গল্প - শ্রীময়ী গুহ






















এই যে এখানে... হ্যাঁ গো...! এই যে, হাত বাড়াও... সাবধানে গো...! এসো! এসো এদিকে...!

ভয় কী?

আমি তো পাশেই তোমার...! দেখো দেখো! দেখতে পাচ্ছো না?

এইইই তো... পেলে আমাকে?

আমার হাতটা ছুঁতে পারলে?

আমাকে দেখতে পেয়েছো?

কী বলছো? আমি ঝাপসা? বাতাসে মেশা? আমি তাও ভীষণ সুন্দর এখনও?


ধ্যাত কি যে বলো! লজ্জা করেনা বুঝি আমার? তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে দু’জনের... এখন কী আর অত প্রেম ভালোবাসা সয় গো? তাছাড়া লোকেই বা বলবে কী? বুড়ো বুড়ি একলা বাড়িতে...., মেয়ে জামাই নাতনি বিদেশে..., আর এই ফাঁকে প্রেম করছে চুটিয়ে!

ছিঃ ছিঃ!

ওদের কাছে বিদেশে যদি খবর যায় এসব, ওরাও তো বকাবকি করবে গো!

বলবে—

“মা! বাবা! তোমাদের বয়স বাড়ছে আর বাচ্চা হয়ে যাচ্ছো নাকি? বারান্দায় বসে লোক হাসিয়ে গান গাওয়া, কবিতে বলা, ওসব বন্ধ করো! ক্যাথিটার ঝুলিয়ে রেখে, এসব কি অসভ্যতা তোমাদের অ্যাঁ!”

তার থেকে ওসব থাক...

ওদের এই বয়সে আসতে দাও বুঝলে! তখন দেখবো কেমন এসব বড়ো বড়ো কথা বলতে পারে!

যাক গে!

তুমি বরং গুনগুন করে গান করে শুধু আমাকে শোনাও আজ, সেই প্রথম বয়সের মতো কানেকানে!

সিরসিরিয়ে উঠুক আমার মনপ্রাণ সব আবার আগের মতন।


কীইইই বলছো?

কলেজ বেলায় করতাম কত দুরন্তপনা! কত দুষ্টুমিভরা প্রেম?

তাআআআআ! তখন আর এখন?

কি এক বলো!

এখন এসব মানায় না গো।

তখন বৃষ্টি মানেই ছিলো অবাধ্যরকম ভেজা দুটো শরীর, মন!

তারপরেও সংসার করতে করতে কতবার তো বৃষ্টিতে তুমুল ভিজেছি দু’জনে, এই বাগানে... মনে পড়ে তোমার?

তুমি বরাবরই বৃষ্টি দেখে গান গাও দরাজ গলায় আর আমাকে টেনে নিয়ে কোমর জড়িয়ে এক্কেবারে যা তা...!

এখন কিন্তু ওসব একদম না বুঝলে। চুপ করে দেখো বৃষ্টির একটানা তান।

চারদিক ভাসছে ডুবছে... আমরা অবশ্য অনেকটা ওপরেই আটকে রেখেছি এখনও নিজেদের। তাও... জল তো ছুঁয়ে নেবেই গো, এই আলমারি, আলনা, খাটের পায়া টেবিল, আর ছোট্ট টেবিলে রাখা ফোটো ফ্রেমটাকেও।


সে তখন দেখা যাবে... এখন তোমাকে দেখি... দু’চোখ ভরে....,

তোমার গুনগুন গান শুনি সেই আগের মতো।


এত অস্থির হয়োনা তো।

ওরা খবর পেয়েছে আগেই... আমরা তো ওদের কাছ থেকে আর কিছু আশা রাখিনি! বরং দিয়ে দিয়েছি সবটাই। তাহলে আর, ওরা এল, কী এল না, ...এসব ভেবে কেন মনখারাপ করো বলো তো?


বোসো তো চুপ করে!

দেখো তো! কীইইই বৃষ্টি চলছে একটানা!

কিচ্ছু শুকোয়নি জামাকাপড় জানো!

কোনও কাজ করতে পারিনি কাল থেকে।

উঠোন থৈথৈ..., ভিতর বারান্দা ভর্তি জল...

বাগানের মাটি ঘেঁটে একশা গো...! আর ঘোলাটে জলে পা ফেলে, গোড়ালি ডুবিয়ে...

এই দেখো তোমার জন্য আর আমার জন্য দু’কাপ চা আনলাম...

এখন এটাই চলুক বুঝলে!

বৃষ্টিটা একটু ধরুক, তারপর না হয় স্টোভটা তুলে দিও চৌকির ওপরে...,

ডালে চালে বসিয়ে দেবো খন!

