উফ, ইন্টারনেটটা আজ যা জ্বালাচ্ছে না!
এই বাক্যবন্ধটি কমবেশি আমরা সবাই ব্যবহার করি কোনো না কোনো সময়ে। এই অতিমারী আক্রান্ত এক সময়ে দাঁড়িয়ে যখন অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছি বা করছি, ব্যাঙ্কে লাইন না দিয়ে অনলাইন ট্রান্স্যাকশনে অভ্যস্ত হবার চেষ্টা করছি, ঝট করে দেখে নিচ্ছি প্রতিদিনের কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা, যোগ দিচ্ছি কোনো ওয়েবিনারে, আতঙ্ক থেকে মুখ ফেরাতে ফেসবুক লাইভে অনুষ্ঠান শুনছি বা করছি, তখন মাঝেমাঝেই যে এই কথা বলতে হবে, তাতে আর আশ্চর্য কী! শরীর থাকলে যেমন রোগ হবে, তেমনি যন্ত্র ব্যবহার করলে তার যন্ত্রণাও যে অবশ্যম্ভাবী!
কিন্তু ভাবুন তো, কমবেশি অসুবিধা সত্ত্বেও সারা পৃথিবীটা এখন কেমন হাতের মুঠোয়! সুদূর ইউরোপ বা আমেরিকার কোনো শহরে বসে কত সহজে আপনি এশিয়ার একটি শহরে যোগাযোগ করতে পারেন! হঠাৎ অর্থের প্রয়োজনে মুহূর্তের মধ্যে পেয়ে যেতে পারেন। কলকাতা থেকে ব্যাঙ্গালোর দুরন্ত এক্সপ্রেসে অক্টোবরের পাঁচ তারিখে টিকিট পাওয়া যাবে কিনা বা মুম্বই থেকে মিউনিখ হয়ে ত্রিয়েস্তে যাওয়ার ফ্লাইট আছে কিনা দেখে নিতে আপনার মাত্র কয়েক মিনিট সময় লাগবে।
এত সুবিধা স্বত্ত্বেও অস্বীকার করার উপায় নেই, অন্তত আমার দেশের মোটামুটি ৪৬% মানুষ এখনো ইন্টারনেট ব্যবহার করেন না, বা বলা ভালো করতে পারেন না। সারা বিশ্বের দিকে যদি তাকাই তাহলেও গড়ে ৪৭% মানুষ এখনো এই পরিষেবার আওতার বাইরে। এই বাইরে থাকাটা খানিকটা মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থানের কারণে আর খানিকটা কোনো একটি জায়গার ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে। এ ছাড়াও অবশ্য প্রচ্ছন্ন কিছু কারণ থেকে যায়। তবুও আমরা যদি এই পরিষেবার বিষয়টিকে সময়ের সঙ্গে দেখি তাহলে দেখব বিশ্বজুড়ে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ২০০৫ সালে ছিল ১৬%। ২০১০এ তা হয়েছে ৩০%, ২০১৭তে ৪৮% ও ২০১৯ এ ৫৩.৬%। ইন্টারনেট ছেড়ে যদি কেবল যোগাযোগ ব্যবস্থার কথা ভাবি তাহলে এই মুহূর্তে মোটামুটিভাবে বিশ্বের ৬১% মানুষের নিজের মোবাইল ফোন আছে এবং স্মার্টফোনের বিচারে সেটা ৪৫% এর কাছাকাছি। নেই-এর অঙ্কে বলতে গেলে ৩৯% এর নিজের মোবাইল নেই এবং স্মার্টফোন ৫৫% মানুষের ছোঁয়ার বাইরে।
