ও বাড়ির চিঠি - শতরূপা দত্ত


ওবাড়ির চিঠি


বাংলাদেশের ঈদ 
শতরূপা দত্ত 



ঈদ মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব। ‘ঈদ’ আরবি শব্দ। যার অর্থ হলো ফিরে আসা। ঈদ যেহেতু আনন্দের বার্তা নিয়ে মুসলমানের দ্বারে বার বার ফিরে আসে, তাই এ আনন্দকে ঈদ হিসেবে নামকরণ করা হয়েছে। 

পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্মে যেসব প্রধান ধর্মীয় উৎসব উদযাপিত হয়, সেগুলোর মধ্যে ঈদুল ফিতর হচ্ছে সময়ের মাপে কনিষ্ঠতম। এই মহান ও পুণ্যময় উৎসবের উদযাপন শুরু হয় আজ থেকে ১৩৮৮ সৌর বছর আগে থেকে। ইসলামের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মদিনাতে হিজরতের অব্যবহিত পরই ঈদুল ফিতর উৎসব পালন শুরু হয়। এর আগে পৌত্তলিক ভাবনায় অগ্নিপূজকদের নওরোজ এবং মূর্তিবাদীদের মিহিরজান নামে দু’টি উৎসবে মদিনাবাসী শরিক হতো। 

বাংলাদেশে ঈদের দিন দুইটি খুবই জাঁকজমকের সাথে উৎসবমুখর পরিবেশে পালিত হয়। সবাই এ দিন যার যার সাধ্য অনুযায়ী ভালো পোশাক পরে। ঘরে ঘরে উন্নতমানের খাবারের আয়োজন করে। আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীরাও এ আনন্দের অংশীদার হয়। মুসলমানরা এ দিন খুতবাসহ ঈদের দুই রাকাত নামাজ আদায় করেন। আত্মীয়-স্বজনের সাথে কুশল বিনিময় করেন। ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সবাই কোলাকুলিসহ সালাম ও শুভেচ্ছা বিনিময় করে। সমাজের ধনী ও সক্ষম ব্যক্তিরা নির্দিষ্ট হারে গরিবদের ফিতরা বা শর্তহীন অনুদান বিতরণ করে থাকে, যা ধর্মীয় দিক থেকে ধনীদের জন্য বাধ্যতামূলক। 

বাংলায় এই উৎসবের কীভাবে উদ্ভব হয়েছিল তার ইতিহাস ও তথ্য সঠিকভাবে আজও জানা যায়নি। বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান তাঁর ‘বাংলায় ঈদ, বাঙালির ঈদ’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘বাংলায় ঈদোৎসবের বিশদ ইতিহাস এখনো লেখা হয়নি। আমাদের এই ভূখণ্ডে কবে, কখন, কীভাবে ঈদোৎসবের উদ্ভব হয়েছে তার কালক্রমিক ঘটনাপঞ্জি কোনো ইতিহাসবেত্তা বা ইসলামের ইতিহাস গবেষক এখনো রচনা করেননি। তবে নানা ইতিহাস গ্রন্থ ও ঐতিহাসিক সূত্র থেকে বাংলাদেশে রোজাপালন এবং ঈদ-উল-ফিতর বা ঈদ-উল-আজহা উদযাপনের যে-খবর পাওয়া যায় তাতে দেখা যায় ১২০৪ খৃস্টাব্দে বঙ্গদেশ মুসলিম অধিকারে এলেও এদেশে নামাজ, রোজা ও ঈদোৎসবের প্রচলন হয়েছে তার বেশকিছু আগে থেকেই। এতে অবশ্য বিস্মিত হবার কিছু নেই। কারণ, বঙ্গদেশ যুদ্ধবিগ্রহের মাধ্যমে মুসলিম অধিকারে আসার বহু আগে থেকেই মধ্য ও পশ্চিম এশিয়া থেকে মুসলিম সুফি, দরবেশ ও সাধকরা ধর্ম-প্রচারের লক্ষ্যে উত্তর ভারত হয়ে পূর্ব-বাংলায় আসেন। অন্যদিকে আরবীয় এবং অন্যান্য মুসলিম দেশের বণিকেরা চট্টগ্রাম নৌবন্দরের মাধ্যমেও বাংলার সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। এভাবেই একটা মুসলিম সাংস্কৃতিক তথা ধর্মীয় প্রভাব যে পূর্ব-বাংলায় পড়েছিল তাতে কোনও সন্দেহ নেই। ঈদোৎসবের সূচনাও ওই প্রক্রিয়াতেই হয়েছে।’ 

বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে রাখা আব্বাসীয় খলিফাদের আমলের রৌপ্যমুদ্রা থেকে জানা যায়, অষ্টম শতকের দিকেই বাংলাদেশে মুসলমানদের আগমন ঘটে। ফলে, এই সুফি, দরবেশ এবং তুর্ক-আরব বণিকদের মাধ্যমে বর্তমান বাংলাদেশে রোজা, নামাজ ও ঈদের সূত্রপাত হয়েছে বলে মনে করা হয়। তবে সেসময় ঈদ-রোজা ছিল বহিরাগত ধর্মসাধক, ব্যবসায়ী ও ভ্রমণকারীদের ধর্মীয় কাজ ও উৎসব। এদেশবাসীর ধর্ম ও সামাজিক পার্বণ নয়। 

এ দেশে রোজা পালনের প্রথম ঐতিহাসিক বিবরণ পাওয়া যায় তাসকিরাতুল সোলহা নামের গ্রন্থে। এ গ্রন্থে দেখা যায় আরবের জনৈক শেখউল খিদা হিজরি ৩৪১ সন মোতাবেক ৯৪১ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় আসেন। বঙ্গদেশে ইসলাম আগমন পূর্বকালে শাহ সুলতান রুমি নেত্রকোনা এবং বাবা আদম শহীদ বিক্রমপুরের রামপালে আস্তানা গেড়ে (সেন আমলে) ইসলাম প্রচার শুরু করেন বলে জানা যায়। শেখউল খিদা চন্দ বংশীয় রাজা শ্রীচন্দের শাসনকালে (৯০৫-৯৫৫ খৃস্টাব্দ) বাংলায় আগমন করেন বলে অনুমান করা হয়। 

তবে এদের প্রভাবেই পূর্ব বাংলায় রোজা, নামাজ ও ঈদ প্রচলিত হয়েছিল, এ কথা বলা যায় না। এঁরা ব্যক্তিগত জীবনে ওইসব ইসলাম ধর্মীয় কৃত্য ও উৎসব পালন করতেন একথা বলাই সঙ্গত। কারণ বাংলাদেশে ‘নামাজ’, ‘রোজা’ বা ‘খোদা হাফেজ’ শব্দের ব্যাপক প্রচলনে বোঝা যায়, আরবীয়রা নয়, ইরানীরাই বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। কারণ শব্দগুলি আরবীয় ভাষার নয়, ফার্সি ভাষার। 

ঢাকার ইতিহাসবিদ হাকিম হাবীবুর রহমান বলেছেন , ১৬৪০ খ্রিস্টাব্দে বাংলার সুবেদার শাহসুজার নির্দেশে তাঁর প্রধান অমাত্য মীর আবুল কাসেম একটি ঈদগা নির্মাণ করেন। এর দৈর্ঘ্য ছিল ২৪৫ ফুট ও প্রস্থ ১৩৭ ফুট।নির্মাণকালে ঈগদাটি ভূমি থেকে বার ফুট উঁচু করা হয়। ঈদগাহের পশ্চিম দিকে ১৫ ফুট উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘিরে সেখানে মেহরাব ও মিনার নির্মাণ করা হয়। মুঘল আমলে দরবার, আদালত, বাজার ও সৈন্য ছাউনির কেন্দ্রে অবস্থিত ছিল এ ঈদগা। প্রথম দিকে শুধু সুবেদার, নায়েবে নাজিম ও অভিজাত মুঘল কর্মকর্তা এবং তাদের স্বজন-বান্ধবরাই এখানে নামাজ পড়তে পারতেন। পরে ঈদগাটি সকলের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। এই ঈদগার পাশে উনিশ শতকের শেষ দিক থেকে একটি মেলারও আয়োজন করা হয়। এই ঈদগার পাশে একটি সুন্দর সেতুর চিহ্নও রয়েছে। ঈদগাটি এখন সংরক্ষিত পুরাকীর্তি। 

