প্রবন্ধ - দীপারুণ ভট্টাচার্য




সম্প্রতি শেষ হয়ে গেল কৃষক আন্দোলন। দীর্ঘ একবছরের বেশি সময় ধরে চলার পর সরকার মেনে নিলেন আন্দোলনকারীদের প্রায় সমস্ত দাবী। ইতিপূর্বে এমন ব্যাপক, শান্তিপূর্ণ এবং দীর্ঘ সময় ধরে চলা আন্দোলন আমরা আর দেখিনি! যদিও এমন বেশ কিছু আন্দোলন আগে আমারা দেখেছি যা বিষয়ের দিক থেকে কৃষক আন্দোলনের মতোই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু আন্দোলনকারীরা বিষয়টাকে জাতি, ধর্মের ঊর্ধ্বে নিয়ে যেতে পারেন নি। হয়তো সেটাই আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার একটা মূল কারণ। আমি কথা বলছি NRC ও CAA নিয়ে। বিষয়টা শুরু হয়েছিল ভারত সরকারের করা এক আইন সংশোধনের ভিত্তিতে। কে ভারতের নাগরিক আর কে নাগরিক নয় এই নিয়েই যত আলোচনা। এই আইন কিভাবে এবং কতটা কার্যকর হবে সে বিষয়ে অনেকেই নিশ্চিত হতে পারেন নি। অনেকের মতে, একটি বিশেষ সম্প্রদায়কে বিপদে ফেলার জন্যে সরকার উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে এই আইন এনেছে। অঙ্গরাজ্য আসামে আইনটি কার্যকর করার পরে দেখা গেছে, প্রায় তিন কোটি মানুষ নানান ভাবে বিপদে পড়েছেন। এরপরেই সরকার এই আইন কার্যকর করার সিদ্ধান্ত থেকে পিছনে সরে এসেছেন। এজন্যে বেশ কিছুদিন ধরে NRC ও CAA নিয়ে আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না। তবে প্রশ্ন হল, ২০২৪ এর নির্বাচনের পরে নতুন সরকার এসে যদি এমন কোন আইন আনেন তখন কি হবে? যে সব নাগরিকরা ভোট দিয়ে সরকারকে নির্বাচিত করছেন, জয়ের পর সরকার যদি তাদের আর নাগরিক হিসাবে মেনে নিতে রাজি না হয়, তাহলে কি হবে?


ধরা যাক আইনের কারণে কোন মানুষ ভারতীয় নাগরিকত্ব হারালেন! তবে তিনি কোন দেশের নাগরিক হবেন? যেমন, কয়েক বছর আগে আমাদের প্রতিবেশী দেশে প্রায় সাড়ে সাত লক্ষ রোহিঙ্গা মানুষ ঢুকে পড়েছিলেন শরণার্থী হয়ে। বর্তমানে এই রোহিঙ্গারা না বাংলাদেশের নাগরিক না মায়ানমারের নাগরিক। আক্ষরিক অর্থে এই উদ্বাস্তু মানুষ গুলো দেশ হীন। সমস্ত পৃথিবীর নিরিখে সংখ্যাটা কিন্তু খুব ছোট নয়। ২০১৮ সালের ১২ই নভেম্বর প্রকাশিত United Nations High Commissioner for Refugees এর রিপোর্ট থেকে জানা যায় সারা পৃথিবীতে এক কোটি কুড়ি লক্ষেরও বেশি মানুষ রয়েছেন যাদের কোনও দেশ নেই। অর্থাৎ কি না “নেই রাষ্ট্রের নাগরিক”। নাগরিক কথাটার সঙ্গে যে ভূমিখণ্ড অঙ্গাঙ্গী ভাবে যুক্ত তা হল দেশ। একটি দেশই একজন মানুষকে নাগরিক বলে পরিচয় দিতে পারে। অর্থাৎ যার দেশ নেই তার নাগরিকত্ব নেই। প্রশ্ন উঠতেই পারে একজন মানুষ কি ভাবে নিজেকে একটি দেশের সঙ্গে যুক্ত করবেন? পৃথিবী বিভিন্ন দেশে মূলত দুই ভাবে বিষয়টি হয়ে থাকে। এক, শিশু যে দেশে জন্ম নেয় জন্ম সূত্রে সেই দেশের নাগরিকত্ব লাভ করে। আর দুই, পিতা মাতা যে দেশের নাগরিক, শিশুও জন্ম সূত্রে সেই দেশের নাগরিকত্ব পায়। তবে, কোন নিয়ম কোথায় কিভাবে কার্যকর হবে সেটা ঠিক করে দেবে সেই দেশের আইন। যেমন ধরা যাক আমেরিকা, এই দেশের কোন অংশে যদি কোন শিশু জন্ম নেয় তবে সে আমেরিকার নাগরিক। শিশুর পিতা-মাতার নাগরিকত্ব এখানে বিবেচ্য নয়। আবার ভারতের নিয়ম অনুসারে যদি কোন ভারতীয় পুরুষ কিংবা নারী কোন শিশুর জন্ম দেয় তবে সে শিশু যে দেশেই জন্ম গ্রহণ করুক না কেন সে ভারতীয় হতে পারে। এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে, ভারতীয় দম্পতি যদি আমেরিকায় তাদের সন্তানের জন্ম দেন, তবে এই নিয়ম অনুসারে শিশুটি তো দুটি দেশেরই নাগরিক হতে পারবে! এই শিশু ভাগ্যবান। কেননা দুটি দেশই তাকে নাগরিকত্ব দিতে আইনত রাজি। তবে আমাদের এই আলোচনা এমন ভাগ্যবান মানুষদের নিয়ে নয়। বরং সেই সব হতভাগ্যদের নিয়ে যাদের কোন দেশই নাগরিকত্ব দিতে রাজি নয়।


