় জটিল প্রশ্ন। এখানে কিছুটা প্রকৃতির কথা আসে। স্বামিজীর প্রকৃতি তাঁকে এই কল্যাণ কর্মে জড়িয়েছে। ‘তাঁর ইচ্ছে’। এই প্রকৃতি থেকেই স্বামিজী তাঁর শিষ্য বিরজানন্দকে বলছেন – দ্যাখ, যদি নিজের মুক্তি খুঁজিস তো জাহান্নামে যাবি, আর অপরের মুক্তির জন্য যদি কাজ করিস তো এখনই মুক্ত হয়ে যাবি ৩। সেই পরমপুরুষের অসাধারণ স্থৈর্য তাঁকে স্থিতিশক্তি জুগিয়েছিল। আর স্বামিজীর অস্বাভাবিক তেজ, তাঁর শক্তি, তাঁকে স্থির হতে দেয়নি। এর ফল যে সবসময় ভালো হতো তা নয়। তাঁর কোনও কোনও গুরুভাই মনে করেছিলেন তাঁদের গুরুর আদর্শে তাঁরা সাধন ভজন করেই দিন কাটিয়ে দেবেন। অন্তর্মুখ সন্ন্যাসীমণ্ডলী পরে শুধু স্বামিজীর কারণেই কি বিশাল কর্মযজ্ঞে নিজেদের নিযুক্ত করেছেন ভাবলে অবাক হতে হয়। গুরু নয়, গুরুভ্রাতার প্রতি সন্দেহাতীত আনুগত্য। সোজা কথা? ঈশ্বর দর্শনই যখন উদ্দেশ্য তখন জাগতিক সব যোগ ছিন্ন হোক, এই ছিল তাঁদের মনের কথা। স্বামিজী যখন বিদেশে, চিঠিপত্র, সংবাদে জানা যাচ্ছে তাঁর বক্তৃতার অংশবিশেষ। তাঁর খ্যাতি ও প্রাপ্তির কথা। এর ফলে শ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্ঘের অন্যতম প্রধান সন্ন্যাসী স্বামী প্রেমানন্দ ক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন খুব ৪। এক চরম হতাশা তাঁকে পেয়ে বসেছিল। এর আগে স্বামিজী একবার পওহারী বাবার কাছে দীক্ষা নেবার জন্য ব্যাকুল হয়েছিলেন। পুনরায় ফিরে আসেন এখানে। কারণ – ‘তাঁর গুরুর জুড়ি নেই’। সেই থেকে বাবুরাম মহারাজের মনে সন্দেহ ছিল তাঁকে নিয়ে। বিদেশের খবরে স্বভাবতই বিচলিত হয়ে তিনি মনে করেছিলেন নরেন্দ্রনাথ তবে ব্যক্তিগত খ্যাতি ও উচ্চাশার জন্যই এত কাঠখড় পুড়িয়েছেন। গুরুর নাম কোথাও নেই কেন? হয়ত পরে নিজের সঙ্গে নিজেই আপোস করেছেন বাবুরাম মহারাজ। পরবর্তীতে দেখা যায় তিনি শান্ত হয়েছিলেন। কারণ নরেনের পত্রে উল্লেখ আছে – এখানে কেউ মুষ্টিভিক্ষা দেয়না। এখানে বক্তৃতায় পয়সা পাওয়া যায়। গুরুর নাম করলে পাছে লোকে তাঁকে হেয় করে, তাই আগে নিজের পায়ের তলার মাটি শক্ত করতে হচ্ছে। এ থেকে অনুভব করা যায় যে বিশ্বখ্যাত স্বামীজিকেও কিছু বিরোধিতার মধ্যে পড়তে হয়েছিল। শর্তহীন আনুগত্য তিনিও প্রথমে পাননি। এইখানেই সমকালের সীমাবদ্ধতা। কেশবচন্দ্র সেনের প্রচারের পরে একমাত্র স্বামী বিবেকানন্দর খ্যাতিতেই সারা বিশ্ব শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসর কথা জানতে পারল।

বিদেশ যাত্রা প্রাক্কালে স্বামীজি একটি স্বপ্ন দেখেছিলেন। দেখেছিলেন তাঁর গুরু তাঁকে বিস্তীর্ণ সাগরের ওপারে হাতছানি দিয়ে ডাকছেন। তিনি এর অর্থ করেছিলেন – তিনি তাঁকে বিদেশ যাত্রায় ডাকছেন। ধর্ম মহাসভায় যোগ দিতে বলছেন। সে সময় তাঁর অশান্ত মনে দেশের সম্মানের জন্য, সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠার জন্য যে আকুলিবিকুলি সেটিই তাঁকে বিচলিত করেছিল। তিনি স্বপ্নের এই অর্থ করেছিলেন। কিন্তু আমাদের মতো সাধারণ মানুষের মনে একটিই অর্থ ভাসে। সেটি হলো – মামনুসর। আমাকে, আমার আদর্শকে অনুসরণ করো। যা আমরা বুঝেছি, তা স্বামীজির মতো মানুষ উপলব্ধি করেননি এ ভাবা নির্বুদ্ধিতা। তবে তিনি নিজের অন্তরের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলেন না কেন? এমন দ্বিধায় কেন পরলেন? আসলে তাঁর প্রকৃতি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। কোনও একটি মহৎ কর্মে জড়াতে না পারলে শান্তি হতো না তাঁর।

এ শুধু একটি দিক। যেদিকটিতে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন বিশ্বচেতনা সমগ্র জগতে ছড়িয়ে। আর একটি দিক থেকে তিনি কখনও কখনও সেই পরমপুরুষের ভাবে র’সে থাকতেন। আলমোড়াতে হিমালয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে শ্রান্ত সন্ন্যাসী কখনও বলতেন – জীবনের কটা দিন এরকম নির্জনে ভগবৎ আরাধনায় অতিবাহিত করতে চাই। এই আমার শেষ ইচ্ছা। কিন্তু এ আর ঘটে ওঠেনি। ঈশরোপলব্ধির চরম কথাটি বলতে গিয়ে বলেছেন – Being one with divinity, there cannot be any further progress in that sense. তাঁর কাছে Divinity হলো এই অনন্ত জনসমুদ্র। তার সাথে এক হওয়া। এই একত্ববোধই, এই point of unionই তাঁর আজীবনের আরাধ্য ছিল। এই একত্ববোধ থেকেই তিনি জাতিভেদকে ঘৃণা করেছেন। শ্রেনীভেদকে ঘৃণা করেছেন। আমরা স্বামীজির শত ভুল খাড়া করতে পারি, তাঁকে হাজার অভিযোগে অভিযুক্ত করতে পারি, কিন্তু মানবপ্রেমিক এই সন্ন্যাসীর মতো করে মানুষকে ভালোবাসতে পারবনা। সেই ক্ষমতা যদি কেউ অর্জন করেন তবেই তাঁর পক্ষে স্বামীজির কাজের পর্যালোচনা সম্ভব। তাঁর উপলব্ধির সেই কথাটি – ত্বং জাতো ভবসি বিশ্বতোমুখঃ, তুমিই এ বিশ্বের প্রতিটি মানুষ, আপাতত এই উপলব্ধিতে উত্তীর্ণ হবার প্রয়াস করি বরং।



তথ্য সূত্র

১) শঙ্করীপ্রসাদ বসু, বিবেকানন্দ ও সমকালীন ভারতবর্ষ, প্রথম খণ্ড, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৯৭৭, মণ্ডল বুক হাউস।
২) তদেব
৩) স্বামী অব্জজানন্দ, স্বামিজীর পদপ্রান্তে, ১৯৮৩, রামকৃষ্ণ মিশন সারদাপীঠ, বেলুড় মঠ।
৪) মহেন্দ্রনাথ দত্ত,শ্রীমৎ বিবেকানন্দ স্বামীজীর জীবনের ঘটনাবলী, দ্বিতীয় খণ্ড, চতুর্থ সংস্করণ, ১৯৭৪


অতিরিক্ত পাঠ

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত, শ্রীম কথিত।

[ঋতবাক মুদ্রিত ২০১৮]

প্রবন্ধ - অরিন্দম ব্যানার্জী





















(১)


মধ্য ইউরোপের ড্যানিউব নদীর তীরে এক জ্যোৎস্নাময়ী রাত্রি। মশাল আলোকিত সেনাছাউনিতে বনফায়ারের পাশে উদ্দাম নাচাগানা হচ্ছে । রোমান সেনানায়কেরা কুয়াদিদের বিরুদ্ধে তাঁদের কষ্টার্জিত জয়ের উপলক্ষে উৎসব করছেন। অবাধ খানাপিনা, রাজনর্তকীদের লাস্যময়ী নৃত্য, হাসিঠাট্টা, আরো কত কি! মৌন গম্ভীর ব্ল্যাক ফরেস্টের প্রান্তে উদযাপনের নানা শব্দ, ক্লান্ত ঘোড়াদের হ্রেস্বাধ্বনির সাথে মিশে এক রহস্যময় পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। কিন্তু এই এতো শব্দময় আয়োজনের মধ্যেও একটি অপেক্ষাকৃত বড় তাঁবুতে যেন এসব কোনকিছুরই স্পর্শ লাগেনি। তাঁবুটির ভেতরের আলোআঁধারিতে দেখা যাচ্ছে এক মধ্যবয়সী রাজপুরুষ খাটের ওপর বালিশে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে বসে তাঁর কোলের ওপর রাখা একটি প্যাপিরাসের দিস্তার ওপর ঝুঁকে পড়ে আত্মমগ্ন হয়ে কি যেন লিখছেন। তাঁর তাঁবুর মধ্যে বিরাজ করছে একটি ধ্যানপূর্ণ প্রশান্তি, অব্যবহিত দূরের অত কোলাহলেও যা ভঙ্গ হচ্ছে না।

হঠাৎ মানুষটি উঠে দাড়ালেন, কাগজের দিস্তাটা হাতে নিয়ে তাঁবুর মধ্যেই পায়চারি করতে করতে পড়তে লাগলেন, "আমি, মার্কস অরেলিয়াস সিজার, আমার পিতামহ ভেরাসের কাছ থেকে শিখেছি মূল্যবোধ। আমার পিতা অ্যানিয়াসের থেকে পেয়েছি বিনয় এবং দৃঢ়তা। আমার মা লুসিলার থেকে পবিত্রতা এবং সংযম। আমি ভাগ্যবান যে মূল্যহীন বাকচাতুরী কিম্বা কুটিল গুহ্যবিদ্যার কবলে কখনও পড়িনি। আমি ধন্য যে চিরকাল আমি উচ্চতর দর্শনের আশ্রয় পেয়ে এসেছি।" বহির্জগতের উন্মত্ত হট্টগোলের মধ্যে তিনি যেন একাগ্রতার একাকী ওয়েসিসে বিরাজ করছেন। মুহূর্তেক থেমে তিনি আবার পাঠ শুরু করলেন, "মার্কস, তুমি প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে ভেবো যে আজকে তোমার সাথে যাদের দেখা হবে তারা বেশিরভাগই হয়তো কৃতঘ্ন, চতুর এবং রূঢ় হবে। তারা ঐরকম কারণ তারা এখনও সত্যসুন্দরের খোঁজ পায়নি, ভালমন্দের তফাৎও বোঝেনি। কিন্তু তুমি তো ওরকম নও! তুমি তো সুন্দর-অসুন্দর, ভালমন্দকে ঠিক ঠিক চিনেছ। তাই তুমি ওদের কখনও ঘৃণা করো না, বরং আপন ভ্রাতাজ্ঞানে ভালোবেসো।" অকস্মাৎ প্রহরীর ডাকে তাঁর ধ্যানভঙ্গ হল। "সম্রাট, জরুরি কথা আছে। উত্তরপূর্ব সীমান্ত থেকে খারাপ খবর এসেছে।"

— "কি হল আবার?" কিঞ্চিৎ বিরক্তকণ্ঠে প্রশ্ন করলেন অরেলিয়াস।

— "বর্বর সার্মেশিয়ানরা থীস নদী পার করে ঢুকে এসেছে। তাদের সঙ্গে ভ্যান্ডলরাও যোগ দিয়েছে। তাদের সাথে প্রচুর সৈন্য রয়েছে। দক্ষিণ গার্মেনিয়ার সামন্তরা বিনাযুদ্ধে আত্নসমর্পণ করেছে।"

— "কিন্তু পূর্বের লাইম ওরা ডিঙলো কি করে? ওই প্রাচীর তো অভেদ্য!"

