প্রবন্ধ - অনিন্দিতা মণ্ডল




মহাকাল। দেবাদিদেব। এত যে বিশেষণ সে সবই এমন একজনের উদ্দেশ্যে যিনি কিনা ছিলেন এক অনার্য দেবতা। বনে জঙ্গলে শ্মশানে মশানে যার অবস্থিতি। জঙ্গলের আরণ্যক মানুষ ও পশু সমভাবে তাঁর কাছ থেকে বরাভয় লাভ করেছে। পরনে বাঘছাল আর গায়ে চন্দন নয়, শ্মশানের ছাই মেখে তিনি যথেচ্ছ ভ্রমণশীল। তাঁর কোনো নির্দিষ্ট স্বর্গ নেই। সভ্য নাগরিক জীবনে তিনি ব্রাত্য। তাঁকে বেদ মানে না। আর্য ঋষিদের যজ্ঞের অনুষ্ঠানে তাঁর নামে ‘স্বাহা’ আহুতি নেই। বলতে গেলে তিনি আমাদের ‘মূল নিবাসী’ দের একচ্ছত্র ঈশ্বর।

এই আহুতি আমাদের পূর্বপুরুষদের অপরাধভঞ্জনের আহুতি।

শুরু করা যাক প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে। সিন্ধু সভ্যতার খননকাজ চলছে। মাঠ পরীক্ষায় উন্নত নগর জীবনের অভূতপূর্ব সব নিদর্শন উঠে আসছে। আমাদের চমকিত করে উঠে আসছে অতি উন্নত নিকাশী ব্যবস্থা। উন্নত পয়ঃপ্রণালী, সেচ ব্যবস্থা, নগরের স্থাপত্য, সব কিছুর মধ্যেই আমাদের সভ্যতার গর্বকে চূর্ণ করার আয়োজন। এই সব নিদর্শনের মধ্যে উঠে আসছে মাটির পুতুল, খেলনা গাড়ি, খেলনা হাতি, চালখেলার ছক ইত্যাদি। আর আসছে মুদ্রা ও ভাস্কর্য। লৌহ যুগ তখনও দূরে। সেই ভাস্কর্যের মধ্যে দেখা যাচ্ছে পশু পরিবেষ্টিত এক মহিমাময় পুরুষ। পশুপতিনাথ। বেদ সম্ভবত তখনও উত্তর পশ্চিমের অক্ষু নদী ও হিন্দুকুশের মধ্যবর্তী অঞ্চলে গুটিকয় যাযাবর নৃশংস শিকারি সম্প্রদায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তখনও একেশ্বরবাদ বহু দূরের গল্প। শুধু প্রাকৃতিক শক্তির পূজা চলছে। বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে কোন্দল অব্যাহত। এক এক গোষ্ঠীর নেতা ইন্দ্র নামে নেতৃত্ব দিচ্ছে। তাদের নিয়মনীতির বালাই নেই। তারা সমৃদ্ধ গ্রাম জনপদ নগর দেখলেই আক্রমণ করে, শস্য লুঠ করে নারী নির্যাতন শিশুহত্যা কিছুই বাদ যায় না। বেদ তাদের পরিচয় দিচ্ছে ‘পুরন্দর’। যিনি পুরকে ধ্বংস করেন। এই লুন্থন এই চৌর্যবৃত্তি মহিমাময় আকার নিলো। ওদিকে আরণ্যক মানুষেরা ভীত। অরণ্যকে দ্রুত গ্রাস করছে এক একটি গোষ্ঠী। উপায়? বৃক্ষতলে পূজিত দেবদেবীকে তারা দক্ষিণ পশ্চিমে সিন্ধুর সমৃদ্ধ নাগরিক রাজ্যগুলিতে দান করতে শুরু করল। আমরা দেখতে পেলাম আরণ্যক দেবতা পশুপতিনাথ নগরে আরাধিত হতে শুরু করলেন। নিপুণ শিল্পীর হাতে আমরা সেই মূর্তির উৎকৃষ্ট শৈল্পিক রূপ দেখতে পাই। জানতে পারি আরণ্যক দেবতা কেমন করে নগরের দেবতা হয়ে উঠলেন। এই আশ্রয় ও সহমর্মিতার মধ্যেই দেখতে পাই একটি ধর্মীয় সমন্বয়। মহাকাল নিশ্চয় তখন তাঁর ভস্মে ঢাকা শরীর নিয়ে কপালে চাঁদের কণাকে ধরে রেখে মুচকি হেসেছিলেন। ‘কাল’কে কে জানে? কাল পরম গতি। আজ যা বর্তমান কাল তা অতীত আবার আজ যা বর্তমান গতকাল তা ভবিষ্যৎ ছিল। একমাত্র ‘মহাকাল’ এই রহস্য জানেন। তাতেও কি তাঁকে গ্রহণ করতে পারে উত্তরের বর্বর যাযাবরেরা? অগ্নিহোম যাদের আরাধনা অনুষ্ঠান, যারা আরণ্যক মানুষ ও বনের পশুর প্রাণের তোয়াক্কা করেনা তারা কী করেই বা এই অরণ্য দেবতাকে, যিনি অগ্নিযজ্ঞ মানেন না তাঁকে গ্রহণ করবে?

