স্মৃতির সরণী - বিপুল দাস



স্মৃতির সরণী


কথামালা
বিপুল দাস



একটি শহরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য গড়ে উঠতে অনেক সময় দরকার। ভৌগোলিক ভাবে যেমন কোনও ক্ষেত্রের উর্বরতা রাতারাতি বৃদ্ধি পায় না, সময় পলি বহন করে আনে। সঞ্চিত হতে থাকে অনুর্বর সেই জমির ওপর। তারপর কর্ষণ, বীজবপন, সারপ্রয়োগ, নিড়ানির পর ফসল ফলে, ঠিক তেমনই কোনও জনপদের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার রাতারাতি তৈরি হয় না। তার জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে হয়। কিছু শর্ত থাকে। প্রাচীন শহরগুলোতে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বহমানতা থাকে। ক্ষেত্র প্রস্তুতই থাকে, শুধু বীজ বপনের অপেক্ষা। একটি জনপদের সমস্ত মানুষের মানসিক শিক্ষার স্তরকে উন্নীত করে তোলা একজন মানুষ বা একটি প্রতিষ্ঠানের সাধ্য নয়। বিশেষ করে সেই শহর যদি অর্বাচীন হয়, নিতান্ত ব্যবসায়িক কারণেই দ্রুত বেড়ে উঠতে থাকে, ভিন ভিন্ন সংস্কৃতির বিচিত্র জনজাতির আবাস হয় – তবে নির্দিষ্ট, একমুখী সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল গড়ে ওঠা কঠিন। নবীন শহর শিলিগুড়ির সেই সমস্যা রয়েছে। বাণিজ্যে, ক্রীড়াক্ষেত্রে এ শহর বেশ এগিয়ে গেছে, কিন্তু শুধু কিছু ঝাঁ-চকচকে পথঘাট, রাতে উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত শহর, অজস্র আধুনিক কেতার দোকানপাট, অসংখ্য হোটেল, বেশুমার নার্সিং-হোম একটা শহরের উন্নতির মাপকাঠি নয়। সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকান্ড যে কোনও শহরের একটি অন্যতম আধুনিকতার পরিচয়। এ শহরে শেষ কবে বড় মাপের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আসর বসেছে, সঙ্গীতপ্রিয় মানুষ ভুলে গেছে। এখানে বড় মাপের টেবিল-টেনিস আসর বসে, নেহরু কাপের খেলা হয়, ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের খেলা হয়, বলিউডি গানার মেহ্‌ফিল বসে, কিন্তু কোনও গবেষকের প্রয়োজনীয় বই আনতে হয় কলকাতা থেকে। একমাত্র নাট্যোৎসবের সময় ‘কলিকাতার’ দল এলে দর্শক আনুকূল্য পায় উদ্যোক্তা। অন্য সময় প্রেক্ষাগৃহ শূন্য। ভালো প্রেক্ষাগৃহ বলতে সবেধন নীলমণি দীনবন্ধু মঞ্চ। এ শহরে কবিসভার চেয়ে হরিসভা, শোকসভা, জনসভার শোভা বেশি। খুব অনিয়মিত ভাবে হাতে গোণা কয়েকটি লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয়। স্বীকার করতে লজ্জা আছে, কিন্তু দ্বিধা নেই – শিলিগুড়ি শহরের আশপাশের ছোট মফস্‌সলি শহরগুলোর সংস্কৃতি চর্চার ঐতিহ্য এবং মান অনেক বেশি গৌরবময়। পাশের শহর, পাশের রাজ্য, এমন কী সীমান্তঘেঁষা শহর বলে পাশের রাষ্ট্র থেকেও এ শহরে মানুষ ছুটে আসে জীবিকার তাগিদে, চিকিৎসার গরজে, কাঞ্চঞ্জঙ্ঘায় সানরাইজ দেখতে। হাতির পিঠে চড়ে গণ্ডার দেখতে। শিলিগুড়ির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য কত পুরনো, এ খবর তাদের কাছে নিতান্ত অপ্রয়োজনীয়। আর, শহরজুড়ে যারা ভিন্ন রাজ্য থেকে এসে শুভলাভের কড়ি গুণে চলেছে, শিলিগুড়ির সাংস্কৃতিক মানোন্নয়ন হ’ল কিনা, তাদের কিছু আসে যায় না।

