ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত



ধারাবাহিক


গার্ড (অনুবাদ গল্প) 
নন্দিনী সেনগুপ্ত 



৪ 

হঠাৎ একটা কণ্ঠস্বর এসে ছিঁড়ে দিয়ে গেল সেই নিঝুম নৈঃশব্দকে। এতখানি উচ্চকিত সেই কর্কশ তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর যে ঠীলের দ্রুতপদের চলন আপনা থেকে ধীর হয়ে গেলো। তার কানে এসে আওয়াজটা আছড়ে পড়তে লাগলো তীব্রভাবে। সে বুঝতে পারলো যে একটা কুটিরের ছাতের খোলা জানালা দিয়ে আওয়াজটা আসছে। কুটিরটা কার সেটা সে জানে। একটু বেশি জানে। 

পাছে নিজের পদশব্দে পরিষ্কারভাবে সেই আওয়াজ শুনতে না পায়, তাই ঠীল একদম পা টিপে টিপে চলতে লাগলো। আস্তে আস্তে এগিয়ে গিয়ে সে কান পাতলো, ঠাহর করবার চেষ্টা করতে লাগলো যে লেনা ঠিক কি বলছে চীৎকার করে... 

-‘ওরে শয়তান, বদমাশ, বজ্জাত! খিদের পোকা আবার কুরকুর করে উঠেছে, তাই না? দাঁড়া, আজ তোকে এয়সান শিক্ষা দেবো, জীবনে যাতে না ভুলিস, সেই ব্যবস্থা করবো।’ এর পরে কিছুক্ষণ চুপচাপ। তারপর ধোপা কাপড় কাচার সময় যেভাবে কাপড় আছড়ে কাচে, সেরকম আওয়াজ পাওয়া গেলো। তারপরে আবার গালিগালাজের বন্যা বইতে লাগলো। 

‘হতভাগা কোথাকার! তোর ঘ্যানঘ্যানানির জন্য কি আমার পেটের ছেলেটা উপোষ করে মরবে?’... হাল্কা একটা কান্না-কান্না গলার বিপরীতে আবার গর্জে উঠল চীৎকারটা... ‘চোপ, একদম চুপ। নয়তো আট দিনের খোরাক একবারে একসঙ্গে গিলে বসে থাক তুই!’ 

কান্নার মিহি হাল্কা আওয়াজটা থামছিল না। 

ঠীলের হঠাৎ মনে হলো যে তার হৃদপিণ্ডটা বড্ড ভারি ঠেকছে। কেমন যেন উল্টোপাল্টা ধপাধপ আওয়াজ হচ্ছে তার বুকের ভেতরে। সে কাঁপতে শুরু করল। তার অন্যমনস্ক দৃষ্টি মাটির দিকে স্থিরভাবে কি যেন দেখছিল, কিংবা কিছুই দেখছিল না। শক্ত পেশল হাত দিয়ে সে বারেবারে নিজের মেচেতার দাগওয়ালা কপালের উপর থেকে ভিজে চুলের গুচ্ছটা সরিয়ে দিচ্ছিল। 

সে যেন সহ্য করতে পারছিল না এই পরিস্থিতিটা। তার শরীরের মাংসপেশী ফুলে উঠলো, আঙুলগুলো শক্ত হয়ে মুষ্টিবদ্ধ হয়ে উঠল তার হাত; কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যই। আবার যেন এক অক্ষম গ্লানি, অদ্ভুত ক্লান্তি নেমে এলো ঠীলের শরীরে। 

ধীরে ধীরে সে সংকীর্ণ, ইট পেতে রাখা প্রবেশদ্বার দিয়ে নিজের কুটিরে ঢুকলো। ক্লান্ত, ভারি পদক্ষেপে সে উঠতে লাগলো উপরে; কাঠের সিঁড়িটায় হাল্কা ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ হলো। 

‘উফফ, উফফ, উফফ’... আবার শুরু হলো চীৎকারটা, একসাথে তিনটে শব্দের মধ্যে যেন পৃথিবীর পুঞ্জীভূত রাগ, ক্ষোভ বেরিয়ে এলো; ‘হাড়হাভাতে, দুষ্টু, ধূর্ত, কুচুটে, ভীতুর ডিম, অসভ্য ছেলে’... প্রত্যেকটা শব্দের মধ্যে দিয়ে গলার জোর ক্রমশ সপ্তমে চড়ছিল। কণ্ঠস্বরটা এক দুই মুহূর্তের জন্য হাঁপাতে লাগলো, তারপর আবার নতুন উদ্যমে শুরু হলো, ‘কী-ঈ-ঈ, তুই আমার ছেলেটাকে মারতে চাস? এত সাহস তোর? এই দুর্বল, অসহায় শিশুর উপরে হাত তুলতে যাচ্ছিস তুই? নীচ কোথাকার! বেশি কিছু বলতে চাই না তোকে আমি... নইলে দেখতিস---’ 