নাগরিকত্ব একটি আইনি বিষয়। তাই আইনের মারপ্যাঁচে মানুষ এটা হারিয়ে ফেলতে পারেন। বিষয়টা অনেক ভাবেই হতে পারে। যেমন, কানাডার নাগরিকত্ব আইন নিয়েই ভাবা যাক। কানাডার নিয়ম অনুসারে নাগরিক দম্পতি যদি দেশের বাইরে সন্তানের জন্ম দেন তবে সেই সন্তানও কানাডার নাগরিক হবে। এখন দেশের বাইরে জন্ম নেওয়া কানাডার নাগরিক নারী ও পুরুষ যদি দেশের বাইরে তাদের সন্তানের জন্ম দেয় তবে সেই সন্তান কানাডার নাগরিক হতে পারবে না। অর্থাৎ দেশের বাইরে জন্মেও নাগরিক হওয়ার অধিকার একটি প্রজন্মের জন্য দেওয়া হয়েছে। এখন এমন এক কানাডার দম্পতির কথা ধরা যাক যারা দুজনেই জন্মেছেন কানাডার বাইরে। ঘটনাচক্রে যদি তারা তাদের সন্তানের জন্ম ভারতের কোথাও দেন তবে সেই শিশুর কোন দেশ থাকবে না। কেননা ভারতীয় নিয়ম অনুসারে বাবা ও মায়ের মধ্যে অন্তত একজনের ভারতীয় হওয়া বাধ্যতামূলক।

উদ্বাস্তু বা দেশ হীন মানুষদের সম্পর্কে সাধারণ ধারণা হল তারা বেআইনি ভাবে এক দেশ থেকে অন্য দেশে চলে গিয়েছেন। এই ধারণা অসত্য নয় তবে এর পাশাপাশি আইনের মারপ্যাঁচেও সারা পৃথিবীতে অনেক মানুষ তাদের দেশ হারিয়েছেন। পৃথিবীতে এমন সাতাশটি দেশ রয়েছে যেখানে শিশুর নাগরিকত্ব ঠিক হয় তার পিতার নাগরিকত্বের ভিত্তিতে। এই সব দেশে মাতার নাগরিকত্ব গুরুত্বহীন। এবার এই পিতা যদি একজন দেশ হীন মানুষ হয়ে থাকেন তবে শিশুটি ও দেশ হীন হয়ে পড়বে। এই রকম দেশ গুলোর মধ্যে আলজেরিয়া, মরক্কো ও সেনেগাল তাদের নাগরিকত্ব আইনে সংশোধন করে পিতার পাশাপাশি মাতার নাগরিকত্বকেও গুরুত্ব দেওয়ার চেষ্টা করছে। দেশ যখন নাগরিকত্বের ভিত্তি তখন দেশ বদলে বা ভাঙে গেলেও মানুষ দেশ হীন হয়ে পড়তে পারে। যেমন হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন বা যুগোশ্লোভিয়া ভেঙে যাওয়ার পরে।


নাগরিকত্ব যেহেতু একটি আইনি বিষয় কাজেই এখানে প্রমাণপত্রই এক মাত্র বিবেচ্য। পৃথিবীর বহু দেশে এমন বহু মানুষ আছেন যাদের কাছে নাগরিকত্বের কোন প্রমাণপত্র নেই। পর্বতে, জঙ্গলে কিংবা শহরের রাস্তায় থাকা মানুষ তো বটেই এমনকি বহু যাযাবর প্রজাতি, আদিবাসী মানুষকেও এই শ্রেণীভুক্ত করা যায়। ইউনাইটেড নেশন চিলড্রেন ফান্ড বা UNICEF এর ২০১৩ সালের এক সমীক্ষা থেকে জানা যায় সারা পৃথিবীতে পাঁচ বছরের কম বয়েসই এমন প্রায় ২৩ কোটি শিশু রয়েছে যাদের জন্ম রেজিস্টার্ড হয়নি। আমাদের দেশে তো বটেই পৃথিবীতে এমন অনেক দেশ রয়েছে যেখানে জন্ম ও মৃত্যু রেজিস্টার্ড করার পদ্ধতি খুব একটা ভালো নয়। কাজেই অনেক সঠিক নাগরিকের নাম যেমন খাতায় থাকে না, তেমনই বহু এমন নাগরিকের নাম পাওয়া যায় যারা হয়তো মৃত।