— "জানিনা সম্রাট, তবে মনে হচ্ছে আমাদের মধ্যেই কোন বিশ্বাসঘাতক রয়েছে। না হলে ওই বর্বরদের পক্ষে দুর্লঙ্ঘ্য লাইম টপকানো কিছুতেই সম্ভব হত না।" মার্কস কিছুক্ষণ একদৃষ্টে মশালের আগুনের দিকে চেয়ে রইলেন। তারপর আদেশের সুরে বললেন, "ম্যাক্সিমাসকে বল, আপাতত আসর গোটানোর সময় এসেছে। কাল সূর্য ওঠার আগেই আমরা পুবমুখে রওনা দিচ্ছি।"

সালটা ১৬৬ খ্রিষ্টাব্দের আশেপাশে। রোমান সম্রাট এবং স্টোইক দার্শনিক মার্কস অরেলিয়াসের রাজত্বকাল। প্যাক্স রোমানা বা রোমক শান্তিযুগের শেষ সম্রাট তিনি। তাঁর জন্ম ১২১ খ্রিষ্টাব্দে, কুখ্যাত পম্পেই শহরে ভিসুভিয়াসের ছাই তখন সদ্যই ঠান্ডা হয়েছে। শৈশবে পিতাকে হারানোয় পিতামহ ভেরাসের কাছে মানুষ হয়েছিলেন তিনি। ভেরাস ছিলেন রাজপুরুষ, নাতি মার্কসকে রাজবংশীয় আদব কায়দাতেই বড় করেছিলেন। ১৩৮ খ্রিষ্টাব্দে মার্কসের কাকা অ্যান্টনিনস্ পিয়স্ রোমান সম্রাট হিসেবে অভিষিক্ত হন। অ্যান্টনিনস অপুত্রক হওয়ায় ভাইপো মার্কসকে দত্তক নিলেন এবং তাঁকেই যুবরাজ ঘোষণা করলেন। শৈশব থেকেই নীতিনিষ্ঠ এবং সত্যবাদী মার্কস ১৬১ খ্রিষ্টাব্দে অ্যান্টনিনসের মৃত্যুর পর রাজসিংহাসনে আসীন হলেন যদিও প্রথমে এতে তার সম্মতি ছিল না। সিংহাসনের প্রতি তাঁর বরং একপ্রকার আতঙ্ক ছিল, পাছে তিনি ক্ষমতার মায়ায় আবদ্ধ হয়ে পড়েন! তিনি চেয়েছিলেন উদাসীন ঋষির মত জীবন কাটাতে কিন্তু স্টোইক কর্তব্যবোধ এবং অন্যদের নির্বন্ধাতিশয্যে তিনি অবশেষে রাজি হয়েছিলেন। তবে সবাইকে অবাক করে দিয়ে তাঁর ন্যায্য সিংহাসন অ্যান্টনিনসের আরেক দত্তকপুত্র লুশিয়াসের সাথে তিনি ভাগ করে নিলেন, বলা বাহুল্য, লুশিয়াসের সঙ্গে তাঁর কোন রক্তের সম্পর্কই ছিল না। যেখানে রাজত্বের লোভে ভাইয়ে ভাইয়ে মারামারিই চিরকালের দস্তুর, সেখানে মার্কস সেচ্ছায় তাঁর পাতানো ভাইকে অর্ধেক ক্ষমতা দান করলেন। রোমের ইতিহাসে প্রথমবার একই সিংহাসনে দু'জন সম্রাট আরুঢ় হলেন। সেটা ছিল এমন একটা সময় যখন রোমান সাম্রাজ্য ভিতরে-বাইরের অশান্তিতে জেরবার হচ্ছিল। একদিকে অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ এবং অন্তর্কলহ, অন্যদিকে বর্বর গার্মেনিক উপজাতিদের নানা দিক থেকে আক্রমণ — মার্কস পেলেন একটা টলমলে সিংহাসন এবং অস্থির বিপর্যস্ত একটি সাম্রাজ্য। অবশ্য মার্কস-লুশিয়াসের এই যৌথ রাজত্ব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৬৯ খ্রিষ্টাব্দে মারকোম্যানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ফেরার পথেই লুশিয়াস জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এরপর থেকে মার্কসকে একাই বিরাট রোমক সাম্রাজ্য সামলাতে হয় এবং তাঁর গোটা শাসনকাল জুড়েই একের পর এক বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হয়।

আগেই বলেছি, অরেলিয়াস ছিলেন স্টোইক দর্শনে বিশ্বাসী এক রাজর্ষি। কৈশোরে দায়োগ্নিতাস এবং পরে সেযুগের নামকরা দার্শনিক অ্যাপোলোনিয়াস ও রাস্টিকাসের কাছে তিনি স্টোইক দর্শনে শিক্ষা পান। মার্কসের মন ছিল স্বভাবত অন্তর্মুখী। বাহ্যজগতের কর্মকাণ্ডের চাইতে দর্শনচিন্তার ধ্যানমগ্নতাই তাঁকে আকর্ষণ করতো বেশি। কিন্তু তাঁর ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ জীবন তাঁকে মধুর নিভৃতিতে দর্শনচর্চা করার সুযোগ দেয়নি, বরং বারংবারই নিক্ষেপ করেছে সুদীর্ঘ রণকলাহলের মাঝে কিম্বা ভয়ঙ্কর মহামারীর দেশব্যাপী প্রলয়ের মধ্যিখানে। তাঁকে দীর্ঘদিন দূরে থাকতে হয়েছে তাঁর প্রিয় পড়ার ঘরটি থেকে। কিন্তু সারা জীবন ধরে প্রতিটা ঝড়ই আরেলিয়াস সামলেছেন অনড় এক স্টোইক দৃঢ়তায়। শুরু থেকেই এসেছে বিপত্তি। যে-বছর মার্কস এবং লুশিয়াস সিংহাসনে বসলেন, সেই বছরের শেষেই টায়বার নদী দু'কুল ছাপিয়ে এক ভীষণ বন্যায় রোমকে প্রায় ভাসিয়ে দিল। বিপুল পরিমাণ খাদ্যশস্য নষ্ট হয়ে গেল। দুই ভাই মিলে ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানে সেই দুর্যোগ কোনক্রমে সামলেছেন, অমনি খবর এলো পূর্বদিক দিয়ে পার্থিয়ান সেনা আর্মেনিয়ায় ঢুকে পড়েছে। আর্মেনিয়া ছিল রোমের প্রতিবেশী বন্ধু দেশ। দুঁদে সেনাপতি এবং অনেক যুদ্ধের বিজয়ী বীর সিভিরিয়ারনস্ ছুটলেন সীমান্ত রক্ষা করতে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, অসংখ্য যুদ্ধে রোমের বিজয় পতাকা উড়িয়েছেন যে নায়ক, তিনি আরেক বিখ্যাত সেনাপতি পার্থিয়ার কসেরোজের চক্রব্যূহে পড়ে প্রাণত্যাগ করলেন। অরেলিয়াস দুশ্চিন্তায় পড়লেন। শেষমেষ লুশিয়াস নিজেই রওনা দিলেন যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে। এদিকে ব্রিটানিয়া এবং উত্তর গার্মেনিয়া থেকে দুর্ধর্ষ চ্যাটি-রা লাইম টপকে রোমের সীমানায় ঢুকে এলো। একসাথে অনেকগুলি রণমঞ্চ খুলে গেলো। প্রায় কাছাকাছি সময়ে গ্রীসের দিক থেকে আক্রমণ করলো কস্টোবোসাই জনগোষ্ঠীর ভয়ঙ্কর যোদ্ধার দল। রোমের সীমান্তে ঢোকার আগে তারা ব্যালকান অঞ্চলে তাণ্ডব চালালো। অরেলিয়াস এদেরও জবাব দিলেন। কঠিন যুদ্ধের পর চ্যাটি এবং কস্টোবোসাই হানাদাররা পিছু হটতে বাধ্য হল। এরই মধ্যে পার্থিয়ার যুদ্ধ জিতে প্রত্যাবর্তনের পথে রোমান সৈন্য এক ভয়াল বিপদকে সঙ্গে করে নিয়ে এলো — অ্যান্টয়েন প্লেগ। এই প্লেগ সেযুগের অর্ধেক পৃথিবী জুড়ে এক ভয়ংকর অতিমারির রূপ নিয়েছিল, নিভিয়ে দিয়েছিল অসংখ্য জীবনদীপ । এর প্রকোপ রোমের মত সর্বশক্তিমান সাম্রাজ্যকেও অর্থনৈতিক এবং সামরিকভাবে নাড়িয়ে দিয়েছিল। যুদ্ধ এবং মহামারীর কারণে রোমের কোষাগার তলানিতে ঠেকলো। সম্রাট অরেলিয়াস নির্দ্বিধায় রাজকোষের মণিমাণিক্য বিক্রি করে দিলেন। রোম তখনকার মত রক্ষা পেল।

কিন্তু এইসব ভয়ানক প্রতিকূলতার মধ্যে সবচেয়ে দুরূহ ছিল ভয়াবহ মারকম্যানিয় সংঘর্ষ — গার্মেনিক বর্বরদের সাথে দীর্ঘায়িত এক প্রচণ্ড যুদ্ধ। এই বহুবর্ষব্যাপী যুদ্ধই অরেলিয়াসের জীবনীশক্তি একেবারে শুষে নিয়েছিল। ১৬৬ খ্রিষ্টাব্দে ড্যানিউব নদী পার করে কুয়াদি উপজাতিদের শক্তিশালী বাহিনী রোমের দিকে পা বাড়ালো। অরেলিয়াস জানতেন তাদের উত্তরসীমান্তে না থামালে রোমের রক্ষে নেই। তিনি ছুটলেন ড্যানিউবের উদ্দেশে। দীর্ঘ এবং ক্লান্তিকর লড়াইয়ের শেষে কুয়াদিরা পরাস্ত হল ঠিকই, তবে সাময়িকভাবে। অরেলিয়াস কুয়াদিদের চুক্তিবদ্ধ করলেন। তিনি ভেবেছিলেন কুয়াদি-যুদ্ধের পরে কিছুদিন রোমে গিয়ে বিশ্রাম নেবেন । কিন্তু তা সম্ভব হল না। ঠিক ওই সময়েই ইরানিয় সার্মেশিয়ানরা বিরাট বাহিনী নিয়ে পূর্ব দিক থেকে চড়াও হল। অরেলিয়াস দম ফেলার সময় পেলেন না। উত্তরপশ্চিম থেকে ছুটলেন পূর্বসীমান্তের দিকে।

