সম্পাদকীয়



সম্পাদকীয়


দিন দশেক আগেই শেষ হলো বইমেলা... মেলা বই নিয়ে নাড়াচাড়া। মূলত মাতৃভাষাতেই। আজ আবার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। 

আমাদের ছোটোবেলায়, মনে আছে বাংলাদেশ দূরদর্শনে এই দিনে বাজতো সেই বিখ্যাত গান - আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলতে পারি! গায়ে কাঁটা দিতো... এখনও বাজে... কিন্তু শিহরিত হই না আর। ভাষার জন্য যে জাতি একদিন প্রাণ দিয়েছিলো, ধর্মের জন্য প্রাণ নিতে তারাই যখন আজ উদ্যত হয়, বড়ো অবাক লাগে, অসহায় লাগে!  কিন্তু সে অন্য প্রসঙ্গ। 

আপাতত, আমরা এই ভেবে খুশি থাকতে পারি যে, বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চার যে নতুন জোয়ার এসেছে, তাতে শুধু দুই বাংলার নয়, সামিল হয়েছেন সারা বিশ্বের মননশীল বাঙালী। এখানে যে অবশ্যই একটা বিশাল ভূমিকা পালন করেছে সোশ্যাল মিডিয়া, একথা অনস্বীকার্য। আর ঋতবাকের জন্ম এবং সাহিত্যযাত্রাও শুরু এই সোশ্যাল মিডিয়াতেই। 

প্রসঙ্গত, একটা ইন্টারেস্টিং ইনফরমেশন দিই। সমস্ত ভারতীয় ভাষা মিলিয়ে সারা বছরে যত বই প্রকাশিত হয়, শুধু বাংলা ভাষায় হয় তার দ্বিগুণেরও বেশি। 

তাই সাহিত্যপ্রেমী বাঙালী, নিশ্চিন্তে ডুব দিন আরও সৃজনশীলতায়। 

শুভেচ্ছা নিরন্তর

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - সুশীল সাহা


প্রচ্ছদ নিবন্ধ


বাংলা ভাষা নিয়ে দু’কথা
সুশীল সাহা 


বাংলা ভাষা নিয়ে আমাদের দুশ্চিন্তা দুর্ভাবনার শেষ নেই। বাংলাদেশে এবং আসামে দু’দুটো বড় রকমের ভাষা আন্দোলন ঘটে গেছে। একুশে ফেব্রুয়ারির জেরে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদায় আমরা বাঙ্গালিরা পরম গৌরবান্বিত। তবু এই ভাষা নিয়ে আমাদের সংশয় আর আশঙ্কা কিছুতেই যেন কাটতে চায় না। শিক্ষার সর্বস্তরে, প্রশাসনিক কাজকর্মে এই ভাষার ব্যবহার নিয়ে আজও আমাদের দ্বিধা কাটলো না। তাই ভাষা দিবসের সম্বৎসরের আয়োজনে কিছু প্রশ্ন আমাদের বিদ্ধ করে। আমরা উৎসব আর অতীত গৌরবের আত্ম কণ্ডুয়নের বিলাসিতায় সময় কাটাতে কাটাতে একসময় কেমন যেন এক আশঙ্কার ভয়ার্ত অন্ধকারে নিমজ্জিত হই। এর যে কিছু সঙ্গত কারণ আছেই। অনেকেই গোড়ায় গলদ বলে এক অব্যর্থ অভিযোগ করে থাকেন। কেন একুশে বা উনিশে? গোড়াতেই আমরা বাংলা সাল ও মাসের কথা ভুলে বসে আছি। আমদের ব্যবহারিক জীবনে বাংলা সাল ও মাসকে আমরা কবে থেকেই তো বর্জন করেছি! কেবল পয়লা বৈশাখ এলে কেমন যেন একটু নড়েচড়ে বসি। কিন্তু তা তো ওই একটা দিনের জন্যেই। পরদিন থেকেই আমরা ভুলে যাই সব। আমাদের জীবনের একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে ইংরেজি কেতা। দীর্ঘ দুশো বছরের গোলামির সংস্কার কবে যে দূর হবে কে জানে! তাই ভাষা দিবস উদযাপনের প্রাক্কালে কিছু নেতিবাচক কথা আমাদের শুনতেই হয়। এই পশ্চিমবঙ্গেই বিভিন্ন স্কুলে বাংলা ভাষার কোনও চর্চাই প্রায় নেই। যেটুকু আছে সেটুকু না থাকারই শামিল। গোটা শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বাংলা ভাষাকে বিতাড়ণের নানা চক্রান্তের আয়োজন আমরা নিয়ত প্রত্যক্ষ করছি। ইংরেজি মাধ্যমের দাপটে বহু ছাত্রই বাংলা পড়তে পারে না। যেটুকু কষ্ট করে বলে তাও কেমন বিদেশি কেতায় আচ্ছন্ন। বাংলা ভাষার চর্চা মানে পিছিয়ে পড়া, এমন একটা ভাবনা খুব সুচতুরভাবে আমাদের মাথার মধ্যে কে বা কারা যেন ঢুকিয়ে দিয়েছে। সেই ঘোর থেকে আমাদের যেন মুক্তি নেই। আমাদের তরুণদের মুখের ভাষার অনেকটা ভুল ইংরেজি আর হিন্দি আর বাকিটা বিকৃত উচ্চারণের বাংলা। প্রচারের যে কোনও মাধ্যমের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই আমাদের চেনা বাংলাকে নানাভাবে উদ্ভট করে তোলা হচ্ছে। এফ এম রেডিওতে ব্যবহৃত কথাগুলোকে কি প্রমিত বাংলা বলা যায়! এই চরম যথেচ্ছাচার থেকে উদ্ধারের জন্যে আমাদের নিত্য হাহুতাশ শুনতে হয়, কিন্তু এ থেকে উদ্ধার পাবার কোনও সুসংহত চেষ্টা আমাদের নেই। তাই প্রতি বছর ভাষা দিবস পালনের প্রাক্কালে কিছু নেতিবাচক অভিযোগে আমরা বিদ্ধ হই। প্রশ্ন হল, এই অভিযোগগুলোর প্রকৃত ময়নাতদন্ত করব নাকি একে চিরাচরিত উপেক্ষার আড়ালে ফেলে দেব? 

নোয়াম চমস্কি একবার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘‘…সর্বজনীন ব্যাকরণকে লঙ্ঘিত করে যে কৃত্রিম ভাষা, তা একজন তত তাড়াতাড়ি শিখতে পারে না যতটা সে সহজ ভাষার মধ্যে ডুব দিয়ে পারে। ওই ধরনের ভাষাচর্চা অনেকটা ধাঁধা বা হেঁয়ালি আয়ত্ত করার মতো। একইভাবে এমন সমাজে কোনও মানুষ সামাজিকভাবে অবস্থান করতেই পারেনা, যা তার জৈব নির্ধারিত ধারণা বা সামাজিক চাহিদাগুলির সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন।’’এই আপ্ত বাক্যটির মধ্যে অনেক গূঢ় সন্দেশ লুকিয়ে আছে। আমাদের চারপাশের ভাষা ব্যবহারের যে স্বেচ্ছাচারিতায় আমরা বিষাদ্গ্রস্ত হই, তা এক ধরনের সাময়িক ধোঁয়াশা ছাড়া আর কিছু নয়। আজন্মলব্ধ ভাষার এক ধরনের মাধুর্য আছে, বিকৃত বিকল্পের সন্ধানে ভাষা ব্যবহারে যে লঘু ও তরল কিছু উপাদান মিশ্রিত হয়ে যুগে যুগে তৈরি হয় যে অপভাষা, তা কিন্তু খুব বেশিদিন স্থায়ী হয় না। তাৎক্ষণিক ঘোরের প্রকোপ আপাত ভয়াবহ হলেও এতে কোনও আশঙ্কার কারণ আছে বলে অনেকেই মনে করেন না। কিন্তু প্রমিত বাংলা ভাষা নিয়ে আমাদের সংশয় কিন্তু থেকেই যায়। আপামর বাঙ্গালির মুখের ভাষার এক এবং অভিন্ন প্রমিত অবয়বের কথা আমরা প্রায়শ বলে থাকি। কিন্তু বিভিন্ন মাধ্যমে তার প্রয়োগের ভিন্নতা দেখতে পাই এবং তা নিয়ে আমরা মাঝে মাঝেই ক্ষোভ প্রকাশ করি। তবু লিখিত ভাষা প্রয়োগের একটা গ্রহণযোগ্য রূপ আমরাকিছু কিছু ভিন্নতা সত্ত্বেও মেনে নিয়েছি। কিন্তু একদিকে আঞ্চলিক ভাষার অসংখ্য ভিন্নতা আর অন্যদিকে প্রচারমাধ্যমের কিছু কিছু অপকৌশলে ভাষা ব্যবহারের এক ধরনের যথেচ্ছাচার নিত্য দেখতে পাচ্ছি। সাময়িকভাবে হলেও বহু মানুষই তাতে আকৃষ্ট হচ্ছেনও।তাই আমাদের চারপাশে নিত্য ঘটে যাওয়া ভাষা ব্যবহারের স্বেচ্ছাচারিতা আমাদের বিষণ্ণ করে। টেলিভিশনের এক অনুষ্ঠানে সঞ্চালক হিসেবে এক বিশিষ্ট বাঙ্গালি যখন বলেন, ‘একটা চটপটা ব্রেক নোব’ কিংবা কারো মৃত্যুসংবাদ দিয়ে সংবাদ পাঠিকা যখন বলেন আমরা তাঁর ‘রুহের মাগ ফেরাত কামনা করি’ তখন ভাষা ব্যবহারে এক ধরনের ‘গাজোয়ারি’ মনোভাব আমাদের আতঙ্কিত করে তোলে। পশ্চিমবঙ্গও বাংলাদেশের সংবাদ পত্রের ভাষাও নানা ক্ষেত্রে ভিন্ন। শোক জ্ঞাপনের অন্য শব্দ যে ‘আহাজারি’ এটা পশ্চিমবঙ্গের অনেকেই জানেন না। ‘ঘাপলা’, ‘পিচ্চি’ ইত্যাদি শব্দ বাংলাদেশে আকছার ব্যবহৃত হয়। এই শব্দগুলোও এই বঙ্গে একেবারেই অপরিচিত। বাংলাদেশে কিছু কিছু সাহিত্যিক আবার মনে করেন ওখানকার লিখিত বা মুখের ভাষা পশ্চিমবঙ্গ থেকে নানাকারণে ভিন্ন। এর সপক্ষে তাঁরা নানাভাবে নানারকম ঐতিহাসিক তথ্যপ্রমাণের উপর ভিত্তি করে অনেক নড়বড়ে যুক্তি খাড়া করেন। তাঁদের সেইসব সাহিত্য রচনার নমুনা আমাদের কিছুটা হলেও বিভ্রান্ত করে বৈ কি ! 

কিন্তু এতসব নেতিবাচক আশঙ্কার বাতাবরণ থাকা সত্ত্বেও বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে আমাদের গৌরব কিছুই ক্ষুন্ন হয় না। ভাবতে ভাল লাগে সারা বিশ্বের তেত্রিশ কোটি মানুষ আজ এই ভাষায় কথা বলে। পৃথিবীর মধুরতম ভাষা হিসেবে স্বীকৃত এই ভাষার স্থান ষষ্ঠ। বহির্ভারতে প্রায় একশোটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ভাষার পঠনপাঠন ও গবেষণা হচ্ছে। বিদেশের বহু মানুষ নানাভাবে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির জন্যে নিরলস কাজ করে চলেছেন। একজন ক্লিন্টন বি সিলি বা উইলিয়াম রাদিচে কেবল নয়, সারা পৃথিবীতে অসংখ্য গুণী মানুষ আছেন, যাঁরা নিরন্তর এই ভাষার জন্যে কাজ করছেন। 

মনে রাখা দরকার, ভাষার ভিতরে আছে এক ধরনের দুর্মর রক্ষণশীলতা, ভাষা নিজেই তার উপর চাপানো সংস্কারের প্রতিকূলতা প্রতিরোধ করে, অনেক ঝড়ঝঞ্ঝা উপেক্ষা করে ভাষা জাতির জীবন-ক্রিয়ার সঙ্গে মিশে থাকে। তার ভিতরের বর্ম ভেদ করে তাকে বিলুপ্ত করা অত সহজ ব্যাপার নয়। পৃথিবী থেকে নানা ভাষার বিলুপ্তির কারণ কেবল সেই জাতি বা গোষ্ঠীর ঔদাসীন্য নয়, এর পিছনে আছে অনেক নৃতাত্ত্বিক অভিঘাত। উপর থেকে চাপানো শক্তিশেল নয়, অন্তর্গত দীনতা ও সংশয় এর জন্যে অনেকটাই দায়ী। 

তবু সম্বৎসরের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা উদযাপনের সময় নানা সংশয় ও দ্বিধা, আশঙ্কা ও পিছুটান আমাদের গ্রাস করে। তবে ভাষা হল এক ধরনের চলমান স্রোত। সেই স্রোতের তোড়ে নানা আবর্জনার সঙ্গে হয়তো কিছু সুমিত অনুধ্যান ভেসে যায়। কিন্তু যে ভাষায় এত মানুষ কথা বলেন, যে ভাষায় প্রতি বছর অসংখ্য গল্প কবিতা উপন্যাস প্রকাশিত হয়, যে ভাষায় এত পত্রিকা, এত বই লক্ষ লক্ষ মানুষের মনোযোগের কারণ,তা কি এত সহজে বিনষ্ট হতে পারে! ভাষার এই প্রবহমান স্রোত যাতে বাধা না পায়, যাতে আমাদের এই মধুরতম ভাষার সম্পদগুলি হারিয়ে না যায়, তার দিকে সচেতন লক্ষ্য রাখতে হবে। আর বাইরের আক্রমণ ও আগ্রাসনের জন্য ভীত হবার তেমন কারণ নেই। কেননা কেবল মুষ্টিমেয় শহরবাসীই শুধু নয়, এই ভাষায় কথা বলেন বিপুল পরিমাণ মানুষ, যাঁরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন গ্রামাঞ্চলে, মফসসলে, দেশবিদেশের বিভিন্ন প্রান্তে। বিপুল প্রান্তিক মানুষের ভাব বিনিময়ের এই একমাত্র মাধ্যমকে বিনষ্ট করা কি অত সহজ? 

পরিশেষে রবীন্দ্রনাথের একটি উক্তি দিয়ে এই লেখার ইতি টানতে চাই। কেননা কেবল ভাষা নয়, জীবনের নানা কর্ম ও উদযাপনে, আরোপ ও উদ্ভাবনে তিনি যে আমাদের মনের আনন্দ, প্রাণের আরাম ও আত্মার শান্তি! 

“পথহীন মাঠের মধ্যে দিয়ে যখন একজন বা দু’চারজন মানুষ কোনো-এক সময়ে চলে গেছে, তখন তাদের পায়ের চাপে মাটি ও ঘাস চাপা পড়ে একটা আকস্মিক সংকেত তৈরি হয়েছে। পরবর্তী পথিকেরা তারই আহ্বান পায়। এমনি করে পদক্ষেপের প্রবাহে এ পথ চিহ্নিত হতে পারে। যদি পরিশ্রম বাঁচাবার জন্যে মানুষ এ পথ বানাতে বিশেষ চেষ্টা করত তাহলে রাস্তা হত সিধে; কিন্তু দেখতে পাই, মেঠো পথ চলেছে বেঁকেচুরে। তাতে রাস্তা দীর্ঘ হয়েছে কিনা সে কেউ বিচার করে নি। 

ভাষার আকস্মিক সংকেত এমনি করে অলক্ষ্যেটেনে নিয়ে চলেছে যে পথে সেটা আঁকাবাঁকা পথ হিসেব করে তৈরি হয় নি, হয়েছে ইশারা থেকে ইশারায়। পুরোনো রাস্তা কিছু কিছু জীর্ণ হয়েছে, আবার তার উপরে নতুন সংস্কারেরও হাত পড়েছে। অনেক খুঁত আছে তার মধ্যে,নানা স্থানেই সে যুক্তিসংগত নয়। না হোক তবু সে প্রাণের জিনিস, সমস্ত জাতের প্রাণ–মনের সঙ্গে সে গেছে এক হয়ে।’’ (বাংলাভাষা পরিচয়, রবীন্দ্র রচনাবলী, ১০ম খণ্ড,পৃষ্ঠা ১০২১-২২, প ব সরকার, ‘৮৯) 

ভাষা নিয়ে এমন অসাধারণ বক্তব্যের সঙ্গে একমত না হয়ে উপায় কী! জল এবং বাতাসের মতো জীবনধারণের প্রধানতম উপকরণের ন্যায় ভাষাও আমাদের অলক্ষ্যে নিজেই নিজের পথ তৈরি করে নিয়ে হয়ে উঠেছে আমাদের জীবনের এক অন্যতম শ্রেষ্ঠ অবলম্বন, তাকে খুব সহজে বিনষ্ট করা যাবে না। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে তাই আমাদের ‘আমরি বাংলাভাষা’র জন্যে কিছু আবেগ, কিছু ভালবাসা এবং কিছু প্রতিজ্ঞা নেবার অবকাশ থেকেই যাবে। এবং তা থেকে হাত গুটিয়ে বসে থাকা আত্মহত্যার নামান্তর হবে!

প্রবন্ধ - পল্লববরন পাল


প্রবন্ধ


পদাতিক ৮০ 
পল্লববরন পাল 



মাপ করবেন, কত বয়েস? 

সাতাশ। 

ও, তাহলে তো ‘পদাতিক’-এরই সমবয়সী! 

আপনি মনে মনে ভাবলেন –দেখলে! দেখলে! কেমন কায়দা করে ‘পদাতিক’-কে ছোকরা বানিয়ে দিলাম। তাছাড়া কথাটাও তো মিথ্যে নয়– সাতাশ বছর আগেই তো প্রথম‘পদাতিক’বেরিয়েছিল। 

কাজেই তার টেবিলে স্বচ্ছন্দে কিছুক্ষণের জন্য ‘পদাতিক’কে আপনি বসিয়ে রেখে গেলেন। ফিরে এসে দেখলেন টেবিল ফাঁকা। চুলে কলপ না দেওয়ার জন্যে যখন আপনার আপসোস হচ্ছে তখন হঠাৎ একদিকে নজর পড়ল। দেখলেন –কী কাণ্ড! 