কিন্তু সময়ের নিরিখে বিচার করলেই আমরা দেখতে পাব এই যোগাযোগ ব্যবস্থায় আসলে কোন ফাঁকে এক বিপ্লব হয়ে গেছে। আমি যখন স্মার্টফোন ব্যবহার করি সত্যি কি ভেবে দেখি ঠিক কোন মুহূর্তে আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপের সেই দৈত্য এসব কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলল? আমাদের স্বভাবই এমন যে আমরা প্রযুক্তি ব্যবহার করি, কিন্তু বিজ্ঞানকে স্বীকার করি না। দেশের এক বিরাট সংখ্যক মানুষ এখনো বিজ্ঞানের বদলে অবিজ্ঞানে ভরসা করেন, রোগমুক্তির জন্য দেবস্থানে মানত করেন, ওঝার কাছে যান, কিন্তু ডাক্তারের কাছে যান না। অবশ্য তার জন্য তাদের অন্যায় দেখার আগে ভাবা দরকার আমরা সঠিক কথা সঠিক ভাবে মানুষের কাছে পৌঁছে দিচ্ছি কিনা। অন্তত আমরা যারা বিজ্ঞানে ভরসা রাখি এ দায়িত্ব তাদেরও।
আজ থেকে ১৫০ বছর আগের কথা। এক আইরিশ বিজ্ঞানী আলোর গতিবিধি নিয়ে কিছু গবেষণা করছিলেন। কিন্তু ওই বিজ্ঞানে যা হয়েছে বারবার, অর্থাৎ accident। যদিও বলাই বাহুল্য, এখানে এই শব্দের মানে দুর্ঘটনা নয়। আলো নিয়ে গবেষণা করতে করতে তিনি বুঝলেন বাতাসে কেবল ধূলিকণা নয়, জীবাণুও থাকে। কেবল বুঝলেন না... প্রমাণ করলেন। মাস্ক বা রেস্পিরেটরের ব্যবহার তখন খানিকটা জানা। জন টিন্ড্যাল বললেন যে সুতির কাপড়ের আচ্ছাদনের মধ্যে কটন উলের একটা ফিল্টার লাগিয়ে দিলে এই জীবাণুকে শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে আমাদের শরীরের ভেতরে যাওয়া থেকে আটকানো যাবে, যার ফলে আমাদের রোগ-ব্যাধি আটকানো খানিকটা সম্ভব হতে পারে। একবার ভাবুন তো আজকের দিনে দাঁড়িয়ে। করোনা অতিমারী থেকে বাঁচার জন্য আমরা কী ব্যবহার করছি আসলে? আজ থেকে ১৫০ বছর আগে যার কথা শুরু করেছিলেন ওই আইরিশ বিজ্ঞানী – জন টিন্ড্যাল।
ভাবছেন, হচ্ছিল যোগাযোগ ব্যবস্থা আর ইন্টারনেটের কথা, আবার কেন এই মাস্কের কথা! বেশ তো একটু বিস্মরণের পথে যাওয়া হচ্ছিল, আবার কেন? আসলে বলা এইজন্য যে, ভদ্রলোক ওই বিশেষ আচ্ছাদনের কথা না বললে, বাতাসে ভাসমান জীবাণুর কথা সেদিন না বললে আজ আমি জ্যান্ত অবস্থায় এই বিষয়ে লিখতাম কিনা, আপনি পড়তেন কিনা আর প্রকাশক ছাপতেন কিনা এ বিষয়ে আমার সন্দেহ আছে।
যাই হোক, আসল কথায় যাই, অর্থাৎ কিনা যোগাযোগের কথায়। টিন্ড্যাল আরেকটি গবেষণা করেছিলেন এর কিছু আগে, সম্ভবত ১৮৫৪ সালে। আলো বিষয়েই। খুবই সহজ পরীক্ষা। যে কোনো সময় আপনি সহজেই এটা করে ফেলতে পারবেন। দরকার হচ্ছে একটি লেসার টর্চ, একটি স্বচ্ছ প্লাস্টিকের বোতল, খানিকটা জল যেটা বোতলে ভরা হবে আর একটি বোতলে ফুটো করার জন্য কোনো যন্ত্র, আপনার যেটা নিতে ইচ্ছে করে, সেটা। ও হ্যাঁ, আরেকটা