এই ১৬৬ খ্রিষ্টাব্দে কুয়াদী যুদ্ধের সময়েই ড্যানিউবের তীরে তাঁবুতে বসে অরেলিয়াস শুরু করলেন তাঁর স্বগত-কথন, Meditations। ১২ টি অধ্যায়ে বিন্যস্ত এই আশ্চর্য ডায়েরীতে অরেলিয়াস তাঁর স্টোইক উপলব্ধি লিপিবদ্ধ করেছেন, স্বগতোক্তির স্টাইলে। তবে সেই বিষয়ে বলার আগে স্টোইক দর্শন নিয়ে দু'য়েকটা কথা বলে নেওয়া দরকার।

স্টোইক দর্শনের প্রবক্তা মনে করা হয় জীনো নামক এক দার্শনিক যিনি খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে গ্রীসের এথেন্স শহরে তাঁর মতবাদ প্রচার করেছিলেন। স্টোইক দর্শন আসলে বৈরাগ্যবাদী একটি মতাদর্শ এবং মনে করা হয় সক্রেটিসের বৈরাগ্যবাদী চিন্তাই স্টোইক দর্শনের প্রধান উৎস। তাঁদের বিশ্বাস ছিল এই নিখিল বিশ্বের একটি নির্ধারিত গতি এবং গন্তব্য আছে। স্টোইকরা ব্যক্তি-ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন না ঠিকই কিন্তু তাঁরা মনে করতেন মহাবিশ্বের সমস্ত ঘটনার পশ্চাতে একটি আধ্যাত্মিক নিয়মতন্ত্রী আছে এবং সমস্ত ঘটনা পরম্পরাই একটি আধ্যাত্মিক যুক্তি মেনে সংঘটিত হয়। এবং তাই একজন ব্যক্তিমানুষের কর্তব্য হচ্ছে সেই মহতী বিশ্বনিয়মের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়া এবং সেই নিয়মকে অনুধাবন করে নিজের জীবনে প্রয়োগ করা, সমাজ এবং বিশ্বের বৃহত্তর মঙ্গলের স্বার্থে। ভোগবাদী নয়, বরং মননশীল নীতিনিষ্ঠ অনাসক্ত জীবনই হল ইউদেমোনিয়া বা আধ্যাত্মিক পূর্ণতা লাভের উপায়। ইউদেমোনিয়াই মনুষ্য জীবনের উচ্চতম আদর্শ। স্টোইকরা মনে করতেন, জীবনের কিছু বিষয়ের উপর মানুষের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ নেই, যেমন ধনসম্পদ, লোকমান্য , সুখদুঃখ ইত্যাদি। এগুলিকে তারা বললেন "অ্যাডিয়াফরা।" এই সব ঘটনার প্রতি স্টোইক ঋষি উদাসীন থাকবেন। কিন্তু যে বিষয়টির উপর মানুষের নিয়ন্ত্রণ আছে সেটি হল তার নিজের মন। বাহ্য জগৎ তার অধীনে নেই, কিন্তু বাহ্য জগতের অ্যাডিয়াফরার প্রতি মানুষের মনোভাব এবং প্রতিক্রিয়া কেমন হবে সেটা তার নিজের হাতে। স্টোইক ঋষি তাই নিজের মনকে নিয়ন্ত্রণ করবেন, আবেগ কে করবেন সংযত। জীবনে যাই ঘটুক না কেন মানুষের মন যদি তাতে প্রতিক্রিয়া না করে তাহলে বহির্জগত মানুষের ওপর প্রভাব হারিয়ে ফেলে। অর্থাৎ, স্টোইক ঋষি জীবনের প্রতি পদক্ষেপে আত্মবিশ্লেষণ করবেন। সত্য এবং নৈতিকতার পরিপন্থী যা কিছু তা বিচার করে বর্জন করবেন। ভয়, হতাশা, কামের মত আবেগগুলিকে অযৌক্তিক মনে করে পরিত্যাগ করবেন। জীবনে ভালমন্দ যাই আসুক তাকে বৃহত্তর সেই মহনিয়মের অন্তর্গত জেনে, উচ্চতম আদর্শের প্রতি নিষ্ঠাবান থাকবেন কারণ বিশ্ব প্রকৃতির সাথে সম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ একটি জীবনই হল শ্রেষ্ঠ জীবন। মোটের উপর স্টোইক দর্শনের এটাই হল নীতিতত্ত্ব। আমাদের নায়ক মার্কস অরেলিয়াস ছিলেন কায়মনোবাক্যে একজন বিবেকবান স্টোইক। তাঁর অন্তর্মুখী মনকে কষ্ট করেই তিনি বিশ্বের কাজে লাগিয়ে রাখতেন। বিশ্বের সর্ব বৃহৎ সাম্রাজ্যের সম্রাট তিনি। তাঁর তো নিরিবিলি ধ্যানের মাধুর্যে ডুবে থাকার উপায় নেই। সমগ্র জাতি যে তার মুখপানে চেয়ে আছে! তাঁর এক শিক্ষাগুরু ফ্রন্টো তাঁকে একবার সরাসরি লিখেছিলেন, "যতই তুমি ক্লিন্থেস কিম্বা জীনোর মত জ্ঞানী হয়ে ওঠো না কেন, নিশ্চিন্ত বৈরাগ্যের আলোয়ান তুমি কোনদিন গায়ে দিতে পাবে না।" যেন বলেছিলেন, "বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি, সে তোমার নয়।" মার্কসের জীবনেতিহাসের সাথে পরিচিত ব্যক্তিমাত্রই জানেন, ফ্রন্টোর কথাগুলি কেমন বর্ণে বর্ণে ফলেছিল।

ফিরে যাওয়া যাক ১৬৬ খ্রিষ্টাব্দে। সমর অভিযানের উদ্বেগ এবং অনিশ্চয়তার মধ্যেও দেখতে পাই অরেলিয়াস রাত্রিকালীন বিরতিতে তন্ময় হয়ে কী সব লিখে চলেছেন। "কী লিখছো অরেলিয়াস?" শুধোলেন বৃদ্ধ অনুচর।

— "নিজের মনকে শাসন করছি ক্যাটুলাস। মন যে কিছুতেই কথা শোনে না।" অরেলিয়াস লিখছেন তাঁর মনের কথা, নিজেরই মনকে উদ্দেশ্য করে। বারবার "তুমি" বলে যাকে সম্বোধন করছেন, সেটি তিনি নিজেই, অন্য কেউ নয়। বইটির তিনি কোন নাম দেননি কারণ গ্রন্থপ্রকাশের কোন উদ্দেশ্যই তাঁর ছিল না। পরবর্তিযুগের ঐতিহাসিকেরা এই গ্রন্থের নাম দেন Meditations। বইয়ের শুরুই অরেলিয়াস করলেন তার পূর্বসূরী এবং গুরুদের ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে। যাঁদের কারণে তিনি 'মার্কস অরেলিয়াস' হয়েছেন তাদের চরণ ছুঁলেন যেন। কিন্তু শুরু থেকে শেষ অবধি যেই সুরটা বইয়ের পাতায় পাতায় বাজতে থাকলো তা হল অনাসক্তি — সম্রাটসুলভ বিলাসের প্রতি, খ্যাতির লালসার প্রতি, ক্ষমতার দম্ভের প্রতি এবং যা কিছু তাঁর ন্যায়সংগত অধিকারের বাইরে, সেই সব কিছুর প্রতি এক গভীর অনীহা। অরেলিয়াস লিখলেন, "কত শীঘ্র সব কিছু মুছে যায়, এই মহাবিশ্বের জড়পদার্থ সব, একসময়ে তাদের স্মৃতিও মুছে যায়। হৃদয়, তুমি ভেবে দেখো, এই যে বিশ্বজোড়া সুখদুঃখের ফাঁদ, এই যে ক্ষয়িষ্ণু খ্যাতির লোভ, কি তুচ্ছ, বিস্বাদ, নশ্বর এসব! হৃদয়, তুমি মৃত্যুকে মনে রেখো। আর মনে রেখো, জগতের এই সমস্ত আয়োজনই আসলে প্রকৃতির প্রয়োজনগত।" রাজা হয়েও মনে মনে দার্শনিক তিনি, তাই লিখলেন:

"সময় একটা বিন্দু, জড়বিশ্ব একটা প্রবাহ, শরীর মরণশীল, আত্মা যেন বায়ুঘূর্ণি! অচিন বিদেশে জীবনের এই অভিযাত্রায় আশ্রয় তবে কী? আশ্রয় কেবল প্রজ্ঞা।" জীবনকে অরেলিয়াস দেখেছেন এক আদর্শবাদী দৃষ্টিতে। জীবন তার কাছে আসলে একটি দৃষ্টিভঙ্গি। তাই তিনি অবলীলায় লিখলেন, "জগৎ একটা রূপান্তরণ, জীবন একটা ধারণা।"..."জীবন সুন্দর, সেই সৌন্দর্য্যকে অবলোকন কর। আকাশের নক্ষত্রদের দেখেছো? তাদের গতির সাথে তাল মিলিয়ে তোমার জীবনও ছুটছে, এই সত্য উপলব্ধি কর।"..."একটি মহৎ জীবনের লক্ষণ হল জীবনের মঙ্গলময় উদ্দেশ্য সম্বন্ধে সচেতন হওয়া। এবং এই চেতনায় মানুষ উপনীত হয় কেবল অবিরাম আত্মবীক্ষণের মাধ্যমে। জীবনসত্যের প্রতি কি গভীর প্রত্যয় থাকলে কেউ বলতে পারেন, "এই জগৎটা একটি অতিকায় জীব; জড় এবং চৈতন্য মিলিয়ে একটি প্রকাণ্ড দেহ। সমগ্র সৃষ্টির একটিই উদ্দেশ্য, সেই বিরাট নিয়তির সাথে নিজেদের ক্ষুদ্রতর নিয়তির সামঞ্জস্য রচনা করা।"

সর্বশক্তিমান পৌরাণিক ঈশ্বর সম্বন্ধে তাঁর মনে কিছু সংশয় ছিল, এই বিষয়ে তিনি লিখছেন,