কীভাবে মহাকাল পশুপতিনাথ শিবে পরিণত হলেন তা দেখার আগে একবার অন্যন্য ধর্মে তাঁর উপস্থিতি দেখে নিই।

সুমেরিয়ার দেবতা আদাদ। বুনো মহিষের পিঠে চেপে যেন যুদ্ধে যাচ্ছেন। আমাদের মহেশ্বরের সঙ্গে তাঁর আর কি কি মিল? যিনি ঝড়ের দেবতা, এবং একই সঙ্গে ধ্বংস ও সৃষ্টির দেবতা। দক্ষিণ সুমেরে তিনি ধ্বংসের দেবতা আবার উত্তরে তিনি কল্যাণময়। আদাদের পিতা ‘আনু’। অর্থাৎ ব্যোম বা শূন্য। ঠিক যেমন মহেশ্বর আরণ্যকদের কাছে কল্যাণময়, আর উত্তরের যাযাবর যাজ্ঞিকদের কাছে তিনি স্বয়ং মৃত্যু। এ থেকে বুঝতে পারা যায় প্রাচীন নদীমাতৃক সভ্যতাগুলির মধ্যে ধর্মীয় ও দার্শনিক আদানপ্রদান চলত।

একটি কাহিনী বলা যাক।

সতী মহাকালকে পতিত্বে বরণ করেছেন। কিন্তু চালচুলোহীন ভিখারি এক পুরুষের গলায় মালা? স্বর্গের দেবতা বা উত্তরের জাতির দেবতাদের কাছে তিনি ব্রাত্য আভিজাত্যহীন। তাই সতী তাঁর পিতৃগৃহে ত্যাজ্য হলেন। কীভাবে? সতীর পিতা রাজা দক্ষ এক যজ্ঞ করলেন। সেই যজ্ঞে সতীপতির নিমন্ত্রণ রইল না। এক তো তিনি অগ্নিহোম করে অরণ্যের ক্ষতি পছন্দ করেননা, ফলে যজ্ঞ পণ্ড হতে পারে, দ্বিতীয়ত তিনি স্বগোত্রীয় দেবতা নন। অন্য জাতে বিয়ে করে সতী মহা অন্যায় করেছেন। কিন্তু সংবাদ পেয়ে সতী উপস্থিত হলেন এবং রাগে দুঃখে অপমানে আত্মহত্যা করলেন। মহেশ্বর এলেন সেই সংবাদ পেয়ে। উপস্থিত দেবতারা তাঁকে ব্যাঙ্গ করলেন নিন্দামন্দ করলেন খুব। মহেশ্বর রুদ্র রূপ ধারণ করলেন। দক্ষের মাথা কাটা পড়ল। অগত্যা যজ্ঞ সম্পূর্ণ করতে ছাগমুণ্ড বসিয়ে যজ্ঞ শেষ করা হল। নটরাজ তখন প্রলয় নাচন নাচছেন। এই পৌরাণিক কাহিনীর অন্তরালে এক গভীর সত্য লুকিয়ে আছে। দক্ষ শিবহীন যজ্ঞ করেছিলেন। শিব, মহাকাল, পরম জ্ঞানের প্রতীক। তিনি ত্রিকালস্রষ্টা। তাঁকে ছাড়া যজ্ঞের অর্থ, দক্ষের পশুর মাথা। ছাগমুণ্ড। সেখানে কখনোই পরম জ্ঞানের আলো পৌঁছবে না।