জিনিসও নেবেন – জলভর্তি বোতলের নিচে রাখার একটি কানা উঁচু বাটি। এটা যে খুব প্রয়োজন তা নয়, তবে না নিলে ফুটো বোতল থেকে জল পড়ে কী হবে বুঝতেই পারছেন। এবার আসি পরীক্ষার কথায়। বোতলে জল নিয়ে তার একপাশ থেকে আলো ফেললে আলো জলের মধ্যে দিয়ে গিয়ে অন্যপাশে দেওয়ালে গিয়ে পড়বে স্বাভাবিক ভাবেই। নিচে ছবিতে লাল তীর দিয়ে (চিত্র ২ অ) যেমন দেখানো হয়েছে আর কি! এইবার মনে করুন আপনি বোতলের একট দেওয়ালে একটি ফুটো করলেন। জল তো বোতল থেকে যেভাবে বাঁকা পথে বেরোনোর কথা তেমন বেরোবে (চিত্র ২ আ); আপনি বোতলের তলায় কানা উঁচু বাটি রেখেছেন, তাই মেঝেয় পড়বে না, কিন্তু আলো? আমার-আপনার স্বাভাবিক বোধ বলছে আলো আগে যেমন বেরোচ্ছিল, তেমন বেরিয়ে দেওয়ালে পড়বে।
কিন্তু ঘটনা হল, আলো তেমন পথে যাবে না। টর্চ একটু নাড়ালে চাড়ালে মাঝে মাঝে যাবে, কিন্তু বেশিরভাগ সময়েই আপনি দেখবেন আলো ওই জলের ধারার পদাঙ্ক অনুসরণ করছে। যদিও টিন্ড্যাল যখন এই পরীক্ষা করেন, তখন তিনি লেসার টর্চ পাননি, সাধারণ একমুখী আলো ব্যবহার করেই পরীক্ষাটি করেন। এই ঘটনাটি আলোর যে বিশেষ ধর্মের জন্য হয়, তার কথা আমরা ছোটবেলায় বিজ্ঞান বইতে পড়ি, তার নাম প্রতিসরণ। দুটো বিভিন্ন ঘনত্বের মাধ্যম ধরা যাক, এখানে যেমন বোতলের ভেতর জল আর বাইরে হাওয়া।
ঘন মাধ্যমে আলো আস্তে চলে, অনেকটা ভিড় স্টেশনে যেভাবে আপনাকে যেতে হয় আর কি! আর লঘু মাধ্যমে আলো জোরে চলতে পারে, ফাঁকা রাস্তায় আপনি যেমন চলতে পারেন, ঠিক সেরকম। এবার ভিড়ের মধ্যে দিয়ে চলতে চলতে হঠাৎ ফাঁকা রাস্তা পেলে আপনি যেমন ভড়কে যান, আলোরও তেমনি হয়, আর এর ফলে আলো বেশ মজার কিছু কাণ্ড ঘটায়। তার মধ্যে একটি হল টোট্যাল ইন্টারন্যাল রিফ্লেক্সন। এতে আলো এতই ভড়কে যায় যে ভাবে, এত ফাঁকা মানে নিশ্চয়ই সামনে গোলমাল। অতএব সে সুড়সুড় করে যে মাধ্যম দিয়ে যাচ্ছিল সেখানে ফিরে আসে। এই পরীক্ষাতেও আসলে তাই হয়েছিল। এতে একটা ভারি মজার জিনিস দেখা গেল। জলের ধারাটাকে আপনি যদি পাইপ ভাবেন, তাহলে আলো কেমন অবলীলায় সেই পাইপ বেয়ে চলে গেল। পরীক্ষা হলেও সেই মুহূর্তে পরীক্ষাটির গুরুত্ব বোঝা যায়নি। আপাতত আমিও বোঝাব না, আরো কিছুদূর হেঁটে নাহয় এ পথে ফেরত আসা যাবে আবার।
