প্রাচীনকথা - অনিন্দিতা মণ্ডল



প্রাচীনকথা


রাজোচিত
অনিন্দিতা মণ্ডল


পর্ব ৩
ভিক্ষু সোমদেব দেখছেন এক অপরূপ দর্শন যুবক। এত সুন্দর মানুষ হয়? দীপ্ত মধ্যাহ্নসূর্যের ন্যায় গাত্রবর্ণ। নীলনয়ন যেন সমুদ্র। মুখে কি সারল্য! অথচ নৃশংস প্রবৃত্তিপরায়ণ এই যুবক। ভালো করে দেখছেন ভিক্ষু। নাহ, এর মধ্যে লোভের প্রবৃত্তি তো নেই! বরং জগতের প্রতি এক প্রবল বিরাগে যেন সে এই ধ্বংসলীলা শুরু করেছে। যেন কিসের সন্ধানে ধরিত্রীর দেহ ছিঁড়েখুঁড়ে দেখতে চাইছে। অথচ সে বস্তুর সন্ধান পেলে সে শান্ত হয়ে যাবে। এমন হত্যালীলা আর সম্ভব হবেনা। আপাতত যুবক চাইলেন – “বলুন কি প্রয়োজনে এসেছেন? কোনও গোপন সংবাদ দিতে চান?” শত্রুসৈন্যকে গোপনে সংবাদ সরবরাহের দারুন পুরস্কার আছে। সোমদেব জানেন। ভিক্ষু কথার উত্তর না দিয়ে অভ্রভেদী দৃষ্টিতে দেখছেন যুবককে। ধীরে ধীরে কালের পর্দা অপসারিত হচ্ছে। তিনি দেখতে পাচ্ছেন এ যুবক ইন্দ্রস্থানের পশ্চিম সীমানা থেকেই চিরতরে ফিরে যাবে। এ পবিত্রভুমির অন্দরে প্রবেশ ঘটবেনা তার। শুধু তাই নয়। এই প্রস্থান তার জীবনসীমার অন্তিম সূচক। ভিক্ষু লক্ষ্য করেছেন যুবকের ভোগও একরকমের নিঃস্পৃহতায় আচ্ছন্ন। লালসা নয়, যেন বিরক্ত ভক্ষক। তিনি স্মিত হাস্যে বললেন – বিদেশী রাজা। আমি শুনেছি আপনি পণ্ডিত, মেধাবী। বহু দার্শনিক পণ্ডিতের কাছে বিদ্যাগ্রহণ করেছেন। মাত্র কিছুকাল আগে ইন্দ্রস্থানে এক মহামানব এসেছিলেন। তিনি অহিংসার বাণী প্রচার করেছেন। তাঁর দর্শনে প্রাচ্যভূমি প্লাবিত, মুগ্ধ। আমি তাই নিয়ে আপনার বিদ্বানসভায় আলোচনা করতে চাই। পারস্পরিক মতের আদানপ্রদানে দর্শনশাস্ত্র সমৃদ্ধ হয়। রাজপুত্র মৌন। ভিতরে ভিতরে হতাশ হয়ে পড়ছেন। কে এই ভিক্ষু? এখন কি তাঁকে প্রমাণ করতে হবে যে তাঁর দেশের দর্শন এদেশের চেয়ে বহুপরিমানে উন্নত? গ্রীকদর্শন হীন? ক্রোধ বাড়ছে। এই কয়েক বছরে বহু সাধু সন্ন্যাসীর সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়েছে। তাঁদের কারুকে কারুকে তিনি ম্যাসিডোনিয়ায় নিয়ে যেতে চেয়েছেন। কেউ কেউ রাজীও হয়েছেন। এখন শিবিরে তাঁরাও আছেন। কিন্তু আজ যেন কি কারণে তিনি বিরক্ত হচ্ছেন। ক্রোধ জাগছে। তিনি শুনেছেন সৈন্যরা আর যুদ্ধে উৎসাহী নয়। অনুগত সৈন্যদল ছাড়া জয় অসম্ভব। আর আনুগত্যহীনতায় তিনিই কি কিছু অভ্যস্ত নাকি? ভিক্ষু তখনও বলে চলেছেন – আমাদের দর্শনে ক্ষমা ও করুণা সমস্ত হৃদয়বৃত্তির মধ্যে মহত্তম। রাজপুত্র স্পষ্টতই বিরক্ত, অন্যমনস্ক। ইশারায় একটি হাত তুললেন। আঁটসাঁট বর্মে শিরস্ত্রাণে ঢাকা দুটি রক্ষক ছুটে এলো। ইঙ্গিত স্পষ্ট। ভিক্ষু সোমদেব বুঝলেন। এরপর আর কথা বলা নিরর্থক। অভিবাদন করে সভা থেকে বিদায় নিলেন। তবু উপলব্ধি করলেন, রাজপুত্রের মহানুভবতা। ইচ্ছে করলে দণ্ডিত করতেই পারতেন। 

