বইঘর - চয়ন



বইঘর


হিতোপদেশের গল্প - রাজশেখর বসু
চয়ন

বিশ শতকের নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে ইংলণ্ডে খুঁজে পাওয়া যায় এক হাতে লেখা বই। শিশুসাহিত্যের গবেষকরা নড়েচড়ে বসেন। খুলে যায় চিন্তার এক নতুন দিক। কী ছিল সেই পাণ্ডুলিপিতে? ১৭৪০এর আশেপাশে নিজের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর জন্য হাতে করে এই বই তৈরী করেছিলেন জেন জনসন। গল্প লিখেছিলেন, ছবি এঁকেছেলেন, যত্ন করে বাঁধিয়েছিলেন নিজের হাতে। এই হাতে গড়া বইয়ের চল সেসময় ইংলণ্ডে ঘরে ঘরে ছিল। কেননা একেবারে ছোটদের জন্য লেখা পড়ার বই সে দেশে তখন খুব একটা পাওয়া যেত না। কত মমতা, কত অধ্যবসায়, কতটাপরিশ্রম যে এসব বইয়ের শরীরে মাখানো থাকে সেটা বোধহয় না বললেও চলে।


জেন জনসনের বইয়ের একটি পাতা

বাংলা ভাষাতেও যে এরকম হাতে গড়া বই আছে, তার হদিশ আমরা সদ্য পেয়েছি। এবং পেয়ে চমকে উঠেছি, গায়ে কাঁটা দিয়েছে। কারণ, দৌহিত্রীপুত্র দীপংকর বসুর জন্য এই অমূল্য শিল্পকীর্তিটি ধীরে ধীরে গড়ে তুলেছিলেন 'পরশুরাম' রাজশেখর বসু।

রাজশেখর বসু রচিত 'হিতোপদেশের গল্প' বইটির একটি সচিত্র সংস্করণ প্রকাশ করে বিশ্বভারতী গ্রন্থালয়, মাঘ ১৩৫৭বঙ্গাব্দে। এই বইয়ের পাণ্ডুলিপি সযত্নে রাখা আছে দীপংকর বসুর কাছে। আমরা হাতে পেয়েছি ডিজিটাল প্রযুক্তির সাহায্যে প্রকাশিত সেটির হুবহু প্রতিকৃতি। ২০১৫ সালে দি কালার্স অফ্ আর্ট (৫২ ডি হিন্দুস্থান পার্ক, কলকাতা --৭০০০২৯) থেকে প্রকাশ পায় এটি। সম্পাদনা করেন পরিমল রায় এবং কাজী অনির্বাণ।

আমরা দেখছি সাড়ে আট ইঞ্চি লম্বা, সাড়ে ছয় ইঞ্চি চওড়া, তিরিশ পাতার একটি খাতা। দেখা যাচ্ছে, খাতাতে ব্রাউনরঙের বোর্ডের কাভার। বেগুনি রঙের মোটা কাগজ দিয়ে মলাট দেওয়া হয়েছিল খাতাটিতে। তিন ইঞ্চি লম্বা ও আড়াইইঞ্চি চওড়া মেটে রঙের এক চিরকুটের চারদিকে তিন ধাপে কালো কালির আয়তাকার বর্ডার। দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ডারের মধ্যের স্থানে হালকা সবুজ রঙের আভাস। ঠিক মাঝখানে কালো কালি দিয়ে রাজশেখর এঁকেছেন এক তোতাপাখি ---এক পা তুলে, বাঁ দিকে মুখ করে গাছের ডালে বসে আছে সে। তার নীচে লেখা বইয়ের নাম : হিতোপদেশের গল্প'। নামের নীচে সরল পাদরেখা। লেখকের নামের জন্য নির্ধারিত স্থানটিতে লেখা শ্রী দীপংকর বসু। এই অনুপম অলংকরণটি আঠাদিয়ে সাঁটা আছে পাণ্ডুলিপির মলাটের ওপরে বাঁ -- কোণে।