ঘন মাধ্যমে আলো আস্তে চলে, অনেকটা ভিড় স্টেশনে যেভাবে আপনাকে যেতে হয় আর কি! আর লঘু মাধ্যমে আলো জোরে চলতে পারে, ফাঁকা রাস্তায় আপনি যেমন চলতে পারেন, ঠিক সেরকম। এবার ভিড়ের মধ্যে দিয়ে চলতে চলতে হঠাৎ ফাঁকা রাস্তা পেলে আপনি যেমন ভড়কে যান, আলোরও তেমনি হয়, আর এর ফলে আলো বেশ মজার কিছু কাণ্ড ঘটায়। তার মধ্যে একটি হল টোট্যাল ইন্টারন্যাল রিফ্লেক্সন। এতে আলো এতই ভড়কে যায় যে ভাবে, এত ফাঁকা মানে নিশ্চয়ই সামনে গোলমাল। অতএব সে সুড়সুড় করে যে মাধ্যম দিয়ে যাচ্ছিল সেখানে ফিরে আসে। এই পরীক্ষাতেও আসলে তাই হয়েছিল। এতে একটা ভারি মজার জিনিস দেখা গেল। জলের ধারাটাকে আপনি যদি পাইপ ভাবেন, তাহলে আলো কেমন অবলীলায় সেই পাইপ বেয়ে চলে গেল। পরীক্ষা হলেও সেই মুহূর্তে পরীক্ষাটির গুরুত্ব বোঝা যায়নি। আপাতত আমিও বোঝাব না, আরো কিছুদূর হেঁটে নাহয় এ পথে ফেরত আসা যাবে আবার।
এই পরীক্ষা যখন হল, তার কাছাকাছি সময়ে আরও একটা যুগান্তকারী আবিষ্কার হয়েছে। ১৮৭৬ সাল। আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল আবিষ্কার করেছেন টেলিফোন। একটা মাইকের মত জিনিসের সামনে কথা বললে একটা তারের মধ্যে দিয়ে সেই কথা বেশ খানিকটা দূরেও পাঠানো যায়, এটা দেখা গেছে। নিচের ছবিটি (চিত্র ৩) প্রথমবার আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল-এর টেলিফোন ব্যবহারের ছবি। এর ঠিক চার বছরের মাথায় ১৮৮০ সালে এই ভদ্রলোকই আরেকটি যন্ত্র তৈরি করেন। তার নাম ফটোফোন। টেলিফোনের থেকে একটু আলাদা এটি। কিন্তু উদ্দেশ্য সেই যোগাযোগ। ১৮৭৬ এর পর থেকেই এই যন্ত্রে আলোর ব্যবহার নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছিলেন গ্রাহাম বেল, কারণ শব্দের তুলনায় আলো দ্রুতগামী। অনেক দূরে কিছু তথ্য পাঠাতে আলোর জুড়ি মেলা ভার।
এই যন্ত্রেও ওই চিত্র ৩ এর মতই একটি কথা বলার জায়গা ও নল ছিল। নল দিয়ে শব্দ গিয়ে নলের অন্য প্রান্ত্রে রাখা একটা আয়নাকে ধাক্কা মারত। আয়নাটা কোনো সাধারণ আয়না নয়, কানের পর্দার মত স্থিতিস্থাপক কোনো পদার্থ দিয়ে তৈরি। কানের পর্দায় শব্দ ধাক্কা মারলে যেভাবে সেই পর্দা কাঁপে, আমাদের বা গ্রাহাম বেলের আয়নাটিও সেইরকম। তাতে আয়নার ওপর যে আলো পড়ত তা বিভিন্ন তীব্রতায় বিভিন্ন দূরত্বে যেত। এই আলোকে ধরে প্রথম যখন তাকে আবার শব্দে পরিণত করা হয়েছিল। তার জন্য ব্যবহার হয়েছিল ভূষাকালি। তবে জানেন কি যে ভদ্রলোক যন্ত্রের মান উন্নত করার জন্য কী কাণ্ড করেছিলেন? নিজের মধুচন্দ্রিমার সময়েও চিন্তাভাবনা, বিজ্ঞানের পেপার পড়া চালিয়েছেন। সেলেনিয়ামের রোধ (resistance) যে আলোর ওপর নির্ভর করে কমে বাড়ে, এই মধুচন্দ্রিমার সময়েই তাঁর এটা গোচরে আসে – একটি পেপার পড়ে। পরের ফটোফোন যন্ত্রে