উত্তরবাংলার এই মফস্‌সল শহরে যাদের জন্ম, তাঁরা বড় হয়েছে তিস্তা, তোর্সা, মহানন্দা, করতোয়ার ভিজে বাতাসে। নদীপারে কাশবনের দোলা আর উত্তরে তাকালেই দা গ্রেট হিমালয়ান রেঞ্জ। পাহাড় পরিষ্কার থাকলেই ভোরে দেখতে পাই কাঞ্চনজঙ্ঘার শুভ্র মুকুটে একরকম লাল, আবার বিকেল গড়ালে সেখানে কেমন দুখি লাল। আমাদের অস্তিত্ত্বের সঙ্গে জড়িয়ে আছে মইষাল বন্ধুর গান, চা-বাগানের কুলি-লাইনের গল্প, বৈকুণ্ঠপুর ফরেস্টের আর মহানন্দা স্যাংচুয়ারির গাঢ় সবুজ গন্ধ। উত্তরের দারুণ বর্ষা আর কনকনে শীত। শালশিমুলজারুলখয়েরের ছায়ায় আমাদের বড় হয়ে ওঠা। মানুষের চৈতন্যে অবিরত রেকর্ডিং হতে থাকে ছড়ানো-ছেটানো এই সব উপাদান। সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে শুষে নেওয়া এই সব উপকরণ যেন একটা আর্কাইভে জমা হতে থাকে। বস্তুত, প্রায় তখনই ঠিক হয়ে সে কী লিখবে, কাদের নিয়ে লিখবে। এ কারণেই উত্তরের লেখকদের গল্পে বারে বারে তিস্তা নদী এসেছে, কাঠমাফিয়াদের কথা এসেছে, ভাওয়াইয়া ও রাজবংশীদের কথা এসেছে। বহুদিন আগে দেখা ডুয়ার্সের বাসে একজন ভুটিয়া রমণীর নাকে সোনার নথের ঝিকমিক মগ্ন-চৈতন্যে নিহিত থাকে। ধূপগুড়ির রোদ্দুর আর ওই নথের ঝিলিক নিয়ে একটা গল্প তৈরি হয় আমার মগজে। স্কুলে পড়ার সময় পিকনিক করতে গিয়ে সেভোকে করোনেশন ব্রিজের ওপর থেকে একমুঠো পাহাড়ি ঝাউপাতা ফেলে দিয়েছিলাম তিস্তার জলে। এই নদী বাংলাদেশে জলে গেছে। এখন বয়স যখন হেলে পড়েছে অড সাইডে, একটা গল্প তৈরি হতে চায়, যার নাম হতে পারে – মনোয়ারা বেগমের প্রতি শুভেচ্ছা।

পাহাড় থেকে গড়িয়ে নেমেই মহানন্দা সমতলে এসেছে শিলিগুড়িতে। পাহাড় গড়িয়ে পাথর আসে। পাথর গড়িয়ে চূর্ণীভবন চলে দীর্ঘকাল ধরে। নদীর গর্ভে বালি জমে। এখন ওই রুগ্ন, কঙ্কালসার নদীর দিকে তাকালে আমার বুকের ভেতরে কষ্টটা টের পাই। থাক, আমি দুঃখটা বালিচাপা দিয়ে রাখি।

কিছুদিন আগে আগে হঠাৎ মনে হ’ল যাই, একটু সেই নদীকে দেখে আসি। আমার প্রিয় মহানন্দা। রাস্তা পার হয়ে নতুন বসতির ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে নদী আর খুঁজেই পাই না। এ কী রে বাবা, পুকুরচুরি শুনেছি, আস্ত নদীটাও চুরি হয়ে গেল নাকি। যেখান দিয়ে হেঁটে এলাম, একদিন সেখানে ডুবজলে সাঁতার কাটতাম। অনেক সরে গেছে নদী। শেষে পাওয়া গেল। ঘরবাড়ি শেষ হওয়ার পর একটা ফাঁকা জায়গা দেখে দাঁড়ালাম। এখানে অন্ধকার। একটা বড় গাছও হয়ে গেছে এ ক’বছরে। হিসেব করে দেখলাম তা প্রায় চল্লিশ বছর পরে আবার নদীর পারে এসে দাঁড়িয়েছি। গাছ তো বড় হতেই পারে।