"যদি ঈশ্বর থেকে থাকেন এবং তিনি যদি ন্যায়পরায়ণ হন , তবে তিনি শুধু তোমার কর্মটুকুই দেখবেন, সে তুমি তাঁকে পুজো কর বা নাই কর। আর যদি তিনি থাকেন অথচ ন্যায়পরায়ণ না হন, তবে তাঁকে উপাসনা করার কি প্রয়োজন?" ..."হয় দেবতারা শক্তিমান, না হয় শক্তিহীন। যদি তাঁরা শক্তিহীন হন তবে তাঁদের পুজো করা কেন? আর যদি তাঁরা শক্তিধর হন তবে তাঁদের কাছে এটা-ওটা না চেয়ে, নির্ভীকতা, সহ্যশক্তি এইসব প্রার্থনা কর না কেন? এই সব অর্জন করলে বাইরের কোন শক্তির ওপর নির্ভর না করে নিজের বুদ্ধির ওপরই তো নির্ভর করতে পারবে!" আর একটি বিষয় এই ডায়েরিতে লক্ষ্য করার মতন — খ্যাতির প্রতি অরেলিয়াসের গভীর অরুচি। ইতিহাসে অমর হওয়ার লোভকে তিনি ঘৃণ্য মনে করতেন। লিখলেন, "এই পৃথিবীর কত যশস্বী বীর আজকে কালের গহ্বরে বিলীন হয়ে গেছে। আর যারা তাদের যশের শৃঙ্গে তুলে একদিন উৎসব করেছিল, তারাও আজ সেখানেই চলে গেছে।"..."জীবন অতি নগণ্য একটি বিষয়, পৃথিবীর ততধিক নগণ্য একটি কোণে যা অতিবাহিত হয়। খ্যাতিও তাই অতি তুচ্ছ একটি বস্তু, একদল ক্ষণস্থায়ী নির্বোধ মানুষের বিবেচনার ওপর যা নির্ভরশীল — সেইরকম কিছু মানুষ, যারা ইতিহাসের চরিত্র তো দূরের কথা, নিজেদের চরিত্রকেও ঠিকমত বোঝে না।" এইরকম মন্তব্য তিনি বারবার করেছেন।

Meditations পড়তে পড়তে যে মহাগ্রন্থের কথা প্রায়ই আমার মনে এসেছে সেটি হল ভগবদ্গীতা। একথা সর্বজনবিদিত যে গীতা কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রচিত। শ্রীকৃষ্ণ তাঁর প্রিয় শিষ্য অর্জুনকে ধর্মশিক্ষা দেওয়ার জন্য বেছে নিয়েছিলেন রণভূমি। সত্যিই তো, জীবনের সমরাঙ্গণে যে নিষ্কাম কর্মসাধনার কথা বাসুদেব বলেছেন তার জন্য এর চেয়ে সঠিক ব্যাকড্রপ অন্যকিছু হতেই পারত না। "কর্মে তোমার অধিকার, কর্মফলে নয়", দ্বিধাগ্রস্থ অর্জুনকে উপদেশ দিয়েছিলেন তিনি। কর্মফল মানুষের নিয়ন্ত্রণে নেই, শুধু কর্ম এবং সেই কর্মের প্রতি মনোভাবই তার অধীনে। তাই কর্মফলের প্রতি অনাসক্তিই গীতার মূল বাণী। অনুরূপভাবে Meditations এর রচনাও রণক্ষেত্রে, যদিও এই প্রেক্ষাপটটি অরেলিয়াসের নির্বাচিত ছিল না, বাধ্যতা ছিল। কিন্তু প্রকারান্তরে অরেলিয়াস সেই নিষ্কাম কর্মের কথাই বললেন নিজের মনকে। অ্যাডিয়াফরার প্রতি অনাসক্তিই জীবনের সারকথা। গীতার "স্থিতপ্রজ্ঞই" স্টোইক পরিভাষায় "সফোস", প্রজ্ঞাবান সাধু। এই স্টোইক জীবনদর্শন যে মোটেই জীবনবিমুখ নিষ্ক্রিয়তা নয়, সম্রাট অরেলিয়াসের জীবনই তার সব থেকে বড় প্রমাণ, যা ছিল ধ্যান, আত্মবীক্ষা এবং সংগ্রামের চমকপ্রদ এক সিম্ফনি।

যাই হোক, Meditations লেখা এগিয়ে চলল জীবনের নানা ওঠাপড়ার মধ্যে দিয়ে। এরই মধ্যে ১৬৯ সালে ভ্রাতা এবং সহসম্রাট লুশিয়াস মারকোম্যানিদের সাথে যুদ্ধ করে ফেরার পথে জ্বরে আক্রান্ত হয়ে দেহত্যাগ করলেন। অরেলিয়াস গভীর আঘাত পেলেন, কিন্তু রইলেন অটল। শুধু কি তাই, অল্প কিছুদিনের বিরতির পরেই কুয়াদি এবং অন্য গার্মেনিক বর্বরজাতিরা শান্তিচুক্তি ভঙ্গ করে আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। স্ত্রী ফস্টিনা এবং রুগ্ন ছেলেমেয়েগুলোর কথা মনে করে বুকের ভিতরটা চিনচিন করে উঠল সম্রাটের। মনে ভেসে উঠল রোমের প্রাসাদে নিভৃত লাইব্রেরির কোণাটাও। আহা! কতদিন হল বৃষ্টির অলস অপরাহ্নে সেই প্রিয় বাতায়নের পাশে বসে এপিকটেটাস্ পড়া হয়নি! পরক্ষণেই মনে পড়ে গেলো গুরু ফ্রন্টোর সেই ভবিষ্যতবাণী। "কর্তব্যের জোয়াল একবার যখন কাঁধে তুলেছ মার্কস আর তা নামানোর উপায় নেই!" মন না চাইলেও তাঁকে যেতেই হবে। একরাতে তাঁবুতে বসে অরেলিয়াস মনকে বোঝালেন বড় সুন্দর একটি কথা,"গতির প্রতিবন্ধকই গতিকে বাঁচিয়ে রাখে। আজকে বাধাই কালকের উপায়।"

কুয়াদি এবং মারকোম্যানিদের সাথে যুদ্ধ আরো অনেকদিন চলল। এমনিতেই অরেলিয়াসের স্বাস্থ্য কোনোদিন গ্ল্যাডিয়েটরসুলভ ছিল না। তার ওপর দীর্ঘস্থায়ী এই যুদ্ধের ক্লান্তি তাঁকে ক্রমশঃ ভগ্নস্বাস্থ্য করে তুললো। এই সবের মধ্যেই ঘটলো আরেক অনর্থ। তাঁর এতদিনের বিশ্বস্ত সেনাপতি মহাবীর ক্যাসিয়াস হঠাৎ বিদ্রোহ করে বসলেন। অরেলিয়াস মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না, কারণ ক্যাসিয়াস ছিলেন তাঁর নির্ভরতার জায়গা। তিনি যে এইভাবে বিশ্বাসভঙ্গ করবেন,অরেলিয়াস তা ভাবতেই পারেননি। অনেক বোঝালেন, দূত মারফত সম্প্রীতির বার্তা পাঠালেন। সময় লাগলো এবং শেষ অবধি অরেলিয়াস দক্ষতার সঙ্গে এই সমস্যার সমাধান করলেন বিনাযুদ্ধেই। শুধু তাই নয়, পুরোপুরি ক্ষমা করে দিলেন বন্ধুকে। "একি মার্কস, অত বড় বিশ্বাসঘাতককে তুমি ক্ষমা করে দিলে? প্রতিশোধ নিলে না!" "হ্যাঁ ক্ষমা করে দিলাম। কারণ, সবথেকে বড় প্রতিশোধ কোনটা জানো? তোমার শত্রুর মত না হওয়া" — লিখলেন অরেলিয়াস। অবশ্য ক্যাসিয়াসের শেষরক্ষা হলো না। তাঁর অনুগামীরাই কিছুদিন পর তাঁকে শিরোশ্ছেদ করে হত্যা করল। বিদ্রোহ ধ্বস্ত হল। অরেলিয়াস লিখলেন, "কেউ কি আমার ক্ষতি করেছে? সে নিজে ভেবে দেখুক।

তার কাজ সে স্বয়ং সমীক্ষা করুক। আমি জানি মহাপ্রকৃতির ইচ্ছাশক্তি আমার কাছে কী চায়, আমি তাই করবো যা আমার প্রকৃতি আমার কাছে প্রত্যাশা করে।"

এই সব যুদ্ধবিগ্রহ মিটিয়ে যখন অরেলিয়াস একটু শান্তির আশায় রোমে ফিরছেন, স্ত্রী ফস্টিনার মৃত্যুসংবাদ এসে তাঁকে অন্তর থেকে কাঁপিয়ে দিল। ফস্টিনা ছিলেন মার্কসের বহুদিনের সঙ্গী, তাঁর প্রথম এবং শেষ ভালবাসা। কিন্তু হায়! শোক কাটিয়ে ওঠার আগেই আবার তাঁকে কুচ করতে হল। উত্তরে গার্মেনিকরা পুনরায় আস্ফালন শুরু করেছে। এবার তাদের শেষ জবাব দিতেই হবে। রোমান সাম্রাজ্য এদের অত্যাচারে বিশ বছর ধরে জর্জরিত, এইবার এর ইতি না টানলেই নয়। আবার আরেক ধীর্ঘ সংগ্রামের জন্য নিজের অবসন্ন দেহমনকে প্রস্তুত করলেন অরেলিয়াস।


(২)

সারা জীবনের মর্মব্যথা মন্থন করে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, "আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু" গানটি, বাঙালিমাত্রেই যা শুনেছেন। একের পর এক শোকের ধাক্কায় কবির হৃদয় বিদীর্ণ হয়েছে, কিন্তু বাইরে থেকে সেই মহাসাগরে আবেগে তরঙ্গোচ্ছাস কখনও দেখা যায়নি। শোকে তিনি বিহ্বল হননি, দুঃখকে তিনি জীবনসাধনায় পরিণত করে নিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের দুই সহস্র বছর আগে ইতিহাসের ক্ষীণ আলোকে ঠিক একই রকম আরেকটি মানুষকে আবছা দেখা যায়। আমাদের গল্পের নায়ক মার্কস অরেলিয়াসও মৃত্যুর মহাশূন্যতাকে হৃদয়ে ধারণ করেছিলেন। প্রিয় ভাই লুশিয়াসের অকালপ্রয়াণ তাঁকে বড় একা করে দিয়েছিল। কিছু বছরের ব্যবধানে ফস্টিনাও বিদায় নিলেন। কিন্তু তাঁকে সব থেকে বেশি রিক্ত করেছিল একের পর এক প্রিয় সন্তানের চলে যাওয়া। ফস্টিনা তাঁকে অনেকগুলি সন্তান উপহার দিয়েছিলেন, দুর্ভাগ্যবশতঃ তারা কেউই স্বাস্থ্যবান ছিল না। অরেলিয়াসের নিজের মৃত্যুর আগে কেবল একটি পুত্রই বেঁচে ছিল, কমোডাস, যিনি অরেলিয়াসের পরে সম্রাট হন। ভাগ্যের কেমন পরিহাস! কমোডাস তাঁর পিতার সুকৃতি অত্যাচার এবং বিলাসের কালিমায় ভূলুণ্ঠিত করে দিয়েছিলেন।

