ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত





















২২


লেফটেন্যান্ট গুঁড়ি মেরে এগিয়ে আসে। ফিসফিস করে… ‘কী ব্যাপার?’

ফাইনহালস থাবড়ে থাবড়ে দেখে। বুঝতে পারে… রক্ত। নাহ… ওয়াইন নয়। রক্ত। সে হাত সরিয়ে নিয়ে নরমভাবে বলে… ‘আমার মনে হচ্ছে ও আর বেঁচে নেই। পিঠে একটা বিশাল ক্ষত… রক্তে মাখামাখি… আচ্ছা, আপনার কাছে ল্যাম্প বা টর্চ আছে?’

‘থাকলেও কি এখন সেটা জ্বালানো উচিত?’

‘তাহলে ওকে তুলে নিয়ে মাঠের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে…’

‘ওয়াইন…’ বলেন লেফটেন্যান্ট… ‘এত ওয়াইন! কেসটা কী? লোকটা কী করবার চেষ্টা করছিল?’

‘মনে হয়… ক্যান্টিনের জন্য’…

ফিঙ্ক খুব একটা ভারি নয়। গুঁড়ি মেরে, বুকে হেঁটে ওকে নিয়ে আসে ওরা ঘাসজমির উপর দিয়ে। আলের উপরে একটু আবছা আলোকিত জায়গায় ওকে শুইয়ে দেয়। পিঠের জায়গাটা রক্তে কালো হয়ে আছে। ফাইনহালস সাবধানে ওকে পাশ ফিরিয়ে দেয়। এই প্রথম সে তার মুখটা ভালভাবে দেখতে পায়। একটা সরু, নরম ,মায়াময় মুখ। এখনও ঘামে ভেজা। ঘন কালো চুলের গুচ্ছ কপালে লেপটে আছে।

‘হে ভগবান!’ ফাইনহালস বলে…

‘কী হল?’

‘ওর বুকে লেগেছে। শরীরের সামনে। একটা হাতের মুঠোর আকারের ফুলকি ঢুকে গেছে…’

‘বুকে?’

‘একদম। কারণ বোধহয় ও স্যুটকেসের উপরে হাঁটু মুড়ে রেখে তারপর হামাগুড়ি দিয়ে এগোচ্ছিল।’

‘সাঙ্ঘাতিক বেনিয়ম!’ বলে উঠলেন লেফটেন্যান্ট। তবে বোধহয় নিজেরই ভাল লাগল না এইসময় এমন রসিকতা। তাই তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন… ‘ওর পে বুক আর আইডেন্টিটি কার্ড বের করে নিন ।’

ফাইনহালস সাবধানে ওর রক্তে ভেজা শার্টের বোতাম খুলে হাতড়াতে গিয়ে ওর হাতে একটা রক্তে ভেজা ধাতব টিনের টুকরো উঠে এলো। বাঁদিকের পকেটে পে বুক ছিল। সেটা পরিষ্কার। কোনও দাগ লাগেনি তাতে।

‘দুত্তোর!’ পেছন থেকে লেফটেন্যান্ট বলে উঠলেন… ‘স্যুটকেসটা ভয়ানক ভারি… এখনও বেশ ভারি।’ তিনি সারা রাস্তা ভাঙ্গা স্যুটকেসটা আর ফিঙ্কের রাইফেলটা টেনে হিঁচড়ে নিয়ে এসেছেন।‘ওর জিনিসপত্র পাওয়া গেল?’

হ্যাঁ… বলে ফাইনহালস।

‘এগিয়ে চলুন!’ লেফটেন্যান্ট স্যুটকেসটা ঠেলতে ঠেলতে এগিয়ে নিয়ে আসেন বাঙ্কারের মুখের কোণ অবধি। তারপর ফাইনহালসকে ফিসফিস করে বলেন… ‘দেওয়ালের পেছনে স্যুটকেসটা একটু ঠেলে দিন।’ ফাইনহালস তাই করে। লেফটেন্যান্ট হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে আসেন। ফাইনহালসও এগিয়ে আসে। দেওয়ালে ঠেসান দিয়ে তারা দুজনে উঠে দাঁড়াবার মত জায়গা পায়।মুখোমুখি দাঁড়ায় তারা। দূরে খড়ের গাদা থেকে জ্বলে ওঠা আগুনের আভার আলো যথেষ্ট পরস্পরকে চিনবার জন্য।তারা এক মুহূর্ত তাকায় একজন আরেকজনের দিকে।

‘আপনার নাম কী?’ প্রশ্ন করেন লেফটেন্যান্ট।

‘ফাইনহালস।’

‘আমার নাম ব্রেশট… বলে লেফটেন্যান্ট অদ্ভুত অপ্রস্তুতভাবে হেসে ওঠেন… ‘আমার স্বীকার করা উচিত যে আমার ভীষণ তেষ্টা পেয়েছে।’ তিনি স্যুটকেসের উপরে ঝুঁকে পড়েন। এক বোঝা ঘাসের স্তুপের উপরে টেনে নিয়ে আসেন ওটা। স্যুটকেসটা খুলে সাবধানে একটা অক্ষত ছোট বোতল বের করে নিয়ে আসেন তিনি… ‘হা ঈশ্বর! টোকাইয়া!’