গাছটার নীচে গিয়ে বসলাম। আমার ছেলেবেলার নদী। আমার পায়ের কাছে মহানন্দা। উত্তরে তাকালে স্পষ্ট দেখা যায় তিনধারিয়া, কার্শিয়াং-এর আলো। অন্ধকারে কালো জল পাড়ে এসে ছলাত্‌ ছলাত্‌ শব্দে ভেঙে পড়ছে। সেই চিরকালের চেনা নদীকে ভীষণ অচেনা মনে হয়। কোথা থেকে এসেছে এই নদী ? কত যুগ ধরে বয়ে চলেছে এই নদী ? এর নাম কে রেখেছে মহানন্দা ? জগদীশচন্দ্র বসুর সেই বিখ্যাত লেখাটার কথা মনে পড়ল। ভাগীরথীর উৎস সন্ধানে। আমি তো বিখ্যাত মানুষ নই, তবু ইচ্ছে হ’ল নদীর সঙ্গে কথা বলতে। ফিসফিস করে উচ্চারণ করলাম –

নদী, তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ ?

কার্শিয়াং-এর কাছে একটা ছোট্ট সরোবরে আমার জন্ম।

নদী, তোমার যাত্রাপথের গল্প বলো।

পাহাড়ে কত শত চঞ্চল ঝর্ণা এসে আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তাদের সবাইকে নিয়ে পাহাড়ের বন্ধন ছেড়ে নেমে এলাম শিলিগুড়ির সমতলে। আমার পবিত্রতা নষ্ট হয়ে গেল। এ শহরের মানুষ নদীকে ভালোবাসে না। আমি কলুষিত হলাম। ওদিকে সুকিয়াপোখরি থেকে বালাসন এসে আমার সঙ্গে মিলিত হ’ল। শিলিগুড়ি পার হয়ে বাংলাদেশের সীমান্ত বরাবর এগিয়ে চলেছি। গজলডোবা থেকে তিস্তা ক্যানাল হয়ে তিস্তার জল এসে পড়েছে আমার বুকে। লকগেট বন্ধ করে সেই জল পাঠিয়ে দেওয়া হয় পশ্চিমে। শুখা মরশুমে ফসল ফলায় উত্তর আর দক্ষিণ দিনাজপুরের সুখা জমিতে।

তারপর ?

তারপর বিহারে ঢুকে পড়েছি। নেপাল থেকে আসা মেচি নদীর সঙ্গে দেখা হ’ল কিষাণগঞ্জের কাছে। সমস্ত জলসম্পদ নিয়ে ক্রমে আরও দক্ষিণে এঁকে বেঁকে, কতবার দিক পালটে অনেক পথ পার হওয়ার পর নাগর ও কুলিকের মিলিত ধারা এসে মালদহ জেলার মহানন্দপুরের কাছে আমার সঙ্গে মিশে গেল। তখন আর আমার সেই পাহাড়ি চঞ্চল খরধারা নেই। কিছুটা অলস ছন্দে আমার এগিয়ে চলা। কত স্ফীত হয়েছি।

নদী তার দুঃখের কথা বলে। কেউ শোনে না। ট্রাক ভর্তি বালিপাথর চলে যায় নগর-সভ্যতার দিকে। শহরের চারপাশে যে সবুজ বলয় ঘিরে রাখত শিলিগুড়িকে, সেই বলয়ের ব্যাসার্দ্ধ ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। উন্নয়ন চাইলে উচ্ছেদও তোমাকে মেনে নিতে হবে। পুবে বৈকুণ্ঠপুর ফরেস্ট কত দূরে সরে গেছে। এখন সেখানে মানুষ, শুধু মানুষ। উত্তরে মানুষের প্রতিরোধ অগ্রাহ্য করে চা-বাগান উচ্ছেদ করে তৈরি হয়েছে বিলাসবহুল আবাসন। পশ্চিমে নদীর ওপারেও চলে গেছে শিলিগুড়ি। আর দক্ষিণে শিলিগুড়ি এখন জলপাইগুড়ির দিকে দৌড়ে চলেছে। শুধু মানুষ, শুধু ধূসর কংক্রিট। বৈকুণ্ঠপুর থেকে সবুজ টিয়ার ঝাঁক এখন আর আসে না শিলিগুড়িতে।