কিন্তু এতো কিছুর মধ্যেও যা সবচেয়ে চমকপ্রদ তা হল অরেলিয়াসের মৃত্যুচিন্তা। জীবনের চাকচিক্যের প্রতি উদাসীন রাজা, মৃত্যুর প্রতিও ছিলেন একই রকম উদাসীন। "মরণ আমাদের দেখে স্মিতহাসি হাসে, আমরা কেবল বিনিময়ে সেই হাসি তার দিকে ছুঁড়ে দিতে পারি।" মৃত্যুর ভয়াবহতা অত কাছ থেকে দেখেও এরকম কথা বলা একজন স্থিতপ্রজ্ঞের পক্ষেই সম্ভব হয়তো। মৃত্যুকে তিনি মুক্তির রূপেও দেখেছেন, জীবনের এবং জড়ের দাসত্ব থেকে চিরমুক্তি। এক জায়গায় লিখলেন, মৃত্যু হল নিষ্কৃতি। ইন্দ্রিয়ের দাসত্ব থেকে, শরীরের বশ্যতা থেকে নিস্তরণ।" অরেলিয়াস চোখে জীবনের মত মরণও সেই মহানিয়মেরই একটি অধ্যায় — যে নিয়মে গাছে পাতা গজায়, ফুল ফোটে, ফল হয় এবং একসময় সেই গাছ মাটিতে মিশে যায়— মানুষ বিশ্বজীবনের বৃক্ষে একদিন উদয় হয় আবার সময়ের নিয়মে একদিন ঝরেও যায়। "কখনও ভুলে যেও না মার্কস, কত মহান দার্শনিক, কত কীর্তিমান রথী-মহারথী, কত অত্যাচারী একনায়ক, জীবনকে শোষণ করে শেষে মরণেই মিশে গেছে। হেলাইক এবং পম্পেইয়ের মত বৃহৎ গৌরবময় শহর আজ ধূলিধূসরিত। জীবন অতি হ্রস্ব এবং তুচ্ছ জিনিস মার্কস। গতকালের একদলা ঔরস আগামীকালের একমুঠো ছাই। জীবনের প্রতিটি দিন প্রকৃতির সাযুজ্যে কাটিয়ে, মৃত্যু এলে বিনা অনুযোগে চলে যাওয়াই তাই কর্তব্য। তুমি কি দেখনি, প্রকৃতির খেয়ালে গাছে কেমন অলিভ ধরে, পাকে এবং ঝরে যায়। তারা কি কখনও অনুতাপ করে?" মৃত্যু তাঁর কাছে অবকাশও, নতুনকে জায়গা করে দেওয়ার একটি সুযোগ: "তুমি কি পরিবর্তনকে ভয় পাও, মার্কস?", তিনি লিখলেন, "বৃক্ষের যদি পরিবর্তন না হতো, তুমি কি স্নানের উষ্ণতা পেতে?" খাদ্যের যদি রূপান্তর না হতো, তুমি কি দেহের পুষ্টি পেতে? তোমার জন্য যদি পরিবর্তন এতো উপকারী হয়, তবে প্রকৃতির বেলায় কেন ব্যতিক্রম হবে?" মৃত্যুকে এভাবেই নির্মোহ দৃষ্টিতে দেখেছেন অরেলিয়াস।…"সৃষ্টি এবং ধ্বংসের চক্র অবিরাম চলেছে। আজ যা সৃষ্টি হচ্ছে কালে তা হচ্ছে নির্বাপিত। গতি এবং পরিবর্তনই বিশ্বকে প্রতিনিয়ত ধারণ করে চলেছে। প্রবহমান সময় জন্ম দিচ্ছে অনন্ত কালচক্রের।".

কালচক্র অন্য ইঙ্গিতও দিচ্ছিল। ফস্টিনার মৃত্যুর পর গার্মেনিকদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ যুদ্ধের ধাক্কা তাঁর শরীর আর বেশিদিন সইতে পারলো না। ধ্যানশীল সম্রাটের শেষ ধ্যানে ডুবে যাওয়ার হওয়ার সময় এগিয়ে আসছিল। অবশেষে ১৮০ খ্রিষ্টাব্দে, রোম থেকে অনেক দূরে প্যানোনিয়ার এক রণশিবিরে অন্তিমনিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন রাজর্ষি অরেলিয়াস। পিছনে পড়ে রইল তাঁর সাধের পড়ার ঘর, তাঁর নিরুদ্বেগ নিরুত্তাপ জীবনের স্বপ্ন, তাঁর ভালোবাসার রোমা। মাত্র আটান্ন বছর বয়সে অরেলিয়াস পাড়ি দিলেন তাঁর চিরকাঙ্খিত শান্তির দেশে। যাওয়ার আগে তাঁর বইয়ের শেষ অধ্যায়ের শেষ পাতায় লিখে গেলেন এই আশ্চর্য বাণী: "এবার তবে বিদায় নাও অরেলিয়াস, সন্তোষে পরিপূর্ণ হয়ে বিদায় নাও। কারণ, তোমার যিনি মুক্তিদাতা সেই তিনিও কাণায়‌ কাণায়‌ পরিপূর্ণ।"

এই বলে রাজা নিশ্চিন্তে ঘুমোলেন।

অমৃত সদন - শামিম আহমেদ









একলব্য তীরধনুক নিয়ে প্রতিদিন সেই মৃন্ময় মূর্তির কাছে আসে, পাঠ নেয় আর চলে যায় বনের দুর্গম এলাকায়। মহাদেবের মন্ত্র পড়ে শর নিক্ষেপ করে। এই ভাবে সমগ্র ধনুর্বিদ্যা তার করায়ত্ত হয় কয়েক মাসে। অঙ্গাগ্রণী তখন গর্ভবতী।

এমনই সময় একদিন অরণ্যে বিস্তর কোলাহল দেখা দিল। অনেক লোকজন নানা রকমের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বনের মধ্যে প্রবেশ করল। তাদের দ্রুতগামী রথ বনের প্রান্তসীমায় রাখা। সেই সব লোকজনের কারও হাতে দড়ি, কেউ বা জাল, বল্লম, তীরধনুক ইত্যাদি মৃগয়ার উপকরণ নিয়ে বনের মধ্যে ঘুরে বেড়াতে লাগল। শিকারী কুকুররা ছূতে বেড়াচ্ছে। লোকজনের মধ্যে কারও কারও বেশভূষা একটু অন্য রকম, তাদের দেখে রাজপুত্র মনে হয়।

একলব্য একমনে ধনুর্বিদ্যার নানা কৌশল ও নিয়মকানুন স্মৃতি থেকে বর্তমান অভিজ্ঞতায় তুলে এনে পরীক্ষানিরীক্ষা করছিলেন। এমন সময় একটি কুকুরের আওয়াজে তার মনোসংযোগের বিঘ্ন ঘটে। কুকুরটি বোধ হয় এমন মানুষ আগে দেখেনি, সে ক্রমাগত ঘেউ ঘেউ করেই যাচ্ছে। একলব্য প্রথম দিকে তেমন গুরুত্ব দেয়নি, কিন্তু চীৎকার যখন সহ্যের বাইরে চলে গেল, সে একসঙ্গে সাতটি বাণ কুকুরের মুখে নিক্ষেপ করল। একে বলে শব্দহরণ বাণ। যে কোনও জীবের স্বরনির্গমনের দ্বারে এই সপ্ততীর নিক্ষিপ্ত হলে সেই প্রাণীর সপ্তস্বর সাময়িকভাবে বিনষ্ট হয়ে যায়। কুকুরটিরও তাই হল। সে ছুটে গিয়ে প্রভুদের কাছে উপস্থিত হল। প্রভুরা ছিলেন হস্তিনাপুরের পাণ্ডব রাজকুমার—যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল ও সহদেব। শরবিদ্ধ কুকুরটিকে দেখে তাঁরা চমকে গেলেন। কে সেই তীরন্দাজ যে এমন অদ্ভুত শরশাস্ত্র সম্পর্কে বিদ্বান! সম্ভবত তাঁদের অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্যও এই শব্দহরণ শরনিক্ষেপ সম্পর্কে অবহিত নন। তাঁরা তীরন্দাজের খোঁজে গভীর অরণ্যে প্রবেশ করলেন।

পাণ্ডবরা দেখলেন, একজন কৃষ্ণবর্ণ, ধূলিধুসরিত, কৃষ্ণজিনজটাধারী যুবক অনবরত বাণক্ষেপ করছে। যুধিষ্ঠির তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কে তুমি? কার লোক?

কৃষ্ণজিনজটাধারী একলব্য জবাব দিল, আমি নিষাদরাজ হিরণ্যধনুর পুত্র, দ্রোণাচার্যের শিষ্য এবং ধনুর্বেদশিক্ষা সম্পন্ন করেছি।

ভীম বললেন, তুমি কার লোক?

একলব্য উত্তর দিলেন, আমি আমার লোক।

অর্জুন খুব বিস্মিত হলেন। গুরুদেব দ্রোণ তাহলে জঙ্গলের নিষাদদের সঙ্গে ষড় করছেন! এই কথা পিতামহ ভীষ্মের কানে তুলতে হবে। আচার্য তাদের জল আনতে বলে অশ্বত্থামাকে অনেক গুপ্তবিদ্যা শিখিয়েছেন তা অর্জুন বিলক্ষণ জানেন। এখন শত্রু পাঞ্চালরাজকে শায়েস্তা করার জন্য হস্তিনাকে ভরসা না করে আচার্য নিষাদদের শরণাপন্ন হয়েছেন। অর্জুন একলব্যকে শান্ত স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, আচার্য দ্রোণ এখানে আসেন না তুমি হস্তিনায় যাও শিক্ষা নিতে?

একলব্য জবাব দেয়, আমি একবার গিয়েছিলাম। তার পর থেকে দ্রোণাচার্য স্বয়ং এই বনের মধ্যে আমাকে সমগ্র ধনুর্বেদশাস্ত্র শিখিয়েছেন।

পাণ্ডব ভাইদের মধ্যে সবচেয়ে বিদ্বান সহদেব বললেন, আমাদের মৃগয়া না করে হস্তিনায় ফিরে সব কথা পিতামহ ভীষ্মকে জানানো উচিত।

দ্রুতগামী রথ চলল হস্তিনানগরের দিকে।

হস্তিনায় পৌঁছে অর্জুন সোজা চলে গেলেন পিতামহ ভীষ্মের কাছে। পাণ্ডুর এই পুত্রটিকে পিতামহ অত্যন্ত স্নেহ করেন। অর্জুনের কাছে সব শুনে ভীষ্ম ডেকে পাঠালেন বিদুরকে।

বিদুর কৃষ্ণ দ্বৈপায়নের পুত্র। তাঁর মা দাসী ও শূদ্রা। সেইজন্য বিদুরকে ক্ষত্তা বলা হয়। বর্ণবিচারে প্রজ্ঞাবান বিদুর পারশব—শবতুল্য, কিন্তু তাঁর বিচক্ষণতা ও কূটবুদ্ধি অপরিসীম। ভীষ্মের ডাকে বিদুর এসে সব শুনে দ্রোণাচার্যকে ডাকা সমীচীন মনে করলেন।

দ্রোণ এলেন, সব শুনলেন। তাঁর হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল ভয়ে। তিনি তোতলাতে তোতলাতে বললেন, বিশ্বাস করুন গাঙ্গেয়, আমি একলব্যকে কোনও প্রকার গুপ্ত বা প্রকাশ্য শিক্ষা দিইনি। আপনি যেমন বলেছিলেন, তেমন ভাবেই তাকে প্রত্যাখ্যান করেছি।

ভীষ্ম বললেন, তবে নিষাদপুত্র এই বিদ্যা কোথা থেকে শিখলো?

