গল্প - অচিন্ত্য দাস




















তখন বোধহয় আমার এগারো, ভাইয়ের সাত। ছেলেবেলার কিছু ঘটনামনে দাগ কেটে যায়, স্মৃতিতে ছবির মতো আঁকা হয়ে থাকে। ঠাকুরদাদা আপিসের কাজ থেকে অবসর নেওয়ার পর একদিন সব্বাইকে ডেকে বললেন শনি-রবিবার আমাদের নাকি কোথায়একটা যেতে হবে।মেদিনীপুর টাউনের কাছে আমাদের একটা পারবারিক বাড়ি ছিলো। বললেন “চল, বাড়িটা সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা যাক, মাঝেমাঝে সবাই মিলে থাকা যাবে।” আমরা সকলে হাওড়া থেকেভোরবেলার মেদিনীপুর লোকাল ধরলাম।

জন্ম থেকেকলকাতার গলি-ঘুঁজিতে মানুষ আমরা, ওইরকম ফাঁকাফাঁকা জায়গায় গিয়ে খুব মজা লেগেছিলো। বেশ বড়ো বাড়ি। সিনেমায় যেরকম জমিদার বাড়ি দেখা যায়, অত বড়োসড়ো কিছু নয় অবশ্য। সামনে একটা খালি জায়গা, ঘাস আর আগাছায় ভর্তি। ঠাকুরদাদা বললেন “এখানে বাগান করতেহবে, বুঝলি। চল রে, আমরা কটা ভালো ভালো চারা কিনে নিয়ে আসি।”

অনেক ঘুরেটুরেবেশ কয়েক রকমের ফুলগাছের চারা আর আম গাছের কলম কেনা হলো।

ঠাকুরদা আর আমরা দুই শ্রমিক মিলে জায়গাটা মোটামুটি পরিষ্কার করলাম। ফুলের চারা লাগানো হলো সার বেঁধে। এককোণে আমগাছ। এবার বললেন“ওইদিকের টগর গাছটা বেশ, প্রায় সারা বছরই ফুল ফুটবে। এই শোন, একটা বকুলের চারা জোগাড় করিস তো, এই দিকটা খালিখালি লাগছে। ইঞ্জিনীয়র বাবু, এটা তোর কাজ।” ঠাকুরদা মজার মানুষ ছিলেন— আমাকে ইঞ্জিনীয়র আর ভাইকে ডাক্তারবাবু বলতেন। খুব ইচ্ছে ছিলো আমরা বড়ো হয়ে তাই হই।

ঠাকুরদার একটা গুণ ছিলো—উনি কথায় কথায় কবিতা কিংবা ছড়া বানাতে পারতেন। অবশ্য লিখতেটিখতেকখনও দেখিনি, সরকারী আপিসে কলম পিষেই জীবন কেটেছে। বিকেলের দিকে বারান্দায় বসে বাগানেরদিকে তাকিয়ে হুট করে মুখেমুখে একটা কবিতা বানিয়ে ফেললেন। তারপর আমাদের দু’ভাইকে বসিয়েমুখস্থ করিয়েও দিলেন।

মনে আছে ট্রেনে যখন ফিরছি তখন ঠাকুরদার দু’পাশে দু’ভাই বসে কবিতাটা অনেক বার আউড়েছিলাম। ছেলেবেলাকার মুখস্থ করা তো, লাইনগুলো মনে গেঁথে আছে—

ফাগুনে জ্বলিবে পলাশের শিখানৈঋতকোণেআম্রবীথিকা
ভরিয়া উঠিবে মুকুলে।
আঘ্রাণে তার মাতিবে কাননধন্য হইবেএই আবাসন
ছাইবে টগরে বকুলে।।

***

চল্লিশ পেরিয়েছি। ডাক্তার, ইঞ্জিনীয়র কিছুই হতে পারিনি আমরা।আমিগ্রামেগঞ্জে দোকানে দোকানে ওষুধ পৌঁছোনোর কাজ করি, সামান্য আয়। দুটো মেয়ে, লেখাপড়ায় আমার থেকেও অঘা। এবছর দুটোর একটাও যদি পাশ করে তো ভাগ্য ভালো বলতে হবে। বৌ সমানে বলে ভালো ট্যুইশন দাও। কোথা থেকে দেবো? একটা বিষয় পড়াতেই সাত-আটশ চায়। ভাই ডাক্তার তো হতে পারেনি, কিন্তু বাড়িতে সারাবছরের পেশেণ্ট। ওর বৌ। শুধু ভোগে।পাঁচমিশেলি কাজ করে সে কোনওরকমে চালাচ্ছে।

মেদিনীপুরের দিকে কাজ ছিলো। চাবিটা নিয়ে বেড়িয়েছিলাম, সময় থাকলে বাড়িটা একবার দেখে আসা যাবে। কাজের পর বিকেলের দিকে সময় কিছুটা পাওয়াগেলো। গেলাম বাড়িটা দেখে আসতে। একটা ঘর ছেড়ে বাকিটা কোচিং ক্লাসের জন্য ভাড়া দেওয়া আছে। ভাইয়ের সঙ্গে আধাআধি ভাগ হয়। বাড়িটা এত চুপচাপ লাগছে কেন? ওহ আজ তো শনিবার, কোচিং ক্লাস ছুটি, তাই কেউ নেই।

বাগানটা আগাছা আর কাঁটা গাছে ভরে আছে।কতদিন কারুর হাত পড়েনি। কেউ যায়ও না, যাবেই বা কেন। চাবি খুলেখালি ঘরটায় ঢুকলাম। একটা বিছানাহীন করম কাঠেরতক্তপোষ। দেওয়ালে ঠাকুদার বেশ বড়ো একটা ফটো টাঙ্গানো আছে।বেশ তুলেছিলো ছবিটা, মুখের সেই হাসিটাও ধরা আছে। আশেপাশে জনপ্রাণী নেইতার ওপরবিকেলের আধো-অন্ধকার।ঘরের ভেতরে ঢুকে কীরকম যেন লাগছিলো। ছবিটার দিকে চেয়েছিলাম কিছুক্ষণ, একসময়মনে হলো, ঠাকুরদা যেন আমাকে কিছু বলছেন।এতদিন পরে ঠাকুরদার কথাযেন শুনতে পাচ্ছি।

“হাঃ হাঃ, বাগানটা কবিতার সঙ্গে মিললো না তো। আরে ওরকম হয়। ফুলগাছগুলো নেই, আমগাছটাও ছাগলে মুড়িয়ে দিয়েছে কবে। বকুলের চারা তো কেউ আনলোই না। যাকগে। তোরাও তো যা আশা করেছিলাম তার কিছুই হলি না। তা আর কী করা যাবে। তবে শোন, একটা কথা বলি। ছড়া কাটতে না পারিস, রং-তুলিতে ছবি আঁকতেনা পারিস তাতে কিছু আসে যায় না। মনে মনে কিন্তু বাগানের ছবি আঁকতেই থাকবি। ভবিষ্যতের বাগান। সেখানেআশ মিটিয়ে ফুল ফোটাবি, ফল ফলাবি। মনের ভেতর একটা ছবি থাকা খুব দরকার। তুই এখন যতটা ভাবছিস তার থেকে অনেক অনেক বেশি জরুরি। বুঝলি? রোজকারের অভাব-অনটনে যেরকম জেরবার হয়ে আছিস তোরা, একটা বাগানের ছবি মনের ভেতর ধরে না রাখলে দিন কাটতেই চাইবে না রে তোদের... কি রে মনে থাকবে তো...

No comments:

Post a Comment