তবু সৃষ্টির বাসনা জেগে থাকে কিছু মানুষের মনে। এই প্যাশনের মৃত্যু হয় না। রয়েছেন কিছু অধ্যাপক। রয়েছে কিছু নাটকের দল। মাঝে মাঝে ছবির প্রদর্শনীও হচ্ছে। গদ্যপদ্যের জগতে শক্তিশালী কলম নিয়ে এগিয়ে আসছে কিছু তরুণ মুখ। ওরাই গানে, কবিতায় মুখর করে তোলে বইমেলা।

কতকাল হ’ল শিলিগুড়ি টাউন স্টেশনের ক্যান্টিন বন্ধ। মমতাজ আলি, আস্‌রাফ আলির কথা মনে পড়ে। পুরনো স্টেশন প্রায় পরিত্যক্ত। আরও দক্ষিণে নতুন স্টেশনঘর হয়েছে। খুঁজেই পাই না কোথায় ছিল আমদের সেই মফস্‌সলি কফি-হাউস রেল-ক্যান্টিন। ওখানেই এক নির্জন দুপুরে অমরেশ ওর প্রেমিকার বান্ধবীর সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দিলে বুঝেছিলাম, কাকে বলে – একটি কথার দ্বিধা থরো থরো চূড়ে ...।

হঠাৎ কোনও দিন বিধান মার্কেটে ‘নেতাজি কেবিন’-এ যাই। এখানেও শিলিগুড়ির লেখক-শিল্পীরা আসা-যাওয়া করত। এখন আর করে কি না, জানি না। তপনের বিখ্যাত বই-এর দোকান ‘বুকস্‌’ বন্ধ হয়ে গেছে। উত্তরবাংলার প্রায় সব লেখককবিরা এখানে আসত তাদের প্রয়োজনীয় বই-এর খোঁজে। আমাদের নিত্যদিনের সায়ং সভার নাটমন্দির ছিল বুকস্‌। যে কোনও বই দরকার হলেই তপনকে বলতাম। তপন ওর লোক দিয়ে আনিয়ে দিত। অনেকেই এক সময় প্রচুর বই আনিয়েছেন এই বুকস্‌ মারফত্‌। আমাদের খুব কষ্ট হয়েছিল বুকস্‌ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর। এত বড় শহর। বলা হয় দ্বিতীয় কলকাতা নাকি। অথচ বুকস্‌-এর মত আর একটা বই এবং লিটল্‌ ম্যাগাজিনের দোকান শিলিগুড়িতে হ’ল না। শহরে এতগুলো কলেজ, কাছেই বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ, এত মানুষ, এত দোকানপশার, অথচ আমাদের একটা পাতিরাম বা ধ্যানবিন্দু নেই। আমাদের হংকং মার্কেট আছে, আমাদের বিদেশি ব্যাঙ্ক আছে, আমাদের বিখ্যাত ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল আছে, আমাদের মন্দির-মসজিদ-গির্জা-গুরুদ্বার আছে, অথচ হায়, একটি ছোটখাটো কলেজ স্ট্রিট নাই।

হবে নিশ্চয় একদিন। আশায় বাঁচে চাষা। কলকাতার ইতিহাস তিনশ বছরের। এই শহরের গঞ্জ থেকে মফস্‌সল শহর হয়ে বড় শহর হয়ে ওঠার ইতিহাস খুব বেশি হলে পঞ্চাশ বছরের। এই শহরের সংস্কৃতির ইতিহাস যেদিন লেখা হবে, সেদিন পাহাড়তলির নাম আলাদা ভাবেই উল্লেখিত হবে।

No comments:

Post a Comment