তোতা পাখি

যে কোনও কাজ আরম্ভ করলে তার তারিখ লিখে রাখতে কখনও ভুল হতো না রাজশেখরের। পাণ্ডুলিপির সামনেরকাভারের পেছন দিকে ওপরের বাঁ-দিকের কোণে, মলাটের ভেতরের ভাঁজে, লেখা রয়েছে ১৪০৩৪৩, অর্থাৎ তিনি হিতোপদেশের গল্প লিখতে আরম্ভ করছেন ১৪ মার্চ, ১৯৪৩।

মলাট ওলটালে চোখে পড়ে পাণ্ডুলিপির আখ্যাপট। ওপরদিকে দু --ধাপে লেখা বইয়ের নাম :

বিষ্ণুশর্মা রচিত হিতোপদেশের গল্প।

তারপর এক আশ্চর্য লেখক পরিচিতি :

শ্রীমান দীপংকর বসুর বড়দাদুর লেখা।

নীচে তারিখ: ২৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৮। পাতার নীচে যেখানে সচরাচর প্রকাশকের নাম ঠিকানা লেখা থাকে সেখানে লেখা আছে রাজশেখরের বসতবাটীর ঠিকানা :

৭২, বকুলবাগান রোড,
কলিকাতা

আখ্যাপট

তারপর রুলটানা কাগজের প্রথম পাতার শীর্ষে লেখা বইয়ের নাম : হিতোপদেশের গল্প। নীচে বারোটি গল্পের শিরোনাম ওপ্রত্যেকটি গল্পের শুরুর পৃষ্ঠাসংখ্যা সমেত সূচিপত্র।

প্রথম গল্পের প্রথম পাতার ওপরে আবার বইয়ের নাম। তলায় প্রথম গল্পের শিরোনাম 'বিষ্ণুশর্মার পাঠশালা।'

সূচিপত্র

প্রতি পাতার দু -- পিঠেই লেখা। বারোটি গল্প চব্বিশটি পাতায়। সবার শেষে টানা পাদরেখায় ঘোষিত সমাপ্তি। শেষ পৃষ্ঠারনীচের দিকে বাঁ -- কোণে সবুজ কালিতে লেখা ২৪০২৪৮। অর্থাৎ, লেখা শেষ হয়েছে ২৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৮ তারিখে।

বিষ্ণুশর্মার পাঠশালা

তাঁর একমাত্র ছোটদের জন্য লেখা বইয়ে কী ভাষা ব্যবহার করেছিলেন রাজশেখর বসু? দেখা যাক :

"ভাগীরথী নদীর তীরে পাটলিপুত্র নামে এক নগর আছে। এখন তার নাম পাটনা। সেই নগরে সুদর্শন নামে এক রাজা ছিলেন। একদিন তিনি শুনতে পেলেন একজন লোক এই কবিতাটি পড়ছে ---

মনের সংশয় যাতে দূর হয়,
যাতে জানা যায় অজানা বিষয়,
যে জন শেখে না বিদ্যা এমন 
চক্ষু থাকিতে অন্ধ সে জন। 
অল্প বয়স আর বহু ধন, 
প্রভুত্ব আর কুকাজেতে মন,
একটিতে এর হয় কত ক্ষতি,
চারটি থাকিলে ভয়ানক অতি।।

কবিতা শুনে রাজা ভাবলেন, 'আমার ছেলেরা লেখাপড়া শিখছে না; তাদের বয়স অল্প, টাকাও অনেক পায়, লোকজনের উপর হুকুম চালায়, কুকাজও করে; চারটি দোষই তাদের আছে। তারা যাতে বিদ্বান আর গুণবান হয় তার ব্যবস্থা করতে হবে।'..."