আমাদের মনে রাখতে হবে, প্রাচীন আর্য যুগে কিন্তু একেশ্বরবাদ সেভাবে আসেনি। নানা দেবতার ছড়াছড়ি। দেবী নেই। কারণ আর্যরা নারীর মনুষ্যত্ব শিকার করেনা। উপনিষদের যুগে প্রথম একেশ্বরবাদের দর্শন। সমস্ত দেবতাদের উর্দ্ধে তিনি। তিনিই ব্রহ্ম, অবাংমানসোগোচর। তিনি আমাদের সমস্ত ইন্দ্রিয়কে নিয়ন্ত্রণ করেন। সমস্ত জগত জুড়ে তাঁর অস্তিত্ব অথচ তিনি আমাদের বাক্য মনের অতীত। এই উপনিষদের সময়কাল খ্রিষ্টপূর্ব সপ্তম অষ্টম শতক। এ সময়ে সিন্ধুর নগরের আর অস্তিত্ব নেই। এক অজ্ঞাত কারণে প্রলয় ঘটে গেছে। শূন্য নগরের ধ্বংসস্তুপে ইতস্তত মৃতদেহ ও ব্যবহৃত নানা বস্তু। সেই সব সিন্ধুনাগরিক মিশে গিয়েছেন বৃহৎ ভূমির নানাস্থানে। তাঁদের একটি বৃহৎ অংশ পরিযায়ী নাগরিকেরা বিন্ধ্য পেরিয়ে রাজমহল পেরিয়ে পুণ্ড্র অঞ্চলে বাসা বেঁধেছিলেন। ধীরে ধীরে শৈববাদ প্রাচীন আরণ্যক ধর্মের সীমা ছাড়িয়ে মিশে গেল মূল স্রোতে। এক সংকর জাতির উদ্ভব হলো সমগ্র জম্বুদ্বীপ (ভারতীয় উপমহাদেশ) জুড়ে। প্রাচীন বেদের কর্মকাণ্ড ছাপিয়ে তখন পূর্বের শ্রামনিক প্রভাব ও অনার্য প্রভাবে জন্ম হয়েছে এক নতুন দর্শনের। উপনিষদের শ্লোকে এই নবলব্ধ জ্ঞানের প্রকাশ। উপনিষদ তাই জ্ঞানকাণ্ড।

উপনিষদের ঋষি এই মহেশ্বরকে ‘রুদ্র’নামে ভূষিত করলেন।

একো হি রুদ্রো ন দ্বিতীয়ায় তস্থুর্য
ইমাঁল্লোকান্ ঈশত ঈশনীভিঃ
প্রত্যঙ্ জনাং স্তিষ্ঠন্তি সঞ্চুকোপালে
সংসৃজ্য বিশ্বা ভুবনানি গোপাঃ

(শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ – ৩/২)

বিগলিতার্থঃ রুদ্রই পরম মায়াবী, কারণ তিনি অদ্বিতীয়—ব্রহ্মবিদগণ দ্বিতীয় কারো আকাঙ্ক্ষায় ছিলেননা। সেই রুদ্রই এই সমুদয় লোককে স্বীয় শক্তিসহায়ে নিয়মিত করেন। তিনি অন্তর্যামী। তিনিই এই নিখিল বিশ্বের স্রষ্টা, পালক ও সংহারক।

ঋষি স্বীকার করছেন রুদ্র সকল দেবতাদেরও দেবতা। জগত কারণ, মহাকারণ। স্বীকার করছেন বেদ যাকে ব্রাত্য বলেছিল সেই মহাকালই আসলে জগত কারণ।