পবিত্র নদী বাণগঙ্গা ও মাঝির সঙ্গমস্থলে দাঁড়িয়ে প্রস্তরনির্মিত ত্রিগর্ত দুর্গ। চন্দ্রভাগা নদীর একটি শাখানদী এই বাণগঙ্গা। ত্রিগর্ত ও কাশ্মীর রাজের মধ্যে বাণগঙ্গার জলধারা নিয়ে কিছু অস্বস্তি আছে। রাজা পরমানন্দ চন্দ্র জানেন বন্যা হলে ত্রিগর্তর প্রজাদের ক্ষতি হয় বেশি। কাশ্মীররাজ অভিসার সাংঘাতিক কূটনীতি বোঝেন। তাঁর সীমান্ত রাজ্যটি বহিঃশত্রুর আক্রমণে যাতে পর্যুদস্ত না হয়, তাই চিরদিন তাদের সঙ্গে সন্ধি স্থাপন করে এসেছেন। এর ফলে ইন্দ্রস্থানের বাকি রাজাদের সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক থাকেনা বললেই চলে। কিন্তু রাজা পরমানন্দ প্রত্যক্ষ শত্রুতায় জড়িয়ে পরেননা। আলোচনার মাধ্যমে দুই দেশের সীমা ও নদীমধ্যে বাঁধ ও জলসংক্রান্ত সমস্যা মিটিয়ে নেবার চেষ্টা করেন। তাঁর দুর্গটি বহুকালের। কথিত আছে তাঁদের পূর্বপুরুষ মহাভারতের কালে এটি নির্মাণ করেছিলেন। সম্ভবত কুরু রাজ্যের সীমায় যাতে পতিত হতে না হয় সেই জন্য। মগধরাজ জরাসন্ধ তাঁদের সমর্থন করতেন। এরই ফলস্বরূপ গঙ্গাহৃদির গঙ্গাবংশীয়রা এবং নন্দবংশীয়রা ত্রিগর্তকে প্রচ্ছন্ন সমর্থন জুগিয়ে আসছে। অবশ্য রাজা পরমানন্দ চন্দ্র বীরপুরুষ। তিনি রাজ্যরক্ষাব্যাপারে কারো মুখাপেক্ষী নন।

