পথে প্রবাসে - শিবাংশু দে



আমার ভারতবর্ষ- ২

দুর্গগুড়ি

তা হয়ে গেলো প্রায় হাজার দেড়েক বছর। খ্রিস্টিয় ছয়-সাত শতকে এই গ্রামটিতে ছিলো আদি চালুক্যদের রাজধানী। নাম আর্যপুরা বা আইয়াভোলে। আজ যাকে লোকে 'আইহোলে' নামে জানে। উত্তর কর্ণাটকের বাদামির কাছে একটা বিস্ময়কর স্বপ্নপুরী। এককালে এখানে একশো পঁচিশটি মন্দির দেখতে পাওয়া

যেতো। কালের কবলে যাবার পরেও চারদিকে ছড়ানো কতো যে চমকে দেওয়া নির্মাণ উৎসাহী মানুষদের জন্য অপেক্ষা করছে, তার ইয়ত্তা নেই।




ধরা যাক, এখানকার সব চেয়ে বিখ্যাত পুরা নিদর্শনটির কথা। নাম, দুর্গগুড়ি (দুর্গ-মন্দির)। বেশিরভাগ লোকই একে দুর্গামন্দির নামে জানে। কারণ এখানেই আছে আমাদের দেশের একটি প্রাচীনতম ও সুন্দরতম মহিষমর্দিনীর মূর্তি। মন্দিরটির নাম এসেছে 'দুর্গদাগুড়ি' থেকে । এর অর্থ, দুর্গের কাছে মন্দির। বৌদ্ধ চৈত্যের স্থাপত্যে নির্মিত এই মন্দিরটি ছিলো সূর্য, শিব বা বিষ্ণুদেবতার প্রতি নিবেদিত। দ্রাবিড় ঘরানার হলেও উঁচু ভিত্তিভূমির উপর রেখনাগর শৈলীতে নির্মিত শিখর ছিলো এর বিশেষত্ব। পরবর্তীকালে এদেশে হিন্দু মন্দিরগুলিতে এই স্থাপত্যশৈলীটিই সব থেকে লোকপ্রিয়তা পায়।

এই মন্দিরটি সম্ভবত আইহোলের সব থেকে সূক্ষ্ম কারুকার্যময় নির্মাণ। স্তম্ভ, দেওয়াল, প্রদক্ষিণ, ছাদ, সর্বত্র বিস্ময়কর মূর্তি, বাসরিলিফ ও খোদাইকরা কারুকার্য ছড়িয়ে আছে। মন্দিরটি সম্ভবত সাত-আট শতক নাগাদ নির্মিত হয়েছিলো। আমাদের দেশের প্রাচীনতম পুরানিদর্শনগুলির মধ্যে একে স্থান দেওয়া হয়।



চারদিকে স্তম্ভ দিয়ে ঘেরা প্রদক্ষিণ বা অলিন্দ অংশটিতেই সব চেয়ে বেশি ভাস্কর্যগুলি দেখতে পাওয়া যায়। ইংরেজিতে বৌদ্ধ চৈত্যের ধরনে নির্মিত মন্দিরের মণ্ডপটিকে Apsidal বলা হয়। ভারতীয় স্থাপত্যে এর নাম 'গজপ্রস্থ' শৈলী। হাতির পিঠের মতো গড়ন এর। এই শৈলী খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকে বৌদ্ধ চৈত্যমন্দিরের অনুসরণে এদেশে শুরু হয়েছিলো। এই মন্দিরের শিখর বা বিমানটির কিছু অংশ এখনও টিকে থাকলেও বিশাল আমলকটি ভূমিসাৎ হয়ে গেছে। গর্ভগৃহে প্রবেশ করতে গেলে প্রথমে মুখমণ্ডপ ও তার পর সভামণ্ডপ পেরিয়ে যেতে হয়।

পশ্চিমি চালুক্যরা মন্দিরটি যখন নির্মাণ করেছিলেন, অর্থাৎ সপ্তম-অষ্টম শতকে, তখন দেশে গুপ্তযুগের শান-শৌকতের স্মৃতি ম্লান হয়ে যায়নি। উত্তরভারতের প্রতাপী রাজারা ছিলেন কনৌজে যশোবর্মণ, কাশ্মিরে ললিতাদিত্য মুক্তাপীড়। ওড়িশায় ভৌমকার বংশের শিবাকর উন্মত্তকেশরী তখন সিংহাসনে। দুর্গগুড়ির সমসাময়িক উল্লেখযোগ্য মন্দির অবশেষ আমি দেখেছি ভুবনেশ্বরের পরশুরামেশ্বর মন্দিরে। এই দুই মন্দিরে স্থাপত্য বা ভাস্কর্যের উৎকর্ষ নিয়ে কোনও মন্তব্যই হয়তো যথেষ্ট নয়। তবে সেই সময়ের মন্দির স্থাপত্যে মিথুন বা যুগলমূর্তির প্রচলন তেমনভাবে দেখতে পাওয়া যায়না। কিন্তু পশ্চিমি চালুক্যদের দুর্গাগুড়িতে দেবদেবী নিরপেক্ষ যুগল ও মিথুন মূর্তির প্রাচুর্য একটু অবাক করে। এর পিছনে তৎকালীন জনজীবনে বৌদ্ধ তন্ত্র বা শৈব তন্ত্রের প্রাবল্য প্রতিফলিত হয়। পাথরে খোদিত এসব কবিতা তেরোশো

বছর কালের কবলে থাকার পরেও আমাদের চমকে দেয়। বুন্দেলখণ্ডি বা কলিঙ্গ মিথুনকাল্ট তখনও দু-তিনশো বছর দূরে। অসংখ্য উদাহরণের মধ্যে থেকে কয়েকটি নমুনা এখানে থাকলো।


আসলে এইভাবে বর্ণনা দিয়ে এই মন্দিরের কোনও সূত্রই পাওয়া যাবেনা। চোখে না দেখলে প্রত্যয় হয়না আমাদের পূর্বপুরুষেরা এদেশে কী পর্যায়ের শিল্পস্থাপত্য সৃষ্টি করে গেছেন। কেন নিজেকে 'ভারতীয়' ভাবতে গর্ব বোধ করি। হাজার অন্ধকারের প্ররোচনা যেন আমাদের সমন্বয়ের ঐতিহ্যকে ম্লান না করতে পারে।




                          

No comments:

Post a Comment