সেলেনিয়াম ফটোডিটেক্টর ব্যবহার করে আলোকে তড়িৎ-এ রূপান্তরিত করা হয়, শেষে আবার শব্দে। তবে দুঃখের বিষয়, এ যন্ত্র টেলিফোনের মত ভালো কাজ করছিল না। গ্রাহাম বেল যদিও উচ্ছ্বসিত হয়ে তাঁর বাবাকে চিঠিতে লিখেছেলেন যে তাঁর বাবা এবার ঠাকুর্দা হয়েছেন, লিখেছিলেন, তিনি এখন সূর্যের হাসি-গান-কাশি সবই শুনতে পাবেন। কিন্তু নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকা তার রীতিমত সমালোচনা শুরু করে। তাদের মনে হয়েছিল, সাধারণ মানুষের জন্য এই সূর্যের আলো ব্যবহার করে কথা বলার আইডিয়াটি কিম্ভূত ও বাড়াবাড়ি ধরণের।
কিন্তু বিজ্ঞানে সমকাল কোনো কাজের গুরুত্ব বুঝতে ভুল করেছে, এ ঘটনা নতুন নয়। এখানেও তাই হয়েছিল। আজকের দিনে আমরা সবাই প্রায় অপ্টিক্যাল ফাইবার বা ফাইবার অপ্টিক কেব্ল-এর কথা জানি। শব্দ, ছবি, তথ্য, সবকিছু আমরা এখন আলো ব্যবহার করেই পাঠাই। যা একসময় বাজে কথা বলে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, তার ওপর নির্ভর করেই আজকের দিনে আমাদের সারা পৃথিবীটা চলছে।
গ্রাহাম বেল-এর সময় পর্যন্ত আলোকে কোনো নল দিয়ে পাঠানো যায়নি। নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর আপত্তি একেবারে অযৌক্তিক বলা যায় না। গ্রাহাম বেল সূর্যের আলো ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন, যার অনেক অসুবিধে। সব জায়গার আয়না দিয়ে আলো ধরা অসুবিধে। সর্বোপরি মেঘলা দিনে তো মহা সমস্যা। বিজ্ঞানীরা কিন্তু চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন।
এর অনেক দিন পর ১৯৩০ সালে জার্মানির এক ডাক্তারি ছাত্রের মনে হল, আচ্ছা শরীরের ভেতর কোনো যন্ত্র গোলমাল করলে শরীরে তার প্রভাব দিয়ে বোঝা যায় হয়ত, কিন্তু সত্যি সত্যি একেবারে শরীরের ভেতরের ছবি বাইরে আনতে পারলে কেমন হয়! প্রথমেই তো আর মানুষের শরীরে পরীক্ষা করা যায় না, তাই প্রথম কাঁচের নল দিয়ে তিনি ছবি পাঠালেন একটা বাল্বের। এই কাজে তিনি ব্যবহার করলেন অনেকগুলো কাঁচের অতি সূক্ষ্ম নল। এই কাঁচের নল ব্যবহার করে আলো পাঠানোর বিষয়টা অবশ্য জানা ছিল ততদিনে।
কিন্তু সেই কাঁচের নলের বান্ডিল ব্যবহার করে ছবি, যা কিনা আসলে একটা তথ্য, পাঠানোর আইডিয়াটা একেবারেই এঁর। অবশ্য বাবারও বাবা থাকে। তাই এই আইডিয়ার পেছনে যে ভাবনা কাজ করেছিল, তা হল স্টেথোস্কোপের মধ্য দিয়ে শব্দ আসার ভাবনা। শরীরের ভেতরের যে শব্দ সহজে শোনা যায় না, তা শোনার জন্য ব্যবহার হত স্টেথোস্কোপ। ঠিক একইভাবে শরীরের