লেবেলটা রক্তে আর ওয়াইনে ভিজে মাখামাখি।ফাইনহালস লক্ষ্য করল যে লেফটেন্যান্ট ভাঙ্গাচোরা কাচের টুকরোগুলোর মধ্য থেকে পাঁচ ছ’টা বোতল আলাদা করে বেছে রাখছেন। সেগুলো অক্ষত। নষ্ট হয়নি। ব্রেশট নিজের পকেট থেকে ছোট ছুরি বের করে একটা বোতল খুলে ফেলে এক ঢোঁক গলায় ঢালেন।

‘অসাধারণ!’ বলে বোতলটা এক পাশে নামিয়ে রাখেন।

‘আপনি নেবেন নাকি একটু?’

‘ধন্যবাদ!’ বলে ফাইনহালস বোতলটা নিয়ে এক ঢোঁক পান করে। স্বাদটা তার কাছে একটু বেশি মিষ্টি বলে মনে হয়। বোতলটা ফিরিয়ে দিয়ে সে আবার বলে ওঠে… ‘ধন্যবাদ!’

গ্রামের উপরে আবার গ্রেনেড আছড়ে পড়ে। যদিও এবার অনেকটা দূরে। হঠাৎ তাদের সামনে কোথাও থেকে মেশিন গানের শব্দ ভেসে আসে গ্রেনেডের জবাবে।

‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ!’ বলেন ব্রেশ্‌ট… ‘এরা এখনও আছে। আমি তো ভাবলাম…’ খালি বোতলটা ঢালু জমিতে গড়িয়ে দেন তিনি… ‘আমাদের এই দেওয়ালটা টপকে বাঁ দিকে যেতে হবে।’

খড়ের গাদাটা দাউদাউ করে জ্বলছিল। গাদাটার নিচের স্তরটা যেন গলে যাচ্ছে আগুনে। ফুলকি উড়ছে চারদিকে।

‘আপনাকে দেখে মনে হয় বেশ জ্ঞানগম্যি আছে।’ বলে ওঠেন লেফটেন্যান্ট।

ফাইনহালস কোনও জবাব দেয়না।

‘মানে বলতে চাইছি যে…’ বলে লেফটেন্যান্ট দ্বিতীয় বোতলটার ছিপি খুলতে শুরু করেন… ‘মানে… এই যুদ্ধটা যে একদম জঘন্য, যাচ্ছেতাই ব্যাপার, সেটা বোঝবার মত যথেষ্ট জ্ঞানগম্যি আছে আপনার!’

ফাইনহালস কোনও জবাব দেয়না।

‘আমি যখন বলছি যে এটা জঘন্য, বিশ্রী যুদ্ধ… তার মানে… যে যুদ্ধ আপনি জিতে যাবেন, সেটা জঘন্য নয়… আর এটা… মানে, এটা একেবারে ভীষণ বিশ্রী, জঘন্য যুদ্ধ!’

‘হ্যাঁ’… বলে ওঠে ফাইনহালস… ‘এটা খুব, খুব খারাপ যুদ্ধ!’ অদূরে মুহুর্মুহু মেশিনগানের শব্দে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত বোধ করছিল সে।

‘মেশিনগান কোথায় বসানো হয়েছে?’ সে নরম ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করে।

‘এই দেওয়ালটা যেখানে শেষ হয়েছে… একটা খামার আছে। মেশিনগানগুলো তার পেছনে বসানো হয়েছে।’

মেশিনগানের গোলাগুলি চলতেই থাকে। তারপর একটু চুপচাপ। আবার রাশিয়ান দিক থেকে গুলির শব্দ আসে। জার্মানরা প্রত্যুত্তরে আরও কিছু গুলি ছোঁড়ে। চাপান উতোর চলতে থাকে। হঠাৎ সব একদম চুপচাপ হয়ে যায়।

‘জঘন্য!’ বলে ওঠেন লেফটেন্যান্ট।

খড়ের গাদাটা ধীরে ধীরে একদম ভেঙ্গে পড়ে যাচ্ছে। এখন আর ফুলকি উড়ছে না সেভাবে। হাল্কা একটু পড়পড় শব্দ হল… চারদিক অন্ধকারে ঢেকে গেল। লেফটেন্যান্ট ফাইনহালসের দিকে বোতলটা একবার বাড়িয়ে দিলেন। ফাইনহালস মাথা নাড়ল… ‘নাহ, ধন্যবাদ, আমার একটু বেশি মিষ্টি লাগছে।’