আর খাবার সময় গরম গরম ডিমভাজা...!

কীইইই! আজ পারবে না এই দিয়ে খেয়ে নিতে?

দেখো বাপু! বেশি বায়না কোরোনা যেন...

কিচ্ছু নেই ঘরে এখন আনাজপাতি, ...যে তোমাকে একটু রেঁধে খাওয়াবো!

সব ঘর তো জলে ভাসছে গো...!

তুমি পা টা তুলে বোসো দেখি!

ভিজলে তো জ্বর আসবে আবার, ...এই তো ক’দিন আগেই ধূম জ্বরে কাঁপছিলে তুমি... আমার অবশ্য তেমন জ্বর আসেনি, তাই না গো?

শুধু শ্বাসকষ্টটাই...

যাক গে... ওসব ভেবে লাভ নেই এখন আর।


এ বাড়ির দলিলটা ভাগ্যিস আগে থেকেই পাঠিয়ে দিতে পেরেছো ওদের ওখানে।

ওরা অসন্তুষ্ট হতো নাহলে।

শুধু শুধু আবার একটা ভুল বোঝাবুঝি হতো। ওদের আর দোষ কি বলো!

সংসার তো ওদেরও করতে হচ্ছে বিদেশ বিভুঁইয়ে...

আর এখন যা অবস্থা, ...এদেশে তো আসা আর সম্ভব নয় ওদের পক্ষে! তার ওপর ঐটুকু বাচ্চা নিয়ে।

তাও এ বাড়ির দলিলটা ওদের হাতে থাকলে যখন খুশি এসে কিছু একটা বন্দোবস্ত...

সে বিক্রি করলে করবে...! না করলে... ওদের যা ইচ্ছে হবে তাই করবে...

এসব ভেবে লাভ নেই গো!

আমরা তো এইই বেশ আছি বলো!

কোনও ঝুট ঝামেলা নেই..., দিব্যি আছি দু’জনে, তাই না?


এখন ফোন ধরারও তাড়া নেই!

ফোনে গলাটা পরিস্কার করে নিয়ে...

“ভালো আছি রে আমরা! তোরা ভালো থাকিস রে... সাবধানে থাকিস!”

“কবে আসতে পারবি রে?”...বলার আগেই ফোন কেটে যাওয়ার কট করে নিষ্ঠুর শব্দ! এসবের অভিনয় করা নেই সপ্তাহান্তে একবার করে...

অহেতুক কান্নাকাটি গেলার চেষ্টা নেই।

মন কেমনের বন্যা নেই।

এইই ভালো গো, তাই না? বলো!


ওরা যদি খবর পায় তো ঠিক আছে... আর না পেলেও..., আমরা ঠিকই আছি তাই না গো?

কি গো! কীইইই এত ভাবছো?

চা টা খাও তো এবার...! ঠান্ডা হয়ে গেলো যে!

রাগ রেখো না ওদের ওপর, ...ওরাও তো নিরুপায় তাই না!

ওরা কী জানতো যে আমি, তুমি, এভাবে... একসাথে দু’জনেই...

যাক গে...! চা খাও।


ওমাআআ! দেখো দেখো!

বাগানের বকুলফুলগুলো বর্ষার জলে ভেসে ভেসে ঘরের চৌকাঠ ডিঙিয়ে আমাদের ছবি ছুঁয়ে ফেলেছে...

এত নীচে রেখে গেছে রামদীন ফোটোটা!

এই টেবিলটাও যে ভীষণ নীচু...


তোমার আমার পায়ের কাছে, ঘোলাটে বৃষ্টির জলে, কত্ত বকুলফুল, কৃষ্ণচূড়ার পাপড়ি আর সবুজ হলুদ ভেজা পাতারা!

এই তো বেশ ভালো আছি তাই না গো! বলো!

হাতটা ছেড়ো না কিন্তু, ...এভাবেই ধরে থাকো কেমন!

বৃষ্টিটা বাড়লো মনে হচ্ছে তাই না। আসলে বৃষ্টি তো বড়ো খামখেয়ালি!


তবে... সংসারযাপনেও কিন্তু এই না শুকোনো জামাকাপড় বা স্যাঁতস্যাঁতে ভালোবাসাকে ছাপিয়েও মাঝে মাঝেই চায়ের কাপ হাতে পুরোনো বর্ষাকেই খুঁজে নেয় আটপৌরে প্রেম... জীবন তো এটাই... কখনও মেঘলা, কখনও রোদ্দুর, কখনও বা তুমুল বর্ষণ।

1 comment: