ধারাবাহিক - সুবল দত্ত



ধারাবাহিক

প্রতিস্রোত
সুবল দত্ত


।।২৭।।

দিগন্তে ভাঙ্গে দুঃসহ দিন সন্ধ্যা নামে খলচক্র ছিঁড়ে যায় হিংসার এবার পালা শেষ 


সৌমজিত
গভীর জঙ্গলে রাতজাগুনি পতঙ্গের হাজার কনসার্ট নিস্তব্ধতা বাড়িয়ে দেয়। সেই চেপে বসা অস্থিরতা ছাপিয়ে সেরগেই এর গম্ভীর কথন সৌমজিতকে চিরে ফালা ফালা করতে থাকে। সৌমজিত চারদিকে চোখ বুলিয়ে নেয়। পাথরের মত অনড় সেনা ও সামনে বসা প্যানেল জজ। সবকিছু যেন প্রাণহীন শিল্যুয়েট কিন্ত হাজার চোখ তীরের মত বিঁধছে সৌমজিতকে। 
সেরগেই এর রাশিয়ান ভাষায় কথা বলা শুরু হওয়া মাত্র পাশে বসা দোভাষী উঠে দাঁড়িয়ে হিন্দিতে তর্জমা শুরু করে দিলেন। সেরগেই অনেক উদাহরণ দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করছিল যে ভারত নামের এই পেনিনজুলা একটি বিশল্যকরনী ভূখন্ড। আর এই বনজ অঞ্চলে তো সমস্ত মারন রোগের ঔষধি ছড়িয়ে রয়েছে। এযে কত বড়ো অমূল্য মানবিক সম্পদ তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। সংযুক্ত সোভিয়েত রাশিয়ার ইউক্রেনে কুষ্ঠরোগগ্রস্ত জনসংখ্যা এত বেশি ছিল যে একসময় রাশিয়ান সরকার এখানের ভেষজ থেকে ওষুধ তৈরি করার প্রোজেক্টের জন্য ভারত সরকারের কাছে প্রস্তাব রেখেছিল। কিন্ত কোনো রাজনৈতিক কারণে তা হয়নি। পৃথিবী জুড়ে এখন মানুষ জটিল অসুখে পীড়িত। উন্নতশীল দেশগুলো এখন ভেষজ ওষুধে অতি আগ্রহী। কারণ তাতে তাদের নিরাময় হচ্ছে। এখানে এসে আমি চরম সর্বনাশ দেখছি। আমাদের সাথে একজন বিশ্বের সেরা উদ্ভিদ বিজ্ঞানী এসেছেন। তিনি সার্ভে করে দেখলেন এখানে প্রকৃতির কোলে অতি দুষ্প্রাপ্য ঔষধি প্রচুর পরিমাণে আছে যাতে বহু মানুষ সুস্থ হতে পারে। কিন্তু কয়েকদিন ধরে একজন মানুষ তার ক্ষমতার অপব্যবহার করে ইন্ডিয়ান আর্মিকে দিয়ে ওই অমূল্য ভেষজের উপর এক মারাত্মক ধ্বংসলীলা চালিয়েছেন। আমাদের দেশে এই ধরনের জাতীয় সম্পদ কেউ তছনছ করলে সঙ্গে সঙ্গে তার ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট বা সাইবেরিয়ায় নির্বাসন হোত। আমাদের দেশে এই পরিস্থিতিতে খনিজ নিস্কাসন করতে হলে আন্ডার গ্রাউন্ড করা হোত। তাও আবার সরকারী তরফ থেকে। 
সেরগেই একটু থেমে আবার বলতে লাগল। কালো ও জংলি মানুষের প্রতি ঘৃণা ও শোষণ পৃথিবীর সব দেশেই প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে। কিন্ত এই এপার্থেড মানে বর্ণবৈষম্য সামুহিক ভাবে ভূভাগ দেশ বা প্রদেশের মানব গোষ্ঠীতে দেখা যায়। এখন তো কোনো দেশেই এই ধরনের আচরন সাধারণত দেখা যায় না। ভারতের মানুষের মধ্যে তো নেইই। কেননা দক্ষিণ ভারতের বেশির ভাগ মানুষেরা কৃষ্ণ বর্ণের। কিন্ত এইখানে এসে দেখলাম কালো জনজাতির উপর কয়েকজন মানুষের প্রবল ঘৃণা যেন ফেটে বেরোচ্ছে। ওদের উচ্ছেদ বা হত্যা না করলে যেন শান্তি নেই। অবশ্য ওদের শোষণ ও উচ্ছেদ তাদের ব্যক্তিগত লাভের একটা হেতু নিশ্চয়ই। আমাদের দেশে এই ধরনের বুর্জোয়া মানসিকতার শাস্তি দৃষ্টান্তমূলক । আর এখানে যে ধরনের ষড়যন্ত্র করে নাশকতার কর্ম হয়েছে তার শাস্তি তো মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত । শেষে এই কথা বলছি, আমাদের যৌথ সৈন্য মহড়াতে বলা হয়েছে যে যুদ্ধ অনুশীলনের সাথে কিছু উগ্রবাদীকে চিরুনি তল্লাশি করে বন্দি করা বা মেরে ফেলা। কিন্ত এখানে সম্পূর্ণ জনজাতিদের ঘরবাড়ি সমেত উচ্ছেদ করা বা মেরে ফেলা হয়েছে। এটা এক ধরনের জেনোসাইড বা গণ হত্যা। একটা পুরো বসতি কখনো উগ্রবাদী হতে পারে না। যদি হয় তো তাকে বিপ্লব বলা হয়। যদি তাই হতো তখন সেনাবাহিনীর ভূমিকা অন্যরকমের হতো। এই কাজ একটা লোভী হিংসক মানসিক রুগীর কাজ। এর শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। আমার তো তাই মনে হয়। আর হ্যাঁ। আমাদের গুপ্তচর ও স্নাইপার টিম রুটিন মাফিক চিরুনি তল্লাশি করে দেখেছে বস্তির কোথাও আর্মস এম্যুনিশেন লুকিয়ে রাখা ছিলো না। 
