প্রবন্ধ - ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়





















বর্ধমান রাজঅন্তঃপুর---
( শেষ পর্ব)

সংসার ত্যাগের পর রাধারাণী দেবী প্রথমে হরিদ্বার ও পরে বারাণসীর ’বর্ধমান হাউসে’ বাকী জীবন কাটান। যদিও সেখানে রাজবাড়ীর লোকজন, পাইকপেয়াদা,রাজকর্মচারীরা বা অন্যান্য সুযোগ সুবিধা ছিল, কিন্তু রাধারাণী দেবী সন্ন্যাসিনীর জীবনই বেছে নেন ও বাকি জীবন সেভাবেই কাটান। ১৯৭২ সালে এই রাণীর মৃত্যু হয়। রাজ অন্তঃপুরের অন্যান্য মহিষীরা যেমন রাণী ব্রজকীশোরী, বিষেণকুমারী (বা বিষ্ণুকুমারী) , কমলকুমারী ইত্যাদির মতো তাঁর জীবন রাজবৃত্তের মধ্যে না কাটিয়ে তিনিই এই পরিবাবের একমাত্র নারী যিনি এই রাজঐশ্বর্য্য, রাণীর বৈভবপূর্ণ জীবনের মায়া ত্যাগ করে সাধারণ সন্ন্যাসিনীর জীবন বেছে নিতে পেরেছিলেন ও সেই সাহস করেছিলেন। তাই বিজয়চাঁদ মহিষী রাধারাণী দেবী এক অনন্য নারী অবশ্যই বলা যায় এবং এই ঘটনাও এক অত্যাশ্চার্য্য ঘটনা বলা যায়।

মহারাজা বিজয়চাঁদের পর রাজা হন মহারাজা উদয়চাঁদ। মহারাজ উদয়চাঁদের বিবাহ হয়েছিল অমৃতসরের লালা ধুনিচাঁদ মেহরার কন্যা রাধারণি দেবীর সঙ্গে। তাঁর আমলেই রাজন্য প্রথা বিলুপ্ত হয় এবং তাঁর রাজত্বও চলে যায়।বিশাল রাজত্ব, রাজপ্রাসাদ, রাজকীয় সম্মান, রাজ অর্থ সবই চলে যায় সরকারের হাতে। সর্বস্ব জনসাধারণ ও একসময়ের প্রজাদের হাতে দান করে তাঁরা চিরদিনের মত চলে যান বর্ধমান ছেড়ে। একসময়ের জনদরদী রাজার সবকিছুকে দিয়ে যান জনগণের জন্যই। কিন্তু মহারাজা বিজয়চাঁদের পুত্রকন্যাদের মধ্যেও কেউ কেউ অন্যজীবন বেছে নিতে পেরেছিলেন। মহারাজার পুত্রকন্যাদের শিক্ষা হয়েছিল বিলাতে। সুতরাং তাঁরা সকলেই ইংরাজি আদব-কায়দায় অভ্যস্ত ছিলেন বলা যায়।

মহারাজা বিজয়চাঁদ জীবিত থাকতেই উদয়চাঁদের হস্তে রাজত্ব অর্পণ করে অন্যান্য পুত্র কন্যাদের নিয়ে বিলাত চলে যান। মহারাজা বিজয়চাঁদের দুই কন্যা, মহারাজকুমারী সুধারানী এবং মহারাজকুমারী ললিতারাণী। ফিরে আসার কিছুদিন পর মহারাজা বিজয়চাঁদ পরলোকগমন করেন। মহারাজা বিজয়চাঁদের কন্যা ললিতাকুমারী রাজপরিবারের প্রথম মহিলা যিনি ছায়াছবিতে অভিনয় করেন, নিজস্ব মতে বিবাহ করেন এবং প্রথম বিবাহ বিচ্ছিন্ন হলে পুনরায় বিবাহ করেন। ছায়াছবিতে অভিনয়ের সংবাদটি জানা গেল কোন ছায়াছবি, এবং ঠিক কোন সময়ে তা এখনও জানা যায় নি, আরো জানার প্রয়োজন।

সেদিক থেকে দেখতে গেলে রাজ অন্তঃপুরের এই নারীটিও অন্যদের তুলনায় অন্যরকম জীবন যাপন করেছেন। যদিও তখন আধুনিক যুগের সূচনা হয়েছে, ইংরাজি শিক্ষার প্রভাবে রাজপরিবারের নারীও রাজপরিবারের পুরুষদের মত বাইরে পা রাখতে শুরু করেছেন। মহারাজা বিজয়চাঁদের পুত্র-কন্যারা সকলেই পাশ্চাত্ত্য শিক্ষায় শিক্ষিত, আদবকায়দাতেও। বিবাহও হয়েছিল সেইরকম পরিবারে। সুতরাং, আধুনিকতার ছোঁয়া তো ছিলই! মহারাজা উদয়চাঁদের সময় রাজন্য প্রথা লোপ পাবার পর বর্ধমান রাজপরিবার তাঁদের রাজবাড়ি ও অন্যন্য যে সকল প্রাসাদ ছিল তা দান করেন শিক্ষাকেন্দ্র হিসাবে। যে সকল দেবতার স্থল এবং পূজার ব্যবস্থা ছিল তার জন্য নির্মিত হয় একটি ট্রাস্টি। যে ট্রাস্টির প্রধান হন ছোট মহারাজাকুমার এবং রাজপরিবারের আইন অনুযায়ী বড় মহারাজকুমারের অনুমতিক্রমে। মহারাজা উদয়চাঁদের পত্নীর মানও ছিল রাধারাণী দেবী। মহারাজা উদয়চাঁদের পত্নী এবং মাতা উভয়েরই নাম ছিল রাধারাণী। উদয়চাঁদ পত্নী রাধারাণী দেবী পরবর্তী সময়ে পশিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়ের অনুরোধে জনসাধারনের কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন এবং আইনসভার সদস্যা নির্বাচিতা হন। দ্বিতীয়বার আইনসভার সদস্যার নির্বাচনে তিনি পরাজিত হন এবং রাজত্ব চলে যাবার মাত্র আট বৎসরের মধ্যে ৩০শে জুন, ১৯৬৩ সালে দার্জিলিং-এ পরলোক গমন করেন। সেদিক থেকে ইনিও একজন উল্লেখযোগ্যা রাজঅন্তঃপুরবাসিনী, যিনি সর্বপ্রথম জনসাধারণের জন্য রাজমহলের ঘেরাটোপের বাইরে এসে পা রাখেন খোলা রাজপথে জনসাধারণের প্রতিনিধিরূপে। বর্ধমানের শেষ মহারাজা উদয়চাঁদের মৃত্যু হয় ১৯৮৪ সালের ১০ই অক্টোবর।

মহারাজা উদয়চাঁদের পুত্রকন্যাদের আর রাজা হওয়া হয়নি। তাঁরা সকলেই মহারাজকুমার ও মহারাজকুমারী এই নামেই অলঙ্কৃত। উদয়চাঁদের তিন পুত্রের মধ্যে জ্যেষ্ঠ্য পুত্র রাজত্ব বিলোপের সময় বিদেশে পাঠরত ছিলেন, কিন্তু ফিরে এসে তাঁর আর রাজা হওয়া হয় নি। তিনিও পিতার মতই তাঁর প্রয়োজনীয় কাজকর্ম সেরে বর্ধমান ছেড়ে চলে যান, আর কোণদিন আসেননি। শেষ হস্তান্তরের কাজ করেন ছোটো মহারাজকুমার প্রণয়চাঁদ। ইতিহাসের এক মনোযোগী ছাত্র এবং শিক্ষক এই অমায়িক, স্নেহপ্রবণ মানুষটি কিন্তু রাজত্ব না থাকায় একটুও অখুশি নন। তাঁর মতে, তিনি পরিবারের সকলের কনিষ্ঠ। তাই রাজপরিবারের আইন অনুসারে তাঁর রাজা হওয়া কোনদিনই সম্ভব ছিল না। কাজেই রাজত্ব গেল কি থাকল তাতে তাঁর কিছু যায় আসে না। কিন্তু যে ভীষণ ঘেরাটোপ, যে কঠিন শৃঙ্খলিত জীবন, যে ভীষণ নিয়মানুবর্তিতার ভিতর দিয়ে রাজকুমার ও রাজকুমারীদের জীবন কাটতো, তা থেকে মুক্তি হয়েছে বলে, ব্যক্তিগত ভাবে তিনি খুবই আনন্দিত। মানুষের নিজস্ব জীবন যদি কেউ কাটাতে না পারে, ভারি বিষম দায় যদি বইতে হয়, তাহলে সত্যিকারের জীবনের পুর্ণ বিকাশ হওয়া সম্ভব নয়, হতে পারে না। শিশুদের যে কঠিন চার-দেওয়ালের মধ্যে বন্দী জীবন তাঁর মনে আছে, তা থেকে এই প্রজন্মের শিশুরা মুক্তি পেয়েছে, এতে তিনি ঈশ্বরের কছে কৃতজ্ঞ। স্বাধীনতা বলে তখন কিছু ছিল না। নিজের পছন্দ করা জীবন সঙ্গী বা সঙ্গিনীকে বিবাহ করার স্বাধীনতাও ছিল না। যারা করেছেন বা পেরেছেন, সে তাঁদের অসীম সাহস বা এক উদাহরণ মাত্র, যা স্বাভাবিক ঘটনার মধ্যে পড়ে না।