আঠারো থেকে একুশ বছরের একরত্তি ছোকরাদের সঙ্গে দিব্যি জ’মেব’সেগেছে‘পদাতিক’।আপনিইশারায়ডাকছেন, কিন্তু সে-কথা তার কানেই যাচ্ছে না। কাছে গিয়ে দাঁড়ালে আপনাকে সে এখন চিনতে পারবে কিনা সন্দেহ। 

দেখলেন তো, টেবিল বদলে ‘পদাতিক’-এর বয়েস কেমন সাতাশ থেকে একুশে নামিয়ে দিলাম! কেননা তখন আমিও ছিলাম একুশ বছরেরই ছোকরা। 

এই সাতাশ বছরে আমার বয়েস বেড়েছে। কিন্তু ‘পদাতিক’ সেই একুশেই আটকে আছে। 

‘পদাতিক’কে একমাত্র সেই কারণেই এখন আমি হিংসে করি। 

‘পদাতিক’ কাব্যগ্রন্থের ভূমিকা - স্বয়ং কবির লেখা– কবির নাম সুভাষ মুখোপাধ্যায়। ৬ই মার্চ ১৯৬৭ সালে অদ্ভুত এই ভূমিকাটি চতুর্থ (প্রথম‘ভারবি’) সংস্করণে ছাপা হয়েছিলো। অর্থাৎ, পদাতিক-এর জন্ম ১৯৪০ সালে – আজ্ঞে হ্যাঁ, ফেব্রুয়ারি ১৯৪০-এ –কবিতা ভবন, ২০২ রাসবিহারী অ্যাভিনিউ, বালিগঞ্জ পি১০৪/১ লেক রোড থেকে গ্রন্থকার-কর্তৃক প্রকাশিত। ৬১ ধর্মতলা স্ট্রিট, রঙমশাল প্রেস থেকে শ্রী কানাই লাল গুপ্ত কর্তৃক মুদ্রিত। উৎসর্গ - বাবা ও মাকে। মূল্য -এক টাকা। পৃষ্ঠা ৩২। 

কমরেড, আজ নবযুগ আনবে না? 
কুয়াশাকঠিন বাসর যে সম্মুখে। 
লাল উল্কিতে পরস্পরকে চেনা – 
দলে টানো হতবুদ্ধি ত্রিশঙ্কুকে, 
কমরেড, আজ নবযুগ আনবে না? 

ভূমিকার পাতা উল্টে সামনে এগোলে একটু হোঁচট খেতে হয় – মানে ‘পদাতিক’ যতোদিন শুধুমাত্র একটা কাব্যগ্রন্থ ছিলো – প্রথম কবিতা ছিলো মে-দিনের কবিতা –যে কবিতার লাইন বিগত প্রায় ষাট বছরের বাংলা কবিতা পাঠকের কন্ঠস্থ- কিন্তু এপ্রিল ১৯৯২ সালে কবিতা সংগ্রহ প্রথম খণ্ডে (প্রকাশক ‘দেজ পাবলিশিং’) মূল বইয়ের দ্বিতীয় কবিতাটিকে টপকে সামনে নিয়ে এলেন কে? – স্বয়ং কবি নাকি এটা নিতান্তই প্রমাদ – জানিনা। কবিতাক্রমে আরও এদিকওদিক আছে –বইয়ের প্রথম সংস্করণে ৫ও ৬ নম্বর কবিতা ছিলো ‘বিরোধ’ ও ‘প্রস্তাব’ – কবিতা সংগ্রহে যথাক্রমে ৬ ও ৫ নম্বর। তেমনি, ১৩ নম্বর আগে ছিলো ‘আলাপ’ – সংগ্রহে সেটি ১৮। আর শেষ দু’টি কবিতা অর্থাৎ ২২ ও ২৩ নম্বরও পরস্পর জায়গাবদল করেছে – ‘কিংবদন্তী’ ও ‘আর্য’ সংগ্রহে যথাক্রমে ‘আর্য’ ও ‘কিংবদন্তী’।অর্থাৎ, এটুকু বোঝা যাচ্ছে, ব্যাপারটা নিতান্তই প্রমাদ নয়। তবে কি কবি নিজেই এই ক্রমে বদল করেছেন? কিন্তু কেন?– শিরোনাম - সকলের গান –

কমরেড, আজ নবযুগ আনবে না?
কুয়াশাকঠিন বাসর যে সম্মুখে।
লাল উল্কিতে পরস্পরকে চেনা –
দলে টানো হতবুদ্ধি ত্রিশঙ্কুকে,
কমরেড, আজ নবযুগ আনবে না?

কোনো ঢাক-ঢাক নেই – সোজাসুজি – সটান – সহজ প্রশ্ন – আজ নবযুগ আনবে না? – এ তো সকলের মনের কথা!অতি অনায়াস ভঙ্গিতে হাঁটতে হাঁটতে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ঢুকে পড়লেন মাত্র একুশ বছরের কলেজ ছাত্র সুভাষ মুখোপাধ্যায়। 

১৯৪০ সাল –প্রাক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমসাময়িক বাঙলায় তখনও রবীন্দ্রনাথ স্বমহিমায় আলো ছড়াচ্ছেন। ‘পদাতিক’ প্রকাশ পায় ফেব্রুয়ারি মাসে, আর জানুয়ারিতে রবীন্দ্রনাথ লিখে সুর দিচ্ছেন 

‘কোথাও আমার হারিয়ে যাবার নেই মানা মনে মনে... 
সূর্য যখন অস্তে পড়ে ঢলি 
মেঘে মেঘে আকাশকুসুম তুলি। 
সাত সাগরের ফেনায় ফেনায় মিশে 
যাই ভেসে দূর দিশে, 
পরীর দেশের বন্ধ দুয়ার দিই হানা 
মনে মনে’ 

১৯৪০ সাল –অর্থাৎ কল্লোল যুগের প্রভাব তখন বাঙলা সাহিত্যের নিঃশ্বাস প্রশ্বাসে। কল্লোল যুগ বলতে বাঙলা সাহিত্যের একটি ক্রান্তিলগ্নকে বোঝায়, যখন বাঙলা কবিতা ও কথাসাহিত্য খোদ রবীন্দ্রনাথকে কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলবার হিম্মত দেখাচ্ছে। রবীন্দ্রনাথকে সসম্মানে অস্বীকার করে বেপরোয়া এক নতুন ধারার বাংলা সাহিত্য উঠে দাঁড়াচ্ছে। ঐতিহাসিকেরা এটাকে বাংলা সাহিত্যের নবজাগরণ হিসেবে দেখতে শুরু করছেন। মানব-মনস্তত্ত্ব বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান বিষয় হয়ে উঠছে। একঝাঁক তরুণ কবি-সাহিত্যিকের হাত ধরে পাশ্চাত্য আধুনিকতা হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ছে বাংলা সাহিত্যের অন্দরমহলে। 

১৯২১ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে কলকাতায় দীনেশরঞ্জন দাস, মানবেন্দ্রনাথ বসু, গোকুলচন্দ্র নাগ ও সুনীতা সেন মিলে দীনেশচন্দ্রের পটুয়াটোলা লেনের বাড়িতেই ‘ফোরআর্টসক্লাব’ নামে একটা ঘরোয়া আড্ডায় নিয়মিত সাহিত্য, সঙ্গীত, শিল্পকলা ও নাটক নিয়ে আলোচনা ও চর্চা করতেন। ১৯২২-এ ‘ঝড়েরদোলা’ নামে একটি ছোটগল্প সংকলন প্রকাশ করে এই ক্লাব। ১৯২৩-এ এই ক্লাব থেকেই দীনেশ রঞ্জন দাশ ও গোকুল চন্দ্র নাগের যৌথ সম্পাদনায় প্রথম প্রকাশ ঘটলো নতুন এক সাহিত্য পত্রিকা –নাম কল্লোল। তখন বাঙলা সাহিত্যের দশদিগন্ত রবীন্দ্র-আলোয় উজ্জ্বল। কল্লোল যুগের নাবিকদের মূল লক্ষ্য ছিল রবীন্দ্র-বৃত্তের বাইরে সাহিত্যের এমন একটি জগৎ সৃষ্টি, যার শেকড় মাটির গভীরে নীহিত। খুব শিগিগিরই উত্তরা (১৯২৫), প্রগতি (১৯২৬), কালিকলম (১৯২৬), পূর্বাশা (১৯৩২) ইত্যাদি অন্যান্য সাময়িক ও সাহিত্য পত্রেও কল্লোল প্রবর্তিত এই আধুনিকতার আগুন ছোঁয়া লাগে। কবি বুদ্ধদেব বসু এই নবযুগের অন্যতম কাণ্ডারী। অন্যদিকে ‘কল্লোল’ আধুনিকতার নামে যথেচ্ছাচারিতা ও অশ্লীলতার প্রশ্রয় দিচ্ছে - এই রকম অভিযোগ এনে শনিবারের চিঠি পত্রিকা ভিন্ন এবং সমান্তরাল কন্ঠস্বর গড়ে তুলছে মোহিতলাল মজুমদার, সজনীকান্ত দাস, নীরদ চৌধুরী প্রমুখের সক্রিয় ভূমিকায়। 

এ কথাও ঠিক যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিছক মানবপ্রেমী সাহিত্যের বৃত্ত থেকে দূরে সরে গিয়ে আধুনিক সাহিত্যের এই দুরন্ত ঝড়কে সাধারণ পাঠকরা খুব সহজে মেনে নেয়নি। ‘শনিবারের চিঠি’র সাথে ‘কল্লোল’ গোষ্ঠীর বেশ কিছু বছর ধরে চলেছিল বিখ্যাত সাহিত্যের তরজা। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এই বিতর্কে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং নিয়মিত কল্লোলে বেশ কিছু রচনা লিখেছিলেন। তিনি নব্য সাহিত্যের এই উদ্যোগের প্রশংসা করলেও এই বাস্তবমুখী সাহিত্যকে মানুষের আদিম ইচ্ছার বশে আনার সারশূন্যতাতেও সোচ্চার হয়েছেন। তাঁর ‘শেষের কবিতা’য় অমিত রায়ের বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি নিজেকেই অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের লেখাকে যে ভাষায় কঠোর সমালোচনা করেছিলেন, তা মূলত কল্লোল গোষ্ঠীর কণ্ঠস্বর হিসেবে প্রতিফলিত। সিগমুন্ড ফ্রয়েড এবং কার্ল মার্ক্স এর প্রভাবে একদিকে দেশেবিদেশে ব্রিটিশ ও জার্মান সাম্রাজ্যবাদের প্রবল হুঙ্কার, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসস্তূপ, রাশিয়ার সাম্যবাদী বিপ্লব, সারাবিশ্বে মার্কসবাদী চিন্তাধারার বিস্তার, অন্যদিকে নিজস্ব শিল্পসাহিত্যে থমকে থাকা ভাব –বাংলা সাহিত্য তখন কল্লোলের মাধ্যমে নতুন এক প্রলেতারিয়েত চরিত্রের সন্ধান করছে। কল্লোল গোষ্ঠীর সাহিত্য আলোচনা সে সময়ের বহু বিখ্যাত প্রগতিশীল সাহিত্যিকদের ভাবনাকে প্রভাবিত করেছিল এ বিষয়ে কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই। 

কল্লোল-এর অর্থ মহাতরঙ্গ বা কলরব। যদিও মাত্র ৭ বছর (১৯২৩-১৯৩০) টিঁকেছিলো পত্রিকাটি, কিন্তু ওই স্বল্প সময়ের মধ্যেই বাঙলা সাহিত্যের ধারা পরিবর্তনে যুগান্তর এনে দিলো। রোমান্টিক আবেগের বদলে জীবনসংগ্রামের চিত্র, নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষের আর্থিক দুর্গতির প্রতি সহানুভূতি, নরনারীর সম্পর্ক বিচারে সংস্কারমুক্ত খুল্লামখুল্লা প্রকাশভঙ্গীএবং সাহিত্যে পোয়েটিক জাস্টিসের বিরোধিতাই ছিল মূলত এই যুগের বিশেষ অবদান। 

অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত লিখছেন - “ভাবতুম, রবীন্দ্রনাথই বাংলা সাহিত্যের শেষ, তাঁর পরে আর পথ নেই, সংকেত নেই। তিনিই সবকিছুর চরম পরিপূর্ণতা। কিন্তু ‘কল্লোল’ এসে আস্তে আস্তে সেভাব কেটে যেতে লাগল। বিদ্রোহের বহ্নিতে সবাই দেখতে পেলুম যেন নতুন পথ, নতুন পৃথিবী। আরো মানুষ আছে, আরো ভাষা আছে, আছে আরো ইতিহাস। সৃষ্টিতে সমাপ্তির রেখা টানেননি রবীন্দ্রনাথ। সাহিত্যে শুধু তাঁরই বহুকৃত লেখনির হীন অনুকৃতি হলে চলবে না। পত্তন করতে হবে জীবনের আরেক পরিচ্ছেদ।” 

মূলত বাংলা কবিতায় গদ্যধারার প্রবর্তন শুরু হয় কল্লোল যুগেই। এই ধারাকে সসম্মানে আত্মস্থ করে রবীন্দ্রনাথ পরপর লিখলেন ‘পরিশেষ’, ‘পুনশ্চ’, ‘পত্রপুট’, ‘শ্যামলী’। সমকালীন ইংরেজি ও বিদেশী সাহিত্যের অনুসরণে বাংলা সাহিত্যের পাঠকরা পরিচিত হলেন ন্যাচারালিজম, শারীরিক ভাবনা, জীবনসংগ্রাম, রাজনীতি, সমাজনীতি সহ নানা নতুন নতুন বিষয়ের সঙ্গে। এ যুগের শক্তিমান কথা-সাহিত্যিকরা হলেন জগদীশ গুপ্ত, বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়, বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়, প্রমথনাথ বিশী, মনোজ বসু, গোপাল হালদার, অন্নদাশঙ্কর রায়, প্রবোধকুমার সান্যাল, সুবোধ ঘোষ, গজেন্দ্রকুমার মিত্র সহ আরো অনেকে। কবিতার ক্ষেত্রে যাদের নাম কল্লোল যুগের শ্রেষ্ঠ নায়ক বিবেচনায় প্রচারিত, তাঁরা হলেন - জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, সমর সেন, অমিয় চক্রবর্তী, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সঞ্জয় ভট্টাচার্য সহ আরও অনেকে। 

এই সময়ের কালোত্তীর্ণ কবিদের মধ্যে প্রথম দুটি নাম অবশ্যই জীবনানন্দ দাশ ও সমর সেন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও এঁদের দুজনকে আলাদা স্বীকৃতি দিয়েছেন। জীবনানন্দের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরাপালক’ (১৯২৭), দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ (১৯৩৬)।বনলতা সেন কবিতাটি প্রথম ছাপা হয় বুদ্ধদেব বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্র ও সমর সেন সম্পাদিত কবিতা পত্রিকার দ্বিতীয় সংখ্যায় -ডিসেম্বর ১৯৩৪-এ। কাব্যগ্রন্থ হিসেবে বনলতা সেন অবশ্য প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৪২-এ। 

৭১ বছরের জীবনে সমর সেন কাব্যসাধনা করেন মাত্র ১২ বছর -১৯৩৪ থেকে ১৯৪৬। জীবনানন্দ দাস তখন তাঁর নিজস্ব নির্জন কোণে মহাসমারোহে হৃদয় খুঁড়ে বেদনা-অক্ষরে সাজাচ্ছেন তাঁর কবিতাঘর। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে যথারীতি নিমগ্ন নিজ নিজ নির্জন গোপনীয়তায়। বুদ্ধদেব বসু যুদ্ধে নেমেছেন নতুন কাব্য ভাষা নির্মাণ তাগিদে। আর ঠিক তখনই এই বুদ্ধদেব বসুর পরামর্শেই গদ্যছন্দ তূণে জুড়ে শব্দশর ছুঁড়ছেন সমর সেন। রবীন্দ্রনাথ তার কাছে জোলো, ‘দুধ ও তামাকে সমান আগ্রহী এই কবি’তাঁর বোধ সীমানার বাইরে। সমরের সদর্প উচ্চারণ আহ্বান - ‘তুমি কি আসবে আমাদের মধ্যবিত্ত রক্তে / দিগন্তে দুরন্ত মেঘের মতো।’ রবীন্দ্রনাথের প্রবল বিরোধিতা করলেও বুদ্ধদেব বসু এক পর্যায়ে গিয়ে স্বীকার করেন যে, আধুনিক কবিদের পক্ষে রাবীন্দ্রিক প্রভাবমুক্ত হওয়া প্রায় অসম্ভব। তার পরে আবার এটাও বলেন - সমর এক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম। অর্থাৎ সমর তৈরি করছেন বাংলা কবিতার নতুন পথ। সমর সেনের কথা এতটা বলবার কারণ বহুল প্রচলিত যে, সমর যেখানে থেমে গেছেন সেখান থেকে সুভাষের শুরু। এখানে সুভাষের জন্য স্বীকৃতির জায়গাটা হলো তাঁর পথচলার শুরুটা নতুন পথে। আর সমর সেনের অমর মেধার সামনে নত মস্তকে দাঁড়িয়েও বলতে হয় - সুভাষ তাঁর নিজের মতো - সে অর্থে বাংলা কবিতায় তাঁর কোনও পূর্বসূরি নেই। তিনি নিজ পায়ে পথচলা ‘পদাতিক’, যিনি বাংলা কাব্য ভুবনে নির্মাণ করেছেন নিজস্ব নতুন পথ। 

এই পটভূমিকায় কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় ও ‘পদাতিক’এর আত্মপ্রকাশ।আমি প্রথম এ বই পড়ি আমার স্কুল জীবনে–এই নিবন্ধের শুরুতে বলা ঐ অদ্ভুত ভূমিকা সম্বলিত সেই ভারবি সংস্করণ - তখন আমি ক্লাশ সেভেন –সত্তর সাল–ক্লাশরুমের ফর্সা ফর্সা দেয়াল রাতারাতি চীনের চেয়ারম্যানের অসংখ্য হাসি মুখ আর বিভিন্ন শ্লোগানের ভীড়ে অস্থির–‘পার্লামেন্ট শুয়োরের খোঁয়াড়’ বা ‘প্রতিক্রিয়াশীলদের মেরে হাড় ভেঙে দেব’–স্কুলের লাইব্রেরিতে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া–কমিউনিস্টদের সম্পর্কে এইরকম প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নিয়ে এক কমিউনিস্ট কবির বই হাতে নিয়ে খুললাম। প্রথম ধাক্কা ওই ভূমিকায়। তারপর একে একে কবিতাগুলো...