এখন শরতের সকালে দুর্গের উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে মেয়েরা আল্পনা দিচ্ছে। আসন্ন অম্বাপূজা উপলক্ষে চারিদিকে সাজসাজ রব। কাটোচ বংশ অম্বার পূজক। বেদবাদী ব্রাহ্মণ্য আরাধনার ধারার সঙ্গে মাতৃপূজার ধারাটি কবে কি উপায়ে মিলিত হয়েছে তা এখন আর কেউ মনে করতে পারেননা। ঠিক যেমন বাণগঙ্গা আর মাঝির মিলনপ্রহর সকলের অজ্ঞাত। একটি উঁচু বেদীতে বসে আছেন রাজা। নীচে পর্বতের সানুদেশে এখনই বাতাস উষ্ণ হয়ে উঠেছে। কিন্তু এই সুউচ্চ দুর্গশিখরে বাতাস শীতল ও নির্মল। নীচে বর্ষার প্রবল জলোচ্ছ্বাসে নদীর গর্জন শোনা যায়। স্থানটি মনোরম ও দুর্গম। শত্রুসৈন্য এ দুর্গে পৌঁছনো কার্যত অসম্ভব। সব দিক চিন্তা করেও ত্রিগর্তরাজের কপালে চিন্তার ভাঁজ। উৎসব বা আবহাওয়া, কোনটিই তাঁকে স্বস্তি দিতে পারছেনা। একটু দূরে বড় বড় কাঠের দোলায় চিত্র আঁকছে চিত্রকর। বনফুলের গভীর রঙের প্রলেপ পড়ছে। সবুজ নীল লাল হলুদ রঙে অম্বার মূর্তি ফুল লতা পদ্ম শঙ্খের চিত্র আঁকা চলছে। শারদ উৎসবে রাজ্যের নানা প্রান্ত থেকে দেবী অম্বার মূর্তি দোলায় চড়ে আসবে দুর্গ প্রাঙ্গণে। একটি মাস ধরে মেলার মতন দুর্গ প্রাঙ্গন মেতে থাকবে পূজায়। উৎসব শেষে প্রতি প্রান্তের পূজিতা অম্বার বিগ্রহ দোলায় করে ফিরে যান আপন আপন মন্দিরে। রাজা পরমানন্দ আসন্ন উৎসবের আয়োজন দেখছেন বটে, কিন্তু জয়বর্মার প্রেরিত সংবাদ তাঁকে বিমনা করছে। সাভতির বেলুবন বিহার থেকে ভিক্ষু সোমদেব স্বয়ং যাত্রা করেছিলেন এক বিদেশীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন বলে। সাভতি পর্যন্ত সংবাদ পৌঁছেছে যে এক যবন রাজপুত্র নাকি ইন্দ্রস্থানের সীমায় এসেছে। এর আগেও আক্রমণ হয়েছে, কিন্তু এতদূর আসেনি কেউ। এই রাজপুত্র সিন্ধুর পারে এসে শিবির ফেলেছেন। ভিক্ষু সোমদেবের সঙ্গে জয়বর্মা দুটি গুপ্তচর প্রেরন করেছিলেন। ভিক্ষু সেই রাজাকে দেখে বিস্মিত হয়েছেন। রাজার সঙ্গে তাঁর সৈন্যদল ছাড়াও বহু জ্ঞানীগুনী পণ্ডিত এসেছেন। রাজা অবসরে তাঁদের সঙ্গে জ্ঞানবিজ্ঞান আলোচনা করেন। এরা নিজেদেরকে পৃথিবীর সবচেয়ে সভ্যজাতি বলে মনে করেন। আবার রাজা প্রবল ভোগাসক্ত। দুটি একসঙ্গে কিভাবে হয় তা ভিক্ষুর চিন্তার অতীত। গুপ্তচর দুটি এই অবসরে জেনে এসেছে, রাজার সৈন্যদল ভারী পটু। যেকোনো যুদ্ধ জয়ে তারা প্রানপাত করে। কিন্তু আপাতত তারা বিরক্ত। রাজা বড়ই নিষ্ঠুর। সৈন্যরা বহুকাল স্বদেশ ছাড়া। গৃহে ফেরার জন্য উন্মুখ। রাজা কম যুদ্ধ তো করলেন না। সুস্থিত হয়ে প্রজাপালনে মন দেবেন এ সুযোগ তিনিও তো এতদিনে পেলেন না। শত্রুরাজ্যের বন্দীদের ওপরে অকারণে ভীষণ হয়ে ওঠেন। এবং সর্বোপরি নিজের সৈন্যদের সুবিধের দিকে তাঁর নজর নেই এতটুকু। এইটুকু সংবাদেই গুপ্তচররা আশার আলো দেখছে। শত্রুর সঙ্গে সমরে তাঁর কোনও সমস্যা নেই, কিন্তু উৎসবের সময়ে এই যুদ্ধবিগ্রহ তাঁর বিরক্তির কারণ হয়েছে।

রাজা পরমানন্দ চন্দ্র যদিও পঞ্চাশটি বছর অতিক্রম করেছেন, তবু তিনি বৃদ্ধ নন। পার্বত্য শরীরে বয়সের চিহ্ন আসতে চায়না। তার ওপরে তিনি শক্তিশালী পুরুষ। এখন অদূরে তাঁর প্রিয়তমা কন্যাটি আলপনায় ব্যাস্ত। সে একটি বিরাট পদ্ম চিত্রিত করছে। পিতাকে অন্যমনস্ক দেখে সে ডাকল – পিতা সহস্রদল কেমন হয়েছে? পিতা কন্যার মাথায় হাত রাখলেন। তারপর মধুর হাস্যে বললেন – সুন্দর হয়েছে মা। তবে যে হাতে চিত্র এঁকেছ সেই হাতে কি অস্ত্র চালনা করতে পারবে? দেবী অম্বার মতন? রাজকন্যা অম্বিকার মুখে হাস্যোজ্জ্বল দীপ্তি – পিতা আমি অস্ত্র ধরতে জানি। প্রয়োজনে দেবী অম্বাকে স্মরণ করব। কিন্তু এখন কি যুদ্ধ পিতা? পিতা হাসলেন। অর্বাচীন। পুত্রী বিবাহযোগ্যা। নিঃশঙ্ক কন্যার একটি উপযুক্ত পাণিগ্রহীতা চাই।