সেরগেই থামতে চারদিক নিঃশব্দতা চেপে বসল। সৌমজিত তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লেফটেন্যান্ট জেনারেল ইকবালকে দেখে আবার বিষন্ন হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। অবিশ্বাস্য রকমের বিশ্বাস ঘাতকতা জীবনে এই প্রথম দেখল সে। হয়তো বা এটাই শেষ। ঘটনাটা এমন ঘটতে পারে তার কোনো আভাসই পায়নি। আর ইকবাল যে এমনভাবে নিজেদের সাঁজোয়া গাড়ি ও ট্যাংক ক্ষতিগ্রস্ত করে প্রমাণ করতে চাইবে যে এটা উগ্রবাদীর কাজ এটাও সৌমজিত জানতো না। হ্যাঁ এরকম ছোটোখাটো ক্ষতির ব্যাপারে সে অনুমতি দিয়েছে ঠিক কিন্তু এমন নির্বুদ্ধিতা! নাকি ইচ্ছাকৃত? এই ইকবালের জন্যে সে কি না করেছে। কাশ্মীরের একটা বেশ বড়সড় বস্তি এমনি ভাবেই উচ্ছেদ করে ওই ইকবালের নিজের লোককে বসিয়েছে। সেই ইকবাল কিভাবে ওকে ফাঁসিয়ে দিল? কোনোদিন হারেনি সে। আজ একটা সামান্য ভুলে জীবনের সবকিছুতে পূর্ণচ্ছেদ আসতে চলেছে। 
সৌমজিত কোনোমতেই মানতে পারছে না এই হার। ছেলেবেলা থেকে কতো যে হিংসক কর্ম করেছে তার কোনোটাতে ধরা পড়েনি। কোনো না কোনো ভাবে বেরিয়ে আসতো। কোলকাতার এক শহরতলির স্কুলে পড়ার সময়ে স্কুলের বাইরে একটা ভিখারী ছেলের ইনিয়েবিনিয়ে ভিক্ষে চাওয়া তার এতো অসহ্য হয়ে গেছিল যে একদিন নির্জন দুপুরে তাকে গলা টিপে মেরে ফেলেছিল। তার ওপর সন্দেহ তো অবশ্যই হয়েছিল কিন্ত কোনো প্রমাণ ছিল না। পরে সেই স্কুল থেকে বেরিয়ে এক মিলিটারি স্কুলে ভর্তি হয়ে এন ডি এ তে পড়তে যায়। 
সেরগেই এর বক্তৃতার সময় সৌমজিত এইসব চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়েছিল। প্যানেল জজের ডাকে চমক ভাঙ্গলো। - মিঃ মেজর জেনারেল। আপনি জেগে আছেন তো? আপনি সাড়া দিচ্ছেন না কেন? আপনি তো শুনলেন যুদ্ধ মহড়ার আপনার সহযোগী রাশিয়ান মেজর জেনারেল সারগেই এর কথা। এবার বলুন এই অঞ্চল জুড়ে সমস্ত অধিবাসীদের আপনি ও আপনার সেনারা কি করলেন যে ওরা এখান থেকে বেমালুম উধাও হয়ে গেল? আর ওদের বসতি গোলা বারুদ দিয়ে ধ্বংস করে দিলেন কেন? 
সৌমজিত উদ্ধত ভঙ্গিতে উঁচু গলায় বলল, - আমি আবার বলছি আমি যা করেছি তা সেন্ট্রাল ডিফেন্স এর পারমিশন নিয়ে করেছি। অবশ্য আমি কোনও রকমের মৌখিক বা লিখিত এমন কোনো অনুমতি আমার সেনাধক্ষ্যদের দিইনি যাতে বস্তির সব মানুষের প্রাণনাশ হয়। আমি অর্ডার দিয়েছিলাম যারা উগ্রবাদী তাদের স্যুট এট সাইটে। এটা আমার কাছে রেকর্ড আছে। এই কাজ যদি নিজে থেকে আমার সহকর্মী লেফটেন্যান্ট জেনারেল ইকবাল সেনাদের অর্ডার দিয়ে থাকেন তো আমি কি করতে পারি। 
ইকবাল সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, স্যার ওনার সাথে আমার এই ব্যাপারে ফোনে যা কথা হয়েছে তা আমি রেকর্ড করে রেখেছি। এই সবুত আমি পেশ করতে চাই। 
সৌমজিতের সারা শরীর আবার ঝিম মেরে গেল। তার মানে এরা আটঘাট বেঁধে অনেক আগেই কাজে নেমেছে। কিন্ত আমি তো সহজে হার মানবো না!

No comments:

Post a Comment