(শেষ পর্ব)
কালো পাথরের খাঁজে যে পলাশের আগুন জ্বলতে দেখে সমুদ্র এতদিন অভ্যস্ত ছিল সেই আগুনে এবার নিজেকেও পুড়তে হবে সেবায়তনে এসে এটা ও কখনোই ভাবেনি।
এখান থেকে রাত্রে বাড়ি ফেরার পথে সুখমণির ওপর একদল লোক চড়াও হয়ে ক্যানেলের শুখা জমির পাশে ফেলে গণধর্ষণ করে খুন করে রেখে ফেলে গেছে। ওর সাইকেলটাকে দুমড়ে মুচড়ে একপাশে স্থবির হয়ে পড়ে আছে। বেশ বেলায় পুলিশ এসে ওর দেহটাকে সদর হাসপাতালে চালান করেছে। প্রকাশ পাখিরা আর লোকাল পার্টীর ছোকরারা বোধহয় এনিয়ে মোমবাতি মিছিল করবে। সামনে ভোট। এইসময় এরকম একটা ঘটনা অনেক ফায়দা দেবে ওদের।শবরকেন্দ্রিক এই অঞ্চলে উন্নতির জন্য এম পি ল্যাডের টাকাটা হজম করেও অনায়াসে সুখমণিকে ইস্যু বানিয়ে ভোটের ফসল তুলতে আর কোনও বাধা রইল না।
সভ্যতার সবথেকে নির্লজ্জ ও অসহনীয় অপরাধের চিহ্ন বুকে করে খোলা আকাশের নীচে নাবাল জমির একধারে রক্তাক্ত সুখমণি ঘুমোচ্ছিল। দুবৃর্ত্তরা ধর্ষণের পর সুখমণির গলায় ক্ষুর চালিয়ে ওকে শুধু খুনই করেনি ওর স্তনবৃন্তদুটিকে ছিন্ন করেছে দেহ থেকে।
প্রান্তিক মানুষ হয়েও নিজের স্বাতন্ত্র রক্ষা আর দলদাস না হতে চাওয়ার দাম যে এভাবে দিতে হবে সেটা বোধহয় ওর জানা ছিল না। সমুদ্র সেবায়তনের বারান্দায় হুইলচেয়ারটায় বসে বসে নিজের পঙ্গু শরীরটাকে অভিশাপ দিতে দিতে অক্ষমের ক্রোধ প্রকাশ করতে থাকে অসহায় ভাবে। প্রকাশ পাখিরা আর তার লোকেদেরই যে কাজ এটা, সে বিষয়ে ও নিশ্চিত। এতদিনকার রাজনৈতিক শিক্ষা আর মূল্যবোধের আজ আর কানাকড়িও দাম নেই। সুখমণি ওর যোগ্য সহযোগী হয়ে উঠেছিল। আজ সত্যি সমুদ্র প্রথম নিজেকে বড় অসহায় বোধ করল।
*********
মা ডাকছিল অনেক্ষণ ধরেই। সাগরিকা একটা ছবিতে তার দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে আনমনা হয়ে গিয়েছিল। ছবিটায় ওর বাবা আছেন। সঙ্গে একজন মহিলা যাকে ও চেনে তার কোলে একটি মাস দুয়েকের শিশু। মহিলাটি কিন্তু ওর মা নন। ওর নিজের থুতনির পাশে যেমন একটা তিল আছে ওই মহিলাটিরও আছে। সর্বোপরি আজকের সাগরিকার সাথে মহিলার অসম্ভব একটা সাদৃশ্য। আশ্চর্যের ব্যাপার এই মহিলাটিকেও ও চেনে। প্রায় বাহাত্তর বছরে পৌঁছে মহিলাটিকে এতদিন 'আন্টি' বলে ডেকে এসেছে। ইনি আর কেউ নন স্বয়ং 'মিসেস লোবো'...!