মহারাজকুমার প্রণয়চাঁদ বিবাহ করেন অধুনা বাংলাদেশের রংপুরের মহিলাকে। নাম নন্দিনী মহতাব। মহারাজকুমারের স্ত্রীকে সকলেই ‘ছোটোমা’ বলে ডাকেন। তাঁর মা ছিলেন ত্রিপুরার রাজপরিবারের। কিন্তু বাংলাদেশ বিভাগের আগেই তাঁরা চলে আসেন এদেশে কলকাতায় ব্যবসাসূত্রে। বাংলাদেশ অপেক্ষা ত্রিপুরার রাজপরিবারের সঙ্গেই ছিল বেশি যাতায়াত। মহারাজ উদয়চাঁদের তিন পুত্রই অর্থাৎ মহারাজকুমাররা তিনভাই-ই ছিলেন দুন স্কুলের ছাত্র। মহারাজকুমার দুন স্কুলে পড়াকালীন তাঁর বর্তমান স্ত্রী অর্থাৎ ছোটমার সঙ্গে পরিচয় ও প্রণয়। পরে তাঁদের মধ্যে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পরে আমেরিকা যাবার পর আবার যোগাযোগ হয় এবং বিবাহ। আগে রাজপরিবারের বিবাহ হত শুধুমাত্র করকোষ্ঠীর মিল দেখে, মানসিকতার মিল দেখে নয়। মহারাজকুমারের মতে প্রথম রাধারাণীর সঙ্গে মহারাধিরাজ বিজয়চাঁদের মানিসিকতা, রুচি, চাল, চলন, শিক্ষা-দীক্ষা কোনকিছুরই মিল ছিল না, শুধুমাত্র করকোষ্ঠির মিলটূকু ছাড়া। বর্তমান প্রজন্মের পুত্র-কন্যারা সকলেই নিজমতে ও নিজ পছন্দ মতে বিবাহ করছেন, তাতে ভালই হয়েছে। নিজের রুচিমত পাত্র বা পাত্রী তাঁরা নিজেরাই নির্বাচন করে নিতে পারছেন। বস্তুতঃ উদয়চাঁদের ভগিনী ললিতাদেবীর সময় থেকেই এই পরিবারে নিজমতে বিবাহ আরম্ভ হয়েছে বলা যায়।

বর্তমানে বর্ধমানের এই রাজপরিবারটি একটি পুরোপুরি বাঙ্গালী পরিবার বলেই মহারাজকুমারও মনে করেন। প্রায় তিনশ বছর আগে পঞ্জাবের সুদূর লাহোর থেকে বঙ্গদেশে এসে বসবাস করা পরিবারটি কেউই আজ আর পিছন ফিরে তাকাতে রাজী নন। মহারাজকুমারের মতে, ঈশ্বরের অপার করুণা ও বর্ধমানবাসীদের অশেষ ভালবাসায় তিনি আপ্লুত। তাঁর এই জীবনে আর কিছু চাইবার নেই। অতুল ঐশ্বর্য্যর অধিকারী, একদা রাজ আদরে লালিত-পালিত এই মানুষটিকে আমাদের অন্তরের শ্রদ্ধা । তিনি ও তাঁর পরিবারের সকলে সুস্থ থাকুন, ভাল থাকুন।

রাজকুমারী সুধাকুমারী
রাজকুমারী ললিতাকুমারী
মহারাজা উদয়চাঁদ মহতাব, বর্ধমানের শেষ রাজা


No comments:

Post a Comment