‘আপনি কি অনেকদিন ধরে রয়েছেন সেনাবাহিনীতে?’ প্রশ্ন করলেন লেফটেন্যান্ট।

‘হ্যাঁ’… বলে ফাইনহালস… ‘চার বছর।’

‘হা যীশু!’ বলেন লেফটেন্যান্ট… ‘মুশকিল হল যে আমি আবার সেনাবাহিনী সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানি না। হাতে কলমে অন্তত নয়। কাজেই উল্টো কথা বলা আপনার সামনে অন্তত অর্থহীন। দু বছরের একটা ট্রেনিং হয়েছিল নাইটফাইটারের… রাষ্ট্র আমার ট্রেনিংএ যা খরচ করেছে, তাতে একটা পরিবারের মাথা গোঁজবার ঠাঁই ভালভাবে হয়ে যেত। তবে কিনা আমায় সেনাবাহিনীর একটা শূন্যপদ পূর্ণ করতে হল, যাতে জীবনের প্রতিটি শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে অবশেষে ভালহাল্লা*তে আমার ঠাঁই পাকা করে নেওয়া যায়… যাচ্ছেতাই… তাই না?’ তিনি সমানে টোকাইয়া পান করতে থাকেন।

ফাইনহালস কিছুই বলেনা।

‘আপনি কী করবেন, যখন আপনার প্রতিপক্ষ আপনার চেয়ে শক্তিশালী?’ লেফটেন্যান্ট একঘেয়ে সুরে ঘ্যানঘ্যান করে বলে যান… ‘দু’দিন আগে আমরা এই জায়গা থেকে বিশ কিলোমিটার দূরে ছিলাম। তখন বলা হল যে, আমরা কোথাও যাচ্ছিনা। কিন্তু তারপর আমরা হাল ছেড়ে দিলাম। এইসব নিয়মকানুন আমি খুব ভাল জানি। এর অর্থ হল যে জার্মান সৈনিক যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে নড়বে না, জান দেবার দরকার হলে জান দেবে… এরকম ব্যাপার। কিন্তু বাপু, আমি তো আর বোবাকালা নই… কী করা উচিত… বলতে পারেন আপনি?’ তিনি গম্ভীরভাবে জিজ্ঞেস করেন… ‘আমাদের কী করা উচিত?’

‘হয়তো পালিয়ে যাওয়া উচিত’ ফাইনহালস বলে।

‘অসাধারণ’… বলেন লেফটেন্যান্ট… ‘চলুন পালাই… অসাধারণ!’ তিনি নরমভাবে হাসেন… ‘আমাদের যুদ্ধের এইসব প্রুসিয়ান নিয়মকানুনের মধ্যে একটা বিরাট গলদ হল যে পিছু হটবার কোনও ট্রেনিং দেওয়া হয়না। সেই জন্য নিজেদেরই এই সব কায়দাকানুন অভ্যেস করে রাখতে হবে। পিছু হটা নয়, শুধু প্রতিরোধ গড়ে তোলার কথা বলা আছে। কিন্তু এখন আর এই কমরেড ভাইবেরাদরদের আটকে রাখা যাবেনা। ছাড়ুন!’ তিনি কথা বলতে বলতে কোটের পকেটে দুটো বোতল ঢুকিয়ে নেন।‘চলুন, আমরা আবার এই অতি সুন্দর যুদ্ধের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ি।’

‘হা ঈশ্বর!’ তিনি আবার বলে ওঠেন… ‘বেচারা ওয়াইন নিয়ে এসেছিল এইখানে… আহা বেচারা!’ ফাইনহালস নিঃশব্দে লেফটেন্যান্টকে অনুসরণ করতে থাকে। দেওয়ালের সামনের দিকে কোণ অবধি পৌঁছাবার আগে শুনতে পায় অনেক মানুষের পায়ের শব্দ। কারা যেন দৌড়ে এদিকে আসছে। পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে পায়ের শব্দ। খুব কাছে। লেফটেন্যান্ট লাফ দিয়ে নিজের মেশিনগান বাগিয়ে ধরেন বগলের নিচে। ‘আমার মনে হয় শীগগির বুকের মধ্যে আঠেরো পেনির মাপের সিসের দানা অর্জন করতে চলেছি আমরা’ তিনি ফিসফিস করেন… কিন্তু ফাইনহালস দেখতে পায় যে তিনি কাঁপছেন।

(চলবে)

*ভালহাল্লা- বেহশ্‌তে যাওয়া অথবা বিশেষ হল অফ ফেমে যাওয়ার সঙ্গে সমার্থক।

No comments:

Post a Comment