নিজের বাল্যকাল সম্পর্কে এক চিঠিতে সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘আমার শৈশব কেটেছে রাজশাহীর নওগাঁয়। বাবা ছিলেন আবগারির দারোগা। নওগাঁ শহর ছিল চাকরি, ব্যবসা, নানা বৃত্তিতে রত বহিরাগতদের উপনিবেশ। হিন্দুমুসলমান ও বাংলার নানা আঞ্চলিক মানুষজনদের মেলানো-মেশানো দিলদরাজ আবহাওয়ায় আমরা একটু অন্যরকমভাবে মানুষ হয়েছিলাম। একদিকে প্রকৃতি, অন্যদিকে যৌথ জীবন। সব সম্প্রদায়েই এমন সব মানুষের কাছে এসেছি যাঁরা স্বধর্মে গোঁড়া, কিন্তু মানুষের সম্বন্ধে উদার। আমার অক্ষরপরিচয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা নওগাঁয়। পড়েছি মাইনর স্কুলে। পাঠ্যবইয়ের চেয়েও বেশি পড়েছি পাঠাগারের বই। সেই সঙ্গে আমাকে শিক্ষা দিয়েছে খেলার মাঠ, গান আবৃত্তি অভিনয়ের মঞ্চ। নওগাঁ শহরের জীবন আমার ব্যক্তিত্বের গোড়া বেঁধে দিয়েছিল।’ 

১৯৩২-৩৩ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কিশোর ছাত্রদল-এর সক্রিয় সদস্যরূপে যোগ দেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়। এই সময় কবি সমর সেন তাঁকে দেন হ্যান্ডবুক অব মার্কসিজম নামে একটি বই। এটি পড়ে মার্কসীয় রাজনীতির সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেন কবি। ১৯৩৯ সালে লেবার পার্টির সঙ্গে সংযোগ হয় তাঁর। আর ১৯৪০ সালে প্রকাশিত হয় ‘পদাতিক’–যখনউনিস্কটিশচার্চকলেজেদর্শনেরছাত্র। 

‘পদাতিক' প্রকাশের মধ্য দিয়ে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় আধুনিক বাংলা কবিতার জগতে একদম স্বতন্ত্র এক নতুন স্বর, নতুন সুর, নতুন কথনভঙ্গি নিয়ে আত্মপ্রকাশ করলেন। আমাদের শ্রেণীবিভক্ত সমাজে পীড়িত মানুষের দুর্দশার বিরুদ্ধে দ্রোহ তাঁর কবিতার মূল চরিত্র। দ্বিতীয় কবিতা –মে দিনের কবিতা–শুধুমাত্র শ্রমিক শ্রেণীর বিজয় ঘোষণাতেই শেষ নয়, সাম্রাজ্যবাদের ধ্বংসেরও স্পষ্ট বার্তা রয়েছে এ কবিতায় –‘পদাতিক’ বইয়ের সবচেয়ে –সবচেয়ে জনপ্রিয় এই কবিতা প্রায় আশি বছর পেরিয়ে এখনও বাংলা পাঠকের ঠোঁটস্থ– 
প্রিয় ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য 
ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা 
চোখে আর স্বপ্নের নেই নীল মদ্য 
কাঠফাটা রোদ সেঁকে চামড়া’। 
...
শতাব্দী লাঞ্ছিত আর্তের কান্না 
প্রতি নিঃশ্বাসে আনে লজ্জা; 
মৃত্যুর ভয়ে ভীরু বসে থাকা, আর না – 
পরো পরো যুদ্ধের সজ্জা। 
প্রিয়, ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য 
এসে গেছে ধ্বংসের বার্তা, 
দুর্যোগে পথ হয় হোক দুর্বোধ্য 
চিনে নেবে যৌবন-আত্মা।। 

এই সহজ সরল এবং ঋজু কথ্যরীতি ও ভঙ্গীই তাঁর কবিতার এই বিপুল পাঠকানুকুল্যের কারণ। মানবিক বোধ ও স্পষ্ট রাজনৈতিক বাণী তাঁর কবিতার অন্যতম প্রধান অভিমুখ। এই রাজনৈতিক স্পষ্টতা এলো কোত্থেকে? আগেই বলেছি –ইতিমধ্যেই সমর সেনের সান্নিধ্যে মার্ক্সীয় রাজনীতিতে দীক্ষা হয়ে গেছে সুভাষের। এবং ‘পদাতিক’ প্রকাশের পরবর্তী কালে ছাত্র নেতা বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায়ের প্ররোচনায় কলেজ জীবনেই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সংস্পর্শে আসেন। ১৯৪২ সালে পান পার্টির সদস্য পদ। এই সময় সদ্য গঠিত ফ্যাসিজম বিরোধী লেখক শিল্পী সংঘের সাংগঠনিক কমিটিতে কবি বিষ্ণু দে-র সঙ্গে যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন সুভাষ মুখোপাধ্যায়। তারপর মাসিক ১৫ টাকা ভাতায় সর্বক্ষণের কর্মীরূপে যোগ দেন পার্টির জনযুদ্ধ পত্রিকায়। ১৯৪৬ সালে দৈনিক স্বাধীনতা পত্রিকায় সাংবাদিক হিসাবে যোগ দেন কবি। ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে কমিউনিস্ট পার্টি বেআইনি ঘোষিত হলে বহু কমিউনিস্ট বন্দীর সঙ্গে দু-বার কারাবরণ করেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ও। এই সময় তিনি সামিল হন দমদম জেলের অনশন ধর্মঘটে। ১৯৫০ সালের নভেম্বর মাসে পান মুক্তি। যখন অগ্নিকোণ (১৯৪৮) প্রকাশ পেলো, ততদিনে সুভাষ মুখোপাধ্যায় কমিউনিস্ট কবি হিসেবে বাংলা সাহিত্য পাঠকের কাছে স্বীকৃত। 

সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘পদাতিক’কে বুঝতে গেলে সবার আগে বিশ্লেষণ করতে হবে তার পটভূমি, সেই সময়টাকে। আমাদের বুঝতে হবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ছারখার ত্রিশের দশকের পৃথিবীতে রাজনৈতিক ব্যারোমিটারের পারদরেখার ঘন ঘন উত্থানপতন, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে হিটলারের আবির্ভাব, প্রতিষ্ঠা ও প্রসার, স্পেনে ফ্যাসিজম-কমিউনিজম দ্বন্দ্ব, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, সমাজতন্ত্রের বার্তা –এসব যেমন প্রভাব ফেলেছে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতায়–তেমনই দেশের অভ্যন্তরের বিপ্লবী ও সন্ত্রাসবাদী কার্যাবলী, বামপন্থী দল-উপদল, গান্ধিজীর ডাণ্ডি অভিযান, সুভাষ বসুর উত্থান, অর্থনৈতিক মন্দা, হিন্দু-মুসলমান বিরোধ তাঁকে প্রভাবিত করেছে সমান। এসব কিছুরই প্রভাব তাঁর ১৯৪০-৫০ এর মধ্যে পরপর প্রকাশিত পদাতিক, অগ্নিকোণ, চিরকুট তিনটি কাব্য গ্রন্থে। 

ব্যতিক্রমী তাঁর ভাষা। তাঁর শব্দেরা তাঁর নিজের, নির্মেদ কবিতার শরীর, প্রকাশ সরাসরি, স্পষ্ট এবং তার শিল্পমান নিয়ে অভিযোগে তাঁর নিন্দুকেরাও মুখে কুলুপ দিয়ে মাথা চুলকেই যাবেন। প্রথম থেকেই তো তিনি মানুষের মিছিলের এক কমরেড। তিনি তো মানুষের কথা বলবেনই। তাঁর ভাষায়, ‘শ্রমিক আন্দোলন করতে করতেই আমার চারপাশের জীবন আমাকে লেখার দিকে ঠেলে দিল।’ 

‘পদাতিক’ সম্পর্কে অগ্রজ কবি ‘কবিতা’ পত্রিকার সম্পাদক বুদ্ধদেব বসু লিখলেন, ‘অভিনন্দন তাঁকে আমরা জানাব, কিন্তু তা শুধু এ কারণে নয় যে, তিনি এখন কবিকনিষ্ঠ। কিংবা নিছক এ কারণেও নয় যে তাঁর কবিতা অভিনব। যদিও তাঁর কবিতার অভিনবত্ব পদে পদে চমক লাগায়। প্রথমত তিনি বোধ হয় প্রথম বাঙালী কবি যিনি প্রেমের কবিতা লিখে কাব্য জীবন আরম্ভ করলেন না। কোন অস্পষ্ট মধুর সৌরভ তাঁর রচনায় নেই যা সমর সেনের প্রথম কবিতাগুলোতেও লক্ষ্যণীয় ছিল। দ্বিতীয়ত কলাকৌশলে তাঁর দখল এতই অসামান্য যে কাব্যরচনায় তাঁর চেয়ে ঢের বেশি অভিজ্ঞ ব্যক্তিদেরও এই ক্ষুদ্র বইখানায় শিক্ষণীয় আছে বলে মনে করি।’ 

পদাতিক যে ভিন্নধর্মী এক কাব্যগ্রন্থ হিসেবে বাংলা কবিতার রাজ্যে উপস্থিত হয়েছিল, এ কথা না মানলে ইতিহাসের অপলাপই করা হবে। প্রশ্ন– পদাতিকের কবি কি কালোত্তীর্ণ হতে পেরেছেন? উত্তরেও প্রশ্ন করা যায়– কেন নয়? পদাতিকের সঙ্গে আজকের প্রজন্মের দূরত্ব প্রায় আট দশকের। তার পরও ভাষা ও প্রকরণগত অনন্যতা নিয়ে পদাতিক আজও পুরোদস্তুর আধুনিক। আটপৌরে বুদ্ধিদীপ্ত সপ্রতিভ কবিতা ভাষা, বিশ্বাস আর বিদ্রুপের তীব্র ঝাঁকুনি, ছন্দের বিস্ময়কর কাজ আজও সমান প্রাসঙ্গিক। তারুণ্যে ভরপুর, চিৎকৃত উচ্ছ্বাসে উদ্বেল পদাতিকের সবগুলো কবিতাই যে কালোত্তীর্ণ, এ দাবি করছি না। পৃথিবীতে কোনো কবির কোনো কাব্যগ্রন্থেরই সব কবিতা কালোত্তীর্ণ হয়নি, হতে পারেনা। মেনে নিচ্ছি, ‘পদাতিক’ কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা ‘সকলের গান’ এর ‘কমরেড, আজ নবযুগ আনবে না?’ নির্দিষ্ট রাজনৈতিক আদর্শের আহ্বান। অসুবিধা হলে কমরেড শব্দটাকে পাশে সরিয়ে রাখুন, ‘আজ নবযুগ আনবে না?’–এ প্রশ্ন কি সবার অন্তরের চাহিদা নয় সময়ের কাছে? চতুর্থ কবিতা ‘রোমান্টিক’–একুশ বছরের এক কলেজ ছাত্রের কাছে রোমান্টিকতাটা কী রকম? 

আগ্নেয়গিরি পাঠালো যে এই রাত্রি 
গলিত ধাতুরা জমাট কখন বাঁধবে? 
ব্যবসায়ী মন মাহেন্দ্রক্ষণ খুঁজছে, 
টিকটিকি ডাকে, - বধির সে নির্বন্ধ। 
... 
রাত্রি কিন্তু রাত্রিরই পুনরুক্তি 
চাঁদের পাড়ায় মেঘের দুরভিসন্ধি; 
হৃদয়-জোয়ারে ভেঙে যায় সংকল্প 
ম্লান হয়ে যায় সব-হারাদের বস্তি।। 

কিংবা আসুন ‘প্রস্তাব ১৯৪০’ কবিতাটিতে, যেখানে গান্ধিজীর অহিংস আন্দোলনকে তীব্র বিদ্রুপ করে কমিউনিস্ট ভাবাদর্শে দীক্ষিত কবি বলছেন – 

...শত্রুপক্ষ যদি আচমকা ছোঁড়ে কামান – 
বলব, ‘বৎস! সভ্যতা যেন থাকে বজায়!’ 
চোখ বুঁজে কোনো কোকিলের দিকে ফেরাবো কান।। 

অথবা ‘নারদের ডায়রি’তে– 

... হৃদয় সম্পর্কে হবু দম্পতির হিং-টিং-ছট; 
ফাল্গুনী সনাক্ত করে শিরোধার্য বৈমানিক পাড়া; 
বাহান্ন হাতির শুঁড়ে হাঁচিগ্রস্ত অহিংস শকট। 
বাপুজি, দক্ষিণ করে আনো যুক্তরাষ্ট্রের মিঠাই; 
সাঙ্গ, প্রভু, সত্যাগ্রহ? একচ্ছত্রে বেজেছে বারোটা? ... 

পদাতিক নামের কবিতাটিতে গদ্যছন্দে এক চূড়ান্ত মার্ক্সীয় আশাবাদ শুনিয়েছেন কবি সুভাষ তাঁর অনন্য ভঙ্গিতে – তিনি বলছেন – 

অগ্নিবর্ণ সংগ্রামের পথে প্রতীক্ষায় 
এক দ্বিতীয় বসন্ত। আর 
গলিতনখ পৃথিবীতে আমরা রেখে যাব 
সংক্রামক স্বাস্থ্যের উল্লাস। 
...
জীবনকে পেয়েছি আমরা, বিদ্যুৎ জীবনকে। 
উজ্জ্বল রৌদ্রের দিন কাটুক যৌথ কর্ষণায় 
আর ক্ষুরধার প্রত্যঙ্গ তরঙ্গ তুলুক কারখানায়। 
... 
উদাসীন ঈশ্বর কেঁপে উঠবে না কি 
আমাদের পদাতিক পদক্ষেপে? 

সেই ‘পদাতিক’ এবার আশি বছরে পড়লো। নিবন্ধের শুরুতে যে ভূমিকার উল্লেখ আছে, সেখানে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় অবশ্য বলছেন –‘পদাতিক সেই একুশেই আটকে আছে’। আমরা যারা সত্তর দশকে স্কুল ও কলেজের ছাত্র ছিলাম, আমাদের মেরুদণ্ডী করে তুলেছেন এই পদাতিক কবি। আমরা উর্ধশ্বাসে পড়েছি সুভাষের চিরকূট, অগ্নিকোণ, ফুল ফুটুক, দিন আসবে, যত দূরেই যাই, কাল মধুমাস, এই ভাই, ছেলে গেছে বনে... আমাদের ঘাড় ধরে উনি মানুষ করে তুললেন। সামাজিক ও রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা শেখালেন। আমরা বিশ্বাস করলাম –‘ধনতন্ত্রের বাঁচবার একটাই পথ/ আত্মহত্যা।/ দড়ি আর কলসি মজুত/ এখন শুধু জলে ঝাঁপ দিলেই হয়।/পৃথিবীকে নতুন করে সাজাতে সাজাতে/ ভবিষ্যৎ কথা বলছে, শোনো, ক্রুশ্চভের গলায়/ নির্বিবাদে নয়, বিনা গৃহযুদ্ধে/ এ মাটিতে/ সমাজতন্ত্র দখল নেবে... 

একটা আস্ত প্রজন্মের চরিত্র গঠনে পৃথিবীতে অন্য আর কোনও কবি এভাবে প্রভাবিত করতে পেরেছেন কিনা, আমার জানা নেই। 

পদাতিক তাই সত্যিই আশি নয়, এখনও একুশেই আটকে আছে, থাকবেও।

প্রবন্ধ - অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়


প্রবন্ধ


পাথর খুঁড়ে স্মৃতি, জীবন ভরে গান 
অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায় 



আমার ঠাকুরদা রেলে কাজ করতেন। দিল্লীর অফিসে। রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লী চলে গেলে উনিও সংসার নিয়ে দিল্লী চলে যান। ব্রিটিশ আমলে সিমলা হয়ে যেত প্রশাসনের গরমকালের রাজধানী। তাই গরম পড়লেই রেলের অফিসও দিল্লী থেকে চলে যেত সিমলা। কয়েকজন বাঙালির সঙ্গে মিলে সিমলার কালীবাড়ী প্রতিষ্ঠা করেন ঠাকুরদা। একবার শীতে নিউমোনিয়া হয়ে ঠাকুরদা মাত্র বত্রিশ বছর বয়সে মারা যান সিমলাতেই। ঠাকুমা ছেলেমেয়ে নিয়ে কলকাতায় ফিরে আসেন। দিল্লী-সিমলার সেই স্মৃতি ঠাকুমা সুন্দর গল্প করে আমাকে বলতেন ছোটবেলায় আর আমি তাঁর কোলে মাথা রেখে সেই গল্প গিলতাম। বেড়ানোর নেশা বোধহয় সেই থেকে মনে ঢুকে গেছে। স্মৃতিতে নেই, বড়দের মুখে শোনা, আমাকে নাকি হাঁটা শেখানো হয়েছে রাজস্থানের পুষ্করে সাবিত্রী পাহাড়ে। ঠাকুমার নামও ছিল সাবিত্রী। তাই ঠাকুমা বলতেন, তুই আমার ঘাড়ে চড়ে হাঁটতে শিখেছিস। 