দ্রোণ উত্তর দিলেন, বিশ্বাস করুন, আমি নিজেই এই বিদ্যা জানি না। কী করে শেখাবো?

অর্জুন বললেন, কিন্তু গুরুদেব, নিষাদপুত্র জানাল যে তার গুরু আপনি, আপনার একটি মূর্তির সামনে সে অস্ত্রশিক্ষা করে থাকে। আপনি অনুমতি না দিলে সে এই সাহস পায় কোথা থেকে!

দ্রোণ ক্ষণকাল চিন্তা করে জানালেন, এখন দেখছি সে বাহ্যত আমার শিষ্য না হলেও ফলত আমারই শিষ্য।

বিদুর এতক্ষণ চুপ করেছিলেন। তিনি এ বার মুখ খুললেন, এই ভাবে কথার খেলা খেললে চলবে না আচার্য!

অর্জুন ক্রোধবশত বলে বসলেন, হে আচার্য! একদা আলিঙ্গন করে প্রীতিপূর্বক আমাকে বলেছিলেন ‘আমার অন্য কোনও শিষ্য তোমার থেকে শ্রেষ্ঠ হবে না’। অথচ আজ? আপনার ‘বাহ্যত নয় কিন্তু ফলত’-শিষ্য আমার থেকে তো বটেই, সমস্ত বীর অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।

দ্রোণ কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, আমাকে একলব্যের কাছে নিয়ে যেতে পারবে?

অর্জুন জবাব দিলেন, পিতামহ আদেশ দিলে নিশ্চয় নিয়ে যাব।

ভীষ্ম অর্জুনসহ অন্যান্য পাণ্ডবদের চলে যেতে বললেন। দ্রোণাচার্য ও বিদুরকে নিয়ে তিনি একটি কক্ষে উপস্থিত হয়ে তার দ্বার রুদ্ধ করে দিলেন।

বিদুর ফিসফিস করে বললেন, হে আচার্য, আপনি যে নির্দোষ তা প্রমাণ করতে পারবেন?

দ্রোণ উত্তর দিলেন, বিশ্বাস করুন আমি একলব্যকে ধনুর্বেদশিক্ষা দিইনি।

ভীষ্ম বললেন, বিশ্বাস বা অবিশ্বাসের প্রশ্ন এখানে তুলছেন না ক্ষত্তা, তিনি প্রমাণ চাইছেন।

দ্রোণ ভয় পেয়ে বললেন, একলব্যকে কোনও প্রকার শিক্ষা যে দিইনি তা আমি দেবতাদের নামে শপথ করে বলছি।

বিদুর হেসে ফেলে জানালেন, একলব্য বলছে আপনি তার গুরু আর আপনি বলছেন সে আপনার শিষ্য নয়। আচ্ছা এক কাজ করুন, আমরা যা বলব, তাই আপনি করতে পারবেন?

দ্রোণ প্রশ্ন করলেন, কী?

বিদুর বললেন, একলব্যকে হত্যা করতে হবে।

দ্রোণাচার্য ভীষণ ভয় পেয়ে গেলেন, না মানে হত্যা করব, মানে...

ভীষ্ম বললেন, ক্ষত্তা, খামোখা আচার্যকে ভীত সন্ত্রস্ত করে তুলো না। হস্তিনাকে সুরক্ষিত রাখার দায় আমার। একলব্য বেঁচে থাকলেও সেই সুরক্ষা সম্ভব।

দ্রোণ যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।

ভীষ্ম বলতে লাগলেন, আচার্য! আপনাকে ডানহাতি সেই তীরন্দাজের দক্ষিণ হস্তের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ কেটে আনতে হবে।

দ্রোণাচার্য অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে পড়ে গেলেন। বিদুর ও ভীষ্ম হো হো করে হাসতে লাগলেন। প্রাতিকামী এসে দ্রোণের চোখেমুখে জল ছিটিয়ে তাঁকে বাড়ি পৌঁছে দিল।

স্ত্রী কৃপী ও পুত্র অশ্বত্থামাকে সব কথা খুলে বললেন আচার্য।

কৃপী উপদেশ দিলেন, এই চাকরি আপনি ছেড়ে দিন ভর্তা।

অশ্বত্থামা বললেন, হে পিতা, সব কথা ধৃতরাষ্ট্র ও তাঁর পুত্রদের অবিলম্বে জানান। আপনার চাকরি চলে গেলে আমরা খাব কী?

ধৃতরাষ্ট্রের জ্যেষ্ঠ পুত্র দুর্যোধন অশ্বত্থামার বিশেষ বন্ধু। দুর্যোধন নিজেকে যুবরাজ বলে ঘোষণা করেছেন কারণ তাঁর পিতা ধৃতরাষ্ট্র হস্তিনার রাজা। ধৃতরাষ্ট্র যেহেতু অন্ধ, তাই তাঁর অনুজ পাণ্ডু রাজা হওয়ার দাবিদার ছিলেন। কিন্তু তিনি রাজত্ব ছেড়ে বনে চলে যান এবং সেখানেই প্রয়াত হন। তাঁর পাঁচ ছেলে এখন হস্তিনার অর্ধেক দখল নিতে চাইছেন। দুর্যোধন তাঁদের কোনও অংশ দেবেন না বলে ঘোষণা করেছেন। পিতামহ ভীষ্ম এবং বিদুর সব সময় পাণ্ডবদের পক্ষে থাকেন। ভীষ্ম দ্রোণকে অস্ত্রগুরুর পদে বসিয়েছেন বটে, কিন্তু দুর্যোধন বাধা দিলে পিতামহ আচার্যকে সরাতে পারবেন না।

দ্রোণ পুত্রকে বললেন, এক্ষুণি কিছু বলার দরকার নেই। দেখি ঘটনা কোন দিকে যায়।

হঠাৎ রাজসভার দূত এসে দ্রোণকে জানাল, বাইরে দ্রুতগামী রথ প্রস্তুত। এক্ষুণি তিনি যেন প্রস্তুত হয়ে রথে উপবেশন করেন, মহামান্য ভীষ্ম এই আদেশ পাঠিয়েছেন।

দ্রোণাচার্য দূতের সঙ্গে বাড়ির বাইরে গিয়ে দেখেন, রথ প্রস্তুত। সারথি ছাড়া সেখানে বসে রয়েছেন অর্জুন।

রথ চলতে শুরু করল। গুরু-শিষ্য কারও মুখে কোনও কথা নেই। এই ভাবে সারা রাস্তা অতিক্রম করে তাঁরা একলব্যের কাছে পৌঁছলেন।

দ্রোণ দেখলেন, ধূলিধুসরদেহ, জটাধারী ও কৌপীনপরিধায়ী নিষাদ একলব্য একমনে ধনু ধারণ করে অনবরত বাণক্ষেপ করছে।

দ্রোণাচার্যকে আসতে দেখে অভিভূত একলব্য তাঁর কাছে গিয়ে চরণযুগল ধারণ করে মস্তক দ্বারা ভূতল স্পর্শ করল। দ্রোণাচার্য বাধা দিলেন না।

আচার্যকে পূজা করে একলব্য নিজেকে তাঁর শিষ্য বলে ঘোষণা করে কৃতাঞ্জলি হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।

দ্রোণ বললেন, হে বীর যদি তুমি আমারই শিষ্য হও তবে আমাকে সেই শিক্ষাদানের বেতন দাও।

একলব্য আনন্দিত হয়ে বলল, কী চান গুরুদেব, আদেশ করুন। হে বেদজ্ঞশ্রেষ্ঠ, গুরুকে অদেয় আমার কিছুই নেই।

দ্রোণাচার্য একটু থামলেন। বললেন, আমাকে শব্দহরণ বাণনিক্ষেপের পাঠ দাও।

অর্জুন অদূরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন।

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত







৩১

ইলোনার সঙ্গে মনে মনে কথা বলে যেত ফাইনহালস। তীব্রভাবে ভাবত তার কথা ঘুমোতে যাবার আগে। কিন্তু সে একদিনও স্বপ্নে এলো না। ঘুমোতে যাবার আগে মনে হত তার যে পাশ ফিরলেই সে দেখতে পাবে ইলোনাকে। অনুভব করতে পারবে তার বাহুর স্পর্শ। কিন্তু তেমন কিছুই হয়নি। সে অনেক দূরে আছে হয়তো। পাশ ফিরবার সেভাবে কোনো দরকার নেই। তার ঘুম আসছিল না। সে অনেকক্ষণ ধরে ভাবছিল তার কথা। তার সঙ্গে দেখা হলে যে ঘরে তার সঙ্গে সময় কাটাবে, রাত্রিবাস করবে, সেরকম একটা ঘরের কথা ভাবছিল সে। ভাবতে ভাবতে কখন যে ক্লান্ত শরীরে সে ঘুমিয়ে পড়ল, সে কথা আর মনেও নেই। সকালে উঠে সে মনে করতে পারছিল না যে ঘুমের মধ্যে কেমন স্বপ্ন দেখেছে। না, সে ইলোনাকে স্বপ্নে দেখেনি।

ঘুমোতে যাবার আগে প্রার্থনা করছিল সে। মনে মনে ভেবে যাচ্ছিল যে ওই অল্প কটা দিনে ইলোনার সঙ্গে তার কী কী কথা হয়েছিল। শেষ দেখার আগে পর্যন্ত প্রতিটি মুহূর্ত পুঙ্খানুপুঙ্খ মনে করবার চেষ্টা করছিল সে। বেশির ভাগ সময়ে ইলোনা কেমন যেন লজ্জায় লাল হয়ে থাকত। সেই স্কুলের ঘরে তাদের দেখা হওয়ার সময়, বাচ্চাদের খেলনা, ম্যাপ, জীববিদ্যার চার্ট, ব্ল্যাকবোর্ড সবকিছু দিয়ে ঠাসা সেই ঘরে ইলোনাকে সব সময় কেমন যেন বিব্রত দেখাত। আসলে সে ধর্ম বিষয়ক যে কোনও কথা বলতে গিয়ে কেমন যেন থমকে যেত। কারণ ফাইনহালস তাকে বলেছিল যে তার চার্চে যেতে একদম ভালো লাগে না। চার্চের ধর্মগুরুদের বাণী, উপদেশ সবকিছু তার কাছে অসহ্য মনে হয়। ইলোনা সম্ভবত ব্যথা পেয়েছিল এই কথায়। বিষণ্ণ স্বরে বলেছিল… ‘কিন্তু প্রার্থনা খুব জরুরি, ঈশ্বরের নাম না করে প্রার্থনা করা কী ভাবে সম্ভব!’…