***********
সুধন্য সেন দেবদাসীদের ওপর কভার স্টোরি করছিলেন বেশ কিছু মাস ধরে। ১৯৪৭এ দেবদাসী প্রথা বিলুপ্ত হবার পরেও কোথাও কোথাও গোপনে তাদেরকে দিয়ে দেহব্যবসা চালানো হচ্ছিল। এমনই একটা চক্রের খবর পান তিনি। তখনই 'মণিমা' বলে একজন মহিলার সাথে পরিচিত হন। 'মণিমা'রা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ব্রহ্মেশ্বর মন্দিরে রুদ্রগণিকার ভূমিকা পালন করে এসেছেন। মন্দিরের প্রধান পুরোহিত অথবা ক্ষমতাশালী ব্যবসায়ী বা নেতাদের মনোরঞ্জনের জন্য এরা ব্যবহৃত হত। মন্দির ট্রাস্টে মোটা টাকার লেনদেন হওয়ায় এসব নিয়ে মুখ খোলার মত কেউ ছিলনা। মণিমা তার দু'মাসের সন্তানকে নিয়ে সুস্থ জীবনে ফিরতে চেয়েছিল সুধন্যর কাছে। মণিমার চোখের ভাষায় একটা বাঁচার আর্তি সুধন্য দেখতে পান। তখনই দ্রুত ফাদার আব্রাহামের সাথে যোগাযোগ করে এক রাতে মণিমাকে সেখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে ওদের একটা হোমে গিয়ে রাখেন। সুধন্যর সাথে আই পি এস অফিসার নরপতি মিশ্রর চেনাজানা থাকাতে পুরো কাজটা সহজ হয়ে যায়। ওই হোমে থাকতে থাকতেই মণিমার নাম বদলে একদিন 'মণিকা লোবো' হয়ে সে এক নতুন জীবন শুরু করে। কৃতজ্ঞতায় সে তার সন্তানটিকে মানুষের মত মানুষ করে তোলার অনুরোধে সুধন্য সেনের হাতে তুলে দেয়। শ্রীরাধাও আপত্তি করেনি কোনওদিন। তাদের একটি ছেলে থাকলেও কন্যাসন্তানের প্রতি একটা আলাদা টান রয়েই গেছিল। 'সাগরিকা' নামটার মধ্যে সমুদ্র নিয়ে অবশেসনটা সুধন্য বজায় রেখেছিলেন। তাই বছরে একবার পরিচয় গোপন রেখে ওরা মিসেস লোবোর কাছ থেকে এসে ঘুরে যেতেন। মণিমা সেটা জানতেন। আর সাগরিকাকে দেখে বুঝতে পারতেন সুধন্য সেন তাকে দেওয়া কথার খেলাপ করেননি। একটা সর্বতোভাবে সুস্থ জীবন দিয়ে 'সাগরিকা' বড় হয়ে উঠছে আস্তে আস্তে।
***********
শ্রীরাধা মেয়ের পিঠে হাত রাখেন। সাগরিকা আজ বুঝতে পেরেছে তার জন্মপরিচয়। সে তার মা কে জাপটে ধরে থাকে। নীড় ভাঙা পাখির কম্পন তার শরীর জুড়ে। দুজনেই অশ্রুস্নাত। সত্যকে সহজ করে মেনে নিতে গেলে বাঁধ ভেঙে যায় কখনো কখনো। মিসেস লোবো তার গর্ভধারিণী হলেও শ্রীরাধাই তার মা....সুধন্য তার বাপি আর সমুদ্র তার দাদাভাই ...এর চেয়ে সত্যি আর কিছু হতে পারেনা কোনওদিন।
সাগরিকার সামনে নীল সমুদ্রের ঢেউ একের পর এক আছড়ে পড়ছে। পড়ন্ত বিকেলের কমলাকোয়া রঙের গোধূলির আলো বালিয়ারির উপর এসে পড়েছে। ব্রহ্মেশ্বর মন্দিরের চূড়ো দূর থেকে দেখা যাচ্ছে। একটি মেয়ে, সে পূর্ণগর্ভা, পরণে তার শৃঙ্গারবেশ। নাচের কমনীয়তা তার এই অবস্থায় নষ্ট হয়নি। সমুদ্রের ধারে এসে সে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। হাওয়ার তার আঁচল উড়ছে, চুল এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে...
সাগরিকা জানে এর নাম বসন্তমঞ্জরী বা মঞ্জিমা। সে একজন দেবদাসী। আর মিসেস লোবোর মত তাকেও ঠিক ওরই মতন দেখতে।
সমাপ্ত
****************
* কৃতজ্ঞতা স্বীকার -
১) ' মায়াটুকুই তো লেগেছিল' কবিতাটি কবিবন্ধু চন্দ্রাণী গোস্বামীর রচিত ও তাঁর সম্মতিক্রমে ব্যবহার করা হল।
২) 'মৃত্যুও ঋতুকাল চিনেছি বাবা চলে যেতে' কবিতাটি কবি বন্ধু চন্দ্রাণী গোস্বামীর রচিত ও তাঁর সম্মতিক্রমে ব্যবহার করা হল।
No comments:
Post a Comment