বাঙালি ভবঘুরে বলে একটা কথা চালু ছিল আমাদের ছোটবেলায়। পরে জেনেছি মানুষই ভবঘুরে। আর মানুষের এই স্বভাব এসেছে প্রাক-মানুষ মানবের থেকে। বানরকুল থেকে বিবর্তনের ধারা মেনে মানবের উদ্ভব পূর্ব আফ্রিকাতে। সেখানেই ঘোরাঘুরি করত। পনেরো লক্ষ বছর আগে হোমো ইরেকটাস নামে এক মানব প্রজাতি আফ্রিকার বাইরে বেরোয় এবং সমুদ্রের উপকূল ধরে ইওরোপ ও এশিয়াতে চলে আসে। ইরেকটাসেরও আগের মানবেরা পাথর ঘসে অস্ত্র বানিয়ে আক্রমণকারী পশুদের থেকে নিজেদের আত্মরক্ষা ও খাবার জন্যে ছোট জন্তু শিকার করত। ইরেকটাস আগুন জ্বালালো। নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার করে রাতে আগুন জ্বালিয়ে পশুদের ভয় দেখিয়ে দূরে রাখত, মৃত পশুর মাংস আগুনে ঝলসিয়ে খেত। মানুষ মানবের শেষ প্রজাতি, আফ্রিকাতেই বিবর্তন, দু লক্ষ বছর আগে। তারা আফ্রিকা থেকে বেরিয়ে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। বেরানোর এই নেশা মানুষের জিনে। আমার বোধহয় একটু বেশি। মফস্বলে বাড়ি। পুকুর ও গঙ্গা দুটোই বাড়ির খুব কাছে। সেখান থেকে বেরিয়ে প্রথম সমুদ্র দেখলাম পুরীতে গিয়ে পাঁচ বছর বয়সে। প্রকৃতি ভয়ঙ্কর, সুন্দর, বিস্ময় এবং আনন্দময়, বুঝেছিলাম ওই বয়সেই। মাধ্যাকর্ষণের মত সুযোগ এলেই ‘চরৈবেতি’। এখনও। শর্তহীন, ঠিকানাবিহীন। 

ক্লাস নাইনে বাবা বিবেকানন্দ প্রদত্ত ভাষণের সংকলন পড়তে দিলেন। আর সেটা হলো কাল। বাবাকে ধরলাম কন্যাকুমারী যাব। কেউ রাজি না হওয়ায় আমি একাই চলে গেলাম একটা পিজবোর্ডের সুটকেস আর সতরঞ্চি মোড়া বালিশ নিয়ে ট্রেনে। পকেটে চল্লিশ টাকা। তখন আমি চোদ্দ। ট্রেনে সহযাত্রীদের থেকে টিকিট চেকার সকলে অবাক হয়ে আমার সাথে গল্প করেছিল। মাদ্রাজে ট্রেন বদলে অন্য ট্রেন এবং কয়েমবাটুর থেকে বাসে চেপে কন্যাকুমারী। বইয়ের বিবেকানন্দ সামনে। ধ্যানমগ্ন। সারা শরীরে শিহরণ! ওই তো তিনটে সমুদ্র আর তার তিনটে আলাদা রঙ। জলের রঙ মিলিয়ে বালি, লাল, কালো, সাদা। বাস্তবের সাথে কল্পনা মিশিয়ে সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগ করছি। খিদে পেয়েছে। সবুজ ঘাসের গালচে পেরিয়ে কয়েক সারি ঘর। গিয়ে বললুম কয়েকজন নেড়া মাথা গেরুয়াধারী সাধুকে। তাদের আশ্চর্য হবার অনেক কিছু ছিল। স্কুলের পরিচয়-পত্র আর আমার আসার কারণ তাদের উৎফুল্ল করে এবং চার আনা ঘর-ভাড়া মুকুব করে আমার জন্য একটা ঘর। সকালে ও দুপুরের খাওয়া রামকৃষ্ণ আশ্রমের ‘প্রসাদ’। রাতে কাছেই গুজরাটি চটিতে চার আনায় পেটচুক্তি। 

একদিন এক মাঝিকে ধরলাম। তার নৌকোয় সমুদ্রের বিশাল ঢেউ পেরিয়ে, যেন আমিই বিবেকানন্দ সাঁতরে যাচ্ছি (তখন কেন, এখনও সাঁতার জানি না), সেই পাথরে। তখনও মন্দির হয়নি। মাঝি সাবধানে নামিয়ে দিল, আমি তিন ঘন্টা সমুদ্র ঘেরা পাথরে উন্মুক্ত আকাশের নীচে সূর্যের তাপে পুড়তে পুড়তে বসে থাকলাম। শুধু অনুভূতি, অপার আনন্দ। আমিও পারি, অবশ্যই কিছুটা। আজও ওই কিছুটাতেই আমার আনন্দ। ছাত্রজীবনে, কর্মজীবনে, সংসারজীবনে, লেখালেখিজীবনে। দামোদরও নই, শেঠও নই, অল্পেতেই খুশি। 

জীবনে বেশিরভাগ পারাটাই তো নকল বিদ্যায়। এপ-দের বংশজাত বলে কথা। সামাজিক শিক্ষা, সমাজ বলে দিচ্ছে ছোটবেলা থেকে এইভাবে শৃঙ্খলা মেনে চলো, যা অন্য মানুষকে অসম্মান হেয় করতে শেখায়। নিজেদের দুষ্কর্ম যাতে অন্যেরা না করে তার জন্যে সমাজের পায়ে বেড়ি। মানিনি। পুরোহিতেরা বলছে এটা তোমার ধর্ম।কাঁচকলা, ধর্ম না ছাই। কতকগুলো কুসংস্কার। পাঁচ বছর বয়সেই কালিঘাটে গিয়ে অসততার শিক্ষা পেয়েছি। যত অধর্ম ওই জায়গাগুলোতেই। দেবতার সামনে, পেছনে কুকর্ম। সারা দিনের পাপ স্খালন গঙ্গায়, রাম তেরি গঙ্গা মইলি হো গয়ি। তাঁতি-বাড়ির বৌকে টেনে তুলে অষ্টমীর দিন দুর্গার চরণ স্পর্শ করিয়েছিলেন ঠাকুমা। হৈ হৈ। পুরুত মশাই রেগে গেলে ঠাকুমার হুঙ্কার, মানতে না পারলে চলে যাও। আনন্দে তালি দিয়ে উঠেছিলাম। আমি তখন নয়। ব্যক্তিগত শিক্ষা অনেক দুঃখ-কষ্ট সয়ে অর্জন করতে হয়, করেছি। স্রোতে ভেসে যাই নি। কোনওরকমে চারিদিকের উচ্ছৃংখল সমাজ-জীবনের বিপরীত টানে টিকে আছি। 

তবে কেন ভোর হবার আগে অন্ধকার গভীর কুয়োয় নেমে তিনটে সমুদ্রের মিলনক্ষেত্র থেকে জল তুলে এনেছিলাম দেবী কুমারীর অভিষেকের জন্যে? ঠিক যেমন যাওয়া কন্যাকুমারী। ভক্তি নয়, শ্রদ্ধা। পুজো নয়, ব্যক্তিপুজো তো নয়ই। অপার কৌতুহল, অজানাকে জানা, অন্ধকারের মধ্যে আলোর বিন্দু দেখা। বিস্মিত হওয়ার উত্তেজনাকে উপভোগ করা। হেডস্যার শুনে বললেন, ‘একখান এসে লিখখ্যা ফ্যাল’। লিখলাম। পরের দিন এসে জড়িয়ে ধরলেন। পরের দুটো উচ্চতর ক্লাসে আমায় দিয়ে পড়ালেন। এত ভালোবাসা, সম্মান। শিক্ষক গুরু, পিতৃসম। এতদিন শুনতাম, এবার শিখলাম। 

সত্তর সালে হায়ার সেকেন্ডারি। পাইপগান, পেটো, রক্ত। সরকার গড়ছে, ভাঙছে। মানুষ তাড়ানো, পরীক্ষা, টোকাটুকি। শ্রমিকের স্বার্থে কারখানা বন্ধ। মালগাড়িতে লাশের পাহাড়। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ভবিষ্যৎ নেই। ‘এখানে জিওলজিতে নকশাল আছে?’প্রেসিডেন্সির প্রিন্সিপালকে বাবার ভয়ার্ত প্রশ্ন। উত্তর শুনে হাত ধরে টানতে টানতে আশুতোষ। ‘না, না, এখানে ডি এস ও’, প্রিন্সিপালের আশ্বাসবাণী। ট্রামে করে চৌরঙ্গী ধরে ফেরার পথে মিউজিয়ামের আগের বাড়িটা দেখিয়ে বললেন, ‘এখানে তোর ভবিষ্যৎ’। জিওলজিকাল সার্ভে অব ইণ্ডিয়াতেই কাটলো সারা কর্মজীবন এবং অবসরও ওই সেদিনের দেখানো বাড়িটা থেকেই। ক্লাস শুরুর প্রথম দিনেই বোম, চারতলা থেকে বেঞ্চি নীচে। আজও বাবাকে কৃতজ্ঞতা জানাই। পৃথিবীকে জানতে, বুঝতে, প্রকৃতির সাথে একাত্ম হতে জিওলজিই একমাত্র বিষয়। অল্প সময়েই ভালোবেসে ফেললাম। ক্লাসরুম ছেড়ে মাঠে জঙ্গলে পাহাড়ে হাতেনাতে শিক্ষা। ‘চরৈবেতি’। প্রথম বছর বাঁকুড়া। পরের বছর ডালটনগঞ্জ, কোয়েলের কাছে। পাহাড়, নদী, জঙ্গল আমার হৃদয়, শহর আমার বেঁচে থাকার উপাদান জোগায়। প্রফেসারেরা বইয়ের পড়া শেখান। জিওলজি শেখালো রাজস্থানের আজমীঢ় জেলার প্রত্যন্ত গ্রামের ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়া এক যুবক। আরাবল্লী পর্বতের উপত্যকা জঙ্গলে হারিয়ে তার শরণাপন্ন, ফিল্ডের গাইড। ‘আপ তো পাত্থর কা ডক্টর’। চমকে গেছিলাম। স্টেথোস্কোপের বদলে হাতুড়ি, লেন্স দিয়ে পাথরের শরীর পরীক্ষা করি, তাই পাথরের ডাক্তার। সহজ মানুষ কত সহজে বুঝে ফেললো যা চার বছরেও প্রফেসরেরা বোঝাতে পারেননি। পৃথিবীর পাথর পরীক্ষা করে তার ইতিহাস জেনে সহজ করে সাধারণকে বোঝানোর দায়িত্ব যে জিওলজিস্টের, তা শিখলাম। সেই দায়িত্ব পালন করে চলেছি। কীসের দায়? আমার শিক্ষা অর্জনের টাকা কে জোগালো? স্কুলের মাইনে চার থেকে বেড়ে ছ টাকা। কলেজের মাইনে বারো। ইউনিভার্সিটিতে ষোল। তার ওপর হাফ কনসেশন। বাবা রিটায়ার্ড। ভারতের গ্রামের সহজ সরল গরীবের আশা ভরসা শিক্ষিতদের ওপর। ভুলি কী করে? না, ফেরত দেবার অহংকার নেই। মানুষের মনের অন্ধকার দূর করে আলোকিত করার সামান্য প্রয়াস। মানুষের ভেতর মৌলিক মহৎ আবেগ যদি সক্রিয় হয়, গান গেয়ে উঠবে আমার হৃদয়। 

তখনও ছাত্র। মাস্টার্স করছি। ডেসার্টেশনের কাজে রাজস্থান, আজমীঢ় – বেওয়ারের মাঝে খরোয়া গ্রামের পঞ্চায়েত অফিসে একটা ঘরে ক্যাম্প। হিন্দুর ঘরে জন্মেছি বলে হিন্দু, তাহলে মুসলমানের ঘরে গরু জন্মালে তার জাত কি? প্রশ্নটা মাথায় এসেছিল সেই রাতেই যেদিন সারাদিন পাহাড়ে জঙ্গলে পাথর দেখার কাজ সেরে ক্লান্ত শ্রান্ত শরীরে সাইকেলে বিছানা বাক্স পাথরের বস্তা চাপিয়ে খরোয়া থেকে চোদ্দ ‘মিল’ হেঁটে পৌঁছলাম শামগড় নামে এক গ্রামে। আমি হিন্দু বলে মুসলমান গ্রামে কেউ থাকতে দেবে না। শেষে এক ব্যক্তি আমাকে পথ দেখায় এক মাস্টারের। বাড়ির সামনে সাইকেল থেকে মাল নামিয়ে চলে গেল সাইকেলওলা। আমি বেডিং-এর ওপর বসে আইডেন্টিটি কার্ড বের করে মাস্টারের হাতে দিয়ে শুধু বলতে পেরেছিলাম, আর পারছি না। আমাকে দড়ির খাটিয়ায় শুইয়ে ওনার স্ত্রী এক বড় ঘটিতে দুধ এনে দিলেন। মাথায় আব্রু নেই দেখে চমকে গেছিলাম। আমাকে যে ঘরে থাকতে দেওয়া হয়েছিল তার পাশের ঘরেই গরু থাকতো। সেদিনই আমার এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন মাস্টার, জন্মসূত্রে নয়, জীবনপালন ধর্ম। সেদিন আরো একবার দেখেছিলাম আমার ভারতবর্ষকে। ভারতের ধর্মকে চিনেছিলাম। প্রকৃত সংস্কৃতি কী তা জেনেছিলাম। এই সংস্কৃতি যৌথভাবে গোষ্ঠীবদ্ধ থাকার সংস্কৃতি যা শুরু হয়েছিল পনেরো লক্ষ বছর আগে। মানুষের আগের মানব প্রজাতির ইরেকটাসরাই প্রথম বুঝেছিল একসাথে থাকার উপকারিতা। অত্যাধুনিক মানুষ জমি, দেশ, রাজনীতি, ধর্মের নামে সেই প্রাচীন সংস্কৃতি ভেঙে ছাড়খাড় করে দিচ্ছে। একাধিক আইডেনটিটি। একেই কি বলে সভ্যতা? না, সভ্যতা হলো একসাথে থাকা। বিভাজন নয়, সংযোজন। প্রয়োজনের অতিরিক্ত প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার না করা, সংযত ব্যবহারিক শিক্ষা যা আগুনের ব্যবহারের থেকে উৎপত্তি। কেন এত রাজনৈতিক সীমানা? বসুন্ধরার সম্পত্তি এভাবে ভাগ করার অধিকার কে দিয়েছে মানুষকে? 

শামগড় থেকে দশ মাইল দূরে মাসুদা গ্রামের হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলের ভূগোলের শিক্ষক, অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টার। স্কুল দেখাতে নিয়ে গেলেন। চমৎকার উচ্চমানের ল্যাবরেটরি। অভিভূত। অন্য শিক্ষকদের সাথে আলাপ করিয়ে দিয়ে পড়াতে চলে গেলেন। টিফিনের সময়ে আমার ডাক। শান্তিনিকেতনের আশ্রমিক স্কুলের গাছতলা, বেদী দিয়ে ঘেরা। মাটিতে ছাত্রছাত্রী, মাস্টারদের সাথে আমার বসার আসন বেদীর ওপর। কলকাতা থেকে এতদূরে এক ছাত্র এসেছে পড়ার জন্য এই নিয়ে বলা শুরু হতে লজ্জায় সংকোচে আমার মাথা প্রায় মাটিতে। তার ওপর বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত আমায় কিছু বলতে বলা। পরকে মুহূর্তে আপন করে নেওয়াই তো ভারতের সনাতন ধর্ম ও শিক্ষা যা উপনিষদেও আছে। ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে প্রতি পদে শিক্ষা, ব্যক্তিগত, অর্জন করতে হয়। মানুষের একটাই ধর্ম, মনুষ্যত্ব। মানবিকতায় যার প্রকাশ। আরাবল্লীর প্রকৃতি ও মানুষ পুরোটাই যেন প্রাচীন আশ্রম। প্রকৃতিই তো প্রথম ও প্রধান শিক্ষাগুরু। মানব ও মানুষের যা কিছু শিক্ষা সে তো তার কাছ থেকেই। প্রকৃতির কোলে যাদের বাস তারাই বয়ে নিয়ে চলে মানব সভ্যতা ও সংস্কৃতি। শহরে আমরা শিক্ষা মুখস্থ করি, চাকরির জন্যে। বিজ্ঞানের ছাত্ররা তর্ক করে, ‘পূজো আমার ব্যক্তিগত ব্যপার’। আরে, ব্যক্তিত্বটাই তো তৈরি হলো না, তাতে আবার ব্যক্তিগত! বিজ্ঞানকে আত্মস্থ করতে অপারগ মেরুদণ্ডহীন দুর্বল। বিজ্ঞানের অসম্মান। সমাজ, সভ্যতা, সংস্কৃতির অসম্মান। দশ আঙুলে নবগ্রহকে ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, গ্রহ কারা? সূর্য, চন্দ্র, রাহু, কেতু! পৃথিবী কেন্দ্রে! প্রাক-কোপারনিকাস যুগে মনটাকে রেখে বিজ্ঞান মুখস্থ করছে। এল ই ডি আলোয় বাইরেটা ঝলমলে, মনটা গহীন অন্ধকার। অসম শিক্ষা ব্যবস্থা পৃথিবীজুড়ে। উন্নতির সেতু এখানেই ভেঙে পড়েছে। মানুষের বিবর্তন কি অধোমুখী হবে? ফিরে যাবে মধ্যযুগের অন্ধকারে? 

