ধারাবাহিক - শ্যামাপ্রসাদ সরকার







উৎসর্গ - সব প্রজন্মের অতীতচারণে আগ্রহীদের


(১)

রাজা রাজবল্লভ সেনকে বঙ্গালের মানুষ আজ ভুলতে বসেছে। যে সাম‍্রাজ‍্য একদিন গৌড়-বঙ্গের ইতিহাসকে দাপট ও কৃতিত্বের সাথে শাসন করে গেছে সে বংশের বংশধরকে এত অপমান কেন সইতে হবে? জন্মগত রাজনীতি বা কুলাচার নাহয় তাকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারে, কিন্তু তাই বলে তার জন্মদাত্রী তনয়ারানী তো কোন দোষ করেনি সেদিন। আজ তাকে দোষ দিতে গেলে দোষ দিতে হবে জীবতত্ত্বের সৃষ্টির সহায়ককারী সেই যৌবনকুসুমকেই। নইলে

রাজা রাজবল্লভ সেনের এক বংশজকে আজ এত অপমান সহ‍্য করতে হত কি।

এইসব ভাবতে ভাবতে গোলকপতি নদীর পাড় দিয়ে আনমনে হেঁটে আসছিল। এই বঙ্গাল দেশে নদী তো আর নিছক কম নেই। এই তো! ওদের গ্রামের পশ্চিমে বইছে পদ্মা নদী, আবার উত্তর ও পূর্বে ধলেশ্বরী নদী এমনকি দক্ষিণে গেলে দেখা যাবে প্রখ‍্যাত আড়িয়াল খাল ও মেঘনা নদীর সংযোগস্থল। আবার গ্রামের মোড়ল বা প্রবীণদেরকেউ কেউ বলে কালিগঙ্গা নদী নাকিও আগে এ অঞ্চলের মাঝখান দিয়ে একেবারে প্রবাহিত হত।

সেসব কথার আজ আর ওর কাছে কোন দাম নেই। ওকে এখন এই মুলুক ছেড়ে পালাতে হবে এটাই যেন পূর্ব নির্ধারিত। তাই আজ ওর মন একদম ভাল নেই। ইদানীং তার সাথে চকমাণিকপুরের এক আড়তদারের সাথে বেশ ভাব হয়েছে। সে লোকটি ও আজকাল সর্ষেস। ভিন্ন তৈলবীজের পাইকারী ব‍্যবসায় বেশ কৃতী। এখন দেশে ইংরেজের শাসন পত্তনের সময় থেকেই বর্ধমান নামের এই দামোদরতীরস্থ জনপদের খুব বাড় -বাড়ন্ত। তাই সেখানেই তাকে আসতে লিখেছে।

অবশ‍্য অনেক আগে মোগল-পাঠানদের আমলে এই বর্ধমানের নাম লোকের মুখে মুখে ফিরত। তবে তা যতটা আদিগন্ত কৃষিক্ষেত্রের অপর্যাপ্ত ভান্ডারের জন‍্য আর ততটাই শের আফগানের সুন্দরী বৌ তথা পরে হিন্দুস্তানের সম্রাজ্ঞী নূরজাহান বা মেহেরুন্নিসার জন‍্য। জাহাঙ্গীরের আমলে সবাই এই অঞ্চলটিকে জাহানাবাদ সংলগ্ন তালুকের পরিচয়ে একডাকে চিনত।

যদিও অতকিছু জেনে তার আর কোন লাভ নেই। সে এখন ভাল করেই বুঝে গেছে যে তার ভগ্নপ্রায় চালা ঘরে বাবুদের লেঠেলরা আগুন লাগাতে আর বেশী দিন অপেক্ষা করবে না । তার সাথে সে এও বুঝে গেছে যে নিছক এক চাকরানীর গর্ভে সে উৎপন্ন হয়েছে সুবিখ‍্যাত সেন বংশের এক দূরাচারী ও লম্পট রাজপুরুষের নিছক খামখেয়ালের বশে।

যদিও রাজানুগ্রহে সেই গর্ভাধানের মূল‍্যের মাসোহারাটি মৃত‍‍্যুর দিন অবধি তার মাতা রাজকোষ থেকে পেয়ে এসেছে। তবে মাতার মৃত‍্যুর পরেও গোলকপতি সেই অর্থ বা রাজন‍্য কূলের বংশমর্যাদা চাওয়ার স্পর্ধা দেখালে সে জেনে গেছে তার অনন‍্য পুরষ্কার হবে জীবন্তদেহে রাজবন্দী অবস্থায় সৎ ভ্রাতৃবর্গ তথা বর্তমান রাজশক্তির হাতে অগ্নিদগ্ধ হয়ে পুড়ে মরা।

No comments:

Post a Comment