মুঘল যুগে ঈদের দিন যে হইচই বা আনন্দ হতো তা মুঘল ও বনেদি পরিবারের উচ্চপদস্থ এবং ধনাঢ্য মুসলমানদের মধ্যে কিছুটা হলেও সীমাবদ্ধ ছিল। তার সাথে সাধারণ মানুষের ব্যবধান না থাকলেও কিছু দূরত্ব ছিল। তাই ঈদ এ দেশে জাতীয় উৎসবে রূপান্তর হতে সময় নিয়েছে। 

‘সেকালের ঈদ’ প্রবন্ধে শামসুজ্জামান খান লিখেছেন, ‘রাজধানী শহর ঢাকার (১৬০৮) প্রতিষ্ঠার পর এখানে মোগল শাসক, ঢাকার নবাব, অভিজাত ধনিক-বণিক সম্প্রদায় এবং আদি ঢাকাবাসীর বর্ণাঢ্য ঈদ উৎসব উদ্​যাপনের পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু গ্রামীণ বাংলাদেশে সেকালে ঈদ উৎসব তেমন একটা ছিল না বললেই চলে। কারণ, কৃষিনির্ভর গ্রামবাংলার মুসলমানরা ছিল দরিদ্র, তাদের হাতে নগদ অর্থ ছিল না। আধুনিক অর্থে সামাজিক চেতনা ও কমিউনিটির বোধেরও তখন জন্ম হয়নি। ফলে ধর্মীয় উৎসবকে একটা সামাজিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর অবস্থাও সৃষ্টি হয়নি। ১৯৩৭-৪০-এ শেরেবাংলা, নজরুল, আব্বাসউদ্দীনের রাজনীতি, সাহিত্য ও সংগীতে তার সূত্রপাত। আর ১৯৭১-এ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর নগর উন্নয়ন, মধ্যবিত্তের বিপুল বিস্তার এবং নগদ অর্থবিত্তের সমাগমে ঈদ উৎসব এক প্রধান বর্ণাঢ্য ও জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে। সেকাল থেকে একালে উত্তীর্ণ ঈদ উৎসব এখন অনুজ্জ্বল থেকে ক্রমে ক্রমে অত্যুজ্জ্বল মহিমায় অভিষিক্ত।’ 

উনিশ শতকের শেষ দিকে ঈদের আনুষঙ্গিক আনন্দ হিসেবে যুক্ত হয় একটি নতুন উপাদান, লোকজ মেলা। সেই ধারা আজো কমবেশি অব্যাহত রয়েছে। বর্তমানে ঈদ উপলক্ষে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঈদ আনন্দমেলার আয়োজন করা হয়। 

ধর্মীয় উৎসব হিসেবে ঈদুল ফিতরের আনুষ্ঠানিকতার দিকটি প্রধানত মুসলমানদের মধ্যেই সীমিত থাকে। তবে বাংলাদেশে ঈদের আনন্দোৎসবের দিকটি সব ধর্ম-বর্ণের মানুষের মধ্যেই সমানভাবে ছড়িয়ে পড়ে। ছোটবেলায় ঈদের দিন সকাল সকাল তৈরি হয়ে বন্ধুদের বাসায় বাসায় বেড়াতে যাওয়ার মজার কথা আজো ভুলতে পারি না। গণমাধ্যম কর্মী হওয়ার সুবাদে এখন ঈদের দিনটা সাধারণত কর্মক্ষেত্রেই কাটাতে হয়। কিন্তু সহকর্মীদের সাথে ঈদের আনন্দ ভাগ করে নেয়ার মজাটা পাওয়া যায়। বয়সে বড় সহকর্মীদের কাছ থেকে সেলামী আদায় করা আর ছোটদের সেলামী দেয়া, কাজের ফাঁকে পরস্পরের হাতে মেহেদী পরিয়ে দেয়া, অফিসে খাওয়া-দাওয়ার বিশেষ আয়োজন আর অফিস শেষে বন্ধুদের সাথে ঘুরে বেড়ানো বা স্রেফ আড্ডার মধ্য দিয়ে এখন ঈদের দিন কাটে। অন্যধর্মের মানুষ হয়েও এ আনন্দে শরিক হতে কোনো দিন কোনো বাধা অনুভব করি নি। আমি এমন অনেক অমুসলিম পরিবারকে চিনি, যারা ঈদ উপলক্ষে নতুন কাপড় কেনেন, ঈদের দিন ঘরে সেমাই, পায়েস, পোলাও-মাংসের আয়োজন করেন। এ যেন শুধুই অকারণ আনন্দে উৎসবে মেতে থাকা। বাংলাদেশে তাই ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’। বাঙালির সংস্কৃতি হলো ধর্মনিরপেক্ষ মানবসংস্কৃতি, উদার সামাজিক সম্প্রীতি ও সহাবস্থানের সংস্কৃতি। বাঙালি সংস্কৃতিতে আছে সামাজিক সম্মিলন ও সমন্বিত ভাবধারা। বাঙালি সংস্কৃতির সামাজিক উপাদানগুলো সংস্কৃতির শক্তিকে বলিষ্ঠতা দিয়েছে।এমনকি ধর্মীয় উৎসব-পার্বণগুলোও পরিণত হয়েছে বাঙালি সংস্কৃতির উপাদানে। 