‘হল্ট’। খরোয়ার কাছে মাথা নীচু করে মন দিয়ে পাথর পরীক্ষা করছি, বাজখাঁই আওয়াজে চমকে উঠে দাঁড়াই। সামনে দুটো অ্যালসেশিয়ান দু পা তুলে আমার দুপাশে। কুকুরে আমার বড় ভয়, চোদ্দটা ইঞ্জেকশন। চকচকে বাদামী ঘোড়ায় আসীন মোম-তা দেওয়া ইয়া মোটা গোঁফ নিয়ে পরেরপর প্রশ্নবাণ। আমি কে, কেন, কবে, কোথায় ইত্যাদি। কথা বলব কি, কাঁপছি রীতিমত। প্রাক-মানুষ মানবের যোগাযোগের ভাষা চোখের ইশারায় বললাম কুকুর সরাতে। এখনও এই ভাষা কথ্য ভাষার সাথে ব্যবহার হয়। বললাম সব। আমন্ত্রণ জানালেন বাড়িতে, বন্দুক উঁচিয়ে বাড়ি দেখালেন। কয়েকদিন পর গেলাম। অনেকগুলো সিঁড়ি। বিশাল সিংহ দরজা। ভেতরে মস্ত ‘চক’। দোতলা প্রাসাদ। ওপরের তলার সামনেটা চারদিকে টানা বারান্দা, অনেকটা চিক দিয়ে ঘেরা। চিকের ফাঁক দিয়ে মহিলাদের উঁকিঝুঁকি। বেরিয়ে এলেন প্রৌঢ়। ‘মেরা নাম লকখণ সিং’। লম্বা বসার ঘর। পুরনো কাঠ ও গদির সোফা-মত বসার জায়গা। মস্ত গোল ও চৌকো দুটো টেবিল, গ্র্যান্ডফাদার ক্লক, কাচের জারে বিদেশি পুতুল ইত্যাদি। শরবত ও চুরমা দিয়ে আপ্যায়ন। কথার ফাঁকে রোমহর্ষক গল্প। বাবা ছিলেন আরাবল্লীর নামকরা ডাকাত। ডাকাতি করে তার কিছু স্বাধীনতা সংগ্রামীদের দিতেন। স্বাধীনতার পর নেহেরু আজমীঢ় থেকে বেওয়ার যাচ্ছেন। বাবা ফায়ার করে নেহেরুর গাড়ি থামিয়ে দিলেন। বন্দুক ও একটা লাল থলিতে গয়না টাকা সব নেহেরুর পায়ে রেখে ডাকাতি করা ছেড়ে দিলেন বলে জানালেন। দুজনের আলিঙ্গন চিরবন্ধুতায় পরিণত হোল। গল্প শুনতে শুনতে ঘরের জিনিস দেখছিলাম। বেরোনোর মুখে বললাম, মেঝেতে যত মূর্তি আছে তার মধ্যে একটা বহুমূল্য পাথরের এবং সেটা চুরি করা। মুহূর্তে চোয়াল শক্ত করে হাসতে হাসতে বললেন, ‘আপ জাসুস ভি হো কেয়া?’উঠোনে এসে ওনার স্ত্রীর সাথে আলাপ করালেন এবং আমার ‘জাসুসি’র প্রশংসা করলেন। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বললেন এটা বাবার আনা, আমি রক্ষা করছি মাত্র। আমি জায়গার নাম বলাতে উনি লজ্জা পেলেন। সত্যকে স্বীকার করে নেওয়ার মধ্যে একটা ব্যক্তিত্ব ফুটে ওঠে, গোঁফ বা বুকের মাপে নয়। 

এক জীবনে, জীবন কই, যৌবনের দোরগোড়ায় এত কিছু দেখলাম, শিখলাম। আমার এক পিসি, মানসিক অসুস্থ। পরে জেনেছি সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত। বড় মেয়ের বিয়ে না দিলে পরের মেয়েদের বিয়ে হচ্ছে না। সমাজের বিধান। ঘুষ দিয়ে পাড়ার এক ছেলের সাথে ‘নামমাত্র’ বিয়ে দেওয়া হলো প্রচূর যৌতুকের বিনিময়ে মাত্র দু দিনের জন্যে। ফুলশয্যার পরের দিন ঠাকুমা মেয়েকে নিয়ে আসে। এসব আমাদের জন্মের অনেক আগের ঘটনা। পিসির আদর খাওয়া, কোলে চড়া সবই করেছি। একটু বুদ্ধি বাড়তে পিসির সাথে বাইরের রকে বসে আছি, হঠাৎ পিসি মাথায় ঘোমটা তুলে দিলেন। ‘কেন পিসি?’‘ওই দেখ আমার বর’। পিসির মাথায় কখনো সখনো সিঁদুর দেখেছি কিন্তু একদিন ঠাকুমা সিঁদুর লাগিয়ে মুছে দিয়ে বললেন, ‘তোর বর মরেছে, তুই বিধবা হলি।’ পিসি কেঁদেছিলেন। কেন কেঁদেছিলেন? অমানবিক নিষ্ঠুর এই ধরনের সামাজিক বিধান আজও সমাজে বহাল। কেন মানবো এই সমাজের বিধান? প্রশ্ন করার শিক্ষাটাও ‘অমেরুদণ্ডী’ মানুষের আজও হলো না। আসলে শিক্ষাটাই তো হয় নি। যা জিন বহন করে এনেছিল সেটাকেও জোর করে আটকে রেখে মেকি মান্যতার একটা আবহ তৈরি করে রেখেছে। জীবন কী? শুধু কি কীটের মত বেঁচে থাকা? প্রাণী বিজ্ঞানের মতে কোনও পরমাণু যখন নিজেদের প্রতিলিপি তৈরি করতে সক্ষম হয়, তখন প্রাণের স্পন্দন দেখা দেয়। প্রাণের জন্য মৌলিক উপাদান অক্সিজেন, কার্বন, হাইড্রোজেন এবং নাইট্রোজেন আরও কিছু সাধারণ মৌলিক উপাদানের সাথে মিশে প্রোটিন ও নিউক্লীক অ্যাসিড তৈরি করে। এরা যে কোন প্রাণীর মূল উপাদান। তার মানে প্রতিটা প্রাণী এক একটা রাসায়নিক গুদামঘর। পাথরের পরমাণু নিজেদের প্রতিলিপি তৈরি করতে অক্ষম, তাই পাথর। আর প্রাণীদের আর এন এ, ডি এন এ থেকে জিন যা বংশানুক্রমিকভাবে প্রজন্ম ও প্রজাতি ধরে বয়ে চলে। এককোষী প্রাণী প্রোক্যারিয়ট ৩৬০ কোটি বছর আগে শুরু হয়েছে। সেই থেকে বিবর্তন হতে হতে ছ কোটি বছর আগে সর্বোৎকৃষ্ট প্রাণী প্রাইমেট বা বানরকুলের আবির্ভাব, শ্রেষ্ঠ মানব প্রজাতি ২৫ লক্ষ বছর আগে আসে। মানুষ তার আগের সবকটা প্রাণীর জিন সঙ্গে নিয়ে জন্মায়। মানুষের নিজস্বতা বলতে খুবই সামান্য, শতকরা এক ভাগ বা তারও কম। বিবর্তন ও উন্নতিতে মানুষের মস্তিষ্ক উন্নততম। 

তাহলে আবার সেই প্রশ্ন, জীবন কী? প্রায় সব ধর্মই জীবনের সাথে আত্মাকে জড়িয়ে দিয়েছে। এই আত্মা কি? ঋগ্বেদ বলছে প্রাণীর মধ্যে সমস্ত উপাদান জোটবদ্ধ এবং এটাই চূড়ান্ত তত্ত্ব। উপাদান মানে elements। মুণ্ডক উপনিষদ আণবিক আত্মার কথা বলছে, যার বাস হৃদয়ে এবং সারা শরীরে তার প্রভাব। ছান্দোগ্য উপনিষদ আরও পরিস্কার করে বলছে মৃত্যুর পর আত্মা দেহ ছেড়ে যায়, প্রবেশের পথ পায় না। তার মানে আত্মা জীবনের উপাদান। ওল্ড টেস্টামেন্টেও আত্মা মানে জীবন। সংস্কৃতে ‘আত্মা’ মানে শ্বাস, জীবন। সব দর্শনেই আত্মা সম্পর্কিত অধিবিদ্যা আধ্যাত্মিক রূপ পেয়েছে। পরিশেষে একটা উপাদানকে স্বীকার করে নেওয়া হলো যা হৃদযন্ত্র সচল রাখে। কী সেই উপাদান? প্রাণবায়ু বা শ্বাসবায়ু। পরে নামকরণ হয়েছে অক্সিজেন। ফলে আত্মা অক্সিজেন, অবিনশ্বর। তাহলেও, শুধু বেঁচে থাকাটাই জীবন? না, একেবারেই না। অর্থপূর্ণ বাঁচাটাই অর্থাৎ আমরা যাকে বলি বাঁচার মত বাঁচাটাই জীবন। সেটা কী? 

জিওলজি পড়তে এসে ডালটনগঞ্জের মাঠে জঙ্গলে প্রশিক্ষণ। কোয়েল দেখে তো খুশিতে আত্মহারা। কাজ করব কি! প্রথম কদিন প্রফেসরেরা চিনিয়ে দিলেন কি ভাবে কাজ করতে হয়। এবার নিজেদের কাজ, প্রতি দুজনের টীম করে এলাকা চিহ্নিত। একদিন দেখি রাস্তার পাশে অনেক কুলের গাছ। বেশ বড় ও মিষ্টি। পাড়তে পাড়তে খেতে খেতে কাজ করছি। একটা গাছে কুল একদিকে মিষ্টি আর অন্য দিকে কষা। কাজ শেষে ক্যাম্পে ফিরে গল্প করছি কুল গাছটার। একজন টিচার বললেন, এটা জিওবোটানি অর্থাৎ মাটির চরিত্র ওখানে দুরকম, শেকড় দুদিকেই ছড়িয়েছে এবং ভিন্ন মাটির রস শেকড়ে ঢুকছে। তাই দুদিকের কুলের স্বাদ আলাদা। প্রাথমিকভাবে সব মানুষের জিন এক কিন্তু ডি এন এ-র গঠন আলাদা বলে সব মানুষ এক রকম দেখতে নয়। এছাড়া মানব প্রজাতির প্রাণীদের মধ্যমস্তিষ্কের ওপরে থাকে গোলাকৃতি গুরুমস্তিষ্ক বা সেরিব্রাম, মস্তিষ্কের বৃহত্তর সম্মুখভাগ। মানুষের মস্তিষ্কের ওজনের চল্লিশ ভাগ গুরুমস্তিষ্ক। এর ওপরের স্তরে বহিরাবরণ বা মগজের ধূসর বাহ্যাংশ ১০০ বিলিয়ন বা দশ হাজার কোটি নিউরন, মস্তিষ্ক কোষের শতকরা ৭৫ ভাগ দিয়ে তৈরি। এখানেই যাবতীয় কল্পনাপ্রসূত চিন্তা, ভাষা, ভাব-আবেগ, স্মৃতি, পরিকল্পনা, বিচার, দোষ, গুণ এবং যত জটিল ক্ষমতার আঁতুড়ঘর। আর এখানেই মানুষকে আলাদা করেছে অন্য প্রাণীর থেকে। দ্বিধা বিভক্ত মস্তিষ্ক মগজের কাজকে ভাগ করেছে। বাম মগজ ভাষা ক্ষমতা, যুক্তি ও বিশ্লেষণ নিয়ন্ত্রণ করে আর ডান মগজ গান, স্মৃতি, ভাবাবেগ সামলায়। এরা অখণ্ডভাবে সম্পূর্ণ মানুষের কাজ করে। ধূসর পদার্থের সামনের অংশ মাংসপেশি সঞ্চালন, হাত পা সঞ্চালন প্রভৃতি স্নায়ু নিয়ন্ত্রিত মোটর কাজ সামলায় এবং পেছনের অংশ ইন্দ্রিয়ের সংকেত গ্রহণ করে সামনের অংশকে নির্দেশ পাঠায় মোটর সঞ্চালনের। মস্তিষ্কের দুপাশে কানের ওপরের অংশ শ্রবণ ও পেছনের অংশ দৃষ্টির ইন্দ্রিয়। স্বাদ ও গন্ধের ইন্দ্রিয়ের গ্রন্থি শ্রবণ গ্রন্থির পাশে। মস্তিষ্কের বাম গোলার্ধে দুটো জায়গা ভাষাকে নিয়ন্ত্রণ করে। একটা ভাষাকে বুঝতে আর অন্যটা ঠোঁট, জিব, গলা ও চোয়ালের মাংসপেশিদের নিয়ন্ত্রণ করে স্বর বেরোতে সাহায্য করে। গাছের মত মানুষের চরিত্রও পরিবেশ নির্ভর। একই পিতামাতার একাধিক সন্তান থাকলে সম-চরিত্রের হয় না। এমনকি যমজেরাও নয়। আলাদা পরিবেশে বেড়ে উঠলেও হয় আবার একই বাড়িতে বড় হলেও হয়। কেউ লেখাপড়ায় ভাল, কেউ গানে আগ্রহী, কেউ খেলোয়ার তো অন্যটা সমাজবিরোধী। সেই আরাবল্লীতেই আবার ফিরে যাই। প্রকৃতির মানুষ, মানুষের প্রকৃতি। দুটোই সরলতার প্রতীক। শামগড় থেকে আরও কিছুটা দূরে বাসাবদল। গ্রামে মুসলমানদের বাস। দশ-বারো ঘর হবে। শীতের রাতে পৌঁছে ঘর পাই না। রেগে গিয়ে ছাগলদের তাড়িয়ে তাদের ঘর দখল করলাম। মাটির মেঝেয় খড় ওলোট-পালোট করে বেডিং পেতে দিলাম। খিদে পেয়েছে। কেউ খাবার করে দেবে না। সঙ্গে আটা আর ভেলিগুড়। তিনটে পাথর দিয়ে কাঠ জ্বেলে উনুন করলাম। ছাগলের খাওয়ার লোহার গামলা উপুড় করে উনুনে দিয়ে রুটি বানালাম। শোব কি, জানলা দরজা আছে বন্ধ করার কিছু নেই। এক মহিলা চট লাগিয়ে দিলেন। কোটি তারার নীচে চারমিনার জ্বলছে। সেই মহিলা সামনে বসে, মাথা বেআবরু। স্বামী মারা গেছেন। এক মেয়ে ডাক্তার, শহরে। এক ছেলে স্কুলে পড়ায় আর অন্য ছেলে ডাকাতি করে জেলে। একই বীজে কেন এমন হয়? আমি নাকি শিক্ষিত। কী জবাব দেব? পরে জেনেছি, মানুষের মনে দু ধরনের চিন্তার জগত – একটা প্রাথমিক বা মৌলিক, অন্যটা সম্ভ্রান্ত, উদার মহৎ। এই দুটোই আত্মসচেতনতার অনুগত এবং জিনবাহিত। মননের মৌলিক উপাদান ছটি রিপু – কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য্য, অর্থাৎ ঈর্ষা। প্রতিহিংসা, বিতৃষ্ণা, গর্ব, অহং ইত্যাদি সবই মানুষের মধ্যে আছে। আর মহৎ আবেগের মধ্যে আসে প্রেম, করুণা, সহানুভূতি, বন্ধুতা, সহযোগিতা, শান্তি ও এই ধরনের ভাবাবেগ। প্রত্যেক মানুষের ভেতরে এই দু ধরনের আবেগ কাজ করে চলেছে এবং তাদের মধ্যে চলে দ্বন্দ্ব। এইবার কোনও একটা কাজে কার কোন আবেগ এই যুদ্ধে জিতবে, তা নির্ণয় করে বাইরের পরিবেশও অন্দরের রাসায়নিক মৌল বা যৌগিক পদার্থ মিশ্রিত নির্যাস। মূলত মস্তিষ্ক থেকে ডোপামিন সেই অবস্থায় যে পদার্থ বয়ে নিয়ে আসবে, সেটাই নির্দেশের ট্রিগার পয়েন্ট। কেন কী হয়, মস্তিষ্কের জগত বেশিটাই এখনও অধরা। 

বিশ্বকর্মা একবার ভালোবাসা আর শান্তি দিয়ে এক নগর গড়বেন বলে ঠিক করেন। আদর্শ দেশ। অন্যের রাজ্যে লোভ করবে না, নিজের রাজ্যকেও বাঁচাবে। সব মানুষের জন্যে নিজস্ব ঘর। নগরের একদিকে সাগর, অন্যদিকে পর্বতপ্রহরী। অনেক ভ্রমণের পরও কোন জায়গা পেলেন না বলে আক্ষেপ করছেন কৃষ্ণকে। যেদিকেই তাকান শুধু দম্ভ আর দেখনদারি ঐশ্বর্যের দামামা বাজছে। কৃষ্ণ সব শুনে বলেন, এসব নির্বোধ লোকের আদর্শ। কেড়েকুড়ে খাওয়া, ভোগলালসা, অহং আর রক্ত। মানুষের বীজে ঢুকে গেছে অকারণ হত্যার ভয়ঙ্কর আনন্দ। সেই তিরিশ হাজার বছর আগে প্রচণ্ড শৈত্যপ্রবাহের সময় মানুষ তার সমগোত্রের নিকট প্রজাতির সাথে খাদ্যসম্পদ ভাগ করে নিতে অস্বীকার করে এবং নির্বিবাদে হত্যা করে পুরো প্রজাতিটাকেই শেষ করে দেয়। অথচ তার আগেই তারা নাকি যৌন মিলন করত। সেই জিনই তো বহন করছি আমরা। রাতে যাকে আদর করে চুমু খায় সকালে তাকেই চাবুক দিয়ে মারে। আবেগের দ্বন্দ্ব হয়েই চলেছে। 

পাথর পৃথিবীর আ-জন্ম ইতিহাস ধরে রাখে তার স্মৃতিতে, খাঁজে খাঁজে। জিওলজিস্ট তা পড়তে পারে। জানতে পারে প্রাণীর জন্ম থেকে মৃত্যুর ইতিহাস। আর মানুষ ধরে রাখে স্মৃতি আ-মৃত্যু, পরতে পরতে। কিন্তু জিওলজিস্ট পারে না আবেগের ইতিহাস উন্মোচন করতে, কারণ আবেগের ফসিল হয় না। আবেগের প্রকাশ ধরা থাকে ভাষায়, সাহিত্যে ও শিল্পকর্মে। সেই আবেগ সুখ-অসুখ, আনন্দ-দুঃখ, ব্যাথা-বেদনা যাই হোক, তা গান হয়ে ওঠে সর্বদাই। জীবনটাই একটা গান – অনেক রকম সুর ও তান দিয়ে ভরিয়ে তোলে শোক-আনন্দের দীপমালা। 

ছোটবেলায় গরমকালে ছাতে রাতের বিছানা, মশারি। চোখের সামনে লক্ষ মানিক, জ্বলজ্বল করছে। কৃত্রিম স্যাটেলাইটগুলো তারাদের পাশ দিয়ে চলে যায়। পাশের বাড়ির রেডিওয় বাজে ‘আনন্দধারা বহিছে ভুবনে’। ঠাকুমা বলেন, রবিঠাকুরের গান। আরাবল্লীর খরোয়া গ্রামে বাঙালি ডাক্তারের সংসার। অমায়িক। প্রায়ই রাতে খাওয়া ওবাড়ি। নিকষ অন্ধকারে ছাতে প্রায় সমবয়সী বড়মেয়ের কোলে মাথা রেখে দেখি আকাশভরা তারা। হৃদয় থেকে বেরিয়ে এল আপনিই –‘আনন্দধারা বহিছে ভুবনে’।