কিন্তু মহাকালের দুটি রূপ আছে। একটি সংহারক অন্যটি কল্যাণময় মঙ্গলদায়ক। যখন রোগে শোকে যুদ্ধে দুর্ভিক্ষে যখন জর্জরিত হই তখন সেই প্রলয়ঙ্কর মূর্তি। আর যখন শান্তম শিবম অদ্বৈতম, তখন তিনি মঙ্গলদায়ক। ঠিক যেমন মধ্যাহ্নের দিনমণি জগত দাহনের কারণ, আবার ঊষার বালার্ক জলরাশি সঞ্চয় করে বর্ষণ ঘটায়। শস্য ফলে। একটু দূরের কথা হলেও বলে নেওয়া দরকার, সেসময় বেদের ঋষিরা বিশ্বাস করতেন এ জগতের সৃষ্টির মূলে পুরুষ। বীর্য বা শুক্র। তাঁরা বলছেন, তদেব শুক্রম তদ ব্রহ্ম (ছান্দোগ্য)। বর্ষণের সঙ্গে সঙ্গে আকাশ থেকে বীর্য পাত হয় ধরিত্রীর বুকে। তাই শস্য ফলে ঠিক যেমন আমাদের সন্তান জন্মায়। শুধু পুরুষই সৃষ্টিকর্তা। নারী আধার মাত্র। কিন্তু সত্য তা নয়। নারীর ডিম্বাণুর সঙ্গে শুক্র নিষিক্ত হলে তবেই ভ্রূণের সৃষ্টি হয়। একথা ভারতের আদিবাসীরা জানতেন। তাই তাঁদের ধর্মে নারীর স্থান ওপরে।

উপনিষদ যখন রুদ্রের বন্দনা করছেন ঠিক তখনই এক ব্রহ্মবাদিনী নারী মহাকালের কাছে অন্য প্রার্থনা জানাচ্ছেন। ক্রন্দনরতা বিদুষী (মার্জনা করবেন, নাম জানতে পারিনি)

রুদ্র যত্তে দক্ষিণ মুখম, তেন মাং পাহি নিত্যম।

রুদ্র তোমার তেজ সংবরণ করো। তোমার কল্যাণময় রূপে প্রকাশ হও, আমি দেখি।

এই ব্রহ্মবাদিনীকে প্রণাম হই। কারণ তিনিই প্রথম রুদ্রকে শান্ত হতে প্রার্থনা করলেন। সশিব হতে প্রার্থনা করলেন। আর তার সঙ্গে মিশে গেল আর একটি গভীর গূঢ় শব্দ—অদ্বৈতম।

যতক্ষণ ভেদ ততক্ষণ মহাকাল রুদ্র। দুই থাকলেই রুদ্র। কিন্তু এক থাকলে অভেদ হলেই তিনি শিব। মঙ্গলময়। রবীন্দ্রনাথ তাই বলেছিলেন—শিব ঐক্যবন্ধনে।এখানে বন্ধনের পরিবর্তে আমরা শিব ঐক্য স্থাপনে ও বলতে পারি।

এই যে নারীকে সামাজিক মর্যাদায় নরের তুল্য করতে হল এ তো রুদ্রকে শান্ত করতেই!

এত কথার মূলে কীভাবে ‘শিব’কে বৈদিক ধর্মে স্থান দিতে হল তার ইতিহাস জানানো।

পরের অংশে দেখব এক উচ্চতর এবং জটিল দর্শনের সৃষ্টি হয়েছে। খৃষ্টীয় নবম শতকে কাশ্মীরে একদল শৈব আচার্যের আবির্ভাব হয়। ৮২৫ খৃষ্টাব্দে আচার্য বসুগুপ্ত এই তত্ত্বের প্রবর্তন করেন। যদিও বেদ একে প্রামাণ্য বলে স্বীকার করেনা। এই দর্শনকে বলে কাশ্মীরি শৈববাদ, বিশ্বের ভাষায় প্যান্থিজম।

কী আছে কাশ্মীরি শৈববাদে?

কাশ্মীরি শৈববাদ অনুসারে শিবের পাঁচটি মুখ। এই পাঁচটি মুখকে যথাক্রমে পরমশিব, শিবশক্তি, সদাশিব, সদাখ্যা, ও সদবিদ্যা বা ঈশ্বর তত্ত্ব বলে।

পরমশিব বা মহাকাল যিনি মহাকারণ, তিনি আপন আনন্দে নিরালম্ব অবস্থায় এই জগত সৃষ্টি করেন। পিতৃরেতঃকে আমরা সেই পরমশিব বলতে পারি। এ অবস্থায় প্রাণের যে বিশুদ্ধ অস্তিত্ব থাকে তাইই পরমশিব। এরপরে পরমশিব আবরণে প্রবিষ্ট হলেন। যাকে বলা হয়—শিবশক্তিতত্ত্ব।