যে অংশ দেখা যায় না, তা দেখার জন্য আলো ব্যবহার করে আসলে স্টেথোস্কোপের মত একটি যন্ত্র তৈরি করতে চেয়েছিলেন তিনি। এই ডাক্তারি ছাত্রের তৈরি জিনিসটাই কিন্তু প্রথম ফাইবার অপ্টিক কেব্ল। সেই যন্ত্র ব্যবহার করে বাল্বের ছবি পাঠানো গেছিল, যদিও ছবি খুব একটা ভালো ছিল না। এর পেটেন্ট ক্লেম করতে গিয়ে ব্যর্থ হন তিনি, কারণ ততদিনে হ্যান্সেল নামে এক আমেরিকান বিজ্ঞানী কাঁচের পাইপ দিয়ে ছবি পাঠানো যায় বলে তার পেটেন্ট নিয়ে বসে আছেন। যদিও ছবি পাঠানোর কৃতিত্ব সম্পূর্ণ ওই ছাত্রেরই ছিল। ছবিটা কীকরে আরেকটু ভালো করা যায় তার জন্য আরেকটু গবেষণা করতে চাইলেন ভদ্রলোক। কিন্তু পারলেন না। কারণ তিনি তখন জার্মানির বাসিন্দা, জাতিতে ইহুদি এবং সময়টা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কিছু আগে। এই ডাক্তারবাবুর নাম হেনরিক ল্যাম। এই প্রযুক্তি আমরা যে যন্ত্রে ব্যবহার করি, এখনও, তা হল এন্ডোস্কোপ।
কিন্তু সেই কাঁচের নলের বান্ডিল ব্যবহার করে ছবি, যা কিনা আসলে একটা তথ্য, পাঠানোর আইডিয়াটা একেবারেই এঁর। অবশ্য বাবারও বাবা থাকে। তাই এই আইডিয়ার পেছনে যে ভাবনা কাজ করেছিল, তা হল স্টেথোস্কোপের মধ্য দিয়ে শব্দ আসার ভাবনা। শরীরের ভেতরের যে শব্দ সহজে শোনা যায় না, তা শোনার জন্য ব্যবহার হত স্টেথোস্কোপ। ঠিক একইভাবে শরীরের যে অংশ দেখা যায় না, তা দেখার জন্য আলো ব্যবহার করে আসলে স্টেথোস্কোপের মত একটি যন্ত্র তৈরি করতে চেয়েছিলেন তিনি। এই ডাক্তারি ছাত্রের তৈরি জিনিসটাই কিন্তু প্রথম ফাইবার অপ্টিক কেব্ল। সেই যন্ত্র ব্যবহার করে বাল্বের ছবি পাঠানো গেছিল, যদিও ছবি খুব একটা ভালো ছিল না। এর পেটেন্ট ক্লেম করতে গিয়ে ব্যর্থ হন তিনি, কারণ ততদিনে হ্যান্সেল নামে এক আমেরিকান বিজ্ঞানী কাঁচের পাইপ দিয়ে ছবি পাঠানো যায় বলে তার পেটেন্ট নিয়ে বসে আছেন। যদিও ছবি পাঠানোর কৃতিত্ব সম্পূর্ণ ওই ছাত্রেরই ছিল। ছবিটা কীকরে আরেকটু ভালো করা যায় তার জন্য আরেকটু গবেষণা করতে চাইলেন ভদ্রলোক। কিন্তু পারলেন না। কারণ তিনি তখন জার্মানির বাসিন্দা, জাতিতে ইহুদি এবং সময়টা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কিছু আগে। এই ডাক্তারবাবুর নাম হেনরিক ল্যাম। এই প্রযুক্তি আমরা যে যন্ত্রে ব্যবহার করি, এখনও, তা হল এন্ডোস্কোপ।
হেনরিক ল্যামের ছবির মান খারাপ ছিল। কিন্তু ওইসময় যে কাঁচের ফাইবার ব্যবহার হত, তাতে ওর চেয়ে বেশি ভালো ছবি পাবার সম্ভাবনা ছিল না। এ বিষয়টা বোঝা গেল পরে। কোনো তথ্য পাঠানোর সময় সবসময়ই কিছু না কিছু অংশ বাদ পড়তে থাকে। ঠিক যেমন, আপনি অনেকখানি রাস্তা হাঁটতে গেলে আস্তে আস্তে আপনার শক্তিক্ষয় হয়, এও তেমনি। ১৯৬৪ সালে দুই বিজ্ঞানী কাও এবং হক্যাম দেখালেন, প্রতি কিলোমিটারে একটা নির্দিষ্ট মানের চেয়ে বেশি তথ্য হারিয়ে যেতে থাকলে, অপ্টিক্যাল ফাইবার দিয়ে ঠিকমত তথ্য পাঠানোর আশা করা যাবে না। সেইসঙ্গে তাঁরা এও বললেন, কাঁচের নল যে কাঁচ দিয়ে তৈরি হচ্ছে তাকে হতে হবে যতটা সম্ভব শুদ্ধ; তবেই এই তথ্য পাঠানোয় সাফল্য আসতে পারে। এর মাত্র ছয় বছরের মধ্যে কর্নিং গ্লাস ওয়ার্কস নামে একটি আমেরিকান কম্পানি এমন অপ্টিক্যাল ফাইবার তৈরি করে যার মধ্যে দিয়ে তথ্য পাঠালে তথ্য হারানোর ভয় খুব কম থাকে। এরাই পরে ক্রমশ ভালো থেকে আরো ভালো অপ্টিক্যাল ফাইবার তৈরি করে। টেলিকমিউনিকেশনের আজকের যে উন্নতি তার পুরোটাই এই অপ্টিক্যাল ফাইবারের জন্য, কারণ অন্য কোনোভাবেই এত বিপুল তথ্য আমরা এক জায়গা থেকে এত সহজে অন্য জায়গায় পাঠাতে পারিনা। প্রথমেই যে ইন্টারনেটের কথা বললাম, তার স্পীড আসে অপ্টিক্যাল ফাইবারের জন্য। ফেসবুকের ক্যালিফোর্নিয়ার হেডকোয়ার্টারে এত সহজে আলোর গতিতে পৌঁছতে গেলে সমুদ্রের তলায় বিছোনো অপ্টিক্যাল ফাইবার-ই ভরসা যে!
এতক্ষণ হেঁটে মনে হয় না আর টিন্ড্যালের আলো বেঁকে যাওয়ার পরীক্ষার গুরুত্ব বোঝাতে হবে পাঠককে। কারণ পাঠক এতক্ষণে নিজেই তা বুঝে নিয়েছেন। আমরা বরং ফিরে দেখব অন্য একজনকে। হেনরিক ল্যাম। রাষ্ট্রব্যবস্থা অসহযোগিতা না করলে এই মানুষটি কাজ চালিয়ে যেতে পারতেন এবং হয়তো আরো আগেই আমরা তথ্য পাঠানোর পথে এগিয়ে যেতাম আরও। ঠিক যেভাবে গ্যালিলিওকে গৃহবন্দী করা হয়েছিল, ডারউইনের তত্ত্ব স্বীকার করতে চায়নি চার্চ, ঠিক যেভাবে নাৎসি জার্মানি থেকে হারিয়ে গেছেন বহু ইহুদি বিজ্ঞানী, সেই একই ধারায় বিজ্ঞানকে অস্বীকার করা হচ্ছে আজও। কিশোরী গ্রেটা থনবার্গও যখন বুঝতে পারে পরিবেশকে কীভাবে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি আমরা, রাষ্ট্রনেতারা তাকে নিয়ে মজা করেন। রাষ্ট্রশক্তি বিজ্ঞানকে আজও অস্বীকার করতে চায়, কারণ বিজ্ঞান বা বিজ্ঞানী, বিক্রি না হয়ে যাওয়া একজন মানুষ সত্য বলেন সবসময়, নতিস্বীকার না করে। ‘হীরক রাজার দেশে’-র সেই গবেষককে মনে আছে তো? প্রতিটি বিজ্ঞানীরই বোধহয় আজ আরেকবার রাষ্ট্রশক্তিকে মনে করিয়ে দেবার সময় এসেছে – “আমি একা, আমি একক, আমি একমেবাদ্বিতীয়ম গবেষক!”
No comments:
Post a Comment