ফাইনহালস ভাবতেই পারেনি যে ইলোনা তাকে চুম্বন করবার অনুমতি দেবে। কিন্তু সে তাকে চুম্বন করেছিল। ইলোনাও প্রতিচুম্বন দিয়েছিল তাকে। তারা একটা ঘরে গিয়ে সময় কাটাবার কথা ভাবছিল। মনে মনে সেই ঘরটার একটা ছবি এঁকে রেখেছিল সে। ঘরটা খুব সাজানো গোছানো পরিচ্ছন্ন নয়। নীলচে একটা হাত ধোবার গামলা থাকবে ঘরটায়, হাত ধোবার জল থাকবে তাতে। বাদামি রঙের খাট। ঘরটার জানালা দিয়ে ফলের বাগান দেখা যাবে। বাগানের গাছের নিচে ফল পেকে পেকে ঝরে পড়েছে। কিছু ফল পচে মাটিতে মিশে গেছে। সে চোখ বুজে এরকম একটা ছবি মনে ভাববার চেষ্টা করত যে ওইরকম একটা ঘরে খাটে শুয়ে শুয়ে সে ইলোনার সঙ্গে গল্প করছে। সে অনেকবার ভেবেছে। কিন্তু এরকম কোনো স্বপ্ন আজ অবধি আসেনি তার ঘুমের মাঝে।

পরের দিন সকালে কাজ শুরু হল। নড়বড়ে হাড়জিরজিরে টেবিলটার সামনে হাতলওয়ালা চেয়ারটার মধ্যে গুটিসুটি মেরে বসে থাকতে হচ্ছিল তাকে। বাড়িটার ঘিঞ্জি চিলেকোঠার ঘরের জানালায় দূরবীনে চোখ রেখে বসেছিল ফাইনহালস। পাহাড়ের দিকে, জঙ্গলের দিকে, নদীর পাড়ে, যে রাস্তা ধরে ট্রাকে করে তারা এখানে এসেছে, সব দিকে নানা ভাবে দূরবীন দিয়ে দেখে যাচ্ছিল সে সারাক্ষণ। কোনো বিপ্লবীর টিকিও দেখতে পায়নি সে। মাঠে ঘাটে কাজ করা চাষাভুষো লোকগুলোর মধ্যেও কেউ বিপ্লবী হতে পারে। হতেই পারে। ফাইনহালস তো আর তাদের চেনে না। দূরবীন দিয়ে দেখে কী বা বোঝা সম্ভব? চারদিক এত চুপচাপ যে তার মনে হতে লাগল যে সে অনন্তকাল ধরে এই চেয়ারটার মধ্যে কুঁকড়ে বসে আছে। আবার দূরবীণের মুখ ঘুরিয়ে গির্জার হলদেটে চুড়ো পেরিয়ে, জঙ্গল পেরিয়ে পাহাড়ের দিকে নজর রাখতে লাগল সে।

বাতাসটা খুব পরিষ্কার। উঁচু পাহাড়ের মাথায় একপাল ছাগল দেখতে পাচ্ছে সে দূরবীনের মধ্য দিয়ে। জন্তুগুলো সাদা সাদা তুলো তুলো মেঘের মত ছড়িয়ে আছে মেঘলা আকাশের মত দেখতে পাহাড়ের ধূসর সবুজ ঢালের গায়ে। দূরবীনের মধ্য দিয়ে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চারপাশের নৈঃশব্দ্য একটু একটু করে নিজের মধ্যে শুষে নিচ্ছিল সে। অদ্ভুত একাকিত্বের মধ্য বুঁদ হয়ে থাকছিল সে। পাহাড়ের গায়ে জন্তুগুলো খুব কম নড়াচড়া করছে। মনে হচ্ছে যেন দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে ওদের। দূরবীনের মধ্য দিয়ে সে এত পরিষ্কার জন্তুগুলোকে দেখতে পাচ্ছে, ঠিক যেমনটি খালি চোখে দু’ তিন কিমি দূরের জিনিস দেখা যায়। কিন্তু আসলে ওরা অনেক দূরে আছে। নিঃশব্দ, একাকী কিছু জন্তু ঘুরে বেড়াচ্ছে পাহাড়ের ঢালে। যে ওদের পাহাড়ের ঢালে চড়াতে এনেছে, সেই রাখালকে দেখা যাচ্ছে না। দূরবীনের লেন্স থেকে চোখ সরিয়ে সে হতবাক হয়ে গেল। গির্জার হলদেটে চুড়া পেরিয়ে পাহাড়ের ঢালটা দেখা যাচ্ছে, কিন্তু খালি চোখে সে জন্তুগুলোর চিহ্নমাত্র দেখতে পাচ্ছে না। সে চোখ কুঁচকে দেখবার চেষ্টা করল। নাহ, কিচ্ছু বোঝা যাচ্ছে না। কোনো সাদা রঙের ফুটকিও সে দেখতে পাচ্ছে না। সব একাকার। অনেক দূরে রয়েছে জন্তুগুলো। সে আবার দূরবীনের লেন্সে চোখ রাখল। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে ছাগলগুলো, যাদের নিশ্চল একাকিত্ব সে এত দূর থেকেও অনুভব করতে পারছে।

হঠাৎ নিচে বাগানে কুচকাওয়াজের শব্দে চমকে উঠল সে। সে দূরবীনটা এবার নিচে বাগানে সার বেঁধে দাঁড়ানো সৈনিকদের উপরে তাক করল। প্রথমে সে খালি চোখে দেখল কিছুক্ষণ সৈনিকদের নড়াচড়া। তারপর লেফটেন্যান্ট মুকএর উপরে তাক করল দূরবীনের নল। সে সবে দু দিন হল মুককে চিনেছে। লোকটা ভারি গম্ভীর। পা থেকে মাথা অবধি গুরুগম্ভীর স্বভাবের। লঘুত্ব, চপলতার লেশমাত্র নেই। সরু, একহারা গড়ন লোকটার। গম্ভীরভাবে কুচকাওয়াজের নির্দেশগুলো উচ্চারণ করছে। হাতগুলো এতটুকুও নড়ছে না। লোকটাকে দেখতে একেবারেই সুদর্শন বলা চলে না। ফ্যাকাসে ঠোঁট, মুখের রঙটাও ফ্যাকাসে, প্রায় ধূসর। ঠোঁটগুলো অল্প নড়ছে, গলার পেশিগুলোতে হালকা কাঁপুনি দেখা যাচ্ছে যখন ‘ডাইনে’, ‘বাঁয়ে’ … ‘পিছে মুড়’ এইসব নির্দেশ বলে যাচ্ছে লোকটা। ফাইনহালস দূরবীন দিয়ে শুধু মুকের মুখটা দেখছে। মুখটা প্রায় অনড়, অটল। ঠোঁটগুলো নির্দেশ বলবার সময় নড়ে কি নড়ে না, হালকা কম্পন দেখা যাচ্ছে। বাম চোখটা বিষণ্ণ। চোখগুলো কুচকাওয়াজে রত সৈনিকদের দিকেও তাকিয়ে নেই। সৈনিকদের দলটা পেরিয়ে অনেক দূরে, অনেক পিছনে লেফটেন্যান্‌ট মুকএর চোখগুলোর দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়ে আছে।

তারপর সে গ্রেসএর মুখের দিকে তাক করে দেখতে লাগল। ওর মুখটা ফোলা, একটা বিরক্তি লেগে আছে। ফাইনহালস আবার খালি চোখে বাগানের দিকে তাকায়। সৈনিকেরা ‘ডাইনে’, ‘বাঁয়ে’, ‘সাবধান’ এসব নির্দেশ মেনে কুচকাওয়াজ করে চলেছে এই অপূর্ব শান্তিপূর্ণ সবুজ উপত্যকার মাঝে। সে দেখতে পেল বাগানের আরেক পাশে এক মহিলা দড়িতে ভেজা কাপড়চোপড় মেলছে। এই মহিলা সম্ভবত বাড়িওয়ালীর মেয়ে, যে গতকাল চিৎকার করে কান্নাকাটি করছিল। মহিলাকে গম্ভীর, বিষণ্ণ দেখাচ্ছে। এতটাই গম্ভীর যে চেহারার সেরকম কোনো চটক চোখে পড়ছে না, অথচ একটা বিষাদময় সৌন্দর্য আছে। সরু, লালচে মুখ, কুঁচকানো ঠোঁট। কাপড় মেলতে মেলতে মহিলা একবারও কুচকাওয়াজে রত চার সৈনিক বা লেফটেন্যান্টের দিকে তাকাচ্ছে না।

পরদিন সকালে আটটা নাগাদ ছাদে উঠে চেয়ারে বসে ফাইনহালসের মনে হল যে সে এই জায়গায় যেন কত মাস, কত বছর ধরে বসে আছে। জায়গাটার চারপাশে প্রকৃতি খুব শান্তিপূর্ণ। ফলে একাকিত্ব একটা অবধারিত বিষয় এখানে। খামারে গরুর হালকা হাম্বা ডাক শোনা যাচ্ছে। আলু ক্ষেতের দিক থেকে পাতা পোড়া গন্ধ ভেসে এসে বাতাসে মিশছে। দূরবীনের লেন্সে চোখ রেখে যন্ত্রটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে গির্জার হলদে চুড়ো পেরিয়ে দূর জঙ্গলের দিকে তাক করেও সে একাকী নীরবতা ছাড়া কিছুই দেখতে পেল না। পাহাড়ে ধূসর সবুজ ঢালে কিছু কালচে পাথর দেখা যাচ্ছে দেওয়ালের মত। লেফটেন্যান্ট মুক নদীর পাড়ে গেছে সৈনিকদের নিয়ে আক্রমণের কায়দাকানুন শেখাতে, ড্রিল করাচ্ছে তাদের। মুকের ছোট ছোট নির্দেশের শব্দগুলো এই নীরবতার মাঝে হালকা আর্তনাদের মত শোনাচ্ছে। শব্দগুলো এতটাই আবছা শোনা যাচ্ছে যে সেগুলো নৈঃশব্দ্য ভঙ্গ করবার বদলে সেটা আরও কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। বাড়ির একতলার রান্নাঘরে বাড়িওয়ালীর মেয়ে একটা ধীরলয়ের বিষণ্ণ সুরের স্লোভাক লোকসঙ্গীত গেয়ে চলেছে। বাড়িওয়ালী নিজে চাষের কাজে সাহায্যকারী লোকটিকে নিয়ে ক্ষেতে কাজ করছেন আলুর ফসল ঘরে তুলবার জন্য।

পাশে আরেকটা খামারবাড়িতেও সব চুপচাপ। সে দূরবীন দিয়ে পাহাড়ের দিকে তাক করে অনেকটা সময় বসে ছিল। নিঝুম নির্জন এলাকা। কেউ নেই। কোনো নড়াচড়া নেই। ডানদিকে জঙ্গলের মধ্যে রেলস্টেশনের কাছে কিছু সাদা ধোঁয়া লক্ষ্য করল সে। ধোঁয়াটা মুহূর্তে মিলিয়ে গেল। ধুলোর কুণ্ডলীর মত পাক খেয়ে উঠেই আবার মিশে গেল গাছের মাথায়। কিন্তু কিছুই শোনা যাচ্ছে না। নদীর পাড়ে ড্রিলের জন্য মুকের ছোট ছোট নির্দেশ আর বাড়ির একতলায় ওই অল্পবয়সী মহিলার বিষণ্ণ গানের সুর ছাড়া তার কানে কোনো শব্দ আসছে না…

সৈনিকেরা ফিরে আসছে নদীর পাড় থেকে। গান গাইতে গাইতে ফিরছে ওরা। চারটে পুরুষের কণ্ঠ। গান গাইছে। উফফ, ওদের গান শুনেও হাই উঠছে তার। ক্লান্ত লাগছে। বিষণ্ণ লাগছে। চার লাইনের গানটা করুণ সুরের ‘ধূসর সেনাদলের সারি’। একই পদ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে গাইছে ওরা। গানের তালে তালে মুক ‘লেফট দুই’ … ‘লেফট দুই’ এসব নির্দেশ দেওয়া বন্ধ করছে না। লেফটেন্যান্ট মুক আসলে এই জায়গাটার নীরবতার সঙ্গে লড়ে যাচ্ছে। কিন্তু এই লড়াইটা একেবারে অর্থহীন। ওর নির্দেশ, সৈনিকদের গান সব কিছুই ফিকে হয়ে যাচ্ছে এই জায়গাটার নৈঃশব্দ্যের সামনে।

সৈনিকেরা বাড়িটার সামনে পৌঁছে যাবার পরে ফাইনহালস দূর থেকে প্রথম গাড়িটার শব্দ পেল। আগের দিন যে শহর থেকে তারা এখানে এসে পৌঁছেছে, গাড়িটার শব্দ সেদিক থেকেই আসছে। ফাইনহালস চমকে উঠে রাস্তার দিকে দূরবীনটা তাক করল। একটা ধুলোর মেঘ এগিয়ে আসছে দ্রুতগতিতে। ড্রাইভারের কেবিনটা বোঝা যাচ্ছে। গাড়িতে ওটা অতিকায় কী রাখা আছে? গাড়ির ছাদ ফুঁড়ে উঁচু হয়ে আছে ওটা কী যন্ত্র?