শক্তি এই শরীর। নারী এই দেহের জন্মদাত্রী। তাই ভ্রূণের আবরণে প্রাণকে শিবশক্তিতত্ত্ব বলে। লক্ষ করার বিষয় হল, শিব ও শক্তি পৃথক অস্তিত্ব নয়। অভেদ অস্তিত্ব। অনেকেই শিবের অর্ধনারীশ্বর মূর্তি দেখেছেন। মূর্তির দক্ষিণ দিকে শিব ও বামে শক্তি মূর্তি। যোগের ভাষায় অবশ্য এর অর্থ লম্বিতভাবে দেহের দক্ষিণ অংশে ঈশ্বরীয় প্রকাশ ঘটে। আর বাম অংশ প্রকৃতি। দেহকে রক্ষা করছেন। দু’য়ে মিলে অর্ধনারীশ্বর। প্রতিটি মানুষ জীবিতকালে এই অর্ধনারীশ্বর রূপে পৃথিবীতে থাকে। মৃত্যুর পর প্রাণের যে চেতনাময় অস্তিত্ব তা আবার পরমশিবে রূপান্তরিত হয়। তাই প্রতি দেহে নর ও নারী সমভাবে বর্তমান। আধুনিক বিজ্ঞানও বলছে নরকে নারীতে বা নারীকে নরতে রূপান্তর সম্ভব। অর্থাৎ প্রচ্ছন্ন সম্ভাবনা না থাকলে এ অসম্ভব ছিল। প্রতিটি মানুষের মধ্যেই তাই এই শিবশক্তি সত্ত্বা বর্তমান।

সদাশিব শিবের সেই মুখ যখন তিনি শান্ত আনন্দে বর্তমান। এই জগত সৃষ্টি করে তার মধ্যেই বাস করছেন। যোগের ভাষায়, দেহে একটি সদা আনন্দের হিল্লোল থাকে। তাইই সদাশিব। শিব তখন লীলা করছেন। যোগক্রীড়া।

সদ্যাখ্যা তত্ত্ব একটি অদ্ভুত দর্শন। সমস্ত জগত জুড়ে যখন অভেদের সূত্রপাত ঘটে, যখন মানুষে মানুষে শিবের প্রকাশে মৈত্রী স্থাপন হবে তখন সদাখ্যা তত্ত্বের পূর্ণ প্রকাশ।

ঈশ্বর তত্ত্বে জগত শিবময়। প্রতিটি মানুষে তার ঐশ্বরীয় সত্ত্বার প্রকাশ ঘটবে। পূর্ণ অদ্বৈত।

কাশ্মীরে যখন এই অপূর্ব দর্শনের উদ্ভব ঘটছে তখন সারা ভারত জুড়ে বৌদ্ধ ধর্মের মহাযানী সম্প্রদায়ের দারুণ প্রভাব। মহাযান ধর্মে নাগার্জুন কল্পনা করেছেন আরও তিন বোধিসত্ত্বের। সবাই জানেন মহাযান মতে অসংখ্য বোধিসত্ত্ব। সেই মোট অনুসারে নাগার্জুন সৃষ্টি করলেন অমিতাভ বোধিসত্ত্ব অবলোকিতেশ্বর বোধিসত্ত্ব এবং মৈত্রেয় বোধিসত্ত্ব। অমিতাভ বোধিসত্ত্ব অমিতজ্যোতিস্বরূপ। জগত সৃষ্টির কারণ। অবলোকিতেশ্বর বোধিসত্ত্ব তিনিই যিনি পরম করুণায় জগতকে অবলোকন করছেন। মনে পড়ে, শিবের অর্ধনিমীলিত করুণায় আর্দ্র দুটি চোখ। মৈত্রেয় বোধিসত্ত্ব আর কাশ্মীরি শৈববাদের ঈশ্বরতত্ত্বে কোনো তফাত নেই। নাগার্জুনের এই তত্ত্ব যদিও প্রায় হাজার বছর আগেকার। তবু দর্শনের তত্ত্বে কেমন অদ্ভুত মিলে যায় দুটি পৃথক মত।