ঈদ সামনে রেখে প্রতিবারই ঈদের বাজার চাঙ্গা হয়ে ওঠে, এতে একই সাথে চাঙ্গা হয়ে ওঠে দেশের অর্থনীতি। ঈদ উপলক্ষে প্রবাসীরা বিপুল পরিমাণ রেমিটেন্স দেশে পাঠায়। ঈদের সময় বৈদেশিক আয়ের প্রবাহ বেড়ে যাওয়া গ্রামীণ অর্থনীতিও চাঙ্গা হয়ে ওঠে। চাঙ্গা হয়ে ওঠে ব্যাংকিং খাতও। 

তথ্যপ্রযুক্তির অগ্রগতি, ইন্টারনেট ও স্যাটেলাইট টিভির প্রভাবে বর্তমানে ঈদ উদযাপনের পদ্ধতি পাল্টে গেছে। আগে ঈদের শুভেচ্ছা জানানোর জন্য ঈদকার্ড প্রেরণ বেশ জনপ্রিয় ছিল। বর্তমানে অফিস ও কর্পোরেট জগতে এর প্রচলন থাকলেও ব্যক্তি পর্যায়ে তেমন একটা নেই বললেই চলে। সে জায়গা দখল করেছে ফেসবুক, হোয়াটসএ্যাপ, ইনস্ট্রাগ্রাম, ভাইবার, টুইটার, ইমেইল বা মোবাইলের এসএমএস বা এমএমএস। ঈদের আনন্দ আবর্তিত হয় ফ্যাশন ডিজাইন, বিউটি পারলার ও শপিংকে কেন্দ্র করে। তবে কিশোরী-তরুণীদের হাতে মেহেদি লাগানো একাল-সেকাল দুই কালেই খুব জনপ্রিয়। ঈদ উপলক্ষে সাত দিনব্যাপী বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন থাকে স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলগুলোতে। 

ঈদের দিনে দল বেঁধে প্রতিবেশীদের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার নিয়ম গ্রামে কিছুটা থাকলেও শহরে এখন নেই বললেই চলে। সারাদিন অলস সময় কাটানোর পর বিকালে বা সন্ধ্যায় শিশু পার্ক, এ্যামিউজমেন্ট পার্ক বা আত্মীয়স্বজনদের বাসায় বেড়াতে বের হয় কেউ কেউ। এছাড়া ঘরে বসে টেলিভিশনে নানা রকম অনুষ্ঠান উপভোগ করেই দিন কাটিয়ে দেয় কেউ কেউ। 

একসময় ঈদের সেলামি হিসেবে বরাদ্দ থাকত পাঁচ-দশ টাকা বা পঞ্চাশ টাকা। এখন অবশ্য সেটা ৫০০ টাকাও ছাড়িয়েছে। আগের মতো যৌথ পরিবারে ঈদ কাটানোর সৌভাগ্য অনেকের হয় না। সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে বদলে গেছে অনেক কিছু।

No comments:

Post a Comment