কোনও রকম বাহুল্য নেই; কোনও ন্যাকামি বা খোকাপনা নেই; ঋজু, সরল, গদ্য। যে কোনও প্রকৃত শিশু সাহিত্যিকের মতোই রাজশেখর জানেন শিশুদের আধা-মানুষ ভাবতে নেই। তার ওপর এই বই তিনি লিখছেন এক বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে। তিনি চান তাঁর দৌহিত্রী-পুত্রকে মাতৃভাষার উত্তরাধিকার প্রদান করতে। চান আবহমান দেশজ কৃষ্টি-সংস্কৃতির অংশ ভাগ করতে। সেই কারণেই, এই বই সযত্নে তিনি গড়ে তুলেছিলেন দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে। যেদিন তিনি পাণ্ডুলিপি লিখতে আরম্ভ করেন সেই ১৪ই মার্চ ১৯৪৩-এ দীপংকরের বয়স মাত্র এক বছর ন'মাস। রাজশেখর জানেন এইবার মুখে বোল ফুটবে তার। তোতাপাখির মতো বুলি শিখবে শিশু। আর তাই, মলাটে আঁকা ছবিতে তোতাপাখি হাজির, সেই পাখির ছবির তলায় নাম লেখা দীপংকর বসু। রাজশেখর স্পষ্ট ভাষায় 'হিতোপদেশের গল্প'-র ভূমিকা রচনা করছেন। তাঁর বৈজ্ঞানিক মন প্রস্তাবনার পর মূল লেখা আরম্ভ করতে চায়। ভারতভূমে যুগ যুগ ধরে চলে আসা হিতোপদেশের নানাকাহিনী থেকে বাছাই করা বারোটি গল্প তুলে এনে এক শিশুকে ভাষা দুনিয়ার শরিক করতে চান রাজশেখর। ২৫শে ফেব্রুয়ারী, ১৯৪৮, যখন পাণ্ডুলিপি শেষ হ'ল তখন দীপংকর সাত পেরিয়ে আটে পড়েছেন। অক্ষর পরিচয় হয়ে গেছে, এবার নিয়ম মেনে লেখাপড়া শুরু হবে। ভবিষ্যতের ভিত তৈরীর ঠিক শুরুর মুহূর্তটিতে পাণ্ডুলিপির আখ্যাপত্রে বেগুনীকালিতে ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ তারিখটি লিখে নিজের হাতে তৈরী করা বিষ্ণুশর্মার হিতোপদেশের গল্প তাঁর হাতে তুলেদেন রাজশেখর। ভবিষ্যৎ নির্মাণের অন্যতম সেরা হাতিয়ার, কথাভুবনের চাবিকাঠি। এইখানে এসে আমাদের মধ্যযুগের ইহুদী সমাজের একটা প্রথার কথা মনে পড়ছে। যে শিশু ভাষা শিখতে আরম্ভ করবে তাকে কোলে বসাতেন গুরুমশাই। একটা স্লেটে লেখা হিব্রু বর্ণমালা, আর ধর্মগ্রন্থের একটা অনুচ্ছেদ শব্দ ধরে ধরে যত্ন করে উচ্চারণ করতেন তিনি। শিশুটি তোতাপাখির মতো অনুকরণ করত গুরুর উচ্চারণ। তারপর স্লেটটায় মধু মাখিয়ে দেওয়া হতো আর খুদে ছাত্র চেটে খেয়ে নিত সেটা। ব্রহ্মী বাক্ এখন তার দেহযন্ত্রের অংশ। আপনারাই বলুন, মিল পাওয়া যাচ্ছে না? অন্তরের সবটুকু বাৎসল্য মধু ঢেলে আদরের দীপকের জন্য যে বই পাঁচ বছর ধরে গড়ে তুলেছেন তার মায়ের দাদু, অপেক্ষা করেছেন এই সময়টির জন্য, সে বই কি শুধু একটা বই? কখনও নয়। সে একটা প্রতীক। রাজশেখর তাঁর দৌহিত্রী পুত্রকে দিচ্ছেন তাঁর মনন, মেধা, শিল্প বোধ, রুচি আর বাণী সাধনার উত্তরাধিকার। এককথায় তাঁর সম্পূর্ণ শীলন। দীপংকরের অস্তিত্বের মধ্যে চারিয়ে যাচ্ছে চিরবহমান সংস্কৃতি চেতনা। আর এই চেতনা যিনি জাগিয়ে তুলছেন তিনি তাঁর সবটুকু সৃজনক্ষমতা ঢেলে একটা বই গড়ে তুলেছেন শুধুমাত্র দীপংকরের জন্য। তিনি সাহিত্যিক রাজশেখর বসু নন। তিনি শুধুই দীপংকরের বড়দাদু।