ঠিক সেই মুহূর্তে ঠীল নিজের বাড়ির বসবার ঘরের দরজা ঠেলে ঢুকল, আর লেনার বাক্যটা অসমাপ্ত রয়ে গেল। ঠীল লক্ষ্য করল যে লেনার মুখ প্রচণ্ড রাগে একদম সাদা হয়ে গেছে, কী এক তীব্র ঘৃণায় যেন বেঁকে উঠেছে তার ঠোঁটদুটো! উদ্যত ডানহাত নামিয়ে নিয়ে লেনা দুধের পাত্রের কাছে গিয়ে শিশুর দুধের বোতল ভরতে লাগলো। যদিও বেশির ভাগ দুধ বোতলের বাইরে উপচে টেবিলে পড়ে গেলো, তবুও সে ভরতে লাগলো। দৃশ্যতঃ ভীষণ অপ্রস্তুত লেনা নতুন করে রান্নাঘরের এটা ওটা কাজ টেনে টেনে করতে শুরু করল। সে ভেবে পাচ্ছিল না যে এরকম অসময়ে ঠীল হঠাৎ ঘরে ফিরে এলো কেন? সে কি তাহলে ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে আড়ি পাতছিল? নাহ... অসম্ভব। আর পাতলে পাতবে। কী এমন অপরাধ করেছে সে? ছেলে মানুষ করতে গেলে অমন করতে হয়। শক্ত হতে হয়। নাহ, সে তার নিজের বিবেকের কাছে পরিষ্কার। লেনা নিজের মনে গজগজ করতে লাগলো। 

ঠীলের কানে লেনার কোনও কথাই ঢুকছিলনা। সে একদৃষ্টে ক্রন্দনরত টোবিয়াসকে দেখছিল। তার ভিতরে ভয়ঙ্কর এক ক্রোধ পাক খেয়ে উঠছিল; সে অতিকষ্টে সেটা চেপে রাখার চেষ্টা করছিল। সেটা চাপতে গিয়ে সে কেশে উঠছিল; পুরনো একটা শ্লেষ্মার দমক উঠে আসছিল তার নাকমুখ দিয়ে, তার চোখে এক অদ্ভুত চোরা চাহনি ঝলকানি দিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ একমুহূর্তের জন্য তার চোখ আটকে গেলো লেনার দিকে। সে দেখতে পেল তার বিশাল বাহু, যা এখনো শান্ত হয়নি। সে দেখতে পেল তার বিশাল অর্ধ-উন্মুক্ত স্তনযুগল নিঃশ্বাসের তালে তালে উঠছে পড়ছে, যেন বক্ষাবরণী ফেটে বেরিয়ে আসবে এখনি। সে দেখতে পেল তার বিশাল ঘেরের স্কার্ট দুলে উঠছে, আরও বিশাল দেখাচ্ছে তার চওড়া নিতম্ব। তার মনে হলো যেন এই নারীর শরীর থেকে অদ্ভুত এক শক্তি নির্গত হচ্ছে, সেটা এতখানি সাঙ্ঘাতিক যে সে এর মুখোমুখি দাঁড়াতে সম্পূর্ণ অক্ষম; ঠীলের নিজেকে ভীষণ অসহায়, ক্ষুদ্র বলে মনে হলো। 
তার মনে হলো এক উর্ণনাভ তাকে ঘিরে জাল বুনে চলেছে, সেটা সূক্ষ্ম অথচ লোহার মতো শক্ত; সে কেটে বেরিয়ে আসতে পারছে না। সেটা সুন্দর, কিন্তু সে বন্দী তার মাঝে; এক অদ্ভুত নেশা যেন তাকে অবশ করে রেখেছে। সে কোনও কথাই বলতে পারছিল না। 

অশ্রুসিক্ত চোখে এক কোণে দাঁড়িয়ে ভীতসন্ত্রস্ত টোবিয়াস লক্ষ্য করল যে তার বাবা দ্বিতীয়বার আর তার দিকে ফিরে তাকাল না। চুল্লির উপরের তাকের এককোণ থেকে ভুলে ফেলে যাওয়া খাবারের থলেটা নেবার আগে সেটা তুলে ধরে একবার লেনার দৃষ্টি আকর্ষণ করল ঠীল। হয়তো বা জবাবদিহি করলো তার হঠাৎ ফিরে আসার ব্যাপারটা নিয়ে। তারপর এলোমেলোভাবে একটা সংক্ষিপ্ত মাথাঝাঁকুনি দিয়ে ঠীল বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। 

ঠীলকে মাঝপথে একবার ফিরে যেতে হয়েছিল, তা সত্ত্বেও সে নির্দিষ্ট সময়ের পনেরো মিনিট পরেই পৌঁছে গেলো তার গন্তব্যে, তার কাজের জায়গায়। শান্ত অরণ্যের মধ্য দিয়ে ভীষণ দ্রুতগতিতে সে হেঁটে গিয়েছিল। আগের যে লোকটি ডিউটিতে ছিল, তার কাজের সময় ফুরিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও সে চলে যায়নি। অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিল যে, ঠীল এলে - তবে সে যাবে। যাবার জন্য একদম তৈরি হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল সে আউটপোস্টের কেবিনের বারান্দায়। সাদারঙ করা ঘরটার দেওয়ালে কালো দিয়ে লেখা নম্বরটা দূর থেকে পাইনের জঙ্গলের ফাঁক দিয়েও বেশ ভালো দেখা যাচ্ছিল। 