কেউ কেউ বলেন শিবমূর্তির চেয়ে শিবলিঙ্গ পূজা প্রাচীন। খুবই সম্ভব। কারণ যোনী থেকে উত্থিত লিঙ্গকে আমরা প্রায় সব শিবমন্দিরেই স্থাপিত দেখি। একমাত্র এই লিঙ্গপুজার ক্ষেত্রেই কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম নিষ্ঠা আচার বিচার নেই। পুরোহিতের প্রয়োজন পড়েনা। স্ত্রীপুরুষ নির্বিশেষে লিঙ্গের মাথায় দুধ ঘি মধু গঙ্গাজল ঢেলে আরাধনা করতে পারেন। প্রাচীন যুগে লিঙ্গকেই স্রষ্টা ভাবা হয়েছে। এ ভাবায় কোনো ভুল নেই। এই যে বিশ্বপ্রপঞ্চ, এর সৃষ্টিও সেই বৃহৎ লিঙ্গ থেকে। যোনী ব্রহ্মশক্তি। লিঙ্গ অর্থে অবশ্য চিহ্নও হয়। এই যে ধারনাটি প্রতীকে চিহ্ন ধারণ করেছে। মহামানব বলছেন—শিবপূজা কেন করে জানো? প্রার্থনা করে মানুষ, হে ঈশ্বর, আমায় যেন আর এই রক্ত নাল মুত্রের মধ্যে দিয়ে পৃথিবীতে আসতে না হয়। (শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস)। আরও গভীরে এর অর্থ এই হয় দেহ থেকে উত্থিত হয়ে যেন আর দেহে পুনরায় না মিশি। জীবন্মুক্ত হই। কাশ্মীরি শৈববাদেরও মূল তাই। জীবন্মুক্ত অবস্থায় ঈশ্বরতত্ত্বে অবস্থিতি। মৈত্রেয় বোধিসত্ত্বও তাই। জগতের প্রতিটি মানুষের প্রতি করুণা। কেন? কারণ এই জগতের প্রতিটি মানুষই আমি। শিব। অদ্বৈতের পূর্ণ প্রকাশ। তখন কে আর কাকে হিংসা করে? কে আর দেহে আবদ্ধ হয়?

জীবন্মুক্তির এই চিত্র আমাদের পরম প্রার্থনীয়। এ জীবনেই সেই আস্বাদ লাভ করতে হবে। নাহলে মহতী বিনষ্টি। এই যে প্রথমে পরমাত্মা (পরমশিব), তাঁর থেকেই এই দেহ (শিবশক্তিতত্ত্ব)। দেহ ও আত্মার মিলন যখন পরমানন্দের জন্ম দেয়, যখন এই দেহে ঈশ্বরীয় লীলার পূর্ণ প্রকাশ তখন সদাশিব। যখন সেই আনন্দে জগতের প্রতি প্রাণের সঙ্গে আত্মীয়তা বোধ হবে, এক অদ্ভুত ভালোবাসা জন্মাবে তখন সদাখ্যাতত্ত্ব। এবং অবশেষে—

সর্বভূতস্থম আত্মানম সর্বভূতানি য আত্মনি, সম্পশ্যন ব্রহ্ম, পরমং যাতি নান্যেন হেতুনা।

সবার মধ্যে যিনি নিজেকে এবং নিজের মধ্যে সকলকে দেখেন তিনিই ব্রহ্ম। তিনিই পরমকারণ শিব। তিনি সর্বকালে প্রকাশিত। ন ততো বিজুগপ্সুতে। তাঁকে গোপন করা যায়না। এইই ঈশরতত্ত্ব। তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ প্রকাশ মানুষে। পশুপতিনাথ মানুষের পাশবিক বৃত্তিকে সংহার করেন রুদ্র রূপে। আর তাকে ঈশ্বরে রূপান্তরিত করেন শিব রূপে।

তাই আর এক মহামানবের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়—জীবই শিব। এই নিবন্ধে সেই সত্য শিব সুন্দরের আরাধনা করি। তিনি আমাদের জাগতিক মায়া থেকে মুক্ত করুন। ঐক্য স্থাপন করুন। মানুষে মানুষে আত্মিক ঐক্য স্থাপিত হোক।

[সাহিত্য আর সংবাদ মার্চ ২০২১]

1 comment:

  1. ভালো লেগেছে। আরো হোক।

    ReplyDelete