এই পাণ্ডুলিপির শুরুর তারিখ লেখা কালো কালিতে, সমাপ্তির তারিখ সবুজ কালিতে, একই তারিখ আখ্যাপত্রে লেখা বেগুনী কালিতে। প্রতি গল্পের শিরোনামের তলায় সবুজ কালির নিম্ন-রেখা; মাঝে মাঝে পৃষ্ঠার নীচের দিকে বেগুনি রঙে লেখা পাদটীকা। এই রঙের বৈচিত্র্য একদিকে যেমন পাণ্ডুলিপির সৌন্দর্য বাড়ায়, অন্যদিকে জানিয়ে দেয় যে রচয়িতা সচেতন ভাবে শিশুমনে রঙ ধরানোর কাজে নেমেছেন।

আমরা পাণ্ডুলিপিটিকে অনুপম শিল্পকর্ম নামে ডেকেছি। এবং, পাণ্ডুলিপিটি তাইই। ভাষা, লিপি, মাত্রা, ও বিন্যাসের শিল্পকর্ম। রাজশেখরের হাতের লেখা দেখে সত্যজিৎ রায় স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন। আমরাও হয়েছি। গল্পগুলি আগাগোড়া কালো কালিতে লেখা। কোথাও সামান্য কাটাকুটি বা অপরিচ্ছন্নতা নেই। প্রতি অনুচ্ছেদের শেষ পংক্তি বাদে অন্য পংক্তিগুলির দৈর্ঘ্য সমান। প্রতি পৃষ্ঠা ওপরে, নীচে, ডাইনে আর বাঁয়ে সমান মার্জিন রেখে লেখা। রূপে-বর্ণে-সৌষ্ঠবে পটে আঁকা চিত্রকে হার মানিয়ে দেয় এই পাণ্ডুলিপি। বই ছাপা হওয়ার সময় আখ্যাপত্র, সূচিপত্র ইত্যাদি তৈরী করেন প্রকাশক। 'হিতোপদেশের গল্প'তে সে কাজটিও করে রেখেছেন রাজশেখর। বইয়ের বেশে এরকম composite art form (একথার বাঙলা করলেও বাঙলা হবে না)এর কোনও নিদর্শন আমাদের বইঘরে অতীতে কখনও আসেনি। ভবিষ্যতেও আসবে বলে মনে হয় না।


ঋণস্বীকার : 
১) রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য
২) পরিমল রায় ও কাজী অনির্বাণ
৩) কিম্বারলি রেনল্ডস্
৪) আলবের্তো মাঙ্গুয়েল্।

2 comments:

  1. Composite art form কে বাংলায় "সাযুজ্যিক
    শিল্পধারা" বলা যেতে পারে।

    ReplyDelete
  2. এই বইটি কী এখন কোনোভাবে সংগ্রহ করা যায়? বিশ্বভারতীর আদি সংস্করণ অথবা কালার্স অফ আর্টের সম্পাদিত সংস্করণটি?

    আমি রাজশেখর বসুর প্রকাশিত সবকটি বই জোগাড় করার চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু কয়েকটি বইয়ের কোনো হদিশ পাচ্ছি না। এটি তার মধ্যে একটি।

    ReplyDelete