দুজনে করমর্দন করল এবং পরস্পরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলো বিপরীত দিকে। একজন ঢুকে গেলো আউটপোস্টের কুটিরের ভিতরে এবং আরেকজন, ঠীল যেদিক থেকে এলো, তার উল্টোদিকে হাঁটতে শুরু করল রেলের ট্র্যাক বরাবর। ঠীলের সেই কাশির আওয়াজটা একবার শোনা গেলো, তারপর সেটা থেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জঙ্গলের ভিতরে মানুষের সাড়াশব্দ একেবারে থেমে গেলো। ঠীল অপরিসর চৌকোনা কেবিনের মধ্যে সেই রাতের ডিউটির প্রস্তুতি শুরু করলো। সে যান্ত্রিকভাবে কাজগুলো করে যাচ্ছিল, কারণ তার মনে বারে বারে উঁকি দিচ্ছিল সেদিনকার ঘটনাটা। সে তার রাতের খাবারটা জানালার লাগোয়া টেবিলে রেখে দিল। জানালা দিয়ে রেলের ট্র্যাক পরিষ্কার দেখা যায়। তারপর সে তার মরচে-পড়া ছোট্ট স্টোভটা ধরিয়ে এক পাত্র জল চড়িয়ে দিল। তারপর গুছিয়ে রাখতে লাগলো তার যন্ত্রপাতি, শাবল, কোদাল, বেলচা ইত্যাদি সবকিছু। লণ্ঠনটা ভালোভাবে পরিষ্কার করে তেল ভরে নিল তাতে। 

যখন সে এসব কাজ সারছিল, তখন কর্কশভাবে তিনবার বেল বেজে উঠল এবং জানা গেলো যে ব্রেসলাউগামী ট্রেন এই আউটপোস্টের নিকটবর্তী স্টেশনে পৌঁছে গেছে। কোনোরকম তাড়াহুড়ো না দেখিয়ে ঠীল কেবিনের ভিতর থেকে গুছিয়ে নিলো গার্ডের কাঁধের ব্যাগ এবং নিশান। ধীরেসুস্থে কেবিন থেকে বেরিয়ে বালির উপরে পায়ে চলা পথ দিয়ে কুড়ি পা হেঁটে সে পৌঁছে গেলো রেলগেটের কাছে। প্রতিবার ট্রেন যাবার সময় নিয়মমাফিক ঠীল রেলের গেট বন্ধ রাখে এবং ট্রেন চলে গেলে খুলে দেয়। যদিও সেই ক্রসিংএর পথ দিয়ে কেউ যাতায়াত করতো না, তবুও সে কোনওদিন নিয়ম ভাঙেনি। গেট বন্ধ করে সে গেটের সাদা কালো ডোরাওয়ালা বারের উপরে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। 

তার ডাইনে বাঁয়ে দুদিকেই রেলপথ হারিয়ে গিয়েছে অরণ্যের গভীরে। ট্র্যাকের পাটাতনগুলোর মাঝে মাঝে বিছানো আছে লালচে রঙের নুড়িপাথর। অনেক দূর থেকে দেখলে মনে হবে রেলওয়ে ট্র্যাকের সমান্তরাল চলে যাওয়া লাইনগুলো যেন লোহার জালের মতো ঘিরে রয়েছে। দিগন্তের কাছে গিয়ে সরু হয়ে যাচ্ছে সেই জালের প্রান্ত। 

ধীরে ধীরে একটা হাওয়া উঠল; জঙ্গলের অন্য প্রান্তে পৌঁছে গেলো সেই বাতাসের তরঙ্গ। ট্র্যাকের সঙ্গে একসাথে এগিয়ে চলা টেলিগ্রাফের লাইন থেকে যেন একটা হাল্কা গুঞ্জন উঠল। টেলিগ্রাফের খুঁটিগুলোকে অতিকায় মাকড়সার মতো দেখাচ্ছিল; মনে হচ্ছিল তারা একটা পোস্ট থেকে আরেকটা পোস্টে ক্রমান্বয়ে জাল বুনে রেখেছে। অজস্র পাখির ঝাঁক ঝুলছিল, দোল খাচ্ছিল টেলিগ্রাফের তারে। একটা কাঠঠোকরা অন্য কোনও দিকে না তাকিয়ে যেন হাহা করে হাসতে হাসতে উড়ে গেলো ঠীলের মাথার উপর দিয়ে। 

(চলবে) 

[গেরহার্ট হাউপ্টমান রচিত ‘বানভ্যার্টার ঠীল’ গল্প অবলম্বনে রচিত] 

No comments:

Post a Comment