এই সব কারণে অনেকেই প্রশ্ন তোলেন, নাগরিকত্ব কি জন্মগত নাকি জন্মের প্রমাণের উপর নির্ভরশীল? এমন প্রশ্নও উঠতেই পারে, যে মানুষটির কাছে প্রমাণপত্র নেই সে কি প্রমাণপত্র নিতে অস্বীকার করেছে কখনো? না কি রাষ্ট্র তাকে এই প্রমাণপত্র দিতে অস্বীকার করেছে? এই দুটি প্রশ্নের উত্তরই যদি ‘না’ হয় তবে রাষ্ট্র সেই মানুষটিকে কি ভাবে দেখবে! প্রসঙ্গক্রমে চীনের কথা তোলা যেতে পারে। দেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য ১৯৮০ সালের ২৫শে সেপ্টেম্বর চীন সরকার, ‘ওয়ান চাইল্ড পলিসি’ ঘোষণা করেন। এই আইন হিসাবে, কোন দম্পতি যদি একটি সুস্থ শিশুর জন্ম দেয় তবে সেই দম্পতি আর কোন শিশুর জন্ম দিতে পারবে না। বালাই বাহুল্য মানব জন্মের মতো একটি জটিল বিষয়কে কখনোই আইন করে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। কাজেই শহরে এই আইন যতটা কার্যকর হয়েছিল গ্রামে ততটা হয়নি। যার ফলে চীনের গ্রাম গুলিতে বহু এমন সন্তানের জন্ম হয় যাদের নাম সরকারি খাতায় লেখা হয়নি। কেন না, আইনের চোখে মানুষ গুলোর কোন বৈধতা ছিল না। এই মানুষ গুলো বিভিন্ন রকম সরকারি সুযোগ সুবিধাও যেমন হাসপাতাল, স্কুল, চাকরি ইত্যাদি পায়নি। মূলত কৃষিকাজই ছিল এই মানুষ গুলোর জীবিকা। ১৯৮০ সালে শুরু হওয়া এই ‘ওয়ান চাইল্ড পলিসি’ চীন সরকার ২০১৬ সালে বন্ধ করে দেন।

ভেবে দেখার বিষয় হল, দীর্ঘ ৩৬ বছর এই আইনটি সেদেশে বলবত ছিল। কাজেই এই সময়ের মধ্যে জন্ম নেওয়া বৈধতা হীন বহু মানুষই বিয়ে করে সংসার ও সন্তান উৎপাদন করেছেন! হয়তো একজন বৈধতা হীন পুরুষ বিবাহ করেছেন একজন বৈধতা হীন নারীকে। কাজেই তাদের সন্তানরাও বৈধ নয়! তথ্যের বিষয়ে চীন অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত একটি দেশ। কাজেই বর্তমানে সেখানে বৈধতা হীন মানুষের সংখ্যা ঠিক কত; কিংবা সেই মানুষ গুলোকে স্বাভাবিক স্রোতে আনার বিষয়ে সরকার কি কি পদক্ষেপ নিচ্ছেন, বাইরের দুনিয়ার পক্ষে সেটা সঠিকভাবে জানা সম্ভব নয়।

সারা পৃথিবীতে এমন অনেক বিষয় রয়েছে যার বিপাকে পড়ে এই মানুষের পৃথিবীতে অনেকেই আজ আইনত দেশ হীন বা নাগরিকত্ব হীন। এমন মানুষের সঠিক সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়তো সম্ভব নয়। আর এদের বিষয় নিয়ে চিন্তা ভাবনা করার মতো সংস্থার সংখ্যাও খুবই সীমিত। আমাদের খুব স্পষ্ট ভাবে মনে রাখতে হবে, নাগরিকত্ব একটি আইনি বিষয়। আর এই আইন তৈরি ও ব্যবহার করে রাষ্ট্র নিজে। কাজেই রাষ্ট্র গুলো যদি আরও খানিকটা মানবিক হয়ে ওঠেন তবেই হয়তো আগামী দিনে এই সমস্যা থেকেও আমরা বেরিয়ে আসতে পারবো। শুভ রাষ্ট্র গুলোর কাছে এটাই ‘নেই রাষ্ট্রের নাগরিক’দের একমাত্র আবেদন।

No comments:

Post a Comment