প্রবন্ধ - ধ্রুবজ্যোতি চক্রবর্তী


প্রবন্ধ


গীতারহস্যামৃতম
(দ্বিতীয় পর্ব)
ধ্রুবজ্যোতি চক্রবর্তী


(৪) 
মহাগ্রন্থ গীতা ভক্তের জন্য ভক্তিযোগ, কর্মীর জন্য কর্মযোগ, রাজপুরুষদের জন্য রাজধর্ম-রাজগুহ্যযোগ, সন্ন্যাসীদের জন্য সন্ন্যাসযোগ, দার্শনিকদের জন্য সাংখ্যযোগ, অনুশীলনকারীদের জন্য অভ্যাসযোগ, আদর্শ পুরুষদের জন্য পুরুষোত্তমযোগ ইত্যাদি প্রায় সর্বসাধারণের জন্য এক কথায় এক অসামান্য হাতে গরম রেডিমেড হ্যান্ডবুক হিসেবে মহাকালের দরবারে চিরকালীন হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে নিয়েছে। 

এত স্বল্প পরিধিতে এত ব্যপকতা আর কোনও গ্রন্থে নেই বললে নিশ্চয় অতুক্তি করা হবে না বলেই আমার মনে হয়। 

গীতা মহাগ্রন্থটি দার্শনিক তথ্যের স্বর্ণখনি। তবু এই মহাগ্রন্থটি ভীষণভাবে ইউসার ফ্রেন্ডলি। মহাগ্রন্থ গীতা কেবল নীতিজ্ঞানের শাস্ত্র নয়; নীতিশাস্ত্রের মতো শুধু ভালো আর খারাপের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করেই ক্ষান্ত হয় না বরং গীতা মহাগ্রন্থে যেটা মহাপ্রাপ্তি সেটা হলো মানুষ যদি গীতা নির্দেশিত পথ অনুযায়ী জীবনযাত্রা নির্বাহ করে তবে তার যা ভালো তার ওপর তোমার মন বসবে আর যা খারাপ সেই অকর্ম সম্পাদন থেকে বিরত থাকবে। আর তার ফলে সে একটি সুখী, শান্তিময়, উদ্বেগহীন জীবন যাপন করতে সমর্থ হবে। 

গীতাকে ধর্মগ্রন্থের থেকেও আরও উচ্চস্থানে প্রতিষ্ঠিত করে তাকে মহাগ্রন্থের শংসাপত্র দিতে চাইবার এটি আর একটি কারণ বলেই আমার কাছে বিবেচিত হয়েছে। 

রাজশেখর বসুর মতে গীতা মহাগ্রন্থ পাঠে সর্বসাধারনের মোক্ষ লাভ হবে কিনা, তা আমার জানা নেই বটে, তবে এই মহাগ্রন্থে Self-upliftmentএর জন্য একটা পথের সন্ধান দেওয়া আছে।সে পথে ক্রমে-ক্রমে অল্পে-অল্পে অনুশীলনের মাধ্যমে অগ্রস্রর হতে পারলে আপনআপন চরম লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব।আর সেই লক্ষ্য যদি ব্যক্তি বিশেষে মোক্ষ লাভ হয়, তবে তাও প্রাপ্ত হতে পারে। 

সর্বসাধারণ সব সময়ে এই পথের চরম লক্ষে পৌঁছতে পারবে কিনা, তা জানা নেই তবে এই পথে অন্তত কিছুটা অগ্রসর হতে পারলেও মানুষ কৃতার্থ হতে পারে... স্বল্পমপাস্য ধর্মস্যত্রায়তে মহতো ভয়াৎ” (সাংখ্য্যোগ – ৪০তম শ্লোকের অন্ত) – এই ধর্মের অতি অল্পও মহাভয় থেকে ত্রাণ করে। 

মনে রাখতে হবে উদ্বেগই উপভোগের প্রধান অন্তরায়। যেহেতু জাতি-ধর্ম, উচ-নীচ সর্বস্তরের মানুষের-ই উদ্বেগহীন শান্তিময় সুখী জীবন উপভোগই একমাত্র কাম্য, সেহেতু গীতা মহাগ্রন্থটি মানবজীবন যাপনের একটি অতীব জরুরি পাথেয় হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। 

পটলবাবুসহ আম জনতার গীতামহা গ্রন্থটি পাঠের এটাই একমাত্র কারণ হিসেবে ধরা যায়। 

জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে… এই আপ্তবাক্যটি গীতা মহাগ্রন্থটিতে অতি সরলভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। আর এই মহাভয় থেকে পরিত্রাণের সোপান গীতা মহাগ্রন্থে বহুভাবে বর্ণিত হয়েছে। জন্ম-মৃত্যুর এই দুই দ্বারের মধ্যবর্তী গমনপথেই জীবন এবং তা সদাই মৃত্যুভয়ে শঙ্কিত। জন্মাবার পর থেকেই মানুষ যদি সদাসর্বদা মৃত্যুভয় নিয়ে জীবনযাপন করে চলে তবে সেই জীবন বিষময় হতে বাধ্য। এই মহাভয় থেকে নিস্তার পাবার জন্য মহাগ্রন্থ গীতাতে যেমন বহু তত্ত্ব আলোচিত হয়েছে, তেমনই মৃত্যুভয় থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে কি ধরনের জীবনযাত্রা অবলম্বন করা উচিৎ, তাও গীতা মহাগ্রন্থে বলা হয়েছে। 

(৫) 
এই প্রসঙ্গে গীতায় বর্ণিত কয়েকটি শ্লোকের দিকে নজর দেওয়া যাক। 

মৃত্যু অবসম্ভাবী প্রসঙ্গে সাংখ্যযোগের ২৭তম শ্লোকে দেখতে পাই শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলছেন, 

“জাতস্যহি ধ্রূবো মৃত্যু ধ্রূবং জন্মমৃতস্য। 
তস্মাদ পরিহার্যেহর্থেনতং শোচিতুমর্হসি।। 
(জাতব্যক্তির মৃত্যু ধ্রূব এবং মৃতের জন্ম ধ্রূব। 
অতএব অনিবার্য বিষয়ে তুমি শোক করতে পার না।। ) 

তার আগে শ্রীকৃষ্ণ আত্মার অবিনশ্বরতা নিয়ে অনেক বক্তব্য রেখেছেন। যেমন – 

(সাংখ্যযোগের ২০তম শ্লোক) 

নজায়তে ম্রিয়তেবাকদাচিন্নায়ং ভূত্বা ভবিতাবান ভূয়ঃ। 
অজোনিত্যঃ শাশ্বতোয়ং পুরাণো ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে।। 

(ইনি কদাচ জন্মেন না বা মরেন না; অথবা এখন উৎপন্ন হয়ে পুর্নবার হবেন না–এও নয়। 
ইনি জন্মহীন, নিত্য, অক্ষয় অনাদি; শরীর হত হলে হত না।।) 

(সাংখ্যযোগের ২৩তম শ্লোক) 

নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্রাণি নৈনং দহতি পাবকঃ। 
ন চৈনং ক্লেদয়ন্ত্যাপো ন শোষয়তি মারুতঃ।। 

(কোনও অস্ত্র এঁকে ছিন্ন করে না, আগুন এঁকে দগ্ধ করে না, 
জলও এঁকে আদ্র করে না, বায়ু শুষ্ক করে না।) 

এইবার দেখা যাক জন্ম-মৃত্যু এই দুই দ্বারের মধবর্তী গমন পথের জীবনযাত্রায় অবসম্ভাবি মৃত্যু ভয় থেকে নিস্তার পেতে হলে কি ধরনের মানসিক স্থিতির প্রয়োজন। 

এই প্রসঙ্গে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলছেনঃ (সাংখ্যযোগ-১৫নং শ্লোকের অন্ত) 

“সমদুঃখসুখং ধীরং সোহমৃতত্বায় কল্পতে” 

(দুখঃ ও সুখে সমভাবাপন্ন ধীর পুরুষই অমৃত লাভের যোগ্য) 

এই প্রসঙ্গে শ্রীকৃষ্ণ স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তির গুন বর্ণনা করেছেন। আরও বলেছেন যে বিষয় সমূহের চিন্তা করতে করতে মানুষের তাতে আসক্তি জন্মায়। আসক্তি থেকে কামনা আর কামনা পূর্ণ না হলে ক্রোধ জন্মায়, ক্রোধ থেকে ভ্রান্তধারণা আর তাই থেকে বুদ্ধিনাশ হয় এবং সর্বশেষে বুদ্ধিনাশ হলে মানুষ বিনষ্ট হয় (সাংখ্য যোগ-শ্লোক নং ৬২/৬৩– অনুবাদক রাজশেখর বসু))। 

(বিষয়চিন্তা করতে করতে মানুষের তাতে আসক্তি হয়; আসক্তি হতে বিষয় প্রাপ্তির ইচ্ছা জন্মে; আবার সেই কামনা প্রতিহত হলে তা ক্রোধের আকার ধারণ করে, ঐ ক্রোধ হতে বিবেকনাশরূপ মোহের উৎপত্তি হয়; মোহ হতে স্মৃতিবিলোপ সাধিত হয়; স্মৃতিভ্রংশের ফলে হয় বুদ্ধিভ্রংশ এবং বিবেক বুদ্ধির নাশ হতে প্রকৃত বিনাশ সংঘটিত হয়। - আনুবাদক স্বামী অপূর্বানন্দ – শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ –ভুবনেশ্বর।) 

দুই আনুবাদকেরই বক্তব্য যখন একই তখন একথা বলতে দ্বিধা নেই যে এই সকল আত্মনিধনকারী শক্তি থেকে মনকে অচঞ্চল রেখে অনুশীলনের মাধ্যমে কর্ম বন্ধনে না পড়ে সিদ্ধি-অসিদ্ধিতে সমান মনোভাব নিয়ে বুদ্ধির সাহায্যে ফলের আশা ত্যাগ করে কর্ম করে উদ্বেগহীন জীবন যাপনই স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তির লক্ষ্য। 


(৬) 
এইখানে পটলবাবু তো কোন ছাড়, শ্রীকৃষ্ণের অতবড় সখা অর্জুন পর্যন্ত টাল খেয়ে গেছেন। বলে ফেলেছেন, (কর্মযোগ-২নং শ্লোক)- 

“ব্যামিশ্রেণেব বাক্যেন বুদ্ধিং মোহয়সীব মে। 
তদেতং বদ নিশ্চিন্ত যেন শ্রেয়োহমাপ্লুয়াম।।” 

যার মোটা বাংলা মানে হচ্ছে “গোলমেলে কথা বলে আমাকে কনফিউজ করছ; যাতে আমার ভাল হয় সেটা ঠিকঠাক করে বলো।” 

আবার মনকে অচঞ্চল রাখার প্রসঙ্গে ম্যাঙ্গোম্যান পটলবাবুদের মতো অর্জুন শ্রীকৃষ্ণকে একেবারে বেসিক প্রশ্ন করে একটু বেকায়দায় ফেলে দিয়েছিলেন। প্রশ্নটা একটু শোনা যাক (ধ্যানযোগ-৩৪নং শ্লোক) – 

“চঞ্চলং হি মনঃ কৃষ্ণ প্রমাথি বলবদ্দৃঢ়ম্ । 
তস্যাহং নিগ্রহং মন্যে বায়োরিব সুদুস্করম ।।”  

(হে কৃষ্ণ, মন চঞ্চল, বিক্ষোভকর, প্রবল,দৃঢ় । 
আমি তার সংযম বায়ুরতুল্য সুদুষ্কর মনে করি।।) 

তবে শ্রীকৃষ্ণ অতি কুশলতার সঙ্গে এই প্রশ্নটির উত্তর দিয়েছেন। এই জন্যই শ্রীকৃষ্ণ পুরো মহাভারতে মোস্ট ইন্টেলিজেন্ট এবং ক্ষুরধার বুদ্ধি সম্পন্ন চরিত্র হিসেবে মান্যতা পেয়েছেন। উত্তরে তিনি কি বলেছেন দেখা যাকঃ (ধ্যানযোগ-৩৫নং শ্লোক) – 

অশংশয় মহাবাহো মনো দুর্নিগ্রহং চলম। 
অভ্যাসেন তু কৌন্তেয় বইরাগ্যেণ চ গৃহ্যতে।। 

(হে মহাবাহো, মন দুর্নিগ্রহ, চঞ্চল – নিঃসন্দেহ। 
কিন্তু, হে কৌন্তেয়, অভ্যাস ও বৈরাগ্যের দ্বারা সংযত হয়।।) 

অতি দুরূহ একটি সমস্যার একটি অসাধারণ সমাধান! 

মনে পড়ে যায়, অঙ্কের খাতা নিয়ে কঠিন অঙ্কটার সমাধান না করতে পেরে ছেলে বা মেয়ে যখন বাবা-মা বা শিক্ষকের সামনে এসে হাজির হয়, তখন তাঁরা সন্তান বা ছাত্র-ছাত্রীদের এই উপদেশটাই দিয়ে থাকেন –মন দিয়ে অভ্যাসকর। প্র্যাকটিস, প্র্যাকটিস এন্ড প্র্যাকটিস অর্থাৎ অভ্যাস কর। 

তাই শুরুতেই যা বলেছিলাম তাই এখন আবার বলছি, গীতা মনুষ্য জীবনে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। 

এবার একটু তার্কিকের দৃষ্টিকোন থেকে গীতাকে বিশ্লেষণ করা যাক।

শ্রীকৃষ্ণকে যদি তৎকালীন কোন এক মানব গোষ্ঠীর নেতা হিসেবে ধরা যায় যিনি নিজের আধিপত্য সমস্ত পৃথিবীতে (সেকালে পৃথিবী বলতে ভারতবর্ষ এবং তার আশেপাশের দেশ গান্ধার ইত্যাদিকে ধরা যেতে পারে) বিস্তার করার ভাবনা-চিন্তা মাথায় নিয়ে একটি সূক্ষ সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনা করেছেন। 

এই ছকে নিজ রাজ্য শাসণকালে তিনি পাণ্ডবদের বীরত্বের খবর পান এবং তাঁদের সাহায্যে পৃথিবীতে নিজের আধিপত্য বিস্তারের স্বপ্ন দেখতে থাকেন। এই স্বপ্নপূরণের রাস্তাটা সহজ করেদেনস্ম্রাট ধৃতরাষ্ট্র যখন তিনি নিজের অজান্তে কৃষ্ণের পাতা ফাঁদে পা বাড়ান। কৃষ্ণ অন্ধ রাজার অন্ধ পুত্রপ্রেমের পুরো ফয়দাটা তুলে নেন। অবশ্য তার আগে জরাসন্ধ, কীচক ইত্যাদি কিছু প্রতিদ্বন্দীদের কুরুক্ষেত্রে একত্রিত হবার আগেই কৃষ্ণ পাণ্ডবদের সাহায্যে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেন। ওই সব মহাযোদ্ধারা যদি কুরুক্ষেত্রে একত্রিত হবার সুযোগ পেতেন তবে হয়ত পাণ্ডবদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠতে পারতেন। 

প্রবন্ধ - সিদ্ধার্থ মজুমদার


প্রবন্ধ


সত্য, সুন্দর এবং বিজ্ঞান 
সিদ্ধার্থ মজুমদার 


সুন্দর বা সৌন্দর্য বহু আলোচিত বিষয় এবং প্রাচীনকাল থেকেই এ নিয়ে চর্চা হয়ে আসছে। দার্শনিক ও চিন্তাবিদরা এ নিয়ে আলোচনাও করেছেন অনেক। আছে নানান ব্যাখ্যা আর বিশ্লেষণ। তবুও সৌন্দর্য নিয়ে এখনও অজস্র প্রশ্নের উত্তর অজানা থেকে গেছে। এর একটা বড় কারণ, সৌন্দর্য বিদ্যার সঙ্গে একাধিক জটিল বিষয়ের সম্পর্ক। 

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতির ফলে সৌন্দর্য বিদ্যারও অনেক নতুন দিক খুলে গেছে আজ। যার ফলে বিস্তৃত হয়েছে সৌন্দর্যের ধারণা ও প্রচলিত সৌন্দর্য অভিজ্ঞতার পরিধি। বহুকাল আগে থেকেই সৌন্দর্যবিদ্যাকে যেমন দর্শন ও শিল্পকলার শাখা হিসেবে মনে করা হত, এখন তা বিজ্ঞানের বৃত্তেও জায়গা করে নিয়েছে। বিশেষত ‘স্নায়ুবিজ্ঞান’ আজ সৌন্দর্য ভাবনার নানান অজানা ক্ষেত্র উন্মোচিত করেছে এবং স্নায়ু বিজ্ঞানীদের এবিষয়ের বিভিন্ন আলোকপাত সৌন্দর্যের জ্ঞানকে বিস্তৃত করেছে। 

‘অ্যাসথেটিকস’ (aesthetics) শব্দটির অর্থ হল ‘নন্দনসংক্রান্ত’, যা গ্রীক aisthetikosথেকে এসেছে। ইংরেজিতে যার মানে sensory perception। বাংলায় তর্জমা করলে দাঁড়ায়, ‘অনুভূতি দিয়ে উপলব্ধ করা’।‘অ্যাসথেটিকস’ বিদ্যার মধ্যে পড়ে সৌন্দর্য-উপভোগ্যতা, শিল্পকলা, সৌন্দর্য, স্বাদ, সৃষ্টি, এই সমস্ত বিষয়গুলি। 

স্বর্ণে রত্নে শোভন লোভন জানি, বর্ণে বর্ণে রচিত ... 

সৌন্দর্য নিয়ে কিছু ভাবতে গেলে প্রথমেই প্রকৃতির কথা আসবে। প্রকৃতির সৌন্দর্য নিয়ে শিল্পী ভিনসেন্ট ভ্যান গখ যথার্থই বলেছেনঃ “যদি তুমি সত্যি প্রকৃতিকে ভালবাসতে পার, তাহলে তুমি সবখানে, সব কিছুর মধ্যে খুঁজে পাবে সুন্দর-কে।” আসলে প্রকৃতির সব কিছুর মধ্যেই তো জড়িয়ে আছে অনিন্দ্য সুন্দর রূপের বৈভব। প্রকৃতির রূপ, রং আর রসের অফুরন্ত সৌন্দর্য অভিজ্ঞতা মানব মনের মণিকোঠায় সদাই বিরাজমান। 

প্রকৃতির মধ্যে এই সৌন্দর্য ছাড়াও আরও এক ধরনের সৌন্দর্য ভাবনার মধ্যে এসে যায়, যা সৃজনশীল মানুষের সৃষ্টি করা চিত্র,শিল্পকলা, ভাস্কর্য, আলোকচিত্র, কবিতা, সংগীত, নাটক, নৃত্যকলা ইত্যাদির শৈল্পিক সৌন্দর্য! 

‘সুন্দর কী?’ বা ‘একটি জিনিসকে কেন সুন্দর বলে মনে হয়?’ সুন্দর-এর কথা প্রসঙ্গে এই প্রশ্নই প্রথমে মনে আসে। এই সব প্রশ্নের স্পষ্ট কোনো উত্তর হয় না। প্রশ্ন দুটির উত্তর পেতে গেলে জানতে হবে ‘সৌন্দর্য চেতনার উৎস’ সম্বন্ধে! বলাবাহুল্য, এবিষয়ে এখনও অনেক প্রশ্নেরই উত্তর অজানা। 

পাশাপাশি আরও কয়েকটি প্রশ্ন জাগে। যেমন, ‘মানুষ কীভাবে বিচার করে, কোনটি বেশি আর কোনটি কম সুন্দর? এবং সেই বিচার প্রক্রিয়াই বা ঠিক কেমন?’ কিংবা, ‘কোনো কিছু জিনিস আমাদের কাছে কেন সুন্দর বলে মনে হয়?’ আর যাকে সুন্দর বলে আমরা মান্যতা দিলাম, তা কি সেই জিনিসটির মধ্যে থাকা সৌন্দর্য? নাকি দ্রষ্টার কাছে তা সুন্দর হিসেবে গ্রহণীয় হয়ে ওঠে বলেইতা সুন্দর মনে হয়? 

এমন নয় যে এই প্রশ্নগুলি নতুন। বহু কাল আগে থেকেই এমন প্রশ্নের উত্তর মানুষ খুঁজে আসছে।সৌন্দর্য ভাবনার এইসব চিরাচরিত প্রশ্নগুলিকে সঙ্গে নিয়ে সুন্দরতার সুলুক সন্ধান এর পথে এগিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা করা হয়েছে এই লেখায়। 

বিভিন্ন সময়ে একাধিক চিন্তাবিদ সৌন্দর্য সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। যদিও সুন্দরকে সংজ্ঞায়িত করা যে কঠিন কাজ, সে কথা তাঁরা বলেছেন। মূলত দুটি দিক থেকে সুন্দরকে বুঝতে চেয়েছেন তাঁরা।প্রথমটি হল -- গঠন,ফর্ম বা অর্ডার সম্পর্কিত। সৌন্দর্য উপাদানের পরিমাপ, অনুপাত, রঙ বা টেক্সচার ইত্যাদি গুণাগুণগুলি এর সঙ্গে জড়িত। দ্বিতীয়টি হল, সৌন্দর্য উপভোগ করার পরে দ্রষ্টার যে অনুভূতি, সুখ, আবেগ বা ভালোলাগার অভিজ্ঞতা হয়, সে সংক্রান্ত। এটা ঠিক যে, সৌন্দর্যের উপভোগ্যতা বিষয়ে কোনো স্পষ্ট ধারণা দিতে পারেননি পণ্ডিতরা। 

সৌন্দর্যের ব্যাখ্যায় গ্রীক দার্শনিক ও স্বনামধন্য গণিতবিদ পিথাগোরাসের (৫৭০ বিসিই - ৪৯৫ বিসিই) ব্যাখ্যা অন্যদের থেকে আলাদা। তিনি বিশ্বাস করতেন, যা কিছু সুন্দর, তার সঙ্গে নিশ্চিতভাবে সিমেট্রি এবং গাণিতিক কোনো সম্পর্ক থাকবে। প্রাচীন ইজিপ্টের মানুষই প্রথম, যারা এই গাণিতিক অনুপাত, নিয়মানুগতা বা ‘গোল্ডেন সেকশেন’-এর কথা ভেবেছিলেন। পিরামিডের ডিজাইনের মধ্যে যে জ্যামিতিক নিয়মানুগতা দেখা যায়, তা যে পিথাগোরাসের ভাবনার প্রতিফলন, এতে কোনো সন্দেহ নেই। 

বিশ্ব-নাচের কেন্দ্রে যেমন ছন্দ জাগে ... 

শিল্পকলাতে গণিতের যে প্রয়োগ দেখতে পাওয়া যায়, সম্ভবত তা শুরু হয় বিশ্বপ্রকৃতির নিয়মানুবর্তিতাকে প্রত্যক্ষ করে। প্রকৃতির সবকিছুর মধ্যে একধরনের গাণিতিক নিয়ম রয়েছে, প্রাচীন চিন্তাবিদরা অনেকেই এমন কথা বুঝেছিলেন। পিথাগোরাস বিশ্বাস করতেন, ‘মিউজিক্যাল হারমনির সঙ্গে যেভাবে গণিত জড়িয়ে থাকে, সেভাবেই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের অন্তর্নিহিত সুরমূর্ছনার প্রকাশের সঙ্গেওমিশে থাকে গণিত।’ পিথাগোরাসের মতন প্লেটো-ও বিশ্বাস করতেন, ফিজিক্যাল-ওয়ার্ল্ডের যে সৌন্দর্য, তার মূলে রয়েছে গাণিতিক সৌন্দর্য। 

বলতে হয় লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির (১৪৫২-১৫১৯) কথাও। তাঁর জগদ্বিখ্যাত চিত্রশিল্পগুলিতে তিনি বিভিন্ন গাণিতিক সূত্র, রঙ আর জ্যামিতিক প্যাটার্নের ব্যবহার করেছেন। বস্তুত তিনিই প্রথম গাণিতিক ভাষার নিপুণ প্রয়োগ করে তাঁর সৃষ্টি করা চিত্রশিল্পগুলিকে এক মহত্তম সৌন্দর্যে উত্তীর্ণ করে তোলেন। 

সে সময়ের চিন্তাবিদদের মতন বর্তমান সময়ের অনেক দিকপাল পদার্থবিদ, রসায়নবিদ এবং গণিতজ্ঞরাও বিশ্বাস করেন, প্রকৃতির মধ্যে থাকা যে শৈল্পিক স্টাইল, তার হলমার্ক হল ‘সিমেট্রি’।বিশ্বপ্রকৃতির সব কিছুর মধ্যে রয়েছে গাণিতিক প্যাটার্ন! প্রকৃতির মধ্যে থাকা এই যে নিখুঁত নিয়ম-শৃঙ্খলা, ছন্দ, তাল, সামঞ্জস্য আর সময় জ্ঞান —তাতো আসলে সৌন্দর্যেরই প্রকাশ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ভাবনায় গণিতের ভূমিকা থাকার কথা নোবেলজয়ী পদার্থবিদ্ রিচার্ড ফেইনম্যানের (১৯১৮-১৯৮৮) কথাতেও স্পষ্ট। তিনি বলেছেন -- “সৌন্দর্যকে প্রকৃতও নিবিড়ভাবে উপলব্ধি করতে হলে কিংবা প্রকৃতির অন্তর্নিহিত যে গভীরতম সৌন্দর্য বিদ্যমান, তা জানার জন্য গণিতের প্রয়োজন। গণিতের ভাষা জানা না থাকলে সেই অপরূপ সুন্দরতাকে সম্যক বোঝা সম্ভব নয়।যদি তুমি প্রকৃতিকে জানতে চাও, বুঝতে চাও,পড়তে চাও, উপলব্ধি করতে চাও, তাহলে প্রকৃতি যে ভাষায় কথা বলে সেই ভাষাটি জানা একান্ত প্রয়োজন।” 

তোমার নৃত্য অমিত বিত্ত ভরুক চিত্ত মম ... 

সৌন্দর্য অনুভবের জন্য মনের একটা বিশাল ভূমিকা থাকে, তা আলাদা করে না বললেও বোঝা যায়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথও সেই কথা বলেছেন --“শুধু চোখের দৃষ্টি নহে, তাহার পিছনে মনের দৃষ্টি যোগ না-দিলে সৌন্দর্যকে বড়ো করিয়া দেখা যায় না। এ মনের দৃষ্টি লাভ করা বিশেষ শিক্ষার কর্ম।” রবীন্দ্রনাথ যাকে ‘মনেরদৃষ্টি’ বলেছেন, বস্তুত সেই দর্শন অনুভূতির কেন্দ্রস্থলটি আসলে ‘মগজ’। সৌন্দর্য অনুভবের সঙ্গে মগজের সম্পর্ক নিবিড়ভাবে জড়িত। মগজের কথায় আমরা পরে আসব। তার আগে, সৌন্দর্যের রসাস্বাদন সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা কী ভাবেন, তা জানার চেষ্টা করব। 

কীর্তিমান বিজ্ঞানীরা যে বিজ্ঞানের কাজে সৌন্দর্যের রসাস্বাদন করেন, বিজ্ঞান কম-জানা মানুষের পক্ষে এমন কথা বোঝা কষ্টকরই বটে। বস্তুত, কেবল কবি-শিল্পী বা শিল্পরসিকরাই যে সৌন্দর্যের রসাস্বাদন করতে পারেন, বিজ্ঞানীরা নয়, এ কথা ঠিক নয়। বিজ্ঞানীরাও এক অর্থে সৌন্দর্যেরই উপাসক। আসলে, বিজ্ঞানের কাজের ধরনের সঙ্গে যেহেতু বিজ্ঞানের বাইরের জগতের মানুষ ততটা পরিচিত নন, তাই তাঁদের পক্ষে সুন্দর আর বিজ্ঞানের এই যোগসূত্র বুঝে ওঠা কিছুটা কঠিনই বটে। 

স্বনামধন্য বিজ্ঞান গবেষকরা সৌন্দর্য বলতে ঠিক কী বোঝেন? তাঁদের কাছে সৌন্দর্যের সংজ্ঞা কি প্রচলিত ধ্যানধারণার থেকে আলাদা কিছু ? এবার সেই কথা বুঝতে চেষ্টা করব। 

প্রথমে যাঁর কথা বলতে হয়, তিনি সুব্রম্যণিয়ম চন্দ্রশেখর (১৯১০-১৯৯৫)। ভারতে জন্ম আমেরিকান অ্যাস্ট্রোফিজিসিস্ট। ১৯৮৩ সালে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন। ‘সৌন্দর্যকী?’ - তা নিয়ে বলা তাঁর একটি কথা পড়ি, - “যে আহ্বানে মানুষের মন সবচেয়ে গভীরভাবে সাড়া দেয়, তাই হল সৌন্দর্য”। বিশ্ববন্দিত এই বিজ্ঞানীর লেখা একটি অসামান্য বই রয়েছে, নাম--Truth and Beauty, Aesthetics and Motivation in Science। চন্দ্রশেখরের সাতটি বক্তৃতার সংকলন নিয়ে এই বই। বিজ্ঞানের মহতী সত্য আবিষ্কার আসলে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অনির্বচনীয় সৌন্দর্য ও রূপের অনুসন্ধান। এই বইয়ে রয়েছে সে কথারই প্রতিধ্বনি। 

আলোকে মোর চক্ষুদুটি মুগ্ধ হয়ে উঠল ফুটি ... 

সৌন্দর্য-অভিজ্ঞতা বোধ বা অনুভবের বিষয় হলেও এর শুরুটা হয় ‘দেখা’ থেকে। তবে এই ‘দেখা’-র সঙ্গে শুধু যে চোখের সম্পর্ক রয়েছে, তা নয়। চোখের মাধ্যমে আমরা দেখি ঠিকই, কিন্তু দেখার ব্যাপারে মগজ বা ব্রেন নামের আমাদের মহার্ঘ অঙ্গটির বিশাল ভূমিকা রয়েছে। তা সে বইয়ের পাতার লেখা হোক বা সুন্দর দৃশ্য, সুন্দর মুখ কিংবা কোনো শিল্প সৌকর্য। যে-কোনো দেখা-ই মগজ নির্ভর। সেরকমই, সৌন্দর্য চেনার ক্ষেত্রেও রয়েছে মগজের প্রত্যক্ষ ভূমিকা। 

দেখার সঙ্গে মগজের সম্পর্ক বুঝতে গেলে, মগজ-এর অসীম ক্ষমতার সঙ্গে একটু পরিচিত হওয়া দরকার। বোধ, মনন,অনুভূতি, চিন্তাশক্তি, মেধা, বুদ্ধি-বিবেচনা, স্মৃতি কিংবা বিশ্লেষণী ক্ষমতা –এইসব ক্রিয়াকলাপের অন্যতম নায়ক হল ব্রেন। মগজের মধ্যে থাকে স্নায়বিক কোষের বিপুল এক নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা। মগজের মধ্যে যে বিপুল সব কর্মকাণ্ড ঘটে, সেই কাজগুলি করে এই বিশেষ স্নায়ুকোষগুলি। শুধু দেখা-র কাজ-ই নয়। অজস্র জটিল কাণ্ডকারখানার সঙ্গে জড়িত ব্রেন। বিস্ময় কিংবা নান্দনিক বোধ বা থ্রি-ডাইমেনশনাল অনুভূতি বা কল্পনাপ্রবণতা -- এসবও নিয়ন্ত্রিত হয় ব্রেনের মাধ্যমে। 


বিপুল তরঙ্গ রে ... 

ব্রেনের যাবতীয় কার্যকলাপ চলে নার্ভকোষের মাধ্যমে। প্রায় এক কোটি নার্ভকোষের জাল বিছিয়ে রাখা আছে আমাদের যাবতীয় মগজিয় কাজের জন্য। এক একটি নার্ভকোষের মধ্যে রয়েছে আবার প্রায় এক হাজার থেকে এক লক্ষ সংযোগ সূত্র। এই সংযোগ সূত্রগুলির মধ্যে দিয়ে তড়িৎ সংবাহন প্রবাহ আদান প্রদান হয় নার্ভকোষের মধ্যে। সে এক দারুণ জটিল সংযোগ ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে প্রত্যেকের মগজ সিস্টেম কাজ করে। এই সব নানান মগজিয় ক্রিয়াকলাপের জন্যেই আমরা দেখতে সমর্থ হই এবং উপভোগ করতে পারি সৌন্দর্য। সৌন্দর্যের সঙ্গে মগজের বিভিন্ন অংশ কিংবা নানান প্রাণরাসায়নিক পদার্থ কীভাবে জড়িত, তা নিয়ে গবেষণা করছেন স্নায়ুবিজ্ঞানীরা। কীভাবে এই জটিল এবং সুসংহত কাজগুলি ঘটে, তা নিয়ে বিজ্ঞানীরা যেটুকু জেনেছেন, সেখানে একটু প্রবেশ করার চেষ্টা করি। 

আমাদের ব্রেনের পেছনের দিকে রয়েছে ‘অক্সিপিট্যাললোব’। চোখ দিয়ে দেখার পর সেখানেই সিগন্যাল যায়, তারপর সেই প্রাথমিক তথ্যগুলি বিশ্লেষণের পরে তা চলে যায় ব্রেনের অন্য অংশে, যেখানে তা আরও উচ্চতর মাত্রায় বিশ্লেষিত হয়। নার্ভ কোষগুলির নিজেদের মধ্যে সংকেত আদান প্রদানের ক্ষেত্রে বিশেষ বিশেষ নিউরো-ট্রান্সমিটার কাজ করে, যেগুলি নার্ভ কোষ থেকে নিঃসৃত হওয়া একধরনের প্রাণরাসায়নিক অণু। সেই রকমই একটি গুরুত্বপূর্ণ নার্ভ-কোষ নিঃসৃত অণু হল ‘ডোপামিন’।গবেষণা থেকে জানা গেছে যে আকর্ষণীয় কোনো কিছু উপভোগ করলে ব্রেনের মধ্যেকার ‘ডোপামিন’ চালিত ‘রিওয়ার্ড-নেটওয়ার্ক’ অংশটি উদ্দীপিত হয়ে ওঠে। সাধারণভাবে এই ‘রিওয়ার্ড-নেটওয়ার্ক’ অংশটি আমাদের সুখ, আনন্দ আর ভালোলাগা বোধের উৎপত্তি স্থল। 

‘অ্যামিগ্ডলা’ নামের একটি অংশকেও চিহ্নিত করেছেন বিজ্ঞানীরা, যেখানে সুন্দর কোনো কিছু দেখে অথবা কোনো ভালোলাগা বোধ হলে, কিংবা ভয়ের কিছু দেখে আতঙ্কিত হলে, ব্রেনের এই অংশটি সক্রিয় হয়ে ওঠে। মগজের নির্দিষ্ট ঠিক কোন জায়গায় সৌন্দর্য বিচার প্রক্রিয়াগুলি হয়, তা নিয়ে সাম্প্রতিককালে একাধিক স্নায়ুবিজ্ঞানী গবেষণা চালাচ্ছেন। বছর পনেরো-ষোলো আগে ‘নিউরোঅ্যাসথেটিকস’ নামে একটি বিশেষ শাখাও গড়ে উঠেছে। 

এ প্রসঙ্গে সব চেয়ে আগে যাঁর নাম বলতে হয়, তিনি হলেন খ্যাতনামা নিউরো-বায়োলজিস্ট সেমির জেকি। ইউনিভার্সিটি কলেজ অফ লন্ডনে ‘ভিজ্যুয়াল-অ্যাসথেটিকস-এরও পর গবেষণা করেন তিনি। ‘আর্টিস্টিক ক্রিয়েটিভিটি অ্যান্ড দা ব্রেন’ শীর্ষক সেমিরের একটি রচনা, যা বিজ্ঞানের নামজাদা পত্রিকা ‘সায়েন্স’ (২০০১)-এর একটি সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে। যেখানে তিনি বলেছেন “অ্যাসথেটিকসের কোনো ব্যাখ্যাই সম্পূর্ণ হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না তা স্নায়বিক দিক থেকে ব্যাখ্যা করা হয়।” 

সুন্দর হে সুন্দর ... 

স্নায়ুবিজ্ঞানীরা কীভাবে পরীক্ষানিরীক্ষা করে মগজের অন্দরমহলের হালহকিকতের খোঁজ পান,সেই সব কথা সহজভাবে একটু বোঝার চেষ্টা করব। ‘নিউরোইমেজিং’ নামের একটি খুব কার্যকরী পরীক্ষার কথা বলি প্রথমে। এই পরীক্ষার মাধ্যমে ব্রেনের ঠিক কোন জায়গা সজাগ ও ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে, তা বুঝতে পারা যায়। বর্তমানে অতি সংবেদী ব্রেন-ইমেজিং টেকনিক, যেমন ‘TMS’এবং ফাংশনাল ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স ইমেজিং (fMRI) ব্যবহার করে আরও ভালোভাবে এই বিষয়গুলি বোঝা সম্ভব। এই সব পরীক্ষার সাহায্যে ব্রেনের রক্ত সঞ্চালন এবং অক্সিজেনেশেনের ছবি পাওয়া যায়। যা থেকে ব্রেনের সংশ্লিষ্ট ক্রিয়াশীল অংশগুলি সম্পর্কে বোঝা যায়। সেই সঙ্গে শিল্পসৌন্দর্যের প্রতিক্রিয়ায় ব্রেনের উদ্দীপিত অংশগুলির মাত্রা নির্ণয় করা যায়। 

পরীক্ষা করে ব্রেনের চারটি অংশকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করেছেন স্নায়ুবিজ্ঞানীরা, যে অংশগুলি সৌন্দর্য অনুভবের ফলে অনেক বেশি উদ্দীপিত এবং ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে। এদের মধ্যে ‘অরবাইটো-ফ্রন্টালকর্টেক্স’ নামের একটি অংশ সৌন্দর্য দেখার ক্ষেত্রে এবং ‘মোটরকর্টেক্স’ অংশ কুৎসিত কোনো কিছু দেখার ক্ষেত্রে সক্রিয় হয়ে ওঠে। 

তবে ‘নিউরো-অ্যাসথেটিকস’ থেকে শিল্প সৌন্দর্য অনুভব সম্পর্কে আমরা সত্যিই কত খানি জানতে পেরেছি? এর উত্তর আমরা পেয়ে যাই ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য স্নায়ুবিজ্ঞানী ভিলায়ান্যুর সুব্রম্যণিয়ম রামচন্দ্রনের কাছে। ভিলায়ান্যুর দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন—‘নিউরো- অ্যাসথেটিকস যে মানুষের সৌন্দর্য অভিজ্ঞতা বোঝার ক্ষেত্রটি সমৃদ্ধ করে তুলতে সক্ষম, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।’ তিনি আরও বলেন– ‘তবে আমরা এ বিষয়ে কেবলমাত্র উপরতলেই আঁচড় কাটতে সক্ষম হয়েছি।শৈল্পিক সৌন্দর্যের যে কেন্দ্রীভূত বিশুদ্ধ অংশ আর সংশ্লিষ্ট সৃজন প্রতিভার যেসব বিষয়, তার কিঞ্চিৎও ছুঁতে পারিনি আমরা।’ 

বিশ্বতনুতে অণুতে অণুতে কাঁপে নৃত্যের ছায়া ... 

বিশ্বপ্রকৃতির দৃশ্যমান জগতের মতনই রয়েছে আরও একটি জগৎ, তা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অদৃশ্য এক জগৎ। প্রকৃতির একদিকে রয়েছে বৃহৎ আর অতি বৃহৎ এর জগৎ (ম্যাক্রো ফিজিক্যাল ওয়ার্ল্ড), অন্য দিকে অণু পরমাণু কণাদের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অদৃশ্য এক অন্যতর জগৎ (মাইক্রো ফিজিক্যাল অয়ার্ল্ড)। সমস্ত কিছুই যে অতীব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণাদিয়ে তৈরি হয়েছে, তা আমরা জানি। বিজ্ঞানীরা আজ জেনেছেন সেই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জগতের মধ্যেও রয়েছে অভাবনীয় রকমের নিয়ম-নীতি পরিমাপ আর সিমেট্রি! আর এই সব কণাগুলির যে কার্যাবলী, সেগুলিও নিয়ন্ত্রিত হয় গাণিতিক নিয়ম নীতি অনুযায়ী, যাকে আমরা বলে থাকি ‘ল’ জঅফনেচার’। এই যে অণুপরমাণু কণাদের অদৃশ্য এবং সূক্ষ্মতম জগৎ সেই সাম্রাজ্যের মধ্যেও কি সৌন্দর্যের প্রকাশ বিদ্যমান? যদি সৌন্দর্য থেকে থাকে, তবে কী ভাবেই বা তার সন্ধান পাওয়া যায়? 

বস্তুত, এই অদৃশ্য জগতের সৌন্দর্য সন্ধানের ক্ষেত্রে আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিশাল এক ভূমিকা রয়েছে। সেই অভিনব সৌন্দর্য উন্মোচনের কথা না জানলে অসম্পূর্ণ থেকে যাবে সৌন্দর্য নিয়ে আমাদের এই আলোচনা। তাই এখন সেই ধরা ছোঁয়ার বাইরের জগৎ সম্পর্কে বুঝতে চেষ্টা করব। 

বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এবং প্রযুক্তির ব্যাপক উন্নতি হওয়ায় মানুষের পক্ষে প্রকৃতির অদৃশ্য জগতের জিনিস আজ দেখা সম্ভব হয়েছে। তবে প্রকৃতির মধ্যেকার অদৃশ্য সৌন্দর্য উন্মোচনের ক্ষেত্রে বিশেষ করে মাইক্রোস্কোপিক টেকনিকের ভূমিকার কথা বলতেই হয়। 

যা ছিল অজানা আর অদেখা, সেই অদৃশ্য জগতের রহস্যময় বৈভব মানুষের কাছে ধরা দিল মাইক্রোস্কোপ বা অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তু, যা খালি চোখে কখনোই দেখা সম্ভব ছিল না, তা আজ দেখতে সক্ষম হয়েছে মানুষ। বিভিন্ন প্রাণ-অণুর কার্যকলাপ সম্বন্ধেও অনেক কিছুই আজ জানা সম্ভব হয়েছে হাই-রেজোলিউশেন মাইক্রোস্কোপি এবং নানান অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে। মাইক্রোস্কোপি টেকনোলজির ইমেজ ক্যাপচার করার ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে আণবিক সিস্টেমের ধারণা পরিষ্কার হয়েছে আজ। চোখের আলোয় যা দেখা সম্ভব ছিল না, সেই অধরা মাধুরীর অতিপ্রাকৃতিক এক অকল্পনীয় সৌন্দর্য জগৎ আজ প্রতীয়মান হয়েছে। 

মানুষের বুদ্ধিমত্তা, উদ্ভাবনীশক্তি, সৃজনশীলতা আর অতি-সংবেদী যান্ত্রিক প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের ব্যবহারের ফলেই সম্ভব হয়েছে এই সন্ধান। অত্যাধুনিক ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপির ব্যবহারে আজ অণু, এমনকি পরমাণুর ছবির আন্দাজ পর্যন্ত পাওয়া সম্ভব হয়েছে। এসেছে নবতম অ্যাটমিকফোর্স মাইক্রোস্কোপ, ট্রান্সমিশন মাইক্রোস্কোপ বা স্ক্যানিং ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপ। এইভাবেই এক নতুন দিগন্ত খুলে গেছে আজ। অণু, পরমাণু, কোষ, ইত্যাদির গঠন বিন্যাস ছাড়াও, তাদের সমন্বয়,সংযোগ, সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণ আর সূক্ষ্ম রাসায়নিক যে রকমফের, এমন নানান গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আজ বুঝতে পারা সম্ভব হয়েছে। বিভিন্ন অণুর অত্যাশ্চর্য যেসব ক্রিয়াকুশলতা আর মুনশিয়ানা আছে, সেসবের অনেক কিছুই আজ জানা সম্ভব হয়েছে। আণবিক নির্মাণ, অণুদের পারস্পরিক সংযোগ, নির্দেশ ব্যবস্থা কিংবা সমন্বয়ের নিখুঁত নিয়ন্ত্রিত প্রক্রিয়ার কথা জেনে মানুষ বিস্মিত হয়েছে বারে বারে। এই পথ ধরেই ছোটোর মধ্যে বিপুল এক সাম্রাজ্যের জ্ঞান অর্জনে সমর্থ হয়েছে মানুষ। 

নৃত্যের বশে সুন্দর হল বিদ্রোহী পরমাণু ... 

এই অভিজ্ঞান অর্জন থেকে মানুষ একদিকে যেমন জীবন ও প্রকৃতির নানান দুর্জ্ঞেয় রহস্যের উত্তর জানতে পেরেছে, তেমনই অন্যতর এক সৌন্দর্য অভিজ্ঞতার সাক্ষী হওয়ায় সক্ষম হয়েছে। এইভাবে সৌসাম্য, সুস্থিতি, শৃঙ্খলা ও দারুণ জটিল নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থার মাইক্রো-ইমেজের বিপুল জগতজন্ম দিয়েছে নতুনতর এক সৌন্দর্য মাত্রার। সূচিত হয়েছে সৌন্দর্যের সর্বাধুনিক সংজ্ঞা। খুলে গেছে সৌন্দর্যের নতুন এক বিদ্যাচর্চা, যা Molecular Aesthetics বা আণবিক সৌন্দর্য নামে পরিচিত। এ এক নতুন প্যারাডাইম। 

গাছ, প্রাণী কিংবা মানুষের মতন একটি অণুও যে এই বিশ্ব প্রকৃতির অংশ, তা এখন আমরা বুঝেছি। আর অণুর অন্দরমহলের মধ্যে থাকা যে পরম সৌন্দর্য, তারই অনুসন্ধান করে চলেছেন একাধিক খ্যাতনামা বিজ্ঞানী। তাঁদেরই একজন কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের নোবেলজয়ী রোয়াল্ড হফম্যান। রসায়নশাস্ত্রে তাঁর মৌলিক গবেষণার জন্য তাঁর নাম বিশ্ববন্দিত। কবি, নাট্যকার এবং প্রাবন্ধিক হিসেবেও সমাদৃত এই বিজ্ঞানী। রসায়নশাস্ত্রের মধ্যে ‘সৌন্দর্য’ খুঁজে  পানহফম্যান। তিনি বিশ্বাস করেন, সৌন্দর্য ধরা দেয় আসলে জটিল অণুর অন্তর্নিহিত ইলেকট্রন অরবাইটেলদের সিমেট্রি ও অ্যাসিমেট্রির জন্যে। দ্রষ্টাসাপেক্ষ সৌন্দর্যের কথা বিশ্বাস করেন তা বোঝা যায় যখন তিনি বলেন --“সরলতা কিংবা জটিলতা, এসবের মধ্যে সৌন্দর্যের অবস্থান নয়। সৌন্দর্যকে প্রস্ফুটিত করা হয়ে থাকে। হতে পারে তা কোনও অণু কিংবা কোনও সংগীত, হতে পারে কোনও সেরামিকের ফুলদানী –যার মধ্যে সৃষ্টি করা হয়েছে সৌন্দর্য।এইসব সৃষ্টির পেছনে থাকে চিন্তা আর মনন। সৌন্দর্যের সন্ধান সেখানেই মেলে, যেখানে রয়েছে অসমঞ্জস সরলতা, জটিলতা, স্থিরতা বা অস্থিরতার প্রসারিত কিনারা।” 

প্রতিটি অণুরই রয়েছে নিজস্ব গঠন এবং তারা কেউ স্থির নয়, সব সময়ই আন্দোলিত হয়ে চলেছে। তাই বলতে হয় , যে-কোনো অণুর গঠন আসলে সেই অণুর অন্তর্গত পরমাণুগুলির গড় অবস্থানের ওপর নির্ভর করে। অণুগুলির জ্যামিতিক সজ্জা কখনও খুব সরল, কখনোবা সেই বিন্যাস অসম্ভব রকমের জটিলতায় ভরা। আণবিক সৌন্দর্য নিয়ে অসাধারণ কয়েটি রচনা আছে রোয়াল্ড হফম্যানের। একজন রসায়নবিদ হিসেবে বিশেষ বিশেষ কিছু অণু তাঁর চোখে কেন সুন্দর হয়ে ওঠে তা নিয়ে হফম্যান লিখেছেন। তিনি বলেন - “অণুগুলিকীকরেএতোঅপরূপসুন্দরহয়েওঠে? হয়তো তার পেছনে রয়েছে তাদের সহজ সরল গঠনের সমমিতি। অথবা এর পেছনে রয়েছে তাদের জটিলতা এবং গঠনের মধ্যেকার বিপুল সম্পদ বৈভব! যে সম্পদের গুণে অসাধারণ কার্যকরী হয়ে ওঠে অণুগুলি। একটি অণুর মধ্যেকার যে সৌন্দর্য, তা কখনও কখনও তার ভাঁজে ভাঁজে লুকনো অবস্থায় থাকতে পারে, যা প্রকাশিত হয়ে ওঠে সঠিক সময়ে আর সঠিক অবস্থানে পৌঁছে। সব মিলিয়ে তাদের নভেলিটি আর আশ্চর্যময় ক্ষমতা, নিপুণ কার্যকারিতা আর প্রয়োজনীয়তার যে ভূমিকা --তার জন্যেই নান্দনিক হয়ে ওঠে অণুগুলি।” 

সেই রকমই, ডিএনএ অণুর ডাবল-হেলিক্স গঠনের মধ্যেকার দারুণ সরল আর এলিগেন্ট রূপ যখন আবিষ্কারকের কাছে ধরা দিল, সেই মুহূর্তের সেই মুগ্ধতা অর্জন ব্যাখ্যা করা হয়তো কঠিন। তবু ডিএনএ অণুর গঠনের রূপ এবং একই সঙ্গে ডিএনএ অণুর প্রতিলিপি তৈরি করতে পারার অভাবনীয় কর্মকুশলতার কথা আন্দাজ করে এর অন্যতম আবিষ্কর্তা ফ্রান্সিস ক্রিক আনন্দে অভিভূত হয়ে বলে উঠেছিলেন ‘দা মলিক্যুল হুইচ হ্যাজ স্টাইল’। এই যে তিনি অণুর স্টাইলের কথা বললেন, তা তো আসলে সৌন্দর্যেরই এক ব্যাখ্যা! 

মধুর তোমার শেষ যে না পাই ... 

তবে একজন রসায়ন বিজ্ঞানীর অনুভবে অণু পরমাণুর যে সৌন্দর্য অথবা একজন সেল-বায়োলজিস্টের কাছে কোষের অন্দরমহলের যে সৌন্দর্য, সাধারণ মানুষ হিসেবে তা যে আমাদের কখনোই মুগ্ধ করতে পারবে না, তা বলা বাহুল্য। আবার এটাও সত্যি যে, সবার কাছে সব কিছু একই রকম উপভোগ্য হয়ে উঠবে এমনটাও সব সময় ভেবে নেওয়া যায় না। যেরকম, অনেক ক্ষেত্রে, কোনো সৌন্দর্য যা আমাদের আকৃষ্ট করে, অথচ আমাদের চারপাশে এমন মানুষ আছেন যাঁদের কাছে তা কোনো আবেদন-ই ফেলতে পারে না। সবার ক্ষেত্রে সৌন্দর্যের আবেদন কেন একই হয় না, মগজ বিজ্ঞানীরা হয়তো এর উত্তর দিতে পারবেন। 

বহু মানুষ যে সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয় অথচ যে কোনো কারণেই হোক, যারা সেইসব সৌন্দর্য বোধে আকৃষ্ট হতে পারে না, সেইসব দুর্ভাগাদের অনুভব শক্তি বাড়ানোর কোনও পথ সম্ভবত আর খোলা থাকে না। স্বনামধন্য শিল্পী অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথাতে সেই কথারই প্রতিফলন শুনতে পাই “যার চোখ সুন্দরকে দেখতে পেলে না আজন্ম তাঁর চোখে জ্ঞানাঞ্জন শলাকা ঘষে ক্ষইয়ে ফেললেও ফল পাওয়া যায় না, আবার সুন্দরকে দেখতে পেলে সে অতি সহজেই দেখে নিতে পারলে সুন্দরকে, কোনও গুরুর উপদেশ পরামর্শ এবং ডাক্তারি দরকার হল না তাঁর, বিনা অঞ্জনেই সে নয়নরঞ্জনকে চিনে গেলো।” 

দ্রষ্টা তাঁর মনের মাধুরী মিশিয়ে ‘সুন্দর’কেসুন্দরকরেতোলেন, নাকিযা সুন্দর তা সত্য এবং চিরকালীন, দ্রষ্টার উপর তা নির্ভরশীল নয়? সৌন্দর্য নিয়ে অনেক উত্তরহীন প্রশ্নের মতন এইসব পুরনো বিতর্ক জারি থাকবে,যতদিন পর্যন্ত না দার্শনিক ও মগজ-বিজ্ঞানীরা সৌন্দর্য আসলে ঠিক কী, তার নির্দিষ্ট কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারবেন।তাঁদের সেই সৌন্দর্য সন্ধানের যাত্রাপথের দিকে মানুষ তাকিয়ে থাকবে। 

তথ্যসূত্র 

S.Zeki, Artistic Creativity and the Brain, Science 6 July 2001:Vol. 293 no. 5527 pp. 51-52 

S. Zeki, Inner Vision: An Exploration of Art and the Brain (Oxford Univ. Press, Oxford, 1999). 

Chelsea Wald, Neuroscience: The aesthetic brain, Nature, Vol. 526, 8 October 2015, 82-83 

Michelle Francl, Zen and the art of molecules, Nature Chemistry, Vol. 4, March 2012, 142-144 

LelioOrci& Michael S.Pepper,Nature Reviews Molecular Cell Biology 3, 133-137 (February 2002) 

Roald Hoffmann, Molecular Beauty , American Scientist, Vol.76, July-August 1988, 389-391 

Hoffmann,R.,J.Aesthet.Art Critic.48,191-204 (1990) 

Steven Brown and Xiaoging Gao,The Neuroscience of Beauty:How does the brain appreciate art? , September 27 (2011), Scientific American, [ http://www.scientificamerican.com/article/the-neuroscience-of-beauty/] 

Gideon Engler, British Journal of Aesthetics, Vol. 30, No 1, January 1990, AESTHETICS in Science and in Art 

Robert Root-Bernstein, Sensual Chemistry: Aesthetics as a Motivation for Research, International Journal for Philosophy of Chemistry