(চলবে)

ধারাবাহিক - শ্যামাপ্রসাদ সরকার





















(৭)

অন্নসত্রের বিপুল জনারণ‍্যে গোলকপতি আজ নিজেকে বড় অসহায়ের মত দাঁড়িয়েছিল।

এবারে অতি ধীর পদে সে রানীমার দানশিবিরের দিকে এগোতে এগোতে ভাবছিল যে, তার পূর্বজরা গৌড়ের রামকেলির কাছে অধিষ্ঠিত যে গয়েশ্বরী বা গৌড়েশ্বরীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এই নবাবহাটের মন্দিরটিও যেন তার অনুকৃতি। তবে জনশ্রুতি এই যে মন্দিরের উপাস‍্য মাতৃকামূর্তিটিই নাকি একদা ওদের 'সেন'বংশেরই উপাস্যা ছিলেন।

এই গৌড়েশ্বরী দেবী শবারূঢ়া, খড়্গ, নরমুণ্ড পানপাত্রধারিণী রূপে অধিষ্ঠিতা হলেও এইপ্রজন্মে এসে দেবী যেন তার প্রতি আজীবন বিরূপ, বিমুখ ও অখুশি । তবে এ ব‍্যাপারে ওর নিজের কাছেও আজন্মলালিত অপরাধবোধটির সম্পর্কে সম‍্যক ধারণা না থাকার জন‍্য তাকে শুধুই ভাগ‍্যপীড়িত হয়ে থাকতে হচ্ছে।

ভীষণ মনে পড়ছে যে আচার্য‍্য সর্বজ্ঞ শাস্ত্রী তাকে মাঝেমধ‍্যে ভীষণ অপত‍্যস্নেহে 'কুন্ডলিনীতন্ত্রে'র এক একটি অধ‍্যায় খুলে ব‍্যাখ‍্যা করে তার জ্ঞানচিকীর্ষার প্রাবল‍‍্যটিকে বেশ উস্কে দিতেন।

তেমনই এক নির্জন চৈত্রের দুপুরে তাকে সর্বজ্ঞ শাস্ত্রী সেই দেবীমাহাত্ম‍্য বড় মধুরভাষণে বর্ণনা করে বলে উঠেছিলেন,

- " জেনে রেখ বাবা ! কালী ও উগ্রতারা উভয়েরই সাথে সাদৃশ্য আছে এই গৌড়েশ্বরী পরমা মাতৃকা রূপের। আর এই শক্তিপীঠের বিশেষত্বটি হল যে এখানে নারীগণই কেবল একটি যোনি আকৃতির কুণ্ডে তাদের পূর্বসূরীদের তর্পণ করতে পারেন। এই প্রথা একান্তভাবেই বাঙালির মাতৃতান্ত্রিক সমাজের অনুসারী। যদিও পূজ‍্যপাদ বল্লাল সেনের পুত্র মহামহিম লক্ষ্মণসেন পরবর্তীকালে সহজযানী বৈষ্ণব ভাবনার রূপকার ও 'ব্রহ্মক্ষত্রিয়' পথের দিশারী, হলেও তিনি যদি তাঁর কূলধর্মকে যদি সামান‍্যতম অসম্মান করতে জানতেন তাহলে তাঁর সভাতেই সেদিন কবি জয়দেব বিষ্ণুর অন‍্যতম অবতার ভগবান বুদ্ধের বন্দনা রচনার সাথে আদিপ্রকৃতি বা শক্তিরূপিণী শ্রীরাধার চরণাশ্রিত কৃষ্ণের লীলাবর্ণনা করে এত খ‍্যাতি লাভ করে উঠতে পারতেন না!" তারপর একটু থেমে সেই বৃদ্ধ পন্ডিত ও সাধক তাঁর গম্ভীর ভাষ‍্যে তার উদ্দেশ‍্যে বলতে থাকেন -

" শোন গোলকপতি, জানবে কূলধর্ম অস্বীকারে কোন দিন কেউই কখনো অভীষ্টলাভ করে উঠতে সক্ষম হয়নি। যদিও ভাগ‍্যবিপর্যয়ে তুমি বিবাহবহির্ভূত এক 'মধুরতি'র জাতক হলেও আদতে রক্তের উত্তরধারায় তুমিও যে একজন ' সেন' বংশধর!.. সেকথা যেন কখনও বিস্মৃত হয়ও না...জানবে স্বয়ং দেবী চাইলে একদিন তিনি তোমার বা তোমার কোনও বংশধরের নামে তার বক্ষের রক্তচর্চিত প্রসাদী ১০৮টি বিল্বপত্রের অর্ঘ‍্য গ্রহণ করবেন! তা সে যতই তোমার অধস্তন পুরুষে এসে সংঘটিত হলেও...এটাই দৈবনির্দিষ্ট!

আর সেদিন সেই রক্তের অঞ্জলিটি দেবেন এক নারী'ই। আহা! মাতৃকাযন্ত্রের গূহ‍্য উপাচারে নারীর স্পর্শই যে পরমকাঙ্খিত হে.... "!

আবার গলার স্বর একটু নীচে নামিয়ে বৃদ্ধটি তাকে স্পর্শ করে বলেছিলেন - " দেখ! নক্ষত্রসমাবেশ দেখে আমি এসবের যেটুকু জানি আজ তোমাকে অগ্রিম কেবল জানিয়ে রাখলাম মাত্র! "

.....

আজ নবাবহাটের অন্নসত্রে দাঁড়িয়ে গোলকপতি বুঝতে পারে যে তার ভাগ‍্য তাকে অজস্র বঞ্চনার পথে এগিয়ে দিলেও তার কূলদেবী গৌড়েশ্বরীর অলক্ষ‍্য লীলায় আজ সে এক যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। সে কিছুতেই ভুলতে পারছেনা যে একজন 'বল্লালী' হয়েও আজ বর্ধমানের রাণীমার কাছে দাঁড়ানো নিছক এক জীবিকা প্রত‍্যাশী নিছক অসহায় 'ভঙ্গকূলীন' নয়!

.........

অন্ন ও অর্থ প্রত‍্যাশীদের ভীড় একটু হাল্কা হলে সে এতক্ষণে দ্বিধাজড়িত পায়ে রাণীমার কাছে এসে মাথা নীচু করে খানিক দাঁড়িয়ে থাকে। গোলকপতি অতি কন্দর্প‍্যকান্তি যুবাপুরুষ না হলেও তার স্বাস্থ‍্য মজবুত ও দেহবর্ণটি ঈষৎ পিঙ্গলবর্ণের।

তার মুখশ্রীটি তাকে সাধারণ‍ বর্ধমানবাসীদের থেকে খুব সহজেই আলাদা করে দেয়। অন‍্যপ্রান্তে রাণীমাও সেই সুদূর পঞ্জাব প্রদেশের জাতিকা বলে বঙ্গালে এসেও বিবাহপরবর্তী আর পাঁচটা আদবকায়দার সাথে তাঁর মুখে 'বঙ্গালী' লবজের সাথে ফেলে আসা পঞ্চনদের তীরের সুবিস্তৃত সেই স্বর্ণবর্ণী শস‍্যক্ষেত্রের এক আশ্চর্য সংমিশ্রণ ঘটেই যায়।

গোলকের আচরণে একটা জড়তার আবহ মহারাণী বিষণকুমারীকে একটু বিস্মিত করল। সাধারণ কৃপাপ‍্রার্থীদের জড়তা এটা নয়। যেন একটি স্বপ্নময় আধারকে কেউ যেন খামখা বলপূর্বক এক অজাচিত জীবনপ্রবাহে বন্দী করে রাখলে যেমন তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে, এই যুবকটির বহিরঙ্গে যেন তারই ছায়া দেখতে পেলেন।

.....

নির্বোধ, শঠ, অনুগত ও নিস্পৃহ এই চারটি চরম স্বভাবের মানব চরিত্র তিনি তাঁর সুদীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় আজকাল বড় সহজেই নির্ণয় করে উঠতে পারেন এমনকি সেই ক্ষমতার জোরেই তিনি নিজের পুত্র ও বর্তমানে বর্ধমানরাজ মহারাজ তেজচন্দ্রের সম্ভাব‍্য খল-পরিকল্পনাগুলির বিষয়ে ঠিক আগে থেকে বুঝে যান বলে স্বয়ং তেজচন্দ্রও সরাসরি তাঁর বিরুদ্ধে দ্বৈরথে নামতে পারেন না ও আড়াল থেকে কেবল নানা কলকাঠি নেড়েই ক্ষান্ত হন।

রাণীমা অন‍্য সব কৃপাপ্রার্থীদের কিছু মোহর আর বহুবিধ শস‍্যসামগ্রীর সিধাটি নিয়ে সবাইকে এবার মন্দিরের প্রসাদ গ্রহণের জন‍্য অনুরোধ করলেন, কেবল গোলকপতির দিকে তাকিয়ে তাকে ইশারা করলেন এই ভীড় হাল্কা হওয়া অবধি আর একটু অপেক্ষা করতে। উনি বুঝতে পেরেছেন যে এই যুবাটি নিছক তোষাখানার কিছু দানসামগ্রীর লোভে এখানে দাঁড়িয়ে নেই।

উনি নিজে যুবাটিকে ইশারা করতেই যখন গোলকপতির দৃষ্টিতে একটা স্বস্তির পরিবর্তন দেখতে পেলেন তখন তিনিও তাঁর আন্দাজটি যেন সঠিকভাবে পেয়ে একটু আশ্বস্ত হলেন।

তাহলে এই ছেলেটি কি তেজচন্দ্র বা ইংরেজদের কাছ থেকে এমন কোন গোপন খবর পেয়ে নিশ্চয় তাঁকে জানাতে এসে কিছু পারিশ্রমিক বা সুযোগ পাওয়ার অপেক্ষায় আছে!