সোপানে কার পদশব্দ। রাজা তাকালেন। বহু মানুষের কোলাহলে প্রাঙ্গন মুখর। তার মধ্য দিয়েও তিনি পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছেন। উঠে আসছেন জ্যেষ্ঠ পুত্র যুবরাজ দ্বিতীয় পরমানন্দ। বড় আদরের। বড় নির্ভরের। পুত্র অসামান্য বীর। কিন্তু একটিই চিন্তা। তিনি অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা করেন কম। তবুও মহারাজ জানেন পুত্র পরমা তাঁকে কোনও যুদ্ধে হারতে দেবেননা। পুত্র এখন সংবাদ এনেছেন যবনরাজ উন্মুখ হয়েছেন আক্রমণের জন্য। কিন্তু তার স্বদেশীয় পণ্ডিত তাঁকে বাঁধা দিচ্ছেন। এ দেশের সব কিছুই তাঁদের চোখে অদ্ভুত ঠেকছে। সবিশেষ না জেনে না বুঝে অগ্রসর হতে বারণ করছেন। কিন্তু রাজপুত্র পরমার বিশ্বাস এই যবনরাজা কারোর বারণ শুনবেন না। ভিক্ষু সোমদেব এমনই বলে গিয়েছেন। শুধু তাই নয়, ভিক্ষু বলে গিয়েছেন, যুদ্ধে এ নিরস্ত হবেনা ঠিকই, কিন্তু পরাজিত হবে। নতমস্তকে চলে যেতে হবে। আর হয়ত পৃথিবী শাসন তার দ্বারা হয়ে উঠবেনা। তবে এ যুদ্ধে ত্রিগর্তর একটি বড় হানি তিনি উপলব্ধি করেছেন। সেটি কি তিনি তা বলেননি। শ্রমণ ভিক্ষুদের এমন অলৌকিক শক্তি আছে তা ইন্দ্রস্থানের বাসিন্দারা জানেন। এঁরা যোগবলে এমন ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারেন।

সন্ধ্যায় প্রাকারের নিভৃত প্রকোষ্ঠে মন্ত্রনায় বসেছেন রাজা সেনাপতি মন্ত্রীগণ ও যুবরাজ। ত্রিগর্ত মেতে আছে উৎসবের প্রস্তুতিতে। সবে বর্ষা গিয়েছে। নদী বিপুলা। পথঘাট পিচ্ছল। অশ্ব ও হস্তীর পক্ষে প্রতিকুল না হলেও রথ ও পদাতিক সৈন্যদের কাছে এই বিজাতীয় ভূমি নিরাপদ নয়। এই গ্রীক রাজা নাকি নানা প্রকার ব্যুহ রচনায় পারদর্শী। অপরাজেয়। কিন্তু সে কি চক্রব্যুহ রচনা করতে জানে? বৃত্তাকার চলনে একটির পর একটি ঘূর্ণনে তৈরি ব্যুহ। সে চক্রে প্রবেশ করলে মৃত্যু নিশ্চিত। তারপর আছে রণহস্তী। হস্তীর আক্রমণের উত্তর দিতে পারা এদের পক্ষে অসম্ভব। এমন বিপুলকায় পশু এরা দেখেনি। গঙ্গাবংশীয় রাজকন্যা পরমানন্দর গৃহে রাজ্ঞী। তিনি জানেন, রণহস্তীর অপ্রতুলতা ঘটবেনা। একটু ধৈর্য ধরে এগোলে যুদ্ধে জয় নিশ্চিত। 

রাজা আদেশ দিলেন। দুর্গ যেমন মেতে আছে, থাক। সৈন্য সাজানো হোক। রণভেরির দামামা শুনলেই তিনি রওনা হবেন। চন্দ্রভাগার উত্তর গতিতে ষাটক্রোশ দূরে যে বিস্তীর্ণ, প্রায় সমতল চারণভূমি আছে, যুবরাজ সেখানে সৈন্য নিয়ে যান। কারণ, পার্বত্য ভূমিতে সুবিধা করতে না পারলে গ্রীক সৈন্য চন্দ্রভাগার পশ্চিমতীর ধরে উত্তরে যাবে। সেখানে যুবরাজ থাকবেন।

No comments:

Post a Comment