স্মৃতির সরণী
অগ্নি বাণ
বিভাস রায় চৌধুরী
সন্ধ্যে নাগাদ ব্যারাকপুরের পরিত্যক্ত রানওয়ের এক কোণে চুপচাপ আমাদের হেলিকপ্টারপার্ক করে দিয়ে আমরা যে যার মেস এ চলে গেলাম। ক্যাপ্টেন শুধু জানিয়ে দিলেন পরদিন ভোর চারটেতে রিপোর্টিং। সেই সাত সকালে আমরা কুম্ভীগ্রাম এয়ার ফোর্স ইউনিট (শিলচর এয়ারপোর্ট) থেকে উড়ে, শিলং, গৌহাটি, বাগডোগড়া (শিলিগুড়ি) হয়ে ব্যারাকপুর পৌঁছতে সূর্য্য ডুবে গেল। অন্ধকারে একটা শক্তিমান ট্রাক আমাদের পাঁচজনকে টিমটিমে আলো আঁধারী মেসের সামনে নামিয়ে দিয়ে ড্রাইভার বলে গেল কাল ভোরে ও নিজেই এসে এখান থেকেই পিক আপ করে নিয়ে যাবে। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সিনেমার মতো এয়ার ফোর্স স্টেশন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ফলে এই সেক্টরে আমাদের আর্মি, এয়ার ফোর্স একটু বেশি রকমের শান্ত।
পরদিন ভোরবেলা এসে হেলিকপ্টার রেডি করে টেক অফ করতে পূর্ব আকাশে লালি ধরে গেল। পশ্চিম দিগন্তের রেখা তবুও কালচে।
ব্যারাকপুর থেকে সোজা গঙ্গার উপড় দিয়ে উড়ে এসে, হাওড়া ব্রিজের কাছে বাঁয়ে পাক খেয়ে ইডেনের লাইট পোস্টের কান ঘেঁষে ল্যান্ড করলো রেস কোর্সে। হাওড়া ব্রীজ আসলে ‘নো ফ্লাইং জোন’। আকাশ থেকে সেই প্রথম হাওড়া ব্রীজ, ইডেন, ধর্মতলা দেখা। একটা তিরিশ মিটার এলাকা ঘাস কেটে হেলিপ্যাড বানানো। স্মোক জেনারেটর জ্বলছে। সেদিন সাত সকালে রেস কোর্সে কোনও ঘোড়া ঢুকতে পারেনি। এক কোণে একটা অলিভ গ্রীন জিপসি আর কয়েকজন আর্মি অফিসার দাঁড়িয়ে। হেলিকপ্টার ল্যান্ড করতেই পাইলট ইঞ্জিন বন্ধ না করে, আমাদের একজনকে ইশারা’তে বললেন নীচে গিয়ে দাঁড়াতে।
শীতের সকালে হেলিকপ্টারের ব্লেডের হাওয়া কানের পাস দিয়ে গুলির মতো ঘষে গেল। একটা পাতলা স্যুট কম্বিনেশন গায়ে।
মিনিট দুয়েকের মধ্যে আরেকটা জিপসি এসে একদম ঘুরন্ত টেল ব্লেডের কাছে থামল। হেলিকপ্টারের পেছনে যে পাখা থাকে, ভীষণ জোরে ঘোরে বলে অনেকের চোখে পরে না। হাত দিয়ে ড্রাইভারকে ইশারা করে পেছতে বললাম। চারজন সায়েন্টিস্ট নামলেন। হাতে একটা করে নোট প্যাড আর একজনের কাছে একটা এস এল আর ক্যামেরা।
পৌনে ঘন্টা পরে আমরা সমুদ্রের ধারে একটা কংক্রিটের হেলিপ্যাডে নামলাম। ডিফেন্স সিকিউরিটি কোর এর গার্ড জানালো জায়গাটার নাম চাঁদিপুর। দূরে কতগুলো গ্রাম দেখা যাচ্ছে। আর বাকিটা DRDO র বাউন্ডারী।
কিছুদিন আগেই এখান থেকে অগ্নি মিসাইলের টেস্ট লঞ্চ হয়েছিল। সেই টেস্ট নিয়ে হৈ চৈ কম হয়নি। তবে প্রথম টেস্টের মিসাইল ছিল হাজার কিমি রেঞ্জের, সাথে হাজার কেজির নিউক্লিয়ার বোম নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা। তখনই বলা হয়েছিল, এর পরের টার্গেট দুই হাজার কিমি দূরত্বে মারতে পারে এমন মিসাইল বানানো। সাথে মাথায় লাগানো থাকবে হাজার কেজির নিউক্লিয়ার বোম।
চারিদিকে বেশ সাজ সাজ রব। DRDO থেকে একজন অফিসার এসে ঐ চারজনকে নিয়ে গেলেন। একটা গাড়ী আমাদের নিয়ে পৌঁছে দিল ওদের ক্যান্টিনে। সমুদ্রের ধারে মেস। সামনে ধুধু বালির সমুদ্র সৈকত, জল তখন প্রায় দুই কিমি দূরে। সকাল থেকে এক কাপ গরম জলও জোটেনি, চা তো স্বপ্ন। ক্যান্টিনে গরম গরম পুরী আর আলুর তরকারী, সঙ্গে এক গ্লাস করে চা। আহা!
দুপুর দশটা নাগাদ আবার ‘টেক অফ’, মিনিট দুয়েকের মধ্যে নীচে শুধু জল আর জল। তার মধ্যে প্রচুর কচ্ছপ ভেসে আছে। এগুলো সব অলিভ রিডলে, সামুদ্রিক কচ্ছপ। এই কচ্ছপেরা প্রতি বছর অস্ট্রেলিয়া থেকে ওড়িশা’তে দলে দলে ডিম পাড়তে আসে। সেক্সুয়ালি ডিমরফিক এই কচ্ছপের পুরুষ প্রজাতির ওজন প্রায় ৪০ কেজি, আর মহিলাদের ওজন ৩৫ কেজির কাছাকাছি। মেক্সিকো আর কোস্টারিকাতেও ডিম পাড়তে যায়, কিন্তু এই অলিভ রিডলের ডিম পাড়া উৎসব ওড়িশা’র গাহিরমাথা এলাকাতেই সব চেয়ে বেশি।
হেলিকপ্টার যখন খুব নীচু দিয়ে ফ্লাই করে, মানে ১০০ বা ২০০ মিটারের উচ্চতায়, সেই উড়ন্ত হেলি থেকে সমুদ্রের নীল জল আর তার মধ্যে জলজ উদ্ভিদ বা এই সব কচ্ছপের ভেসে থাকা দেখতে দেখতে মনেই থাকেনা সময় কোথা দিয়ে চলে গেল।
একটা আইল্যান্ড দেখা যাচ্ছে। এর নাম তখন ছিল হুইলার্স আইল্যান্ড। আপাত দৃষ্টিতে এই আইল্যান্ড, অলিভ রিডলের ব্রিডিং গ্রাউন্ড বা প্রজনন ক্ষেত্র। আসলে এই দ্বীপকেই সেই সময় তৈরি করা হচ্ছিল ইন্ডিয়ার মিসাইল টেস্ট লঞ্চ প্যাড হিসেবে। ওড়িশা সরকার ১৯৯৩ সালে এই দ্বীপ Defence Research and Development Organisation (DRDO) দিয়ে দেয়।
আইল্যান্ডে কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়ালাম। রিডলে ছাড়াও দেখতে পেলাম অসংখ্য লাল কাঁকড়া। আর কি কি দেখলাম সেগুলো লেখা যাবেনা। তবে বুঝলাম কিছু একটা হতে চলেছে।
সেবারের মতো বিকেলে সেই চার মূর্তীকে দমদম এয়ার পোর্টে নামিয়ে পরদিন কুম্ভীগ্রামে ফিরে এলাম।
ওদিকে দেশের পশ্চিম সীমান্তে তখন অন্য কিছু চলছিল। ৫৮ নং ইঞ্জিনিয়ার রেজিমেন্টের এক দল সেনা তখন ব্যাস্ত মরুভূমিতে কিছু করতে। কিভাবে করতে হবে জানে, কিন্তু কেন করছে জানেনা। এক জন দু’জন করে নতুন লোক আসেন। আর্মির ড্রেস পরেই আসেন, কিন্তু হাঁটা চলা দেখেই সন্দেহ হয়।
খাবার আসে প্যাকেটে। জল আসে প্লাস্টিকের পাউচে। খাওয়া হয়ে গেলে কিছু ফেলে রাখলে হবে না। সব প্যাকেট বানিয়ে ফেরত পাঠিয়ে দিতে হবে। এক জায়গার কাজ শেষ হলে সরে এসে অন্যত্র আবার সেই ভাবেই কাজ চলে। কাজ হয়ে গেলে তাঁবু ওঠাও আর চলো অন্য সাইটে।
আমরা ফিরে আসতেই, আবার একটা হেলিকপ্টার আরেক দিন চাঁদিপুর গেল। ফিরে এল দিন তিনেক বাদে। আবার একদিন গেল, ফিরেও এলো। শীত কমে গেল। বেশ কয়েক বার চাঁদিপুর ট্রিপ মেরে আমরা এটাকে প্রায় জল ভাত ভেবে নিয়েছি।
এর মধ্যেই একদিন আবার আমার টার্ন এলো চাঁদিপুরের। তবে এবারে অন্য রুটে। কলকাতা বাই পাস করে সোজা কলাইকুন্ডা। সেখান থেকে ভুবনেশ্বর। পুরনো এয়ারপোর্টের একটা হ্যাঙ্গারে হেলিকপ্টার রেখে আমাদের আস্তানা DRDO র গেস্ট হাউস। পরদিন সকালে দেখি গেস্ট হাউসে একটু বেশি রকমের চাপা উত্তেজনা।
সকালে এয়ারপোর্টে গিয়ে সব কিছু রেডি করতে করতে, সিডিউল টাইমের আগেই কনভয় এসে গেল। খান তিনেক গাড়ী। যাত্রী দু’জন। একজন প্রধান মন্ত্রীর সাইন্টিফিক অ্যাডভাইজার, অন্যজন তার সাগরেদ। সোজা হুইলার্স আইল্যান্ড। গ্রীষ্মের প্রখর রোদে, হেলিপ্যাড তেতে আছে। সেখানেই হেলিকপ্টারের নীচে দাঁড়িয়ে একটা ডাবের জল খেলেন অ্যাডভাইজার সাহেব। একটা চার্ট পেপার সাইজের সার্কিট ডায়াগ্রাম নিয়ে সেখানেই মিনিট দশেকের মিটিং করে তারপর গেলেন লঞ্চ প্যাডের কাছে। সেখানেও প্রচুর ভিড়। মানুষের থেকেও বেশি যন্ত্রপাতি। আর তার প্যাকিং কেস। একটা কুড়ি মিটার লম্বা অগ্নি-২, মিসাইল, ঘাড় কাত করে শুয়ে আছে। দুই হাজার কিমি দূরত্বে অ্যাটম বোমা মারতে পারার মতো মিসাইল তখন আমাদের হাতে ছিল না। সবার মধ্যে একটা চাপা উত্তেজনা।
গরম বাড়ছে, ১৯৯৮ সালের ১১ মে মাস। সন্ধ্যেবেলা আসামের জঙ্গল আর চা বাগান ঘেরা সেই ইউনিট থেকে ফিরে টায়ার্ড শরীর ঠাণ্ডা মেঝেতে এলিয়ে দিয়ে টিভি খুলতেই শুনলাম পোখরানে অপারেশন শক্তি সাকসেসফুল। ভারত, দ্বিতীয়বার পারমাণবিক পরীক্ষা সফল ভাবে করে ফেলেছে। প্রায় ৪৫ কিলো টন ‘টি এন টি’র বিস্ফোট, আর সেটা করেছে সবার অজান্তে। পাকিস্তানী গুপ্তচর আর আমেরিকান স্যাটেলাইটকে ধোঁকা দিতে অগ্নি -২ এর টেস্ট প্রিপারেশনের জন্য আমাদের গত চার পাঁচ মাস ধরে চাঁদিপুর আর হুইলার্স আইল্যান্ডে চক্কর কেটেছি। যাতে আমেরিকান স্যাটেলাইটের চোখ ভারতের পূর্ব প্রান্তে ফোকাস হয়ে থাকে। সেই সুযোগে পোখরানে আর্মির ছত্রছায়ায় আমাদের নিউক্লিয়ার সায়েন্টিস্ট এর দল সমস্ত প্রস্তুতি ঠিক ভাবে করে ফেলতে পেরেছিলেন। কারোর সন্দেহ হয়নি।
আর হ্যাঁ, ঐ প্রাইম মিনিস্টারের অ্যাডভাইজার ছিলেন, মিসাইল ম্যান, কালাম সাহেব। পরে রাষ্ট্রপতি হলে, তখনও একবার সুযোগ হয়েছিল ওঁকে নিয়ে এক দুর্গম পাহাড়ে যাওয়ার। সে গল্প অন্য কোথাও শোনাবো। আর ওই হুইলার্স আইল্যান্ডের নাম পালটে দেওয়া হয়েছে। কালাম আইল্যান্ড।
রাম চন্দ্রের সেতু বানাতে কাঠবেড়ালি’র একটা ছোট্ট রোল ছিল। পুণ্যভূমি পোখরানে আমেরিকান সি আই এ আর পাকিস্তানী আই এস আই ইন্টেলিজেন্সিকে ধোঁকা দিতে আমরা দেশের পূর্ব প্রান্তে সেই রোলটাই প্লে করেছিলাম।
Darun lekha hoyeche. Kono chobi nei oe somoy er?
ReplyDeleteএই ধরনের কাজে ছবি তোলা নিষেধ। তথ্যের সিকিউরিটি একটা সেনসিটিভ ইস্যু।
DeleteKhub sundor barnona. Asa kori aro pabo amra. Jai Hind.
ReplyDeleteধন্যবাদ। জয় হিন্দ!
Delete